অনুভব

হাসনাত  আবদুল  হাই

এই সকালে বসবার ঘরের ভেতর যে-পাখিটা কিংবা পাখিগুলো ওড়াউড়ি করছে তাকে বা তাদের তিনি স্পষ্ট করে দেখতে পাচ্ছেন না, পাখির ডাকাডাকিও তার কানে ঠিকমতো পৌঁছাচ্ছে না। কিন্তু তিনি জানেন, অতীতের অভিজ্ঞতা তাকে বলে দিচ্ছে যে, পাখিগুলো চড়ুই। এই সকালে আর কোন পাখিই বা আসবে, অন্য কোন পাখিরই বা ঘরের ভেতর ঢোকার সাহস হবে।

এখন যে সকাল তা তিনি ঘড়ি দেখে কিংবা ঘরের জানালা গলিয়ে দুষ্ট ছেলের মতো হাত বাড়িয়ে দেওয়ার মতো রোদের ফালি দেখে বুঝতে পারছেন না। কিন্তু তিনি জানেন এখন সকাল, কেননা কিছুক্ষণ আগে তাঁকে নাস্তা খেতে দিয়েছে; নাস্তা খাওয়ানো হয়েছে বলাই সংগত যেহেতু অন্যের হাতে খেতে হয়েছে নাস্তার বেশিরভাগ। খাওয়া শেষ হলে কেয়ারগিভার লোকটি তাঁর কানের কাছে এসে জোরে জোরে প্রায় চিৎকার করে কথা বলেছে, যেন তিনি শুনতে পান। ভালো করে না শুনলেও তিনি বোঝেন, যারা কানের কাছে মুখ নিয়ে আসে, তারা জোরে জোরেই কথা বলে তার শোনার সুবিধার জন্য। কিন্তু তিনি ভালো করে কেন, মোটামুটিভাবেও শোনেন না আজকাল। বেশ কয়েক মাস হলো এমন হয়েছে। তার আগেও খোলা কানে শুনতেন না; কম্পিউটার লাগানো হিয়ারিং এইড দিয়ে অন্যের বলা কথা ম্যাগনিফাই করে শুনতে পেতেন। সত্যি বলতে কী, ওই যন্ত্র দিয়ে একটু বেশিই শুনতে পেতেন। শোবার ঘরে থেকে অদূরে রান্নাঘরে চাকর-বাকরদের কথাবার্তা এমন স্পষ্ট হয়ে তার কানে এসে পৌঁছাতো যে মনে হতো তারা সবাই সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। কথা বলছে। ঝগড়া করছে। তিনি তাদের সবার সব কথা শুনতে পেতেন, যেন সামনেই দাঁড়িয়ে

আছেন। এমনকি তিনি দূরের রাস্তার যানবাহনের চলাচল, হকারের ডাকও খুব স্পষ্ট শুনতে পেতেন। চারিদিকে একটা কোলাহলের জগৎ তৈরি করেছিল কম্পিউটার লাগানো হিয়ারিং এইড। তিনি ছেলেকে হেসে বলেছিলেন, বড় বেশি শোনা যায়। কোলাহলের মতো শোনায়। বিরক্ত লাগার মতো। আমার এখন এত কিছু শোনার প্রয়োজন নেই। শুনতে ভালো লাগে না। কষ্ট হয়।

শুনে তাঁর ছেলে বলেছে, খুলে রাখবেন। সব সময় পড়ে থাকার দরকার নেই। তারপর একটু থেমে বলেছে, খুব ভালো যন্ত্রটা। একেবারে স্টেট-অফ-দি-আর্ট টেকনোলজি। আমেরিকায় তৈরি। আমার এক সহকর্মীকে দিয়ে আনিয়েছি।

তিনি আন্দাজ করে ছেলের দিকে তাকিয়ে বলেছেন, আগেও বলেছো। যন্ত্রটা অবশ্যই ভালো। কিন্তু আমার চাহিদার চাইতে একটু বেশি মেটাচ্ছে। বলে তিনি হাসলেন।

ছোট ছেলে তাঁর বারো বছরের নাতি বলেছে, হ্যাঁ দাদু, বাবা যা বলছে তা-ই করবে। যখন দরকার হবে না খুলে রাখবে। আমি কাছে থাকলে আমাকে বলবে, আমি খুলে দেবো তোমার কান থেকে।

তিনি হেসেছেন তার কথা শুনে। সবার মতো সেও তাঁকে সাহায্য করতে চায়, তাঁর দুর্বলতার কথা ভেবে। দুর্বলতা না বলে অসহায়তা বলাই ভালো। যত দিন যাচ্ছে তার অসহায়তা বেড়ে চলেছে। ‘আই গ্রো ওল্ড, আই গ্রো ওল্ড। আই শ্যাল ওয়ার মাই ট্রাউজারস রোলড।’

তাঁর নাতির বয়স বারো, তাঁর এখন বিরানববই চলছে। ‘তোমার হলো শুরু, আমার হলো সারা।’ বিরানববই বছর! ভাবতে অবাক লাগে, কী করে পেরিয়ে এলেন এতগুলো বছর, এসে পৌঁছুলেন এতদূর পর্যন্ত!

ধীরে-ধীরে সেই হিয়ারিং এইডের কার্যকারিতা হ্রাস পেতে থাকলো। অমন যে স্টেট-অফ-দি-আর্ট টেকনোলজি সেটা নিয়েও যন্ত্রটা একসময় অকেজো হয়ে গেল। একেবারে না, কিন্তু এখন কথা শুনতে আগের মতো সেটা তেমন সাহায্য করে না। শুধু মাঝে মাঝে টুকরো কথা কানের ভেতর ঢোকে, তিনি শুনতে পান বিচ্ছিন্ন কিছু শব্দ। কখনো শব্দগুলো জোড়া দিয়ে তিনি আভাসে বুঝতে পারেন কী বলা হচ্ছে তাকে। আজ সকালে নাস্তা খাওয়ার পর যখন কেয়ারগিভার লোকটা কানের কাছে মুখ এনে বললো, বাইরের ঘরে যাবেন? তিনি প্রথমে শুধু ‘যাবেন’ কথাটা শুনতে পেলেন। বুঝতে না পেরে মুখ তুলে বললেন, অ্যাঁ? কী বলছো? জোরে বলো।

বাইরের ঘরে যাবেন? একই কথা পুনরাবৃত্তি করলো লোকটা, তিনি সেটা বুঝতে না পারলেও। এখন এটাই নিয়ম। একটা কথা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বললে তিনি খেই হারিয়ে ফেলেন। একই ভাবে একই কথা বলা হলে তিনি কথাগুলো একে একে ধরতে পারেন। আজ সকালে তিনি ধরতে পারলেন প্রথমে ‘যাবেন’, তারপর ‘বাইরের ঘর’। অবশ্য এই কথা রোজ সকালেই বলা হয় তাকে একবার কিংবা দুবার। প্রায় রুটিনের মতো হয়ে গিয়েছে। সুতরাং সেই অভিজ্ঞতাও তাঁকে কথাটা বুঝতে সাহায্য করে। তিনি বিছানা থেকে উঠে ওয়াকারে হাত দিলেন, বুঝতে পারলেন লোকটা এগিয়ে দিয়েছে তার ধরার সুবিধার জন্য। তিনি হাত বাড়িয়ে একটু  খুঁজতেই পেয়ে গেলেন।

হ্যাঁ, চোখে এখন তিনি ভালো করে দেখছেন না, যার জন্য হাত দিয়ে স্পর্শ করে বুঝতে হয় কোনটা কী। তার চোখের সামনে এখন শুধু রং ভাসে, চলাফেরা করে। কখনো-কখনো লাফাতে থাকে। নানা ধরনের রং। তারা বেশিরভাগ সময় স্থির হয়েই থাকে। তখন মানুষের স্থির অবয়বের আউটলাইন চোখে পড়ে, আবার কখনো বিদ্যুচ্চমকের মতো আলোর রেখা জানিয়ে দেয় মানুষের দেহ নড়ছে তাঁর সামনে। খুব পাওয়ারফুল চশমা নিয়েও ভালো করে দেখার মতো লাভ হয়নি। ডাক্তার বলেছে, তাঁর স্বাভাবিক দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাওয়ার জন্য কোনো চিকিৎসা নেই। শুনে তিনি হতাশ হয়েছেন, রেগেও গিয়েছেন। চিকিৎসাশাস্ত্র এত এগিয়েছে, চোখের দৃষ্টি ফিরিয়ে আনতে পারে না কেন? তিনি তো জন্মান্ধ ছিলেন না।

বাইরের ঘরে বসে তিনি ওড়াউড়ি করতে থাকা চড়ুই পাখিগুলো দেখতে পাচ্ছেন না, তাদের ডাকাডাকিও স্পষ্ট করে শুনছেন না। কিন্তু তিনি জানেন তারাই এসেছে। এই ঘরের জানালা দিয়ে তারা সবসময় আসে, দিনের ঠিক এ-সময়টায়। তারপর সারা দিন কোথায় যে থাকে, কী করে তারাই জানে। তিনি পঞ্চাশ বছর ধরে চড়ুইপাখি দেখছেন, যখন এ-বাড়িতে প্রথম আসেন, স্থায়ীভাবে থাকার জন্য, তখন থেকে। আগে স্পষ্ট দেখতেন খালি চোখে। এখন সাদা রেখার মতো দেখা যায় একটু পরপর। এই রেখা দেখে তিনি বোঝেন, টের পান যে, চড়ুইগুলো উড়ছে। পঞ্চাশ বছর আগে দেখা চড়ুই নয়, বিশ বছর আগে দেখা চড়ুই নয়, দশ বছরের পুরনো চড়ুইও নয় হয়তো। চড়ুই পাখি এতদিন বাঁচে না। কিন্তু একই না হোক চড়ুই পাখি আসে তার বসবার ঘরে। সব সময় এসেছে, আসবে ভবিষ্যতেও। তিনি জানেন। ‘তখন আমায় নাইবা মনে রাখলে।’

ছেলের বউ কানের কাছে মুখ এনে বললো, একজন এসেছে। দেখা করতে চায়।

তাঁর কানে কম্পিউটার লাগানো হিয়ারিং এইড লাগানো, যদিও সেটা এখন খুব একটা কাজে দেয় না। এই জন্য ছেলের বউ বেশ জোরে-জোরেই কথাটা বললো।

অ্যাঁ? তিনি সামনে মুখ তুললেন। পুত্রবধূর শাড়ির রং ঝলসে উঠলো কিছুক্ষণের জন্য তাঁর চোখের সামনে। ছেলের বউ এবার আরো জোরে বললো, একজন লোক। বলছে ডেভেলপার। দেখা করতে চায়।

এবার তিনি ‘দেখা করতে চায়’ কথাটা হঠাৎ শুনতে পেলেন। এই রকমই হয় আজকাল। কিছু শব্দ ধরে ফেলেন, তারপর সমস্তটা বোঝার চেষ্টা করেন। মাঝে মাঝে পেরেও যান বুঝতে।

তিনি বললেন, দেখা করতে চায়? ও। তা আসতে বলো।

কথা বলতে তাঁর কোনো অসুবিধা হয় না, কথা মুখে জড়িয়ে যায় না। এইটুকুর জন্য ঈশ্বরকে ধন্যবাদ। নিজেকে এখনো পুরোপুরি ব্যক্ত করতে পারেন। বোবা হয়ে যাননি কিংবা তোতলাতে হয় না তাঁকে। পৃথিবীর সঙ্গে, এই সংসারের সঙ্গে বলাই ভালো, এটাই তাঁর একমাত্র নিখুঁত যোগাযোগ। অবশ্যই একতরফা; তা হোক। কথা বলে তিনি নিজের অস্তিত্ব খুব ভালোভাবে, বলতে গেলে সজোরে টিকিয়ে রাখতে পারেন অন্য মানুষের সামনে। ‘আই টক দেয়ারফোর আই অ্যাম।’ (দেকার্তে মাফ করবেন, একটু বদলে নিলাম আপনার কথা। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তিনি বিনয় প্রকাশ করলেন।) হ্যাঁ, মুখের কথা তাঁকে এখন কিছুটা হলেও মানুষের সমাজে স্বাধীনতা দিয়েছে। তাঁর অস্তিত্ব সম্বন্ধে কোনো সন্দেহ নেই, থাকার সুযোগ দেন না তিনি। ঈশ্বরকে আবার ধন্যবাদ।

চোখের সামনে একটা ছায়া নড়ে উঠলো। মানুষের অবয়ব। নতুন কিছু রঙের সমাবেশ হলো সামনে। তিনি বুঝলেন ঘরের ভেতর একটা নতুন লোক এসেছে। তাঁর সামনে। তিনি তার গায়ের গন্ধ পেলেন। হ্যাঁ, চোখ এবং কানের শক্তি যত কমছে তাঁর অন্য ইন্দ্রিয়গুলো ক্ষতিপূরণের জন্য বেড়ে গিয়েছে। আগের চেয়ে তাঁর ঘ্রাণশক্তি এখন অনেক বেশি। তিনি না দেখেও বলে দিতে পারেন সামনে মানুষ এসেছে। কিছুক্ষণ নিবিষ্ট মনে ঘ্রাণ নিলে মানুষটা কি পুরুষ না নারী তাও টের পান তিনি। এমনকি তার বয়সও। হাত দিয়ে স্পর্শ করলে তো কথাই নেই। চোখে তিনি যা দেখতে পান না স্পর্শ তার অনেক কিছু বলে দেয়।

পুত্রবধূ পাশ থেকে চেঁচিয়ে বললো, ডেভেলপার দশ কোটি টাকা দেবে। পঞ্চাশটা ফ্ল্যাটের মধ্যে পঁচিশটা দেবে তৈরি হলে। তিন বছর লাগবে।

তিনি শুধু ‘দশ কোটি টাকা’ শুনতে পেলেন। শুনে বললেন, দশ কোটি! অনেক টাকা।

পুত্রবধূ বললো, হ্যাঁ। অনেক টাকা। আপনি প্রস্তাবে রাজি হবেন কিনা জানতে চায়। কী বলবো তাকে? তারপর শ্বশুরের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, আপনিই বলে দিন না। আপনার মুখ থেকেই শুনুক।

‘রাজি’ কথাটা শুনতে পেলেন তিনি। কপালে ভাঁজ ফেলে বললেন, রাজি? কিসের জন্য রাজি?

পুত্রবধূ তার কানের কাছে মুখ এনে জোরে জোরে বললো, ডেভেলপার। এই বাড়ি নিয়ে হাইরাইজ করবে। দশ কোটি টাকা দেবে। সিগনেচার মানি। দেবেন? রাজি আছেন?

তিনি এবার ‘ডেভেলপার’ শুনতে পেলেন। কথাটা বেশ পরিচিত। আগেও শুনেছেন। শুধু শোনা নয়, চোখেও দেখেছেন বেশ কয়েকজন ডেভেলপারকে। তখন তাঁর দৃষ্টি ভালো ছিল, লোকজন দেখতে পেতেন। ডেভেলপারদের তিনি প্রথম প্রথম বাসায় আসতে দিয়েছেন কিন্তু বেশি কথা বলতে দেননি। শুনেই বলেছেন, আমি বেঁচে থাকতে এই বাড়ি, এই জমি যেমন আছে তেমনই থাকবে। যান। আর আসবেন না। এক ডেভেলপার গিয়েছে, সে আর আসেনি কিন্তু অন্যেরা এসেছে। তিনি বিরক্তি চেপে তাদের একই কথা বলে বিদায় দিয়েছেন। আগে ডেভেলপাররা সিগনেচার মানি দেবার কথা বলেনি। তাদের প্রস্তাব ছিল সিক্সটি-ফরটি হারে ফ্ল্যাট দেওয়া। আর মাসে মাসে বাড়িভাড়া দেওয়া, যতদিন ফ্ল্যাট না হস্তান্তর হয়। কিছুদিন হলো ডেভেলপাররা সিগনেচার মানি দেওয়ার কথা বলছে। বোঝা যায় জমি পাওয়ার জন্য খুব প্রতিযোগিতা চলছে। জমির মালিকদের প্রলোভিত করার জন্য নতুন নতুন ফন্দি বার করছে তারা। তিনি শুনে রেগে গিয়েছেন, বলেছেন তাকে প্রলোভিত করা যাবে না। তার জেদ, সংকল্প একটুও নড়বে না। এই বাড়ি এইভাবেই থাকবে, তিনি যতদিন বেঁচে আছেন।

পুত্রবধূ বললো, দশ কোটি টাকা। তাই বললাম।

তিনি আবারও ‘দশ কোটি’ কথাটা শুনতে পেলেন। বললেন, কী হবে দশ কোটি টাকা দিয়ে? আমি শুনতে পাই না, চোখে দেখি না। কী করবো দশ কোটি টাকা দিয়ে? একমাত্র তোমাদের দেওয়া ছাড়া এই টাকা দিয়ে আমার কোনো উপকার হবে না। তারপর একটু থেমে বললেন, তোমাদের দশ কোটি টাকা দেওয়ার কী দরকার? আমি চলে গেলে এই বাড়ি তো তোমাদেরই হবে। তখন যা খুশি তাই করবে, নিষেধ করার জন্য আমি থাকবো না। এখন এইসব কথা বলো না আমাকে।

পুত্রবধূ একটু বিব্রত হয়ে বললো, আমাদের কথা ভেবে দশ কোটি টাকার কথা বলিনি বাবা। আপনি ভুল বুঝবেন না।

তিনি পুত্রবধূর কথা শুনতে পেলেন না। জোর গলায় বললেন, ওকে যেতে বলো। এই সকালে আমার মেজাজ খারাপ করে দিয়েছে। বলে দাও আমার মৃত্যুর পর আসার জন্য। ভাগাড়ের শকুনের মতো অপেক্ষা করতে বলো ওকে। অন্য ডেভেলপার যারা আসবে তাদেরও।

পুত্রবধূ ডেভেলপারকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিতে দিতে বললো, আববা এই বাড়ি ছেড়ে কোথাও যাবেন না। এখানে তাঁর অনেক স্মৃতি। কত বছর থেকে এখানে আছেন। বোঝেনই তো। আপনারা এসে বিরক্ত করবেন না। করলে তিনি উত্তেজিত হবেন। আপনারা তাঁর কথা শুনে বিব্রত হবেন। আর আমি কিংবা আমার স্বামী আপনাদের কথা বললে তিনি আমাদের ভুল বুঝবেন।

ডেভেলপার কোম্পানির লোকটা রুমাল দিয়ে মুখ মুছে বললো, বুঝতে পারছি। সরি। কিছু মনে করবেন না। ব্যবসার জন্য এমন করতে হয় আমাদের। উপায় নেই। খুব কমপিটিশন।

পুত্রবধূ ডেভেলপারকে বিদায় দিয়ে তাঁর কাছে এসে বসলো, কানের কাছে মুখ নিয়ে জোরে জোরে বললো, চলে গিয়েছে।

তিনি শুনতে পেলেন না। তার শরীরের ভেতর জমে ওঠা উত্তেজনা, ক্রোধ ধীরে ধীরে কমছে এখন। তিনি চুপ করে থাকলেন। চোখের সামনে বিদ্যুচ্চমকের মতো সাদা রেখাগুলো দেখা যাচ্ছে না। চড়ুইগুলো চলে গিয়েছে।

চলে গিয়েছে?

জি।

চড়ুইগুলোর কথা বলছি। তিনি ‘জি’ শুনতে পাননি।

ও। হ্যাঁ, জি। চড়ুইগুলো চলে গিয়েছে। পুত্রবধূ জানালার দিকে তাকিয়ে বললো। হলুদ রং ঢেলে দিয়ে রোদ ঢুকছে ভেতরে। বেলা বাড়ছে। সে উঠে দাঁড়িয়ে বললো, রান্নাঘরে যাই। কী রান্না করছে দেখি।

তিনি শুধু শুনতে পেলেন ‘রান্না’। বললেন, কী রান্না হচ্ছে আজ? তারপর একটু থেমে বললেন, তোমাদের জন্য। আমার তো রোজ প্রায় একই খাওয়া।

আমাদের জন্য কী রান্না তাই দেখতে যাচ্ছি। আপনার খাবারও তৈরি হচ্ছে কিনা দেখবো। বলে পুত্রবধূ রান্নাঘরের দিকে যেতে যেতে কী ভেবে শ্বশুরের দিকে তাকিয়ে বললো, আপনার কি খাওয়া খুব একঘেয়ে হয়ে যাচ্ছে? তারপর এত দূর থেকে স্বাভাবিক স্বরে বলা তাঁর কথা তিনি একটুও শুনতে পাবেন না বুঝতে পেরে কাছে এসে বললো, আজ অন্য কিছু খাবেন? নতুন কিছু?

নতুন? কী নতুন? তিনি বুঝতে না পেরে জিজ্ঞাসা করেন।

খাবার।

ও খাবার। বলে একটু চুপ করে থাকলেন তিনি। তারপর মুখ নামিয়ে বললেন, না। নতুন কী আর হবে। ডাক্তার যা বলেছে তাই দাও। নতুন খাওয়ার বয়স নেই আমার। তাঁর স্বরে আক্ষেপ।

পুত্রবধূ রান্নাঘরের দিকে যেতে থাকে। তার ছেলে মেঝেতে বসে গেমস খেলে, বিড়বিড় করে নিজের মনেই কথা বলে। মা তার দিকে তাকিয়ে বলে, দাদুর সঙ্গে মাঝে মাঝে কথা বলো। জোরে জোরে বলবে যেন শুনতে পান।

ছেলেটি মাথা তুলে বললো, আহ্! ডিসটার্ব করো না। মরটাল কমব্যাট এখন ফাইনাল স্টেজে। তার হাতে ধরা মনিটরে লাল, হলুদ, সবুজ রং লাফাচ্ছে।

তার মা বিরক্তির ভ্রূকুটি মুখে নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকলো। আজ শুক্রবার, তাই রান্নাঘরে যাওয়ার সময় পেয়েছে সে। অন্যদিন রান্নাঘরে না, অফিসে কাটাতে হয় সময়, সকাল থেকে বিকেল। সন্ধ্যায় ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফেরার পর রান্নাঘরে ঢোকার ইচ্ছে থাকে না। বাবুর্চি, চাকর-চাকরানি এরাই খাবার এনে টেবিলে দেয়। তার আগে শ্বশুরের খাওয়া হয়। কখনো সে সামনে দাঁড়িয়ে থাকে, বেশিরভাগ সময়ই তা হয়ে ওঠে না। মাসের পর মাস, বছরের পর বছর পার হয়ে যাওয়ার পর শ্বশুরকে এখন সবসময় চোখে চোখে রাখা সম্ভব হয় না। এমনকি যখন সে এবং তার স্বামী ঘরে থাকে সপ্তাহের সেই সব দিনেও না। শুধু শুক্রবার আর কখনো শনিবার ছুটির দিনে শ্বশুরের কাছে গিয়ে বসার সময় হয় তাদের। সংসারের কাজে ব্যস্ত থাকায় সেই সময়টুকু তাঁকে দেওয়া যায় না। গত কয়েক বছর থেকে তাঁকে দেখাশোনা করার জন্য চবিবশ ঘণ্টা কেয়ারগিভার রাখা হয়েছে। বারো ঘণ্টা করে দুইজন এসে ডিউটি করে যায়। তারাই চোখের সামনে রাখে তার শ্বশুরকে। তাঁর সঙ্গে কথা বলে তারা, যদিও তিনি সব শুনতে পান না। সে এবং তার স্বামী বলেছে, তারা যেন তাঁর সঙ্গে মাঝে মাঝেই কথা বলে। এই ভাবে কথা শোনার অভ্যাসটা তাঁর টিকিয়ে রাখতে হবে। কোনো কথা না শুনলে যেটুকু শোনার ক্ষমতা আছে তাও চলে যাবে।

দুপুরে খাওয়ার পর তিনি ঘুমোন। এটা রুটিন। যখন ঘুম ভাঙে তখন বিকেল বেলা। ঘড়ি দেখতে না পেলেও তিনি বোঝেন বিকেল হয়েছে। তাঁর স্নায়ু আর ইন্দ্রিয় বলে দেয় এখন বিকেল। তাছাড়া আগের অভিজ্ঞতাও রয়েছে। আগে ঘুম তাঁর বিকেলেই ভাঙতো, যেমন এখন ভাঙে।

সকালে তাঁকে ওঠানো হয় বিছানা থেকে। তিনি বাথরুম করেন। কেয়ারগিভার দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দেয় তাঁকে। তিনি ভেতরে ঢুকলে খোলা দরজার সামনেই দাঁড়িয়ে থাকে সে। মাঝে মাঝে আড়চোখে তাকায় তাঁর দিকে সবকিছু ঠিক আছে কিনা দেখার জন্য। বাথরুম শেষ করে ফিরে এলে ওয়াকার হাতে তিনি ঘরের একপাশে দাঁড়িয়ে থাকেন, যেন মনে মনে ঠিক করছেন কী করবেন। কেয়ারগিভার পাশে থেকে জোরে জোরে বলে, বসার ঘরে নাস্তা করবেন? না এখানে?

তিনি ‘নাস্তা’ শুনে বলেন, নাস্তা করবো।

এখানে, না বসবার ঘরে?

বসবার ঘরে। এবার তিনি ‘বসবার ঘরে’ শুনতে পেয়েছেন।

তাঁর সব খাওয়া নির্দিষ্ট। কখন কী, কতটুকু খাবেন সব ডাক্তার ঠিক করে দিয়েছে। সকাল-বিকাল ব্লাড টেস্ট করা হয়। সুগার লেভেল দেখে খাবারের পরিমাণ বাড়ে কিংবা কমে। এইসব কাজ কেয়ারগিভারই পারে।

বসবার ঘরে এসে তাঁর নির্দিষ্ট চেয়ারে বসার পর কেয়ারগিভার কানের কাছে মুখ এনে বললো, একটা ছেলে এসেছে। পত্রিকা অফিস থেকে।

পত্রিকা? কী পত্রিকা? আমি তো পত্রিকা পড়তে পারি না।

কেয়ারগিভার গলার স্বর বাড়িয়ে বলে, পত্রিকা অফিস থেকে একজন এসেছে। সে প্রায়ই আসে আপনার কাছে।

প্রায়ই আসে? কে? আসতে বলো তাকে।

ঘরের ভেতর নতুন মানুষ ঢোকে। তিনি তার গন্ধ পান। পুরুষ মানুষ। অল্প বয়স। কাপড়ে ধুলোবালির গন্ধ। তাঁর চোখের সামনে কিছু নতুন রং বিদ্যুচ্চমকের মতো ঝলক দেয়। তারপর রং থিতু হয়ে যায়। দেখে তার চোখের মণি একটু কেঁপে ওঠে।

ছেলেটি তাঁর দিকে মুখ এনে বলে, কেমন আছেন?

তিনি বলেন, এ্যাঁ?

কেমন আছেন?

কেমন? এই তো দেখতে পাচ্ছো। তিনি ‘কেমন’ শুনে বলেন। ছেলেটার স্বর পরিচিত। আগেও এসেছে। যখন লিখতে পারতেন লেখা নিয়ে যেতো। ছাপা হলে পত্রিকা নিয়ে আসতো দেবার জন্য।

ছেলেটি বলে, লেখা নিতে এলাম। একটা কবিতা। যত ছোট হোক।

তিনি ‘কবিতা’ কথাটা শুনলেন। হেসে বললেন, এক সময় কবিতাই আমার জীবন ছিল। এখন পড়তে পারি না, লিখতেও না। এরচেয়ে বড় শাস্তি হয় না।

আপনি বলে যাবেন। শুনে অন্য কেউ লিখে নেবে। একেবারে লেখা ছাড়বেন না।

বলে যাবো? তিনি ‘বলে যাবেন’ শুনতে পান। তারপর হেসে বলেন, বলে যাওয়া কি এত সোজা? চোখ দিয়ে দেখা, কান দিয়ে শোনার পরই তো ভাব আসে মাথায়। তারপর বলে যাওয়া যায়। লেখা যায়। তখন সৃজনী শক্তি কাজ করে।

কল্পনা করবেন। স্মৃতি থেকে অভিজ্ঞতা মনে করেও লিখতে পারেন। তাই না? এর জন্য তো দেখার বা শোনার দরকার নেই। শেষের কথাগুলো বলে ছেলেটি কিছুটা ম্রিয়মাণ হয়ে যায়, একটা অপরাধবোধ এসে তাকে গ্রাস করে। কথাটা বলা ঠিক হলো না। খুব চাঁছাছোলা হয়ে গেল। সাংবাদিক হলে কি এমন ভাবলেশহীনই হতে হয়? সে অপ্রস্ত্তত হয়ে হাতগুটিয়ে বসে থাকলো।

তিনি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, বাইরের পৃথিবী, সংসারের মানুষ দেখেই ভাব আসে মনে। সেই ভাব তাড়া করে ফেরে মুক্তির জন্য। মুক্তি পেয়ে কবিতা হয়। আমি তো সেই পৃথিবীতে থেকেও নেই। নির্বাসিত একজন। তারপর স্বগতোক্তির মতো বলেন, অভিজ্ঞতা ছাড়া কবিতা লেখা হয় না। কল্পনা পাখা মেলে না। তাঁর স্বরে হতাশা এবং ক্লান্তি। ‘আই হ্যাভ সিন দি মর্নিং, দা ইভেনিং অ্যান্ড দি আফটারনুন/ আই হ্যাভ মেজার্ড মাই লাইফ উইথ এ কফি স্পুন।’

ছেলেটি নড়েচড়ে বসে। বলে, তা হবে কেন? আপনার স্পর্শবোধ আছে, ঘ্রাণশক্তি আছে। এরাই আপনাকে অভিজ্ঞতা দেবে। দিচ্ছে।

তিনি ‘স্পর্শ’ আর ‘ঘ্রাণ’ স্পষ্ট শুনতে পেলেন। চঞ্চল হয়ে উঠলেন কিছুক্ষণের জন্য। মুখ তুলে তাকালেন সামনে। তাঁর হাত দুটো কাঁপছে। এক হাতে চেয়ারের হাতলটা শক্ত করে ধরলেন। কাঠ, মসৃণ, ঠান্ডা। অন্য হাতটা নিজের বুকের ওপর চেপে ধরলেন। নরম, উষ্ণ, খসখসে কাপড়ের আবরণ। ইস্ত্রি নেই, ভাঁজ পড়েছে। কী পড়েছেন তিনি আজ? শার্ট না পাঞ্জাবি? হাত বুলিয়ে নিয়ে বুঝলেন পাঞ্জাবি। যখন পড়েছেন এটা ধোয়া ছিল, পরিষ্কার এবং মসৃণভাবে ইস্ত্রি করা। এখন, একদিন পর সেই মসৃণতা চলে গিয়েছে। তিনি জোরে জোরে শ্বাস নিলেন। একটা গন্ধ নাকে এলো। শতরঞ্চির গন্ধ। ধুলোমাখা, ঠান্ডা, স্যাঁতসেঁতে। তিনি জিভ নাড়লেন, সেখানে রুটির গন্ধ। হালুয়ার গন্ধ। মিষ্টি গন্ধ। তাই তো, ভুলেই গিয়েছিলেন একেবারে নির্বাসিত নন তিনি। এখনো বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে। তিনি কথা বলতে পারেন আগের মতো। কথা বলার অভিজ্ঞতা অন্যরকম। কথা বলতে তাঁর একটুও আটকায় না। কিন্তু তার ভিত্তিতে কিছু লেখা যায় না। কথাও এক ধরনের লেখার মতো, বক্তব্য বেরিয়ে আসে। দৈনন্দিনের ছাপ থাকে সেখানে, কিন্তু অভ্যাসের রুটিন অনুযায়ী বলা সেই সব কথায় সৃষ্টিশীল কিছু নেই। খুবই ফাংশনাল, ব্যবহারিক – মুখের কথা।

সাংবাদিক ছেলেটা চলে যায়। সাহিত্য সাময়িকীর সম্পাদনা করে এক পত্রিকায়। বলে যায়, আবার আসবে। তিনি শুনতে পান না। তাঁর দুহাত তখন আশপাশের বস্ত্ত স্পর্শ করে চলেছে।

সন্ধ্যায় বিছানায় শুয়ে তিনি বালিশে হাত বুলিয়ে দেখেন স্পর্শ করেন নানাভাবে, বিভিন্ন মাত্রার শক্তি দিয়ে। আস্তে, আলতোভাবে, একটু জোরে, বেশ জোরের সঙ্গে। বালিশটা তাঁর স্পর্শে প্রাণ পায়, অন্য কিছু হয়ে যায়। শুধু বালিশ নিয়ে একটা কবিতা হতে পারে। কেন হবে না? এ তো শুধু কাপড় আর তুলো ভরা একটা বস্ত্ত না। তার হাতের স্পর্শে এর নবজন্ম হয়েছে। শুধুই কি স্পর্শ? তিনি বালিশে নাক গুঁজে দীর্ঘশ্বাস নেন। তাঁর মাথার চুলের গন্ধ, তেলের গন্ধ, হাতের গন্ধ, রাত আর দুপুরের গন্ধমাখা বালিশ। চমৎকার লেখার বিষয়। বালিশ!

পরদিন সকালে নাস্তার পর বাইরের ঘরে বসে যতক্ষণ চড়ুইগুলো ওড়াউড়ি করে তিনি চেয়ারে বসে থাকেন। তিনি তাদের স্পষ্ট দেখেন না, শুধু বিদ্যুচ্চমকের মতো রেখাগুলো  ঝিলিক দিয়ে যায়। মাঝে মাঝে ‘চিড়িং’ শব্দ শুনে বোঝেন চড়ুইগুলো এখনো আছে। তাদের ছোট শরীরের গন্ধ ভেসে আসে ঘরের বদ্ধ বাতাসে। তাদের পাখায় সবুজের গন্ধ, মাটির গন্ধমাখা। একসময় চড়ুইগুলো চলে যায়। তিনি কেয়ারগিভারকে বলেন, বাইরে যাবো।

বাইরে? লোকটা অবাক হয়ে তাকায় তাঁর দিকে। কোথায় যাবেন?

তিনি ‘কোথায়’ শুনতে পান। বলেন, বাগানে যাবো। গাছগুলো হাত দিয়ে দেখবো। যে সব গাছ আমি আর আমার স্ত্রী লাগিয়েছি অনেক বছর আগে, সে সব স্পর্শ করবো। ফুল ফুটে থাকলে ফুলের ওপর হাত রাখবো।

হ্যাঁ। ফুল ফুটেছে। নাম জানি না। লোকটা জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিযে বলে। জানালা দিয়ে বাগানের কিনারা ঘেঁষে ফুলের কেয়ারি দেখা যায়। তিনি দেখতে পান না।

‘ফুটেছে’ শুনতে পেয়ে তিনি খুশি হয়ে হাসেন। কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়িয়ে ওয়াকারে হাত রাখেন।

বাগানের লনে তিনি খালি পায়ে হাঁটেন। সবুজ ঘাস তাঁর পা টেনে ধরে, সামনে নিয়ে যায়। যেন খেলা করে। সবুজ গন্ধ, মাটির গন্ধ তাঁর নাকে এসে ঢোকে। তিনি কেয়ারগিভারকে বলেন, ঘাসের ওপর বসবো। বসাও আমাকে। বলে তিনি ওয়াকার ছেড়ে দাঁড়িয়ে থাকেন কেয়ারগিভার তাঁকে ধরার অপেক্ষায়।

ঘাসের ওপর বসে তিনি পরম মমতার সঙ্গে হাত বুলিয়ে যান। নরম, ভেজা ভেজা, পিচ্ছিল। সবুজ গন্ধ নাকে এসে ঢোকে। মাটিতে স্যাঁতসেঁতে ভাব। তিনি ঘাসের ওপর হাত বুলাতে থাকেন। ‘মনে হয় ঘাস হয়ে জন্মাই, ঘাসের ভেতরে।’ তিনি অস্ফুটে উচ্চারণ করেন।

আমগাছটা এখনো কোনায় দাঁড়িয়ে আছে নিশ্চয়ই। আমের সিজন কি এখন? আম ধরেছে? তিনি জিজ্ঞাসা করেন কেয়ারগিভারকে, আম ধরেছে?

কেয়ারগিভার বলে, এখনো কয়েকটা আম ঝুলছে। বেশ বড়।

তিনি ‘বড়’ কথাটা শোনেন। বলেন, হ্যাঁ বড় তো হবেই। খুব ভালো জাতের আমগাছ। আমার স্ত্রী লাগিয়েছিলেন। আমগাছ তার খুব প্রিয় ছিল। তারপর একটু থেমে বললেন, নিয়ে চলো গাছটার কাছে। তার কান্ডে হাত দিয়ে দেখবো।

খসখসে, শক্ত। আমগাছের কান্ডে তিনি হাত রেখে স্পর্শ করেন। কান্ডের ভেতর থেকে মৃদু গন্ধ আসে। গাছের রসের। ওপরের পাতা থেকে বুঝি সবুজ গন্ধ ঝরে। ফটো-সিনথেসিসের গন্ধ। তিনি তন্ময় হয়ে থাকেন। একটা কিছু তাঁর আঙুল কামড়ে দেয়। জ্বালা করে ওঠে। তিনি হাত সরিয়ে এনে লোকটার দিকে তাকান। কেয়ারগিভার বলে, লাল পিঁপড়ে। হাত দেবেন না।

তিনি ‘পিঁপড়ে’ শুনতে পান। শুনে একটুও বিরক্ত হন না। হাসেন। হাসি থামিয়ে বলেন, হ্যাঁ। আমগাছের গুঁড়িতে ওরা থাকে। আগে দেখেছি। তারপর বলেন, বেশ বড় আম হয়েছে?

জি। বেশ বড়।

তিনি ‘বড়’ শোনেন। তারপর বলেন, ওরা বলেনি। তাঁর স্বরে চাপা ক্ষোভ। তিনি মনে মনে বলেন, হ্যাঁ, আমগাছ ও পিঁপড়ে নিয়ে একটা কবিতা লেখা যায়। তারপর নিচের দিকে তাকান। খালি পায়ে ঘাসের স্পর্শ। ঘাস নিয়ে অনেক আগেই একজন কবিতা লিখে গিয়েছেন। আবারও লেখা যায়। দৃষ্টিকোণটা আর ভাবনা পৃথক হবে। একই বিষয় নিয়ে বারবার কবিতা লেখা যায়।

তাঁর হাতের আঙুল বাগানের ফুলের পাপড়ি নিয়ে খেলা করে। নরম, পিচ্ছিল, মসৃণ পাপড়িগুলো। ঘ্রাণ আসে মৃদু মৃদৃ। চাপা মিষ্টি। তিনি কেয়ারগিভারকে বলেন তাঁকে শক্ত করে ধরে রাখতে। তিনি মুখ নিচু করবেন। ফুলের কাছে নাক নিয়ে ঘ্রাণ নেবেন। একটু পর তিনি বুক ভরে ঘ্রাণ নেন। এবার আরো মিষ্টি মনে হয়। তিনি আবেগে চোখ বোঁজেন। ফুল নিয়েও কবিতা লেখা খুব পুরনো। পূর্ণিমার চাঁদ নিয়ে লেখার মতো। পুরনো হলেও এই ঘাসের মতো ফুল নিয়েও কবিতা লেখা যায়। তাঁর এখনকার ফুল দেখা অন্যরকম। ভেবে তিনি মনে মনে খুশি হয়ে ওঠেন। বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ বাড়ছে। তাঁর নির্বাসন চূড়ান্ত নয়।

সকালে নাস্তা নিয়ে এসেছে কেয়ারগিভার। রুটির গন্ধ, ডিমের গন্ধ আগের মতো। কিন্তু তাঁর নাকের ছিদ্র স্ফীত হচ্ছে। অন্য একটা অপরিচিত গন্ধ পাচ্ছেন তিনি। কিছুক্ষণ একমনে গন্ধটা ভেতরে টেনে নেওয়ার পর তিনি বোঝেন আগের কেয়ারগিভার নেই। তার জায়গায় নতুন একজন এসেছে। ঘ্রাণ বলছে তার বয়স কম। চুলে নারকেল তেল দিয়েছে। গায়ের কাপড়টা মেঝে ছুয়েছে। নিঃশ্বাসের গন্ধে এক ধরনের উষ্ণতা। এখন শীতকাল। গন্ধটা তাঁর নাকে এসে উষ্ণতা ছড়াচ্ছে। নারী।