অলীক রাতের গল্প

জাকির তালুকদার

আমাদের এলাকার বরকত আলীর বড়লোক বনে যাওয়ার কাহিনি আলাদা বয়ানের কোনো প্রয়োজন পড়ছে না এই কারণে যে, স্বাধীন সোনার বাংলায় যারা যারা বড়লোক হয়েছে, তাদের সবার গল্প প্রায় একই রকম। প্রত্যেকেরই একটা করে আলাদিনের জিন পাওয়ার ঘটনা রয়েছে। তবে বড়লোক হওয়ার পরে কেউ আর একরকম থাকে না। তাই তাদের প্রত্যেকের গল্প আলাদা আলাদা করে বলা বা লেখার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। সেই আলাদাদের মধ্যেও বরকত আলী আবার বিশেষ রকমের আলাদা। বড়লোকরা বড়লোক হওয়ার পরে বেশিরভাগই ধার্মিক হয়ে যায়। কেউ কেউ অবশ্য সংস্কৃতিবান হওয়ার জন্য উঠেপড়ে লাগে। তবে বরকত আলী সে-পথে যায়নি। সে-ও ধর্মপথেই যেতে চেয়েছে। ইহকালে আল্লাহ তো অনেক অ-নে-ক অনেক দিলেন, এখন সেই অনেকের খানিকটা ঠিকমতো ব্যবহার করতে পারলেই পরকালের পথটাও খোলাসা হয়ে যায়। বরকত আলী তাই ধার্মিকই হতে চায়। তবে অন্য বড়লোকদের চাইতে অন্যরকম ধার্মিক। একেবারে ছহি ও আসল ধার্মিক।
ছোটবেলায় কয়েক বছর মাদ্রাসা-মক্তবেই পড়েছিল বরকত আলী। গরিবের ছেলেরা পড়তে চাইলে মাদ্রাসা ছাড়া আর কোথায় যাবে! সে-কারণে কিছু আরবি-ফারসি শব্দ এখনো মনে আছে তার। সেই শব্দগুলোর অন্তর্নিহিত ওজন এতদিনে তার মনে পরিষ্কারভাবে ধরা পড়ে। ছহি! আহা শব্দটার তাৎপর্য যে কত ব্যাপক! ছহি। খাঁটি, আসল, পুরোপুরি ভ্রান্তিহীন, যেখানে কোনো রকমের বেদাতের চিহ্ন পর্যন্ত নেই। সেই ছহি পথে ধর্ম পালন করবে বরকত আলী।
ধর্মের পাঁচ খুঁটির মধ্যে কালেমা তো তার মুখস্থই আছে। নামাজ শুরু করে দিয়েছে কয়েক মাস থেকে। আরবি উচ্চারণ যাতে সঠিক হয়, সেজন্যে এ-শহরের সবচেয়ে দামি আরবি শিক্ষককে মাইনে দিয়ে পড়তে শিখছে কোরানের ভাষা। রোজা করাটা কঠিনই হবে। কিন্তু আগামী বছর থেকে সেটা সে করবেই করবে। হজ তো হাতের মুঠোয়। চাইলেই ভিআইপি কোটায় গায়ে সাদা কাপড়ের এহরাম বেঁধে উড়াল মেশিনে মক্কায় গিয়ে জিলহজ মাসে হাজরে আসওয়াদে চুমু খেয়ে আসা যাবে। সে এ-মৌসুমেই সেটি পালন করবে। আগে বিভিন্ন ব্যবসায়ী দলের সঙ্গে, মন্ত্রী-এমপিদের সঙ্গে কয়েকবার ওমরাহ করে এসেছে সে। নিয়মকানুন সব মুখস্থ। বড় হজ এবারই হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ। কিন্তু সবচেয়ে ছহিভাবে সে পালন করতে চায় পঞ্চম খুঁটি জাকাত। এ-জায়গাতেই তার সঙ্গে অন্যসব বড়লোকের তফাৎ। তারা সবাই বছর বছর জাকাত দেয় বটে, কিন্তু তাদের একজন হিসেবেই বরকত আলী জানে যে, ছহি জাকাত কেউ আদায় করে না। একটা কোনোরকম থোক টাকা হাতের মুঠোয় গমের দানা নিয়ে জংলি পায়রাদের মধ্যে ছিটিয়ে দেওয়ার মতো করে বছরান্তে ছিটিয়ে দেয় পেয়ারের নারী-পুরুষদের মধ্যে। বরকত আলী সেটি করবে না। সে ছহিমতে, ছহি পরিমাণে এবং ছহি পদ্ধতিতে জাকাত দেবে।
সে-পরিকল্পনামতো বরকত আলী নেমেও পড়েছে কাজে।
জাকাত দিতে হবে একেবারে সম্পদের নির্দিষ্ট পরিমাণ হিসাব করে। একই সঙ্গে দেওয়ার পদ্ধতিও হতে হবে নির্ভুল। এমন লোককে দিতে হবে, যে সত্যি সত্যি জাকাতের হকদার। তার ওপর জাকাত বিতরণ করতে হবে গোপনে। কোনো এক মওলানার সুরেলা ওয়াজ-কণ্ঠ ভেসে আসে তার কানে Ñ এমনভাবে জাকাত দিবে গো ভাইরা যাতে তুমি ডান হাত দিয়ে দেওয়ার সময় তোমার বাঁ-হাতও তা টের না পায়…
গ্রামের রাস্তায় জষ্টিমাসের ধুলো-ওড়ানো বাতাসের মতো নোংরা এক সন্ধ্যা উতড়ানোর পরপরই তৈরি হতে শুরু করে বরকত আলী। যা যা সঙ্গে নিতে চায় এমনসব জিনিস নিজে স্টোররুমের পাশের একটা ঘরে আগে থেকেই জমা করে রেখেছিল। তার বিশাল বাড়ির অগুনতি ঘরে প্রায় গোপনেই যে-কোনো কাজ সারা যায়। কত গোপন কাজ সে এ-বাড়িতে সেরেছে! তার কোনো কাজে কাঁধের ওপর দিয়ে বা দূর থেকে উঁকি দেওয়ার সাহস এ-বাড়িতে কারো নেই। আছে কেবল তার বউয়ের। কিন্তু তার সময় নেই বরকত আলী কী করছে না করছে তার খোঁজ নেওয়ার। কারণ সে এখন লেডিস ক্লাবসহ বিভিন্ন সংগঠনের ওপরের দিকের সদস্য। কোথাও সংবর্ধনা, কোথাও বিচিত্রানুষ্ঠান, কোথাও সেমিনার Ñ এসব নিয়ে মহাব্যস্ত। কাজেই বরকত আলী পুরোপুরি নিজের মতো করে নিজেকে গুছিয়ে নেওয়ার সময় পায়। এশার আজান হতে হতেই তার বোঁচকা গোছানো শেষ। এখন এ-বাড়িতে একজন মাইনে করা ইমাম রাখা হয়েছে। তিনি আজানও দেন। নিচতলার বড় একটা হলঘরকে নামাজের ঘর বানানো হয়েছে। পাঁচ ওয়াক্ত জামাতে নামাজ হয়। বাড়িতে যারা যারা থাকে, আত্মীয়-আশ্রিত এবং কাজের লোক, সবাইকে নামাজ পড়তে হয় পাঁচ ওয়াক্ত জামাতে।
এশার নামাজের পরেই বোঁচকা নিয়ে বরকত আলী একাকী বেরিয়ে পড়ে বাঁধের পথে।
বাঁধের ওপর বুনো পানির তাড়া খাওয়া মানুষদের ঘর। খোঁজ নিলে দেখা যাবে, দশ বছর আগেও এরা অনেকেই ছিলেন সম্পন্ন চাষি, কেউ ছিলেন ভাগচাষি। চরের জমিতে ফসল ফলানো ছিল তাদের কাছে ধর্মপালনের মতো নিয়মিত ব্যাপার। কিন্তু অনেকদিন থেকেই যে তাদের জমির তলার জমিনটাকে ফোঁপরা করে তুলছিল, সেটা টের পায়নি কেউই। একবারে এক বড় জলভাঙনের ধাক্কায় পুরো জমি নদীর ঘোলা পানিকে আরো ঘোলা করে পানির সঙ্গে একাকার হয়ে গেলে কেবল তখনই টের পায়, এ-মুহূর্ত থেকে তারা ভূমিহীন। নিজেদের চর হারিয়ে তারা যায় আরেক চরে। কিন্তু সেখানেও টিকতে পারে না। একদিকে আছে নদীর আক্রমণ, আরেকদিকে থাকে চরদখল যুদ্ধের আক্রমণ। যারা কোনো একটা জুজুধান দলের সঙ্গে ভিড়ে যেতে পারে, কোঁচ-ট্যাঁটা-বল্লম-সড়কি চালাতে পারে, তারা টিকে যায়। বাকিরা নানা জায়গায় তাড়া খেয়ে খেয়ে কেউ কেউ টেম্পরারি ঘর পায় বাঁধের ওপর, অন্য সবাই হারিয়ে যায় শহরের জঙ্গলে।
বরকত আলীর মনে হয়েছে, এরকম বাঁধে আশ্রয় নেওয়া সবহারানো মানুষগুলোই জাকাতের সবচেয়ে ছহি হকদার।

বাঁধের ওপর তখন গভীর রাত। অথচ বরকত আলীর হাতঘড়িতে রাত মাত্র ৯টা। বাতি জ্বলছে না প্রায় কোনো ঘরেই। রেডিও-টেলিভিশন চলার প্রশ্নই ওঠে না। তবে চর-চাষের মানুষ। গান-টান অথবা শাস্ত্রকথা তো কিছুটা জানা থাকার কথাই তাদের। সেসব নিয়ে আসর বসানোর কথা কোনো এক কোণে। আসরও হবে, সুখ-দুঃখের কথাও হবে। কিন্তু কোনো শব্দই নেই। নিজেদের জমি-জিরাত, নিজেদের ঘরের কথার মতো নিজেদের শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে বয়ে চলা সেসব কথকতা-গীতও কি স্মৃতি থেকে হারিয়ে গেল মানুষগুলোর! যেখানে মানুষ বাস করে, সে-জনপদ এমন নিঃশব্দ থাকে কী করে! বাঁধের ওপর দিয়ে হাঁটার সময় নিজেকে ভূতের মতো একাকী মনে হতে থাকে বরকত আলীর। কাঁধে বোঁচকা। বোঁচকার মধ্যে চাল-ডাল, কয়েকটা শাড়ি, লুঙ্গি, কয়েক গজ ছিটকাপড়। নগদ টাকা পকেটে আছে বেশ কয়েক হাজার। কিন্তু অনভ্যস্ত কাঁধে বোঁচকা বইতে গিয়ে ইতোমধ্যেই কাঁধের নুনছাল উঠে গিয়ে জ্বালা শুরু হয়েছে। অভিজ্ঞতা থেকে সে জানে, এরপর কাঁধ এবং হাত পুরোটাই অবশ হয়ে আসতে থাকবে। কাজেই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, কাঁধের এ-বোঝা তাকে ঝেড়ে ফেলতে হবে। চেনাপরিচিত কেউ তাকে এ-অবস্থায় দেখলে মুখের ভাব কীরকম হবে, ভাবতে গিয়েও হাসি পায় তার। কোটিপতি বরকত আলী, যাকে কি-না অন্যেরা কাঁধে তুলতে পেলে বর্তে যায়, সেই লোক নিজের কাঁধে বোঝা নিয়ে হাঁটছে অচেনা অন্ধকার রাস্তায়। নিজেকে একবার তার দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর বলে মনে হয়। পরক্ষণেই জিভ কাটে। তওবা তওবা! কার সঙ্গে নিজেকে তুলনা করছে সে! তার মতো কয়েক লাখ বরকত আলীকে জোড়া দিলেও ওমরের একটা চুলের সমান ওজন হবে না আল্লার দাঁড়িপাল্লায়।
বাঁধের ওপরের ঘরগুলো একটা থেকে আরেকটা বেশ খানিকটা তফাতে। এমন দূরে দূরে কেন একেকটা শরণার্থী পরিবার। সম্ভবত এভাবেই থাকতে বলা হয়েছে তাদেরকে, যাতে তারা কোনো সমাজ গড়ে তুলতে না পারে। সমাজ মানেই কিছুটা জোটবদ্ধতা। তাহলে তাদের যখন-তখন উচ্ছেদ করা সহজ হবে না।
প্রথম ঘরটার কাছে এসে হাঁফ ছেড়ে বাঁচে বরকত আলী। ধপ করে মাটিতে পড়ে যেতে দেয় কাঁধের বোঝাটিকে। কিছুক্ষণ হাঁফায় সশব্দে। বসে পড়তে ইচ্ছা করে। কিন্তু নোংরা মাটিতে বসার মতো এতটা সাধারণ বলে নিজেকে ভাবতে অন্তত রাজি নয় বরকত আলী। কোনো শব্দ আসছে না ঘর থেকে। যাহ্, কেউ নাই নাকি ঘরে? আর সত্যি সত্যি এটা কি একটা ঘর? একটু পরে নিজের নিশ্বাসের শব্দ কমে স্বাভাবিক হয়ে এলে বরকত আলী টের পায়, সে যেটার সামনে এসে দাঁড়িয়ে আছে, সেটা আসলেই একটা ঝুপড়িঘর এবং ভেতরে মানুষ আছে। একাধিক মানুষ। ঘুমন্ত মানুষের গাঢ় নিশ্বাসের শব্দ তাকে আশ্বস্ত করে। সে ঠিক জায়গামতোই এসে পৌঁছেছে। সে শব্দ করার জন্য দরজা খুঁজতে থাকে। কিন্তু অন্ধকারে ঘরটাকে কেবলমাত্র একটা চৌখুপি ঝুপড়ি ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না। একবার সে ঘরটার চারপাশ দিয়ে চক্করও দেয়। কিন্তু কোনটা দরজা আর কোনটা বেড়া ঠাহর করতে পারে না। সে তাই আবার বোঁচকার কাছে ফিরে এসে খলপার বেড়ায় আলতো থাবা দিয়ে ডাকতে শুরু করে Ñ বাড়িতে কেউ আছেন? আছেন নাকি ভাই?
প্রথমে ভদ্রোচিত নিচু গলা। তারপরে গলা চড়াতে হয় তাকে। চড়াতে চড়াতে একপর্যায়ে যখন মনে হয় তার কণ্ঠনালি ফেটে যাওয়ার উপক্রম, তখন ভেতর থেকে চাপা মেয়েলি কণ্ঠে সাড়া আসে Ñ কেডা?
সব পরিবারে নারীরাই আগে সজাগ হয়।
নারীকণ্ঠের সঙ্গে কথোপকথনে প্রস্তুত ছিল না বরকত আলী। সে একটু ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করে Ñ বাড়িতে পুরুষ মানুষ নাই? আমি তার সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই।
নারীকণ্ঠ ঘরের ভেতর থেকে বলে Ñ তাই অসুখ্যা মানুষ। ঘুমায় পড়িছে ওষুদ খায়্যা। জাগনা করা মুশকিল। কী কতে চান, আমাক কন! কে আপনে? কুন জাগাত থাক্যা আইছেন?
এভাবে কথোপকথন হয়! একটু বিরক্তি জাগে বরকত আলীর মনে। কিন্তু আজ তো তাকে বিরক্তি চেপে রাখতেই হবে। সে কণ্ঠস্বর মোলায়েম করে বলে Ñ আমি একজন সাধারণ মানুষ মা। আল্লাহর নির্দেশে আমি কিছু মালসামান এনেছি আপনাদের জন্য। দয়া করে এগুলো আপনি গ্রহণ করলে খুশি হবো।
বরকত আলীর ধারণা ছিল এ-কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে তড়িঘড়ি-তোড়জোড় শুরু হবে ঘরের মধ্যে। কিন্তু তার বদলে কয়েক মুহূর্তের নিস্তব্ধতা নেমে আসে। তারপর ভেতরের সেই অনুচ্চ নারীকণ্ঠ বলে – এ-ব্যাপারে তো আমার একলার কিছু করার নাই। বাড়ির মুরুব্বিরে জিগান লাগবি। তারে জাগনা করা মুশকিল!
বাইরে থেকে অনুনয়ের সুরে বলে বরকত আলী – তাকে একটু জাগান মা!
এবার ভেতর থেকে এই যে হুনছেন জাতীয় শব্দের পাশাপাশি ঠেলা-ধাক্কার মচমচ ওঠে। একজন বয়সী পুরুষ বিরক্তির সঙ্গে জানতে চায় Ñ কী হইছে?
নারীকণ্ঠ অনুচ্চস্বরে তাকে বোধহয় বৃত্তান্ত জানায়।
আবার কিছুক্ষণের স্তব্ধতা নেমে আসে। বোধহয় পুরুষ লোকটা ভাবছে কিছু একটা। মনে মনে হাসে বরকত আলী। নিশ্চয়ই লোকটা ভাবছে কী মতলব নিয়ে বাড়ি বয়ে জিনিস দিতে এসেছে সে! হয়তো খারাপ কিছুই ধারণা করছে। তবু এমন ছন্নছাড়া অভাবী পরিবার। জিনিসপত্রের লোভ তাকে উদ্বেল করবেই। যত অসুখই থাকুক লোকটা এবার বেরিয়ে আসবেই।
কিন্তু কেউ বেরিয়ে আসে না ঘর থেকে। বরং পুরুষকণ্ঠ শোনা যায় নারীকে জিজ্ঞেস করতে – আমি তো অসুখ নিয়া কামে যাবার পারমু না কয়দিন। তা ঘরে খানাদানার কী অবস্থা কও তো শুনি।
নারীকণ্ঠ তাকে আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে বলে – ঘরে চাইল-ডাইল, আলু-পটোল যা আছে তা দিয়া আমাগো তিনদিন চল্যা যাবি।
তাহলে আর ভাবনা কী! তিনদিনের মধ্যে আমি অসুখ সারাবার পারমু। কামেও যাবার পারমু। তাহলে আর মানুষের জিনিস নেওনের দরকার কী?
কথোপকথন বাইরে থেকেই শুনছিল আর অবাক হচ্ছিল বরকত আলী। এবার তাকে পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্যের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে যেন ঘরের মানুষটা বলে – শুনেন দয়ালু ভাই, আমাগো বাড়িত তিনদিনের খাওন মজুত আছে। আমরা আর কিছু লিবার পারমু না। আপনে আপনের মালসামান অন্য কোনো গরিব মানুষরে দান করেন গিয়া।
নিজের কানকে কিছুতেই বিশ্বাস করতে মন চাইছে না বরকত আলীর। সে আবার কথাগুলো ভালো করে শোনার জন্যই জিজ্ঞেস করে – নেবেন না আপনারা জিনিসগুলো?
একই উত্তর ভেসে আসে ভেতর থেকে।

এবার পরবর্তী ঘরটার দিকে হাঁটতে শুরু করে বরকত আলী। লোকে কথায় কথায় বলে, সে নিজেও সে-কথা শতভাগ বিশ্বাস করে যে, মাগনা পেলে বাঙালি আলকাতরাও খায়। কিন্তু এ কী কথা শুনতে হলো আজ তাকে! এ কী অবিশ্বাস্য কথা শোনাল তাকে আল্লাহ!
পরের দরজায় শব্দ করার সঙ্গে সঙ্গেই বেরিয়ে আসে এক লোক। চেহারা দেখা যায় না। কিন্তু অন্ধকারেও কাঠামো বোঝা যায়। বোঝা যায়, বয়স হয়েছে লোকটার। এককালে দশাসই ছিল। এখন বয়স, অভাব, অনিরাপত্তা শরীরে তার খাবলা খাবলা আঘাত বসিয়ে চলেছে অবিরাম। বাড়ির বাইরে বেরিয়ে এসে সালাম দেয় লোকটা তাকে। বরকত আলী কাঁধের বোঁচকাটা মাটিতে নামিয়ে রাখার উদ্যোগ করতেই লোকটা এগিয়ে এসে হাত লাগায়। কাঁধের বোঝা হালকা হওয়ার পরে তাকে কিছুক্ষণ হাঁফানোর অবকাশও দেয় লোকটা। তারপর জিজ্ঞেস করে – অনেকদূর থিক্যা আইলেন ভাইজান? একটু বসেন না-হয়। আমি টুল আনতিছি। পানি-টানি খাবার চান?
এই নোংরা বাড়ির, নোংরা হাতের, নোংরা ঘটি-গেলাসের পানি! শিউরে ওঠে বরকত আলী। অতদূর নামতে আর পারবে না সে। তড়িঘড়ি বলে – না ভাই, পানি লাগবে না। আমি বেশি দেরিও করব না। দায়িত্ব পালন করেই চলে যাব।
ও আচ্ছা।
বলেই থেমে যায় মানুষটা। জানতেও চায় না, কোন দায়িত্ব পালন করতে এসেছে এ-লোকটা। এখন তাকে আরো বেশি অন্ধকারাচ্ছন্ন বলে মনে হতে থাকে বরকত আলীর। নিজেই নিজের কথার খেই ধরে। বলে, আমি আপনাদের জন্য কিছু জিনিস এনেছি।
কী জিনিস?
এই-ই কিছু চাল-ডাল, কাপড়-চোপড় আর কী। আর কিছু টাকা। আসলে আপনাদেরই জিনিস। আপনাদেরই পাওনা আর কী। আল্লাহ আমার কাছে গচ্ছিত রেখেছিলেন। আজ দিতে এসেছি আল্লার হুকুমে।
আমার পাওনা!
ওই আর কী। আপনাদের মতো মানুষদের পাওনা।
ও বুঝবার পারিছি।
অন্ধকারের মধ্যেই লোকটার ঠোঁটে কী হাসি ফুটে ওঠে এক চিলতে? বরকত আলীর ধারণা ছিল ওই মুখে ফুটে উঠবে বিস্ময় আর প্রত্যাশা। কিন্তু কেন যেন মনে হয় মানুষটাকে স্পর্শই করেনি আসন্ন কিছু জিনিস পাওয়ার প্রত্যাশা। নগদ অর্থপ্রাপ্তির সম্ভাবনাও তাকে বিন্দুমাত্র উদ্বেল করেনি। তাকে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বরকত আলী তাড়া দেয়। বলে Ñ এই জিনিসগুলান ঘরের ভেতরে নিয়ে যান ভাই।
বোঁচকার দিকে একটা হাত দুলিয়ে ইঙ্গিত করে সেই হাতটাকেই টাকা বের করার জন্য পকেটে ঢোকাতে যায় বরকত আলী। অন্ধকারের মানুষটা একটা হাতের চেটো তার দিকে মেলে ধরে বলে – একটু থামেন ভাইজান।
এরপর সে এখানে দাঁড়িয়েই ঘাড়টিকে সামান্য একটু ঘরের দিকে বাঁকা করে গলা তুলে ঘরের মধ্যকার কোনো একজনের উদ্দেশে গলা উঁচিয়ে বলে – ও ফজলের মাও, আমাগো ঘরে যা আছে তাই দিয়ে কয়দিন চলবি কবার পারো?
অনুচ্চ নারীকণ্ঠের উত্তর আসে – খাড়ান দেখতিছি।
এবার কিছু হাঁড়ি-পাতিল নাড়াচাড়ার ঢুক-ঢুক শব্দ আসে। হাঁড়ির মধ্যে চাল-ডাল নাড়ানোর খচর-খচর শব্দও পাওয়া যায় খানিকটা। তারপর উত্তর আসে – কালকার তিনবেলা চলার মতোন আছে।
আলহামদুলিল্লাহ।
তারপর মানুষটা সারাগায়ে যেন আরো বেশি আঁধার মাখিয়ে ফিরে তাকায় বরকত আলীর দিকে। বলে Ñ শুনবার পাইলেন তো জনাব, ঘরে যা আছে তা দিয়া আমাগোর আরো তিনবেলা চলবি। আপনার জিনিস আমাগোর লাগবি না। যার ঘরে কিছু নাই, সেইরকম মানুষেক জিনিসগুলান দ্যান গিয়া ভাইজান।
মাত্র তিনবেলার ডাল-ভাত বা খিচুরি-ঘ্যাঁটের বন্দোবস্ত আছে বলে একটা অভাবী মানুষ এভাবে ফিরিয়ে দিতে পারে এতখানি প্রাপ্তির সম্ভাবনা! বরকত আলী তো স্বপ্নেও ভাবতে পারে না এমন কথা। কিন্তু তাকে আর কথা বলার অবকাশ না দিয়ে লোকটা বিদায় দেয় এবং নেয় – আমার ভোরবেলাত উঠ্যা কামে যাবার লাগবি। শুতে যাচ্ছি। আপনে কী করবেন? যদি এটি রাতে থাকতে চান, তাহলে বিছানপাতির ব্যবস্তা করি!
না না, লাগবে না।
তাহলে সেলামালেকুম।

কাঁধের বোঁচকা এখন রীতিমতো মুর্দার খাটের মতো ভারী ঠেকছে বরকত আলীর কাছে। এ কী ঝামেলায় পড়েছে সে! পরপর দুটি এমন অবিশ্বাস্য মানুষের মুখোমুখি হওয়ার ঘটনা তাকে বিমূঢ় করে ফেলেছে প্রায়। একবার মনে হয়, সে সত্যি সত্যি জেগে আছে তো! যা দেখছে তা কি স্বপ্নের মধ্যে ঘটে চলেছে? কিন্তু কাঁধের বোঝা এবং ব্যথা-জ্বলুনি যে নিরেট বাস্তব। এ-অবস্থাতেই সে হেঁটে চলে অন্ধকারের মধ্যে ঘুমিয়ে থাকা আরেক ঘরের দিকে।
এবার তার ডাকে সাড়া দিয়ে বেরিয়ে আসে অনেক বৃদ্ধ একজন মানুষ। কথা বলার আগে প্রতিবারই কাশছে সে। বিনয়-টিনয় এখন উধাও হয়েছে বরকত আলীর ভেতর থেকে। সে তড়বড়িয়ে জিজ্ঞেস করে Ñ আপনারা নিশ্চয়ই খুব অভাবী মানুষ।
তা আর কওয়ার অপেক্ষা রাখে বাবাজি! গরিব মানে একেবারে হদ্দ গরিব আমরা। এখন তো দুইজন বুড়াবুড়ি। ছাওয়াল-পাওয়াল জুয়ান হইছে। নিজের নিজের মতোন থাকে। আমি গতর খাটাতে পারি না এই হাঁপ-কাশির জন্যে। মানুষ আমাক কামেই লিবার চায় না। তাই সবদিন কামও পাই না। যেদিন পাই সেদিন চল্যা যায়। যেদিন পাই না সেদিন…
সেদিন কীভাবে চলেন?
তাকে থামিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করে বরকত আলী। আর বরকত আলীর প্রশ্নটা মাটিতে পড়ার আগেই বৃদ্ধ বলে Ñ আমি কী আর কিছু করি! না কিছু করবার পারি! আল্লাহ চালায়। আল্লাহ চালায়া ল্যায়।
জায়গামতো পৌঁছানো গেছে মনে করে মনে মনে হাঁফ ছাড়ে বরকত আলী। বলে Ñ আমি আপনাদের জন্য কিছু জিনিস এনেছি, আর কিছু টাকা। এই বস্তাটা আপনার টানতে কষ্ট হবে। চলেন এটা আমি আপনার ঘরের মধ্যে দিয়ে আসি!
খাড়ান খাড়ান! আগেই দিয়েন না। আমি আমার বুড়িরে আগে জিজ্ঞাস করি।
বরকত আলীকে অপেক্ষায় রেখে বুড়িকে জিজ্ঞেস করার আগেই কাশির দমকা কাশে। সেই কাশির ঝাঁকুনিতে বেঁকে হেলে পেছনদিকে টুকরো টুকরো ভেঙে পড়ার উপক্রম হয় বৃদ্ধ। মুখে রুমাল চাপা দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে বরকত আলী। কাশি শেষ হলে তারপরও কিছুক্ষণ হাঁফায় বুড়ো। তারপর ভেতরের দিকে উদ্দেশ করে খনখনে গলায় জিজ্ঞেস করে Ñ ও বুড়ি, আমাগোর ঘরেত কী আছে ক শুনি!
ভেতর থেকে উত্তর আসে Ñ পান্তা আছে। কাল বিয়ান বেলাখান চলবি দুইজনার।
তাহলে তো হয়্যাই গেল।
বরকত আলীর দিকে ফেরে বৃদ্ধ। বলে Ñ শুনবার পালেন তো বাবাজি! কাল বিয়ান বেলার খাওন আছে আমার ঘরে। একবেলার জন্যে ভাবনা নাই। বাকি বেলার ব্যবস্তা হয়্যা যাবি। আল্লাহ ব্যবস্তা করবি। চিরকাল ব্যবস্তা করতিছে। তাহলে বুঝলেনই তো, একবেলার খাওন ঘরে থাকা অবস্থাত কী কর‌্যা আমরা আপনের সাহায্য লিবার পারি? আপনে বরং অন্য জাগাত দ্যান গিয়া আপনের মালসামান, ট্যাকা-পয়সা।

বাঁধের পথে কাঁধে বস্তা নিয়ে আর হাঁটার শক্তি নাই বরকত আলীর। পরপর তিনটি এমন ঘটনা, এমন পরিবারের মুখোমুখি হওয়ার পরে স্নায়ু প্রায় বিবশ। তবু নিজেকে টেনে নিয়ে এগিয়ে চলে সে।
হঠাৎ-ই মুখের ওপর তীব্র টর্চের আলো এসে পড়ে। অন্ধকারে এবার পুরো অন্ধ হয়ে পড়ে সে। নিজেকে ধাতস্থ করার আগেই তার গায়ের ওপর এসে পড়ে সপাট রুলারের বাড়ি – শালা হারামির বাচ্চা। এই গরিব পাড়াতও চুরি করতে আসিস। পাইছি শালা আজ তোরে। চল। তোর চুরির খায়েশ চিরদিনের জন্যে মিটায়া দিব।
কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বুকের ওপর একটা রামধাক্কা।
কাঁধে বস্তা নিয়ে এমনিতেই টলমল করছে বরকত আলী। তীব্র আলো ধাঁধিয়ে দিয়েছে চোখ এবং মগজ। তার সঙ্গে পিঠের ওপর লাঠির বাড়ি এবং বুকে ধাক্কা। হুড়মুড় করে ভূমিশয্যা নিতে এক মুহূর্ত সময় লাগে না তার। ততক্ষণে তিন টহল পুলিশ ঘিরে ফেলেছে তাকে। একজন বস্তার ওপর টর্চের আলো ফেলে। মুখ খোলে বস্তার। সব্বনাশ! এ তো দেখতিছি সব নতুন নতুন শাড়ি আর লুঙ্গি! শালা তো ঘাগু মাল রে! এই বাঁধের কুন বাড়িত নতুন শাড়ি আছে, কুন বাড়িত নতুন লুঙ্গি আছে Ñ বাইছা বাইছা তুইলা আনিছে। লাগা, শালার গোয়াত বেশি কইরা লাত্থি লাগা!
মুখ থেকে কথা শেষ হওয়ার আগেই তার পিঠে-পাছায় এলোপাতাড়ি বুটের লাথি আঘাত হানতে শুরু করে। নিজের অজান্তেই গোঙানি বেরিয়ে আসে বরকত আলীর মুখ চিরে। সেইসঙ্গে ঘটনার আকস্মিকতায় এতই হকচকিয়ে গেছে বিধায় নিজের পরিচয় দেওয়ার কথাও মনে আসে না। তার মুখের ওপর আবার টর্চের আলো এসে পড়ে। মন্তব্য কানে আসে Ñ শালাক দেখলে তো চোর মুনে হয় না। দিব্যি তেল-জলের ভদ্দরলোকের লাহান চেহারা। সেই শালার এই অপকম্মো। মার শালাক আরো কয়েক ঘা!
আবার কয়েক ঘা বসানোর পরে প্রশ্ন আসে – এই শালা তোর বাড়ি কুন জাগাত?
এবার নিজের কথা বলার বা নিজের পরিচয় দেবার অবকাশ পাওয়া যায়। কিন্তু সুযোগটা নিতে পারে না সে। বোঁচকা কাঁধে এতটা রাস্তা হাঁটা, তিন-তিনটা গরিব পরিবারে এমন অদ্ভুত অপ্রত্যাশিত  অভিজ্ঞতা, আর তারপরে এরকম হামলে পড়া পুলিশি মারের চোটজনিত শারীরিক এবং মানসিক আতঙ্কে ইতোমধ্যেই মাটিতে ঢলে পড়া বরকত আলী মাটিতে মুখ গুঁজেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকে।

দুই
ওসি সাহেব বারবার চায়ের জন্য পীড়াপীড়ি করলেও সেই আপ্যায়নের অনুরোধ পায়ে ঠেলে স্বামীকে প্রায় কোলে তুলে নিয়ে থানা থেকে বেরিয়ে সোজা নিজেদের প্রাডো গাড়িতে ওঠায় বরকত আলীর বউ। কেবল ফজরের ওয়াক্ত শেষ হয়েছে। ভালো করে সকাল ফুটে ওঠেনি। সেই কম আলোতেই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে বরকত আলীর মুখ-পিঠের কালসিটে দাগগুলো। স্বামীর গায়ে এমন মারধরের চিহ্ন দেখার পর থেকে দুঃখে নয়, রাগে ফুঁসছে বেগম সাহেবা। পুলিশকে দেখে নেবে সে। কিন্তু আগের কাজ আগে। আগে স্বামীকে বাড়িতে নিয়ে যেতে হবে, সুস্থ করে তুলতে হবে। তারপর দেখা যাবে পুলিশগুলানের কী ব্যবস্থা করা যায়। কিন্তু গাড়িতে ওঠার পরই সে বিস্ফোরিত হয় স্বামীর ওপরেই। এইটা তোমার কেমন আক্কেল! তোমার পজিশনের মানুষ কীভাবে এমন কাজ করতে পারে! মানুষকে সাহায্য করবে ভালো কথা, তার জন্য এমন কাজ কেউ করে? তোমার কি ভীমরতি ধরেছে?
মিনমিন করে বউকে কিছু একটা উত্তর দিতে চেষ্টা করে বরকত আলী। কিন্তু বউ সেই আলট্রা লো ফ্রিকোয়েন্সির শব্দ কানেই তোলে না। হাইপিচ কণ্ঠে তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে – জাকাত দিবে ভালো কথা। কীভাবে দিবে, তা আমার কাছে শুনতে চাইলেই তো হতো! চলো, বাড়িতে পৌঁছালেই দেখবে, আমি সব ব্যবস্থা করে রেখেছি।
বাড়িতে ঢোকার মুখে এই এত সকালেই গেটের সামনে বেশ বড়সড় মানুষের জটলা।
এত মানুষ তার বাড়ির সামনে কেন?
বউ সংক্ষেপে উত্তর দেয় – জাকাত নিতে।
মানে?
চলো। আগে বাড়িতে ঢোকো। বিশ্রাম নাও। গোসল করো। নাস্তা করো। তারপর বলছি।
কিন্তু অতোটা সময় পাওয়া যায় না। তার আগেই গেটের বাইরে থেকে বেশ জোরে জোরে চিল্লাপাল্লা আর ঠেলাঠেলির শব্দ ভেসে আসতে থাকে।
ও কী?
দেখার জন্য সে উদগ্রীব হয়ে ওঠে। উদ্বিগ্নও।
কিন্তু বউ তাকে গেটের কাছে যেতেই দেয় না। তিনতলার ব্যালকনিতে আরাম চেয়ার পেতে দিয়ে বলে – এখান থেকে দ্যাখো।
সেখানে বসে গেটের দিকে তাকিয়ে সে স্তম্ভিত হয়ে যায়। গেটের সামনে শত শত মানুষের ভিড়। ওরা এখানে কেন?
জাকাত নিতে।
খবর পেল কোথায় যে এখানে জাকাত দেওয়া হবে? আর এত সকালেই সব জড়ো হলো কীভাবে?
বউ বেশ গর্বের সঙ্গে নিজের বুদ্ধিমত্তার আত্মপ্রসাদ নিয়ে বলে – তার জন্য আমাকে কোনো ঢোল পেটাতে হয়নি বাপু। আমি খালি থানায় যাওয়ার সময় বাড়ির চাকর আর দারোয়ানদের বলে গেছি যে, তোদের সাহেব জাকাত দিতে গিয়ে ঝামেলা বাধিয়েছে। সেই জাকাত আমি আজকেই দান করব। চাকররা বলেছে কথাটা পাড়ার দোকানে। সেখান থেকে লহমার মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে পুরো শহরে। লোকে ছুটে আসছে জাকাত নিতে। মেয়ে-মর্দ, জোয়ান-বুড়ো সক্কলেই। দ্যাখো, নিজের চোখেই দ্যাখো। এমন একটা কাজের জন্য তুমি নিজেকে কোন ঝামেলার মধ্যেই না জড়িয়ে ফেলেছিলে!
ব্যালকনি থেকে নিচের দিকে তাকিয়ে ভালো করে দেখতে গিয়ে বরকত আলীর চোয়াল ঝুলে পড়ে। এখান থেকে তিনদিকের রাস্তাই দেখা যায় অনেকদূর পর্যন্ত। সেই রাস্তা যতদূর দেখা যায়, সে দেখতে পায় পিলপিল করে ছুটে আসছে মানুষ তার বাড়ির দিকে। মানুষ আর মানুষ। পড়িমড়ি করে ছুটে আসছে সবাই। শত শত মানুষ, হাজারে হাজারে মানুষ, কাতারে কাতারে মানুষ। এত ওপর থেকে আর এতদূর থেকে, দেখতে বামনের মতো লাগে। কিন্তু তারা মানুষই। এবং তারা ছুটে আসছে তার বাড়িতে জাকাতের নামে কিছু যদি পাওয়া যায় সে-লোভে।
সেইসব ছুটে আসা মানুষ দেখতে দেখতে হঠাৎ গতরাতের কথা মনে পড়ে যায় বরকত আলীর। গতরাতে যে তিনটি পরিবারের কাছে গিয়েছিল সে বাঁধের ওপরে, তারা কি সত্যি সত্যি মানুষ ছিল? তার সন্দেহ হতে থাকে যে, সে নিজেও সত্যি সত্যিই কি গতরাতে গিয়েছিল বাঁধের ওপরে? নাকি তার দেখা মানুষগুলো ছিল পুরোপুরি অবাস্তব মানুষ? নাকি গতকালের রাতটাই ছিল অলীক অবাস্তব একটা রাত?