অস্পষ্ট সীমানার সন্ধানে

জাহিদ মুস্তাফা

Jahid102-2
সেই আশির দশক থেকে আমরা দেখছি – বাংলাদেশের কয়েকজন শিল্পীর শিল্পকর্মে উঠে আসছে সামাজিক অসংগতি আর অবক্ষয়ের চিত্র। তাঁদের কাজে দেখেছি মানুষে মানুষে ভেদাভেদ আর বৈষম্যকে ব্যঙ্গাত্মকভাবে তুলে ধরতে। মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা-পরবর্তীকালের রাজনৈতিক অস্থিরতা, হত্যা, ক্যু, সন্ত্রাস সে-সময়কার সমাজজীবনকে তছনছ করে দিয়েছে, রাষ্ট্রকে কলুষিত করেছে। অগণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় রাষ্ট্র নিজেই হয়ে উঠেছিল নিপীড়ক। সে-সময়কার তরুণ কতিপয় শিল্পী সে-সময়ের যন্ত্রণাকে ধারণ করেছিলেন তাঁদের কাজে। তাঁদেরই কেউ কেউ সময় নামে একটি শিল্পীগোষ্ঠী গড়ে তুলেছিলেন।
সমাজবাস্তবতার ওই শিল্পধারা এখনো প্রবহমান আমাদের এখানে। এখনো কতিপয় তরুণ ও নবীন শিল্পী মানুষ ও সমাজের অবক্ষয় নিয়ে আঁকছেন। এরই ধারাবাহিকতা আমরা প্রত্যক্ষ করলাম নবীন শিল্পী শারদ দাসের চিত্রকর্ম ও ভাস্কর্যে। সম্প্রতি ধানমণ্ডিতে ঢাকা আর্ট সেন্টারের দোতলার চারটি কক্ষে প্রদর্শিত হলো তাঁর প্রথম একক শিল্পকর্ম-প্রদর্শনী।
তাঁর একক প্রদর্শনীর শিরোনাম ‘অস্পষ্ট সীমানা’। ঢাকা আর্ট সেন্টারের আয়োজনে এবং শিল্পকলাবিষয়ক ত্রৈমাসিক কাগজ ডেপার্ট-সম্পাদক শিল্পী মোস্তাফা জামানের নির্বাচনে (কিউরেটিংয়ে) এ-প্রদর্শনীটি চলেছে গত ১১ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার থেকে ২২ সেপ্টেম্বর ২০১২ শনিবার পর্যন্ত। এতে শিল্পীর ২৮টি চিত্রকর্ম, তিনটি ভাস্কর্য ও একটি ভিডিও ইনস্টলেশন প্রদর্শিত হয়েছে।
নবীন শিল্পী শারদ দাসের জন্ম ও বেড়ে ওঠা চট্টগ্রামে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই সম্প্রতি স্নাতকোত্তর করেছেন চারুকলায়। ২০০৩ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত ত্রিশটি যৌথ চারুকলা প্রদর্শনীতে অংশ নিয়েছেন তিনি। এর মধ্যে আছে ঢাকায় আয়োজিত চতুর্দশ দ্বিবার্ষিক এশীয় চারুকলা প্রদর্শনী ২০১০। অষ্টাদশ ও ঊনবিংশতিতম জাতীয় চারুকলা প্রদর্শনী এবং নবীন শিল্পী চারুকলা প্রদর্শনীর দুটি আসর। আরেকটি উল্লেখযোগ্য প্রদর্শনীতে তিনি অংশ নিয়েছেন, যেটি এ-বছর ঢাকার ইতালীয় দূতাবাস আয়োজন করে বেঙ্গল শিল্পালয় ও সন্তরণকে সঙ্গে নিয়ে।
শারদ দাস এক নবীন প্রতিভা, সদ্যই যিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চারুকলায় স্নাকোত্তর হয়েছেন – ঢাকায় এসেছেন নিজের শিল্পভাবনা শিল্পানুরাগীদের মধ্যে পরিচয় করিয়ে দিতে। প্রদর্শনীর কিউরেটর শিল্পী ও শিল্পের লেখক মোস্তফা জামান শারদের ব্রোশিওরে তাঁর কাজের গতিপ্রবাহ নিয়ে লিখেছেন পাশ্চাত্য শিল্পী ফ্রান্সিস বেকন, জ্যাক দেরিদা প্রমুখ খ্যাতনামা শিল্পীর বিষয়ভাবনা আর দর্শনের প্রেক্ষাপটকে ধারণ করে। আমার তো মনে হয়, এই নবীনের কাজে তাঁর পূর্বসূরি অনেকেরই প্রভাব আছে কমবেশি। বিশেষ করে স্বয়ং কিউরেটর মোস্তফা জামানের চিত্রগত দর্শন ও করণকৌশলের সঙ্গে অনেক সাযুজ্য লক্ষ করি।
গ্লোবালাইজেশনের এ-যুগে পুঁজি ও বাণিজ্যের ক্ষমতা এমন সর্বব্যাপ্ত যে, মানুষের চিন্তা-চৈতন্যে এর প্রভাব স্বাভাবিক মানবিক মূল্যবোধ ও সুকুমারবোধকে একপ্রকার পণ্যে পরিণত করার প্রয়াস পাচ্ছে। অদ্ভুত এক ইঁদুরদৌড়ের পেছনে ছুটছে মানুষ। শুভ বোধবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষও সহজে এড়াতে পারছেন না – পুঁজির পরাক্রমকে। সমাজবদ্ধ ও ঐক্যবদ্ধ মানুষ ক্রমে একাকী ও আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়ছে। পরার্থপরতার পরিবর্তে মানুষ দিনকে দিন হয়ে উঠেছে স্বার্থপর ও বিবেকবর্জিত। সমাজের এই নেতিবাচক প্রবণতা থেকে আমরাও মুক্ত নই। আমাদের চারপাশে প্রতিদিন কত খারাপ খবর! নবীন হয়েও শিল্পী শারদের মধ্যে এ-উপলব্ধির প্রমাণ আমরা পেয়ে যাই তাঁর আঁকা চিত্রকর্মে – তাঁর শিরোনাম ‘অস্পষ্ট সীমানায়’। স্যুররিয়ালিস্টিক প্রবণতা আমরা লক্ষ করি তাঁর সৃজনধারায়।
শারদ দাসের এই একক প্রদর্শনীতে দুটি সিরিজ চিত্রকর্মের প্রাধান্য রয়েছে। একটি অস্পষ্ট সীমানা ও অন্যটি ‘নগর স্বপ্ন’। ‘নগর স্বপ্ন-৩০’ শীর্ষক চিত্রকর্মে অন্ধকারাচ্ছন্ন কালো রঙের ভেতর দুটি নগ্ন ফিগর দণ্ডায়মান। ধূসর রঙের নগ্ন পুরুষ দুহাতের ভাঁজে মাথা নুইয়ে যেন ঘুমোনোর চেষ্টা করছে। যেন সে নগরজীবনের উদ্বাস্তুর প্রতীক। কিন্তু সামনেই দাঁড়ানো শব্দদূষণকারী এক প্রচারযন্ত্ররূপী মানুষ। তাদের আশপাশ দিয়ে যাচ্ছে খণ্ড খণ্ড মেঘ। ‘নগর স্বপ্ন-২৫’ শীর্ষক চিত্রকর্মটিতে তিনজন মানুষ তিনরকম অভিব্যক্তি প্রকাশ করছে। একজনের হাতে প্রচারযন্ত্র, একজন ঊর্ধ্বপানে তাকিয়ে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছে, অন্যজনের অভিব্যক্তিতে কিংকর্তব্যবিমূঢ়তা। তিনজনই নিরাভরণ। ভারমিলিয়ন রঙে রঞ্জিত গোটা ক্যানভাসে অবয়বগুলো ইয়েলো অকার, ব্রান্টসিয়েনা ও সাদা-কালোর মিশ্রণে আঁকা। চিত্রপটের বাঁদিকে বেশকটি হ্যাঙার ঝুলছে। একই সিরিজের ২২-সংখ্যক চিত্রকর্মটিতে প্রাণপণে বেঁচে থাকার আকুতি নিয়ে ভয়ার্ত এক মানুষ অবয়ব দেখা যাচ্ছে। তার চারপাশে অনেক শব্দযন্ত্র, চোখের ওপর তাক করা জ্বলন্ত বাল্ব এবং তাঁর দিকে ধেয়ে আসা দুটি হাত। চিত্রকর্মটির সামনের বড় প্যানেলের ঊর্ধ্বাংশে নির্মাণাধীন স্থাপনার অংশ, নিচে টাই বাঁধা চারটি অবয়বের আভাস। অসংখ্য ইলেকট্রনিক মিডিয়া যেন ধেয়ে আসছে তার দিকে। সে যেন গার্মেন্ট শ্রমিক, অথচ নিজে বস্ত্রহীন। অর্থাৎ যে-শ্রমিকের শ্রমে মালিক শ্রেণির বিত্ত-বৈভবের পাহাড় গড়ে উঠছে, তার প্রাপ্তি যৎসামান্য। এ-বৈষম্যকে শিল্পী তুলে ধরেছেন।
পরিকল্পনাহীন নগরায়ণ, নাগরিক সুবিধাবঞ্চিত নগরজীবনের নানা বিষয়গুলোর সঙ্গে, মানুষের স্বপ্ন ও রূঢ় বাস্তবতাকে শিল্পী তুলে ধরেছেন তাঁর অঙ্কিত ‘নগর স্বপ্ন’ সিরিজের নানা চিত্রকর্মে। পোশাকি এ-নগরজীবনে শারদ দাসের আঁকা ফিগরগুলো পোশাকশূন্য কেন – এ-প্রশ্ন উঠতেই পারে। সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য বোঝানোর প্রতীক হিসেবে শিল্পী হয়তো চরিত্রচিত্রণে পোশাক বর্জন করেছেন।
শিল্পীর আরেকটি সিরিজ ওজিং অর্থাৎ ‘বহমানধারা’। এই সিরিজের ২-সংখ্যক চিত্রে মুণ্ডুহীন এক মানুষের পিঠ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে রক্তধারা। দুনিয়াজুড়ে অহরহ ঘটমান রক্তাক্ত ঘটনাবলির প্রতীক যেন এটি। ঢাকায় দ্বাদশ এশীয় দ্বিবার্ষিক চারুকলা প্রদর্শনীর গ্র্যান্ড পুরস্কারপ্রাপ্ত ওমানের শিল্পী বুদোর আল-রাইয়ামির ভিডিও ইনস্টলেশনের কথা মনে পড়ে গেল। একটি উন্মুক্ত পিঠ রক্তে ভরে যাচ্ছে, দুটি হাত বেশ যন্ত্রসহকারে ব্যান্ডেজ কিংবা তুলা দিয়ে পিঠের রক্ত মুছে দিচ্ছে – এরপর আবার পিঠটা ভরে যাচ্ছে রক্তে। এ-কাজটির চেতনার সঙ্গে শারদ দাসের চিত্রকর্মটির সাযুজ্য আছে।
কল্পিত সুপার হিরো আর সমসাময়িক বিশ্বরাজনীতির হিরোদের প্রতিকৃতি নিয়ে মিশ্রমাধ্যমে প্রিন্ট করেছেন শিল্পী। এ চিত্রটির শিরোনাম গল্প এবং গল্পের পর। সুপারম্যান, ব্যাটম্যান, স্পাইডারম্যান, গডজিলাদের সঙ্গে এক কাতারে আছেন রোনাল্ড রিগ্যান, পিতা-পুত্র দুই বুশ, ওবামা, লাদেন, মোল্লা ওমর, জাওয়াহিরি প্রমুখের অবয়ব। অবয়বের ভেতরেই লেখা হয়েছে বীরত্ব, যখন পাগলামিতে পরিণত হয়! সমসাময়িক বিশ্বপরিস্থিতির দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই – এত হানাহানি, জাতিতে জাতিতে সংঘাত, একই দেশে ভিন্নমতের প্রতি অশ্রদ্ধা থেকে গৃহযুদ্ধ – এসব তো বন্ধ হচ্ছে না। ‘শান্তির লালিত বাণী যেথায় শোনাইবে ব্যর্থ পরিহাস’ রবীন্দ্রনাথের এ-বাণী যেন অমোঘ হয়ে ওঠে বিশ্বপরাশক্তির হিরোইজমে। শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের ইঁদুরদৌড়ে মানবতা হয়ে ওঠে অসহায়। এই পরিস্থিতিটা শিল্পী তুলে ধরেছেন হিরোদের কর্মকাণ্ডের অন্তরায় শূন্যতার দিকনির্দেশ করেই।
নবীন শিল্পী শারদ দাসের প্রথম একক শিল্পকর্ম প্রদর্শনীটি নানা দিক দিয়ে দর্শক-বোদ্ধাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। প্রদর্শনীটি উৎসর্গ করা হয়েছে অকালপ্রয়াত শিল্পী অশোক দাশ (১৯৫৩-৯৩) স্মরণে। তিনি শারদের জনক। তাঁর ব্যবহার করা উঁচু পায়া এক শূন্য চেয়ার এবং সেটিকে কেন্দ্র করে মিনিটখানিকের একটি ভিডিও ইনস্টলেশন এক ধরনের শূন্যতাবোধ তৈরি করে।
ব্যতিক্রমী এ-প্রদর্শনী আয়োজনের জন্য ঢাকা আর্ট সেন্টার কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ।