অ্যালিস মুনরোর গল্পের ভুবন : বিন্দুতে সিন্ধু-দর্শন

আলী আহমদ

গত বছর, অর্থাৎ ১৯১২ সালের, সাহিত্যে নোবেল ঘোষণার সময় ঘটনাক্রমে আমি টরন্টোতে ছিলাম। সে-সময়ে কানাডার বড় ওই শহরের ছোটবড় অনেক বইয়ের দোকান তন্নতন্ন করে খুঁজেও নোবেলজয়ী চীনা লেখক মো ইয়ানের একটি বইও পাইনি। তার তিন-চারদিন পর নিউইয়র্কেও ওই একই অবস্থার মুখোমুখি হয়েছিলাম। না, মো ইয়ান ওদের কাছে অপরিচিত ছিল না; তবে তাঁর ইংরেজি অনুবাদের কয়েকটি বইয়ের সামান্য দু-চারখানা বই ওইসব দোকানে যা ছিল, নোবেল পুরস্কার ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই তা নিশ্চয়ই বিক্রি হয়ে গিয়েছিল। আমি অবশ্য তার দিন কয়েক পরে ঢাকায় বসে টরন্টো থেকে পাঠানো মো ইয়ানের বেশকটি বই-ই পেয়েছিলাম। এবারের নোবেলজয়ী অ্যালিস মুনরোর সঙ্গে এ-বিষয়ের অবতারণা সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক, জানি। তবু স্রেফ টরন্টো আর কানাডার কথা বলতেই এ-কথাগুলো বলা।

অ্যালিস মুনরোর লেখার সঙ্গে আমার বেশ খানিকটা পরিচয় আছে; ২০০৯ সালে আন্তর্জাতিক ম্যান বুকার পুরস্কার পাওয়ার আগে The New Yorker মাগ্যাজিনের দু-একটি কপিতে তাঁর দু-একটি গল্প পড়েছি – তার নাম এখন আর মনে নেই। তবে আন্তর্জাতিক ম্যান বুকার পাওয়ার পর তাঁর কয়েকটি বই জোগাড় করে পড়ে ফেলি। এক বিশেষ ধরনের ভালোও লেগে যায় তাঁর লেখা। সত্যি বলতে কী, কানাডার যে-লেখকের প্রতি আমার সবচেয়ে বেশি দুর্বলতা – এবং অনেক ভালোবাসা – তিনি মার্গারেট এটউড, অ্যালিস মুনরো নন। নিবন্ধের শুরুতেই টরন্টো আর কানাডার প্রসঙ্গ টেনেছিলাম এই এটউডের কথা বলতে। তাঁর বসবাস টরন্টোতে, আর লেখার পটভূমি মূলত কানাডা। গত বছরের নোবেল ঘোষণার সময় এটউডের পুরস্কার পাওয়ার কথা নিয়েই ভেবেছিলাম। মার্গারেট এটউড না-হলেও, এবারের পুরস্কার তবু কানাডায় গেল – অ্যালিস মুনরোর হাতে। একশ তেরো বছরের সাহিত্য পুরস্কারের মধ্যে এই প্রথমবার, ২০১৩ সালে; কানাডার কোনো লেখক জিতলেন এ-পুরস্কার। মার্গারেট এটউড বয়সে মুনরোর চেয়ে আট বছরেরও বেশি ছোট; সুতরাং তাঁর নোবেল পাওয়ার সময় এখনো আছে। তবে সাহিত্যে নোবেলের যে-ধারা আমরা লক্ষ করে আসছি, তাতে তিনি কোনোদিন এ-পুরস্কার যে পাবেন এমন ভবিষ্যদ্বাণী, বোধহয়, কেউই করতে সাহস করবেন না।

খুব প্রাসঙ্গিক না-হলেও, আরেকটি বিষয় এখানে একটু উল্লেখ করতে চাই। নোবেলজয়ী সাহিত্যের মূল ভাষা হিসেবে এককভাবে ইংরেজির আধিপত্য থাকলেও, একক দেশ হিসেবে কিন্তু এখনো ফ্রান্স সাহিত্যে সর্বাধিক নোবেলজয়ী; এর পরপরই অবস্থান যুক্তরাষ্ট্রের। ইংরেজি সাহিত্যে প্রথম পুরস্কার পান ইংল্যান্ডের রুডইয়ার্ড কিপলিং, ১৯০৭ সালে; আর যুক্তরাষ্ট্র সাহিত্যে প্রথম নোবেল জেতে ১৯৩০ সালে, সিনক্লেয়ার লুইসের মাধ্যমে; অস্ট্রেলীয় ঔপন্যাসিক প্যাট্রিক হোয়াইট এ-পুরস্কার পান ১৯৭৩ সালে; দক্ষিণ আফ্রিকার (বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ার অভিবাসী) জে. এম. কোয়েটযি এই পুরস্কার পান ২০০৩ সালে। সে-তুলনায় আমাদের বাঙালি কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯১৩ সালে প্রথম অ-ইয়োরোপীয় হিসেবে সাহিত্যে নোবেল জিতে আমাদেরকে সত্যিই গৌরবান্বিত করেছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য এই যে, এখন থেকে ঠিক একশ বছর পূর্বে আমাদের সাহিত্যে নোবেল এলেও, পরবর্তীকালে নোবেল পাওয়া তো দূরের কথা, বিশ্বসাহিত্যের অঙ্গনে আমাদের সাহিত্য বর্তমান সময় পর্যন্তও যেন অপাঙ্ক্তেয় হয়েই রইলো।

এবারে অ্যালিস মুনরোর কথায় আসি। সাহিত্যের অঙ্গনে ছোটগল্প বলে যে জনপ্রিয় ধারাটি প্রচলিত, তিনি সে-ধারার লেখক।           এ-ধারাটি পাঠকদের কাছে যেমনি, লেখকদের কাছেও ঠিক তেমনি প্রিয়। বিশ্বসাহিত্যের সুবিশাল পরিসরে এমন কোনো ঔপন্যাসিক সম্ভবত পাওয়া যাবে না, যিনি কোনো ছোটগল্প লেখেননি, কিন্তু এমন বহু ছোটগল্প-লেখক আছেন যাঁরা উপন্যাস লেখেননি, কিংবা লেখেন না। আর ছোটগল্প সাহিত্যের মূলধারারই অংশবিশেষ; তুলনামূলকভাবে ক্ষুদ্রতর এবং/ কিংবা সংকীর্ণতর পরিসরে মানুষের জীবন-সমাজ-সংসারের ভেতর-বাইরের অনুসন্ধান ও চিত্রায়ণ, উপন্যাসের মতোই, ছোটগল্পের কাজ। অথচ গত একশ বারো বছরের সাহিত্যে নোবেলের মহাভোজসভায় গরিব আত্মীয়ের মতো ছোটগল্প প্রায় সবার অলক্ষে অনেকখানি দূরত্বে  কাব্য-উপন্যাস-নাটক-প্রবন্ধের মতো অভিজাতদের ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে যেন জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। সাহিত্যের গদ্যশাখায় এতকাল পর্যন্ত যাঁদের পুরস্কার দেওয়া হয়েছে তাঁদের প্রায় সবাই ঔপন্যাসিক; প্রায় সবাই-ই ছোটগল্প কমবেশি লিখেছেন, এবং তাঁদের মধ্যে যাঁরা এখনো সক্রিয় তাঁরা অনেকেই ছোটগল্প লিখছেন। কিন্তু নোবেল কমিটি তা যেন কখনো আমলে নেয়নি। আর শুধুই ছোটগল্প লিখেছেন, এমনকি কবিতা-প্রবন্ধও লিখেছেন, অথচ উপন্যাস লেখেননি, তেমন কোনো সাহিত্যিককে এতোদিন সাহিত্যের নোবেল দেওয়া হয়নি। সাহিত্যের পাঠকমাত্রই আন্তন চেখভের কথা ভাববেন এ-প্রসঙ্গে। আরো অনেকের কথা না-হয় না-ই বললাম। অথচ বারট্রান্ড রাসেল কিন্তু নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন সাহিত্যে। রাসেল মনীষী; আধুনিক জগতের চিন্তা-চেতনার ধারাকে তিনি ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে বহুলাংশে তার অবয়ব দিয়েছেন। তাঁকে সম্মান প্রদর্শন করে নোবেল কমিটি তাই নিঃসন্দেহে একটি মহৎ কাজ করেছে। কিন্তু তিনি লিখেছেন প্রবন্ধ – দর্শন, রাজনীতি, সমাজ, মনস্তত্ত্ব, এমনকি অঙ্কশাস্ত্র নিয়ে। প্রচলিত অর্থে সাহিত্য বলতে যা বোঝায় তার চর্চা তিনি করেননি। তবু তাঁকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হলো সাহিত্যে, অথচ আন্তন চেখভ পুরস্কার না-পেয়ে বহু পূর্বেই পৃথিবী থেকে চলে গেছেন। কিন্তু তাঁর ছোটগল্পগুলো নোবেল কমিটির স্থায়ী একটি লজ্জার কারণ হয়ে বিশ্বসাহিত্যের অঙ্গনে অমর ভালোবাসায় বেঁচে আছে সাহিত্য-অনুরাগীদের মনে।

কিন্তু এবার, এই ২০১৩ সালে, শতাধিক বছরের এই কলঙ্ক যেন মোচন করলো নোবেল কমিটি। এবারের সাহিত্য পুরস্কার দিলো ছোটগল্প-লেখক অ্যালিস মুনরোকে। তিনি কবিতা লিখেছেন; আর লিখেছেন ছোটগল্প; কিন্তু উপন্যাস বলতে যা বোঝায়, তা তিনি লিখেননি। এই বিষয়টি নিয়ে অবশ্য মতবিরোধ আছে সাহিত্যবোদ্ধাদের মধ্যে। আন্তর্জাতিক পাঠক-সমালোচক মহলে তিনি ছোটগল্প লেখক হিসেবেই সাধারণভাবে পরিচিত। তবে কেউ কেউ, যেমন মার্গারেট এটউড, মনে করেন যে, মুনরো একটি উপন্যাসও লিখেছেন। ১৯৭১ সালে প্রকাশিত Lives of Girls and Women-কে এটউড অ্যালিস মুনরোর একমাত্র উপন্যাস বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। আমার জানামতে অন্যান্য সমালোচক মুনরোর আরো কয়েকটি গল্প-সংগ্রহের মতো ওই বইখানিকে পরস্পর সম্পর্কিত, কিন্তু কতিপয় চরিত্রের নাম ও পরিচিতি ছাড়া অন্যসব বিষয়ে স্বতন্ত্র, কয়েকটি গল্পের সংগ্রহ হিসেবেই বিবেচনা করেন। এ-কথা ঠিক যে, অ্যালিস মুনরোর পনেরো-ষোলোটি প্রকাশিত বইয়ের অনেকগুলোর গল্পই একটির সঙ্গে আরেকটি সম্পর্কিত মনে হতে পারে, এমনকি এক বইয়ের একটি গল্পের কাহিনির সঙ্গে অনেক আগে কিংবা পরে প্রকাশিত অন্য আরেকটি বইয়ের কোনো গল্পের পারস্পরিক সম্পর্ক শুধু চরিত্রের নামের মধ্যেই সীমাবদ্ধ না-থেকে, কাহিনির সূত্রও সম্পর্কিত হতে পারে। অথচ ওইসব গল্পের কাহিনি, প্লট, স্থান ইত্যাদি সবকিছুই আলাদা হতে পারে। এসব কারণে সমালোচকদের এই দ্বিধাবিভক্তি। মার্গারেট এটউড, নিবন্ধের শুরুর দিকেই যেমন উল্লেখ করেছি, এখন পর্যন্ত নোবেল পুরস্কার              না-পেলেও, এমনকি কখনো যদি তা না-পান তাহলেও, বর্তমান সময়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখক। তবু সাহিত্য-সমালোচনায়, আলোচ্য ক্ষেত্রে বইয়ের শ্রেণিবিন্যাসে, তিনি ত্রুটি-বিবর্জিত ও বাইবেলীয় আনুগত্যে অনুসরণীয় এমনটি ভাবার কোনো কারণ নেই। পুরো বিষয়টিই আসলে দৃষ্টিভঙ্গির; এবং সেখানে পার্থক্য হতেই পারে। সমস্যা এই যে, মার্গারেট এটউড তাঁর এই মতটি প্রকাশ করেছেন ২০০৬ সালে অ্যালিস মুনরোর ওই সময় পর্যন্ত প্রকাশিত গল্পগ্রন্থগুলো থেকে মুনরোর নিজের বাছাই-করা সতেরোটি গল্প নিয়ে CARRIED AWAY নামে প্রকাশিত গল্প-সংগ্রহটির ভূমিকায়। ওই বইয়ের কোথাও এ নিয়ে মুনরোর কোনোরকম উচ্চবাচ্যের অনুপস্থিতি ‘মৌনং সম্মতি লক্ষণম…’ হিসেবে ধরে নেওয়াই পাঠকের পক্ষে স্বাভাবিক।

আমরা যাহোক সুস্পষ্টভাবে কোনো দলে না-ভিড়ে, অথবা যদি ইচ্ছে হয় সংখ্যাগরিষ্ঠের সঙ্গেই থেকে, মুনরোর সাহিত্যকর্ম বিবেচনায় নামতে পারি। মুনরোর গল্পগুলো চেখভীয় বাস্তববাদী ধাঁচের; তবে সেগুলোর ধরন একেবারেই আলাদা। কারণ তাঁর গল্পের ভুবন চেখভের, এবং অন্যান্য আরো অনেকের লেখার, ভুবন থেকে একেবারেই আলাদা। অ্যালিস মুনরোর জন্ম ১৯৩১-এর ১০ জুলাই, কানাডার অন্টারিও প্রদেশের ছোট্ট শহর উইংহামে। মাত্র এগারো বছর বয়সেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনি লেখক হবেন। বাবা রবার্ট এরিক লেড্ল ছিলেন খেঁকশিয়াল খামারের মালিক। আমাদের পাঠকদের কাছে অদ্ভুত শোনালেও, ওইটিই আসলে ছিল তাঁর পেশা। এবং এলিসের মা এন চ্যামনি লেড্ল ওই পেশায় তাঁর বাবাকে সাহায্য করতেন।

স্কুল ফাইনাল পরীক্ষায় সর্বোচ্চ স্থান অধিকার করে বৃত্তি নিয়ে তিনি ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্টার্ন অন্টারিওতে ভর্তি হয়েছিলেন সাংবাদিকতা নিয়ে পড়াশোনা করবেন বলে, কিন্তু কিছুকাল পরে তা ছেড়ে দিয়ে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে অনার্স নিয়ে স্নাতক হলেন তিনি। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ই তাঁর লেখা গল্প প্রথমে কলেজ-সাময়িকী ও পরে বিভিন্ন বিখ্যাত সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়ে তাঁকে ওই ছাত্রজীবনেই খ্যাতিমান করে তোলে। বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকতে থাকতে ১৯৫১ সালের ২৯ ডিসেম্বর মাত্র ২০ বছর বয়সে তিনি জেমস আর্মস্ট্রং মুনরোকে বিয়ে করে ফেলেন, এবং স্বামীর সঙ্গে ভ্যানকুভারে চলে যান। সেখানে ১৯৫৩ সালের অক্টোবরে তাঁর তিন মেয়ের মধ্যে প্রথম মেয়ে শিলা মার্গারেট মুনরো জন্মগ্রহণ করে। কিছুকাল পরে আবার তিনি উইংহামে ফিরে আসেন, এবং বলতে গেলে এখনো সেখানেই আছেন। ১৯৬৮ সালে তাঁর প্রথম গল্পসংগ্রহ Dance of the happy shades প্রকাশিত হয়। এই প্রথম বইয়ের জন্যই তিনি কানাডার সর্বোচ্চ সাহিত্য পুরস্কার গভর্নর জেনারেল’স অ্যাওয়ার্ড পেয়ে যান। তাঁর মোট গল্পগ্রন্থের সংখ্যা সতেরো। তিনি তাঁর দেশের সর্বোচ্চ ওই সাহিত্য পুরস্কার পান মোট তিনবার। পৃথিবীব্যাপী নোবেল পুরস্কারের ঠিক নিচেই যার অবস্থান বলে বিবেচনা করে হয়, সেই আন্তর্জাতিক ম্যান বুকার প্রাইজ পান ২০০৯ সালে। তিনি নোবেল পুরস্কার কখনো পাবেন – এমন কেউ ভেবেছেন বলে মনে হয় না। তাঁর মেয়ে যখন তাঁকে এ-খবরটি জানিয়েছিল, তিনি নিজেও তখন তা বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। তার কারণ ছোটগল্প লেখকদের এ-পুরস্কার কখনো দেওয়া হয় না বলেই সবাই ধরে নিয়েছিলেন। তিনি যা হোক শেষ পর্যন্ত এ-পুরস্কার জিতে নিজের স্বীকৃতিই শুধু আদায় করলেন না, শতাব্দীকালের অধিক জমে থাকা একটি অলিখিত নিষেধাজ্ঞাও অতিক্রম করলেন।

আধুনিক পাশ্চাত্য সাহিত্যের, বিশেষত তাঁর গল্প-উপন্যাসের, সঙ্গে যাঁদের একটু ঘনিষ্ঠ পরিচয় আছে, তাঁরা কেউ যদি অ্যালিস মুনরোর কোনো গল্পের সঙ্গে প্রথমবার পরিচিত হতে যান তাহলে প্রথমেই হোঁচট খেতে পারেন। কারণ তাঁর লেখার ঘরানাই আলাদা। জেন অস্টেনের প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস বা, সেন্স অ্যান্ড সেন্সিবিলিটি উপন্যাসে ছোট শহরের পটভূমি কিংবা জর্জ ইলিয়টের সাইলাস মারনার, দি মিল অন দি ফ্লস ইত্যাদি উপন্যাসের শিল্পবিপ্লব-পূর্ব ইংল্যান্ডীয় গ্রামীণ চরিত্রের সঙ্গে, এমনকি কখনো কখনো তার পারিপার্শ্বিকতার সঙ্গেও, অনেক স্থানেই মিল পাওয়া যাবে মুনরোর গল্পের। গত শতকের ষাট, সত্তর কিংবা আশির দশকে যখন তিনি তাঁর বিখ্যাত সব গল্প লেখেন তখন দক্ষিণ-পশ্চিম অন্টারিও মূলত তার ছোট ছোট শহর, ছোট-বড় কয়েকটি হ্রদ, খরস্রোতা নদী, আর দিগন্ত-প্রসারিত গমের ক্ষেত নিয়ে যে-আবহ বজায় রেখেছিল তা-ই হচ্ছে অ্যালিস মুনরোর গল্পের পটভূমি। এই ছোট শহরের ক্ষুদে ব্যবসায়ী, তার খেটে-খাওয়া মানুষ, দেহোপজীবিনী, পল্লী অঞ্চল থেকে আসা গৃহবধূ, আর তাদের সব ভালো-লাগা মন্দ-লাগা, ঈর্ষা-বিদ্বেষ, আশা-আকাঙ্ক্ষা, এসবই পাওয়া যাবে অ্যালিস মুনরোর গল্পের ভুবনে।

অ্যালিস মুনরোর বিরূপ সমালোচকেরও অভাব নেই। অনেকে তাঁর গল্পগুলোকে এক ফুঁৎকারে সাহিত্যের আসর থেকে একেবারে উড়িয়ে দিতেও চান। তবে ও-রূপ সমালোচনা নিতান্তই একপেশে। তাঁর সম্পর্কে মার্গারেট এটউডের মূল্যায়ন আমার কাছে বেশ ভারসাম্যময় মনে হয়েছে। এই আলোচনার একেবারে প্রথমদিকে আমি নিজেই অ্যালিস মুনরোর চেয়ে এটউডের প্রতি কোনোরূপ রাখঢাক ছাড়া আমার পক্ষপাতিত্ব প্রকাশ করেছি। কানাডায় এবার প্রথমবারের মতো সাহিত্যের নোবেল পুরস্কার যদি গেলই, তাহলে তা অ্যালিস মুনরো পাওয়ায় এটউডের একটুও কি খারাপ লাগেনি? কে বলতে পারে সে-কথা? তবে পুরস্কার ঘোষণার পরপরই টুইটারে তিনি অ্যালিস মুনরোকে ‘হুর-রে’ জানিয়েছেন। আর অ্যালিস মুনরোর বাছাই-করা গল্প-সংগ্রহের ভূমিকায় মুনরোর যে-মূল্যায়ন করেছেন তা যথার্থ বলে আমার মনে হয়েছে।

মুনরোর Lives of girls and women উপন্যাস নাকি গল্পসংগ্রহ মার্গারেট এটউডের সঙ্গে এই বিতর্কে না-জড়িয়েও আমরা অ্যালিস মুনরো সম্পর্কে নিচে বাংলা অনুবাদে উদ্ধৃত তাঁর সার্বিক মূল্যায়নটি সানন্দে গ্রহণ করতে পারি :

অ্যালিস মুনরো আমাদের সময়ের ইংরেজি গল্প-উপন্যাস লেখকদের মধ্যে অন্যতম প্রধান লেখক হিসেবে বিবেচিত …মুনরোর সাহিত্যে সৌন্দর্যের অপার বিস্তার, কিন্তু তা আশ্চর্যজনক এক ধরনের খোলসে আচ্ছাদিত : আগে-ভাগে কোনো কিছুই বলা সম্ভব নয়। আবেগ উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে। পূর্বধারণা হুড়মুড় করে ধসে পড়ে। তাক-লাগানো বিষয়-আশয় ডালপালা ছড়িয়ে হঠাৎ এসে উপস্থিত হয়। অবাক করা সব কান্ড ঝুপ করে লাফ দিয়ে এসে সামনে দাঁড়ায়। অসদুদ্দেশ্যে করা কোনো কাজ সুফলবাহী হয়ে উঠতে পারে। প্রত্যাশা যখন বলতে গেলে একেবারেই থাকে না, তখনি এসে উপস্থিত হয় পরিত্রাণ, এবং তা-ও উদ্ভট কোনো ধরনে। (Carried Away নামক গল্পসংগ্রহে মার্গারেট এটউডের লেখা ভূমিকা থেকে উদ্ধৃত – লেখক)।

হ্যাঁ, এই ছোট্ট একটি অনুচ্ছেদে অ্যালিস মুনরোর সাহিত্য-কীর্তির এক অসাধারণ মূল্যায়ন হিসেবে বিবেচিত হতে পারে এটউডের এই কথা কটি। তবে এগুলো হচ্ছে এলিসের সাহিত্যকর্মের সারকথা। আমরা যদি তাঁর বিখ্যাত দু-একটি গল্পের একটু বিচার-বিশ্লেষণে যাই তাহলে সহজেই বুঝতে পারবো যে, এই কথাগুলো কত সত্য। আবার, অন্যদিক থেকে দেখতে গেলে, আমরা দেখবো যে মুনরোর গল্পে কোথাও কোথাও যেমন রয়েছে খ্রিষ্টীয়টা, তেমনি আবার কোনো কোনো গল্পে রয়েছে যৌনতা। তবে এ দুটির কোনোটিরই কলরব উপস্থিতি নেই তাঁর কোনো গল্পে। খ্রিষ্টীয়তা তাঁর গল্পে এসেছে সাংস্কৃতিক পটভূমি হিসেবে। শতকরা হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে ইয়োরোপীয় খ্রিষ্টানের সংখ্যা, এবং তার মধ্যে আবার ক্যাথলিকদের শতকরা অংশ, কানাডায় অনেক বেশি। রাষ্ট্রব্যবস্থা থেকে ধর্মকে কখনো আলাদা করা হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রে এ-বিষয়টি ঠিক তার উলটো। রাষ্ট্রীয় অর্থে পরিচালিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বাইবেল শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রার্থনা কানাডায় প্রচলিত, যুক্তরাষ্ট্রে নয়। এসব কারণে খ্রিষ্টীয়তা কানাডার, বিশেষ করে ছোট্ট শহর ও গ্রামীণ কানাডার, সংস্কৃতির অংশ হয়ে গেছে। ‘The Beggar maid’ গল্পের অন্যতম চরিত্র ফ্লো তার সদর দরজার বাইরে লিখে রেখেছে ‘The Lord is my Shepherd/ Believe in the Lord Jesus Christ and Thou Shalt be Saved.’ অর্থাৎ ভগবান আমার রাখাল/ ভগবান যিশুখ্রিষ্টে বিশ্বাস করো, তাহলেই তুমি মুক্তি পাবে। অথচ ফ্লো কিন্তু তেমন ধার্মিক কোনো মেয়ে নয়।

যৌনতার ব্যাপারটি সময়ের বাস্তবধর্মিতা সামনে রেখেই গল্পে টেনেছেন অ্যালিস মুনরো। চরিত্রদের বয়স ও সামাজিক অবস্থান ভেদে যৌনতার আলাপ ও তার উপস্থাপন ঘটিয়েছেন মুনরো তাঁর বিভিন্ন গল্পে। অবিন্যস্ত বিছানার চাদর কিংবা দুমড়ানো-মোচড়ানো বালিশের কথা বলে অ্যালিস মুনরো যৌনতার যে-ছবি অাঁকতে পারেন অনেক তথাকথিত অশ্লীল বাক্যও তেমন জীবন্ত ছবি অাঁকতে সমর্থ হয় না। ‘The Turkey Season’ গল্পের লিলি তার প্রতিবেশিনী মারজোরিকে বলছে : আমার স্বামী মদ পান করে ফিরলে তাকে আমি কাছেই ঘেঁষতে দিই না; তবে সে যদি মদ পান না-করে, তাহলে আবার আমার কাছেই আসে না।’

এমনি অনেক উদাহরণ দিয়ে অ্যালিস মুনরোর গল্পের অসাধারণ সব বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা যায়। তবে তাঁর বইগুলো লক্ষ করে পড়লে বোঝা যাবে যে, তিনি মূলত তাঁর নিজের কথা, নিজের সময়ের কথা, নিজের অঞ্চলের কথাই চিত্রিত করেছেন তাঁর লেখার মাধ্যমে। এবং এক-একটি গল্পের স্বল্প পরিসরে অনেক সময়ই তিনি এক-একটি উপন্যাসের কাহিনি উপস্থাপন করেছেন অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে। তুলনামূলকভাবে স্বল্প-পরিচিত (অন্তত আমাদের অঞ্চলে) এ-লেখককে পুরস্কৃত করে নোবেল কমিটি একদিকে যেমন একজন গুণী শিল্পীকে সম্মানিত করলো, অন্যদিকে আবার ছোটগল্পকেও আবার বিশ্বসাহিত্য-সভায় সম্মানের আসনে বসিয়ে নিজেদের একশ তেরো বছরের অন্যায়ের প্রতিকার ঘটালো নিজেরাই। সেজন্য তাদের ধন্যবাদ জানাই।