আদমসওদা

স্বকৃত নোমান

জোয়ারে ন আইলি রে পুত ভাডায় ন আইলি
কন হাঙরে কন কুমীরে মোর পুতরে খাইলি ॥

চারশো বছর আগে সিতারা বানুর দেখা স্বপ্নের প্রায় কাছাকাছি একটা স্বপ্ন দেখেছিল কুমারী নূরনিসা, তার এক শিশুপুত্র তার কোল থেকে ধনেশ পাখি হয়ে আকাশে উড়ে গেছে। ছেলেটা ডানা মেলে উড়ছে, নূরনিসা বুক চাপড়ে ‘হায় হায়’ করতে করতে তার পিছে পিছে ছুটছে, গ্রামের পর গ্রাম, মাঠের পর মাঠ পেরিয়ে যাচ্ছে, ধনেশরূপী ছেলেটা চেষ্টা করছে মায়ের কোলে ফিরে আসতে, অথচ কোনোভাবেই পারছে না, নিয়তি তাকে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে মাইলের পর মাইল।
এই দুঃস্বপ্ন নূরনিসাকে প্রায় সারাজীবন তাড়িয়ে বেড়ায়। সংসারজীবনে সে আট সন্তানের মা হয়েছে। প্রথমে দুই মেয়ে, তারপর দুই ছেলে, কয়েক বছর বিরতি দিয়ে পরপর তিনটি মেয়ে। সর্বশেষ চল্লিশ বছর বয়সে জন্ম দেয় আরো একটি ছেলের, পরবর্তীকালে যে এই বৃত্তান্তের অন্যতম চরিত্র হয়ে ওঠে। নূরনিসা যখন শিশুপুত্রদের কোলে নিত, কোমরের তাগার সঙ্গে তার আঁচলের কোণটা গিঁট দিয়ে রাখত। দোলনায় শোয়ানোর সময়ও দড়ি দিয়ে একটা পা বেঁধে রাখত, কোনোভাবেই যাতে উড়ে যেতে না পারে। এসব করত সে অত্যন্ত গোপনে, কেউ কোনোদিন টের পায়নি, পেলেও কিছু আন্দাজ করতে পারেনি। পারবে কী করে, তার সেই গোপন স্বপ্নের কথা তো কেউ জানত না, কাউকে তো কোনোদিন সে জানায়নি। একবার শুধু স্বামী আবদুল অদুদকে জানিয়েছিল, প্রথম পুত্রের জন্মের পর। অদুদ গুরুত্ব দেয়নি। স্বপ্নে তেমন বিশ্বাস নেই তার। ঘুমের ঘোরে মানুষ কত স্বপ্নই তো দেখে, কটাই-বা ফলে। বহু বছর আগে সেও একটা স্বপ্ন দেখেছিল, মানুষের কাছে সে লাখ লাখ টাকা ঋণী। অথচ সারাজীবনে তাকে খুব একটা ধারদেনা করতে হয়নি। বিশেষ কোনো দরকার পড়েনি। ক্ষেতগেরস্তির গুণে অভাব কোনোদিন নাগাল পায়নি তার।
তারপর নূরনিসা আর কোনোদিন স্বপ্নটির কথা কাউকে বলেনি। সর্বশেষ পুত্রের জন্মের পর স্বপ্নটা মৃত্যুচিন্তার মতো এমন ভয়াবহ আতঙ্কে রূপ নিল, বাধ্য হয়ে সে এমন এক গুনিনের কাছে গেল, কবরগুনিন নামে যার পরিচিতি, যে পুকুরের জলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ডুব মেরে বসে থাকতে পারে এবং পুঁটি, কই ও বোয়াল মাছের পেট থেকে জীবনঘাতী তাবিজ বের করে আনতে পারে, যে-তাবিজের ভেতরে থাকে মানুষের নখ, কাফনের টুকরো, মাথার চুল আর শ্মশানের কয়লা। কুলসিবাসা গ্রাম থেকে চার মাইল দূরে প্রাচীন এক কবরের কাছে গুনিনের আস্তানা, যে-কবরটি এক মজ্জুবের, লোকের মুখে যে এখন ইলিয়াসপীর নামে খ্যাত, জীবৎকালে যে নেংটি পরে থাকত, তীব্র শীতের রাতেও তার গায়ে সুতাটি পর্যন্ত থাকত না এবং প্রচ- গরমের দিনেও কেউ কোনোদিন যাকে গোসল করতে দেখেনি। তার কবরের কাছে মস্ত এক বটগাছ ছিল। দিনের বেলায় তাকে দেখা যেত গাছটির তলায়। রাতে ঘুমাত পুবের জঙ্গলে, যেখানে এখন পদ্মার ধু-ধু চর। রোজ ভোরে একটা বাঘের পিঠে চড়ে বটতলায় আসত এবং সন্ধ্যায় বাঘটির পিঠে চড়েই আবার জঙ্গলে ফিরে যেত। কিংবদন্তি, তার মৃত্যুর পর বাঘটি প্রায় কুড়ি বছর তার কবর পাহারা দিয়েছিল।
আদি ও আসল সোলেমানি খোয়াবনামার পাতা ওলটাতে ওলটাতে গুনিন বলেছিল, এই স্বপ্ন মিথ্যা হতে পারে না। শয়তান নয়, ফেরেশতারা দেখিয়েছে এই স্বপ্ন। দুষ্ট গ্রহের আসর আছে তার ছেলেদের ওপর। আসর কাটাতে বড় জেয়াফত দিয়ে পাঁচ গ্রামের মানুষ খাওয়াতে হবে। গুনিনের কথামতো সে পৈতৃকসূত্রে পাওয়া একখ- জমি বেচে গরু-খাসি জবাই দিয়ে ছেলেদের আকিকার নামে বিরাট এক জেয়াফতের আয়োজন করেছিল, পাঁচ গ্রামের প্রায় সাড়ে আট হাজার মানুষকে দাওয়াত করে খাইয়েছিল। সেই জেয়াফতের কথা মানুষের মুখে মুখে ছিল বহুদিন। জেয়াফতের গুণেই কিনা কে জানে, ছেলেরা বড় হওয়ার পর সেই দুঃস্বপ্নের কথা প্রায় ভুলেই গিয়েছিল। প্রায় দশ বছর খুব এটা মনে পড়েনি। ততদিনে তার বড় ছেলে স্কলারশিপ নিয়ে অস্ট্রেলিয়ায়, মেয়েদেরও বিয়ে হয়ে গেছে, মেজো ছেলে ঢাকায় একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করছে এবং ছোট ছেলে বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স তৃতীয় বর্ষে পড়ছে। সেদিন সেন্টমার্টিন দ্বীপ ভ্রমণে গিয়ে তার ছোট ছেলে, যাকে সে আদর করে শিবু বলে ডাকত, সমুদ্রস্নানের সময় উত্তাল জোয়ারে ভেসে গেলে সেই দুঃস্বপ্নের স্মৃতি আবার তার মাথায় চাড়া দিয়ে উঠল।
সমুদ্রস্নানের সময় শিবুসহ ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের চার ছাত্র এবং অজ্ঞাতপরিচয় দুই যুবক ভেসে যাওয়ার সংবাদটি সারাদেশে আলোড়ন তুলেছিল। সবকটি জাতীয় দৈনিক সংবাদটি একযোগে শীর্ষ শিরোনাম করে এবং বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলোও গুরুত্বসহকারে সম্প্রচার করে। সবচেয়ে বেশি আলোড়ন তুলেছিল ভ্রমণযাত্রার আগের রাতে ফেসবুকে দেওয়া শিবুর একটি স্ট্যাটাস। বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনারের সামনে বুকে হাতমুড়ে দাঁড়ানো থ্রি-কোয়ার্টার একটি ছবিসহ সে পোস্ট দিয়েছিল : ‘চলে যাচ্ছি, একদম নেটওয়ার্কের বাইরে।’ লাইক পড়েছিল বিরাশিটি এবং কমেন্টস সাতাশটি। সেন্টমার্টিন ট্র্যাজেডির সংবাদটি গণমাধ্যমে প্রচার হলে পরে তার ভার্চুয়াল বন্ধুরা তার ওয়ালে গিয়ে পোস্টটির স্ক্রিনশট নিয়ে প্রত্যেকে আলাদা-আলাদা পোস্ট দিয়েছিল। অনেকেই বিস্ময়ে মন্তব্য করেছিল, মানুষ তো তার ভবিষ্যৎ জানে না, এই ক্ষমতা মানুষের নেই। শিবু কীভাবে জানল! কীভাবে সে বুঝতে পারল আসলেই সে নেটওয়ার্কের বাইরে চলে যাচ্ছে! ফেসবুক ইউজার এক আধুনিক মাওলানা, যে দ্বিতীয় শ্রেণির একটি খবরের কাগজে ধর্মবিষয়ক কলাম লেখে, শিবুর স্ক্রিনশটটি শেয়ার নিয়ে মন্তব্য করেছিল, মৃত্যু আগাম টের পায় মানুষ। মৃত্যুর কয়েক দিন আগে আজরাইল ফেরেশতা তাকে মৃত্যুর কথা ইশারায় জানান দিয়ে যায়। প্রমাণ হিসেবে সে বাদশা সোলায়মানের আমলের এক যুবকের কাহিনি উল্লেখ করে, আজরাইলের হাত থেকে বাঁচতে যে বাদশার শরণ নিয়েছিল। বাদশার আজ্ঞাবাহী বাতাসে চড়ে সে জেরুজালেম থেকে সুদূর হিন্দুস্থান পালিয়ে গিয়েছিল। তবু শেষ রক্ষা হলো না, হিন্দুস্থানেই তার জান কবজ করে আজরাইল।
বন্ধুদের সঙ্গে তিনদিনের ভ্রমণে গিয়েছিল শিবু। ফেব্রুয়ারির সতেরো তারিখ মঙ্গলবার রাতে রাজধানী ঢাকা থেকে একটি চেয়ারকোচে রওনা হয়ে বুধবার ভোরে পর্যটননগরী কক্সবাজার পৌঁছে। ফেরার কথা ছিল বিষ্যুদবার রাতে। ফিরল না। বুধবার বিকেল থেকে তার মোবাইলে সংযোগ পাওয়া যাচ্ছিল না। সকালেও তার সঙ্গে কথা বলেছে নূরনিসা, অথচ বিকেল থেকে যতবারই ডায়াল করল ততবারই বন্ধ পেল। আশ্চর্য! শিবু তো কখনো মোবাইল বন্ধ রাখে না। গভীর রাতে কল এলেও রিসিভ করে। সন্ধ্যায় নূরনিসা আবার ডায়াল করে। বন্ধ। আবার করে। বন্ধ। সারারাত ডায়ালের পর ডায়াল করে গেল, সংযোগ কিছুতেই পেল না। যতবারই ডায়াল করে ততবারই তার অস্থিরতা বাড়ে, অজানা আতঙ্কে বুকটা ধড়ফড় করে, বানভাসা কচুরিপানার মতো নানা দুশ্চিন্তা মাথায় ভিড় করে। কী হলো শিবুর। মোবাইল হারিয়ে গেল, ছিনতাই হয়ে গেল, না চার্জ ফুরিয়ে গেল। নাকি কোনো দুর্ঘটনার শিকার হলো। সড়ক দুর্ঘটনা তো ইদানীং প্রায় লেগেই আছে, রাস্তাঘাটে প্রতিদিনই মানুষ মরছে পিঁপড়ার মতো। দুশ্চিন্তা তার পিছু ছাড়ে না। রাতে হাই পাওয়ারের ঘুমের ওষুধ খেয়েও চোখে এক মুহূর্তের জন্য ঘুম নামাতে পারে না। আবদুল অদুদ তাকে সান্ত¡না দেয়, দেশের শেষ মাথা সেন্টমার্টিন। রিমোর্ট এরিয়া। হয়তো এখনো মোবাইল কোম্পানিগুলোর টাওয়ার বসেনি। শিবু হয়তো বন্ধুদের সঙ্গে আনন্দ-ফুর্তি করছে। নিশ্চয়ই কাল রাতে ফিরে আসবে। এত অস্থির হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু মায়ের মন কি আর এতো সহজে স্থির হয়?
পরদিন দুপুরে রান্নার জন্য এক ফালি কুমড়া কাটতে গিয়ে ধারালো বঁটির পোঁচ লেগে নূরনিসার বাঁ হাতের একটা আঙুল কেটে গেল। কে জানে কেন, সঙ্গে সঙ্গেই মনে পড়ে গেল তামাদি সেই দুঃস্বপ্নের স্মৃতি। এমনই দুর্বার গতিতে স্মৃতিটা হানা দিলো, শরীরের রক্তপ্রবাহ দ্বিগুণ বেড়ে গেল। দারুণ ধড়ফড় করতে লাগল বুকটা। এক মুহূর্তও দেরি না করে বোরকাটা গায়ে চড়িয়ে ছুটতে ছুটতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে একটা অটোরিকশায় চড়ে সোজা চলে গেল কবরগুনিনের আস্তানায়। তার মন বলছিল, নিশ্চয়ই শিবুর কোনো বিপদ হয়েছে। বিপদের কারণ হিসেবে যথারীতি সে দায়ী করল অজানা শত্রুর করা তাবিজকে। তাবিজ-কবজে তার অতিমাত্রায় বিশ্বাস। তার মতে, যেখানে আল্লাহ সেখানেই শয়তান। আলোর বিপরীতে অন্ধকার যেমন। আল্লাহর কালাম থাকলে কুফুরি কালামও থাকবে। ঘরের বহু ধান-চাল আর নগদ অর্থ সে ফকির-গুনিনের পেছনে ঢেলেছে। সংসারে অশুভ কিছু ঘটতে দেখলেই তার পেছনে কুফুরি কালামে লেখা তাবিজ-কবজের কারসাজি খুঁজে পায়, যে তাবিজের স্রষ্টা মগ জাতির গুনিন-তান্ত্রিকরা। তাবিজ-কবজে বিশ্বাস তার এমন মাত্রায় পৌঁছে গেছে, বন্যায় ফসলের ক্ষতি হলে বা শিলাবৃষ্টিতে আমের মুকুল ঝরে গেলে, এমনকি বাড়ির কারো অসুখ-বিসুখ হলে সে তাবিজ-কবজকে দায়ী করে। নিশ্চয়ই শত্রুপক্ষ তাবিজ করেছে। নইলে এমন আপৎ পিছু লাগল কেন?
একবার প্রচ- জ্বর উঠল আবদুল অদুদের। হাই অ্যান্টিবায়োটিক খেতে দিয়ে ডাক্তার বলল, কটা দিন বিশ্রামে থাকুন, সেরে যাবে। টানা তিনদিন সে বালিশ থেকে মাথা তুলতে পারল না। তারপর জ্বর নামল বটে, কিন্তু শুরু হলো প্রচ- কোমরব্যথা। এমনই ব্যথা, না পারে বসতে, না পারে শুতে। নূরনিসা কি আর চুপ করে বসে থাকতে পারে? কোথা থেকে ডেকে আনল ঝাঁকড়া চুলের এক গুনিন, দেখতে যে জ্যান্ত নরকঙ্কালের মতো। বাড়ির পেছনে মজাপুকুরে ডুব দিয়ে সে টাকি মাছের পেট থেকে বের করে আনল চকচকে তামার খোলের একটা তাবিজ। নূরনিসা তো বটেই, আবদুল অদুদও অবাক। কে করতে পারে এই তাবিজ? জমি নিয়ে যার সঙ্গে মামলা চলছে সে ছাড়া আর কে!
আরো একবার সোনার একটা আংটি হারিয়ে গিয়েছিল তার। যথারীতি ডাক পড়ল জ্যান্ত কঙ্কাল সেই গুনিনের। তার বিশ্বাস ছিল গুনিন ঠিকই জাদুবলে আংটিটা বের করে আনতে পারবে। তুলারাশির জাতকের মাধ্যমে বাটিচালা দিয়ে, সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত বহু চেষ্টা-তদবির করেও আংটিটা উদ্ধারে ব্যর্থ হলো গুনিন। ব্যর্থ হয়েছে তাতে কি, তাবিজ-কবজে নূরনিসার বিশ্বাস তিলমাত্র তো কমলই না, বরং আরো বেড়ে গেল দ্বিগুণ। কেননা গুনিন বলেছে, আংটিটা চুরি করার সময় চোর এমন এক তাবিজ পরেছিল যে-তাবিজ তন্ত্ররাজ্য কামরূপ কামাখ্যা থেকে আনা। এই আংটি উদ্ধারের ক্ষমতা তার নেই, আছে একমাত্র কবরগুনিনের। বহুব্যবহারে জীর্ণ কয়েকশ টাকার আংটির জন্য কবরগুনিনের পেছনে হাজার টাকা ঢালার চিন্তা সে বাদ দিলো।
পড়ন্ত দুপুরে কবরগুনিনের আস্তানায় পৌঁছল নূরনিসা। ততদিনে ইলিয়াসপীরের কবরখানার চেহারা পালটে গেছে। কবরের ওপর পেঁয়াজের মতো গম্বুজঅলা দালান উঠেছে। কবরের একদিকে উঠেছে পাকা মসজিদ, আরেকদিকে গুনিনের চৌচালা টিনের ঘর। গুনিন তখন ভাত খেয়ে পান চিবুতে চিবুতে কোলবালিশে হেলান দিয়ে রেডিওতে দুপুরের সংবাদ শুনছিল। খবর পেয়ে বৈঠকখানায় এসে ছারপোকায় ভরা তার গদিঅলা চেয়ারটিতে বসল। নূরনিসাকে সে চিনতে পারল না। চিনতে পারার কথাও তো নয়। রোজ কত মানুষ কত কিসিমের সমস্যা নিয়ে তার কাছে আসে, কজনের কথা মনে রাখবে। দশ বছর আগে একটি স্বপ্নের ব্যাখ্যা জানতে তার কাছে এসেছিল নূরনিসা তাকে স্মরণ করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করল, তবু ঠিক স্মরণে এলো না তার। নূরনিসা তার বর্তমান বিপদের কথা জানালে গুনিন কতক্ষণ চোখ বুজে চুপ করে থাকল। তারপর আরেক খিলি পান মুখে দিলো। চিবুতে চিবুতে রসের ধারা কষে এসে ঠেকলে হঠাৎ চেয়ার থেকে এক লাফে দাঁড়িয়ে উচ্চৈঃস্বরে হাসতে শুরু করল। উত্তেজনায় নূরনিসাও দাঁড়িয়ে গেল। কেন হাসছে গুনিন? নিশ্চয়ই কোনো সুসংবাদ! যাক, শিবুর কোনো বিপদ হয়নি তবে। নাকি কোনো দুঃসংবাদ?
হাসি থামাল গুনিন। ঝড়শেষের নীরবতা নামল কক্ষজুড়ে। চেয়ারে বসে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল মালেকুল মউত! তারপর বেদনার্ত কণ্ঠে বলল, দুষ্ট গ্রহের আছর, সব দুষ্ট গ্রহের আছর। বলে সে মাথাটা ডানে-বাঁয়ে দোলায় আর মুখে চুকচুক শব্দ করে। আতঙ্কিত নূরনিসার চোখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, সমুদ্র দেখেছেন কখনো?
কোত্থেকে দেখব! কখনো তো যাইনি। কাঁপা গলায় জবাব দিলো নূরনিসা।
গ্রহের আছরে সমুদ্রে জোয়ারভাটা হয়। বিরাট-বিরাট ঢেউ ওঠে। ঢেউয়ের চূড়ায় বসে খোয়াজ খিজির তখন সমুদ্র শাসন করেন। বলে চুপ করল গুনিন। তারপর মাথাটা আবারো ডানে-বাঁয়ে নাড়াতে-নাড়াতে বলল, আপনার ছেলে আর কোনোদিন ফিরব না। দয়াল খিজির ঢেউয়ের চূড়ায় চড়িয়ে তাকে নিয়া গেছে।
নিয়া গেছে! কোথায় নিয়া গেছে?
মউতের দেশে।
মউতের দেশে! কী বলছেন এসব?
কবরগুনিন মিথ্যা বলে না। ছেলের আশা করে আর লাভ নাই। বাড়ি গিয়া বরং কুলখানির ব্যবস্থা করেন।
গুনিনের মুখ এবং মুখের ভেতর লাল দাঁতগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে নূরনিসার কেমন যেন লাগে, বুকের মাঝখানে কী একটা যেন চরকির মতো ঘোরে। যেন একটা পাখি চক্কর দিচ্ছে বুকের খাঁচায়। চক্কর দিতে-দিতে মাথার দিকে উঠতে থাকে। উঠতে থাকে… উঠতে থাকে…। এই বুঝি নাকের ফুটো দিয়ে বেরিয়ে আকাশে উড়াল দেবে। কাঁপা হাতটা সে নাকের দিকে টানতে থাকে। নাকটা চেপে ধরার আগেই সহসা পাখিটা উড়াল দিলো। গোঙানির একটা চাপা স্বর বেরিয়ে এলো তার মুখ দিয়ে। এক লাফে সে দাঁড়িয়ে গেল এবং দ্রুত গুনিনের কামরা থেকে বেরিয়ে মাজারপ্রাঙ্গণ মাড়িয়ে বটতলা দিয়ে প্রথমে পশ্চিমে গিয়ে কোনো পথ খুঁজে না পেয়ে মোড় নিয়ে আবার দক্ষিণে ঘুরে সর্ষেক্ষেতে নামল। বিমর্ষ চোখে আকাশের দিকে তাকাল। একটা কাক মুখে এক টুকরো সাবান কি একখানা হাড় নিয়ে তার মাথার ওপর উড়ছে। কাকটিকে ধনেশ পাখি বলে মনে হয় তার। ‘বাবা বাবা’ বলে পাখিটার দিকে হাত দুটো বাড়িয়ে সে ছুটতে লাগল। মাজারপ্রাঙ্গণে যেসব ছেলেপিলে খেলছিল তার দশা দেখে তারা ইলিয়াসপীর অথবা কবরগুনিনের অলৌকিক কোনো কেরামতি টের পায়। পেয়ে তারাও তার পেছনে ছুট লাগায়। তাদের হট্টরোল শুনে বুড়োরাও ছোটায় যোগ দেয়। মানুষের বিশাল স্রোত ছুটতে লাগল তার পিছু পিছু। কেউ তাকে থামায় না, থামানোর চেষ্টাও করে না, একটিবার জিজ্ঞেস করে না কেন সে এভাবে পাগলের মতো ছুটছে। ছুটতে থাকা মানুষদের মনে কিছুটা কৌতূহল, বাকিটা ভয়।
শেষ বিকেলে, ক্লান্ত সূর্য যখন গাছগাছালির আড়াল হলো, ছুটতে থাকা উৎসুক মানুষেরাও যখন ক্লান্ত হলো, কুলসিবাসা গ্রামের অদূরে বিশাল এক বাগানের মাঝখানে মস্ত আরেক বটগাছের তলায় নূরনিসাকে তারা মুখ থুবড়ে পড়ে যেতে দেখল। ভয়ে কেউ তার কাছে ঘেঁষার সাহস করল না। নিশ্চয়ই জিনের কা-। বটগাছে দুষ্ট জিনেরা থাকে। আস্তানার বটগাছ থেকে জিনটা উড়াল দিয়ে এই বটগাছে চড়েছে। নইলে ঠিক ঠিক বটগাছের তলায় এভাবে পড়ে যাবে কেন মহিলাটা!
বেহুঁশ নূরনিসার বুকে সওয়ার হয়ে পৃথিবীতে সন্ধ্যা নামে। ভয় এবং রহস্যের একটি কালো পর্দা আসমান থেকে নেমে গাছটিকে বেষ্টন করতে থাকে। যত যাহোক, রাতের বেলায় একটা মেয়েলোক বটগাছের নিচে পড়ে থাকবে, গ্রামের মানুষ কি আর এতোটা নির্দয়? তারা তাকে উদ্ধারের কথা ভাবে, কিন্তু ভয় তাদের বাধা দেয়, সাবধান! গায়ে হাত দেবে না। দিলে দুষ্ট জিন তোমাকেও আছর করতে পারে। কী করা যায় তবে? কর্তব্য যখন ঠিক করতে পারছিল না কেউ, কালো পর্দাটা যখন আরো কালো হয়ে উঠছিল, জিন-ভূতে অবিশ্বাসী কলেজপড়–য়া দুই যুবক, যারা বামপন্থি একটি ছাত্রসংগঠনের কর্মী, সাহস করে বটতলার দিকে এগিয়ে গেল এবং অজ্ঞান নূরনিসাকে একটা রিকশায় তুলে কুমারখালী সদর হাসপাতালে নিয়ে গেল।
রাতে ফেসবুকের মাধ্যমে শিবুর দুঃসংবাদটি জেনে তার মেজোভাই এক মুহূর্তও দেরি না করে কমলাপুর রেলস্টেশনের উদ্দেশে রওনা হলো। তূর্ণানিশীথা এক্সপ্রেসে চড়ে ভোরে চট্টগ্রাম এবং বিকেল নাগাদ সেন্টমার্টিন পৌঁছে গেল। দ্বীপের বাতাসে তখন নানা গুজব পাক খাচ্ছে। কেউ বলছে, সমুদ্রস্নানের সময় ভাটার স্রোতে ভেসে গেছে ছয় যুবক। কেউ বলছে, সমুদ্রের একদল মেছোভূত টেনে নিয়ে গেছে। কেউ বলছে, কদিন ধরে কয়েকটা মস্ত তিমি এদিকটায় ঘোরাফেরা করছে, ছয় যুবক তাদের পেটেই গেছে নিশ্চিত। কেউ কেউ এমন কথাও বলে বেড়াচ্ছে, সৈকত থেকে একসঙ্গে ছয় যুবক একঝাঁক শঙ্খচিলের সঙ্গে উড়াল দিয়ে দক্ষিণ সমুদ্রের দিকে চলে গেছে।
কোস্টগার্ড ও স্থানীয় জেলেদের প্রচেষ্টায় সেদিন সন্ধ্যায় দুজনের এবং পরদিন আরো একজনের লাশ উদ্ধার করা গেলে ধীরে-ধীরে খসে যেতে লাগল গুজবের ডানাগুলো। চতুর্থ দিনও খোঁজাখুঁজি চলল। শিবুসহ বাকি তিনজনের লাশের কোনো হদিস মিলল না। শিবু আর কোনোদিন ফিরবে না জেনেও তার মেজোভাই সৈকতে দাঁড়িয়ে প্রতীক্ষা করেছে। জোয়ারের সঙ্গে পচাগলা হলেও যদি লাশটা ভেসে আসে। সৈকতে ঢেউয়ের পর ঢেউ ভাঙল, অথচ শিবুর লাশের কোনো খোঁজই মিলল না। ফেসবুকে আগাম বার্তা দিয়ে সে চলে গেছে একদম নেটওয়ার্কের বাইরে।

দুই

সেই না সাইগরের মাঝে হার্ম্মাদ্যার দল
বাঁকে বাঁকে ঘুরে সদাই বড় বেয়াকল ॥

ফেব্রুয়ারির শুরুর দিকে, শীত আর কুয়াশার দাপট যখন ধীরে ধীরে কমে আসছিল, যেসব জেলে মাছ শিকারে সেন্টমার্টিনের দক্ষিণে গভীর সমুদ্রে গিয়েছিল তারা দেখেছিল পাশাপাশি নোঙর করা ট্রলারের একটি বহর। কোস্টার জাহাজও ছিল তিনটি। জেলেদের মনে খটকা লাগে। এখানে সমুদ্র গভীর, কোনো ট্রলার বা জাহাজ নোঙর করার কথা নয়। সাধারণত করে না, করতে কখনো দেখা যায় না। ট্রলারগুলো হয়তো জেলেদের, কিন্তু কোস্টার জাহাজগুলো এলো কোত্থেকে? এই ধরনের জাহাজ সাধারণত ঢাকা-চট্টগ্রাম নৌরুটে মালামাল পরিবহনে ব্যবহৃত হয়, গভীর সমুদ্রে খুব কমই দেখা যায়। কোথা থেকে এলো জাহাজগুলো, কোথায় যাবে, এখানে নোঙর ফেলল কেন, তেল ফুরিয়ে গেল, নাকি পথ হারিয়ে ফেলল একটিতেও কোনো মানুষ ছিল না যে জিজ্ঞেস করে নেবে। যেন ভুতুড়ে জাহাজ, সাগরের তলদেশ থেকে মৃত তিমির মতো ভেসে উঠেছে। হয়তো মানুষ ছিল, জেলেরা ভয়ে কাছে যায়নি বলে দেখতে পায়নি। ভয়, কারণ, অপহরণের ঘটনা শুধু নাফ নদীতেই ঘটে না, এদিকেও ঘটে। কখনো জলদস্যু, কখনো বিজিপি হানা দিয়ে জেলেদের ধরে নিয়ে যায়। দস্যুরা দাবি করে মুক্তিপণ, বিজিপি চালান করে দেয় কারাগারে। জায়গাটা মিয়ানমার সীমান্তের কাছে, যে-কোনো সময় বিজিপি হানা দিতে পারে। তা ছাড়া ট্রলারগুলো তো দস্যুদেরও হতে পারে। কৌতূহল মেটাতে গিয়ে পাছে বিপদে পড়ে।
জেলেদের খটকা আরো গভীর হয় ধীরে ধীরে ট্রলারের সংখ্যা কমে যেতে দেখে। শুরুতে ট্রলার ছিল মোট আটটি। দশদিন পর দেখা গেল মাত্র পাঁচটি। তারও সাত কি আট দিন পর কমে গেল আরো চারটি। থাকল কেবল একটি ট্রলার ও তিনটি জাহাজ। ফেব্রুয়ারির শেষ নাগাদ দেখা গেল মাত্র একটি জাহাজ। দূরে থেকে মনে হয় একটা কালো বিন্দু। আদিগন্ত অথই জলে বিন্দুটা ভাসছে। বাকি ট্রলার ও জাহাজগুলো কোথায় গেল কিছুই জানে না তারা। নানা প্রশ্ন সৃষ্টি হয় তাদের মনে, কোথায় গেল জলযানগুলো? খালি গেল, না কোনো পণ্য বোঝাই করে নিয়ে গেল? নেওয়ার মতো কী আছে? এদিকে তো কোনো ঘাট নেই, সেন্টমার্টিন এখান থেকে অন্তত দশ মাইল দূরে। ঘাট নেই তো নেওয়ার মতো কিছু নেই। তার মানে খালিই গেছে। নাকি আবার জলের অতলে তলিয়ে গেছে!
না, এসবের কিছুই জানে না জেলেরা। জানার কথাও নয়। মাছ নিয়ে তাদের কারবার। সমুদ্রে কত ট্রলার কত জাহাজ চলাচল করে। কোথাকার ট্রলার কোথায় গেল, কোনো পণ্য নিয়ে গেল, না ইয়াবা ট্যাবলেট দিয়ে গেল, নাকি আবার অস্ত্র খালাস করে গেল, এতো খোঁজ রাখার সময় কই। জানে কেবল একজন সিতারাবানু। সে সর্বজ্ঞ। এই বৃত্তান্তের কোনো ঘটনাই তার অজানা নয়। সে জানাচ্ছে, আটটি ট্রলারে মানুষ ছিল, দুটি কোস্টার জাহাজেও মানুষ ছিল। সেই মানুষরা কোথা থেকে এসেছিল, গন্তব্য কোথায় এবং তাদের দেশ ও জাত পরিচয়ও তার অজানা নয়। কিন্তু জানলেই যে বলতে হবে এমন তো কোনো শর্ত নেই। সিতারাবানু এই বৃত্তান্তের কথক, সে যা বলবে লেখক তাই লিখবে। সে যা বলেনি লেখক তা বানিয়ে লিখবে না। আটটি ট্রলার ও দুটি কোস্টার জাহাজে যাত্রী ছিল প্রায় সাড়ে সাত হাজার, এই তথ্য তার। সর্বশেষ জাহাজটিতে যাত্রী আছে পাঁচশো তিরাশি জন, এই তথ্যও তার। সে যা হিসাব দিচ্ছে ঠিক তাই লেখা হচ্ছে। সংখ্যার কোনো গরমিল নেই। সে হিসাব দিচ্ছে, সর্বশেষ জাহাজের যাত্রীদের মধ্যে বাঙালি আছে শদেড়েক, বাকিরা রোহিঙ্গা। যাত্রীদের মধ্যে শিশু আছে, কিশোরও আছে, তরুণ আছে, যুবকও আছে। বুড়োও আছে কয়েকজন, বয়স যাদের পঞ্চাশের বেশি নয়, অথচ দেখে মনে হয় ষাটের বেশি। সত্তরও মনে হতে পারে। জীবনের সঙ্গে লড়তে লড়তে শরীরকে তারা বয়সের বৃত্তে রাখতে পারেনি। শিশু আর বুড়োদের আলাদা করলে সংখ্যা দাঁড়ায় মাত্র আঠারোজন। বাকি থাকে পাঁচশো পঁয়ষট্টিজন। তাদের মধ্যে বয়সে কেউ তরুণ, কেউ যুবক। চল্লিশের বেশি নয় কারো বয়স। আর নারী-পুরুষ আলাদা করলে নারীর সংখ্যা দাঁড়াবে তেইশ। সব যাত্রীর বয়স আন্দাজ করা যায় কেবল নারীদের ছাড়া। পায়ের পাতা ও হাতের কব্জি দুটি বাদে সর্বাঙ্গ তাদের রংজ্বলা কালো বোরকায় ঢাকা। শরীর যেন তাদের মণি-মুক্তায় গড়া। কাউকে দেখাতে নেই। দেখালে চুরি হয়ে যেতে পারে, ডাকাতি হয়ে যেতে পারে। শরীরের উদোম অংশটুকু দেখেই বয়স আন্দাজ করে নিতে হয়। আন্দাজে বলা যায়, তেইশজনের মধ্যে যুবতীর সংখ্যা অন্তত পাঁচ, বয়স যাদের তিরিশের বেশি নয়। সাতজনও হতে পারে, বেশিও হতে পারে। তবে তা দশের কোটা ছাড়াবে না।
পাঁচশো পঁচাত্তরজন যাত্রী নিয়ে, জাহাজিদের ভাষায় যারা আদম, সর্বশেষ এই কোস্টার জাহাজটি, অর্থাৎ এমভি সাউথ বেঙ্গল-৩, মালয়েশিয়ার উদ্দেশে নোঙর তোলার কথা ছিল ফেব্রুয়ারির আটাশ তারিখ ভোরে। কিন্তু রাতে জাহাজ-মাস্টারের কাছে জরুরি একটা ফোন এলো। নেটওয়ার্ক এতই সমস্যা করছিল সব কথা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল না। বুঝল শুধু এটুকু, কক্সবাজারের ইনানি থেকে একটি ট্রলার রওনা হয়েছে, পৌঁছতে পরদিন দুপুর হয়ে যাবে। বাকিটা মাস্টার বুঝে নিল ট্রলারটি না পৌঁছা পর্যন্ত জাহাজের নোঙর তোলা যাবে না। এমন ঘটনা অতীতেও ঘটেছে। যাত্রার দিনক্ষণ সব ঠিক, অমনি জরুরি ফোন নোঙর তোলা যাবে না। এসবে বিরক্তির চেয়ে সে বরং খুশিই হয়। খুশি, কারণ, যত আদম তত টাকা।
কিন্তু পরদিন দুপুরেও ট্রলারটি পৌঁছল না। অপেক্ষায় থাকতে থাকতে সূর্য যখন পাটে নামল আট আদম নিয়ে ট্রলারটি ভিড়ল। জাহাজের আন্নিতে, হেজের ছাদে এবং দেয়ানি হলের দুই গলিতে তখন বহু যাত্রী দাঁড়িয়ে। আশিজন হতে পারে, একশ বা দেড়শোজনও হতে পারে। কারো চোখে আনন্দ, কারো চোখে আতঙ্ক। কারো চোখ দূর সমুদ্রে, কারো চোখ সন্ধ্যার আকাশে নীড়গামী পাখিদের দিকে, আর কারো অস্তগামী সূর্যের দিকে। কেউ আলাপ করছিল আর কেউ বিড়ি টানছিল। চোখে সানগ্লাস পরা এক তরুণ আন্নির রেলিংয়ে হেলান দিয়ে মোবাইলে ছবি তুলছিল। ট্রলার থেকে জাহাজে উঠে দেয়ানি হলের গলিতে অসহায়ের মতো খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে, তারপর সামনে এগিয়ে সিঁড়ি বেয়ে আন্নিতে উঠে লিস্টার ইঞ্জিনের কাছে দেখতে মোড়ার মতো আলাদ বাঁধার একটা মোটের ওপর বসল কমল। পাশে দাঁড়াল দীপঙ্কর। গভীর সমুদ্রে দূরযাত্রায় অপেক্ষমাণ জাহাজটিতে ওঠার পর দুজন এতটাই বিস্মিত, একটা কথাও সরছিল না মুখ দিয়ে। কেন তাদের এই জাহাজে তোলা হলো ভেবে কূল পাচ্ছিল না। জাহাজটির গন্তব্য কোথায়, কাউকে জিজ্ঞেস করার সাহসও পাচ্ছিল না।
তখন সিঁড়ি বেয়ে আন্নিতে উঠল জুলফিকার। এক হাতে তসবি জপতে জপতে আরেক হাতে লম্বা দাড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে কমলের মুখোমুখি দাঁড়ায়। আড়চোখে বারবার তার মুখের দিকে তাকায়। হিন্দু না মুসলমান চেহারা দেখে বোঝার চেষ্টা করে। আচমকা চোখাচোখি হয়ে গেলে মুচকি হেসে সালাম না দিয়ে পারে না। মাথা নাড়িয়ে জবাব দেয় কমল। মুসাহাবার উদ্দেশে হাতদুটো বাড়িয়ে জুলফিকার বলল, ভাইজানের সফরও কি মালয়েশিয়ায়?
কমল চমকে ওঠে। অন্ধকার রাতে টর্চের আলোয় ফণা তোলা গোখরো দেখে পথিক যেভাবে চমকায়। বুকের ভেতর স্থির হয়ে বসে থাকা ভয়ের পাথরটি নড়ে ওঠে। চোখে আজন্মের বিস্ময় নিয়ে হাঁমুখে জুলফিকারের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। নিষ্পলক। জাহাজটির গন্তব্য কোথায় বুঝতে তার দেরি হলো না। তবু নিশ্চিত হতে জিজ্ঞেস করে, আপনারা কোথায় যাচ্ছেন?
খোদা চাহে তো মালয়েশিয়া।
মালয়েশিয়া?
জে।
সবাই?
তা তো কবার পারছি না ভাই। মালয়েশিয়া ছাড়া যাবে আর কই?
দুজনের কথোপকথনের মধ্যে মাস্তুলের মাইকটা বেজে উঠল হঠাৎ। কমল চমকে উঠল। জাহাজে আবার মাইকও থাকে! জুলফিকার হাসে। মাইকে বাজা কণ্ঠটা তার চেনা। জাহাজে ওঠার পর থেকে বেশ কয়বার শুনেছে। দুর্বোধ্য আঞ্চলিক ভাষাকে সর্বজনবোধ্য রূপ দিয়ে ঘোষক যা বলল তার অর্থ এই, একটু পর খাবার দেওয়া হবে। খেতে চাইলে সবাইকে হেজে নামতে হবে। যে ওপরে থাকবে সে খাবার পাবে না।
মাইকটা থামার সঙ্গে সঙ্গে জুলফিকার নেমে গেল। এমনভাবে নামল, যেন কেউ তাকে তাড়া করছে, অথবা হেজে তার কোনো স্বজন মরে যাচ্ছে, শেষ দেখা দেখার জন্য সে ছুটে যাচ্ছে। তার দেখাদেখি বাকিরাও ব্যস্ত হয়ে পড়ল। হেজে নামার সিঁড়ির কাছে হুড়োহুড়ি লেগে গেল। ঠেলাঠেলিতে কয়েকজন চিৎ-কাত হয়ে পড়েও গেল। খিদার টান বলে কথা। সেই দুপুরে একবার খাবার দেওয়া হয়েছে। ঠিক দুপুরেও নয়, বেলা এগারোটাকে তো আর দুপুর বলা চলে না। এক ঠোঙা ভাত, খানিকটা আলুভর্তা আর দু-চামচ ডাল খাবার বলতে এই। পেটের অর্ধেকও ভরেনি। ওসমান ফিরতি এক ঠোঙা ভাত চেয়েছিল, বাবুর্চি ধমক দিয়ে বলেছে, জীবনে কোনোদিন ভাত চোখে দেখস নাই বেটা? ওসমান ভড়কে যায়। খারাপ তো কিছু বলেনি, বাড়তি এক ঠোঙা ভাত চেয়েছে, তাতেই বাবুর্চির এমন ঝাড়ি! একবার তাকে বলতে ইচ্ছা হয়েছিল, ভিক্ষা তো চাইছি না মিয়া, পেটে খিদা আছে তাই ভাত চাইছি। পেট ভরে ভাত খেতে না পেলে ষাট হাজার টাকা দিয়েছি কিসের জন্য? বাবুর্চির মুখের দিকে তাকিয়ে বলার সাহস পায়নি। চেহারাটা ডাকাতের মতো, নাকটা খাড়া, নেশাখোরের মতো লাল চোখ দুটো অস্বাভাবিক রকমের ফোলা, কোটর থেকে যে-কোনো মুহূর্তে যেন মার্বেলের মতো গড়িয়ে পড়বে। আর শরীরখানা ঠিক রামগতি বাজারের রিকশার মহাজনের মতো। বপুটাও একই সাইজের।
মাথায় তেলচিটচিটে বাবরি চুল। লুঙ্গির ওপর মলিন গামছা পরে পুরনো একটা চেয়ারে বসে পলিথিনের ঠোঙায় ঠোঙায় ভাত-তরকারি বেড়ে দিচ্ছে। কতক্ষণ পরপর মুগুরের মতো বাঁ-হাতে নাক ঝাড়ছে, পাছায় হাতটা মুছে আবার পাতিল ধরছে। ঘৃণায় যাত্রীদের গা রি-রি করে, কিন্তু মুখে কেউ কিছু বলে না। কে তাকে বলবে, খবরদার, ওই ময়লা হাতে পাতিল ছুঁয়ো না। কার এতো সাহস। কাউকে শায়েস্তা করার জন্য ওই হাতের একটা ঘুষিই যথেষ্ট। তার সঙ্গে কথা বাড়িয়ে যেচে বিপদ ডেকে আনবে কেন ওসমান? এমনিতেই সবকিছু তার কাছে গোলমেলে ঠেকছে। সে কল্পনাও করতে পারেনি এমন জীর্ণদশার একটা মালবাহী জাহাজে চড়ে তাকে বিদেশ যেতে হবে। ডাক্তারের মুখে প্রথম সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া যাওয়ার কথাটা শুনে জাহাজের যে-ছবিটা কল্পনায় এঁকে নিয়েছিল, সাউথ
বেঙ্গল-৩-এ ওঠার সঙ্গে সঙ্গে সেটি সাগরে তলিয়ে গেল। গেল তো গেলই, কোনোভাবেই আর খুঁজে পায় না। সেন্টমার্টিন থেকে তাকে তুলে ট্রলারটি টানা পাঁচ ঘণ্টা চলার পর জাহাজটির কাছে পৌঁছে। সারা রাত জেগে থাকায় মাথাব্যথা করছিল খুব, খিদাও লেগেছিল প্রচ-। শোয়ার ব্যবস্থা কোথায়, খাবার কোথায় পাওয়া যাবে জিজ্ঞেস করার মতো জাহাজের কাউকে খুঁজে পাচ্ছিল না। সবাই তো আদম, তার মতোই তাদের দশা। জাহাজের পাছার দিকে তিনতলা কেবিনে জাহাজিরা আছে। তারা মোট এগারোজন। একজন মাস্টার, দুজন করে সুকানি ও গ্রিজার, এক বাবুর্চি এবং পাঁচ লশকর। ঠিক লশকর নয়, লাঠিয়ালের মতো একেকজনের চেহারা, হাতে হাতে লাঠি নিয়ে জাহাজ পাহারা দিচ্ছে, বললে প্রহরী বলা যেতে পারে। জুলফিকার এক প্রহরীর কাছে জানতে চেয়েছিল, লাশতা কখন দিবি ভাইজান? লোকটা মুখ ঘুরিয়ে নিল। চেহারায় এমন একটা ভাব আনল কথাটি যেন শুনতে পায়নি, শুনলেও উত্তর দিতে যেন বাধ্য নয়। সংকোচে নাশতার প্রসঙ্গ এড়িয়ে জুলফিকার এবার জানতে চাইল, আচ্ছা ভাই, হামরা যে জাহাজোত চড়ে যামো সেডে কি ম্যালা দূরে?
এবার মুখ ঘুরাল লোকটা। যেটুকু ফাঁক না করলেই নয় ঠোঁট দুটো ঠিক সেটুকু ফাঁক করে খনখনে গলায় বলল, ইয়ানরে কি ঠেলাগাড়ি মনে অর তোমার?
হে হে হে… কি যে কচ্ছেন ভাইজান!
কী কইর?
না, কচ্চি যে এডে তো যাত্রীবাহী জাহাজ লয়।
এ্যাহ্, এডে যাত্রীবাহী জাহাজ লয়, লোকটা মুখ বিকৃত করে বলে, বাড়ি কডে শালা? এই জাহাজত কি গরু-ছল আনে-নে মনে গরস না তুই?
জুলফিকার উত্তর দেয় না। উত্তর দেওয়ার মতো কোনো কথা আসলে খুঁজে পায় না। কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকে, তারপর হাসিটা কান পর্যন্ত ঠেকিয়ে বলে, কিচু মনে করবেন না, হায়দর ভাই হামাক ফাইভ স্টার হোটেলের লাগান জাহাজের কতা কচলো তো তাই…কচ্ছি… হেহ্ হে।
এবার ক্ষেপে উঠল লোকটা। চোখের কোনা দুটো কুঁচকিয়ে, ঠোঁট দুটো যতটা পারে চ্যাপ্টা করে কণ্ঠস্বর বিকৃত করে বলল, এ্যাঁহ্, ফাইভ স্টার হোটেল! ঘরম্মাঝে ভাতর পাতিল আছে না ব্যাডা?
এডে কেংকা কথা ভাই!
চুপ! হুজুর মানুষ এত কতা কস ক্যান?
জুলফিকারের মুখটা এবার মলিন হয়ে গেল। তার মতো এমন একজন হক্কানি আলেমকে তুই-তোকারি করায় কয়েকজন যাত্রী হইহই করে উঠলে সিঁড়ি বেয়ে কেবিনের দোতলায় উঠে গেল প্রহরী। দেয়ানি হলের গলিতে গিয়ে উঠন্ত সূর্য পেছনে রেখে হলের ওপর হাত রেখে দূর সমুদ্রে তাকায় জুলফিকার। মনে খুব চোট পেয়েছে বেচারা। বিদেশের কথা আলাদা, দেশে ফেরার পর কেউ কোনোদিন তার সঙ্গে আঙুল তুলে কথা বলেনি, মসজিদের ইমাম হিসেবে কমবেশি সবাই ইজ্জত-সম্মান দিয়েছে, অথচ বয়সে তার চেয়ে অন্তত দশ বছরের ছোট জাহাজের আদনা একজন প্রহরী কিনা তার সঙ্গে এমন দুর্ব্যবহার করল। অপমানে সে দমে যেতে লাগল। দমতে দমতে, দূর সমুদ্রে তাকিয়ে থাকতে থাকতে, গাঙচিলদের ওড়াউড়ি দেখতে দেখতে হঠাৎ টের পেল বুকটা দুরুদুরু কাঁপছে। কেন কাঁপছে? ঠান্ডা বাতাসে, নাকি ভয়ে? ঠিক বুঝতে পারে না। প্রহরীর দুর্ব্যবহার তাকে গুয়ান্তানামোর স্মৃতি মনে করিয়ে দিচ্ছে, বুদ্বুদের মতো ভেসে উঠছে দুঃসহ সেসব স্মৃতি। আবার বুঝি তেমন কোনো কারাগারে বন্দি হতে যাচ্ছে। আবার বুঝি খেতে হবে হারাম কোনো পশুর মাংস। আবার বুঝি শুরু হবে নিষ্ঠুর নিপীড়ন।
ভাবতে ভাবতে চেহারায় অপমানের ছাপটা মিলিয়ে আতঙ্কের ছাপ ভেসে ওঠে। মাথার ভেতরটা কেমন খালি খালি লাগে, বুকের কাঁপুনিটা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। মনে হয় কঠিন কোনো হাত এখুনি বুকটা চেপে ধরবে। চোখ বন্ধ করে সে বসে পড়ে। বসে বসে কাঁদে। কাঁদে আর বলে, মাবুদ, হামি তোমার নাফরমান বান্দা, হামার বেবাক গুনাখাতা মাফ করে দেও। ওসমান তাকে সান্ত¡না দেওয়ার চেষ্টা করে। ছাইচাপা আগুনের মতো কান্না আরো উসকে ওঠে তাতে। কাঁদতে কাঁদতে সরু গলিতেই সেজদায় লুটিয়ে পড়ে। নিদারুণ বিপন্ন বোধ করে ওসমান। অল্প সময়েই লোকটার সঙ্গে খাতির জমে উঠেছে তার। কথা একটু বেশি বলে, কিন্তু মনটা সাদা। শেষরাতে ট্রলারে দু-টুকরো পাউরুটি আর একটা সবরি কলা খেতে দিয়েছে। তাকে এভাবে কাঁদতে দেখে তার কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়ে। মঈনের ঘটনাটা শুনে এমনিতেই সে উদ্বিগ্ন, জুলফিকারের হাল দেখে উদ্বেগ আরো বাড়ে। যাত্রাতেই এমন গ-গোল, কে জানে কী আছে ভবিষ্যতে! ভাবে, ডাক্তার কি তার সঙ্গে প্রতারণা করল? শিক্ষিত মানুষ এমন প্রতারক হতে পারে! কে জানে, প্রতারণা হয়তো করেনি, প্রতারণা করার মতো মানুষ নয় ডাক্তার। তার খারাপ কোনো মতলব থাকলে টাকা নিয়ে আগেই চম্পট দিতে পারত, চট্টগ্রাম পর্যন্ত তাকে এগিয়ে দিত না। নিশ্চয়ই কোথাও বড় কোনো ঝামেলা হয়েছে। একসঙ্গে এত মানুষ মালয়েশিয়া যাবে হয়তো জানা ছিল না তার। যাত্রীবেশী হয়ে যাওয়ায় ট্রাভেল এজেন্সির মালিকেরও হয়তো কিছু করার ছিল না।
জীবনে বড় হতে হলে অনেক কষ্ট করতে হয় – বাড়ি থেকে যাত্রার সময় মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলেছিল তার বাপ। কথাটা ভেবে মনে কিছুটা জোর পায়। নিজেকে সান্ত¡না দেয়, এ আর এমন কী কষ্ট, এর চেয়ে কত কত কষ্টের অভিজ্ঞতা তার। কতদিন কুকুর-বিড়ালের মতো শুধু মাড় খেয়ে পার করে দিয়েছে, কতদিন ফকির-মিসকিনের মতো উপোস কাটিয়ে দিয়েছে। সেসব দিনের কথা এখনো তো ভোলেনি। দু-একদিন উপোস থাকলে কি আর মরে যাবে? জাহাজটা তো চিরকাল এখানে থেমে থাকবে না, একদিন না একদিন মালয়েশিয়া পৌঁছবেই। কয়টা দিন কষ্ট না হয় করলই, তারপর তো কেবল সুখ আর সুখ।

যাত্রীরা হেজে নামার কিছুক্ষণ পর চটের একটা বস্তা হাতে দুই প্রহরীসহ বাবুর্চি এসে জনপ্রতি একটি করে ঠোঙা বিতরণ করতে লাগল। রাতের খাবার হিসেবে ভেতরে এক মুঠো চিঁড়া আর এক টুকরো গুড়। খিদায় কাহিল যাত্রীদের মাথা কি আর ঠিক থাকে! শুরু হলো তুমুল হট্টগোল, ভাত না দিয়ে এসব কেন? এসব খেয়ে থাকা যায়? ভাত চাই ভাত, আমরা খাব না এসব। বিক্ষুব্ধ কজন যাত্রী ঠোঙাগুলো ছুড়ে ফেলে দিলো। বাবুর্চি চোখ পাকিয়ে তাদের শাসায়, কথা কম কইস হালার পুতেরা। এটা কি শ্বশুরবাড়ি পাইছস? ভাত এক বেলার বেশি কেউ পাবি না।
যাত্রীরা পরস্পরের মুখের দিকে তাকায়। কয়েক মুহূর্তের জন্য হেজজুড়ে নীরবতা নামে। প্রত্যেকের চোখে-মুখে বিস্ময়। কী বলছে বাবুর্চি এসব! এমন আশ্চর্য কথা যেন জীবনে কোনোদিন তারা শোনেনি। ক্ষুব্ধ জুলফিকার গলা উঁচিয়ে বলল, এগলে কতা আগে কলো না ক্যা? এডে কেংকা চিটেরি!
বাবুর্চি তার কথা শুনেও শুনল না, ঠোঙা বিলাতে বিলাতে প্রহরীদের নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে আবার ওপরে উঠে গেল। জুলফিকার সমানে বকতে থাকে, চিটেরির আর জাগা পাওনা হারামির বাচ্চারা! খোদার গজব পড়বি মাথাত। মানুষোক ঠকে বড়লোক হবি? কবরোত মুগুর মারে বড়লোকি বার করবিহিনি, হুঁ হুঁ। ওসমান তার কথায় তাল দেয়, বাবুর্চির মা-বোন ধরে গালাগাল করে তালেব। এক যাত্রী নিজের ভাগ্যকে দোষারোপ করে, শালার কপালটাই খারাপ। মাথায় কিস্তি টুপিঅলা বুড়ো আবুল কাশেম ওরফে কাশুমিয়া, সোহরাব-রুস্তমের কাহিনি যার মুখস্থ, যে সকাল থেকেই জাহাজিদের পক্ষে সাফাই গেয়ে আসছে, বাবুর্চির কথার যৌক্তিকতা খুঁজে পায়। ইনিয়ে-বিনিয়ে একবেলা ভাতের পক্ষে সে নানা যুক্তি হাজির করে, তিন বেলা ভাত দেওয়া তো আসলেই অসম্ভব। এতগুলো মানুষের জন্য রান্না কি সোজা কথা? রান্নার জন্য চাল লাগে, তরিতরকারি লাগে। কাঁচা তরকারি কি জাহাজে একদিনের বেশি রাখা যায়? তা ছাড়া রান্নার জন্য লাকড়ি লাগে, নইলে সিলিন্ডার গ্যাস লাগে। ছোট্ট একটা জাহাজ, মানুষের মাথা মানুষে খাচ্ছে, এত মালসামান তুলতে গেলে তো জাহাজটা তলিয়ে যাবে।
বিকেলে আন্নিতে দাঁড়িয়ে মোবাইলে যে-তরুণটি ছবি তুলেছিল, রনি, রাতেও যার চোখে সানগ্লাস, কাশুর মুখের সামনে তর্জনী নাড়াতে নাড়াতে বলল, দালালি থামাইন চাচা। নগদে আশি হাজার ট্যাকা দিছি, বুঝলাইন? এক ট্যাকাও কম নিছে না। ট্যাকা নেওয়ার সময় তো কইছে না ভাত একবেলার বেশি দিবো না। এহন এত নাটক ক্যা?
কাশুর সব যুক্তি হাওয়ায় উড়ে গেল, মুখ আর খুলতে পারে না সে। এশার নামাজ পড়ার অজুহাতে হেজের কোনায় ওপরে ওঠার সিঁড়ির দিকে হাঁটা ধরে কোনোরকমে মুখ লুকাল। জুলফিকার ততোক্ষণে এক কোনায় গামছা বিছিয়ে নামাজে দাঁড়িয়ে গেছে। তার পেছনে বসে ফ্যা ফ্যা করছে মঈন। শাহপরীর জেটিঘাট থেকে সেই যে কান্না শুরু করেছে এখনো অবিরাম চালিয়ে যাচ্ছে। কাঁদছে, কিন্তু চোখে পানি নেই। চোখে কি আর এতো পানি থাকে? যা ছিল ট্রলারেই তো সব নিঃশেষ করে দিয়েছে। বিরক্ত জুলফিকার নামাজের সালাম ফিরিয়ে ধমকে ওঠে, ছাগলের লাহান ম্যাঁ ম্যাঁ করো না তো ভাই! তুমি তো মিয়ে ছোলপোল লও? বেটা ছোল, শরম লাগে না ইংকা করে কান্দিতে?
কথাগুলো মঈনের আঁতে গিয়ে বিঁধল। লজ্জা পেয়ে সে কান্না থামাল। সে আস্ত একটা পুরুষ এতক্ষণে বুঝি টের পেল। কান্না থামে, কিন্তু আতঙ্ক কাটে না। কাটবে কীভাবে? জোর করে কেন তাকে বিদেশ নেওয়া হচ্ছে – এই প্রশ্নের উত্তর তো এখনো পায়নি। জোর করে মানুষ মানুষের কাছ থেকে টাকা-পয়সা ছিনতাই করে, জায়গাজমি দখল করে, হামলা-মামলা করে, জেলে পাঠায়, জোর করে বিয়ে করে, ধর্ষণও করে, কিন্তু জোর করে কেউ কাউকে বিদেশ নেয় – এমন কথা জীবনে কোনোদিন শোনেনি। বিদেশ সে যেতে চায় না, তা তো নয়। তালেবের মতো জমা টাকা থাকলে সেও চেষ্টা করে দেখত। কোনো চেষ্টাই করল না, কাউকে একটা পয়সাও দিলো না, মুখ ফুটে কোনোদিন বিদেশ যাওয়ার কথা কারো কাছে একটি বার উচ্চারণ পর্যন্ত করল না, অথচ তাকে কিনা জোর করে বিদেশ নেওয়া হচ্ছে! সারাদিন নানাজনের কাছে এর কারণ জিজ্ঞেস করেছে, কেউ ঠিক উত্তরটি দিতে পারেনি। মুরব্বি মানুষ কাশুমিয়া, তার কাছেও জানতে চেয়েছিল একবার। সে হাসতে হাসতে বলেছে, মালেশিয়া যাইবা ইয়ান তো ভালা কথা। তুঁই চিন্তা ক্যাঁ গরর ইয়ান তো ন বুজির। মঈনের জিবের তলায় তখন ‘মাদারচোদ’ গালিটা চলে এসেছিল, ঠোঁট চেপে কোনো রকমে ঠেকিয়ে রাখল।
সন্ধ্যা থেকে হেজের সিলিংয়ে লম্বা তারে ঝোলানো ক্ষীণ আলোর যে-বাল্বটি জ্বলছিল, যাত্রীরা চিঁড়া-গুড়গুলো খেয়ে শেষ করার আগেই হঠাৎ নিভে গেল। মাস্তুলের মাথায় জ্বলছে হাই ভোল্টেজের একটি লাইট। হেজে আলো-বাতাস ঢোকার জন্য ছাদের চার কোনার চারটি হলকা সরিয়ে ছোট ছোট যেসব ফোকর করা হয়েছে সেসব ফোকর গলিয়ে মাস্তুলের আলোর কটি ক্ষীণ রেখা ভেতরে ঢুকছে। ফোকরগুলো না থাকলে কিম্ভূত অন্ধকারে ছেয়ে যেত হেজের ভেতরটা। যাত্রীরা বলেছিল সব কটি হলকা সরিয়ে ছাদটা পুরোপুরি উদোম করে দিতে। মাস্টার রাজি হয়নি। অন্ধকারে এখন সবাই তার মা-মাসি ধরে গালাগাল করছে, এটা কেমন কথা! রাত না নামতেই বাতি নিভিয়ে দিলো কেন! মানুষের কি হাগা-মোতা লাগে না? এতো তাড়াতাড়ি ঘুম আসে? কিন্তু কে শোনে তাদের ওসব গালাগাল। জাহাজিরা তো কেবিনে, শোনার মতো কে আছে। তারা বলে তারাই শোনে।
বলতে বলতে শুনতে শুনতে যখন বুঝল ঘুমিয়ে পড়া ছাড়া আর কোনো গতি নেই, ঘুমের দোয়া পড়তে পড়তে গাদাগাদি করে সবাই শুয়ে পড়ল। গাদাগাদি, কারণ, এখানে, পেছনের এই দুই নম্বর হেজে শুতে পারে বড়জোর দুশো যাত্রী, অথচ শুয়েছে কিনা প্রায় তিনশো। বাকিরা সামনের এক নম্বর হেজে। দুই নম্বর হেজের তুলনায় ওই হেজটা ছোট। মাঝখানে আবার চটের পর্দা ঝুলিয়ে দুই ভাগ করা। এক ভাগে মহিলা, অন্যভাগে পুরুষরা। এক হেজ থেকে আরেক হেজে যাওয়ার পথ নেই। আলাদা ম্যানহোল, আলাদা সিঁড়ি। যেন কারাগারের দুটি ওয়ার্ড।
অন্ধকারে কার পায়ের চাপ খেয়ে একজন কঁকিয়ে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে ধমক, দেখে হাঁটতে পারো না মিয়া। এতক্ষণ চুপচাপ থাকা জুলফিকার এবার মুখ খুলল, আজব কতা শুনালে ভাই। আন্দারোত মানুষ চোকে দেখপি, মানুষ কি বাদুড়? তার কথায় নিস্তব্ধ হেজ জুড়ে হাসির রোল উঠল। হাসি থামলে শুরু হলো তার বকাবকি। শুয়ে শুয়ে সে বকে চলে, মানুষোক তো দেকিচ্চি বিশ্বেস করা পাপ। মানুষ ইংকা বিশ্বেসঘাতক হয় কেংকা করে! হায়দর আলী ইংকা চিটেরি করলো? চিন্তেও করিনি ইংকা চিটেরের পাল্লাত পরমো। কি ভাবিচো তুমি? মনে করিচো আল্লা কিচু দেকিচ্চে না? সব দেকিচ্চে, সব। কাল হাশরের মাঠোত ইংকা চিটেরির জবাব দেওয়া লাগবিনে ভাবিচো? ভুল, ভুল ভাবনা তোমার। কড়ায় গ-ায় হিসাব দেওয়া লাগবি হ।
তার কথাগুলো ধীরে ধীরে ওয়াজের সুর পায়। সুরে সুরে সে হাশরমাঠের নানা হালের কথা বয়ান করে। সেদিন আল্লাহ কোথায় থাকবেন, তার পেয়ারে হাবিবের স্থান কোথায় হবে, আদম থেকে ঈসা পর্যন্ত যত নবী-রসুল দুনিয়ায় এসেছেন তাদের কী দশা হবে, সূর্য মাথার কয় বিঘত ওপরে থাকবে, মুমিনরা বিজলির গতিতে কীভাবে পুলসিরাত পার হবে, পাপীরা কীভাবে কাটা পড়ে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে ইত্যাদি। শ্রোতাদের কেউ চুপচাপ শোনে, শুনতে শুনতে কেউ দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। কাশু বুড়ো হুহুস্বরে একেকবার কেঁদে ওঠে। কেউ কেউ আবার বিরক্তও হয়। যেমন দীপঙ্কর। অন্য সময় হলে জুলফিকারের সঙ্গে সে তর্ক-বাহাস শুরু করে দিত, কঠিন সব যুক্তি দিয়ে একেবারে নাস্তানাবুদ করে ছাড়ত। কিন্তু এখন তার শরীরে ক্লান্তি, মনে উদ্বেগ। তর্ক-বাহাস তো দূরের কথা, ঠোঁটজোড়া ফাঁক করে একটা শব্দও উচ্চারণ করতে ইচ্ছা করছে না। শুনতেও না। তবু কমল আতঙ্কে আছে কখন আবার সে বাহাস শুরু করে দেয়! ধর্মতত্ত্ব নিয়ে বাহাস করার জন্য সে মুখিয়ে থাকে, সুযোগ পেলেই ধর্ম নিয়ে যার-তার সঙ্গে বিতর্ক শুরু করে দেয়। কমল আবার তর্কে যায় না। ধর্মে তার মতি নেই, ধর্ম নিয়ে আবার মাতামাতিও নেই। পৃথিবীতে ধর্ম নামের কিছু আছে, জীবনে কোনোদিন যেন সে শোনেনি।
কিন্তু জুলফিকারের ওয়াজ না থামলে তো এখন ঘুমানো মুশকিল। সুনসান নীরবতা ছাড়া তার আবার ঘুম আসে না। হাঁচি-কাশির শব্দেও তার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে। গলাটাকে যথাসম্ভব নরম করে, কোনোভাবে যাতে বিরক্তি প্রকাশ না পায়, সে ডাক দিলো, হুজুর!
জুলফিকার জবাব দেয় না।
ও হুজুর!
জি, বলেন।
রাত তো কম হয়নি, এবার ঘুমান। সকালে সবাই মিলে আপনার ওয়াজ শুনব।
তার কথায় সমর্থন দিয়ে আরো কজন যাত্রী বলে উঠল, হ্যাঁ হ্যাঁ, এবার থামেন হুজুর। ফজরের নামাজ পড়তে হবে না? ঘুমান ঘুমান।
জুলফিকার আরো কিছুক্ষণ চালিয়ে তারপর থামল। এবার শুরু হলো কাশু বুড়োর গুনগুনানি। কান্নার সুরে গুনগুন করে সে গজল গাইতে শুরু করল। বেসুরো গলা, কিন্তু সুরটা আসছে ভেতর থেকে। প্রাণ থেকে নির্গত সুর শ্রোতার ওপর প্রভাব বিস্তার করে। কী এক বেদনা ঝরে ঝরে পড়ে তার গুনগুনানিতে, যে-বেদনা মুখে প্রকাশ করা যায় না, মুখের কথায় ঠিক ধরা যায় না। সে-কারণেই হয়তো তার গুনগুনানিতে বিরক্ত হয় না যাত্রীরা। হলেও কেউ কিছু বলে না। মর্মস্পর্শী সুরটা হয়তো সবার শৈশব-কৈশোরের স্মৃতি জাগিয়ে তুলছে। সুরের সঙ্গে তারা স্মৃতির ভেলায় ভাসতে ভাসতে ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে যাচ্ছে।
কমলের মন তখন অন্যদিকে। কাশু বুড়োর বেদনাসিক্ত গজলের সুরে তার মাথার ভেতর আবার জীবন্ত হয়ে উঠছে পূর্ববঙ্গ গীতিকার পঙ্ক্তিগুলো। সন্ধ্যায় জুলফিকারের কাছ থেকে যখন জানল জাহাজটি মালয়েশিয়া যাবে তারপর থেকেই পঙ্ক্তি কটি মাথায় ঘুরপাক খেতে শুরু করে
সেই না সাইগরের মাঝে হার্ম্মাদ্যার দল
বাঁকে বাঁকে ঘুরে সদাই বড় বেয়াকল।
লুডতরাজ করে তারা আর দাগাবাজি
সাইগরে হার্ম্মাদ্যার ডরে কাঁপে নায়র মাঝি। পঙ্ক্তিগুলো তাকে ইতিহাসের গভীরে টেনে নিয়ে যায়। চারশো বছর আগের সেই ইতিহাস, যে-ইতিহাসের নজির সমগ্র পৃথিবীতে বিরল, যে-ইতিহাস মগ-ফিরিঙ্গি হার্মাদদের ধ্বংসযজ্ঞের ইতিহাস, মানবতা নিয়ে হোলিখেলার ইতিহাস। পশ্চিম দিগন্তে সোনালি আবিরের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকতে থাকতে ইতিহাসের সেসব অধ্যায় সিনেমার দৃশ্যের মতো একে একে তার মানসপটে ভেসে উঠছিল। সে তখন এতটাই বুঁদ ছিল, সবাই হেজে নেমে যাওয়ার পরও একা আন্নির রেলিং ধরে আলো-অন্ধকারে দাঁড়িয়ে রইল। তখন মাইকটা আবার বেজে উঠল, কিরে, কতা কানের বিদি যাচ্ছে না?
সে সাড়া দেয় না। শুনেছে বলেও মনে করে না।
মাইকে এবার ঝাঁঝাল কণ্ঠ, বুকাচুদা নাহি? নাবতি কচ্ছি শোনতোছো না?
মগ্নতায় এবার ছেদ ঘটে তার। অতীত থেকে সে বর্তমানে ফেরে। কেবিনের দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে নিজেকে একা আবিষ্কার করে অবাক হয়। এখানে আর দাঁড়িয়ে থাকা চলবে না বুঝে পশ্চিম দিগন্তে শেষবারের মতো চোখ বুলিয়ে ধীরপায়ে দুই নম্বর হেজের ম্যানহোলের সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামে। সিঁড়ির গোড়ায় দীপঙ্করের দেখা পায়। আবছা অন্ধকারে তার মুখ দেখে টের পায় যারপরনাই উদ্বিগ্ন সে। কমল ভেতরে তাকিয়ে দেখল মানুষ আর মানুষ। ভেতরে এত মানুষ থাকতে পারে তার ধারণাতেই ছিল না। এতগুলো মানুষ ছোট্ট এই জাহাজে চড়ে কিনা চোরাইপথে মালয়েশিয়া রওনা হয়েছে! অবাক লাগে তার। জীবনের মায়া কি নেই এদের? আবার ভাবে, জীবনের মায়াতেই হয়তো তারা এই ঝুঁকি নিয়েছে। ঝুঁকি নিয়ে মানুষ তো চোরাইপথে বিদেশ যায়। বাঙালিরা কি চোরাইপথে
ইউরোপ-আমেরিকার নানা দেশে যাচ্ছে না? মালয়েশিয়া বা সিঙ্গাপুরও তো যায়। রোহিঙ্গারা নাফ নদী পাড়ি দিয়ে, বড় বড় পাহাড় ডিঙিয়ে চোরাইপথে বাংলাদেশে ঢুকছে না? জীবনের মায়ায় তারা ঝুঁকি নিয়ে এক দেশ থেকে আরেক দেশে পাড়ি দিচ্ছে। তারা দেশহীন, তারা উদ্বাস্তু, তারা নিরন্ন। জাতিগত বিদ্বেষ ও সামরিক বাহিনীর
নির্যাতন-নিপীড়নে নাস্তানাবুদ এক অসহায় জাতি। তাদের ওপর চলে রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন। চলে বিটিএফ, ইউএমপি, শিউ কাই, নাগাজিন, মাইয়াট মন, সেব ও নাগামিন নামের ভয়াবহ সব অপারেশন। পূর্বপুরুষের বসতভিটা থেকে তাদের উচ্ছেদ করে প্রত্যাবাসন করা হয় মগ-রাখাইনদের, জবরদস্তিমূলক শ্রমদানে তাদের বাধ্য করা হয়, নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয় যাতায়াতে, বন্ধ করা হয় পানি ও বিদ্যুৎ সরবরাহ, রাতের আঁধারে পুড়িয়ে দেওয়া হয় তাদের ঘর। চলে লুণ্ঠন, অপহরণ, ধর্ষণ, হত্যা এবং গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় তাদের মসজিদ। দমন-পীড়নে অতিষ্ঠ হয়ে জীবনের মায়ায় চোরাইপথে তারা মালয়েশিয়ার উদ্দেশে রওনা হতেই পারে। আর জুলফিকারের মতো যেসব বাঙালি মালয়যাত্রা করেছে তার পেছনেও নিশ্চয়ই কারণ আছে। হয়তো অভাব-অনটনের শিকার হয়ে উন্নত জীবনের স্বপ্নে সমুদ্রের দুর্গম পথে তাদের এই যাত্রা। কিন্তু তাকে আর দীপঙ্করকে কেন জোর করে জাহাজে তোলা হলো? কাউকে তো কখনো বলেনি তারা মালয়েশিয়া যেতে চায়।
দীপঙ্কর বলল, কিছুই তো মাথায় ধরছে না। মালয়েশিয়ায় নিয়ে করবেটা কি আমাদের?
দাস বেচাকেনার কথা পড়োনি ইতিহাসে?
তা কি হয়! এখন কি আর দাস বেচাকেনার কারবার আছে?
কমল চুপ করে থাকে। উত্তর খুঁজে পায় না।
মেরে ফেলবে না তো আবার?
বিচিত্র কিছু নয়।
আমাদের মেরে তাদের কী লাভ?
একই প্রশ্ন কমলেরও, কী লাভ? কোন লাভে তাদের অপহরণ করে আনা হলো? কোন লাভে মালয়েশিয়া নেওয়া হচ্ছে? উত্তর খুঁজে পায় না। কে জানে, এমনও হতে পারে, তাদের হত্যা করে চোখ আর কিডনিগুলো বেচে দেবে আন্তঃদেশীয় কোনো চক্রের কাছে। এমন হওয়াটা বিচিত্র কিছু নয়। পত্রপত্রিকায় এমন সংবাদ তো প্রায়ই চোখে পড়ে।
রাত ক্রমে গভীর হলো। মাঝ আকাশে উঠে এলো চাঁদ। কাশুর গুনগুনানি থেমে গেছে, যাত্রীরা ঘুমাচ্ছে অথবা ঘুমানোর চেষ্টায় চোখ বন্ধ করে রেখেছে। কমলও ঘুমাতে চেষ্টা করে, কিন্তু ঘুম কিছুতেই আসে না চোখে। কী করে আসবে? ঘুম তো মস্তিষ্কের ব্যাপার। তার মস্তিষ্ক তো দখল করে রেখেছে পূর্ববঙ্গ গীতিকার পঙ্ক্তিগুলো। মৌসুমি বায়ুকু-লীর মতো ঘুরছে তো ঘুরছেই। যতই ঘোরে ততই তার উদ্বেগ বাড়ে। পঙ্ক্তিগুলো তাকে চারশো বছর আগের
মগ-ফিরিঙ্গি হার্মাদদের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। কেবলই মনে হয়, যেন সে হার্মাদের কবলে পড়েছে। চারশো বছর পর হার্মাদরা আবার ফিরে এসেছে। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় কেবলই সে এপাশ-ওপাশ করে। পঙ্ক্তিগুলো মাথা থেকে তাড়িয়ে দিতে চায়, কিন্তু পারে না। পঙ্ক্তিগুলো পূর্ববঙ্গ গীতিকার কোন পালার মনে করার চেষ্টা করে। ভেলুয়ার, পরীবানুর হাঁহলার, নাকি নুরুন্নেহা ও কবরের কথার? নাহ, ঠিক মনে করতে পারে না। হার্মাদের ভয় মন থেকে তাড়াতে সে ভেলুয়ার চেহারাটা কল্পনা করে, তার চোখের ভঙ্গিমা কল্পনা করে, তার চিকন কেশ, উদ্ধত বুক আর অনিন্দ্য জঘনের কথা কল্পনা করে। ভেলুয়ার ছবি কল্পনা করতে করতে কল্পনা ধাবিত হয় নুরুন্নেহার দিকে। নুরুন্নেহার মুখখানা কল্পনায় ধরতে গিয়ে, কী আশ্চর্য, ভেসে ওঠে লাবণীর মুখ। বুকের ভেতরটা কেমন মোচড় দিয়ে ওঠে। কে জানে লাবণী কী করছে এখন। নিশ্চয়ই সারাদিন তার নম্বরে ডায়াল করেছে। এখনো হয়তো করছে। কোনোভাবে সংযোগ পাচ্ছে না বলে নিশ্চয়ই দুশ্চিন্তায় ভুগছে। হয়তো তার ওপর রেগে আগুন হয়ে আছে। কিংবা রাগে-দুঃখে বসে বসে কাঁদছে।
এসব ভাবতে ভাবতে তার চোখে তন্দ্রা নামে। জুলফিকারের নাক ডাকার শব্দে তন্দ্রাটা হঠাৎ কেটে যায়। আবার চাগিয়ে ওঠে পঙ্ক্তিগুলো, চোখে আবার ভেসে ওঠে হার্মাদদের ভয়ংকর মূর্তিগুলো, পাল্লা দিয়ে আবার বাড়তে শুরু করে উদ্বেগ। সে কৈশোরের রঙিন স্মৃতিগুলো জাগিয়ে তোলে। স্মৃতির সমুদ্রে সাঁতার কাটতে কাটতে সমস্ত উদ্বেগ মন থেকে ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করে। কিন্তু পারে না। পঙ্ক্তিগুলো মাথা থেকে কিছুতেই সরে না। ঢাকা শহরের অসহনীয় যানজট, যাত্রীদের দুর্ভোগ, বন্ধুদের মুখ, লাবণীর মোহনীয় চোখ কল্পনা করে, তবু সরে না। সাহিত্য ও দর্শনের জটিল সব তত্ত্ব নিয়ে ভাবে, তবু না। সব স্মৃতি, সব মুখ, সব চোখ এবং সব তত্ত্ব ছাপিয়ে পঙ্ক্তিগুলো মাথার ভেতর কেবলই ঘুরতে থাকে। ঘূর্ণায়মাণ পঙ্ক্তিগুলোর ফাঁকে ফাঁকে বেনোস্রোতে ভাসা লতাগুল্মের মতো ভেসে ওঠে ইতিহাসস্নাত কাঠের মস্ত নৌকা, বিশাল গলুই, উড়ন্ত পাল, লাল নিশান, কোমরের খাপে তলোয়ার গোঁজা একদল হার্মাদ, নৌকার অন্ধকার খোলে বন্দি শত শত মানুষের আর্তনাদ, ভাত ভাত বলে কাতরকণ্ঠের চেঁচানি, একটু জল দাও গো ভাই একটু জল – কার যেন আহাজারি। ডেকের ছাদে পায়ের আওয়াজ, মুহূর্তে খোলের ঢাকনাটা খুলে যায়, ছরছর শব্দে কে যেন পেশাব করে, মারাত্মক দুর্গন্ধ, অন্ধকার খোলে একটা লাশ, পাশে ভেদবমি, রক্ত, মল, পেশাবের গন্ধ আর লাশের গন্ধ একাকার, এক মুঠো ভাতের জন্য ক্ষুধার্ত বন্দিদের হাহাকার, ঢাকনাটা আবার খুলে যায়, কিছু চাল পড়ে ওপর থেকে, হাঁস-মুরগির মতো বন্দিরা হুমড়ি খেয়ে কুড়াতে থাকে, কারো ভাগে এক মুঠো, কারো ভাগে আধমুঠো, চাল চিবানোর কুরকুর শব্দ, লাশটার গন্ধ তীব্র হয়ে ওঠে, কেউ একজন চিৎকার করছে ভয়ে, ঢাকনাটা আবারো খুলে যায়, দুটি ছায়ামূর্তি নামে, লাশটা টেনে ওপরে তোলে, গলুইর কাছে নিয়ে দোলনার মতো দুলিয়ে নোনাজলে নিক্ষেপ করে।
শোয়া থেকে হুড়মুড়িয়ে উঠে বসে কমল। সারাশরীর ঘামে ভিজে গেছে। ভয় পাচ্ছে ভীষণ, বুকের ভেতর হামানদিস্তার ঘা পড়ছে, কেমন শীত শীত লাগছে, শরীরের রোমগুলো দাঁড়িয়ে যাচ্ছে বারবার, কানের কাছটায় শোঁ-শোঁ করছে। জ্বর উঠল নাকি! এতক্ষণ কি জ্বরের ঘোরে ছিল? জ্বরের ঘোরে কোনো দুঃস্বপ্ন দেখল? অন্ধকারে হাতড়ে পায়ের কাছে দীপঙ্করের উপস্থিতি নিশ্চিত করে নিচু গলায় ডাক দেয়, দীপঙ্কর!
সাড়া নেই।
এই দীপঙ্কর!
তবু সাড়া নেই।
বেকায়দায় শুয়ে থাকতে থাকতে ডান পায়ে ঝিঁ-ঝিঁ ধরে গেছে তার। পা দুটো সোজা করার চেষ্টা করে, কিন্তু পারে না। কীভাবে পারবে? ডানে-বাঁয়ে মানুষ, সামনে পেছনেও মানুষ। চারদিকে মানবপ্রাচীর। ভ্যাপসা গরম, তার ওপর মানুষের গরম নিশ্বাস। ঘামের গন্ধে নিশ্বাস নেওয়া দায়। পাদের গন্ধ তো আছেই। কতক্ষণ পরপরই টোস-টাস শব্দ। গন্ধটা দূর হতে কয়েক মিনিট লেগে যায়। ছাদের ফোকরগুলো দিয়ে তো বাতাস ঢুকছে না, গন্ধটা পাক খেয়ে ফোকর পর্যন্ত পৌঁছতে সময় লাগে। তার ওপর নাকডাকার শব্দ। অন্যদের যেমন-তেমন, ঠিক মোটরবাইকের শব্দে নাক ডাকছে জুলফিকার। বদ্ধ হেজে শব্দটা দ্বিগুণ শোনায়। দুবার তাকে ধাক্কা মেরে জাগিয়ে দিয়েছে। কিছুক্ষণ বন্ধ থাকল, তারপর আবার শুরু হলো খর খর… হিস… খর খর… হিস। বিরক্তি চরমে ওঠে তার। এ কেমন বদভ্যাস মানুষের! এত জোরে কেউ নাক ডাকে? সে আবারো তাকে ধাক্কা মারে। জুলফিকার নড়েচড়ে ওঠে, কয়েক মিনিট বিরতি দিয়ে যথারীতি আবার শুরু করে। কানের ফুটোয় দু-হাতের তর্জনী ঢুকিয়ে সে আবার ঘুমানোর চেষ্টা করে। একটা শোঁ-শোঁ শব্দ টের পায় হঠাৎ। যেন বৃষ্টির শব্দ। নাকি তুফানের? বাইরে কি তুফান হচ্ছে? কিন্তু এখন তো ঝড়-তুফানের মৌসুম নয়। সবে তো ফাল্গুন, সমুদ্র এখন শান্ত। শব্দটা তবে কিসের? অন্ধকারে হাতড়ে ঝিঁ-ঝি ধরা পা-টা টানতে টানতে ওপরে ওঠার সিঁড়ির কাছে এসে টের পায় জাহাজটি চলছে। ছাদের ফোকর দিয়ে আলো ঢুকছে ভেতরে। ভোরের পবিত্র আলো।

তিন

পরাণের লালছ নাই রে বড়ই জাহিল
সাইগরে লড়িতে তারা না হয় কাহিল ॥

জাহাজটি চলতে থাকুক। রাশি রাশি ঢেউ ভাঙতে ভাঙতে গন্তব্যের দিকে উজিয়ে যাক। সিতারাবানু এখন অন্য বৃত্তান্ত বলতে চায়। সেন্টমার্টিন দ্বীপের দক্ষিণে গভীর সমুদ্র থেকে সাড়ে সাত হাজার যাত্রী নিয়ে ছেড়ে যাওয়া আটটি ট্রলার ও দুটি কোস্টার জাহাজের বৃত্তান্ত সে এড়িয়ে গিয়েছিল। এখন তার মতি ফিরেছে। এখন সে বহরের একটি ট্রলারের বৃত্তান্ত বলতে চায়। অতএব লেখকও তাই লিখতে চায়। কেননা তার মতির ওপর নির্ভর করছে এই বৃত্তান্তের গতি। সে জানাচ্ছে, বহরের সবকটি ট্রলার ও জাহাজের গন্তব্য ছিল থাইল্যান্ড উপকূল। যাত্রীদের মধ্যে ছিল বাঙালি ও রোহিঙ্গা। মালয়যাত্রার কারণও সবার একই। যে-কারণ ওসমানের, যে-কারণ জুলফিকারের, তালেব, দীপঙ্কর, কমল এবং সাউথ বেঙ্গল ৩-এর সব যাত্রীর। যাত্রাপথে তাদের দুর্ভোগও ছিল একই। ক্ষুধা-তৃষ্ণায় তারাও ছিল কাতর। যাত্রার শুরুতে প্রতিটি ট্রলারে দু-একজন যাত্রীকে প্রায় বিনা দোষে হত্যা করা হয়। কাউকে চাবুক দিয়ে পিটিয়ে, কাউকে গুলি করে, হাত-পা বেঁধে কাউকে সাগরে ফেলে দিয়ে।
টানা আট দিন আট রাত চলার পর সাতটি ট্রলার ও দুটি জাহাজ ঠিকঠাকমতো থাইল্যান্ড উপকূলে পৌঁছে। পৌঁছল না শুধু একটি ট্রলার, এমভি পাইলিন, যেটির পেছন দিকটায় দোতলা কেবিন, মাঝখানের পাটাতনে গাদাগাদি করে রাখা একশ আটাত্তরজন আদম। যাত্রার শুরুতে তারাও যথারীতি মুখোমুখি হয় দুর্যোগের, যে-দুর্যোগ মানবসৃষ্ট, মাঝিদের যদি মানব বলা যায়। তাদের মানুষ হিসেবে গণ্য করতে সিতারাবানুর ঘোর আপত্তি। মানুষের মনে বোধ থাকে, ভয় থাকে, দয়া থাকে, মায়া থাকে, স্নেহ আর ভালোবাসা থাকে। তাদের মনে এসবের কিচ্ছু নেই। তারা হাসতে জানে না, সুন্দর করে কথা বলতে জানে না, পাজুবান অংকাচোতেফান ছাড়া আর কাউকে ভয় করে না, যাত্রীদের তারা কেনাবেচার পণ্য ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারে না। দেখতে তারা মানুষের মতো, কিন্তু অন্তরটা দানবের।
এমভি পাইলিনের যাত্রীদের মধ্যে ভাগ্যান্বেষী বাঙালি ছিল সাতান্নজন, বাকিরা বাস্তুত্যাগী রোহিঙ্গা। যাত্রার প্রথম দিন বিকেলে এক বাঙালি যাত্রীকে, যে কিনা মায়ের গয়না বেচে আর ধানিজমি বন্ধক দিয়ে দেড় লাখ টাকা ব্যয় করে বুকভরা স্বপ্ন নিয়ে মালয়যাত্রা করেছে, পাটাতনে ফেলে রাবারের চাবুক দিয়ে মারতে শুরু করল মাঝিরা। প্রতিটি আঘাত বাইন মাছের মতো ফুলে উঠছিল তার শরীরে। নাক থেকে, কান থেকে, ঠোঁট এবং পিঠ থেকে অঝোর ধারায় রক্ত গড়িয়ে পড়ছিল। প্রতিটি আঘাত তাকে সাত হাত মাটির নিচে দাবিয়ে দিচ্ছিল। মুখ ফুটে একটিবার বলার সুযোগ পাচ্ছিল না, আমার কী অপরাধ? কোন অপরাধে এভাবে মারা হচ্ছে আমাকে?
অপরাধ আসলে কী, যাত্রীদেরও অজানা। তেমন কোনো অপরাধ তো সে করেনি। সকালে সমুদ্রের বিশালতা আর এটুকু ট্রলারে এত মানুষের ভিড় দেখে খুব ঘাবড়ে গিয়েছিল বেচারা। মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছিল ভয়ে। বারবারই বলছিল, এতো লোক তোলা ঠিক হয়নি, যে কোনো মুহূর্তে ট্রলারটা ডুবে যেতে পারে। যাত্রীদের নড়াচড়ায় ট্রলারটি দুলছিল খুব। মাঝিরা তখন লাঠি হাতে বারবার হুঁশিয়ার করছিল, সাবধান, একদম নড়বে না কেউ, যে যেখানে আছ চুপ করে বসে থাক। সে তখন প্রতিবাদ করল, আশ্চর্য! আটার বস্তা নাকি আমরা? এক জায়গায় কতক্ষণ বসে থাকা যায়? তার কথা মাঝিরা শুনতে পেলেও কিছু বলেনি। দুপুরে ভাতের বদলে এক মুঠো ভেজা ছোলা খেতে দেওয়ায় আবারো সে প্রতিবাদ করল, আমরা কি ঘোড়া?
হয়তো এই ছিল তার অপরাধ, একে অপরাধ যদি আদৌ বলা যায়। তখনই তার ওপর চড়াও হয় মাঝিরা। বিনা দোষে তাকে মারছিল বলে বাধা দিতে গিয়েছিল এক রোহিঙ্গা যুবক। মাঝিদের ধমক দিয়ে বলেছিল, আশ্চর্য! মানুষটা তো মরে যাচ্ছে! কেন মারছেন তাকে? মাঝিরা এবার চড়াও হলো তার ওপর। পিঠে চাবুকের কয়েকটা চবকানি দিয়ে বলল, তুই কে রে শালা? মারব কাটব, ইচ্ছে হলে সাগরে জ্যান্ত ভাসিয়ে দেব, তোর সমস্যা কী? এই শালা তোর বাপ লাগে? তোর এত দরদ কেন?
ধমক খেয়ে সরে আসতে চেয়েছিল যুবক, অথচ সরতে তাকে দিলো না, গেঞ্জির কলার ধরে টানতে টানতে কেবিনের ছাদে নিয়ে গেল। রড দিয়ে পিটিয়ে মাজা ভেঙে সুতলি দিয়ে হাত-পা বেঁধে সাগরে ফেলে দিলো। যেন সে মানুষ নয়, একটা কুকুর। ঘেউ-ঘেউ অসহ্য ঠেকছিল বলে উপযুক্ত শাস্তিটি দিয়েছে। তার এই নির্মম পরিণতি দেখে বাকিরা কি আর টুঁ শব্দটি করার সাহস পায়? ট্রলারজুড়ে অদ্ভুত নৈঃশব্দ্য নামে। চাবুকের আঘাতে রক্তাক্ত লোকটি নৈঃশব্দ্যকে আরো গভীর করে তোলে। প্রায় তিন ঘণ্টা বেহুঁশ পড়ে থেকে হুঁশে এসে যখন ‘পানি পানি’ বলে কাতরাচ্ছিল আবার তাকে চাবকাতে শুরু করল মাঝিরা। মারতে মারতে অজ্ঞান করে পাটাতনের এক কোনায় ফেলে রাখল। পৃথিবীতে সন্ধ্যা নামল, তার হুঁশ ফিরল না। মধ্যরাত কেটে গেল, একটিবার চোখ মেলে তাকাল না। শেষরাতে হুঁশ ফিরেছিল, কিন্তু শোয়া থেকে উঠে বসার মতো শক্তি ছিল না, অস্ফুট স্বরে শুধু ‘পানি পানি’ বলে ককাচ্ছিল। কেউ তার ককানি শুনতে পেল না। কীভাবে পাবে? তখন তো রাত। মুখের সঙ্গে মুখ, ঘাড়ের সঙ্গে ঘাড়, পেটের সঙ্গে পেট আর পায়ের সঙ্গে পা লাগিয়ে সবাই তো তখন ঘুমে। যারা তার কাছাকাছি ছিল তারা হয়তো শুনতে পেয়েছে। শুনেও সায় দেয়নি। কেন দেবে? জীবনের মায়া কি নেই তাদের? তারা তো দেখেছে তুচ্ছ কারণে কীভাবে জলজ্যান্ত একজন মানুষকে হাত-পা বেঁধে সাগরে ফেলে দেওয়া হয়েছে। দোষ থাকুক বা না থাকুক, যার ওপর মাঝিরা নাখোশ, যাকে মারতে মারতে তারা জীবনের শেষ স্টেশনে ফেলে রেখেছে, তাকে সহযোগিতা করতে গেলে মাথার ওপর খড়্গ যে নামবে না তার তো কোনো নিশ্চয়তা নেই। মানবিক বোধ যাদের প্রখর, প্রাণের প্রতি যাদের মায়া বেশি, মানবতার অপমান দেখে যাদের বুক কাঁপে, তারা শুধু নিঃশব্দে কেঁদেছে। মনে মনে মুমূর্ষু লোকটির উদ্দেশে বলেছে, আমরা অধম, কিছুই করতে পারছি না তোমার জন্য, আমাদের ক্ষমা করে দিয়ো ভাই।
পৃথিবীতে আবার ভোর নামল। জলে-স্থলে প্রাণেরা জাগল। যাত্রীরা জেগে দেখল লোকটা মরেনি। এখনো বুকের ওঠানামা হচ্ছে, ‘পানি পানি’ বলে এখনো ককাচ্ছে। জ্বরের তীব্রতায় একেকবার কেঁপে কেঁপে উঠছে। গোপনে এক বাঙালি কোথা থেকে এক মগ পানি এনে খেতে দিলো। ঢোক গিলতে পারছিল না সে। বহু কষ্টে এক ঢোক গিলে ফুলে যাওয়া চোখ দুটো মেলে উঠে বসার চেষ্টা করল। পারল না। অস্ফুট আর্তনাদ করে পড়ে গেল। মাথাটা চেপে ধরে ‘মা মা’ বলে ককাতে লাগল। তার ক্রমাগত ‘মা মা’ ডাক বেদনার একটা আবহ তৈরি করল ট্রলার জুড়ে। যাত্রীদের কেউ কেউ মুখ চেপে ধরে গোপনে কাঁদে। সবাই তার জন্য মনে মনে প্রার্থনা করে, তুমি প্রাণের মালিক মাবুদ, জীবন-মৃত্যুর চাবি তোমার হাতে।
হ্যাঁ, জীবন-মৃত্যুর চাবি তাঁর হাতেই বটে। নইলে মাঝিরা যখন ছুরি দিয়ে মুমূর্ষু লোকটার পেট চিরে সাগরে ফেলে দিচ্ছিল তখন তাদের হাতগুলো তিনি অবশ করে দিতে পারতেন না? তিনি তো সর্বশক্তিমান। তাঁর তো সবই পারার কথা। কিন্তু তা তো করলেন না। সুতরাং, যাত্রীরা ভাবে, এই মৃত্যুর পেছনে নিশ্চয়ই তাঁর হাত আছে। আগেই তিনি ঠিক করে রেখেছেন অপঘাতেই লোকটার মৃত্যু হবে। মৃত্যুর বিভীষিকা দেখে কেউ চোখ ঢাকল, ভয়ে যেন হুঁশ না হারায়। কেউ বুক খামচে ধরল, হৃদকম্পন যেন থমকে না যায়। কেউ মুখ চেপে ধরল, ভয়ার্ত স্বরটা যেন বেরিয়ে না যায়।
যাত্রীদের মন থেকে দুটি হত্যাকা-ের বিভীষিকা মোছার আগেই তৃতীয় দিন শুরু হলো ডায়রিয়ার প্রকোপ। প্রথমে একজন, তারপর দুজন, তারপর আটজন, তারপর কুড়িজন। আক্রান্তের সংখ্যা পাল্লা দিয়ে বাড়তে লাগল। চতুর্থ দিন আক্রান্ত হলো অর্ধেকেরও বেশি যাত্রী। কী করে মাঝিরা? ডায়রিয়া সংক্রামক ব্যাধি, তাদের মধ্যেও তো সংক্রমিত হতে পারে। উপায় কিছু খুঁজে পায় না তারা। আক্রান্তদের এক মগ করে গুড়-লবণের শরবত খেতে দিলো। তাতে কি আর এই মহামারির উপশম হয়? ধীরে ধীরে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে লাগল। ঘণ্টায় ঘণ্টায় টয়লেটে যেতে যেতে তারা কাহিল হয়ে পড়ল। আটজনের অবস্থা এতই নাজুক, দাঁড়ানোর শক্তিও
থাকল না। সারাদিন তারা মড়ার মতো পড়ে থাকল। রাতে ঠোঙায় ভরে ভাত খেতে দেওয়া হলো, তাদের মুখে রুচল না। আতঙ্কে রাতে ঘুমাতেও পারল না। পরদিন আর কথা বলার শক্তিও থাকল না। মাঝিরা তখন তাদের কর্তব্য সম্পাদনের উদ্যোগ নিল। জ্যান্ত মানুষগুলোকে ধরে ধরে প্রকাশ্যে তারা সাগরে ফেলে দিতে লাগল। নিষ্ঠুরতার চূড়ান্ত প্রকাশ দেখে দিশা খুঁজে পায় না যাত্রীরা। কী করবে, কী করা উচিত কিছুই বুঝতে পারে না। ভয় তাদের এতোটাই কাবু করে ফেলল মাঝিদের পায়ে পড়ে মিনতি করবে সেই সাহসটুকুও করে উঠতে পারে না।
প্রবাদ, গোবরেও পদ্মফুল ফোটে। কাপুরুষের ভিড়ে বীরপুরুষও থাকে। যেমন ছিল জোবায়ের শিবলি। লম্বা-চওড়া বাঙালি যুবক। খালি পা, পরনে জিন্সের প্যান্ট, গায়ে ফুলহাতা শার্ট। মুখের দিকে তাকালে পল্লিবাংলার বনেদি পরিবারের কথা মনে পড়ে যায়। বুক টান টান করে সে এগিয়ে গেল। হেড মাঝির হাতদুটো চেপে ধরে বলল, এমন নিষ্ঠুর হবেন না ভাই, এই মানুষগুলোর অভিশাপ লাগবে।
ঝাটকা মেরে হাত ছাড়িয়ে মাঝি ধমকে উঠল, এ্যাহ্! অভিশাপ। হিয়ালর দোয়ায় মুরগি মরে? একজনর লাই দশজন মরিব না?
মরতে মরতে তারা বেঁচেও তো যেতে পারে ভাই।
মরিবাল্লাই দিশা ন পার, আবার বাঁচা!
শিবলি আর কথা বাড়ায় না। ভয়ার্ত চোখে ভাসমান মানুষগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে। কেউ তলিয়ে গেছে, কেউ ঢেউয়ের সঙ্গে আবার ভেসে উঠছে, কেউ হাবুডুবু খাচ্ছে, ঢেউয়ের সঙ্গে লড়তে লড়তে কেউ বাঁচার জন্য আর্তনাদ করছে। তার মনে হয় না সে বাস্তব দুনিয়ায় আছে। পথ ভুল করে যেন অন্য দুনিয়ায় এসে পড়েছে। মাথাটা ঘুরতে থাকে ভীষণ। আকাশ এবং আকাশের সূর্য, সমুদ্র এবং সমুদ্রের ঢেউ, ট্রলার এবং পাটাতনের যাত্রীরা তার চোখের সামনে ঘুরতে থাকে।
টানা সাত দিন সাত রাত চলার পর, সমুদ্রে যখন ভরাকটালের উত্তাল জোয়ার, গর্ভে সঞ্চিত সমস্ত রশ্মি যখন ঢেলে দিচ্ছিল পূর্ণিমার মনোহর চাঁদ, গভীর সমুদ্রে নোঙর ফেলল ট্রলারটি। যাত্রীরা আনন্দে হই-হুল্লোড় শুরু করে দিলো। নিশ্চয়ই গন্তব্যে পৌঁছে গেছে ট্রলার। নইলে নোঙর ফেলল কেন? আহা, দুর্ভোগের অবসান হলো তবে! বুকভরা স্বস্তি আর চোখভরা স্বপ্ন নিয়ে সুখজাগানিয়া গপ মারতে মারতে সবাই ঘুমিয়ে পড়ল। কিন্তু যখন ভোর হলো, কুয়াশার পর্দাটা যখন ধীরে ধীরে অপসৃত হলো, সমস্ত আনন্দ তাদের মুহূর্তে নিকেশ হয়ে গেল। কোথাও স্থল বলতে কিছু দেখতে পায় না, চারদিকে শুধু জল আর জল, ঢেউ আর ঢেউ। এই গভীর সমুদ্রে মাঝিরা কেন নোঙর ফেলল কেউ কিছু বুঝতে পারে না। নানাজন নানা কথা বলতে লাগল। কেউ বলল, থাইল্যান্ড হয়তো আর বেশি দূরে নয়, লাইন ক্লিয়ার আছে কিনা মাঝিরা হয়তো খোঁজখবর নিচ্ছে। কেউ বলল, এতোগুলো মানুষ নিয়ে ট্রলারটি ঘাটে ভিড়লে হয়তো সমস্যা হবে, ঘাট থেকে ছোট নৌকা এসে হয়তো দশ-বারোজন করে তুলে নিয়ে যাবে। কেউ বলল, ইঞ্জিন নষ্ট হয়ে গেছে, আর কেউ বলল, ডিজেল ফুরিয়ে গেছে।
নানাজনের নানা কথার ফাঁক গলিয়ে দিনের সূর্য অস্ত গেল, ট্রলারটি নোঙর তুলল না। সারারাত কেটে গেল, তবু না। ভোরে যাত্রীরা অধৈর্য হয়ে হইচই শুরু করে দিলো, কী ব্যাপার? ট্রলার ছাড়বে কখন? এখানে আর কদিন? মাঝিদের মুখে তালা। চেহারা দেখে মনে হয় না কিছু শুনতে পাচ্ছে। যেন তারা বধির। কানের কাছে ঢোল পেটালেও শুনতে পাবে না। কিন্তু কতক্ষণ আর সওয়া যায় কানে? হই-হুল্লোড়ে অতিষ্ঠ হয়ে হেড মাঝি শেষমেশ বলেই ফেলল আসল কথাটা, ট্রলার আর ন যাইবো।
আশ্চর্য! যাবে না মানে কী?
বাংলা কথা বোঝ না মিয়ারা? ন যাইবো মানে ন যাইবো। বুইঝ্ঝনে এবার?
এটা কেমন কথা! এখানে থেমে থাকবে নাকি?
না, ন থামিবো। এডে ডুবাই দিয়ুম দে।
মানে?
কিচ্ছু গরার নাই, মালিকর হুকুম।
কিসের মালিক? কোথাকার মালিক?
ট্রলারর মালিক।
মাঝির কথার মাথামু-ু কিছু বুঝতে পারে না কেউ। বুঝলেও বিশ্বাস করতে পারে না। এতোগুলো মানুষসুদ্ধ ট্রলারটি ডুবিয়ে দেবে, এ কি বিশ্বাস করার মতো কথা? নিশ্চয়ই মাথা খারাপ হয়ে গেছে লোকটার। নইলে কেউ এমন আবোলতাবোল বকে? যাত্রীদের শোরগোল থামে না, পাল্লা দিয়ে বরং বাড়তে থাকে। হেড মাঝির উদ্দেশে গালিও দিতে লাগল কেউ কেউ। মাঝি নির্বিকার। মুখে কেউ থুতু দিলেও যেন চোখটি তুলে তাকাবে না। তার নির্বিকারত্ব যাত্রীদের শঙ্কা আরো বাড়িয়ে তোলে। কেউ তাকে গালি দেবে আর সে চুপচাপ হজম করবে, এমন ভালোমানুষ তো সে নয়। তবে কি সে সত্যি বলেছে? ট্রলারটি সত্যি সত্যি ডুবিয়ে দেওয়া হবে?
শিবলি একা তার সঙ্গে দেখা করতে কেবিনে উঠল। মাঝি বসে বসে বিড়ি ফুঁকছে। চেহারায় বিমর্ষতা। বড় কোনো দুর্ঘটনার অভিঘাতে মানুষের চেহারা যেমন দেখায়। শিবলি জানতে চাইল, কী ব্যাপার বলুন তো, ট্রলার কি সত্যি সত্যি যাবে না?
ন যাইবো। মাঝির সেই একই উত্তর।
কিন্তু এখানে তো আর থেমে থাকবে না, কোথাও না কোথাও তো নিশ্চয়ই যাবে।
খনমিক্কা ন যাইবো, এডে ডুবাই দিয়্যুম দে।
কিন্তু কেন?
মালিকর হুকুম।
আশ্চর্য! মালিক বললেই আপনারা এমন একটা জঘন্য কাজ করবেন? দিলে কি দয়া-মায়া নাই আপনাদের?
কিচ্ছু গরার নাই, আঁরা তার গোলাম।
শিবলি চুপ করে থাকে। মাঝির চোখ দেখে তার মনের কথা বোঝার চেষ্টা করে। লোকটা সত্যি বলছে, নাকি গোপন কোনো মতলব আছে তার? যত যাই বলুক, মতলব তো কিছু একটা আছে নিশ্চয়ই। যাত্রীদের ভয় দেখিয়ে হয়তো টাকা-পয়সা খসানোর ধান্ধা করছে। নইলে এতগুলো মানুষকে সাগরে ডুবিয়ে মারা কি সহজ কথা! মরণের ভয় কি নেই তার? মতলবটা খুঁড়ে বের করতে সে মাঝির পেছনে আঠার মতো লেগে গেল। মাঝি তো বলবেই না। শিবলিও নাছোড়। মাঝি তাকে যতই হুমকি-ধমকি দেয় সে গায়ে মাখে না। তার একটাই কথা, ট্রলার কেন যাবে না খোলাসা করে বলতে হবে। আমরা ডুবে মরতে রাজি, কিন্তু মৃত্যুর কারণ না জেনে কেউ মরব না। দরকার হলে লড়াই করে মরব।
হয়তো বিরক্তিতে অথবা ভয়ে মাঝি এবার কিছুটা নরম হলো। ট্রলার ডুবিয়ে দেওয়ার কারণ হিসেবে যা জানাল তার সংক্ষিপ্তসার এই, মতলব-টতলব আসলে কিছু নয়, মানবপাচারের অভিযোগে ট্রলার মালিকের বিরুদ্ধে মামলা করেছে থাইল্যান্ডের পুলিশ। অন্য এক মালিকের আদমভর্তি একটি ট্রলার পুলিশ ইতোমধ্যেই আটক করেছে। থাইল্যান্ড গেলে এটিকেও আটকাবে। তাতে তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ সত্য প্রমাণিত হবে। সুতরাং তার বাঁচার পথ একটাই, ট্রলারটি গভীর সমুদ্রে ডুবিয়ে দেওয়া। তাতে সাক্ষী-প্রমাণ কিছু পাবে না পুলিশ। সাক্ষী-প্রমাণ নেই তো মামলা খারিজ।
কথাটা এবার অবিশ্বাস হলো না শিবলির। অন্যরাও বিশ্বাস না করে পারল না। এমন সর্বনাশা কথা শুনে মাথা কি আর ঠিক থাকে কারো? কান্নাকাটির রোল পড়ে গেল ট্রলার জুড়ে। মৃত্যুর পদধ্বনি শুনতে পায় যাত্রীরা। দূর সমুদ্রে তর্জন-গর্জন করছে আজরাইল। মৃত্যুর পরোয়ানা হাতে নিয়ে সমুদ্রের জল দুভাগ করে ঢেউয়ের পিঠে চড়ে সে আসছে। ভয়ংকর থাবায় একশ আটষট্টি যাত্রীকে নিমেষে টেনে নেবে তার অতলান্ত গহ্বরে। কোথাও বাঁচার কোনো পথ খুঁজে পায় না কেউ। পাখি হলে উড়াল দিত, মাছ হলে সাঁতার দিত। তারা মানুষ। শাস্ত্রপ্রোক্ত আশরাফুল মাখলুকাত। সৃষ্টির সেরা জীব। অথচ কি আশ্চর্য, সমুদ্রের এই বেশুমার জলের কাছে তারা কতই না অসহায়! ডাঙায় যেমন মাছেরা, খাঁচায় যেমন পাখিরা।
মানসিক চাপ সইতে না পেরে অজ্ঞান হয়ে পড়ল অন্তত তেরোজন যাত্রী। হওয়ারই কথা। মানুষ জানে না কবে কখন কোথায় তার মৃত্যু হবে। জানে না বলেই বেঁচে থাকাটা এতো সুন্দর, এতো আনন্দের। জানলে জীবনটা তার বিষাদে ভরে উঠত, যে বিষাদে ভরে উঠেছে একশ আটষট্টি আদমের জীবন। তারা জেনেছে, মৃত্যু তাদের সন্নিকটে। যে-কোনো মুহূর্তে তারা মরে যাবে। জেনেছে বলেই চূড়ান্ত মৃত্যুর আগে তারা মরে যাচ্ছে, মস্তিষ্ক তাদের ধীরে ধীরে বিকল হয়ে যাচ্ছে। অতল সমুদ্রে তারা নিজেদের নিষ্প্রাণ দেহটি দেখতে পাচ্ছে। দেখতে পাচ্ছে বলেই তারা অজ্ঞান হয়ে পড়ছে। তাদের জ্ঞান ফেরানোর জন্য বাকিদের চেষ্টার অন্ত থাকে না। হাত ঘষে, পা ঘষে, চোখে-মুখে জলের ছিটা দেয়। এসব করে দুজনের হুঁশ ফেরানো গেলেও বাকিদের গেল না। হুঁশ তাদের ফিরবে না কোনোদিন। নিজেদের নিষ্প্রাণ দেহ দেখে মস্তিষ্কে তাদের রক্তক্ষরণ শুরু হয়ে গেছে। তারা মরে গেছে টের পেয়ে মাঝিরা এলো, ধরাধরি করে তাদের লাশ সাগরে ফেলে দিলো। কেউ একবারও বলল না, মরবে তো সবাই, এদের আর আলাদা করে ফেলে দেওয়ার কী দরকার।
সারাদিন কান্নাকাটি করল যাত্রীরা, মাঝিদের হৃদয় এমনই পাষাণ, এতোটুকুও গলল না। যাত্রীরা যতই মিনতি করে, ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে তাদের একই জবাব কিচ্ছু করার নাই আমাদের। যতবারই বলে ততবারই যাত্রীদের বুকে হাতুড়ির ঘা পড়ে, বুকটা ভেঙেচুরে যেতে চায়, ভয়ের তীব্রতায় রক্তনালিতে বাঁধ পড়ে যায়। তখন মাথাটাও আর কাজ করে না, ফলে কিছু ভাবতেও পারে না। চোখও আর কাজ করে না, ফলে কিছু দেখতেও পায় না। দেখে শুধু ঘোর অন্ধকার।
উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে রাত পুইয়ে ভোর হলো। দুশ্চিন্তার চাপে রাতে মারা পড়ল আরো দুই যাত্রী। মরার জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে আরো কয়েকজন। শেষবারের মতো হেড মাঝির সঙ্গে কথা বলতে আবার তার কামরায় গেল শিবলি। মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করতে করতে সে ক্লান্ত। ট্রলারটি সত্যি যদি ডুবাতে হয় ডুবিয়ে দিক না। দেরি করছে কেন? অপেক্ষার মতো কষ্টের আর কিছু হয় না। অপেক্ষা তাও মৃত্যুর জন্য। এই দুঃসহ অপেক্ষার চেয়ে মরে যাওয়া অনেক ভালো। মাঝির সামনে দাঁড়িয়ে ভয়ভীতি উপেক্ষা করে সে স্পষ্ট ভাষায় বলল, ট্রলার হয় ডুবিয়ে দিন, নয় আমাদের খেতে দিন।
মাঝি তার দিকে তাকায় না। কথাটি সে আবারো বলে, আরো জোরে, আরো স্পষ্ট ভাষায়। মাঝি তবু তাকায় না, জবাব দেওয়ার কোনো প্রয়োজন বোধ করে না। একটার পর একটা বিড়ি ধরায় আর ফোঁস ফোঁস করে ধোঁয়া ছাড়ে। হাত দুটো বুকে মুড়ে তার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে শিবলি। আগের বলা কথাটি যখন সে তৃতীয়বারের মতো বলতে যাচ্ছিল তার দিকে ফিরে খেঁকিয়ে উঠল মাঝি, চুপ গরিবিনে বাইঞ্চোত? শিবলি চুপ করে না, সে আবারো কথাটির পুনরাবৃত্তি করল। মাঝি তাকে বেরিয়ে যেতে বলল, সে নড়ল না। মাঝি তাকে ধমক দিলো, সে পাত্তা দিলো না। মাঝির বিড়ি টানা শেষ হলে সে বলল, আমাদের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলার অধিকার আপনাদের কে দিয়েছে? মাঝি চোখ পাকিয়ে তার দিকে তাকায়। সাহস দেখে অবাক হয়। মুখে কোনো কথা না বলে উঠে দরজার কাছ থেকে চাবুকটা এনে শিবলির মুখোমুখি দাঁড়ায়। শিবলির চোখে তখন সেদিনের সেই আহত লোকটার মুখ ভেসে উঠল, চাবকাতে চাবকাতে যাকে মেরে ফেলেছিল নিষ্ঠুর মাঝিরা। লোকটির মুখে বিদ্রƒপের হাসি। সেই হাসির অর্থ এই, আমি না হয় দুর্বল। আমি না হয় মেরুদ-হীনের মতো পড়ে পড়ে মার খেয়েছি। মার খেতে খেতে মরে গেছি। তোমার কি মেরুদ- নেই? তুমি কি না-পুরুষ?
চাবুক দেখে এক পা সরে দাঁড়িয়েছিল শিবলি। হয়তো ফিরে যেতে চেয়েছিল। হঠাৎ ঘুরে দাঁড়াল। এক ঝাটকায় চাবুকটা কেড়ে নিল মাঝির হাত থেকে। তুড়ি বাজিয়ে আঙুল উঁচিয়ে কঠিন ভাষায় হুশিয়ারি দিলো, মৃত্যুকে আমি কেয়ার করি না মাঝি। মরব। তবে একা নয়, সঙ্গে তোদেরও নেব শালারা!
মাঝিকে আর কে থামায়। টানা সাত বছর ধরে এই ট্রলারে চড়িয়ে কতশত আদম সে মালয়েশিয়া পাচার করেছে, কত আদমের রক্তে হাত লাল করেছে, কত আদম তার সামনে দাঁড়িয়ে হেগে-মুতে কাপড় নষ্ট করে ফেলেছে কখনো কেউ তাকে হুমকি দেওয়া তো দূরে থাক, সামনে দাঁড়িয়ে চোখ তুলে কথা বলারও সাহস করেনি। কী দুঃসাহস এই যুবকের, তার হাত থেকে কিনা চাবুক কেড়ে নিয়ে উলটো তাকে শাসাচ্ছে! মেজাজ কি আর টেনে ধরে রাখতে পারে? শিবলির চোয়াল বরাবর প্রচ- একটা ঘুষি মেরে সে কুঁদে উঠল, শুয়োরের পোয়া অডা তুই, চিনন নে তুই আঁরে?
শিবলিও পারত চাবুকের কয়েকটা ঘা বসিয়ে দিতে তার গায়ে। দিলো না। কারণ তার আশার বাতিটা তখনো মিটিমিটি জ্বলছিল,
যে বাতির আলোয় সে বাঁচার পথ দেখতে পাচ্ছিল। শক্ত করে সে ধরে রাখল চাবুকটা। মাঝি তাকে ধাক্কাতে ধাক্কাতে কাঠের রেলিংয়ের কাছে নিয়ে এলো। হইচই শুনে ছুটে এলো বাকি চার মাঝি। শিবলিকে আর বাঁচায় কে। শুরু হলো তাকে নিয়ে টানাহেঁচড়া। শেয়ালের পাল মুরগি নিয়ে যেমন করে। একজন লাথি মারে তো একজন ঘুষি। আরেকজন লাঠি দিয়ে ঠেঙায়। সেও কম যায় না, হাতে ধরা চাবুকটা চালিয়ে যতটা পারে আত্মরক্ষা করতে থাকে। কিন্তু মানুষ তো সে একা, তাগড়া জোয়ান পাঁচ মাঝির সঙ্গে কী করে কুলিয়ে উঠবে। অগত্যা হাল ছেড়ে দিতে হয়। এক মাঝি হাত থেকে চাবুকটা কেড়ে নিয়ে মারতে মারতে তাকে পাটাতনে ফেলে গলাটা পায়ে চেপে ধরল। আরেকটু দেরি হলে হেড মাঝি ডেগারের তীক্ষè ডগাটা তার পেটে ঢুকিয়ে দিত। পারল না বাঙালি যাত্রীদের কারণে। ক্ষুধা-তৃষ্ণায় কাতর যে মানুষরা এতো দিন ধরে মাঝিদের কাছে নতজানু ছিল, চকচকে অস্ত্রটা দেখে অকস্মাৎ তারা বিদ্রোহে ফেটে পড়ল। তারাও যে মানুষ, তাদেরও যে হাত-পা আছে, চোখ-কান আছে, বিবেকবোধ আছে, তারাও যে বিদ্রোহে ফেটে পড়তে পারে, ইচ্ছা করলেই পাঁচ মাঝিকে নিমেষে খুন করে সাগরে ভাসিয়ে দিতে পারে বিবেক তাদের কানে কানে বলে গেল। মুহূর্ত দেরি না করে হইহই করে বুনো গয়ালের মতো তারা হেড মাঝির ওপর চড়াও হলো। ট্রলারটি দুলতে লাগল ভীষণ। কোথা থেকে কাঠের একটা চেলি কুড়িয়ে এনে মাঝির মাথায় প্রচ- একটা বাড়ি মারল একজন। আঘাতটা ফসকে মাঝির পিঠে পড়ল। ডেগারটা ছিটকে পড়ে গেল হাত থেকে। কুড়িয়ে নিল আরেকজন। ছুড়ে ফেলল সাগরে। কেবিনের আতিপাতি খুঁজে অস্ত্রশস্ত্র যা ছিল সব সাগরে ফেলে দিলো বিক্ষুব্ধ যাত্রীরা।
ইচ্ছা করলে মাঝিদের মেরে-কেটে তারা সাগরে ভাসিয়ে দিতে পারত। শিবলি থামিয়ে দিলো সবাইকে। মেরে ফেললে তো সমস্যার সমাধান হবে না। যে করেই হোক ট্রলারটি কূলে ভেড়ানো চাই। কূলটা হোক বাংলাদেশ, মিয়ানমার অথবা থাইল্যান্ডের। প্রাণ বাঁচানোর জন্য আপাতত ডাঙা দরকার। ডাঙা উত্তরে না দক্ষিণে, পুবে না পশ্চিমে কিছুই তো জানে না তারা। জানে কেবল মাঝিরা। কিন্তু এতো মার খেয়েও আগের সিদ্ধান্তেই তারা অটল, কূলে কিছুতেই ভেড়াতে পারবে না ট্রলার। ভেড়ালে তাদের খুন করে ফেলবে ট্রলারমালিক। হেড মাঝি হাত দুটো জোড় করে সবার উদ্দেশে বলল, ইয়াত্তোনারে ভালা অইবো দে, অ ভাই অক্কল, তোঁয়ারা আঁরারে মারি ফেলো।
কী করে যাত্রীরা? একজন যাত্রীও নেই ইঞ্জিনটা যে চালু করতে পারে, হালটা ধরতে জানে বা সমুদ্রের গতি-প্রকৃতি বোঝে। মাঝিদের জিম্মি করে ইঞ্জিন না হয় চালু করল, হালও না হয় ধরিয়ে রাখল। কিন্তু তারা ট্রলারটি ঠিক ঠিক বাংলাদেশ, মিয়ানমার বা থাইল্যান্ড উপকূলের দিকে নিয়ে যাবে তার কী নিশ্চয়তা? ট্রলারটি তো তারা আরো গভীর সমুদ্রের দিকেও নিয়ে যেতে পারে, যেখান থেকে জীবনে কোনোদিন কেউ আর ফিরতে পারবে না। ফলে স্থির কোনো সিদ্ধান্ত তারা নিতে পারে না, অলৌকিক সাহায্যের প্রত্যাশায় হাঁটু-মাথা এক করে বসে থাকে।
সেদিন সকালে তো নয়ই, দুপুরেও খাবার বলতে কেউ কিছু পেল না। তখন বিকেল। পশ্চিম আকাশে হেলানো সূর্য। সমুদ্র শান্ত। সীমাহীন ক্লান্তিতে অনেকে নিস্তেজ হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় যাদের চোখে ঘুম আসছিল না তারা বসে বসে ঝিমুচ্ছিল। কেউ টের পেল না ট্রলারের পেছনে কখন একটি ইঞ্জিননৌকা এসে ভিড়ল। টের পেল তখন, নৌকাটি যখন ট্রলার থেকে কয়েক হাত দূরে সরে গেছে। নৌকার পাটাতনে ট্রলারের হেড মাঝিসহ বাকি চারজন দাঁড়িয়ে। যাত্রীও আছে একজন, সম্পর্কে যে হায়দর আলীর ভাতিজা, যে সবসময় মাঝিদের কেবিনে থাকত, যাত্রীরা প্রথম প্রথম যাকে মাঝি বলেই ধারণা করেছিল।
বোঝার কিছু আর বাকি থাকল না কারো। ট্রলার জুড়ে শুরু হলো হুলস্থূল কা-। কয়েকজন ঝাঁপ দিলো সাগরে। সাঁতরে নৌকাটিতে ওঠার চেষ্টা করল। পারল না। কীভাবে পারবে? ঢেউয়ের সঙ্গে লড়ার মতো শক্তি তো থাকতে হবে। ট্রলারের অসহায় যাত্রীরা চিৎকার শুরু করে দিলো, সদ্যোজন্মা শিশুরা যেভাবে চিৎকার করে। কে শোনে তাদের চিৎকার। এই গভীর সমুদ্রে, যেখানে জল আর অসীম শূন্যতা ছাড়া কিছু নেই, শোনার মতো কে আছে। তাদের সমস্বরের চিৎকার ভয়ংকর নৈঃশব্দ্যের ইথারে হারিয়ে যায়।
সবার দৃষ্টি তো তখন দিগন্তে মিলিয়ে যাওয়া নৌকাটির দিকে। ফলে কেউ টের পেল না ট্রলারের খোল যে ভরে যাচ্ছে সর্বনাশা আদিম পদার্থে। পায়ের পাতায় নোনাজলের আছড়ে পড়া দেখে বুঝতে কারো বাকি থাকে না নূহের প্লাবন শুরু হয়ে গেছে তাদের পৃথিবীতে। বাইরের পৃথিবীতে তখনো সন্ধ্যা নামেনি, পশ্চিম দিগন্তে সূর্য তখনো সোনালি রোদ ছড়াচ্ছে। মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়ানো ডুবন্ত যাত্রীরা সূর্য দেখতে পায় না, রোদ দেখতে পায় না, সমুদ্রের বেশুমার জল দেখতে পায় না, আকাশের অসীম শূন্যতাও দেখতে পায় না। পৃথিবীর সব বস্তু ও অবস্তু একাকার হয়ে এমন এক অন্ধকার তৈরি করল, যা অমাবস্যার চেয়েও গাঢ়।
তারপর জোয়ার শুরু হলো সমুদ্রে। অস্থির, স্বেচ্ছাচারী, চির বহমান সমুদ্রের অথই জলে ট্রলারের মাস্তুলটিও যখন ডুবে যাচ্ছিল, সিতারাবানু খুব স্পষ্টভাবে খেয়াল করল, এক হাতে শক্ত করে একটা বয়া এবং অন্য হাতে মাস্তুলের মাথাটা জড়িয়ে ধরে লম্বা-চওড়া সেই বাঙালি যুবক, জোবায়ের শিবলি, ডুবন্ত সূর্যের দিকে ফিরে চিৎকার করে বলছিল, এই পুতুল খেলা তোমাকে মানায় না, তোমাকে মানায় না মাবুদ।
বনু আদমের তিরস্কারে হয়তো লজ্জা পেয়েছিলেন তার মাবুদ। অথবা লজ্জা তিনি পাননি। অলক্ষ্যে বসে আসলে দেখছিলেন কুদরতি ফুৎকারে মাটির পিঞ্জরে যে-প্রাণ তিনি সৃষ্টি করেছিলেন, যে-প্রাণকে তিনি তার প্রতিনিধি করে মাটির পৃথিবীতে পাঠিয়েছিলেন, তার শক্তি আসলে কতটুকু।
প্রাণের শক্তি অসীম বটে। বড় শক্ত মানুষের প্রাণ। নষ্ট না করলে সহজে নষ্ট হয় না। শত দুর্বিপাকেও টিকে থাকে। বয়াটা ধরে টানা তেরো ঘণ্টা মৃত্যুর অজস্র ফাঁদে ভরা অথই সমুদ্রে ভেসে থেকে শেষ পর্যন্ত টিকে গেল শিবলি। অন্ধকার রাতে ভেসে থাকতে থাকতে, মাছেদের ঠোকর এবং ভয়ের তাড়া খেতে খেতে মধ্যরাতে আকাশে চাঁদ উঠল। চিরায়ত আলোকখ-টি থেকে সে আর চোখ সরায় না। চাঁদটা তাকে বেঁচে থাকার প্রেরণা জোগায়। চোখে চোখ রেখে বলে, দেখ কত বিশাল এই ব্রহ্মা-, কত বিশাল এই আকাশ। দেখ চারদিকে কী অসীম শূন্যতা। আমার চারদিকে কতশত নক্ষত্র জেগে আছে, তবু দেখ আমি কী ভয়ংকর একা। এই নিঃসীম শূন্যতায় লাখো কোটি বছর ধরে আমি কি পরিভ্রমণ করছি না? এই সত্য জেনে রেখো, প্রকৃতির প্রতিটি প্রাণ শেষ পর্যন্ত একা। যেমন একা আমি, যেমন একা তুমি। অতএব একাকিত্বে ভয় কী তোমার? মনকে শক্ত করো। বলো তুমি মরবে না, বলো তুমি মরবে না, বলো তুমি মরবে না। বলো তুমি বাঁচবে, বলো তুমি বাঁচবে, বলো তুমি বাঁচবে। তোমার বুকটা ভরিয়ে দাও দুরন্ত সাহসে। দেখবে, সাহসই শেষ পর্যন্ত তোমাকে বাঁচিয়ে দেবে।
বুকটাতে বিপুল সাহস ভরিয়ে দিয়ে মৃত্যুকে থোড়াই কেয়ার করে প্রকৃতির সঙ্গে সে অদ্ভুত খেলায় মেতে উঠল। ঠান্ডায় শরীরটা জমে যাচ্ছিল, তবু জলজ প্রাণীদের মতো ভেসে থাকাটাকে সে উপভোগ করতে লাগল। যখনই তীব্র ভয় অক্টোপাসের মতো আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরছিল তখনই সে চোখ বন্ধ করে নিজেকে এ-কথা বলেছে, মরেই তো যাব, মরার আগে বরং দেখে যাই প্রকৃতির অপার লীলা। তার মন সাক্ষী দিচ্ছিল, আমি বেঁচে যাব। হৃদকম্পনের সঙ্গে বারবার এই কথাই ঘোষিত হচ্ছিল, আমি মরব না, আমি মরব না, আমি মরব না।
রাত পুইয়ে ভোর হলো, সে মরল না। চাঁদ চলে গেল আরেক পৃথিবীতে, সে মরল না। এই পৃথিবীতে সূর্য উঠল, সে মরল না। প্রাণের উচ্ছ্বাসে বিশ্বচরাচর জাগল, তবু সে মরল না। কুয়াশার রেখাটা দিগন্ত থেকে মুছে গেলে, সূর্যটা যখন মাথার ওপর উঠতে আর কিছুটা বাকি, হঠাৎ সে দেখতে পেল জাহাজের এক ধূসর মাস্তুল। ঢেউয়ের তালে তালে হেলছে, দুলছে। সে জোরে জোরে চিৎকার করতে থাকে, আমি মরব না… আমি মরব না… আমি মরব না। ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে জাহাজটি। বিপুল আনন্দে সে আরো জোরে চিৎকার করে ওঠে, আমি মরব না। বাতাসের উচ্চপ্রবাহ আর ঢেউয়ের উচ্ছল শব্দে চিৎকারটা চাপা পড়ে যায়। সে থামে না। জাহাজটি তার কাছাকাছি এলে সে আরো জোরে চিৎকার শুরু করে, আমি মরব না… আমি মরব না… আমি মরব না।
হঠাৎ জাহাজটা যখন মাত্র দু-হাত দূরে, সে দেখতে পেল, দেয়ানি হলের ওপর থেকে একটা কাছি নিচে নামছে। অসম্ভব প্রাণশক্তির জোরে, নিভে যাওয়ার আগে হয়তো প্রাণের শক্তিটা প্রচ-ভাবে জ্বলে উঠেছিল, কাছিটা বেয়ে সে জাহাজে উঠে এলো। হেজের গলিতে কতক্ষণ মাথা নুইয়ে বসে থাকল, তারপর হাঁপাতে হাঁপাতে হেজের ছাদে হাতে কাছি ধরা লোকটার মুখের দিকে তাকাল। ডাকাতের মতো চেহারা, খাড়া নাক, প্রকা- বপু, উষ্কখুষ্ক বাবরি চুল, অস্বাভাবিক ফোলা দুই চোখ, পরনের লুঙ্গির ওপর মলিন গামছা। কে জানে কেন, হয়তো মৃত্যুপথযাত্রী একটা মানুষকে উদ্ধারের সাফল্যে, লোকটা হুহু করে কাঁদতে শুরু করল। লোকটার কান্নাসিক্ত মুখের দিকে তাকিয়ে রইল সে।

চার

বিদেশে বিবাসে যদি পুত্র মারা যায়
দেশে না জানিবার আগে জানে কেবল মায় ॥

চারশো তেইশ আদমকে আলাদা আলাদা ট্রলারে তুলে সাতুন ও রাত্তফুম উপকূলের গভীর জঙ্গলের দিকে নিয়ে যাচ্ছে পাজুবান অংকাচোতেফানের লোকেরা। তা তারা নিক। জীবন-মরণ তো এখন তাদের হাতেই। জঙ্গলে কেন, সাপ-বিচ্ছুয় ভরা সুড়ঙ্গে ঢুকতে বললেও ঢুকতে হবে। কিন্তু যারা সিতারাবানু কথিত এই বৃত্তান্তের সাক্ষী, যারা এতক্ষণ ধৈর্য ধরে সাউথ বেঙ্গল-৩ জাহাজটিকে অনুসরণ করেছেন, জাহাজের ভেতরে মানবতার চরমতম স্খলন দেখে বিগলিত অশ্রু মুছতে মুছতে এর শেষ দেখার অপেক্ষায় থেকেছেন, তারা তো জানেন, এই ভাগ্যান্বেষী আদমদের গন্তব্য সাতুন বা রাত্তফুমের গভীর জঙ্গল নয়, তাদের গন্তব্য মালয়েশিয়া। জীবন বাজি রেখে তারা সমুদ্রযাত্রা করেছিল ওই স্বপ্নের দেশে পৌঁছার জন্যই। তাহলে কেন নেওয়া হচ্ছে গভীর জঙ্গলে? এইখানে সিতারাবানু থামে। পালের গরু-মোষের মতো এতগুলো মানুষকে জঙ্গলের দিকে নিয়ে যাওয়ার পেছনে কোনো কারণ সে খুঁজে পায় না।
সিতারাবানু থেমে থাকুক। দম নিক। অথবা আদমদের অনুসরণ করুক। তাদের কোথায় নেওয়া হচ্ছে স্বচক্ষে দেখুক। সহৃদয় পর্যবেক্ষক, এই অবসরে আপনারা বরং এই বৃত্তান্তের গোড়ায় ফিরে যান, যেখানে বৃত্তান্তের অন্য চরিত্ররা আছে। যেমন নূরনিসা, যাকে এখনো দুঃস্বপ্ন তাড়িয়ে বেড়ায়। তার স্বামী আবদুল অদুদ, পুত্রশোকে যে এখনো মুহ্যমান। জুলফিকারের হতভাগিনী স্ত্রী মরনি, বুড়ো শাশুড়িকে ভাশুরের কাছে রেখে বাপের বাড়ি গিয়ে যে স্বামীর ফোনের অপেক্ষায় প্রহর গুনছে। শুধু লাবণীর কথা থাক। তার খবর কেউ জানে না। তার বন্ধুবান্ধব, তার সতীর্থ এবং কমলের বন্ধুরাও না। সিতারাবানু সর্বজ্ঞ, এই বৃত্তান্তের লেখক নয়। লাবণীর খবর কেউ না জানলে লেখকও জানে না। তবে অনুমানের ভিত্তিতে বলা যায়, লাবণী ইচ্ছা করেই তার পরিম-ল থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে। তার বন্ধুরা এখন আর শাহবাগ টিএসসি পাবলিক লাইব্রেরি আজিজ মার্কেট বা কনকর্ড টাওয়ারের কোথাও তার দেখা পায় না। কমলের মতো তারও কোনো ফেসবুক আইডি নেই, থাকলে বন্ধুরা তার খবর কিছু না কিছু পেত। সে এখন বাসা থেকেই বেরোয় না। বাসা কোথায় কেউ জানেও না। দুই বান্ধবী মিলে একদিন তার খোঁজে ধানম-ির ‘স্বপ্ন মঞ্জিলে’ গিয়েছিল। তাকে পায়নি। দারোয়ান বলেছে, বাসা বদল করে তারা অন্যত্র চলে গেছে। তারপর খোঁজ আর করেনি তারা। মোবাইল নম্বর জানা থাকলে যোগাযোগ করতে পারত। যে-নম্বরটি জানা ছিল সেটি বন্ধ। মোবাইলটি সে হারিয়ে ফেলেছে। কাস্টমার কেয়ারে গিয়ে সিমটা আবার তুলতে পারত। ইচ্ছা করেই তোলেনি। কমলের অন্তর্ধানে সে এতটাই বিহ্বল, মোবাইল ফোন কেন, জীবনটাই তার কাছে অর্থহীন হয়ে পড়েছে। সে নিশ্চিত কমল আর কোনোদিন ফিরবে না। টেলিভিশন ও পত্রপত্রিকায় সেন্টমার্টিন ট্র্যাজেডির সংবাদ পেয়ে নিশ্চিত ধরে নিয়েছে, সমুদ্রস্নানের সময় ভেসে যাওয়া ছজনের মধ্যে অজ্ঞাতপরিচয় দুজন কমল ও দীপঙ্কর ছাড়া আর কেউ নয়। কেননা পনেরো তারিখ বিকেলে কমল তাকে ফোনে বলেছিল, ষোলো তারিখ কক্সবাজারে থেকে সতেরো তারিখ ভোরে তারা সেন্টমার্টিনের উদ্দেশে রওনা দেবে। পরবর্তী দুদিন লাবণী আর ফোন করেনি। যখন-তখন তো আর ফোন করতেও পারে না। করতে হয় ছাদে গিয়ে অথবা রুমের দরজা বন্ধ করে। কার সঙ্গে এতো কথা, যদি জিজ্ঞেস করে তার মা, কী উত্তর দেবে সে? বাড়ির কাউকে তো জানায়নি তার বিয়ের কথা। ভেবেছিল কমল কক্সবাজার থেকে ফিরলেই গোপন কথাটা সবাইকে জানাবে। সবাইকে না হোক, অন্তত মাকে। কমল সাধারণত ফোন করে না। লাবণীই তাকে বারণ করেছে। বলা তো যায় না কখন কে রিসিভ করে। ফোন হয়তো করেছিল লাবণী, কিন্তু বারবারই বন্ধ পেয়েছে। সেন্টমার্টিন ট্র্যাজেডির খবরটা পেয়ে অস্থির হয়ে কমলের এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে ফোন করেছিল। সঠিক কোনো খবর সে দিতে পারেনি। তারও আশঙ্কা, অজ্ঞাতপরিচয় দুজন কমল ও দীপঙ্করই হবে। ঘটনার সপ্তাহখানেক পর প্রথমসারির একটি দৈনিকে এ নিয়ে একটি প্রতিবেদনও প্রকাশিত হয়। তারপর হাজারো খবরের নিচে সেন্টমার্টিন ট্র্যাজেডির খবরটা চাপা পড়ে গেছে। লাবণীও কমলের নামটা চাপা দিয়ে দিলো, গোপন কথাটা গোপনই রেখে দিলো। সে পারত আগের জীবনে ফিরে যেতে, নতুন করে কারো সঙ্গে সম্পর্কে জড়াতে, যদি তার মন সাড়া দিত। তার মনটা মরে গেছে। অতীতের সব স্মৃতি মুছে দিয়ে নতুন করে জীবন শুরু করতে চেয়েছে। কে জানে, এমনও হতে পারে, এখনো সে কমলের ফেরার প্রতীক্ষায়।
খেয়াল রাখা দরকার, লাবণী সম্পর্কে এতক্ষণ যা বলা হলো তার সবই অনুমাননির্ভর। সত্যি হতে পারে, মিথ্যাও হতে পারে। সত্য প্রমাণের দায় নেই লেখকের। কারণ লাবণী এখন এই বৃত্তান্তের হারিয়ে যাওয়া এক চরিত্র। যেভাবে হারিয়ে গিয়েছে রনি, মঈন, কাশু বুড়ো, বাবুর্চি কিংবা মায়াবী চোখের সেই মেয়েটি।
হারায়নি জুলফিকারের বউ মরনি। ছোটবেলা থেকে দারিদ্র্য আর রোগ-ব্যারামের সঙ্গে লড়তে লড়তে শত দুর্বিপাকে টিকে থাকার দুর্বার একটা শক্তি সে অর্জন করছে। যাওয়ার সময় জুলফিকার তাকে শপাঁচেক টাকা দিয়ে বলেছিল, টেনেটুনে কোনোরকম কয়টা দিন চালিয়ে নিতে, তারপর যেভাবেই হোক সে টাকা পাঠাতে শুরু করবে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির এই কালে পাঁচশো টাকা কি আর টাকা? দশ দিনেই খতম। তারপর শুরু হলো উপোস থাকার দিন। কুড়ি কেটে গেল, টাকা আসা দূরে থাক, একটা ফোন পর্যন্ত এলো না। স্বামী বেঁচে আছে, না মরে গেছে, সেই খবরও পেল না। প্রায় এক মাস পর তার বাপ তাকে দেখতে এলে বুড়ো শাশুড়িকে ভাশুরের কাছে রেখে সে স্বামীর বাড়ি ছাড়ল। সে যেতে চায়নি, বাপই তাকে জোর করে নিয়ে গেছে। নেবে না? সন্তান দিনের পর দিন অভুক্ত থাকবে তা কোন বাপের সহ্য হয়। বাপের সংসার বড়, একদিক সামাল দিতে গেলে আরেক দিক বেসামাল হয়ে পড়ে। তাই বলে মেয়েকে তো আর অকূল সাগরে ভাসিয়ে রাখতে পারে না। তার সন্দেহ, মেয়েজামাই হয়তো জাহাজডুবিতে মরে-টরে গেছে। নইলে এক মাসে একটিবার ফোন করত না? ফোন না করুক, একটা চিঠি তো অন্তত লিখত। সাধ্যমতো সে জামাইয়ের খোঁজখবর নেওয়ার চেষ্টা করেছে। গ্রামের ভূঞাবাড়ির যে-ছেলেটি মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুর থাকে, ফোনে তার সঙ্গেও একবার কথা বলেছে। জুলফিকারের কোনো খোঁজ সে দিতে পারেনি। বলেছে, মালয়েশিয়া কি বগুড়া শহর? কত বড় দেশ, কত শহর বন্দর। হাজার হাজার বাঙালি চাকরি করছে, কার খবর কে রাখে।
মরনি নিজেকে ভাগ্যের হাতে সঁপে দিলো। কপালে যা লেখা আছে তা হবে। সারাজীবন তো ওই ভাঙা কপালটার ওপরই নির্ভর করেছে। বেঁচে আছে তো কপালটারই জোরে। টাইফয়েডে তো মরেও যেতে পারত। এবং বিয়ে তার নাও তো হতে পারত। খোঁড়া মেয়েকে কে করত বিয়ে? হয়েছে কপালের জোরেই। অন্তত সে তা-ই বিশ্বাস করে। কপালে থাকলে স্বামী একদিন-না-একদিন ফিরে আসবেই। স্বামীর ফেরার প্রতীক্ষায় সে প্রহর গুনতে থাকে। খোঁড়া পা-টাকে টানতে টানতে দিনে কতবার যে বাড়ির ঘাটায় গিয়ে দাঁড়ায় হিসাব থাকে না। যতদূর চোখ যায় কেবল ধু-ধু প্রান্তর। প্রান্তরের মাঝখানে হাটে যাওয়ার রাস্তা। হাটুরেরা আসে, ফেরিঅলারা আসে, দলবেঁধে ভিক্ষুকেরা আসে, গরুর পাল নিয়ে রাখালেরা আসে, দূরের গ্রাম থেকে মাঝেমধ্যে নাইওরও আসে, অথচ তার কাক্সিক্ষত মানুষটি আসে না। সূর্য ডোবার পর রাস্তাটা অন্ধকারের দখলে চলে না যাওয়া পর্যন্ত সে দাঁড়িয়ে থাকে একাকী তালগাছের মতো। অন্ধকার বাড়ে ধীরে ধীরে। প্রাণিকুল নীড়ে ফেরে। বিষণœমনে তাকেও ফিরতে হয়। রাতে শরীরটা তার ঘরে থাকলেও মনটা পড়ে থাকে বাইরে। মধ্যরাত পেরিয়ে যায়, মনটাকে সে ঘরে ফেরাতে পারে না। পাতা ঝরার শব্দ হলে অথবা গাছ-বিরিখির ঢালে পাখপাখালি ডানা ঝাপটালে সে চমকে ওঠে। এই বুঝি মানুষটা এলো! গভীর নৈঃশব্দ্যে পোষা কুকুরটা ডাক দিয়ে উঠলে দুরুদুরু বুকে কুপি নিয়ে সে গভীর নির্জন উঠানে নামে। মানুষটাকে খোঁজে। অথচ অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই ঠাওরে আসে না।
প্রায় দুই মাস পর এক খাঁ-খাঁ দুপুরে প্রান্তরের পথ ধরে এক লোক এলো, রোদেপোড়া মুখে যার সাদা চাপ দাড়ি, মাথায় গম্বুজের মতো পাঁচতালির টুপি এবং গায়ে সাদা পাঞ্জাবি। বেশভূষায় ভালো মানুষ বলে মনে হলেও চোখে কী এক গোপন রহস্য খেলা করে। লোকটা নিজের পরিচয় দিলো এইভাবে, হামি হুজুরের একজন মুসল্লি। ভক্তও কবার পারেন। হুজুরের তাবিজ দিয়ে হামার ছোট বেটার একনা ব্যারাম সারে গেচলো। বড় হাক্কানি আলেম। তার পিচে একতেদা করলে মনে হচ্চিলো হামি আসলেই এবাদত করিচ্চি। আহা, কি সোন্দর করে কেরাত পড়িচ্চিলো! কি সোন্দর গলা! জানেন, শ্যাষ রাতোত হুজুর নামাজ পড়ে কান্দিচ্চিলো। খুবই আল্লাএলা মানুষ। তাও দেকেন আল্লার বান্দারা কেংকা পাষাণ, ইংকা একজন মানুষোক বন্দি করে রাকচে!
বন্দি করে রেখেছে! মরনি চমকে ওঠে। পায়ের তলার মাটি নড়ে ওঠে। যেন ভূকম্পন শুরু হয়েছে পৃথিবীতে। আঁচলে মুখ চাপা দিয়ে সে ফুঁপিয়ে ওঠে। তার বাপ ঘোলা চোখে লোকটির দিকে তাকায়। মনে মনে সে এমন আশঙ্কাই করছিল। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলল, পাসপোট ভিসে না লিয়ে বিদেশোত গেলে বন্দি কোরবের লয়? অতি চালাকের গলাত দড়ি, বুঝলু ভাই? কতবার মানা করিচি চুরি কোরে বিদেশোত যাবের লাগবিনে। শুনলোই না! শুনবি ক্যা? হামি হনু বাসের ডাইভার, হামার কতার দাম আচে নাকি? একন বুঝুক। দুই দ্যাশের ব্যাপার, হামি কী করমো? মরুক।
না না ভাইজান, মাথা দোলাতে দোলাতে আগন্তুক বলে, আপনি যা বুঝিচেন ব্যাপারডা কলেম তা লয়। হুজুর আসলে থাইল্যান্ডের জঙ্গলোত ডাকাতেগেরে হাতোত পরচে।
ডাকাতেগেরে হাতোত পরচে? কী কন!
হ। মুক্তিপণ ছাড়া ছাড়বিনে।
মুক্তিপণ! মরনির বাপের অস্ফুট কণ্ঠস্বর।
হ, মুক্তিপণ। খুবই খারাপ ওরা। তাও আবার পাঁচ-দশ হাজার ট্যাকা লয়, লগদ এক লাক ট্যাকা। দিবার না পালে জ্যান্ত দাফনের ভয় দেকাচ্চে।
চোখ বড় বড় করে লোকটার দিকে তাকিয়ে থাকে মরনি। কথাগুলো তার ঠিক বিশ্বাস হয় না। তার বাপেরও না। এসব কি বিশ্বাস করার মতো কথা? মোবাইল ফোন এখন মানুষের হাতে হাতে। তাদের ঘরেও আছে তিনটি। জুলফিকারের ভাইদের কাছে তো আছেই। এতো এতো ফোন থাকতে দূর গ্রামের একটা অচেনা মানুষকে কেন ফোন করবে জুলফিকার? লোকটাকে সন্দেহ হয় মরনির বাপের। দেশে তো ধান্ধাবাজের অভাব নেই। কে জানে কোন ধান্ধা নিয়ে এসেছে লোকটা।
তার মনের কথা বুঝি টের পায় আগন্তুক। চোখ দুটো টান টান করে বলে, ওরা জলদস্যু। বুকোত দয়ামায়া কিচুই নাই। হুজুরের ব্যাগট্যাগ সবই কাড়ে লেচে। আপনেগেরে কারু লম্বর ওর মুকস্তো নাই। কপাল ভালো হামার লম্বরটা আচলো। থাকপিনে? দ্যাশোত থাকতে দিনে কম করে হলেও হামাক চার-পাঁচবার করে ফোন দিচ্চিলো। মুকস্তো হয়ে গেচে, বুঝিচেন? তা না হলে মারে-টারে ফালে দিলেও দ্যাশোত খবর আসলো না হিনি।
লোকটা বাঁ-হাতের কব্জি উলটে ঘড়ি দেখতে দেখতে বলে, ঠিক দেট্টায় ফোন আসপি। আপনেরাই না হয় কথা কন।
মরনির বাপের চোখেমুখে সন্দেহের যে-মেঘ ভাসছিল ফোন আসার কথা শুনে মুহূর্তে সরে গেল। লোকটাকে ভুল বুঝেছে বলে খানিকটা অনুতপ্তও হলো। খাতির-যতœ করে ঘরে নিয়ে বসাল তাকে। রান্নাবাড়ার আয়োজন শুরু করে দিলো তার জন্য। পৃথিবীতে কার জন্য কে কী করে। সবাই তো নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত। এত কষ্ট করে লোকটা এত দূর থেকে এসেছে, সামান্য ডালভাত না খাওয়ালে কি হয়? লোকটি বলে, খাওয়া-দাওয়ার ঝামেলা কোরে কী হবি ভাইজান। দোয়া করেন আল্লা য্যান হুজুরোক ভালোয় ভালোয় দ্যাশোত ফিরে আনে।
মরনির বুকে দুরুদুরু শুরু হয়। যেন ঢেঁকির পাড় পড়তে লেগেছে। সত্যি ফোন আসবে তো? তর সয় না তার। দেড়টা বাজার তখনো এক ঘণ্টা বাকি। তার মনে হয় সময় যেন থমকে আছে। সূর্যটা মাথার ওপর সেঁটে আছে। একটুও নড়ছে না। অনন্তকাল যেন সেঁটে থাকবে। এক ঘণ্টাকে তার এক বছর মনে হচ্ছে। স্বামীর সঙ্গে কী কী কথা বলবে মনে মনে ভাবে। চুলায় ভাত-তরকারি চড়াতে চড়াতে কথাগুলোর মহড়াও দেয় একবার – কতবার মানা করছিনু বিদ্যাশ যাওয়ার কাম নাই। শুনলেন না হামার কথা। যাই হোক, আপনি কুনো চিন্তা করবেন না, কেউ কুনো ক্ষতি করব্যার পারবি না আপনের। হায়াত-মউতের মালিক আল্লা।
চুলা থেকে পাকিয়ে ওঠা ধোঁয়ায় তার চোখে জ্বালা ধরে। ঝাপসা চোখে হঠাৎ সে স্বামীর মুখখানা দেখতে পায়। কাঁদতে কাঁদতে বলে তার স্বামী, ট্যাকা না পালে ওরা হামাক মারে ফালে দিবি বউ। যেংকা করেই হোক এক লাক ট্যাকার ব্যবস্তা করে দ্যাও। তুমি ছাড়া দুনিয়্যাত হামার আর কেউ নাই।
মরনি চমকে ওঠে। স্বামীর কাতর কণ্ঠ শুনে বুক ফেটে কান্না আসতে চায়, কিন্তু দুশ্চিন্তার ভারে নির্গমনের পথ পায় না। দুশ্চিন্তা টাকার কথা ভেবে। এক লাখ টাকা কি সোজা কথা! এতো টাকা সে পাবে কোথায়। জায়গাজমি বেচে তার বাপ না হয় টাকার ব্যবস্থা করল, কিন্তু থাইল্যান্ড তো বহুদূরের পথ, এত দূরে টাকা পৌঁছাবে কেমন করে! মাথায় কিছু ধরে না তার।
ঠিক পৌনে দুটায় যখন ফোন এলো, মোবাইল সেটটি কানে ধরে ‘হ্যালো’ শব্দটি উচ্চারণ করা ছাড়া আর কিছুই এলো না তার মুখ দিয়ে। কান্নার ধকলে সাজিয়ে রাখা সব কথা চোখের জলে ভেসে গেল। কথা বলল তার বাপ। প্রায় পনেরো মিনিট। জুলফিকার যা জানাল তার সংক্ষিপ্তসার এই, ডাকাত নয়, সে আদম পাচারকারীর খপ্পরে পড়েছে। তারাই তাকে জঙ্গলে বন্দি করে রেখেছে। এক লাখ টাকা না দিলে জঙ্গলে জ্যান্ত পুঁতে ফেলবে।
মরনির বাপের মাথায় গোটা পৃথিবীটা ঘোরে। মরনির বিলাপে পাড়াপড়শিরা এসে জড়ো হয়। মেয়ের বুকভাঙা বিলাপ সইতে পারে না তার বাপ। মনে মনে সিদ্ধান্ত নেয়, যে করেই হোক টাকার ব্যবস্থা সে করবেই। মাঠে যে জমিটুকু আছে দরকার হলে তা বেচে দেবে। কিন্তু তার খটকা লাগে, টাকার ব্যবস্থা করে করবেটা কী? টাকা নিয়ে কে যাবে থাইল্যান্ডের জঙ্গলে? তখন আগন্তুক বলে, ক্যা, হায়দর আলীর কতা কিচু কয়নি আপনেক?
হায়দর আলী? না তো!
আগন্তুক বলল, এই দেক হুজুরের কা-! কতা শ্যাষ না করেই ফোন রাকে দিলো! আচ্চা যাই হোক, হায়দর আলীর বাড়ি নাকি কক্সবাজার। ট্যাকা তার কাচেই দিয়ে আসা লাগবি। ট্যাকার ব্যবস্তা করেন, লাগলে হামি আপ্নের সাতে যামো। আপ্নি কুনু চিন্তে করবেন না।
মরনির বাপ টাকার ব্যবস্থা করুক, আগন্তুককে নিয়ে হায়দর আলীর খোঁজে কক্সবাজার যাক। সহৃদয় পর্যবেক্ষক, আপনারা এবার নূরনিসার খবর নিয়ে আসুন। সমুদ্রে ভেসে যাওয়া পুত্রের শোক কিছুটা সামলে নিয়েছিল নূরনিসা। মনকে এই বলে সান্ত¡না দিয়েছিল, এক বেটা পাখি হয়ে উড়ে গেছে, আরো দুই বেটা তো আছে। তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে সে শিবুর শোক ভুলে থাকার চেষ্টা করেছিল। পারল না শিলাবৃষ্টিতে নিহত হাজার হাজার পাখির লাশ দেখে। সেন্টমার্টিন ট্র্যাজেডির প্রায় সাড়ে চার মাস পর, জুলাইয়ের শুরুর দিকে, কুলসিবাসা গ্রামে শিলাবৃষ্টি হয়েছিল। শিলার আঘাতে হাজার হাজার পাখি মারা পড়েছিল, যেভাবে মরেছিল উজানটেকে, চারশো বছর আগে। চারশো বছর পর একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। ফারাক শুধু স্থানে। নিহত পাখিদের জড়ো করা হলো গ্রামের স্কুলের মাঠে। উৎসুক গ্রামবাসীর সঙ্গে নূরনিসাও এলো দেখতে। নিষ্প্রাণ পাখিরা পড়ে আছে উপুড় হয়ে, কাৎ হয়ে, চিৎ হয়ে। চড়–ই, শালিক, সারস, টিয়া, মাছরাঙা, দোয়েল, কোয়েলসহ চেনা-অচেনা সব পাখি। একসঙ্গে এত পাখির মৃত্যু কেউ কোনোদিন দেখেনি। নিষ্প্রাণ পাখিদের সামনে তারা বিহ্বল দাঁড়িয়ে। নূরনিসার বুকে শোক জাগে, যে-শোক জেগেছিল সিতারাবানুর বুকে। ডানা ধরে একটা একটা পাখি সে টেনে তোলে, একদিন যেভাবে তুলেছিল সিতারাবানু। তাদের মুখ দেখে, চোখ দেখে, ঠোঁট দেখে, হাত-পা-নখ সব দেখে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। কোনো কিছু বাদ রাখে না। দেখে আর হায় হায় করে। একেকবার ফুঁপিয়ে ওঠে। আহা, এই পাখিটাই বুঝি তার উড়ে যাওয়া পুত্র! না না, এটি নয়, ওটি পাখনাভাঙা শালিকটি। শিবু ঠিক এভাবে উপুড় হয়ে ঘুমাত। শালিকটা বুকে চেপে ধরে ‘ও শিবু, বাপ আমার’ বলে সে কান্নায় ভেঙে পড়ে। কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে গড়াগড়ি খায়। গ্রামবাসী অবাক হয়। তার বেটা সমুদ্রে ডুবে মরেছে এ-কথা সবার জানা। কিন্তু মৃত পাখি বুকে নিয়ে বেটার জন্য কান্নার কারণ কেউ বুঝতে পারে না। ভাবে, মায়ের মন, কখন কী মনে আসে কে বোঝে।
নূরনিসা স্থির হয়ে বসে। পাখিটাকে আবার উলটেপালটে দেখে। হঠাৎ ছুড়ে ফেলে বিড়বিড় করে বলে, এ তো দেখি শালিক! বেটা তো আমার ধনেশ হয়ে উড়ে গেছে। ধনেশ কোথায়? এখানে কি ধনেশ নাই? আমার বেটা কি নাই এখানে? বলে আর হন্যে হয়ে ধনেশ পাখি খোঁজে। তার কা- দেখে কেউ হাসে, পাগলে কিনা বলে! কেউ আফসোস করে, আহা বেচারি, পুত্রশোকে মাথাটা একদম গেছে। কেউ আবার ভয় পায় বটগাছের ভূতটা বুঝি আবার আছর করল তাকে।
আবদুল অদুদ তখন অন্য কথা ভাবে। কিছুতেই বুঝে আসে না কেন বারবার ধনেশ পাখির কথা বলে তার বউ। মাথায় তো কোনো সমস্যা নেই। সংসারের সব কাজ তো ঠিকঠাক মতোই করে। খাওয়া-দাওয়াও ঠিক, ঘুমেরও কোনো সমস্যা নেই, অক্তমতো নামাজ পড়তেও ভুল করে না। সবকিছুই সুস্থ মানুষের মতো স্বাভাবিক, অস্বাভাবিক শুধু ধনেশ পাখির জন্য তার বিলাপ। সমুদ্রে ডুবে শিবুর মৃত্যুসংবাদটা শোনার পর থেকেই শুরু হয় ধনেশ পাখির জন্য তার আহাজারি। সারাক্ষণ কেবল ধনেশ আর ধনেশ। অস্ট্রেলিয়ায় বড় বেটার সঙ্গে ফোনে কথা বলার সময় কাঁদে আর বলে, তুইও ধনেশ হবি না তো বাপ? তুইও উড়ে যাবি না তো আমাকে ছেড়ে? ঢাকা থেকে ছুটিছাটায় মেজোবেটা বাড়ি এলে তাকে বুকে চেপে ধরে কাঁদে আর একই কথা আওড়ায়।
শুরুতে সবাই ভেবেছিল ধনেশ পাখির জন্য তার এই বিলাপ হয়তো রূপক। শিবুর মৃত্যুকে হয়তো সে পাখির উড়ে যাওয়ার সঙ্গে তুলনা করছে। তাই এ নিয়ে কেউ তেমন মাথা ঘামাল না। কিন্তু শিবুর চল্লিশার দিন সন্ধ্যায় কোথা থেকে একটা পায়রা উড়ে নূরনিসার শোবার ঘরের খাটের কোনায় আশ্রয় নিলে সেটিকে বুকে নিয়ে যখন সে বিলাপ শুরু করল আবদুল অদুদের তখন সন্দেহ হলো। এই ধনেশবুলির অন্তরালে নিশ্চয়ই কোনো রহস্য আছে। নইলে একটা পায়রাকে সে ধনেশ বলবে কেন? সন্ধ্যায় পথ ভুলে ঘরে ঢুকে পড়া পায়রাটির সঙ্গে শিবুর ফেরার সম্পর্কই-বা কী?
সেদিন শিলাবৃষ্টিতে নিহত পাখির স্তূপের ভেতর ধনেশ পাখি খুঁজতে দেখে আবদুল অদুদের সন্দেহটা আরো গভীর হয়। বউকে সে পাবনার মানসিক হাসপাতালে নেওয়ার কথা ভাবে। কিন্তু ভাবনাটা চাপা পড়ে যায় আদিম সংস্কারের নিচে – না, এই সমস্যার সমাধান কোনো ডাক্তারকে দিয়ে হবে না। তার পাশে দাঁড়ানো গ্রামের এক বুড়ো অনুচ্চস্বরে বলে, তাকে বরং কবরগুনিনের কাছে নিয়ে যাও।
আবদুল অদুদ আর দেরি করল না, বউকে কিছু না জানিয়ে চলে গেল সর্বরোগের চিকিৎসক কবরগুনিনের আস্তানায়। যে-সন্দেহ তার মনে বাসা বেঁধেছিল গুনিনের কথার সঙ্গে হুবহু মিলে গেল। কুলসিবাসা গ্রামের কোথাও একটা ধনেশ আছে, যেটির পায়ের সঙ্গে খারাপ একটা তাবিজ বাঁধা। তাবিজটি বেঁধেছে নূরনিসার শত্রুরা। পাখিটিকে ধরে তাবিজটি উদ্ধার করা না গেলে তার অবস্থা দিন দিন আরো খারাপ হবে এবং ধনেশ পাখি ছাড়া স্মৃতি থেকে বাকি সব মুছে যাবে।
হাজার বছর ধরে গ্রামবাংলায় প্রচলিত তন্ত্রমন্ত্রের এই বিশ্বাসকে অস্বীকার করতে পারে না আবদুল অদুদ। তবে কথাটা সে গোপন রাখে। জানে শুধু কবরগুনিন, আর জানে তার বিশ্বস্ত জিনেরা, যারা পাখিটার ঘাড় ধরে গুনিনের পায়ের কাছে এনে ফেলবে। অপেক্ষা শুধু শনিবারের। শনি-মঙ্গলবার ছাড়া সপ্তাহের অন্য কোনো দিন গুনিনের ডাকে সাড়া দেয় না তার জিনেরা।
কিন্তু বিষ্যুদবার ঘটে গেল সেই আশ্চর্য ঘটনা। সেদিন বাজার থেকে কাগজের একটা ঠোঙায় করে মসুর ডাল এনেছিল আবদুল অদুদ। একটি বহুল প্রচারিত দৈনিকের প্রথম পাতার অর্ধেকটা দিয়ে ঠোঙাটা তৈরি। ডালগুলো বয়ামে ঢোকানোর সময় নূরনিসার দৃষ্টি থেমে গেল ঠোঙার একটি ছবির ওপর। তেরপলের একটি তাঁবুর সামনে সারবেঁধে বসা একদল মানুষ। সবার সামনে কঙ্কালসার এক যুবক, যার মাথায় উষ্কখুষ্ক চুল, পরনে লুঙ্গি, গায়ে চিত্রা গেঞ্জি এবং হাত দুটো বুকের ওপর ভাঁজ করা। চোখের পলক পড়ে না নূরনিসার। ঠোঙাটা নিয়ে দৌড়ে সে উঠানে নামে। যুগপৎ আনন্দ ও আতঙ্কের স্বরে চিৎকার করে বলে, আমার শিবু! আমার শিবু! দেখেন আমার শিবু মরেনি। আমি নিশ্চিত এই ছবি আমার বেটার।
আবদুল অদুদের মুখ সাদা হওয়া ধরে। সন্ধ্যার আধো অন্ধকারে ভয়ার্ত চোখে সে চারদিকে চোখ বুলায়। নিশ্চয়ই দুষ্ট ধনেশটা বাড়ির আশপাশে কোথাও ঘুরঘুর করছে। ভয়ে তার গায়ে কাঁটা দেয়। বাড়ির কোনায় একটা তক্ষক থেমে থেমে ডাকছে। তাতে ভয় আরো বাড়ে তার। নূরনিসা তাকে ধমকায়, আপনি পাগল? কোথায় কী দেখেন? এই দেখেন আমার শিবু। বেটা আমার মরেনি।
ঠোঙাটা স্বামীর হাতে দিয়ে মাটি চাপড়ে বিলাপ শুরু করল নূরনিসা। পড়শিরা ছুটে আসতে লাগল চারদিক থেকে। আবদুল অদুদ ছবিটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে। এই ছবি তার ছেলের! নাহ্, ঠিক একিনে আসে না। পাঁচ মাস আগে যে ছেলে সাগরে ভেসে গেছে, যার চল্লিশা পর্যন্ত হয়ে গেছে, সে বেঁচে আছে – এ-কথা কি বিশ্বাস করার মতো? ছবির নিচের ক্যাপশনটা সে মনোযোগ দিয়ে পড়ে। আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা এএফপির বরাত দিয়ে ক্যাপশনে লেখা
‘চোখে-মুখে ক্লান্তি আর দুশ্চিন্তার ছাপ। মানব পাচারকারীদের অমানুষিক নির্যাতনের শিকার এসব ভুখা-নাঙ্গা বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গা অভিবাসীর শেষমেশ ঠাঁই মিলেছে মালয়েশিয়ার লংকাবি দ্বীপের পুলিশ সদর দপ্তরে। এর আগে গতকাল সকালে মালয়েশিয়ার উপকূল থেকে উদ্ধার করা হয় তাদের।’
আবদুল অদুদের খটকা লাগে। কোথায় সেন্টমার্টিন দ্বীপ আর কোথায় লংকাবি দ্বীপ! শত শত মাইলের দূরত্ব। হতেই পারে না। এই ছবি নিশ্চয়ই অন্য কারো। একজনের চেহারার সঙ্গে আরেকজনের মিল কি থাকতে পারে না? মিল কি নেই? পৃথিবীতে একই চেহারার তিনজন মানুষ থাকে। লংকাবি দ্বীপের আশ্রয় শিবিরের এই যুবক আর যে-ই হোক শিবু নয়, তার চেহারার অন্য কেউ। কিন্তু কথাটি নূরনিসাকে কোনোভাবেই বোঝাতে পারে না। তার কথা একটাই, আমি নিশ্চিত এই ছবি আমার বেটার।
হামাগুড়ি দিতে দিতে কথাটা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল সারা গ্রামে। গ্রাম থেকে শহরে। দুদিন পর শহর থেকে জাতীয় দৈনিকের দুজন স্থানীয় সাংবাদিক নূরনিসার সাক্ষাৎকার নিতে এলো। জানতে চাইল, কীভাবে নিশ্চিত হলেন এই ছবি আপনার ছেলের? নূরনিসার সংক্ষিপ্ত অথচ জোরালো উত্তর, আমি শিবুর মা। মায়ের চোখ কখনো ভুল করে না।
পরদিন দুটি জাতীয় দৈনিকের প্রথম পাতায় শিবু ও নূরনিসার ছবিসহ একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়, যার শিরোনাম ছিল, ‘সেন্টমার্টিনে সাগরে ডুবে যাওয়া শিবু মালয়েশিয়ায়!’ প্রতিবেদনটি কপি হয়ে ছড়িয়ে পড়ল এলেক্সা র‌্যাংকিংয়ে এগিয়ে থাকার প্রতিযোগিতায় ইঁদুরদৌড় দৌড়ানো অনলাইন নিউজ পোর্টালগুলোতে, ফেসবুকে পড়ে গেল স্ট্যাটাসের হিড়িক, রাতে টিভি টকশোর আলোচনার একমাত্র বিষয় হয়ে উঠল সমুদ্রপথে মানবপাচার ও শিবু। পররাষ্ট্র ও প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সমালোচনায় মুখর হয়ে উঠল সুশীলসমাজ। শিবুকে দেশে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়ার দাবিতে মিছিল-মিটিং ও মানববন্ধনের ঘোষণা দিলো জনবিচ্ছিন্ন বামপন্থী কয়েকটি রাজনৈতিক দল। দেশ পরিচালনায় সরকারের সীমাহীন ব্যর্থতার অভিযোগ তুলে প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করল বিরোধী দলের একজন শীর্ষ নেতা। গরম তেলে জলের ছিটা পড়ল জাতিসংঘের একটি সম্মেলন উপলক্ষে রুয়ান্ডা সফররত পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর দেওয়া এক ফেসবুক স্ট্যাটাসে। শিবুকে ফিরিয়ে আনা প্রসঙ্গে তিনি লিখলেন : ‘ছবিটি আদৌ শিবুর কিনা এ-বিষয়ে আমরা এখনো নিশ্চিত নই। ছবিটি কোনো রোহিঙ্গার হতে পারে। তা ছাড়া শিবুকে ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নয়, প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের।’
ব্যস, শুরু হয়ে গেল দুই মন্ত্রণালয়ের রশি টানাটানি। এই টানাটানি চলল টানা চারদিন। সরকারের অভ্যন্তরীণ সমন্বয়হীনতা নিয়ে দৈনিক পত্রিকাগুলো বড় বড় প্রতিবেদন আর উপসম্পাদকীয় ছাপতে শুরু করল, উপদেশের ঢালি নিয়ে টকশোতে হাজির হতে লাগল ডিজিটাল বুদ্ধিজীবীরা। শিবুর প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে সবাই মেতে উঠল সরকারের অভ্যন্তরীণ সমন্বয়হীনতা এবং নৌপথে মানবপাচার বন্ধে আশু করণীয় সম্পর্কে।
সপ্তাহখানেক পর রাজধানীর একটি আবাসিক এলাকায় দুর্বৃত্তদের চাপাতির আঘাতে জনৈক নাস্তিক হত্যার চাঞ্চল্যকর ঘটনার নিচে চাপা পড়ে গেল শিবু ও মানবপাচার ইস্যুটি।

পাঁচ

পচ্ছিম দিগেতে রাজ্য দরেয়ার শেষ
মাইন্সে মানুষ বেচি খায় আচানক দেশ ॥

ভুল আসলেই করে না মায়ের চোখ। ঠিকই ধরেছিল নূরনিসা। লংকাবি দ্বীপে আশ্রয় পাওয়া একশ চৌত্রিশ অভিবাসনপ্রত্যাশীর মধ্যে ছিল জোবায়ের শিবলি, অভুক্ত থাকতে থাকতে যে হয়ে পড়েছিল দুর্ভিক্ষকবলিতের মতো কঙ্কালসার, যার মাথায় ছিল উষ্কখুষ্ক চুল, পরনে লুঙ্গি এবং গায়ে চিত্রা গেঞ্জি। প্রতিবেদন তৈরি করতে সরেজমিন যাওয়া বিবিসির এক সাংবাদিককে তার আসল নামের পাশাপাশি ডাকনামটিও বলেছিল শিবু। আর বলেছিল, সাতুন উপকূল থেকে কীভাবে তাকে পেদাং বেসার জঙ্গলে মানবপাচারকারীদের ক্যাম্পে নেওয়া হয় এবং সেখান থেকে কীভাবে আশ্রয় পেল লংকাবি দ্বীপে।
থাইল্যান্ডের শংখলা প্রদেশের পেদাং বেসার জঙ্গলে, বিপন্ন মানবতা যেখানে গুমরে গুমরে কাঁদে, এক মাস চব্বিশ দিন বন্দি রাখা হয় তাদের। যুগ-যুগান্তরের নিস্তব্ধতাবাহী প্রাচীন বৃক্ষরাজিতে ভরপুর গহিন জঙ্গল। পাখি ও কীটপতঙ্গের ডাক ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই, আশপাশের বিশ-পঁচিশ মাইলের মধ্যে কোনো জনবসতি নেই। এমন জায়গাও আছে, সৃষ্টির শুরু থেকে আজ পর্যন্ত যেখানে কোনো মানুষের পা পড়েনি। সাতুন উপকূল থেকে এই জঙ্গলে পৌঁছতে তাদের প্রায় চারদিন লেগেছিল। ট্রলার থেকে নামানোর পর শুরু হয় হাঁটা। ভাগ্যান্বেষী একশ চব্বিশ বাঙালি আদমের বিশাল কাফেলা হাঁটে। যেন দুর্ভিক্ষকবলিত কোনো জনপদ ত্যাগ করছে অধিবাসীরা। কোটরে ঢোকা চোখ, ভাঙা গাল, কঙ্কালসার শরীর এবং উষ্কখুষ্ক চুল-দাড়িতে ছিল তারই আভাস। কাফেলায় রোহিঙ্গা একজনও ছিল না। ফের সংঘর্ষের আশঙ্কায় তাদের আলাদা করে অন্য ট্রলারে চড়িয়ে রাত্তফুম উপকূলের দিকে নিয়ে যায় পাজুবানের লোকেরা।
পেদাং বেসার জঙ্গলে পৌঁছতে চব্বিশ ঘণ্টার বেশি লাগত না, আদমদের শরীরে যদি হাঁটার মতো শক্তি থাকত। শক্তি তো সেই কবেই ফুরিয়ে গেছে, অবশিষ্ট যা ছিল তাতে একটানা এক ঘণ্টাও হাঁটতে পারছিল না। এক ঘণ্টা হাঁটে তো আধা ঘণ্টা জিরায়। পা ফেলার শক্তিও ছিল না কারো কারো। যেমন তালেব। খুবই করুণ অবস্থা ছিল তার। যতটা না খিদায় তার চেয়ে বেশি মৃত্যুচিন্তায়। রনি ও মঈন খুন হওয়ার পর তার ভেতর ডেরা বাঁধা মৃত্যুচিন্তাটা আর দূর করতে পারেনি। খাবারের অবশিষ্টাংশ নিয়ে বাঙালি-রোহিঙ্গার ভয়াবহ সংঘর্ষের সময় চোখের সামনে মৃত্যুর উলঙ্গ নৃত্য দেখে মৃত্যুচিন্তাটা আরো প্রবল হয়ে ওঠে, জীবনে প্রথমবারের মতো মৃত্যুকে গভীরভাবে টের পায়, অস্তিত্বের অসহনীয় সংকট তৈরি হয় তার ভেতর। একদিন সে এই পৃথিবীতে থাকবে না, একদিন নাই হয়ে যাবে, চোখের সামনে যেমন নাই হয়ে গেছে জলজ্যান্ত এতোগুলো মানুষ – এই চিন্তা তাকে দিশাহারা করে তোলে। মৃত্যুচিন্তা গোটা মস্তিষ্ক দখল করে নেওয়ায় মারাত্মক মানসিক চাপ অনুভব করতে থাকে। প্রতি মুহূর্তে মনে হতে থাকে, এই বুঝি মাথা ঘুরে পড়ে গেল, এই বুঝি মাথার সবকটি রগ ছিঁড়ে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল। এই মানসিক অবসাদের ফলে শরীরটা তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেল। মস্তিষ্ক তো শরীরের নিয়ন্তা। ইঞ্জিন বলা যায়। ইঞ্জিন বিকল হলে বগি কি আর চলে? হেজের কোনায় সারাক্ষণ ঝিমানো মুরগির মতো বসে থাকত জড়োসড়ো। বসে থাকতে থাকতে পায়ে ঝিঁঝি এসে গেলে শুয়ে থাকত। কারো সঙ্গে তেমন কথা বলত না। ওসমানের সঙ্গেও না। ওসমান কিছু জিজ্ঞেস করলে ভয়ার্ত শিশুর মতো ফ্যালফ্যাল করে তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকত। এক প্রশ্ন তিনবার করলে উত্তর দিত একবার, খুব সংক্ষেপে, অনুচ্চস্বরে। কোথাও কোনো শব্দ হলে অথবা কেউ জোরে কথা বললে চমকে উঠত। কেউ কারো সঙ্গে রাগারাগি বা ঝগড়াঝাঁটি করলে ভয়ে একেবারে কুঁকড়ে যেত। বুকটা ধপধপ করত ভীষণ। প্রতি রাতে স্বপ্নে দেখত, সাত হাত লম্বা ভয়ংকর সুন্দর একটা সাপ তাকে দংশন করেছে, অথবা পাগলা-কুকুর তার পায়ে কামড় দিয়েছে, সে মরে যাচ্ছে, রক্তবমি করছে, একদল মানুষ তার লাশ খাটিয়ায় তুলে কলেমা পড়তে পড়তে গোরস্তানের দিকে রওনা হয়েছে। এসব দুঃস্বপ্নের তাড়নায় গভীর রাতে ঘুমের ভেতর বোবার মতো হাই-হুই করে গোঙাত। ভয় তার ভেতরে এমনভাবে সেঁধিয়ে গিয়েছিল, কেবলই মনে হতো, এই বুঝি রনি, মঈন অথবা কাশু বুড়োর মতো তাকেও খুন করে পেট চিরে লাশ সাগরে ফেলে দিলো!
থাইল্যান্ডের আন্তর্জাতিক জলসীমা থেকে সাতুন উপকূলে নেওয়ার জন্য বাঙালি আদমদের আলাদা করে যখন জাহাজ থেকে ট্রলারে ওঠানো হয়, ওসমানের চোখ তখন তালেবকে খুঁজে বেড়ায়। তালেব ছাড়া পরিচিত সবাইকে সে ট্রলারে দেখতে পায়। ট্রলারের কোনাকাঞ্চি খোঁজা বাদ রাখল না সে। কোথাও নেই তালেব।
কোথায় গেল? ভুল করে রোহিঙ্গাদের ট্রলারে উঠে পড়ল না তো! তার নাম ধরে সে জোর গলায় হাঁক দেয়। সাড়া পায় না। হাত দুটো চোঙা বানিয়ে মুখে ধরে আবারো হাঁক দেয় : তা লে ব। তবু জবাব আসে না। তার মনে তখন সন্দেহ জাগে, ট্রলারে আদৌ উঠেছে তালেব, নাকি জাহাজেই রয়ে গেছে! ভারসাম্যহীন যে মানসিক অবস্থায় সে পতিত, হতেও তো পারে, জাহাজের হেজে ঘুপসি মেরে বসে আছে। ওসমান আর বসে থাকতে পারল না, ব্যাগটা কমলের কাছে রেখে দ্রুত জাহাজে উঠে গেল। যা ভেবেছিল হেজে নেমে তাই দেখল। হাঁটু-মাথা একত্র করে শীতার্ত বিড়ালের মতো চুপচাপ শুয়ে আছে তালেব। খুব রাগ ওঠে তার, পাগল নাকি এ্যাঁ? আশ্চর্য! ট্রলার তো ছাড়ি দিলো। যাইতেন না মালয়শিয়া?
ওসমানের গলা শুনে তালেব কেঁপে ওঠে। সীমাহীন ভয় নিয়ে চোখ মেলে তাকায়। বিড়বিড় করে কী যেন বলে। যেন মন্ত্র পড়ছে। ওঠেন ওঠেন – ওসমান তাগাদা দেয়। তালেব দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। কাপড়ের ব্যাগটা হাতে নিয়ে কোনোমতে উঠে দাঁড়ায়। ধীরকদমে সিঁড়ির দিকে হাঁটে। খানিকটা হেঁটে আচমকা ব্যাগটা ছেড়ে দিয়ে ধপ করে বসে পড়ে। ওসমান বুঝল হাঁটার মতো শক্তি নেই শরীরে। তখন সে ব্যাগটা নিজের কাঁধে নিয়ে দুহাতে টেনে তুলল তাকে। তার হাত ধরে কোনোমতে ট্রলারে উঠল তালেব। দুই হাঁটুর মাঝখানে মাথা গুঁজে পাটাতনে বসে রইল চুপচাপ। যেন আজন্মের বোবা। সমুদ্রের বেশুমার ঢেউ ভাঙতে ভাঙতে টানা তিন ঘণ্টা ট্রলার চলল, জাহাজের অসহ্য দুর্ভোগ থেকে মুক্তির আনন্দে সবাই হৈ-হুল্লোড় করল, অথচ তার মুখ গলিয়ে একটা শব্দও বের হলো না। ট্রলার কূলে ভিড়লে ওসমান যখন বলল, চলেন ভাই, দীর্ঘ নীরবতার পর সে ক্ষীণস্বরে বলে উঠল, কোথায়?
আশ্চর্য! কোথায় জানেন না?
মালয়েশিয়া?
তা ছাড়া কোথায় আর? চলেন চলেন।
তালেব নড়ে না। বসা থেকে ওঠার মতো শক্তি পায় না। শরীরে শক্তি আছে, মনে নেই। সব যাত্রী নেমে গেল, সে একা বসে রইল আহত পাখির মতো। কমল ও শিবু তার দুই বাহু ধরে ট্রলার থেকে নামাল তাকে। নেমে এক মুহূর্তও আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না, সৈকতের বালির ওপর ধপ করে বসে পড়ল। জুলফিকার তখন ধমকে উঠল, হাঁটপের না পারলে মালেশিয়া যাবা কেংকা করে? তোমার জন্যি কি হাওয়াই জাহাজ আসপি মিয়া? কষ্ট কি তুমি একলাই করিচো? হামরা কি জাহাজত আরামে আচনু? হাঁটো তো ভাই হাঁটো।
তালেব ধীর লয়ে মাথা নাড়ায়। হাঁটতে সে পারবে না। তার মাথার নাড়ানি এই কথার সাক্ষ্য দেয়, জীবনের প্রতি সে নিদারুণ বিতৃষ্ণ। একটা পা মৃত্যুর হাতে সঁপে দিয়েছে। মৃত্যু তাকে টানছে সজোরে। যত জলদি পারে অন্য পা-টাও সে সঁপে দিতে চায়।
জুলফিকার একই কথার পুনরাবৃত্তি করে, হাঁটপের না পারলে মালেশিয়া যাবা কেংকা করে?
তালেব আবার মাথা নাড়ায়। মালয়েশিয়া সে যাবে না।
জুলফিকারের মগজে এবার আগুনের আঁচ লাগে। সে গলা চড়ায়, যাবি কুন্টি শুনি? এটিই থাকবা? শ্যাল-কুত্তো খাবি, বুঝলে? বাঘ আসে টানে লিয়ে যাবি হ। দ্যাশোত ফিরে যাবার কতা ভাবিচো? হে হে, সে রাস্তা বন্ধ। মাতা কুটে মরলেও কেউ দরিয়ের ও-পারোত লিয়ে যাবের লয়। কষ্ট যিংকাই হোক, হাঁটা লাগবিই। ওঠো, পাও চালাও মিয়া।
ততোক্ষণে হাঁটা ধরেছে কাফেলা। সবার আগে পাজুবান অংকাচোতেফানের চার অনুচর। দুজন বেঁটে-খাটো, বোঁচা নাক, মাথার চুলে কদমছাঁট। আরেকজনের মু-ানো মাথা, ওপরের পাটির দাঁতগুলো ঠেলে বেরিয়ে পড়া এবং সারা গায়ে অস্বাভাবিক ঘন পশম। দেখতে লম্বা-চওড়া লোকটা বাকি তিনজনের লিডার। কপালে বেখাপ্পা ধরনের আঁচিল, মু-ানো মুখ, কুচকালো ঠোঁট, পায়ে ধুলো-ময়লায় বিবর্ণ রাবারের স্যান্ডেল এবং পরনে কালো প্যান্ট ও ফুলহাতার সবুজ শার্ট। তাকে ‘মিয়াভাই’ বলে ডাকে বাকিরা। মিয়া তো আর নাম নয়, উপাধি। তার নাম একটা আছে নিশ্চয়ই, কিন্তু ভুলেও কেউ নামটা মুখে নেয় না। জাহাজের মাস্টার সুকানি গ্রিজার বা প্রহরীদের মতো এরাও নিজেদের নাম গোপন করে রাখে। গায়ে জড়িয়ে রাখে রহস্যের মোটা চাদর। চাদরটা ভেদ করে তাদের ভেতরে ঢোকা কঠিন। চোখেমুখেও চলে রহস্যের দাবাখেলা।
তালেবকে আবার তাগাদা দেয় জুলফিকার, ক্যারে, উটিসনে ক্যা ভাই? শ্যাষে কলেম তোমাক ফালে যাওয়া ছাড়া উপোয় থাকপিনে।
তালেব ক্ষীণকণ্ঠে বলে, তাই করেন, হাঁটতে আমি পারব না।
জুলফিকারের দিগদারি এবার চরমে ওঠে। সে আর দাঁড়ায় না, ধলি বকের লম্বা লম্বা পা ফেলে হাঁটা ধরে। কমল তাকে ডাকে, সে কানে তোলে না। উলটো বরং ঝাড়ি মারে, লিজের জান বাঁচিচ্চে না আবার দরদ! উপায় ঠিক করতে না পেরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে কমল। দীপঙ্কর আর শিবুও অনড়। ওসমান খুব অসহায় বোধ করে। এ কদিনে তালেবের সঙ্গে আন্তরিক যে-সম্পর্ক গড়ে উঠেছে তাতে মন সায় দিচ্ছে না কাপুরুষের মতো তাকে একা ফেলে চলে যেতে। কিন্তু নেবেই-বা কেমন করে? ক্লান্ত তো সেও, হাঁটতে তো তারও কষ্ট হবে। কে কাকে সাহায্য করবে।
শেষ পর্যন্ত তালেবকে ফেলেই চলে যেত সবাই, যদি না কমলের মাথায় হঠাৎ বুদ্ধিটা আসত। জোয়ারে ভেসে-আসা সৈকতে পড়ে থাকা শক্ত দুটি লাঠি জোগাড় করে আনল কমল। তালেবের ব্যাগ থেকে একটা লুঙ্গি বের করল। লাঠির সঙ্গে লুঙ্গির কোনা গিঁট দিয়ে একটা দোলনা বানাল। দোলনায় তালেবকে বসিয়ে চারজনে মিলে কাঁধে নিয়ে বেহারার মতো হাঁটা ধরল। কাফেলা ততক্ষণে বেশ খানিকটা দূরে চলে গেছে, তাদের ধরতে দ্রুত পা চালায় তারা। দোলনায় বসে ঘন ঘন চোখ মোছে তালেব। মানুষের প্রতি যে ভীতি আর অবিশ্বাস জন্মেছিল তার মনে, তা কাটতে শুরু করে ধীরে ধীরে।
মাথার ওপর এপ্রিলের মগজ বলকানো রোদ। ঘণ্টাখানেক হেঁটে নিদারুণ হাঁপিয়ে উঠল আদমেরা। হাঁটতে আর পারছিল না কেউ। গায়ে উৎকট গন্ধ, বুকটা মরুভূমির মতো ধু-ধু। একটু পানির জন্য সবাই চাতক হয়ে ওঠে। কোথায় পাবে পানি! আশপাশে খুঁজলে হয়তো পুকুর-ডোবা পাওয়া যাবে। কিন্তু খোঁজার সময় কই? মিয়াভাই তাড়ার ওপর তাড়া দিচ্ছে, জোর কদমে হাঁটো মিয়ারা। দুই ঘণ্টার মধ্যে পৌঁছতে না পারলে মালয়েশিয়া যাওয়া হবে না, হুঁ। মিয়াভাইয়ের হাতে একটা লাঠি। গোড়ার দিকটা সুচাল। শুকনো কাঠ, কিন্তু লোহার মতো শক্ত। যেন সে রাখাল। লাঠিটা নাড়িয়ে সবাইকে শাসায়, রাখাল যেমন গরুকে। গালাগালও করে মাঝেমধ্যে। কেউ কিছু বলে না, চুপচাপ হজম করে নেয়। কী বলবে? মেজাজ তার জাহাজ-মাস্টারের চেয়ে কম কিসে? প্রতিবাদ করে কে খাবে তার লাঠির বাড়ি!
মিয়াভাইয়ের তাড়ায় অথবা সময়মতো গন্তব্যে পৌঁছার আশায় আবার হাঁটা ধরে আদমেরা। কতক্ষণ হেঁটে আবার জিরাতে বসে। জিরিয়ে আবার হাঁটা ধরে। আবার জিরায়। আবার হাঁটে। হাঁটতে হাঁটতে জিরাতে জিরাতে প্রায় চার ঘণ্টা পর নির্জন এক সড়কে উপনীত হলো, যেখানে অপেক্ষা করছিল সাতটি পিকআপ ভ্যান। দ্রুততম সময়ের মধ্যে সবাইকে ভ্যানে তুলে ঠাসাঠাসি করে বসিয়ে তেরপল দিয়ে ঢেকে দিলে। বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় থাকল না তেরপলের নিচে মানুষ, না পণ্য।
পিকআপে ওঠার সময় প্রথমবারের মতো কাছ থেকে মিয়াভাইকে দেখতে পায় জুলফিকার। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে সুচাল লাঠিটা নাড়িয়ে সবাইকে দ্রুত ভ্যানে ওঠার জন্য তাগাদা দিচ্ছিল সে। কপালের বেখাপ্পা আঁচিলটা থেকে জুলফিকারের চোখ সরছিল না। খুব চেনা মনে হচ্ছিল লোকটাকে। কিন্তু মনে করতে পারছিল না কোথায় দেখেছে। চেহারা, বেশভূষা আর কথা বলার ধরন দেখে নিবাসও আন্দাজ করতে পারছিল না। থাইল্যান্ড যে নয় সে নিশ্চিত। থাইল্যান্ডের মানুষ তো আর বাংলায় কথা বলে না। সে কথা বলছিল আধা চাটগাঁইয়া ভাষায়। তার মানে হয় সে বাঙালি, নয় রোহিঙ্গা। পরিচয় জিজ্ঞেস করার ইচ্ছে হয়েছিল একবার। সাহস পায়নি। উত্তর না দিয়ে উলটো যদি হাতের লাঠিটা দিয়ে গুঁতো মেরে বসে! মুখ আর চোখের ভাষা বলে দিচ্ছিল খুনখারাবিতেও তার হাত পাকা।
খানাখন্দে ভরা রাস্তা ধরে ভ্যান চলতে থাকে। উত্তরে না দক্ষিণে, পুবে না পশ্চিমে যাচ্ছে বোঝা মুশকিল। তেরপলের কারণে বাইরের কিছুই তো দেখা যায় না। গাদাগাদি ঠেলাঠেলি ঝাঁকুনি ভ্যাপসা গরম আর ঘামের উৎকট গন্ধে দম আটকে অক্কা যাওয়ার মতো দশা। এমন ভয়াবহতার মধ্যেও মিয়াভাইয়ের মুখটা জুলফিকারের চোখ থেকে সরে না। এমন পরিচিত মুখ! তার অবাক লাগে। কোথায় দেখেছে মনে করার চেষ্টা করে। চট্টগ্রাম, কক্সবাজার বা টেকনাফের কোথাও? তার মনে পড়ে, কক্সবাজারে বাস থেকে নেমে কয়েকজন অচেনা লোকের সঙ্গে কথা বলেছিল হায়দর। তাদের মধ্যে কি মিয়াভাই ছিল? নাহ্, ঠিক মনে করতে পারে না। এ এক সমস্যা তার, একান্ত চেনাজানা কেউ না হলে দু-একবারের দেখা-সাক্ষাতে কারো চেহারা ঠিক মনে রাখতে পারে না। ভাবে, লোকটিকে হয়তো সে চেনে না, আগে কখনো দেখেনি, এ হয়তো তার মনের ভুল। এমন ভুল তার আগেও হয়েছে। পাকিস্তানে একবার রাস্তায় সাদা জোব্বা আর পাগড়ি পরা এক লোকের সঙ্গে দেখা, যে কিনা দেখতে জনৈক আফগান মুজাহিদের মতো। সালাম দিয়ে হাসিমুখে সামনে দাঁড়াল সে। লোকটি বলল, আপ কোন হ্যায়? সে তার নাম বললে লোকটি মাথা নাড়িয়ে ঠোঁট উলটিয়ে কাঁধ উঁচিয়ে বুঝিয়ে দিলো, এ-নামের কাউকে সে চেনে না।
টানা তিন ঘণ্টা চলার পর ন্যাড়া এক পাহাড়ের পাদদেশের কাঁচা রাস্তায় ভ্যানগুলো থামল। হাঁটুজল ডিঙিয়ে খরস্রোতা একটি খাল পার হলো সবাই। তারপর আবার শুরু হলো লাল মাটির ধূলিধূসরিত নির্জন রাস্তা ধরে হাঁটা। ওসমানের হাত ধরে হাঁটার চেষ্টা করে তালেব। পারে না। খানিকটা হেঁটেই হাঁপিয়ে ওঠে, বুকটা ভীষণ দুরুদুরু করে। কী আর করে তার সঙ্গীরা, আবার তাকে দোলনায় তুলে নিল। দৃশ্যটা দেখে মিয়াভাইয়ের পিত্তি জ্বলে। হাতের লাঠিটা নাড়াতে নাড়াতে জ্বলা পিত্তির ধোঁয়া উগরায়, নবাবের বেটা! হাঁটতে পারে না শালার বিদেশ যাবার শখ!
হাঁটতে হাঁটতে ঠিক দুপুরে তারা এক রাবার বাগানে পৌঁছল, যেখানে তাদের জন্য রান্না হচ্ছিল ভাত আর ভেড়ার মাংস। খিদায় তো সবার চোখে ঘোর অন্ধকার, খাবারের গন্ধে দ্বিগুণ উসকে উঠল খিদা। তর সইছিল না একটুও। খাওয়া তো দুরাস্ত, আহা, কতদিন মাংসের ঘ্রাণ পর্যন্ত পায় না! ইচ্ছে করছিল হাঁড়ি-পাতিল
লাড়কি-সড়কি সব গিলে ফেলতে। কিন্তু কাঁচা তো আর খেতে দেবে না। রান্না শেষ হওয়া অবধি অপেক্ষা করতে হবে। তারা অপেক্ষা করে। মরা গরু সামনে নিয়ে যেভাবে অপেক্ষা করে শকুনের দল।
বাগানের মাঝখানে বড়সড় জীর্ণ একটা চালাঘর। বেড়া নেই, নড়বড়ে খুঁটির ওপর চালটা কোনোরকমে ঠেকে আছে। দমকা বাতাস বইলে উড়ে যাবে নিমেষে। চালাটার পেছনে শ্যাওলায় ঢাকা কুয়ায় নেমে হাতমুখ ধুয়ে নিল সবাই। ততক্ষণে খাবার প্রস্তুত। আর কি দেরি করা চলে! লাইন ধরে খেতে বসে গেল সবাই। থালা-বাসন কিছু নেই, তমাদি কালের জেয়াফতের মতো কলাপাতায় করে ভাত-তরকারি দেওয়া হলো। বহুদিন পর ভাপওঠা ভাত পেয়ে গোগ্রাসে গিলল সবাই। পেটের একটু জায়গাও আর ফাঁকা রাখল না। খাওয়া শেষে শরীরটা ভেঙে এলে চালাঘরের শুকনো খড়কুটোর বিছানায় এলিয়ে দিলো। সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘুমাল একটানা। মিয়াভাই হাঁকডাক শুরু না করলে ঘুমের ঘোরেই রাতটা কেটে যেত।
ভরাট চাঁদ উঠল পুবের আকাশে। চিত্রা জোছনা ছড়িয়ে পড়ল সমস্ত বাগানে। আলুভর্তা আর বেগুন ভাজা দিয়ে সবাইকে আবার ভাত খেতে দিলো। যে যত পারল খেল। কেউ বাধা দিলো না। খেয়ে আবার শুয়ে পড়ল এবং খানিকের মধ্যে অনেকে ঘুমিয়েও পড়ল। পড়ারই কথা। কত দিনের ঘুম চোখে জমা, কত আর ভার বইবে চোখ। কমল গুনগুন করে গান ধরল : ‘এবার তোর মরা গাঙে বান এসেছে, জয় মা বলে ভাসা তরী…।’ নাউযুবিল্লাহ অনুচ্চস্বরে বলল জুলফিকার। শব্দটার মধ্যে কতটা ঘৃণা মিশ্রিত, বুঝতে অসুবিধা হয় না কমলের। তবু সে থামে না, পুরো গানটাই গায়। তার গান শুনতে শুনতে ঘুমানোর চেষ্টা করে তালেব। কিছুতেই আসে না ঘুম। তার কেবলই মনে হয়, পায়ের কাছে লকলকে জিব বের করে একটা গোখরো ফণা তুলে হিসহিস করছে। সে এপাশ-ওপাশ করে আর শুধু বিষধর প্রাণীটার কথা বলে। কমল তাকে অভয় দেয়, এত মানুষের মধ্যে মরতে আসবে সাপ? নিশ্চিন্তে ঘুমান ভাই। না, নিশ্চিন্ত সে হতে পারে না। খোদার লানতপ্রাপ্ত সাপেরা বড় খতরনাক, মানুষের অনিষ্ট করার জন্য হরহামেশা মওকা খোঁজে। কমল যে-সাপের নাম মুখে আনল সেজন্য ভয় বরং আরো বেড়ে গেল তার। তার বিশ্বাস, রাতের বেলায় সাপের নাম মুখে আনতে নেই। আনলে তারা শুনতে পায়। শুনলে অনিষ্ট করার চেষ্টা করে। বলতে হয় দড়ি। তার কথা শুনে কমল হাসে। বলে, সাপের নাম যে সাপ তা কি তারা জানে? নামটা তো মানুষের দেওয়া, তাই না?
তালেব কি আর শুয়ে থাকতে পারে! হুড়মুড়িয়ে উঠে বসল। সর্বনাশ! এমন জোছনা রাতে এতোবার অজাতশত্রুর নাম মুখে আনল কমল, তারা কি এমনি এমনি ছেড়ে দেবে? ভয়ে তার গায়ে কাঁটা দেয়। শোয়া থেকে উঠে চালার বাইরে গিয়ে একাকী বসে থাকে। খড়কুটোর নিচে তারা নেই তার কি নিশ্চয়তা? তার কা- দেখে কমলের হাসি পায়। হা-হা করে হাসে আর বলে, এতো ভয় পেলে চলবে ভাই? গোটা জগৎটা দখল করে রেখেছে ভয়। একমাত্র মানুষই পারে ভয়কে জয় করতে।
তালেব বলে, ভয়ের জিনিস ভয় পামু না? ওরেব্বাপ! বড় ভয়ংকর ওরা। এক কামড়ে পগারপার।
কথা বলার জন্য জুলফিকারের গলাটা খচখচ করছিল। মওকাটা সে হাতছাড়া করল না, এতো ভয় পালে তো ভাই মালেশিয়াত আর যাওয়া হবার লয়। আসো, নিদের দোয়া পড়ো। জানো তো? বিসমিল্লাহি আমুতু ওয়া আহইয়া। বুঝলে, ঘুমের মানে মরণ। আল্লার কাচে কও, মরণোত থাকে সকালোত য্যান আবার জীবন্ত উঠপের পারো। হায়াত-মউতের মালিক উনি। তার ইঙ্গিত ছাড়া দড়ি-দড়ার ক্ষমতা নাই তোমার কুনো ক্ষতি করবে।
জুলফিকারের মগজে তখন স্মৃতিরা হানা দেয়। সাপের প্রসঙ্গ ধরে সে চলে যায় তার অতীতে। আফগানিস্তানের কোথায় কোন শ্বাপদসঙ্কুল পাহাড়ি পথ ধরে গোটা এক রাত পায়ে হেঁটে মার্কিন সৈন্যদের ঘাঁটি আক্রমণ করেছিল, শুয়ে শুয়ে সেই গল্প শুরু করে। গল্পটা শেষ হলে শুরু করে কবর আজাবের কাহিনি। মাটি কীভাবে চারদিক থেকে মুর্দাকে চেপে ধরবে, অমাবস্যার অন্ধকারের চেয়ে কালো বর্ণের ভয়ংকর সাপেরা কিভাবে লেজে পেঁচিয়ে আছাড় মারবে এবং সেসব সাপের দাঁত চোখ জিব দৈর্ঘ্য-প্রস্থ সবকিছুর বিস্তারিত বর্ণনা দেয়। যেন সে চাক্ষুষ করে এসেছে। যথারীতি তার কথাগুলো ওয়াজের সুর পায়। বহুদিনের চর্চার ফলে পরকালবিষয়ক কোনো কথা স্বাভাবিক কণ্ঠে সে বলতে পারে না, নিজের অজান্তেই সুর এসে যায়।
তখন, বাইরে চুলার কাছে কেউ একজন হেঁড়ে গলায় ধমকে ওঠে, ওয়াজ মারাচ্চে কুন শালা? খাবার পায়ে পেটোত আনন্দের গোটা পড়েছে, লয়? চুপচাপ নিন্দ যাও। কাল ফজরে উটপের না পারলে কলেম পাচাত লাত্থি মারে উঠোমো।
জুলফিকার থামে। অনুচ্চস্বরে বলে, নাস্তেক।
সশব্দে হেসে দেয় কমল, খিক।
হাসিটা শুনতে পায় না জুলফিকার। হয়তো পায়। অথবা তার শোনা ও না-শোনার মধ্যবর্তী স্থান গলিয়ে শব্দটা চলে যায়। তার কানে ভাসছে বাইরে থেকে উড়ে আসা কথাগুলো। সব কথা নয়, মাত্র একটি শব্দ ‘লয়?’। আজন্মের চেনা শব্দ, যে-শব্দ তার গ্রামের মানুষের মুখে মুখে ফেরে। গত দেড় মাসে এমন শব্দ কারো মুখে শোনেনি। কে উচ্চারণ করল এই শব্দ? কণ্ঠটা খুব পরিচিত মনে হয় তার। এমন কণ্ঠ কোথায় যেন শুনেছে আগে। কোথায় ঠিক মনে করতে পারে না। হয়তো বগুড়ায় অথবা কক্সবাজারে অথবা সাতুন উপকূলে। একবার ভাবল কমলের গলা কি না! কিন্তু কমল তো তাকে এভাবে ধমকানোর কথা নয়। এতো অভদ্র সে নয়। তবে কি ওসমানের? তা-ইবা কী করে হয়। ওসমান তো তার পাশেই শোয়া। তাহলে মিয়াভাই বা তার সঙ্গীদের কেউ? হতে পারে। তারা ছাড়া এখানে তাকে ধমক দেওয়ার মতো আর কে আছে। এসব ভাবতে ভাবতে তার চোখে তন্দ্রা নামে। স্বপ্নের দুরন্ত ঘোড়ায় চড়ে সে ছুটে চলে ঘুমের দেশে।
বনমোরগেরা একসঙ্গে ডেকে রাত্রি শেষের ঘোষণা দেয়। পৃথিবীতে ভোর নামে। শান্ত স্নিগ্ধ ভোর। পাখপাখালি আর কীটপতঙ্গরা জাগে। জাগে একশ চব্বিশ আদম। আর জাগে তালেব। জেগে নিজের আশ্চর্য পরিবর্তন টের পায়। ক্লান্তি অনেকটা দূর হয়ে গেছে তার। বেশ চাঙ্গা অনুভব করছে এখন। বহুদিন পর হস্তমৈথুনের খায়েশটা চাগিয়ে ওঠে। মৃত্যুচিন্তাটা তখনো মগজে কুটকুট করছিল বলে সঙ্গে সঙ্গে আবার দমেও যায়।
হঠাৎ তার চোখ গেল একটা বুনো ফুলগাছের দিকে। একটা ফুল ফুটে আছে, বিবর্ণ আরেকটা ফুল পড়ে আছে গাছের তলায়। ঝরা ফুলটা থেকে চোখ সরে না তার। তাকিয়ে থাকতে থাকতে তার মানসিক পরিবর্তন ঘটতে থাকে। একদিন এই পৃথিবীতে থাকবে না বলে অস্তিত্বের যে অসহনীয় শূন্যতা তৈরি হয়েছিল তার ভেতর, ভোরের পবিত্র আলোয় ঝরা ফুলটা দেখে মুহূর্তে তা কেটে যায়। ফুল ফুটবে, ঝরে পড়বে এটাই প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়ম। মানবজীবনও তাই। মৃত্যু আছে বলেই জন্ম আছে এবং পৃথিবী এতো সুন্দর। মৃত্যু না থাকলে প্রাণের উচ্ছ্বাসে ভরপুর এই পৃথিবী নরকে পরিণত হতো। কেবলই জন্ম, মৃত্যু নেই। জন্ম হতে হতে… জন্ম হতে হতে পৃথিবীটা মানুষে মানুষে ভরে উঠত। এত মানুষের জায়গা হতো কোথায়? সুন্দর এই পৃথিবী হয়ে উঠত বিভীষিকাময় নরক। এই নরকজীবন বয়ে বেড়াতে বেড়াতে একটা সময় মানুষ ক্লান্ত হয়ে পড়ত ভীষণ। আর তখন জীবন থেকে পালানোর জন্য আত্মহত্যার হিড়িক পড়ে যেত।
জীবন ও মৃত্যু বিষয়ে প্রকৃতির কাছ থেকে নেওয়া এই পাঠ তাকে সাহসী করে তুলল। দীর্ঘ পাহাড়ি পথ আর হাঁটুজলের বিস্তীর্ণ জলাশয় পাড়ি দেওয়ার মতো শারীরিক ও মানসিক শক্তি অর্জন করল। মৃত স্বপ্নগুলো ধীরে ধীরে আবার জীবন্ত হয়ে উঠতে লাগল। স্বপ্নদের জেগে ওঠা সে টের পায়। কানে কানে তারা বলে যায়, হাঁটো। জীবন মানেই হাঁটা। ছুটে চলা। তুমিও ছোটো।
তালেব হাঁটে। অদৃশ্য কণ্ঠ বারবার তাকে তাগাদা দেয়, জীবন মানেই হাঁটা… ছুটে চলা। অতীতের সব দুঃখ-কষ্ট মন থেকে ঝেড়েমুছে সে জোর কদমে হাঁটে। তার সঙ্গে হাঁটে পুরো কাফেলা কিংবা কাফেলার সঙ্গে সে। দুর্গম পাহাড়ি পথযাত্রা তার কাছে উপভোগ্য হয়ে ওঠে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তার মনটাকে চাঙ্গা করে তোলে। হাঁটতে হাঁটতে সে গান ধরে : ‘এই পথ যদি না শেষ হয় তবে কেমন হবে তুমি বলো তো…?’
হাঁটতে হাঁটতে সূর্য পাটে নামে। পরিশ্রান্ত পথিকেরা থামে। হাঁটা অব্যাহত রাখার জন্য মিয়াভাইয়ের শত তাগাদা আর কাজে আসে না। কীভাবে আসবে? মানুষ কি গরু-গাধা? একটানা কতক্ষণ হাঁটা যায়! মিয়াভাইকে যতবারই পথের দূরত্ব জিজ্ঞেস করে ততবারই তার সংক্ষিপ্ত উত্তর, বহুদূর। এই বহুদূর আসলে কতদূর খোলাসা করে কিছু বলে না।
রুপালি তেজ হারিয়ে সূর্য পশ্চিমের আকাশে ঠেস দিয়ে পড়ে আছে অসহায়। পড়ে থাকে কিছুক্ষণ। ধীরে ধীরে ডুবে যায়। ঝিঁঝির ডাকে সন্ধ্যা নামে। দিনশেষের ঘোষণা দেয় তক্ষক। বাসন্তী বাতাস বয়। দূরে কোকিলেরা ডাকে। মিয়াভাই আবার তাগাদা দেয়, ওঠো মিয়ারা, জলদি পৌঁছা লাগবে। কিন্তু কেউ নড়ে না। দুই পাহাড়ের মাঝখানে শুকনো দূর্বাঘাসে ঢাকা একটা মাঠে হাত-পা ছড়িয়ে সবাই শুয়ে পড়ে। রাতটা তাদের ওখানেই কাটে। পরদিন সূর্য ওঠার আগে আবার শুরু হয় হাঁটা। ঘণ্টাদুয়েক হাঁটার পর, খিদায় যখন সবাই অস্থির, দেখল, সামনে দিগন্তবিস্তৃত এক জলাশয়। ওই কূলের কিছু ঠাওরে আসে না একূল থেকে। আবছা কুয়াশা। কাফেলায় গুঞ্জন ওঠে, কীভাবে পাড়ি দেব এই জলাশয়? নানাজন নানা কথা বলে। কেউ বলে নৌকা আসবে, কেউ বলে কলার ভেলা বানাতে হবে, কেউ বলে সাঁতরে পার হতে হবে। মিয়াভাই বলল অন্য কথা, পায়ে হেঁটে পাড়ি দিতে হবে। টানা সাত ঘণ্টার পথ। শুনে জুলফিকার হেসে দেয়। হাসির সঙ্গে নাকের তরল সিকনি বেরিয়ে আসে। খিকখিক করে হাসে আর বলে, আল্লার দুনিয়েত দেখি সগলি পাগল। তার কথা শুনে বাকিরাও হাসে। কথাটা না শোনার ভান করে থাকে মিয়াভাই। অন্য কেউ বললে চোখ তামা করে ঘুরে তাকাত, পিটিয়ে পিঠের চামড়া তুলে ফেলত। জুলফিকারের কণ্ঠ বুঝতে পেরে চুপ করে থাকে। অজানা কারণে তাকে সে এড়িয়ে চলে। সামনে খুব একটা পড়ে না। পড়লেও ঝটপট মুখ ঘুরিয়ে নেয়।
রাবার বাগান থেকে যাত্রার সময় প্রত্যেকের হাতে চিঁড়া-গুড়ের একটি করে ঠোঙা দেওয়া হয়েছিল। রাতে কিছু খেয়েছে, বাকি যা ছিল খেতে শুরু করল। পেট ভরে পানিও খেল। খাওয়া শেষ হতে দেখে মিয়া ভাই আর দেরি করল না, প্যান্টটা ঊরু অবধি গুটিয়ে রাবারের স্যান্ডেল জোড়া হাতে নিয়ে জলাশয়ে নেমে পড়ল। আদমেরা কি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারে? কী করবে দাঁড়িয়ে থেকে? কোথায় যাবে? যাওয়ার পথ তো সব বন্ধ। অজানা-অচেনা দেশ, কে দেবে ঠাঁই? নামে না শুধু জুলফিকার। একঠাঁয় দাঁড়িয়ে কী যেন ভাবে। বিন্দু বিন্দু ঘাম গড়িয়ে পড়ে তার দুই গাল বেয়ে। কমল তাকে তাড়া দেয়, দাঁড়িয়ে আছেন কেন হুজুর, আসেন আসেন। জুলফিকারের ভাবনায় ছেদ পড়ে। ময়লা রুমালটায় মুখ মুছে জুতো জোড়া হাতে নিয়ে সে পানিতে নামে। ধীরপায়ে হাঁটে, চুপচাপ সবার পেছনে। এত এত পথিকের পদচ্ছাপে ক্রমাগত ছপ ছপ খল খল শব্দ ওঠে জলে। কোথাও পায়ের পাতা ডোবা জল, কোথাও-বা হাঁটুজল। পায়ের নিচে কিরকিরে বালি থাকায় হাঁটতে তেমন অসুবিধা হয় না।
সূর্য মাথার ওপর ওঠে। পথিকেরা হাঁটে। হাঁটে আর মাঝেমধ্যে হাতের কোষে পানি নিয়ে মাথায় ঢালে। একটিবার কেউ পেছনে তাকায় না। তাকালে দেখতে পেত ক্লান্ত দুই পথিক হাঁটুজলে বসে কীভাবে হাঁপাচ্ছে। এতটাই ক্লান্ত তারা, গলাটা চড়িয়ে একটি বার বলতে পারছে না, আমাদের নিয়ে যাও, হাঁটতে আর পারছি না গো ভাই। বলতে হয়তো পারত, কিন্তু হাঁটতে না পারার অপরাধে মিয়াভাই পাছে পেঁদানি দেয় এই ভয়ে তারা চুপ করে থাকে। কিংবা বলেছিল। কেউ শুনতে পায়নি। অবিরাম ছপ ছপ খল খল জলস্বরে তাদের কণ্ঠ চাপা পড়ে গেছে। শ্বাস ফেলার জন্য তারা মাথাটা জলহস্তীর মতো উঁচিয়ে রেখে অশ্রুত নয়নে কাফেলার চলে যাওয়া দেখে। ঘনঘন শ্বাস ফেলে আর শ্বাসের সঙ্গে বেরিয়ে আসে আল আল আল। মাঝেমধ্যে তারা চোখ মেলে ঊর্ধ্বে তাকায়। বিস্তীর্ণ আসমানের দিকে। তাদের এই দুর্বোধ্য আল আল ধ্বনি কেউ শুনতে পাচ্ছে কি না দেখে। মধ্যাহ্নের তীক্ষè সূর্যরশ্মিতে তাদের চোখে জ্বালা ধরে। তারা চোখ নামায়। বসে থাকে খানিকক্ষণ। তারপর শুয়ে পড়ে। আল আল শব্দটা তলিয়ে যেতে থাকে জলের অতলে।
পশ্চিম আকাশে হেলে পড়ল সূর্য। পথিকেরা হাঁটে। সূর্য পাটে নামে। ক্লান্ত পথিকেরা তখন থামে। জলাশয়ের পথ শেষ, সামনে ডাঙা। গভীর জঙ্গল। শুকনো বালির ওপর তারা বসে পড়ে। কেউ-বা শুয়ে পড়ে হাত-পা ছড়িয়ে। মিয়াভাই বসে বসে হাঁপায়। অনুগত তিন সঙ্গী তার পাশে বসা। জুলফিকার দু-হাতে ঠেস দিয়ে বসে খানিকক্ষণ জিরায়। তারপর উঠে মিয়াভাইয়ের পেছনে দাঁড়ায়। মিয়াভাইয়ের নজর এড়ায় না। পেছন থেকে ঘুরে জুলফিকার তার সামনে এসে দাঁড়ায়। মিয়াভাই তবু চোখ তুলে একটিবার তাকায় না। জুলফিকার ঘুরঘুর করে। একবার সামনে, একবার পেছনে। এবং আড়চোখে তার দিকে বারবার তাকায়। মিয়াভাই তাকে দেখেও না দেখার ভান করে থাকে। সে খুব বিব্রত, চেহারা দেখে বেশ বুঝতে পারে জুলফিকার। তার মুখে হাসি ঝুলে।
মিয়াভাই হঠাৎ বলে উঠল, ঘুরঘুর গরনদে ক্যান হুজুর?
জুলফিকার নিশ্চুপ।
যান। যাইয়রে জিরন। আরো কিন্তু ম্যালা পথ আঁডা পরিবো।
জুলফিকার পেছনে গিয়ে দাঁড়ায়।
আজব লোক ত মিয়া অনে! ঘুরঘুর কেইত্তো গরন্দে কিস্সু ত ন বুঝির।
ঘুরঘুর করিচ্চিনে ভাইজান। জুলফিকার এবার মুখ খোলে।
তাইলে?
আপনেক দেকিচ্চি।
আঁরে দেখেন দে? হামাক দেখার কী আছে?
হামাক! হে হে হে। এমনি। দ্যাকার স্বাদ হচে।
আজব! আঁই উগ্গা আজব চিড়িয়া? ফাইজলামি পাইয়ন্দেনে?
জুলফিকার চুপ করে থাকে। তার মুখ থেকে চোখ সরায় না মিয়াভাই।
আচ্ছা, আপনের নামডা জানবের পারি?
কাঁটার ঘা খেল যেন মিয়াভাই। মুহূর্তে খেপে উঠল বুনো দাঁতালের মতো। লাফ মেরে উঠে হাতের লাঠিটা জুলফিকারের পিঠে চালিয়ে দিলো, আদমের বাচ্চা আদম, তুই আমার শালা-দুলাভাই লাগিস? নাম জিগাইলি ক্যান? ইয়ার্কি মারাস চুদির ভাই!
জুলফিকার বুকে হাত মুড়ে সটান দাঁড়িয়ে থাকে। কেন কে জানে, মুখের হাসিটা মিলায় না তার। মিয়াভাই ক্ষ্যান্ত দিয়ে দূরে গিয়ে দাঁড়ায়। তখন, বাঁ-হাতটা পেছনে নিয়ে জুলফিকার যখন পিঠ ডলছিল, তার মুখ দেখে শিবুর মনে হলো, পৃথিবীতে তার মতো অসহায় দ্বিতীয়টি নেই। খুব মায়া হলো তার। মিয়াভাইয়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সক্রোধে জিজ্ঞেস করল, গায়ে হাত তুললেন কেন? নাম জানতে চাওয়া কি অপরাধ?
মিয়াভাই গোখরোর মতো ফোঁস করে ওঠে। শিবুর নাকের ডগায় লাঠির গুঁতো মেরে ধমকায়, তুই কন? যাবিগই নে এহন হেডার পোয়া। নইলে জিয়াতা গারাই ফেলায়্যুম কিন্তু। আঁচা কইলাম।
শিবু পিছু হটে। প্রতিবাদ করার জন্য যারা এগিয়ে আসছিল তারাও। কেউ আর টুঁ-শব্দটি করার সাহস পায় না। কী এক জিজ্ঞাসা নিয়ে মিয়াভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে জুলফিকার। তার চেহারা দেখে মনে হয় সে যতটা না ব্যথিত তার চেয়ে বেশি বিস্মিত। অস্তগামী সূর্যের আভা তার মুখটাকে রক্তিম করে তুলল।
পথিকদের বিষণœ মুখ আরো বিষণœ করে ধূসর সন্ধ্যা নামল। স্যান্ডেল-জোড়া পায়ে গলিয়ে ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে আবার হাঁটা শুরু করল মিয়াভাই। বাধ্য হয়ে তার পেছনে উদ্বিগ্ন আদমেরাও। পেছনে হঠাৎ গুঞ্জন উঠল, কাকে যেন খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। গুঞ্জনটা মিয়াভাইয়ের কান এড়াল না। পেছনে ফিরে লাঠিটাতে ভর দিয়ে দাঁড়াল সে। আদমদের গুনে দেখতে বলল তিন সঙ্গীকে। সবাইকে লাইনে দাঁড় করিয়ে গুনতে শুরু করল তারা। দুই চার ছয় আট দশ বারো জোড়ায় জোড়ায় গুনতে গুনতে যখন একশ বাইশে এসে ঠেকল, বিরক্তি ঝেড়ে তিনজনের একজন আবার গোনা ধরল। ফিরতি গোনায়ও সংখ্যা সেই একই, একশ বাইশ। মিয়াভাই তখন রাগ ঝাড়ে, কডে গিয়্যে ইতে হারামজাদা? কী জোয়াব দিয়্যুম আঁই!
কী জবাব দেবে সে পাজুবানকে। দুই আদম মানে ত্রিশ হাজার বাথ। সহজ কথা! এতোগুলো বাথ হাতছাড়া হয়ে যাবে, পাজুবান কি এতো সহজে ছাড়বে তাকে? আশপাশে কোথাও তারা আছে নিশ্চয়ই। ক্লান্তিতে হয়তো বেহুঁশ হয়ে পড়ে আছে বালুচরে। সে আবার হাঁটা ধরল জলাশয়ের দিকে। তার পেছনে আদমেরাও।
চাঁদের আলো জোছনা হয়ে ঝরছে বালুচরে। ডানে বাঁয়ে সামনে যেদিকে তাকাও দিগন্ত প্রসারিত চর আর জল। এই খাঁ-খাঁ শূন্যতায় দ্বিগুণ উজ্জ্বলতায় ঝরে পড়ছে জোছনা। দূরে জলাশয়ের মাঝখানে দেখা যায় খ- খ- আলোকবিন্দু। কিসের আলো? নক্ষত্রের প্রতিফলন, না আলেয়া? না শিকারি জেলেদের লণ্ঠন? হাত-পা ছড়িয়ে ওই খ- খ- আলোকবিন্দুর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ক্লান্ত আদমদের চোখে টান পড়ে। চোখ বুজে তারা ঘুমের স্টিমারে চড়ে বসে। সঙ্গীদের নিয়ে হারানো দুই আদমকে খুঁজতে থাকে মিয়াভাই। কোথাও নেই তারা। দুশ্চিন্তায় ভারী হয়ে ওঠে মিয়াভাইয়ের মাথা। কী করবে ভেবে পায় না। তাদের রেখে চলে যাবে, না সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করবে? এক মন বলে, থাক তারা, চলো গন্তব্যে। কিচ্ছু বলবে না পাজুবান। এমন দীর্ঘ যাত্রায় দু-চারজন তো মারা পড়তেই পারে। আরেক মন বলে, অপেক্ষা করো। এখন তো রাত। সকাল হোক। দিনের বেলায় নিশ্চয়ই তাদের খুঁজে পাবে।
অপেক্ষা করবে মিয়াভাই। রাতটা সে এখানেই কাটিয়ে দেবে। গন্তব্য এখনো বহুদূর। চার-পাঁচ ঘণ্টা তো লাগবেই। সেও ক্লান্ত খুব। তারও বিশ্রামের দরকার। কিছুক্ষণ ঘুমাতে পারলে ক্লান্তিটা কেটে যাবে। ব্যাগ থেকে চিঁড়া-গুড় বের করে তিন সঙ্গীসহ খেয়ে নিল। জলাশয় থেকে জল খেয়ে আদমদের মতো বালির বিছানায় শুয়ে পড়ল। একটা হাই তুলে যখন হাত-পা ছড়িয়ে আকাশের দিকে তাকাল, মনে পড়ে গেল জুলফিকারের মুখটা। হারানো দুজনের একজন কি জুলফিকার মাওলানা? সঙ্গীদের কাছে জানতে চাইল সে। ঠেলা দাঁতের লোকটি বলল, না, সে আছে। একটু আগেও তাকে দেখা গেছে।
জুলফিকার তখন কী করে? চাঁদের বুড়ির হাড়গোড় গোনা ছাড়া কী আর করবে। তার সহযাত্রীরা নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে, অথচ তার চোখে ঘুম নেই। বুড়ির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তার মাথায় বুঝি আবার গ-গোল দেখা দেয়। নিজেকে তার চন্দ্রবাসী বলে মনে হয়। মিয়াভাইয়ের সুচাল লাঠিটার মতো একটা লাঠিতে ভর দিয়ে সে চষে বেড়ায় চাঁদের বুক। মাঝেমধ্যে লাঠিটা চাঁদের গায়ে ঠেসে ধরে। দেবে যায় বেশ খানিকটা। আবার টেনে তোলে। তখন দেখে, লাঠির সুচাল ডগায় লেগে আছে তাজা রক্ত। কার রক্ত? বুড়ির? লাঠির ডগাটা নাকের সামনে ধরে। চোখ বন্ধ করে রক্তের গন্ধ শোঁকে। এমনই খিদা তার, ডগায় লেগে থাকা রক্ত চেটেপুটে খেতে ইচ্ছা করে খুব।
চাঁদের বুড়ি চাঁদটাকে ঠেলতে ঠেলতে জলাশয়ের ওপারে নিয়ে গেল। শেষ রাতের আভাস দেখা দিলো চাঁদের ক্ষীয়মাণ আলোয়। ধীরে ধীরে ডুবে গেল চাঁদ, উঠে এলো সূর্য। সবার আগে কমলের ঘুম ভাঙল। শোয়া থেকে উঠে ধুলোবালি ঝেড়ে জলাশয়ে নেমে মুখটা ভালো করে ধুয়ে নিল। শার্টের হাতায় মুখ মুছতে মুছতে যখন সে ফিরছিল, চোখ আটকে গেল উত্তরে, মিয়াভাই ও তার সঙ্গীরা যেখানে শুয়ে। ধীরপায়ে এগিয়ে গেল সেদিকে। মিয়াভাইকে জাগিয়ে তুলতে হবে। রওনা দিতে হবে রোদ তেতে ওঠার আগে। কাছাকাছি গিয়ে হঠাৎ থমকে দাঁড়াল সে। মুখটা হাঁ হয়ে গেল অকস্মাৎ। বিস্ফারিত চোখে দেখল, বালিতে মাথা গুঁজে চিৎ হয়ে পড়ে আছে মিয়াভাই, তলপেটে গেঁথে আছে তার সেই সুচাল লাঠি। শুকনো বালি শুষে নিচ্ছে শরীরের সব রক্ত।
লিডারের লাশ দেখে ঘাবড়ে গেল সঙ্গীরা। সহসা মৃত্যুভয় হানা দিলো তাদের মনে। দেওয়ারই কথা। তারা তো মোটে তিনজন, আর আদমের সংখ্যা একশ বাইশ। ঠিকমতো একশ বাইশটা ঘুষি পড়লেই তো খেলা খতম, লিডারের মতোই হবে তাদের দশা। ফলে হত্যাকা-টি নিয়ে তেমন বাড়াবাড়ি করল না তারা। যে গেছে, সে তো চিরকালের জন্যই গেছে। যত যাই করুক সে তো আর ফিরে আসবে না। লাশটা তারা দ্রুত বালিচাপা দিয়ে আদমদের নিয়ে গন্তব্যের উদ্দেশে রওনা দিলো।
বনের দুর্গম পথ ধরে টানা প্রায় পাঁচ ঘণ্টা হাঁটার পর, ঠিক দুপুরে, তাতানো সূর্যের কাছে গাছপালা তরুলতারা যখন নতজানু, আদমেরা পৌঁছল সেখানে, যেখানে তাদের জন্য অপেক্ষা করছিল বিপুল বিস্ময়। এমন একটা ধাক্কা খেল তারা, চোখের পলক ফেলার কথা ভুলে গেল। প্রাচীন বৃক্ষরাজিতে ভরপুর এই গভীর জঙ্গলে এত বিশাল বন্দিশিবির থাকতে পারে, শিবিরে এতো এতো মানুষ থাকতে পারে, আগে থেকে কেউ কল্পনাও করতে পারেনি। যেন একটা গ্রাম। যে-গ্রাম মানবসৃষ্ট গ্রাম গঞ্জ হাট বাজার শহর বন্দর থেকে বিচ্ছিন্ন। এই গ্রামে বাড়ি নেই, ঘর নেই; আছে ঘরের মতো দোতলা তিনতলা কাঠের মাচা। ওপরে তেরপলের ছাউনি। প্রতি মাচায় দুজন করে মোট ছজন আদম। কেউ শুয়ে, কেউ বসে। বাঙালি-রোহিঙ্গা মিলিয়ে হাজারখানেক তো হবেই। রোহিঙ্গা নারীর সংখ্যাও কম নয়। চারদিকে তারকাঁটার বেড়া আর বন্দুক-পিস্তল-ডেগার হাতে প্রহরীদের সতর্ক পাহারা। পালানোর কোনো পথ নেই। কেউ পালানোর চিন্তাও করতে পারে না। শেষ রাতে তন্দ্রাচ্ছন্ন প্রহরীদের চোখ ফাঁকি দিয়ে তারকাঁটার বেড়া ডিঙিয়ে না হয় পালাল। কিন্তু পালিয়ে যাবে কোথায়? প্রথমেই এই বলে সবাইকে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে, পেদাং বেসার জঙ্গল পাজুবানের অংকাচোতেফানের রাজত্ব। এ তল্লাটের সে অঘোষিত সম্রাট। সে সাতুন প্রদেশের প্রশাসনিক সংস্থার সাবেক প্রেসিডেন্ট। কো তং বা বড়ভাই হিসেবে তার পরিচিতি। পেদাং বেসারের মেয়র বানজং পোংফোল তার কথা ছাড়া এক পা নড়ে না। চারদিকে তার গ্যাংয়ের লোকেরা ওতপেতে আছে। জঙ্গলে আর দূর লোকালয়ে তার পাতা অজস্র ফাঁদ। লোকালয়ে এমন কেউ নেই যে পাজুবানের ভয়ে কাঁপে না। পুলিশ বা নৌবাহিনী কি তার কথার বাইরে? আদম পাচার করে টাকা তো সে একা কামাচ্ছে না, চার ভাগের এক ভাগ চলে যাচ্ছে তাদের পকেটে। বাংলাদেশ আর মিয়ানমার থেকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে একটা আদমকে সে এতদূর আনল কিছু টাকা খসাবে বলে, অথচ তার চোখে ধুলো দিয়ে লোকটা পালিয়ে যাবে, তাহলে তারা আছে কিসের জন্য? অতএব সাবধান!
বন্দিশিবিরে সীমাহীন দুর্ভোগের বর্ণনা দিতে গিয়ে বিবিসির সেই সাংবাদিককে বলেছিল শিবু, পেদাং বেসার ওই শিবিরে জীবন-মৃত্যুর মাঝখানে অবস্থান করত আদমেরা। কাউকে রাখা হতো এক সপ্তাহ, কাউকে এক মাস, কাউকে-বা দুই মাস। হাতের কোষে মেপে মেপে দিনে একবার চাল-ডালের ঠান্ডা খিচুড়ি খেতে দেওয়া হতো। কখনো-বা দুদিনে একবার। খেতে গেলে দাঁতের নিচে বালি কিরকির করত। খিদার যন্ত্রণা, ধর্ষিত নারীদের আর্তনাদ আর মশার উৎপাতে রাতে ঠিকমতো ঘুমাতে পারত না কেউ। মড়ার মতো পড়ে পড়ে ঘুমাত শুধু তারা, বাঁচার আশা ছেড়ে দিয়েছিল যারা। নিজেদের জীবনেরই কোনো মূল্য ছিল না তাদের কাছে, মশার কামড়ে আর ভয় কী। হয়তো তারা মানবিক বোধের ঊর্ধ্বে উঠে গিয়েছিল। মড়ার মতো তারা পড়ে থাকত শক্ত মাচায়। সকালে জেগে উঠত চোখেমুখে অন্তহীন বিস্ময় নিয়ে। বেঁচে আছে এ কথা বিশ্বাস করতে কষ্ট হতো। কারণ, প্রতি রাতে ঘুমানোর আগে তারা ভাবত, এই ঘুমই তাদের শেষ ঘুম, আর কখনো জাগবে না, আর কখনো দেখবে না স্বর্ণবর্ণ সূর্যোদয়, পৃথিবীর এই বিপুল বৈভব। গভীর রাতে ঘুমের ভেতর আজরাইল তার লম্বা হাতকে আরো লম্বা করে বুকের খাঁচাটা খামচে ধরে প্রাণটা ছিনিয়ে সিদরাতুল মুনতাহার দিকে উড়াল দেবে। অথচ প্রতি রাতেই আজরাইল তাদের সঙ্গে ছলনা করত। পুব দিগন্তে সূর্য ওঠে। প্রাচীন বৃক্ষের শাখা-প্রশাখা আর লতাপাতা ভেদ করে সূর্যকিরণ ঠিকরে পড়ে তাদের চোখে। তারা জাগে। বিস্ময় কাটিয়ে উঠলে ভয় ভর করে তাদের ওপর। প্রহরীদের ভয়। কারণ, রোজ ভোরে শুরু হতো নির্যাতনের পালা। একসঙ্গে চার-পাঁচজনকে এক জায়গা জড়ো করে হাত-পা বেঁধে মুক্তিপণের জন্য মারধর করা হতো। কারো পিঠে চলত চাবুকের প্রহার, কারো হাত-পায়ের নখ উপড়ে ফেলত প্লায়ার্স দিয়ে, কারো অ-কোষ টিপে ধরে রাখত নিষ্ঠুর হাতে। অসহ্য যন্ত্রণায় তারা যখন চিৎকার করত প্রহরীরা তখন মুখের সামনে ধরে রাখত মোবাইল ফোন। ফোনের অপর প্রান্তে নির্যাতিতদের আত্মীয়স্বজন। নির্যাতন করে প্রত্যেকের বাড়ির ফোন নম্বর আগেই সংগ্রহ করে নেওয়া হয়। প্রাণের ভয়ে সবাই ফোন নম্বর দিয়ে দেয়। যদি কেউ বলত, ভাই, আমার বাবার তো কোনো ফোন নাই, প্রহরীরা তখন বলত, তোমার ভাইয়ের তো আছে?
আমার কোনো ভাইবোন নাই।
তোমার গ্রাম তো আছে। গ্রামের মেম্বার-চেয়ারম্যানের নম্বর দাও।
আমি গরিব মানুষ, তাদের নম্বর কি আমি জানি!
জানো না? তাহলে বাড়ির ঠিকানা দাও।
বাড়ির পূর্ণাঙ্গ ঠিকানা দিয়ে সে হাঁফ ছাড়ত। যাক, নির্যাতন থেকে তো বাঁচা গেল। আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠত তার চেহারা। আনন্দটা দুদিন লেগে থাকত চোখেমুখে। তৃতীয় দিন প্রহরীরা তার কানে ফোন ধরিয়ে দিয়ে বলত, কথা বলো তোমার বাবার সঙ্গে, মায়ের সঙ্গে, বউয়ের সঙ্গে অথবা গ্রামের মেম্বার-চেয়ারম্যানের সঙ্গে। সে তখন বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে যেত। পাজুবানের হাত এত লম্বা! কোথায় বাংলাদেশের আমতলা জামতলা কাশতলা গ্রাম। সেখানেও পৌঁছে গেল তার লোকেরা! বিস্ময় কাটত প্রহরীদের চাবুকের প্রহারে, কথা বল শুয়োরের বাচ্চা।
হ্যালো মা, আমি রফিকুল।
হ্যালো বাবা, আমি সাইফুল।
হ্যালো ছোটন, আমি তোর ঝোটন ভাইয়া।
হ্যালো খোকার মা, আমি খোকার বাপ।
কমলের কাছে তার বাড়ির ফোন নম্বর চাইলে সে বলল, তার বাবা-মা কেউ বেঁচে নেই। সে তাদের একমাত্র সন্তান। নদীতে গ্রামের বাড়ি বিলীন হয়ে গেলে সে ঢাকায় চলে যায়। ঢাকায় তার স্ত্রী আছে, কিন্তু তার মোবাইল নম্বরটি মুখস্থ নেই। মোবাইল সেটে নম্বরটি সেভ করা ছিল, গোরকঘাটায় অপহরণকারীরা সেটটি কেড়ে নিয়ে গেছে।
প্রহরীরা কি তার কথা বিশ্বাস করে? নিশ্চয়ই কারো না কারো নম্বর মুখস্থ আছে তোমার। ধানাই-পানাই করে কোনো লাভ নেই, ভালোয় ভালোয় নম্বরটি বলে দাও।
বন্ধু-বান্ধবদের অন্তত একটি নম্বর মনে করার বহু চেষ্টা করল কমল। নাহ্, স্মৃতি তার সঙ্গে প্রতারণা করল। ব্যস, শুরু হয়ে গেল নির্যাতন। কখনো লাঠির ঠ্যাঙানি, কখনো চাবুকের প্রহার। সে ঝিম মেরে সয়ে যায়। দুদিন চলল মারধর। তৃতীয় দিন হাতের নখে ঢোকানোর জন্য যখন সুচ আনল, হঠাৎ তার মনে পড়ে গেল ব্যাগের গোপন পকেটে রাখা আসগর বাবুর্চির আমানত কুড়ি হাজার টাকার কথা। মানসিক চাপে টাকাগুলোর কথা ভুলেই গিয়েছিল। এই টাকার বিনিময়ে সে নির্যাতন থেকে বেঁচে গেল। কে জানে কেন, বাড়তি টাকার জন্য প্রহরীরাও তার ওপর জোর-জবরদস্তি কিছু করল না আর। হয়তো ভেবেছে, জবরদস্তি করে লাভ নেই, দিতে পারবে না।
দীপঙ্করের কাছে প্রহরীরা মুক্তিপণ দাবি করলে কমলের সুরে সুর মিলিয়ে সে বলল, তার বাবা-মা বেঁচে নেই এবং বসতভিটা ছাড়া জায়গাজমি বলতে কিছু নেই। ঢাকায় ছোটখাটো একটা চাকরি করে কোনোমতে সে পড়ালেখা চালিয়ে যাচ্ছে, মেরে ফেললেও তার পক্ষে মুক্তিপণ দেওয়া সম্ভব নয়। যথারীতি প্রহরীরা বলল, তাহলে বাড়ির ঠিকানা দাও। এবার সে গ্যাঁড়াকলে আটকে গেল। প্রাণের মায়ায় বাড়ির ঠিকানা দিতে বাধ্য হলো। দুদিন পর খবর এলো সে যা বলেছে তার সবই মিথ্যা। তার বাবা-মা আছে এবং উপজেলা সদরে বাবার বিশাল চালের আড়ত আছে। হাজার হাজার টাকার কারবার। মুখে আর কথা ফোটে না তার। মিথ্যা বলার শাস্তি হিসেবে তিনদিন তাকে উপোস রাখল, পাশাপাশি চলল নির্যাতন। এতো নির্যাতনের পরও তার একটাই কথা, মুক্তিপণের কথা কিছুতেই বলবে না বাবাকে। মেরে ফেললেও না। প্রহরীরা যখনই তার মুখের সামনে ফোনটি ধরে তখনই সে মুখে তালা এঁটে বসে থাকে। যতই মারে, কিছুতেই খোলে না। তার সহ্যক্ষমতা দেখে প্রহরীরাও অবাক বনে, বাপ রে, মানুষ না গ-ার! এত মার খেয়েও মুখ খোলে না হারামজাদা! একদিন প্রহরীরা তার মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে বলল, হয় কথা বল, নইলে গুলি। তবু সে মুখ খুলল না, চোখ বুজে সটান দাঁড়িয়ে রইল। বিপদ টের পেয়ে তার হয়ে কমল তখন তার বাবার সঙ্গে কথা বলে।
হ্যালো আঙ্কেল!
ধুত্তুরি তর আঙ্কলের গুষ্টি কিলাই।
আঙ্কেল আমি রাহাত কমল। দীপঙ্করের বন্ধু।
কইলাম ত আমি বিশ্বাস করি না।
প্লিজ আঙ্কেল, আমরা ঘোরতর বিপদে পড়েছি।
গুষ্টি কিলাই বিপদের, দীপঙ্করের বাবা খেদ ঝাড়ে, এমুন পুত অওয়াইয়া আমি ভুল করছি। সারা জনম আমারে দুঃখ দিছে। নানা বাহানায় আমার হাজার হাজার টেহা নষ্ট করছে, ধুকা দিয়া লইয়া গেছে। হে পোলা নামের কলঙ্ক। আমি এক টেহাও দিতারতাম না।
না দিলে ছেলের মুখ কোনোদিন আর দেখবেন না।
মইরা যাকগা। এমুন পোলার মুখ দেহার আমার আউস নাই।
কথা বুঝতে চেষ্টা করেন আঙ্কেল, থাইল্যান্ডের জঙ্গলে মানবপাচারকারীরা আমাদের আটকে রেখেছে। মুক্তিপণ ছাড়া ছাড়বে না।
মানবপাচারকারী! এবার আঁতকে উঠল দীপঙ্করের বাবা। চুপ করে রইল খানিকক্ষণ। শব্দটা হয়তো তার পরিচিত ঠেকে। পত্রিকায় এমন শব্দ হয়তো বহুবার পড়েছে, রেডিও-টেলিভিশনেও হয়তো শুনেছে। সমুদ্রপথে মানবপাচারের ঘটনা হয়তো তার অজানা নয়। টেলিভিশনের সংবাদে দেখা লংকাবি দ্বীপের পুলিশ সদর দপ্তরে ঠাঁই পাওয়া নিখোঁজ শিবুর কথাও হয়তো তার মনে পড়ে। এবার সে নিস্তেজ কণ্ঠে বলে, আমি দীপঙ্করের লগে কতা কইতাম চাই, হেরে দেও।
দীপঙ্কর কী আর করে, কাঁপা হাতে ফোনটা তাকে ধরতে হলো, কথা তাকে বলতে হলো। তবে একটা শর্তে মুক্তিপণ হাতে পাওয়া মাত্র তাকে যেন দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়। প্রহরীরা দিলো পালটা শর্ত, তাহলে নগদ তিন লাখ টাকা দিতে হবে। সে আপত্তি করল না। তার বাবাও না। তবে সময় লাগবে। জমা টাকা যা ছিল জমি কেনায় খরচ হয়ে গেছে। জমি বেচে টাকা হাতে পেতে সপ্তাহ-দশ দিন লেগে যাবে।
ওদিকে তালেবের বাবা প্রথমে বিশ্বাস করতে পারেনি তার ছেলে আদমপাচারকারীর খপ্পরে পড়েছে। এতো বছর সে সরকারি চাকরি করেছে, চাকরির সুবাদে কত জায়গায় ঘুরেছে, কোনোদিন শোনেনি মানবপাচারকারীরা এভাবে মানুষকে বন্দি করে মুক্তিপণ আদায় করে। ফোনে তালেবের মুখে এসব কথা শুনে প্রথমে রূপকথার কাহিনি বলে মনে হয়েছিল, পরে ছেলের বাঁচার আকুতি তাকে অস্থির করে তোলে। যত যাই হোক, নিজের ঔরসের সন্তান। সন্তানের আর্তনাদ কোন বাবা সইতে পারে? চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার সময় এককালীন পাওয়া চার লাখ টাকা তালেবের মায়ের নামে পোস্ট অফিসে জমা রেখেছিল, বাধ্য হয়ে তুলতে হলো সেই টাকা। তালেবের ফোন পাওয়ার পরের দুদিন ছিল সরকারি ছুটি, টাকা উত্তোলনের আবেদন করল রোববার। সরকারি কাজ, কত টেবিল ঘুরতে হয়। টাকা হাতে পেতে লেগে গেল দশ দিন। বারো দিনের মাথায় সে টেকনাফ গিয়ে হায়দর আলীকে দেড় লাখ টাকা বুঝিয়ে দিলো। টাকাপ্রাপ্তির সংবাদটা সেদিনই পৌঁছে গেল পাজুবানের কাছে। প্রহরীরা তালেবকে জানাল, দুদিনের মধ্যে তাকে মালয়েশিয়া পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে। তালেব শুনল, তবে ঠিক বিশ্বাস করতে পারল না। এই বন্দিদশা থেকে মুক্তির আশা সে ছেড়ে দিয়েছে। এখানেই তাকে মরতে হবে, যেভাবে মরেছিল ভাগ্যাহত শত শত আদম এবং যেভাবে তাদের গণকবর দেওয়া হয়েছিল, ঠিক সেভাবে তাকেও, জানাজা আর কাফন ছাড়া, মাটিচাপা দিয়ে রাখবে। এই জঙ্গলের মাটিতেই মিশে যাবে তার অস্থিমজ্জা। বিশ্বাস করতে পারেনি তার বাবা তার মতো নালায়েক সন্তানের মুক্তির জন্য দেড় লাখ টাকা পণ দেবে।
পেদাং বেসার জঙ্গলে বন্দিত্বের এক মাস চব্বিশ দিন পর সোয়া পাঁচশো আদমবোঝাই যে-দুটি ট্রলার মালয়েশিয়ার উদ্দেশে যাত্রা করে তার একটিতে ছিল শিবু, অন্যটিতে ওসমান আর তালেব। মুক্তিপণ দিতে পারেনি ওসমান। নেহাত ভাগ্যের জোরে সে বন্দিশিবির থেকে মুক্তি পায়। তালেবকে যেদিন মালয়েশিয়াগামী ট্রলারে তোলার জন্য সাগরপারে নেওয়া হচ্ছিল, তার পিছে পিছে সেও হাঁটা ধরল। প্রহরীরা তাকে আলাদাভাবে খেয়াল করেনি। সোয়া পাঁচশো আদমের বিশাল বহর, কজনকে আর খেয়ালে রাখা যায়। প্রহরীরা ভেবেছিল তালেবের মতো সেও হয়তো মুক্তিপণ পরিশোধ করেছে। অথবা খেয়ালে তাদের ঠিকই ছিল, মুক্তিপণ হিসেবে কানাকড়িও যে দিতে পারেনি ঠিকই জানা ছিল। ওসমানের অবস্থা দেখে তাদের মনে হয়তো দয়া জেগেছিল। শুকিয়ে সে এমন কঙ্কালে পরিণত হয়েছিল, তার ওপর বিচি-পাঁচড়া উঠে শরীরের এমন দশা হয়েছিল, তার বউ তো নয়ই, বাবা-মাও তাকে ঠিকমতো চিনতে পারত কিনা সন্দেহ।
শিবুর কাছে মুক্তিপণ হিসেবে কানাকড়িও দাবি করেনি পাজুবানের লোকেরা। না করার কারণ জানে না শিবু। সিতারাবানুও না। পৃথিবীতে নানা অলৌকিক কা- ঘটে। নেপথ্য কারণ মানুষ জানে না। সিতারাবানুও তো মানুষ, সে জানবে কী করে। জানার চেষ্টাও করেনি। তবে তার অনুমান পাজুবান অংকাচোতেফান ও তার গ্যাংয়ের লোকেরা হয়তো ভেবেছিল, যে-মানুষ অনিবার্য মৃত্যুর হাত থেকে এতবার বেঁচে গেছে নিশ্চয়ই তার অলৌকিক কোনো ক্ষমতা আছে। পাজুবান তো মানুষ এবং সে বিশ্বাসী। অলৌকিক ক্ষমতাকে সে অবিশ্বাস করে কেমন করে। উপায় থাকলে শিবুকে সে দেশে পাঠিয়ে দিত। উপায় হয়তো ছিল। ফিরতি জাহাজে উঠিয়ে দিতে পারত। কেন ওঠাল না তার কারণ অজানা। যেমন অজানা তালেব আর ওসমানের সঙ্গে কঙ্কালসার শিবু ট্রলারে ওঠার সময় প্রহরীরা বাধা না দেওয়ার কারণ।
বাকি থাকল জুলফিকার। মুক্তিপণ সে দিতে পেরেছিল কিনা জানে না শিবু। কীভাবে জানবে? তখন তো সে মালয়েশিয়ার পথে। ওসমান বা তালেবও জানে না। দীপঙ্করও না। জানে শুধু সিতারাবানু। আর জানে কমল। বন্দিদশার সময় সে জুলফিকারের সামগ্রিক অবস্থা সংক্ষেপে টুকে রেখেছিল এভাবে – জুলফিকার : ফোন। আবার মাথায় গ-গোল। নাওয়া খাওয়াহীন। বৃষ্টিতে ভেজা। জ্বর। প্রলাপ। সংস্কৃত শ্লোক। বেদ? উপনিষদ? রামায়ণ? মহাভারত? (পরে জেনে নিতে হবে)। কান্না। প্রলাপ। ফাঁসি।
সংক্ষিপ্ত এসব টোকাটুকির বৃত্তান্ত হচ্ছে, এই বউয়ের সঙ্গে ফোনে কথা বলার পরপরই জুলফিকারের মাথায় আবার গ-গোল দেখা দিলো। তাকে তখন ঠিক চেনা যেত না। সারা গায়ে বিচি-পাঁচড়া। সাদা জোব্বা আর পায়জামাটা ধুলো-ময়লায় বিশ্রী হয়ে উঠেছিল। ময়লা রুমালটা কোমরে বেঁধে রাখত সারাক্ষণ। নামাজের ধার ধারত না। কেউ নামাজের কথা মনে করিয়ে দিলে চোখ পাকিয়ে ঠোঁট খিঁচিয়ে খিস্তি করত, কলমা জানস হারামজাদা? জানস? তার খিস্তি শুনে এত দুঃখের মধ্যেও বন্দিরা হি-হি করে হাসত। খানাপিনার কথা খেয়ালে থাকত না। পাতায় মুড়ে সামনে কেউ খিচুড়ি এনে দিলেও ছুঁয়ে দেখত না। দীপঙ্কর বা কমল কখনো জোর করে মুখে তুলে দিলে কয়েক লোকমা খেত। মজা পেয়ে গেলে নিজ হাতে খাওয়া শুরু করত। খেলে আর বসে থাকতে পারত না, আধোয়া হাত নিয়েই মাচায় শুয়ে পড়ত। খানিকের মধ্যেই গভীর ঘুমে তলিয়ে যেত। দুপুরে ঘুমালে সন্ধ্যা গড়িয়ে গোটা রাত ফুরিয়ে যেত, একটিবার নড়াচড়া করত না। একবার জেগে গেলে আর ঘুমাত না, বসে বসে নখ দিয়ে গায়ের বিচি-পাঁচড়া খুঁটত। মাঝেমধ্যে শেষ রাতে ঘুম থেকে জেগে ওয়াজ শুরু করে দিত। ওয়াজের বিষয় ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে ওই একটাই, হাশরের মাঠে খোদার হুকুমে এক চোরকে লানতের ফেরেস্তারা দুই বাহু ধরে জাহান্নামের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। চোর বেটা হাঁটে আর খানিক পরপর আরশের দিকে তাকায়। খোদার কৌতূহল জাগে। বারবার পেছনে তাকাচ্ছে কেন লোকটা? হেতু জিজ্ঞেস করলে চোর বলল, মাবুদ, শুনেছি তুমি রহমানুর রহিম। পরম দয়ালু। বারবার পিছনে তাকিয়ে দেখছি তোমার রহমত আমার দিকে ধেয়ে আসছে কিনা।
খোদার রহমতের দরিয়ায় তখন তুফান উঠল। কুদরতি জবানে তিনি এরশাদ করলেন, হে আদম সন্তান, সারা জীবনে একটি পুণ্যের কথা বলো, যার বদৌলতে তুমি ক্ষমা পেতে পারো।
আমার মনে পড়ে না মাবুদ।
স্মরণ করো।
পাপ ছাড়া আর কিছুই আমার মনে পড়ছে না মাবুদ।
স্মরণ করো।
কী স্মরণ করব মাবুদ, জীবনটা তো পাপেতাপে ভরপুর, পুণ্য বলতে কিছু তো নেই। শুধু একটি কথা মনে পড়ছে।
বলো কী সেই কথা।
একদিন বয়সের ভারে ন্যুব্জ এক প-িত হাঁটুজলের নদী পার হচ্ছিলেন। পরনে ধুতি-পাঞ্জাবি। দুই হাতে বই ছিল বলে জুতাজোড়া নিতে কষ্ট হচ্ছিল। আমি তার জুতা দুটি বগলে নিয়ে নদী পার হতে তাকে সাহায্য করেছিলাম। জানি না এটি কোনো পুণ্যের কাজ কি না।
জুলফিকার প্রশ্ন করে, খোদা তকন কী কলো জানো?
কেউ উত্তর দেয় না। কে উত্তর দেবে? এই মরণদশায় কার মুখে এতো কথা ফোটে। তা ছাড়া একই ওয়াজ কতবার শোনা যায়। জুলফিকার তখন আবার বলতে শুরু করে, আল্লাহ তখন ফেরেশতাগেরোক কলো, হে ফেরেশতারা, তোমরা হামার এই প্রিয় বান্দাক সহি-সালামতে পুলসিরাত পার করে দ্যাও।
সোয়া পাঁচশো আদমবোঝাই ট্রলার দুটি যেদিন মালয়েশিয়ার উদ্দেশে ছেড়ে গেল সেদিন খুব বৃষ্টি হয়েছিল। টানা দুই ঘণ্টার ঝুম বৃষ্টি। সঙ্গে আকাশ ফাটানো বজ্রপাত। একটা প্রাচীন পদাউকের তলায় ঠায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজল জুলফিকার। একটুও নড়চড় ছিল না। দৃষ্টি ছিল উদাস এবং হাত দুটো বুকের ওপর ভাঁজ করা। যেন বোধহীন পাথরমূর্তি। যেন সৃষ্টির আদিকাল থেকে এভাবে দাঁড়িয়ে। মাচা থেকে কমল তাকে বারবার ডাকল, জ্বর উঠবে হুজুর, ভেতরে আসেন তাড়াতাড়ি। সে কানে তোলেনি। ফলে যা হওয়ার হলো, রাতে প্রচ- জ্বর উঠল। রাতভর প্রলাপ বকল। কী বকছিল স্পষ্ট কিছুই বোঝা যাচ্ছিল না। পরদিন সকালে তার সিথানে এসে বসল কমল। জুলফিকার চোখ মেলে তাকাল। চোখদুটো হলুদ। কোণ বেয়ে অশ্রুবিন্দু গড়িয়ে পড়ছে।
আমি না নিষেধ করেছিলাম বৃষ্টিতে ভিজতে?
হুঁ?
জ্বর তো দেখছি কমল না!
জুলফিকার বিড়বিড় করে। কী বলে কিছুই বোঝা যায় না। মুখের কাছে কান পাতে কমল, একটু জোরে বলেন হুজুর।
গলাটাকে এবার একটু চড়ায় জুলফিকার। কমল শুনল কান পেতে। যা শুনল তাতে অবাক না হয়ে পারল না। তার কপালে বিস্ময়ের ভাঁজ পড়ল। ছুটে তার মাচায় গিয়ে ব্যাগ থেকে ডায়েরি আর কলমটা আনল। জুলফিকার তখনো বিড়বিড় করে শ্লোকটা আওড়াচ্ছে : ‘জাতস্য হি ধ্রুবো মৃত্যুর্ধ্রুবং জন্ম মৃতস্য চ। তস্মাদপরিহার্যেহর্থে ন ত্বং শোচিতোমর্হসি।’ একই শ্লোক বারবার আওড়ায়। অবিরাম। কমল তার ডায়েরিতে শ্লোকটা টুকে নেয়। সে সংস্কৃত জানে না। তবে বারবার শুনে তার মনে হচ্ছিল শ্লোকের অন্তর্নিহিত অর্থ
মৃত্যু-সংক্রান্ত। একজন মাওলানার মুখে সংস্কৃত শ্লোক শুনে তার গায়েও জ্বর ওঠার জোগাড়। হিসাব মেলাতে পারে না। সে দীপঙ্করকে ডাক দেয়, ভালো করে শুন তো দীপঙ্কর, কিছু বুঝিস কিনা!
দীপঙ্কর কান পাতে। শোনে। কিন্তু অর্থ বোঝে না। জুলফিকারের মাথায় হাত রাখল কৌতূহলী কমল।
হুজুর!
হুঁ।
আপনি বেদ পড়েছিলেন কখনো?
জুলফিকার ধীরে মাথা নাড়ায়। পড়েনি।
উপনিষদ?
না।
গীতা?
না।
তবে?
জুলফিকার আবারো শ্লোকটা আওড়াতে শুরু করে। আরো উচ্চৈঃস্বরে। পাঁজর টান টান করে সিধা হয়ে বসে কমল। এও কি সম্ভব? কী আশ্চর্য! তার গা ছমছম করে। জঙ্গলের ভেতর মৃত্যুর পদধ্বনি টের পায়। দৌড়ে সে এক প্রহরীর কাছে ছুটে যায়, লোকটা মরে যাচ্ছে ভাই। একটা নাপা ট্যাবলেট কি নাই কারো কাছে?
প্রহরী নিশ্চুপ।
প্লিজ ভাই, একটা ট্যাবলেট হলে ভালো হয়ে যেত লোকটা। খুব জ্বর।
প্রহরী ধমকে ওঠে, মরুক ফকিন্নির বেটা। এক টাকা ছাড়া বিদেশ যাওয়ার শখ!
ভাঙা মন নিয়ে কমল আবার জুলফিকারের সিথানে ফিরে এলো। জুলফিকার তখন মাচায় হেলান দিয়ে বসেছে। কপালে হাত দিয়ে দেখল জ্বর কিছুটা কমেছে। দুপুর নাগাদ জ্বর পড়ে গেল। মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে এলো। পরবর্তী দুদিন আর জ্বর এলো না। তৃতীয় দিন সন্ধ্যায় মাচায় বসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদল। কাঁদতে কাঁদতে বলছিল কোনো এক নারীর কথা। তার খোঁপার ঘ্রাণের কথা। বলছিল ইঁদুর মারার ওষুধ খেয়ে তার মৃত্যু এবং তুমুল বৃষ্টির রাতে বাঁশবাগানে পড়ে থাকা তার লাশের কথা। কান খাড়া করে তার কথাগুলো শুনছিল কমল, যদিও বুঝতে পারছিল না কিছুই। তার অবিরাম বকাবকি অসহ্য লাগছিল দীপঙ্করের। সে গলা উঁচিয়ে বলেছিল, বাড়িতে ফোন দেন হুজুর। টাকা আনেন, টাকা। বুঝলেন, কেঁদেকেটে কী হবে, টাকা ছাড়া মুক্তি নাই।
জুলফিকার কান্না থামায়। ধীরপায়ে মাচা থেকে নেমে অন্ধকারে পা বাড়ায়। হয়তো পেশাবের বেগ পেয়েছে, ভাবল কমল। বন্দিশিবিরের কোথাও পায়খানা-পেশাবখানা নেই। বেগ পেলে জঙ্গলে ছুটে যাও। কাজ সেরে কুলুপ দিয়ে মোছো। জুলফিকার মাচায় আবার ফিরেছিল কিনা খেয়াল করেনি কমল। সারারাত সাড়াশব্দ কিছু পায়নি। হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে, ভেবেছিল সে। পরদিন সকালে তাকে মাচায় দেখা গেল না। কোথায় গেল অসুস্থ লোকটা? হন্যে হয়ে কমল তাকে খুঁজতে লাগল। খুঁজতে খুঁজতে একটা খাদের পাড় ধরে জঙ্গলের ভেতরে ঢুকল। প্রকা- সব গাছগাছালিতে ভরপুর জায়গাটা। গা ছমছম করে তার। হিসহিসানি শুনতে পায়। হয়তো বাতাসের। হয়তো সাপের। অথবা জঙ্গলের গুপ্ত অন্য কোনো প্রাণীর। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ সে থমকে দাঁড়ায়। বিস্ময়ে দেখে, অচেনা এক বৃক্ষের নিচু ডালে বুনো লতায় ফাঁস নিয়ে ঝুলে আছে জুলফিকার। দেহটা ধীরলয়ে দুলছে।
আর দীপঙ্কর? প্রহরীদের দেওয়া শর্ত সে পূরণ করেছিল। হায়দর আলীকে ঠিক তিন লাখ টাকাই বুঝিয়ে দিয়েছিল তার বাবা। অথচ তার দেওয়া শর্ত পূরণ করেনি প্রহরীরা। জুলফিকারসহ যেদিন মুমূর্ষু বিরানব্বইজন আদমকে বন্দিশিবিরের অদূরে গণকবর দিলো, তার পরদিন বাঙালি ও রোহিঙ্গা মিলিয়ে যে আড়াইশো আদমকে মালয়েশিয়াগামী ট্রলারে তুলে দিলো, তাদের মধ্যে ছিল তারা দুজন কমল ও দীপঙ্কর।

ছয়

মাঝ দরিয়ায় ছোড নুকা ঢেউয়ের মাথাৎ খেলে
দেখি তারা ধীরে ধীরে নুকা ধরি ফেলে ॥

তালেব আর ওসমান শেষ পর্যন্ত মালয়েশিয়া পৌঁছতে পেরেছিল কিনা সিতারাবানু জানে না। হয়তো পেরেছে। চাকরিবাকরি নিয়ে হয়তো থিতু হতে পেরেছে স্বপ্নের দেশে। কিংবা পারেনি। এমনও হতে পারে, পেদাং বেসার বন্দিশিবির থেকে মুক্তি পেয়ে তাদের ঠাঁই হয়েছে অন্য কোনো বন্দিশিবিরে। পাচারকারীরা তো এক আদমকে এক বন্দিশিবিরে বেশিদিন রাখে না। থাইল্যান্ড আর মালয়েশিয়ায় কত যে বন্দিশিবির তার তো কোনো শুমার নেই। রোগে-শোকে হয়তো তারা বন্দিশিবিরেই মরে গেছে। এমনও হতে পারে, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া বা ইন্দোনেশিয়ার পুলিশ বা নৌবাহিনী কর্তৃক আটক হয়ে কোনো থানাহাজত, আশ্রয়শিবির অথবা কোনো কারাগারে বন্দি। যেমন বন্দি শিবু। শুধু শিবু কেন, তিন দেশের অসংখ্য আশ্রয়শিবির আর কারাগারে বন্দি হয়ে পড়েছে অভিবাসনপ্রত্যাশী হাজার হাজার রোহিঙ্গা ও বাঙালি। অথবা এমনও হতে পারে, আন্দামান সাগরে তেল ফুরিয়ে যাওয়া কোনো ট্রলারে ভাসছে। কে জানে, ক্ষুধা-তৃষ্ণা অথবা নৌডুবিতে মারাও যেতে পারে, যেভাবে মরেছে ভাগ্যাহত শত শত আদম। অথবা আন্তর্জাতিক কোনো মানবাধিকার সংস্থা আশ্রয়শিবির থেকে তাদের উদ্ধার করে দেশে পাঠিয়ে দিয়েছে। ততো দিনে তো সমুদ্রপথে মানবপাচারের এই গুপ্ত কাহিনি ফাঁস হয়ে গেছে, জেনে গেছে গোটা বিশ্ব। থাইল্যান্ডের দক্ষিণাঞ্চলের জঙ্গলে আবিষ্কার হচ্ছে ডজন ডজন বন্দিশিবির আর গণকবর। মাটি খুঁড়লেই পাওয়া যাচ্ছে শত শত মানুষের কঙ্কাল। পৃথিবীর সব মানবাধিকারকর্মী ও সাংবাদিকের চোখ এখন থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার দিকে। একযোগে মানবপাচারের ঘটনা প্রচার করছে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো। শিউরে উঠছে মানবিক বোধসম্পন্ন মানুষেরা। নিন্দার ঝড় বইছে বিশ্বজুড়ে। তথ্যপ্রযুক্তির এই উৎকর্ষের কালে মানবতার এমন বিপর্যয় ঘটতে পারে! উদ্বেগ জানিয়ে বিবৃতির পর বিবৃতি দিচ্ছে জাতিসংঘ। তাতে দারুণ বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে গেছে মিয়ানমারের জান্তা সরকার। উদ্বাস্তু রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে দেশটি যে দায় এড়াতে পারে না জোর দিয়ে বলছে সব দেশ, সব সংস্থা এবং বিশ্বের সব বিবেকবান মানুষ। কর্মসংস্থানের অভাবে ঝুঁকি নিয়ে বিদেশ পাড়ি দিচ্ছে নাগরিকরা – এ নিয়ে বাংলাদেশ সরকারও কম বিব্রত নয়। তার চেয়েও বেশি বিব্রত থাইল্যান্ড। মানবপাচার রোধে ব্যর্থ হলে দেশটিকে নিষেধাজ্ঞার হুমকি দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন। বাধ্য হয়ে পাচারকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেছে দেশটির সরকার। মানবপাচারের মূল সন্দেহভাজন হিসেবে থাই পুলিশ গ্রেফতার করেছে পেদাং বেসারের মেয়র বানজং পোংফোলকে এবং হন্যে হয়ে খুঁজছে পাচারকারী চক্রের মূল হোতা পাজুবান অংকাচোতেফানকে। ঝুঁকিপূর্ণ অবৈধ অভিবাসন সমস্যার টেকসই সমাধানের উপায় খুঁজে বের করার চেষ্টায় দফায় দফায় বৈঠকে বসছে জাতিসংঘের বিভিন্ন অঙ্গসংস্থাসহ যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং আসিয়ান দেশগুলো।
সিতারাবানু বলছে, এসব আন্তর্জাতিক প্রসঙ্গ থাক। কারণ এই বৃত্তান্ত সমুদ্রভাসা মানুষের। ওসমান আর তালেবের প্রসঙ্গ থাকুক। জোবায়ের শিবলি ওরফে শিবুকে, সন্তানের জন্য কাঁদতে কাঁদতে যার মায়ের চোখ শুকিয়ে গেছে, দেশে ফিরিয়ে আনার কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল কিনা সে-প্রসঙ্গও থাকুক। এই বৃত্তান্তে তাদের কথা আর একটিবার উচ্চারণ করতে সিতারাবানু অনিচ্ছুক। তার চোখ এখন আন্দামান সাগরে ভাসমান একটি মাছ ধরার ট্রলারের দিকে, বাঙালি ও রোহিঙ্গা মিলিয়ে যেখানে আড়াইশো আদম, যাদের বেশিরভাগই সাউথ বেঙ্গল ৩-এর যাত্রী, যারা মৃত্যুকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে কিংবা মৃত্যু তাদের তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। অতি ব্যবহারে জীর্ণ বহু বছরের পুরনো ট্রলার। মৌসুমি বায়ু গর্ভে নিয়ে সমুদ্র ক্ষেপে উঠলে ঢেউয়ের দুরন্ত তোড়ে চোখের পলকে ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে, এমনই দশা। ট্রলারের মাঝি নেই, ইঞ্জিনে ডিজেল নেই, খাওয়ার মতো এক ফোঁটা পানি নেই। অলৌকিক সাহায্যের আশায় যাত্রীরা দুহাত তুলে কাঁদছে। শব্দহীন। নিরশ্রু।
সেদিন ভোরে পেদাং বেসার উপকূল থেকে ট্রলারটি নোঙর তোলার সময় তিনজন মাঝি ছিল। আড়াইশো যাত্রীকে তারা চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে মালয়েশিয়ার উপকূলে নামিয়ে দেওয়ার কথা ছিল। টানা দশ ঘণ্টা চলল ট্রলার। পড়ন্ত বিকেলে পশ্চিম দিগন্তে গাছগাছালির ক্ষীণ রেখা দেখে যাত্রীদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা কেটে যেতে লাগল। ওই রেখাটাই বুঝি স্বপ্নভূমি মালয়েশিয়া! আনন্দে তারা এতোটাই উৎফুল্ল হয়ে উঠল ক্ষুধা-তৃষ্ণার কথা প্রায় ভুলেই গেল। অথচ তখন, সমুদ্র যখন ধীরে ধীরে রঙিন হয়ে উঠছিল, ট্রলার থামিয়ে নোঙর ফেলল মাঝিরা। মাঝসমুদ্রে হঠাৎ নোঙর ফেলার কারণ বুঝতে পারল না কেউ। ভাবল, হয়তো অন্য কোনো ট্রলার এসে নিয়ে যাবে তাদের। মালয়েশিয়ার উপকূলে পৌঁছে গেল কিনা জানতে চাইল কমল। মাঝিরা জবাব দিলো না। উদ্বিগ্ন কমল আবার জিজ্ঞেস করলে এক মাঝি ধমকে উঠল, চুপ।
কমল চুপ করে। খিদায় সে এতোটাই ক্লান্ত, মুখে কথা আসছিলও না ঠিক। তাকে দেখে আর চেনাই যায় না। তার বন্ধুবান্ধব কেউ তাকে দেখলে কবর থেকে উঠে আসা নরকঙ্কাল ভেবে নিশ্চিত দৌড়ে পালাবে। সারা গায়ে বিচি-পাঁচড়া। গায়ের গোরা রংটা রোদে পুড়ে তামাটে হয়ে পড়েছে, চোখের নিচে বুড়োদের মতো পড়েছে অসংখ্য ভাঁজ। লম্বা চুলগুলো আরো লম্বা হয়ে কাঁধ ছুঁয়েছে। মুখে গজিয়েছে লম্বা দাড়ি। বাকিদেরও একই হাল। দুপুরে ভাত রান্না হয়েছে, অথচ কাউকে খেতে দেয়নি। তখন, নোঙর ফেলার পরে, হয়তো নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায়, পলিথিনের ঠোঙায় মাঝিরা এক মুঠো ঠান্ডা ভাত আর দুই টুকরো করে শসা খেতে দিলো সবাইকে। খেতে গিয়ে হেঁচকি ওঠে যাত্রীদের। ভাত খেতে দিয়েছিল আগের দিন দুপুরে, পেট তো শুকিয়ে কাঠ, হেঁচকি ওঠাটাই স্বাভাবিক। এক ঢোক পানির জন্য তারা আকুতি জানাল। মাঝিরা পানি দিতে কার্পণ্য করল না। জনপ্রতি দুই মগ, কেউ কেউ তিন মগও পেল।
মাঝিদের এই উদারতা দেখে কমলের মনে সন্দেহ উঁকি দিয়েছিল। দুপুরে এক মগ পানির জন্য যাত্রীরা কতবার বাপ ডেকেছে, কতবার হাতেপায়ে ধরেছে, তবু তাদের মন এতটুকু গলেনি, অথচ এখন কিনা তারা দাতা হাতেম তাঈ! তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় একটা বিপদের গন্ধ টের পাচ্ছিল তখন। খানিকের মধ্যে সন্দেহটা আবার কেটেও গেল। ভাবল, ট্রলার হয়তো সত্যি সত্যি মালয়েশিয়ার উপকূলে পৌঁছে গেছে। পানি পর্যাপ্ত আছে বলেই হয়তো খেতে দিচ্ছে। শেষ বেলায় মাঝিরা হয়তো যাত্রীদের অভিশাপ নিতে চাচ্ছে না।
আকাশটাকে শূন্য করে দূর পশ্চিমে গাছগাছালির ক্ষীণ রেখাটির আড়ালে পালিয়ে গেল সূর্য। চারদিকে শুরু হলো আলো-অন্ধকারের পাঞ্জা লড়াই। ঠিক তখনই ট্রলারটি দেখা গেল। অস্তাচলের দিক থেকে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। প্রথম দেখতে পায় দীপঙ্কর, তারপর কমল এবং তারপর বাকিরা। কমল ভাবল, থাই বা মালয়েশিয়ান জেলেদের ট্রলার হবে হয়তো। সারাদিনে এমন ট্রলার আরো দেখা গেছে। কেবিনের রেলিং ধরে মাঝিরা দাঁড়িয়ে। তাদের চোখ দেখে মনে হচ্ছিল এতক্ষণ তারা ট্রলারটির প্রতীক্ষাই করছিল।
ধীরে ধীরে আরো কাছে এগিয়ে এলো ট্রলারটি। পাছার সঙ্গে পাছা লাগাল। পাটাতনে একদল অস্ত্রধারী দাঁড়িয়ে। রোদেপোড়া তামাটে মুখ আর চোখগুলো খুনির। ডাকাত ভেবে যাত্রীরা হই-হুল্লোড় শুরু করে দিলে এক মাঝি বলল, ডাকাত নয়, খাবার আর ডিজেল নিয়ে এসেছে তারা। খাবারের কথা শুনে আনন্দ কি আর রাখার জায়গা পায় যাত্রীরা! সমস্বরে হর্ষধ্বনি দিতে শুরু করল। তবে তা কয়েক মুহূর্ত। সহসা তারা এই ভেবে চিন্তিত হলো, তবে কি মালয়েশিয়া আরো দূরে?
দূরে হবে কেন? এসেই তো পড়েছি। অভয় দিলো এক যাত্রী।
তাহলে ডিজেল আর পানি কেন? প্রশ্ন করল আরেকজন।
প্রথমজন বলল, আমাদের নামিয়ে দিয়ে মাঝিদের আবার পেদাং বেসায় ফিরে যেতে হবে না? তেল-পানি ছাড়া যাবে কেমন করে?
হর্ষধ্বনির ওই মুহূর্তগুলোই কাজে লাগাল তিন মাঝি। যাত্রীরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই চট করে তারা ট্রলারটিতে উঠে পড়ল, আর অমনি ভটভট শব্দ তুলে কালো ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে যেদিক থেকে এলো ট্রলারটি সেদিকে ছুটতে শুরু করল। হতভম্ব যাত্রীরা অবিশ্বাস্য চোখে সেদিকে তাকিয়ে রইল। তারা ভেবে পায় না এই অকূল সাগরে এতগুলো মানুষকে ফেলে কোথায় চলে যাচ্ছে মাঝিরা। আশঙ্কার বাস্তব রূপ দেখে কমলের ঠোঁটে হাসি ঝুলতে লাগল। তখন তাকে ধ্যানমগ্ন ঋষির মতো দেখায়। যাত্রীদের উদ্দেশে বলল, তারা আমাদের ফেলে পালাচ্ছে।
পালাচ্ছে মানে?
আর কখনো ফিরবে না।
তুমি কী করে জানো ভাই? তারা কি বলেছে তোমাকে?
সব কথা বলতে হয় না, কিছু কথা আন্দাজ করে নিতে হয়।
বিপন্ন যাত্রীরা পরস্পরের মুখের দিকে তাকায়। নিঃশব্দে। চোখেমুখে জিজ্ঞাসা, লোকটা কি সত্যি বলছে? মাঝিরা সত্যি সত্যি আমাদের ফেলে পালাচ্ছে? উত্তর দিতে পারে না কেউ। বিস্মিত চোখে সবাই আবার কমলের দিকে তাকায়। বিস্ময় কেটে অসহায়ত্ব ফুটে উঠতে থাকে সবার চেহারায়। বিপন্ন কণ্ঠে একজন বলে, আমরা এখন কোথায় যাব? কী হবে আমাদের?
কী আর হবে, মরণ।
কথাটি কমল এমন গলায় বলল, তাদের মনে হলো, সত্যি সত্যি যেন পাটাতনের নিচে ওত পেতে আছে মৃত্যু। এখনই থাবা মেরে জানটা কবজ করে নিয়ে যাবে। সবার চোখেমুখে মৃত্যুর বিভীষিকা জেগে উঠল। দিগি¦দিক জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ল তারা। কেউ কেউ দোয়া-দরুদ পড়তে শুরু করল। কান্নাকাটির রোল পড়ে গেল ট্রলারজুড়ে। আতঙ্কে জ্ঞান হারিয়ে ফেলল কয়েকজন। মানসিকভাবে চরম বিপর্যস্ত দীপঙ্কর পাগলের মতো বোবা চিৎকার করতে লাগল। মাঝিরা পালিয়ে গেছে সে জন্য নয়, সে চিৎকার করছে কল্পচোখে ভেসে ওঠা নিজের পচা-গলা লাশ দেখে। সমুদ্রের মাছেরা লাশটি খুবলে খাচ্ছে, সে দেখতে পায়। খেতে খেতে এক বিন্দু মাংসও আর অবশিষ্ট রাখে না। তারপর কঙ্কালটা তলিয়ে যাচ্ছে সমুদ্রের গভীর তলদেশে – সে স্পষ্ট দেখতে পায়। নিজের এহেন পরিণতি দেখে সে থরথর করে কাঁপে। মুমূর্ষু মানুষের মতো চোখ দুটো ঘোলা হওয়া ধরে। কমল তাকে ধমকায়, কাপুরুষের মতো মরার আগেই মরে যাচ্ছিস দীপঙ্কর? তুই না দর্শনের ছাত্র? তুই না ডারউইন, ফ্রয়েড আর বার্ট্রান্ড রাসেল পড়েছিস? এতো এতো পাঠ তোর বৃথা গেল? তুই না বুড়ো সান্তিয়াগোর বীরত্বের কথা বলতি? তার কথা ভুলে গেলি?
বুড়ো সান্তিয়াগো! নামটা শুনে দীপঙ্করের চেহারায় সেঁটে থাকা আতঙ্কের ছাপ কিছুটা হালকা হওয়া ধরে। আর্নেস্ট হেমিংওয়ের বিখ্যাত উপন্যাস দি ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সির প্রধান চরিত্র সান্তিয়াগো। ঔপন্যাসিক হেমিংওয়ের সান্তিয়াগো আর নাট্যকার সেলিম আল দীনের তিরমন এই দুই চরিত্র নিয়ে গেল বছর তার পত্রিকার ঈদ সংখ্যায় সে ছোট্ট একটা প্রবন্ধ লিখেছিল। দেখিয়েছিল দুই চরিত্রের তুলনামূলক বীরত্ব। পাটাতনে বসে কাঁপতে কাঁপতে বুড়ো শিকারি সান্তিয়াগোর স্থলে সে নিজেকে কল্পনা করে। কমল তার পিঠে হাত রেখে বলে, যেভাবে বলেছিল সাউথ বেঙ্গল-৩ জাহাজে, খাবার নিয়ে সংঘর্ষের শেষে আমাদের বাঁচিয়ে রাখতে প্রকৃতির যদি আপত্তি থাকে, শত চেষ্টা করেও লাভ হবে না। যতক্ষণ বেঁচে আছিস লড়াই কর, যেমন লড়াই করেছিল সান্তিয়াগো। এই পৃথিবী একটা যুদ্ধের মাঠ। প্রকৃতি তার লড়াকু সন্তানদের ভালোবাসে।
কথাগুলো পবিত্র স্তোত্রের মতো মনে হয় দীপঙ্করের। যেন গীতার কোনো শ্লোকের বাংলা অনুবাদ। মহামতি কৃষ্ণ যেন উপদেশ দিচ্ছেন অর্জুনকে। বিমর্ষ চোখে সে কমলের মুখের দিকে তাকায়। উত্তীর্ণ সন্ধ্যার আলো-অন্ধকারে মুখটা স্পষ্ট দেখা যায় না। কান্নার ঢেঁকুর ওঠে তার বুকের ভেতর থেকে। সঙ্গে বেরিয়ে আসে গভীর জিজ্ঞাসা, এখন কী হবে আমাদের?
যা হওয়ার হবে। চল ইঞ্জিন চালু করা যায় কিনা দেখি।
বলে আর দাঁড়াল না কমল, সোজা ইঞ্জিনরুমে ঢুকে গেল। পেছনে দীপঙ্করও। দুজনে মিলে ইঞ্জিনটা চালু করতে নানাভাবে চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো। হাল ছেড়ে দিয়ে যখন বাইরে এসে দাঁড়াল, দুজন রোহিঙ্গা ঢুকে মুহূর্তের মধ্যে চালু করে দিলো। আরেকজন ধরল হাল। কমল ও দীপঙ্কর তার দুপাশে বসে হাল ধরার কায়দা-কানুন শিখে নেয়। ট্রলার চলতে থাকে। গন্তব্যহীন। অন্ধকার ধীরে ধীরে আরো ঘন হয়ে আসে। আকাশে চাঁদ নেই। উঠবে কিনা কে জানে। মৃত্যুর কাছাকাছি দাঁড়িয়ে কে রাখে চাঁদের হিসাব! রাত ক্রমে ঊষার দিকে গড়ায়। কমল আর দীপঙ্কর পালা করে হাল ধরে। যাত্রীরা হাঁটু-মাথা এক করে ঝিমায়, কেউ কেউ নাক ডেকে ঘুমায়, কেউ আবার নিশাচরের মতো চোখ-কান খোলা রেখে শিকারির মতো মৃত্যুকে পাহারা দেয়। কাছে এলেই খপ করে ধরে ফেলবে। এতো সহজে মৃত্যুর হাতে নিজেদের সঁপে দেবে না। কমলের চোখ দুটো ঘুমে ভারী হয়ে আসতে চায়, কিন্তু ঘুমালে হাল ধরবে কে? তার দেখাদেখি দীপঙ্করও যদি ঘুমিয়ে পড়ে! তাই সে গল্প বলা শুরু করে। পূর্ববঙ্গ গীতিকার ভেলুয়া সুন্দরী আর আমির সাধুর গল্প। কথা বলার মতো শক্তি নেই, তবু চালিয়ে যায়। ভেলুয়ার গল্পটা শেষ করে সে গুনগুন করে গাওয়া ধরে
এদিকে হইল কিবা শুন বিবরণ
নছররে কি করিল যত ডাকুগণ।
সেই না ছুলুপ আর ছিল যত মাল
বেচিয়া পাইল ডাকু টাকা টালে টাল॥
তারপর কী হলো নছরের জানিস?
কোন নছর?
ওই যে পূর্ববঙ্গ গীতিকার নছর মালুম, আমিনা সোন্দরীকে ঘরে রেখে যে সমুদ্রযাত্রা করে আর ফিরল না। সুন্দরী বউকে ভুলে বিয়ে করল বার্মার অঙ্গী শহরের কন্যা এখিনকে। তার সঙ্গে সংসার পেতে কাটিয়ে দিলো ছয়টি বছর। তারপর একদিন ব্যবসার কাজে আবার সমুদ্রযাত্রা করল নছর। বাহার দরিয়ায় এলে পর্তুগিজ হার্মাদদের কবলে পড়ল তার ডিঙা। দাঁড়ি মাল্লা সুকানি টে-ল সবাইকে বন্দি করল হার্মাদরা। নছরকে বিক্রি করে দিলো এক গেরস্তের কাছে। গেরস্তের গোলামি করে নছর। বাজার-সদাই করার জন্য তাকে যে নৌকাটা দেওয়া হয়েছিল সেটি নিয়ে গোপনে একদিন সে দেশের উদ্দেশে রওনা হয়ে গেল। বেমান সাগরে তার ছোট্ট নৌকা ভেসে চলল টানা চারদিন। ক্ষুধা-তৃষ্ণায় তো সে কাহিল। আচমকা তুফান উঠল অকূল দরিয়ায়। নছর তো বেদিশ। আল্লার নামে জিকির করতে করতে সে বেহুঁশ হয়ে পড়ল। কী সুন্দর গীতিকা শোনো –
দরেয়ার পীর সেই খোয়াজ খিজির
শুনিল শুনিল যেন তাহার জিকির ॥
বড় বড় নুকা লৈয়া খাটাইয়া পাল
সারি গাইয়া যায় রে জাইল্যা বোসাইতে জাল ॥
মাঝ দরিয়ায় ছোড নুকা ঢেউয়ের মাথাৎ খেলে
দেখি তারা ধীরে ধীরে নুকা ধরি ফেলে ॥
নছররে পাইয়া তারা তুলিয়া আনিল…
গাইতে গাইতে চোখ ভারী হয়ে এলো কমলের। ঘুম আর বাঁধ মানতে চাইল না। হাঁটুতে মাথা গুঁজে নাক ডাকছে দীপঙ্কর। কমল তাকে ধাক্কা দিয়ে জাগিয়ে তোলে। হালটা তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে নোনাজলে মুখটা ধুয়ে নেয়। পুব দিগন্তে তাকিয়ে দেখে রক্তিম লালিমা। অন্ধকার হালকা হয়ে আসছে ধীরে ধীরে। সমুদ্রপাখিদের ওড়াউড়ি শুরু হয় নির্মল আকাশ জুড়ে। ভোরের পরিচিত সূর্য দেখে ট্রলারের গতিপথ টের পায় কমল। কপালে হাতের তেলো ঠেকিয়ে উদয়াচলের দিকে তাকায়। আকাশ ও সমুদ্র ছাড়া আর কিছুই ঠাওরে আসে না। এই ভেবে সে চিন্তিত হয়, সারারাত ট্রলার পুব দিকে চলেছে! তার আন্দাজ, পুবে নয়, মালয়েশিয়া দক্ষিণে। দ্রুত সে দক্ষিণে হাল ঘুরিয়ে দিলো। শিশুসূর্য বাঁয়ে রেখে ট্রলার ছুটতে লাগল দক্ষিণে। ততক্ষণে যাত্রীরাও জেগে ওঠে। খাবারের সন্ধানে তারা কেবিনের কোনাকাঞ্চি তল্লাশি শুরু করে দেয়। ট্যাঙ্কিতে কিছু পানি ছাড়া খাওয়ার মতো আর কিছু পায় না কেউ।
ট্রলার যে ডিজেলে চলে তা একবারও কমলের মাথায় আসেনি। সে ভেবেছিল ট্রলারটা এভাবে অনন্তকাল চলতে থাকবে। একবার ডাঙার নাগাল পেলে বেঁচে যাবে এই ভাবনা তাকে স্বস্তি দিয়েছিল। কালো ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে ইঞ্জিনটা যখন বন্ধ হয়ে গেল, সে ভাবল যান্ত্রিক কোনো ত্রুটি বুঝি। তখনো ডিজেলের কথা তার মাথায় এলো না। প্রায় আধা ঘণ্টা ধরে ইঞ্জিন চালুর ব্যর্থ চেষ্টার পর এক রোহিঙ্গা যখন বলল, ডিজেল ফুরাই গিইয়্যে পাঁল্লার, সে তখন চমকে উঠল। নিদারুণ বিপন্ন বোধ করতে লাগল। কোমরে হাত ঠেকিয়ে অসহায় দাঁড়িয়ে রইল। এখন কী উপায়? মাস্তুলে পাল তুলে দিলে একটা গতি হয়, কিন্তু পাল তৈরির মতো ট্রলারে কিছু নেই। কেবিনের কাঠ খুলে দাঁড়ের ব্যবস্থা না হয় করল, কিন্তু বাইবে কে? যাত্রীদের শরীরের অর্ধেক তো যমের দখলে চলে গেছে। যমের সঙ্গে লড়বে, না দাঁড়ের সঙ্গে? অগত্যা হাল ছেড়ে বসে থাকা ছাড়া উপায় থাকল না তার।
ততক্ষণে ভাটা শুরু হয়ে গেছে। ভাটার স্রোতে সওয়ার হয়ে ট্রলার চলতে থাকে দক্ষিণে। ধীরে। রোদের তীব্রতায় শরীরের হাড়সুদ্ধ সেদ্ধ হওয়ার জোগাড়। তখন যাত্রীদের মধ্যে কথাটা ছড়িয়ে পড়ল যে, দক্ষিণে শুধু সাগর আর সাগর। মহাসমুদ্র। ডাঙা বলতে কিছু নেই। ওই সমুদ্র থেকে কেউ কোনোদিন জ্যান্ত ফিরতে পারে না।
কথাটার ভার বইতে না পেরে কান্নাকাটি শুরু করে দিলো সবাই। বাঁচার সর্বশেষ উপায় হিসেবে হাতগুলো করজোড়ে তুলে ধরল, মাবুদ, আমরা তোমার গুনাগার বান্দা। এই মুশকিল তুমি আসান করো।
সমস্বরের কান্নার ভেতর দূর দক্ষিণে জাহাজের মাস্তুলটা কেউ একজন প্রথম দেখতে পেল। আঙুলের ইশারায় সে দেখাল তার পাশের জনকে। চোখগুলো ক্রমশ স্থির হলো দক্ষিণে, মাস্তুলের দিকে। মুহূর্তে মাস্তুলটা সবার নজরসীমায় চলে এলো। আনন্দে একসঙ্গে চিৎকার করে উঠল সবাই। আনন্দ ও বিষাদের অশ্রু মিলেমিশে একাকার হয়। এই ঘটনাকে তারা তাদের স্রষ্টার বিশেষ করুণা হিসেবে দেখে। নইলে প্রার্থনা শেষ হওয়ার আগেই জাহাজটা দেখা যাবে কেন? নিশ্চয়ই বান্দার ফরিয়াদ তিনি কবুল করেছেন। নিশ্চয়ই তিনি তাদের উদ্ধার করতেই জাহাজটা পাঠিয়েছেন। শুকরিয়া আদায় করতে কেউ কেউ পাটাতনে সেজদায় লুটিয়ে পড়ল।
ধীরে ধীরে আরো কাছে এগিয়ে এলো জাহাজটি। মাস্তুলে ওড়া পতাকা দেখে কমল আন্দাজ করল জাহাজটি নৌবাহিনীর। কোন দেশের নৌবাহিনী? পতাকাটি কোন দেশের? ঠিক আন্দাজ করতে পারে না সে। পৃথিবীতে কত দেশ, কত পতাকা – কটার কথা মনে থাকে! তবে মালয়েশিয়ার পতাকা যে নয়, মোটামুটি নিশ্চিত। বছর দুই আগে মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী ড. মাহাথির মোহাম্মদের স্মৃতিকথা নিয়ে লেখা অ্যা ডক্টর ইন দ্য হাউস বইটির বাংলা অনুবাদ পড়ে দেশটি সম্পর্কে জানার সুযোগ হয়েছিল তার। বইয়ের এক পাতায় মালয়েশিয়ার পতাকা হাতে ড. মাহাথিরের একটি ছবিও ছিল। পতাকার রং এখনো মনে আছে তার, এক কোণে চাঁদ-তারা খচিত, বাকিটা লাল-সাদা রেখাঙ্কিত।
কোন দেশের পতাকা তবে? থাইল্যান্ডের? তা তো হওয়ার কথা নয়। থাইল্যান্ড তো উত্তরে। তবে কি ইন্দোনেশিয়ার? কে জানে, হলেও হতে পারে। ভাটার স্রোতে ভাসতে ভাসতে ট্রলারটি হয়তো ইন্দোনেশিয়ার জলসীমায় চলে এসেছে।
যাত্রীরা হাউমাউ করে কাঁদে আর হাত বাড়িয়ে জাহাজের নাবিকদের সাহায্য প্রার্থনা করে। নাবিকেরা নিশ্চুপ। চেহারা দেখে বোঝা মুশকিল তারা বিরক্ত, না রাগান্বিত। কেবিনের ছাদে দাঁড়িয়ে কমল তাদের মতি বোঝার চেষ্টা করে। বুকটা দুরুদুরু কাঁপে। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বিপদের গন্ধ টের পায়। ভিনদেশের সমুদ্রসীমায় অনুপ্রবেশের দায়ে সবাইকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাবে না তো! নিক। এতগুলো মানুষকে মেরে তো ফেলবে না আর! বড়জোর কারাগারে চালান করবে। করুক। এই দিকচিহ্নহীন সমুদ্রে ভাসার চেয়ে কারাগার অনেক ভালো। ক্ষুধা-তৃষ্ণায় অন্তত মরতে হবে না। হাঙর-কুমিরের পেটে চলে যাওয়ার ভয় থাকবে না।
ছোট্ট একটা নৌকায় চড়ে চার নাবিক ট্রলারে উঠল। শার্টের সঙ্গে আটকানো তাদের কাঁধে পিতলের মনোগ্রাম দেখে কমল বুঝতে পারল তারা ইন্দোনেশিয়ার নৌবাহিনী। কাউকে কিছুই জিজ্ঞেস করল না তারা। জীর্ণ ট্রলারে ভাসমান কঙ্কালসার মানুষরা কারা, কোথা থেকে এসেছে, কোথায় যাবে – সবই যেন তাদের আগে থেকে জানা। অবশ্য জিজ্ঞেস করেও তো লাভ নেই। কে বুঝবে তাদের ভাষা। ইংরেজিতে বললে কমল বা দীপঙ্কর না হয় বুঝত। পরস্পরের সঙ্গে তারা এমন এক দুর্বোধ্য ভাষায় কথা বলছিল, অনেক চেষ্টা করেও কমল একটি শব্দও ঠিকমতো বুঝতে পারল না।
ছোট্ট নৌকাটি থেকে দুই টিন বিস্কুট আর কিছু মিনারেল ওয়াটারের বোতল ট্রলারে তুলল নাবিকেরা। তারপর তুলল এক টিন ডিজেল। বিস্কুট আর পানি নিয়ে যাত্রীরা কাড়াকাড়ি শুরু করে দিলে এক নাবিক ছুঁচোর মতো মুখটা কুঁচকে চিৎকার করে যে-শব্দটা উচ্চারণ করল তা কমবেশি সবাই বুঝতে পারল। তাদের কাছে ‘বাস্টার্ড’ খুব বেশি অপরিচিত শব্দ নয়। কিন্তু ক্ষুধার তোড়ে গালিটা তিষ্ঠোবার জায়গা পেল না, কাড়াকাড়ি সমানে চলতেই লাগল। ঠেলাঠেলির কারণে ট্রলারটি এমনভাবে দুলতে লাগল, নাবিকেরাও ভয় পেয়ে গেল। পরিস্থিতি নিজেদের নাগালে আনতে পিস্তল উঁচিয়ে নাবিক গুলি ছুড়ল একটা। মুহূর্তে নীরবতা নেমে এলো ট্রলারজুড়ে। হাতের ইশারায় সবাইকে শান্ত হয়ে বসতে বলল নাবিকটি। কথা অমান্য করল না কেউ, যে যার জায়গায় চুপচাপ বসে পড়ল। নাবিকেরা তখন সবার হাতে হাতে বিস্কুট আর পানি বিতরণ শুরু করে দিলো।
কমলের আতঙ্ক কিছুটা কাটে। নাবিকরা তাদের আটক করে নিয়ে যাচ্ছে না, এই ভেবে স্বস্তি বোধ করে। দীপঙ্করসহ ডিজেলের টিনটা ধরে ইঞ্জিনরুমে নিয়ে গেল। শেষ বিন্দুটুকু ঢেলে ইঞ্জিন চালু করে দিলো। দীপঙ্করকে হাল ধরিয়ে দিয়ে কেবিনের ছাদে উঠে দাঁড়াল সে। চার নাবিক ততক্ষণে তাদের নৌকায় উঠে গেছে। ট্রলার চলতে শুরু করেছে দেখে যাত্রীরা আনন্দে হই-হুল্লোড় শুরু করে দিলো। সত্যি সত্যি তবে তাদের উদ্ধার করছে নাবিকরা? আল্লাহ মেহেরবান! নৌকা থেকে তখন এক নাবিক হাতের ইশারায় কমলকে যা বোঝাতে চাইল তার অর্থ এই, দক্ষিণে নয়, ট্রলার উত্তরে ঘোরাও।
উত্তরে কেন? প্রশ্নটা করতে চেয়েছিল কমল। কিন্তু সে এতোটাই হতাশায় আক্রান্ত, প্রশ্ন করার মতো ভাষা খুঁজে পেল না। নাবিকটির চোখের ভাষা বলে দিচ্ছিল, ট্রলারের হাল এক্ষুনি উত্তরে না ঘোরালে সে অঘটন ঘটিয়ে বসবে। তারা সমুদ্রপ্রহরী, ঘটাতেই পারে। সেই অধিকার রাষ্ট্র তাদের দিয়ে রেখেছে। তাদের সঙ্গে কত অস্ত্র। দেশের স্বার্থ রক্ষার্থে একটা গুলি খরচ করলে কারো কাছে জবাবদিহি করতে হবে না।
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ভেতরে গিয়ে ট্রলারটা উত্তরে ঘুরিয়ে দিলো কমল। ঢেউ ভাঙতে ভাঙতে ট্রলার ছুটতে থাকে উত্তরে। সে চুপচাপ হাল ধরে বসে থাকে। যাত্রীদের মধ্যে অদ্ভুত নীরবতা। চোখেমুখে বিস্ময়। চিৎকার করে কেঁদেকেটে আবারো নাবিকদের সাহায্য চাইবে, না পাটাতনে কপাল ঠুকবে, ঠিক বুঝে উঠতে পারে না তারা। শুকিয়ে পেট-পিঠ এক হয়ে যাওয়া যে রোহিঙ্গা যুবক মোনাজাত ধরে সবচেয়ে বেশি কান্নাকাটি করেছিল এবং নৌবাহিনীর জাহাজের মাস্তুল দেখে অপার্থিব রোশনাইয়ে যার চেহারাটা উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল, কমলের দৃষ্টি তার দিকে। লোকটি মাথা কাৎ করে আকাশের দিকে তাকিয়ে হাসছে। তীব্র বিদ্রƒপমাখা অট্টহাসি।
মাথা সোজা করে লোকটা পাটাতনের দিকে তাকাল। চোখ বুজে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল। চোখ বুজে আছে কেন লোকটা? সূর্যের উত্তাপ কি তার দৃষ্টি ঝলসে দিয়েছে? সে কি চারদিকে অন্ধকার দেখছে? তখন, অন্ধকারে কিছু ঠাওর করতে পারছিল না বলেই হয়তো, অকস্মাৎ পা ফসকে সে সাগরে পড়ে গেল। সর্বনাশা ঢেউ মুহূর্তে তাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল বহুদূরে। পাটাতনের নিচে ওত পেতে থাকা মৃত্যুর ভয়ংকর থাবা দেখে ভয়ার্ত যাত্রীরা চিৎকার করে উঠল। তাদের চোখেমুখে আবারো জেগে উঠল মৃত্যুর বিভীষিকা।
ট্রলার চলতে থাকে। চলাটাই যেন তার নিয়তি। তিন দিন দুই রাত চলার পর যখন সন্ধ্যা ঘনাল, উত্তরে দেখা গেল আরেকটি জাহাজ। দেখতে প্রায় আগেরটির মতো। নাবিকদের পোশাকের রংও একই। শুধু পতাকার রং আলাদা। জাহাজটি দেখে আগের মতো কেউ আর উৎফুল্ল হলো না। ভীতও না। পাটাতনে সবাই ঝিম মেরে বসে রইল। দীপঙ্করের হাতে হাল ধরিয়ে কেবিনের ছাদে এসে দাঁড়ায় কমল। নতুন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হওয়ার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুতি নেয়। জাহাজটি যখন আরো কাছে এলো, বিস্ময়ে সে দেখল, তার দিকে বন্দুক তাক করে আছে এক নাবিক। সে নড়ে না। দুরন্ত সাহস নিয়ে সটান দাঁড়িয়ে থাকে। জাহাজ থেকে ভেসে এলো মাইকের শব্দ। ট্রলারের যাত্রীদের উদ্দেশে দুর্বোধ্য ভাষায় কথা বলছে এক নাবিক। কমলের অনুমান, থাই ভাষা। পেদাং বেসার জঙ্গলে পাজুবানের লোকদের মুখে এমন ভাষা শুনেছে, তার মনে আছে। কিন্তু কী তাদের বক্তব্য, কিছুই বুঝতে পারল না। বন্দুকধারী নাবিকটির হাত নাড়ানোর ধরন দেখে পূর্বাভিজ্ঞতা থেকে আন্দাজ করতে পারল, সাবধান, উত্তরে নয়। উত্তরে যাওয়া বারণ। গেলে গুলি করে মারা হবে। দ্রুত দক্ষিণে হাল ঘুরাও।
পৃথিবীকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ক্লান্ত সূর্য পশ্চিমে ডোবে। চরাচরে সন্ধ্যা নামে। আকাশ আর সমুদ্র গলাগলি করে। ছাতিফাটা তৃষ্ণায় অতিষ্ঠ হয়ে নোনাপানি গিলে বুক ভেজায় যাত্রীরা। নাড়িভুঁড়ি চিনচিন করে, তবু খায়। নোনা হলেও তো পানি। বুকটা তো অন্তত ভিজবে। এক বাঙালি, পেদাং বেসার জঙ্গলে হাতুড়ির আঘাতে যার বাঁ-হাতের আঙুলগুলো চূর্ণ করে দিয়েছিল প্রহরীরা, পাগলের মতো সে মগ কেটে কেটে নোনাপানি গিলতে লাগল। অন্ধকারে তার এই কা- কেউ দেখে না। দেখে শুধু সিতারা। সিতারাবানু। সে তো সর্বদ্রষ্টা। কিছুই তার চোখ এড়ায় না। সে দেখল, নোনাপানি গিলতে গিলতে লোকটার পেট যখন ঢোল হয়ে উঠল, হাত-পা ছেড়ে দিয়ে সে পাটাতনে শুয়ে পড়ল। যাত্রীরা তখন শোরগোল শুরু করল, মরল নাকি?
মরুক। বেঁচে থেকে কী লাভ? বলল কেউ একজন।
লোকটার হেঁচকি ওঠে। নাকে-মুখে জল ছাড়ে। ডাঙায় তোলা মাছের মতো একেকবার লাফিয়ে ওঠে। কেউ একজন ভয়ে কেঁদে ওঠে অন্ধকারে। মৃত্যুর উপস্থিতি টের পেয়ে তটস্থ হয়ে পড়ে সবাই। সবার মুখে মুখে সেই প্রাচীন শ্লোক লা ইলাহা ইল্লা আন্তা…। কিন্তু শ্লোকের পরোয়া করল না পাটাতনের নিচে ওতপেতে থাকা আজরাইল। মধ্যরাতে লোকটার পিঞ্জরে নেমে এলো তার সর্বনাশা থাবা।
মৃত্যুর নিষ্ঠুর এই থাবা চলতে থাকে টানা চার দিন। কখনো সকালে, কখনো বিকেলে, কখনো বা মধ্যরাতে। কখনো একজন, কখনো দুজন, কখনো বা একসঙ্গে তিনজন থাবার শিকার হতে থাকে। জীবিতরা লাশগুলোকে সমুদ্রে ফেলে দেয়। এতোটুকু শোক করে না। চোখে এতোটুকু অশ্রু আসে না। একটা লাশ ফেলে
হাত-পা গুটিয়ে অপেক্ষায় থাকে কখন তার ডাক পড়বে। কখন তার লাশটি তুলে দেওয়া হবে আদিমতার কোলে।
চতুর্থ দিন কৌতূহলী কমল গুনে দেখল আড়াইশো যাত্রীর মধ্যে আছে মাত্র একশ সাতাশজন। তার বুক ফেটে কান্না এলো। কল্পচোখে লাবণীর মুখটা ভেসে উঠলে দ্বিগুণ বেগে উথলে উঠল কান্না। বাবা-মায়ের মুখ মনে পড়ে। বন্ধুদের মুখগুলো মনে পড়ে। শুনতে পায় কোনো এক বন্ধুর ডাক। তার নাম ধরে ডাকছে। তার কণ্ঠ ভেসে আসছে বহুদূর থেকে।
দিগন্তের দিকে বুক টান টান করে দাঁড়িয়ে সে অশ্রু সংবরণ করে। চোখেমুখে জলের ঝাপটা দিয়ে সে যখন কেবিনে ঢুকছিল হাড়জিরজিরে এক রোহিঙ্গাকে উবু হয়ে বসে থাকতে দেখল। তার সামনে এক রোহিঙ্গা কিশোরের লাশ। কমলকে দেখে লোকটি মুখ লুকায়। কী যেন চিবুচ্ছে লোকটা। কমলের দৃষ্টি স্থির হলো লাশটার ডানহাতে। বাহুতে মস্ত একটা ক্ষত। বুভুক্ষু কোনো হিংস্র প্রাণী যেন মাংসটা খুবলে নিয়েছে।
ইঞ্জিনরুমে ঢুকে দীপঙ্করের গা-ঘেঁষে বসল কমল। দীপঙ্কর মুুখটা হাঁ করে ঘুমাচ্ছে। চেহারায় হাসির খানিক আভাস। ঘুমানোর আগে কি সে হাসছিল? কেন হাসছিল? জাহাজের মায়াবী চোখের সেই মেয়েটির কথা মনে পড়ে গিয়েছিল বুঝি? হাসিমাখা শীর্ণ মুখখানার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কমলেরও ঘুম পায়। স্বপ্নের স্টিমারে চড়ে সে চলে যায় আরো দূর সমুদ্রে। হঠাৎ লাবণীকে দেখতে পায়। কোনো এক সমুদ্রতীরে লাবণী দাঁড়িয়ে। একা। পরনে লাল-সবুজ শাড়ি। আঁচলটা পতপত করে উড়ছে বাতাসে। অথই জলে হাবুডুবু খেতে খেতে সে ‘লাবণী লাবণী’ বলে চিৎকার করে। লাবণী শুনতে পায় না।
দীপঙ্কর আর জাগেনি। তার মতো কমলের ঘুমও হয়তো আর কোনোদিন ভাঙত না, যদি না মুখে ঠান্ডা জলের পরশ লাগত। সে চোখ মেলে দেখল, তাকে ঘিরে একদল অচেনা মানুষ দাঁড়িয়ে। বেশিরভাগই সমুদ্রের জেলে। কারো মাথায় কালো ক্যাপ, কারো মাথায় ঝাঁকড়া চুল, কেউ শ্যামলা, কেউ ফর্সা। কেউ তার দিকে তাকিয়ে, কেউ কথা বলছে, কেউ হাসছে। সে আবার চোখ বন্ধ করে। বেঁচে আছে না মরে গেছে বুঝে ওঠার চেষ্টা করে। তারপর আবার চোখ মেলে তাকায়। অচেনা লোকগুলো তার মুখের দিকে তাকিয়ে হাসছে। তাদের হাস্যোজ্জ্বল মুখ দেখেই কিনা কে জানে, তার দু-চোখের কোণ বেয়ে দুই ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। সিতারাবানু তখন দূর সমুদ্রে ঢেউয়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে বলল তার শেষ কথাটি, ডুবন্ত নৌকা থেকে নছর মালুমকেও একদিন জেলেরাই উদ্ধার করেছিল। ঠিক এভাবে।