আমাদের সুরুচির বরপুত্র

রশীদ আমিন

কাইয়ুম চৌধুরীর অকস্মাৎ মহাপ্রয়াণে সত্যি আমাদের শিল্পাঙ্গনে শোকের ছায়া নেমে এসেছে; কারণ কাইয়ুমবিহীন আমাদের এই শিল্পের ভুবন কল্পনাই করা যায় না। তিনি ছিলেন আমাদের এই ভুবনের সুরুচির বরপুত্র। আমাদের মধ্যবিত্ত শ্রেণির রুচিনির্মাণে তিনি ছিলেন কান্ডারি। স্বাধীনতা-উত্তর এই দেশের শিল্পের সুলুক সন্ধানে কাইয়ুম চৌধুরী ছিলেন নিরলস অভিযাত্রী। তাঁর শিল্পযাত্রা হয়ে উঠেছিল বহুমুখী, চিত্রকলার নিজস্ব ঘেরাটোপ পেরিয়ে তিনি স্পর্শ করতে পেরেছিলেন আমজনতার রুচি ও মননকে, অথবা, তিনি এক সহজিয়া শিল্পশৈলী নির্মাণের মধ্য দিয়ে আমজনতার শিল্পবোধের উত্তরণে নির্মাণসৃজনে হয়ে উঠেছিলেন এক অনিন্দ্যকারিগর। তাই শিল্পকলায় কাইয়ুম-যুগের অবসান কেউ মেনে নিতে পারছেন না।

কাইয়ুম চৌধুরী ছিলেন আমাদের শিল্পকলার ভুবনে রোলমডেল; বিশেষ করে তরুণদের কাছে। সফেদ বাবড়ি চুলের দীর্ঘদেহী মানুষটির চলন-বলনও ছিল শিল্পময়। তিনি নিজে ড্রাইভ করে আসতেন চারুকলায়, গাড়ি থেকে নেমে সটান হেঁটে যেতেন গ্রাফিক ডিজাইন ডিপার্টমেন্টে, আর আমরা দূর থেকে তাকিয়ে দেখতাম কাইয়ুম চৌধুরী যাচ্ছেন। তাঁর হেঁটে যাওয়ার মধ্য দিয়ে যেন একধরনের ব্যক্তিত্বের আভা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ত, আর আমরা ভেতরে ভেতরে সবাই একজন কাইয়ুম চৌধুরী হয়ে উঠতে চাইতাম। তাঁর এই সটান ভঙ্গি তাঁর চিত্রকর্মেও বিদ্যমান। তাঁর তুলিরেখার ঋজুতা আমাদের মুগ্ধ করে, তিনি একটানেই যেন এঁকে ফেলেন সমস্ত অবয়ব, রেখায় কোনো ভঙ্গুরতা নেই, যেন আত্মা-নিংড়ানো এক শক্তিমত্তার উদ্ভাস। তাঁর চিত্রকর্ম, তাঁর চালচলন ও ব্যক্তিত্ব সবই যেন একই সূত্রে গাঁথা। তিনি সবসময় সটান হয়ে চলাফেরা করতেন, তাঁর ঋজুতা মুগ্ধ হওয়ার মতো। তিনি মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়িয়ে ঋজু হয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলতেন, আমরা মুগ্ধ হয়ে শুনতাম শিল্পের কথা, সংগীতের কথা। তাঁর নান্দনিক ভাষণ শোনার জন্য আমরা অপেক্ষা করতাম। তিনি যেন সটান দাঁড়িয়েই আমাদের শেষ বিদায় জানালেন, মৃত্যুকে সেভাবেই আলিঙ্গন করলেন, একেবারে বীরের মতো।

শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী আমাদের মননের স্রোত বেয়ে দীর্ঘদিন বয়ে চলেছেন, তিনি জয়নুল, কামরুল, সুলতানের পরম্পরার উত্তরসূরি। তবে তিনি একটি কাইয়ুমীয় ভুবন তৈরি করেছেন, যা একান্ত তাঁর নিজস্ব। তিনি এই দীর্ঘ শিল্পযাত্রায় হেঁটেছেন নিজের পথেই, তাই অনেকদূর থেকেই চেনা যায় তাঁর চিত্রকর্ম; তাঁর নিজস্ব স্টাইল বা শৈলীতে বাঙালি জাতি দীর্ঘদিন ধরে আচ্ছন্ন। বইয়ের প্রচ্ছদ থেকে শুরু করে শাড়ির আঁচলে সর্বত্র রং-রেখায় বুনোট করে গেছেন সুকুমার চিত্রকাব্য। শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী জয়নুল-কামরুল-সুলতানের উত্তরসূরি হলেও তিনি চিত্রকর্মে একধরনের নিজস্ব আঙ্গিক নির্মাণ করেছেন, যা এই দেশের মাটি থেকে উৎসারিত। তিনি বাংলাদেশের লোকজ উপাদানকে নিজের মতো করে আধুনিক আঙ্গিকে উপস্থাপন করেছেন। শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী সারাজীবন বাংলাদেশকে এঁকে গেছেন। বাংলাদেশের নদী-নৌকা, বিস্তর প্রান্তর, ধানের ক্ষেত, বৃক্ষ বনস্পতি, ফুল-পাখি, বাংলার নারী, বাংলাদেশের গৌরবান্বিত মুক্তিযুদ্ধ, সবই এঁকেছেন নিজস্ব ঢঙে। ভিক্টোরিয়ান বাস্তবধর্মী রীতির ঊর্ধ্বে উঠে নিজস্ব আঙ্গিক গড়ে তুলেছেন। দ্বিমাত্রিক রঙিন জমিনে রেখার তীব্র টানে ফুটে ওঠে অবয়ব। তাঁর ক্যানভাসে উজ্জ্বল রঙের সমাহার। বাংলাদেশের উজ্জ্বল রং। হলুদ, লাল আর নীল। নিসর্গের শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী ঘুরে বেড়িয়েছেন সমস্ত বাংলাদেশ, তাঁর এই ভ্রমণ ছিল কখনো জলপথে, কখনো স্থলপথে। তবে জলজ ভ্রমণ ছিল তাঁর প্রিয়, স্টিমারে চড়ে তিনি প্রায়ই অজানা পথে বেরিয়ে পড়তেন, আর নদীর দুধারের প্রকৃতি প্রাণভরে উপভোগ করতেন। আর এই  দেখাই ছিল তাঁর মূল শক্তি, দুচোখ দিয়ে যা দেখতেন, তা-ই যেন ক্যানভাসে উদ্ভাসিত হতো কাব্যিক দ্যোতনায়।

শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন রুচির দৈন্যের বিরুদ্ধে যে-সুরুচির আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন, তার একজন অগ্রদূত ছিলেন কাইয়ুম চৌধুরী। তিনি শুধু তাঁর ক্যানভাসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলেন না, বরং তিনি তাঁর শিল্পের ডানা ছড়িয়ে দিয়েছিলেন ব্যাপক আমজনতার দুয়ারে, তা বিস্তৃত হয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল প্রকাশনাশিল্পেও। মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়েছিলেন শিল্প-সৌকর্যের বার্তা। এই দেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণির রুচি নির্মাণে তিনি হয়ে উঠেছিলেন অগ্রপথিক। তাঁর অঙ্কিত প্রচ্ছদ, পোস্টার, অলংকরণ, আমাদের দেশের ব্যাপক আমজনতার শিল্পের ক্ষুধা মিটিয়েছে, সেক্ষেত্রে তাঁকে গণশিল্পীর অভিধায়ও অভিষিক্ত করা যায়। তবে কাইয়ুম চৌধুরীর প্রচ্ছদকে শুধু মামুলি গ্রাফিক ডিজাইন হিসেবে ধরা যাবে না, বরং তা একেকটি চিত্রকর্ম। তিনি গ্রাফিক ডিজাইন ও চিত্রকর্মকে একাকার করে দিয়েছেন, এখানেই বোধহয় শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর সার্থকতা।

শিল্পের সাধক পুরুষ কাইয়ুম চৌধুরী বাঙালির শিল্পমননে যুগ যুগ ধরে বেঁচে থাকবেন। মিউজিয়ামের দেয়ালে তাঁর চিত্রকর্মগুলো যেমন শোভা পাবে, তেমনি মানুষের বইয়ের শেলফগুলোতে তাঁর প্রচ্ছদগুলোও শিল্পের আভা ছড়াবে, আর এভাবেই তিনি অমর হয়ে থাকবেন শিল্প ও মননে।