এইসব মনভোলানো দোলা

মোহাম্মদ আযাদ
ওয়েলকাম!
চোখের সামনে বিশাল এক লাউঞ্জ। জোড়া-জোড়া আলোর বুক পাকিয়ে বেরোচ্ছে শীতল নিশ্বাস। বয়সটা এমনই কমে গেছে, যেন ছোট্ট শিশুর মতো একপা-দুপা, অতঃপর ইতস্তত কোমল নিতম্বসহ ধপ করে মেঝেতে পড়ে খিলখিল করে হাসা, আহা! এমনই সরল ঘোরে জীবন চমকায় যে, পাঁচতারা হোটেলের ইসপ্লাসে দাঁড়িয়ে শরীরটাকে সুচালো করে সুইমিংপুলে গেঁথে যাই। তালমাতাল জলের বুকে বুঁজ্জ্ করে মাথাটা তুলতেই দেখি তুমি দাঁড়িয়ে, মুখে ফণা তুলে হাসছ। আমিও সপাটে হেসে বলি, কখন?
সেই কখন…
সুইমিং থেকে নিজেকে ছিটকে দিই পাড়ে। পায়ের কাছে হাঁটু গেড়ে প্রণতি প্রকাশের মতো ইনিয়ে-বিনিয়ে বলি কত কথা। পাকা ফলের মতো সময়টা ফেটে যায়। নিজেকে মেকি উদাস করে বয়ে যায় অনুচ্চারিত হাওয়া। তবু যেন, তোমার ছেঁড়া-ছেঁড়া হাসির ভেতর দেখতে পাই আমার ইচ্ছের অবাধ্যতা। কত যে মনলোভা আর আদর্শিক লাগে এসব মুহূর্ত –
তোমার হাত চেপে বলি, বার-বি-কিউ চলবে?
না।
অন্য কোনো স্নাকস?
না।
তাহলে চলো।
চলো।
চলন্ত সিঁড়ি ডিঙিয়ে আরেকটি লাউঞ্জ। কিছুটা বাঁয়ে গিয়ে বলি, শপিং করবে?
করব।
কী মধুর সম্মতি। পুরো অবয়বজুড়ে স্বচ্ছ আলোর দাগ।
তুমি স্বপ্নাহত হবে না, কারণ তুমি সরল। তাই তো বাহুলগ্ন করে ভাবি, এই রোমাঞ্চিত দিনক্ষণ লিখে রাখার জন্য আস্ত একটা ডায়েরি দরকার। সোকল্ড প্রেম কিংবা একটু উষ্ণতার ফালতু ভাবাবেগ ছুড়ে দিয়ে প্রাপ্তির আস্বাদে আস্বাদে মুহূর্তটা যদি হয় অনন্ত – মন্দ কি!
শপিং সেন্টারে ঢুকে জামা নয়তো অর্নামেন্টের প্রতি তোমার গভীর মগ্নতা দেখে নিশ্চিত হলাম, তুমি আমার প্রেমে পড়নি। কাঁধে হাত রাখলাম। দ্বিধাগ্রস্তের মতো কেঁপে ডানে-বাঁয়ে তাকালে না দেখে ভীষণ ভালো লাগল, নইলে তোমার আন্তরিক সদিচ্ছা নিয়ে ক্ষণিক অন্যমনস্ক হয়ে পড়তাম। সম্পূর্ণ দ্বিধাহীনভাবে তোমার মতোই সামনে ঝুঁকে বলি –
এটা সুন্দর।
না না, এটা।
সত্যি?
হুঁ।
মেনে নিলাম। নিতে হয়। নইলে তুলোর মতো শূন্যে ভাসব কীভাবে। অতিসুন্দর কিছুর স্পর্শে বুকের ভেতরটা খসখস করে। হৃদয়ের শব্দ কি এমন? জানি না। এও জানি না, কখন ফুলের মৌসুম। পাতাঝরা নগ্ন-ধূসর গাছে তাকিয়ে উদাস হাওয়ায় নিজেকে বহুদিন ব্যাকুল করেছি। যদিও দিনক্ষণ মনে নেই। এখন যদি ডানাহীন শরীরটাকে মেলে দিই হাওয়ায়, নিশ্চিত করেই বলছি, আমি ভাসব। আমাকে নামাতে হলে ডিজিটাল কণ্ঠ লাগবে। মনে হয় তোমার তা আছে। বহু পথ-মত নিকেশ করে আজ যেমন তুমিও ভাসছ তুলোর মতো, সেটি কি একদিনে? শপিং করতে করতে মনে হলো, এ তো মহাজাগতিক অপার দোলা। আরেকটি নতুন দিনের মুহূর্তগুলো এই মনভোলানো দোলা ডিঙিয়ে কতদূর যেতে পারবে? হয়তো-বা বহুদূর, তবু ভয় আর সন্দেহের যুগপৎ শিহরণে শরীর কাঁপতে থাকে। বরং এই তো ভালো, পাঁচতারা হোটেলের শঙ্কামুক্ত স্পেসগুলোতে আমাদের যমজ ছায়া নেমে যায়।
চলো।
কোথায়?
ইন্টারনেটে।
এক হাতে শপিং ব্যাগ, অন্য হাতে পার্স। জীবনের মুঠো-মুঠো সুখ যেনবা বেলুন হয়ে উড়ছে। লাল গালিচার ওপর উচ্ছ্বসিত আবেগের শীতল কাঁথা বিছিয়ে দিচ্ছে কেউ। অনলাইনে চ্যাটিং করছে অনেকে। আমরাও বসলাম। রুচিহীন স্ক্রিনসেভার সেট করা। ও নিজের আইডি লগ অন করে স্ক্র্যাপবুকে চলে গেল। কতরকম বাজে এসএমএস জমা পড়েছে। লেখাগুলো আপাতত ধাক্কা দিলেও অতিভদ্রোচিতভাবে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ল। যুগ থেকে শতাব্দীর এই যে আপনমগ্ন প্রবাহ, সেখানে আর যা-ই হোক মানুষের বিষাদ-অনুভূতি বলে হয়তো কিছু নেই। সবটাই রোমান্টিক। সেরকম উপলব্ধির সরস যুবক হয়ে পাঁচতারা হোটেলকে নিয়েছি চির-আদিমতায়, নিজের ভেতর সুখ রোমন্থনের কতশত চিৎকার শুনি –
দু-একটি এসএমএস রিপ্লাই করে ঠোঁটের চেপে রাখা হাসিটায় অদ্ভুত কাতরতা এনে বললে, দেখলে কেমন  নোংরা ভাষা?
কারটা, তোমার না ওর?
তুমি না –
এমনভাবে উঠে দাঁড়ালে, যেন সমুদ্রের পাড়ে গড়িয়ে-পড়া ঢেউগুলোর ছোবল থেকে নিজের পা-দুটো মুহূর্তকালের জন্য আড়াল করতে চাচ্ছ। আর আমিও তোমার মনলোভা সুন্দর ঢংটিকে স্যালুট করতে করতে এগিয়ে নিচ্ছি ভণ্ডামিহীনভাবে। ভাবতে পারো, আমাদের সিদ্ধান্ত আমাদের আনন্দকে কতটা মুগ্ধতা দিচ্ছে…
আমরা রেস্তোরাঁর ভেতর ঢুকে পড়লাম। ভেতরে কেমন রহস্যময় আলো-ছায়ার খেলা। মাথার ওপর অনেকগুলো ল্যাম্পশেড। কম ভলিউমে বেজে চলছে ওয়েস্টার্ন মিউজিক। আগেও কতশতবার পাঁচতারায় এসে নিজেকে লোপাট করে হুমড়ি খেয়ে পড়েছি, তখন তুমি ছিলে না।
তোমার মতোই অন্যরা কেউ কেউ সকৌতুক স্পর্শে বুঝিয়েছিল অস্তিত্বের ব্যাখ্যা। জীবনের ধাপে ধাপে সংক্রমিত অন্ধকারকে নিকেশ করে টান-টান উত্তেজনার যমজ আনন্দে খলখল করে কত যে হেসেছি। এখনো রেস্তোরাঁর গ্লাস পেইন্টিংয়ে অর্থবিত্তের প্রবল আত্মবিশ্বাস শীতল নিশ্বাস হয়ে গলে গলে পড়ে। বস্তুত তোমাকে বাহুমূলে সেঁটে আজো প্রত্যাশা করি আরেকটি আধুনিক অপসনে ভরা নতুন পাঁচতারা হোটেল। সেদিন হয়তো তুমি থাকবে না। দৃষ্টিসীমায় কেউ ঋজু হয়ে এলে আরেকজন লম্বালম্বি দাঁড়িয়ে যায়। একটি নতুন মাত্রা, নতুন বোধ, নিশ্চিতভাবেই শরীরে গড়িয়ে পড়বে ফোঁটা-ফোঁটা শিশিরের মতো।
বলি, কী খাবে?
চিংড়ির মালাই।
তুমি?
ফ্রাইড রাইস।
আর?
অ্যাটাচড বারে পাঁচ-ছয় পেগ হুইস্কি।
এরপর?
এক্সক্লুসিভ স্যুইট।
নটি বয়!
আহা, এমনই রঙ্গব্যঙ্গভরা মিষ্টি উচ্চারণ, বুঝিবা বাতাসে নতুন ঢেউ জাগল। আমিও ক্রমসঞ্চারণশীল সুখের আভায় নিজেকে মেকি কষ্টের বিপর্যস্ত যুবক ভেবে তোমার হাতকেই চেপে ধরি। তখন তুমি-আমি অভিসন্ধিহীনভাবে বাঁকা। তোমার শরীরকে মাউস বানিয়ে ক্লিক করে, ইচ্ছে করে ঢুকে যাই নতুন নতুন ই-মেইলে। মনে মনে বলি, আই হেইট মাইসেলফ।
কেন যে এরকম বলে বসি, বুঝি না। অনুভূতির এ-দুর্বোধ্যতা এক্সক্লুসিভ স্যুইটের ভেতর প্রবল টোকা মেরে ফের জাগিয়ে তোলে। নির্ভারে দেহকে তাই তো ছুড়ে দিই শূন্যে। ধপ করে পতনের শব্দটা নিজেই উপভোগ করি। উবু হয়ে বলি, ভালোবাসি।
কাকে?
তোমাকে।
হুঁম্ম্ম্ হি-হি –
হোয়াট রাবিশ!
বাঁকা হাসির তোড়ে তুমি ছিটকে পড়ো আরেকটি চলমানতায়। তোমার শিরায়-শিরায় জ্বলে ওঠে বিষময় আশীর্বাদ। স্যুইটের মেঝেতে কখন যে নির্বাক স্তব্ধতা নিয়ে চলে আসে প্রাগৈতিহাসিক প্রহরী। হাতে বর্শা, চামড়ার পোশাক, একেবারে মূর্তিমান বিভীষিকা, তবু কত নীরব। ঠোঁট গলে খসে পড়ছে ইতিহাসের একেকটি অক্ষর। আদিযুগ থেকে মধ্যযুগ অতঃপর যুগ-যুগান্তের বাঁকে আজো প্রতিবাদহীন সরল ক্রীতদাস।
কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে বললে, একটি সত্যি কথা বলবে?
কী?
তোমার স্ত্রীকে ভালোবাস না?
নিশ্চয়ই।
আমাকেও?
ঠোঁটভরা যত না প্রশ্ন, চাপা হাসির চমকটা তত বেশি। বিচলিত না হয়ে ভাবি, মানুষকে কখনো কখনো ভারাক্রান্ত করে একটা বিশেষ ঘোর। এও ভাবি, এসব নারীসুলভ প্রশ্নের ভেতর তুমি শতভাগ দুর্বোধ্য। আজকের প্রশ্ন কালকেই হয়তো প্রশ্নহীন চমকে জীবনকে মোচড় দেবে অদ্ভুত নাটকীয়তায়। সত্য-মিথ্যার আবর্তিত ছন্দে তুমি কেবল সরল আশ্বাসে নেচে যাচ্ছ, নিজেকে সফল মনে করলে কষ্ট পাবে না, মনে না করলে কারো কিছু এসে-যায় না। পালটা হো-হো করে হেসে ফেলতেই মেকি অভিমানে জোড়া ঠোঁট একপাশে মোচড় দিয়ে বললে, ইরেসপনসিবল!
এরপর?
কোনো কষ্ট তোমাকে ভাবায় না?
না।
নাহ্ –
না।
তুমি একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছ। তোমার দৃষ্টির পথ ধরে অনেকদূর যাওয়া যেতে পারে। প্রেম কিংবা প্রত্যাশার আপেক্ষিক বিচারে আদর্শিক সঞ্চয় বলে কিছু থাকে কি? নিজের দু-পা গুটিয়ে জীবনের আলোড়িত অভিজ্ঞতায় তোমার এ-মুহূর্তের দৃষ্টিকে তুড়ি মেরে ইচ্ছে করে নিজের মাথায় লম্বা একটা ঘোমটা টেনে দিই। বেশ আলতোভাবে এক হাত টেনে বললে, কষ্ট পেয়েছ?
কেন?
আমার কথায়?
দূর!
আমি হঠাৎ হঠাৎ বোকার মতো কথা বলে বসি।
এবার সত্যি-সত্যি হাসি পায়, কিন্তু কষ্ট করে চেপে রাখি।
মনোজাগতিক আদর্শের গালগল্প নিয়ে মানুষ কি হয়ে যায় আত্মসচেতন, নাকি বিপর্যস্ত? বুঝতে পারি না। কল্পনায় কেবল মাউস বাটন টিপতে থাকি অবিরাম। অন্তর্গত বিস্ময় যেনবা ট্রেনের হুইসেল বাজিয়ে অনন্ত পথপরিক্রমায় ঝকর-ঝক্ শব্দের উত্থান-পতনে এগিয়ে চলছে একটানা। সমান্তরাল রেলপথে ইঞ্জিনের ক্রমগতিশীলতা শোঁ-শোঁ শোঁ-ও-ও-ও করে বাঁক নেওয়ার পর স্টেশনে অপেক্ষমাণ যাত্রীদের চকিত-চমক ফুটো করে উঠে আসে কতরকম কষ্টজনিত ভাবনা –
অতীতের ভেতর বিশেষ কতগুলো স্মৃতিচিহ্ন কাটা মাছের মতো তড়পায়। অতঃপর এক্সক্লুসিভ স্যুইটের হিমশীতল বিছানা অনন্ত আঁধারে তলিয়ে যেতে যেতে কীভাবে যে নিরন্তর আশ্বাসে বেঁধে নেয়… কোনো বয়সিনীর কোমল স্পর্শের মতো শিরশির করে দেহের শিরায় শিরায় রক্তপ্রবাহ জেগে ওঠে। নির্ঘুমে নির্ঘুমে রক্তবর্ণ কাতর চোখ সচকিত করে অপেক্ষা করেছি, কখন যে গ্রিন সিগন্যালের পর ইঞ্জিনকে ফের স্টার্ট করা যায়। সেসব আমূল বোধ চমকে দিয়ে, চলমান ইঞ্জিন বাঁক নেওয়ার মতো অকস্মাৎ জীবনও বাঁক নিতে পারে পরিবর্তনের হাওয়ায়, এ তো বিচিত্র কিছু নয়। তবু যেন জোছনার আলোয় গড়িয়ে পড়তে দেখেছি শত শত ঝরাপাতা। কাল থেকে বুঝি আর সূর্যোদয় হবে না, ছোট্ট কোনো পাখি অনুভূতি বাজিয়ে বুঝি গেয়ে গেল নতুন গান… এসব বিপরীত ভাবনার ভেতর স্টেশনের কাছে এসে আচানক ট্রেন লাইনচ্যুত! ঝকর ঝকর-র-র খটাখট-খট বেমালুম স্তব্ধ! গন্তব্যের কাছে এসেও গন্তব্যহীন কেমন একটা ইঙ্গিতবহ চমক, অনিঃশেষে বেঁকে যায় অতীত। আমি বুঝিবা বর্তমানে –
যতদূর মনে পড়ে, ভোরবেলা হয়তো তোমাকেই রিং দিয়ে বলেছি, আমার তো ঘুম হয়নি।
এখন ঘুমাও।
সারারাত আসেনি, এখন কি আসবে?
আসবে, এখন ঘুম আসবে।
ঘুমভাঙা ভোরের দ্যোতনায় তোমার কণ্ঠস্বর এতটাই জলদগম্ভীর ছিল যে, সত্যি সত্যি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম ম্যাজিকের মতো। এরপর জীবনের অমার্জিত ভার নয়তো দগ্ধ পোড়ামাটির ফ্যাকাশে গন্ধ নিয়ে কতদিন যে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়েছি স্টেশনের দিকে, বুঝিবা গ্রিন সিগন্যাল দেখা যায় – আর কোনো কষ্টের কথা মনে পড়ে কি?
গনি মিঞার আজ হালচাষ হয়নি, সলিমুদ্দির সংসারে টানাপড়েন – এসব উদ্ভট ভাবনাবিলাসের চৌকো অনেক আগেই ডিঙিয়ে এসেছি। লক্ষ করে দেখ, এসব ভাবনার ভেতর যাদের কষ্ট থাকে, তাদের একটা কষ্টবিলাসও থাকে। কখনো-বা আন্তরিক স্পর্শে পকেট থেকে যদি দুটো টাকা উঠেও আসে, হুড়মুড় করে চলে আসে আরেকটি বিকৃতি। মানুষের ‘আবেগ’ আর ‘অধিকার’ নিকেশ করে এতদূর এসেছি, এটা কি অতলস্পর্শী যোগ্যতার সূক্ষ্ম স্টান্টবাজি নয়? কজন পারবে। একবুক ঈর্ষা নিয়ে যারা সমালোচনা করে, সেই ব্যর্থদের অনেক আগেই মুখরিত করেছি ‘ভোট চাই’, ‘ভোট চাই’ স্লোগানে। এখন আমি পাঁচতারা হোটেলের পঞ্চভূত। মাউসে এবার সত্যি-সত্যি ক্লিক করতেই তোমার শরীর চষে বেরোয় নতুন অপশন –
ওহ্ প্লিজ।
না।
পারভারটেড!
নট অ্যাট অল।
ইউ ব্লাডি বাস্টার্ড!
হোয়াট অ্যা টেরিবল প্লেজার!

Published :


Comments

Leave a Reply