একটি প্রজ্ঞাশাসিত সংকলন

সৌভিক রেজা
জ্ঞানতাপস আব্দুর রাজ্জাক স্মারকগ্রন্থ
সম্পাদক : আনিসুজ্জামান
বেঙ্গল পাবলিকেশন্স লিমিটেড
অক্টোবর ২০১২
৪০০ টাকা

সরদার ফজলুল করিম তাঁর শিক্ষক অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাককে নিজের ‘দ্বিতীয় পিতা’ হিসেবে গর্বের সঙ্গে উল্লেখ করেছিলেন। আর পুত্রের সে-দায় খানিকটা হলেও তিনি শোধ করতে চেয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও পূর্ববঙ্গীয় সমাজ (প্রথম প্রকাশ : ১৯৯৩) গ্রন্থটির মধ্যে দিয়ে, যা কিনা সরদার স্যারের সঙ্গে রাজ্জাক স্যারের আলাপচারিতার ফসল। আমরা, যারা বেশ খানিকটা দেরিতে জন্ম নেওয়ার কারণে অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাককে সরাসরি শিক্ষক হিসেবে পাইনি, কিংবা তাঁর সংস্পর্শে আসতে পারিনি, তারা সরদার ফজলুল করিমের এই উদ্যম আর পরিশ্রমের কারণে অন্যভাবে খানিকটা হলেও রাজ্জাক স্যারকে পেয়েছিলাম। এছাড়া সরদার ফজলুল করিমের নানারকম লেখালিখির ভেতরও রাজ্জাক স্যারের প্রসঙ্গ কতোভাবেই না পাই! সে-কারণেই হয়তো সরদার ফজলুল করিমকে ছাড়া রাজ্জাক স্যারের কথা চিন্তা করতে পারি না, রাজ্জাক স্যারের কথা উঠলেই সরদার ফজলুল করিমকে মনে না-করে থাকা কষ্টকর। বলতে পারি যে, সরদার ফজলুল করিমের মধ্যস্থতায় রাজ্জাক স্যারের সঙ্গে আমাদের পরিচয়।
রাজ্জাক স্যারের সেই আলাপচারিতাকে এক ‘স্বতঃস্ফূর্ত স্মৃতিকথা’ হিসেবে উল্লেখ করে সরদার ফজলুল করিম বলেছিলেন, ‘অধ্যাপক রাজ্জাকের এ স্মৃতিকথা… একান্ত ব্যক্তিগত সংগ্রহে না রেখে তাকে অপর দশজন পাঠক এবং সমাজবিদের সামনে পেশ করার চেষ্টা করেছি।’ কেন করেছেন তার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সরদার স্যার লিখেছেন, ‘চেষ্টা করেছি এই চেতনা থেকে যে, একজন ব্যক্তির জীবন তাঁর কালের সমগ্র ইতিহাস না হলেও, সে-জীবন সেই কালের দেশ-সমাজ ও মানুষের উপাদান।’ অনেকটা প্রায়-একই কারণে অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাককে নিয়ে শ্রদ্ধেয় আহমদ ছফা তাঁর স্মৃতিকথা  লেখেন যদ্যপি আমার গুরু (প্রথম প্রকাশ ১৯৯৮)। দুটি বই ঠিক এক মাপের নয়। নয় যে সেটা আহমদ ছফাও বুঝতেন, জানতেন। সে-কারণেই সরদার ফজলুল করিমের বইটিকে তিনি  ‘অসাধারণ গ্রন্থ’ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে ভোলেননি। এটা নিছক আহমদ ছফার বিনয় নয়। রাজ্জাক স্যারকে নিয়ে তাঁর স্মৃতিকথা প্রকাশের কারণ হিসেবে ছফা জানিয়েছিলেন, ‘আমার শিক্ষক অধ্যাপক রাজ্জাকের অনন্য ব্যক্তিত্বের মহিমা আমি যেভাবে অনুভব করেছি, অন্তত তার কিছুটা উত্তাপ দশজনের কাছে প্রকাশ করি।’ তিনি যে তাঁর সেই অনুভব ও অভিজ্ঞতা প্রকাশ করেছিলেন সেজন্যে তাঁর কাছে আমরা কৃতজ্ঞ। কৃতজ্ঞ এ-কারণে যে, অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক ছিলেন সেই বিরলতম শিক্ষকদের একজন যিনি মনে করতেন, ‘A teacher will continue to be older by a year each year of his life but the students will be of a constant age. And each year the the teacher will grow less capable of establishing communication with his young students. ছাত্রছাত্রীদের প্রতিতুলনায় একজন শিক্ষক হিসেবে নিজের বাস্তব অসমর্থতার এমন চিন্তার নিদর্শন দেখা যায় না। প্রশ্ন জাগে, তাহলে কি  অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের সাধনা ছিল নিজেকে প্রতিনিয়ত যোগ্য করে তোলা? যাতে পরবর্তী প্রজন্মের কাছ থেকে অবজ্ঞা বা নিস্পৃহতা-মিশ্রিত শ্রদ্ধা পেতে না হয়?

দুই
একজন ব্যক্তি তার কর্মজীবনে কি পারিবারিক অথবা সমাজজীবনে কেমন এবং কতটুকু সক্রিয় ভূমিকা রেখে গেছেন এটা সে-ব্যক্তির নিজের অভিজ্ঞতার বিবরণ থেকে কিংবা তার স্মৃতিকথা থেকে যেমন জানতে পারি, তেমনি ওই ব্যক্তি সম্পর্কে অন্য ব্যক্তিদের প্রকাশিত তথ্য ও অভিজ্ঞতা থেকেও একটি পরিচয় পাওয়া যায়। সেরকমই একটি উদ্দেশ্য নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে জ্ঞানতাপস আব্দুর রাজ্জাক স্মারকগ্রন্থ, যেখানে ‘নিবেদন’ অংশে বলা হয়েছে, ‘বিংশ শতাব্দীর বাংলাদেশে জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক (১৯১২-৯৯) ছিলেন সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমধর্মী এক মানুষ। অর্ধশতাব্দীর অধিককাল তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন, এটিই ছিল তাঁর প্রাণকেন্দ্র। তবে কর্তব্যবোধে বৃহত্তর রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে তিনি ভূমিকা পালন করেছিলেন। বিলেতফেরত এই ব্যক্তির জীবনযাপন প্রণালির সারল্য, অনাড়ম্বর দেশীয় সজ্জা এবং মৌখিক ভাষার নিজস্ব ঢং তাঁকে বিশিষ্টতা দিয়েছিল। জ্ঞানপিপাসা ও পাঠাভ্যাস, মৌলিক চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গি, অকুতোভয়ে নিজের  বিবেক-অনুযায়ী চলা ও বলা, সাহিত্যিক-শিল্পী-শিক্ষক-গবেষককে উৎসাহদান, শ্রেণিকক্ষে স্বল্পবাক কিন্তু ঘরোয়া আলাপে অসাধারণ বাক্সিদ্ধি, জীবনের সর্বক্ষেত্রে মাতৃভাষাকে প্রতিষ্ঠানে দৃঢ়প্রত্যয়, খাদ্যপ্রীতি ও রন্ধননৈপুণ্য, তাস ও দাবা খেলায় আগ্রহ, মানুষের প্রতি অনুরাগ ও দায়িত্ববোধ – এসবই ছিল তাঁর চরিত্রগুণ।’ এই স্মারকগ্রন্থে বিভিন্ন ব্যক্তির লেখায় নানাভাবে সেসব বিষয়ই           ভিন্ন-ভিন্নভাবে উঠে এসেছে।

তিন
অধ্যাপক মনসুর মুসা লিখেছেন, ‘মাতৃভাষাকে লেখার মাধ্যম করার জন্য তাঁর উৎসাহ ছিল অদম্য। ড. কামাল হোসেন আর ড. রেহমান সোবহান বাংলা লেখেন না বলে তিনি অনুযোগ করতেন।’ সেইসঙ্গে মুসা এও জানিয়েছেন, ‘অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক সচরাচর কথাবার্তায় বাংলা প্রমিত চলিত ভাষা ব্যবহার করতেন না। তিনি ঢাকাকেন্দ্রিক মৌখিক ভাষায় কথা বলতেন। …রাজ্জাক স্যারের নিজের একটি কথ্যরীতি ছিল, যা কিনা আঞ্চলিক বলে অনেকেই ভুল করতেন। তাঁর কথা নিজের স্টাইল ছাড়া আর কিছু নয়।’ (পৃ ৩৯) এ-প্রসঙ্গে আহমদ ছফাও বলেছিলেন, ‘ঢাকাইয়া বুলি তিনি অবলীলায় ব্যবহার করেন, তাঁর মুখে শুনলে এ-ভাষাটি ভদ্রলোকের ভাষা মনে হয়।’ (যদ্যপি আমার গুরু, পৃ ১৮) মনসুর যে বলেছেন রাজ্জাক স্যারের মুখের কথা তাঁর নিজের স্টাইল ছাড়া আর কিছু নয়, সেটি যদি এদেশের শিক্ষিত সম্প্রদায়ের একাংশ বুঝতেন, তাহলে সেটির যথেচ্ছ অনুকরণ করা থেকে নিজেদের  অন্তত দূরে রাখবার চেষ্টা করতেন।
রাজ্জাক স্যার বিগত দিনের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকমণ্ডলী আর তাঁদের শিক্ষাপ্রদান-পদ্ধতি, নীতি-নৈতিকতা সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে সরদার ফজলুল করিমকে বলেছিলেন, ‘সেদিন অ্যাকাডেমিক লাইফে এ-বিবেচনাটা প্রধান ছিল : সেকেন্ড ক্লাস আর ফার্স্ট ক্লাস আলাদা : এক নম্বর, দুই নম্বরের কথা না এটা। ইফ ইউ বিলং দেয়ার, ইউ উইল গেট, নট আদারওয়াইজ। পরীক্ষা নিয়ে কোনোরকমের কারচুপি, কোনোরকমের শিথিলতা ছিল না ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে। এমন কোনো একজন শিক্ষক ছিল না, হু ড্রেমট অব ডুয়িং এনিথিং, যা তার করা উচিত না।’ অতীতের সঙ্গে বর্তমানের তুলনা টানতে গিয়ে তিনি আক্ষেপের সঙ্গে বলেছিলেন, ‘এইগুলা মিস করি আজকাল। তা না হলে আজকালকার আপনারা লেখাপড়ায় খারাপ না। কিন্তু শিক্ষকদের মধ্যে এই বোধটা দেখি না, দ্যাট টিচিং ইজ অ্যা সিক্রেট টাস্ক।’ বোধকরি এসব কারণেই সরদার ফজলুল করিম তাঁর নিজের ব্যক্তিত্বের ওপর রাজ্জাক স্যারের আসর (মজলিস) ও আসরের (প্রভাব) কথা সবসময়ই কৃতজ্ঞচিত্তে স্বীকার করতেন (‘আমার দ্বিতীয় পিতা’, পৃ ৫১)। রাজ্জাক স্যারের এই ‘আছর’ প্রসঙ্গে আহরার আহমাদ (Ahrar Ahmad) বলেছিলেন, ‘Prof. Razzaq identified with a different genre of teachers altogether … He situated himself within a much older Indian intellectual convention and practice Ñ the parampara (tradition) that binds a guru (teacher) and shisya (student) together.’ (পৃ ২৮৬) আর এই গুরু-শিষ্যের সম্পর্কের ক্ষেত্রেই বলি আর জ্ঞানের আদান-প্রদানের কথাই যদি বলা হয়, তাহলে শিষ্যের দায়িত্বও কিন্তু বেশি ছাড়া কম ছিল না। তার যৌক্তিক কারণ হিসেবে আহমাদ জানিয়েছেন, ‘Education  was not something that you hawked like a vendor at a carnival, or ladled out in large dollops into empty heads. It had to come from the student, from his/her curiosity, dedication, attitude, perseverance and, beyond everything else, humility. Razzaq Sir would not light a fire in your belly. But if you brought some embers to him he would gladly fan it into a blaze.’ (পৃ ২৮৬)।
ছাত্র বা শিষ্যের মনে আগুনের সে-শিখাটি প্রজ্বালনের জন্যে যিনি একজন সত্যিকার অর্থে সৎ শিক্ষক, তিনি বড়জোর সেই ফুঁ দেওয়ার কাজটি করেন। অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক এরকম কাজ করার সামর্থ্য যথেষ্ট পরিমাণেই রাখতেন। কথাটির যাথার্থ্য বুঝতে অসুবিধে হয় না, যখন সরদার ফজলুল করিম প্রখ্যাত ফটোশিল্পী নাসির আলী মামুনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘রবি গুহ, নাজমুল করিম আমি এবং আরো দু-একজনসহ আমাদের দলটা রাজ্জাক সাহেবের কথাবার্তা-চালচলনে অভিভূত ছিলাম। … আমার এই বুড়া বয়সেও স্যারের কাছে গেলে তিনি বলতেন, ‘সরদার আইছেন। কী চেহারাটা হইছে শরীরটা কী বানাইছেন!’ রাজ্জাক স্যারের আসরে আক্রান্ত হয়েছিলেন বলেই-না বৃদ্ধ বয়সেও নানা রকম বাধা উপেক্ষা সরদার ফজলুল করিম তাঁর প্রিয় শিক্ষকের কাছে ছুটে যেতেন। আর এইসব কারণেই সন্দেহ করবার উপায় থাকে না যে ‘ÔRazzaq Sir was both wise, and a great teacher.’ (পৃ ২৯২)।
ছাত্রের ওপর আব্দুর রাজ্জাকের মতো শিক্ষকের ‘আছরে’র এ-বিষয়টা আরো পরিষ্কার হয়ে উঠেছে প্রফেসর আনিসুজ্জামানের লেখায়। তিনি জানাচ্ছেন, ‘আমার পরীক্ষার ফল জেনে কিংবা মুনীর চৌধুরীর কাছে আমার প্রশংসা শুনে … রাজ্জাক সাহেব আমার সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছে প্রকাশ করেন। … তাঁর সঙ্গে দেখা করলাম। … আমাকে বসতে বলে ঢাকার আঞ্চলিক ভাষায় জানতে চাইলেন, এমএ পাশ করে আমি কী করব। বললাম, ইচ্ছে শিক্ষকতা করার, তবে তার আগে গবেষণা করবো। কী নিয়ে গবেষণা করবো জিজ্ঞাসা করায় জবাব দিলাম, আধুনিক সাহিত্য নিয়ে। রাজ্জাক সাহেব প্রশ্ন করলেন, ‘ও আধুনিক সাহিত্য? তা আধুনিক সাহিত্য কইতে কী বুঝান আপনারা?’ কী বিপদে পড়তে যাচ্ছি, তা না বুঝেই জবাব দিলাম : উনিশ শতক থেকে রচিত সাহিত্য আধুনিক। এবারের জিজ্ঞাসা, কী কী লক্ষণ হলে আধুনিক সাহিত্য হয়? বললাম, মানবপ্রধান হলে আধুনিক, ধর্মপ্রধান হলে মধ্যযুগীয়। ‘তাহলে চৈতন্যচরিত কী?’ আমি একটু উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করি, তার সূত্র ধরে তিনি আরো প্রশ্ন করেন। শেষ পর্যন্ত মনে হলো, পালিয়ে বাঁচি।’ পৃ ১১৫-১১৬, কিন্তু আনিসুজ্জামানও শেষ পর্যন্ত পালাতে পারেননি। কেন পারেননি সে-বিষয়টি খুব পরিষ্কার করেই তিনি বলেছেন : ‘ফিরে এসে দেখি আমার মনে শান্তি নেই; সারের প্রশ্নের উত্তর পেতে হবে। এবং সে-উত্তর পেতে তাঁর কাছেই যেতে হবে। আবার গেলাম তাঁর কাছে। আমার নিজের মধ্যেও অনেক প্রশ্ন জাগে, ওঁর কাছে আবার ছুটে যাই।’ (পৃ ১১৬) শুধুই প্রফেসর আনিসুজ্জামানের একার নয়; এরকম অভিজ্ঞতা আরো অনেকেরই হয়েছে। যে-কারণে সলিমুল্লাহ খান লিখেছিলেন, ‘আব্দুর রাজ্জাকের বিদ্যা আমার শেখার পথে কোনো বাধা হয় নাই। আমি টের পাই নাই আমি একজন বিদ্বানের সঙ্গে আছি। স্যার আব্দুর রাজ্জাকের জাদু এইটাই।’ (পৃ ২০৬)  অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের শুধু একটা নয়, অনেক ‘জাদু’ই ছিল। আনিসুজ্জামান তো বলেইছেন, ‘তিনি এত কথা বলতেন, এত বিষয়ের অবতারণা করতেন, এত গ্রন্থকার ও গ্রন্থের নাম উল্লেখ করতেন যে, তাঁর সান্নিধ্যে থাকলেই মনে হতো আমি সমৃদ্ধ হচ্ছি।’ আবার খানিকটা রসিকতা করেই হয়তোবা আনিসুজ্জামান বলেন, ‘পরে দেখলাম যে সারের কথা শুনলে সারা জীবন আমার বই পড়েই কাটাতে হবে তাঁর মতোই।’ ওই একই প্রসঙ্গে আহমদ ছফাও কৃত্রিম অভিযোগের সুরে বলেছিলেন, ‘আমার পক্ষে পিএইচডি করা সম্ভব হয়নি।… তার জন্যে প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাককে আমি দায়ী করি।’ কী অসাধারণভাবে – সব শ্রদ্ধা – প্রকাশ, ভাবা যায় না! রাজ্জাক স্যারের আরেক ছাত্র সরদার ফজলুল করিমও এসব ব্যাপারে কম যান না! তিনি যেরকম নিষ্ঠার সঙ্গে প্রাঞ্জল ভাষায় এরিস্টটলের ‘পলিটিক্সে’র অনুবাদ করেছিলেন, তাকে আমাদের ভাষার একটি সম্পদ হিসেবে বিবেচিত করা যায়। এ-অনুবাদ প্রসঙ্গে সরদার ফজলুল করিম ১৯৮৩ সালে বলেছিলেন, ‘আসলে এরকম কাজে আদৌ আমি হাত দিতাম না যদি না অধ্যাপক রাজ্জাক তাঁর সঙ্গে পরিচয়ের শুরু থেকেই ধমক দিয়ে বলতেন : ‘বেহুদা ক্যান্ লেখাপড়া করছেন? বাপমায়ের টাকা-পয়সা এভাবে নষ্ট করার কী হকটা আছে? যদি এ টাকার ঋণ কিছু শোধ করতে চান, তবে যা একটু জানচেন-টানচেন তা বাংলায় পেশ করেন। আপনার বাবা তো আপনার ইংরেজি পইড়া বুঝবো না, পোলা তার কত জিনিস জানছে, আর সে-জিনিসে তার কত উপকার হইতেছে আর হইবো।’ সরদার ফজলুল করিম কাজটা শেষও করেছেন আবার রাজ্জাক স্যারকে এভাবে বলেওছেন, ‘স্যার, আপনিও বুড়া হয়েছেন, দেখুন আমিও বুড়ো হয়েছি। এখন তো আমরা সমান।’ এই দেশের আর কোনো শিক্ষক ছাত্রদের এরকম ভক্তি-শ্রদ্ধা অর্জন করতে পেরেছেন কি না তা আমাদের জানা নেই। আবুল মাল আবদুল মুহিত যথার্থই বলেছিলেন, আব্দুর রাজ্জাক ‘ছিলেন জ্ঞানের পূজারি ও শিক্ষক। তাঁর পড়াশোনার পরিধি ছিল ব্যাপক এবং বিস্তৃত। গবেষণাকর্মে দিকনির্দেশনা দিতে তিনি ছিলেন সবিশেষ পারঙ্গম। আলাপচারিতায় তিনি শুধু পারদর্শী ছিলেন না, ছিলেন অনবদ্য। … শিক্ষকের সরলতা ও আড়ম্বরহীন জীবন ছিল তাঁর ট্রেডমার্ক। পরোপকার যেন ছিল তাঁর ধর্ম। শুধু তাঁর পছন্দের লোকের ভালোর জন্য তিনি সচেষ্ট ছিলেন না, অন্যরাও সেরকম সাহায্য, সহায়তা বা পৃষ্ঠপোষকতা তাঁর কাছ থেকে পেত।’ সেইসঙ্গে জনাব মুহিত আরেকটি দিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করবার চেষ্টা করেন; সেটি হচ্ছে অধ্যাপক রাজ্জাকের জীবনদর্শনের জায়গা। আবুল মাল আবদুল মুহিত জানাচ্ছেন, ‘আমার বিবেচনায় তিনি বিশ্বব্যবস্থা সম্বন্ধে একটি উদার দর্শনে বিশ্বাস করতেন। তিনি বোধহয় মনে করতেন যে, তামাম দুনিয়ার সমস্যা সমাধানের দায় আমার স্কন্ধে ন্যস্ত নয়, কিন্তু পৃথিবীর গোলকধাঁধা সমাধানের একটি সূত্র আমি। আমি আমার দায়িত্বটি যথাযথ পালন করতে পারলেই মানবসভ্যতায় আমার নিবেদন হলো ফলপ্রসূ।’ এর পরপরই মুহিত সাহেব বলেছেন, ‘এমনি সুন্দর দায়িত্ববোধ যদি বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর থাকে তাহলেই তো সভ্যতা বর্তে যায়।’ কিন্তু বাস্তবে তো সেরকম হয় না। হয় না যে সেটির কারণ সম্পর্কে তাঁর অভিমত হচ্ছে : মুশকিল হলো যে আমাদের এলিট যাঁরা সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনা করেন, তাঁরা এই দর্শনে বিশ্বাস করেন না। তাঁরা প্রত্যেকেই অতিমানব, সারাবিশ্বের মঙ্গল তাঁদের ওপরই নির্ভরশীল। তাই তাঁরা একান্তভাবেই অপদার্থ এবং সমাজের অমঙ্গলই তাঁরা সাধন করেন। তাঁরা তাঁদের ব্যক্তিগত দায়িত্বও যেমন পালন করেন না, তেমনি সমাজেরও অনর্থ সাধন করেন। (পৃ ৯০) এই বিশ্লেষণের সূত্র ধরেই অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের মহত্ত্ব আরো একবার আমাদের কাছে প্রতিভাত হয়।

পাঁচ
অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের প্রসঙ্গ উঠলেই অবধারিতভাবে যে-কথাগুলো উঠে আসে তার একটি হচ্ছে : তিনি অনেক কিছু পড়েছেন, জেনেছেন কিন্তু তেমন কিছুই লিখে যাননি। কেউ-কেউ এমনও বলবার চেষ্টা করেছেন যে-বেশিমাত্রায় পড়াশোনার প্রতি ঝুঁকেছিলেন বলেই তিনি নাকি লিখতে পারেননি। আব্দুর রাজ্জাক অবশ্য হুমায়ুন আজাদকেও তাঁর আলস্যের কথা বলে এড়িয়ে গিয়েছিলেন। অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের না-লেখার বিষয়ে অত্যন্ত যুক্তিযুক্ত জবাব দাঁড় করিয়েছেন শ্রদ্ধেয় রেহমান সোবহান। খ্যাতনামা এই অর্থনীতিবিদ দৃষ্টান্ত দিয়ে বলেছেন, ‘In the old days, at Oxford or Cambridge, most colleges provided a home to a few such teachers, who spent their days in their study, surrounded by books, which they devoured intensively, breaking off from their reading to give tutorials to the occasional student who emerged stimulated by the insightful and provocative exchanges with their tutor. In the evenings, these scholars retired, after a handsome dinner in their college, to the teachers common room, to drink claret or brandy and hold forth in brilliant conversation with their peers.’ সেইসঙ্গে অধ্যাপক রেহমান সোবহান এটিও উল্লেখ করতে ভোলেননি যে, ‘Such teachers usually published little and mostly retired as Lecturers rather than Professors. But they inspired generations of students who themselves graduated to become professors, bankers and some even Prime Ministers. (পৃ ২৫২)। এরপরও যাঁরা অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের লেখালিখি নিয়ে অনর্থক কূটকচালি করতে চাইবেন, তারা রেহমান সোবহানের এ-বিশ্লেষণের পরে সম্ভবত এ-বিষয়ে আর অগ্রসর হতে চাইবেন না। কারণ আব্দুর রাজ্জাকের দৃষ্টান্তও ঠিক একই রকমের। আর তিনি যে সে-অর্থে কিছু লিখে যাননি, সে-কারণেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও স্যারের ছাত্রছাত্রীদের রীতিমতো গর্ব করা উচিত। তারপরও যাঁরা শুধু লেখালিখির কথা তুলতে চাইবেন, তাঁরা প্রফেসর রওনক জাহানের লেখাটি পাঠ করে সান্ত্বনা পেতে পারবেন। অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের তিনটি বিশিষ্ট রচনাকম Political parties in India, The Military in Pakistan I Bangladesh : State of the Nation পাঠের এক দুর্লভ অভিজ্ঞতা থেকে প্রফেসর রওনক জাহান লিখেছেন, ‘All of his writings share some common features. He was always putting forth originals ideas challenging conventionnal wisdom. His analytical framework was that of a political economist. His arguments were forceful. His writing style was literary.’ (পৃ ২৭৮) আমরা আশা করব ‘আব্দুর রাজ্জাক ফাউন্ডেশন’ তাঁর এই রচনাকর্মগুলো প্রকাশের ব্যবস্থা করবে, যাতে নতুন প্রজন্মের উৎসাহী পাঠকরা শুধু স্যারের ছাত্রছাত্রীদের স্মৃতিকথা নয়, সেইসঙ্গে অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের রচনাকর্ম বিষয়েও একটি বিস্তারিত ধারণা পেতে পারেন।

দুই
এই স্মারকগ্রন্থ পাঠ করে এই অভিজ্ঞতাই হয় যে, একজন শিক্ষক হিসেবে তাঁর উত্তরপ্রজন্মের ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক শ্রদ্ধামিশ্রিত যে-ভালোবাসা পেয়েছিলেন আজকের দিনে তা বিস্ময়কর ঠেকে। উমর স্যার (বদরুদ্দীন উমর) তো সংগত কারণেই বলেছেন, আব্দুর রাজ্জাকের সংস্পর্শে যাঁরাই এসেছেন ও তাঁর স্নেহ লাভ করেছেন তাঁদের সকলে কাছেই তিনি অবিস্মরণীয়। এখানে আরেকটি প্রসঙ্গ উল্লেখ করতেই হয়। ড্রাকার (Peter F. Drucker)যে বলেছিলেন, ‘There are no poor or stupid or lazy students for the real teacher and real pedagogue.’ এ-সংকলটি তার একটি অসামান্য নমুনা। শুধু অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক একা নন, বরং এ-সংকলনে তাঁর ছাত্রছাত্রীসহ শুভানুধ্যায়ীদেরও রুচি, বিদ্যা-বুদ্ধি, সৌজন্যেরও একটি পরিচয় পাওয়া যায়। অন্য কারো কথা জানি না, তবে ধারণা করি, এ-সংকলনটি হাতে পেয়ে বদরুদ্দীন উমর নিশ্চয়ই তাঁর চাঁছাছোলা ভাষায় বলে উঠবেন, ‘আমাদের রাজ্জাক স্যার মারা গেছেন ১৯৯৯ সালে আর এই এখন ২০১২ সালের শেষে এসে কিনা স্মারকগ্রন্থ, ছোঃ!’ আর যাঁকে নিয়ে এ-আয়োজন সেই রাজ্জাক স্যার পরপার থেকে হয়তো বলে উঠবেন, ‘আনিসুজ্জামান, আপনারা পারেনও বটে!’ আমাদের তরফ থেকে শুধু এইটুকু বলার রয়েছে : এরকম একটি সংকলনগ্রন্থ পাঠ করতে পেরে নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করছি।