আফসার আমেদ
\ ২২ \
মা-বাবা বিছানা ছেড়ে কখন উঠে গেছে। কখন সকাল হয়েছে। সেঁজুতি ঘুম থেকে উঠছে না। আচ্ছন্ন অবস্থায় পড়ে আছে। কতদিন পর গ্রামের বাড়িতে এসেছে, সেই আনন্দে বিছানায় শুয়ে আরাম খাচ্ছে। সহজে উঠবে না। শুয়ে-শুয়েই বাড়ির হালচাল সব বুঝতে পারছে। দাদা নবকুমার আজ কোর্টে যায়নি। রূপ বারবার এসে পিসিকে দেখে গেছে। পুকুরে বেড় জাল টানা হয়েছে। বড়ো কাতলাটা ধরা পড়েছে। মা এসে বলে গেল উঠে দেখতে। বউদি এসে বলল, ‘কেমন লাফাচ্ছে এসে দ্যাখো।’ সেসব মনশ্চক্ষে দেখতে পায়। উঠে পড়লেই আয়েশ ছিঁড়ে যাবে। মা-বাবার বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে আছে।
মনে পড়ল আলমের কথা। আলম তার সঙ্গে এসেছে। আলম যেন তার অধিকৃত মূল্যবান সামগ্রী। কিংবা সম্রাজ্ঞীর রক্ষীর মতো। তার বিলাসিতার কাজে লাগছে। কিন্তু আলমকে নিয়ে সে করবে কী? লোককে দেখাবে, ওই দ্যাখো এমন সুদর্শন আজ্ঞাকারী নিয়ে আমি থাকি। বয়সে দু-তিন বছরের ছোটই হবে আলম। চমৎকার নরম মন। অনুগতও। দেখতে দেবদূতের মতো। দেখলে অনেক মেয়ে প্রেমে পড়ে যাবে। আলমের সে-উপলব্ধি নেই, নিজের রূপজ গুণপনায়, বরং হীনমন্যতায় ভোগে। কেননা, তার অপরাধ, সে ছিল পকেটমার। কলকাতার বাসে-বাসে সে পকেটমারি করেছে, নানা স্থানে পকেটমারি করেছে। এমন সুদর্শন যুবক তার আনুগত্যে চলে এসেছে।
এর ভেতর এক ধরনের সফলতা ও প্রসন্নতা পেল সেঁজুতি। মনে করল, অনেককিছু বঞ্চনা আছে তাকে ঘিরে। এস্টাব্লিশমেন্টের গোলকধাঁধায় কলকাতায় হারিয়ে যাচ্ছিল, তলিয়ে যাচ্ছিল সে, এখন উঠে দাঁড়ানোর শক্তির মধ্যে আলমকে পাওয়া ন্যূন করতে চাইল না। বরং এ-প্রাপ্তিকে প্রথম প্রথম বুঝতে পারেনি। এখন বুঝতে চাইছে, বুঝতে পারছে কিছুটা। তার প্রতি প্রেম হয়নি, মায়া পড়েছে। আলম হলো একটা সাইকেল বা হাতঘড়ির মতো, যা তার প্রয়োজনে লাগে।
তাছাড়া কী করবে সে আলমকে নিয়ে? আলমকে সান্নিধ্যে আনার মধ্যে একটা জেদও কাজ করছে, যেহেতু আলম অন্য একটি সম্প্রদায়ের, সে-সম্প্রদায়ের প্রতি আত্মসমাজের প্রত্যাখ্যান আছে, সন্দেহ আছে, বিরোধ আছে, সে-প্রথা ভাঙতে চেয়েছে সে। এই যে এখানে নিয়ে এলো, তাদের বিছানায় শুলো, তাদের থালাবাসনে খেল, এমন থানইট মারা এ-সমাজের পরিবারে ঘটানো চলতেই পারে। হয়তো এমএ পড়তে গিয়ে এ-শিক্ষা সে পেয়েছে।
শুয়ে-শুয়েই খবর পেল, সকাল সাড়ে ৮টা বেজে গেছে, আলম ঘরে-দোরে নেই। ঘরদোর, আশপাশ, দোকানতলা খুঁজেও পাওয়া যায়নি। সেঁজুতি মনে-মনে বলল, কাছাকাছি কোথাও গেছে, একটু পরেই ফিরে আসবে।
বিছানা ছাড়ে সেঁজুতি। রূপকে কোলে নিয়ে আদর করে। রূপ উঁকি মেরে দেখে-দেখে প্রস্ত্ততই ছিল, পিসির কোলে যেতে আপত্তি করেনি। বড়ো কাতলা মাছটা দেখে। এখনো লাফাচ্ছিল। দু-চারটে চিড়িং মাছ ও বেশকটা বাটা মাছ ধরা পড়ে। ন্যাদোশ মাছেরও দেখা মিলল। সেই ভোরে ধরা হয়েছে। নবকুমার বাজার করে ফিরল সাইকেলে করে। উঠোনতলায় ক্রিং ক্রিং। রূপ ঝাঁপিয়ে পড়ছে কোল থেকে। বাড়িতে বাবা থাকলে আর কারো কাছে যাবে না। শুনল, খুব সকালে মনাদা এসেছিল, সেঁজুতির আসার খবর শুনে। সে এখন অফিসে বেরিয়ে গেছে। কাকা-কাকিমারাও এসেছিল। এই বেশ। নিজের কম আসার ঢেঁকুর এসব। যতসব আদিখ্যেতা! সে আসেনি। এতে কার কী যায় আসছিল? কারো বাড়াভাতে ছাই দেয়নি। শুধু সুশীল মামার জন্য কষ্ট হয়। তারই হাতে মারা গেল, তার জন্য আফসোস! শীতলাতলার যেমন চলছিল, তেমনই তো চলছিল। তার না আসার জন্য কিছু আটকে ছিল না।
পাড়ার তার থেকে দু-চার বছরের ছোট মেয়েদের কার কার যেন বিয়ে হয়ে গেছে, সেসব খবর দিলো মা। এসব খবর জানাতে মা বেশি আগ্রহ পায়। মা জানে না, সে যে এসেছে ফিরে যাওয়ার জন্য। তারও বিয়ে হবে তার জন্য নয়। সে কলকাতা শহরে একটি মেয়ে শুধু। তাকে তার পথে চলতে হবে।
বাবা উঠোনে একটা চেয়ারে ঠায় বসে থাকে। মা-ই তাকে ধরে ধরে বাথরুমে নিয়ে যাচ্ছে। নানাকিছু খাবার দিচ্ছে। বাবা মাঝে মাঝে দরকারে মাকে ডাকছে, ‘নবর মা’। মায়ের সব সময় কান খাড়া, সঙ্গে-সঙ্গে চলে আসছে। জল এনে দেয়।
শাশ্বতী অাঁশবঁটিতে কাতলা মাছটা কাটে। সেঁজুতি দাঁতে ব্রাশ ঘষতে ঘষতে তা দেখে।
অমনি ঝেপে বৃষ্টি এলো।
নব উঠোনতলা থেকে সাইকেলটা তুলতে নেমে গেল।
রূপ এখন বাবার কোলে।
বৃষ্টি দেখে সেঁজুতির মনে পড়ে গেল আলমের কথা। ‘ছেলেটা কোথায় গেল একবার খুঁজে দেখলি না?’
মা বেরিয়ে এলো। ‘সে তো কখন বেরিয়েছে। কী জানি বাপু, পরের ছেলেকে কেন নিয়ে আসা। তা আবার মুসলমান।’
নব বলল, ‘এসে যাবে। নতুন জায়গা ঘুরে দেখছে। মোবাইল নেই?’
সেঁজুতি বলল, ‘আমি তো তার মোবাইল নম্বর পর্যন্ত জানি না।’
শাশ্বতী বলল, ‘সে কী?’
‘তাই-ই তো। বে-আক্কেলে ছেলে। দাদা, তুই ছাতা নিয়ে বেরো তো।’
‘কোথায় যাব শুনি?’
‘এই আশপাশে?’
‘আশপাশে দেখা হয়েছে। এখানে নেই।’
‘তাহলে কোথায় যাবে?’
‘স্টেশনের দিকে হয়তো। আরে বাচ্চা নয় তো হারিয়ে যাবে, অত চিন্তা করছিস কেন?’
শাশ্বতী বলল, ‘চিন্তার বিষয়।’
সেঁজুতি বলল, ‘আরে ও কলকাতার বাইরে কিছু চেনে না।’
‘আসবে আসবে।’
শাশ্বতী বলল, ‘চলে যায়নি তো?’
‘না বলে তো যাবে না। অত সাহস হবে না।’
শাশ্বতী বলল, ‘তোমার চাকর নাকি? পরের ছেলে। মুসলমান বলেই বলছি।’
‘তোমরা অত মুসলমান-মুসলমান করো না তো।’ সেঁজুতি বলল, ‘সবকিছুতে এক কথা। আরে ও তো মানুষ নাকি?’
শাশ্বতী বলল, ‘কী পড়ে?’
সেঁজুতি বলল, ‘জানি না।’
‘জানো না, সে কী কথা ঠাকুরঝি! তুমি বুঝি না জেনে না বুঝে বাড়িতে নিয়ে চলে এসেছ?’
‘আরে না না, ও খুব ভালো।’
সেঁজুতি আর কথায় যেতে বাধ্য নয়, বাথরুমে ঢোকে।
বউদির বোধহয় আলমকে মনে ধরেছে। তার বিষয়ে কথা বলছে। বিরূপ কথাও। মনে মনে হাসল সেঁজুতি। আলমকে বুঝতে তার কোনো আবিলতা নেই। আলমের দিকে বউদির চোখ পড়বে না, এ হয় না। তাতেও কোনো আবিলতা থাকার কথা নয়। পৃথিবীর তেমনই নিয়ম, সব মানুষই এমন সৌন্দর্যসন্ধানী। সেখানে নিজেকে ভালোবাসার কথা আছে। কে নিজেকে ভালোবাসতে চায় না? সেঁজুতি নিজেকে একটু কম ভালোবাসে, না হলে আলমকে প্রেমিক করে তুলত। সে তমোঘ্নকেই ভালোবাসে। মনেপ্রাণে তমোঘ্নর ভালোবাসা পেতে চায়। কিন্তু তমোঘ্নর কোনো উচ্চারণ নেই, উদ্দেশ নেই। ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে, হারিয়ে যেতে বসেছে। তমোঘ্নর জন্য তার চোখে জল চলে এলো এ-ভাবনার ভেতর। নীরবে অশ্রুপাত করল। কোথায় তমোঘ্ন? হারিয়ে গেলে? কোথায় হারিয়ে গেলে? কথা ছিল কি?
সেই কথায় বাথরুমে বেশি-বেশি সময় কাটায় সেঁজুতি। বাইরে বৃষ্টিও থেমে গেছে। বাইরে ওরা সব নানা কথা বলে। হয়তো আলমকে নিয়ে কথা বলে। বলুক।
বাইরে বেরোতেই মা গরম চা দেয়।
মা বলল, ‘তুই কি কাঁদলি?’
‘না। মায়ের কথা দেখো।’
‘আমার ভুল মনে হয়েছে।’
‘কাঁদব কেন?’
‘তাই তো।’
‘বাবার জন্য কষ্ট হয়।’
‘তোর বাবা এখন ঠিক আছে।’
‘চোখে দেখতে পায় না।’
‘আমি তো তাকে দেখি।’
‘দেখো মা, আমি তো আর থাকতে পারি না। আমার কথা ছেড়েই দাও।’
‘ছেড়ে দেব? কেন?’
‘আমার অনেক কাজ।’
‘সারাজীবন কাজ করবি নাকি? থিতু তো হতে হবে।’
‘আমাকে কাজ করে যেতেই হবে।’
‘টুল দিয়েছি, বাবার পাশে বোস, আলুভাজা মুড়ি দিচ্ছি।’
নবর কোলে এখন রূপ। বাবার পাশে বসে মুড়ি আলুভাজা খায় সেঁজুতি।
বাবা বলছিল বাদামগাছটা বড়ো হয়েছে, পাকা হয়েছে, সেটা কেটে তার জন্য একটা খাট বানাবে। গণেশ মান্না বড়ো সরুছুতোর, ভালো খাট বানিয়ে দেবে। পুকুরের ঘাটটা ভেঙে গেছে, নতুন করে শানের ঘাট বানাবে। অনেককিছুর পরিকল্পনা শোনাচ্ছিল বাবা। নানা কথা শুধোচ্ছিলও।
কিন্তু আলম এখনো ফিরল না? বলতে-বলতে আলম এসে গেল। তার হাতে একটা ব্যাগ, কীসের মালপত্র।
‘কী রে, কোথায় গিয়েছিলি?’
‘এই ইলেকট্রিকের কিছু মাল কিনে আনলাম।’
‘মানে?’
‘বাবা-মায়ের ঘরটা ওয়্যারিং করে দেব।’
‘তুই কি এখানে খেপ খাটতে এসেছিস?’
‘কতক্ষণ লাগবে আর, বিকেলে চলে যাব। যানে পড়ে গা।’
‘নিজের পয়সায় কিনে আনলি এসব?’
‘নবদা দিয়ে দেবে, রাতে বলেছিল।’
‘ও তুই কোথায় নবদা তাহলে জানত!’
‘জানত না, আমিই না বলে চলে গেছি। কতক্ষণ আর লাগবে, তাই।’
শাশ্বতী চা আনল আলমের জন্য।
মা আলমকে ডেকে নিয়ে কী কথা বলল। এই সময়ের মধ্যে এ-বাড়ির সকলের গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়েছে।
আবার বৃষ্টি এলো।
আলম মুড়ি-আলুভাজা খাচ্ছে বাবার পাশে বসে।
বাবা কথা বলছে আলমের সঙ্গে। আলম যে মুসলমান, এ-কথা সকলে এখন ভুলে গেছে। সবার সঙ্গে মিশে গেছে আলম। আলম বাংলা বলতে জানে। মাঝে-মাঝে হিন্দি মেশায়। তাতে কারো কোনো অসুবিধে হয় না। মা-বাবার ঘরের আজ সে ওয়্যারিং করে দেবে। বাড়ির সবকিছু ঠিকঠাক নেই। বাড়ির বাইরেটা প্লাস্টারিং করা হয়নি। বারান্দার মেঝের সিমেন্টের প্রলেপ নেই। বিকেলবেলা আলম ফিরে যাবে? যাওয়া তার ঘোচাচ্ছে সে। সব ঘর ওয়্যারিং করে দিয়ে যাক। যা লাগে সে দেবে।
আলম এখন কাজ করছে, করুক। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে হোক। দাদা আলমের কাছে, কাজে সাহায্য করছে।
মা তাকে আরেক কাপ চা দিয়ে গেল। এটাই চাইছিল সে। আবার চা পায় আলমও।
পুকুরে ডুবে স্নান করতে গেল সেঁজুতি। কতদিন পুকুরে স্নান করেনি। জল ছুঁতেই জলের আরাম পেল। সাঁতার কি ভুলে গেছে? জানে না। কাকার মেয়ে বালিকা খুদি এসে সাঁতার কাটতে লাগল। সেও সাঁতার কাটার চেষ্টা করল। প্রথম প্রথম ডুবে গেল। জলও খেল। দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল যখন, তখন তমোঘ্নর কথা মনে এলো। তারপর ভেসে উঠে সাঁতার কাটতে-কাটতে সংকল্প করল, তমোঘ্নকে সে ছাড়বে না, দেখে নেবে। তার জন্য তার কী করা উচিত? তমোঘ্নর কাছে যাওয়া? হয়তো যাওয়া। জলঢাকার সেই ঝালংয়ে? দরকার হলে যাবে। কবে?
তাই তো, কবে যাবে? সাঁতার কাটতে কাটতে সে-কথাই ভাবে, নিশ্চিত সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। তখন সে তার রক্ষীর কথা আশ্রয় মনে করে। তমোঘ্নকে মিলিয়ে দিতে আলমের সহায়তা লাগতে পারে। আলমের প্রতি তার অনেক ক্ষোভ ও আক্রোশ, মেটাতেও হবে।
মা হাঁকল ঘরের জানালা দিয়ে, ‘ভারী জলে এতক্ষণ সাঁতার কাটছিল কেন, শেষে জ্বর বাধাবি।’
সেঁজুতির ইচ্ছে হলো জ্বর বাধাতে। আরো স্নান করতে লাগল, আরো সাঁতার কাটতে লাগল।
বিকেলে সত্যি জ্বর আসতে চাইছিল। বউদির হাতের কড়া র-চা খেল। বাথরুমে গিয়ে সিগারেট খেল। একদিন সিগারেট খায়নি বলে অসুবিধে লাগছিল। প্রাণভরে ধোঁয়া গেলে। শান্ত হতে চায়। এই সিগারেটের কারণে এখানে থাকা আর সম্ভব হবে না। সে তার মতো করে থাকবে, থাকবেই। আচম্বিত গ্রামের পিছুটান তাকে চমকে দিয়েছিল, দ্রুত ফিরিয়ে নিচ্ছে নিজেকে। বাথরুমে গিয়ে-গিয়ে সিগারেট খেতে হবে।
বেরিয়ে আসতেই শাশ্বতী ধরে ফেলল, মিটিমিটি হাসছে। ‘আমি জানি, তুমি কী খেলে?’
‘একদম মা না জানে।’
‘মা জানতে পারবে না? জানবে না?’
‘জানবে না। তুমি বলবে না।’
‘কবে থেকে ধরলে?’ শাশ্বতী হাসে।
‘মাথা তোর ভেঙে দেব শাশ্বতী।’
‘আগে বলো, আলমের সঙ্গে তোমার কীভাবে পরিচয়?’
‘বাসস্টপে। আমার টাকা ফুরিয়ে গিয়েছিল। বাসভাড়া ছিল না, ফিরতে পারছিলাম না, ও দেয়।’
‘তারপর?’
‘তারপর কিছু নয়। তোকে কিছু বলেছে বউদি?’
‘না। শুধোলাম কখন? – খালি গায়ে পুকুরে নেমে স্নান করল।’ শাশ্বতী হিহি করে হাসে।
সেঁজুতি বলল, ‘খুব মজা না?’
‘একটু পরেই নাকি চলে যাবে?’
‘বলছিল?’
‘বলছিল।’
‘ওর যাওয়া দেখাচ্ছি।’
‘তোমার কথা শুনবে?’
‘শুনবে। ও থাকুক, তুই এটা চাইছিলি বউদি?’
‘থাকুক না।’
‘কালকেই ওকে নিয়ে ফিরে যাচ্ছি।’
‘ওমা কেন, বেশ তো থাকছিলে।’
‘এই তো দুদিন থাকা হবে।’
‘মা যে তোমাকে মোটা পুকুরে স্নান করাতে নিয়ে যাবে, রোগা হয়ে যাচ্ছ বলে।’
‘ওমা, রোগাই তো ভালো।’
‘মা সেকেলে মানুষ, জানে না। এখনকার মেয়েরা শসা-মুড়ি খেয়ে থাকে তাই। তেমন খায় না, স্লিম হতে চায়।’
‘মোটাপুকুর, সেটা আবার কোথায়?’
‘দশ-বারো কিলোমিটার দূরে, দক্ষিণে।’
‘তুই যা।’
‘আমি রোগা নাকি?’
‘একেবারে মোটাও নোস।’
‘চলো, তোমাকে রূপের অন্নপ্রাশনের ছবি দেখাই।’
‘থাক না, দেখা ফুরিয়ে ফেলছিস কেন?’
‘তুমি কি থাকবে?’
‘জানি না।’
‘পুজোতে আসবে?’
‘জানি না।’
‘তোমার কাছে একদিন যাই আমার ইচ্ছে হয়।’
‘যাস, কদিনের জন্য।’
‘তুমি তো বলোই না।’
‘এই তো বলছি।’
‘কলকাতায় চিড়িয়াখানা আছে, জাদুঘর আছে, সায়েন্স সিটি আছে, কত কী? আলম দেখাতে পারবে না?’
‘খুব-খুব। আলম দেখালে তুই খুব খুশি হোস?’
‘তা কেন, আলমের তো দেখছি কাজকম্ম নেই।’
‘ভালো বুঝেছিস।’
‘ভাবছি একটা বেড়াল পুষব। তাকে খেতে দেব, তার সঙ্গে কথা বলব। তোমার দাদার তো কোর্ট, নানা ব্যস্ততা, আমার সঙ্গে কথা বলার সময় কই। ছেলে মায়ের কোলে বাবার কোলে মানুষ হয়ে যাচ্ছে। পাড়া বেড়াতে ভালোবাসে, পাড়ার লোকজনের ন্যাওটা। সংসারে রান্না করার কাজ আর কতক্ষণ করব। সে তো মাও করে। বেড়ালের তুমি একটা নাম ঠিক করে দিও।’
শাশ্বতী ফিরে যায় রান্নাঘরে, কিছু একটা করতে। আলম দাদার সঙ্গে বসে চা খায়। আলমের সঙ্গে তার কথা বলাই হয় না। নাটাইয়ের সুতো ছাড়ার মতো ছেড়ে দিয়েছে সেঁজুতি আলমকে। যা কিছু করুক, যা কিছু থাকুক।
কোথায় যেন মেলা হয় আশপাশের গ্রামে? রথের মেলাও হয়। তার গন্ধ নাকে এসে লাগে। গ্রামের মানুষরা যায়। হয়তো শাশ্বতীও যায়। সে আর ফিরে পাবে না সেসব, ফিরে পেতেও চায় না।
আজ বিকেলে আলম ফিরে যাবে না, সেঁজুতির এই অনিচ্ছার কথাটা পৌঁছে গেছে আলমের কাছে। শাশ্বতীই বলে দিয়েছে। আলম তার কাছে খুব একটা আসছে না। নবদার ঘনিষ্ঠ হয়েছে। ওয়্যারিং করে দিয়ে নবদার প্রিয় হয়েছে। মা-বাবাও তার কাজে সন্তুষ্ট হয়েছে। খাতির পাচ্ছে সবার কাছে।
পাড়ার সমবয়সী নন্দিনী আজ সকালে বাপের বাড়ি এসেছে। তার তিন বছর হলো বিয়ে হয়েছে। গলায়-গলায় দুজনের ভাব ছিল। নন্দিনীর সঙ্গে দেখা হবার খুব ইচ্ছে সেঁজুতির। খবর পাঠিয়েছিল খুদির হাতে। খুদি এসে বলেছিল, বিকেলে আসবে। নন্দিনীর অপেক্ষায় পথ চেয়ে বসেছিল সেঁজুতি। বিকেল তো কখন হয়েছে। এখনো এলো না। এলো না কেন? নন্দিনীর আসার অপেক্ষায় অস্থির হয়ে উঠেছে সেঁজুতি। মেঘ আছে আকাশে, তাই বিকেল সরে আসছে, আলো কমে আসছে ক্রমশ।
মা এসে পাশে দাঁড়াল। ‘কী রে, কিছু বলছিস?’
‘না, যাই।’
‘কোথায়?’
‘ওদের বাড়ি।’
‘কাদের?’
‘ওর তো আসার কথা ছিল।’
‘কোনো কিছুতে আটকেছে।’
‘সকালে যাস।’
‘সকালে আমার সময় হবে না, বেরিয়ে যাব।’
ফিরে যাওয়ার কথায় মা মনখারাপ করল।
তাতে সেঁজুতির কিছু করার নেই। ‘যাই -’ বলে উঠোনতলায় নেমে গেল। আর অমনি বৃষ্টি নামল। সে যাবে নন্দিনীর বাপের বাড়ি, নন্দিনীর সঙ্গে দেখা করতে। আলম একটা ছাতা নিয়ে ছুটে এলো। ছাতা মাথায় দিয়ে পাশের বাড়ি রওনা দেয় সেঁজুতি। (চলবে)
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.