এক জীবনে অনেক যাপন

মোহাম্মদ আজম

তাঁর জন্ম হয়েছিল বৃহত্তর ঢাকায়, এক সচ্ছল হিন্দু ব্যবসায়ী পরিবারে। পরে তিনি ঘটনা-পরম্পরায় পৌঁছেছেন কলকাতায়। পূর্ব বাংলার বিপুল মানুষ এই পরিচয়ে জন্মলাভ করে, বেড়ে ওঠে, হয়তো আগেই কলকাতার সঙ্গে শিক্ষা বা কর্মসূত্রে সম্পৃক্ত হয়ে, পরে স্থায়ীভাবে কলকাতায় বসতি গেড়েছেন সাতচল্লিশে বা আগে-পরে। গত দুশো বছরের বাঙালি ভদ্রলোক হিন্দু পরিবারের ইতিহাসে এ-ধরনের ঘটনা এত বেশি পাওয়া যাবে যে, শুধু এর জন্য কোনো জীবন বা জীবনীকে আমরা হয়তো অধিক মূল্য দিতে উৎসাহবোধ করব না। পরিতোষ সরকারের জীবনে দুটি ভিন্ন ঘটনা ঘটেছে, যা ওই গড়পড়তা কাহিনি থেকে ভিন্ন। এক, তাঁদের পরিবারের বিপর্যয় প্রত্যক্ষত সাতচল্লিশের বিভাগজনিত কারণে হয়নি, আগেই শুরু হয়েছিল। দুই, তিনি পশ্চিম বাংলায় হিজরত করেছেন বেশ খানিকটা পরে। জনগোষ্ঠীর ইতিহাসের দিক থেকে দুটিই তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা।কশিকাঁথার জীবন নাম দিয়ে আত্মজীবনী লিখেছেন পরিতোষ সরকার। নামের সঙ্গে একটি উপনাম জুড়ে দিয়েছেন তিনি : ‘সামান্যের অসামান্য জীবনকথা’। নাম এবং উপনাম – দুটিই বেশ তাৎপর্যপূর্ণ হয়েছে। তিনি খুব সামান্য নন হয়তো, কিন্তু ভেবেছেন, তাঁর জীবন ঠিক অসামান্য হয়ে ওঠেনি। ফলে যাঁদের জীবনের গুণেই জীবনী অসামান্য হয়ে ওঠে, তিনি তাঁদের দলের নন। অন্য আরেকটি দল আছে, যাঁদের জীবনী নিয়ে সাধারণ্যে ব্যাপক আগ্রহ দেখা যায়। জাতীয় বা সামষ্টিক জীবনের কোনো বড় ঘটনার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা ব্যক্তিগত কৃত্যে খুব উল্লেখযোগ্য না হলেও ওই ঘটনার অন্তরঙ্গ পরিচয়ের সন্ধানে লোকে তাঁদের জীবনকথা পাঠ করেন। পরিতোষ সরকার ঠিক এ-ছাঁচেও পড়েন না। তাহলে তিনি জীবনীগ্রন্থ প্রণয়ন করছেন কেন? উপনামটি সেই সাফাই সাক্ষ্যই দিচ্ছে : তিনি সামান্য হতেও পারেন, কিন্তু তাঁর জীবনটি – দৈবযোগেই হয়তোবা – সামান্য নয়। তাঁর এ-দাবির মধ্যে একবিন্দু বাড়াবাড়ি নেই। জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তিনি মধ্যবিত্ত গন্ইণ্ডিতেই জীবন কাটিয়েছেন। মাঝের লম্বা বিপর্যয়সহ। ওই বিপর্যয় তাঁর জীবনের এমনসব বাঁক তৈরি করেছে যে, মধ্যবিত্ত জীবনের কোনো পরিচিত ছাঁচ দিয়েই তাকে আর চেনা সম্ভব হচ্ছে না। তাতে তাঁর যাপিত জীবনটি অসামান্য হয়ে উঠেছে।

সরকার-পরিবারের নানা ধরনের বিপর্যয় বস্তুত বেশ দ্রুতই হয়েছিল। আর্থিক বিপর্যয়ে তার শুরু। ক্রমে পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ এবং উপার্জনক্ষম পুরুষ সদস্যদের মৃত্যু বা আত্মহত্যা, নিজেদের বাড়ি-ভিটা ত্যাগ করে অন্যত্র আশ্রয় গ্রহণ, শেষে দেশত্যাগ। খুবই নাটকীয় পতন। পরিতোষ সরকার এজন্য শরিকদের দায়ী করেছেন, বিশেষত নারী সদস্যদের। জেঠাই এবং জেঠাতো ভাইয়ের বউকে বিশেষভাবে দুষেছেন। তাঁর এ-বিবরণী কতটা নিরাসক্ত বলা মুশকিল। তিনিও তো নির্ভর করেছেন অন্যদের ওপর। তাঁর নিজের বয়স তখন এত কম যে, নিজের বিবেচনা থেকে কোনো গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা করা সম্ভব ছিল না। কারণ যাই হোক, সরকার পরিবারের এই পতন পরিতোষ সরকারের পরবর্তী কয়েক দশকের জীবন-সংগ্রাম এবং সে-অনুপাতে জীবন-নাটকের মূল উৎস। একটা প্রশ্ন এখানে তোলা যেতে পারে। শরিকদের কোনো একটা অংশ এজমালি সম্পত্তি গ্রাস করেছে এবং অন্য অংশকে পথে বসিয়েছে – এরকম কাহিনি আমরা হরহামেশা শুনি। এ-মনোবৃত্তির সঙ্গে কি অভিবাসী হওয়ার সম্ভাবনার কোনো সম্পর্ক আছে? অন্যত্র চলে গেলে তাদের নির্লজ্জ কারবারের সাক্ষ্য বা কৈফিয়ত তলব করার মতো কেউ থাকবে না, এমন সম্ভাবনা কি এ-ধরনের প্রবৃত্তিকে আশকারা দেয়? বিশ শতকের চল্লিশের দশকে পূর্ব বাংলার সম্পন্ন হিন্দু পরিবারে এ-ধরনের ঘটনা কি কিছু বেশি পরিমাণে ঘটেছিল? অভিবাসী মনস্তত্ত্ব ও বাস্তবতা নিয়ে যাঁরা কাজ করেন, তাঁরা হয়তো এ-বিষয়ে খোঁজখবর দিতে পারবেন।

যা হোক, পরিবারটির এ-বিপর্যয়ের মধ্যেই ঘনিয়ে আসে দেশভাগের ক্ষণ। পরিবারের বিভিন্ন অংশ যার যার মতো করে দেশত্যাগের প্রস্ত্ততি নেয়। পরিতোষ সরকারের জীবনে সে-পর্বও ভিন্ন রকমের গল্প তৈরি করে। তাঁর বড় ভাই পবিত্র সরকারকে আগেই পালক দেওয়া হয়েছিল পিসিদের কাছে। তারা তুলনামূলক সচ্ছল। কাজেই কলকাতায় একটা বন্দোবস্ত করা তাদের পক্ষে সহজ ছিল। পবিত্র সরকারের যমজ বোনটি কিন্তু শেষ পর্যন্ত থেকে যাবে সাভারে, বহু বছর পরে তার সঙ্গে দেখা হবে ততদিনে বিখ্যাত হয়ে যাওয়া পবিত্র সরকারের এবং সেই সাক্ষাৎ সংবাদপত্রে খবর হয়ে প্রকাশিত হবে। কিন্তু খবরে তো যন্ত্রণা আর বেদনা অপ্রকাশিতই থেকে যায়। আর পরিতোষ সরকার তাঁর আরেক বাড়ি-পালানো ভাই এবং মাকে নিয়ে জীবন-সংগ্রাম চালিয়ে যেতে থাকেন ঢাকায়। তাঁদেরও লক্ষ্য কলকাতায় পৌঁছানো। কিন্তু দেশত্যাগের জন্য যে আর্থিক সংগতি দরকার হয়, তা না থাকায় তাঁদের অপেক্ষা করতে হয় আরো কয়েক বছর, যদ্দিন না তাঁর বাড়ি-পালানো ভাইটি কতকটা সত্য, কতকটা মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে মাতা-পুত্রকে ঢাকা ছেড়ে যাওয়ার বন্দোবস্ত করতে পারে। প্রশ্ন হলো, তাঁদের জন্য ঢাকা ছেড়ে যাওয়া কি অপরিহার্য ছিল? তাঁরা এখানে খারাপ জীবনযাপন করছিলেন বটে, কিন্তু ওপারেও তো কোনো সুসংবাদ ছিল না। তাঁদের পরিবারের একটা অংশ তো ঢাকায় থেকেই গিয়েছিল। অনেক বছর পরে পরিতোষ সরকার ঢাকায় বেড়াতে এসে তাঁদের কারো কারো সচ্ছলতা দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন। কিন্তু পরিতোষ সরকার এবং তাঁর মা সাতচল্লিশের পরের বছরগুলোতে অপেক্ষা করছিলেন দেশত্যাগের জন্য। এর কারণ হয়তো এই যে, পরিবারের এক সদস্য পিসিদের সঙ্গে আগেই চলে গিয়েছিল কলকাতায়। অন্য ছেলে কিছু উপার্জনের বন্দোবস্ত করতে পেরেছিল সেখানেই। পরিতোষ সরকার এবং তাঁর মা এভাবে সাতচল্লিশ-পরবর্তী দেশত্যাগের একটা অংশের প্রতিনিধি হয়ে রইলেন। এ জীবনকাহিনি সেই বাস্তবতা ও মনস্তত্ত্বের নির্ভরযোগ্য আখ্যান হয়ে থাকল।

পরিতোষ সরকাররা মা-বেটা কলকাতায় থিতু হয়েছিলেন আরো কবছর পর। আগে থাকতে হয়েছিল আলিপুরদুয়ারে। বেশ মর্মান্তিক সে-জীবন। অন্যের বাড়িতে কাজ করা, অন্যের দয়ায় থাকার ঘর পাওয়া, বিড়ি বাঁধার কাজ করে খাওয়ার এবং পড়ার খরচ জোগানো, প্রতি মুহূর্তেই জীবনযাপনের অনিশ্চয়তায় বিষণ্ণতায় ভোগা – এ ছিল সে-জীবনের নিত্যকার চিত্র। চিত্রটা অবশ্য শুরু হয়েছিল আরো আগে ঢাকায়। পরিতোষের মায়ের জন্য সে-জীবন ছিল অধিকতর বেদনার। সচ্ছল পরিবারের মেয়ে এবং বউ তিনি। রাতারাতি নিপতিত হয়েছিলেন হতদরিদ্র দশায়। পরিতোষ সরকারের ভাষায় ‘রাজপ্রাসাদ থেকে পর্ণকুটিরে’ অবনয়ন। আরেক বোনসহ আশ্রয় নিয়েছিলেন ভাইদের বাসায়। পারিবারিক কূটনীতিতে পরাস্ত হয়ে সে-আবাস থেকে বিচ্যুত হন। এরপর কাজ করতে হয়েছে অন্যের বাড়িতে, গস্নাস ফ্যাক্টরির নিচুস্তরের কর্মী হিসেবে। তাতেও বালকপুত্র পরিতোষের জন্য খাওয়া-পরার বন্দোবস্ত করতে পারেননি। অগত্যা বালক পরিতোষকে আশ্রয় নিতে হয়েছিল টিকাটুলির রামকৃষ্ণ মিশন আশ্রমে। মধ্যবিত্ত জীবনের জন্য সার্বিক অর্থেই অচেনা এ-ধরনের জীবনের মধ্য দিয়ে পরিতোষ সরকার গেছেন জীবনের অনেকগুলো বছর, যদ্দিন না তিনি পৌঁছতে পেরেছেন কলকাতায়, ভাই পবিত্র সরকারের তত্ত্বাবধানে, ভর্তি হতে পেরেছেন কলেজে। তাঁর পরবর্তী জীবনকে আমরা কমবেশি মধ্যবিত্ত ছাঁচে ফেলে পড়তে পারি।

পরিতোষ সরকারের এই বৃহদাকার জীবনী পড়তে পড়তে মানুষের জীবনের একটা মনস্তাত্ত্বিক বাস্তবতা সম্পর্কে গভীর প্রত্যয় জন্মে। ধ্বংসযজ্ঞের মধ্য থেকে একজন মানুষ কিসের ভরসায় নাক উঁচু করে বেঁচে থাকে? কী তার প্রেরণা? জীবন-সংগ্রামের ওই অংশে তিনি যে জীবনযাপন করেছেন, এরকম জীবন বাংলার কোটি কোটি মানুষের নিত্যকার জীবন। পার্থক্যের মধ্যে এই, তাঁর অন্যরকম জীবনের স্মৃতি ছিল। সেই স্মৃতিই কি তাঁকে মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে আসতে নিত্যপ্রেরণা জুগিয়ে গেছে? এখানেই হয়তো তাঁর জীবনে ভাই পবিত্র সরকারের এত বড় ভূমিকা। জীবনীর বাকি অংশ সাক্ষ্য দেয়, পবিত্র সরকার প্রত্যক্ষত ভাইকে বেশি পরিমাণে সাহায্য করতে পারেননি। অন্তত আশানুরূপ সহযোগিতা তাঁর কাছ থেকে পাওয়া যায়নি। হয়তো সম্ভব ছিল না। সম্ভব হয় না। তবু ভাইয়ের প্রতি তাঁর কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। তার প্রধান কারণ হয়তো এই যে, মাটির সমতলে এত বছর পার করে তিনি যে মাটির সঙ্গে মিশে যাননি, মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পেরেছেন শেষ পর্যন্ত, তার প্রধান প্রেরণা ছিলেন পবিত্র সরকার। একদিকে ভাইয়ের অ্যাকাডেমিক রেজাল্ট আর শোভন জীবনযাপন তাঁকে নিত্য খুঁচিয়ে জাগ্রত রেখেছে, অন্যদিকে ভাইয়ের কিছু সহযোগিতা পাওয়া যাবে, এ-আশ্বাস নিজেকে প্রস্ত্তত করার প্রেরণা জুগিয়েছে। ওই আশ্বাসটা আসলে তাঁর রক্তেই ছিল। যে-জীবন তিনি যাপন করছেন, তা যে তাঁর নিজের জীবন নয়, এ-বোধ সর্বদা রক্তে ক্রিয়া করেছে বলেই হয়তো তিনি উঠে আসতে পেরেছেন।

উঠে আসার পর তাঁর জীবনটি বেশ সাদামাটা হতে পারত; কিন্তু জীবন-নাটকের উত্তুঙ্গ সাসপেন্স যেন তাঁর সঙ্গে নিয়তির মতোই বাঁধা। চাকরি পেলেন মাস্টারির। কলকাতা বা পশ্চিমবঙ্গে পেলেই ব্যাপারটা সাধারণ হয়ে উঠত। কিন্তু তিনি কাজ পেলেন ত্রিপুরায়। বেশ কবছর সেখানে শিক্ষকতা করলেন। নতুন পরিবেশ আর পরিস্থিতির সঙ্গে আবার খাপ খাওয়াতে হলো। মানুষ, জীবন, জীবিকা, সংস্কৃতি আর সামষ্টিক মনস্তত্ত্ব সম্পর্কে নতুন অভিজ্ঞতা হলো। আমরা পাঠকরাও সে-অভিজ্ঞতার ভাগ পেলাম। এর মধ্যে সবচেয়ে লক্ষণীয় দিক সম্ভবত এই যে, ভারত রাষ্ট্রের সঙ্গে এই পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশগুলোর ভৌগোলিক দূরত্বের সঙ্গে সঙ্গে মনস্তাত্ত্বিক দূরত্বের একরকম ফিরিসিত্ম এখানে পাওয়া গেল।

নকশিকাঁথার জীবন গ্রন্থে পরিতোষ সরকার নিজের এবং পরিবারের হতদরিদ্র জীবনের রাখঢাকহীন বিবরণ দিয়েছেন; কিন্তু সব ব্যাপারে তিনি এতটা খোলামেলা হয়েছেন বলে মনে হয় না। এখানে প্রেমের বা প্রেম-সম্ভাবনার পরিচয় আছে; কিন্তু যৌনতার কোনো চিত্র নেই। যৌন-মনস্তত্ত্বেরও কোনো পরিচয় নেই। এ-ব্যাপারে তিনি যে অন্তত অংশত নীতিধর্ম বা সামাজিক সম্পর্ক দ্বারা চালিত হয়েছেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তাঁর কলকাতার জীবনে রিফিউজি জীবনের সংগ্রাম বেশ ধরা পড়েছে। তবে স্থানীয়দের সঙ্গে সাংস্কৃতিক-মনস্তাত্ত্বিক সংঘাত হয়েছে কি না, বা বিখ্যাত ঘটি-বাঙ্গাল দ্বন্দ্ব তাঁকে কোনোভাবে স্পর্শ করেছে কি না, তা খুব একটা স্পষ্ট নয়। হয়তো তাঁর ক্ষক্ষত্রে এরকম কোনো সংকট হয়নি। যদি না হয়, তাও বিশেষভাবে পাঠযোগ্য। কলকাতায় উনিশ-বিশ শতকে ‘বাঙালি সংস্কৃতি’র যে বিশিষ্ট ধরন ও রূপ গড়ে উঠেছিল, পূর্ব বাংলার সম্পন্ন হিন্দু পরিবারগুলোর সঙ্গে তার যোগ ছিল বেশ নিবিড়। সাতচল্লিশে বা তার আগে-পরে পূর্ব বাংলা থেকে দেশত্যাগী মানুষেরা সে-সুবিধা পেয়েছিলেন বলেই মনে হয়। বুদ্ধদেব বসু, নীরদচন্দ্র চৌধুরী, তপন রায়চৌধুরী, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বা শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের স্মৃতিকথা থেকে নিশ্চিত করে বলা যায়, এঁদের কারো ক্ষক্ষত্রেই সামাজিক-সাংস্কৃতিক সম্পর্কের সমস্যাটা প্রধান হয়ে ওঠেনি। অভিবাসী মনস্তত্ত্বের আরো গভীরতর সংকট অবশ্য কথাসাহিত্য বা সিনেমায় ফুটে উঠেছে। পরিতোষ সরকার সেদিকটায় বেশি মনোযোগ দেননি। মনোযোগ দিয়েছেন অন্য তিনটি দিকে। পশ্চিমবঙ্গের ষাট-সত্তর-আশির দশকের তিনটি দিক তাঁর লেখায় বিস্তারিত উঠে এসেছে। তাঁর নিজের মতো করেই। এজন্য এই আত্মজীবনীটি ইতিহাস-পাঠকদের কাছে বিশেষ মূল্য পেতে পারে।

প্রথমত, কলকাতার সংস্কৃতি-চর্চার একটা অংশ – বিশেষত পারফর্মিং আর্টের দিক থেকে – এখানে গুরুত্বের সঙ্গে উঠে এসেছে। পারফর্মিং আর্টে পরিতোষ সরকারের আগ্রহ আর পারদর্শিতা অল্প বয়সেই বিকশিত হয়েছিল। আলিপুরদুয়ারে জীবনে খেলাধুলা আর সংস্কৃতি-চর্চা তাঁকে জীবনযাপনে বেশ খানিকটা মর্যাদা আর সুবিধা দিয়েছিল। কলকাতায় বৃহত্তর পরিসরে সে-চর্চা তিনি থামিয়ে দেননি। লেখালেখির সঙ্গেও তিনি খানিকটা যুক্ত হয়েছিলেন। সংস্কৃতির অঙ্গনে তাঁর যাতায়াত ও অংশগ্রহণ ঠিক উচ্চকোটির ছিল না; কিন্তু তিনি কেন্দ্রের কাছাকাছিই ছিলেন। ফলে ইতিহাসের কিছু তথ্য-উপাত্ত, খ্যাতিমান ব্যক্তিদের কিছু অন্তরঙ্গ পরিচয় তাঁর লেখায় প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ হিসেবে পাওয়া যাবে।

দ্বিতীয়ত, ক্ষমতার রাজনীতি সম্পর্কে তিনি সম্ভবত খানিকটা রয়েসয়ে মন্তব্য করেছেন। বিবরণী প্রস্ত্তত করার সময়ে বর্তমান ক্ষমতাসীনদের কথা তাঁর মাথায় ছিল। ফলে পূর্ববর্তীদের সম্পর্কে মন্তব্য ও বিশেস্নষণে তার প্রভাব পড়া স্বাভাবিক। নকশাল আন্দোলন-সম্পর্কিত বিবরণেও তার ছাপ রয়ে গেছে। তিনি নিজে নকশাল আন্দোলনে প্রত্যক্ষত যুক্ত ছিলেন না। কিন্তু যাঁরা যুক্ত ছিলেন, তাঁদের কেউ কেউ তাঁর ঘনিষ্ঠ ছিল। সে-সময় তিনি ছাত্র এবং সংস্কৃতিকর্মী। ফলে খুব কাছ থেকে আন্দোলনের সংগঠন এবং পরবর্তী প্রতিক্রিয়া দেখতে পেরেছেন। বর্তমান রচনায় তার বিবরণ বেশ নিরাসক্ত। কিন্তু তাতে অন্তরঙ্গতার ঐশ্বর্য আছে। নকশাল রাজনীতির প্রত্যক্ষদর্শীর আখ্যান হিসেবে তাই নকশিকাঁথার জীবন মূল্য পাবে।

তৃতীয়ত, তিনি দীর্ঘদিন কাজ করেছেন শিক্ষা-প্রশাসনে। অধ্যক্ষ হিসেবে তাঁকে বেশ সফলই বলতে হবে। তিনি চেষ্টা করেছেন কাজ করতে। সে-কাজ অনেক সময়ই হয়তো ছিল সাধারণ দায়িত্বের চেয়ে বেশি। বস্ত্তত তাঁর জীবনের যে-উদ্যম তিনি রপ্ত করেছিলেন জীবনসংগ্রামে, তার এক ধরনের বাস্তবায়ন দেখি শিক্ষা-প্রশাসনে। কাজ করতে গিয়ে তাঁকে স্থানীয় প্রভাবশালীদের সামলাতে হয়েছে, রাজনৈতিক ক্ষমতার ব্যাকরণ সম্পর্কে সাবধান থাকতে হয়েছে, কলেজের অভ্যন্তরীণ নানা পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হয়েছে। ব্যক্তির নাম ধরে যেসব বিবরণ তিনি দিয়েছেন, তার সবটা হয়তো পক্ষপাতমুক্ত নয়। কিন্তু সার্বিকভাবে পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষা ও রাজনীতির অবস্থা তাতে ভালোই ফুটেছে। যাঁরা শিক্ষা-প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত, তাঁদের কাছে এ-বই বাড়তি মূল্য পাবে বলেই ধারণা করি।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এ-ধরনের বহু কৃতী ব্যক্তি আত্মজীবনী লিখেছেন, যাঁদের জীবনাভিজ্ঞতা সাতচল্লিশের বাংলাভাগের সঙ্গে যুক্ত। পূর্ব বাংলা থেকে যাওয়া এবং কলকাতায় থিতু হওয়া এই ব্যক্তিদের আত্মজীবনীগুলো অভিজ্ঞতার সাযুজ্যের কারণেই মিলিয়ে পড়ার সুযোগ আছে। এ-তালিকার সংযোজন হিসেবেই পরিতোষ সরকারের আত্মজীবনীকে দেখা সংগত। তবে অন্য অধিকাংশের সঙ্গে তাঁর জীবনকথার মৌলিক পার্থক্য আছে। গোড়ার পার্থক্য এই যে, তিনি নিজের জীবনীই লিখেছেন। বিশেষ সময় ও সমাজকে বেশি মূল্য দিতে চাননি। তাঁর হয়তো সে-সুযোগও কম ছিল। কারণ তিনি অন্য অনেকের চেয়ে কম ‘কৃতী’। এই বিশেষত্বই কিন্তু এই আত্মজীবনীর অন্যরকম গুরুত্বের দ্বার উন্মোচন করেছে। কথাটা খুলে বলা দরকার। মিহির সেনগুপ্তের বিষাদবৃক্ষ আত্মজীবনীর ছলে একটি ঐতিহাসিক ট্র্যাজেডির অন্তরঙ্গ বিষণ্ণতা ধরতে চেয়েছে। তপন রায়চৌধুরীর বাঙালনামা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার সঙ্গে ঐতিহাসিক সিদ্ধামেত্মর সমীকরণের এক নিপুণ দৃষ্টান্ত। এ বইগুলো অনেকাংশে ‘সাহিত্যিক’। এ অর্থে যে, বিবরণীর লক্ষ্যই সেখানে অন্যতর তাৎপর্যের অন্বেষণ। এ-লক্ষ্য হয়তো যে-কোনো রচনারই থাকে। কিন্তু নকশিকাঁথার জীবনে অন্তত ঘোষিতভাবে এবং আখ্যান রচনার স্টাইলে এ-ধরনের ‘সাহিত্যিক’ প্রেরণা দেখা যায়নি। ফলে মতাদর্শিক চাপ অন্তরঙ্গতার ঘাটতির যে-সম্ভাবনা তৈরি করে, এ-বই তা থেকে যথাসম্ভব মুক্ত থেকেছে। তার মানেই হলো, ‘মুক্ত’ পাঠের সম্ভাবনা বেড়েছে।

মতাদর্শিক চাপ আর সাহিত্যিক প্রণোদনা থেকে যথাসম্ভব মুক্ত থেকে এ-গ্রন্থ যে-মানুষটিকে সামনে নিয়ে এসেছে, সে-মানুষটি আরেকটি কারণে খুব উলেস্নখযোগ্য। বেশিরভাগ আত্মজীবনীর লেখক সাধারণ মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে এক অন্যতর লোকে অবস্থান করেন। পাঠক বইটি পড়েও সেই ভঙ্গিতে। পরিতোষ সরকারের অবস্থান এবং ভঙ্গি একেবারেই বিপরীত। তিনি কথা বলেছেন দশের এক হয়ে। নৈর্ব্যক্তিক হওয়ার কোনো চেষ্টা না করেই। তাতে ধরা পড়েছে তাঁর ব্যক্তিজীবনের কঠিন সংগ্রাম, উত্থান এবং পতন, উৎকণ্ঠা এবং আনন্দ। ঘটনাক্রমে তাঁর জীবনটিই এমন যে, তার সাংবাদিকী বিবরণেও খানিকটা থ্রিলারের স্বাদ পাওয়া যায়। হয়তো উৎসাহও জন্মে। গভীর পতিত দশা থেকে অটুট মনোবল আর পরিশ্রমের সিঁড়ি বেয়ে যে ভেসে ওঠা যায়, তার প্রত্যক্ষ নজির হিসেবে বইটি পড়া সম্ভব। সম্ভব অনুপ্রাণিত হওয়াও।