এক নৈরাশ্যবাদীর নেপথ্যে

আরো একটি আত্মহত্যার বিবরণ শুনে অফিস ছাড়ার আগে সংকেত মুখার্জির মনে পড়ছিল ট্রেনে তার পকেটমারি হওয়ার কথা। এভাবেই সে যখন এর আগেও অফিস কলিগ বাপ্পার বড়দির একমাত্র মেয়ের আত্মহত্যার বিবরণ শুনেছিল, সেদিনও হাত-পা অবশ হয়ে এসেছিল তার। ভিড়-ট্রেনে দাঁড়াবার জায়গা পাওয়া গেলেও, সেই শনিবার নগদ তিনশো আটান্ন টাকা, ট্রেনের মাসিক টিকিট, এটিএম কার্ড ও বেশ কিছু দরকারি কাগজপত্রসহ খোয়া গিয়েছিল তার মানিব্যাগটি। পকেটমার কে হতে পারে? বিছানায় শুয়ে নির্বাক চলচ্চিত্রের কোনো গোয়েন্দার মতো সে চেষ্টা চালিয়েছিল ক্লু বের করার। সাময়িক বিভ্রান্তির খেলায় তার সময় কেটেছিল নিজের সঙ্গে নিজের যুক্তিতর্কে। এবার সরখেলদার ভাইয়ের ছেলের আত্মহত্যা। সংকেত মুখার্জির শরীর অবশ লাগলেও সচেতন থাকার জন্যেই স্টেশনের বাইরে দাঁড়িয়ে সিগ্রেট জ্বালায়। রেলপুলিশের প্রচ্ছন্ন ভয়, মুহূর্তে তার কলার চেপে ধরে। এখানে সিগ্রেট টেনেই পাঁচশো পঞ্চাশ টাকা গচ্ছা দিতে হয়েছিল অনুপমকে। অফিসে অনুপম
কথায় সবাইকে টেক্কা দিলেও সেদিন রেলপুলিশের সামনে কিচ্ছু বলার সাহস দেখাতে পারেনি। সে বের হয়ে আসে স্টেশনের বাঁদিকে খাবারের স্টলগুলোর পাশে। সান্ধ্যকাগজে স্কুলে ঢুকে পাশবিক হত্যালীলা চালানো এক বন্দুকবাজ ছাত্রের বর্ণনা। তার নিচেই অন্য আরেকটি খবরে সে জানতে পারে, মঙ্গলে যেতে চাওয়া এক বাঙালি তরুণের কথা। আঙুলের টুসকিতে সিগ্রেটের ছাই ফেলতে গিয়ে তার চোখ পড়ে সেই খুদে আর মিষ্টি আঙুলগুলোর দিকে, যারা লস্যির দোকানের আবর্জনার ড্রাম থেকে ব্যবহৃত গস্নাসগুলোকে বের করে চাটছিল। সেসব খুদে হাত ও আঙুল ফেলে-দেওয়া শালপাতার বাটিতে লেগে-থাকা তরকারি, গস্নাসের তলানিতে অবশিষ্ট লস্যি চেটেপুটে খাচ্ছিল। কোজাগরির আগে এভাবেই প্রকৃত জ্যোৎস্নার মুখোমুখি হয় সে। অন্তত সে-মুহূর্তে দাঁড়িয়ে সংকেত মুখার্জির তা-ই মনে হয়েছিল। যেভাবে মঙ্গলে যেতে চাওয়া তরুণের কথা পড়তে পড়তে দেবুদার ভাইপোকে মনে পড়ছিল তার। টেলিফোন অফিসে চাকরি করা রাজচন্দ্রপুরের দেবুদার সঙ্গে আলাপ ট্রেনে যাতায়াতের সুবাদে। সকালের অফিসযাত্রী ট্রেন বেলঘরিয়া পার হয়ে দমদমের দিকে ছুটে যাওয়ার সময়, যেসব যাত্রীর মনস্কাম ও ভক্তি ভেসে যায় দক্ষক্ষণেশ্বরের পথে – দেবুদা তাদের অন্যতম।

যদিও অফিসযাত্রী ট্রেনে ভক্তিরসের প্রাধান্য বেশ জনপ্রিয়ও হয়ে উঠেছে। সকালে আটটা দশের নৈহাটি লোকালের প্রথম ভ্যান্ডার বগিতে যেমন সিটে রীতিমতো শ্রীকৃষ্ণ-বিগ্রহ রেখে, ধূপকাঠি জ্বালিয়ে, প্রার্থনাসংগীত গাইতে গাইতে অফিসমুখো হন একদল যাত্রী। খোল-করতালসহ তাদের পুরো গ্রম্নপটা কীর্তন দলের মতো। ট্রেন শেয়ালদহ ঢোকার আগে প্রসাদ হিসেবে সন্দেশ, গুজিয়াও খাওয়ান কামরার বাকি যাত্রীদের। গানের দল অবশ্য আরো কিছু আছে। সকাল দশটা চল্লিশের ব্যারাকপুর লোকাল যেমন। এ-ট্রেন কলেজ ছাত্রছাত্রীদের। এ-ট্রেনে বেশ কয়েকবার যাতায়াতের সুবাদে সংকেতের মনে হয়েছে, কিশোরকুমার সব প্রজন্মেই ছাত্রছাত্রীদের একজনকে না একজনকে তাঁর গলার কিছু গুণাবলি দান করে গেছেন। যেভাবে ট্রেনের লোহার শরীর কিংবা সিটের কাঠে সংগত দিয়ে চলে আসেন আর. ডি বর্মণও। সেই ট্রেনে নিত্যযাত্রীর কামরায় রাজচন্দ্রপুরের দেবুদা বলেছিল, ওর ভাইপো অহমের মঙ্গলে যাওয়ার আবেদন নাকি ইতোমধ্যে গ্রহণ করেছে নাসা। সে যাবে মঙ্গলে।

মঙ্গল কিংবা আত্মহত্যার বর্ণনারা যখন একটু ফিকে হয়ে ট্রেনের রোজকার লড়াইয়ে ঠেলে দিয়েছে তাকে, তখনই ফোনটা এলো। এমন সমবেত গা জোয়ারি সময়ে ফোন ধরা বা করাটা কতটা সমস্যার, তা কে কাকে বোঝাবে! ফোনে বেশ বিপর্যস্ত শোনাচ্ছিল সাধু খাঁর গলা – তোমার পকেটে পাঁচশো বা হাজার টাকার নোট আছে? তাহলে সোজা করে ধরো। দ্যাখো টাকা থেকে গান্ধীজির ছবি ভ্যানিশ।

জাল টাকা? কৌতূহলে প্রশ্ন করে।

আরে বাবা জাল হবে কেন? তুমি দ্যাখোই না।

সাধু খাঁর ফোন দ্রম্নত চাউর হয়ে গিয়েছিল বুঝি!

পরপর ফোন আসে। সংকেত মুখার্জি খেয়াল করে কামরার সব লোকই তার মতো ব্যস্ত ফোনে। কী আশ্চর্য, তার মতো বাকি সকলেই অতি সাবধানে পকেট থেকে একশ, পাঁচশো, হাজার টাকার নোটগুলো মিলিয়ে দেখার চেষ্টায়।

এই যা! কোনো একজনের কথা আর্তনাদের মতো শোনায়।

কী হলো? প্রশ্ন করে কেউ।

পড়ে গেল। মানে ভ্যানিশ। জবাব দেয় লোকটি।

কী? এবার সমবেত প্রশ্ন।

টাকা থেকে গান্ধীজির ছবিটা।

সে কি!

 

রাতে বাড়ি ফেরার পথে সে একটি জটলার ভেতর ঢুকে পড়ে। স্টেশনসংলগ্ন ছোট রাসত্মা দিয়ে তাড়াতাড়ি ফেরার কারণেই এই বিপত্তি। চা-দোকানে স্থানীয় বেকারির দেওয়া অসমান সুজি-বিস্কুটের মতো জটলা, যা একই রকম ভঙ্গুর ও নমনীয়। সাধারণত সব জটলাই এমন মেজাজের হয়। ফাঁক গলে সে নিজেও ঢুকে পড়ে বৃত্তে, যার কেন্দ্রে বসে আছে মাথায় চুল-কামানো এক নারী। ওই মহিলার পাশেই পড়ে আছে সদ্য কামানো চুল। পুনরায় মাথায় বসিয়ে সংকেত মুখার্জি যখন তাকে চিহ্নিত করার চেষ্টায়, তখনই পুলিশভ্যান তুলে নিয়ে গেল তাকে। এবার তার চোখ পড়ে মহিলার পোশাকের সেই বিশেষ বিশেষ অংশে, যা সদ্য ছেঁড়া হয়েছে। পুলিশের সঙ্গে কথা বলছিল নেতাগোছের কেউ। না, এ-মহিলা তার পরিচিত মুখ নয়। সঙ্গে আরো কেউ ছিল কি? সংকেত মুখার্জির নজরে পড়ে কোমরে দড়ি বাঁধা অবস্থায় জনাতিনেক ছেলে ও মেয়েকে। দলটায় একজন বৃদ্ধও রয়েছে।

পুকুরপাড়ে ফকটে পাওয়া হাঁসের ডিমের মতোই গল্পটা চাউর হয়ে গেল। ক্ষেত্রে বসাকের ছানিপড়া চোখের মতো ভোর ততক্ষণে রায় জুয়েলার্সের এলইডি বোর্ড হয়ে উঠেছে। শীতের খেজুররসের স্বাদ পাওয়া যাচ্ছিল ছোটখাটো সব জটলাতেই। একটু নিচু স্বরে আলোচনা শুরু হলেও, বুড়ো বটতলা এখন রীতিমতো সরগরম। রোববারের সকাল মানেই গোটা তলস্নাটের ছেলে, ছোকরা কিংবা বয়স্কের দল ভিড় জমাবে বুড়ো বটতলায়। আর শীতের রোববার হলে তো কথাই নেই। অঞ্চলের বার্ষিক অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা দীর্ঘ ধারাবাহিকের মতো পর্বান্তরে চলতে থাকে প্রতি রোববারেই। আজ অবশ্য বিষয় অন্য। ট্রেনে নাছোড় আমলকী-বিক্রেতার মতো আসরকে তার নিয়ন্ত্রণে নিয়ে ফেলেছেন রামরতন পাল। পাড়া, অফিস কিংবা যাতায়াতের পথ, এমন একদল মানুষকে পাওয়া যাবেই যারা সব বিষয়ে অনর্গল কথা বলতে পারে। সে তার জানা হোক বা অজানা। চশমার ঘোলাটে কাচ লুঙ্গিতে মুছে নিতে নিতে তিনি বলে ওঠেন – শোনো, অন্য পাড়ায় কে কোন কাজে, কজন মহিলা ধরা পড়ল তা নিয়ে আমাদের ভেবে লাভটা কী? তবে এ-ইতিহাস অভিশাপের মতো লেগে আছে আমাদের অঞ্চলে।

কেন? কী ইতিহাস? প্রশ্নকর্তা প্রভাত চ্যাটার্জি বেশ উত্তেজিতও।

আলোচনার রাশ হাতে নিয়ে রামরতন পাল ইতোমধ্যেই সিগ্রেট জ্বালিয়েছেন। সে-ধোঁয়া মৌজ করে ভাসিয়ে দিয়ে তিনি শুরু করেন ফের – ওই যে ঝোপঝাড়ে সরু কড়াইশুঁটির মতো ফল দেয় যে-গাছ, তাকে তোমরা চেনো?

চীনা কড়াইশুঁটি। টিভিতে কুইজ শোতে ফোর্থ রাউন্ডে ফ্রুট জুসার জেতা অর্ণব সরকারের চটজলদি জবাবকে ঘাড় নাড়িয়ে সমর্থন করে কেউ কেউ।

এই এক হয়েছে তোমাদের। যা পারছ তাতেই চায়না জুড়ে দিচ্ছ। বাজারে পার্শে মাছ কিনতে গেলেও দোকানদার বলবে চায়না পারশে। আর ছাতা, চটি, রুটি কিংবা সুচ যাই কিনি না কেন, সবই নাকি চায়নার। এমনকি লোকনাথ বাবার স্ট্যাচু থেকে জয়নগরের মোয়া, সবশালা নাকি চায়না প্রোডাকশন! আমাদের চায়নাপ্রীতি যত বাড়ছে, ওদিকে ওই দেশটাও ততটাই হুড়কো ঢুকিয়ে দিচ্ছে প্রতিদিন। যাই হোক, ওই গাছগুলো হলো নীল গাছ।

নীল গাছ! সেকি, আমরা জানতামই না? আবার উত্তেজিত প্রভাত চ্যাটার্জি।

জানার কথাও নয়। ব্রিটিশ পিরিয়ড হলে বাপ-বাপ করে চিনতাম। কিন্তু একেকটা সময় হয় না, যা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ছিল তা-ই আবর্জনা হয়ে ওঠে।

সেটা আপনে ঠিকই বলছেন পালদা। সম্পর্কের ব্যাপারেও এমনটাই ঘটে। এই তো ছোটবেলা থেকে ভাই ভাই করতাম। বাবা কিছু আনলে ভাইকে না দিয়ে খাবার কথা ভাবতেও পারতাম না। বাবা মারা যাওয়ার পর সেই ভাইয়ের কা-টা তো আপনারা দেখলেন? বাসব বিশ্বাসের এমন মন্তব্যের অবশ্য সমর্থন জুটল না। রামরতন পালও এমন বিষয়কে আমল দিলেন না। সিগ্রেটের আমেজে গল্পের ভেতর ফের ঢুকে পড়লেন তিনি।

ওই নীল গাছগুলো এখানে ঝোপে-জঙ্গলে এখনো এভাবেই টিকে রয়েছে। কারণ একটাই। নীলচাষ হতো এখানে। সেই চাষ যতটা না জরুরি ছিল, তার চেয়েও জরুরি ছিল এসব পাড়াগাঁয়ের মেয়েমানুষ। কুটির সাহেবরা দিনে চাষ বুঝতেন, আর রাতে… সাহেবদের এই ফুর্তির বিরুদ্ধেই রুখে দাঁড়িয়েছিল এখানকার মানুষ। শুনলে অবাক হবে, গোটা দেশে প্রথম নীলকরদের কুঠি পুড়িয়ে দিয়েছিলাম আমরাই। মানে এখানকার বিপস্নবীরা।

কই ইতিহাস বইয়ে এমন কথা পড়িনি তো? প্রভাত চ্যাটার্জি আবার উত্তেজিত।

সব কথা ইতিহাসে লেখা থাকে না। এক ধমকেই তাকে চুপ করিয়ে ফের গল্পের মেজাজে রামরতন পাল।

কিন্তু এখানে অভিশাপটা কোথায়? দমে না গিয়ে পালটা প্রশ্ন করে বসেন প্রভাত চ্যাটার্জি।

রামরতন পাল অবশ্য মোবাইল কানে ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন তখন। বটতলার সবার মতো সংকেত মুখার্জিও দেখে বাকি কথা শেষ না করেই সাইকেলে উঠছেন তিনি।

শালা মধুচক্রের আবার শাপ-অভিশাপ। শুনুন মশাই, চাহিদা বাড়লে, টাকার জোগান না থাকলে, নীতি-নৈতিকতা সব উইদাউট পাসপোর্টে বিদেশ ভ্রমণ করে। বাকি সব ঢপ। দালাল আর ছোটখাটো মাফিয়ারা ছাড়া বাকি সকলেরই দশা চিপসানো মুড়ির মতো। আপনারা জানেন, প্রতিরাতে একেকটা ড্যান্স বারে কত কত টাকা ওড়ায় ওরা? আন্দাজ আছে? সদ্য পার্টি বদল করে ঠকে যাওয়া নেতা বরুণ দাশের বাকি কথা কানে পৌঁছার আগেই ফোন আসে সাধু খাঁর। ফোনে আগের মতোই শঙ্কিত শোনায় সাধু খাঁর গলা – তোমার আশপাশে কোনো দর্জির দোকান আছে?

কেন?

টিভি দ্যাখোনি?

না।

সে কি। সকাল থেকেই তো সব চ্যানেলে ব্রেকিং দেখাচ্ছে।

কী?

আরে দুধ, ফল, মাছে বিষক্রিয়া পর্যন্ত ঠিক ছিল। এবার নাকি এমন একটা ভাইরাস ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে এদেশে যে, প্রতিদিন দুই ইঞ্চি করে কমে যাবে মানুষের শরীর।

সে কি?

হ্যাঁ। এটা নাকি কোনো একটা বিদেশি জঙ্গি গোষ্ঠীর কাজ। তবে নামটা জানা যায়নি। গোটা দেশে রেড অ্যালার্ট জারি করা হয়েছে। আমার শালা স্যান্ডেলটা এখন থেকেই বড় বড় লাগছে।

তুমি মেপেছ?

পাগল। আমার ভয় করছে। বাড়িতে একটা ফিতে টেপ আছে। কিন্তু তুমি তো জানোই, ইঞ্চি আর সেন্টিমিটারের অঙ্কে আমি বরাবরই কাঁচা।

 

সংকেত মুখার্জির মাথায় আসছিল না এসব কী এবং কেন হচ্ছে তার সঙ্গে? টাকা থেকে গান্ধীজির ছবি ভ্যানিশ হওয়া সাময়িক বিভ্রান্তি হিসেবে ধরে নিলেও, মানুষের ছোট হওয়া? শহর জুড়ে ফিল্মস্টার থেকে বিখ্যাত ব্যক্তিত্বদের কাটআউটে সাজানো বাসস্ট্যান্ড, পার্ক। সরকারি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাসস্ট্যান্ডগুলোর দখলদার এখন কুকুর, ভবঘুরে, পাগলরা। কলেজ পালানো ছাত্রছাত্রী কিংবা কোনো সম্ভ্রান্ত কেউ এলে ওরা অবশ্য জায়গা ছেড়ে দেয়। সংকেত মুখার্জি এখানেই দেখেছিল সেই অচেনা, অজানা খ্যাপাটে সেই লোকটাকে, যে তাকে অন্য আতঙ্কের কথা শুনিয়েছিল।

দুপুরের ধর্মতলা চত্বর ম-ম করছে গোশতের গন্ধে। এমন গন্ধ নাকে আসার পর, খিদের চুরচুরানি ভাবটা ফের চাগার দিয়ে ওঠে। ঠিক এ-সময়ই তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে সকালের কাগজে দেখা ছবিটা। অনাহারে চা-শ্রমিকের মৃত মুখকে অবশ্য ভুলেই গেল সে। শহরের সব ক্যামেরা এখন মন্ত্রমুগ্ধের মতো তুলছে নেতা, মন্ত্রী, বিদ্বজ্জনদের গোশত খাওয়ার ছবি। চা-বাগানে এই ক্যামেরা, এই লেন্সই ছিল কি? কী অদ্ভুত এই বিভাজন! সবকিছুতেই সীতার অগ্নিপরীক্ষা প্রমাণসহ রি-মেক হচ্ছে যেন! সঙ্গে রয়েছে চোরাগোপ্তা সন্ধি। না হলে অফিসে কম্পিউটার সাপস্নায়ারের কাছ থেকে টাকা নেওয়া ও ধরা পড়ে যাওয়া বোসদাই ম্যানেজার পদে বহাল থাকেন কীভাবে? সে নিজেও কি এর বাইরে? অফিসে বোসদা ধরা পড়ার পর বাকি সকলের মতো সোচ্চার হয়েছিল সেও। আবার সেই বোসদাই ম্যানেজার হওয়ায় সবার মতোই তো অলিখিত সন্ধি করে নিয়েছে সে।

লোকটাকে সে দেখেছে কি দেখেনি বুঝে ওঠার আগেই লোকটা নিজেই সংলাপ হয়ে দাঁড়িয়েছিল পাশে।

ভাবছেন পালাবেন? উহু আর জায়গা নেই। কোথায়? কেন? কী কারণে সে পালাবে বুঝে ওঠার আগেই লোকটি ফের বলে ওঠে, শরণার্থীদের দেখুন। কী চেয়েছিল ওরা, একটু আকাল, যার নিচে বাঁচবে ওরা। কিংবা ওই লোকটা, যাকে জঙ্গি সন্দেহে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল মাঝরাতে।

কাদের কথা বলছেন?

এই আমার-আপনার বাকি সকলের। ভাবুন তো, কোনো এক রাতে দরজা খুলে যদি দেখেন আপনার ভাই, বোন, বন্ধু কিংবা কোনো প্রতিবেশী আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আপনাকে তাক করে।

আপনি কে? আমাকে এসব আবোল-তাবোল বলছেন কেন?

আমাকে চিনতে পারছেন না?

না।

মুম্বই থেকে নাইজেরিয়া, প্যারিস, সিরিয়া কিংবা ঢাকা – সব জায়গাতেই তো ছিলাম আমি। আমার ছবি ছাপা হয়েছে কাগজে। আপনি কি ফটোগ্রাফার?

না। আপনি আমায় চিনতে পারছেন না। অবশ্য দোষটা আপনার নয়। এই ধরুন না আজ সকালে যে চা-শ্রমিকের মৃতমুখ আপনি কাগজে দেখেছেন, তার মুখ কি আপনার মনে আছে? কোনো হাইওয়ের সামনে দাঁড়ালে আমরা যেমন আলাদা করে মনে রাখতে পারি না কোনো গাড়িকে, এও তেমনি। শুধু ছুটে যাওয়াটা মনে রাখি আমরা। গাড়িগুলোর অবিরাম যাতায়াত। যাতে মানুষ আছে। তাদের সংসার আছে। আর আছে তাদের শখ, আহ্লাদ, স্বপ্ন।

আপনি ঠিক কী বলতে চাইছেন আমাকে?

ওই মনে রাখার বিষয়টা। নজর দেওয়াটা খুব জরুরি। চোখ খোলা রাখা। না হলে দেখুন না ওই যে একটা লোক দিব্যি গাছে চড়ে আত্মহত্যা করল সবার সামনে। গোটা দেশ দেখল। লোকটা মরল কী জন্যে? প্রতিবাদে। তো সেই প্রতিবাদের কথাও তো ভুলে গেলাম আমরা।

হ্যাঁ। কিন্তু এসব কথা হঠাৎ আপনি আমার সঙ্গে… কেন?

 

বুড়ো বটতলায় রামরতন পালকে পাওয়া গেল সিগ্রেট হাতেই। সেদিনের বাকি গল্প শোনার আশায় যারা ভিড় জমিয়েছিল, তাদের নিরাশ করেই রামরতন পাল শুরু করেন ফের – সে-সময় সাহেব-টাহেবরা মিশনারিদের ধরে এনে যাকে পারছে খ্রিষ্টান বানাচ্ছে। পিয়ানো বাজিয়ে সাহেবদের নাচগান ভালোই চলছে। তবে এসবের চেয়ে জনপ্রিয় ছিল সুকুমার চৌধুরীর ওসত্মাদি গান। সে ছিল ওই কায়েতপাড়ার বাসিন্দা।

সে কি, অমন নাম তো শুনিনি ও-পাড়ায়? প্রভাত চ্যাটার্জির প্রশ্নে একটু দম নিয়ে শুরু করেন রামরতন পাল।

শুনবে কি? তাকে তো ধরে নিয়ে গেল পর্তুগিজ দস্যুরা। বাংলায় তখন ছিল তিন দস্যুর রাজ। নীলকর ইংরেজ, পর্তুগিজ দস্যু আর ফরাসি ঔপনিবেশিক। যে যেমন পারছে লুটছে।

পর্তুগিজ দস্যুরা তাকে ধরে নিয়ে গেল মানে?

ওই গান। ব্যাটারা দস্যু হলেও, শিল্প-সংস্কৃতিটা বুঝত। সুকুমার চৌধুরীকে ধরে নিয়ে যাওয়া এ-কারণেই। তখন তো আর অ্যারোপেস্নন ছিল না। জাহাজে টানা দেড় মাসের যাত্রা।

তারপর? প্রভাত চ্যাটার্জি এবার কৌতূহলী।

অন্য ক্রীতদাসদের থেকে সুকুমার চৌধুরীর বিষয়টা ছিল আলাদা। ডেকে শোবার জায়গার পাশে বসে তিনি গান করতেন। আহা, কী মধুর সে-সংগীত। দিনে সময়-সুযোগ পেলে তিনি ডায়েরিও লিখতেন। তবে পর্তুগিজরা তাঁকে দিয়ে খ্রিষ্টীয় ধর্মের প্রচারের কথাও লেখাত। ফলে তা একপ্রকার ধর্মপুস্তকও। বাংলায় ওটাই বোধহয় প্রথম কোনো আত্মজীবনী অথবা উপন্যাস।

বলেন কী? প্রভাত চ্যাটার্জি এবার সত্যিই বিস্মিত।

তো সেই সুকুমার চৌধুরীর গান তো আর রেকর্ড হয়নি।

সে-যুগে তেমন কোনো ব্যবস্থাও ছিল না। তারপর যদি গানের কথাই বলো তো আমাদের…

রামরতন পালের পুরো কথা শোনা হয় না সংকেত মুখার্জির। আবার সাধু খাঁর ফোন। এবারো শঙ্কিত তার গলার আওয়াজ।

তোমার বাড়িতে কেউ পান খায় তো?

কেন বলো তো?

সে কি তুমি শোনোনি?

কী?

সে একটা আজব রোগ। মিঠুন চক্রবর্তীর ওই সিনেমাটা ছিল না।

কোনটা?

আরে … ডিস্কো ড্যান্সার

হ্যাঁ।

ওই সিনেমার নামেই নাম রোগটার।

কী সেটা?

বলব কী ভাই লজ্জার বিষয়। তোমার ওটা, মানে ইয়ে… কী?

যৌনাঙ্গ। পুরুষরা নাকি যৌনাঙ্গ হারাচ্ছে।

ধুর।

সত্যি গো।

তাহলে দেশে এত ধর্ষণ বাড়ে?

মাইরি বলছি। এবারেরটা সত্যি। শুধু চুন লাগালে ওটা ফেরত পাওয়া যায়।

 

মঙ্গলে জলের প্রমাণ সকলেই কাগজে পড়েছে। দেবুদার ভাইপো অহমের চোখেমুখে রোদ্দুরে প্রতিবিম্ব হওয়া আয়নার আলো। রাজচন্দ্রপুরের যে-ঘরটায় বসে সে শুনছে মঙ্গলে যেতে চাওয়া এক তরুণ স্বপ্নের কথা, সে-ঘরের নুন-ওঠা দেয়ালের কোণ থেকে উঁকি মারা সবুজ যেন আলাদিনের প্রদীপের আশ্চর্য আলো হয়ে ছড়িয়েছে এ-মুহূর্তে। নাসার চিঠি থেকে ল্যাপটপে বন্দি খবরের কোলাজ। সংকেত মুখার্জির নজরে পড়ে চায়ের কাপ-হাতে দাঁড়ানো মহিলার মুখ ঢেকে আছে পুকুরপাড়ের প্রাচীন বাবলাগাছের ছায়ায়, যা কখনো-বা রোদ্দুরের আভা পেয়ে চকচক করে উঠছে।

বাড়ি ফেরার সময় সে মুগ্ধদৃষ্টিতে দেখছিল রাতের আকাশ। জ্বলজ্বলে নক্ষত্র ও উল্কার পথে গ্রহান্তরে যাবে অহম। অন্য এক সভ্যতায়। অন্য এক কাউন্টডাউনে। কী হবে সময়ের হিসাব? সেখানে কি ঝুলবে লোকনাথ বাবার ছবিসহ ক্যালেন্ডার, নাকি অন্য আরেক দেবতার ছবি ছাপা হবে তাতে?

ছন্দ কাটল সেই লোকটা। কুকুরের মতো পেছন পেছন আসছিল বুঝি! লোকটা কদিন ধরেই ট্রেন-বাস এমনকি অফিসের গলিতে এভাবেই পিছু নিয়েছে। বাধ্য হয়েই এবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে সে।

লোকটা বলল, তাহলে আপনি এখনো বুঝে উঠতে পারছেন না, যে-কেউ একদিন সন্ত্রাসবাদী হয়ে উঠতে পারে। আপনার ভাই, বন্ধু…

সজোরে ঘুসি চালায় সংকেত মুখার্জি। লোকটার আর্তনাদ ও রক্তাক্ত মুখ তাকে সুযোগ দেয় আরো একটা ঘুসি চালাবার।

 

অফিস থেকে ফেরার পথে সে পেয়ে গেল বিসর্জনে যাওয়া একটা পুজো কমিটিকে। গাড়িতে প্রতিমা আর মিউজিক বক্স। তারই তালে তালে উদ্দাম নাচে ছেলে, মেয়ে, বউরা। নাচের ওই দলে স্টেশন চত্বরে দেখা সেই বাচ্চাগুলোকেও দেখতে পেল। পুজো কমিটিরই কয়েকজন ট্রাফিক পুলিশের মতো যাতায়াত ব্যবস্থা সামলাচ্ছে। এর ভেতরই কেউ কেউ মেতেছে আতশবাজিতে। আবারো মাথায় ফেট্টি-বাঁধা সেই নাচের দলে অনায়াসেই ঢুকে পড়ে সংকেত মুখার্জি। নাচের তালে তালে হাত-পা ছোড়ে – কোমর ঝাঁকায়। এই নাচতে নাচতেই সে দেখতে পায়, রাসত্মার দুপাশে দাঁড়িয়ে থাকা সেই বিস্মিত মুখগুলোকে, আবাসনের বর্ণময় আলো কেটে বের হয়ে আসা সেসব আশ্চর্য মু-। সাধু খাঁকেও কি দেখা গেল ওখানে? নাচতে নাচতেই সে দেখে, বুড়ো বটতলায় আরো এক অসমাপ্ত আঞ্চলিক ইতিহাসের বর্ণনায় রামরতন পাল। তাকে অজস্র প্রশ্নে বিব্রত করছেন প্রভাত চ্যাটার্জি। নাচতে নাচতেই গুটখার রসের মতো হাসির বিদ্রূপে ভরে ওঠে সংকেত মুখার্জির মুখ।