এখন তোমার যেমন দরকার

জিয়া হাশান

সকালেই অ্যাডটা চোখে পড়ে। পত্রিকার দুটো পাতা ওলটাতেই সে বুক চিতিয়ে দাঁড়ায়, কিন্তু লুবনা তাতে থিতু হতে পারে না। তার ওপর নজরের একটু ছোঁয়া দিয়ে এগিয়ে যেতে হয়। মনোযোগের জোয়ারি জলে তারে আর ডোবানো হয় না।

তবে একনজরেই বোঝে ­- অ্যাডটার দাবি-দাওয়া ভিন্ন ধাঁচের, চেহারা-সুরত আলাদা ধরনের। ক্লাসিফায়েড গোত্রের, পাত্র-পাত্রী চাই গোছের কিন্তু তাদের মতো হাতেগোনা শব্দের রোগে ভোগা জীর্ণ-শীর্ণ নয়। বরং মোটাতাজা পরিপাটি দেহাবয়ব। তিন কলাম তিন ইঞ্চি জায়গা জুড়ে তার আসন। হাত-পা ছড়িয়ে রিলাক্স মুডে বসা। আবার তার গা এলিয়ে থাকার জায়গাটাও মোক্ষম – চারের পাতার টপে। তাই পত্রিকার দুটো পাতা ওলটালেই চোখের সামনে হাজির হয়। তখন তারে পাশ কেটে সামনে এগিয়ে যাওয়া অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। তবে লুবনা তারে দু-দন্ড সময় দিতে পারে না। তার চোখ-মুখপানে অপলক তাকাবে, চেহারা-সুরত ভালো করে চিনে নেবে কিংবা দাবি-দাওয়ায় মনোযোগ দেওয়ার সুযোগকে ঘরছাড়া করে এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টরের কড়া নির্দেশ – ‘আপডেট থাকবেন। দেশ-দুনিয়ার খবরে ঝুলি বোঝাই করে রাখবেন।’ তাই লুবনা নিউজের পিছে ছোটে। প্রথম পাতার রাজপথ পাড়ি দিয়ে ভেতরের অলিগলিতেও দৌড়ায়। বিজ্ঞাপনের কানাগলিতে আটকে থাকতে পারে না।

সপ্তাহ দুই আগে আপডেটের ঝুলিটা একটু খালি ছিল। কোনাকাঞ্চিতে ফাঁকফোকর দেখা দেয়। ব্যস, তা গলে এক বিপাক ঢুকে পড়ে। সে-সব ডিরেক্টরের সামনে অপমানে হাবুডুবু খাওয়ায়। আজো সে-ধকল কাটেনি। মাঝে মাঝে তা খচখচ করাত চালায় মনের এ-মাথা ও-মাথায়।

সেদিন ডিরেক্টরদের মান্থলি মিটিং। কনফারেন্স রুমের সেন্ট্রাল টেবিলের চারপাশের সব চেয়ার বোঝাই। কোনো ডিরেক্টর গরহাজির নেই। আপন নিয়মে মিটিং শুরু হলে বিভিন্ন প্রোগ্রামের আপডেট হাজিরা দেয়। ডিরেক্টররা বলে যান। কেউ কেউ ফিউচার প্ল্যানও হাজির করেন। সামনে অ্যাসেসমেন্ট। প্রমোশনের বাসনা কার-ই বা কম। এডুকেশন প্রোগ্রামের পালা আসতেই এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর নড়েচড়ে বসেন। কারণ এ-প্রোগ্রামের আওতায় নন-ফরমাল স্কুল। এ নিয়ে সরকারের সঙ্গে এনজিওর টানাপড়েন এখন বার্নিং ইস্যু। আলোচনার টগবগা তপ্ত বিষয়।

এডুকেশন প্রোগ্রাম লুবনার হাতে। তার আওতায় দেশজুড়ে ছড়ানো কয়েক হাজার নন-ফরমাল স্কুল। সেগুলোর উঠবস, খোলা কিংবা বন্ধ হওয়া সবই হয় লুবনার হাতের ইশারায়। তার স্বাক্ষর করা সার্কুলারের লাইন ধরে। সুতরাং এ নিয়ে কথা বলার হক তার। আর কেউ তা কেড়ে নেয়, আগ বাড়িয়ে কিছু বলে কৃতিত্বের দাবিদার হয়ে ওঠে – এ আশঙ্কায় লুবনা তড়িঘড়ি মুখ খোলে – ‘গভর্নমেন্ট নিজেই নন-ফরমাল স্কুল খুলতে যাচ্ছে। এডুকেশন মিনিস্টার বলেছেন, গেজেট রেডি। কেবল পাবলিশ হওয়া বাকি।’

লুবনার কথা শেষ হওয়ার আগেই মিটিংজুড়ে খুকখুক কাশিরা হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ে। তারা ডিরেক্টরদের মুখে মুখে ভর নেয়। লুবনা তাই সবার ওপর একদফা নজর বোলায় – একি! এ যে মিটিমিটি হাসিতে সয়লাব। মুখ না-খোলা হাসির হুল্লোড়। ওহ, মাই গড! তাহলে ভুল পথে পা পড়েছে? খাদের অতলে পড়ে গেছি? তাই ওপর থেকে সবাই তারে দেখছে। তার খাবি খাওয়া, অবলম্বনের আশায় দেয়াল হাতড়ানো উপভোগ করছে।

এমনিতে সে সবার ছোট। সর্বকনিষ্ঠ ডিরেক্টর বলে অনেকের ঈর্ষার পাত্রী। তারপর সুন্দরী হিসেবে নামডাকও অফিসজুড়ে হাত-পা ছড়ানো। আর সবার ওপর চূড়ায় বাঁধা লোভনীয় তোড়া – এখনো সে সিঙ্গেল। এত উঁচায় উঠেও বিয়ের পিঁড়িতে বসেনি। সুতরাং তার খাদে পড়ায়, খাবি-খাওয়ায় ডাবল-ট্রিপল সহকর্মীরা মিটিমিটি হাসির হুল্লোড়ের মাত্রা ছাড়বেন ক্যানো?

শোনা যায়, গভর্নমেন্টের মুখ ফেরাতে, নন-ফরমাল স্কুল নিয়ে তারে আর আগাতে না দিতে এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টরের হাত আছে। তিনি বহু  দেনদরবারে, টেবিল গরম করে গভর্নমেন্টের দরজায় আগল এঁটে দিছেন। কিন্তু লুবনার কথায় সে-কৃতিত্বের জাহির নেই। বরং তা যেন কালো কাপড়ে ঢাকা পড়ে গেছে। ম্লান হয়ে গেছে অনুপম কীর্তি। তাই এক্সিকিউটি ডিরেক্টর রুষ্ট ভাবরে কণ্ঠ থেকে আলাদা করতে পারেন না। না চাইতেও চলে আসে – ‘লুবনা! আপনি আজকাল নিউজপেপার পড়েন না? আপডেট খবর রাখেন না? এডুকেশন মিনিস্টার ইউটার্ন নিয়েছেন। বলেছেন গভর্নমেন্ট নন-ফরমাল স্কুল খোলার পথে আর হাঁটবে না। এনজিওদের হাতেই থাকবে।’

লুবনার একটা এক্সকিউজ ছিল। তা বললে খাদ থেকে উঠতে না পারলেও একটা অবলম্বন হয়তো জুটত। ডিরেক্টরদের মুখটেপা হাসিতে আগল পড়ত। কারণ লাস্ট উইকের পুরোটাই সে ফিল্ডে ছিল। সিলেট-সুনামগঞ্জের হাওর-বাঁওড়ে ঘুরে বেড়াইছে। নতুন প্রোগ্রাম খোলার তত্ত্ব-তালাশ নিছে। কিন্তু সে-পথে না জানি আর কোন ফাঁদ লুকানো আছে। কেউ মুখের ওপর বলে বসতে পারে – মফস্বলে কি পত্র-পত্রিকা যায় না? রেডিও-টিভি চলে না? তাছাড়া আজকাল মোবাইলের পেটে পেটে কত আপডেট। তাই লুবনা আর কোনো পথে পা দেয় না। এ সুযোগে মিটিংয়ের বাকি সময়টা তার ঘাড়ে বোঝা হয়ে চাপে। সে ভারে সে মুখ নিচু করে রাখে। শেষে এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর তার সুপারভাইজারি স্পিচেও সবক দেন – ‘আপডেট থাকবেন। দেশ-দুনিয়ার খবর রাখবেন। না হলে পিছিয়ে পড়বেন। ব্যাক স্টেপে থেকে যাবেন।’

না, লুবনার ব্যাক স্টেপে থাকা চলবে না। তার চাই ফরওয়ার্ড স্টেপ। আগামীর পথে পা। তা না হলে সকাল নাই সন্ধ্যা নাই, এমনকি রাত-বিরাতেও রিপোর্ট তৈরি, ই-মেইল চালাচালি কেন? লুবনা তাই অ্যাডের কানাগলি রেখে নিউজের রাজপথে হাঁটে। তরতাজা ছটফটা খবরের পিছে ছোটে।

তবে তার এ ছোটাছুটি কেবল রাস্তায় সীমিত। উত্তরা থেকে বনানীর পথটুকুতে সীমাবদ্ধ। কারণ অফিসে যাবার প্রস্ত্ততি সকালটা খেয়ে নেয়। তখন আর কোনো দিকে মুখ ফেরানোর উপায় থাকে না। তাছাড়া বাসায় এখন আর কেউ পত্রিকা পড়ার নেই। তাই গাড়িতে নিয়া ওঠে। পিছনের সিটে গা এলায়ে তার ভাঁজ খোলে। ইংরেজি পত্রিকাটার পাতার পর পাতায় ঘুরে আপডেট নেয়।

চারের পাতার অ্যাডটা পাড়ি দিয়া লুবনা সামনে কদম বাড়ায়। দেশসেরা পত্রিকাটার আরো গভীরে ঢোকে। কেননা কেবল এনজিও-প্রোগ্রাম রিলেটেডের মধ্যে থাকলে চলে না। তার চৌহদ্দির বাইরেও তাকে ঘোরাঘুরি করতে হয়। আপডেট নিতে হয়। কারণ এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টরের মতিগতি বোঝা মুশকিল।  এনজিও-প্রোগ্রামের বাইরেও  ইদানীং তার বেশ হাঁটাহাঁটি। সিভিল সোসাইটির বিবৃতিতে প্রায়ই তার নাম ওঠে। টেলিভিশন টক শোতেও মাঝে মাঝে দেখা যায়। তাই পরীক্ষা নিতে, নিয়মিত আপডেট আছে কিনা তা যাচাইয়ের জন্য মিটিংয়ের মধ্যে সবার সামনে জিজ্ঞেস করে বসতে পারেন – ‘এবার ন্যাশনাল গ্রোথের রেট কত?’ কিংবা ‘পলিটিক্যাল পার্টিগুলোর মধ্যে সমঝোতার সম্ভাবনা কতখানি?’ তখন কিছু বলতে না পারলে, আপডেটের ঝোলা থেকে দু-একটা নমুনা তুলে দেখাতে না পারলে, সেদিনের মতো পড়া না-পারা ছাত্র হয়ে মাথা নিচুতে মিটিং পাড়ি দিতে হবে।

সকালে রাস্তায় জ্যামের উৎপাত থাকে না। তাদের জেঁকে বসার আগেই সাদা টয়োটা উত্তরা থেকে বনানী পাড়ি দেয়। মোড়ে মোড়ে গোটা তিনেক রক্তচক্ষু যা একটু পথ আগলায়। সাতসকালে তাদেরও চোখ রাঙানি থাকে কোমল। সামান্য সময় গাড়ি আগলায়। সব মিলিয়ে বিশ থেকে পঁচিশ মিনিটের কারবার। এতটুকু সময়ের মধ্যে দেশের সর্বাধিক সার্কুলেটেড ইংরেজি দৈনিকটির আগাগোড়া পড়া, এ-মাথা ও-মাথা সায়ের করা অসম্ভব। তাই লুবনাকে হেডিংয়ে আপডেটের তৃষ্ণা নিবারণ করতে হয়। নিউজের গভীরে মুখ বাড়ানো, ভেতরে পা দেওয়ার সুযোগ হয় না।

আবার যেদিন রাজনীতির কোনো চালবাজি কিংবা সড়ক দুর্ঘটনার খপ্পরে পড়ে রাস্তা। সাতসকালে জ্যামরে ডেকে এনে বুক ভরে তোলে। গাড়িতে গাড়িতে সয়লাব হয়ে যায় তার গা-গতর। সেদিন শুরু হয় পাঞ্চটাইমের সঙ্গে যুদ্ধ। লুবনাকে বারবার ঘড়ি দেখতে হয়। আটটা ত্রিশের আগে জ্যামটা ছাড়বে কি? অফিসের হাজিরার পাঞ্চটাইমটা ধরতে পারব তো? নাকি লেট মার্ক খাবো? মাসে তিনদিন হলে আর কথা নাই, পাঞ্চ মেশিন কোনো দয়ামায়া দেখাবে না। সোজা একদিনের স্যালারি হজম করে নেবে। তার চেয়েও বিপজ্জনক, হাজিরা শিটে লাল কালির দাগ। এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টরের চোখে পড়লে আর রক্ষা নাই। ই-মেইলে কৈফিয়ত হাজির করতে হবে। কেননা, তিনি এমনিতে ধোপদুরস্ত ভদ্রলোক, বিনয়-বিনম্রে চোস্ত কিন্তু অফিসের নিয়মকানুনে স্ট্রিক্ট। এতটুকু গাফিলতি তার অসহ্য। তাই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় লুবনা তখন সামনের গাড়ির সারির দিকে বারবার তাকায়। জানালা খুলে উঁকিঝুঁকি মারে। আপডেটের হাতিয়ার, সারাবিশ্বের খবরের তোড়া ইংরেজি পত্রিকাটা তখন পাশের সিটে অযত্ন-অবহেলায় শুয়ে থাকে। তার কোমরের ভাঁজটাও হয়তো খোলা হয় না।

আজ রাস্তা ক্লিয়ার। জ্যাম-জটের আসর নাই। রক্তচক্ষুরাও সদাশয়। দুটো সিগন্যালে তো ব্রেকও কষতে হয় না। তাই প্রায় এক নিঃশ্বাসে গাড়িটা বনানীর সাততলা ভবনের সামনে এসে থামে। অফিসের কেতাদুরস্ত ড্রাইভার দরজা খুলে দাঁড়ায়।

অফিসে লুবনার পত্রিকা পড়ার উপায় নাই। চেয়ারে গা এলায়ে তার সঙ্গে দু-দন্ড সময় কাটানো অসম্ভব। কর্তৃপক্ষ পছন্দ করে না। কেননা, উন্নয়নের মহতী কাজে গাফিলতি তাদের বরদাস্তের বাইরে। তাছাড়া এক হাতে লুবনাকে দু-দুটো প্রোগ্রাম সামলাতে হয়। তাদের মুগুর পিটুনিতে অফিসের টাইমটা চিঁড়েচ্যাপটা হয়ে থাকে। শ্বাস ফেলার সময় পাততাড়ি গুটায়। তারপর পত্রিকা দেখা? তার তো অসম্ভবের ঘরে বসত হয়ে দাঁড়ায়। তাই দেশসেরার তবক অাঁটা দৈনিকটি সারা দুনিয়ার খবরে পেট বোঝাই করে গাড়ির পিছনের সিটে জবুথবু হয়ে শুয়ে থাকে। পুরা অফিসটাইমটা কাটে এভাবে অনাদর-অবহেলায়। বিকালে কোনো কোনো দিন তার দিনমানের রাগ-অভিমান হয়তো কাটে –  ফেরার পথে লুবনা তার ক্লান্ত শিথিল হাতে তোলে, পাতা ওলটায়, নেড়েচেড়ে অনাদর কাটায়।

কিন্তু আজ তার পরম সৌভাগ্য, দু-ভাঁজে কেতাদুরস্ত হয়ে মালকিনের ব্যাগের সাইড পকেটে জায়গা পায়। অহংকারে তাই মাথা উঁচু করে রাখে। বাইরে থেকেও দেখা যায়। কাজের ফাঁকে কিংবা দুপুরের লাঞ্চ টাইমটা লুবনা যদি একটু শর্ট করতে পারে তাহলে একবার চোখ বোলাবে। চারের পাতার অভিনব অ্যাডটারে মনোযোগের জলে ডুবাবে।

অফিসে লুবনা প্রোগ্রেস রিপোর্ট নিয়া বসে। এ-মাসের রিপোর্টটা খুব ইম্পর্ট্যান্ট। কেননা, সামনেই ডোনার মিটিং। রিপোর্টটা জুতসই করতে পারলে, ডোনার স্যাটিসফায়েড হলে, নেক্সট ফাইভ ইয়ার নিশ্চিন্ত। কথা আছে, তারা লংটার্ম অ্যাগ্রিমেন্টে যাবে। কিন্তু একি! নাবিলা কী লিখেছে? দুদিন ধরে এত বুঝিয়ে দিলাম, তারপরও এত গ্যাপ কেন? লুবনা একেক পাতা আগায় আর কপালে তার একেকটা ভাঁজ জন্ম নেয়।

দ্যাখো! সাকসেস স্টোরিগুলার ছিরি! এত করে বললাম একটু ডিটেইলস লিখো। বেনিফিশিয়ারির মুখে দু-চারটা পজিটিভ সেনটেন্স অ্যাড করে দিও। কই! তার নামগন্ধও নাই। দু-চার লাইনে, এক-আধ প্যারার পর ফুলস্টপ দিয়া রেখেছে।

আবার দ্যাখো! স্কুল ইমপ্লিমেন্টেশনের ঘরটার অবস্থা। বলে দিলাম একটু ভারী হয় যেন। দরকার হলে লাস্ট মান্থেরটা যোগ করে দিও। প্রেজেন্টেশনের সময় মুখে মুখে সব বলে দেব। কোনো ঝামেলা হবে না। কিন্তু তা কই? কিছুই অ্যাড করে নাই। এত পুওর  ইমপ্লিমেন্টেশনে  ডোনার কি তুষ্ট হবে? ক্ষেপেও যেতে পারে। নাহ! নাবিলারে দেওয়া ঠিক হয় নাই। মেয়েটা ইংরেজি ভালো লেখে বটে কিন্তু মোরালটা এখনো টনটনে। অরগানাইজেশন তো তা ধুয়ে খাবে না। তার  টিকে থাকতে হবে। নিজেরে রান করতে হবে।

কিন্তু এ-রিপোর্ট দিয়া পাঁচ বছর তো দূরের কথা এক বছরও ডোনার ধরে রাখা যাবে না। তারা একবার হাত গুটায়ে নিলে আর কি মুখ ফেরাবে? শেষে দেখা যাবে প্রজেক্ট বাতিল। তাতে অবশ্য অরগানাইজেশনের কিছু আসে-যায় না। এত দূরে বিস্তৃত তার  শাখা-প্রশাখা, সুগভীরে পোঁতা শিকড়, ফলে দু-একটা প্রজেক্ট হাতছাড়া হলে তার গায়ে অাঁচড়ও লাগবে না। আর সব প্রোগ্রাম দিয়া ঠিকই রান করবে। মাঝখান থেকে বিপদে পড়তে হবে আমাদের। প্রজেক্ট না থাকলে চাকরি থাকে কি করে? শেষে কি অন্য অরগানাইজেশনের দুয়ারে দুয়ারে হাত পাততে হবে?

লুবনা আর নিজেরে ধরে রাখতে পারে না। রিপোর্টটা হাতে নিয়া রুম থেকে বার হয়। নাবিলার কিউবিকের সামনে গিয়া তার মুখের ওপর ছোড়ে – ‘কী লিখেছো অ্যাঁ? এত গ্যাপ। এতদিন ধরে আছ, প্রোগ্রেস রিপোর্ট লেখাও শেখনি?’

নাবিলা কাঁপতে কাঁপতে চেয়ার ছেড়ে দাঁড়ায় – ‘আপা! ফিল্ড থেকে আসা সব ডাটা ইনক্লুড করা হয়েছে।’

– তাতেই খালাস! তাহলে হেড অফিসে তোমরা আছো কী জন্য? এত পয়সা দিয়া তোমাদের পুষে লাভ কী অ্যাঁ?… নাও, এক ঘণ্টার মধ্যে সব অ্যাডজাস্ট করে নিয়া আসো। আজকেই সাবমিট করতে হবে।

লুবনা ফিরে গিয়া ভেতর থেকে তার রুমের দরজা বন্ধ করে দেয়। কিন্তু তাতে ডিপার্টমেন্টের তাওয়ায় লাগা আঁচে ভাটা পড়ে না। বরং তা তপ্তই থাকে – আজ পাগলা ঘোড়া ক্ষেপেছে। নাবিলার ওপর দিয়া গেছে তার প্রাইমারি ঝড়। এখনো তার ঘাড়-গর্দান বাকি। রুমে বসে ফুঁসে-ফুঁসে গতিবেগ বাড়াচ্ছে। কখন যে কার ওপর আছড়ে পড়ে তার ঠিক নাই। তাই সবাই কম্পিউটারে চোখ গেঁথে হাতের মুঠোয় মাউস ধরে অ্যাটেনশন ভঙ্গিতে কাঠ হয়ে থাকে।

কিন্তু সাদেক ভাই স্বাভাবিক। কেননা তারে কখনো ‘লুবনা-ঝড়’ ছোঁয় না। তিনি উঁচা-লম্বা, ডিপার্টমেন্টের পুরানা কর্মী, বয়সেও ভারী। তাই ঝড় হয়তো তার নাগাল পায় না। নিচু পথে আশপাশ দিয়াই কেবল সে বয়। নাবিলা তাই রিপোর্ট কমপ্লিট, গ্যাপে গ্যাপে খুঁটি পুঁতে শক্তপোক্ত করে তার শরণাপন্ন হয় – ‘সাদেকভাই! আপনি আপার কাছে নিয়া যান।’

তিনি রিপোর্টে একনজর সায়ের দেন। এ-মাথা ও-মাথায় চোখ বুলান। শেষ মাথায় গিয়া তার ঢেকুর ওঠে – ‘পারফেক্ট হয়েছে। আর কোনো গ্যাপ নাই। তুমিই যাও, এখন আর বলার কিছু নাই।’

– না, আপনি যান। সকালে আমার ওপর দিয়া একপালা গেছে। এখন আবার শুরু হলে চাকরির গোড়ায় ঘা পড়বে। নড়বড়ে হয়ে যাবে আজই।

শেষে সাদেক ভাই আগান। তারে দেখে লুবনা সত্যিই ফণা নামায়। টেবিলের ওপর ঝুঁকে তার দিকে আগায়। এমনকি নাবিলার চালাকিটা হাতের মুঠোয় পেয়েও কিছু বলে না। কেবল সাদেক ভাইর মুখের পানে একপলক তাকায়।

তিনি ডিপার্টমেন্টের সবচেয়ে পুরনো কর্মী। লুবনা বছর দুই আগে জয়েন করে তারে পায়। দু-কদম আগানো তখন তার পজিশন। কিন্তু ইংরেজির সঙ্গে জুতসই গাঁটছড়া বাঁধা নাই। বোঝেন সবই কিন্তু কিছু লিখতে গেলেই হাত কাঠ, শক্ত হয়ে যায়। বাক্য আর আগায় না। বাঙালি শিক্ষিত মধ্যবিত্তের রোগ আর কি। অপরদিকে লুবনা ‘ও’ লেভেল ‘এ’ লেভেলের সাগর-মহাসাগর সাঁতরে আসা। এনজিওর ইংরেজি, রিপোর্ট লেখা, প্রেজেন্টেশন তৈরি করা তার কাছে খাল-ডোবা পাড়ির মতো জলবৎ তরল।

সে তাই সাদেক ভাইয়ের সাহায্যে আগায়। তিনিও হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন। ফলে রিপোর্ট, ফিউচার প্ল্যান সবকিছু লুবনা আগাম পেয়ে যায়। কাকপক্ষী জানার আগে তার হাতে আসে। গরম গরম থাকতে তা সে বসের কানে তুলে দেয়। পরে সাদেক ভাই যখন তা সাবমিট করেন তখন তা পান্তা কিংবা ত্যাশ্যা। গরম গরম পেলে কে আবার বাসি খায়। আর পান্তা তো ছুঁয়েও দেখে না। তাই সাদেক ভাইয়ের বাসি-পান্তা রিপোর্ট বস মুখে তোলেন না। অনেক সময় না ছুঁয়েই রেখে দেন। শেষে ‘বড় দাঁও’ মেরে অন্য অরগানাইজেশনে পাড়ি জমানোর আগে তিনি লুবনার নামে সুপারিশ করেন – ‘বয়স একটু কম হলেও ও পারবে। স্ট্যামিনা আছে। চালাক-চতুরও বেশ। সবদিক খেয়াল রাখে।’ ফলে দু-বছরের মাথায় লুবনা গোটা তিনেক ধাপ টপকায়। কিউবিকের খোপ ছেড়ে ডিরেক্টরের কাঁচঘেরা দরবার হলে এসে বসে। তবে তার মহানুভবতা – উঠেই মই ফেলে দেওয়ার চিরাচরিত পথে সে হাঁটেনি। সাদেক ভাইরে সযতনে রেখে দিছে। বরং তারে সমীহের চোখে দেখে। মুখের ওপর কখনো কথা বলে না।

অবশ্য প্রজেক্ট-প্রোগ্রামের আগাপাশতলা, ভুরুঙ্গামারী থেকে বরগুনা, জাফলং থেকে ঝালকাঠি সব যেন সাদেক ভাইয়ের হাতের তালুতে আঁকা। তার দিকে একনজর বুলিয়েই বলে দিতে পারেন গফরগাঁও উপজেলার ভুজকোটা গাঁওয়ের স্কুলের ছাত্র ও ছাত্রীর রেশিও কত, শিক্ষকের নামধাম এমনকি বংশ পরিচয়ও। লুবনা এখনো প্রোগ্রামের এত গভীরে মুখ বাড়াতে পারেনি। পারলে তখন না-হয় গোড়ায় কামড় বসানো যাবে। শিকড় কেটে দেবে। আর গাছ যতই জায়গা জুড়ে দাঁড়াক না কেন, শাখা-প্রশাখায় যতই ভারী হোক না কেন, শিকড়বিহীন বাঁচতে পারে না। আপছে উপড়ে পড়ে। তখন না-হয় সাদেক ভাই অন্য কোথাও চাকরি খুঁজে নেবেন। দরকার হলে লুবনা নিজে তার নামে সুপারিশ করবে।

কিন্তু এখন রিপোর্টটা ইম্পর্ট্যান্ট। একবার তার পাতা ওলটায়ে সাদেক ভাইর দিকে আগায়ে দেয় – ‘আপনি দেখে দিছেন, তাহলে আর প্রবলেম থাকার কথা নয়। দিন, আজকেই পাঠায়ে দিন। লাস্ট ডেটের জন্য ওয়েট করার দরকার কী?’

লাঞ্চের আগে লুবনা কাজের ঘন বুননের মাঝে কোনো ফাঁক খুঁজে পায় না। তারা একটার পর একটা নিবিড় হয়ে গেঁথে থাকে। বহুল প্রচারিত ইংলিশ পত্রিকাটা তাই ব্যাগের ঘাড়ে ঝিমায়। তাকে আর নামানো হয় না। কিন্তু এক ঘণ্টার লাঞ্চ টাইমটারে লুবনা কোমর বরাবর কাটে। পাশের রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ সেরে আধঘণ্টার মধ্যেই ফিরে আসে। তখন পত্রিকাটা হাতে নেয়। এবার অলিগলি কিংবা রাজপথে না গিয়া সরাসরি চারের পাতায় চোখ রাখে। কিন্তু অদ্ভুত অ্যাডটায় মনোযোগের খুঁটি গাড়ার আগেই মোবাইল বাজে। রিনার ফোন – ‘শোন, সন্ধ্যার পর আমার বাসায় ঘরোয়া গানের আসর। গুণী শিল্পীরা আসবেন। তুই টাইমলি চলে আসিস।’

ছাত্র অবস্থায়ই রিনার লাইনঘাট রেডি হয়। পাশের পরপরই তাই বিয়ের আসরে বসে। এখন দু-দুটো ছেলেমেয়ের মা। বরের এক্সপোর্ট-ইম্পোর্টের বিজনেস। দিন দিন তাতে জোয়ার। রিনার নিজের কিছু করার দরকার পড়ে না। কেবল ছেলেমেয়ে দুটো সামলায়। আর পরিচিত যারা এখনো একা একা চড়ে বেড়ায়, তাদের কারো সঙ্গে জুতে দেবার, নিজের মতো ঘর-সংসারের গোয়ালে ঢোকানোর তালে থাকে। উৎসাহে টগবগায়। আজকের গানের আসরও হয়তো তার কোনো মহড়া। গেলে কানের কাছে ফিসফিসাবে – ‘দ্যাখ! মাঝের সারির কর্নারে বসা। পছন্দ হয়? বেশ হ্যান্ডসাম। বাবা ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট। বাইরে থেকে পড়াশোনা শেষ করে এখন ফ্যামিলি বিজনেস দেখছে। চল, আলাপ করিয়ে দেই।’

কিন্তু লুবনা ঘাড় বাঁকায় – ‘না রে, তোর গানের আসরে যেতে পারব না। অফিসের পার্টি আছে।

– সন্ধ্যার পরও তোর অফিস? পারিসও বটে তুই।

– হ্যাঁ রে, ডাচ অ্যাম্বাসেডরের ফেয়ারওয়েল। এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর বলে দিয়েছেন অ্যাটেন্ড করতে হবে। ওরা আমাদের বিগেস্ট ডোনার।

– তোর অফিসের বাহাদুরির শেষ নাই। থাক তুই তোর অফিস নিয়া।

রিনা ফোন কেটে দিতেই শুভ্রা একগাদা কাগজপত্র নিয়া ঢোকে। আপার জরুরি সিগনেচার দরকার। লুবনা তড়িঘড়ি পত্রিকাটা গুটায়। এবারে একবারে ব্যাগের পেটের ভেতরে লুকায়। শুভ্রা যেন টের না পায় তার অদ্ভুত অ্যাড দেখা। কেননা, ডিপার্টমেন্টের মেয়েগুলারে তার চেনা আছে। তিল রে তাল বানানোয় ওস্তাদ। টের পেলে কানে কানে ঢোল পিটাবে – ‘জানিস, আপার বিয়া। দেখলাম পাত্র খুঁজছেন।’

লুবনার জীবন-ছকের সবগুলো কোটা ভরা, গলায় গলায় পূর্ণ – দেশে-বিদেশে হাত-পা ছড়ানো অর্গানাইজেশনে চাকরি, সেরা ধাপে থিতু। কংক্রিটে গাঁথা পজিশন, আজীবন স্থায়ীত্বের           নিশ্চয়তা। আবার কোনো কোনোটা তো উপচেপড়া – পৈতৃক গাড়ি-বাড়ি-ফ্ল্যাট, ফের মাসে মাসে মোটা মাইনের চালান। কিন্তু বিয়া? এত বড় কোটাটা শূন্য। মরুভূমির মতো ধুধু। কানাকড়িও নাই তাতে।

রিনারা পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে লাইনঘাট সব ঠিক করে রাখে। পাশের পর নিজ নিজ কোটা ভরে নেয়। কেউ কেউ দু-এক কদম হাঁটাহাঁটির কষ্টটুকুতেও যায়নি। একেবারে ঘরের ভেতরে কাজ সারে। ক্লাসমেটরে বগলদাবা করে। রিনা অবশ্য দু-কদম পা ফেলে তিন বছরের সিনিয়ারের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধে। কিন্তু লুবনা এসবের কোনো পথেই পা দিতে পারেনি। পড়াশোনার এত চাপ। তারপরও ভয়, না জানি কখন ফার্স্টক্লাসটা হাতছাড়া হয়। তাই বলে কেউ যে পিছু নেয়নি। নীলখামে ডাকেনি তা নয়। তবে তারাও পাশের পর যে যার পথে পা দিছে। বিয়া করে ঘর-সংসারে থিতু হয়েছে। কেবল ফরহাদ পিছু ছাড়েনি। সে বরং বারবার গোলাপ নিয়া হাজির হয়েছে। বছরখানেক আগেও একবার জন্মদিনের ছুতায় ডিনারে ডাকে। দামি হোটেলের আলো-আঁধারিতে হাত ধরতে চায়।

এমনিতে ফরহাদের ব্যাপারে কোনো আপত্তির মাথা তোলা নাই। শিক্ষিত সজ্জন। তারপর একটি মোবাইল কোম্পানির মার্কেটিংয়ের কর্ণধার। কিন্তু লুবনার সামনে তখন ডিরেক্টরশিপের সোনালি মুলা। নাকের আগা ছুঁইছুঁই। একটু এদিক-ওদিকে পা পড়লেই ফসকে যাবে। হয়তো শফিক ভাই লুফে নেবেন। তাই লুবনা কোনো রিস্কে যেতে চায়নি। ফরহাদকে নিরাশ হয়ে ফিরে যেতে হয়। এত দিনে সেও নিশ্চয়ই নিজের পথ বেছে নিছে। ঘর-সংসারে পা দিছে।

আর লুবনা? তার কী? কেবল ঊর্ধ্বমুখী মুখ। সামনে ঠাস বুনুনীতে গাঁথা ধাপ। একটার গা ঘেঁষে আরেকটা। মাঝে ফুরসতের জায়গা কোথায়? আশেপাশে চোখ মেলার চান্স কই? তবে এখন উঁচা ধাপে পা। কংক্রিটে গাঁথা পজিশন। সুতরাং ফুরসত যেন গা ঘেঁষে দাঁড়ানো। ইচ্ছেরা জড়ো হলে তারে জাপটে ধরা যায়। বুঝ দেওয়া যায় কোটাটারে। কিন্তু ই-মেইলরে বুঝ দিতে দিতেই লুবনার অফিস টাইম পার। তারপরও আরো দুটোর রিপ্লাই দিয়া তবে সে উঠতে পারে।

ওদের আর্লি ডিনারের অভ্যেস। তাই সন্ধ্যার পরপরই পার্টি শুরু হয়। লুবনা অফিস থেকে সরাসরি গিয়া অ্যাটেন্ড করে। এসব পার্টিতে কাপলের দাওয়াত থাকে। মিস্টার অ্যান্ড মিসেস। সবাই তাই যুগল হয়ে আসে। হাত ধরাধরিতে ঢোকে। পাশাপাশি বসে। লুবনাকে একা দেখে এম্বাসির ফার্স্ট সেক্রেটারি আগায়। পিছন থেকে কোমরে হাত নামাতে যায়। লুবনা শীতের সাপের মতো কুন্ডলী পাকায়। সলাজ বধূর মতো শাড়ি টানাটুনি করে। তবে যার ওয়েলফেয়ার সে-ই অ্যাম্বাসাডরের তাড়া। বিদায়বেলায় কত জায়গায় যে তার হাত মেলাতে হবে। তাই সাড়ে ৮টার মধ্যে সব ক্লোজ। লুবনার বাসায় ফিরতে ফিরতে ৯টা পার।

বাসা একদম ফাঁকা। গড়ের মাঠ। বাবা-মা অবশ্য ভরার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। পাশের পর তাঁরা লুবনার পিছে লাগেন। বয়স হয়ে গেছে। যে-কোনো সময় পরপারের ডাক আসবে। তার আগে মেয়ের একটা হিল্লে করে দিতে চান। নিজে তো কিছুই করল না। এখন দেখেশুনে ভালো একটা ছেলের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে দিতে পারলে তাঁদের মুক্তি। নিশ্চিন্তে ওপারে যেতে পারেন। কিন্তু ‘নতুন চাকরি, একটু পাকাপোক্ত হোক, আর কটা দিন ওয়েট করো’ কিংবা ‘সামনে একটা বড় প্রমোশন, এখন কোনো ঝামেলায় জড়ালে হাতছাড়া হয়ে যাবে। আর দুটো বছর মা’ – এরকম একটার পর একটা দেয়াল তোলে লুবনা। আর সে লৌহপ্রাচীর বাবা-মা  আত্মীয়-স্বজন মিলেও ভাঙতে পারেনি। কখনো একটু টালও খায়নি তাতে। শেষে হাল ছেড়ে দিয়ে বাবা-মা আমেরিকায় বড় ছেলের কাছে পাড়ি দিছেন। আর কখনো দেশমুখো হবেন বলে মনে হয় না। লুবনা তাই পৈতৃক সূত্রে পাওয়া এত বড় ফ্ল্যাটে একা। দু-একটা কথা বলারও কেউ নাই। আছিয়ার মা সার্বক্ষণিক আছেন বটে তবে তার সঙ্গে বাজার-সওদা, রান্না-বাড়ার বাইরে আর কোনো কথা আগানোর দরকার পড়ে না। বাসায় এসেও লুবনা তাই ল্যাপটপ খুলে বসে। ইন্টারনেট, ই-মেইল, অফিসের রিপোর্ট বুকে আগলে থাকে।

আজ অবশ্য সে-পথে পা দেয় না। সোফায় গা এলায়ে ইংরেজি দৈনিকটা খুলে বসে। অ্যাডটার ওপর মনোযোগ জড়ো করে। সত্যিই অন্য রকম। অদ্ভুতও বলা যায়। পাতাজুড়ে পাত্রপাত্রী চাই, ফ্ল্যাট বিক্রি, বাড়ি ভাড়ার হাজারো ক্লাসিফায়েডের ঘন জঙ্গল। তাদের থেকে গা বাঁচায়ে আলাদা বক্সে বসা। তার ভেতর পেটমোটা অক্ষরে লেখা ‘ওয়ান্ট টু বি অ্যা হাউস হাসব্যান্ড’। বাংলা করলে দাঁড়ায়  গৃহস্বামী হতে চাই। তার নিচে একটা মোবাইল নম্বর। আর কোনো নামধাম, ঠায়-ঠিকানার ডালপালা, লতাগুল্মের বালাই নাই। কাটা এক শিরা গাছের মতো শোয়ানো।

আবার দ্যাখো অ্যাডের ডিমান্ডটা? লুবনা আরো একবার ইংরেজি বাক্যের ওপর চোখ বুলায়। এতদিন দেখে আসছি পাত্রী চাই, সুন্দরী, স্বাস্থ্যবতী আরো কত কিছু। আর মাম্মি-আন্টিদের পেশা লিখেছি হাউসওয়াইফ, গৃহবধূ। আর এ দ্যাখো, হাউস হ্যাসবেন্ড, গৃহস্বামী হতে চায়। মানে কী? ঘরদোর দেখবে, শপিংয়ে যাবে, বউয়ের সঙ্গে ঘুরে বেড়াবে? বাহ! সুন্দর সুব্যবস্থা। লুবনা চমৎকৃত। ওর সঙ্গে খাপে খাপে মিল। তাহলে পার্টিতে কেউ কোমরে হাত দিতে চাইবে না। মিটিং-সিটিংয়ে কারো মুখের লালা ঝরবে না। চোখে চাটবে না। আবার বাসায় ফিরে দুটো কথাও বলা যাবে। তাহলে কি ফোন দেব? জিজ্ঞেস করব – হ্যালো! আপনার মতলবটা কী?

নাহ! থাক। বরং রিনাকে বলি। ওর ঘাড়ে পা দিয়া আগাই। বলি তুই ফোন কর। দ্যাখ কী চায়। ও তো উৎসাহে হাত-পা ছুড়বে। কিন্তু সে যে এখন গানের মজমায়। গুণী শিল্পীদের আসর। রাত গহিনে না গেলে কি ও ফ্রি হবে?

বাবা-মা নাই। এখন যা করার নিজেরই করতে হবে। লুবনা  টি-টেবিল থেকে মোবাইল নিয়া অ্যাডের এগারো ডিজিট তোলে। তবে কল বাটনে আঙুল ছোঁয়ার আগে একটু থিতু হয়।

ফ্রডও তো হতে পারে। মেয়ে ধরার নতুন ধরনের কোনো ফাঁদ। কল দিলেই নম্বরটা ক্যাপচার করে রাখবে। তারপর নতুন কোনো জাল ফেলে একটু একটু করে টানবে। তার মতো ভারী, সচেতনতায় ভরপুর ঘড়া হয়তো তুলতে পারবে না। কিন্তু হয়রানি? যখন-তখন ফোন। হুমকি-ধমকি, ছলচাতুরীর তো রেহাই দেবে না।

তবে স্বীকার করতেই হবে অ্যাডটা দারুণ স্মার্ট। একবারে মেদহীন তন্বী তরুণী। আবার খাপ খোলা তলোয়ারের মতো ধার। সকালের একনজরের ঘায়ে  রক্তক্ষরণ শুরু। দিনমানের দীর্ঘ পথ পাড়ির পর এখন এত রাতেও সে বহমান। তার মুখ আগলাতেই যেন লুবনা কল বাটনে আঙুল ছোঁয়ায়। সঙ্গে সঙ্গে অপর প্রান্ত কথা বলে – হ্যালো! সারাদিন তোমার ফোনের অপেক্ষাতেই ছিলাম।

– ফরহাদ তুমি! তুমি এ্যাই অ্যাড দিছো?

– এখন তোমার যেমন দরকার। হিসাব করে রেখেছি, নেক্সট উইকে একটা ভালো লগ্ন আছে…।