এলোমেলো হাওয়ায় উড়ে আসা ফুল

পিয়াস মজিদ
এলোমেলো হাওয়া
সনৎকুমার সাহা

শুদ্ধস্বর
ফেব্রুয়ারি ২০১৩

৪৫০ টাকা

সনৎকুমার সাহা গদ্য অঙ্কন করেন; অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর যেভাবে ছবি লিখতেন। এই সিদ্ধান্তে আমরা নিঃসংশয়
অন্তত এবার বইমেলায় প্রকাশিত তাঁর এলোমেলো হাওয়া  পাঠান্তে। ষোলোটি ভাবনা ও ভাষাদীপ্ত প্রবন্ধপুষ্পে গেঁথে তোলা ফুল যেন আলোচ্য গ্রন্থ। প্রারম্ভ যদি ‘স্বপ্ন’ ও ‘বনলতা সেন’ দিয়ে, পরিশেষ তবে ‘ভাষা-সাহিত্যের রাজ্যপাট : ভাঙনের শব্দ শুনি’তে। তাৎপর্য আছে বইকি! স্বপ্ন থেকে ভাঙন অবধি এক দুস্তর পরিক্রমাই তো তিনি বয়ন করে তুলেছেন মেধাবী তন্তুতে। কত সিন্ধু, কত দিগন্তমন্থন তাঁর! জীবনানন্দ থেকে হাসান আজিজুল হক, কুন্ডেরা থেকে মাহমুদুল হক, মেঘদূত-মহাভারত থেকে কমনওয়েলথ সাহিত্য, বিষ্ণু দে থেকে মোহাম্মদ রফিক, জুলিয়াস ফুচিক থেকে নাজিম মাহমুদ ইত্যাকার কতবিধ ধ্র“বপদ যে বেঁধেছেন সনৎকুমার সাহা তাঁর অপ্রতিম অনুভবে-অনুধ্যানে; ভাবলে অবাক হতে হয়। এই তারল্যপ্রধান গদ্যের রাজত্বকালে এ নেহায়েত ব্যতিক্রমী গদ্য নয়; সাহিত্যভোক্তার পাতে এমন মহার্ঘ্য ব্যঞ্জনপ্রাপ্তি এখন সত্যিই ভাগ্যের ব্যাপার। ভূমিকায় বলেছেন লেখক –
‘লেখাগুলো বিভিন্ন সময়ের। বিষয় যখন যেমন মাথায় এসেছে তেমন। কখনো কখনো বইয়ের তাগিদ যে কাজ করেনি, তা নয়। যা বলবার, তা হলো, ধারাবাহিক কোনো যোগসূত্র এদের নেই। এলোমেলো হাওয়ায় উড়তে উড়তে এক জায়গায় জড়ো হওয়া না, ‘জড়ো করা’ – বলাটাই ঠিক। ওড়াটা অবশ্য এলোমেলোই।’
আমরা বলি আপাত-বিক্ষিপ্ততার আড়ালে এই বইয়ের মূল বৈচিত্র্য নিহিত। ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ে রচিত সারগর্ভ ব্যাখ্যান মিলেমিশে তৈরি করে এক অখণ্ড বোধিভাষ্য, যার কাছে বিধিবদ্ধ ধারাবাহিকতা ম্লান, অনুজ্জ্বল।
স্বতন্ত্র চিন্তাকণা সমবায়ে যে-সৌধের নির্মাণ ঘটে পাঠকের মননে, তা যুগপৎ বহুতলস্পর্শী ও ঊর্ধ্বাকাশী। ধ্র“পদী থেকে সমকালীন সাহিত্য পর্যন্ত এলোমেলো হাওয়ার বিস্তার। ধ্র“পদী বলতে মেঘদূত ও মহাভারত বিষয়ে তাঁর পর্যালোচনা দুটোকে গণ্য করতে পারি। আমরা। বুদ্ধদেব বসুর অনুবাদকৃত মেঘদূতের দিকে তাকাতে গিয়ে সনৎকুমার সাহার সর্বতোগামী দৃষ্টির রেখা টের পাই। বলেছেন তিনি
‘… বুদ্ধদেব অনুবাদে আধুনিক বাংলা কবিতার বৃত্তে ‘মেঘদূতে’র রূপান্তর ঘটিয়েছেন। যদিও বজায় রেখেছেন শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মন্দাক্রান্তা ছন্দের গতি। অসম্ভবকে সম্ভব করার মতো এ এক উদ্যোগ।’ (পৃ ৬৫)
আবার এমন উপলব্ধির প্রকাশেও তিনি নির্দ্বিধ –
‘মেঘদূতে’ তপ্ত প্রাণের আকুলতা, যা সমাসে, ধ্বনিব্যঞ্জনায় বা শব্দের ক‚টার্থে ও ইঙ্গিতময়তায় রূপ পেতে উন্মুখ, তা অনুবাদে কখনো কখনো অনায়ত্ত থেকে যায়। একটা কারণ বোধহয় ঐ প্রকরণসমূহে আধুনিক বাংলা কবিতার এবং বুদ্ধদেব বসুর অবশ্যই – অনাস্থা। তাতে কিন্তু ‘মেঘদূতে’র মেজাজ কোথাও কোথাও হারিয়ে যায়।’ (পৃ ৬৬)
এমন সুস্থিত বিবেচনার স্বাক্ষর এই বইয়ে আদ্যন্ত মুদ্রিত। সৎ সাহিত্যবিচারের যা কুললক্ষণ।
এক গহন কবিসত্তার রূপও বিপুল বর্ণচ্ছটায় প্রতিভাসিত সনৎ সাহার গদ্যের মুকুরে –
‘মহাভারতের কথা’ বুদ্ধদেব বসুর হৈমন্তিক ফসল। শীতের অভিজ্ঞতা তাঁর হয়নি। বার্ধক্যকে তিনি ছুঁতে পারেননি। তার আগেই তাঁর আকস্মিক জীবনাবসান। প্রৌঢ়ত্বের প্রগাঢ়তা ও প্রজ্ঞা মিলিয়ে তাঁর শেষ বেলার যে কর্ষণ, তারই এক অসামান্য পরিণাম ‘মহাভারতের কথা’।’
জীবনানন্দ দাশকে প্রাবন্ধিক নতুন চিন্তার নিকষে যাচাই করে নেন। রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল আসে সঙ্গে সঙ্গে। এসে সংহত-পূর্ণায়ত করে জীবনানন্দ বিবেচনা। জীবনানন্দের বিরুদ্ধে পূর্বজ কবির অনুকরণের অন্যায় অভিযোগ খণ্ডনে প্রবৃত হন সনৎকুমার সাহা; খণ্ডন বাক্যমালায় বিধৃত যেন নবতর বহু ভাবনার বীজ। প্রসঙ্গে-অনুষঙ্গে ইয়েটস আসেন, ইয়েটসের সমান্তরালে আসেন কিটস। রবীন্দ্রনাথ আসেন, তাঁর সমান্তরালে আসেন ত্রিশের কবিকুল। তুলনা-প্রতিতুলনা নানাগিরি আর সমতল পরিব্রাজন শেষে পৌঁছে সমুদ্রগর্ভ নীরবিন্দুতে –
‘কালের অস্থিরতার চৈতন্যশাসিত প্রতিনিধি হয়ে ওঠে এরা; যদিও ‘স্বপ্নের’ জগৎকে যে পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করে, তা-ও নয়। তবে কবিতা যখন পাপড়ি মেলে, তখন তার দলগুলো আলাদা আলাদা আমরা দেখি না। সব মিলে তার ঐক্য ও একত্ব দুই-ই আমরা দেখি। সেই দেখাটাই পুরো দেখা। এবং তেমন দেখতে পারাতেই কবিতার সার্থকতা। ‘বনলতা সেন’ এমন সার্থকতার সর্বত্তোম নিদর্শন। ‘স্বপ্ন’ চিহ্ন তার শরীরে আঁকা থাকলেও তাতে এর হেরফের হয় না।’ (পৃ ২৮-২৯)
তিন কথাকার হাসান আজিজুল হক, মাহমুদুল হক ও জাহানারা নওশিন বিষয়ে পাঠকের সঙ্গে আলাপ করেন প্রাবন্ধিক। আলাপ বলছি এজন্য যে, তাঁর কথাসাহিত্য পর্যালোচনাও দারুণ আখ্যানময়। ফলে পাঠকের সুযোগ হয় গল্প কিংবা উপন্যাসপাঠ ও আবিষ্কারের আনন্দ। হাসান আজিজুল হকের গৃহ নিয়ে একটি লেখা ‘বিহাসে এখন হাসান আজিজুল হক’। এই লেখা হাসানের বাড়ির সদর-খিড়কি, বারান্দা-উঠোনের ইতিউতি ভিড় করায় বঙ্গীয় কথাসাহিত্যের বৃহৎ-বিস্তারী ভুবন। উদ্ধৃতির লোভ সংবরণ অসাধ্য –
‘বিহাসে তাঁর বাড়ির নাম ‘উজান’। ‘আগুনপাখি’ রচনা করেন তিনি এখানে। বিশ্ববিধানে কিছুই হাতে জমা পড়ে না। তার বিপরীতে যে-পথচলা, তাতেই পাওয়া-না-পাওয়ায় মিশে জীবনের নৈর্ব্যক্তিক  সঞ্চয় একটু একটু করে গড়ে উঠতে থাকে। মানুষের মহিমা এই খানেই। এইটুকু। এমনকি কিছুই যদি না জোটে দিনের পর দিন, তবুও। আগুনপাখি পাখা মেলে’ (পৃ ১৩৩)
‘মাহমুদুল হক : আমি একা হতেছি আলাদা’ শিরোনামে খুঁড়ে আনেন অনুর পাঠশালা, খেলাঘর, জীবন আমার বোন কিংবা নিরাপদ তন্দ্রার  লেখককে। ব্যক্তি মাহমুদুল আর শিল্পী মাহমুদুলের মধ্যবর্তী কোনো সেতু তিনি তৈরি করেন না। বরং দেখে ওঠেন ব্যক্তির সততা কী করে অন্বিত হয় শিল্পের অঙ্গীকারের সঙ্গে। ফলে তার উপলব্ধি যে, ফাঁকির কারবারে নিদারুণ নিরুৎসাহ মাহমুদুল হককে জীবনের এক পর্যায়ে কলমহীন করে তুলেছে। কারণ তাঁর কলমটিতে কালির আধারে পুরিত ছিল আত্মদীপের আলো। তাই থেমে যান মাহমুদুল হক। সনৎ সাহা  মনে করিয়ে দেন এই জরুরি বার্তা – দলছুট নক্ষত্রের মতন বাংলা সাহিত্যের আকাশে মাহমুদুল হক অনন্য নক্ষত্রের আভা ছড়িয়ে যাবেন তাঁর স্বল্পজ সৃষ্টির বহুপ্রজ ব্যঞ্জনায়।
প্রয়াত সংস্কৃতিগুণী নাজিম মাহমুদ সম্পর্কে প্রস্তাবনা অংশে লিখেছেন, ‘নাজিম মাহমুদের লেখাদুটো চোখ বুলিয়ে আজকের পাঠকেরা তাঁর বইগুলো, বিশেষ করে যখন ক্রীতদাস পড়ায় যদি আগ্রহী হন, এবং মানবভাগ্যের অনন্ত সম্ভাবনার সঙ্গে সীমাহীন লাঞ্ছনার কথাও ভাবেন, তবে তাতে আমি অনেক সান্ত্বনা পাবো।’
অতঃপর নাজিম মাহমুদ অপরিচয়ের আবরণ ভেদ করে সমুজ্জ্বল হয়ে ওঠেন তাঁর একাত্তর, তাঁর সংস্কৃতিযজ্ঞ – গান ও নাটক, সাহিত্যশস্য – কবিতা ও স্মৃতিচর্যা এবং অতিঅবশ্যই স্ফ‚র্তিময় প্রাণসত্তা নিয়ে যা আমাদের নির্জীব পরিপার্শ্বকে সতত ব্যঙ্গ করে। ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি হিসেবে সনৎকুমার সাহা তাঁকে পর্যবেক্ষণ করেন আর তাকে আঁকেন নৈর্ব্যক্তিক শিল্পীর তুলিতে। একজন নাজিম মাহমুদের সূত্রে তাই আমাদের ঘটে দেশ, সময় ও সমাজ-দর্শন। আমরা প্রকৃতই আগ্রহ বোধ করি নাজিম মাহমুদের পুস্তক থেকে তাঁর ভাবনা ও কর্মবিশ্বে অবলোকনে, যার কেন্দ্রভাবে আছে নির্বিশেষ মানব।
নাজিম মাহমুদের লেখার মূল্যাঙ্কন করতে গিয়ে প্রাবন্ধিক প্রসঙ্গক্রমে শম্ভু মিত্র ও সত্যজিৎ রায়ের সাহিত্যকৃতির যে-পরিচয় তুলে ধরেন, তা আমাদের ভাবিত করে। কলাবিদ্যার একটি ক্ষেত্রে খ্যাতি অর্জিত হলে তার লেখকসত্তাকে গৌণজ্ঞান করা কতটুকু সংগত এ-প্রশ্ন ছুড়ে দেন তিনি সখেদে –
‘বাংলা ভাষাতেই গত পঞ্চাশ বছরের সাহিত্যকীর্তির তালিকা থেকে শম্ভু মিত্রের ‘চাঁদবণিকের পালা’কে বাদ দেওয়াকে মনে করি এক অমার্জনীয় ত্র“টি। কিন্তু বাংলা সাহিত্যের কারবারিদের কাছে দেখি শম্ভু মিত্র থেকে যান মূলস্রোতের বাইরে। তাঁর নামটাও অনেকের কাছে অপরিচিত। একইভাবে আমরা খেয়াল করি না, সত্যজিৎ রায় আধুনিক বাংলা শ্রেষ্ঠ গদ্যলেখকদের একজন’। (পৃ ১৭৪)
ত্রিশের বিষ্ণু দে আর ষাটের মোহাম্মদ রফিককে বিশ্লেষণ-সংশ্লেষণ করে দেখান সনৎকুমার সাহা; কোন কোন আপন বৈশিষ্ট্যে অপরাপর কবির মাঝে তাদের বিশিষ্টতা। বিশ্বগত চেতনালোকের অধিকারী দুই কবির মর্মমূলে যে শাশ্বত বাংলার বসবাস – তা-ই প্রবন্ধকারের প্রধান আগ্রহের বিষয়। বিষ্ণু দে-কে বিশেষত পুরাণের পটে আর মোহাম্মদ রফিককে তাঁর দগ্ধ সমকালের পরিপ্রেক্ষিতে স্থাপন করে নিরীক্ষণ করেন সনৎকুমার সাহা। জ্যোৎস্নাবাস্তবের ভেতর ঘাঁটি গেঁড়ে থাকা তিমির যেভাবে জাজ্ব¡ল্য হয়, এই দুই কবির করতলে তাকে উদ্ঘাটন করে ওঠেন নিজস্ব আর্শিতে। বিষ্ণু দে-র বৈশিষ্ট্য শনাক্ত করতে গিয়ে লিখেন – ‘… চিন্তাপ্রবাহের ক্রম-বিপর্যয়, প্রোটন ঘিরে ইলেকট্রনের নাচানাচির মতো ছন্দ ও গতিসুষমায় রহস্যময়তার সৃষ্টি, এগুলো থেকেই যায়।’ (পৃ ১০০)
মোহাম্মদ রফিকের সাম্প্রতিক কবিতার কুল-ঠিকুজির উদ্ধার ঘটে এভাবে – ‘… অবাক হই কবির বিমূর্ত চিন্তার রূপনির্মাণ কুশলতায়, তাঁর নিস্পৃহ উচ্চারণে। আবেগের বিন্দুমাত্র স্পর্শ নেই, বিজ্ঞানের মৌলিক কোনো তত্ত্বের মতো নিরঞ্জন, অথচ অনুভবের ঘনত্বকে ধরে রাখে ঠিক। মানবভাগ্যের নিরুপায় বিড়ম্বনার নিরশ্র“ ভাষ্যের সামনে বিচলিত আমরা হতবিহ্বল দাঁড়াই।’ (পৃ ১৬৩)
জুলিয়াস ফুচিক যখন চলে আসেন মিলান কুন্ডেরার সঙ্গে সম-আলোচনায় তখন তা নেহায়েত দুই মহান ব্যক্তিত্বের কৃতির পর্যালোচনা থাকে না। বরং ইতিহাসের ক্রমউত্থান থেকে ক্রমবিপর্যয়কে ব্যক্তির হাত ধরে যেন প্রত্যক্ষ করে ওঠি আমরা। জুলিয়াস ফুচিকের নোট্স ফ্রম দি গ্যালোজকে মিলিয়ে পাঠ করেন মিলান কুন্ডেরার দি আনবেয়ারেবল লাইটনেস অফ বিংয়ের সঙ্গে। সূর্যোদয়ের গান কেন দূর করতে পারে না অস্তিত্বের অসহনীয় লঘুভারকে তার ব্যাখ্যা খোঁজেন; ফুচিক ও কুণ্ডেরার সূত্রে মানবেতিহাসের অলিতে-গলিতে। বৈষম্যতান্ত্রিক সমাজের অবসান চেয়ে মানুষ যে সামষ্টিক সূর্যোদয়ের সংগীত রচনা করেছিল, তাতে ব্যক্তিমানবের অস্তিত্ব উন হয়ে পড়ায় যে-প্রলয়কাণ্ড সংঘটিত হয়, গত শতকের সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ায় তাকে কেবল রাজনৈতিক ইতিহাস হিসেবে না দেখে সনৎ চলে গেছেন মানুষের মৌল সত্তার কাছে। মানববাদী বলেই তাঁর অটল বিশ্বাস ‘সমাজবাস্তবতা একদিকে টলে পড়লে মানুষের আকাক্সক্ষা জোর পায় অন্যদিকে। দুটোর কোনোটিই একমাত্র সত্য নয়, আবার কোনোটি মিথ্যাও নয়। আমাদের তাই দুটোর প্রতিই শ্রদ্ধাশীল হতে হয়।’ (পৃ ১৯৫)
উপর্যুক্ত লেখায় শুধু নয়, এলোমেলো হাওয়ার পুরো প্রাঙ্গণজুড়েই রয়েছে সাহিত্যের সূত্রে সমাজ-সংস্কৃতি-রাজনীতি-অর্থনীতির সুবিপুল সম্ভোগ। ইতিহাসের অজস্র প্রান্ত এসে গঠন করে লেখকের ভাবনাকেন্দ্র। তাই দেখি মহাভারতের সৌতি থেকে শুরু করে ধর্মপুরুষ ইসমাইলের কাহিনিরও সমান উপস্থিতি।
এই বইয়ের দুটো ভিন্নতাবাহী রচনা ‘কমনওয়েলথ সাহিত্যে নতুন বসতি’ এবং ‘ভাষা-সাহিত্যের রাজ্যপাট : ভাঙনের শব্দ শুনি’। আমাদের মূলধারার সাহিত্যের সমান্তরালে বহির্দেশে ভিনভাষায় বাঙালি বংশোদ্ভূত লেখকদের হাতে যে ডায়াসপোরার জন্ম হচ্ছে তার সূত্র শনাক্ত করেছেন তিনি। আদিব খান, মনিকা আলী, সীমা নুসরত আমীন, তাহমিমা আনাম প্রমুখের সাহিত্যকর্ম তদন্ত করে লেখক আশা পোষণ করেন যে, ইংরেজি সাহিত্যের প্রথাগত ঐতিহ্যের বাইরে গিয়ে ইংরেজি ভাষায় যেমন ওলে সোয়িঙ্কা, চিনুয়া আচেবে, নাদিন গর্ডিমার, ওয়ালকট, আর কে নারায়ণ, অরুন্ধতী রায় কিংবা অমিতাভ ঘোষের বিকাশ ঘটেছে, ঠিক তেমনি বাংলাদেশের ইংরেজিভাষী লেখকরাও আপন যোগ্যতায় বিস্তৃত করে চলবেন কমনওয়েলথ সাহিত্যের সীমানা। শেষ বিচারে তা বিশ্বসাহিত্যকেই করবে ঋদ্ধিমান কারণ স্বাতন্ত্র্যমণ্ডিত বহুস্বরেই তো ধরা আছে বিশ্বমানবের বাণী।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোকলোর বিভাগের কলা অনুষদ থেকে সমাজবিজ্ঞান অনুষদে যাত্রাতে ভাঙনের শব্দ শুনেন সনৎকুমার সাহা। এই নেতির ইঙ্গিত কেবল বিভাগের অনুষদ-বদলের কারণে নয়, বরং শিক্ষাব্যবস্থা এবং সামগ্রিকভাবে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির অগস্ত্যযাত্রাই যে এর গূঢ় কারণ তা নানা পরম্পরায় উদ্ঘাটন করে দেখান –
‘বোঝা যায়, বাণিজ্য-বিপণন-বিদ্যার দাম চড়া। শহরের অলিতে গলিতে যে এখন হঠাৎ হঠাৎ বিশ্ববিদ্যালয় গজিয়ে উঠছে, সেখানেও প্রথম পছন্দের বিষয় ব্যবসা-বিদ্যা। লক্ষ্মীর দাসীবৃত্তিই বুঝি আজ সরস্বতীর নিয়তি।’ (পৃ ২১৯)
এই করুণ বাস্তবকে স্বীকার করে নিয়েও বলতে চাই অনন্য গদ্যগ্রন্থ এলোমেলো হাওয়া আমাদের রিক্ত মানসে নতুন করে এই প্রতিতি জাগিয়ে তুলেছে যে, সারস্বত সাধনা ছাড়া মানুষের মুক্তি নেই। এই সাধনার যোগ প্রয়োজন বিদ্যাশিক্ষা থেকে রাষ্ট্রচালনা; সর্বত্র।
নানা বর্ণের ভাবনামালা যে অভূত রূপবন্ধনে গ্রথিত করেছেন সনৎকুমার সাহা, তার পরিমিতি ও প্রসারণ, টুকরো কথার সংহতি, শব্দ ও চিন্তার সমবিচ্ছুরণ আমাদের গদ্যচর্চাকে নতুন দিশা নির্দেশ করবে নিঃসন্দেহে।