এ-কালের মহীরুহ

রবিউল হুসাইন

বাংলাদেশের চিত্রশিল্পজগতের আধুনিক পথের অন্যতম পথিকৃৎ শিল্পী সফিউদ্দীন আহমেদ আজ আমাদের মাঝে অনুপস্থিত কালের নিয়মে। আমাদের যে-দেশে শিশুমৃত্যু এবং মানুষের গড় আয়ুর হার আশঙ্কাজনকভাবে কম, যেখানে তাঁর মতো দীর্ঘায়ু হওয়া অবশ্যই দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এই শালপ্রাংশু নিবেদিতপ্রাণ, একান্তভাবে প্রচারবিমুখ এবং একধরনের নৈর্ব্যক্তিক সন্ন্যাসব্রত অনুসারী মানুষটি মধুর ব্যবহার, স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গি ও নিপাট ভদ্র শিষ্টাচারের জন্যে ছাত্রছাত্রীসহ সবার কাছে প্রিয় একজন ব্যক্তিত্ব যে-মতো পাওয়া এই বিক্ষুব্ধ সমাজে অতিশয় কষ্টকর বা নেই বললেই চলে। এরকম মানুষকে বলা হয়ে থাকে একটি বংশ বা ঘরানার শেষ প্রতিভূ। আমাদের চিত্রশিল্পে এ-ধরনের ব্যক্তিত্বের তিনিই প্রথম এবং শেষ প্রতিনিধি। একটি যুগ যখন আরেকটি যুগের মুখোমুখি হয়ে সামনের দিকে গড়িয়ে যায় এ-সময়ে এই ধরনের মানুষের আবির্ভাব ঘটে। দুটি যুগের মধ্যবর্তীকালে তিনি দুটি সময়ে কালাতিপাত করেছেন একটি ঝুলন্ত সেতু হিসেবে। ব্রিটিশ ভারতে যখন চিত্রশিল্পের আনুষ্ঠানিক শিক্ষাপ্রদান পদ্ধতি প্রচলিত হলো, চিত্রশিল্প প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ১৮৫০ সালে মাদ্রাজে, ১৮৫৪ সালে কোলকাতায় এবং ১৮৫৭ সালে বোম্বে নগরীতে, তখন থেকেই এই অঞ্চলের সার্বিক শিল্পজগৎ অতীতের গুমোট এবং দিকচিহ্নহীন একটি পরিবেশ থেকে নতুন একটি জগতে প্রবেশপথের ঠিকানা পেতে থাকে। ভারতীয় চিত্রশিল্প ভাস্কর্যের তুলনায় সর্বদাই অবহেলিত ছিল, এখন যেমন দেখা যায় এর উলটোটি। এছাড়া ধর্মীয় বর্ণপ্রথার কারণে শিল্পীদের মান, মর্যাদা ও অবদান কখনো সামাজিকভাবে স্বীকৃত হতে পারেনি। এই কারণে বংশের পেশা অনুযায়ী কত কত মেধাবী শিল্পীর অবদান আমরা এখন দৈবক্রমে দেখতে পারি বটে, কিন্তু কোনোদিন তাঁদের নাম জানা যাবে না। সেই পাল আমলের ধীমান, বীতপাল এবং মোগল যুগে অাঁকা রিজা, আবুল হাসান, সৈয়দ আলি, গোবিন্দ, ধনরাজ প্রমুখ শিল্পীর নাম ছাড়া আর কারো পরিচয় পাওয়া যায় না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এই প্রথা ভেঙে সব ধরনের আগ্রহী মানুষের জন্যে চিত্রশিল্পচর্চা উন্মুক্ত হয়ে যায়। ধর্মীয় বাধার কারণে মুসলমান সমাজে চিত্রশিল্পচর্চা সর্বদা ব্যাহত হয়। তবু ওই সময়ে বহু আগ্রহী মানুষ চিত্রশিল্প সম্বন্ধে আকৃষ্ট হতে থাকেন। নিষিদ্ধ ও প্রবল সামাজিক বাধা সত্ত্বেও যাঁরা এসবে এগিয়ে আসেন তাঁদের সাহস ও মনোবলের প্রতি সবসময় শ্রদ্ধা জাগে। সেই বৈরী সময়ের মধ্যে যাপিত জীবনের মানসিক ও সামাজিক চাপ সম্বন্ধে ধারণা করা এই মুক্ত পরিবেশে কল্পনাও করা যায় না। ই. বি. হ্যাভেল কর্তৃক কলকাতা আর্ট কলেজের কার্যভার গ্রহণ করা হয় ১৮৯৮ সালে। পরে অবনীন্দ্রনাথসহ বেঙ্গল স্কুল ধারা প্রতিষ্ঠা পায়। ভারতীয় অতীত চিত্রধারাই মুখ্য, এই পরিপুষ্ট ধারা থেকেই ভারতের চিত্রশিল্প উন্নয়নের একমাত্র উপায় হিসেবে গণ্য হতে থাকে। এই অতীতমুখীনতা সে-সময়ে আধুনিকতা বলে পরিচিত – যদিও ঠিক একই সময়ে ইউরোপের শিল্পজগতে চলছে নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষা। যেমন প্রকাশবাদ, অনুভববাদ, ঘনকবাদ, ভাববাদ প্রভৃতি প্রকরণ। এই মতবাদের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন কুমার স্বামী, পার্শি ব্রাউন, রদেনস্টাইন প্রমুখ চিন্তক।
বলা হয়ে থাকে, এই অতীতমুখীনতা ভারতের আধুনিক শিল্পের অনেক ক্ষতিসাধন করেছে। তাঁদের উচিত ছিল আধুনিক চিত্রশিল্প, যার মূলধারা ইউরোপে চলছিল, সেই স্রোতের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়া। কিন্তু অচিরেই এই উপলব্ধি অনেকের মাঝে বিস্তারলাভ করে এবং তাই বেঙ্গল স্কুলের ভাবধারা থেকে বেরিয়ে গগনেন্দ্রনাথ ও তাঁর অনুসারীরা আধুনিক চিত্রের সঠিক ধারায় চিত্রচর্চা শুরু করেন।
জাপানি শিল্পী ওকাকুরা কাকাজুর প্রাচ্যের ধারণা বইটিও প্রভাব বিস্তার করে। হিসিডা, ইউকোহামা প্রমুখ জাপানি শিল্পীর ছাপচিত্র প্রশিক্ষণ এবং শান্তিনিকেতনে ফরাসি ছাপচিত্রী কারপেলের আগমন – সবমিলে মূল ছাপচিত্রধারা পরিপুষ্ট হতে থাকে। পেইন্টিংয়ে যত না উৎকর্ষ দেখা দিলো, তার চেয়ে বেশি দেখা দিলো ছাপচিত্রে। ছাপচিত্র ব্যবসাগতভাবে অধিক লাভজনক বিবেচিত হওয়ায় এই মাধ্যম জনপ্রিয়তা লাভ করে, তবে সেইমতো শিল্পমূল্যের বিচারে ততোটা সমৃদ্ধতর হতে পারেনি। নন্দলাল বসুর ছাত্র রমেন চক্রবর্তী, যিনি কারপেলের কাছে ছাপচিত্র শিখেছিলেন, তাঁর কাছে সরকারি আর্ট স্কুলের অনেক ছাত্র যেমন হরেন দাস, সত্যেন ঘোষাল, মুরলীধর টালি এবং আমাদের সফিউদ্দীন আহমেদও ছিলেন। তখন ছাপচিত্রে সর্বদা নিসর্গ এবং একটি বিষয়ের বাস্তবচিত্র ফুটিয়ে তোলা মুখ্য বিষয় বিবেচিত হতো। আধুনিক বিষয় প্রকৃতপক্ষে মনোগত দিকের প্রতি চিন্তাভাবনা যেখানে বোধ, অনুভব, স্বপ্ন, ভাব, অনুভূতি প্রধান, যা দৃশ্যগত পরিসরের চেয়ে অন্তর্গত মনোজগতের প্রতি অধিক কার্যকরী – এই বোধ শিল্পীদের মধ্যে তখনো আসেনি যে, বোধটি স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ তাঁর বিভিন্ন নাঈভশৈলীর স্কেচসমূহে সর্বপ্রথম পরিস্ফুট করার চেষ্টা করে সফলকাম হন। আধুনিক চিত্রচর্চার এই কালে সবরকম প্রায় পরীক্ষা-নিরীক্ষার শেষ পর্যায়ে যখন প্রতিটি স্বাধীন দেশের শিল্পজগতে সেই দেশের মূল চিত্রধারা সম্বন্ধে আগ্রহী হওয়ার সাম্প্রতিক প্রবণতা দেখা যাচ্ছে এবং বলা হচ্ছে যে, অতীতের ভিত্তিতে বর্তমান বা আধুনিকতা গড়ে তুলতে হবে, নিজের সার্বিক এবং প্রকৃত পরিচয় দৈশিক অনুষঙ্গে – সেটিকেই নতুন করে আবিষ্কার করতে হবে – এটিকেই এই সময়ে উত্তর-আধুনিক চিন্তা-চেতনায় সম্পৃক্ত হওয়া, এরকম বলা হচ্ছে। ভাবতে অবাক লাগে, অবনীন্দ্রনাথ প্রমুখ এই একই ভাবধারা অতীতে করে গেছেন। প্রশ্ন জাগে, তাহলে তাঁরা কি সে-আমলে প্রথম উত্তরাধুনিক চিন্তার প্রবক্তা ছিলেন, যদিও তাঁদের সঙ্গে ছিল না আধুনিক ভাবধারার সেরকম যোগাযোগ। এখন স্বকীয়তা আনতে হলে আধুনিকতার সঙ্গে অতীতের মেলবন্ধন করতে হবে। আধুনিকতা ব্যতিরেকে স্বকীয়তা প্রকাশ করলে তা কি উত্তরাধুনিকতা হিসেবে গণ্য হবে না? এসব প্রশ্ন এবং আলোচনা যশস্বী শিল্পী সফিউদ্দীন সম্বন্ধে বলতে গেলে স্বতঃস্ফূর্তভাবে চলে আসে। তিনি কলকাতা থেকে ঢাকায় আসেন এবং জয়নুল আবেদিনের প্রতিষ্ঠান-গঠনমুখী কার্যক্রমে সক্রিয়ভাবে যোগ দেন। নমিত ও সীমিত স্বভাবী মানুষটি শিল্পী হিসেবেও ওইরূপ ছিলেন। এজন্যে তাঁর কাজ বয়সের তুলনায় কম। তিনি আমাদের একজন বিরলপ্রজ শিল্পী। যা অাঁকেন মন, সময়, শৈলী আকুতি – সব দিয়ে অাঁকেন। একেকটি ছবি অাঁকতে দুই-তিন বছর সময় নেন এবং সেসব ছবি দেখাও ভার। যাঁরা দেখতে পারেন বা যাঁরা তাঁর ছবি সংগ্রহে রেখেছেন তাঁরা সৌভাগ্যবান এই কারণে, তাঁর একক প্রদর্শনী নেই বললেই চলে। সর্বমোট তিনটি। আশ্চর্য এরকম নিরাসক্ত, নির্বেদী, নিরহংকার পুরুষ পুরুষকারই বটেন, যা এই ক্ষয়াটে সময়ে পাওয়া একপ্রকার অসম্ভব।
আমি ব্যক্তিগতভাবে খুবই সৌভাগ্যবান যে, তিনি তাঁর বিশেষ কয়েকটি কাজের মাধ্যমে আমাকে খুব স্নেহ করতেন। তাঁরা স্বামী-স্ত্রী অনেকবার আমার কার্যালয়ে পদধূলি দিয়ে আমাকে আপ্লুত করেছেন। কেন যেন তিনি আমাকে খুব পছন্দ করতেন। ধানমন্ডির বাসায় গিয়েছি, হাত ধরে বলেছেন, এমন করে বাঁচা যায়, কবে তিনি আমাকে উঠিয়ে নেবেন। চোখ দুটো সজল হয়ে ওঠে এসব কথা মনে এলে। খুব অবাক হয়ে খুশি হয়েছিলাম, যখন তিনি দুটি প্রিন্ট আমাকে উপহার হিসেবে পাঠিয়েছিলেন। এই স্মৃতি কখনো ভুলব না। সেগুলো যক্ষের ধনের মতো আগলে রেখেছি।
তাঁর প্রয়াত প্রখ্যাত বন্ধু ও শিল্পী হরেন দাস বলেছেন, সফি কম কাজ করত, – সফি আর ঘোষাল প্রিন্সিপালের রুমে ঢুকে এচিং করত… সফিউদ্দীন আহমেদের কাজ ছিল খুব নিখুঁত। সফির সাবজেক্ট ইন্টারেস্টিং হতো সবচেয়ে বেশি – যেমন পায়রার বাসা, এসব। তার সাঁওতাল পল্লী, দুমকা সিরিজ, বন্যা, খোয়াই নদী, নৌকো টানা অনবদ্য। প্রকৃতপক্ষে সেই নিখুঁতের ধারা এখনো তিনি যক্ষের ধনের মতো আগলে রেখেছেন। খুঁতখুঁতে হন তাঁরাই যাঁরা সবসময় অপরিতৃপ্ত, বিশেষ করে শিল্পের অজানা বিস্তৃত সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে। এছাড়া যখন তিনি লন্ডনে ছাপচিত্রের উচ্চশিক্ষার জন্যে ছিলেন সেই সত্তরের দশকে, তখন পিকাসোসহ গ্রেট মাস্টারদের সঙ্গে যৌথ প্রদর্শনীতে অংশ নিয়েছিলেন, যা খুব উল্লেখ্য।
চোখ, মাছ, জাল, জল, কান্না তাঁর বিখ্যাত আর প্রিয় সিরিজ। জালের জ্যামিতিক শৈলী ও রূপ, রাগী মাছের মধ্যে সে-সময়ে অর্থাৎ আয়ুবীয় সামরিক শাসনের প্রতীক হিসেবে দেখে গিয়েছে। রানী মাছটি জাল ছিঁড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। আর জালের যে কত জলনির্ভর রূপ, ছন্দ, বিন্যাস আর রং ও প্রকাশ তা তাঁর ছবিতেই এদেশের শিল্পীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রতিভাত হয়েছে। মাছের সঙ্গে চোখের সাদৃশ্য রয়েছে যেমন, তেমনি চোখের ভাষাই মানুষের অন্তর্গত ও মনোগত ভাষা। মানুষের অবচেতনতা চোখের মাধ্যমেই প্রকাশ পায়। এসব শিল্পসম্মত অনুভব তিনি ছাপচিত্রের মাধ্যমে ও তেলরঙের ব্যবহারে প্রকাশ করেছেন। একদা যিনি নিসর্গ ও জনজীবনের হুবহু অনুকৃতি ফুটিয়ে তোলার দিকে বিশেষভাবে দৃষ্টি দিয়েছিলেন, তিনিই আবার মানুষের অন্তর্গত অতলান্তিক অনুভূতির রূপকার হয়েছেন। এই উত্তরণটি বিশেষভাবে বিচার্য এবং প্রণিধানযোগ্য। শিল্পের উৎকর্ষ সাধনের জন্যে তাঁর এই আন্তরিক প্রয়াস সারাজীবনের সাধনা ও ব্রত। এ কারণে তিনি সবার মধ্যে থেকেও নিঃসঙ্গ ও এক কঠিন পথের পথিক। এই নিঃসঙ্গ ভ্রমণ-প্রবণতা তাঁকে একক একটি পৃথক সত্তায় রূপান্তরিত করেছে। কান্না সিরিজের জন্ম হয়েছে মানুষের অসহায় বেদনাবোধ থেকে। বিখ্যাত নৃত্যশিল্পী গওহর জামিল শিল্পীর প্রতিবেশী ছিলেন। একদিন সকালবেলা তিনি বাজার করতে বের হয়েছেন তখন দেখা। পরে যখন ফিরলেন তখন দেখেন তার বাড়িতে বহু মানুষজন, ভিড়, কী ব্যাপার – পরে জানলেন জামিল সাহেব দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। এই ঘটনা তাঁকে এত ব্যথিত করে তোলে যে, সেই থেকে তিনি ‘কান্না’ শিরোনামে বহু ছবি অাঁকা শুরু করেন, যা কান্না সিরিজ নামে পরিচিতি, যা মুক্তিযুদ্ধের অত্যাচার ও নিপীড়নচিত্রও বটে। এরকম প্রখর মানবপ্রেমী ও প্রভূত অনুভূতিসম্পন্ন শিল্পীমানুষ তিনি। তিনি বিরলপ্রজ অতিপ্রজভাবে কালাতিপাত করুন। তাঁর ছবি ও তিনি একীভূত এক সত্তা। সবাই তা-ই চেয়েছিল কিন্তু তিনি নিজের চিত্রসৃষ্টির লক্ষ্যে অবিচল ছিলেন চিত্রশিল্পের জন্য। বক্তৃতা-বিবৃতি, সভা-সমিতিবিমুখ, বিজ্ঞাপন ও প্রচারে আজীবন নির্লোভ অনীহাসক্ত এই সময়ের এই আশ্চর্য মানুষ শিল্পী সফিউদ্দীন আহমেদ আমাদের মাঝে চিরকাল বেঁচে থাকবেন এবং ফিরে ফিরে আসবেন প্রখর উজ্জ্বল প্রভাতে বারবার প্রতি বছর প্রতিদিন প্রতিক্ষণে। 