কখন যে জেগে ওঠে অচেনা গোপন!

জা কি র  তা লু ক দা র

মেয়েটি ভাসছিল হালকা কুয়াশার মধ্যে।

এই নগরের সব বাসাবাড়ির মানুষ ততক্ষণে কাজে নেমে পড়েছে। তৃপ্ত সঙ্গমের পরে গাঢ় ঘুমে রাত পার করা বধূরা সকালে দরদের সঙ্গে পছন্দের নাস্তা খাইয়ে অফিস-বিদায় করেছে স্বামীদের। নগরের রাস্তাগুলোতে অফিসভিড়ের প্রথম চালান কেটে যাওয়ারও অনেকক্ষণ পরে ভাসন্ত মেয়েটা নেমে এলো গত রাতে ঘুমানো বিছানায়। তখনই মনে হলো, তার এখন জাগার সময় হয়েছে।

মেয়েটি জানে যে, বিছানাটি তার পরিচিত মনে হবে না, ঘরটিও নয়, আর সেই বিছানায় যে-পুরুষের সঙ্গে রাত কাটিয়েছে, সেই লোকটিকেও চোখ খুলে ঠিক চিনতে পারবে না সে। এমনটাই তো ঘটে তার ক্ষেত্রে।

তবে একটু অন্যরকমও লাগছে তার। সাধারণত ভোর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কিংবা আগেই এই ধরনের ফ্ল্যাটের বাসিন্দা বিদায় করে দেয় তাকে। কিন্তু আজ তাকে কেউ গায়ে অমার্জিত ঠেলা দিয়ে ঘুম ভাঙতে, বিছানা ছাড়তে এবং ঘর ছাড়তে বাধ্য করেনি।

সে চোখ খুলে আরো একটু অবাক হয়। জানালার পর্দাগুলো টেনে দেওয়া, যাতে রোদ ঢুকে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাতে না পারে। এমনটা তো গেরস্তরা করে থাকে প্রিয় এবং সম্মানিত অতিথির জন্য। তবে অবাক হলেও সে উঠে বসে বিছানায়। অভ্যাসবশত অমার্জিত হাই ওঠে। আর সেই শব্দের প্রতিশব্দ হিসেবেই বোধহয় পাশের ঘরে পায়ের শব্দে জেগে ওঠে। পাল্লা ঠেলে ঘরে ঢোকে গতরাতের শয্যাসঙ্গী। তাকে এতটা সময় তৃপ্তির ঘুম ঘুমানোর সুযোগ দেওয়ার জন্য মেয়েটি নরম চোখে লোকটির দিকে তাকায়। মেয়েটি তখনো জানে না তার জন্য আরো বিস্ময় অপেক্ষা করছে। মানুষটি নরম হাসির সঙ্গে তাকে জিজ্ঞেস করে – ঘুম ভালো হয়েছিল তো?

তারপর আরো অবাক করে দিয়ে বলে – তোমার চা বানিয়ে রেখেছি। নিয়ে আসছি। বিস্ময়ের ঘোর কাটার আগেই লোকটি বেরিয়ে যায় এবং ফিরে আসে। আর মেয়েটি অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে দেখতে পায় তার সামনে বাড়িয়ে ধরা আছে একটু একটু ধোঁয়া এবং একটু একটু সুগন্ধ ছড়ানো চায়ের কাপ।

কাপটা হাতে নিতে গিয়েও হাত গুটিয়ে আনে সে। বুকের ওপর ছিল শুধু ওড়নাটা। রাতে সেই যে সব কাপড় খুলে ফেলেছিল তা আর পরা হয়নি। হাত বাড়াতে গিয়ে ডানদিকের ওড়নাটা সরে গিয়েছিল। ওইটুকু সময়ের মধ্যেই লোকটার চোখ পড়েছিল তার স্তনের ওপর। একটু চকচকেও হয়ে উঠেছিল দৃষ্টি। মেয়েটি মনে মনে হাসে এবং গালিও দেয় – হালার ব্যাডামানুষ!

লোকটাকেও সেজন্য কোনো লজ্জা পেতে দেখা যায় না। বলে – মেয়েদের স্তন হচ্ছে আমার কাছে সবচেয়ে সুন্দর সৃষ্টি। বিশেষ করে আধাখোলা স্তন।

এই বলে আলতো করে হাত বাড়িয়ে একবার ছুঁয়েও দেয় দুই স্তন।

মেয়েটির মনে হয়, এখনই বোধহয় বিছানায় উঠে আসবে লোকটা। তা হলে ট্যাকাও বেশি দিতে হইব। রাইতের হিসাব চুইক্যা গ্যাছে রাইতে।

কিন্তু না। তার হাতে চায়ের কাপ তুলে দিয়ে লোকটা বেরিয়ে যাওয়ার জন্য ঘুরে দাঁড়ায়। বলে – তুমি কি চা খেয়ে একবারে গোসল-টোসল সেরে নেবে? সময় লাগলে অসুবিধা নেই। তুমি আরাম করে ফ্রেশ হয়ে নাও। আমি অপেক্ষা করছি। একসঙ্গে নাস্তা করব।

তার মতো মেয়েরা সচরাচর কোনো কিছুতেই অবাক হয় না। কিন্তু আজ তার অবাক না হয়ে উপায় থাকছে না। সেই কারণেই বাথরুমে তার সময় লেগে যায় অনেকখানি।

বাথরুম থেকে বেরোনোর পরে পাশের ঘর থেকে আওয়াজ আসে – নাস্তা এখানে।

ডাইনিং টেবিলে বসে ধৈর্যের সঙ্গে সিগারেট টানছে লোকটা। দেখিয়ে দেওয়া চেয়ারটায় বসতে বসতে মেয়েটি একটু লজ্জিত সুরেই বলল – দেরি হয়া গেল।

লোকটা তার দিকে প্লেট এগিয়ে দিতে দিতে বলল – অসুবিধা নাই।

এবার লোকটাকে কৌতূহল নিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে শুরু করল মেয়েটি। মাঝবয়সী। শরীরের গাঁথুনি তেমন শক্তপোক্ত নয়। সেটা কাল রাতেই বোঝা গেছে। মাঝারি উচ্চতার। চেহারার মধ্যে সুপুরুষের কোনো বৈশিষ্ট্যও তেমন নেই। তবে চোখদুটো একেবারেই অন্যরকম। নরম চাহনি। মায়া লেপ্টে আছে। কিন্তু সেইসঙ্গে আরো কিছু একটা আছে। বোধহয় একধরনের দৃঢ়তার ছাপ। আর কেন যেন মনে হচ্ছে, লোকটার মধ্যে ঝামেলার কিছু একটা আছে। ভালো করে খুঁটিয়ে দেখার পরে মেয়েটি নিশ্চিত হয়, এই ধরনের কোনো লোকের সঙ্গে সে এর আগে কখনোই মিলিত হয়নি।

নাস্তা খাওয়ার পরে তার মোবাইল নম্বরটা চেয়ে নিল লোকটা। একটু কৌতুক মিশিয়ে জিজ্ঞেস করল – কী নামে সেভ করব?

ইসমত আরা।

মনে মনে প্রমাদ গোনে ইসমত আরা। এবার বোধহয় শুরু হবে ফ্যাদরা প্যাঁচাল। তোমার বাড়ি কোথায়, এই লাইনে কেন এলে, কেমনভাবে এলে – এসব প্রশ্ন শুনলেই গায়ের মধ্যে চিড়বিড় শুরু হয়।

কিন্তু সেদিকে যায় না লোকটা। বলে – ও। আমার নাম আনিসুর রহমান। আর বাসা তো চিনলেই।

এই বাসাত কে কে থাকে?

আমি আর ওই যে আবদুল বারেক।

আপনের বউ নাই? পোলা-মাইয়া?

নাহ্। ওইসব করার সময় পাইনি। তা তুমি কি এখন বেরোবে?

হ্যাঁ।

আচ্ছা।

 

ইসমত আরা উঠে দাঁড়ায়। একটু ইতস্তত করে। মানে টাকাটা দিয়ে দিলে সে এবার যেতে পারে। কিন্তু আনিসুর রহমানের মধ্যে টাকা বের করার কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। সে ততক্ষণে নাস্তা শেষে আয়েশ করে নতুন একটা সিগারেট ধরিয়েছে। শেষে ইসমত আরাকেই মুখ খুলতে হয় – ট্যাকা!

আনিসুর রহমান বলে – টাকা। তা তো দিতেই হবে। কিন্তু ব্যাপারটা কেমন নোংরা লাগে না ইসমত আরা? এই যে শরীর নিয়ে, মানে, একরকম ভালোবাসাবাসিই তো করলাম আমরা, তার বিনিময়ে টাকা দেওয়াটা একটু নোংরাই লাগে, তাই না?

হতভম্ব হয়ে পড়ে ইসমত আরা। শালার মানুষডা তো হাড়ে হারামি! দেখতে-শুনতে অন্যরকম। ওদিকে ট্যাকা দেওয়ার বেলা চিকন চালাকি!

পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে এই পরিস্থিতিতে যেভাবে কথা বলা দরকার সেভাবেই তীক্ষনকণ্ঠে বলে সে – ওইসব ভাবের কথা রাখেন। কাম সারছেন, এখন আমার পাওনা ট্যাকা দিয়া বিদায় করেন।

আরে তোমার পাওনা তো তুমি পাবেই। তবে সেটা টাকা হলে খুব খারাপ দেখায় না বলো! খুব অরুচিকর লাগে না ব্যাপারটা?

অরুচি? খেপে ওঠে ইসমত আরা – আমার শরীল খাওয়ার টাইমে অরুচি কই ছিল মিয়া? অহন অরুচির কথা কন! ট্যাকা ছাড়েন।

তবু আনিসুর রহমান বোঝানোর চেষ্টা করে ইসমত আরাকে –  ছি ছি, তুমি ভুল বুঝছ। আমি ওই ধরনের অরুচির কথা বলিনি। আমি তো তোমাকে বিনিময়ে একটা কিছু দেবই। শুধু বলেছি যে, টাকা দেওয়াটা খুব অশস্নীল দেখায়।

আঙুল তুলে টেবিল দেখিয়ে বলে – ওই দ্যাখো, ওই টেবিলের ওপর তোমার জন্য শাড়ি এনে রেখেছি। শাড়িটা নাও। অনেক ভালো হবে ব্যাপারটা।

আমি কি আপনের পিরিতের মাগি যে শাড়ি নিব? আমি তো আপনের সঙ্গে পিরিত করবার আসি নাই। আইছি গতর বেইচা ট্যাকা নিতে। ট্যাকা দ্যান।

খুব আহত দেখায় আনিসুর রহমানকে। বলে – তুমি ওই টেবিলের কাছে যাও। শাড়ির প্যাকেটটা তো ওপরেই আছে। আর দুই হাজার টাকা আছে ড্রয়ারের মধ্যে। খোলা আছে ড্রয়ার। তোমার যেটা ইচ্ছা সেটাই নাও। শাড়ি নিতে পারো, টাকাও নিতে পারো।

ধুপধাপ পা ফেলে টেবিলের কাছে চলে যায় ইসমত আরা। টান দিয়ে খোলে ড্রয়ার। টাকা দেখা যাচ্ছে। কিন্তু হাতে নিতে গিয়ে হঠাৎ কোত্থেকে যে মুহূর্তের দ্বিধা আসে ইসমত আরার মনে! টাকার দিকে বাড়ানো হাতটা কিছুক্ষণ স্থির হয়ে থাকে। চোখ যায় শাড়ির প্যাকেটের দিকে। বারকয়েক শাড়ি আর টাকার ওপর ঘোরাঘুরি করে চোখ। নিজের এই অচেনা দ্বিধা টের পেয়ে নিজের ওপরই রেগে ওঠে ইসমত আরা। তারপর নিজেকে একটা গালি দিয়ে টাকা হাতে তুলে নিয়ে বেরিয়ে যায় একবারও পেছনে না তাকিয়ে। পেছনে তাকালে যদি দীর্ঘশ্বাস দেখতে হয়!

 

দুই

আসলেই দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিল আনিসুর রহমান। তারপর পড়তে শুরু করেছিল মার্কেজের আমার স্মৃতিভারাতুর বেশ্যারা। কিন্তু ভালো লাগল না বেশিক্ষণ। তার বহুকালের বিশ্বাস একটু চিড় খেয়েছে আজ। নারী, সে যে-স্তরেরই হোক না কেন, নারীত্ব কখনো হারায় না। কঠিন আবরণের নিচে লুকিয়ে রাখতে চাইলেও কখনো না কখনো তা বের হয়ে আসবেই। অল্প সময়ের জন্য হলেও বের হয়ে আসবেই। সে প্রাণ থেকে বিশ্বাস করে আসছে, মানুষের মনুষ্যত্ব সবসময় জাগিয়ে তোলা না গেলেও নারীর নারীত্বকে জাগিয়ে তোলা যাবেই যাবে। আরো একটা সিগারেট ধরিয়ে নিজেকে বলল আনিসুর রহমান – তাহলে কি কবিরা ভুল? কবি আনিসুর রহমান তুমিও তাহলে ভুল? নাকি ব্যর্থ?

 

তিন

আনিসুর রহমানের বাড়ি থেকে মোড় পর্যন্ত হেঁটে এসে রিকশায় উঠল ইসমত আরা। রিকশাওয়ালারা তাদের চেনে। অথবা না চিনলেও বুঝতে পারে। তাই দরদাম করা লাগে না। কোথায় যাবে তা বলতে হয় না। রিকশায় উঠে ডাইনে বা বাঁয়ে চলতে বললে সেদিকে চলে।

আজ তার ক্লাস্তি লাগার কথা নয়। রাতে ভালো বিছানায় ঘুমানোর অবকাশ পেয়েছে, ঘুমিয়েছে, সকালে ফ্রেশ হয়ে নাস্তা খেয়েছে; তবু ওই বাড়ি থেকে গলির মাথায় আসতে আসতেই যেন হাঁপিয়ে উঠেছিল ইসমত আরা। আবার রিকশায় বসেও তার খারাপ লাগাটা দূর হতে চায় না। আনিসুর রহমানের নরম নরম  কথাগুলো মনে পড়ে আর মেজাজ খারাপ হতে থাকে। বাড়িভর্তি বই ওই লোকের; কিন্তু আসলে শালা একটা আকাট মুখ্যু। লোকটা দুনিয়াদারি জানে? মনে তো হয় না। সে কিনা ইসমত আরাকে বলে শাড়ি নিতে। আরে শাড়ি নিলে তার চলবে কেমন করে? এই যে টাকা, এর পুরোটা সে তো ঘরে নিয়ে যেতে পারবে না। রাস্তার মোড়েই বসে আছে এই এলাকার দালাল। তাকে কমিশনের টাকা বুঝিয়ে দিয়ে তারপরে যেতে পারবে সে। না দিলে এই এলাকায় আর ব্যবসা চালাতে আসতে পারবে না সে। দালালের কাছ থেকে টাকা নেবে এলাকার সরকারি দলের মাস্তান, তারপর পুলিশ। আরো ছুটা-মুটা লোককে টাকা দিতে হয়। রিকশাওয়ালার ভাড়া ডবল। এই লাইনে কেউ কাউকে ফাঁকি দেয় না। সবকিছু চলে মুখের কথার বন্দোবস্তে।  কিন্তু একবার যদি কোনো এক জায়গাতে কথার খেলাপ হয়ে যায়, তাহলেই তার ব্যবসা শেষ। মুনমুনকে দেখেছে সে। দালালের সঙ্গে শুধু একবার নখরা করেছিল শুধু। তারপর ব্যবসা তো ব্যবসা, বেঁচে থাকাই প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছিল। ওই শালা কবি আনিসুর রহমানরে ইগুলান বুঝাইবো ক্যাডা?

এবার নিজের ওপরেই রেগে ওঠে ইসমত আরা। সে ওই লোকটার কথা ভাবছে কেন? ওই লোক তাকে ভালো ভাবল না খারাপ ভাবল, তাতে তার কী আসে-যায়! আর কোনো মানুষ তাদের মতো মেয়েদের ভালো তো ভাববেই না। এক রাইতের খইদ্দার! মাল খসায়া মাল দেয়।

তবু মাথা থেকে সরে না আনিসুর রহমানের মুখটা। এমন মানবিক আচরণ করল লোকটা! আর টাকা নিয়ে বাজে কথা বলায় একেবারে অন্যরকম হয়ে গেছিল মুখের চেহারা। ইসমত আরার সঙ্গে এমন ব্যবহার করছিল, যেন সে তার প্রেমিকা। আবার আশাও করছিল ইসমত আরাও তার সঙ্গে সেই রকম ব্যবহারই করুক। লোকটা ওইরকম ভাবে কোন আক্কেলে? গাধা একেবারে! দুনিয়ায় অচল। সে-কারণেই বোধহয় বউডাও ভাইগ্যা গ্যাছে।

লোকটার কথা কিছুতেই মাথা থেকে সরাতে পারে না ইসমত আরা। যত ভাবে তত রাগ ধরে তার নিজের ওপর, আর ওই লোকটার ওপর।

মোড়ের ওপর এসে দ্যাখে দাঁড়িয়ে আছে হালিম মিয়া। তাকে দূর থেকে দেখেই দাঁত কেলিয়ে হাসে। রিকশাওয়ালাকেও কিছু বলতে হয় না। সে হালিম মিয়ার কাছে এসে দাঁড়িয়ে পড়ে। সে নামে না রিকশা থেকে। হালিম মিয়াই কাছে ঘেঁষে আসে। ইসমত আরা তার হাতে এক হাজার টাকা তুলে দেয়। তারপর রিকশাওয়ালাকে, হালিম মিয়াকে এবং সম্ভবত নিজেকেও হকচকিত করে বলে ওঠে –  ওই রিকশা ঘোরাও! যেইখান থনে উঠছি, সেইখানে নিয়া চলো! r