কথারাই মনের প্রকাশ

জিললুর রহমান

 

‘এ

কটি অমেয় সিঁড়ি মাটির পৃথিবী হতে নক্ষত্রের আকাশে উঠেছে – উঠে ভেঙে গেছে’ – এমন একটি অদ্ভুত দৃশ্যকল্প দিয়ে লেখাটির সূচনা। ভাবছি, কী হতে পারে এই লেখার বিষয়বস্তু? এটা কি প্রবন্ধের পা-ুলিপি? এ কি কোনো সুপরিসর উপন্যাসের খসড়া? শুরুতেই কী অদ্ভুত স্বরে উচ্চারিত হলো – ‘সারাদিন আমি শুধু মানুষ দেখি, প্রান্তরে প্রান্তরে ছায়া বিবমিষাময় মানুষ। মানুষগুলো সব কেমন যেন – একই অবয়ব – একই কথা বলা, একই ঠোঁট  নেড়ে চলা।’  তার পরেই প্রশ্ন ‘মানুষের গায়ের গন্ধও কি এক?’ – হঠাৎ থমকে যাই – সত্যিই তো সমস্ত সামাজিক আয়োজনের পরেও মানুষের কিছু একান্ত নিজস্ব বিষয় থাকে – একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার। এসব অদ্ভুত সব চিন্তার ভেতর দিয়ে আমাকে দাঁড় করিয়ে  দেয় এক মৌলিক প্রশ্নের সামনে – ‘মানুষ কোথায় পেল তার এই ভাষা?’ আর এই প্রশ্নের জবাবের অনিশ্চয়তা বা সংশয় প্রকাশও সঙ্গে সঙ্গেই আছে। তবে কি এটি কোনো দর্শনের বই?

হবেওবা। আর নয়ই বা কেন? এর ভেতর দিয়ে যখন ক্রমশ মানুষের উৎপত্তি, ভাষা, একক মানুষের ভাবনা, যৌথ মানুষের স্বপ্ন ইত্যাদি মূর্ত হয়ে ওঠে, তখন তাকে দর্শনের বই বলাটাই সম্যক মনে করি। তার চেয়েও বড় হয়ে ওঠে এর সাহিত্যিক দ্যোতনা। মনে হচ্ছে, বিশ্বের তাবৎ সাহিত্য, দর্শন ও রাজনীতির সংমিশ্রণে লেখক এখানে তাঁর মনোজগতের অন্তর্কথনকে অক্ষরে রূপ দিয়েছেন। তাই প্রবল দার্শনিকতায় উচ্চারিত হতে দেখি ‘মানুষের মহত্ত্ব এখানেই যে, সে জানে সে নিঃসম্বল, গাছ জানে না’। কিন্তু ব্যাপারটা কি সত্যিই এতটা হতাশায় নিপতিত? তবে মানুষ কেন এত এত আশার উচ্চারণে চারপাশ ধ্বনিত করে তুলেছে? এসব প্রশ্নের জবাব খুঁজতে খুঁজতে লেখক একসময় অনুধাবন করেন, ‘এই যে মানুষ – ভারি ঠুনকো মানুষ, দিনশেষে কতটুকু তার, এই ভাবনায় সবকিছু তার গুলিয়ে যায়। কোথাও পা না রাখার স্পর্ধায় একাকী দাঁড়াতে হয় বারান্দায়।’ আর সে একাকিত্বের স্পন্দনে অনুভূত হয় যে, আজো শব্দের আগমন থেমে নেই। মানুষ শব্দময় নৈঃশব্দ্যে জড়িয়ে পড়ে। লেখকও জড়ান। আর তিনি সমস্ত মহাবিশ্বের যাবতীয় ইতিহাস পাঠ ও পর্যবেক্ষণ করেন। সকল রাজনৈতিক বীক্ষার সঙ্গে মিলিয়ে নেন সকল দার্শনিক প্রজ্ঞাকে। তিনি মনে করেন, শব্দ বা কথাই জগতের সবচেয়ে প্রধান আকর্ষণ। তার নানান রকমফের নানা গতিপ্রকৃতি। ‘মানুষের কথার মাঝে কাজের মাঝে সর্বদা দুই বিপরীত ধারা বিরাজিত। একটির নাম অনুসরণ, অন্যটি নিষেধ। মানুষ তো শব্দের নিষেধের সীমানা পেরিয়েই অনুসরণ করে ভেতরের ডাক। তুলে আনে

কুলঙ্গি-উপচানো বরফের জল। মানুষের অস্তিত্ব তার পরিবেশ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। আরো ভালো করে বললে মানুষ চারপাশে ভেসে  বেড়ানো শব্দের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। কী হতো পৃথিবীতে যদি শুধু শব্দ না থাকতো। যদি দুনিয়া ভরা থাকতো নৈঃশব্দ্যে।’

‘কথারা আমার মন’ আমাকে নৈঃশব্দ্যের ভেতরেও শব্দময় করে তোলে। শব্দই মানুষের সম্পর্করেখা ধার্য করে দেয়। তাই লেখক বলেন, ‘শব্দ এখন কোনো মানে দেয় না, বাক্য এখন আর শব্দকে ধারণ করতে পারে না। শব্দের সাথে শব্দের সম্পর্ক মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্কের আরেক নাম।’ আবার কখনো-বা এই শব্দই মানুষে মানুষে দূরত্ব বাড়িয়ে দিচ্ছে – মানুষ বুঝতে পারছে না মানুষের ভাষা। যেমন বলা হচ্ছে ‘শব্দেরা রূপকথার পাখায় করে চলেন ফেরেন দৃশ্য আর বাস্তবতার বিকর্ষক সংযুক্তিতে। আমি চেয়ে  দেখি সারাদিন কথা বলছে মানুষ, কেউ কারো কথা বুঝছে না, আমি  চেয়ে দেখি নড়ে চলছে ঠোঁট অথচ মানুষ চোখ পাথরের অন্তরের মত শীতল, আমি দেখি মানুষ কথা বলছে আর তার জিহ্বা স্থির – প্রতিটি শব্দ বেরিয়ে আসছে তার দাঁত হতে। আর প্রতিটি শব্দই দুর্বল, ক্লান্ত, অনুভূতিহীন, কোমলতাহীন, নির্মম, পরস্পর-বিচ্ছিন্ন। শব্দরা কি বন্ধন ছাড়া বাঁচে, পাতারা কি আলো ছাড়া বাঁচে, মানুষ কি সংযুক্তিহীন অদম্য আকর?’ যখন শব্দের এমনতরো বিশ্লেষণে ডুবে থাকি, মনে হয় যেন ভাষাতত্ত্বের কোনো গবেষণাপ্রবন্ধ পাঠ করছিলাম। কিন্তু পরক্ষণে লেখক যখন প্রশ্ন ছুড়ে দেন, ‘মানুষ সংযুক্তিহীন অদম্য আকর’ – তখন মনে হয় জাহিদুর রহিম মূলত দার্শনিক। ‘তাই তো চেয়ে দেখি চেনা-অচেনা পরিবেশ-প্রতিবেশে উচ্চগীত, কলহ আর বর্ণিল সন্ধ্যায়, কোমলের শূন্য অনুভূতির আকুতি আর সম্পর্কের দেয়াল পলকা কাচের মতন খান খান হয়ে যায়। মানুষের ইট-পাথর মানুষের রক্ত মাংস, মানুষের মানুষী চাওয়া তার চোখের মনির চারপাশে সাদা রক্ত হয়ে জমে আছে।’

আমরা জানতে পারি ‘বাস্তবতা এক ভ্রম, যদিও তা ক্ষণস্থায়ী’।  যেমন ভাস্কর চক্রবর্তীর কবিতা থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে লেখক জানান দিচ্ছেন – ‘সব কথা শেষ হয়ে গেছে/ আর কোনো কথা নেই স্বপ্ন  নেই/ শুধু কিছু দিন আর রাত্রি পড়ে আছে।’ একবার ভাবুন, সেই মহাভারতের মহাযুদ্ধের কথা, কিংবা রামায়ণের যুদ্ধ, অথবা ট্রয়ের যুদ্ধ, ভাবুন না প্রথম কিংবা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কথা। যখন সমস্ত ধ্বংসযজ্ঞ শেষ  – যুদ্ধের দামামা আর বাজছে না  – যখন চারদিকে এক পরম নিস্তব্ধতা চরম নির্মমতাকে বুকে নিয়ে বসে আছে, তখন কী মূল্য বহন করে কথা বা অক্ষর, কী স্বপ্ন বাকি থাকে আমাদের সামনে? সেই প্রেক্ষাপটের আবহে যখন আমি অবগাহন করছি, তখন লেখকও আমার সামনে তুলে ধরছেন এক ভয়াবহ সত্য – ‘ভয় আছে জীবনের নির্মম আঘাতের – যে-আঘাত মনে করিয়ে দেয়, আপনি আলোতে থাকলে অনেক পোকাকেও নাচতে  দেখবেন, আপনি অন্ধকারে গেলে আপন ছায়াও কাছে থাকে না।’ এভাবে একে একে আমাদের সামনে নতুন বিশ্লেষণে ধরা দেয় টিএস এলিয়টের পোড়োজমি, এরিক মারিয়া রেমার্কের পশ্চিম রণাঙ্গনের নিস্তব্ধতা। আমাদের হৃদয় থেকে বিশ্বাসের বিলোপ ঘটতে চায়। মানুষ খ-িত হয় এবং বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে একে অপরের কাছ থেকে।

কিন্তু সম্পর্কের এই তন্তুগুলোকে একে একে সেলাই করতে করতে যখন নির্মমতা আর নির্মোহতার পরিবেশে এসে দার্শনিকতা থমকে দাঁড়ায়, তখন সাহিত্যই আবার আমাদের দাঁড় করিয়ে দেয় শান্তির স্নিগ্ধতার মোড়ে  – বড় রাস্তায়। আমরা যেন সাহিত্যের নির্মল আলোছায়ার ফাঁকে প্রশান্তির স্নিগ্ধ সড়কের দেখা পাই। ‘কিন্তু এমন নিষ্ঠুর নির্মম বাস্তবের পাশেও আছে প্রশান্তির এক সড়ক যা মানুষের মনের সব ভয়কে মুহূর্তে তাড়িয়ে দেয়। সব গ্ল­ানি থেকে  দেয় মুক্তি। সব ভয়ের মূলে আছে মানুষের জীবনের প্রতি অন্ধ  মোহ। মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও মানুষ এই পৃথিবীতে তার স্মৃতির কাছে অমর এক কাল্পনিক পৃথিবী তৈরি করতে থাকে প্রতিনিয়ত। সেই পৃথিবীর কোনো রূপান্তর বা ধ্বংসের ভয়ে আতংকিত মানুষ। ভয় থেকে মুক্তির জন্যে প্রথমে প্রয়োজন মনকে শূন্য করা। তখন মানুষ জয়-পরাজয়,

জন্ম-মৃত্যু, পাওয়া-হারানোর সব শংকার ঊর্ধ্বে মনে এক রাজসিক শান্তির সংকেত পায়  – যেমন পেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু আমরা কি খুব বেশিক্ষণ ছিন্নপত্রের সাহিত্যিক আবেশে স্থির থাকতে পারি? আমরা ফের ঢুকে পড়ি রাজনীতির ঘুলঘুলিতে। ট্রটস্কির সীমানাবিহীন যুদ্ধের তত্ত্ব, কিংবা ফকেয়ামার ইতিহাসের সমাপ্তি ও সর্বশেষ মানুষ, অথবা হান্টিংটনের সভ্যতার দ্বন্দ্ব আমাদের সামনে চমস্কির নয়া সাস্রাজ্যবাদী কৌশলকে উন্মোচিত করে দেয়। আমাদের সামনে আমাদের পেছনে যা কিছু দেখি তা  কেবল যুদ্ধ আর যুদ্ধ। কিন্তু লেখক আমাদের স্মরণ করিতে দেন যে, যুদ্ধ যে-কোনো রোমাঞ্চ নয় তা জর্জ বার্নার্ডশ ক্যাপ্টেন ব্লান্টশলি নাটকে খুব সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছেন। তাই আমরা বুঝতে পারি লেখকের সঙ্গে সঙ্গে বুঝি এরিক মারিয়া রেমার্কের সঙ্গে ‘মৃত্যু  কোনো অ্যাডভেঞ্চার হতে পারে না, যারা এটার মুখোমুখি দঁাঁড়ায়।’ মূল কথা হলো  – মানুষ বাঁচতে চায়।

তাই কোনো একসময় আমাদের ওপর ভর করে জীবনানন্দের  সেইসব পঙ্ক্তি – ‘মৃত্যু এলে মরে যেতে হবে/ ভালোবাসা নদীর জলের মতন হয়ে র’বে/ জলের থেকে ছিঁড়ে গিয়েও জল/ জোড়া লাগে আবার যেমন নিবিড় জলে এসে।’ আর আমরা উপলব্ধিতে  পৌঁছে যাই  – মৃত্যু নয়, প্রেমই আরাধ্য  – যে-প্রেম এক চিরকালীন আবেশের নাম। সেই প্রেম মানুষকে ধাবিত করে সুন্দরের সাধনায়। আর সক্রেতিসের ভাষায়, মানুষের সামগ্রিক সুন্দর তার মনের ভেতরেই বিরাজ করে। তাই নিজেকে সুন্দর করে তুলতে পারলেই মানুষ পরম সুন্দর হয়তো হয়ে উঠবে। হয়তো এমন কোনো ইতিবাচকতা দিয়ে লেখাটির শেষ টানা যেত; কিন্তু লেখক মানুষের সীমাবদ্ধতাকেও আমাদের সামনে তুলে ধরতে চান। আর ইঙ্গিত কি দেন যে, আমাদের মনকে কলুষমুক্ত করলেই সর্বাঙ্গীণসুন্দর সামনে এসে ধরা দেবে? নয়তো, জালালুদ্দিন রুমির সে বিখ্যাত উক্তিইবা আমাদেরকে চিন্তার ছেদ ঘটানোর জন্যে সমাপ্তি বাক্যে উৎকলিত হবে? – ‘মানুষ মনে করে আলো আসে সূর্য হতে। সে  তো ভুল। আলো থাকে মনে, যেই আলোতে সূর্য আলোকিত হয়।  যেই আলোতে যে চোখে দেখে না সেও জগত দেখে।’