কপালের নাম নেপাল

কৃষ্ণেন্দু পালিত

‘কপালে নেইকো ঘি, ঠক্ঠকালে হবে কি!’ – প্রবাদবাক্যটি  এ- যাত্রায় এভাবে সত্যি হয়ে উঠবে, স্বপ্নেও কল্পনা করিনি। বছরের পর বছর রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে নেপালের দরজা ট্যুরিস্টদের কাছে একরকম বন্ধই ছিল। মাত্র কয়েক বছর হলো সে-সমস্যার সমাধান হয়েছে। মানুষ নির্ভয়ে, নিশ্চিন্তে যাচ্ছে। মধ্যবিত্ত বাঙালির কাছে সহজলভ্য বিদেশ বলতে প্রথমেই যে-নামগুলি মনে আসে, নেপাল তাদের অন্যতম। ভারতীয়দের জন্যে পাসপোর্ট-ভিসার কোনো ঝামেলা নেই, কেবল নাগরিকত্বের প্রমাণ হিসেবে সচিত্র কোনো পরিচয়পত্র দেখালেই হলো, খরচও আয়ত্তের মধ্যে, যাকে বলে সাধ্যের মধ্যে সাধ পূরণ। অন্তত আমার মতো মানুষের কাছে। জীবনের প্রথম বিদেশ সফর হিসেবে তাই নেপালকেই বেছে নিয়েছিলাম।

খুব অল্পদিনের পরিকল্পনায় নেপাল যাওয়া ঠিক হয়েছিল। ট্রেনের টিকিট না মেলায় বিহারের রক্সৌল হয়ে নেপালে ঢোকার সহজ রুট ছেড়ে বেছে নিতে হয়েছিল শিলিগুড়ির পানিট্যাঙ্কি। পানিট্যাঙ্কি থেকে হাঁটাপথে সীমান্ত পেরোলেই নেপালের কাকরভিটা। কাকরভিটা থেকে নেপালের প্রায় সর্বত্র বাস যোগাযোগ আছে। আমরা শুরু করব পোখরা দিয়ে। দুপুর ৩টা নাগাদ পোখরাগামী বাসে চেপে বসলাম। কাকরভিটা থেকে পোখরার দূরত্ব ৭৩৬ কিলোমিটার। সময় লাগে ১৪ ঘণ্টা। লটঝড়ে বাস, ততোধিক খারাপ রাস্তার হাল। আগে বাসের কন্ডিশন দেখে নিয়ে টিকিট কাটা উচিত ছিল। আক্কেলসেলামি হিসেবে সারারাত নরকযন্ত্রণা ভোগ করে, সর্বাঙ্গে ব্যথা নিয়ে পরদিন ভোর ৫টায় যখন পোখরা পৌঁছলাম, আকাশের মুখ তখন ভার হয়ে আছে।

বাস থেকে সেখানে নামলাম, এই সকালেই সেখানে ছোটখাটো একটি সবজিবাজার বসেছে। মূলত চাষিরাই এসেছেন তাদের ক্ষেতের সবজি নিয়ে, আমাদের এদিকে গ্রামের মোড়ের মাথায় যেরকম বাজার বসে আর কি! রুকস্যাক নামিয়ে ক্যামেরার ব্যাগটা বের করে ফেললাম। আমার দেখাদেখি সঙ্গীদের দু-একজনও ক্যামেরা বের করলো। শুরু হলো ছবি তোলার পালা। আমাদের কান্ড দেখে ট্যুরের সর্বসম্মতিক্রমে নির্বাচিত ম্যানেজার সুজিত চৌধুরী তেড়েফুঁড়ে এলো, এসব কী হচ্ছে! কোথায় আগে হোটেল ঠিক করবে তা নয়… সময় কি চলে যাচ্ছে? ভুলে যেও না, আমরা এখানে তিনদিন থাকব।

সুজিতের কথায় রণে ভঙ্গ দিতে হলো। ম্যানেজার বলে কথা, তাকে অমান্য তো করা যায় না। তাছাড়া, কথাটা খারাপ কিছু বলেনি। আগের কাজ আগে করা উচিত। প্রতিটি ট্যুরের মতো এখানেও আমরা হোটেল বুক না করেই চলে এসেছি। অভিজ্ঞতায় দেখেছি, তাতে ঝকমারি একটু বাড়লেও আখেরে লাভই হয়। খরচ যেমন কম পড়ে, দেখেশুনে পছন্দসই হোটেলেও ওঠা যায়। পোখরার হোটেলগুলি মূলত ফেওয়া লেককে কেন্দ্র করে, লেকের উত্তরপাশে। এখান থেকে যার দূরত্ব মাত্র দুই কিলোমিটার। সারারাত দুর্বিষহ জার্নির পর পিঠে লাগেজ নিয়ে এতোটা পথ হাঁটার মতো এনার্জি কারো নেই, বিশেষ করে চড়াই-উতড়াই ভেঙে, পাহাড়ি পথে। প্রয়োজন একটা গাড়ির।

গাড়ির খোঁজ নিতে গিয়েই এ-যাত্রার প্রথম হোঁচটটা খেলাম। আশপাশে কোথাও কোনো যানবাহনের চিহ্ন নেই। এ-ধরনের জনপ্রিয় একটি ট্যুরিস্ট স্পটে এমনটা তো হওয়ার কথা নয়। কোথায় যেন একটা অসঙ্গতির ঈঙ্গিত পাচ্ছিলাম। স্থানীয় মানুষের কাছে খোঁজ নিতে গিয়ে জানলাম, আমাদের অনুমানই ঠিক। আজ এখানে চবিবশ ঘণ্টার বন্ধ। এখন উপায়?

হাঁটা ছাড়া আর কোনো পথ নেই ভেবে আমরা যখন মানসিকভাবে প্রস্ত্তত হচ্ছি, মুশকিল আসান করে আমাদের বয়সী একটি ছেলে উপযাজক হয়েই এগিয়ে এলো। এতক্ষণ পাশে দাঁড়িয়ে আমাদের কথাবার্তা শুনছিল। বলল, আমার হোটেল আছে। ফেওয়া লেকের ধারেই। আপনারা সেখানে উঠতে রাজি থাকলে আমার স্কুটারের পেছনে দুজন করে বসিয়ে নিয়ে যাবো।

রাজি হলাম। মোট তিন কিস্তিতে হোটেলে গিয়ে পৌঁছলাম। বাড়ি কাম হোটেল। হোটেল থেকে লেকটা দেখা না গেলেও লেকের পাশেই। আয়তনে ছোট কিন্তু ছিমছাম আর পরিচ্ছন্ন। প্রথম দেখাতেই পছন্দ হয়ে গেল। হোটেলের বারান্দা থেকেই দূর আকাশের গায়ে অস্পষ্ট ছবির মতো দেখা যাচ্ছে কিছু তুষারাবৃত শৃঙ্গ, যার মধ্যে মচ্ছপুছরে এবং অন্নপূর্ণা অন্যতম। খুব অল্প সময়ের জন্যেই তাদের দেখা পেলাম, তারপর হারিয়ে গেল মেঘের আড়ালে। এ-যাত্রায় এই প্রথম এবং শেষ তাদের দর্শন। কারণ আমরা থাকা অবধি আকাশ আর মেঘমুক্ত হয়নি।

যা হোক, হোটেলে উঠে ফ্রেশ হয়ে কিছুটা টেনশনমুক্ত হওয়ার পর পেট বাবাজি জানান দিতে শুরু করল। বন্ধের দিন, দোকানপাট বন্ধ। হোটেলের ছেলেটিকে বললাম, টিফিনের ব্যবস্থা করতে। গরম গরম রুটি আর আলু-চ্চচরি। রান্না খারাপ নয়। দুপুর আর রাতের অর্ডারটাও তাকে দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। ফেওয়া লেকটা দেখে আসি। সেইসঙ্গে প্রয়োজনীয় খোঁজখবর। আগামী দুদিনের ট্যুর প্লানটাও করে ফেলতে হবে।

 

শুরু হলো আমাদের পোখরা ভ্রমণ

চারপাশ পাহাড়ঘেরা পোখরা উপত্যকার মূল আকর্ষণ অবশ্যই ফেওয়া লেক। লেককে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে শহর। একপাশে উঁচু সারাংকোট পাহাড়, অন্যপাশে জনবসতি, দোকানপাট, হোটেল-রেস্তরাঁ, ক্যামো-কফি আর বিমানবন্দর নিয়ে আধুনিক শহর। পাহাড়ের পাদদেশে ঘনজঙ্গল, নাম কুইন ফরেস্ট। জঙ্গলে হরেক পাখি, পক্ষীপ্রেমীদের স্বর্গরাজ্য। ফেওয়া লেকের ওপর ছাতার মতো রয়েছে তুষারধবল অন্নপূর্ণা পর্বতমালা। লেকের জলে তার ছায়া পড়ে অপূর্ব দৃশ্যের সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে মচ্ছ পুছরে চূড়াটির। হুবহু মাছের লেজের মতো। নামও তাই ‘ফিশটেল’। আমাদের কপাল মন্দ, আকাশ মেঘে ঢাকা – যে-কারণে ক্যালেন্ডারের পাতায় দেখা সেই অসাধারণ দৃশ্য এ-যাত্রায় অধরা থেকে গেল। লেকের জলে বোটিং করার ব্যবস্থা আছে, ঘণ্টায় জনপ্রতি ১০০ টাকা। আছে প্যাগোডাধর্মী একটি মন্দির, ঠিক লেকের মাঝখানে। মন্দিরের উপাস্য বরাহী দেবী। এছাড়াও পোখরা থেকে এভারেস্ট এয়ারের বিশেষ উড়ালে আকাশপথে দেখে নেওয়া যায় পশ্চিম হিমালয় পর্বতমালার একাংশ। চাইলে প্যারাগ্লাইডিংও করতে পারেন। নেপালের বিখ্যাত কয়েকটি ট্রেকরুটের ‘গেটওয়ে’ও এই পোখরা। যাদের মধ্যে অন্যতম মুক্তিনাথ এবং অন্নপূর্ণা বেসক্যাম্প। যদিও মুক্তিনাথ এখন সড়কপথে যাওয়া যায়, যাওয়া যায় ছোট বিমান কিংবা হেলিকপ্টারে। পছন্দ অনুযায়ী একটা বেছে নিলেই হলো।

আজ এখানে বন্ধ চলছে, যানবাহন বন্ধ, ইচ্ছা থাকলেও সাইট সিন করা যাবে না। আস্ত একটা দিন হোটেলে শুয়েবসে কাটাতে হবে, যা একেবারেই আমাদের স্বভাববিরুদ্ধ। তাছাড়া সঙ্গে শিশু বা মহিলাও নেই, ছ-ছটি যুবক ছেলে। না, অহেতুক সময় নষ্ট করতে আমরা রাজি নই। খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারি, দূরে ওই পাহাড়টার মাথায় একটা জাপানি বৌদ্ধমন্দির আছে, যার পোশাকি নাম বিশ্বশান্তি স্তূপ। স্থানীয় মানুষের কাছে ‘স্তূপা’। ভারতের অনেক হিল স্টেশনেই জাপানিরা এমন শান্তিস্তূপ বানিয়েছে, যেগুলো দেখতে সব একইরকম। যা হোক, যাতায়াতের পথগুলি তো আর এরকম নয়। ভিন্ন প্রকৃতি, ভিন্ন মানুষ, ভিন্ন তাদের বেশভূষা, কালচার। আর এগুলিও তো দেখার বিষয়। এসব না দেখলে, না জানলে যে-কোনো ভ্রমণই বোধহয় অসম্পূর্ণ থেকে যায়।

সময় নষ্ট না করে আমরা রওনা দিই স্তূপার উদ্দেশে। সড়কপথে প্রায় তিন কিলোমিটার হাঁটার পর শুরু হয় প্রকৃত ট্রেকরুট। অন্যদিন হলে এই পর্যন্ত বাস কিংবা অটোয় আসা যেত। আজ হন্ট নেই। একেবারে পাহাড়ের পাদদেশ থেকেই শুরু হয়েছে পায়ে চলার রাস্তা। পাহাড়ি পথে আড়াই কিলোমিটার। পথে পড়ে ছোট ছোট জনবসতি, গ্রাম। সহজ-সরল মানুষগুলির সঙ্গে আলাপ জমতে সময় লাগে না। সহজেই আপন করে নেয়। ছবি তুলতে গেলেও আপত্তি করে না, বরং সহযোগিতা করে। এখানকার মেয়েরা মোটেও রক্ষণশীল নয়, বরং বেশ মুক্তমনা। এ-পথে বিদেশিদের সংখ্যাও চোখে পড়ার মতো। দলে দলে স্তূপা দর্শনে চলেছে সাদা চামড়ার নারী-পুরুষ। এরকম বেশকিছু ট্যুরিস্টের সঙ্গে আলাপ হয়। অবাক হই জার্মান থেকে আসা প্রেমিক যুগলকে দেখে। মেয়েটির হাঁটতে কষ্ট হওয়ায় ছেলেটি অনায়াসে তাকে পিঠে তুলে নিয়েছে। কোনোরকম সঙ্কোচ নেই কারো মধ্যে।

ঘণ্টাতিনেকের ব্যবধানে পৌঁছে যাই পাহাড়চূড়ায়। সত্যিই শান্তির জায়গা, স্বর্গীয় পরিবেশ। অসীম নিস্তব্ধতায় মোড়া শীর্ষদেশে অল্পকিছু ট্যুরিস্ট, যার ফিতের মতো একেবেঁকে বয়ে চলেছে কোনো এক নদী, হতে পারে তার নাম সেতি গন্ডোকি। ওয়েদার ভালো থাকলে এখান থেকে হাত-বাড়ানো দূরত্বে অন্নপূর্ণা রেঞ্জের ধ্যানগম্ভীর উপস্থিতি। সবমিলে অদ্ভুত এক ভালোলাগা পরিবেশ। ঘণ্টাখানেক এখানে কাটিয়ে নেমে আসি।

হোটেলে ফিরতে চারটে পার হয়ে যায়। স্নান করে ফ্রেশ হতে আরো ঘণ্টাখানেক। ততক্ষণে খিদেটাও জানান দিতে শুরু করেছে। বিকেল ৫টায় দুপুরের খাওয়া-দাওয়া সেরে ফিরে আসি নিজেদের রুমে। এবার একটু বিশ্রামের প্রয়োজন।

পরদিন ভোর ৪টায় হোটেলের সামনে গাড়ি লেগে যায়। আমরা অবশ্য তার আগেই তৈরি হয়ে নিয়েছি। রাত ৩টা থেকে ম্যানেজার আমাদের ওপর তান্ডব চালাচ্ছে ঘুম থেকে তোলার জন্যে। কখনো গায়ের কম্বল টেনে নিচ্ছে তো কখনো পা ধরে টানছে। সে এক যাচ্ছেতাই ব্যাপার। একজন ঘুমন্ত মানুষ আর কতক্ষণ যুঝতে পারে্একজন বাতিকগ্রস্ত মানুষের সঙ্গে! বাতিকগ্রস্ত এজন্য বললাম, সে ম্যানেজারির দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকেই দেখছি সমস্ত ব্যাপারে অহেতুক টেনশন নিয়ে যাচ্ছে। সবকিছু পাংচুয়াল হওয়া চাই। অতিষ্ঠ হয়ে ইতোমধ্যেই আমরা তাকে বেশ কয়েকবার হুমকি দিয়েছি, এভাবে চললে শাস্তি হিসেবে আমরা তাকে দেশের প্রধানমন্ত্রী কিংবা রাষ্ট্রপতি বানিয়ে দেবো। বিন্দুমাত্র কাজ হয়নি তাতে। বরং দ্বিগুণ উৎসাহে সে আমাদের ওপর ম্যানেজারি শুরু করেছে।

একে ম্যানেজারের অত্যাচার, তার ওপর আকাশের মুখ ভার – আমরাও গোমড়ামুখে গাড়িতে গিয়ে বসলাম। যাচ্ছি সারাংকোট। সূর্যোদয় দেখতে। কপাল মন্দ, কিছুদূর এগোতেই শুরু হলো ঝিরঝিরে বৃষ্টি। বৃষ্টি মাথায় নিয়েই পৌঁছলাম সারাংকোট। ছোট্ট তিববতি গ্রাম। মেঘ-বৃষ্টিতে অস্পষ্ট জলছবির মতো। মাঝখান দিয়ে এঁকেবেঁকে বয়ে চলেছে সেতি গন্ডোকি নদী। পাহাড়ের গায়ে সবুজ ধাপচাষ। সবমিলে সত্যিই ছবির মতো। গাড়ি থেকে নেমে তাড়াতাড়ি দৌড়লাম ভিউপয়েন্টের দিকে। সেখানে তখন সূর্যোদয় দেখতে ভিড় জমানো অসংখ্য ট্যুরিস্ট ছাতামাথায় দাঁড়িয়ে। জানি এ-অপেক্ষা কোনো পরিণতিতে পৌঁছবে না। তবু এই পাহাড়চূড়া থেকে দেখা নিচের পৃথিবী, বিশেষ করে পোখরা শহরের একাংশ – মেঘের অবগুণ্ঠনে যে এখন রহস্যময় রমণীর মতো। ঘণ্টাখানেকেরও বেশি সময় সেখানে কাটিয়ে, সূর্যদেবের দেখা মেলার যখন আর কোনো সম্ভাবনাই নেই, একবুক হতাশা নিয়ে আর অপয়া ম্যানেজারকে দোষারোপ করতে করতে ফেরার পথ ধরলাম। অথচ ওয়েদার ভালো থাকলে এখান থেকেই দেখা যায় ধৌলাগিরি, সাউথ অন্নপূর্ণা, অন্নপূর্ণা ওয়ান, টু, থ্রি, ফোর, ফাইভ, ফিশটেল, মাউন্ট মানাস্লুসহ আরো অনেক বিখ্যাত শৃঙ্গ। নেপালের যে-কটি জায়গা থেকে সূর্যোদয় দেখা যায়, সারাংকোট যে তাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ সে-বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

সারাংকোট থেকে ফেরার পথে দেখে নিই বিন্ধবাসিনী মন্দির। পোখরার পুরনো বাজারটিও বেশ আকর্ষণীয়। ফেওয়া লেক থেকে দূরত্ব মাত্র চার কিলোমিটার। এখানে নেওয়া সম্প্রদায়ের বেশ কিছু মন্দির আছে। বিন্ধবাসিনী তাদের মধ্যে সবচেয়ে পবিত্র এবং জাগ্রত। শনি ও মঙ্গলবারে ভক্তদের ঢল নামে। এখনো এখানে বলির প্রথা চালু আছে। মন্দিরের সামনে পুণ্যার্থীদের লম্বা লাইন, হাতে পূজার উপাচার। মন্দির-চাগলে এক জায়গায় হোমযজ্ঞ চলছে, পুরোহিত মন্ত্র পড়ছেন, ঘি-পোড়া গন্ধে চারপাশ ম-ম করছে। হঠাৎ হুড়মুড়িয়ে বৃষ্টি এলো। ছুটে গিয়ে বসলাম গাড়িতে।

বিন্ধবাসিনী দর্শন শেষ করে সোজা হোটেলে। ব্রেকফাস্ট সেরে (কেউ কেউ স্নানটাও সেরে নেয়) – আবার বেরিয়ে পড়া দ্বিতীয়পর্বের পোখরা দর্শনে। এ-যাত্রায় আছে দেবী ফল্স বা ছাঙ্গো জলপ্রপাত, গুপ্তেশ্বর মহাদেবের মন্দির, মহেন্দ্র কেভস, মাউন্টেন মিউজিয়াম, মহেন্দ্রপুল এবং ফেওয়া লেকের মাঝে বরাহীমন্দির।

প্রথমেই মহেন্দ্র পুল। পোখরা শহরের মাঝখান দিয়ে বয়ে চলেছে সেতি গন্ডোকি নদী। মাঝে মাঝেই সে অন্তঃসলিলা। কোথাও দু’মিটারের কম চওড়া আবার কোথাও গভীরতা ২০ মিটারেরও বেশি। মিশন হসপিটালের কাছে অবস্থিত মহেন্দ্রপুল থেকে খুব ভালোভাবে দেখা যায় নদীর জলোচ্ছ্বাস ও গভীর গিরিখাত।

দেবী ফল্স বা ছাঙ্গো জলপ্রপাতটি বেশ অভিনব। স্বাভাবিক গতিতেই ঝরনাটি এসে হঠাৎ করে চোখের আড়ালে চলে যায় বা অন্তঃসলিলা হয়ে যায়। এখানে আর তাকে খুঁজে পাওয়া যায় না। দেখা মেলে গুপ্তেশ্বর মহাদেবের মন্দির পেরিয়ে গুহার ভিতরে আরো ১০০ মিটার প্রবেশ করলে।

দেবী ফল্স থেকে গুপ্তেশ্বর মন্দির খুব দূরে নয়। হাঁটাপথে মিনিট পাঁচেক। মহেন্দ্রকেভের ভেতর গুপ্ত অবস্থায় আছেন প্রকৃতিদত্ত দেবাদিদেব। তবে মূল গুহা দর্শন করতে হলে মন্দির পেরিয়ে আরো ভেতরে প্রবেশ করতে হবে। তার জন্য নির্ধারিত প্রবেশমূল্য দিয়ে টিকিট কাটতে হবে। অভ্যন্তরে লাখ লাখ চামচিকে, তাদের শরীরের কটু গন্ধ। স্যাঁতস্যেঁতে দেয়াল। অন্ধকারে পথ ঠাওর হয় না। সঙ্গে টর্চলাইট থাকা আবশ্যক। চুনাপাথরের এই গুহায় স্টালাকটাইট ও স্টালাগমাইটের কারুকার্য দেখার মতো। গুহার শেষপ্রান্তে দীর্ঘ লম্বা একফালি ফাটলজুড়ে আলোর ঝলকানি, ঝরনা নামছে সশব্দে, রোদ এসে পড়েছে সেই ঝরনার জলে – সে এক অভাবনীয় দৃশ্য।

গুহাদর্শন শেষ করে পরবর্তী গন্তব্য মাউন্টেন মিউজিয়াম। বিশাল জায়গা নিয়ে মিউজিয়াম চত্বর। অনেক বিরল প্রজাতির গাছ রয়েছে চত্বরজুড়ে, যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য রুদ্রাক্ষ, কর্পূর ইত্যাদি। আছে কফিগাছও। মিউজিয়ামটিও বেশ বড়। চারটি প্রদর্শনকক্ষ আছে এখানে। বেসমেন্টে সবচেয়ে বড় কক্ষটি পাহাড়ি আদিবাসীদের (তামাং, থাকলি, গুরুং, নেওয়ার, শেরপা প্রভৃতি) পোশাক, অলংকার, বাদ্যযন্ত্র, বাসনপত্র তাদের সাংস্কৃতিক আচার-আচরণের বিবরণী।

দ্বিতীয় প্রদর্শনকক্ষটি পৃথিবীর যে-চৌদ্দোটি শৃঙ্গের উচ্চতা ৮০০০ মিটারের বেশি – সেসব শৃঙ্গের বিশাল ছবি দিয়ে সাজানো। সঙ্গে তাদের বিস্তারিত তথ্য। পাশের কক্ষটি নেপালের স্থানীয় উদ্ভিদ এবং জীবজন্তুর ছবি দিয়ে সাজানো। আছে কিছু পাখি এবং কয়েকটি জন্তুর স্টাফ। আরেক দিকে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের শিলা, যা পাহাড়ের ভূতাত্ত্বিক গঠন সম্পর্কে বুঝতে সাহায্য করে।

পরবর্তী ঘর পাহাড়ে অভিযান চালাতে যেসব জিনিস ব্যবহৃত হয়, যে-ধরনের পোশাক পরা হয় – সেসব দিয়েই সাজানো। শেষ কক্ষটি শুধুমাত্র এভারেস্ট অভিযানের ওপর। ১৯২১ সালের ব্রিটিশ অভিযান এবং ১৯৫৩ সালের প্রথম সফল অভিযানের অসংখ্য ছবি এবং তাঁদের ব্যবহৃত জিনিসপত্র রাখা আছে।

মিউজিয়াম দেখা শেষ করে আমরা বাইরের মুক্ত প্রাঙ্গণে গ্রামীণ রেস্টুরেন্টে এসে বসি। গলাটা একটু ভেজানো দরকার। এ প্রসঙ্গে বলে রাখি, এখানে জৈবসারের তৈরি কফি পাওয়া যায়। অবশ্য একবার চেখে দেখা দরকার। সেই অবসরে বেশ কিছু বিরল প্রজাতির পাখি এবং একটি বৃহদাকার গিরগিটিকে ক্যামেরাবন্দি করে ফেলি।

মিউজিয়াম দর্শনের পর আমাদের গাড়ি ছুটে চলে ফেওয়া লেকের দিকে। যাবো বরাহীদেবীর মন্দিরে। এ-যাত্রায় এটিই আমাদের শেষ দ্রষ্টব্য।

লেকের ঠিক মাঝখানে মন্দির। মন্দিরে যাওয়ার জন্যে রয়েছে অসংখ্য রংচঙে সব সুদৃশ্য নৌকা। কেউ কেউ দেখলাম লেকের জলে মাছ ধরছে। পানকৌড়ি ভেসে বেড়াচ্ছে লেকের জলে। লেকের মাঝে ছোট্ট একখন্ড দ্বীপভূমি, সেখানেই মন্দির। মন্দিরচত্বরে হাজার হাজার নৌকা। হরেক কিসিমের সওদা নিয়ে বসে আছে দোকানিরা। আছে পূজার উপকরণ। কাঠের তৈরি প্যাগোডাধর্মী মন্দিরটি আয়তনে ছোট হলেও সুদৃশ্য। মন্দিরের চূড়া স্বর্ণবর্ণ। এখান থেকে মূল দ্বীপখন্ড ছবির মতো দেখায়। মন্দির দর্শন শেষ করে ফিরে আসি মূল দ্বীপখন্ডে। এখান থেকে আমাদের হোটেল খুব দূরে নয়। গাড়ি ছেড়ে দিয়ে হেঁটে ফেরায় মনস্থির করি। এখানকার বাজারটি বেশ জমজমাট, এই অবসরে ঘুরে দেখে নেব। স্মৃতি হিসেবেও কিছু কেনা দরকার। প্রিয়জনরা অপেক্ষায় আছে। এ-প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখি, নেপালে টাকার মূল্য কম। ভারতীয় ১০০ টাকায় ১৬০ টাকা পাওয়া যায়। কেনাকাটার সময় তাই, দোকানি কোথাকার কারেন্সিতে দাম বলছে, সেটা আগেভাগে জেনে না নিলে ঠকার সম্ভাবনা প্রবল।

পোখরায় আজই আমাদের শেষ দিন। কপাল এখানে বিশেষ সহায় হয়নি। আকাশের মুখ ভার এখনো। মাঝে মাঝে বৃষ্টি হচ্ছে ঝিরিঝিরি। সেইসঙ্গে একটা দিন বন্ধও পালন করতে হয়েছে। এখন দেখার, পোখরা ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কপালটাও যদি বদলায়। বন্ধুদের সঙ্গে এসব আলোচনার ফাঁকে বাজারটা ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম। সাধারণ জনজীবনের ছবি তুলছিলাম। হঠাৎ দুঃসংবাদটা পেলাম একটা রেস্টুরেন্টে টিফিন করতে ঢুকে। স্থায়ী সংবিধান নির্মাণের দাবিতে আগামী পরশু থেকে নেপালে অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য ধর্মঘট শুরু হচ্ছে। মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল আমাদের। এখন উপায়?

হোটেলে ফিরে মালিকের কাছে খবরের সত্যতা সম্পর্কে জানতে চাইলাম। তিনিও সহমত পোষণ করলেন এবং জানালেন, বন্ধ কতদিন চলবে তার পক্ষে বলা অসম্ভব। এখানে বন্ধের প্রভাব মারাত্মক। আমরা যেন কালই নেপাল ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি। অন্যথায় আটকে পড়ার সম্ভাবনা প্রবল। এ-যাত্রায় আর কাঠমান্ডু দেখা হলো না। অন্যান্য দর্শনীয় স্থানের কথা না-হয় ছেড়েই দিলাম। কী আর করা যাবে! কপালে নেই কো ঘি…! হঠকারী সীমান্ত নিয়ে বিপদে পড়ার থেকে পালিয়ে যাওয়াই ভালো। দেশে ফেরাই মনস্থির হলো সর্বসম্মতভাবে।

পরদিন রওনা হলাম দেশের পথে।