কাছের মানুষ অন্নদাশঙ্কর

সুরজিৎ দাশগুপ্ত

আমার তখন সেই বয়স যখন নরনারীর রহস্যময় সম্পর্ক নিয়ে কৌতূহল জাগতে শুরু করে। পড়ি জলপাইগুড়ি জেলা স্কুলে। হাতে আসে অন্নদাশঙ্কর রায়ের আগুন নিয়ে খেলা। পড়ে তাঁর আরো বই পড়ার জন্য উৎসুক হই। সহপাঠী গোপাল চক্রবর্তীর বাড়িতেই ছিল তেলিপাড়া লাইব্রেরি। গোপাল এনে দিলো অন্নদাশঙ্করের দুখানি বই, জীবনশিল্পী ও পথে প্রবাসে। উপন্যাস নয়, একটি প্রবন্ধের বই, অন্যটি ভ্রমণকাহিনি। কিন্তু পড়ে ফেললাম। পাঠ্যবইয়ে রুচি না থাকলেও দুবার দুর্ঘটনার ও একবার অস্ত্রোপচারের কারণে ছোটবেলাতেই বহুদিন বিছানায় থাকার সময় বইপড়ার অভ্যাস শিখি। জীবনশিল্পীতে রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে দুটি প্রবন্ধ ছাড়াও আরো কিছু প্রবন্ধ ছিল, একটি ছিল গ্যেটের ফাউস্ট নিয়ে প্রবন্ধ, তার শেষে ছিল চিরন্তন নারীর বন্দনা করে একটি উদ্ধৃতি। অপর বই পথে প্রবাসেতে শুনি যৌবনে ভরপুর ইউরোপের হৃৎস্পন্দন। সে-দেশের তরুণ-তরুণী ছুটি পেলেই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে দূরের ডাকে।

প্রকাশকের প্রযত্নে চিঠি দিই অন্নদাশঙ্করকে। উত্তর এলো পোস্টকার্ডে। তাতে তাঁর ঠিকানা ছিল আয়রন সাইড রোডের। তাঁর চিঠি পেয়ে আমিও চিঠি দিই দ্বিগুণ উৎসাহে। তিনিও মধ্যে মধ্যে উত্তর দিতেন। একদিন তাঁর চিঠির মাথায় ঠিকানা দেখলাম শান্তিনিকেতন। অকাল অবসর নিয়ে তিনি শান্তিনিকেতনে চলে গেছেন স্থায়ীভাবে বাস করার জন্যে।

ম্যাট্রিক পাশ করে জলপাইগুড়ির একমাত্র কলেজে ভর্তি হয়ে পেলাম নতুন বন্ধুবান্ধব। দ্বিতীয় বছরের গরমের ছুটিতে নিত্যানন্দ দাশগুপ্ত ও আমি পথে প্রবাসেতে পড়া ইউরোপীয় তরুণ-তরুণীর মতো বেরিয়ে পড়লাম দেশ ভ্রমণে। কীই বা আমাদের আর্থিক সামর্থ্য! বোলপুরে নেমে হেঁটে হেঁটে পৌঁছলাম শান্তিনিকেতনে। তখন মহর্ষির তৈরি শান্তিনিকেতন বাড়িতেই ছিল অতিথিশালা। কী সাংঘাতিক গরম। প্রথম কাজ হলো চৌবাচ্চার জলে ভালো করে স্নান। দুপুরটা ঘরে কাটিয়ে বের হলাম অন্নদাশঙ্করের খোঁজে। শ্রীনিকেতনের পথে ক্ষিতিমোহন সেন, নন্দলাল বসুর বাড়ি ছাড়িয়ে ডান দিকে মস্ত বাগানওয়ালা একটা বাড়ি দেখিয়ে একজন সাইকেলারোহী আমাদেরকে অন্নদাশঙ্করের বাড়ির নিশানা দিলেন।

অন্নদাশঙ্কর তখন সাদা হাফ শার্ট সাদা ফুলপ্যান্ট পরে টেনিস র‌্যাকেট হাতে উত্তরায়ণে টেনিস খেলতে যাচ্ছিলেন। আমরা জলপাইগুড়ি থেকে এসেছি শুনে তিনি আমাদের অপেক্ষা করতে বলে আবার ঘরে ফিরে গেলেন। আমরা বাইরে দাঁড়িয়ে দেখছি সামনের লাল রঙের নাবাল জমির গর্ভে জমা একটু লাল জল। খানিক পরে অন্নদাশঙ্কর বেরিয়ে এসে বললেন, ‘চলো, একটু বেড়িয়ে আসি।’ দেখলাম প্যান্ট-শার্ট ছেড়ে খদ্দরের ধুতি আর গেরি রঙের পাঞ্জাবি পরে এসেছেন, পাঞ্জাবির            বোতাম-ঘর বুকের বাঁ দিক ঘেঁষে উঠেছে গলায়, আর হাতে টর্চ। আমাদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে তিনি চললেন শ্রীনিকেতনের দিকে। তিনিই কথা বলছিলেন, আমরা শুনছিলাম। অধিকাংশ কথাই ছিল গান্ধীজী ও গান্ধীর অর্থনীতি সম্বন্ধে। সাহিত্যের কথা অল্পই। জীবনানন্দ দাশ সম্বন্ধে আমার প্রশ্নের উত্তরে তিনি বললেন, ‘জীবনানন্দ আমাদের শুদ্ধতম কবি।’

পরের বছর আইএ পরীক্ষা দেওয়ার পরে অন্নদাশঙ্করের চিঠিতে জানলাম তাঁরা গরমের ছুটিতে দার্জিলিং বেড়াতে আসছেন, থাকবেন নর্থ পয়েন্টের লগ কেবিনে। কয়েকদিন বাদে আমরা দু-তিনজন বন্ধু চলে গেলাম দার্জিলিং। তখনকার কালে দার্জিলিং বেড়ানো বলতে বোঝাত বাসা ভাড়া করে মাসখানেক ধরে বাস করা। তবে আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে যখন বেড়াতে গেলাম তখন উঠলাম স্টেশনের কাছে এক বাঙালি হোটেলে। আমরা গিয়ে হাজির হলাম লগ কেবিনে। অন্নদাশঙ্করের পরনে তখন সাহেবি টাই-কোট-সুট-বুট কিন্তু লীলা রায়ের পরনে শাড়ির ওপরে কালো কার্ডিগান। হেসে তিনি বললেন, উনি এতদিন প্লেন লিভিং হাই থিঙ্কিং করেছেন, এখন করছেন উলটোটা, আমার কাজ কমপ্রোমাইজ করা। কথায় কথায় উঠল ঢাকাতে সদ্যঘটিত একুশে ফেব্রুয়ারির কথা। এতোক্ষণ বেশ স্বাভাবিকভাবেই আমাদের কথাবার্তা হচ্ছিল; কখনো সাম্প্রতিক সাহিত্য, কখনো পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা, কখনো ফারাক্কা ব্যারেজের ভবিষ্যৎ ইত্যাদি নিয়ে। কিন্তু একুশে ফেব্রুয়ারির কথা উঠতেই কেউ যেন সুইচ টিপে তাঁর মুখে জোরালো আলো জ্বেলে দিলো। বললেন, ‘একুশে ফেব্রুয়ারির প্রাণদান বিফলে যেতে পারে না, ইতিহাসে এর সুদূরপ্রসারী ফল দেখতে পাবে।’ অন্নদাশঙ্করের স্মৃতিচারণ করতে গেলে ১৯৫২-র মে কি জুন মাসে দার্জিলিংয়ের লগ কেবিনের বারান্দায় কাঞ্চনজঙ্খার সামনে উচ্চারিত ঘোষণাটির কথা মনে পড়ে। ওই শাহাদাতের পরিণামেই আঠারো বছর পরে বাংলাদেশের জন্ম হয় এবং নতুন শতাব্দীর সূচনাতে একুশে ফেব্রুয়ারি স্বীকৃত হয় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস রূপে। সেই আনন্দে অন্নদাশঙ্কর আমাদেরকে ভোজন করান যদিও তাঁর খাওয়া-দাওয়ার ওপরে তখন অনেক বাধানিষেধ ছিল। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস আসলে তো বাংলাভাষা দিবস।

জলপাইগুড়ি থেকে আইএ পাশ করে কলকাতায় আসি ইংরেজিতে অনার্স পড়তে, ভর্তি হই স্কটিশ চার্চ কলেজে, কিন্তু কলেজের কোনো হোস্টেলে জায়গা পাই না। থাকি হরি ঘোষ স্ট্রিটের এক মেসে জলপাইগুড়ির বন্ধু মৃণাল মুখুজ্যের গেস্ট হিসেবে, ভাব হয় দীপক মজুমদারের সঙ্গে, সেও ছিল কবি ও সাহিত্যপাগল। তার পাল্লায় পড়ে এক প্রবল শ্রাবণধারায় শান্তিনিকেতনে পৌঁছোই ‘বর্ষা শুনতে’। দীপকের ছিল খুব ভালো গানের গলা। শান্তিনিকেতনে পৌঁছে সে চলে গেল তার বড়মামা শান্তিদেব ঘোষের বাড়ি। আমি কোথায় যাই? ভিজতে ভিজতে আরো খানিকটা এগিয়ে
গেলাম অন্নদাশঙ্করের বাড়িতে। একরাশ বকুনি দিয়ে হাতে বড় ছেলে পুণ্যশ্লোকের পাজামা-পাঞ্জাবি ধরিয়ে দিয়ে লীলা রায় আমাকে পাঠিয়ে দিলেন বাথরুমে। কলকাতায় থাকার তখনো জায়গা পাইনি শুনে বললেন, শান্তিনিকেতনে ভর্তি হয়ে যেতে, এখানে ওপেন শেলফ লাইব্রেরিতে পারবে খুশিমতো বই খুঁজে নিতে, পাবে বিখ্যাত অধ্যাপকদের কাছে পড়ার ও দেশ-বিদেশের বহু স্কলারের সঙ্গে মেলামেশার সুযোগ। ভেবে দেখলাম, সে সঙ্গে পাব অন্নদাশঙ্কর ও লীলা রায়ের সান্নিধ্য। আরো দেখলাম যে, অন্নদাশঙ্করের ঘরে দেয়ালে দুটো ছবি টাঙানো আছে। এ-দুটি ছবি কাদের খোঁজ করে জানলাম, একটি দান্তের ও অন্যটি গ্যেটের। বুঝলাম দান্তে ও গ্যেটের সঙ্গ অন্নদাশঙ্কর নিত্য লাভ করেন। পরদিন তাঁর চিঠি নিয়ে দেখা করলাম রেজিস্ট্রার নিশিকান্ত সেনের সঙ্গে। বললেন, ‘সেশন অনেকদিন শুরু হয়ে গেছে, অনেক মেকআপ করতে হবে, তুমি বরং ইতিহাসে অনার্স নাও, আজই ভর্তি হয়ে যাও।’ বললাম, ‘টাকা-পয়সা তো আনিনি।’ তাতে বললেন, ‘এই চিঠিটা তো এনেছ; এখন শুধু কলকাতা থেকে তোমার বাক্সপেঁটরা নিয়ে এসো – কালই।’

শান্তিনিকেতনে থাকাকালে প্রায়ই যেতাম মেসোমশায়-মাসিমার কাছে। যদিও শান্তিনিকেতনে বড়দের দাদা বা দিদি বলার            রেওয়াজ, তবু তাঁদেরকে আমি মেসোমশায় ও মাসিমাই বলতাম। শান্তিনিকেতনের জীবন তখন ছিল একটা বিরাট যৌথ পরিবারের জীবন। ছিল বিভিন্ন ঋতুর উৎসব ও মঙ্গল অনুষ্ঠান। সেসবে যোগ দিতে বাইরে থেকে অনেকে আসতেন। বহিরাগতদের সবচেয়ে বেশি ভিড় হতো পৌষ উৎসবে। আচার্য রূপে সেবার জওয়াহেরলাল নেহরু এসেছিলেন। আর সেবারই উত্তরায়ণের পুবের মাঠে শেষবার পৌষমেলা হয়। পৌষমেলার পরে আর এক মেলার কথা উঠল। এই প্রথম হবে সে মেলা। সাহিত্যমেলা।

মেসোমশায়ের বাগানে মোড়া পাতা হলো। একে একে ক্ষিতীশ রায়, হীরেন দত্ত, অশোকবিজয় রাহা প্রমুখ এসে বসলেন। চায়ের সঙ্গে মাসিমার হাতে করা কেকের টুকরো। নিমাই চট্টোপাধ্যায় ও গৌরী দত্তর ওপরে দেওয়া হলো অনেক কাজের বোঝা। এক বছর পূর্তি হবে বাংলাভাষার জন্যে ঢাকার রাজপথে শাহাদাতের। সেই উপলক্ষে সাহিত্যমেলা। দেশ ভাগ হয়েছে, কিন্তু ভাষা ভাগ হয়নি, জাতি ভাগ হয়নি, সাহিত্য ভাগ হয়নি, তবে গত পাঁচ বছরে দুরাষ্ট্রের আশ্রয়ে বাংলা সাহিত্য কোন দিকে কতটা ও কীভাবে বিকশিত হয়েছে তাই নিয়ে দুরাষ্ট্রবাসী বাঙালি সাহিত্যিকদের মিলনমেলা। সমস্ত পরিকল্পনা ও পরিচালনা মেসোমশায়ের। তাঁর প্রথম জীবন কেটেছিল ওড়িশায়, যৌবনের কিছুটা বিহারে, কিছুটা বিদেশে, বাংলায় বাস করতে এলেন চাকরির সুবাদে। চেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের উত্তরসূরি হতে, বাঙালি সাহিত্যিক হতে। চাকরি-জীবনের অর্ধেকটা কাটিয়েছেন পূর্ববঙ্গে, অর্ধেকটা পশ্চিমবঙ্গে। বাংলার অখন্ডতা ছিল তাঁর অভিজ্ঞতায় ও উপলব্ধিতে। বাঙালির সংহতি ছিল তাঁর স্বপ্নের সত্য।

বাহান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি পূর্ব পাকিস্তানে একদিকে যেমন বাঙালি জাতিসত্তার বীজ বপন করে, তেমন অন্যদিকে সরকারি মনোভাবকে ভারতবিরোধী করে তোলে। আশঙ্কা ছিল করাচিস্থ পাকিস্তান সরকার পূর্ব পাকিস্তান থেকে বাঙালি সাহিত্যিকদের ভারতে আসতে দেবে কি না। কিন্তু ভারতে শুধু শান্তিনিকেতনেই পাকিস্তানের বাঙালি সাহিত্যিকদের যাওয়া চলবে – এই শর্তে চারজন বাঙালি সাহিত্যিককে আসার অনুমতি দেওয়া হয়। অন্নদাশঙ্কর ও লীলা রায় পাকিস্তান থেকে আসা সাহিত্যিকদের কেমন আদরযত্ন করেছিলেন তার জীবন্ত বিবরণ শামসুর রাহমান কালের ধুলোয় লেখা নামের স্মৃতিকথায় লিখেছেন। দুই বাংলার অমন মিলনমেলা আর কখনো হয়নি। তার জন্য সমস্ত প্রশংসা পাওয়া ছিল ওই রায় দম্পতির।

বিএ পরীক্ষার আগে ঘনঘন শরীর খারাপের জন্য আমাকে বারবার হাসপাতালে যেতে হয়। তখন মাসিমা-মেসোমশায় আমাকে হাসপাতাল থেকে তাঁদের বাসাতেই নিয়ে গেলেন। তাঁরা তখন হাসপাতালের কাছে মুকুল দে-র বাড়ি ভাড়া নিয়েছিলেন। তাঁদের আদরযত্নে থেকে আমি টেস্ট পরীক্ষা দিয়ে জলপাইগুড়িতে মায়ের কাছে চলে যাই এবং শরীর সারিয়ে শান্তিনিকেতনে ফিরে বিএ পরীক্ষা দিই। কিন্তু তিন মাস বাদে শরীর এমন খারাপ হলো যে, প্রায় দুবছর শয্যাবন্দি থাকতে হলো। তখন মেসোমশায়ের সঙ্গে পত্রালাপ চলতে থাকে।

শান্তিনিকেতনে থাকাকালে দেখেছিলাম মেসোমশায়ের অভ্যেস ছিল প্রতিদিন বিকেলে টেনিস খেলতে অথবা হাঁটতে যাওয়া। টেনিসের জন্য একরকম পোশাক, হাঁটার জন্য অন্যরকম। বই, কাগজ, চিঠিপত্র পড়ার জন্য বসতেন, কিন্তু বসে বসে ভাবা তাঁর ধাত ছিল না, এদিক থেকে ওদিক হেঁটে হেঁটে ভাবা তাঁর স্বভাব  ছিল এবং হাঁটতেনও যথেষ্ট দ্রুত বেগে। হাঁটার অভ্যেসটা তাঁর যোধপুর পার্কেও বজায় ছিল, কিন্তু যোধপুর পার্কে থাকাকালেই ভাবার জন্য হাঁটার ধাতটা কমে বা চলে যায়, থেকে যায় স্বাস্থ্যের জন্য পদচারণা। তাঁর লেখাপড়ার কোনো বাঁধা সময় ছিল না, তবে সকালে ও সাঁঝের বেলাতেই লিখতেন সাধারণত। তাঁর লেখা ছিল টাইপরাইটারে টাইপ করা। তবে শান্তিনিকেতনে দেখেছি, একটা ঘরে মাসিমা শুতেন ও তাঁর টাইপরাইটারে খটখট করে লিখতেন এবং অন্য একটা ঘরে মেসোমশায় শুতেন ও লিখতেন তাঁর বাংলা টাইপরাইটারে।

মেসোমশায়ের ঘরে থাকত দুটো টেবল। ছোটটাতে থাকত টাইপরাইটার। অন্য টেবলে বসে কাগজে-কলমে চিঠিপত্র, লেখাপড়ার নোটস বা ডায়েরি এবং ছড়া লিখতেন। তাঁর একটা খাতা ছিল, যাতে উপন্যাসের বিষয় কী হবে, কোন চরিত্র কোন ভাবনার বাহক হবে, কতগুলি চরিত্র হবে, কার সঙ্গে কার কী সম্পর্ক হবে এসব নিয়ে যখন যা ভাবনা তাঁর মনে আসত তখন তা লিখে রাখতেন। টাইপ করে লেখার সময় কোনো জটিল ভাবনাকে সরলভাবে কেমন করে লেখা যায় কাগজে-কলমে আগে তা লিখে নিয়ে তার পরে সেভাবে সরল করে টাইপে লিখতেন। লেখার সময় কেউ কথা বলতে বা দেখা করতে এলে তখন তখনই কাজের কথা সেরে নিতেন। বিশ্বাস করতেন যে, তাঁর যেমন সময়ের দাম আছে তেমনই অতিথির বা দর্শনার্থীরও সময়ের দাম আছে। সাধারণত অভ্যাগতকে বিদায় দেওয়ার সময় নিজেও উঠে দাঁড়াতেন এবং দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিতেন। একবার মঞ্জু ও আমাকে বোলপুর স্টেশন পর্যন্ত এগিয়ে দিয়েছিলেন। মেসোমশায়, মাসিমা ও মঞ্জু বোলপুর স্টেশনে একটা বেঞ্চে বসে আছেন তার ছবি তুলেছিলাম, সে-ছবি একটা পত্রিকায় ছাপাও হয়েছিল।

শান্তিনিকেতন থেকে কলকাতায় এলে মেসোমশায়ের একটা প্রিয় যাওয়ার জায়গা ছিল নিউমার্কেট অঞ্চল। ওই অঞ্চলের বইয়ের দোকানগুলোতে সাজিয়ে রাখা বইগুলো দেখতে ও কিনতে ভালোবাসতেন। সাহিত্য অকাদেমি থেকে আমার লেখা অন্নদাশঙ্কর রায় বইয়ের মলাটে তাঁর যে-ছবি আছে সেটা অমনই এক বইয়ের দোকানের সামনে তোলা ছবি। কলকাতার সিনেমা, থিয়েটার, সংগীতানুষ্ঠান ইত্যাদির খোঁজখবর রাখতেন এবং সেসবের টানে চলে আসতেন কলকাতায়। বহুরূপীর নাটক হলেই শম্ভু মিত্র ডাক পাঠাতেন আর তিনিও সোৎসাহে উপস্থিত হতেন। সবিতাব্রত দত্তের ব্যাপিকা বিদায় তিনি টিকিট কেটে দেখতে গিয়েছিলেন। খবর পৌঁছল মঞ্চের পেছনে সবিতাব্রতের কাছে। সঙ্গে সঙ্গে তিনি চলে এলেন প্রেক্ষাগৃহে। মেসোমশায়কে প্রণাম করে বললেন, ‘খুবই ইচ্ছে ছিল আপনাকে নাটক দেখাব, কিন্তু ডাকার সাহস পাইনি।’ চৌরঙ্গিতে মেট্রোপলিটন বিল্ডিংয়ে তখন মার্কিন তথ্যসেবা কেন্দ্র ছিল। বিখ্যাত ব্যালে নর্তকী মার্থা গ্রাহাম কলকাতায় এলে তাঁর অনুষ্ঠান দেখতে শান্তিনিকেতন থেকে মেসোমশায় ও মাসিমা চলে এলেন কলকাতায়। শান্তিনিকেতনে বসে কাগজে বিজ্ঞাপন দেখে একবার আমাকে একটা পোস্টকার্ড লিখলেন, কলকাতায় আবার রেড শুজ সিনেমাটি এসেছে, দেখে এসো। ওই লাল জুতো জোড়া ছিল ব্যালে নাচের জাদু জুতো। ওই জুতো পায়ে পরলেই দেহে মনে জাগে ব্যালে নাচের দুরন্ত ছন্দ, শ্রেষ্ঠ নর্তকি হওয়ার প্রচন্ড আকাঙ্ক্ষা ভুলিয়ে দেয় জীবনের আর সব কামনা-সাধনা। ছবিটি প্রথমবার যখন কলকাতায় আসে তখনই মেসোমশায়রা দেখেছিলেন। শান্তিনিকেতনে বাস করলেও কলকাতার সাংস্কৃতিক জগৎ সম্বন্ধে তাঁর আগ্রহ সজীব ছিল এবং তাতে অংশও নিতেন সক্রিয়ভাবে।

শান্তিনিকেতনে অন্নদাশঙ্কর সম্বন্ধে বলার মতো মানুষ এখন খুবই কম, কিন্তু এখনো অনেকে আছেন কলকাতায় তাঁর সম্বন্ধে বলার জন্য। তাই সে সম্বন্ধে অল্প একটু বলি।

সকালে খবরের কাগজ পড়তেন, একটি নয়, অনেকগুলি কাগজ রাখতেন ও পড়তেন। তার পরে বইপত্র পড়তেন এবং দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পরেও পড়তেন বিছানায় শুয়ে শুয়ে, পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়তেন। বিকেলে চা খেয়ে কিছুক্ষণ লেখাপড়ার পরে বেড়াতে বেরোতেন। এই বেড়ানোটা ছিল কঠোর রুটিন মেনে। সন্ধেবেলায় একা থাকলে লেখাপড়ার টেবলে বসতেন। নেশা ছিল দূরদর্শনের সংবাদ দেখাশোনা। বয়স হলেও বিশ্ব সম্বন্ধে বৈরাগ্য আসেনি, দুনিয়ার কোথায় কী হচ্ছে না-হচ্ছে সে সম্বন্ধে তাঁর আগ্রহ ছিল জীবনের শেষ পর্যন্ত। রামমন্দির নিয়ে দেশজুড়ে আন্দোলনে এবং কলকাতায় আনন্দমার্গীদের তান্ডব নৃত্যের খবরে দেশের পরিস্থিতি সম্বন্ধে তাঁর উদ্বেগ বেড়েছিল, কিন্তু বাড়ির কাছে বালিগঞ্জে আনন্দমার্গীদের হত্যাকান্ডে অত্যন্ত অশান্ত হয়েছিলেন এবং মৈত্রেয়ী দেবী প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তির সংগঠন করেছিলেন ওই হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে। অনেকে বলেছিলেন, ওই কান্ডের পেছনে তৎকালীন শাসকদলের হাত আছে। কিন্তু তিনি কোনো দলের পক্ষে বা বিপক্ষে প্রতিবাদ সংগঠন করেননি, করেছেন এক নারকীয় কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে। আবার বাংলাদেশে যখন তসলিমা নাসরিনের বিরুদ্ধে মৌলবাদীরা সক্রিয় হয় তখনো তিনি কলকাতাস্থ বাংলাদেশের ডেপুটি হাইকমিশনারের অফিসের সামনে ধরনাতে বসেন। তখন তাঁর দাবি ছিল, শিল্পীর স্বাধীনতাকে রক্ষা করা। বাংলাদেশিদের অনুপ্রবেশ নিয়ে তিনি একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন আনন্দবাজার পত্রিকাতে। কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা দফতর খবর পায় যে, একদল মৌলবাদী তাঁর ওপরে হামলার চক্রান্ত করছে, তাই রাজ্য  সরকারকে নির্দেশ দেয় তাঁর নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে। নববই বছর পেরিয়েও অন্নদাশঙ্কর ছিলেন শতাব্দীর অতন্দ্রপ্রহরী, বিবেকের আলোকস্তম্ভ।