কাজী নজরুল : এক নীড়হারা পাখি

বাঁধন সেনগুপ্ত

কবি কাজী নজরুল স্বভাবে ছিলেন আজীবন কিঞ্চিৎ অস্থির, কিঞ্চিৎ চঞ্চল। কিন্তু প্রতিভার এই বরপুত্র সৃষ্টির ক্ষেত্রে ছিলেন আজীবন গভীর নিমগ্ন এক স্রষ্টা। অস্থিরতা তাঁর বৈচিত্র্য ভাবনার সহচর। আর চাঞ্চল্য তাঁর অদমিত প্রাণশক্তির প্রকাশ।
ব্যক্তিজীবনে নিরন্তর অবস্থানক্ষেত্রে পরিবর্তন সেই অস্থিরতা ও চাঞ্চল্যের পরিচয় বহন করে। অনেকে তাঁকে বলতেন – বাসাবদলের কবি। বস্ত্তত কৈশোরে পিতৃবিয়োগের পর থেকেই স্থান থেকে স্থানান্তরে নজরুলের উপস্থিতি লক্ষ করা গেছে। কখনো শিক্ষালাভের আশায়, কখনো জীবনধারণের বেপরোয়া চাপে সেই অস্থির কিশোরের ছুটে বেড়ানোর প্রবণতা কারো নজর এড়ায় না। ১৯০৮ সালে পিতা কাজী ফকির আহমদের প্রয়াণের সময়ে নজরুলের বয়স আট বছর দশ মাস। এরপর বছরখানেক কবি জন্মভূমি চুরুলিয়ায় গ্রামের মক্তবে পড়াবার কাজ ও মসজিদে ইমামদারির কাজ অর্থের আশায় করেছিলেন। বছর দশেক হতেই তাই যোগ দিয়েছিলেন কবি বাসুদেবের লেটোর দলে গায়ক, রচয়িতা (পালা) ও অভিনেতা হিসেবে।
তখন থেকেই শুরু হলো শিল্পীর বোহেমিয়ান জীবনযাত্রা। লেটোগায়ক হিসেবে কখনো পরে ওস্তাদ গোদা, মপু মিঞা (চুরুলিয়া) দলে যোগ দিয়ে সফর করেছেন তিনি সেকালের বিস্তৃত লেটো সাম্রাজ্য রাখাকুড়িয়া, খুশনগর ও খোটাডিহি অঞ্চলে। তখন থেকেই সেই বালক প্রতিভার অনিশ্চিত জীবনযাত্রার শুরু। অবশ্য লেখাপড়ায় কৃতী কিশোর নজরুল এরই ফাঁকে বর্ধমান জেলার মঙ্গলকোট থানায় নবীনচন্দ্র ইনস্টিটিউটে (মাথরুণ হাই স্কুল) ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হন। কিছুকাল পরে আর্থিক কারণে স্কুলত্যাগে বাধ্য হয়েছিলেন এই কবি। সেখানে শিক্ষক হিসেবে তিনি পেয়েছিলেন সেকালের বিখ্যাত কবি কুমুদরঞ্জন মল্লিককে।
১৯১২ সালে পেটের তাগিদে কবি বর্ধমান জেলার অন্ডাল থানার খ্রিষ্টান গার্ডের প্রসাদপুর বাংলোয় চাকরি নিতে বাধ্য হন। গার্ডের খাবার তিনি নিয়মিত স্টেশনে গিয়ে পৌঁছে দিতেন। গার্ডের স্ত্রী অরুণা ঘোষ। কিশোর নজরুলকে তিনি খুব ভালোবাসতেন। বাড়িতে ছিল চমৎকার একটি বিদেশি যন্ত্র – পিয়ানো। নজরুল তা বাজানো ও শেখবার লোভে মাতাল গার্ডের অত্যাচার সহ্য করতেন। মত্ত অবস্থায় নজরুলের গান শুনতেন গার্ড শৈলেন ঘোষ। কিন্তু গার্ড তাঁকে ষড়যন্ত্র করে একটি খোঁড়া মেয়ের সঙ্গে জোর করে বিয়ে দেবার ফাঁদ পাততে চলেছেন জেনে স্নেহময়ী অরুণার পরামর্শে নজরুল সেখান থেকে বাধ্য হয়েই পালিয়ে আসেন। রানীগঞ্জে এসে অবশেষে ঘুরতে ঘুরতে হাজির হন আসানসোলে। সেখানে মোতালেব বক্সের (অর্থাৎ এম এ বক্স) এম এ বক্স বেকারিতে চাকরি পান। গ্রাম থেকে ভোররাতে নজরুল রুটি ও বিস্কুট বয়ে আনতেন বলে অনেকের বিশ্বাস। টাটকা রুটি ও বিস্কুটগুলো দ্রুত সাজিয়ে রাখতে হতো সেই কিশোর কবিকে। অবসর সময়ে আপনমনে দোকানে বসে বসে কবি গান গাইতেন। দেয়ালে আশেপাশে কখনো তা লিখেও রাখতেন। সেখানে কাছাকাছি থাকতেন দোতলায় ভাড়াটিয়া পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর কাজী রফিজুল্লাহ। তিনি নজরুলের গান শুনতেন বাড়িতে ফিরে এসে। তাঁরা ছিলেন নিঃসন্তান। তাই নজরুলকে এনে তিনি তাঁর পরিবারে স্থান দেন। বালক নজরুলের পড়াশোনায় আগ্রহ দেখে তিনি ১৯১৪ সালে পনেরো বছরের কবিকে নিয়ে স্বেচ্ছায় ময়মনসিংহ জেলায় নিজের গ্রামে এনে দরিরামপুর হাইস্কুলে ভর্তির ব্যবস্থা করেন। আগে রুটির দোকানে মাইনে পেতেন তিন টাকা। রফিজুল্লাহ সেখান থেকে এনে ফাইফরমাশ করবার জন্যে দিতেন মাসে পাঁচ টাকা। অবশেষে নজরুলকে এনে স্নেহপ্রবণ রফিজুল্লাহ দেশের বাড়িতে স্থান দিয়ে কবির লেখাপড়ার ব্যবস্থা করে দেন। ১৯১৪ সালে কবিকে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি করেন তিনি। পরের বছর (১৯১৫) ক্লাসে কৃতিত্বের পরিচয় দিয়ে কবি অষ্টম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হন। কিন্তু সে-বছর জানুয়ারি মাসে নীরবে কাউকে কিছু না জানিয়ে অজ্ঞাত অভিমানে ময়মনসিংহ ছেড়ে নজরুল বর্ধমানে ফিরে আসেন।
বর্ধমানে এসে গোড়ায় ভর্তি হয়েছিলেন নিউ স্কুলে। কিছুকাল পরে সেই স্কুলই উঠে গেল। বাধ্য হয়ে এসে ভর্তি হন রানীগঞ্জ শিয়ারসোল রাজ হাইস্কুলে। অষ্টম শ্রেণিতে ভর্তি হয়ে মাসিক পাঁচ টাকা বৃত্তি পেলেন। সেইসঙ্গে স্কুলের লাগোয়া মুসলিম বোর্ডিংয়ে বিনা খরচে থাকবার সুযোগ পেলেন তিনি। শিক্ষক হিসেবে এখানে তখন ছিলেন বিপ্লবী নিবারণচন্দ্র ঘটক ও বিপ্লবী বিপিনবিহারী গাঙ্গুলি। সংগীতরসিক শিক্ষক সতীশ কাঞ্জিলালকেও এখানেই পেয়েছিলেন নজরুল। আর বন্ধু হিসেবে পেয়েছিলেন আবাল্য সঙ্গী শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়কে। দশম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ নজরুল ছিলেন ১৯১৬ সালে ক্লাসের ফার্স্টবয়। পরের বছর তাঁর ম্যাট্রিকুলেশন দেওয়ার কথা (১৯১৭)। কিন্তু সকলের অজ্ঞাতে তিনি ও বন্ধু শৈলজানন্দ সৈন্যদলে নাম লেখানোর আশায় কলকাতায় পালিয়ে আসেন। লক্ষ্য অস্ত্রচালনা শিক্ষা ও বিদেশি ইংরেজ শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করে সশস্ত্র সংগ্রামে পরাধীন ভারতকে স্বাধীন করা। শৈলজার দাদু রায়বাহাদুর মৃত্যুঞ্জয় আড়ালে হঠাৎ কলকাঠি নেড়ে তাঁকে অন্ডালে নিয়ে যান। বন্ধুকে রেখে বাধ্য হয়ে নজরুল একা জুলাই ১৯১৭ সালে সৈন্যবাহিনীতে যোগ দিয়ে ট্রেনিং শেষে নৌশেরায় বেঙ্গলি ডবল কোম্পানি অর্থাৎ ৪৯নং বেঙ্গলি রেজিমেন্টে সৈনিক হিসেবে যোগ দেন। ১৯২০ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর কবি প্রথমে জানুয়ারি মাসে এসে পরে মার্চ মাসে পাকাপাকিভাবে কলকাতায় প্রত্যাবর্তন করেন।
এভাবে প্রথম জীবনের অর্ধাংশ অর্থাৎ ২১ বছর কবি সর্বত্র ছুটে বেড়িয়েছেন। অর্থাৎ চুরুলিয়া থেকে নানা জায়গায় লেটো গানের সঙ্গী হয়ে মাঝেমধ্যে, এখানে-ওখানে কাজ ও অন্তত মোট পাঁচটি স্কুলে প্রায় বছর দশেক লেখাপড়ার টানে তিনি ছুটে বেড়িয়েছিলেন। কখনো মঙ্গলকোট, কখনো ময়মনসিংহ এবং কখনো ফের শিয়ারসোল স্কুলে। স্কুলের ফার্স্টবয় হয়েও ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় প্রি-টেস্ট পরীক্ষার পর তাঁর ফাইনালে আর বসা হয়ে ওঠেনি। কবিমনের অস্থিরতা, চঞ্চলতা ও আত্মভোলা স্বভাবের কারণে তাঁকে আজীবন ছুটেই বেড়াতে হয়েছে।

দুই
যৌবনে কলকাতায় বসবাসকল্পে পা ফেলেন কবি সৈন্যবাহিনী ছেড়ে এসে ১৯২০ সালের গোড়ায়।
লক্ষণীয়, প্রথম পর্বে চুরুলিয়া, রানীগঞ্জ, মাথরুণ, অন্ডাল, আসানসোল ও করাচির সেনানিবাসে বছর বারো কেটেছিল।
কিন্তু কলকাতায় আসার পর জীবনের দ্বিতীয় পর্বে সুস্থাবস্থায় অর্থাৎ ১৯২০ থেকে ১৯৪২ সালের মধ্যে নজরুলকে নানা কারণে বাসাবদল করতে হয়েছে প্রায় ২৮ বার। যেমন –
১। রমাকান্ত বোস স্ট্রিট, বাদুড়বাগান, কলকাতায় কবি বাল্যসহচর শৈলজানন্দের মেসে প্রথম উঠেছিলেন। অবাঞ্ছিত অবস্থার কারণে বন্ধুর আতিথ্য সত্ত্বেও শৈলজানন্দকে না জানিয়ে নজরুল কলকাতায় তাঁর প্রথম আস্তানা ছেড়ে চলে আসেন (মার্চ, ১৯২০)।
২। ৩২ কলেজ স্ট্রিটে (কলকাতা) সঙ্গী মুজফফর আহমদের সঙ্গে বসবাস করতে শুরু করেন কবি। যোগ দেন নবযুগ পত্রিকা (প্রথম প্রকাশ ১২ জুলাই ১৯২০) সম্পাদনার কাজে। দেওঘর ভ্রমণ (ডিসেম্বর, ১৯২০)।
৩। ৪৭/১ মির্জাপুর স্ট্রিটের (বর্তমান নাম সূর্য সেন স্ট্রিট) মেসে দোতলায় একই ঘরে মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র সঙ্গে বসবাস। আলী আকবরের সঙ্গে হঠাৎ সেখান থেকেই কুমিল্লার কান্দিরপাড় গমন ও দৌলতপুর সফর (মার্চ-এপ্রিল ১৯২১)।
৪। মার্কুইস লেন, কলকাতা।
৫। ৬ টার্নার স্ট্রিট, তালতলা, কলকাতা (নবযুগ প্রকাশনা পর্বে)। সঙ্গী মুজফফর আহমদ।
৬। ৮/এ টার্নার স্ট্রিট (নবাব আবদুর রহমান স্ট্রিট, নবযুগ প্রকাশনা পর্ব)। সঙ্গী মুজফফর আহমদ।
৭। দেওঘর (বিহার) সাঁওতাল পরগণা। স্বাস্থ্যোদ্ধারের উদ্দেশ্যে গমন ও বিশ্রাম। উঠেছিলেন ব্যবসায় বাণিজ্য পত্রিকার সম্পাদক শচীন্দ্র বসুর বাড়িতে। পরে কলকাতার কার্তিক বোসের দেওঘরস্থিত স্যানাটোরিয়াম কটেজ ভাড়া করে বসবাস (ডিসেম্বর ১৯২০) করেন।
৮। ৩/৪সি তালতলা লেন, কলকাতা। এখানে বসবাসকালেই ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষদিকে মধ্যরাতে নজরুল রচনা করেন তাঁর বিখ্যাত কবিতা ‘বিদ্রোহী’। প্রথম সাক্ষী ও পাঠক : সঙ্গী মুজফফর আহমদ।
৯। ৩২ কলেজ স্ট্রিট, কলকাতা। বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির অফিসে দ্বিতীয়বার অবস্থান। এবার সঙ্গী মোহাম্মদ আফ্উজাল উল্ হক। এঁরই পিতা শান্তিপুর (জেলা : নদিয়া) নিবাসী বিখ্যাত কবি নজরুল-সুহৃদ মোজাম্মেল হক।
১০। ৭ প্রতাপ চাটুজ্জে লেন, কলকাতা। এ-বাড়িতেই নজরুল তাঁর সম্পাদিত ধূমকেতু (সাপ্তাহিক) পত্রিকাটির ঠিকানা স্থানান্তর করেছিলেন (১৯২২)। ধূমকেতু প্রথম অবশ্য প্রকাশিত হয় ৩২ কলেজ স্ট্রিট থেকে। প্রকাশক ও মুদ্রক ছিলেন আফ্জাল উল্ হক। তখন তা মেটকাফ প্রেস, কলকাতা (৭৯ বলরাম দে স্ট্রিট) থেকে প্রকাশিত হতো। প্রতাপ চাটুজ্জে লেনের বাড়িতে পুলিশ কবির খোঁজে হানা দেয় ৮ নভেম্বর ১৯২২ তারিখে। কিন্তু কবি গ্রেফতার হন ২৩ নভেম্বর কুমিল্লায়।
১১। ৬ হাজী লেন, কলকাতা। এ-বাড়িতে থেকেই কবি প্রমীলাকে বিয়ে করেছিলেন (২৫ এপ্রিল ১৯২৪)।
১২। ৮/১ পানবাগান লেন, এন্টালি, কলকাতা (দোতলায়, ১৯২৪)।
১৩। প্রথমে হুগলি বিদ্যামন্দিরে থাকবার কয়েকদিন পরে (১৯২৪) হুগলির কাঠগড়ায় খগেন ঘোষের বাড়িতে সপরিবার বসবাস। কবির প্রথম পুত্র স্বল্পায়ু কৃষ্ণ মহম্মদের (কাজী আজাদ কামাল) জন্ম।
১৪। হুগলি মোগলটুলি এলাকায় বন্ধু নবী মোক্তারের বাড়িতে বসবাস (১৯২৫) শুরু।
১৫। হুগলি চকবাজার এলাকায় বিখ্যাত ‘রোজ ভিলা’ (Rose Villa) বাড়ির একাংশে বসবাস (১৯২৫)।
১৬। কৃষ্ণনগর (নদিয়া) গোয়াড়িতে গোলাপটি এলাকায় বসবাস (৩ জানুয়ারি ১৯২৬)। দেনায় জর্জরিত অসুস্থ কবিকে বন্ধু হেমন্ত সরকার হুগলি থেকে জোর করে তাঁর শহর কৃষ্ণনগরে নিয়ে যান এবং দেনা পরিশোধের ব্যবস্থা করেন।
১৭। চাঁদ সড়ক এলাকা, কৃষ্ণনগর (নদিয়া) খ্রিষ্টান বস্তি এলাকায় কবি আর্থিক কারণে আসতে বাধ্য হন এবং বসবাস শুরু করেন (১৯২৬)। এ-বাড়িতেই কবির দ্বিতীয় পুত্র বুলবুলের (অরিন্দম খালেদ) জন্ম হয় (৯ সেপ্টেম্বর ১৯২৬)।
১৮। ১৫ জেলিয়াটোলা স্ট্রিট, কলকাতা। নলিনীকান্ত সরকারের বাড়িতে অল্প কিছুকাল কবি সপরিবারে কাটাতে সমর্থ হন।
১৯। ১১ ওয়েলেসলি স্ট্রিট, কলকাতা। এটি ছিল সওগাত পত্রিকার অফিস। সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরুদ্দীন সপরিবারে সেই বাড়িতে স্থান দিয়েছিলেন।
২০। তালতলা এলাকায় জনৈক অ্যাংলো ইন্ডিয়ানের বাড়ি। সন্তানসম্ভবা প্রমীলার কারণে সুযোগ-সুবিধাযুক্ত (privacy) একতলা (১৯২৭) বাড়িটিতে প্রয়োজনের কথা ভেবেই কবি ঠিকানা বদল করেছিলেন।
২১। ৮/১ পানবাগান লেন, কলকাতা। এখানে কবি দ্বিতীয়বার এসে ওঠেন। এখানেই তৃতীয় পুত্র সানির (কাজী সব্যসাচী) জন্ম হয় (৯ অক্টোবর ১৯২৮)।
২২। মসজিদবাড়ি স্ট্রিট, কলকাতা। এ-বাড়িতেই কবির দ্বিতীয় পুত্র বুলবুলের মাত্র চার বছর বয়সে জলবসন্ত রোগে মৃত্যু হয় (৭ মে ১৯৩০)।
২৩। গিরিশ পার্কের বাছে জেলিয়াটোলা লেন, কলকাতা। অনিরুদ্ধের জন্ম এ-বাসায় (১৯৩১)।
২৪। হরি ঘোষ স্ট্রিট, কলকাতা।
২৫। ৩৯ সীতানাথ রোড, কলকাতা (১৯৩৩)।
২৬। ৩৭/১ সীতানাথ রোড, কলকাতা। ১৯৩৬ থেকে ১৯৪১ সাল পর্যন্ত কবি এ-বাসায় সপরিবারে বসবাস করেছিলেন।
২৭। ১৫ শ্যামপুকুর স্ট্রিট, কলকাতা। ১৯৪১ সালে অল্পকালের জন্য কবি এ-বাসায় এসে ওঠেন। এখানে থাকাকালে কবির মানসিক পীড়ার লক্ষণ দেখা দিতে থাকে।
২৮। ১৫/৪ শ্যামপুকুর স্ট্রিট, কলকাতা (দোতলা বাড়ি)। এখানে আসার পর ১৯৪২ সালে কবির চাঞ্চল্য ও অস্থিরতার লক্ষণ দ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকে (১৯৪২ থেকে ১৯৫১)।
২৯। স্বাস্থ্যোদ্ধারের আশায় মধুপুরে গমন (জুলাই ১৯৪২)।
৩০। লুম্বিনী পার্ক মানসিক হাসপাতাল, কলকাতায় অবস্থান।
৩১। বজবজ, দক্ষিণ ২৪ পরগণার একটি ভাড়া বাড়িতে বসবাস।
৩২। রাঁচি ইউরোপিয়ান অ্যাসাইলাম হোমে (বিহার) ভর্তি হয়ে টানা প্রায় এক বছর চিকিৎসার জন্যে অবস্থান (১৯৫২)। চিকিৎসক ডা. ডেভিস।
৩৩। ১৬ রাজেন্দ্রলাল স্ট্রিট, কলকাতা (১৯৫২-৫৮)। এ-বাড়িতেই কাজী অনিরুদ্ধ ও কল্যাণীর বিয়ে হয়।
৩৪। চিকিৎসার্থে নজরুলকে প্রমীলা, রবিউদ্দীন ও ছোট ছেলেসহ ইয়োরোপে গিয়ে থাকতে হয়েছিল (১৯৫৩)। ১০ মে ১৯৫৩ তারিখে রওনা হয়ে কবি জাহাজে জলপথে ইংল্যান্ডে যান (১১ জুন)। পরে যান ভিয়েনায় (১০ ডিসেম্বর)। পূর্ব জার্মানির বন হয়ে সাত মাস পর কবি বিমানে কলকাতায় ফিরে আসেন (১৪ ডিসেম্বর)।
৩৫। ১৬৫/সি মন্মথ দত্ত রোড (তেতলায়) পাইকপাড়া, কলকাতা (১৯৫৯)। এ-বাড়িতে এখনো কবির পৌত্রের বসবাস (কাজী অরিন্দম)।
৩৬। সিআইটি বিল্ডিংস, ক্রিস্টোফার রোড, ব্লক-এল, ফ্ল্যাট-৪, কলকাতা (১৯৬২)। এ-বাড়ি থেকেই কবি ২৪ মে ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের অতিথি হিসেবে ঢাকায় (ধানমন্ডি) গমন করেন এবং বছর পাঁচেক অবস্থান করেন।
৩৭। অসুস্থ কবি পরে ঢাকা পিজি হাসপাতালে ভর্তি হন। কয়েক মাস পরে সেখানেই ২৯ আগস্ট ১৯৭৬ সালে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।

তিন
কবি কৈশোর থেকেই সুদূরের পিয়াসী। তাই আজীবন যেন তাঁর অন্বেষা – হেথা নয়, হেথা নয়, অন্য কোথা, অন্য কোনোখানে। তিনি অস্থির, তাই চঞ্চল। তাঁর নিজের কথায়, ‘এই বাঁধনহারা মানুষটি ঘরোয়া আঙিনা পেরিয়ে পালাতে চেষ্টা করেছে। যে নীড়ে জন্মেছে এই পলাতক, সেই নীড়কেই সে অস্বীকার করেছে সর্বপ্রথম উড়তে শিখেই। আকাশ আলো কানন ফুল, এমনি সব না-চেনা জনেরা হয়ে ওঠে তার অন্তরতম। বিশেষ করে গানের পাখি যারা, তারা চিরকাল নিরুদ্দেশ দেশের পথিক।… গানের পাখি, তাকে গানের কথাই জিজ্ঞাসা কর, নীড়ের কথা জিজ্ঞাসা করো না। নিজেই বলতে পারবে না যে, কোথায় ছিল তার নীড়।’ (বেগম শামসুন নাহার মাহমুদকে লিখিত কবির পত্র, কৃষ্ণনগর, ১১ জুন ১৯২৬)।
সত্যিই তিনি স্বভাবকবি। ভালোবাসার টানে তাঁর তাই নিরন্তর আকর্ষণ। কৈশোরবেলায় যা ছিল অচেনাকে চেনার ও জানার ব্যাকুলতা তা-ই তাঁকে তাড়া করেছে আজীবন। মাত্র বাইশ বছরের সক্রিয় সৃষ্টির ভুবনে সেই ছুটে বেড়ানো মানুষটিকে হয়তো তাই বুঝতেও ভুল হয়েছে। তাঁর মন তখন আপন মনের মাধুরীকে মেলে ধরবার তিয়াসায় মগ্ন। চেনা থেকে অচেনার পদচিহ্ন ধরে চলেছিল নজরুলের নীরব অন্বেষণ। কবিজীবনের গাঢ়, গভীর তন্নিষ্ঠ জীবনের যাত্রাপথে আজীবন সে-মানুষটি যেন অধরাই থেকে গেছে। ব্যক্তিজীবনের অনিশ্চয়তা, অভাব, অভিযোগ, সকলকে খুশি করতে চাওয়ার বিড়ম্বনা তাঁকে হজম করতে হয়েছে। সহ্য করতে হয়েছে কবিজীবনের প্রারম্ভ থেকেই অসূয়াপ্রসূত সেই অনভিপ্রেত আঘাত। আড়ালে তবু থেকে গেছে ভালোবাসার গোপন স্মৃতি। অস্থিরতার মধ্যে তিনি তখন আত্মগোপন করে বাঁচতে চেয়েছিলেন। সাফল্য তাঁকে দান করেছে প্রতিষ্ঠার মুকুট। কিন্তু বেদনা তাঁকে উপহার দিয়েছিল অস্থিরতা আর চিরন্তন অন্বেষার অহংকার, যা ছিল জীবনব্যাপী সাধনা তা অলক্ষ্যে হয়ে ওঠে তাঁরই স্বোপার্জিত পুরস্কার। বাসাবদলের কবিকে চেনা তাই বড়োই কঠিন। কবির উপলব্ধিতে –

আদি নাই, অন্ত নাই। ক্লান্তি তৃপ্তি নাই –
যত পাই তত চাই – আরো আরো চাই, –
সেই নেশা সেই মধু নাড়ি-ছেঁড়া টান
সেই কল্পলোকে নব নব অভিযান, –
(‘গোকুল নাগ’, সর্বহারা) 