কিরকমভাবে বেঁচে আছি

হরিশংকর জলদাস

পুত্র,

যেদিন ভোর সকালে ঘর থেকে বেরিয়ে আসি, তুমি তখন ঘুমিয়ে। সামনে তোমার পরীক্ষা, রাত জেগে পড়ো তুমি, গত রাতেও পড়েছ। একটু বেলা করে ঘুম থেকে  ওঠো তুমি। বেরোবার সময় ঘুমন্তই ছিলে। চিৎ হয়ে শুয়ে ছিলে, ঠোঁটটা একটু ফাঁক করা, কম্বলটাও বুক পর্যন্ত নামানো। তুমি হয়তো জানো অথবা জানো না, সূর্যের আলো ফুটলেই আমি বিছানা থেকে নেমে তোমার কাছে যাই, মশারিটা স্ট্যান্ড থেকে খুলে একপাশে রাখি, কম্বল বা চাদর, যখনই তুমি যা গায়ে দাও, গলা পর্যন্ত টেনে দিই। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকি তোমার দিকে। তারপর আমার ডান হাতটা তোমার কপালে আলতো করে ছোঁয়াই, সামান্য সময়ের জন্য। এমনভাবে রাখি যাতে তোমার ঘুম না ভাঙে। আমার মাঝে মাঝে মনে হয় আমার এই কর্মকান্ডটি তুমি উপভোগ করো, কারণ কখনো কখনো তোমার মুখমন্ডলে তৃপ্তির আভা গাঢ় হয়ে দেখা দেয়। তোমাকে ডাক্তার বানাতে চেয়েছিলাম। তুমি বলেছিলে, ‘বাবা, আমি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ব।’ তোমার সিদ্ধান্তকে মর্যাদা দিয়েছি আমি। কারণ তুমি ছাড়া আমার কোনো দ্বিতীয় পুত্র নেই।

সেদিনও আমি আমার কর্তব্যকর্ম শেষ করেছি, যথা অভ্যাসে। ওইদিন আমার কোথাও যাবার ছিল না। শুক্রবার ছিল। তোমার মাকে রাতে বলেছিলাম, ‘কাল দুপুরে ভুনা খিচুড়ি করো। ছেলেটা খাসির মাংস খেতে পছন্দ করে।’ আরো একটা আবদার করেছিলাম, ‘বড্ড লুচি খেতে ইচ্ছে করছে, যদি কষ্ট না হয় সকালের নাস্তায়…।’

আমার কথা শেষ করতে দেয়নি তোমার মা। বলেছিল, ‘সে দেখা যাবে।’

তোমার মায়ের কথাবার্তা রসকষহীন। আমি বুঝে নিয়েছিলাম – সকালের নাস্তায় লুচি হবে।

শুক্রবার দিন একটু দেরিতে শয্যা ছাড়ি। অন্যান্য দিনের সকাল সকাল শয্যা ত্যাগ করার শোধটা নিই শুক্রবারে। কিন্তু কেন জানি ওইদিন শীতসকালে অভ্যেসমতো তাড়াতাড়িই ঘুম ভেঙে গেল আমার। বিছানায় এপাশ-ওপাশ করছি হঠাৎ বারান্দায় ছড়ানো রোদের দিকে নজর পড়ল আমার। রোড পোহানোর লোভটা চাগিয়ে উঠল মনে। শৈশবের কথা মনে পড়ল আমার। দরিদ্রঘরের ছেলে আমি। সন্তান উৎপাদনে বাবা ছিল অনাধুনিক। পৌষ-মাঘ মাসের সকালে ছেঁড়াখোঁড়া জামাকাপড় গায়ে দিয়ে ভাইবোনেরা রোদের দিকে পিঠ দিয়ে বসে থাকতাম উঠানে। সেই দৃশ্য হঠাৎ মনে পড়ে গেল আমার। আমি বিছানা ছেড়ে শীতসকালের রোদেলা বারান্দার চেয়ারে গিয়ে বসলাম।

বারান্দায় গোল টি-টেবিলের দুদিকে দুটো চেয়ার। অপর চেয়ারে তোমার মা এসে বসল। কী রকম যেন রাগি রাগি চেহারা। চোখ পড়তেই ভেতরটা অাঁতকে উঠল আমার। তোমার মায়ের এরকম রাগী চেহারা ঝগড়ার পূর্বাভাস। আমি দ্রুত আমার চোখকে অতীতে ফেরালাম। আতিপাতি করে খুঁজেও রাগ করার মতো কোনো ঘটনা আমার মনে পড়ল না।

চাদর জড়িয়ে একটু কুঁজো হয়ে বসেছে তোমার মা। হঠাৎ বলল, ‘কম্বলটা ছোট। ওটা গায়ে দেওয়া যাবে না।’

দিন কয়েক আগে একটা নতুন কম্বল কিনেছিলাম। স্প্যানিশ কম্বল, তুলতুলে।

জিজ্ঞেস করলাম, ‘উপায়’।

‘শীত পড়ছে বড়। আগের কম্বলটা নামাও। ওটা বড়, ভালোও।’

বললাম, ‘ওটা তো বেশ পুরনো। রং চটে গেছে।’

‘তারপরও ওটা ভালো। নতুনটা গায়ে দেবো না।’

পুরনো কম্বলটা বহু বছর আগে আমার দুবাইনিবাসী ভাই উপহার দিয়েছিল আমাদের।

আমি বললাম, ‘নতুন কম্বলটা ভালো। দামিও।’

কেন জানি হঠাৎ করে ধমক দিলো তোমার মা, ‘আমাকে কম্বল চেনাও। ফকিরনির মাইয়া না আমি। দামি, স্পেন, ভালো – এসব কথা আমাকে বোঝাচ্ছ, বারবার!’

আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। কী কথার মধ্যে কোন কথাটি টেনে আনল তোমার মা!

তুমি হয়তো ভাবছ – এসব কথা আমি তোমাকে কেন লিখছি! তুমি ছাড়া যে দুঃখ বোঝানোর মতন আর কেউ নেই আমার। হ্যাঁ, বোন ছিল তোমার একজন। ‘ছিল’ শব্দটি সচেতনভাবেই ব্যবহার করলাম। বোন তোমার এখনো বেঁচে আছে। কিন্তু আমার কাছে সে ‘ছিল’ হয়ে গেছে। আগাপাশতলা না ভেবে একটা ইন্টারপাশ ছেলেকে ধুম করে বিয়ে করে ফেলল সে। তাকে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়তে পাঠিয়ে মস্তবড় ভুল করেছিলাম আমি। জীবিত থেকেও সে এখন আমার কাছে মৃত। তাই তোমাকে আমার কষ্টের বোঝা বইতে হবে। শুনতে হবে আমার লাঞ্ছনাময় দিবারাত্রির কাব্য।

এমএ পাশ করে একটা হাইস্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেছিলাম। প্রধান শিক্ষকের চাকরি, সাতশো টাকা বেতনের। বাবা ঠিক করল – পুত্রবধূ আনবে ঘরে। কিলবিলে সংসার আমাদের। অভাব বেশুমার। বউ এনে রাখার ঘরটি পর্যন্ত নেই। তারপরও বাবা কনে খুঁজতে বেরোল। কনের অভাব নেই গাঁয়ে-শহরে। কিন্তু দরিদ্রঘরে কে মেয়ে দেয়? শেষ পর্যন্ত একজনকে খুঁজে পেল বাবা। তিনি তাঁর একমাত্র আইএ-পড়ুয়া মেয়েকে আমার সঙ্গে বিয়ে দিতে রাজি হলেন। ভাবিশ্বশুর একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অ্যাকাউন্টেন্ড। সচ্ছল পরিবার। ইটের ঘর টিনের ছাউনি হলেও শ্বশুরবাড়িটি আমার পছন্দ হলো। কিন্তু তেমন করে পছন্দ হলো না শ্বশুরের মেয়েটিকে। মাঝারি হাইটের হাড্ডিসার মেয়েটি। শেষ পর্যন্ত তার বিপুল চুল দেখে আমার মন নড়েচড়ে বসল। আমার সঙ্গে যাওয়া কনে-দেখিয়েরা বলল, ‘দেখতে ছোটোখাট হলে কী হবে, বিপুল চুলের মাঝখানে কঁচি মুখটা কিন্তু ভীষণ পছন্দ হয়েছে আমাদের।’

তোমার মা আমাদের ঘরে এলো, তার সঙ্গে এলো প্রবল অহঙ্কার। অহঙ্কার এবং রাগ প্রায় সময় তোমার মাকে অন্ধ করে ফেলত। ব্যবহার তখন তার সংযত থাকত না। স্বাভাবিকতা আর সামাজিকতার লক্ষণরেখা সে০হেলায় অতিক্রম করত। প্রাকৃতিক নিয়মে তোমরা এলে আমাদের ঘরে, আমার জীবনে। তোমাদের পেয়ে তোমার মা বাৎসল্যে ভাসল।

তারপর আমি একটা সরকারি চাকরি পেলাম। ধীরে ধীরে পদোন্নতি হলো আমার। মা-বাবাও মারা গেল ইতোমধ্যে। আমি গ্রাম ছেড়ে তোমাদের নিয়ে শহরে ঠাঁই নিলাম। বোনদের বিয়ে হলো। ভাইয়েরা দাঁড়িয়ে গেল যার যার জায়গায়।

ও হো, তোমাকে একটা কথা লিখতে ভুলে গেছি। বিয়ের কথা যখন ঠিকঠাক, ঠিকুজি মিলানো হয়েছে, বিয়ের দিন-তারিখ-লগ্ন ঠিক করা হয়ে গেছে, উভয়পক্ষ থেকে নিমন্ত্রণকার্ডও বিলি করা সমাপ্তির পথে, একদিন আমার সঙ্গে শ্বশুরমশাই দেখা করতে এলেন আমার স্কুলে। স্কুল তখন ছুটি হয়ে গেছে, ছাত্র-শিক্ষক চলে গেছেন। আমি যাবার প্রস্ত্ততি নিচ্ছি, ওই সময় আমার কক্ষের সামনে শ্বশুরকে দেখে বেশ অবাকই হয়েছিলাম আমি। বিয়েটা কি ভেঙে দিতে এসেছেন তিনি? চেয়ারে বসতে দিয়ে ভয়ে ভয়ে তাকালাম তাঁর দিকে। তিনি ভূমিকা ছাড়া বললেন, ‘তোমাকে একটা কথা বলতে এলাম বাবা, তোমাকে ডেকেও বলতে পারতাম। ভাবলাম – দুর্বলতা যখন আমার, আমারই আসা উচিত তোমার কাছে। তাই এলাম।’ তারপর এদিক-ওদিক তাকিয়ে মৃদুস্বরে বললেন, ‘মেয়েটি কিন্তু আমাদের না।’

আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না। বোকা চেহারা নিয়ে তাকিয়ে থাকলাম তাঁর দিকে। তিনি অদ্ভুত মায়াবি কণ্ঠে বললেন, ‘আমরা নিঃসন্তান। বিয়ের অনেক বছর পরও যখন আমাদের ঘরে সন্তান এলো না, তখন ঠিক করলাম দত্তক নেব। ছেলেও নিতে পারতাম। কিন্তু আমাদের বিশ্বাস জন্মাল, মেয়েই আমাদের বাৎসল্যকে পূর্ণতা দিতে পারবে। তাই সাত মাস বয়সে ওকে আমরা দত্তক নিলাম। একদিন না একদিন কথাটা প্রচার পাবে। তখন তুমি বিষয়টা মেনে নাও নিতে পারো। তখন তোমার চোখে আমরা দোষী সাব্যস্ত হব।’ বলে চুপ করে গেলেন তিনি।

আমি তাঁর দিকে সোজা চোখে তাকালাম। দেখলাম তাঁর কালো কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। আমি স্পষ্ট গলায় বললাম, আপনি হয়তো ভেবেছেন, এ-কথা শুনে আমি এ-বিয়েটা ভেঙে দেবো।’ তাঁর দিক থেকে চোখ সরিয়ে বললাম, ‘আমার কাছে মানুষ বড়।’

তিনি লম্বা একটা শ্বাস ফেললেন। দেখে মনে হলো – ভারী একটা জগদ্দল পাথর তাঁর বুক থেকে সরে গেল। তারপর অনুনয়ের কণ্ঠে বললেন, ‘তুমি যখন সাহসই দিলে বাবা, তাহলে তোমাকে একটা অনুরোধ করি – তুমি, কখনো আমার মেয়েটিকে ব্যাপারটি নিয়ে আঘাত দিও না।’

আমি ধীরে ধীরে মাথাটা ডানদিকে কাত করেছিলাম।

এই-ই তোমাদের মায়ের অতীত গল্প। এই গল্প এতদিন অকথিত ছিল।

যা-ই হোক, চাকরিতে উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে আমাদের আসবাবপত্র, জামাকাপড়, চালচলনের পরিবর্তন হতে লাগল। তোমরা স্কুল-কলেজে যাতায়াত শুরু করলে। তোমার মা নিজের চুল, আঙুল, অবয়ব, পায়ের পাতা – এসবের দিকে মনোযোগ দিলো। ঘরে দুজন কাজের মেয়ে। একজন ফ্ল্যাটটি ঝোড়েঝুড়ে মুছে দিয়ে যায় প্রতিদিন। অন্যজন তোমার মায়ের ব্যসনে সহায়তা করে। অভাবে পরিবারের মানুষজনদের মধ্যে সংহতি বাড়ে, ভালোবাসা গাঢ় থাকে, প্রাচুর্য মানুষকে অপথে পরিচালিত করে, কুচিন্তায় মগ্ন করে। কারণ তার হাতে তখন প্রচুর সময়। সময় – প্রাচুর্য তাকে বাজে চিন্তায় প্ররোচিত করে।

তোমার মা চাকরি করে না, চারপাশে ঐশ্বর্য। তোমার মা বাজে চিন্তায় মগ্ন হলো। অফিসের বড় কর্মকর্তা আমি। সকাল থেকে বিকেল, কখনো কখনো সন্ধে পর্যন্ত অফিসে সময় দিতে হয় আমাকে। অফিসে সুন্দরী-অসুন্দরী নারীরাও নানা পদে চাকরি করে। একটা অফিস তো শুধু পুরুষ দিয়ে চলে না! ওই নারীরাই আমার দাম্পত্যজীবনে বিঘ্নের কারণ হলো। তুমি ভাবছ – তোমার বাবা বুঝি ওই নারীদের নিয়ে ফুর্তিফার্তিতে মেতে উঠেছে। খুব ছোটবেলা থেকে আমার বাপকে দেখে এসেছি – মাঝেমধ্যে বউ পেটাচ্ছে, কিন্তু ভালোবাসার সময় কোনো খামতি দেখিনি বাপের মধ্যে। মায়ের কপালের ডানদিকে পোড়া একটা দাগ ছিল। কখনো ওই পোড়াদাগের জন্য মাকে অপমান করতে দেখিনি বাপকে। অভাবের সংসারে বিপুলসংখ্যক ভাইবোনকে খাইয়ে তারপর মা-বাবা খেতে বসত। তখন বেঁচে-যাওয়া এক টুকরা মাছ পরস্পরকে সাধাসাধি করত তারা। শেষ পর্যন্ত ওই মাছের টুকরাটি মাকে খাইয়ে ছাড়ত বাবা। স্ত্রীকে গভীরভাবে ভালো না বাসলে কি কেউ এরকম করে?

আমিও সেই বাপের সন্তান। তোমার মায়ের প্রতি আমি একনিষ্ঠ। কখনো তোমার মাকে আমি প্রতারিত করিনি। অফিসের নারী-পুরুষ সবাই আমাকে খুব শ্রদ্ধা করে। আমি কিন্তু তোমার মাকে বিষয়টি বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছি। কেউ যদি আগে থেকেই কোনো একটা বিষয়কে তার বিশ্বাসের ভিত্তিমূলে সুদৃঢ়ভাবে গেঁথে নেয়, তাহলে তার কাছে সব যুক্তি বা প্রমাণ অগ্রাহ্য হয়।

তোমার মায়ের মনে এ-বিশ্বাসটা প্রোথিত হয়ে গেল যে, আমি আগে চরিত্রবান থাকলেও এখন একেবারে পচে গেছি। অফিসের নারীদের নিয়ে আমি কৃষ্ণলীলায় মগ্ন। অফিস থেকে দেরি করে আসি শুধু ওদের নিয়ে বেলেল্লাপনায় মগ্ন থাকি বলে। আমি কোনোক্রমেই তাকে বোঝাতে পারিনি – আমি যে-অফিসে চাকরি করি তা বিশাল এক শিপিং করপোরেশনের অফিস। আমি সে-অফিসের অধিকর্তা। এই ধরনের অফিসের কোনো টাইমটেবিল নেই। কাজ শেষ না করে বড়কর্তার অফিস ছাড়তে নেই।

তোমার মা আমার সকল যুক্তি ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেয়। বেঁকা হাসি ছড়িয়ে দেয় সারা মুখে। আমি অপমানে জরজর হই। কথার পিঠে কথা লাগিয়ে সাধারণ প্রসঙ্গকে বিপুলাকার দিতে তোমার মায়ের জুড়ি নেই। তাই আমি চুপ করে থাকি। অপমানের হাত থেকে বাঁচার জন্য অন্য ঘরে যাই। চুপ থাকায় এবং অন্য ঘরে যাওয়ায় তোমার মায়ের সন্দেহ আরো নখদন্ত বিস্তার করে। আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলে, ‘চুপ থাকবে না! মাগিখোরের আবার কথা বলার সাহস আছে নাকি? অন্য ঘরে যাবেই তো, যদি ঠোঁটের গালের লিপস্টিকের দাগ আমি দেখে ফেলি।’

কোনো কোনো সন্ধ্যায় ঘরে টিকতে না পেরে বেরিয়ে পড়ি। দুচোখ যেদিক যায় হাঁটার জন্য। দরজা খুলে সিঁড়িতে পা দিতেই পেছন থেকে গর্জে ওঠে তোমার মা, ‘যাবেই তো। বাইরে তো মেয়ের অভাব নেই। কী জানি অফিসের কোনো মাগি রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে হয়তো।’ মাথা নিচু করে ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে পড়ি। সেই সময় আমার দুচোখ কি জলে ভরে ওঠে? জানি না।

এক বিকেলে তোমার মায়ের মন বেশ ফুরফুরে দেখলাম। সাজগোজ করছিল, মুখে ‘আমার মল্লিকা বনে’। আমি আলতো করে ড্রেসিংটেবিলের পাশে বসলাম। তোমার মা কৌতুকী চোখ তুলে তাকাল আমার দিকে। আমার সাহস বেড়ে গেল। বললাম, ‘তোমাকে একটা কথা বলতে চাই?’ তোমার মায়ের চোখে মুখে প্রশ্নবোধক চিহ্ন। আমি বললাম, ‘আমাকে নিয়ে তোমার অনেক অশান্তি।’

‘মানে!’ ভ্রু কুঁচকে তোমার মা আমার দিকে ফিরে তাকাল।

বললাম, ‘তোমার মনের সন্দেহ আমাদের দাম্পত্য জীবনের সুখটা নষ্ট করছে। তুমি এক কাজ করো, একদিন, যখন তোমার ইচ্ছে, আমাকে না জানিয়ে আমার অফিসে চলে এসো। তোমার সকল সন্দেহ ঘুচে যাবে।’

এবার গরগর করে উঠল তোমার মা, ‘আমাকে কচি খুকি পেয়েছ যে, আমি তোমার ওপর চালাকি বুঝব না। কী প্রমাণ করতে চাইছ তুমি এ-কথা বলে? ধোয়া তুলসীপাতা তুমি? ফষ্টিনষ্টি করো না?’ তারপর চোখ পাকিয়ে আরো বলল, ‘ওইসব বাজারে মাগিদের কোলে বসিয়ে রাখো না তুমি?’

তখন আমার চিৎকার করে সীতার মতো বলতে ইচ্ছে করছে, ‘ধরণি দীর্ণ হও, আমি পাতালে প্রবেশ করি।’ মাথা হেঁট করে আমি ড্রেসিংটেবিলের পাশ থেকে সরে আসি।

এসব যন্ত্রণা-অপমান আমি দিনের পর দিন সহ্য করেছি। ওপাশের ফ্ল্যাটের মানুষরা আমার দিকে বিশেষ চোখে তাকাতে শুরু করেছে। ও ফ্ল্যাটের মহিলার সঙ্গে তোমার মায়ের খুব খাতির।

মাথা নিচু করে সকালে ঘর থেকে বেরোই, চোখ বন্ধ করে বিকেলে ঘরে ঢুকি। এইভাবেও যদি আমার জীবনটা চলত তাহলেও আমি বর্তে যেতাম। কিন্তু তোমার মা সেভাবেও চলতে দিলো না আমাকে।

একদিন অফিস থেকে ফিরে গায়ের জামাজোড়া ময়লাকাপড়ের বাস্কেটে খুলে রাখলাম। তিনদিন পরা প্যান্ট-শার্ট ময়লা হয়ে গিয়েছিল। বুয়া জমানো কাপড় সপ্তাহে দুবার ধুয়ে দেয়। বাথরুম থেকে ফিরে দেখলাম – তোমার মা আমার ছেড়ে দেওয়া প্যান্টের সামনের দিকের বিশেষ একটি অংশে কী যেন আতিপাতি করে খুঁজছে। আর বারবার নাকের কাছে প্যান্টের ওই অংশটি এনে বিশেষ কিছু একটার ঘ্রাণ পেতে চাইছে।

অপমানে আমার মাথা ঝিম ঝিম করে উঠল। চোখ নিকষ আঁধারে ভরে গেল আমার। আমি নিথর শরীর নিয়ে দেয়াল ধরে দাঁড়িয়ে থাকলাম।

এইভাবে আমি বেঁচে আছি পুত্র। আমার ব্যক্তিত্ব ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। আমার জীবন তছনছ হয়ে গেছে। তোমার মায়ের প্রতি আমার প্রেম শ্রদ্ধা সব কোথায় উবে গেছে। আমার চারপাশে সবাই আছে, তারপরও আমার মনে হয় এই সংসারে আমি একা, বড্ড একা। মাঝেমধ্যে তোমাকে বোঝাতে চেয়েছি, বুঝিয়ে বুক থেকে বেদনার ভার কমাতে চেয়েছি; কিন্তু তুমি তেমন করে আমল দাওনি আমাকে।

আজ সকালের কথাই ধরো। তোমার মা যখন আমাকে চূর্ণবিচূর্ণ করছিল তার অশালীন কথাবার্তায়, আমি থরথর করে কাঁপছিলাম। নিরুপায় হয়ে তোমার কাছে গেলাম, তোমার সাহায্য প্রার্থনা করলাম। ঘুমের ঘোরে কিনা জানি না, তুমি বললে, ‘শেষ রাতে ঘুমিয়েছি বাবা, একটু ঘুমাতে দাও। তোমাদের ব্যাপার তোমরা মিটাও।’

অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম আমি তোমার শয্যাপাশে। তারপর তোমার মাথায় হাত বুলিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলাম। ওইসময় তোমার মা বাথরুমে।

শুধুমাত্র মানিব্যাগটা নিয়েছি সঙ্গে। মোবাইল সঙ্গে নেওয়া প্রয়োজন বোধ করিনি।

এত সকালের রাস্তায় দাঁড়িয়ে আমি কিংকতর্ব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লাম। এখন কোথায় যাব আমি? আমার জন্মগাঁয়ের কথা মনে পড়ল।

বাসে উঠে পড়লাম আমি। বিশ কিলোমিটারের রাস্তা যেন হঠাৎ করেই ফুরিয়ে গেল। ভাইয়েরা আমাকে দেখে অবাকই হলো,  ‘দাদা, তুমি! কোনো বিপদ আপদ হয়নি তো?’

আমি ম্লান হেসে বলি, ‘না না, তোরা ভাবিস না। মন চাইল চলে এলাম। বসতে তো দে অন্তত।’

সবার ছোট ভাইটি পরম যত্নে আমাকে তার ঘরে নিয়ে গেল।

তিনদিন কাটিয়ে দিলাম। মনস্থির করেছি, ‘ফ্ল্যাটে আর ফিরব না। কিছুতেই না।’

ভাইয়েরা কী চোখাচোখি করছে? যে-দাদা একদিনের জন্য আসার সময় পায় না, তিনদিন কাটিয়ে দিলো! ঘটনা কি! আমি বুঝতে পারি। বুঝতে পারি বলেই এক বিকেলে বেরিয়ে পড়ি। আসবার সময় বলি, ‘ভালো থাকিস তোরা সব।’

প্রাচীনকালে মানুষরা বানপ্রস্থে যেত। গার্হস্থ্যজীবনে যখন পূর্ণতা আসত, পুত্ররা সংসারের হাল ধরার মতো যোগ্যতা অর্জন করত, তখন প্রবীণরা ভাবত – আমাদের দিন শেষ। এবার বানপ্রস্থে যাওয়ার পালা। তখন তারা কাম-ক্রোধ-মোহ ভুলে এক কাপড়ে বেরিয়ে পড়ত। পেছনে ফিরে তাকাত না। আমারও অকালে বানপ্রস্থে যাবার সময় এসে গেল।

কিন্তু আমার যে কামনা পূরণ হয়নি, পুত্র সংসারে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। আমার কি সংসার ত্যাগ করা উচিত! এই সময় তোমার মায়ের কথা মনে পড়ল। তোমার মায়ের না-হয় মান-অপমানবোধ নেই, আমার তো আছে। আমার সমাজ আছে, সমাজে মান্যতা আছে। গৃহকোণের নিত্যদিনের অপমান একদিন রাজপথে চলে আসবে। তখন মুখ লুকাবার জায়গা খুঁজে পাব না। তার চেয়ে এই-ই ভালো। বানপ্রস্থ। সংসার ত্যাগ। বহুদিন তো সং সেজে থাকলাম, এবার না-হয় সারের সন্ধানে বেরিয়ে পড়ি।

রেলস্টেশনে বসে বসে তোমাকে এ-চিঠি লিখছি। সামনে ট্রেন দাঁড়িয়ে আছে। এর গন্তব্য কোথায় জানি না। জানার আগ্রহও নেই আমার। জেনে লাভ কী! আমারও যে গন্তব্য নেই। চিঠিটি ডাকবাক্সে ফেলে উঠে পড়ব ট্রেনে। তারপর? তারপর কী হবে তা তো আমার জানা নেই।

 

ইতি

তোমার বাবা