কিলিমান্জারোর বরফপুঞ্জ

 

মূল : আর্নেস্ট হেমিংওয়ে

অনুবাদ : হাসান আজিজুল হক

 

বরফাচ্ছাদিত কিলিমান্জারোর উচ্চতা ১৯,৭১০ মিটার। এটাই আফ্রিকার সর্বোচ্চ পর্বত। এর পশ্চিম শৃঙ্গটিকে বলা হয় মাসাই এন্ গাই – ঈশ্বরের প্রাসাদ। পশ্চিম শৃঙ্গের কাছে শুকনো জমাটবাঁধা একটি চিতাবাঘের কঙ্কাল রয়েছে। অত উঁচুতে এই চিতাবাঘটি কী খুঁজছিল তা কেউ ব্যাখ্যা করেনি।

আশ্চর্য কথা কি জানো? এটা একেবারেই যন্ত্রণাহীন। এমন হলেই তুমি জানতে পারবে শুরু হয়ে গিয়েছে।

সত্যিই তাই?

একেবারে একশ ভাগ তাই। অবশ্য এই অসহ দুর্গন্ধটার জন্য আমি খুবই দুঃখিত।

বলো না, দয়া করে বলো না।

এদিকে চেয়ে দেখ। এই ঘা, না এই দুর্গন্ধ, কোনটার জন্য এই অবস্থা?

যে-খাটিয়ায় মানুষটা শুয়ে ছিল, সেটা বড় একটা মিমোসা গাছের নিচের ঘন ছায়ায় রাখা ছিল। সেখান থেকে সে দেখতে পেল, ছায়ার সীমানার বাইরে রোদ-জ্বলা মাঠের মতো জায়গাটায় তিনটি কুৎসিত শকুন বসে রয়েছে। আকাশেও এক ডজন ঘুরপাক খাচ্ছে। তাদের ছায়াও তাদের মতো মাটিতে ঘুরপাক খাচ্ছে।

যেদিন ট্রাকটা বিকল হলো, সেদিন থেকেই ওরা এখানে রয়েছে। আজকেই এই প্রথম দেখছি তাদের মধ্যে একটি মাটিতে নেমে এসেছে। আমি লক্ষ করেছি যেভাবে তারা সতর্কতার সঙ্গে উড়ে বেড়াচ্ছিল, আর সাবধানতার সঙ্গে নিচে নেমে আসছিল তাতে আমি ভেবেছিলাম, ওদেরকে নিয়ে একটা গল্প লিখি।

হাস্যকর চিন্তা। এটা নিয়ে চিন্তা না করাই ভালো।

আহা, আমি বলার জন্যই বলছি। কথা বলা সহজ। যদি কথা বলি, তাতে ব্যাপারটা একটু সহজ হয়ে আসে। সেই জন্যেই বলা। আমি কিন্তু তোমাকে বিরক্ত করতে চাই না।

তুমি তো ভালো করেই জানো আমি কখনোই বিরক্ত হই না। আমি শুধু বেশি নার্ভাস হয়ে গিয়েছি, কিছুই করতে পারছি না। আমার একটাই ভাবনা, উড়োজাহাজটি আমাদেরকে এখান থেকে নিয়ে যেতে না আসা পর্যন্ত তোমাকে যেন সুস্থ রাখতে পারি। তুমি দয়া করে বলো, আমি তোমার জন্য কী করতে পারি। নিশ্চয় আমার কিছু করার আছে।

তুমি আমার এই পা-টাকে কেটে ফেলতে পারো। তাহলে আমার আর যন্ত্রণা থাকবে না, যদিও তাতেও আমার সন্দেহ। অথবা তুমি আমাকে গুলি করে মেরে ফেলতে পারো। তুমি তো লক্ষ্যভেদে
ভালোই, অব্যর্থ গুলি করতে পারো। আমিই তোমাকে গুলি করতে শিখিয়েছিলাম, শেখাইনি?

দয়া করে ওভাবে বলো না। আচ্ছা, আমি কি তোমাকে কিছু পড়ে শোনাতে পারি?

কী পড়বে?

এই আমাদের ব্যাগের মধ্যে যা আছে তার মধ্যে থেকে কিছু একটা।

আমার শোনার ধৈর্য নেই। তার চেয়ে কথা বলা অনেক সহজ। বরং এসো আমরা ঝগড়া করি। তাতেও সময় কেটে যাবে।

না, আমি ঝগড়া করি না। আমরা যেন কখনোই ঝগড়া না করি। যত নার্ভাসই আমরা হয়ে যাই না কেন। হতে পারে আরেকটা ট্রাক আজকেই এসে পড়বে, হতে পারে আমাদের জন্য একটা  উড়োজাহাজ আসবে।

আমি নড়তে চাই না। একমাত্র তোমাকে দায়মুক্তি দেওয়া ছাড়া এখান থেকে নড়াচড়া করার আর কোনো উদ্দেশ্য থাকতে পারে না।

না, এটা তুমি খুব কাপুরুষের মতো কথা বলেছো।

আচ্ছা, একটা লোক নিশ্চিন্ত মনে মরতেও পারবে না? তখনো তাকে কথা শোনাবে? এত বকাঝকা করার দরকার কি!

তুমি মরবে না।

আমাকে এমন করে এত কথা বলার কি কোনো দরকার আছে?

বোকার মতো কথা বলো না তো। আমি কিছুক্ষণের মধ্যেই মারা যাব। ওই বেজন্মা শকুনগুলোকে জিজ্ঞেস করো।

মাঠের যেখানে নোংরা শকুনগুলো বসে আছে, সে সেদিকে চাইলো। তাদের ছোলা মাথা, আর ঘাড়টা প্রায় ডানার ভিতর গুঁজে রাখা।

ওই দেখ আর একটা এসেছে। মাটিতে পড়েই বেশ খানিকটা দৌড়ে যাবে, তারপর আসেত্ম আসেত্ম অন্যদের সঙ্গে গিয়ে মিশবে।

আহা, এরা তো প্রত্যেক ক্যাম্পের চারপাশেই আছে। তুমি কখনোই এদের লক্ষ করো না, করার কিছু নেইও। কথা হচ্ছে তুমি যদি নিজেই আশা ছেড়ে না দাও, তাহলে তুমি মরতে পারো না।

এটা আবার তুমি কোথায় পড়লে? তোমার মতো এরকম   নির্বোধ-গাধা আর দেখা যায় না।

তুমি বরং অন্য কারো কথা নিয়ে ভাবতে পারো।

যিশুর দিব্যি, এই ভাবাটাই হচ্ছে আমার পেশা।

কিছুক্ষণ সে চুপ করে শুয়ে থাকলো, দেখলো সমতল ফাঁকা জায়গাটায় চোখ ধাঁধানো তীব্র রোদ একেবারে জঙ্গলের কিনারা পর্যন্ত পৌঁছেছে। সামনে কতকগুলো বড় হরিণ দেখা যাচ্ছিল। তবে তারা এতটাই দূরে ছিল যে, তাদের জঙ্গলের হলুদ রঙের পাশে ধবধবে সাদা দেখাচ্ছিল। আরো খানিকটা দূরে একদল জেব্রা দেখা গেল। সবুজ জঙ্গলের পাশে তাদের বেশ সাদা দেখাচ্ছিল। বেশ আরামদায়ক, মন প্রফুলস্নকর একটা ক্যাম্প এটা। এই ক্যাম্পের চারপাশে বড়-বড় গাছ রয়েছে, পাহাড়ের গায়ে হেলান দিয়ে রয়েছে যেন। মিষ্টি জল রয়েছে এখানে, সামান্য দূরে শুকনো একটা জলের গর্ত। সকালে ওখান থেকেই গুড়ুলে পাখিগুলো উড়ে যায়।

তুমি কি চাও না আমি তোমাকে কিছু পড়ে শোনাই? মহিলাটি তখন তার বিছানার পাশে ক্যানভাসের চেয়ারে বসেছিল, বেশ বাতাস ছেড়েছে কিন্তু।

না, না, তোমাকে কিছু পড়ে শোনাতে হবে না।

হতে পারে ট্রাক আজকেই আসবে।

দেখ, এই ট্রাক-ফ্রাক নিয়ে আমি এখন একটুও ভাবব না।

তুমি ভাববে না, কিন্তু আমি ভাবব।

তুমি অনেক কিছু নিয়েই ভাবনা করো, যার কোনোকিছু নিয়েই আমার মাথাব্যথা নেই।

না, না, হ্যারি অনেক কিছু নয়।

আচ্ছা, একটু হুইস্কি খেলে কেমন হয় হেলেন?

এটা বোধহয় তোমার জন্য ভালো হবে না। এই সময়টায় অ্যালকোহল বাদ দেওয়াই দরকার।

মোলো। হ্যারি চিৎকার দিয়ে উঠল।

বলুন সাহেব।

যাও, হুইস্কি আর সোডা নিয়ে এসো।

এখনি আনছি সাহেব।

তোমার পক্ষে উচিত নয়। ছেড়ে দাও বলতে আমি এইটাই বলতে চেয়েছিলাম। সত্যিই এটা তোমার জন্য খারাপ। আমি জানি এটা তোমার জন্য খারাপ।

না, এটা আমার জন্য ভালো।

সে চিন্তা করল, এখন আর সে কোনো কিছুই শেষ করার সুযোগ পাবে না। তাহলে একপাত্র পানীয় নিয়ে কথাকাটাকাটিতেই সবকিছুর অবসান হলো! তার ডান পায়ে গ্যাংগ্রিন শুরু হওয়ার পর থেকে আর কোনো ব্যথা নেই। ব্যথাও যেমন চলে গেছে, তেমনি ভয়ংকর ভীতিটাও চলে গেছে। এখন সে শুধু ক্লান্ত। আর প্রচ- ক্রুদ্ধ এইভাবে তার সবকিছু শেষ হয়ে গেল বলে। কাজেই এখন যা কিছু ঘটতে যাচ্ছিল সে-বিষয়ে তার সামান্যই কৌতূহল আছে। বছরের পর বছর মৃত্যুচিন্তা তাকে আতঙ্কগ্রস্ত রাখত। এখন আর কোনো কিছুতেই কিছু এসে-যায় না। কি অদ্ভুত যে, এত সহজেই ক্লান্ত হয়ে ওঠা যায়! সে আর কখনোই যা-যা লিখতে চেয়েছিল, লিখবে না। এখন সে জানে, খুব ভালো-করে না-জেনে যে লেখাগুলো পরে লিখবে বলে রেখে দিয়েছিল, সে আর কোনোদিনই সেসব লিখতে পারবে না। এমনকি লেখার চেষ্টা করে ব্যর্থ হওয়ার সুযোগও সে আর পাবে না। হতে পারে তুমি এগুলো আর কখনোই লিখতে পারবে না। এর কারণ হচ্ছে, পরে লিখবে বলে রেখে দিয়েছিলে, লেখা শুরু করনি। যা-ই হোক, সে আর কোনোদিন লিখতে পারবে না। কেন তা সে আর জানে না, জানবেও না কোনোদিন।

আমার এখন মনে হচ্ছে, আমরা যদি এখানে আদৌ না    আসতাম, হেলেন বলল। হাতে পানীয়ের গস্নাসটি নিয়ে সে নিজের ঠোঁট কামড়ে ধরে তার দিকে চেয়েছিল।

দেখ, যদি প্যারিস হতো তাহলে তোমার এসব কিছুই হতো না। তুমি চিরকাল বলে এসেছ প্যারিস তুমি ভালোবাস। সেখানে আমরা দুজন একসাথে থাকতে পারতাম, যেখানে খুশি যেতে পারতাম। তোমার সঙ্গে আমিও যেখানে খুশি যেতে পারতাম। আমি বলেছিলাম, তুমি যেখানে চাইবে আমি সেখানে যেতে তৈরি আছি, তুমি যদি চাইতে, তাহলে আমরা শিকার করার জন্য হাঙ্গেরিও যেতে পারতাম আর তাতে খুশিই হতাম।

হেলেন বলল, না-না, এটা বলা তোমার ঠিক হচ্ছে না। আমার যা কিছু আছে তার সবই আমাদের। সব ছেড়ে দিয়েছি, আমি সব ছেড়ে এসেছি, তুমি যেখানে যেতে চেয়েছিলে সেখানেই গিয়েছি এবং তুমি আমাকে যা করতে বলেছিলে আমি তা-ই করেছি। কিন্তু এখানে না এলেই ভালো হতো।

কেন? তুমি যে বলেছিলে এখানে আসতে ভালোবাসো।

সেটা বলেছিলাম যখন তুমি সম্পূর্ণ সুস্থ ছিলে। এখন আমার খুবই বিতৃষ্ণা বোধ হচ্ছে যে এখানে এসেছি। জানি না, কী কারণে তোমার পায়ের এরকম দশা হবে! আমরা কী এমন করেছি যে তোমার এরকম হতে হবে?

যখন আমি ওটাকে জোরে জোরে চুলকেছিলাম আমার মনে হয়, তখন আমি ওর ওপর আয়োডিন দিতে ভুলে গিয়েছিলাম। তারপর ওটার দিকে আমি আর কোনো মনোযোগ দিইনি। কারণ আমার কখনোই ইনফেকশন হয় না। তারপরে এটা যখন খারাপ হয়ে গেল তখন সম্ভবত নষ্ট হয়ে যাওয়া কার্বলিক সলিউশন  ব্যবহার করেছিলাম। অন্যসব সংক্রমণবিরোধী ওষুধগুলো ততদিনে শেষ হয়ে গিয়েছিল। সূক্ষ্ম-সূক্ষ্ম রক্তবাহী নালিগুলো অবশ হয়ে গিয়েছিল। আর তাতেই গ্যাংগ্রিন শুরু হলো। হ্যারি হেলেনের দিকে তাকাল। এছাড়া আর কী বলো!

এই আর কী!

আমি ও-কথা বলতে চাইনি। যদি আমরা একটা ভালো মিস্ত্রি সঙ্গে করে আনতাম, একজন অপটু কিক্যুইকে ড্রাইভারকে না এনে। সে তাহলে তেলটা পরীক্ষা করতে পারত আর কিছুতেই ট্রাকের বিয়ারিংটা পুড়ে যেতে দিত না।

না, না, আমি সেটাও বলতে চাইনি।

তুমি যদি তোমার আত্মীয়স্বজনকে ছেড়ে না আসতে, তোমার ওই হতচ্ছাড়া জায়গাগুলো ওয়েস্টবেরি, সারাটোগা, পামবিচ। আমাকে সঙ্গ দেওয়ার জন্যে এদেরকে ছেড়ে যদি না আসতে।

কেন? আমি তো তোমাকে ভালোবাসি। তুমি ওরকম বলো না। ওটা বলা তোমার উচিত হচ্ছে না। আমি তোমাকে ভালোবাসি, এখনো ভালোবাসি। চিরকাল তোমাকে ভালোবাসবো। তুমি কি আমাকে ভালোবাসো না?

না, লোকটি বলল, আমার তা মনে হয় না। আমি কোনোদিনই তোমাকে ভালোবাসিনি।

হ্যারি, এসব তুমি কী বলছ? তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে?

না, মাথা খারাপ হওয়ার জন্য কোনো মাথাই আমার নেই।

ওইটা আর খেয়ো না, মদটুকু আর খেয়ো না। দয়া করে খেয়ো না। যা কিছু আমরা করতে পারি তোমাকে ঠিক করার জন্যে তা আমাদের করতে হবে।

তাহলে তুমিই তা করো, আমি ক্লান্ত।

এখন সে তার মনের চোখে দেখল কারাগাছ রেলস্টেশনে দাঁড়িয়ে আছে। তার বগলে নিজের কাপড়চোপড়ের একটা ব্যাগ, ওই যে দেখা যাচ্ছে অন্ধকার ভেদ করে সিমুলন হেডলাইট এগিয়ে আসছে। সেনাবাহিনীর পশ্চাদপসরণের পরে সে এখন থেস ছেড়ে চলে যাচ্ছে। যা কিছু লিখতে হবে বলে সে মনের মধ্যে ভেবে রেখেছে, এটা তার একটা। সে লিখবে সকালে ব্রেকফাস্টের সময়। ব্রেকফাস্ট করতে-করতে সে জানালার মধ্যে দিয়ে বাইরের দিকে চেয়ে লিখতে থাকবে। বাইরের দিকে চেয়ে সে বুলগেরিয়া পাহাড়চূড়ার ওপর বরফপুঞ্জ দেখতে পাবে। তখন নানসেনের সেক্রেটারি বৃদ্ধ মানুষটাকে জিজ্ঞেস করছে, ‘ওটা তো বরফ, তাই না?’ বৃদ্ধ মানুষটি সেদিকে চেয়ে বলছে, না-না, ওটা বরফ না। বরফ এত আগে পড়তে শুরু করে না। তখন সেক্রেটারি অন্যান্য যুবতীর কাছে আবার বলল, তোমরা যা দেখছ ওটা বরফ নয়। আমরা বরফ বলে ভুল করেছিলাম। কিন্তু একদিক থেকে ঠিকই, বরফই এবং মানুষজন যেখানে বদলা-বদলি করে নেওয়া হচ্ছিল তাদের সেখানে পাঠিয়ে দেওয়া হলো। তারা বরফের ওপর দিয়ে হাঁটতে-হাঁটতে এগিয়ে গেল, যতদিন পর্যন্ত না তাদের সেই শীতে মৃত্যু হলো।

সমস্ত ক্রিসমাসের পুরো সপ্তাহ ধরে সেই যে বরফ পড়া শুরু হয়েছিল একেবারে গুয়ার্টাল পর্যন্ত সময়টা তারা এক কাঠুরের বাড়িতে ছিল। সামনেই ছিল একটা পোর্সিলেনের চৌকো, বড় স্টোভ এবং স্টোভটাই ঘরের অর্ধেকটা জুড়ে ছিল। তারা বিচ গাছের পাতা ভরা তোশকের ওপর শুয়ে ছিল। সেই সময় যারা সেনাবাহিনী ছেড়ে চলে এসেছিল তাদের বরফে পা ঠান্ডা আর রক্তাক্ত হয়েছিল। সে বলেছিল, পুলিশ তার ঠিক পিছনেই রয়েছে, তারা তাকে পশমি মোজা দিয়েছে আর পাহারাদার দিয়েছে। যতক্ষণ পর্যন্ত না রাস্তা পরিষ্কার হয়ে এসেছে ততক্ষণ পর্যন্ত পাহারাদার তাদের সঙ্গে কথা বলেছে। ওই ক্রিসমাসেই বরফ এত ঝকঝকে ছিল যে তা খুব চোখে লাগছিল। ওয়েনস্টুভের ভিতর দিয়ে চেয়ে দেখছিল, তাদের প্রত্যেকে গির্জা থেকে ফিরে আসছে। এটা সেই জায়গা যেখানে তারা হাঁটতে-হাঁটতে উঠে গিয়েছিল। রাস্তাটা ছিল সেস্ন­জ গাড়ির হরিণদের প্রস্রাবে হলুদ হয়ে যাওয়া সমতল একটা রাস্তা। নদীর ধার দিয়ে দীর্ঘ পাইন গাছওয়ালা পাহাড়গুলোর পাশ দিয়ে যেতে-যেতে তাদের স্কি করার জিনিসপত্র তাদের কাঁধের ওপর চেপে বসেছে। ম্যাডলেনারহচের ওপর দিয়ে
গেস্নসিয়ার ধরে স্কি করার রাস্তা নেমে গেছে। বরফ এতই মসৃণ মনে হচ্ছে যেন বরফের কেক তৈরি হয়েছে, পাউডারের মতো হালকা। আর তার মনে পড়ল সেই নিঃশব্দে দৌড়, যতক্ষণ না সে মরা পাখির মতো বরফের ওপর পড়ে গেল। তারা ম্যাডলেনারহচে পুরো একটি সপ্তাহ বরফে আটকা পড়ে ছিল। প্রচ- ঝোড়ো বাতাসের মধ্যে তারা লণ্ঠনের আলোর ধোঁয়ার ভিতর বসে তাস
খেলেছিল এবং জুয়ার দান বেড়েই যাচ্ছিল যতক্ষণ পর্যন্ত ভদ্রলোক অনেক টাকা হেরে না গেলেন। শেষ পর্যন্ত তাঁর সব টাকাই চলে গেল, সব…। স্কি করার জন্য যে টাকা ছিল আর সারাসময় ধরে তার যে-লাভ হয়েছিল, এমনকি তার  পুঁজিটাও তিনি হারালেন। সে এখন ওঁর লম্বা নাকটা দেখতে পাচ্ছে। তাড়াতাড়ি তাস তুলছে তারপর খুলে দেখাচ্ছে সাঁ ভয়ের। তখন সব সময় জুয়া খেলা চলছিল। যখন বরফ চলে গেল তখনও জুয়া খেলাই চলছিল আর জুয়ার দান দেওয়ার জন্যে তেমন কোনো টাকাই আর কারো কাছে ছিল না। সে ভেবে এসেছে যে, নিজের জীবনের বেশিরভাগ সময়ই সে বাজি রেখে কাটিয়েছে।

এসবের কোনো কিছু নিয়েই সে একটা লাইনও লেখেনি। সেই প্রচ- ঠান্ডা নিয়েও নয়। আর সেই উজ্জ্বল ক্রিসমাস নিয়েও নয়। সেই ক্রিসমাস এত উজ্জ্বল ক্রিসমাস সেটা যে,  পাহাড়গুলো সমতল ভূমির ওপারে দেখা যাচ্ছিল। অস্ট্রিয়ান অফিসাররা যখন দৌড়িয়ে ট্রেন থেকে নামছিল গার্ডনার তখন তার প্লেন নিয়ে অফিসারদের ওপর প্রবলভাবে বোমা বিস্ফোরণ ঘটাচ্ছিল। তারা যখন দৌড়িয়ে এদিক-ওদিক ছড়িয়ে পড়ছিল তখন মেশিনগান দিয়ে গুলিবৃষ্টি করছিল বলে তার মনে পড়ছে। গার্ডনার মেসে ফিরে এসে এই সব গল্প যখন করেছিল তখন কীরকম একটা নৈঃশব্দ্য নেমে এসেছিল। কে একজন চিৎকার করে উঠেছিল, তুমি বেজন্মা, ব্লাডি, খুনে। ওই একই অস্ট্রিয়ানদের তারা হত্যা করেছিল, যারা অস্ট্রিয়ানদের সঙ্গে এসে পরে স্কি করেছিল। না, ঠিক একই নয়, হ্যারি যার সঙ্গে সারাবছর স্কি করেছিল সেই হ্যান্স তখন কাজার জেগার্সের সঙ্গে ছিল। আর যখন তারা খরগোশ শিকার করছিল একসঙ্গে পাহাড়ের উপত্যকার এখানে-সেখানে, কাঠ চেরাই করার মিলের ওপরের দিকে, তখন তারা পাসিবিওতে যে-যুদ্ধ হয়েছিল সে-সম্বন্ধে কথা বলছিল। আর পার্টিকায় যে-আক্রমণ হয়েছিল এ নিয়ে একটা শব্দও সে লেখেনি। আর মন্টিকর্ন নিয়ে নয়, সিয়েট কমাম নিয়ে নয়, আর আসালন সিয়েডো নিয়েও নয়।

আচ্ছা, ভোরালার্গে সে কটা শীত পার করেছিল, আর অলবার্গেই বা কটা? চারটে হবে। তারপর তার মনে পড়ল, ওই লোকটা যে শিয়াল বেচতে এসেছিল যখন তারা ব­yডেঞ্জে ঢুকে পড়েছিল। উপহারসামগ্রী কেনার জন্যে আর চেরিপিটের স্বাদওয়ালা চমৎকার কার্স্চ্ খেতে অতি পিছল বরফকণাপূর্ণ পথ তারা পা দিয়ে ভাঙছিল আর গাইছিল – ‘হি হি সিড রলি’। একেবারে খাড়া বরফপথটা যেটা একেবারে পথের শেষ ছিল, সোজা সেটা ধরে, তারপর অর্চাড বাগানের ভিতর দিয়ে দৌড়ে তিনবার মোড় নিয়ে খালটার ওপর দিয়ে পান্থশালার পাশের বরফঠান্ডা রাস্তা ধরে। নিজের
জামাকাপড় বোঁচকা একটু আলগা করে স্কিগুলোকে লাথি দিয়ে পাশে সরিয়ে পান্থশালার কাঠের দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে। জানালা দিয়ে ল্যাম্প লাইটের আলো আসছে, আর ভিতরটাতে ধোঁয়া ভরা নতুন মদের উষ্ণ সুগন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। তখন তারা অ্যাকর্ডিয়ান বাজাচ্ছিল।

 

প্যারিসে আমরা কোথায় থাকতাম?

হ্যারি মহিলাকে জিজ্ঞেস করল। মহিলাটি তার পাশেই একটা ক্যানভাস চেয়ারে বসে ছিল। এখানেই, এই আফ্রিকায়।

আমরা ক্রিলঁতে থাকতাম, তুমি তো জানো।

কেন, জানব কেন?

এখানেই আমরা সব সময়েই থাকতাম।

না, সব সময় নয়।

হ্যাঁ, সেখানে প্যাভিলঁ, কোয়ার্টার, তারপর সেন্ট জার্মানে আমরা থেকেছি।

কেন, তুমি জায়গাটাকে ভালোবাসতে।

ভালোবাসা হচ্ছে আবর্জনার সত্মূপ। আমি সেই নোংরা আবর্জনার ওপর দাঁড়িয়ে কক্রো… কুই… বলে চিৎকার করছি।

আচ্ছা, সত্যিই তুমি যদি চলেই যাও, তাহলে এটা কি এতই দরকার, তুমি যা কিছু সারাজীবনে করেছ তার সবকিছু একেবারে ধ্বংস করে চলে যাবে? তুমি কি সমস্ত কিছুই নিয়ে যেতে চাও? তোমার কি নিজের
বাহনটাকেও খুন করতে হবে? আর তোমার স্ত্রী, তাকেও? তোমার ঘোড়ার পা-দানি যেটা তোমার অস্ত্র, সেগুলোকেও কি নষ্ট করে যেতে হবে?

হ্যাঁ, সে বলল। তোমার ওই কদর্য অর্থ ছিল আমার বর্ম, আমার ঘোড়া আর আমার অস্ত্র?

বলো না।

আচ্ছা বলব না। চুপ করে গেলাম। আমি তোমাকে আঘাত দিতে চাইনি।

একটু দেরিই হয়ে গেল।

বেশ আছি তাহলে, আমি তোমাকে আঘাত দিয়েই যাব। সেটা আরো মজার। যে একমাত্র জিনিসটা তোমার সঙ্গে করতে পছন্দ করতাম সেই জিনিসটা আমি এখন আর করতে পারছি না।

না, তা ঠিক নয়। তুমি অনেক কিছুই করতে পছন্দ করতে, তুমি সবকিছুই করতে পছন্দ করতে এবং তুমি যা কিছু করতে চেয়েছ তা আমি করেছি।

যিশুর দোহাই, চুপ করবে তুমি? এসব তোষামুদি কথা বলা বন্ধ করবে?

হ্যারি মহিলাটির দিকে চেয়ে দেখল সে কাঁদছে।

শোন, সে বলল, তুমি কি মনে করো এটা করা এখন মজা করা? আমি নিজেই জানি না, কেন এরকম করছি। শুধু তোমাকে বাঁচানোর জন্যে নিজেকে খুন করার চেষ্টা করছি। আমরা যখন কথা বলতে শুরু করেছিলাম, তখন সবকিছু ঠিক ছিল। আমি এটা আরম্ভ করতে চাইনি। আমি এখন যতটা পারি তোমার প্রতি বোধশূন্য নিষ্ঠুর হতে চাইছি। কাজেই আমার কথা গ্রাহ্য করো না। ডার্লিং, এখন আমি যা কিছু বলি, কিছু মনে করো না। আমি তোমাকে সত্যিই ভালোবাসি আর তুমি জানো আমি তোমাকে ভালোবাসি। আর কাউকেই এরকম করে ভালোবাসিনি।

সেই মিথ্যা কথাটা আবার বলল। যে-মিথ্যাটিকে সে দৈনন্দিন রুটি-মাখন জোটানোর জন্য বলতে অভ্যস্ত ছিল।

তুমি আমার কাছে খুব মিষ্টি।

তুমি একটা কুত্তি, খুব ধনী কুত্তি। এটাই মজা। আমি এখন পুরো কবিতার মধ্যে রয়েছি। পচা এবং কবিতা, পচা কবিতা।

থামো, হ্যারি। তোমাকে কেন এরকমভাবে শয়তান হয়ে যেতে হবে?

আমি কিচ্ছু ফেলে রেখে যেতে চাই না। হ্যারি বলল, আমি কিছুই আমার পেছনে রেখে যেতে রাজি নই। কিচ্ছু না।

 

এখন সন্ধে, হ্যারি ঘুমিয়ে পড়েছে। সূর্য পাহাড়টার পিছনে, চারদিকে শুধু ছায়া। সমতল জায়গাটায় ছোট ছোট প্রাণী কাছাকাছি চরে বেড়াচ্ছে। মাথা নিচু করে খাচ্ছে আর লেজ নাড়াচ্ছে। হ্যারি দেখতে পেল, তারা এখন ঝোপ-জঙ্গলের আশপাশ থেকে চলে গেল। পাখিগুলো এখন আর মাটিতে থাকল না, তারা সব আশপাশের গাছে গিয়ে বসল, তাদের সংখ্যা অনেক। কাজের লোকটি তার বিছানার পাশেই বসে আছে। মেমসাহেব শিকার করতে গেছেন, চাকরটি বলল। সাহেব, কিছু কি চান?

কিছু না।

মহিলা আশেপাশে শিকার কিছু পাওয়া যায় কিনা যাতে একটু মাংস জোগাড় হয় তার জন্যে বন্দুক নিয়ে বেরিয়েছিল। সে জানত শিকার দেখতে হ্যারি কীরকম পছন্দ করে। হেলেন অনেকটাই দূরে গিয়েছিল। যাতে ওই সমতল ছোট্ট জায়গাটা হ্যারি দেখতে পায়। মহিলাটি সবসময় বেশ ভেবেচিন্তে কাজ করে, হ্যারি ভাবল। যা কিছু সে জানে, করেছে কিংবা শুনেছে সবকিছু নিয়ে সে যথেষ্ট সচেতন। এটা তার দোষ নয় যে, হ্যারি যখন তার কাছে গিয়েছিল সে তখন ফুরিয়ে গেছে। কী করে একজন মহিলা জানবে যে, একটা মানুষ যা বলছে তার কিছুই ঠিক বলছে না। সে শুধু অভ্যাসে বলছে বা একটু স্বসিত্ম পাবে বলে বলছে। কী করে জানবে যে, হ্যারি যা বলছে, তার কোনোই অর্থ নেই, বলছে শুধু সেই মিথ্যেগুলোই যেগুলো মেয়েদের সঙ্গে খাপ খেয়ে যায়। তাদেরকে সত্য বলার চেয়ে সে যে মিথ্যে কথা বলত তার একমাত্র কারণ হচ্ছে, বলার মতো সত্যি তার তখন আর কিছুই ছিল না। জীবন যেভাবে তার কাটানোর কথা ছিল সেটা কাটানো হয়ে গেছে। এখন সে   বাঁচতে চাইছে অন্য মানুষদের সঙ্গে, যাদের আরো বেশি টাকা আছে। একই জায়গার সবচাইতে ভালোদের সঙ্গে এবং কিছু নতুন মানুষের সঙ্গেও বটে।

চিন্তা বাদ দিতে পারলে সবকিছুই অতি চমৎকার। তোমার ভিতরের ভালো জিনিসগুলো দিয়ে তুমি যদি সুরক্ষিত থাক তাহলে তুমি ভেঙে টুকরো-টুকরো হয়ে যেতে পার না। তুমি এমন একটা দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলেছিলে যে, যেভাবে তুমি কাজ করতে অভ্যস্ত ছিলে তা নিয়ে কোনো কিছুরই তোয়াক্কা করনি। যেভাবে কাজটা তুমি করছিলে এবং যে-কাজটা এখন আর তোমার করার উপায় নেই, অথচ মনে-মনে তুমি বলছ এই সমস্ত লোককে নিয়ে লিখবে, বড়লোকদের নিয়ে লিখবে, যাদের তুমি কেউ নও, যাদের জগতে একজন গুপ্তচর হিসেবেই থাকবে। তুমি জান যে, তুমি তাদের ত্যাগ করবে, তারপর তাদের নিয়ে লিখতে বসবে আর লেখা হয়ে গেলে লেখক নিজেই জানতে পারবে কী নিয়ে সে লিখেছে। কিন্তু সে কোনোদিন তা করতে পারবে না। কারণ
প্রতিদিন না লিখে আয়েশ করতে করতে – যা করতে সে বলতে কি ঘৃণাই বোধ করে অথচ তাই করে-করে সে তার সামর্থ্য ভোঁতা করে ফেলেছে। নিজের ইচ্ছেশক্তিকে এভাবে এত নরম করে ফেলেছে যে, শেষপর্যন্ত  সে আর আদৌ কিছু লিখতে পারবে না। যে সমস্ত মানুষকে সে জানত তারা এখনো হয়তো আরো আরাম-আয়েশে সময় কাটাচ্ছে; কিন্তু সে কোনো কাজ করেনি। তার জীবনের
সবচাইতে ভালো সময় এই আফ্রিকায়, যেখানে সে জীবনের সবচাইতে ভালো সময় কাটিয়েছিল। ওটাই আবার শুরু করার জন্যে সে এখানে ফিরে এসেছে। তারা এই শিকার অভিযাত্রায় এসেছে খুব সাধারণভাবে থাকার জন্য, যেখানে কঠিন পরিশ্রম নেই, বিলাসিতাও কিছু নেই। সে ভেবেছিল ফিরে যেতে পারবে, তার বাকি ট্রেনিংটা শেষ করতে পারবে। যেভাবেই হোক সে ভেবেছিল তার আত্মার চর্বি ঝরিয়ে ফেলবে, যেমন করে একজন যোদ্ধা করে থাকে। সে পাহাড়-জঙ্গলে গিয়ে কাজ করে, যাতে করে তার দেহটার ভিতরে আত্মাকে একেবারে পুড়িয়ে বের করে ফেলতে পারে।

মহিলাটিও এটা পছন্দ করতেন। তিনি বলতেন, কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে তিনি ভালোবাসেন। যা কিছু উত্তেজনাপূর্ণ, যা কিছুতে সামনের দৃশ্যপট বদলে যায়, তা-ই তিনি পছন্দ করতেন। যেখানে নতুন লোকজন, যেখানে সবকিছু বেশ প্রফুলস্নকর। হ্যারি কিন্তু ঠিকই অনুভব করতে পেরেছিল আবার আগের মতো কাজ করার শক্তি ফিরে পাওয়ার আশা করা একটা বিভ্রম মাত্র। এটা যদি এভাবেই শেষ হয়ে যায় – অবশ্য সে জানতও যে, এভাবেই শেষ হবে – তাহলে যে-সাপের মেরুদ- ভেঙে গিয়েছে সে সাপের মতো নিজেকে নিজে সে কামড়াবে না। এই মহিলাটির দোষ নয় এটা। যদি এই মহিলাটির দোষ না হয়, তাহলে অন্য কার দোষ! যদি সে মিথ্যা আশ্রয় করে এতকাল বেঁচে থাকে, তাহলে বরং মিথ্যার আশ্রয় নিয়েই তার মরার চেষ্টা করা উচিত। সে সময় টিলার পিছনে একটা গুলির শব্দ শুনল।

সত্যিই হেলেনের লক্ষ্যভেদ করার দক্ষতা উলেস্নখযোগ্য। এই ভালো মানুষ ধনী কুত্তিটার, এই দয়ার্দ্রচিত্ত তার সেবাকারিণী কুত্তিটার। এই তার প্রতিভার বিনষ্টকারী। বাজে কথা, সে নিজেই নিজের প্রতিভাকে নষ্ট করেছে। কেন সে এই মহিলাটিকে দায়ী করতে যাবে? এজন্যে যে, সে তাকে ভালো রাখার চেষ্টা করেছে? সে তো তার নিজের প্রতিভা ব্যবহার না করে নিজেই ধ্বংস করেছে। সে নিজের প্রতিই বিশ্বাসঘাতকতা করেছে, সে যা-যা বিশ্বাস করেছিল তা মদ খেয়ে-খেয়ে নষ্ট করে ফেলেছে। আলস্য করে, কুঁড়েমি করে সে নিজেকে নষ্ট করেছে। সেইসঙ্গে আত্ম-অহংকারও তার সাথে ছিল। এই অহংকার আর মিথ্যা বিশ্বাস নিয়ে যা ইচ্ছে তা-ই করে সে নিজের ক্ষমতাকে নষ্ট করেছে। এটা কি, এটা কি পুরনো বইয়ের একটা তালিকা? তার মেধাটা কি ছিল আসলে? মেধা তার ঠিকই ছিল, কিন্তু সেটাকে ব্যবহার না করার বদলে সে তা নিয়ে ব্যবসা করতে গেছে। যা সে করতে পারত তা না করে সে কোনোমতে এটা ব্যবহার করে গেছে। সে বেছে নিয়েছিল, তার জীবিকা সে কলম বা পেনসিলের বদলে অন্য কোনোভাবে উপার্জন করবে। অদ্ভুত কথা, তাই নয় কি? যখন সে আরেকটি মেয়ের প্রেমে পড়ত তখন সে হিসেব করত সেই মহিলা যেন তার আগে প্রেমেপড়া মহিলার চাইতে বেশি টাকাওয়ালা হয়। যখন তার প্রেম সম্পূর্ণ চলে গেল তখন সে কেবলই মিথ্যা বলেছিল, যেমন এখন এই মেয়েটির কাছেও বলছে। যার কাছে আগের সকল মহিলার চাইতে বেশি টাকা আছে, অনেক অনেক টাকা, যার একজন স্বামী ছিল, সন্তান ছিল, যার প্রেমিকও অনেক ছিল, যাদের প্রতি সে ক্রমে বিরক্ত হয়ে উঠেছিল, শেষ পর্যন্ত সেই মেয়েই লেখক হিসেবে তাকে ভালোবাসল মানুষ হিসেবে, সঙ্গী হিসেবে এবং যেন গচ্ছিত ধনের গর্বে গর্বিত হয়ে। সবচেয়ে অদ্ভুত কথা হলো, যখন সে আর তাকে ভালোবাসে না, কেবলই মিথ্যা বলে, তখন সে এই মহিলাকে তাঁর টাকার জন্যই তার সবকিছু উজাড় করে দেওয়ার কথা বলছে, অথচ সে যখন তাকে সত্যিই ভালোবাসত তখন এই কথাটা কিন্তু তাকে বলেনি। হ্যারি ভাবল, আমরা যাই-ই করতে চাই না কেন, তার জন্য আমাদের অনেক কিছু বাদ দিতে হবে। যাই হোক, তুমি তোমার জীবিকা সংগ্রহ করো সেটা দিয়েই যেখানে তোমার সত্যিকার মেধা রয়েছে। কিন্তু তুমি তা বিক্রি করে দিয়েছ যেনতেনভাবে। আর যখন তোমার প্রেম-ভালোবাসায় টান ধরেছে তখনই তুমি টাকাকে অধিক মূল্য দিয়েছ। হ্যারি এটা বুঝতে পেরেছে, কিন্তু এটা কখনোই সে লিখবে না, এখনও নয়। সে লিখবে না। যদিও এটা লেখার জন্য খুব উপযুক্ত ও গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

এখন হেলেনকে দেখা যাচ্ছে, খোলা জায়গাটা দিয়ে ক্যাম্পের দিকেই আসছে। সে শিকারের জন্য বিশেষ ধরনের প্যান্ট পরেছিল, হাতে ছিল রাইফেল। ছোকরা চাকর দুটোর ঘাড়ে একটা টমি       ঝুলছিল। তারা হেলেনের পিছু-পিছু আসছিল। হেলেন এখনও যথেষ্ট আকর্ষণীয়। তার শরীর এখনো আনন্দদায়ক। সত্যিই বিছানায় তার যথেষ্ট প্রতিভা, পারদর্শিতা আর বোধবুদ্ধি ছিল। খুব সুন্দরী সে নয়, কিন্তু হ্যারি তার মুখশ্রী পছন্দ করত। প্রচুর পড়ত হেলেন। ঘোড়ায় চড়ে শিকার করতেও খুব পছন্দ করত। আর বেশ মদ্যপানও করত। যখন সে তুলনামূলকভাবে আরো তরুণী ছিল, তখনই তার স্বামী মারা যায়। তারপর সে তার সন্তানদের যত্নে নিজেকে ব্যাপৃত রাখল, যদিও বাচ্চা দুটির আর তখন তাকে দরকার ছিল না। তার নিজের ঘোড়ার আস্তাবল, নিজের পড়ার বই, তার নিজস্ব পানীয় – এসবে তারা খুব বিব্রত বোধ করত। সন্ধেবেলায় ডিনারের ঠিক আগে হেলেন স্কচ হুইস্কির সঙ্গে সোডা মিশিয়ে খেতে-খেতে বই পড়ত। ডিনার শেষ হতে হতে সে প্রায় মাতাল হয়ে যেত। ডিনারের সময়ে আবার এক বোতল সুরা পান করার ফলে সে এতটাই মাতাল হয়ে যেত যে অকাতরে ঘুমিয়ে পড়ত।

এসব অবশ্য আগেকার কথা। তারপর যখন তার প্রেমিকরা দেখা দিল তখন সে আর অত বেশি পান করত না, কারণ তখন তার মাতাল হয়ে ঘুমিয়ে পড়ার প্রয়োজন ছিল না। প্রেমিকরা হেলেনকে খুবই বিরক্ত করত, খুব একঘেয়ে লাগত তাদের সঙ্গে। তবে এমন একজনকে বিয়ে করেছিল, যে জীবনে তাকে কখনো একঘেয়েমিতে ভুগতে দেয়নি। কিন্তু এই প্রেমিকরা তাকে সত্যিই একঘেয়েমিতে ভুগিয়েছে।

এরপর তার দুই ছেলের একজন প্লেন ক্রাশে মারা গেল আর সেটা যখন ঘটেই গেল তখন থেকে আর কোনো প্রেমিককে কাছে ঘেঁষতে দেয়নি। মদপানেও কোনো প্রশান্তি না মেলায় হেলেন তখন অন্য একরকম জীবন বেছে নিল। তারপর হঠাৎ একদিন সে একা হয়ে যাওয়ার ভয়ে খুবই ভীত হয়ে পড়ল। এমন একজনকে সে চাইল, যাকে নিজের সঙ্গে-সঙ্গে তাকেও শ্রদ্ধা করতে পারবে।

সামান্যভাবেই ওদের প্রেম শুরু হয়েছিল। হ্যারি যা লিখত, তা পড়তে হেলেন পছন্দ করতো। হ্যারি যেভাবে জীবনযাপন করতো, তাতে তার হিংসা হতো। সে ভাবলো, এই ভদ্রলোক যা করতে চান, ঠিক তা-ই করেন। একেকটা সিঁড়ি পেরিয়ে হেলেন তাকে পেয়ে গেল আর শেষ পর্যন্ত তার প্রেমে পড়লো। এ সবই ছিল নিয়মমাফিক। একটু-একটু করে সে তার জীবনটা নতুন করে তৈরি করে নিতে পারল। হ্যারিও এটা চালিয়ে গেল, তার পড়ন্ত জীবনে যা কিছু ছিল তা এই মহিলার সঙ্গে বদলাবদলি করে নিল।

হ্যারি যে এটা বাণিজ্যের মতো করল তা কি নিরাপত্তার জন্যে? আরামের জন্যে? তাতে আর সন্দেহ কি? এটা অবশ্য তার জানা ছিল না। হ্যারি যা কিছু চাইত হেলেন তা-ই কিনে দিত। হ্যারি তা জানত, এই মহিলা কল্পনাতীতরকম চমৎকার একজন মানুষ। চমৎকার মহিলা সে। হ্যারি তার সঙ্গে বিছানায় যাবে, যেমন অন্য মহিলাদের সঙ্গে যায়। এটাই স্বাভাবিক। তবে তাদের মধ্যে বিশেষ করে এই হেলেন থাকবেই, কারণ সে ধনী, সদা হাস্যময়ী। বিছানায় কখনো কোনো অবাঞ্ছিত দৃশ্যের অবতারণা করেনি। এখন তার সঙ্গে তিনি এই যে জীবন গড়ে তুলেছেন সেটার মেয়াদ কি ফুরিয়ে আসছে শুধু এই কারণে যে, দু-সপ্তাহ আগে হাঁটুটা যখন ছিঁড়ে গিয়েছিল তখন তিনি আয়োডিন ব্যবহার না করে হাঁটু আঁচড়েছেন! তিনি একদল হরিণের ছবি নেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। ওই জল-হরিণগুলো মাথা উঁচু করে চারিদিক দেখছিল আর তারা নাক দিয়ে আশপাশের বাতাসের গন্ধ নেওয়ার চেষ্টা করছিল। কান দুপাশে ছড়ানো, যাতে সামান্য শব্দ হলেই টের পাওয়া যায়, যাতে তারা সঙ্গে সঙ্গে ঝোপঝাড়ের আড়ালে চলে যেতে পারে। ছবি তোলার আগেই তারা দৌড়ে নিমেষে অদৃশ্য হয়েছিল।

ওই যে হেলেন এলো। সে খাটিয়া থেকে মাথা ঘুরিয়ে তার দিকে তাকাল।

এই যে, ফিরলে?

আমি একটা মদ্দা টমি শিকার করেছি। তোমার জন্যে খুব ভালো স্যুপ হবে। আমি তাতে কিছু আলু দিয়ে দেব আমার নিজের জন্যে। কেমন লাগছে এখন?

অনেক ভালো।

বাঃ, খুব ভালো কথা। জানো, আমি ভাবছিলাম তুমি এখন অনেকটা ভালো বোধ করবে। যখন আমি বেরিয়ে যাই তখন তুমি ঘুমাচ্ছিলে।

হ্যাঁ, আমার একটা চমৎকার ঘুম হয়ে গেল। তুমি কি অনেক দূরে গিয়েছিলে?

না, ওই যে টিলাটা দেখা যাচ্ছে ওর পিছনের দিকে। টমিটাকে সহজেই শিকার করেছি।

তুমি চমৎকার নিশানা করো।

হ্যাঁ, আমি শিকার করতে ভালোবাসি। আফ্রিকাকে আমি ভালোবেসে ফেলেছি। সত্যি বলছি, তুমি যদি ভালো থাকতে তা হলে আজ পর্যন্ত যত আনন্দ-ফুর্তি করেছি এটা হত তার মধ্যে সবচেয়ে মজার। তুমি তো জানো না, তোমার সঙ্গে শিকার করতে গেলে কী যে মজা। আমি দেশটাকে ভালোবেসেই ফেলেছি।

আমিও ভালোবাসি।

সোনা, তুমি যে এখন একটু ভালো বোধ করছ, তাতে আমি কী যে আনন্দবোধ করছি! তুমি যখন ওইসব কথা বলছিলে আমি সহ্য করতে পারছিলাম না। তুমি কখনো আর এভাবে আমার সঙ্গে কথা বলবে না, ঠিক তো? কথা দাও।

না, বলব না। হ্যারি বলল, কী বলেছিলাম আমার মনে পড়ছে না।

আমাকে তোমার ধ্বংস করতে হবে না, বুঝলে। আমি একজন মাঝবয়সী মহিলা মাত্র, এই মহিলা তোমাকে ভালোবাসে, তুমি যা করতে ভালোবাসো সেও তাই করতে পছন্দ করে। আমি এর মধ্যেই দুবার বা তিনবার বিধ্বস্ত হয়েছি, তুমি আর আমাকে ধ্বংস করবে না, করতে চাইবে না, ঠিক তো?

আমি তোমাকে কয়েকবার বিছানায় বিধ্বস্ত করতে চাই।

হ্যাঁ, সেটাই হলো সবচাইতে ভালোভাবে বিধ্বস্ত হওয়া। এভাবেই তো আমরা দুজনে বিধ্বস্ত হবো। কাল প্লেন আসবে।

তুমি জানলে কী করে?

আমি নিশ্চিত, কাল আসতে বাধ্য। চাকর-বাকররা গাছপালা সরিয়ে প্লেন নামার চমৎকার ব্যবস্থা করেছে। আমি ওদিকে গিয়েছিলাম, আজকেও দেখে এলাম। প্লেন নামার জায়গাটা যথেষ্ট বড় হয়েছে। নামার জন্যে যে-পথ করা দরকার তার এ মাথা-ও মাথা দু-মাথাই ঠিক করা হয়েছে।

কাল প্লেন আসবে তুমি নিশ্চিত হলে কী করে?

আমি নিশ্চিত, আসবেই। আগেই আসার কথা ছিল। যা-ই হোক তারা তোমাকে শহরে নিয়ে গিয়ে তোমার পা ঠিক করে দেবে। তারপর আবার কয়েকটা ভালো বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনা হবে। আর এরকম ভয়ংকর কথাবার্তা বলবে না।

আচ্ছা, আমরা কি একটু পান করব? সূর্য ডুবে গেছে।

তোমার কি মনে হচ্ছে, সেটা তোমার করা উচিত?

আমি তো এখুনি এখন।

ঠিক আছে, আমরা দুজন একসঙ্গে একটু খাব। মলো, হুইস্কি আর সোডা নিয়ে এসো।

তুমি বরং মশা তাড়ানোর জন্যে তোমার বুট পরে নাও, হ্যারি বলল।

না, ওটা পরব স্নানের পরে। দাঁড়াও আমি স্নান করে নিই।

সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে এলে তারা একসঙ্গে কিছুটা পান করল। আর যখন বেশ অন্ধকার নেমে এলো, শিকার করার জন্য যখন আর কোনো আলো নেই, তখন একটা হায়েনা খোলা জায়গাটা দিয়ে হেঁটে টিলাটার পিছন দিকে চলে গেল।

এই বেজন্মা জন্তুটা প্রত্যেক রাতে একবার করে এইখান দিয়ে যায়, হ্যারি বলল।

গত দুই সপ্তাহ ধরে প্রত্যেক রাতে। ওইটাই সেটা, যেটা রাতে চিৎকার করে। আমি একটুও গ্রাহ্য করি না। নোংরা, হতচ্ছাড়া প্রাণী।

একসঙ্গে পান করতে-করতে দেখা গেল, এখন আর কোনো যন্ত্রণা নেই। শুধু একভাবে অনেকক্ষণ শুয়ে থাকার জন্য একটু পাশ ফিরতে ইচ্ছে করছে। আফ্রিকান চাকরগুলো একটা আলো জ্বালাল। ক্যাম্পের ওপর ছায়া ঝাঁপিয়ে পড়ল। সে অনুভব করল, তৃপ্তিকর আত্মসমর্পণের সময়টা ফিরে এলো। হেলেন সত্যিই তার প্রতি খুবই দরদি। সে-ই বরং তার প্রতি নিষ্ঠুর হয়েছে। বিকেলবেলায়
কতকগুলো অন্যায্য কথা বলেছে। আসলে সে অতি চমৎকার মহিলা, অসাধারণভাবে ভালো, ঠিক তখনই তার মনে হলো, মৃত্যু আসন্ন। হুশ করে সে চলে এলো, জলের মতো, ঢেউয়ের মতো নয়, বাতাসের মতো ঝাপটা দিয়ে নয়, বরং একটা বিশ্রী গন্ধওয়ালা আকস্মিক শূন্যতার মতো। আর সবচাইতে বেখাপ্পা ব্যাপার হলো, হায়েনাটা ঠিক তখুনি হালকাভাবে এর ধার ঘেঁষে চলে গেল।

হ্যারি কী হয়েছে? হেলেন জিজ্ঞাসা করল।

কিছু না, সে উত্তর দিলো। তুমি বরং একটু ওপাশে যাও, ওই বাতাসের দিকে।

মলো তোমার পা-টা কি আবার ধুয়ে-মুছে দিয়েছে?

হ্যাঁ, আমি এখন ওই ঠিকঠাক বোরিকটা ব্যবহার করছি।

কেমন লাগছে তোমার?

একটু যেন এলোমেলো।

আচ্ছা, আমি এখন স্নান করতে যাচ্ছি। এক্ষুনি বেরিয়ে আসব, এসে তোমার সঙ্গে খাব, তারপর তোমার খাটিয়াটা ভিতরে নিয়ে আসব।

সে নিজে-নিজে বলল, ভালোই করেছি আমরা, ঝগড়া করা বন্ধ করেছি। এই মহিলার সঙ্গে সে কখনোই বেশি ঝগড়া করেনি। কিন্তু অন্যদের সঙ্গে সে এতই ঝগড়া করত, এতই বিরক্তি সঞ্চার করত যে শেষ পর্যন্ত তারা তাদের নিজেদের মধ্যে ভালোবাসা যা একটু থাকত সেটাকে একেবারেই ধ্বংস করে ফেলত। সে বড্ড বেশি ভালোবেসেছে, বড্ড বেশি দাবি করেছে। এই করে-করে সে নিজেকে ক্ষয় করে ফেলেছে।

বাড়ি ছাড়ার আগে প্যারিসে যে ঝগড়া হয়েছিল, এখন কনস্টান্টিনোপলে সে একা সেই সময়টার কথা চিন্তা করছিল। ওই সময়টায় সে বারাঙ্গনাদের সঙ্গেই বেশি সময় কাটিয়েছিল। তারপর যখন কিছুতেই সে তার একাকিত্ব দূর করতে পারছিল না, বরং অবস্থা যখন আরো খারাপের দিকে গেল তখন যে তাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল তাকেই প্রথম চিঠি লিখেছিল। চিঠিতে সে লিখেছিল, শত চেষ্টা করেও তার একাকিত্বকে সে খুন করতে পারেনি। যখন তাকে রিজেন্সের বাইরে একবার দেখেছিল সে ভিতরে ভিতরে খুবই অসুস্থতা অনুভব করেছিল। সে স্থির করেছিল সেই মেয়েটিকেই অনুসরণ করবে যে মেয়েটি দেখতে অনেকটা তার মতোই ছিল। তারপরে ভয়ই পেয়ে যাবে, যখন সে দেখবে ব্যুলেভার ধরে তাকে অনুসরণ করতে-করতে যখন তাকে দেখতে পাবে সে দেখবে, আরে এ তো সেই মেয়েটি নয়। তার প্রথম যে অনুভূতি হয়েছিল সেটা হারিয়ে ফেলার ভয়ে ভীত ছিল সে। যাদের যাদের সঙ্গে সে রাত কাটিয়েছিল তাদের সবাই শেষ পর্যন্ত তাকে হারিয়ে ফেলার অনুভূতিই দিয়েছিল। অথচ তাদের কেউই তার কাছে কোনো ব্যাপারই ছিল না। যাদের সঙ্গে সে রাত কাটিয়েছিল তারা প্রত্যেকেই হারিয়ে ফেলার অনুভূতি দিয়েছিল হ্যারিকে। মহিলাটি অন্যদের সঙ্গে যা করেই থাকুক না কেন তারা তাদের হারিয়ে ফেলার অনুভূতি দিয়েছিল। মহিলাটি যাই-ই করে থাকুক না কেন, তাতে তার কিছুই এসে-যাওয়ার কথা নয়। কারণ সে জানত, সে কিছুতেই নিজেকে ভালোবাসার রোগ থেকে নিরাময় করতে পারবে না। এই চিঠি সে ক্লাবে বসে লিখেছিল খুব ঠান্ডা মাথায়। তারপরে নিউইয়র্কে পোস্ট করে দিয়েছিল আর তাকে বলেছিল সে যেন তার প্যারিসের অফিসে চিঠি লেখে। এটাই নিরাপদ বলে মনে হয়েছিল। ওই রাত্রিতে সে ভিতরে-ভিতরে শূন্যতা আর একরকম অসুস্থতা বোধ করছিল। তখন রাতে সে ট্যাক্সিমের রাস্তায় ঘুরতে-ঘুরতে একটি মেয়ে সংগ্রহ করল আর রাতের খাবারের জন্য তাকে সঙ্গে নিয়ে গেল। তারপরে সে তাকে নিয়ে একটা নাচের ক্লাবে গেল। মেয়েটি মোটেই ভালো নাচে না। কাজেই সে এক গনগনে আর্মেনিয়ান ছেনাল মেয়ের জন্য ওই মেয়েটাকে ত্যাগ করল। আর্মেনিয়ান ছেনালটি তখন এমন করে তার পেটটা তার শরীরে লাগালো যেন মনে হলো শরীরের ওই অংশটা পুড়ে গেছে। সে একজন ইংরেজ বন্দুকবাজের কাছ থেকে বেশ একটা ঝামেলা-ফ্যাসাদ করে মেয়েটিকে ছিনিয়ে নিল। বন্দুকবাজ তাকে বলল বাইরে যেতে। বাইরে এসে তারা পাথরকুচি-ছড়ানো রাস্তার ওপরে অন্ধকারে  অনেকক্ষণ মারামারি করল। হ্যারি লোকটাকে দুবার আঘাত করেছিল তার চোয়ালের পাশে। তারপরও সে যখন মাটিতে পড়ে গেল না, সে বুঝল যুদ্ধটা এখন চালাতেই হবে। বন্দুকবাজ তাকে প্রচ- আঘাত করল, এবারে তার চোখের পাশে। সে ঘুরে দাঁড়িয়ে বাঁ-হাতে একটা ঘুসি ছুড়ল, বন্দুকবাজ তার ওপরেই পড়ে গেল। কিন্তু পড়েই সে হ্যারির কোট চেপে ধরে একটা হাতা টেনে ছিঁড়ে ফেলল। হ্যারি তখন তার মাথায় আরো দুটো ঘুসি মারল কানের পাশে, তারপরে ডান হাতের আর একটা ঘুসিতে তাকে নিজের ওপর থেকে সরিয়ে দিল। বন্দুকবাজটা যখন মাথা নিচু করে মাটিতে পড়ে গেল তার মাথায় প্রচ- আঘাত লাগল। এই ফাঁকে সে মেয়েটিকে নিয়ে দৌড় দিল। তারা শুনেছিল মিলিটারি পুলিশ আসছে। একটা ট্যাক্সি নিয়ে তারা বসফরাস ধরে লিমেলিহিসার দিকে চলে গেল। তারপর নির্জন ঠান্ডা রাতে একসঙ্গে বিছানায় গেল তারা। হ্যারির মনে হলো, একটু যেন বুড়িয়ে গেছে মেয়েটি। কিন্তু তার গাত্রচর্ম মসৃণ গোলাপের পাপড়ির মতো, সিরাপের মতো মিষ্টি, পেটও তার খুবই মসৃণ। স্তন দুটি বিশাল আর তার কোমরের নিচে কোনো    বালিশ লাগে না।

মেয়েটি চলে যাওয়ার আগেই সে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। সকালের প্রথম আলোতে বিশ্রী লাগছিল তার। পেরা প্যালেসের দিকে সে তাকাল, একটা চোখ তো আঘাত পেয়ে কালো হয়ে আছে। কোটটা সে হাতে নিয়েছে, কারণ তাতে একটা হাতা নেই। ওই রাতেই সে আনাতোলিয়া ছাড়ল। তার মনে পড়ল, রাস্তার একপাশে পপি ক্ষেতের ভিতর দিয়ে সে সারাদিন ঘুরে বেড়াল। পপি তারা আফিম তৈরি করার জন্য বুনেছে। আশ্চর্য ব্যাপার, শেষ পর্যন্ত এরই প্রভাবে বোধহয় চারদিকের দূরত্ব গোলমেলে বলে মনে হলো। অফিসাররা এসে যাওয়ার আগে কোথায় যে তারা আক্রমণ করেছিল কিছুই তারা জানত না। কামানবাহিনী তাদের ওপরে গুলিবর্ষণ করতে শুরু করল আর খোঁজখবর সন্ধানী ইংরেজ অফিসারটি বালকের মতো কেঁদে উঠল। সেই সে প্রথম দেখেছিল মানুষের মৃতদেহ। তাদের শরীরে ছিল যোদ্ধার পোশাক, আর উলটো করে রাখা জুতোগুলো আর তাদের পদ-পরিচয়সূচক উর্দিগুলো। তুর্কিরা যখন সতর্কভাবে এগিয়ে এলো তখন হ্যারি উর্দি পরা লোকগুলোকে দেখেছিল দৌড়ে পালাচ্ছে আর অফিসাররা তাদের ওপর গুলি ছুড়ছে। তারা নিজেরাও পালাচ্ছে। সে আর ইংরেজ পুলিশটা ফুসফুস ব্যথা না করা পর্যন্ত দৌড়েছিল। তাদের মুখ ধুলোয় পরিপূর্ণ, শেষ পর্যন্ত তারা পাথরের আড়ালে গিয়ে থেমেছিল। তখনো তুর্কিরা খুব সতর্কতার সঙ্গে এগোচ্ছে, তারপরে সে এমন দৃশ্য দেখেছিল যা সে কখনো ভাবতে পারেনি, পরেও নয়। অবশ্য পরে সে আরো খারাপ অবস্থা দেখেছিল। কাজেই সে যখন প্যারিসে ফিরে গেল, সে এ-সম্বন্ধে কোনো কথাই বলতে পারত না অথবা আর কেউ এ-ব্যাপারে কথা বললে সহ্যও করতে পারত না। চলে যাওয়ার সময় সে একটা কফি হাউস দেখল। একজন আমেরিকান কবি গোল আলুর মতো নির্বোধ মুখ নিয়ে কতকগুলো সসার সামনে রেখে বসেছিল আর একজন রোমানিয়ানের সঙ্গে ‘দাদাইজম’ নিয়ে কথা বলছিল। রোমানিয়ানটি তার নাম বলেছিল ট্রিস্টানযারা। সব সময় সে একটা মনোকল পরে থাকতো। মাথাব্যথায় ভুগত সব সময়। পিছন দিকে অ্যাপার্টমেন্টে তার স্ত্রী থাকত, এখন সে আবার ভালবাসতে শুরু করেছে। ফ্যাসাদ নেই, ঝগড়া নেই, মাথাব্যথা নেই, বাড়ি ফিরে এলেই তার বউ খুশি। অফিস থেকে রাতেই তার কাগজপত্র পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তখন একজনকে যে চিঠি সে লিখেছিল তার উত্তরটা এলো সকালে। আর যখন সে ওই চিঠির হাতের লেখা দেখতে পেল, সমস্ত শরীরটা তার হিম ঠান্ডা হয়ে গেল। সে চেষ্টা করল চিঠিটা অন্য চিঠির তলায় রাখতে, কিন্তু তার স্ত্রী জিজ্ঞেস করল, কার কাছ থেকে এই চিঠিটা এলো ডার্লিং? ব্যস, সেটাই হলো তাদের শুরুর শেষ।

সে এদের সঙ্গে যে চমৎকার সময় কাটিয়েছিল তা তার মনে পড়ল। ঝগড়াগুলোও। অবশ্য ঝগড়া করার জন্য তারা সব সময় উপযুক্ত জায়গাটাই বেছে নিত। যখন সে মোটামুটি ভালো বোধ করতে শুরু করত তখনই কেন যে তারা ঝগড়া শুরু করত কে জানে? এসবের কোনো কিছুই সে কিন্তু লেখেনি। বোধহয় এই কারণে যে, সে কখনোই কাউকে আঘাত দিতে চায়নি। তারপর তার কাছে মনে হতো, এসব ছাড়াও লেখার অনেক কিছু আছে। সে সবসময় শুধুই ভেবেছে যে, শেষ পর্যন্ত সে লিখবেই – এত লেখার রয়েছে ঝগড়া-টগড়া বাদ দিয়েও। পৃথিবীর বদল যা ঘটেছে তা সে দেখেছে, শুধু ঘটনার ব্যাপারই নয়, যদিও নানা রকম ঘটনা সে দেখেছে আর মানুষকে গভীরভাবে লক্ষ করেছে। মানুষের মধ্যে খুব সূক্ষ্ম পরিবর্তনও সে খেয়াল করেছে। সে লক্ষ করেছে নানা সময়ে কীভাবে মানুষের বদল ঘটছিল। সে যে এর মধ্যেই ছিল। সবই তার দেখা। এসব লেখা তার কর্তব্য ছিল, কিন্তু এটা আর সে কোনোদিন করবে না।

 

কেমন লাগছে তোমার এখন? স্নান করে মহিলাটি তাঁবুর বাইরে এসেছেন।

আমি ঠিক আছি।

এখন কি তুমি কিছু খাবে?

চাকর মলোকে সে পিছনেই দেখতে পেল, হাতে তার গোটানো টেবিলটা। আর অন্য চাকরটির হাতে খাবারের প্লেট।

আমি লিখতে চাই, সে বলল।

তোমার এখন কিছু পুষ্টিকর খাবার খেয়ে নেওয়া দরকার যাতে তুমি খানিকটা বল পাও।

আমি আজ রাতেই মরব। আমার বিশেষ কোনো শক্তি বা বলের প্রয়োজন নেই।

তুমি এরকম হাস্যকর নাটক কেন করছ? করো না হ্যারি।

তুমি কেন তোমার নাকটা ব্যবহার করছ না বলো তো? আমার ঊরু পর্যন্ত অর্ধেক পা পচে গেছে। এখন আমার এ পুষ্টিকর খাবারের কী দরকার? মলো, যাও হুইস্কি আর সোডা নিয়ে এসো।

তুমি এই স্যুপটুকু খেয়ে নাও ডার্লিং।

আচ্ছা, ঠিক আছে দাও।

স্যুপটা বেশ গরম ছিল। কাপটা সে অনেকক্ষণ ধরে থাকল যতক্ষণ না চুমুক দেওয়ার মতো হয়। তারপর সে এক চুমুকে খেয়ে ফেলল স্যুপটা।

 

তুমি অতি চমৎকার মহিলা। আমার কথায় কান দিয়ো না।

মহিলা তার দিকে তাকালেন। ভালোবাসায় পরিপূর্ণ সেই চেনা মুখখানি তার দিকে চেয়ে। একটু মদ্যপান করেছেন বলে খানিকটা অন্যরকম লাগছিল। বিছানায় ঠিক শোবার মতো নয় যেন। কিন্তু ‘শহর, নগর ও মফস্বল’ বইটা এমন করে ধরা ছিল যে তার সুন্দর স্তনদুটি দেখা গেলো না। আর ওই চমৎকার ঊরু দুটি, হালকা ছোট আদর করার মতো হাত দু-খানিও! হ্যারি যখন তার দিকে চেয়ে দেখছিল, তখন সে তার চমৎকার মিষ্টি হাসিটি দেখতে পেল আর ঠিক তখনই সে অনুভব করল মৃত্যু আসছে। এখন আসাটা আবার তত দ্রুত নয়। ছোট একটা হালকা নিঃশ্বাসের মতো, এক ঝলক বাতাসের মতো। যে-বাতাসে মোমবাতি কেঁপে ওঠে আর তার শিখাটা লম্বা হয়ে যায়।

তারা কিন্তু আমার মশারিটা নিয়ে এসে ওই গাছের নিচে বিছানাতে টাঙিয়ে দিতে পারে আর আগুনটাকে আরেকটু জ্বালানি দিয়ে জোরাল করতে পারে। এখান থেকে এখন নড়াচড়া করার কোনো দরকার দেখছি না। পরিষ্কার রাত্রি, এই রাতে কোনো বৃষ্টি হবে না।

তাহলে এইভাবেই তুমি মরবে দীর্ঘশ্বাসের শব্দে। যে-শব্দ তুমি আগে শোননি। ঠিক আছে আর কোনো ঝগড়া হবে না। সে এখন এটা প্রতিজ্ঞা করেই বলতে পারে, যে-একটি মাত্র অভিজ্ঞতা (মৃত্যু) সে কখনোই পায়নি, সেটাকে সে এখন আর নষ্ট করতে চায় না। তবুও সে হয়তো নষ্ট করেই ফেলবে। তুমি তো সবকিছু নষ্টই করে ফেলেছ, বোধহয় এটাকেও সে নষ্ট করবে।

আচ্ছা তুমি অনুলিখন করতে পার?

না, আমি এখনো এটা অভ্যাস করিনি।

ঠিক আছে।

অবসর ছিল না বটে। কিন্তু টেলিস্কোপের ভিতর দিয়ে নক্ষত্র দেখার মতো হয়তো এক প্যারাগ্রাফেই এই লেখাটা শেষ করতে পারতে। অবশ্য যদি এটাকে ঠিকমতো পেতে।

 

কাঠের তৈরি একটা বাড়ি। সাদা প্লাস্টার দেওয়া। হ্রদের ওপরে টিলাটায়। দরজার কাছে তার একটা ঘণ্টি ছিল দণ্ডির সঙ্গে লাগানো। ওটা বাজিয়ে অতিথিদের খাবার পরিবেশনের খবর দেওয়া যেত। বাড়ির পিছনে মাঠ আর মাঠের পরেই মূল্যবান বৃক্ষের বন। এক সারি লম্বা পপলার বাড়ি থেকে সোজা বনের ধার পর্যন্ত গেছে। অন্যান্য পপলারও একই দিকে গেছে। একটা রাস্তা এই বাড়ির পাশ দিয়ে টিলাগুলোর ওপরে উঠেছে যেখান থেকে সে কালোজাম তুলে খেয়েছিল। তারপর একদিন ওই কাঠের বাড়িটা পুড়ে ছাই হয়ে গেল। যে-বন্দুকগুলো ঠ্যাসানো ছিল আগুনের পাশেই, সেগুলোও পুড়ে গিয়েছিল, আর তাদের নলগুলোর ম্যাগাজিনের মধ্যে সিসাগুলোও গলে গেল। পুড়ে শেষ হয়ে গিয়েছিল জমা খাবারও, সেগুলো ওই ছাইয়ের ওপরেই পড়ে ছিল। বড়-বড় কেতলি ধরার জন্য যে সাঁড়াশি ছিল সেগুলোও পুড়ে গেল। তোমার পিতামহকে জিজ্ঞেস করেছিলে তুমি এগুলো নিয়ে খেলা করতে পারো কিনা। আর তিনি বলেছিলেন – না। বুঝতেই পারছ এগুলো সব তাঁর বন্দুক ছিল। তারপর আর একটি বন্দুকও তিনি কেনেননি। একটি পশুও শিকার করেননি। বাড়িটা আবার তৈরি করা হয়েছিল একই জায়গায়, ওই একইরকম কাঠ দিয়ে, সাদা রঙেই রং করা হয়েছিল। আর বাইরে পোর্চ থেকেই দেখা যেত পপলার গাছগুলো আর তাদের পিছনে লেকটাকে। তখন আর বেশি বন্দুক ছিল না। বন্দুকের নলগুলো ঝোলানো ছিল দেয়ালের গায়ে হরিণের পায়ের হাড়ের যে সমস্ত র‌্যাকের মতো ছিল সেগুলোতে। পাশেই ছিল ছাইয়ের গাদা। কেউ আর কোনোদিন এদের স্পর্শ করত না।

যুদ্ধের পরে বস্ন্যাক ফরেস্টে আমরা একটা বাড়ি ভাড়া করেছিলাম। ওখানে পৌঁছানোর জন্য দুটো রাস্তা ছিল। ওখানকার ছোট্ট খালটায় রুই মাছ ছিল অনেক। রাস্তা দুটোর একটা ওই টিলার নিচে থেকে ট্রিবার্গের চারপাশের গাছের ছায়ার মধ্যে দিয়ে উঁচুসমতলভূমির ওপরের দিকে উঠে গেছে। এই রাস্তাটার দুই পাশের বড় গাছগুলোর সারির মাঝখান দিয়ে। রাস্তাটা ধবধবে সাদা। তারপর আলাদা একটা রাস্তা একেবারে টিলার ওপর দিয়ে ছোট-ছোট খামার বাড়ি পেরিয়ে পৌঁছে গেছে খালটা পর্যন্ত। এইখান থেকেই তাদের মাছ ধরা শুরু। অন্য রাস্তাটা খাড়া উঠে জঙ্গলের ধার পর্যন্ত চলে গেছে। তারপরে টিলাগুলোর ওপর দিয়ে পাইন গাছগুলোর ভিতর ঢুকে আবার সেখান থেকে বেরিয়ে ছায়াবহুল জঙ্গলাকীর্ণ জায়গাটার ধার ঘেঁষে সেতু পর্যন্ত গেছে। এর মধ্যে বার্চ গাছ আছে। ছোট সরু এই নদীর স্রোতের পাশ দিয়ে বার্চ গাছের সারি। নদীর স্রোতটা তেমন চওড়া নয়, বরং সংকীর্ণ; তবে জলটা ঝকঝকে আর স্রোতটা দ্রুত বয়ে যাচ্ছে। আর যেখানে বার্চ গাছের তলার মাটি কাটতে হচ্ছে সেখানে আলাদা হয়ে পুকুরের মতো জল জমে আছে। আর ওখানে টিবার্গের যে হোটেল আছে তার মালিকের একটা চমৎকার অবসর কাটানোর জায়গা আছে। জায়গাটায় গেলেই মন ভালো হয়ে যায়। আমরা সবাই ঘনিষ্ঠ বন্ধু। পরের বছর মুদ্রাস্ফীতি দেখা দিল। সে-বছর হোটেল মালিকটির কাছে যথেষ্ট টাকা ছিল না তাই তার হোটেল চালানোর জন্য দরকারি জিনিসপত্র সরবরাহ করা সম্ভব হয়নি। সে তখন আত্মহত্যা করে।

তুমি রায় দিতে পারবে, কিন্তু তাই বলে তুমি তাদের মানাতে বা আটকাতে পারবে না – ওই যে কট্রোসক্রাপ্ট, যেখানে ফুল বিক্রেতারা ফুলগুলো রং করে, রঙের স্রোত রাস্তা দিয়ে গড়িয়ে যেখান থেকে অটোবাসগুলো ছাড়ে সেখানে পৌঁছোয় আর বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা সবসময় মদ খেয়ে মাতাল হয়ে পড়ে থাকে, আর ক্রমাগত ঠান্ডা লেগে ছেলেমেয়েদের নাক দিয়ে সর্দি ঝরে, সেখানে ঘামের বিশ্রী গন্ধ, মাতলামিতে মশগুল কফি হাউস। আর যে-সমস্ত দেহ পসারিণী ডালমাস্টিয়ারে আছে তারা ওপরে থাকে। যে পরিদর্শিকাটি রিপাবলিকের গার্ডকে নিজের ঘরে নিয়ে তার মনোরঞ্জন করছিল তার হেলমেটটা একটা চেয়ারের ওপরে রয়েছে। হলঘরের ভিতর দিয়ে যেখানে তার স্বামী রয়েছে সে সাইকেল দৌড়ে একজন প্রতিযোগী, সে পারী-ট্যুরে তৃতীয় স্থান অধিকার করেছে। সকালে মহিলাটি লা-অটোতে দেখলেন তার স্বামী প্রতিযোগিতায় তৃতীয় স্থান পেয়েছে – আর এটা হচ্ছে তার প্রথম প্রতিযোগিতা – মহিলাটি একটু লজ্জারাঙা হয়ে তাকে ডাকতে-ডাকতে খেলাধুলাবিষয়ক হলুদ যে লেফাফাটা ছিল সেই কাগজটা নিয়ে হইহই করে ওপরে উঠে গেলেন। মহিলার স্বামী একটা ট্যাক্সি চালাত। হ্যারিকে সকালবেলার প্লেনটা ধরতে হবে সেজন্য ওই ভদ্রমহিলার স্বামী দরজায় টোকা দিল তাকে জাগিয়ে দেওয়ার জন্য। তারপর তারা নিজেরা এক গস্নাস করে সাদা মদ পান করল রওনা হওয়ার আগে। সে আশেপাশের লোকদের চিনত। তারা সকলেই খুব দরিদ্র ছিল।

জায়গাটার আশপাশে দুই ধরনের মানুষ ছিল, মাতাল আর ফুর্তিবাজ। মাতালরা তাদের দারিদ্র্য ভুলে থাকত মাতাল হয়ে, আর গরিবরা বাইরে ফুর্তি করত। তারা ছিল কমিউনার্ডদের বংশধর। কমিউনার্ডদের রাজনীতি কী হবে তা নিয়ে তাদের কোনো ঝামেলা পোহাতে হতো না। তারা ঠিকই জানত কে তাদের বাবাদের হত্যা করেছে, আত্মীয়দের হত্যা করেছে, তাদের ভাইদের হত্যা করেছে, তাদের বন্ধুদের হত্যা করেছে। ভার্সাই পদাতিক বাহিনী এসে এই শহরটাকে দখল করে কমিউনের সবাইকে হত্যা করে ফেলল। যারা টুপি পরত, অন্য কোনো একটা চিহ্ন ব্যবহার করত বা কারো
কড়াপড়া হাত দেখত তখনি বোঝা যেত যে এরা ওই দলে কাজ করার লোক। এমন দারিদ্রে্যর মধ্যে বাউচেরি শেভালাইয়ের আশেপাশে দিয়ে যেসব কোয়ার্টার ছিল আর একটা মদের কো-অপারেটিভ ছিল সেখানেই, তখন সে কিন্তু তার লেখা শুরু করেছিল। যা কিছু তাকে লিখতে হবে তা সে আরম্ভ করেছিল। প্যারিসের এই অংশটাকে সে খুবই পছন্দ করত। এই গাছগুলো, সাদা প্লাস্টার করা বাড়িগুলো যাদের নিচের অংশ আবার বেগুনি রং করা হয়েছে, ওই লম্বা সবুজ অটোবাসগুলো গোলচত্বরের পাশ দিয়ে যেগুলো চলত আর ফাঁকা রাস্তাগুলোকে রঙিন ফুলের রঙে ভিজিয়ে দেওয়া হতো, তারপরে অকস্মাৎ টিলার একেবারে নিচে কার্ডিনাল লেমইন রাস্তা যে-রাস্তা ধরে নদীতে যাওয়া যেত। আরেকটা রাস্তা দিয়েও যাওয়া যেত, যেটা খুব সংকীর্ণ মানুষের ভিড়ে ভরা মৌফেটার্ড এলাকা দিয়ে। এই রাস্তাটাই প্যান্থেয়নের দিকে উঠে গেছে, আর অন্য রাস্তাগুলো দিয়ে বাইসাইকেল চলাফেরা করত, সাইকেলে করে সে ওই রাস্তাই ধরত। আর একমাত্র অ্যাসফল্টের রাস্তা, যা পুরো এলাকায় একটি মাত্রই ছিল, গাড়ির চাকার তলায় খুবই মসৃণ। আর সেইসব খুব উঁচু কিন্তু সংকীর্ণ বাড়ি, সস্তা উঁচু হোটেলগুলো যেখানে পল ভের্লেন মারা গিয়েছিলেন। তারা যেখানে বাস করত সেই অ্যাপার্টমেন্টে দুটি মাত্র ঘর ছিল। একেবারে ওপরতলায় আর একটি ঘর ছিল, যেটার জন্য মাসে ষাট ফ্রাঁ করে ভাড়া গুনতে হতো। এখানেই বসে লেখালেখি করত আর এখান থেকেই সে শহরের অনেক ছাদ আর চিমনি, আর প্যারিসের টিলাগুলো দেখতে পেত।

নিজের অ্যাপার্টমেন্ট থেকে সে শুধু দেখত ঝোপ-জঙ্গল আর কয়লা বিক্রির জায়গা। ওই লোকটা মদও বেচত, বাজে মদ। ‘বৌচেরি সেভা’ লাইনের পাশে যেখানে সোনালি ঘোড়ার মাথাটা রাখা আছে, সেখানে অনেক হলুদ মৃত ঘোড়ার দেহ ঝুলত, তাদের রং ছিল সোনালি। জানালায় লাল আর সবুজ রং করা কো-অপারেটিভ, সেখান থেকে তারা মদ কিনত, ভালো মদ, সস্তা মদ। বাকিগুলোরই প্লাস্টার করা দেয়াল আর প্রতিবেশীদের দিকে জানালা। প্রতিবেশীদের কেউ রাতে যখন রাস্তার ওপর মদ খেয়ে পড়ে থাকত, গোঙাত অদ্ভুত ফরাসি দেহাতি ভাষায়, বলত তোমাদের যেটা বিশ্বাস করার জন্য প্রচার করা হচ্ছে তার কোনো অসিত্মত্ব নাই। তখন জানালাগুলো খুলে যেত আর নিচু শব্দের কথাবার্তা শোনা যেত।

পুলিশের লোক কই? যখন তুমি পুলিশ ঠিক চাও না, তখনই ওই উজবুকটা এসে হাজির হবে। এখন সে হয়তো একজন পরিচারিকার সঙ্গে শুয়ে আছে। এজেন্টকে ডাক। যতক্ষণ পর্যন্ত না এক বালতি জল জানালা দিয়ে ওদের গায়ে ছুড়ে দেওয়া হতো ততক্ষণ পর্যন্ত ওরা ওই রকম করে গোঙাত। তারপর গায়ে জল পড়লেই চুপ।

এটা কী? জল! আহা, একেবারে ঠিক কাজ!

জানালাগুলো বন্ধ হলো। একজনের স্ত্রী, মেরি, আট ঘণ্টার কর্মদিবসের প্রতিবাদ করত। স্বামী যদি ছ-টা পর্যন্ত কাজ করে এক-আধটু মদ খেয়ে মাতাল হয় বাড়ি আসার পথে তাহলে খুব বেশি কিছু এসে-যায় না।

যদি সে পাঁচটা পর্যন্ত কাজ করত আর প্রত্যেকদিন নেশা করত তাহলে তার কোনো টাকা-পয়সাই থাকত না। এই সমস্ত কর্মী বা খেটে বেড়ানো মানুষ যারা কিনা এরকম করে কম ঘণ্টার কাজ পেয়ে কষ্টে থাকত তখন তাদের স্ত্রীদেরই ভুগতে হতো। কারণ তাতে টাকা কম রোজগার হতো।

 

আচ্ছা, এই পুষ্টিকর ঝোলটা একটু খাবে না? মহিলা তাকে জিজ্ঞাসা করল।

নাঃ, তোমাকে অনেক ধন্যবাদ। এটা খেতে আসলে খুবই ভালো।

দেখ না, আরেকটু পারো কি না।

না, আমি এখন হুইস্কি আর সোডা পছন্দ করব।

এটা তোমার জন্য ভালো নয়।

এটা আমার জন্য খারাপ ঠিকই। কোল্ড পোর্টার এই কথাগুলোই লিখেছেন আর সংগীতও রচনা করেছেন। এটা আমার জানা যে, তুমি পাগল হয়ে যাচ্ছ আমার জন্য।

তুমি জান, তোমাকে একটু পান করতে দেখা আমি পছন্দ করি।

হ্যাঁ, এটা আমার জন্য খারাপই।

 

মহিলা চলে গেলে সে চিন্তা করল, যা কিছু আমার দরকার আমাকে তা পেতেই হবে। না, সবকিছুই নয়, কিন্তু যা কিছু আছে। হ্যাঁ, সে খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল, অত্যন্ত ক্লান্ত। সে এখন একটু ঘুমুবে। সে যখন স্থির হয়ে শুলো সেখানে তখন মৃত্যু ছিল না। এটা নিশ্চয়ই অন্য কোনো রাস্তায় চলে গেছে। হয়তো এটা প্যারিসে গেছে বাইসাইকেল চড়ে। রাস্তার ওপর দিয়ে সম্পূর্ণ নিঃশব্দে চলে গেছে।

 

না, সে কখনোই প্যারিস সম্বন্ধে লেখেনি। যে-প্যারিস তার কাছে যথেষ্ট মূল্যবান ছিল তা নিয়ে নয়, শুধু বাকিগুলোর সম্বন্ধেও তো সে কোনোদিন লেখেনি। সেই যে রেঞ্চ আর রুপোলি ধূসর সেজের ঝোপঝাড়, খালগুলোতে দ্রুত ধাবমান পরিষ্কার পানি আর আলফাআলফার ঘন সবুজ যে পানির গর্তগুলো ছিল, রাস্তাটা সেখানে টিলাগুলোর ওপর দিয়ে গেছে। গ্রীষ্মকালে ওখানে গরু-বাছুর চরত, তারা হরিণের মতোই সদা সচকিত। নিচে ঝরনার জলে ফেলার জন্যে যখন কেউ নানারকম জিনিস ফেলছে, তখন বাতাসেরও একটা স্থির টানা শব্দ উঠছে, তাতে ধুলোও উড়ছে। সন্ধ্যার আলোয় উপত্যকার ভিতর দিয়ে আসার সময় উপত্যকাটিকে কি উজ্জ্বলই না দেখা যেত! একবার সে মনে করে দেখল, সে নিচে নেমে আসছে বড়-বড় বৃক্ষের সারির ভিতর দিয়ে ঘোড়ার লেজ ধরে, কারণ কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। এই সমস্ত গল্প লিখতে চেয়েছিলে তুমি তার কিছুই লেখা হয়নি।

আর ওই যে ফাই-ফরমাশ খাটা ছোঁড়াটা যাকে ওই খামারের ভার দিয়ে বলা হয়েছিল, কেউ যেন ওখান থেকে এক আঁটি খড়ও না নিয়ে যায়। বেজন্মা বুড়োটা ছেলেটাকে মারত যখনই সে কিছু একটা খাবার জন্য কাজ কিছুক্ষণ বন্ধ রাখত। মারা শুরু হলে ছেলেটা হাত তুলে ঠেকাতে গেলেই বুড়োটা বলত, তাকে আবার পেটানো হবে। বোকা-হাঁদা ছেলেটা একদিন রান্নাঘরে রাইফেলটা পেয়ে গেল। বুড়োটা যখন তার দিকে আসছিল খামারের ভিতর দিয়ে, সে তাকে গুলি করল। পরে যখন খামারে লোকজন ফিরে এলো তারা দেখল, এক সপ্তাহ ধরে ওখানে পড়ে থাকায় দেহ একেবারে জমে গেছিল। কুকুররা ততদিনে দেহের অনেকটাই খেয়ে ফেলেছিল। তবু যেটুকু বাকি ছিল সেটা বেঁধে-ছেঁদে একটা কম্বলের মধ্যে ঢুকিয়ে দড়ি দিয়ে বেঁধে ছেলেটাকে বলা হল এটা তুলতে। তারপর তাদের মধ্যে দুজনে স্কি করার রাস্তার ওপর নিয়ে এসে শহরের মধ্যে দিয়ে ষাট মাইল পর্যন্ত নিয়ে গেল। তারপরে ছেলেটিকে ফিরতেই হলো। তার কোনো ধারণাই ছিল না যে, সে গ্রেফতার হয়ে যেতে পারে। সে ভাবল, সে যখন তার করণীয় কাজটা করেছে তাহলে সে বরং কিছুটা পুরস্কারই পাবে। কারণ সে ওই বুড়োটাকে বয়ে নিয়ে যেতে সাহায্যই করেছে। সবাই যেন জানতে পারে বুড়োটা কী রকম বদমাশ ছিল যে ছেলেটা কিছু আহার্য চুরি করতে চেয়েছিল, অবশ্য তার ছিল না, অন্যের ছিল। শেরিফ যখন তার হাতে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে দিল সে বিশ্বাসই করতে পারছিল না। সে কাঁদতে শুরু করল। এই একটা গল্প, এটা লেখার জন্য হ্যারি মনে করে রেখেছিল। সে জানত অন্ততপক্ষে বিশটা গল্প সেখান থেকে সে লিখতে পারে আর তাদের একটাও সে লেখেনি। কেন?

 

তুমি তাদের জিগ্গেস করো, কেন? হ্যারি বলল।

কিসের কেন ডার্লিং?

কেন কিছুই নয়।

মহিলা যে খুব বেশি মদ্যপান করতেন, তা নয়। অন্তত হ্যারিকে কাছে পাওয়ার পর সে আর তেমন মদ্যপান সত্যিই করত না। কিন্তু হ্যারি যদি বেঁচে থাকত তার সম্বন্ধে কিছুই সে লিখত না। এখন হ্যারি জানে কারোর সম্বন্ধেই না। ধনীরা নির্বোধ হয়, বড্ড বেশি মদ্যপান করে এবং বড্ড বেশি জুয়া খেলে। তারা স্থূলবুদ্ধি নির্বোধ আর বারবার একই কথা বলে। তার মনে পড়ল, বেচারা জুলিয়ান কেমন করে একটা গল্প লিখতে শুরু করেছিল এইভাবে ‘যারা খুব ধনী তারা তোমার আমার থেকে আলাদা।’ তারপর কে একজন    জুলিয়ানকে বলল, হ্যাঁ, তাদের টাকা আছে। এ-কথা শুনে মজা পেল না জুলিয়ান। সে ভাবত তারা বিশেষ একটা জাঁকজমক এবং আড়ম্বরপূর্ণ জাতি! যখন সে এটা বুঝতে পারল যে, তারা তা নয় তখন এটা তাকে প্রায় বিধ্বস্ত করে দিল। যেমন আগে যে-কোনো জিনিস তাকে ধ্বংসই করে দিয়েছে।

যারা ধ্বংস হয়েছে তাদের প্রতি তার ঘৃণাই ছিল। হ্যারি যেহেতু এটা বুঝত, সেজন্য সে এটা পছন্দও করত না। যে-কোনো জিনিস সে ঝেঁটিয়ে বিদায় করতে পারত। কারণ কেউ কাউকে কোনোভাবেই আঘাত করতে পারবে না, যদি সে তোয়াক্কাই না করে।

ঠিক আছে, এখন সে মৃত্যুকে তোয়াক্কা করবে না। একটা জিনিসকেই সে ভয় পেয়ে এসেছে, সে হলো তীব্র যন্ত্রণা। যন্ত্রণা সে সহ্য করতে পারে অন্য যে-কোনো লোকের মতো, যদি না এটা আর বেশিক্ষণ ধরে চলে, তাকে একেবারে পরিশ্রান্ত করে তোলে। কিন্তু এখানে কিছু একটা রয়েছে, যা তাকে ভীতিজনকভাবে আঘাত করছে আর ঠিক তখনই যখন সে এটা বোধ করতে পারল যে, এটা তাকে বিধ্বস্ত করে ফেলেছে তখনই যন্ত্রণাটা থামল।

তার মনে পড়ল, অনেক আগে যখন উইলিয়ামসন বোমা ফেলার দায়িত্বে নিযুক্ত ছিলেন তখন একদিন নিজেই বোমাতে আহত হলেন। বোমাটা জার্মান পাহারাদাররা তার দিকে ছুড়েছিল যখন তিনি সেই রাতে ফিরে আসছিলেন তারগুলোর ভিতর দিয়ে। তিনি তখন চিৎকার করে প্রত্যেকের কাছে অনুরোধ করছিলেন তাকে হত্যা করার জন্য। তিনি ছিলেন একজন মোটাসোটা খুবই সাহসী ভালো অফিসার। তবে কিছু অদ্ভুত ধরনের ব্যাপারে তিনি খুব আসক্ত থাকতেন। সে-রাত্রে তিনি যখন তারে আটকা পড়েছিলেন তখন একটা তীব্র আলো তাকে শূন্যে তুলে দিয়েছিল আর তার সমস্ত নাড়িভুঁড়ি বেরিয়ে ওই তারকাঁটায় ঝুলছিল। ওরা জীবন্তই নিয়ে এলো, তবে তাকে নিয়ে আসার জন্যে তারকাঁটাগুলো কেটে তাকে বের করা হয়েছিল। হ্যারি আমাকে গুলি কর, যিশুর কসম। আমাকে গুলি কর। তখন তাদের মধ্যে তর্কাতর্কি হয়েছিল আমাদের খ্রিষ্ট সম্বন্ধে। লর্ড বলেছেন, কোনো কিছুই তোমাদের কাছে পাঠানো হয় না, যা তোমরা সহ্য করতে পার না। একজনের তত্ত্ব ছিল, যে কোনো একটা সময়ে যন্ত্রণাটা আপনা-আপনিই চলে যায়। কিন্তু সে সবসময়ই উইলিয়ামসনকে মনে করত, সেই রাতের উইলিয়ামসন। কিছুতেই উইলিয়ামসনের একটুও উপশম হয়নি। হ্যারি তার সব মরফিন ট্যাবলেট তাকে দিয়ে দিয়েছিল, যা সে নিজে ব্যবহার করবে বলে রেখে দিয়েছিল। কিন্তু তারপরও সেগুলো ঠিকমতো কাজ করেনি।

এটা যদি যেমন রয়েছে তেমনিই থাকত, তার চেয়ে খারাপ না হতো, তাহলে এটা নিয়ে তার দুশ্চিন্তাই থাকত না। সে হয়ত আরো ভালো সঙ্গীদের সঙ্গে সময় কাটাতে পারত।

কী ধরনের সঙ্গ সে পছন্দ করত তা নিয়ে সে একবার ভাবল।

নাঃ, সে ভাবল, যখন যা কিছু কর, তুমি লম্বা সময় ধরে কর আর দেরি করে ফেল। তখন কিন্তু তুমি তোমার চারপাশে মানুষজন থাকবে এটা আশা করতে পার না। সমস্ত লোক চলে গেছে, পার্টি শেষ। তুমি এখন তোমার দেখভালের কর্ত্রীর সঙ্গে রয়েছে।

ওঃ, আমি বিরক্ত হতে-হতে মারা যাচ্ছি। সে ভাবল, মরণসহ সবকিছু নিয়ে আমি এখন অত্যন্ত বিরক্ত বোধ করছি।

ভীষণ ক্লান্তিকর? চেঁচিয়ে বলল সে।

কী বলছ ডার্লিং?

যা কিছু করা হয় বড্ড লম্বা সময় ধরে কর।

এই বলে সে মহিলার মুখের দিকে তাকাল। তার আর আগুনকুণ্ডির আলোর মাঝখানে তখন মহিলাটি বসে। তিনি একটা ক্যাম্বিসের চেয়ারে হেলান দিয়ে বসেছেন। তার সুন্দর প্রফুলস্ন মুখের ওপরে আলো পড়েছে। তার মনে হলো, মহিলার বোধহয় ঘুম পাচ্ছে, শুনতে পেল, হায়েনাটা আবার চিৎকার করছে। আগুনটার বৃত্তের ঠিক বাইরে।

আমি লিখছিলাম, হ্যারি বলল। কিন্তু ক্লান্ত হয়ে পড়েছি।

তুমি কি মনে কর এখন তুমি ঘুমোতে পারবে?

নিশ্চয় পারব। তুমি ভিতরে যাও না কেন?

আমি এখানে তোমার পাশেই বসে থাকতে চাই।

আচ্ছা, তোমার কি কিছু অদ্ভুত লাগছে? হ্যারি মহিলাকে জিগ্গেস করল।

না তো, একটু ঘুম পাচ্ছে।

আমি কিন্তু অদ্ভুত কিছু অনুভব করছি।

সে আরেকবার মৃত্যুর আসা অনুভব করল। সে বলল মহিলাকে, জান, যে জিনিসটি আমার কখনো নষ্ট হয়নি সেটা হলো আমার কৌতূহল।

তোমার কোনো কিছুই নষ্ট হয়নি। তুমি হচ্ছো আজ পর্যন্ত আমার দেখা সম্পূর্ণ মানুষ।

হায় যিশু, কত কম জানে মহিলারা! কীভাবে বলছি? এটা কি তোমার বোধের ব্যাপার?

কারণ ঠিক তখনই মৃত্যু এসেছে। সে তার মাথাটা খাটের পায়ের দিকে ঠেস দিয়েছে। মৃত্যুর গন্ধ পাচ্ছিল হ্যারি। সে বলল, তুমি কখনো ওই সমস্ত কাসেত্ম, মাথার খুলি এইসব বিশ্বাস করবে না। দুজন বাইসাইকেলে চড়া পুলিশ হতে পারে এটা কিংবা একটা পাখি অথবা একটা হায়েনার চওড়া মুখ। এটা এখন তার ওপরে চেপে বসেছে। কিন্তু তার এখন আর কোনো আকার নেই, আকৃতি নেই। এটা শুধু জায়গা দখল করে আছে। একে বল চলে যেতে।

 

সে চলে গেল না। বরং আরেকটু কাছে এলো।

ইস্, কি বিশ্রী দুর্গন্ধ তোমার নিঃশ্বাসে, সে তাকে বলল, নোংরা বেজন্মা কোথাকার। তবু সে আরো কাছে চলে এলো। এখন হ্যারি আর কোনো কথা বলতে পারছে না। মৃত্যু যখন দেখল, সে আর কথা বলতে পারছে না তখন সে আরো কাছে এলো। হ্যারি এখন চেষ্টা করল কোনো কথা না বলে তাকে সরাতে। কিন্তু সে তার দিকেই আরো সরে এলো, ওর ভারটা হ্যারির ওপর চেপে বসল। সে গুড়ি মেরে
আসছিল, হ্যারি কথা বলতে পারছিল না, উঠতেও পারছিল না, তখন সে মহিলাটিকে বলতে শুনল, সাহেব এখন ঘুমিয়ে পড়েছে। খাটিয়াটা আসেত্ম করে তুলে ক্যাম্পের মধ্যে নিয়ে এসো।

সে হেলেনকে বলতে পারল না মৃত্যুকে সরে যেতে বলতে। সেটা এখন আরো গুড়ি মেরে এগিয়ে এসেছে, আরো ভারী। সে  নিঃশ্বাস নিতে পারছে না। তারপর ওরা খাটিয়াটা তুলল, হঠাৎ করে সব যথাযথ হয়ে গেল, আর তার বুকের ওপর থেকে ভারটা নেমে গেল।

এখন সকাল। সকাল বেশ কিছুক্ষণ আগে হয়েছে এবং এখনো সকালই রয়েছে। সে উড়োজাহাজটাকে দেখতে পেল। খুব ছোট্ট দেখাচ্ছিল। তারপর সেটা বড়-বড় চক্কর দিতে শুরু করল আর চাকর-বাকরগুলো ছুটে বাইরে চলে গেল, কেরোসিন দিয়ে আগুন জ্বালাল, শুকনো ঘাস জড়ো করল, তারপর দুটো বেশ বড়সড় জায়গা ঠিক করল উড়োজাহাজ নামার জন্য। ভোরবেলার বাতাস আগুনের ছাইভস্মকে ক্যাম্পের দিকে সরিয়ে আনছিল। উড়োজাহাজটা আরো দু-বার চক্কর দিল। এখন অনেক নিচে নেমে এসেছে। তারপর মসৃণভাবে ভূমিতে নামল, আর পূর্বপরিচিত কম্পটন সাহেব সস্ন­vকস একটা টুইড জ্যাকেট আর একটা বাদামি ফেল্ট হ্যাট মাথায় দিয়ে তার দিকে এগিয়ে এলো। কম্পটন জিজ্ঞেস করল, কী খবর হে?

পায়ের অবস্থা খুব খারাপ। তুমি কি সকালবেলার নাস্তা খাবে?

ধন্যবাদ, আমি একটু চা খাব।

তুমি জান যে এটা ছোট্ট পুশ মথ। আমি তো মেমসাহেবকে  এটাতে নিয়ে যেতে পারব না। মাত্র একজনের জায়গা আছে। তোমার লরি আসছে, পথে রয়েছে।

হেলেন কম্পটনকে একপাশে নিয়ে গিয়ে তার সঙ্গে কথা বলল। কম্পটন আবার ফিরে এলো, আগের থেকে সে প্রফুলস্ন।

আমরা এক্ষুনি তোমাকে প্লে­নে তুলব। তারপর আবার আমি মেমসাহেবকে নেওয়ার জন্য আসব। এখন আমার মনে হচ্ছে আরুসাতে হয়তো জ্বালানি নেওয়ার জন্য একবার থামতে হবে। মনে হয় এখুনি আমাদের যাওয়া উচিত।

কী হলো, চা খাবে না?

না, না, এখনই আমি চা খাওয়ার কথা ভাবছি না।

চাকর-বাকররা খাটিয়াটাকে তুলে সবুজ ক্যাম্পগুলো ঘুরে পাথরের নিচে গিয়ে প্লে­ন পর্যন্ত সমতল জায়গাটা পেরিয়ে গেল। এই জায়গাটা এখনও রোদে পুড়ছে। ঘাস সবই পুড়ে গেছে আর আগুনে জোর বাতাস দিচ্ছে। তাকে ভেতরে তোলা খুব মুশকিল হচ্ছিল। তবে একবার যখন সে একটা চামড়ার সিটের ওপরে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়তে পারল – আর তার পা-টা সোজা হয়ে রইল সিটের পাশ দিয়ে তখন তার আর কোনো অসুবিধা হচ্ছিল না। কম্পটন বসল    ওখানেই। প্লেনের ইঞ্জিন চালু করল। হেলেনের দিকে সে হাত নাড়ল, চাকর-বাকর যারা ছিল তাদের দিকেও। পে­নের ইঞ্জিন যেভাবে গরম হয়ে শব্দ করে সেরকম শব্দ উঠল। তারপরে সেটা মাটিতে যে সমস্ত ছোটখাট গর্ত ছিল তার ওপর দিয়ে গড়াতে লাগল, দু-তিনবার লাফাল, তারপরে যেখানে আগুন জ্বলছিল তার পাশে লম্বা খোলা জায়গাটায় আর একবার লাফিয়ে উঠল, তারপরেই আকাশে উড়ল। সে দেখতে পেল ওরা নিচে হাত নাড়ছে, টিলার পাশেই ক্যাম্পটা এখন আসেত্ম আসেত্ম চ্যাপ্টা হয়ে যাচ্ছে আর সমতল জায়গাটা কী রকম ছড়িয়ে পড়ছে। গাছপালার জঙ্গল, সমতল দেখান ঝোপঝাড়, জীবজন্তু যাবার রাস্তাগুলো এখন এমন শুকনো যে ছোটখাট পুকুরগুলো ছিল তারা তার ওপর দিয়ে সমানে দৌড়ুচ্ছে। তারপর পানি দেখা গেল, যে পানি সে আগে দেখেনি। কম্পটন জেব্রা দেখতে পেল। এখন জেব্রাগুলোকে পেছন থেকে বেশ সুন্দর গোলাকৃতির দেখাচ্ছে। টুইড কোট আর ফেল্ট হ্যাট মাথায় কম্পিকে দেখা গেল। বড়-বড় হরিণকে দেখা গেল লম্বা-লম্বা আঙুল নিয়ে সমতল ভূমিতে চরে বেড়াচ্ছে। টিলাগুলোর ওপর দিয়ে যাচ্ছে, তাদের নিচে দৌড়ুচ্ছে ওয়াইল্ডারবিস্টগুলো। এবার তারা যাচ্ছে পাহাড়গুলোর ওপর দিয়ে – হঠাৎ নিচে সবুজ অরণ্যের গভীরতা নজরে পড়ল আর তার ঢাল বেয়ে ঘন নিবিড় বাঁশবন, তারপর আবার গভীর অরণ্য, আর মাঝে মাঝে বনের মধ্যে মাথা উঁচু করে রাখা পর্বতশীর্ষে – এইরকম চলল যতক্ষণ না তারা নিচু টিলাগুলোর ঢাল ধরে আবার একটা সমতল জায়গায় পৌঁছুল। জায়গাটা গরম, লালচে ধূসর রং ভীষণ গরম – এবার কম্পি একবার ঘাড় ফিরিয়ে পিছন দিকে চেয়ে দেখল কেমন করে সে প্লেনটাকে চালিয়ে এনেছে। আরো কিছু উঁচু পর্বত অবশ্য সামনে আছে।

তারপর আরুশা যাওয়ার বদলে তারা বাঁয়ে মোড় নিল। সে হিসেব করে দেখল যথেষ্ট গ্যাস এখনো আছে। নিচের দিকে তাকিয়ে দেখা গেল লালচে একটা মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে আর মেঘের ভিতর দিয়ে একটা ঝড়-ঝড় কোথা থেকে এলো সে বুঝতে পারল না। মরসুমের তুষারঝড়ের মতোই মনে হলো। ঝড়টা দক্ষিণ-দক্ষিণ দিক থেকেই এলো। তারপর তারা আবার ওপরে উঠতে শুরু করল।
তারা পুব দিকেই যাচ্ছে বলে মনে হলো। তারপর সন্ধে হলো, আঁধার নামল আর তারা একটা ঝড়ের মধ্যে পড়ল। এত ঘন বৃষ্টি যে, মনে হল, জলপ্রপাতের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। সেখান থেকে বেরিয়ে কম্পি মাথাটা একটু ফিরিয়ে দেখল আর হাসল। আর আঙুল তুলে দেখাল সামনে কী রয়েছে। পৃথিবীর মতো বিরাট বিশাল উঁচু অবিশ্বাস্য রকমের সাদা কিলিমান্জারো পর্বত। তখন হ্যারি জানল সে কোথায় চলেছে।

ঠিক তখনই হায়েনাটা বিশ্রী আওয়াজ করা থামাল আর একটা অদ্ভুত, প্রায় মানুষের মতো কেঁদে ওঠার শব্দ করল। সেটা শুনতে পেয়ে হেলেন অস্বসিত্মর সঙ্গে বিছানায় নড়েচড়ে উঠলেন। তিনি ঘুম থেকে জাগেননি, স্বপ্নে তিনি দেখছেন : তিনি লং আইল্যান্ডে তার বাড়িতে আছেন আর এটা হচ্ছে তার মেয়ের পেশাগত জীবন শুরু করার প্রথম রাত্রি। যেভাবেই হোক তার বাবা সেখানে ছিলেন। তিনি তখন বড্ড রূঢ় হয়েছিলেন। হায়েনার আওয়াজটা এতই জোরে তিনি শুনলেন যে, জেগে গেলেন এবং একটা মুহূর্তের জন্য বুঝতে পারলেন না কোথায় তিনি রয়েছেন। ভীষণ ভয় পেলেন তিনি। তারপর
টর্চলাইটটা নিলেন আর খাটিয়ার ওপর ফেলে দেখলেন তারা হ্যারিকে ভিতরে নিয়ে এসেছে। সে ঘুমোচ্ছে। মশারির ভিতর দিয়ে তার শরীর দেখা যাচ্ছিল কিন্তু তার একটা পা বাইরে বেরিয়ে এসে খাটিয়ার পাশে ঝুলছিল। ঘায়ের ওপর যে ব্যান্ডেজ ছিল সেটা খুলে নিচে এসে পড়েছে। ওর সেই ভয়ানক ক্ষতের দিকে মহিলা তাকাতে পারলেন না।

মলো, চিৎকার করে উঠলেন তিনি। মলো… মলো…

তারপর তিনি ডাকলেন, হ্যারি… হ্যারি…। তারপর তার কণ্ঠ আরো ওপরে উঠল, ও… ও… হ্যারি…। কোনো উত্তর এলো না। তিনি তার নিঃশ্বাস নেওয়ার আওয়াজ শুনতে পেলেন না।

ক্যাম্পের বাইরে হায়েনাটা আবার ওই অদ্ভুত আওয়াজটা করে উঠল। এই আওয়াজটাই তাকে জাগিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু তার নিজের হৃৎপি- এমন ধব্-ধব্ আওয়াজ করছিল যে, হ্যারির নিঃশ্বাসের শব্দ তিনি শুনতে পাননি। r