কেউ কারো কথা শোনে না

রেজাউর রহমান

আমি দিনকয়েক হলো শিকাগোতে এসেছি। একমাত্র মেয়ে মঞ্জুরীর গ্র্যাজুয়েশন-কনভোকেশন। মেয়ের এখানকার লেখাপড়া শেষ। অনুষ্ঠান শেষে ঢাকায় ফিরে যাবো। শিকাগো আমেরিকার অন্যতম এক শহর। এটি উইন্ডি সিটি নামে পরিচিত। সারাবছর এ-শহরে এলোমেলো ঠান্ডা বাতাস বয়। এর প্রধান কারণ, এ-শহরাঞ্চলে লেক মিশিগানের অবস্থান। এই লেক পৃথিবীর সর্ববৃহৎ প্রাকৃতিক হ্রদের একটি।

সকাল থেকে ঘরে বসা। ছোট ঘর – নড়াচড়ার যথেষ্ট জায়গা নেই।  তাই মেয়েকে বলছিলাম, চল একটু ঘুরে আসি। প্রথমটায় ঠান্ডার অজুহাতে সে বারণ করেছিল। পরে সে-ই আবার প্ল্যান করলো, চলো কাছেই ট্রেনস্টেশন। হিটেড ট্রেন। একবার তাতে চড়ে বসতে পারলে শিকাগো শহরের একটা বিশেষ এলাকা চোখে পড়ে। একটু গরিব এলাকা, তবে দৃশ্যটা মন্দ না। উঁচুনিচু গাছগাছালিতে ভরা। বরফ পড়লে আরো সুন্দর লাগে। সাদা বরফে কালো গাছের কঙ্কাল। তাই মা-মেয়ের বেরিয়ে পড়া।

আমরা ডেভিস সিটিএ (রেল) স্টেশন – ইভানস্টনে দাঁড়িয়েছিলাম। ট্রেনের অপেক্ষায়। সন্ধ্যালগ্নের অন্ধকার ছাড়িয়ে স্টেশন ছাদের সামান্য দূরত্ব পরপর সাজানো হাইপাওয়ারের এনার্জি বাল্বগুলো জ্বলে আছে তেজী আলো ছড়িয়ে। এখানকার আরেকটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো, এ-বাতিগুলো যে শুধু আলো ছড়াচ্ছে তাই নয়, বরং এগুলো যথেষ্ট পরিমাণে উষ্ণতা উত্তাপও বিলিয়ে চলে, যা অপেক্ষায় থাকা যাত্রীদের শীত নিবারণের সহায়ক এক বিধিব্যবস্থাও। যার-যার সুবিধাজনক অবস্থানে দাঁড়িয়ে ঘুরেফিরে যাত্রীরা সেই উষ্ণতা উপভোগ করছে। আমরাও তা থেকে বাদ গেলাম না।

আর তখনই সাদা ধবধবে মাথাভরা চুল, নাদুস-নুদুস দেহভার সামলে ভদ্রমহিলা দুকদম এগিয়ে এসে হাতমোজা পরা বাঁ-হাতে ডানটা খুলে স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ খালি হাত বাড়িয়ে দেন আমার দিকে।

‘আমার নাম ইয়ানা নোভাকোভা।’

আমি এ-পরিস্থিতির জন্য মোটেই প্রস্ত্তত ছিলাম না।

আমি এখন প্রচন্ড শীতে জবুথবু, একেবারেই কোণঠাসা এক নিশ্চল রোবটম্যান হয়ে আছি। সজ্ঞানে যেন আমার হাত-পা নাড়ারও জো নেই। এক অর্থে আমার শরীরের তখন শুধু বেরিয়ে আছে দুটি চোখ ও নাসারন্ধ্র। পারতপক্ষে আমি যেন চাইছিলাম, কোনো প্রকারে যদি আমার চোখ-নাক ঢেকে ফেলতে পারতাম, তাহলে হয়তো আমার আরেকটু রক্ষে হতো। শীতের কাঁপুনি-ঝাঁকুনি থেকে রেহাই পেতাম আরো খানিকটা। শিকাগোর  আবহাওয়ার পূর্বধারণা আমার যথাযথ ছিল না। বিশেষ করে নভেম্বর-ডিসেম্বরের। মঞ্জুরী এসে আমাকে সাবধান করেছিল।

বর্ষীয়ান নাদুস-নুদুস ভদ্রমহিলা খোলা হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছেন আগের মতোই।

‘আই অ্যাম ইয়ানা নোভাকোভা।’

এবার আমার মেয়ে মঞ্জুরী এগিয়ে আসে। আমার ডান হাতের মোজা খুলতে আমাকে সে সাহায্য করে। আমি কাঁচুমাচু হয়ে হাত এগিয়ে দিই।

‘আই অ্যাম শামীমা মোহসীন।’

‘কী সুন্দর নাম!… সাউন্ডস মিউজিক্যাল।’

এটি তোমার মেয়ে?

‘হ্যাঁ’

‘তার নাম?’

‘মঞ্জুরী মোহসীন।’

বিউটিফুল।… ওয়াও…।’

ইয়ানা কৌতূহল প্রকাশ করেন।

‘তোমার হাসব্যান্ডের নামের শেষ কি মোহসীন?’

‘না… তাঁর পুরো নাম, মোহসীন আলী খন্দকার?’

‘তাহলে তুমি তোমার পরিচয়ের ক্ষেত্রে প্রথম নামটা ব্যবহার করেছো… তোমার ফ্যামিলি নাম যে খন্দকার?’

মঞ্জুরী বিরক্ত হয়ে আমার সাহায্যে এগিয়ে আসে।

‘আমরা নামের ব্যাপারে তোমাদের মতো রিজিড নই। আমরা ইচ্ছামতো তা বসাই।’

‘কিন্তু এটা তো ঠিক নয়। পাসপোর্টের ক্ষেত্রে?’

‘হ্যাঁ… অসুবিধা হয়। একত্রে ট্রাভেল করলে ইমিগ্রেশনে ফ্যামিলি নেইম দেখে। তখন বুঝিয়ে দিতে হয়… আমরা এসব ওয়েস্টার্ন ফর্মালিটিসের ধার ধারি না। আমরা আমাদের মতো চলি… আমরা ওরিয়েন্টাল।’

‘ওহ ভালো কথা, তোমাদের দেশের  খবর তো নিইনি। তোমরা কি ইন্ডিয়ান?’

‘না?…. আমরা বাংলাদেশি।’

মঞ্জুরী বিরক্তির সাঁজ মিশিয়ে বলে দুপা সরে একটু দূরে গিয়ে দাঁড়ায়। এবং চোখেমুখে ঔদাসীন্যের ভাব ফুটিয়ে অন্যদিকে চেয়ে থাকে।

ইয়ানা যেন তাই চাইছিলেন। আমার কাছে এগিয়ে আসেন তিনি।

‘দিস নিউ জেনারেশন বড় অ্যারোগ্যান্ট। আমাদের মতো বয়স্কদের সব কথায় তারা বিরক্তি প্রকাশ করে। মনে করে আমরা অবান্তর কথা বলি।… এসব ছাইভস্ম শোনার কী আছে?…’

একটু থেমে আবার বলে যান ইয়ানা।

‘আসলে কি তাই… আমাদের অগাধ অভিজ্ঞতা… দীর্ঘ জীবনের অভিজ্ঞতা শুনলে তোমাদের মঙ্গল হবে, ভালো হবে, সেটা কি তারা বোঝে… মোটেই না। আবার তরুণ সমাজ কেন… বয়স্করাও কি শোনে কারো কথা?’ আমি সম্মতিসূচক মাথা নাড়ি। ভদ্রমহিলা আরো উৎসাহিত হন।

‘ভালো কথা, নামের ব্যাপারে বলছিলাম। আসলে আমার নাম তিনটা : ১. ইয়ানা নোভাকোভা ২. ইয়ানা অ্যাঙ্গেল ম্যানোভা ৩. তিলকসিং ওরোরা।’

আমি কৌতূহল প্রকাশ করি, ‘তিনটা কেন?’

ততক্ষণে হাওয়ার্ড-বেলমন্ডমুখী রেল চলে আসে হা-হা করে। দ্রুতগতিতে।

মঞ্জুরী আমাকে টেনে নিয়ে সরাসরি খোলা ট্রেন-কামরার খোলা দরজায় না উঠে পেছনেরটায় উঠে যায়। হয়তো সে ইয়ানাকে পাশ কাটাতে চেয়েছিল, কিন্তু সে সফল হয়নি। ইয়ানা প্রায় উঠে যাওয়া কামরা থেকে নেমে দ্রুতগতিতে আমাদের বগিতে এসে চড়েন। আমার পাশে বসে পড়ে হাঁপাতে থাকেন।

‘আরেকটু হলে ট্রেনটা মিস করে ফেলেছিলাম। আচ্ছা ভালো কথা, তোমাকে তিনটা নামের কথা বলছিলাম… আমি জাতিতে চেক্ – চেকোশ্লোভাকিয়ার বাসিন্দা। আমার প্রথম স্বামীর নাম ব্লাদমির নোভাক। সে করতো টুপির ব্যবসা। আমি আমার ফ্যামিলি নেইম ছেড়ে হয়ে গেলাম ইয়ানা নোভাকোভা। আমি তখন থাকি প্রাগে। বিজ্ঞান অ্যাকাডেমি জীব গবেষণাগারে কাজ করি। সারা পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা আসতেন সেখানে। এলো ডেভিড অ্যাঙ্গেলম্যান। তেষট্টি বছরের বুড়া কিন্তু মেয়েপাগল। আমার বয়স তখন তেত্রিশ। ভরাদেহী চেক সুন্দরী… আমার রূপের খ্যাতি ছোটবেলা থেকে। বুড়া আমেরিকান বিজ্ঞানী আমার পেছন পেছন… সারাক্ষণ। মাথায় বুদ্ধি খেলে যায়। এই তো সুযোগ। তখন সোভিয়েত সমাজতন্ত্র ভেঙে পড়ার পথে। আমাকে পাড়ি দিতে হবে গণতন্ত্রের দেশে। সেই প্ল্যানমতো একদিন বুড়ার ঘরে আমার শরীর অর্ধেকটা উদাম করে দাঁড়িয়ে গেলাম তার সামনে। সে এগিয়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে আর বিড়বিড় করে বলে চলে, ‘আই লাভ ইউ ইয়ানা।’ এইটুকুন বলতে পেরে ইয়ানা নির্ভার এক বেলেল্লাপনার চাপা হাসি হাসেন, যা আমাকে এক বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দেয়। তাঁর হাসিটা আমার ভালো লাগেনি।

ততক্ষণে আমার ট্রেন ড্যামস্টার ছেড়ে মেইনে চলে আসে। ঘণ্টা বাজিয়ে তা থামে। যাত্রী নামে, যাত্রী ওঠে লাইন ধরে।

‘ওহ্… ভালো কথা, তোমরা কোথায় নামবে?’ ‘আমি যাবো হেওয়ার্ড স্টেশন ছাড়িয়ে বেলমন্ড। সেটা শেষ স্টেশন। আমি সেখানে নেমে মিনিট পাঁচেক হাঁটি। হাঁটা শরীরের জন্য ভালো।…’

‘আমরা কোথাও যাবো না। আমরা এমনি বেরিয়েছি। ঘরে বসে বসে…। একটু এই আউটিং আর কী… শেষ অবধি গিয়ে আবার ফিরে যাবো ইভানস্টনে… একই ট্রেনে।’

আবার বকে যেতে শুরু করেন ইয়ানা।

‘বোর হচ্ছো না তো?’

‘না।’ বলে আমি মঞ্জুরীর দিকে চাই। আড়ে-আড়ে। দেখি সে রাগত। মহিলার ওপর যথেষ্ট বিরক্ত। আমার ভাবমর্জি অন্যরকম। বকে যাক না অন্তত একজন সঙ্গীসাথি পাওয়া গেছে। এ-শহর বিদেশ বিভুঁইয়ে কে কাকে পুছে?

‘শোনো, এরপরের ঘটনা তেমন দীর্ঘ নয়। ডেভিড অ্যাঙ্গেলম্যান একেবারে ধরাশায়ী। ষাট পেরোনো বৃদ্ধের হাতের নাগালে উপচেপড়া পরিপূর্ণ নারীদেহের স্বাদ আস্বাদনের মাতলামো বলো আর পাগলামিই বলো না কেন, সে এক ভয়ংকর জিনিস। ডেভিড আমার দেহের ওপর নেতিয়ে পড়ে যেতে যেতে বলে যায়, তোমায় ছাড়া আমি প্রাগ ছাড়ছি না। মরে গেলেও না।’

রেল তখন সাউথ বুলেভার স্টেশন ছুঁয়ে চলছে। হেওয়ার্ডের দিকে।

ইয়ানা চপল হাসি হেসে বলতে থাকে, ‘আমি সেই সুযোগেই ছিলাম। আমি বললাম, আমার যে দুই মেয়ে… তাদের রেখে…? ডেভিড বলে, তারা আমারও মেয়ে। সবাই একসঙ্গে যাবো।’

আমার সন্দেহ হয়।

‘তুমি পারবে?’ সে মুচকি হাসে। ‘আমার একদিন মাত্র লাগবে। আমি আমেরিকান প্রফেসর…।’

‘মদ্যপ ব্লাদমির নোভাককে ফেলে চলে এলাম আমেরিকায়। এখানে এসে দেখি অ্যাঙ্গেলম্যানের আরেক চেহারা। সারাদিন কাটে তার বিশ্ববিদ্যালয়ে, না হয় স্টাডিরুমে। বইপত্র, লেখালেখি… কম্পিউটার…। এই তার জীবন! আমি তখন বিচলিত। আমার সময় কাটে না।’

রেল হেওয়ার্ডে এসে থামে। যাত্রী ওঠে। যাত্রী নামে।

তিনি বলে যান,

‘দেখো শামীমা… আমেরিকা এমন এক জায়গা… চোখ খোলা রাখলে বাঘের চোখও পাওয়া যায়। পেয়ে গেলাম তিলক সিংকে। সে বিরাট এক মলের হেড সিকিউরিটি গার্ড। ইন্ডিয়ান… ওয়ার ভেটার্ন।

ইন্ডো-চায়না ওয়ারে তিববত বর্ডারে গুরুতর আহত হয়েছিল। সেখানে অনেক ভারতীয় সৈন্য মারা যায়। পাবে আমাদের দেখা। দেখা থেকে প্রেম। প্রেম থেকে একত্রে বসবাস। লিভিং টুগেদার। আমাদের একটা ছেলে হয়েছিল। সে বাঁচেনি।’

বেলমন্ড সিটি স্টেশনে ট্রেন চলে এলে ইয়ানার নামার কথা। তিনি নামলেন না। ট্রেনের দরজা বন্ধ হয়ে যায়। ট্রেন ফিরে চলে মেইন ডেমেস্টার হয়ে ডেভিস স্টেশনে – ইভানস্টনের দিকে। ইয়ানা সরল হাসি হাসেন। ‘ঠিক আছে… বাংলাদেশি বন্ধু যখন পেয়েছি আরেকটু একত্রে কাটাই! গল্প করি। এখানে কার কথা কে শোনে?’

‘তোমাকে যে আবার একা ফিরতে হবে?’

‘হ্যাঁ… ফিরবো… কী আছে? আমার তো কোনো কাজ নেই বাড়িতে। আমি একা।’

‘একা কেন?’ আমি উদ্বিগ্ন হই। ‘মেয়েরা?’

‘ওরা অ্যাঙ্গেলম্যানের ওখানে থাকে। অ্যাডপটেড ডটার।’

‘তিলক সিং?’

‘ওহ্… হ্যাঁ… তিলক সিং অরোরার সঙ্গে গিয়েছিলাম পাঞ্জাবে। তার গ্রাম ইছালঘেরায়। সুন্দর নদীঘেরা গ্রাম। গাছগাছালিতে ভরা। আমার মন্দ লাগছিল না… কিন্তু সমস্যা হয়ে দাঁড়ালো অন্য জায়গায়।…’

একটু থেমে বিচিত্র হাসি হাসেন ইয়ানা।

‘গোবর-লেপা মাটির ঘর সই করতে পারলাম কোনোমতে; কিন্তু স্বয়ং আধা আমেরিকান তিলক যখন আমাকে বললো, তোমাকে গরুর গোবর খেয়ে শুদ্ধ হতে হবে… এ-সমাজে বসবাস করতে হলে। তখন আর থাকতে পারলাম না। ফিরে এলাম আমেরিকায়। তিলক সিং অরোরা রয়ে গেল দেশে।’

ততক্ষণে ইভানস্টোনের ডেভিস স্টেশনে আমাদের নামতে হয়। আমাদের গন্তব্যস্থল।

আমরা নেমে পড়ি। নামে ইয়ানাও। আমি অবাক হলাম।

‘কই তুমি নামলে যে?’

‘তোমাদের বাড়ি পৌঁছে দিই… কী আছে? আমার বাড়ি ফেরার তাড়া নেই। আর তোমাদের বাড়িটাও চেনা হলো…।’

মঞ্জুরী খু-উ-ব বিরক্ত হয়।

‘তুমিও আর কাজ পাও না। কোথাকার এক বুড়ি… তার সঙ্গে তুমি কথা বলো কেন? যতসব পাগলের পাগলামি… কখন থেকে বুড়ি আমাদের পেছন পেছন…!’

ইয়ানা আমাদের বাড়ির দোরগোড়া পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে বিদায় নেয়।

‘বাড়িটা চিনে গেলাম। ফ্ল্যাট নাম্বারটা?’

‘৩০২।’

ইয়ানা আমাকে গালে চুমো খেয়ে বিদায় নেয়। মঞ্জুরীকে তিনি তাঁর নাগালে পেলেন না। ততক্ষণে মঞ্জুরী দ্রুত দুয়ার ঠেলে বিল্ডিংয়ে ঢুকে গেছে। শীতের অজুহাতে।

 

সকাল থেকে এই উইন্ডি সিটি এর ভয়াবহ তান্ডবনৃত্যের মহড়ায় মাতোয়ারা হয়ে উঠেছে। শুরু হয়েছে ভারী তুষারপাতের তোড়। সঙ্গে মিশিগান লেক থেকে ছুটে আসা তীক্ষ্ণ বেতালা বাতাসের এলোপাতাড়ি ঝাপটা। পথঘাট প্রায় জনমানবশূন্য। হাঁটা পথচারী নেই বললেই চলে। গাড়িঘোড়ার চলাচল আছে বইকি। তাও অন্যদিনের তুলনায় কম। তিন মিলিয়ন লোকের শহর যেন প্রায় স্থবির।  বেশিরভাগ মানুষ ঘরমুখো অন্তরীণ।

কিন্তু আমার যে অন্তরীণ হওয়ার জো নেই। আমাদের শিকাগো-ঢাকা ফ্লাইট বিকেল ৫টায়। নিদেনপক্ষে ঘণ্টাতিনেক আগে আমাদের ও’হের  বিমানবন্দরে পৌঁছতে হবে। আজ রানওয়ের অবস্থা কেমন কে জানে? গতকাল একমাত্র বিকেলবেলাতেই ৪৫০ ফ্লাইট ক্যানসেল হয়েছে। আজ না আবার কোন অবস্থা হয়? আমরা সকাল থেকে মোটামুটি তৈরিই ছিলাম। মঞ্জুরী ক্যাব বুকিং দিয়েছিল দুপুর ১টায়। কিন্তু রাস্তাঘাটের দুরবস্থা চিন্তা করে আমি তা এগিয়ে আনি ১২টায়। পথে বরফ জমে গেলে আরেক বিপদ। শুধু বিপদ নয়, সে এক মহাবিপদ। রাস্তাঘাট বরফজমার কারণে একবার পিচ্ছিল হয়ে গেলে গাড়ি এগোয় না। ঘুরপাক খায়। দেদার দুর্ঘটনা ঘটতে থাকে একে-একে।

সময়মতো ক্যাব আসে। আমরা বেরিয়ে পড়ি আমাদের ব্যাগ-লাগেজ নিয়ে। আমাদের ইভানস্টোনের বাসার মেইন গেট থেকে এগিয়ে  সামান্য হাঁটাপথ। স্নো-ফল হলেও এই হাঁটাপথ ব্যবহারযোগ্য থাকে। আমরা ট্রলি ঠেলে এগিয়ে যাই। দুকদম এগোতেই ইয়ানা এসে আমাদের সামনে দাঁড়ায়।

‘তোমরা চলে যাচ্ছো?’

‘হ্যাঁ।’

‘তোমাদের ফ্লাইট কয়টায়?’

‘৫টায়।’

‘এতো আগে!’

‘হ্যাঁ আগেই বেরোলাম… রাস্তাঘাটের যে অবস্থা।’

‘তা বটে। আমি এসেছিলাম… তোমাদের সঙ্গে দেখা করতে… তোমরা যে চলে যাবে… কাল তো বলোনি… আবার কবে আসবে?’

‘দেখি।’

মঞ্জুরী এগিয়ে যায়। তাড়া দেয় সে।

‘আম্মা আসো তো।’

ইয়ানা আমার সামনে দাঁড়িয়েই থাকে।

‘এই ট্রেন ধরে বেরিয়ে পড়েছিলাম। ভাবছিলাম… ভাবছিলাম… তোমাদের কথা। গতকাল তোমাদের সঙ্গ খুব ভালো লেগেছিল আমার।… কত গল্প না করলাম? কথা না বলতে পারলে কী ভালো লাগে… দিন কাটে কেমনে?’

একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে আবার বলে যান ইয়ানা।

‘এতো বড় শহর… এতো লোকের বাস… কিন্তু কথা বলার লোক পাই না। কেউ কারো কথা শোনেও না। তোমরা আবার কবে  আসবে?’

‘আসবো… দেখি।’

ইয়ানা আমার হাতের মুঠোয় তাঁর টেলিফোন নাম্বারটা দিন।

‘এসেই কল দেবে… কেমন।’

‘হ্যাঁ।’

আমরা এগিয়ে যাই। ইয়ানা আমাদের গালে চুমু খেয়ে বিদায় জানান।

গাড়িতে বসে মনে হলো ইয়ানাকে তো জাজ্বল্যমান এক মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে এলাম। আমরা যে আর কোনোদিন এদিকে ফিরে আসবো না। মঞ্জুরীর লেখাপড়া শেষ।

ট্যাক্সিক্যাব এগিয়ে চলে। ইয়ানার নিঃসঙ্কোচে বলে যাওয়া তাঁর জীবনের সব কথা আমার মনে পড়তে থাকে। তাঁর প্রতি আমার একধরনের ঈর্ষা জেগে ওঠে। অকপট প্রকাশের শক্তিতে সে বলীয়ান।

তখন মনে হতে থাকে, আমারও যেন কিছু বলার ছিল ইয়ানাকে। বলা হলো না। ট্যাক্সিক্যাব স্নো আইস কেটে এগিয়ে চলে। ও’হের বিমানবন্দরের দিকে। আমি আমার হাতের মুঠিতে রাখা ইয়ানার টেলিফোন নাম্বারটা একবার দেখে ভ্যানিটি ব্যাগে রেখে দিই। যতন করে।