কড়িশিমের ঝুনঝুনি

ইমতিয়ার শামীম

ধানের ডোলের ভেতর গুটিসুটি মেরে মরতে-মরতে বেঁচে থাকি আমরা। চারপাশে কালবৈশাখকাল গর্জায় আর আমাদের চোখজুড়ে মৃত্যুবিষাদ নামে, আমাদের গহিনে বেঁচে থাকার রোমহর্ষ জাগে। গা-হাত-পা বেয়ে বিড়বিড়িয়ে হাঁটছে ধানের পোকা; পায়ের পাতা, হাঁটু, কনুই থেকে শুরু করে সারাশরীরে লাগছে শুকনো ধানের তীক্ষ্ণ মাথার খোঁচা। যেন আমাদের বাঁচিয়ে রাখতেই এইসব অস্বস্তি ও যন্ত্রণার এত আয়োজন! বাঁচতে বাঁচতে আমরা তবু মরে যেতে থাকি – মরতে মরতেও কানগুলো বেঁচে থাকে আমাদের, চোখগুলো বেঁচে থাকে আমাদের, আরও বেঁচে থাকে বাতাসকে জড়িয়ে ধরার তীব্র ভালোবাসা। বাতাস, আহ্, কত সুন্দর বাতাস, আমাদের বুক ভরে যায়, আমাদের মাথা বাতাসের বুক খুঁড়ে টেনে নেয় অদৃষ্ট শীতলতা। মৃত্যুউপত্যকা পেরোনো আমাদের কানজুড়ে টিনের চালে গুলি পড়ার ঝমঝম শব্দ ছড়িয়ে পড়ে আর অনেকদিন পর আমার মনে হয়, কবে যেন বুবুর সঙ্গে আমরা শিলাবৃষ্টির মধ্যে নেচেছিলাম উঠোনটাতে। শিলাবৃষ্টির জলের সঙ্গে গড়িয়ে যাচ্ছিল ধান নষ্ট হওয়ার বিষাদ। বিষাদের সে জল আনন্দনৃত্যে মগ্ন আমাদের চোখে পড়েনি। আজ এই কালবৈশাখকালেও আমাদের দেখা হয় না গুলিবৃষ্টির সঙ্গে ঝরতে থাকা মৃত্যুবিষাদ। ঝাঁকঝাঁক গুলি ছুটে যায়, প্রচন্ড ভয়ে মাথা নিচু করি আমরা, অনায়াসে হজম করি শুকনো ধানের খোঁচা। এখন, ঘরের বাইরে গেলে নিশ্চয়ই চোখে পড়বে অজস্র দিগ্ভ্রান্ত গুলি দরজার সামনে, উঠোনজুড়ে, গাছের তলায় ছড়িয়ে আছে; আবার কোনো-কোনোটা আটকে গেছে গাছের ডাল কিংবা পাতার বোঁটার চিপায়। ঘরের আলতো অাঁধারের মধ্যে আছড়ে পড়ছে গোয়ালঘরে গুলিলাগা ভয়ার্ত ও মরিয়া গাভীর শেষ চিৎকার। মানুষের মতো মুখ বুজে বেঁচে থাকার দায় নেই তার। বর্ষা মৌসুমে পাখি শিকারের সময় আমাদের মনে সম্ভ্রম জাগানো চাচার দোনলা বন্দুকের ঠুসঠুস শব্দকে করুণা করে, যুবাবয়সী চাচাতো ভাইয়ের সারা গাঁয়ের মধ্যে কেবল তাদের বাড়িতেই একটা বন্দুক থাকার চাপা উল্লাসকে উপহাস করে একটানা গুলি ছুটে আসছে। গুলির আড়ম্বরে কম্পিত মৃত্যুউপত্যকায় থেকেও চিন্তা করার যোগ্য হই একটু একটু করে, যেন অন্ধকার সরিয়ে টুকরো-টুকরো আলো অথবা যন্ত্রণা ফুটে উঠতে থাকে, তখন ধানের ডোলে মাকড়সার জালের অস্তিত্ব আমাদের বিরক্ত করে, ক্ষুব্ধ করে, মনে হয় গাভীগুলোর মতো চিৎকার করে উঠি। চটপট কাজকাম করতে পারে বলে প্রতি মাসে নগদ ত্রিশ টাকার মজুরি ছাড়াও শীত এলে একটা গেলাব পাওয়ার প্রতিশ্রুতি আদায় করে নেওয়া মজু হঠাৎ একটা কোলার আড়াল থেকে কথা বলে ওঠে। বোঝাতে থাকে, এসবই মেশিনগানের গুলি – একবার শুরু হলে থামতে জানে না খুব সহজে। গাজীপুরের কোনখানে নাইটগার্ডের কাজ করার সময় সে এই মেশিনগান দেখে এসেছে মিলিটারিদের কাছে। মিলিটারিরা সেগুলো কাঁধে করে একবার নেমে এসেছিল সাঁজোয়া গাড়ি থেকে। আইয়ুব খানকে দেখার একচিলতে লোভ মুহূর্তের মধ্যে নিজের ময়লা ট্যাঁকে গুঁজে ফেলেছিল সে মিলিটারিদের সাজসজ্জা দেখে। তারপর বেশ নিরীহ ভদ্র আলাভোলা হয়ে চায়ের দোকানের সামনে কানের ময়লা পরিষ্কার করতে করতে এক লোকের মুখ থেকে শুনতে পেয়েছিল, মেশিনগানের গুলি কিন্তু খুবই ছোট। তবে ছড়ছড়িয়ে বের হয় তো  তাই লোকজনকে এক ধাক্কায় শুইয়ে ফেলতে পারে।
মজু এসব কথা বলার আর সময় পেল না? এইটুকু ঘরের মধ্যে এতগুলো মানুষ – কেউ কেউ কাজ করছিল গোয়ালঘরে, কেউ ছিল জলার ধারে, কেউ আবার গাছে চড়েছিল ডাব পাড়তে, কেউ উঠোনে জড়ো হয়ে রোদে শুকানো সিদ্ধ ধান তুলছিল ঝেড়েঝুড়ে। কিন্তু গোলাগুলি শুরু হতেই কিসের ধান আর কিসের কাজ – এক লাফে ঘরে এসে উঠেছে সবাই। মরলে সবাই একসঙ্গেই মরি – বলতে বলতে সটান শুয়ে পড়েছে মেঝের ওপর। আর কী অবাক ব্যাপার – আমরা কজন লুকিয়েছি ধানের ডোলে – যেন খানসেনা এলে ধানের ডোলে উঁকি দেবে না, ধানের ডোলের মধ্যে আমরা নিশ্চিন্তে বেঁচে থাকব যুগ-যুগান্তর। তাই লাফ দিয়ে ডোলের মধ্যে উঠে আমাদেরও একে একে সেখানে তুলে নিয়েছে বাবা। এইভাবে স্বার্থপরের মতো লম্বা লাফ মেরে ধানের ডোলে উঠে গুটিসুটি মারায় বাবার কি একটু লজ্জা লাগছে এখন? তাই লজ্জাটুকু পুষিয়ে নিতে মজুকে সে থামিয়ে দিচ্ছে চড়া-কড়া কণ্ঠে?
চুপ কর হারামজাদা।
মজুর কথার পিঠে বাবা কষে গালি দিলে ধানের আরেক ডোলের মধ্যে থেকে আমাদের ছোট বোনটি র-কে ল বলার সহজাত প্রবণতার ব্যতিক্রম ঘটিয়ে নিখুঁত উচ্চারণে বলে ওঠে, খারাপ কথা বলা লাগে না, বাবা।
বোন যাতে র-কে ঠিকমতো র-ই বলে সেজন্যে বাবাকে দেখেছি অফুরন্ত ধৈর্য নিয়ে প্রতিদিন প্রতিটি উচ্চারণ শুধরে দিতে। কিন্তু এখন বাবাকে অবাক করে ঠিকঠাক শব্দ বলেও প্রশংসা না পাওয়ায় সে অবাক হতে থাকে। অবাক হতে হতে অপেক্ষা করে, এই বোধহয় বাবা তাকে প্রশংসা করবে। এইভাবে সে অপেক্ষা করতে করতে শেষ পর্যন্ত ছটফটানো গলায় বলেই ফেলে, ঠিক হয়েছে বাবা?
বড় অসময়ে কন্যার এই কৃতিত্বে উদ্বেলিত বাবার চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়া পানি আলতো অাঁধার আড়াল করে রাখে। আমি বোনের পিঠ চাপড়াই অজস্র গুলি আর আলতো অাঁধারের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে। চিন্তা করি, মেশিনগানের গুলি কি পেঁপের বিচির মতো? না কি তেঁতুলের বিচির মতো? অনেক অনেক পেঁপে কিংবা তেঁতুলের বিচি জড়ো করে টিনের ওপর ফেললেই তো শব্দ হয় এইরকম টরর-টরর। পয়সা ফেললেও হয় নিশ্চয়। কিন্তু অত পয়সা কি কেউ একবারে সংগ্রহ করে রাখতে পারে?  পারে কি একটুও মায়া না করে অবহেলায় সেসব পয়সা টিনের ওপর ঝরঝরিয়ে ফেলে দিতে?
রেলস্টেশনে খানসেনারা ঘাঁটি গেড়েছে গত চারদিন হয়। তারা আসার আগে থেকেই ফাঁকা হতে শুরু করেছে স্টেশনের আশপাশের পাড়া-গাঁগুলো। শূন্য বাড়িঘর, বিরান ধানের চড়া, সকালের নিঃসঙ্গ রোদ ক্রমশ মেজাজ চড়ায়, আমাদের গা-হাত-পা পুড়তে থাকে, মাথা অকস্মাৎ সিদ্ধ কাঁচা বেল হয়ে যায়। এর মধ্যে খানসেনারা এলো কেমন করে? আমরা কোবাদ দাদার কাছ থেকে শোনা কথা উলটেপালটে শুনি, নেড়েচেড়ে দেখি – পিশাচ না হয় আগুনলাগা বনের হরিণ, এ ছাড়া আর কেউ কি পারে এরকম রোদে চলাফেরা করতে? তারপরও গাঁ ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে, মানুষজন চলে যাচ্ছে দেশ-দেশান্তরে। আমরা যাই-যাই করেও যাইনি আজও। বাবা প্রতিদিন রাতে শুয়ে চিন্তা করে সকালে উঠেই যেদিকে দুচোখ যায় সেদিকে রওনা দেবে। আর সকালে উঠে চিন্তা করে, দিনের বেলা খানসেনাদের সামনাসামনি পড়ে গেলে বিপদ হবে। অতএব রাতে যাওয়াই ভালো। পরশু স্টেশন লাগোয়া বেতকান্দি থেকে ফৌজিয়া ফুপুরা খানসেনা আসার আলামত পেয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে চলে এসে আমাদের আতঙ্ক বাড়ায়। বাবা-চাচারা আমাদের ভালো করে শেখায়-পড়ায়, খানসেনারা এলে সঙ্গে সঙ্গে হাত তুলে সালাম দিতে হবে। বলতে হবে, ‘আচ্ছালামু আলাইকুম। খোশ আমদেদ, খোশ আমদেদ…’। অদ্ভুত এই কথার মানে আমরা কেউ বুঝতে পারি না, খলখল করে হাসি, হাসতে হাসতে খকখক করে কাশি, কিন্তু বারবার আউড়ে একসময় কব্জা করে ফেলি। তারপর, কী তাজ্জব ব্যাপার, মিচকা শয়তানের মতো কথাগুলো বারবার বলতে ভালোও লাগে। বাবা মসজিদের দেয়ালে লাগানো কাঠের তাকের ওপর সাজিয়ে রাখা নারকেলের অাঁশ দিয়ে বানানো টুপি নিয়ে এসে সবার মাথায় পরিয়ে দেয়। আমরা খুব খুশি হই টুপি না-থাকা মুসুল্লিদের টুপিগুলো খানিকক্ষণের জন্যে হলেও আমাদের দখলে আসায়। বাটির মধ্যে পোলাওয়ের চিকন চাল ঢেলে আগুনে-জ্বলা আগরবাতি গুঁজে ঘুরতে গিয়ে টের পাই, বেলালের মতো একটিও পাঞ্জাবি নেই আমার। কাঁধের কাছে নকশা করা, হাঁটু পর্যন্ত লম্বা পাঞ্জাবি গায়ে চড়িয়ে আতর-খুশবু মেখে ঘুরতে বেরোনোর আগে বেলাল নতুন কেনা লাটিমটা ঘরে রেখে আসে অজু নষ্ট হওয়ার ভয়ে। ওর ওই আতর-খুশবু আমাদের কাছে এত অচেনা যে জিনিসটা নষ্ট নাকি ভালো, কয়েকদিন আগের নাকি অনেক আগের, কিছুই জানতে চাইতে পারি না। কবে সেই ঈদের সময় শেষবার মুরবিবদের শরীর থেকে আতরের খুশবু এসে আমাদের নাকে ঝাপটা মেরেছিল, তা আর মনে নেই বলে মেয়াদ পেরোনো এই আতরের গন্ধও আমাদের নাকে আর বিদঘুটে লাগে না।
পাঞ্জাবি পরে বেলাল যখন অজু নষ্ট হওয়ার ভয়ে আমাদের থেকে নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে আছে, ভাবছে খানসেনাদের মনটাকে পাতলা জাউ বানিয়ে ফেলার জন্যে তার দাদার তসবিহটাও হাতে করে ঘুরে বেড়াবে কি না, প্রথম বিকট আওয়াজটা আসে ঠিক অমন সময়। আওয়াজ শুনে ঊরুর ওপর টাইকরাস নিয়ে পাটের দড়ি পাকাতে ব্যস্ত মাজেদ চাচা দ্রুত উঠে দাঁড়ায়; সত্যিই তার কোমরে কোনো ব্যথা আছে কী না তা নিয়ে তখন বিভ্রান্ত হই আমরা। আকাশে তাকাই কালবৈশাখী ঝড়ের আশঙ্কায়, কিন্তু কোথাও কোনো বিদ্যুচ্চমক চোখে পড়ে না, শুধু শোনা যায় কয়েক বাড়ি পরে নূরু চাচা খনখনে গলায় বলছে, ‘মেলেটারি আইলো না হি রে?’ চাড়ির মধ্যে রাখা বাঁশের সুস্বাদু কচি পাতা, তরতাজা ধানের ভুলে যাওয়া গন্ধ মেশানো নতুন খানিক খড়, শবরি কলাগাছ লাগানোর উদ্দেশ্যে কেটে ফেলা বিচাকলাগাছের টাটকা চাক-চাক কন্দ আর খইল মেশানো পানি নাক ডুবিয়ে খেয়ে ফেলার মায়া কাটিয়ে আমাদের সদ্য বিয়োনো গাইটা তার খুরা খুঁটতে থাকে মাটির ওপর। তারপর একসময় কীভাবে যেন পট্টাস করে দড়ি ছিঁড়ে দৌড় দিতে দিতে দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে যায়। উঠোনে ছানাপোনা নিয়ে ঘুরতে ঘুরতে সদ্য মা হওয়ার সলজ্জতায় মোরগ দেখলেই পালকগুলো ছোট ছোট ব্যাঙের ছাতা বানাতে দক্ষ মুরগিটা কী অদ্ভুত কায়দায় শব্দ করে আর তাই এক লহমায় সেটার কচি কচি ছানাপোনা কোথায় লুকিয়ে পড়ে, তাও আর টের পাই না। বোন আমার অবাক হয়ে আকাশ দেখতে থাকে, আর মা তাকে বলা নেই কওয়া নেই, একটানে কোলে তুলে ঘরের দিকে হঠাৎ দৌড় দিলে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে। কিন্তু কেউই তার কান্না থামানোর জন্যে দৌড়ে আসে না। পৃথিবীর সবকিছু এখন বদলে গেছে আমাদের সবার কাছে, এমনকি আমাদের মতো বালক আর শিশুদের কাছে। কেউ আসবে, যদিও সে অনাকাঙ্ক্ষিত, তবু তার না আসার অস্বস্তি দুমড়ে-মুচড়ে দিচ্ছে আমাদের দিনরাতকে। আমরা চেষ্টা করছি আগের মতোই  থাকার। কিন্তু আমাদের চারদিকে গড়িয়ে পড়ছে ঝরাপাতা, আমরা ডুবে যাচ্ছি খয়েরিপাতার নিচে। তবু কখনো কখনো সেই খয়েরিপাতার নিচ থেকে উঠে আসছে চাপা উল্লাস। কেননা উত্তেজনায় শশব্যস্ত মা-বাবা কিংবা চাচা-টাচারা আগের মতো আর শ্যেনদৃষ্টিতে জানতে চায় না, সারাদিন আমরা কী করে বেড়াই। কোনো ছুতো খুঁজে মারধরও করে না আগের মতো। সকালে দাঁত মেছওয়াক করতে করতে কিংবা রাতে শোয়ার আগে তারা আর পরামর্শ করে না, মানুষ করার জন্যে আমাদের পাঠিয়ে দেবে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দেওবন্দ লাইনের মাদ্রাসাতে।
তারপরও কেন যে সবকিছু এত ম্যাড়মেড়ে হয়ে যায়! বিলের ধার থেকে এঁটেল মাটি এনে বাটুলের গুলি বানাতে আর ভালো লাগে না। ভালো লাগে না রহমত ফকিরের একতারাটা সারাদুপুর লুকিয়ে রাখতে আর ‘রহমত, তোর কী হারাইছে?’ বলেই তার কাছ থেকে দৌড়ে সরে যেতে। তবু এক দুপুরে দলবেঁধে হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূর চলে যাই আমরা। অনেক দূরের এক লম্বা শিমুলগাছ সেদিন হাতছানি দিয়ে ডাক দেয় আমাদের। যদিও সকাল থেকেই বরকত চাচার ছোট ছেলেকে আর পাওয়া যাচ্ছে না কোনোখানে। যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই এরকম অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটে চলেছে। রাতে খায় কি খায় না, গান গাইতে গাইতে ঘুমাতে যায় চার হাত-পায়ের জ্বলজ্যান্ত সুস্থ মানুষ; কিন্তু সকালের রোদে তাকে আর পাওয়া যায় না কোনোখানে। এমনিতেই মানুষজনের ঘুমটুম কমে এসেছে – বিছানায় শুয়ে থেকে শুধু শুধু অস্থিরতার সঙ্গে কথা বলতে আর কত ভালো লাগে? মন চায়, একটু রেডিও শুনতে। কিন্তু ওইটা আর বাবা-চাচারা আমাদের কখনও শুনতে দেবে বলে মনে হয় না। এদিকে আলো জ্বালানোরও কোনো উপায় নেই – একদিকে মিলিটারির ভয়, আরেকদিকে কেরোসিনের অভাব সারা তল্লাটে। সন্ধ্যার আলো হারিয়ে যাওয়ার আগেই যা হোক একটা কিছু খেয়ে নিই আমরা। না-হলে খেতে হয় অন্ধকারে। অনেক কষ্টে স্টেশন থেকে গত সপ্তাহে এক সের কেরোসিন জোগাড় করতে পেরেছে বাবা। দোকানদারকে নাকি খুব দরকারের সময় কবে কোনকালে বাবা তিন টাকা কর্জ দিয়েছিল। সেই তিন টাকা কর্জ পাওয়ার কৃতজ্ঞতা এখনও লেপ্টে আছে তার চোখের কোণে। লোকটা নাকি চলেই যাচ্ছিল দোকান বন্ধ করে। কিন্তু বাবার জন্যে আবারও দোকানের ঝাঁপি তোলে। তারপর এক সের তেল মেপে দেয়। তেলের ড্রাম অবশ্য তার সাইকেলের ক্যারিয়ারেই বাধা ছিল। তবে তেল মাপার জন্যে দাঁড়িপাল্লা, বাটখারা আর কর্ক বের করার উদ্দেশ্যে দোকানের ঝাঁপি খুলতে খুলতে বাবাকে সে জানিয়েছে, এক ফোঁটা তেলও আর দোকানে রাখবে না, সব তেল সে রেখে দেবে নিজের বাড়ি। বিক্রি করবে কি, এখন তো তার নিজেরই গ্যালন গ্যালন কেরোসিন লাগবে। ওদিকে ট্রেন আর আসছে না শহর থেকে, তেলের চালানও তাই আটকে আছে হয়তো কোনো বড় জংশনে। হয়তো কোথাও মুক্তিরা রেলপথ তুলে ফেলেছে, হয়তো কোথাও ব্রিজ ভেঙে ফেলেছে – কত কিছুই তো ঘটে থাকতে পারে। তা ছাড়া ট্রেন এলেই বা কী? কার বুকের পাটা এত বড় যে, খানসেনায় গিজগিজ শহরের মোকাম থেকে মাল আনতে যাবে গাঁয়ের এরকম দোকানের জন্যে? যেটুকু তেল তার দোকানে ছিল, সেটুকুও আবার লাল কেরোসিন। কোথায় শাদা কেরোসিন, আর কোথায় এই লাল কেরোসিন! কোথায় কুপি আর হারিকেনের ফকফকে শাদা আলো, আর কোথায় এই লাল কেরোসিনের আবছা হতাশ কালো ধোঁয়া তোলা একটু আলো! লাল কেরোসিনের টিমটিমে আলোতে দরকারি কাজ সেরে খেতে বসে বাবা-চাচারা ঠিক করে, এখন থেকে সন্ধ্যা নামার আগেই সেরে ফেলতে হবে রাতের খাবারদাবার। দ্রুত নিভিয়ে ফেলতে হবে কুপিবাতি আর হারিকেন। জোনাকির আলোয় ছুটে আসা বাবুই পাখির মতো এই আলোয় ধেয়ে আসে খানসেনারা, অনেকদূর থেকেই তারা চিনে নেয় জনবসতি। খুব বড় না হলেও নেহায়েত ছোটও নয় আমাদের এই পাড়াটা। চারদিকের বিরান চড়ার মধ্যে একরখানেক উঁচু ভিটার ওপর পাড়াটাকে গাছে চড়ে দেখতে ভালোই লাগে। ভিটার সমান উঁচু হওয়ার ধকল সইতে সইতে একটা সড়ক স্টেশনের দিকে চলে গেছে চড়ার জমিজমার মধ্যে দিয়ে। কয়দিন আগে সন্ধ্যায় খাওয়া-দাওয়ার পরে তাজুল ভাইকে আমরা তার মামা আর আমাদের চাচার সঙ্গে চাপা ঝগড়া করতে দেখি বিবিসি শোনা নিয়ে। বরকত চাচা তাকে গালিগালাজ করে বলে, ‘খানসেনারা ঘাড়ের ওপর চলে এসেছে। এখন বিবিসি আর না শোনাই ভালো, রেডিও শুনে আর দরকার নেই বিপদ ডেকে আনার।’ শুনে তাজুল ভাই কী যে গালিগালাজ করতে থাকে সবাইকে! মনে হয়, সেইসব গালিগালাজ শুনে কাঁধের ওপর হিশেব-নিকেশ লিখতে বসা ফেরেশতা দু’জন দৌড় দিয়েছে বেদম লজ্জা পেয়ে। মুখ খুলে গালিগালাজ দিয়ে তাজুল ভাই সড়কের ওপর চুপচাপ বসে থাকে। মজু একবার অভ্যাসবশত জোরে ‘বাড়ির কাছে ব্যাতের আড়া/ হাল বইতাছে দ্যাওড়া ছ্যারা/ এত ব্যালা হইল ভাবিজান/ পান্তা নাই মোর প্যাটে রে…’ গেয়ে উঠলেও বাবার ধমক খেয়ে চুপ মেরে যায়। কিছুক্ষণ হাত-পা আর গা চুলকায়। তারপর ‘এত বিয়ানে শুইতে কি বালো ঠ্যাকে?’ বলতে বলতে শুয়ে পড়ে। তাজুল ভাইও শুয়ে পড়ে মনে হয়। কিন্তু সকালে তাকে আর বিছানায় পাওয়া যায় না। বাবা-চাচারা আকারে-ইংগিতে এখানে-ওখানে খোঁজে তাকে। পরিষ্কার করে জিজ্ঞেসও করতে পারে না লোকজন কী না কী ভেবে বসে, এই ভয়ে। কার মনে কী আছে কে জানে! কেউ যদি খানসেনাদের কাছে খবর পাঠায়, তাজুল ভাই মুক্তিযুদ্ধে গেছে, তাহলে তো মানুষ মেরে আর আগুন জ্বালিয়ে পুরো পাড়াই সাফ করে রেখে যাবে!
তাজুল ভাইকে আমরা তাই খুঁজে ফিরি চুপেচাপে। কিংবা খুঁজে ফিরি গাছের পাতার ফাঁকে লুকিয়ে থাকা মাজুলের বাসা, খুঁজে ফিরি মাছের আধার। যদিও মাছধরা লাটে উঠেছে, মাজুলের বাসার দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা চালাই, ডিমগুলো মাছের খাদ্য হয়ে উঠেছে কি না। মাজুলের বাসা ভেঙে মাছের আধার বানানোর পর তাজুল ভাই আমাদের লাল নীল সবুজ হলুদ কমলা বেগুনি কাগজ কেটে বিয়েবাড়ির ঝালর বানাতে শেখায়, দেখায় ঘরদোর সাজাতে হয় কেমন করে, আর কেমন করে পা ফেলতে হয় খেজুর গাছ থেকে পুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়ার সময়; আরও শেখায়, নিজেদের বাড়ি থেকেই চাল, ডাল, ডিম আর বেগুন নিয়ে মাঝে মাঝে খাঁখাঁ দুপুরে পরানের ভিটায় মাটিখোঁড়া চুলা দিয়ে পিকনিক করতে। মাথার মধ্যে গম আর প্যারা ওঠা ক্ষেতের নাড়ায় আগুন জ্বালিয়ে গাঁয়ের লোকজনের ভয় দেখানোর চক্রান্ত পুরে আমরা সেই তাজুল ভাইকে খুঁজে ফিরি। চক্রান্ত বাদ দিয়ে বেতের ফল ছিঁড়ে খেতে খেতে আমরা তাজুল ভাইকে খুঁজি। বেতের ফলের কষে মুখটা চেপে এলে চোখ দুটো ছেড়ে দিই মাঠের পরে, সেখানে ‘চাষের তেমন সুবিধা নেই কৃপণ মাটির গুণে’, সেখানে মাঠের ওই পারে ‘পঁয়ত্রিশ ঘর তাঁতির বসত, ব্যবসা জাজিম বুনে।’ সেখানে, সেই অনেক দূরে একটি ন্যাড়া শিমুল গাছ। টকটকে লাল ফুলগুলো এখনও আছে, কেউ কেউ মরে গেছে, ফুলের মধ্যে দিয়ে বেরিয়ে এসেছে শিমুলের মোচা। আর কিছুদিন গেলেই হয়তো কেউ সেগুলো পেড়ে নিয়ে জাগ দেবে আর না হলে সেগুলো গাছেই ফাটতে শুরু করবে রোদে শুকিয়ে খটখটে হয়ে। তখন ভেতর থেকে উঁকি দেবে শিমুলের তুলো। আর বাতাস এসে তার চারদিকে নাছোড়বান্দা ফকিরের মতো খাবি খেতে থাকবে। তখন শিমুল তুলো বাউরি খাবে আকাশজুড়ে। শূন্যে উড়াল দিতে দিতে কিছু শাদা মেঘ-তুলো নেমে আসবে মাটির টানে নিচের দিকে আর কিছু হারিয়ে যাবে মহাশূন্যে। আমরা ভাবি, তাজুল ভাইয়ের জন্যে সেই শিমুল তুলোর খোসা নিয়ে আসব। আর তাজুল ভাই আমাদের অবাক করে দেবে সেটা দিয়ে নতুন কিছু করে।
ন্যাড়া শিমুল গাছের হাতছানিতে মত্ত আমরা হাঁটতে থাকি। দৌড়াই কখনো। কখনো আবার একটু থামি। ক্ষেত থেকে চীনা উঠে গেছে ক’দিন আগে। উঠে গেছে গম আর মসুর কালাই। আর কিছুদিনের মধ্যেই আউশ ধান লাগানো হবে। বলা তো যায় না, বর্ষা কেমন হবে, আমাদের এই নিচু জমিতে আউশই ভালো। বিরান মাঠ হা-হা করছে, কারও কারও ক্ষেতে আগাম আউশ আর মানুষজন যার-যার বাড়িতে ব্যস্ত গমের শুকনো শিস আলাদা করার কাজে। এই কাজ আমাদের ভালো লাগে না। একদমই ভালো লাগে না আর। শুকনো খরখরে হলদে কাঠির মাথায় গমের ঝুঁটি, তার গোড়া ধরে একটু চাপ দিতেই ভেঙে যায় মট করে। ওই মট্টাৎ আওয়াজটুকু অবশ্য প্রথম-প্রথম ভালোই লাগে! কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই গমের শিস লেগে হাত-পা-গা চুলকাতে থাকে, মনে হয় সারা গায়ে কেউ লাগিয়ে দিয়েছে ইঁদুররাজার গুঁড়ো। গমের শিস কাটার কাজে ফাঁকি দিতে আমাদের তাই ভারি ভালো লাগে। ফাঁকা চড়ায় আমরা নতুন বাছুরের মতো তিড়িংবিড়িং করে ঘুরপাক খাই। এইখানে আমাদের দেখভালের জন্যে কোনো বাবা নেই, কোনো বড় ভাই নেই – আমরা শখ করে আয়েশি ভঙ্গিতে কুড়িয়ে পাওয়া গাছের ছোট ডালকে বিড়ি বানিয়ে টানি। মাঠের বাড়ন্ত পাটগাছ চেষ্টা করছে চারপাশে দাহ ছড়াতে, কিন্তু আমরা মুগ্ধ চোখে দেখে নিচ্ছি তার সবুজ পাতা। তারপর পাটের ক্ষেত পেরোতেই হয় কি, সবাই সারবেঁধে দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করার আনন্দে মেতে উঠি। কার প্রস্রাবের ধারা কত বেশি ওপরে ওঠে, ওপর থেকে নিচের দিকে টান মেরে প্রস্রাবের ধারা সাঁই করে নামিয়ে এনে কে কতবার আরেকজনের প্রস্রাবের ধারা কাটতে পারে, ঠাঠা দুপুরে শুরু হয় তার প্রতিযোগিতা। তারপর প্রস্রাবসংকটে প্রতিযোগিতার দফারফা হলেও হাসাহাসি করি হা-হা করে, খ্যা-খ্যা করে; হাসতে হাসতে আবার সময়সুযোগমতো মনে করি, ইদানীং শিশ্নটায় একটু নাড়াচাড়া পড়তেই সেটা কেমন শক্ত হয়ে ওঠে! সকালে তো হয়-ই, মাঝেমধ্যে দিনেদুপুরেও এই এক ঝামেলা নাকাল করে ফেলে। এবং এই বেলা তাই শুরু হয় নতুন আরেক প্রতিযোগিতা – কার শিশ্ন কত লম্বা, শক্ত হয়ে উঠলে কার শিশ্ন হয় আরও কত লম্বা। কেউ কারও কথা বিশ্বাস করি না। কে যেন বলে, লাটিমের দড়ি দিয়ে এখ্খুনি কারটা কত বড় তা মেপে দেখে নিতে। কিন্তু একজন আরেকজনের শিশ্ন মাপতে নারাজ বলে সকলেই যার যার মতো সবচেয়ে বড় শিশ্নের অধিকার দাবি করে আত্মবিশ্বাসী কাকদের মতো ডাকাডাকি শুরু করি। এইভাবে আমরা ক্রমাগত সামনের দিকে এগোতে থাকি। আমরা যত আগাই, শিমুলগাছটা ততই পেছায়। তবু আমরা এগোতে থাকি। তারপর পত্রহীন সেই শিমুলগাছের নিচে গিয়ে দাঁড়ালে আর বুঝতে পারি না কোত্থেকে এতদূর চলে এসেছি, কোনখানে এসেছি। খনখনে ভাঙা গলার পিশাচের মতো গাছটা নিঃশব্দে হাসতে থাকে। হতাশ হই গাছের নিচে ঝরেপড়া শিমুলের ফুল আর কুঁড়িগুলো রোদের তাপে খটখটে হয়ে গেছে দেখতে পেয়ে। শিমুলগাছের গা ভরা কাঁটা, রোদের তাপে সেগুলো আরও হিংস্র, আরও দাঁতালো। দেখে মন দমে যায়। গাছ বেয়ে ওপরে উঠে তরতাজা কয়েকটা কুঁড়ি যে পেড়ে আনব, তারও উপায় নেই – অগত্যা সবাই নেমে পড়ি ক্ষেতের ভেতর। জুতসই মাটির ঢিল খুঁজতে থাকি চীনার মুথার ফাঁকে আর কচি পাটগাছের গোড়ায় তল্লাশি চালিয়ে। কিংবা যদি পাই ইটের ভাঙা টুকরো, তাহলে তো আরও ভালো হয়। কিন্তু কোনোটাই হয় না। মাটির ঢেলা পাওয়া গেলেও কেন যেন গাছের ডালে লেগেই গুঁড়িয়ে যায়, শিমুলের বৃন্তকে একটুও টলাতে পারে না সে-ঢেলা। তখন এত খারাপ লাগে যে, সুযোগ পেয়েও রমজানের হাফপ্যান্ট পেছন থেকে টান দিয়ে পাছাটা উদাম করার উৎসাহ পাই না। আর বেলাল তো কেবলই বলতে থাকে, মটরশুঁটির দিন হলে মেটে হুঁকো বানিয়ে খুব করে ধোঁয়া টেনে সোনদাওয়ের বিলের নলখাগড়ার বনে ঘুমিয়ে থাকা যেত।
তখন আকাশ কেমন ধোঁয়াটে হয়ে আসে, আর ধোঁয়ার প্রেক্ষাপটে শিমুল কুঁড়িগুলো ন্যাড়া গাছের ডালে রক্তক্ষরণের বেদনা নিয়ে ঝাপসা হতে থাকে। কোথাও নিশ্চয়ই বাড়িঘরে আগুন জ্বেলেছে খানসেনারা। এতদূর থেকেও শোনা যাচ্ছে পটপট করে গমের দানা ফোটার আওয়াজ। আহ্ রে, কার যে গমের পালায় আগুন লেগেছে, কে তা জানে! নাকজুড়ে গরম গমভাজা ঘ্রাণ জেগে ওঠে। খোয়াব দেখি, উঠোনজুড়ে গমের দানার লোভে নেমে আসছে শালিকের দল। একটা দলছুট বুলবুলিও উড়ে এসেছে কোথা থেকে। খানসেনারা আছে নদীর ওপার আর নদী পেরিয়ে এপারে আসা এত সোজা না – তবু কেমন যেন লাগে। কালিপদ মাঝি অনেক আগেই পিঠটান দিয়েছে – সঙ্গে করে নাকি নিয়ে গেছে ছোটভাই তারাপদকেও। আর যাওয়ার আগে, জলিল গাড়োয়ান নিজের চোখে দেখেছে, কালিপদ আর তারাপদ নৌকার তলা ফুটো করেছে। তারপর নৌকাটা আস্তে আস্তে ডুবে যেতে শুরু করলে ‘এহন আয় শালার খানসেনা, কত আসবি! হুহ্, নাও পাওয়া অত সোজা না’ বলে কোনোদিকে নাকি রওনা হয়েছে নদীর কিনার ধরে। খানসেনারা কি এখন নদীর ওপারে দাঁড়িয়ে আছে? নাকি ট্রেনের জন্যে অপেক্ষা করছে? ট্রেনে করে নদীর ওপরকার রেলব্রিজ পেরিয়ে স্টেশনের খানসেনাদের সঙ্গে মিলে আসবে আমাদের গাঁয়ে? আমরা দূরের আকাশে ঘন হয়ে ওঠা ধোঁয়ার দিকে তাকিয়ে থাকি। ‘আগুন দিছে – নে, তাড়াতাড়ি বাড়ি যাই’ – নজরুল তাড়া দেয় বাড়ি ফেরার। শুনতে না শুনতেই ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়াতে থাকি উলটো দিকে, বুকজুড়ে আতঙ্কিত কুকুরের হাঁফানি জাগতে থাকে দৌড়াতে গিয়ে। তবু খুব জানতে ইচ্ছে করে, তাজুল ভাই কোথায় গেছে? আর গেলই যদি, আমাদের নিয়ে গেল না কেন? তাহলে কী ভারতেই চলে গেছে? আর তাই আমাদের কাউকে বলে যায়নি? শহর থেকে দলে দলে পালিয়ে আসা মানুষদের মতো তাহলে তাজুল ভাইও হারিয়ে গেল!
সদেড়েক আগে আমরা প্রথম শহুরে মানুষ দেখি। আলাদা কিছুই না, একেবারে গ্রামের লোকের মতোই, খালি তফাৎ বলতে এই, ঘাড়ের ওপর গামছা রাখে না। আর একা একা পায়খানায় যেতে ভারি ভয় পায়, বেহুদাই বদনা খোঁজে, পাগাড়ের ধারে গিয়ে পাছা ধুতে এদের মনে হয় লজ্জা লাগে! গ্রামের মধ্যে তারা আসে আতঙ্ক আর অবসাদ, উৎকণ্ঠা আর ক্লান্তি সঙ্গে করে। বলে, শহরে সারি সারি লাশ, জমে যাওয়া রক্তের বোটকা গন্ধ আর আগুনে পোড়া বাড়ি ছাড়া তেমন কিছুই নেই। কারফিউ ওঠার সঙ্গে সঙ্গে তাই সবাই ঢাকা ছেড়েছে। এখন তারা কেউ কেউ গ্রামেগঞ্জে আত্মীয়স্বজন খুঁজে বেড়াচ্ছে। কেউ আবার বলছে, ভারত চলে যাবে, বউ-পোলাপান রেখে যুদ্ধের ট্রেনিং নেবে। মুখে এইসব বলে; কিন্তু গাছের নিচে জিরানোর জন্যে বসে কিছুতেই আর উঠতে পারে না। খরদুপুরের অবসাদে নিস্পন্দ তারা সবাই পড়ে থাকে গাছের কান্ডে হেলান দিয়ে। তাদের সঙ্গে আসা মেয়ে আর মহিলারা এর-ওর বাড়ি ঢোকে, কাপড়ের অাঁচলে মুখের অর্ধেক নাকি সিকিখানেক ঢেকে আমাদের মা-বোন আর দাদি-নানিদের সঙ্গে নিচুকণ্ঠে কথা বলতে বলতে এতই ফোঁপায় যে, কিছু আর স্পষ্টভাবে শোনা যায় না। আমাদের বাবা-চাচাদের দেখি পালিয়ে আসা সেইসব শহুরের জন্যে ভীষণরকম অধীর আর কাতর হতে। আমার পোষা লাল মোরগটা এই কাতরতার খপ্পরে পড়ে জোরে জোরে ক্ব-ক-ক্ব-ক করে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু জুরান আলী চাচা তাকে খপ করে ধরে ফেলে এবং মাত্র মিনিটখানেকের মধ্যেই সেটি জবাই হয়ে যায়। আমি বিহবল চোখে গলাকাটা মোরগটার দিকে তাকিয়ে থাকি – এখনও দাপাচ্ছে উঠানের ওপরে, পাখা দুটো দিয়ে ঝাপটা মারছে মাটির গায়ে, চেষ্টা করছে সোজা হয়ে দাঁড়ানোর। ডানার ঝাপটায় সে মাটিতে রক্তের বিচিত্র আল্পনা অাঁকতে অাঁকতে আরও খানিকটা এগিয়ে গেল, আর-আর আমার দিকে কি একবার তাকিয়ে দেখল একেবারে স্থির হয়ে যাওয়ার আগে? আমার বমি পেল। মুখটা কি লাল হয়ে উঠেছে? ঘামছি কেন? ঘরের পেছনে গিয়ে আমি অনেকক্ষণ বসে থাকলাম নিমগাছের নিচে। তারপর থেকে আমি মোরগের মাংসের কথা চিন্তা করতেই বমি করার এক অভাবনীয় জগতে বন্দি হয়ে গেলাম। বমিটা কোথায় যেন লুকিয়ে থাকে আর মাকে আজকাল সন্ধ্যার পরও ঠিকমতো কাছে পাই না বলে কখনও পেটের মধ্যে, কখনও আবার মাথা হয়ে গলার কাছে এসে ঘনঘন মোচড় মেরে চলে। কিন্তু মা সেইসব শহুরে মেয়ে-মহিলাদের নিয়ে এতই ব্যস্ত হয়ে পড়ে যে, আমাকে গাছের নিচে বসিয়ে মাথায় কয়েকটা মৃদু চাপড় মেরে সামান্য একটু বমি করিয়ে হাতের তালুতে কয়েকটা কাগজি লেবুর পাতা গুঁজে চলে যায়। তারপর তার আর দেখা পাওয়া যায় না। শহুরে মানুষগুলো ভারত চলে যাবে শুনে লেবুপাতার গন্ধমাখা হাতের তালু শুঁকতে শুঁকতে আমি তাদের চলে যাওয়ার রাস্তা চিনে রাখার চেষ্টা করি।
চিনে রাখা সেই রাস্তাটা দূরে থাক, দূরের সেই শিমুলগাছের তলা থেকে বাড়ি ফেরার রাস্তাটাও সেদিন আর ভালোভাবে মনে করতে পারি না আমি। আর আমি তো আমি – বেলাল, রমজান, হামিদ, কাশেম, রশিদও নাকানিচুবানি খায়।  সামনের খাঁখাঁ চড়াকে মনে হয় শীতকালের ঘোলাটে রুপালি বদ্ধ নদী। একবার পশ্চিম না কি উত্তরে যাই, আরেকবার পূর্বে না কি দক্ষিণে যাই। আবার মাঝেমধ্যে ভয়ার্ত চোখে দেখে নিই দূরের আকাশে আগুনের কালো ধোঁয়া। অবশেষে পাড়ার দেবদারু গাছটার মাথা চিনতে পেরে সেটাকেই নিশানা মেনে এগোতে থাকি। বাড়ি পৌঁছানোর আগেই টাইফয়েডের ঘোরে কাঁপতে থাকা মানুষের মতো কী এক ভয়ে দুলে দুলে উঠতে থাকি। হঠাৎই বুঝতে পারি, আশপাশে বিড়বিড় করছে প্রায়সন্ধ্যা। ওদিকে অাঁধারজাগা আকাশজুড়ে আগুনের আলো এখন আরও লেলিহান। শিমুল ফুলের চেয়েও গাঢ় রক্তাক্ত সেই আগুনের দিকে চেয়ে হিম হয়ে যাই। এত দূর থেকেও বুঝি, অাঁধারের উসকানিতে তুমুল পাল্লায় নেমেছে আগুন আর সেই ফটফট শব্দ। তার মানে আগুনের তাপ এখন ঘরবাড়ির বাঁশের খুঁটিকে গ্রাস করছে, বাঁশের গাঁট ফুটছে বিভক্ত হওয়ার তীব্র তাড়নায়। আহ্ রে, কোন গাঁও পুড়ছে এখন? কোন আকাশে জাগছে এত চিৎকার, আর কান্না? দিন তো গেছে, রাত নেমেছে, বাড়ি ফিরতে এত দেরি করে ফেলেছি যে ভয় হয়, বাবা-চাচারা মারবে আমাদের। হাইলা নড়ির শপাং শপাং বাড়ি খাওয়ার আগাম যন্ত্রণায় অন্য কোনোখানে চলে যেতে ইচ্ছে করে তাজুল ভাইয়ের মতো। আবারও মনে করার চেষ্টা করি, কোন পথ দিয়ে চলে গেছে শহুরে মানুষরা। আর গাঁয়ের কাছাকাছি এসে দেখি, ক্ষেতের আইলের পাশে গরু নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আবদুল্লাহ চাচা। আমাদের দেখেই গলার দড়ি টান দিয়ে ক্ষেতের মধ্যে থেকে গরুটার মুখ সরিয়ে নিলে বোঝা যায়, আইলের ঘাস খাওয়ানোর অছিলায় আরেকজনের ক্ষেতের ফসল খাইয়ে গরুর শরীর তাজা বানাচ্ছে আবদুল্লাহ চাচা। এটা তার পুরনো অভ্যাস। বিকেলে আসরের নামাজ পড়ে আবদুল্লাহ চাচা দৈনিকই তার নতুন বিয়োনো গরুটিকে আরও দুধেল করে তুলতে এর-ওর ক্ষেতের আলে নিয়ে যায়। তারপর লোকজন না থাকলে গরুর গলার দড়ি আলগা করে দেয়।
সেদিনও একই অপকর্ম করার সময় হঠাৎ আমাদের দেখে ভূত দেখার মতো চমকে ওঠে সে। তারপরই ধমক বসায়, জানতে চায়, সারাদিন আমরা কোথায় ছিলাম।
আমরা শুনি, আমাদের বাড়িতে কান্নার রোল পড়েছে। বাড়ির লোকজন ভাবছে, হাঁটতে হাঁটতে আমরা এমন কোথাও চলে গেছি যেখানে খানসেনারা বসে আছে রাইফেল আর বেয়নেট বাগিয়ে। হয়তো তাদের সামনে আমরা স্লোগান দিয়ে ফেলেছি ‘জয়বাংলা’, হয়তো বলে ফেলেছি, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো।’ তখন তারা আমাদের হাফপ্যান্ট আর ছোট্ট লুঙ্গি টান দিয়ে খুলে ফেলে নিশ্চিত হয়েছে, আমাদের নুনুর মাথার চামড়া কাটা নেই, অতএব মালাওনের জাত আমরা। তখন তারা আমাদের খাস মুসলমান বানাতে মোসলমানি করিয়েছে। আর এত বড় হওয়ার পরও মোসলমানি করিনি বলে সেখানে ছড়িয়ে দিয়েছে খানিকটা কাঁচা লবণ – যেমন দিয়েছিল বানিয়াগাঁতীর পোলাপানদের। আমরা আকুল আতঙ্কে ত্রাহি ত্রাহি চিৎকার জুড়লে তারা আরও ক্ষেপে উঠে প্রথমে মুখটা বেঁধে ফেলেছে। তারপর কানের কাছে নেমে আসা জুলফি ধরে অনেকক্ষণ টানাটানি করেছে। টানাটানিপর্ব শেষে তাদের এও হয়তো মনে হয়েছে, নাভীর মধ্যে একমুঠো ধান রেখে পায়ের গোড়ালি দিয়ে ঘুরাতে থাকলে বেশ ভালো হয়। অতএব তারা আমাদের চিৎ করে শুইয়ে ফেলে আশপাশের বাড়ি থেকে ধান নিয়ে এসে তাই করেছে।
আমরা আতঙ্কে নীল হয়ে যাই। আরেকজনের ক্ষেত খাওয়ানোর কীর্তি ঢাকতে আবদুল্লাহ চাচা বানিয়াগাঁতীর আতঙ্ক ছড়িয়ে দিচ্ছে আমাদের মধ্যে – বুঝতে পেরেও শক্ত কাঠ হয়ে যাই। কিন্তু অবিশ্বাসই বা করি কী করে? এরকমই তো ঘটছে এখন, আবদুল্লাহ চাচার মতো কেউ এইভাবে বলেনি, কিন্তু চুপে চুপে টিনের বেড়ায় কান লাগিয়ে, ঘরের পেছন দাঁড়িয়ে থেকে ঠিকই তো আমরা জেনে গেছি এইসব ঘটনা। কেউ কোনোদিন আমাদের কাছে বলেনি এসব, বলেনি ভয়ে মরো-মরো হবো ভেবে, কিন্তু ঠিকই তো সব ঘটনা ছড়িয়ে পড়েছে পাখির শিসের মতো। আমজাদ কাকা বাবার কাছে বলেছে এসব ফিসফিসিয়ে, যেন কানে কান লাগিয়ে; আর বলার সময় আমাদের ধারেকাছে দেখতে পেলেই সরিয়ে দিয়েছে ধমক মেরে। তবুও জেনে গেছি আমরা, খানসেনারা মেয়েদের কাপড়-চোপড় ছিঁড়ে ফেলে আজেবাজে কাজ করে, তারপর বেয়নেট দিয়ে খোঁচাতে খোঁচাতে একেবারে মেরে ফেলে। আমজাদ কাকা কাজ করে রেলস্টেশনে, দিনের মধ্যে হাজারবার প্লাটফর্মের এক মাথা থেকে আরেক মাথায় চক্কর দেয়, আর ট্রেন আসার খবর পেলে রেললাইনের পাশে বসানো সিগন্যালের হুইল ঘুরায়। পতাকা তুলে দোলাতে থাকে। কিন্তু এখন দিন ভালো না, কাকা তাই আর স্টেশন মাড়ায় না। মাঝে মাঝে কাকা খুব উত্তেজিত হয়ে যায়, গ্রামবাসীকে শোনায় স্টেশনের কথা – যেখান থেকে এই ক’দিন আগেও মানুষজন রেলে চড়ে শহরে যেত। আমজাদ কাকা সেই স্টেশন আর শহরের কথা বলে। মনে হয় বিরান এক শহরের গল্প শোনাচ্ছে সে, যেখানে একদল দানব এসেছে রক্ত চুষে নিতে। সেখানে মানুষজন চিৎকার করতে করতে ছত্রখান হয়ে পড়ছে চতুর্দিকে, ঘরবাড়ি থেকে লাল আগুন আর ধোঁয়া বেরোচ্ছে এবং মানুষজন ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে আসছে আমাদের গ্রামের দিকে আর আমরা দেখছি প্রথম শহুরে মানুষ। ততদিনে ছাত্ররাও চলে গেছে সেই শহর ছেড়ে, ছাত্রাবাস ও রাজপথ ছেড়ে। কোদাল দিয়ে খোঁড়া বাংকার ছেড়ে তারা চলে গেছে কয়েকটা গাদা বন্দুক আর দু-চারটে এলএমজি দিয়ে যুদ্ধ করা যায় না বুঝে। কাকা বলে, ছাত্ররা বুঝতে পারছিল না শহর ছেড়ে কোথায় যাবে। তখন পরম মিত্র হয়ে তাদের সামনে আসে রেলড্রাইভার হাদী। বলে, ট্রেনে করে সবাইকে সে সরাসরি হিলি হয়ে নিয়ে যাবে একেবারে ভারতের মধ্যে। কিংবা অতদূর যাওয়া না গেলে নিয়ে যাবে যতদূর যাওয়া সম্ভব। প্রতিটা স্টেশন ঝড়ের বেগে পেরোয় হাদী। মাঝেমধ্যে ছাত্ররা ট্রেন থামিয়ে নামে, তুলে ফেলে পেছনের রেলের স্লিপার। এইভাবে সে আমাদের স্টেশনেও আসে, স্টেশন পেরিয়ে গাড়ি থামায়, রেলের স্লিপার তুলে ফেলে আর আমজাদ কাকা তাদের উবদা মরিচ কেটে মুড়ি বানিয়ে খাওয়ায়, স্টেশনের ইঁদারা থেকে পানি তুলে খাওয়ায় আর এক ছাত্রের কাঁধে ঝোলানো একটা বন্দুক নেড়েচেড়ে দেখে। ছাত্ররা চলে গেলে আমজাদ কাকা স্টেশন লাগোয়া লাল কোয়ার্টারের কাছে দাঁড়ায়, উবদা মরিচ গাছের দিকে তাকায়, দেখে গাছে আবারও মরিচের শাদা-নীল কুঁড়ি দেখা দিয়েছে। কবে যেন স্টেশনমাস্টারের বউ এই গাছ লাগিয়েছিল। কিন্তু তারা আর কোয়ার্টারে নেই – স্টেশনমাস্টার আমজাদ কাকার কাছে স্টেশনঘরের চাবি দিয়ে অনেক আগেই কেটে পড়েছে; প্রথম তো আমজাদ কাকা এত কিছু ধারণাই করেনি। কিন্তু শহর থেকে যেদিন ঝাঁকে ঝাঁকে মানুষ আসতে লাগল, সেদিন সে বুঝতে পারল ঘটনা খারাপ। সেদিন থেকে আমজাদ কাকার মনটা খারাপ – শালার স্টেশনমাস্টার তাকে এইরকম বোকা বানিয়ে গেল, আর সে টেরও পেল না! কিন্তু ছাত্ররা চলে গেলে লাল কোয়ার্টারের মরিচগাছগুলোর দিকে তাকিয়ে আমজাদ কাকার মন নাকি ভালো হয়ে যায়। আমজাদ কাকা নাকি মনে মনে স্টেশনমাস্টারের বউটাকে দোয়া করেন, উবদা মরিচগাছ লাগিয়েছিল বলে।
কিন্তু মরিচগাছে নতুন ওই শাদা-নীল কুঁড়ি দেখে আমজাদ কাকার নাকি কেমন লাগে। এইটা কেমন কথা, এখনও মরিচ ঝুলছে সারাগাছে, তাহলে কেন আবার নতুন নতুন ফুলের কুঁড়ি দেখা দিচ্ছে? আমজাদ কাকা প্লাটফর্মের এদিক থেকে ওদিক যায়, ওদিক থেকে এদিক আসে – কিন্তু এই প্রশ্নের সুরাহা হয় না। পুরো স্টেশন খাঁখাঁ করছে, অভয় মুচির নাদুসনুদুস কুকুরটা সেখানে অনবরত চক্কর দিচ্ছে আর ঘেউ ঘেউ করছে, মনে হচ্ছে ভুল করে সে ঢুকে পড়েছে কলেরাভর্তি গ্রামে। আমজাদ কাকা লাঠি নিয়ে কুকুরটাকে স্টেশনছাড়া করে; কিন্তু কিছুদিন পর খবর আসে, ছাত্রদের ট্রেনটা নাকি জংশনে পৌঁছানোর আগেই খানসেনারা থামিয়ে দিয়েছে। রেললাইন তুলে ফেলে খানসেনারা নাকি বসেছিল জংশনের আগের বাঁকে। হাদী তাদের দেখতে পেয়ে ছাত্রদের বলে, ট্রেন স্লো করার সঙ্গে সঙ্গে লাফ দিয়ে ক্ষেতের মধ্যে নেমে পড়তে, আর তারপর হামাগুড়ি দিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে। বলে, শেষের জন নামার পর সেও না কি চলতি ট্রেন থেকে লাফ দিয়ে নেমে পড়বে। অতঃপর আমরা জলে ভেজা কাহিনি শুনি। কেননা হাদী ট্রেন থেকে নামে না। কেননা সে বোঝে ট্রেন যে স্লো হচ্ছে, মুক্তিরা সবাই যে নেমে পড়ছে খানসেনারাও তা দেখছে রাইফেল উঁচিয়ে। আর প্রস্ত্ততি নিচ্ছে মর্টার ছোড়ার। অতএব ছাত্ররা নামতে না নামতেই হাদী ট্রেনের গতি আরও বাড়িয়ে দেয়। মনে হয়, বিদ্যুৎবেগে সে পেরিয়ে যেতে চাইছে তুলে ফেলা রেলের লাইনটুকু। কিন্তু পেরোতে না পেরে লাইনচ্যুত হয়ে ধুঁকতে ধুঁকতে উঁচু রেললাইন থেকে গড়ান বেয়ে নিচের দিকে গড়িয়ে পড়ল দুই কি তিনটি বগি, আর একটি বিচ্ছিন্ন বগি লাফিয়ে উঠল আকাশ ছুঁতে, তারপর দুম করে পাছাটা ঠুকল মাটির বুকে, লকলক করে জ্বলে উঠল খানসেনাদের বাংকারগুলোর ওপর কিংবা ধারেকাছে গিয়ে। কিন্তু তাতে আর কয়জনই বা মরে! কয়জনই বা আহত হয়ে কোঁকায়! বেশির ভাগই পিঠ বাঁকিয়ে তেড়ে আসে রেললাইন ঘেঁষা ঢালু বেয়ে ক্ষেতের দিকে। সেখান থেকে যে কয়জন ছাত্র ধরা পড়ে তাদের সবার নাভীতে ধান রেখে ডলে ডলে আধমরা করা হয়। তারপর ছুড়ে ফেলা হয় আগুন ধরা রেলওয়াগনের ভেতর।
আমজাদ কাকা জোরে জোরে নিশ্বাস নেয়। আগুনে পোড়া মানুষের ঘ্রাণ এসে ছেঁকে ধরছে তাকে, ঢেকে দিচ্ছে গ্রামজুড়ে ছড়ানো চৈতালীঘ্রাণ। নিশ্বাসও কি বন্ধ হয়ে আসছে কাকার? বমি করছে ওয়াক ওয়াক শব্দ আর হেঁচকি তুলে, সালামের বাপ তার চুলকানিওয়ালা হাত দিয়ে বুলিয়ে দিচ্ছে কাকার মাথার চুল। আর কাকা ঘরের ডোয়ায় বসে উগড়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে পাকস্থলিতে জমা হওয়া সবকিছু। কিন্তু পেটে তো কিছুই নেই। না পান্তাভাত, না মুড়ি অথবা খই। কেবল পিত্তিরস বেরিয়ে এসে তার চোখ আর মুখ, ঠোঁট আর নাক, কপাল আর কপোলকে কুঞ্চিত করে তুলছে। তার হাত থেকে সিগন্যাল দেওয়ার সবুজ আর লাল পতাকা সেই বমির তোড়ে খসে পড়লে আমরা খেয়াল করি, এতক্ষণ তা তার হাতেই ছিল। কিন্তু আমরাই বেখেয়ালে শুধু দেখে চলেছি চাচার সামান্য হলদেটে বমিকে ঘিরে জমে ওঠা কালো পিঁপড়ার দলকে। আমাদের আর মনে নেই, বোধহয় বহুদিন মনে হবে না, স্টেশন থেকে রেললাইন ধরে হাঁটলেই পাওয়া যায় অযত্নে গজিয়ে ওঠা অফুরান শ্বেতদ্রোন। সেই শ্বেতদ্রোনকে ঘিরে নাচানাচি করে মৌমাছিরা। কখনও স্টেশনের দিকে গেলে সেই মৌমাছিদের সঙ্গে আমাদের পাল্লা শুরু হয়, তাদের হুলের যন্ত্রণা উপেক্ষা করে আমরা এক-একটি ফুল ছিঁড়তে থাকি, ছিঁড়ে নিয়ে ঠোঁট গোল করে চুষতে থাকি, যতক্ষণ না ভেতরের মধুর আস্বাদ আমাদের জিভে উঠে আসে, যতক্ষণ না সেই সামান্য মধু ফুরিয়ে না যায়। আমাদের মনে হয় না, ট্রেন আসার সময় আমরা সতৃষ্ণ চোখে রেললাইনের দিকে তাকিয়ে থেকে ভাবি, আহা! অন্তত এক পয়সার একটা মুদ্রা পেলেও তো ওখানটায় শুইয়ে দেওয়া যেত। তারপর ট্রেন চলে গেলে আমরা দৌড়ে গিয়ে দেখতাম, চাকার চাপ আর উত্তাপে কী ভীষণ লম্বাটে আর সমান হয়ে গেছে সেটা। আমজাদ কাকাকে বাইরের ঘরের চকির ওপর শুইয়ে দেয় আমার বাবা। মনোযোগ দিয়ে আয়াতুল কুরসি পড়তে বলে – তাহলে নাকি সব মুশকিল আসান হয়ে যায়।
তারপর আমজাদ কাকা যে কয়দিন গাঁয়ে থাকে, আমাদের আলাপে ট্রেন, খানসেনা, শহর, মর্টার, গুলি, মানুষের মৃত্যু আর যুবকদের ভারত চলে যাওয়ার সংগোপন গল্প চলে বাড়ির ভেতরে কাঁঠালগাছের নিচে। কাশেম ফিসফিসিয়ে বলে, ‘আয়াতুল কুরসি পড়ার পরও বিড়ি খাওয়ার দায়ে সে মার খেয়েছে আজ বিকেলে। তাহলে ওটা পড়ার কোনো মানে হয়? বিড়ি খেয়েই মারের হাত থেকে বাঁচা যায় না, খানসেনাদের হাত থেকে বাঁচা যাবে ওটা পড়ে?’ সংশয় আচ্ছন্ন করে আমাদের, আমরা তার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারি না। বাবা আর চাচা মুখোমুখি দুটো টুলে বসে গল্প করে, তামাক সাজায়। মা একটা কাঁসার গ্লাস এনে আমজাদ কাকার হাতে তুলে দেয়। দেখি, বেলের শরবত কানায় কানায় ভরা। কিন্তু আমজাদ কাকা তা কিছুতেই খেতে চায় না বাবাকে রেখে। আর বাবা কেবলই বলে, আরে খাও, খাও, তোমার এখন এইসব খাওয়া দরকার। আমি আর আমার ছোট বোন চোখের পাতা না ফেলে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি, আমজাদ কাকা চোঁ-চোঁ করে সবটুকু শরবত টেনে নিল পেটের ভেতর। তারপর খালি গ্লাসটা নামিয়ে রাখল মাটির ওপর। সাতসকালে মানুষজনের চোখকে ফাঁকি দিয়ে কুড়িয়ে আনা এ বছরের প্রথম বেল এইভাবে আমজাদ কাকার পেটে চলে গেলে মনের ক্ষোভে আমি আর কী করি – ছোটবোনটি কী যেন বলার সঙ্গে সঙ্গে ধাঁই করে একটা দশাসই চড় বসিয়ে দেই। তারপর তার চিৎকার আর কান্না পূর্ণমাত্রা পাওয়ার আগেই এক দৌড়ে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে আসি। সম্ভাব্য চড়থাপ্পড় এড়ানোর জন্যে তরতরিয়ে ঘরলাগোয়া পাইঙ্গা গাছে উঠতে গেলে দু-তিনটা মুরগি গাছের ডাল থেকে কক কক করে মাটির ওপর লাফিয়ে পড়ে। আমি এবার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার একটা উপায় খুঁজে পাই। এবং ‘মা, মুরগি তো খোপে ঢোকে নাই, গাছের ডালে উঠে বসে আছে’ বলতে বলতে বাড়ির ভেতরে ঢুকি। মা তখন বোনকে দেওয়া চড় নিয়ে কথা বলার সুযোগ হারায় এবং অাঁতকে ওঠে : ‘বলিস কি?’ বলে ভাজাকাটাটা চুলার পারে নামিয়ে রেখেই মুরগির খোঁজে বেরোয়। পোড়ানো সিদ্ধ বেলের সুঘ্রাণ আমার নাক আচ্ছন্ন করে, আমার চোখ সেই সুঘ্রাণের উৎস খুঁজে ফেরে। আমি দেখি, ছোটবোন চুলার কিনারে দাঁড়িয়ে একফালি পোড়ানো বেল নিয়ে আস্তে আস্তে কামড় বসাচ্ছে। যদিও তখনও তার চোখে লেগে আছে ভেজা কান্নার আস্বাদ। চোখে চোখ পড়তেই সে আমার দিকে বেলের টুকরা বাড়িয়ে ধরে হাসি ছড়িয়ে। খানিকটা ভেঙে মুখে পুরতে গিয়ে অযথাই ওকে চড় দেওয়ার লজ্জা আমাকে অধোবদিত করে রাখে। পাকা বেল ফুরাতে না ফুরাতেই এই কাঁচা বেল কখন পোড়ানো হলো তা আর জানতে ইচ্ছে করে না।
ওদিকে বাবা আর আমজাদ কাকার ট্রানজিস্টার শোনা আরও বেড়ে গেছে। আর তখনও তাজুল ভাই এক রাতের মধ্যে মিলিয়ে যায়নি – সেও গিয়ে বাবা-কাকাদের কাছে বসে রেডিও শোনে, গল্প করে, আমাকে দেখলেই পেঁয়াজ-মরিচ কেটে মুড়ি বানিয়ে আনতে বলে। বড় রঙিন মার্বেলটা পাওয়ার আশায় আমি না বলি না তার সামনে। তবে একদিন মুড়ি বানিয়ে আনি তো আরেকদিন বাড়ির মধ্যে বসে বসে খানিকক্ষণ একা-একাই ডাঙ্গুলি খেলতে থাকি। শহর থেকে যেদিন শত শত মানুষ এসেছিল, সেইদিনই মায়ের মুড়ির ভান্ডার ফুরিয়ে গেছে – জানা আছে আমার। মুড়ি ভালো ভাজে আদিলের মা, কিন্তু আদিলের মা এদিকে আসছেই না সপ্তাহখানেক হলো। মা-ও তাই পারছে না নতুন করে মুড়ি ভাজতে। অথবা হয়তো ওইদিনই শহুরে লোকজনের জন্যে মুড়ি ভাজতে ভাজতে মুড়ির চাল ফুরিয়ে গেছে! আদিলের মা এলেও মুড়ি আর ভাজা হবে না। এদিকে পা বেয়ে লাল মাজুল ওঠে, পৌঁছে যায় কানের লতির নিচে, তবু বাবা টের পায় না – এতই সে ব্যস্ত থাকে রেডিও স্টেশন টিউন করার কাজে। শুনতে শুনতে কখনো তাদের চোখের মণিতে আলো জ্বলে। কখনো আবার কপালে ভাঁজ পড়ে।
অফিসে যাওয়া লাইগবো! কামে যোগদান করা লাইগবো! হু-উ-হ্, কইলেই হয় – আমজাদ কাকা আর বাবা গজগজায়। অফিসে গিয়ে কাজে যোগ না দিলে নাকি ধরে নিয়ে গিয়ে শাস্তি দেওয়া হবে। আমজাদ কাকা ভেবে পায় না স্টেশনেই ফিরে যাবে নাকি মুখের রুচি ফিরে এলে বর্ডার পাড়ি দেবে।
বাজার ফুরিয়ে যাওয়ায় পরদিন খুব সকালে আলুভর্তা দিয়ে ভাত খেয়ে আমজাদ কাকা স্টেশনে চলে যায়। রাতে আবার ফিরে আসে। বলে, খানসেনারা নাকি তেমন খারাপ না। তারাও মানুষ। তবে গোঁফগুলো বেশ বড় বড়। আর কথা বলে উর্দু ভাষায়। পুকুরের পানি নাপাক মনে হওয়াতে তারা আজ অজু করতে পারেনি, তাই নামাজও পড়তে পারেনি। আমজাদ কাকাকে নাকি অজুর আর নামাজের নিয়ত জিজ্ঞেস করেছিল একজন। কাকা তা বলতে পারায় খানসেনারা নাকি অবাক হয়ে গেছে। তারপর একজন কী বলেছিল, আমজাদ কাকা তা বুঝতে পারেনি, তবে তা শুনে সবাই তার দিকে তাকিয়ে হাসছিল হো-হো করে। শুনে তাজুল ভাই চুপ করে থাকে। আর আমাদের পাশের বাড়ির রমিজ তাঐ উত্তেজিত ভঙ্গিতে বলতে থাকে, ‘আমি কইছিলাম না? কইছিলাম না, খারাপ না খানসেনারা? শোনো, পাঞ্জাবি আর পাঠানরা হইল খাঁটি মুসলমান, ধর্মপ্রচারের জন্যে তাগারে পূর্বপুরুষরা এই দ্যাশে আইছিল। তারা তো আর আমাগারে মতো ‘শুইন্যা মুসলমান’ না। তারা যা কয় ঠিকই কয়, আমাগারে ভালার জইন্যেই কয়। খালি খালি তোমরা শ্যাখের পিছে লাফালাফি করো।’
‘তাঐ সাব, খালি পাঠান আর পাঞ্জাবিরা না – আমাগারে এহানকার ম্যালাজনের পূর্বপুরুষও তো আরব থেকে আসা!’ – তাজুল ভাইয়ের এই কথায় রমিজ তাঐ গজগজ করে ওঠে, ‘হইতে পারে। তবে মালুগারে সাতে থাইকা থাইকা কাফের হয়্যা গ্যাছে।’
‘আপনেও তো জন্মের পর থাইকা মালুগারে সাথে আছেন। এই যে আপনে ব্যবসা করেন  – আপনের সব কারবারই তো মালুগারে সাতে… আপনেও তো মনে কয় কাফের হয়্যা গ্যাছেন…’
‘এই শয়তানডা খালি বেশি কতা কয়।’ – বলে রমিজ তাঐ আর কিছুই বলে না।
আমজাদ কাকা পরদিন আবারও স্টেশনে যায়। কেননা তার মনে হয়, কাজ করতে কোনো ঝামেলা নেই, বরং মুক্তিরা ট্রেনিং নিয়ে দেশে এলে লুকিয়ে রাখা যাবে। কাকা চলে গেলে তাজুল ভাই কিছুক্ষণ অস্থির হয়ে একবার এদিকে, আরেকবার ওদিকে চলাফেরা করে। একবার হুঁকাও টানে বিড়ি ফুরিয়ে যাওয়ায়। ওদিকে মাঝে মাঝে ট্রেনের হুইসেল শোনা যায়। আমরা বুঝতে পারি, আবারও ট্রেন চলাচল শুরু হয়েছে। আমজাদ কাকা আবারও সিগন্যালের হুইল ঘুরাচ্ছে, লাল অথবা সবুজ পতাকা দুলিয়ে সিগন্যাল দিচ্ছে। জয়বাংলা তা হলে হেরে গেল! আমরা ভীষণ মনমরা হই।  ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ স্লোগানটা কেমন ম্যাড়মেড়ে মনে হয়, ঠিক জমে না। আর ‘জয়বাংলা’ কত শানানো! ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা’ – আহ্, কী স্লোগান! মনে হয় চিৎকার করে বলতে বলতে ঠোঁটের কোণে ফেনা তুলি, গলা শুকিয়ে কাঠ করে ফেলি, বুকের মধ্যে থেকে রক্ত তুলে এনে গলা ভিজিয়ে আবারও স্লোগান শুরু করি, রক্ত দিয়ে গলা ভিজিয়ে স্লোগান দিতে দিতে রক্তহীন হয়ে মরে যাই চিরতরে। এসবের বদলে সেই ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ স্লোগানটা আবার দিতে হবে! মনটাই খারাপ হয়ে যায়! কিন্তু ট্রেন চললেও আমজাদ কাকা আর আগের মতো সন্ধ্যার পর ফিরে আসে না। রাত বাড়ে, তবু ফেরে না। তারপর দিন আসে, দিন গড়িয়ে রাত নামে, তবু আর কাকা বাড়ি ফেরে না। আমরা ভাবি, এতদিন রেল বন্ধ ছিল, কাজের চাপও বেশি, তাই সে আসতে পারছে না। কিন্তু কয়েকদিন পর ঘুরতে ঘুরতে জালাল ফকির খবর নিয়ে আসে, কাকাকে নাকি ট্রেনের পেছনে দড়ি দিয়ে বেঁধে ছ্যাঁচড়াতে ছ্যাঁচড়াতে মেরে ফেলেছে খানসেনারা। জালাল ফকিরকে বিস্তারিত কিছু বলতে হয় না, মাঝে মধ্যেই গুলির ছাড়া ছাড়া শব্দ আমাদের জানিয়ে দেয়, আশপাশে কিংবা দূরের কোনো গাঁয়ে লুটপাট হচ্ছে। আমাদেরও গাঁ ছাড়া উচিত, পালানো উচিত। কিন্তু আমরা যে কোথায় পালিয়ে যাব, তা ঠিক করে উঠতে পারি না। কেবল রমিজ তাঐ আমাদের একনাগাড়ে ধৈর্য ধরার পরামর্শ দিতে থাকে, ‘আরে কই যাইবা? খানসেনারা কী আর ভালো মানুষেক মারে? শোনো, পাঠান আর পাঞ্জাবিরা একটু পিঁয়াজ খায় জইন্যে মাথা গরম – এই আর কি! তাছাড়া কুনু ভালো মানুষেক মারার খবর কি পাইছো? এই যে আমজাদের কথাই ধরো… হে কি ভালো মানুষ আছিল? জানোই তো তোমরা, আমজাদ তার ভাবিক ভাগায়া নিয়া বিয়া করছিল।’
বলতে বলতে রমিজ তাঐ খ্যাকখ্যাক করে হাসে, এক অনাস্বাদিত পৈশাচিক আনন্দে তার ভাঙাচোরা গাল নড়তে থাকে, যেন আমজাদ কাকা নয়, তার নিজের জীবনেই ঘটেছিল এই ঘটনা; অথবা, তার আনন্দের অন্য কোনো গূঢ় কারণ আছে, যা আমাদের সে কখনো বলবে না, আমাদের দেখিয়ে দেখিয়ে সে কেবল হাসবে আর তাড়িয়ে-তাড়িয়ে সেই আনন্দ একা-একা উপভোগ করবে। তার হাসি শুনতে শুনতে তাজুল ভাইয়ের গাল শক্ত হয়ে ওঠে, পাখসাট তুলে একঝাঁক পাখি উড়ে যায়, চৈতালীর ঘ্রাণ মিইয়ে আসে, সারা গাঁয়ে বেহুলা সিনেমার একমাত্র দর্শক আলিমের চোখ দুটো গলে গলে টলে টলে দুলে দুলে রক্ত জমায় আর ‘বাছুর হারায়ে গ্যাছে’ বলে উঠে যায় খয়ের আলী। আর কয়দিন বাদে খুব ভোরে তাজুল ভাইকে আর পাওয়া যায় না কোনোখানে। শুনে আমজাদ কাকার মা কাঁদে আর হাসে, হাসে আর কাঁদে, কাঁদে আর বলে, বলে আর হাসে, ‘আমজাদ, মোর আমজাদ তাজুলেক ডাক দিয়্যা নিয়্যা গ্যাছে…’
আমজাদ কাকা কি আমাদেরও ডাকছে? তার সঙ্গে ডাকছে তাজুল ভাইও? আমজাদ কাকা আর তাজুল ভাই ডাকলে ভয় কিসের? আমরা অভয়, আতঙ্ক আর আড়ষ্টতা মেশানো চোখে আবদুল্লাহ চাচার শাসন হজম করতে থাকি। চাচা ক্রমশ গলা চড়ায়, ‘সারা দিন টো-টো কইরা ঘুইরা বেড়াস! আমার পোলা হলি তোগারে আমি গুলি কইরা মাইরা ফ্যালাইতাম!’
হ, তোমার কাছে হাজার-হাজার গুলি বন্দুক আছে! – মনে মনে উত্তর দিই আমরা আর চাচা ‘যা, বাড়ি যা’ বলতেই দৌড় দিই ঊর্ধ্বশ্বাসে গাঁয়ের দিকে। ভয়ে ভয়ে বাড়ির কাছাকাছি আসতেই দেখি আমাদের মা আর বাবা, চাচি আর চাচারা ছুটে আসছে। যেমন ছুটে আসে বন্যার পানি তিতাস কিংবা যমুনা ভেঙে। কাঁদতে কাঁদতে আমাদের মায়েরা আমাদের জড়িয়ে ধরে। বাবা, বাবা বলতে বলতে কাঁদে, চুমু দেয়, চুলে-পিঠে হাত বুলায়, আদর করে আর বুকে অল্প অল্প থুথু দিতে দিতে কেবলই বলে, ‘আলাইবালাই, আলাইবালাই…।’ আমরাও কাঁদতে থাকি, কাঁদতে বলি, ‘আর যামু না মা, আর যামু না, কুনুদিন না…।’
মায়েপুতে মিলে কান্নাকাটি করছি দেখে আমাদের ছোট বোন খিলখিলিয়ে হেসে উঠে আমাদের সজাগ করে। তবু খানিক পরে আহমেদ কবিরাজকে ডেকে আমাদের পিঠে ভয়-তাড়ানি থালা লাগায় জমির দাদা। এতসব টানাটানিতে আমাদের আর হাসিখুশি থাকা হয় না। কোথায় কী যেন হয়ে গেছে, শশী মালতি দিয়ে কিংবা চিবানো সবুজ ঘাস লাগিয়ে তা আর জমাট বাঁধা যাবে না। আপনাআপনিই এসব বুঝে ফেলি আমরা। তাই দলবেঁধে আর ঘোরা হয় না। শীতের শেষপ্রান্তে তৈরি করা বেগুনের টাল থেকে বেগুন তুলতে বারবার হাতের আঙুলে কাঁটা ফোটে। তবু তা নিয়ে হইচই করি না। খেতে বসে কেবল ডিম আর ডাল দেখে থালাবাটি ছুড়ে ফেলি না। জানতেও চাই না ডালে আজ জিরা-রসুন ভাজা তেলে সোম্ভার দেওয়া হয়নি কেন? সবখানে কী এক ফাটল হা-হা করে। কেবল শীত-গ্রীষ্ম পেরিয়ে বর্ষা আসবে জেনে সারবেঁধে দেয়াল বেয়ে শুকনো জায়গায় ঘর বানানোর কাজে লিপ্ত পিঁপড়াদের আসা-যাওয়ার লাইনে কোনো ফাটল ধরে না।
আমজাদ চাচা এইভাবে গুম হয়ে গেলে, তাজুল ভাইও নিরুদ্দেশে গেলে মৃত্যু যেন প্রতিক্ষণ আমাদের ঘাড়ের ওপর উত্তপ্ত শ্বাস ফেলতে থাকে। ফিসফিসিয়ে বাবা-চাচারা কীসব বলাবলি করে বুঝতে পারি না। কেউ যদি খানসেনাদের খবর দেয় তাজুল ভাই ভারত গেছে? রমিজ তাঐও তো দিতে পারে! আমাদের গলা শুকিয়ে ওঠে।
বাবা চাচাকে বলে, ‘চলো, আগেভাগেই সরে পড়ি।’
‘কিন্তু কোনখানে যাব আমরা?’ এর কোনো উত্তর জানা নেই। শুধু জানা আছে, কোথাও না কোথাও যেতে হবে। যমে ঘর চিনেছে, এখন যে কোনোদিন যে কোনো মুহূর্তে এইদিকে চলে আসবে খানসেনারা। প্রতিবেশীরা উঠানে এসে বসে থাকে। বাবার ওপর অগাধ বিশ্বাস নিয়ে সিদ্ধান্তের জন্যে চেয়ে থাকে মুখের দিকে। একবার চায় বাবার মুখের দিকে, আরেকবার চায় ক্ষেতের দিকে। ক্ষেতের আকুতি তাদের আটকে রাখতে চায়। আসন্ন আউশের ধান ঘরে তোলার মায়ায় তারা দোমনা হয়ে পড়ে। সবকিছু ছেড়ে এইভাবে চলে যেতে হবে? পেছনে পড়ে থাকবে এই বিস্তৃত জমি তাদের আশায়? পাখি আর পশুদের খাদ্য হয়ে ফুরিয়ে যাবে, নষ্ট হবে এতসব বীজধান? আর আসন্ন খন্দের সময় উন্মনা হয়ে অপেক্ষা করতে করতে একদিন এই বিস্তৃত প্রান্তর তার ফসলহীন বর্ষার জল তুলে নেবে?
তারপর যেন যুদ্ধ নয়, উৎসবের এক প্রস্ত্ততি দেখি আমরা। উঠোন খোঁড়া হচ্ছে, বাবা চাচা মজু থেকে শুরু করে সবার হাতেই কোদাল। কোদালের কোপে উঠে আসছে চাপচাপ মাটি, ঝুরঝুরে মাটি, খটমটে মাটি, ভিজে মাটি। কেঁচোরা পিঠ দেখিয়ে চেষ্টা করছে দ্রুত সরে যাওয়ার, বিদঘুটে গুবড়ে পোকা ভয় পেয়ে পা বেয়ে দৌড়ে উঠে ভয় খাইয়ে দিচ্ছে মানুষকে। জীবনের মায়ায় ঘরদোর ছাড়ার আগে কী এক ক্ষীণ আশায় মাটির তলায় বানানো হচ্ছে ভবিষ্যতের খাদ্য ও বীজভান্ডার। কিংবা তা নয়। যেন এক দীর্ঘ কবর রচনা করা হচ্ছে অসংখ্য অনাগত নিহত মানুষদের জন্যে। তাড়াতাড়ি-তাড়াতাড়ি কাজ সারতে হবে, যে কোনো মুহূর্তে আসতে পারে খানসেনারা – আমরাও হাত লাগাই বড়দের সঙ্গে। কোমর পরিমাণ উঁচু মাটির গহবরে পেতে দেই বাঁশের চাটাই, খড় ও গাছের শুকনো পাতা। তার ওপর জমির দাদা আর মজুরা একের পর এক নামিয়ে রাখে নানা মাপের কোলা। প্রথমে সবচেয়ে দরকারি কোলাগুলো, যেসবে রাখা আছে ধান, পাট, ডাল, সরিষার বীজ। আর যদি জায়গা বাঁচে তাহলে রাখা হবে খাওয়ার মতো ধান চাল ডালের কোলা, রাখা হবে ঘরের তৈজসপত্র। একেক দিকে রাখা হয় একেক বাড়ির কোলা। কিন্তু পাট আর পাটশলা তো মাটির নিচে রাখা যাবে না। রাখা যাবে না খড়বিচালি। অথচ খানসেনারা এসে আগুন জ্বালালে ওগুলোই হবে আগুনের প্রধান রসদ। অতএব আমরা বালতি বালতি পানি এনে সেসব ভিজিয়ে দিতে শুরু করি। রমিজ তাঐ কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখে। তারপর সেও কয়েকটা কোলা নিয়ে আসে। বলে, ‘হুরের মইধ্যে তো ভালোমন্দ ঠাওর করা যায় না। রাইখ্যা দ্যাও, বাঁইচা থাকলি কামে লাইগবো।’ মা তখন ঘরের সিলিংয়ের ওপর থেকে অনেকগুলো কাঁসা-পিতলের থালা, বদনা আর মগ নামিয়ে আনে। বলে, এগুলো তো আমানত। এগুলোও মাটির নিচে লুকিয়ে রাখো। আমরা জানতে পারি, আশপাশের গাঁ-গেরাম থেকে চলে যাওয়ার আগে একেকজন মার কাছে এসেছে আর সিকি, আধুলি, দু-এক টাকা যা হোক নিয়ে এসব জিনিস রেখে গেছে। তারপর তারা পাড়ি জমিয়েছে বর্ডারের দিকে। মা এখন দারুণ বিপাকে পড়েছে এসব নিয়ে।
বাবা তাকে গালি দিতে থাকে, ‘তুমি রাখতে গেলে কেন? টাকাপয়সা এমনিতেই দিয়ে দিলে পারতে। এখন যদি কেউ আর ফিরে না আসে?’

মা নাকানিচুবানি খায়। বলে, ‘একেবারে কিছু না রাখলে যদি আর পয়সা ফেরত না দেয় -’

বাবা তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে। কিন্তু বলতে পারে না কিছুই। শুধু দেখা যায়, চোয়াল-চোয়াল তার শক্ত হয়ে আছে আর কপালে ভাঁজ পড়েছে, নিশ্বাস একটু ভারি আর মজুকে দিয়ে কাঁসা-পিতলের জিনিসপত্রগুলো নামিয়ে রাখছে মাটির গহবরে।

মেশিনগানের গুলি এসে আমাদের ঘরবাড়িতে পড়তে থাকে পরদিন বিকেলবেলায়। ততক্ষণে আমাদের পায়ের চাপে, গোল্লাছুট খেলায় উঠোনখোঁড়া মাটি বসে গেছে সমানভাবে। তার ওপর গোবরজল লেপা হয়েছে সাতসকালে। উঠোনের রোদে মেলা সিদ্ধ ধান ঝেড়েঝুড়ে তুলছে সবাই। খানসেনারা কখন আসে কিংবা আদৌ আসবে কী না এসব ভেবে আমাদের মাথা থেকে মসজিদের সেই নারকেল ছোবড়ার টুপিও খুলে ফেলেছি আমরা তখন। আমি আর আমার ছোটবোনটি লুটোপুটি করছি উঠোনের খড়ের গাদায়। তখন পুবপাড়ায় কখন আগুন জ্বলে উঠেছে কেউ তা বুঝতেই পারিনি। ওদিকে আমাদের ছোটবোন কড়ইগাছের তলা থেকে কুড়িয়ে নিয়েছে কয়েকটা শুকিয়ে যাওয়া শিম। সামান্য নাড়া দিতেই ঝুনঝুন শব্দ তুলছে শুকনো কড়িশিমের বিচি। বোনের দেখাদেখি কড়িশিম কুড়াচ্ছি আর ঝুনঝুনির মতো বাজাচ্ছি আমরা সবাই। গুলি শুরু হতে আগুনও চোখে পড়ে। তখন আমাদের মা চিলের মতো ছোঁ দিয়ে বোনকে দুই হাতে তুলে নিয়ে ধানের ডোলের মধ্যে নামিয়ে দিলো। আর কে কোথায় গেল, ঘরের কোনখানে লুকালো না কি মাটিতে শুয়ে পড়ল জানা হলো না। অনেক পরে টের পাই, বাবা-মা আর মজুও আছে ঘরের ভেতর। তবু গলা শুকিয়ে আসে। গুলি তবু চলতে থাকে। ‘কী হয়’, বাবা বলে, ‘চলো বাড়ির পেছন দিক দিয়ে ক্ষেতের মধ্যে নেমে চলে যাই নদীর দিকে। তাই করি আমরা। বেরিয়ে পড়ি ঘরের মধ্যে থেকে পেছনের দরজা খুলে। দেখি, হুড়মুড় করে গ্রাম ভেঙে আর সবাইও বেরিয়ে পড়েছে। সড়কপথে বিপদ বেশি। তাই আলপথ বেয়ে হাঁটতে থাকি। আর খানিক বাদেই সন্ধ্যা হবে। তারপর রাত। আমরা কোথায় যাব কিছুই জানি না। কিন্তু হেঁটে চলি। চৈতালী তোলার পর প্রায় ফাঁকা ফসলের ক্ষেতে আলের ওপর দিয়ে হেঁটে চলি আমরা। আর ভয়ে ভয়ে বারবার তাকাই দূরের সড়কপথের দিকে। যে কোনো সময় সেখানে দেখা দিতে পারে খানসেনাদের জিপ, দেখা দিতে পারে গ্রামের রাস্তা দিয়ে মার্চ করে আসা হানাদাররা। ওই তো দেখা যাচ্ছে ওদের – দৌড়াও, জোরে দৌড়াও… আরও জোরে…। আমাদের ছোটবোন আমাদের এইসব উৎকণ্ঠার কিছুই বোঝে না। দৌড়ানো দূরে থাক, সে আর হাঁটতেও পারে না। তখন তাকে কোলে তুলে নিই। সে ভাবে, হয়তো নানাবাড়ি যাচ্ছি আমরা সবাই। এত তাড়াহুড়ো করে নানাবাড়ি যাওয়ার কারণ সে খুঁজে পায় না। এমনকি যখন ঝাঁকঝাঁক গুলি এসে খোলা চড়ার মধ্যে আমাদের ওপর আছড়ে পড়তে থাকে, তখনও সে কিছুই বোঝে না। আমাদের কেউ লুটিয়ে পড়ে, কেউ খোঁড়াতে খোঁড়াতে দৌড়ে চলে, কেউ শূন্য চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে কাউকে খোঁজে। আমাদের বোন এবার ব্যথা পেয়ে, রক্ত দেখে কাঁদতে থাকে। সেই যে সে তার হাতে কড়িশিম তুলেছিল, সেগুলো আপনাআপনি ঝুনঝুনিয়ে বাজতে থাকে দ্রুত দৌড়াতে গিয়ে। যত দৌড়াই, আওয়াজ তার ততই বাড়ে। পা আমার শ্লথ হয়ে আসে, শ্লথ হয়ে আসে বাবার, মায়ের কিংবা মজুর পা। এমনকি বোনের কান্নাব্যথার স্বরও মিইয়ে আসে। কিন্তু কড়িশিমের ঝুনঝুনি আর শেষ হয় না। আমার বোন তার দুর্বল হাত দিয়ে ঝুনঝুন করে কড়িপাতা বাজাতে থাকে আর মৃত্যুর মধ্যে ডুবে যেতে যেতে অযথাই মায়ের কাছে শেখা ছড়া বলতে থাকে, ‘আয় ছেলেলা আয় মেয়েলা মামাল বাড়ি যাই, মামাল বাড়ি বলো মজা, কিলচল নাই…’