চন্দ্রগ্রসত্ম পাঠঘোর

ফেরদৌস আরা আলীম

তাঁর নাম, তাঁর কাব্য এবং তাঁর কিস্সাময় জীবন হানাহানি, রেষারেষি ও যুদ্ধবাজির এই দুনিয়ার নিদারম্নণ দহন-দিনে মাঠ-ঘাট-দিগমত্ম একাকার করে আসা এক আকাশ বৃষ্টির মতোই বটে। তাঁর পিতার জীবনও ছিল অনুরূপ। তবে তিনি মহাসমুদ্র হলে পিতা সমুদ্র। নিশাপুর ছেড়ে যেদিন তাঁরা চলে যাচ্ছিলেন সেদিন পিতার পেছনে তাঁর ন-বছরের শিশুপুত্রটিকে দেখে ফরিদউদ্দিন অতরের (অ্যাররনামার রচয়িতা) তাই মনে হয়েছিল। তাঁর মন যেন তর্জনী তুলে তাঁকে বললে, দেখ-দেখ সমুদ্রের পেছনে মহাসমুদ্রের যাত্রা দেখ। তিনি দেখলেন এবং বললেন, হায় খোদা, এ কী দৃশ্য দেখালে তুমি আমায়!
পাঠক অতঃপর পিতা-পুত্রের গল্প শোনার জন্য উদগ্রীব। পিতার কথাই হোক আগে। মোঙ্গলদের পদপিষ্ট মাতৃভূমিতে তিনি আর ফিরবেন না। যেখানে ১২ হাজার মসজিদ ধ্বংস হয়েছে, ১৪ হাজার পবিত্র ধর্মগ্রন্থ ভস্মীভূত হয়েছে এবং ১৫ হাজার আলেম ও ছাত্র নিহত হয়েছে এবং ২ লাখ পুরম্নষকে যেখানে কচুকাটা করা হয়েছে, সেই বল্খ নগরীতে তিনি আর ফিরবেন না। বাগদাদের আমির-ওমরাহ ও খলিফাদের সনির্বন্ধ অনুরোধও তিনি উপেক্ষা করেন, কারণ বাগদাদ আর ধর্ম, ন্যায় ও জ্ঞানের পথে নেই। লারেন্ডেতে সাত বছর কাটিয়ে তিনি সেলজুক সাম্রাজ্যের রাজধানী কেনিয়ায় স্থায়ী হলেন। কেনিয়ার সুলতান আলাউদ্দিন কায়কোবাদের আমন্ত্রণ তিনি গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু মাত্র দুবছর পরে ৮৫ বছর বয়সে ১২৩১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি পরলোকগমন করেন। তাঁর মৃত্যুসংবাদ পেয়ে উৎপাটিত বৃক্ষের মতো আলুথালু শেখ বুরহান উদ্দিন আল তিরমিজি ছুটে এলেন কারণ তাঁর মুর্শিদ আর নেই। সুতরাং মুর্শিদের
রক্ত-মাংসের উত্তরাধিকার শেখ জালালুদ্দিনের দায়িত্ব নিতে হবে তাঁকেই।
বুরহান উদ্দিন আল তিরমিজির নির্দেশমতো জালালুদ্দিন আলেপ্পে ও দামাস্কাসে দর্শন ও ধর্মতত্ত্বে প্রভূত পা–ত্যের অধিকারী হয়ে ফিরলেন। ৪০ দিন করে তিন দফায় বুরহান উদ্দিন-নির্দেশিত চিলস্না সাধনায় কামিয়াব জালালুদ্দিনের জ্ঞান ও সুফি সাধনার খ্যাতি তখন ছড়িয়ে পড়েছে দূর-দূরামেত্ম। দীর্ঘকায়, শীর্ণ, সৌম্য জালালের বাদামি চোখের তারায় কী দেখে শেখ বুরহান জানতে চান, কী দেখছ জালাল?
: দেখছি দুনিয়াটা কুয়াশায় ঢাকা।
: কেমন কুয়াশা?
: মায়ার মতো, কান্নার মতো কুয়াশা।
অতঃপর আমরা শুনতে থাকব মওলানা জালালুদ্দিন রম্নমির কথা। এক অবাক করা নিষ্পাপ উদাসীনতা তাঁকে ঘিরে থাকে সর্বক্ষণ। প্রতিদিন প্রায় ৪০০ ছাত্র তাঁর কাছে পাঠগ্রহণ করে। তাঁর অমৃতকথন শুনতে ছুটে আসেন বিশিষ্ট প–ত,
আমির-ওমরাহ এমনকি স্বয়ং কেনিয়ার সুলতান। চলার পথে তাঁকে ঘিরে মানুষের ভিড় জমে ওঠে। এদের যে-কোনো প্রশ্নের তিনি উত্তর দেন; কিন্তু মৃদু হেসে অনুচ্চ কণ্ঠে সেইসঙ্গে যোগ করেন আরো একটি কথা : আমার কথাই কিন্তু শেষ কথা নয়।
দামাস্কাস থেকে ফেরার পর হুশামউদ্দিন চেলেবি, গ্রিক যুবক থিরিয়ানোস এবং মওলানার জ্যেষ্ঠ সমত্মান সুলতান ওয়ালাদ তাঁর সার্বক্ষণিক সঙ্গী হয়ে থেকেছেন। কালক্রমে তাঁর এই পুত্রষ্টকে আমরা সুলতান-উল-উলেমা হতে দেখব। এবং হুশাম চেলেবির কাছে সারা দুনিয়াকে ঋণী থাকতে দেখবো। কারণ হুশাম চেলেবি ছিলেন মওলানার লিপিকর, সার্বক্ষণিক। বই নিয়ে, বইয়ের পরমায়ু নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে তর্ক-বিতর্কের অমত্ম নেই। মলাটে-বাঁধানো পত্রাবলি টিকবে তো শেষ পর্যমত্ম? এ বিষয়টি নিয়ে মওলানা হুশামের সঙ্গে কথা বলেছিলেন। পিতার লেখা মারিফ তাঁকে খুব টানে। সাধন-ভজনের তত্ত্ব ছাড়াও সে-গ্রন্থের ৩০টি মুক্ত-পঙ্ক্তি মওলানার বড় আদরের ধন। পিতা কিতাবের গল্প খুব ভালোসতেন। বলতেন, গন্ধটা হারিয়ে যাওয়া আতরের মতো। আর সে-আতর বহুদিন আগে মরে যাওয়া এক কস্ত্তরি মৃগের নাভি থেকে তৈরি। মওলানা বলেন, অবিশ্বাসীরা কিতাবের স্থায়িত্বে বিশ্বাস করে না। কিন্তু এও কি সম্ভব? কী করে সম্ভব? এ-জগৎ কি মহান আলস্নাহতায়ালার লেখা কিতাব নয়? তাঁর কলমেই তো জগৎ ফুটেছে। এই হুশামকে অতঃপর আমরা মসনবীর লিপিকার হিসেবে দেখবো। ১৫ বছর ধরে ২৫ হাজার ৬৬৮টি দ্বিপদীর ফুলে মসনবীর মালা গাঁথবেন হুশাম। ছয়টি খ–র এই কাব্যকাহিনি মওলানার মুখনিঃসৃত অমৃত মুরতিমতী বাণী। মওলানা বলেছেন, হুশাম লিখেছেন। কেনিয়ার রাসত্মাঘাটে, বাজারের পথে-পথে, মেরামে-মাদ্রাসায়, হামামে কি গাছতলায় – মওলানাকে কোথায় লেখেননি হুশাম?
প্রশ্ন একটা ওঠে মাঝেমধ্যে। মসনবীর রচয়িতাকে মসনবীতে কতটুকু মেলে? আমাদের এই শহরে (চট্টগ্রাম) সৈয়দ আহমেদুল হককে আমরা দেখেছি। মওলানার জীবন ও কাব্য তাঁর আজীবনের আরাধ্য ছিল। তিনি মসনবীর অনুবাদ ও ভাষ্য রচনার কাজে ব্যাপৃত ছিলেন আমৃত্যু। শুধু তাই নয়, মওলানার তরিকায় জীবনযাপন এবং মওলানার জীবন ও কাব্য অধ্যয়ন ও অনুশীলনের লক্ষে রুমি সোসাইটি গড়ে গেছেন। উচ্চপদস্থ সরকারি চাকরিজীবন থেকে অবসর নেওয়ার পর মওলানাকেন্দ্রিক এক ধ্যানস্থ জীবন তিনি যাপন করে গেছেন। মসনবীর সঙ্গে তাঁর আবাল্য পরিচয় (মূল ভাষায়) ও মুগ্ধতার ঋণ তিনি আমৃত্যু স্মরণ ও বহন করেছেন। মওলানার প্রেমবাদ, হামাউসত্ম বা অদ্বৈতবাদ, আধ্যাত্মিক বিবর্তনবাদ, ভক্তিবাদ এবং ‘সামা’ বা ধর্মীয় নৃত্য-বাদ্য সম্পর্কীয় শেস্নাক বা বয়েতের তিনি অনুবাদ বিশেস্নষণ করেছেন। লালন ও রবীন্দ্রনাথের গানে, বৈষ্ণব পদকর্তাদের পদে, এমনকি শেক্সপিয়র ও ডারউইনেও তিনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ এই সুফি-কবির প্রভাব আবিষ্কার করেছেন এবং দৃষ্টামত্ম দেখিয়েছেন। মওলানার শেস্নাকের শাশ্বতত্ব, আধুনিকত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে তিনি ছিলেন এক নিরলস সাধক। আধ্যাত্মিক সাধক মওলানার যেসব বাণী বা দার্শনিক উক্তি বিশ শতক পেরিয়ে একুশ শহকেও সত্যবাণীর মর্যাদা পেয়েছে, তিনি তাদের চিহ্নিত করেছেন। মওলানার সৃজনভুবনের প্রাসঙ্গিকতা, যৌক্তিকতা ও প্রয়োজনীয়তার কথা তিনি বলে গেছেন অকাতরে। শুধু মসনবী নয়, মওলানার গদ্য রচনা বিশেষ করে তাঁর ৭১টি নিবন্ধের সংকলন কিহি মা কিহেও ছিল তাঁর আলোচনার বিষয়। সৈয়দ আহমেদুল হক এবং তাঁর মতো আর যে-গবেষকগণ মওলানাকে নিয়ে গবেষণা করেছেন তাঁদের কল্যাণে আমরা জেনেছি যে, এই বাংলার হিন্দু-মুসলমান ৫০০ বছর আগেও মসনবী আবৃত্তি করতেন। এবং ষোড়শ শতকের বৈষ্ণব কবি মওলানার বাঁশিটিই শ্রীকৃষ্ণের মুখে তুলে দিয়েছেন – এমনও বলেছেন কেউ-কেউ। শেক্সপিয়রের জন্মের ৩০০ বছর আগে মসনবীর কথা ছড়িয়ে পড়েছিল স্পেন, ফ্রান্স ও ইউরোপে। এসব কথা আজ আর অজানা নয় কারো; কিন্তু তাব্রিজের সেই শাম্সউদ্দিনকে কোথায় পাব এবং কোথায় পাব সেইসব কিস্সা, যেসব কিস্সায় বলা হয়েছে যে, তাব্রিজি জীবনে না এলে মওলানার দ্বিতীয় জন্ম হতো না এবং মসনবীও হয়তো বা হতো না।
মুর্শিদ শেখ বাহাউদ্দিনের (মওলানার পিতা) পুত্রটিকে জীবনের একটা পর্যায়ের জন্য তৈরি করে দিয়ে শেখ বুরহান বিদায় নিয়েছিলেন। যাওয়ার বেলায় মওলানার জীবনে তাব্রিজের সূর্যের আগমনের কথা তিনি বলে যান। এও বলে যান যে, দুই সিংহ এক জায়গায় থাকতে পারে না। তাব্রিজ শহরটি শাম্সউদ্দিনের যুবা বয়সে সাধক-সুফি দরবেশ দ্বারা পরিপূর্ণ ছিল। তাঁদের মধ্যে অমত্মত ৭০ জন এমন সাধক ছিলেন যাঁদের আত্মা প্রতিরাতে লাল ও সবুজ ঘুঘু হয়ে উড়ে যেত মক্কায়। সারারাত কাবা প্রদক্ষিণ করে তাঁরা ভোর ফোটার আগেই তাব্রিজে ফিরে আসতেন। এই কাহিনি বয়ানকারী মওলানার সেই সূর্যের জীবনের কিস্সার অমত্ম নেই। কেউ বলতেন, তিনি অশিক্ষিত এক কলন্দর। কেউ বলতেন, জাদুকর। তাঁকে দ্বিতীয় সোক্রাতেক বলার লোকেরও অভাব ছিল না। উদ্দাম আবেগ, চরম দারিদ্র্য এবং ভয়ংকর মৃত্যু ছিল তাঁর নিয়তি। মওলানার জীবনে তাঁর আবির্ভাব পূর্ণ স্বরূপে আসা প্রেমেরই মতো। মূর্তি ধরে সেই প্রেম এসেছিল মওলানার জীবনে। সে নারী কি পুরম্নষ তাতে কিছু যায়-আসে না। সারাটা জীবন ধরে আকণ্ঠ, আমর্ম তৃষ্ণাতাড়িত সে-মানুষটিও এক পরশপাথরের খোঁজে ছুটে বেড়াচ্ছিলেন। ‘পবিত্র অগ্নিশিখা’ ছিলেন তাঁরা একে অন্যের জন্য।
এসব কিস্সা কোনো গ্রন্থে বা গবেষণাগ্রন্থে আছে কিনা আমরা জানি না। তবে শারদীয় প্রতিদিন ১৪১৯ এবং ১৪২০ বঙ্গাব্দে প্রণম্য রবিশঙ্কর বলের সে কাব্য অনেক এবং আয়নাজীবনে পেয়েছি। জীবনের গোধূলিবেলায় কিস্সার এমন গোলকধাঁধায় একবার ঢুকে গেলে কি হয় সে শুধু তিনিই জানেন, যিনি একবার সেখান থেকে ঘুরে এসেছেন। মওলানাকে বুঝতে বা জানতে অতঃপর আর কোনো মসনবীর প্রয়োজন নেই। কিন্তু মওলানার ঘোর, ইবন্ বতুতার ঘোর এবং ঔপন্যাসিক রবিশঙ্কর বলের ঘোর পাঠককে কোথায়, কতদূরে নিয়ে যেতে পারে বলা মুশকিল।
তাঞ্জানিয়া ছেড়ে তীর্থযাত্রার প্রথম বাঁকে ইবন্ বতুতা পৌঁছুলেন নয়নে নীলস্বপ্নের ঘোর লাগা আলেকজান্দ্রিয়ায়। সেখানে পেলেন ইমাম বুরহানউদ্দিন অল অরজকে। এঁর কাছে তিনি শোনেন চাঁদে পাওয়া সেই মানুষটির কথা। তাঁর ঘূর্ণিনৃত্যের লীলাক্ষেত্র কেনিয়ার কথা। ইমাম বলেন, কেনিয়া যাওয়ার পথের প্রতিটি পাথরে প্রতিটি গাছের পাতায়-পাতায় মওলানার কবিতা লেখা রয়েছে। অতঃপর ‘নক্ষত্র দোষের মতো, গানের সুরের মতো’ শহর আনাতোলিয়া। এই শহরের সরাইখানায়, চলমত্ম ক্যারাভানে, ফুতুয়ায়, দরবেশ লজে, মাদ্রাসায়, নদীতীরের মেরামে যাত্রাবিরতিতে যেখানেই যাচ্ছেন,
থাকছেন, শুনছেন কিস্সা। কিস্সা এবং কিস্সা। কিস্সার আগে কিস্সা, কিস্সার পরেও কিস্সা। এবং ঘুরেফিরে উচ্চারিত হয় যাঁর নাম তিনি মওলানা জালালুদ্দিন রম্নমি।
৩০ বছরের তীর্থ পরিক্রমার পর তাঞ্জানিয়ায় পৌঁছে লিপিকরকে ভ্রমণবৃত্তামত্ম বুঝিয়ে বলে মওলানার জীবনকাহিনি নিয়ে ধ্যানস্থ হলেন ইবনে বতুতা। এ-কাহিনি তিনি লিখবেন। কারণ মওলানার বাঁশির সুর তিনি শুনেছেন। সে-সুর আর কিছু নয়, সে কেবল ঘরে ফেরার আকুতি জড়ানো ক্রন্দন। আর মওলানার জীবন? ‘নকশা-খচিত এক ছড়ানো চাদর’ মওলানার জীবন। সে-জীবনকাহিনির উৎস ‘মনাকিব এর কিস্সা’। ইবন্ বতুতার হাতে সে-কিস্সা এলো কেমন করে এখন সে-কিস্সাটি শুরম্ন হোক।
তাঞ্জানিয়া থেকে সেই যে আনাতোলিয়ায় এলেন ইবনে বতুতা – এক ক্যারাভান-সরাইয় তিন বণিকের সঙ্গে প্রথম রাত্রিবাস – এঁদেরই একজনের মুখ থেকে শোনা সে-কিস্সা। কিস্সা ঘোরে এর কাছ থেকে ওর কাছে। ঘুরতেই থাকে। অনমত্মকাল থেকে বয়ে চলে কিস্সা আর এ-ফুলের মালায় গাঁথা হতে থাকে জীবন। মওলানা অমত্মঃসলিল ফল্গুধারার মতো বয়ে যান সে-জীবন।
‘সে-কাব্য অনেক’ থেকে একটা দৃষ্টামত্ম দেওয়া যেতে পারে। এক ‘ফুতুয়া’ থেকে বিদায় নেওয়ার সময় এক বণিক (পালামাস) ইবনেকে একটি আয়না উপহার দিয়ে বললেন, নিজেকে দেখুন। দেখুন অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যেতে-যেতে দিনে-দিনে কীভাবে আপনি সুন্দর হয়ে উঠছেন, আয়নায় তা দেখবেন। কেন, সুন্দর হবো কেন? বতুতার প্রশ্নের জবাবে উপহারদাতা বলেন, তাহলে তো মসনবী থেকে একটা কিস্সা শোনাতে হয় আপনাকে। শুনুন তবে দিব্যজ্যোতি ইউসুফের কিস্সা। কিস্সাময় জীবন এভাবে গড়িয়ে চলে।
কিস্সা শোনালেন কাজী ইবন্ কালাম। শোনেন ইবন্ বতুতা, বাজার হচ্ছে কোনো শহরের সবচেয়ে রহস্যময় জায়গা। কেনিয়ার বাজারে স্বর্ণকারের সোনা পেটানোর ধাতব শব্দের ভেতরে রয়েছে মওলানার গল্প, কারণ ওই তাঁর ঘূর্ণিনৃত্যের তালের ধ্বনি। সূচিশিল্পের দোকানে মওলানা, তাঁর বুরাকের পিঠের গদির জন্য অশ্রম্ন বা রক্ত দিয়ে নকশাদার কাপড় তৈরি করতে চেয়েছিলেন তিনি।
আতর-বিক্রেতা জানে, সুরভির রহস্য। সুরভি কেন আচ্ছন্ন করে রাখে মানুষকে? শুনুন তবে মওলানার গল্প। খাবারের দোকানে মওলানাকে ছাড়া কোনো গল্প হয়? কারণ রান্নার নানা অনুষঙ্গ তাঁর সাধনা ও কাব্যের বিষয়। কাঁচাকে সুপাচ্য ও সুস্বাদু করে রান্না। খোদা নিজে রাঁধছেন বলে, রাঁধবেন বলে তুমি মানুষ উপভোগ্য হয়ে উঠছ। স্বাদেরও রকম আছে। কোনো কোনো স্বাদ ধীরে-ধীরে ডানা মেলে। কোনো স্বাদ স্মৃতিধার্য হয়ে যায়।
ইবন্ বতুতা কি শুধু শুনেই গেছেন তিরিশটা বছর ধরে? তা কিন্তু নয়। শুনতে-শুনতে তিনিও কথক বনে গেছেন।
চলতে-চলতে তাঁর নিজের জীবন জুড়েও নেমেছে গল্প। তৈরি হয়েছে তাঁর জীবনের গল্প। ভালোবাসার গল্প। মেরামে যাচ্ছেন ঘোড়ার গাড়ি চরে। চালক যুবককে তিনি প্রশ্ন করেন, নামাজ পড় তুমি? জোরে, না আসেত্ম? শোনো, মওলানা বলেছেন মধ্যপন্থাই শ্রেয়। তাঁর দেশের মানুষ তুমি; ইতিহাসের দায় বহন করতে হবে তোমাকে।
লেখাপড়ার প্রচলন হলো কীভাবে, কোত্থেকে কীভাবে লেখাপড়ার কথা মানুষ খুঁজে পেল, সে-গল্প। মওলানার বরাত দিয়ে শোনান ইবন্ বতুতা। মওলানা বলেছেন, আলস্নাহ প্রথমে কলম তৈরি করেছেন তারপর মসিপাত্র; লিখেছেন আমাদের কথা। আমাদের জন্ম হলো।
তাঁর কলম থেকে জন্ম নেওয়া এক-একটি কিতাব আমরা প্রত্যেকে। মানুষের জীবন-কিস্সা খোদা তাঁর কলমে লিখে চলেছেন।
পাহাড়ে, অরণ্যে, নদীতীরে, মেরামে – কোথায় ঘোরেননি ইবন্ বতুতা। মুরিদদের নিয়ে মওলানা যেখানে বসতেন যে-পথে হাঁটতেন, তিনি খুঁজে বেড়িয়েছেন সেইসব জায়গা। মওলানা যখন একা হাঁটতেন তখন মেরামের হাওয়ায়-হাওয়ায় ছড়িয়ে পড়ত কবিতার পঙ্ক্তি। তাঁর ছায়াসহচর হুসাম সেসব লিপিবদ্ধ করতেন। মেরামের অদূরে নদীতীরে বসে কোনো দরবেশ হয়তো বাঁশি বাজাচ্ছেন। কার জন্যে? না, মওলানার জন্যে। বাঁশির ক্রন্দনধ্বনিই তো তার জীবনবেদ। এখানেই একদিন ইবন্ বতুতা শোনেন ইয়াকুব আল মুসত্মাসিমির কথা। মওলানার জীবনকথা লিখছিলেন তিনি। শেষ হলে সে-কিতাব তুলে দেবেন ইবন্ বতুতার হাতে। এঁরই পালিত কন্যা মেষপালিকা এক
প্রকৃতিকন্যাও বটে। এই মেয়েটি ইবন্ বতুতার জীবনে এক নতুন কিস্সার জন্ম দেয়। সে-গল্পে আনন্দ যত, বেদনাও তত।
‘আয়নাজীবনে’ রবিশঙ্কর বল মওলানা ও তাব্রিজির অদ্বৈত সত্তার কাহিনি লিখেছেন। তাব্রিজি আর এক রহস্য; কিস্সার গোলকধাঁধার মধ্য দিয়ে পাওয়া তাঁর জীবন ইবন্ বতুতার কাছ থেকেই নিয়েছেন রবিশঙ্কর। সদ্য কৈশোরে খোলস ছেড়ে বেরোনো পাগলপারা শামসুদ্দিন তাব্রিজিকে দেখে তাঁর পিতা জানতে চান, তাঁর পুত্রের হয়েছেটা কী? এত উদ্ভ্রামত্ম কেন সে? পুত্র হাঁসের ডিমের কিস্সা শোনান পিতাকে। মুরগি তা দিয়েছে হাঁসের ডিমে। ডিম ফুটে ছানারা যখন নদীতীরের ঢালু বেয়ে সোজা পানিতে নেমে গেল, মুরগির তখন তীরে দাঁড়িয়ে ছানাদের শুধু দূর থেকে দেখা ভিন্ন অন্য কিছু করার নেই।
: তার মানে? পিতা জানতে চান।
: মানে হচ্ছে আমি একটা হাঁসের ছানা আর আপনি সেই মুরগি। আমরা এক বস্ত্রখ- থেকে তৈরি পোশাক নই আববা।
এই তাব্রিজি স্বয়ং প্রেম হয়ে নিঃশব্দ চরণে এসেছিলেন মওলানার জীবনে। এর আগে তিনিও ঘুরেছেন পথে-পথে। বহু সাধুসঙ্গ করেছেন। তবু ভরিল না চিত্ত। শত হাজার কিস্সার ফুল ফোটানো জীবন তাঁরও।
একটা স্বপ্ন দেখেছিলেন তিনি। অবশ্য তার আগে একটা গল্প আছে। আউলিয়া-এ-খোদার দেখা পাওয়ার জন্য আলস্নাহর কাছে দোয়া চেয়েছিলেন তাব্রিজি। স্বপ্নে কেউ যেন তাঁকে বলে গেল আনাতোলিয়া বা রম্নমের রম্নমিই হচ্ছেন সেই আউলিয়া। তখন কিন্তু মওলানাকে দেখে তাব্রিজির মন ভরেনি। তখনো তিনি অরন্ধিত। কাঁচা। সেরকমই মনে হয়েছিল তাব্রিজির। ১৫ বছর পরে কেনিয়ায় আবার যখন দেখা হলো, দুজনেই প্রতিটি মুহূর্তে গ-ূষ ভরে পান করেছেন প্রেম। বিশ্বের তাবৎ কাব্য-কাহিনির মতো এক অধরা মাধুরীকে খুঁজেছেন দুজনের মধ্যে দুজনে। একে অন্যের কূল পাননি। যেন এঁদের মিলন হবে বলে এতদিন দিন গুনেছে এই দুনিয়া। হুশামকে ডেকে তাব্রিজি একদিন বললেন, সিসকুর নামের এক পাখি আগুনে পোড়ে না কিন্তু জলে ডুবে যায়। আর হাঁস? জলে ডোবে না কিন্তু আগুনে পুড়ে যায়। এমন পাখি কোথায় আছে বল যে আগুনে পোড়ে না জলেও ডোবে না! হুশাম বলে, আপনিই সে পাখি।
: না হুশাম। আমি সামান্য পরিন্দা মাত্র। মওলানার খাঁচায় এসে বাঁধা পড়েছি। তবে কি জানো হুশাম, কোনো কোনো বন্ধন মুক্তির কথা বলে। এও সেই রকম।
তাব্রিজি মওলানাকে ভিড় থেকে সরিয়ে একা করেছেন। কারণ ভিড়ে সত্য থাকে না। অন্যদিকে তাব্রিজিকে পেয়ে মওলানা যেন খুঁজে পেলেন ভালোবাসার সেই বাড়ি, যে-বাড়ির
দরজা-জানালা-ছাদ সবই গজল আর গান দিয়ে গড়া। তাব্রিজি তাঁর জীবনে ভালোবাসার সেই তন্দুর, যার আগুনে হৃদয়
পুড়তে-পুড়তে সুরভি ছড়ায়। কিন্তু গোলাপ ফোটা সাঙ্গ হলে বুলবুলি একদিন উড়ে যায়। মওলানার জীবনব্যাপী দহনযজ্ঞ শুরম্ন হয়। প্রায় এক বছর মওলানা ‘শমা’ করেননি। হুশামকেও ডাকেননি। কেবল উৎকর্ণ থেকেছেন তাব্রিজির পায়ের শব্দ শোনার অপেক্ষায়।
শাম্স তাব্রিজি যখন আর তাঁর জীবনে নেই, তখন এক রাতে প্রেমকেই প্রশ্ন করেন মওলানা : সত্যি করে বল তো তুমি কে? কিছুক্ষণের মধ্যে শোনা গেল একঝাঁক পাখির ডানার ঝাপট। মওলানা বললেন, একবার প্রকাশিত হও। বলো তুমি কে? এবারে যেন ‘নে’র (বিশেষ বাদ্যযন্ত্র) মর্মভেদী সুর শুনতে পেলেন তিনি। সঙ্গে সেই কণ্ঠস্বর : আমি অনাদি, অনমত্ম জীবন। আমি কেবল জীবন প্রসব করছি।
: স্থান-কালের অতীত হলে বলো তোমার ঘর কোথায়? কোথায় থাকো তুমি? উত্তর এলো : হৃদয়ের আগুনে এবং অশ্রম্নভেজা চোখে।… আমার শরীর? আলোর মতো, শব্দের মতো। আমি টিউলিপের গাঢ় লাল রং। আমি বিলাপের মাধুর্য। মওলানা বুঝলেন পরীক্ষা দিতে হচ্ছে তাঁকে। চরম বিচ্ছেদের কাছে পৌঁছুতে হবে তাঁকে। শামসুদ্দিন তাব্রিজি আর একবার ফিরলেন মওলানার জীবনে। এবারে আর যেন তাঁকে হারাতে না হয় সেজন্যে অন্যরকম এক মায়ার বাঁধনে তাঁকে বাঁধলেন মওলানা। সদ্য ফোটা ফুলের মতো পালিতা কন্যা কিমিয়ার সঙ্গে বৃদ্ধ তাব্রিজির বিয়ে দিলেন তিনি। শুরম্ন হলো তাব্রিজি হত্যার
প্রাসাদ-ষড়যন্ত্র। কারণ মওলানার কনিষ্ঠ পুত্রটি স্বয়ং ছিল কিমিয়ার প্রেমিক। পিতাকে ইসলামবিরোধী নৃত্য-গীতের পথে নিয়ে যাওয়ার জন্য তাব্রিজির ওপর এমনিতেই ক্ষুব্ধ ছিল তাঁরা সকলে। কিতাবখানে সেদিন মওলানা ও তাব্রিজির শেষ রজনী। বাইরে প্রবল তুষারঝড়। আনাতোলিয়ার সূর্য সেদিন আনাতোলিয়ার আলোকে শোনাচ্ছিলেন ফরিদউদ্দীন অতরের তিন প্রজাপতি ও মোমবাতির কিস্সা। প্রথম প্রজাপতি মোমবাতির দূরত্বে থেকে কি তাপ, কি তাপ বলে পালিয়ে গেল। দ্বিতীয় প্রজাপতি একটি পাখা ঝলসে যেতেই পালালো। ঠিক এই সময় বাইরে থেকে ভৌতিক এক হাড় হিম করা ডাক ভেসে এলো : শেখ শামসুদ্দিন বেরিয়ে আসুন। অচেনা, অদৃশ্য আগন্তুককে অপেক্ষা করতে বলে তৃতীয় প্রজাপতির গল্পটি তিনি শেষ করেন।
তৃতীয়টি ঝাঁপ দিলো আগুনে। সে ছাড়া আর কে জানবে আগুন কী। আবার সে-ডাকটি শোনা গেল। শেখ জানেন কারা তাঁকে ডাকছেন, কেন ডাকছেন। কোরবানির জন্য প্রস্ত্তত গরম্নর দৃষ্টি তাঁর চোখে। মওলানা চোখ বুজে সুরা এখলাস পড়ছেন। তাঁর সূর্যকে তিনি বাধা দিলেন না, আগলেও রাখলেন না। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে দূর থেকে ভেসে এলো সকরম্নণ আর্তনাদ। প্রজাপতি ছাড়া কে জানবে সম্পূর্ণ দগ্ধীভূত হলে কী হয়!
সঙ্গীদের নিয়ে বাইরে এলেন মওলানা। চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে চরাচর। ঝকঝকে সাদা বরফের গায়ে সামান্য
ছোপ-ছোপ রক্তের দাগ, আর কোথাও কিছু নেই।
সবশেষে বলি, মসনবীর পাঠক (বা মরমিয়ারা) বজ্রনির্ঘোষ শুনে, বৃষ্টির আশ্বাস পেয়ে তৃণভূমি যেমন সুখী হয়,
মসনব- পাঠে তেমন আনন্দিত হন কি না বা মসনবীর জন্য ক্লামত্ম চোখ যেভাবে ঘুমের প্রতীক্ষায় থাকে সেভাবে কেউ অপেক্ষমাণ থাকেন কিনা, জানি না। রবিশঙ্কর বলকে পড়ে পাঠক কি পেতে পারেন তার কিছুটা আভাস হয়তো দিতে পেরেছি।
কৃতিত্ব সম্পূর্ণই ঔপন্যাসিকের। তিনি ইবন্ বতুতার ‘নকশাখচিত চাদর’টিকে আকাশ জুড়ে ছড়িয়ে দিয়েছেন। সেখানে নিজের মতো করে কিছু মণি-মুক্তোর কাজ করেছেন। প্রথম খ–র শিরোনামে শিরোধার্য করেছেন জয় গোস্বামীর কবিতার পঙ্ক্তি, সে কাব্য অনেক। সুযোগ পেলেই ডেকে নিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ দাশ বা আর কাউকে। মওলানার দ্বিতীয় স্ত্রী গ্রিক নারী কিরার রূপমাধুরীতে মুগ্ধ লেখক বলেন, এ-পৃথিবী একবার পায় তারে, পায়না কো আর। ভিন্ন-ভিন্ন অনুষঙ্গে রবীন্দ্রনাথ রয়েছেন অঙ্গবিহীন আলিঙ্গনে। সব মিলিয়ে সে কাব্য অনেক ও আয়নাজীবন পাঠ এক মহাজাগতিক অভিজ্ঞতা; আমাদের পাঠের ভুবনে ও বোধের জগতে এক অশামত্ম আলোড়ন তোলা সুগভীর সত্মব্ধতা।