চিঠিপত্রে রবীন্দ্র-মানস

অভিজিৎ দাশগুপ্ত

বিদ্বজ্জনেদের কাছে লেখা

রবীন্দ্রনাথের অগ্রন্থিত চিঠিপত্র

সম্পাদনা : সমীর সেনগুপ্ত

কলকাতা

২০০ টাকা

সারা জীবনে কত চিঠি লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ। আড়াই হাজার নাকি তারও অনেক বেশি। সংখ্যা জিনিসটা অনেকের না-পছন্দ হতে পারে। প্রচুর লেখা মানেই যে তা উৎকৃষ্ট, এমনটা নয়। বরং অল্প লিখেও কেউ-কেউ রচনা ও দৃষ্টিভঙ্গির গুণে আমাদের মনে স্থান করে নেন। কিন্তু যখন দেখি চিঠিপত্রের মতো বিষয়, সৃষ্টিশীলতার এও এক আশ্রয়। অবশ্যই নিজস্ব। অথচ বুঝতে পারি কবির মূল্যবান জীবনের
খুঁটিনাটি জানার ক্ষেত্রে এর চেয়ে ভালো কিছু হতে পারে না। সেইসঙ্গে মানুষটিকেও।

রবীন্দ্র-গবেষক ও চিন্তক সমীর সেনগুপ্ত-সম্পাদিত গ্রন্থ বিদ্বজ্জনেদের কাছে লেখা রবীন্দ্রনাথের অগ্রন্থিত চিঠিপত্র আমাদের নাগালের মধ্যে না থাকা অথবা থাকা কবির এমন অনেক চিঠি নতুন করে পড়তে সাহায্য করে। ভূমিকায় সমীরবাবু জানিয়েছেন, ‘রবীন্দ্রনাথের শত শত অমূল্য চিঠিপত্র ছড়িয়ে আছে নানা দুষ্প্রাপ্য পত্রিকায়, নানাজনের লেখা বইয়ে বেশ কিছুদিন থেকে মন গিয়েছিল এসবের যা হাতে আসে সব সংগ্রহ করে রাখতে।’ ১৫ জন বিশিষ্ট মানুষকে (গ্রন্থভুক্ত) নানা সময়ে কবি যেসব পত্র লিখেছিলেন, তা থেকেই ‘কিছু চিঠি নিয়ে এই বইটি’ নির্মাণ। মোট চিঠি ১২৩টি। জন্মবর্ষের ক্রম অনুসারে পত্রপ্রাপকগণ হলেন – নবীনচন্দ্র সেন (পাঁচটি), অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় (দুটি), দ্বিজেন্দ্রলাল রায় (একটি), ললিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় (দুটি), অতুলপ্রসাদ সেন (নয়টি), প্রিয়ম্বদা দেবী (নয়টি),
প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় (নয়টি), শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (একটি), রাজশেখর বসু (একটি), সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় (একটি), অমল হোম (৩২টি), তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় (পাঁচটি), ‘বনফুল’ (১৯টি), আশালতা সিংহ (ছয়টি) এবং মৈত্রেয়ী দেবী (২১টি চিঠি)। গ্রন্থভুক্ত ১৫ জন মানুষের ভেতর মাত্র দুজন, নবীনচন্দ্র ও অক্ষয়কুমার, ছিলেন রবীন্দ্রনাথের চেয়ে বড়। এই সারণি (পত্রসংখ্যা) পাঠককে অনুমাননির্ভর করে। মনে হবে, অমল হোম বা মৈত্রেয়ী দেবীর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের যেমন ভাব-ভালোবাসা ছিল; তেমনটা হয়তো নবীনচন্দ্র, প্রভাতকুমার বা সুনীতিকুমারের সঙ্গে ছিল না। যদিও তথ্য বলছে অমল হোম বা মৈত্রেয়ী দেবীর মতো অপর
তিনজনের সঙ্গেও কবির যথেষ্ট হৃদ্যতা ছিল। তাই আলোচনার শুরুতেই নির্যাস হিসেবে আমরা বলতে পারি, পত্রগুলো থেকে সে-সময়কালে কবির স্পন্দন আর প্রখর ব্যক্তিত্বকেই খুঁজতে চেষ্টা করব।

এই গ্রন্থের চিঠিগুলোকে তিন পর্যায়ে ভেঙে দেখলে আলোচনা ও বোঝার ক্ষেত্রে সুবিধা হবে। পরিচিত, ঘনিষ্ঠ, অতিঘনিষ্ঠ। প্রথম দলে আছেন অক্ষয়কুমার, ললিতকুমার, রাজশেখর বসু, প্রিয়ম্বদা দেবী ও আশালতা সিংহ। ঘনিষ্ঠরা হলেন নবীনচন্দ্র,
দ্বিজেন্দ্রলাল, অতুলপ্রসাদ, শরৎচন্দ্র, তারাশঙ্কর ও বনফুল। আর অতিঘনিষ্ঠরা হলেন প্রভাতকুমার, সুনীতিকুমার, অমল হোম ও মৈত্রেয়ী দেবী। এই ত্রি-বিভাগ আমার ভাবনা থেকেই করা। এর পরিবর্তন করা যায়। এ কথাও বিবেচ্য, চিঠির সংখ্যা ধরে এই বিভক্তি করা হয়নি। তাহলে আশালতা সিংহ (ছয়টি চিঠি) ও সুনীতিকুমারের (একটি) স্থান পালটাত।

চিঠিপত্রে রবীন্দ্রনাথের মানসিক ভাবটি সবচেয়ে ভালো ফুটত। ১৯২৯, ২৬ ডিসেম্বর সুনীতিকুমারকে লেখা পত্রে কবি জানাচ্ছেন, ‘দেশের লোকের কাছ থেকে আমি যা পাই তা আমার প্রাপ্য নয় এবং যা না পাই তাই আমার প্রাপ্য এই বলে হিসেব-নিকেশের নালিশ তুলে কিছু লাভও হয় না। মানরক্ষাও হয় না।’ এই বিরোধ দীর্ঘ সময়ের। কখনো দেশবাসী, কখনো ব্যক্তি। দ্বিজেন্দ্রলালকে ১৯০৫, ৬ মে কবি লিখছেন, ‘প্রিয়বরেষু, আপনি আমার স্তাবকবৃন্দের মধ্যে ভর্তি হইতে পারবেন না এ-কথাটা এতটা জোরের সঙ্গে কেন যে বললেন আমি ভালো বুঝতে পারলাম না। ‘আপনার নিন্দুকের দলে আমি যোগ দিতে পারব না’ এ-কথাও তো আপনি বলতে পারতেন। এ সমস্ত অনাবশ্যক কথা গায়ে পড়ে উত্থাপন করা কী জন্যে?’ প্রসঙ্গত বলার, অমল হোমকে রবীন্দ্রনাথের একটি চিঠির (পত্র-৭) বিষয়ে সম্পাদক মহাশয় যে টীকা দিয়েছেন তা এইরকম – ‘জোড়াসাঁকোর প্রাঙ্গণে অগ্নিসৎকারোৎসবের খবর’ : বিচিত্রাভবনের দোতলায় যখন রবীন্দ্রনাথ ও গান্ধী আলোচনায় মগ্ন, ঠিক তখনই গান্ধীর উৎসাহী ভক্তরা রবীন্দ্রনাথের বিরোধিতা প্রচার করতে সেই জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির প্রাঙ্গণেই বিলিতি কাপড়ের সত্মূপ পোড়াচ্ছিলেন – কারণ তাঁরা জানতেন, রবীন্দ্রনাথ বিলিতি কাপড় পোড়াবার বিরুদ্ধে ছিলেন।’ এই খবরটি ইন্ডিয়ান ডেইলি নিউজে প্রকাশ পায়। কারণ সেই সময় অমল হোম এই পত্রিকাটির সহকারী সম্পাদক ছিলেন। সুতরাং বিশ্বনাগরিক রবীন্দ্রনাথের অনুভব-সংকট দীর্ঘ সময়ের, বলা যায়।

সাহিত্য-সংক্রান্ত বেশ কিছু চিঠি এই বইয়ে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বনফুল বা বলাই চাঁদ, তারাশঙ্কর, প্রিয়ম্বদা, আশালতারা কবির কাছ থেকে দুর্লভ উৎসাহ পেয়েছেন। বয়সের কারণে কোনো-কোনো চিঠি হয়তো যথেষ্ট বড় হয়ে ওঠেনি, কিন্তু তাতে বিচারকের দৃষ্টি হারিয়ে যায় না। ‘ধাত্রীদেবতা’ সম্পর্কে জানাচ্ছেন, ‘বইয়ের প্রথম অর্ধেক অংশে তোমার হাতের নৈপুণ্য উজ্জ্বলভাবেই ্রকাশ পেয়েছে। কিন্তু যেখানেই তোমার গল্পের জন্যে উচ্চমঞ্চ গড়ে তুললে সেখানেই সে স্থানচ্যুত স্বভাবভ্রষ্ট হয়ে পড়ল।… একশ্রেণির পাঠকের কাছে তুমি পুরস্কার পাবে কিন্তু সেই পুরস্কার তোমার যোগ্য হবে না। তোমার এ-লেখাটিকে পরিমাণে বড়ো করতে গিয়ে সম্মানে ছোট করেছ আমার এই অভিমত ক্ষোভের সঙ্গে তোমাকে জানাতে হলো।’ আশালতা সিংহকে অমিতার প্রেম উপন্যাস সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ভাবনা ব্যক্ত করেছেন। সাম্প্রতিক একটি আলোচনায় সুদেষ্ণা চক্রবর্তী জানাচ্ছেন, ‘আশালতার জনপ্রিয়তা একসময় নেহাত কম ছিল না। তার এক বড় প্রমাণ, একদা তাঁর সাহিত্য রচনাকে তীব্রভাবে আক্রমণ করা হত বিদ্রোহী ও নীতিহীন রূপে। সেই সঙ্গে কুৎসা রটনা চলত তাঁর ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে।… প্রায় অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে আশালতার শিক্ষিত, রুচিশীল ডাক্তার স্বামী নিজের স্ত্রীর বিরুদ্ধে কলঙ্ক প্রচারে পরোক্ষে ইন্ধন জুগিয়েছিলেন।’ (বইয়ের দেশ জুলাই-সেপ্টেম্বর-২০০৬)। সেই অভিব্যক্তিগুলো তাঁর লেখাতেও বেশ ভালো রকমে থাকত। পত্র-৩ সংখ্যকে (১৯৩৪, ১ মে) রবীন্দ্রনাথ তেমন মন্তব্যই প্রকাশ করেছেন লেখিকার মৌলিকত্বকে মেনে নিয়ে। ‘পড়তে পড়তে বারবার মনে হয়েছে আমি হয়তো জানিনে। আমি হয়তো যেখানে যুক্তিসঙ্গত সুবিচার খুঁজছি সেটা পুরুষবুদ্ধি থেকে। মেয়েদের ভালোবাসার বায়ুবিজ্ঞানে ঝড় এবং গুমট, সাইক্লোনিক এবং এন্টিসাইক্লোনিক মেজাজ শীতাতপের যে বৈষম্যে অকস্মাৎ ঘটে সেটার গূঢ় রহস্য আমাদের হয়তো জানা নেই।’

অতিঘনিষ্ঠদের প্রতি রবীন্দ্রনাথ আটপৌরে ভালোবাসা দেখিয়ে এসেছেন আজীবন। এরা বয়সে অনেক ছোট। ফলে, অজস্র মায়া খেলা করত কবির দায়বদ্ধতায়। যেমন অমল হোম, যেমন মৈত্রেয়ী দেবী বা প্রভাতকুমার, সুনীতিকুমারদের ক্ষেত্রে ঘটেছে।

অমল হোমের বাবা গগনচন্দ্র হোম ছিলেন নববিধান ব্রাহ্মসমাজের সদস্য এবং তিনি রবীন্দ্রনাথের পরিচিত। তাই ছোটবেলা থেকেই অমল হোম কবির বিষয়ে অবগত ছিলেন। দীর্ঘ ৩১ বছর তাঁদের চিঠি চালাচালি চলে। বহু কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় উঠে এসেছে এই চিঠিগুলোতে। যেমন – ‘অজিতের কাছে জানা গেল যে তুমি নাকি কি কাগজ বের করে সাহিত্যচর্চায় এমন মনোনিবেশ করেছ যে কলেজের পাঠ্য পড়বার আর অবকাশই পাচ্ছ না। তোমার অভিভাবক সম্প্রদায় তোমার এই অকাল সাহিত্যপ্রীতির মূলে শামিত্মনিকেতনের যোগ কল্পনা করে ক্ষুব্ধ শুনেছি।’ অথবা গগনচন্দ্রের মৃত্যুর পর সান্তবনা দিয়ে চিঠি লিখেছেন, ‘শোকের দিনে সান্তবনা দেবার চেষ্টা বিড়ম্বনা। জীবনে শোকের কার্য আছে। আত্মীয় বিচ্ছেদকে তার শেষ অর্ঘ্য দিতেই হবে। এই দানের মুহূর্তে জীবনের প্রতি অন্ধ আসক্তির বন্ধন শিথিল হয়। এই আসক্তি ক্ষীণ হলে জীবনের কর্তব্য বিশুদ্ধ হয়।’

ঠিক এরকম আর একজন মৈত্রেয়ী দেবী। সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্তের কন্যা মৈত্রেয়ী শিশুকাল থেকেই কবিকে জানতেন, চিনতেন। কবির শেষ জীবনের সুনিশ্চিত বিশ্রামস্থল ছিল মৈত্রেয়ী-মনোমোহন সেনের মংপুতে। ‘মিত্রা শরীর খারাপ। ডাক্তার এখানে আসতে নিষেধ করেছিলেন – কিন্তু আমাদের বঙ্গীয় সমতট অত্যন্ত অসহ্য। শরীরের দুর্লক্ষণের না উপশম হওয়া পর্যন্ত নির্ডাক্তার দেশে যাওয়া নিরাপদ নয়।’ কখনো একটি পেলিকান কলম দলিলপত্রসহ কবি লিখে দিয়েছিলেন প্রিয় মৈত্রেয়ীকে। ‘আমি বিখ্যাত কবি সার্বভৌম রবীন্দ্রনাথ শ্রীমতী মৈত্রেয়ী দেবীকে অদ্য পুণ্য জ্যৈষ্ঠমাসের কৃষ্ণা দশমী তিথিতে দিনমানে পূর্বাহ্নে ইংরেজি সাড়ে নয় ঘটিকায় পেলিকান-রচিত একটি উৎসলেখনী স্বেচ্ছায় স্বচ্ছন্দচিত্তে দান করিলাম।… চন্দ্র সূর্য সাক্ষী।’ অমূল্য এই সংগ্রহ গ্রন্থটির ‘ছোটখাট ভুলভ্রামিত্মগুলি মুদ্রণপ্রমাদ বলে ধরে নিয়ে’ সম্পাদক মহাশয় ‘ঠিক করে’ দিয়েছেন। কিন্তু মংপুতে রবীন্দ্রনাথ গ্রন্থে রয়েছে –

‘নগাধিরাজের দূর নেবু নিকুঞ্জের

রসপাত্রগুলি… ’ (প্রাইমা)

আর আলোচ্য গ্রন্থে পাচ্ছি –

‘নগাধিরাজের দূর নেবুনিকুঞ্জের

রসপাত্রগুলি… ’ (পৃ ১৭২)

৯৯-১ এন, কর্নওয়ালিস স্ট্রিট – ঠিকানাটি খুঁজতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ একবার নম্বর বিভ্রাটে বিপাকে পড়েছিলেন। এখানে সেই পত্রটি (১৯) থাকলেও কবির দেওয়া প্রস্তাবটি নেই। বেশ কিছু প্রস্তাব দিয়ে অমল হোমকে দীর্ঘ চিঠি পাঠান তিনি। তার একটি – ‘অ) রাস্তায় অবস্থিত বাড়িগুলির নম্বর একটি বাতিস্তম্ভ থেকে পরবর্তী বাতিস্তম্ভের মধ্যে থাকা উচিত। একটি তীর চিহ্ন আঁকা
থাকবে এবং সেই অনুযায়ী নম্বরগুলি আরোহণ এবং অবরোহণ পদ্ধতিতে সাজানো হবে। উদাহরণ – ৪৮

– ৫ জি

৫৬ – ৬৪…।’ (অনুবাদ : মধুছন্দা মৈত্র। ‘পুরশ্রী’, ২০১২, ২০ মে)।