চেতনাপ্রবাহের বিচিত্র উদ্ভাস

সৈয়দ আজিজুল হক

সুশান্ত মজুমদারের (জ. ১৯৫৪) গল্পপাঠ পাঠকদের প্রচুর মনোযোগ দাবি করে। কারণ, বহির্বাস্তবের রূপ বর্ণনার পরিবর্তে অন্তর্বাস্তবতার স্বরূপ উন্মোচনই তাঁর গল্পের প্রধান প্রবণতা। এই বৈশিষ্ট্যসূত্রেই কাহিনি বয়ানে অনিবার্যভাবে অন্বিষ্ট হয়েছে চেতনাপ্রবাহ রীতি১। মানবমনের চিন্তনপ্রক্রিয়ার নিগূঢ় রহস্যকে তিনি চিত্রাত্মক পরিচর্যার মাধ্যমে বিশ্লেষণ করতে আগ্রহী। চেতনাপ্রবাহ রীতির স্বভাবধর্ম অনুযায়ী, তাঁর গল্পের কাহিনি আখ্যানধর্মী নয়, বরং কাল-পারম্পর্যহীন, উল্লম্ফনমূলক ও মনোবিশ্লেষণাত্মক। এ-কারণে তীক্ষ্ণ ও প্রখর মনোযোগ ছাড়া তাঁর গল্প-কাঠামোয় অনুপ্রবেশ করা কিংবা চরিত্রের মনোজগতের কল্পনাপ্রবাহকে অনুসরণ করা দুরূহ।
উনিশ শতকের শেষ পর্যায় থেকে বিশ শতকের প্রথম পর্বে মানব মনস্তত্ত্ব সম্পর্কে এমন কিছু যুগান্তকারী আবিষ্কারের ঘটনা ঘটে২ যা চিন্তাশীল ও সৃজনশীল মানুষের সৃষ্টিজগতে সূচনা করে ব্যাপক পরিবর্তনের। বিশেষত মানবমনের সচেতন, অবচেতন ও অচেতন স্তরসম্পর্কিত ফ্রয়েডীয় ব্যাখ্যা চিত্রশিল্প ও কথাসাহিত্যের ভাবজগৎকে পালটে দেয় বিপুলভাবে। উনিশ শতকীয় কথাশিল্পের কাহিনিবিন্যাসে কাল-পরম্পরায় অন্বিত বিস্তৃত সময়পরিসরে বহির্বাস্তবের ঘটনাচিত্রণই ছিল মুখ্য। কিন্তু মনের অবচেতন ও অচেতন স্তর সম্পর্কে ধারণা লাভের পর অন্তর্জগতের উন্মোচনেই আগ্রহী হন কথাসাহিত্যিকরা। ফলে প্রাধান্য পায় সংলাপের (dialogue) পরিবর্তে আত্মকথন (monologue)। মানবমনের চিন্তনপ্রক্রিয়ার সূত্র ধরে বহির্বাস্তব হয়ে পড়ে সংকুচিত, ভেঙে যায় কাল-পরম্পরা। কল্পনা, স্মৃতিময়তা, স্বপ্নচারিতা প্রভৃতির যৌথ সমবায়ে মুখ্য হয়ে ওঠে উল্লম্ফনধর্ম। অন্যদিকে বহির্বাস্তবেও সংক্ষিপ্ত হয়ে যায় সময়ের পরিসর, স্থানসম্পর্কিত ধারণা।
বাংলা কথাশিল্পে এই রীতি প্রয়োগে পথপ্রদর্শকের ভূমিকা পালন করেন ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় (১৮৯৪-১৯৬১), গোপাল হালদার (১৯০২-৯৩) প্রমুখ। বাংলাদেশের কথাসাহিত্যে চেতনপ্রবাহরীতিকে অত্যন্ত সৃজনশীলভাবে প্রয়োগ করেছেন সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ (১৯২২-৭১) ও তাঁর সার্থক উত্তরসূরি আখতারুজ্জামান ইলিয়াস (১৯৪৩-৯৭)। এই দুই কথাশিল্পীর রচনাতেই আমরা লক্ষ করি কীভাবে ভেঙে পড়ে সময়ের প্রচলিত কাঠামো, পালটে যায় প্লটের ধারণা এবং কাহিনি হয়ে পড়ে অনেকাংশে সংলাপশূন্য। বহির্বাস্তবের রূপ অন্বেষণের চেয়ে মনোজগতে তার প্রতিক্রিয়ার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণই হয়ে ওঠে এঁদের কাহিনির মূল বৈশিষ্ট্য। মনের সচেতন, অবচেতন ও অচেতন – এই তিন স্তরই এঁদের দক্ষ হাতে একই সময়তলে বিন্যস্ত হলে পাঠকের পক্ষে দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে তার গতিধারা অনুসরণ বা তার স্তর-বিভাজন।
১.০. সুশান্ত মজুমদারের গল্পে অনুসৃত চেতনাপ্রবাহরীতি এরই ধারাবাহিকতায় এক বিশিষ্ট সংযোজন। কোথাও কোথাও অবশ্য পূর্বসূরিদের প্রভাব খুবই স্পষ্ট এবং শরীরে শীত ও টেবিলে গুন্ডাপান্ডা (১৯৯৮) শীর্ষক তৃতীয় গল্পগ্রন্থের উৎসর্গপত্রে লেখক স্বীকারও করেছেন আখতারুজ্জামান ইলিয়াসকে ‘বোধ ও বোধির আত্মীয়’ বলে। তবু এক্ষেত্রে মোটেই অস্পষ্ট নয় লেখকের স্বকীয় ভাবনা ও উদ্ভাবনীশক্তির পরিচয়। তার প্রমাণ মিলবে গল্প-বিশ্লেষণেই। সুশান্ত মজুমদারের চারটি গল্পগ্রন্থ (ছেঁড়া খোঁড়া জমি, ১৯৮৮; রাজা আসেনি বাদ্য বাজাও, ১৯৯৪; শরীরে শীত ও টেবিলে গুন্ডাপান্ডা, ১৯৯৮; জন্ম-সাঁতার, ১৯৯৮)৩ অবলম্বনে রচিত হয়েছে এ-প্রবন্ধ।
১.১. ‘সরল সত্য’ (ছেঁড়া খোঁড়া জমি) গল্পে বিধৃত হয়েছে পুত্র ও পুত্রবধূ কর্তৃক গৃহ থেকে বিতাড়িত এক অসহায় বৃদ্ধের চেতনাপ্রবাহ। বৃষ্টিজর্জরিত এক দিনে হতভাগ্য এ-বৃদ্ধ এক ধনাঢ্য গৃহের বারান্দায় আশ্রয় নিয়ে নিমজ্জিত হয় কল্পনা, স্মৃতি, বাস্তব ও স্বপ্নের মধ্যে। বহির্বাস্তবে বারান্দায় বাড়ির পরিচারক মুরগি জবাই করতে এসে হুমকি দেয় বৃদ্ধকে চলে যাওয়ার, মেয়েরা খেলতে আসে, বাড়ির কর্তা আসে বাইরে থেকে রিকশা চেপে। এসব বহির্ঘটনা বৃদ্ধের কল্পনা ও স্মৃতিমগ্নতার সূত্রকে বারবার ছিন্ন করলেও প্রতিবারই নতুন কোনো ঘটনার আঘাতে তা আবির্ভূত হয় নতুন নতুন রূপে। প্রথমে গরু দেখে তার মনে আসে পুত্র হানিফের মৃত গাভীর কথা, গাভীর দুধ থেকে পুত্রবধূ কর্তৃক বঞ্চনার কথা। উঠে যাওয়ার নির্দেশে তার মনে আসে মৃত্যুচিন্তা। গৃহপরিচারকের মুরগি জবাইয়ের ঘটনায় মনে জাগে মুরগির মাংস দিয়ে ভাত খাওয়ার স্মৃতি ও আকাঙ্ক্ষা। স্মৃতিতে আসে শ্বশুরবাড়িতে মাছ-মাংস-দুধ ও নানারকম ব্যঞ্জনসহযোগে পরম আদরে খাদ্যগ্রহণের ঘটনা। মুরগি জবাইয়ের ছুরি দিয়ে গৃহপরিচারক আক্রমণের হুমকি দিলে বৃদ্ধের মনে সৃষ্টি হয় আতঙ্ক, মৃত্যুভীতি। আর এর প্রতিক্রিয়ায় স্মৃতিতে জাগে : পুত্র হানিফ বাঁ-হাতে দা এবং ডান হাতে কাগজ নিয়ে চাপ দিয়েছিল তার নামে জমি লিখে দেওয়ার জন্য। মেয়েদের খেলার শব্দে বিনষ্ট হয় এই স্মৃতিও। নিজের থলির মধ্যে কুড়িয়ে পাওয়া কৌটা শিশি দেখে মনে জাগে নাতিদের এসব উপহার দেওয়ার কথা। কিন্তু পুত্র ও পুত্রবধূ কর্তৃক বিতাড়িত হওয়ার সময় নাতিরা তাকে গৃহে ফিরিয়ে নিতে আসেনি – এ-কথা স্মৃতিতে জাগলে সঙ্গে সঙ্গে বেঁকে বসে মন। তারপর বৃষ্টির প্রভাবে আবার বৃদ্ধ তলিয়ে যায় স্মৃতির গভীরে। পুত্র হানিফকে জন্মদানের সময় তার স্ত্রী ফাতেমার সকরুণ মৃত্যুর ঘটনার সঙ্গে স্ত্রীর আরো স্মৃতি হাতড়ানোর সময় অন্দরমহল থেকে মুরগি রান্নার ঘ্রাণ বৃদ্ধের নাকে এলে স্মৃতি হারিয়ে বাস্তবে উদ্রেক হয় ক্ষুধার।
আমাদের মনের সচেতন, অবচেতন ও অচেতন অংশের কর্মপ্রক্রিয়ার স্তরবিভাজন করা দুরূহ। এগুলো প্রায়শ মিলেমিশে একাকার হয়ে সৃষ্টি করে চেতনাপ্রবাহের এক জটিল রূপ। এই জটিলতার রহস্য উপলব্ধি করেই লেখককে অাঁকতে হয় মনোজগতের ছবি। ‘সরল মৃত্যু’ গল্পে লেখক বৃদ্ধের মনোজগৎকে উন্মোচন করেছেন বাইরের পৃথিবীর কর্মকোলাহলের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে। বৃদ্ধের মনোভূমির অবচেতন অচেতন থেকে যে স্মৃতিচিত্র চয়ন করা হয়েছে, তাতে নিশ্চিতভাবে রক্ষা করা হয়নি কাল-পরম্পরা। গল্পের বহির্জাগতিক কালপরিসর অতিশয় সংক্ষিপ্ত – কমবেশি এক ঘণ্টার মধ্যে বিস্তৃত।
‘শরিক’ গল্পেও বহির্ঘটনার কালপরিসর অতিমাত্রায় সংক্ষিপ্ত – পড়ন্ত বিকেল থেকে সন্ধ্যা। বারান্দায় ইজিচেয়ারে উপবিষ্ট গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র মমিনউদ্দিন ১৯৭১-এর ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহের এক শেষ বিকেলে গভীরভাবে চিন্তামগ্ন। দুবার কনিষ্ঠপুত্র ও একবার মধ্যমপুত্রের উপস্থিতিতে ছিন্ন হয় তার এই চিন্তাসূত্র। পাকিস্তান রাষ্ট্রের সমর্থক মমিনউদ্দিনের জ্যেষ্ঠ ও মধ্যমপুত্র মুক্তিযুদ্ধে ছিল সক্রিয়। কনিষ্ঠপুত্রও তাদের অনুসারী। তাদের মধ্যে মুক্তিস্পৃহার যে তারুণ্যব্যঞ্জক উগ্রতা তা আহত করে মমিনউদ্দিনকে। এ-গল্পে মমিনউদ্দিনের স্মৃতিময়তাও অন্বিত নয় কাল-পরম্পরায়। সেখানে প্রথমে আসে ১৯৪৭-এর ১৪ আগস্ট পাকিস্তানের সৃষ্টিপর্ব; কিন্তু তারপরই আসে মোনায়েম খাঁর প্রসঙ্গ এবং আরও পরবর্তীকাল অর্থাৎ ১৯৭১-এ নিজ সন্তানদের মুখে পাকিস্তান সম্পর্কে বিদ্রূপাত্মক মন্তব্য। এরপর তার স্মৃতিতে জাগ্রত হয় ১৯৪৭-উত্তরকালে এদেশ ছেড়ে-যাওয়া হিন্দুর বাড়ি কিনে ভোগদখলের ঘটনা। একই সঙ্গে স্মৃতি হয় আরও পশ্চাৎমুখী; ১৯৪৭-পূর্বকালে মমিনউদ্দিনের এন্ট্রান্স ফেলের ঘটনা নিয়ে দুই লীগ-নেতা কীভাবে তাকে সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধির কথা বলে সমর্থক করে তোলে পাকিস্তান আন্দোলনের, উপস্থাপিত হয় তারই কলুষতাকাতর বিবরণ। তারপর তার বিয়ের ঘটনা এবং তারও পরে পাকিস্তান পর্বে তার শহরে সবুর খানের আগমনকে কেন্দ্র করে জনবিচ্ছিন্নতার দোহাই দিয়ে অপরাধী শক্তির সঙ্গে লীগ-নেতার মদ্যপান প্রভৃতি শেষে ১৯৭১-এ পাকবাহিনীর আগমন, তার পুত্রদের মুক্তিবাহিনীতে যোগদান নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ, সেপ্টেম্বরে এক মুক্তিযোদ্ধাকে তাড়া করে অবশেষে তার বাড়ি থেকে পাক-সেনাদের দ্বারা গ্রেপ্তারের বিরূপ স্মৃতি রোমন্থন প্রভৃতি ছিন্ন হয়ে যায় কনিষ্ঠপুত্র কর্তৃক জিন্নাহর বাঁধানো ছবি পদাঘাতে পিষ্ট করার শব্দে।
এগারো পৃষ্ঠার এ-গল্পে দুই পৃষ্ঠাও ব্যয় হয়নি বহির্বাস্তবের ঘটনার বিবরণে। বাকি পুরোটাই মমিনউদ্দিনের মনোভূমির কল্পনাপ্রবাহ। মমিনউদ্দিনের মনোলোকে স্মৃতিচিত্রের গতিময়তা সম্পর্কে লেখকের কয়েকটি উচ্চারণ এখানে পরিবেশন করা হলে সহজ হতে পারে চেতনাপ্রবাহরীতি সম্পর্কে একটি ধারণা লাভ। যেমন –
ক. পুরনো বিস্কুটের মতো ভেঙে যেতে থাকে ধুলোয় জমা ছবিগুলো;
খ. বিস্তর ছবি আসছে একে অন্যকে ধাওয়া করে। ধারাবাহিকতা ভেঙে যাচ্ছে;
গ. মচমচ জুতোর দাম্ভিক আওয়াজের লক্ষ্যে স্বর ছুটে গেলে আলগোছে খুলে পড়ে পুরনো স্মৃতির ফ্রেম;
ঘ. হারানো দিনের এই ঢাউস অক্ষত ছবিটা দেখি বয়সী সত্ত্বেও বেশ পরিচ্ছন্ন আছে;
ঙ. ফটাস শব্দে হঠাৎ বারান্দার দরজা খুলে গেল। সঙ্গে সঙ্গে মনোযোগও উলটে যায় মমিনউদ্দিনের।
এতক্ষণের চালু ফ্লাশব্যাক ছিঁড়ে যেতে সাদাকালো কালোসাদা আলো-ছায়ার খেলা হয়।
চ. কষ্ট যন্ত্রণার কোপে পুরোদস্ত্তর আহত হতেই দিব্যি স্বচ্ছ একটা ছবি অবাধ্য বেগে লাফ দিয়ে উঠে বসে;
ছ. বিনা নোটিশে এই ছবিটা টুপ করে বোঁটা খসা হয়। এর বদলে মাত্র মাস চার আগের তাজা ছবি, ধুলো পড়েনি; ঝকমকে; – বাতাসে পৃষ্ঠা উলটে যাওয়ার মতো হুট করে বেরিয়ে এলো। …নিঃশ্বাসের সঙ্গে মিশে ঠিক নিঃশ্বাসের মতো নিঃশব্দে ছবিটা চলে এলো।
জ. হঠাৎ ধড়ফড় করে জেগে ওঠেন মমিনউদ্দিন। …ঝটিতি হুঁশ-জ্ঞানের নাগাল পেয়ে যান।
লেখক এসব বিবরণের মাধ্যমে মমিনউদ্দিনের চেতনালোকের যে-ব্যাকরণকে পরিস্ফুট করেছেন তা হলো : স্মৃতির জগৎ বিশৃঙ্খল, পারম্পর্যহীন; অতি পুরনো কোনো স্মৃতিচিত্রের রূপও হতে পারে অনেক বেশি স্বচ্ছ, স্পষ্ট; আবার তুলনামূলকভাবে নিকট-স্মৃতিও হয়ে উঠতে পারে ধূসর। বাইরের ঘটনার অভিঘাতে স্মৃতির চলচ্চিত্রায়ণের ধারা যেমন ব্যাহত হতে পারে, তেমনি তার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নতুন কোনো স্মৃতি উঠেও আসতে পারে অবচেতন থেকে সচেতনলোকে কিংবা সেখানে ঘটতে পারে সামঞ্জস্যহীন কোনো স্মৃতির আকস্মিক উদ্ঘাটন।
কাহিনিবিন্যাসের ক্ষেত্রে চেতনাপ্রবাহরীতির অনুসরণই লেখকের প্রধান বৈশিষ্ট্য। এই রীতির সৃজনশীল প্রয়োগে উজ্জ্বল হয়ে আছে অনেক গল্পই। কিন্তু সব গল্প বিশ্লেষণ করা হলে প্রবন্ধের পরিসর দীর্ঘ হওয়ার এবং পুনরুক্তিদোষ ঘটার আশঙ্কা। আমরা তাই সীমাবদ্ধ থাকছি ওপরের দুটি গল্প-বিশ্লেষণের মধ্যেই। শুধু পেশ করছি এ রীতি প্রয়োগের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য গল্পের একটি তালিকা : ‘ছেঁড়া খোঁড়া জমি-১’, ‘ছেঁড়া খোঁড়া জমি-২’, ‘রাজা আসেনি বাদ্য বাজাও’, ‘রক্তমাংস’, ‘ভেগল’, ‘ককটেল’, ‘তৃতীয় ঘটনা’, ‘নিজস্ব মেদিনী’, ‘মুন্ডু মুখোশ’, ‘আমি মুক্তিযোদ্ধার সন্তান’, ‘শরীরে শীত ও টেবিলে গুন্ডাপান্ডা’, ‘বাবার গ্লানি’, ‘শব্দ নৈঃশব্দ্য’ এবং ‘লম্বা চুল ও পাঁচটি বিয়ার’।
১.২. লেখকের প্লট পরিকল্পনা সর্বদাই সুনিয়ন্ত্রিত ও সুসংহত। কোথাও শাখা-প্রশাখায় বিস্তৃত হয়ে ব্যাহত হওয়ার সুযোগ পায়নি কাহিনির একমুখী গতি। চারটি গল্পগ্রন্থে সংকলিত সাঁইত্রিশটি গল্পের মধ্যে কেবল তিনটি গল্পের পরিসরই কিছুটা দীর্ঘ; বাকি সব গল্পই সংক্ষিপ্ত পরিসরসম্পন্ন। কাহিনিগ্রন্থনে লেখকের পরিমিতিবোধের এ এক উজ্জ্বল উদাহরণ। অন্তর্বাস্তবতার রূপচিত্রণই যেহেতু লেখকের প্রধান প্রবণতা সেহেতু এরই সূত্র ধরে সর্বত্র অনুসৃত হয়েছে আত্মকথনের বৈশিষ্ট্যটি এবং এরই অনিবার্য অনুষঙ্গ হিসেবে কাহিনিতে লক্ষণীয় হয়ে উঠেছে সংলাপবিরলতা। ‘বাবার গ্লানি’ গল্পটি এর উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত।
কাহিনিবিন্যাসের ক্ষেত্রে তিনটি গল্পের স্বাতন্ত্র্য বিশেষভাবে লক্ষণীয় : ‘টুথপেস্ট’, ‘রক্তমাংস’ ও ‘আমি মুক্তিযোদ্ধার সন্তান’। একটা তীব্র ও প্রবল নাটকীয় উৎকণ্ঠা গল্পজুড়ে বজায় রেখে সবশেষে আখ্যানের জটিলতা উন্মোচনের ক্ষেত্রে বিশিষ্ট হয়ে আছে ‘টুথপেস্ট’ গল্পটি। ‘রক্তমাংসে’ একই গল্প-অবয়বে সমন্বিত হয়েছে দুটি কাহিনি। সমকালীন এক ঘটনা-শৃঙ্খলের গর্ভে অনুপ্রবিষ্ট হয়েছে প্রাগৈতিহাসিক কালের এক আখ্যান। এই উভয় আখ্যানকে এক সূত্রে গ্রথিত করেছে তাদের প্রতীকধর্ম। অন্যদিকে ‘আমি মুক্তিযোদ্ধার সন্তান’ গল্পে ভিন্ন-ভিন্নভাবে নানা চরিত্রের প্রেক্ষণবিন্দু ব্যবহারের মাধ্যমে মূলোদ্ঘাটিত হয়েছে কাহিনিগত জটিলতার।
১.৩. লেখকের চরিত্রায়ণ-বৈশিষ্ট্যের মূল দিক হলো : সামাজিক জীবনবিন্যাসের চেয়ে চরিত্রের অন্তর্লোকের উন্মোচনেই লেখক কেন্দ্রীভূত করেছেন অধিকতর মনোযোগ ও শ্রম। এক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবে কেন্দ্রীয় চরিত্রের মনোবিশ্লেষণই অর্জন করেছে প্রাধান্য। কেন্দ্রীয় চরিত্রকে পরিস্ফুটিত করার প্রয়োজনেই অন্যসব চরিত্রের আগমন ঘটায় তুলনামূলকভাবে কম গুরুত্ব পেয়েছে ওইসব চরিত্র। ফলে প্রান্তিক চরিত্রসমূহ সমর্থ হয়নি আবশ্যকীয় স্পষ্টতা অর্জনে। লেখক মূলত স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করেছেন মধ্যবিত্ত চরিত্র রূপায়ণেই। তবে এরই পাশাপাশি চিত্রিত করেছেন জোতদার, রাজনীতিবিদ ও গুন্ডা-মস্তান চরিত্র। এবং সেই সঙ্গে জোতদারের শোষণ-পীড়নে জর্জরিত হতদরিদ্র দিনমজুর, পুত্র কর্তৃক বিতাড়িত আশ্রয়হীন অসহায় বৃদ্ধ, শহরের মঞ্চ তৈরির কারিগর, চতুর গৃহপরিচারিকা, স্বামীর দায়িত্বহীনতার কাছে নিরুপায় গ্রামীণ কর্মজীবী নারী, সংখ্যাগুরুর পীড়নের শিকার ও নিরাপত্তার অভাববোধ-তাড়িত সংখ্যালঘু প্রভৃতি চরিত্র অঙ্কনেও রয়েছে লেখকের আন্তরিকতা ও দক্ষতার স্বাক্ষর। ক্ষমতা-কাঠামোর বাইরে অবস্থিত এসব নিম্নবর্গীয় চরিত্রের স্বরূপ বিশ্লেষণে স্পষ্ট হয়ে ওঠে লেখকের নিগূঢ় পর্যবেক্ষণমূলক দৃষ্টি ও বিচিত্র জীবনাভিজ্ঞতার পরিচয়।

২.০. গল্পশৈলীর জটিল বিন্যাসের মধ্যেই লেখক লুকিয়ে রাখেন এর বিষয়গত বৈভবকে। সেখানে জ্বলজ্বল করে মুক্তিযুদ্ধ, যুদ্ধোত্তর সংকট, বামধারার রাজনীতির চরমপন্থী কর্মপ্রক্রিয়া, রাজনীতির কূটচক্র, জোতদারি শোষণ-জুলুম ও তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, পুরুষতন্ত্রের কাছে অসহায় নারীর দায়িত্বশীলতা, সংখ্যালঘুর বিরূপ মনস্তত্ত্ব, মস্তানি রাজনীতি ও মনুষ্যত্ববোধের জাগরণ। বিষয়ভাবনায় লেখকের রাজনীতিসচেতনতা এবং সমাজ ও জীবন সম্পর্কে গভীরতর উপলব্ধি কথাসাহিত্যিক হিসেবে তাকে এনে দাঁড় করায় এক দায়িত্বশীল অবস্থানে।
২.১.১. মুক্তিযুদ্ধকালীন পরিস্থিতির নানা রূপ পরিস্ফুটিত হয়েছে ‘একাকার’, ‘বিদেশী বুট’, ‘শরিক’, ‘রাজা আসেনি বাদ্য বাজাও’, ‘মুন্ডু মুখোশ’ প্রভৃতি গল্পে। এর মধ্যে রয়েছে পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণ, অত্যাচার, নির্যাতন, গণহত্যা, লুণ্ঠন ও দহন অভিযান, মুক্তিযোদ্ধাবিরোধী নিষ্ঠুরতা এবং এর বিপরীতে মুক্তিযোদ্ধাদের দেশপ্রেম-উদ্বুদ্ধ সাহসী লড়াই। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আক্রমণ থেকে জীবন বাঁচাতে ঘরবাড়ি ছেড়ে মানুষের পলায়ন, এ-ধরনের দুর্যোগময় পরিস্থিতিতে ধর্মবর্ণের ঊর্ধ্বে উঠে মানুষের প্রতি মানুষের সহানুভূতি প্রকাশ, ঐকাত্ম্যচেতনা, পাকিস্তানি বাহিনীর পক্ষে মুষ্টিমেয় লোকের ঘৃণ্য সহযোগিতায় মুক্তিযোদ্ধাদের গ্রেফতার বরণ, দেশাত্মবোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে তথ্য-গোপনে দৃঢ়তা, অসহনীয় নির্যাতন ভোগ ও মৃত্যু প্রভৃতির নির্মম চিত্র উপস্থাপনেও তাৎপর্য অর্জন করেছে এ-গল্পগুলো।
২.১.২. যুদ্ধোত্তর সংকটের নানা রূপ বিশেষত মুক্তিযুদ্ধের বিপরীত চেতনার সম্প্রসারণ সংক্রান্ত কলঙ্কজনক চিত্র উপস্থাপিত হয়েছে ‘মুক্তি এবং ছেঁড়া ঠোঁট’, ‘নিজস্ব মেদিনী’, ‘আমি মুক্তিযোদ্ধার সন্তান’ এবং ‘লম্বা চুল ও পাঁচটি বিয়ার’ শীর্ষক গল্পসমূহে। প্রথম গল্পে এক মুক্তিযোদ্ধার কন্যা যখন তার প্রেমাস্পদের কাছ থেকে শহীদ পিতা সম্পর্কে ‘ইসলামের দুশমন’ এরূপ বিরূপ মন্তব্য শোনে তখন ক্রোধবশত তাকে শুধু তাড়িয়েই দেয় না, ক্রোধে ছিঁড়ে ফেলে তার ঠোঁট। এ ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় জনতা মুক্তিযোদ্ধার সন্তানের প্রতি অবনত হয় শ্রদ্ধা ও সহানুভূতিতে, অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তির প্রতি ব্যক্ত করে তীব্র ক্ষোভ ও ঘৃণা। ‘নিজস্ব মেদিনী’ গল্পে বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে একটি সংখ্যালঘু পরিবার দেশত্যাগের কথা ভাবলে দেশাত্মবোধে অনুপ্রাণিত হয়ে এর বিরোধিতা করে ওই পরিবারেরই সদস্য এক মুক্তিযোদ্ধা তরুণ। তার প্রশ্ন : মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যে দেশ স্বাধীন করেছি সে দেশ ত্যাগের প্রশ্ন আসে কেন? তার এই প্রশ্ন যেমন সংগত ও দেশাত্মবোধজাত তেমনি যারা বাস্তবতা উপলব্ধি করে দেশ ছাড়তে চায় তাদের সিদ্ধান্তের পেছনেও আছে কিছু অকাট্য যুক্তি। মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ব্যক্তি এখন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান। তৃতীয় গল্পে এক মুক্তিযোদ্ধার সন্তান মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তির ব্যাপারে অনমনীয় মনোভাব অব্যাহত রাখলে নিহত হয় তাদের দ্বারা। শেষ গল্পটিতে এদেশেরই অ্যালকোহলসেবী কদমছাঁট এক নাগরিকের মুসলিমপ্রীতির নামে পাকিস্তানি ক্রিকেট দলের প্রতি সমর্থনকে বিদ্রূপবাণে জর্জরিত করেছেন লেখক। স্বাধীনতা-উত্তরকালে ইসলামের নামে পাকিস্তান-প্রীতি ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী তৎপরতার উত্থানকে, এসব গল্পে, তার সূক্ষ্মমাত্রাসহ চিহ্নিত করা হয়েছে যথার্থভাবেই ।
২.২.০. স্বাধীনতা-উত্তরকালে এদেশের রাজনীতিতে যে নানা ধরনের অনৈতিক ও স্বার্থপর বৈশিষ্ট্য অনুপ্রবেশ করেছে তার তীব্র সমালোচনা ব্যক্ত হয়েছে লেখকের চারটি গল্পে। এগুলোর নাম : ‘ভেগল’, ‘ককটেল’, ‘ডিগবাজি’ ও ‘সাধারণের হাত’। প্রথম গল্পটিতে বিদ্রূপের শিকার হয়েছে যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে শাসক আওয়ামী লীগের সঙ্গে বামপন্থীদের অনভিপ্রেত ঐক্য। দ্বিতীয়টিতে বিশ্লেষিত স্বাধীনতাবিরোধীদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট অাঁতাতের স্বরূপ। একই সঙ্গে পরিবেশিত হয়েছে ইসলামের নামে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ব্যক্তির অনাধুনিক, সাম্প্রদায়িক ও রক্ষণশীল মনোভাবের কিছু অমার্জিত চিত্র। তৃতীয় গল্পটি এদেশে সামরিক সরকারের মস্তান-তোষণের এক কলুষতাক্লিষ্ট উদাহরণ। অপরাধী ব্যক্তিদের দলীয় ক্যাডার হিসেবে আহরণের অপরিণামদর্শী নেতিবাচক রাজনীতির এক ঘৃণ্য দৃষ্টান্ত হয়ে আছে এ-গল্প। শেষোক্ত গল্পটিতে ব্যক্ত হয়েছে সাধারণ নিম্নবর্গীয় মানুষের প্রতি ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতিকদের হৃদয়-গভীরে লালিত গোপন ঘৃণা ও অবজ্ঞা। অথচ বক্তৃতা-বিবৃতি ও প্রকাশ্য আচরণে প্রতিনিয়ত তারা মমতার খই ফোটায় সাধারণের প্রতি।
২.২.১. ‘ডিগবাজি’র মতো আরো তিনটি গল্পে (‘ভিন্ন পেশী অন্য তাপ’, ‘শরীরে শীত ও টেবিলে গুন্ডাপান্ডা’ এবং ‘সামান্য উপায়’) ব্যক্ত হয়েছে পেশিশক্তির উত্থানের কাহিনি। বখাটে-মাদকসেবীদের বিরুদ্ধে পুলিশি ব্যবস্থা সুফলদায়ক হয় না অথচ কমিশনার প্রার্থী মস্তানকে চাঁদা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেই বন্ধ হয়ে যায় বখাটে-উৎপাত। শিক্ষিত কমিশনার প্রার্থী ভোটের জন্য ভোটারদের বাড়ি বাড়ি গিয়েও সমর্থ হয় না শিক্ষিতজনদের মন জয়ে অথচ মস্তান-প্রার্থীর কাছে ভোটাররা নিজেরাই উপস্থিত হয় ভোটদানের প্রতিশ্রুতিসহ। প্রথম গল্পটিতে সমাজে শক্তিধর মস্তানদের এই দাপটের বিবরণ তুলে ধরে লেখক উন্মোচন করেছেন আমাদের রাষ্ট্রীয় ও সমাজব্যবস্থার পচনশীল নীতিদুষ্ট বৈশিষ্ট্যকে। দ্বিতীয় গল্পটিতে অঙ্কিত হয়েছে এ-প্রক্রিয়ার আরো প্রলম্বিত রূপ। শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পিতা-মাতা-কন্যার কাছেও গুন্ডা নামে পরিচিত চাঁদাবাজ-বখাটে যুবক কীভাবে আদৃত হচ্ছে তার স্বরূপ বিশ্লেষণ করেছেন লেখক। শেষোক্ত গল্পে প্রতীকী পরিচর্যার মাধ্যমে সুস্পষ্ট করে তোলা হয়েছে অনৈতিক ক্ষয়িষ্ণু রাজনীতির গর্ভে সৃষ্ট এই পেশিশক্তির জনবিচ্ছিন্ন পরিণামকে। মুক্তিযুদ্ধোত্তরকালে রাজনীতির অসুস্থ ও নেতিবাচক ধারাটিই ক্রমশ শক্তি অর্জন করলে তা পরার্থপরতা কিংবা দেশপ্রেম বিসর্জন দিয়ে হয়ে ওঠে ব্যক্তি-স্বার্থপরায়ণ ও মেধার পরিবর্তে পেশিশক্তিনির্ভর। এসব গল্পে লেখক চিত্রিত করেছেন রাজনীতি ও সমাজের এই বিষাক্ত ও স্বার্থদুষ্ট পরিবেশকেই।
২.২.২. লেখকের বিশেষ চরমপন্থী বামধারার রাজনীতি-সচেতনতার দৃষ্টান্ত হিসেবে উল্লেখযোগ্য চারটি গল্পের তিনটিরই শিরোনাম ‘ছেঁড়া খোঁড়া জমি’; যা ১, ২ ও ৩ সংখ্যা দ্বারা পৃথকীকৃত। অন্য গল্পটির নাম ‘আমিই রমজান’। এদেশের বামপন্থী রাজনীতির সশস্ত্র বিপ্লবী ধারার অন্তর্কলহই এসব গল্পের মূল উপজীব্য। গল্পগুলোতে উন্মোচিত হয়েছে ক্রমশ বিভক্তিপরায়ণ উগ্রপন্থী বাম ধারার রাজনীতির জনবিচ্ছিন্নতা ও অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতার স্বরূপ। বাংলাদেশে গোপন রাজনৈতিক কর্মকান্ডে অভ্যস্ত এই ধারা শ্রেণিশত্রু নিধনের নামে রক্তাক্ত ও দুর্বল হয়েছে ভাঙন ও অন্তর্গত সংঘাতে। অনুমান করি, লেখক এই রাজনীতিকে অত্যন্ত নিকট থেকে পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ পেয়ে বিধৃত করতে সমর্থ হয়েছেন এর প্রকৃত বৈশিষ্ট্যকে। এসব প্রবণতার মধ্যে রয়েছে : কর্মস্থল হিসেবে গ্রামকে নির্বাচন, শ্রেণিশত্রু হিসেবে জোতদারদের চিহ্নিত করা, থানা লুট করে অস্ত্র আয়ত্ত করা, সর্বদা তাত্ত্বিক বিতর্কে নিয়োজিত থেকে ন্যায়ান্যায়রহিত যান্ত্রিক যুক্তিতে আচ্ছন্ন থাকা, প্রতিনিয়ত দল ভাঙা, অভ্যন্তরীণ বিভেদ ও সংহারপ্রবণতা, সেইসঙ্গে ইনারকিলিং প্রভৃতি। জনস্বার্থ পূরণে সীমাহীন ব্যর্থতা ও জোতদারবিরোধী অভিযানের নিষ্ফলতা এ-গল্পগুলোতে চিত্রিত হওয়ার মাধ্যমে পরিস্ফুটিত হয়েছে বাম রাজনীতির এ-ধারাটির অপরিসীম সংকীর্ণ দৃষ্টি ও অন্তঃসারশূন্যতা।
২.৩. ‘ছেঁড়া খোঁড়া জমি-৩’ গল্পে জোতদার কর্তৃক নিহত এক দিনমজুরের স্ত্রী যখন গোপন রাজনীতিতে সক্রিয় এক যুবকের কাছে প্রশ্ন রাখে, ওই ঘটনার প্রতিশোধ গ্রহণের প্রতিশ্রুতি পূরণে তারা কতদূর এগোল, তখন সদুত্তর দিতে ব্যর্থ ও অনুশোচনায় দগ্ধ হয় ওই যুবক। অন্যদিকে ‘আমিই রমজান’ গল্পে দিনমজুর রমজান জোতদারের লালসা থেকে স্ত্রী-কন্যার সম্ভ্রম রক্ষায় ব্যর্থ হয়ে অবলম্বন করে এক উপায়হীন ও অবমাননাকাতর আত্মহত্যার পথ। গ্রামীণ পটভূমিতে জোতদারি শোষণ-জুলুমের কাছে কৃষক-দিনমজুরদের অসহায়ত্বের বিষয়টি বাংলাদেশের এক সাধারণ প্রবণতা। আমরা জানি, মানবতার লাঞ্ছনায় সংবেদনশীল লেখকমাত্রই অন্তর্গত সত্তায় রক্তাক্ত হয় আর তারই প্রতিফলন ঘটে নিজ সৃষ্টিকর্মে। এভাবেই লেখকের আরো দুটি গল্পে (‘কফিলউদ্দিনের কি হয়েছে?’ ও ‘জন্ম-সাঁতার’) উপস্থাপিত হতে দেখি জোতদারি শোষণ-জুলুমের বিবরণ। প্রথম গল্পটিতে জোতদার-চেয়ারম্যানের অন্যায় জুলুমের নির্মম শিকার দিনমজুর আরজ আলীর কিশোরপুত্র কফিলউদ্দিন এর প্রতিকারার্থে গুলতির অব্যর্থ আক্রমণে চেয়ারম্যানের এক চোখ নষ্ট করে দিতে সমর্থ হলেও পরিণামে নিঃস্ব ও ভিটেচ্যুত হয় তাদের সমগ্র পরিবার। অন্যদিকে কফিলউদ্দিনের পরিণতি অনির্দেশ্য। ‘জন্ম-সাঁতার’ গল্পে এক দিনমজুর রাতভর তার মালিকের জন্য মৎস্য শিকারের ব্যর্থ চেষ্টায় নিয়োজিত হয় প্রতিফলের কোনো আশা ছাড়াই। শ্রমের উপযুক্ত মূল্য থেকে বঞ্চিত হওয়ার পাশাপাশি বিনামূল্যে কত শ্রম যে প্রতিনিয়ত নিয়োগ করতে হয় অসহায় দিনমজুরদের সেই প্রতিকারহীন সত্যটি মূর্ত হয়ে উঠেছে এ-গল্পে।
২.৪. বিশ্বের সব প্রান্তেরই একটি লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য হলো, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নানারকম পীড়ন-ভোগ। বর্ণগত, ধর্মগত কিংবা জাতিগত সব ধরনের সংখ্যালঘুদের ক্ষেত্রেই এ-কথা সত্য। আর এ পীড়ন হতে পারে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক কিংবা মনস্তাত্ত্বিক। মুক্তিযুদ্ধ ও যুদ্ধোত্তর সংকটের আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে ‘একাকার’ ও ‘নিজস্ব মেদিনী’ শীর্ষক দুটি গল্প। এ ছাড়া আরো তিনটি গল্পে (‘তৃতীয় ঘটনা’, ‘শূদ্রের ঘাড়’ ও ‘এক মতুয়ার হোববোল’) রূপায়িত হয়েছে সংখ্যালঘুদের মনস্তত্ত্ব। ‘একাকার’ গল্পে পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণ থেকে বাঁচাতে এক মুসলিম পরিবার এক হিন্দু বৃদ্ধাকে আশ্রয় দিলেও দিনভর অব্যাহত থাকে ওই গৃহে অন্নজল গ্রহণে বৃদ্ধার সংস্কারগত বাধা। অথচ বৃদ্ধার সম্পত্তি রক্ষা করতে গিয়ে নিহত হয় ওই পরিবারের এক তরুণ। এদিকে বৃদ্ধাকে আশ্রয় দেওয়ার কারণে নিজের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করার অপরিণামদর্শিতা সম্পর্কে ওই পরিবারের কর্তাব্যক্তিকে সাবধান করে দেয় মুসলিম সম্প্রদায়ের কয়েকজন। ‘নিজস্ব মেদিনী’তে একটি সংখ্যালঘু পরিবার অন্তর্গত সত্তায় অনুভব করে এদেশে তাদের নিরাপত্তার অনিশ্চয়তা। গোপনে দেশত্যাগের সিদ্ধান্ত নিতে চাইলে পরিবারের এক তরুণের মধ্যে জাগ্রত হয় দেশাত্মবোধ। অথচ পুরো পরিবারের মনে হয়, ওই তরুণের দেশপ্রীতির আবেগ তাদের সকলের জন্য ডেকে আনবে সমূহ সর্বনাশ। ‘তৃতীয় ঘটনা’ গল্পে শ্রীপতি নামে শহরের এক মধ্যবিত্ত চাকুরে প্রথমত ছিনতাইয়ের কবলে পড়লে, দ্বিতীয়ত তার পুত্র পাকিস্তানি ক্রিকেট দলকে সমর্থন না-করায় খেলার বন্ধুদের দ্বারা হিন্দু বলে বিতাড়িত হলে এবং তৃতীয়ত, বাবু সম্বোধনসহ বাড়িওয়ালা তার স্ত্রীকে কপালে লাল ফোঁটা দিতে বারণ করার পরামর্শ দিলে মনোজগতে প্রত্যক্ষ করে এক বিরূপ বিশ্ব এবং হয়ে পড়ে বিপুলভাবে শক্তিহীন ও অসহায়। ‘শূদ্রের ঘাড়’ ও ‘এক মতুয়ার হোববোল’ গল্পদ্বয়ে মূলত চিত্রিত হয়েছে নিজ সম্প্রদায়ের অভ্যন্তরীণ সংকটের বিচিত্র রূপ। এই সংকটটি বর্ণগত ও জাতপাতসংক্রান্ত বৈষম্য-উৎসারিত। কিন্তু ওপরের তিনটি গল্পে সংখ্যাগুরুর আচরণের পরিপ্রেক্ষিতে সংখ্যালঘুর মনে নিরাপত্তাহীনতার যে বোধ সঞ্চারিত হয়েছে তা এদেশের সামগ্রিক বাস্তবতারই এক বিশ্বস্ত চিত্র।
২.৫. এ সমাজে পুরুষ-আধিপত্য অবহেলা ও বঞ্চনার শিকার হতে বাধ্য করেছে নারীকুলকে। এই আধিপত্যের কাছে নারী অসহায় ও নিরাপত্তাহীনতায় জর্জরিত। এরূপ বাস্তবতার কারণেই এদেশের নারীসমাজের মধ্যে গড়ে উঠেছে এক বিশেষ মনস্তত্ত্ব। ‘বাবার গ্লানি’, ‘বুয়ার তিনদিন’, ‘শব্দ-নৈঃশব্দ্য’, ‘লতাপাতার ফাঁস’, ‘এক মতুয়ার হোববোল’ প্রভৃতি গল্পে ব্যক্ত হয়েছে এই মনস্তত্ত্বের বিচিত্র পরিচয়। ‘বাবার গ্লানি’ গল্পে বসন্ত রোগে আক্রান্ত দুই পুত্রের সেবা-যত্নসহ গৃহস্থ-কর্মের সমগ্র দায়িত্ব মায়ের ওপর ন্যস্ত করে পিতা রোগটির সংক্রামকতার কথা বিবেচনা করে নিজেকে রাখে স্পর্শমুক্ত। রোগাক্রান্ত হওয়ার যে-ভয় পিতার মধ্যে সঞ্চারিত তা একইভাবে মাতার মধ্যে প্রবেশ করলে চিকিৎসা ও সেবার অভাবে সন্তানদের মৃত্যু ছিল অবধারিত – এ বিবেচনায় কাতর হয় না পিতৃমন। পিতার এই দূরত্ব রক্ষার মধ্যে যে কত বড়ো স্বার্থপরতা, অমানবিকতা ও দায়িত্বহীনতা জড়িত তা উপলব্ধি করা যায় গল্পপাঠে। কিন্তু সমাজে পুরুষের আধিপত্য স্বাভাবিক বলে গ্রহণ করেছে এমন স্বার্থপরতাকে। বলা বাহুল্য, দৈনন্দিন সংসার-পরিচালনায় পুরুষের ঔদাসীন্য নারীর জন্য বয়ে নিয়ে এসেছে তার দায়িত্ব পালনের অতিরিক্ত কিছু মানসিক চাপ, যার মধ্যে একাকিত্ববোধ অন্যতম। ‘লতাপাতার ফাঁস’ গল্পে গ্রামীণ পটভূমিতে অঙ্কিত হয়েছে অসহায় নিম্নবর্গীয় এক নারীর দুর্দশাকাতর জীবনচিত্র। পুরুষতন্ত্রের পীড়ন, সংসার-ঔদাসীন্য প্রভৃতির শিকার ওই নারী তার অস্তিত্ব রক্ষা করে গ্রাম থেকে আহৃত শাকসবজি শহরে নিয়ে বিক্রির মাধ্যমে। শুধু তাই নয়, স্বামীর দ্বিতীয় স্ত্রী ও সন্তানের দায়িত্বও অর্পিত হয় তার ওপর। সপত্নী ও তার সন্তানকে পুরুষতন্ত্রের পীড়ন থেকে রক্ষার ব্যাপারে তার ভূমিকা সহমর্মিতামূলক। এক অশিক্ষিত কর্মজীবী নারীর মহত্ত্বও কতটা উচ্চতর পর্যায়ে উন্নীত হতে পারে এ-গল্প তার প্রমাণ। অপরপক্ষে এ-গল্পে অঙ্কিত দুই পুরুষ-চরিত্রই স্বার্থপরতা ও দায়িত্বহীনতায় সমগোত্রীয়। ‘বুয়ার তিনদিন’ গল্পে চিত্রিত হয়েছে এক শহরের গৃহপরিচারিকার চৌর্যবৃত্তি, অপচয়মূলক মানসিকতা, অনিয়ম, কর্মে অবহেলা ও লোক-দেখানো চাতুর্যপূর্ণ কর্তব্যপরায়ণতার রূপ। এ-ধরনের নিম্নবর্গীয় চরিত্রকে তার নিজ ভাষা ও সক্রিয়তার স্বকীয় ভঙ্গিসহ উপস্থাপনে লেখক দেখিয়েছেন অসামান্য কুশলতা। মাত্র তিনদিনের চাকরিকালে সংঘটিত মাত্রাহীন অঘটনের পরিণামে যখন সে আকস্মিকভাবে কর্মচ্যুতির নোটিশ পায় তখন তার প্রতিক্রিয়াটি তাৎপর্যপূর্ণ। দ্রুত সে সামলে নেয় হঠাৎ-বিদায়ের আলোড়ন; এবং প্রত্যুত্তরের কণ্ঠটি তার হয়ে ওঠে নিরুত্তেজ, অসহায় অথচ আক্রমণাত্মক : ‘মোগো ঘর থাকপো ক্যান।’ …‘মোরাতো বাইরের মাগী-উগী। ঘরে ঘরে কাম করনে মোগো পয়দা।’ …‘তয়, আপনেরা যে নিজেত ঘরেতে বুয়ার নাহান এইডা বোঝপার পারেন না।’
‘এক মতুয়ার হোববোল’ গল্পে অঙ্কিত হয়েছে দুরারোগ্য ব্যাধির শিকার এক নারীর স্বামী কর্তৃক চরম অবহেলার চিত্র। এই অবজ্ঞার মূলে সক্রিয় পুরুষতন্ত্র, জাতপাতবৈষম্য ও অসুস্থতাজনিত নারীর অসহায়তা। গ্রামীণ পটভূমিতে রচিত এ-গল্পে চিত্রিত হয়েছে শ্বশুরালয় থেকে যৌতুকলাভে আগ্রহী, অথচ গান-বাজনায় বিভোর আপাত-উদাসীন এক পুরুষের নির্বিকারভাবে দ্বিতীয় স্ত্রী গ্রহণের এমন এক উদ্ভট বৈসাদৃশ্যপূর্ণ সাংস্কৃতিক অভিরুচি যা নারীর জন্য সৃষ্টি করে না কোনো মুক্ত-উদার পরিবেশ।
অন্যদিকে ‘শব্দ-নৈঃশব্দ্য’ গল্পে শহুরে পটভূমিতে পরিবেশিত হয়েছে একান্নবর্তী ও একক পরিবার-কাঠামোয় এক গৃহবধূর মনোযন্ত্রণার বিপরীত চিত্র। শব্দময় একান্নবর্তিতায় অন্য বধূদের সঙ্গে ঈর্ষা-হিংসাজর্জর কলহ-বিবাদপূর্ণ জীবন থেকে একক পরিবার বিন্যাসে গিয়ে সায়রা নামে গৃহবধূটি প্রথমে বিভোর হয় এক স্বস্তিময় উল্লাসে। কিন্তু এই নতুন জীবনের নৈঃসঙ্গ্য ও নৈঃশব্দ্য অচিরেই তার অবচেতনকে করে তোলে বিপরীতমুখী অস্থিরতায় আকুল।
২.৬. কতকগুলো গল্পে লেখকের জীবনবোধ উচ্চকিত হয়ে ওঠে মানবিক প্রেরণায়। রেনেসাঁ-উত্তর আধুনিককাল মানুষের জীবনদৃষ্টিতে এনেছে যে ইহজাগতিকতা ও মানবসর্বস্বতা তারই প্রতিফলনে তাৎপর্যদীপ্ত এসব গল্প : ‘এক জোড়া মোজা’, ‘সরল সত্য’, ‘রক্তমাংস’ ও ‘শূদ্রের ঘাড়’। অন্যদিকে মানুষের গাত্রবর্ণ, ধর্ম-বর্ণ, অর্থ ও ক্ষমতার দাপট প্রতিনিয়ত মানবতার অবমাননায় যে-ভূমিকা রাখছে, লেখক দেখিয়েছেন তার অন্তঃসারশূন্যতাকে। প্রথম গল্পটিতে উন্মোচিত হয়েছে অধস্তনের ঘৃণামিশ্রিত অবজ্ঞা। কিন্তু অবজ্ঞার মূলে সক্রিয় যে নাগরিক রুচি তা কর্তাব্যক্তির নিজের দ্বারাই ভূলুণ্ঠিত হওয়ার তথ্যটি গল্পের শেষে নাটকীয়ভাবে পরিবেশিত হলে মুহূর্তে খসে পড়ে শিক্ষিতজনদের সৌন্দর্যবোধের বাহ্যিক আবরণটি। ক্ষমতার আধিপত্য কীভাবে মানুষের দ্বারা মানুষের অবমাননাকে নিশ্চিত করে তোলে তার উদাহরণ হিসেবে এ-গল্পটি গুরুত্ববহ। এ-গল্পে আরো লক্ষণীয় যে, মানবিকতা ক্ষমতাকেন্দ্রিক নয়, তার প্রকৃত অধিষ্ঠান ক্ষমতাহীন নিম্নবর্গের জীবনবিন্যাসে। ‘সরল সত্য’ গল্পে মুখ্য হয়ে উঠেছে পুত্র ও পুত্রবধূ কর্তৃক বিতাড়িত আশ্রয়চ্যুত এক অসহায় বৃদ্ধের জীবনযন্ত্রণার মর্মবাণী। এক বৃষ্টিমুখর দিনে কোনো ধনশালীর বারান্দাও এই অপরিচ্ছন্ন ও ক্ষুধার্ত বৃদ্ধের জন্য যোগ্য বিবেচিত হয় না সাময়িক আশ্রয় হিসেবে। আশ্রয়চ্যুতির হুমকি আসে বারবার। নিরুপায় বৃদ্ধের জন্য সৃষ্টি হয় আতঙ্কজনক পরিবেশ। বিপন্ন হয় মানবিকতা। ‘শূদ্রের ঘাড়’ গল্পে মুমূর্ষু ব্রাহ্মণের দুই পুত্র পিতৃসম্পত্তির অধিকার নিয়ে কলহে লিপ্ত হলে মৃত ব্রাহ্মণের শবদেহ বহনে এগিয়ে আসে অস্পৃশ্য শূদ্র। ব্রাহ্মণের উচ্চম্মন্যতার মধ্যে উচ্চকিত হতে পারে না মানবিকতা, তা শেষ পর্যন্ত আশ্রয় করে চিরকাল পতিত ও দলিত নিম্নবর্গের শূদ্রশ্রেণির অবহেলিত জীবনধারাকে।
এ-পর্যায়ের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য গল্প ‘রক্তমাংস’। এ-গল্পে পাশাপাশি বিন্যস্ত দুই কালের দুই কাহিনির মধ্য দিয়ে প্রতীকী ব্যঞ্জনায় মূলত উদ্ভাসিত হয়েছে মানুষের বৈষম্য ও বিভেদমুক্ত একত্ববোধের বাণী। একটি কাহিনি সুদূর প্রাচীনকালের – আর্য-দ্রাবিড়ের বর্বর সংঘাতময় পরিবেশের। আর্যদের দ্বারা অন্যায় ও নির্মমভাবে হত্যার শিকার দ্রাবিড়ের শরীরেও যখন তারা দেখতে পায় তাদের মতোই লাল রঙের রক্ত ও মাংস তখন চমকিত হয় বিস্ময়বোধে। অন্যদিকে এ-কালে মানবিকবোধে উজ্জীবিত হয়ে গল্পের উত্তম পুরুষ কথক-চরিত্র একদা হাসপাতালে রক্তদানে বাঁচিয়ে তোলে এক অপরিচিত বধূকে। এর অনেককাল পরে কৃষ্ণবর্ণের রক্তদাতার সঙ্গে পরিচয় ঘটলে ওই শ্বেতশুভ্র বধূর কণ্ঠ থেকে কৃতজ্ঞতার পরিবর্তে প্রকাশিত হয় ঘৃণা : ‘কী বিদঘুটে কালো, এর রক্ত! আমার গা ঘিনঘিন করছে।’ সমগ্র পৃথিবীর মনুষ্য প্রজাতির শরীরে একই রঙের রক্ত বহমান অথচ মানুষই মানুষের মধ্যে সৃষ্টি করেছে বিভেদের নানা প্রাচীর, যা সুপ্রাচীনকাল থেকে আজো বর্তমান। ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, জাতি, অর্থ-সম্পদ, শিক্ষা ও সংস্কৃতির নামে মানুষের মধ্যে সৃষ্ট বৈষম্য সর্বকালে নানা অমানবিক কার্যক্রমেরও উৎস। লেখক এ-গল্পের মর্মমূলে বাঁচিয়ে রাখেন একটি আকাঙ্ক্ষাকে, যার মূলকথা : বহির্জাগতিক বৈষম্যকে ছিন্নভিন্ন করে অন্তর্লোকের সৌন্দর্যকে অনুধাবনের মধ্যেই নিহিত সর্বজনীন কল্যাণ ও মহত্ত্ব।

৩.১. ভাষাবিষয়ক সচেতনতা একজন কথাশিল্পীর কাছে অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ। বৈচিত্র্যময় চরিত্র-সৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে তাদের পরিপার্শ্ব ও মনোলোকের উপযোগী ভাষা নির্মাণেও একজন লেখককে হতে হয় দক্ষ এবং সমাজ ও জীবন সম্পর্কে সূক্ষ্মভাবে অনুসন্ধিৎসু। ভাষার মাধ্যমে প্রকাশিত হয় চরিত্রের অন্তর্জগৎ, তার জীবনবীক্ষা ও সাংস্কৃতিক অভিরুচি। সুতরাং চরিত্রকে তার যথার্থ শ্রেণি-স্তর ও ভাব-পরিমন্ডলে উপস্থাপন করতে হলে ভাষার বিভিন্নতা সৃষ্টিসহ সহায়তা অনিবার্য। লেখকের ও চরিত্রের ভাষার মধ্যে একটা ব্যবধান সৃষ্টির ব্যাপারেও সচেতন থাকতে হয় কথাশিল্পীকে। লেখক ও তাঁর সৃষ্ট একাধিক চরিত্র যখন ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় কথা বলেন তখন যে বহুস্বরিকতা সৃষ্টি হয়, তা হয়ে ওঠে ওই রচনাকে সার্থক করে তোলার অন্যতম পূর্বশর্ত।
কথাশিল্পে ভাষা ব্যবহারের এই তাৎপর্য সম্পর্কে সুশান্ত মজুমদার সচেতন। চরিত্রের সংলাপ সৃষ্টি কিংবা তার মনোজগৎ উন্মোচনের ক্ষেত্রে লেখক সর্বদা সতর্ক থাকেন তার সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিপ্রেক্ষিত সম্পর্কে। এ-কারণেই পার্থক্য সূচিত হয় গৃহকর্ত্রী ও গৃহপরিচারিকার ভাষাভঙ্গিতে, জোতদার ও দিনমজুরের আচরণে, শিক্ষিত গৃহকর্তা ও গৃহবধূর মনোভাব প্রকাশে। এ দুয়ের সামাজিক স্তরগত ব্যবধান মাপকাঠি হয়ে ওঠে শব্দচয়ন, আঞ্চলিক ভঙ্গি ও উচ্চারণগত শুদ্ধতা-অশুদ্ধতারও। লেখক বিস্মৃত হন না গ্রামীণ ও শহুরে পটভূমির বিভেদরেখাটি। ফলে অনিবার্য হয়ে ওঠে উপভাষার ব্যবহার। ‘একাকার’, ‘ভেগল’, ‘আমিই রমজান’ প্রভৃতি গল্পে দক্ষিণবঙ্গের আঞ্চলিক ভাষা, ‘মুন্ডু মুখোশে’ পুরনো ঢাকার উপভাষা এবং ‘বিদেশী বুট’ গল্পে উর্দু ভাষার ব্যবহারে লেখকের দক্ষতা অনস্বীকার্য। কয়েকটি উদাহরণ নিম্নরূপ :
ক. ‘আমি কি করিছিরে? কারো সাতেপাঁচে গেছি। শুধু ভোটডা দিছিলাম। তাও ছ্যামরারা চ্যাংদোলা করে ধরে নিয়ে গিছিলো। না হলি কি ভিড়ের মধ্যি গুঁতো-গাতা খাতি যাই?’ (‘একাকার’)
খ. ‘ম্যাভাই, তুমি আবার আইছো? পাবা নানে। এরা এহন গান্ধি চোসা ধান। আর টাকাডা পাবা কি কইরে?’ (‘ভেগল’)
গ. ‘আগেই ভি আন্দাজ করছি, জোসনা বহুত বদ হইয়া গ্যাছে গ্যা।’… ‘তুর কি ইজ্জত? তুর মাহমুদের ঠ্যাং-এর ভি দাম নাইক্কা। হালা, ও ভি লেখ্যাপড়া আদমি, নেতা-উতা আছে।’ (‘মুন্ডু মুখোশ’)
ঘ. ‘ইয়ে উজবুক কেহা কররাহা হ্যায়। ঝটপট কাম খতম কারো।’ (‘বিদেশী বুট’)
৩.২. চরিত্র-উপযোগী ভাষা ব্যবহারের পাশাপাশি লেখক গল্পের বর্ণনা ও বিবরণকে সজীব ও অব্যর্থ করার লক্ষ্যে আশ্রয় নিয়েছেন বিশেষণের। এসব বিশেষণ চয়ন তাঁর গল্পকে করেছে বিশেষ মাত্রাবোধক। কেননা তিনি বারবারই অতিক্রম করে গেছেন প্রচলিত কাঠামোর পরিসীমা। এবং স্বীকার্য যে, এক্ষেত্রে লেখক আয়ত্ত করেছেন বিশেষণ প্রয়োগের একটা স্বকীয় ধরন বা ভাষা; যা তাঁর জীবনের একান্ত অভিজ্ঞতা-উৎসারিত বা পর্যবেক্ষণমূলক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচায়ক। কতকগুলো উদাহরণ নিম্নরূপ :
‘মাংস পচা ঘন একটা গন্ধ’ (‘এক জোড়া মোজা’)
‘নেকড়ে পুরুষের ফাজিল গলা’, ‘ভুষো কালির জোয়ান’ বা ‘দুধনাদুস দেহ’ (‘অনিবার্য’)
‘নিরীহ জ্যোৎস্না’ (‘ছেঁড়া খোঁড়া জমি-২’)
‘আকন্দ রসের মতো সাদা ও ফিনফিনে সুখী, শোভন, সহজ মহিলা’ (‘রক্তমাংস’)
‘কুড়ুলমারা কাশি’, ‘ফুটন্ত আফসোস’, ‘জ্ঞান-শূন্য রাগ’ বা ‘অাঁচ-মরা উনুন’ (‘ভেগল’)
‘বড় বড় কাঁঠালের কোয়া সাইজের চোখজোড়া’ (‘মুন্ডু মুখোশ’)
‘নিরুত্তেজ’, ‘ঢেউ খলবলশূন্য তাঁর গলা’ (‘বুয়ার তিনদিন’)
এসব উদাহরণে পরিস্ফুটিত হয়েছে লেখকের সৃজনশীলতার স্বকীয় আবেগ, নিগূঢ়ভাবে জীবন-অনুসন্ধানের সংবেদনময় আগ্রহ। গ্রামীণ জীবনধারা ও তার নিসর্গকে ষষ্ঠেন্দ্রিয় দ্বারা অনুভবের প্রয়াসে বিশেষণগুলো হয়ে উঠেছে অর্থদ্যোতনাময়।
৩.৩. বিশেষণ প্রয়োগের মতো উপমা সৃষ্টির ক্ষেত্রেও সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে লেখকের স্বাতন্ত্র্যের পরিচয়। উপমার সৃষ্টিশীল প্রয়োগে ভাষা হয়ে উঠেছে অলংকৃত ও ব্যঞ্জনাদীপ্ত। উপমার-উৎস চয়নের ক্ষেত্রেও জীবনাভিজ্ঞতাকেই অধিকতর গুরুত্ব দিয়েছেন লেখক। পরিহার করেছেন প্রথা অনুসরণের ধারা। তিনি আমাদের বোধের আওতায় প্রাণবন্ত করে তুলেছেন গ্রামজীবন ও পল্লী-প্রকৃতির নির্যাসকে। যেমন –
‘পোনা মাছের মতো মানুষের ঝাঁক’। (‘অনিবার্য’)
‘বেজির লেজের মতো পুষ্ট গোঁফ’। (ওই)
‘গলা ছিলানো মোরগের মতো ধবধবে চামড়া’। (ওই)
‘ফড়াৎ করে কাপড় ছেঁড়ার মতো আওয়াজ ওঠে মরিয়মের গলায়’। (‘একাকার’)
‘ফুটি-ফাটা মাঠ চিরে আসা অবাধ্য বাতাসের মতো দীর্ঘশ্বাস’। (‘বিদেশী বুট’)
‘পুরনো বিস্কুটের মতো ভেঙে যেতে থাকে ধুলোয় জমা ছবিগুলো’। (‘শরিক’)
‘জবরদস্ত এক ফন্দি তাঁর ঘিলুর ওপর জিয়ল গাছের আঠার মতো সেঁটে যায়’। (‘শরিক’)
‘ঠেলা দিতে কপাট দুটো সরে আত্মীয়ের মতো পথ করে দেয়’। (‘ছেঁড়া খোঁড়া জমি-১’)
‘মানুষের গালের মতো নরম পুরনো জুতো’। (‘ছেঁড়া খোঁড়া জমি-৩’)
‘কাঁকরোলের কাঁটার মতো তাঁর মুখময় দাড়ি’। (ওই)
‘ধানী লংকার মতো মেজাজ’। (‘প্রতিপক্ষ’)
‘গরম খইয়ের মতো ফুটতে থাকা এক মুক্তিযোদ্ধা পাখি পড়ানোর মতো করে বিভিন্ন বৃত্তান্ত মন্টুকে বুঝিয়ে দিতে থাকে’। (‘রাজা আসেনি বাদ্য বাজাও’)
‘চোখজোড়া দেয়াল লাগোয়া বাঁধাছাঁদা সংসার সামগ্রীর উপর ঘাসফড়িংয়ের মতো লাফিয়ে লাফিয়ে বসতে থাকে’। (‘রক্তমাংস’)
‘তৎক্ষণাৎ পাকা মরিচের মতো সে লাল হয়’। (ওই)
‘জালালের ওপর কুতুবের ক্রোধ সদ্য জ্বরো রুগীর গা গরমের মতো লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ে যেতে থাকে’। (‘ভেগল’)
‘আকাশে ঘষা পয়সার মতো চাঁদ’। (‘আমিই রমজান’)
‘শান্তনু ও সুদীপ্তর রোগা চেহারা হয় বুড়ো ক্ষয়াটে পুরনো দেয়ালের মতো খরখরে’। (‘বাবার গ্লানি’)
‘বাইরে থেকে দেখলে তাঁর স্ত্রীকে মনে হবে এক পাকা আতা, এই বুঝি পড়ে ঠাস করে ফেটে যাবে’। (ওই)
‘দারুণ তেষ্টায় তার গলা মাড় দেয়া কাপড়ের মতো খসখসে এখন’। (ওই)
‘পোনা মাছের ঝাঁক’, ‘বেজির লেজ’, ‘গলা-ছিলা মোরগ’, ‘মাঠের অবাধ্য বাতাস’, ‘জিয়ল গাছের আঠা’, ‘ধানী লংকা’, ‘গরম খই ফোটা’, ‘ঘাসফড়িং’, ‘পাকা মরিচ’, ‘গাছ-পাকা আতা’ প্রভৃতি উপমার-উৎস চয়নে লেখকের গ্রাম-জীবনাভিজ্ঞতার সারাৎসারই স্পষ্ট হয়ে ওঠে আমাদের উপলব্ধিতে। আর কিছু উপমার-উৎস প্রয়োগে অভিব্যক্ত হয় লেখকের সূক্ষ্ম অনুভূতির অন্তর্বয়ন। যেমন : ‘কাপড়-ছেঁড়ার ফড়াৎ শব্দ’, ‘পুরনো বিস্কুটের ভেঙে-যাওয়া’, ‘আত্মীয়সুলভ সরে-যাওয়া কপাট’, ‘সদ্য-জ্বরাক্রান্ত রোগীর দ্রুত বৃদ্ধিশীল তাপমাত্রা’, ‘ঘষা-পয়সা’, ‘বুড়ো ক্ষয়াটে বাড়ির প্রাচীন দেয়াল’, ‘মাড় দেয়া খসখসে কাপড়’ প্রভৃতি। তবে উপমার-উৎস চয়নই এখানে বড়ো কথা নয়, আমরা লক্ষ করি উপমেয়র সঙ্গে অব্যর্থ সাদৃশ্য স্থাপনেই নিশ্চিত হয়েছে লেখকের সার্থকতা।
৩.৪. ভাষা নির্মাণের ক্ষেত্রে লেখকের দক্ষতা সর্বাধিক উচ্চতা অর্জন করে মনোবাস্তবতার চিত্র-উপস্থাপনে। কাহিনিবিন্যাসের ক্ষেত্রে বহির্বাস্তবতার চিত্র-নির্মাণের পরিবর্তে লেখক যেহেতু অধিকতর মনোযোগী চরিত্রের অন্তর্জগতের রহস্য উন্মোচনে, সেহেতু তাকে আশ্রয় নিতে হয়েছে এর উপযোগী ভাষাশৈলীর। আমরা সরাসরি দেখতে পাই বহির্জগতের চিত্র, এবং তার বিবরণের উপযুক্ত ভাষা ঐতিহ্যগতভাবে আমাদের আয়ত্ত। কিন্তু আমরা চোখে দেখি না মনোজগতের চিন্তনক্রিয়া, কল্পনাপ্রবাহ বা স্মৃতিময়তাকে, সুতরাং একে সম্পূর্ণভাবে উপলব্ধি করতে হয় কল্পনাসহযোগে। এবং পাঠকের বোধের কাছে লেখকের এই উপলব্ধিকে চিত্রময় করে তোলার জন্য বিশেষভাবে আশ্রয় নিতে হয় এক নতুনতর পরিচর্যা রীতির। কিন্তু সহজসাধ্য নয় মনোবাস্তবতার চিত্রাত্মক পরিচর্যা রচনা। এজন্যে প্রয়োজন কল্পনার বিপুল বিস্তার ঘটানো; যার পরিচয় মিলবে নিম্নোক্ত উদাহরণসমূহে :
‘এই বিস্ময় জিজ্ঞাসা যোগে বৃষ্টির পানির মতো চুইয়ে চুইয়ে এসে করোটির তলে চলাচল করে।’ (‘রক্তমাংস’)
‘সাদা, তেমন জোরালো সাদা নয়, পোশাক পরা এক মানুষ যাত্রীদের টিকিট চেক করেন। ট্রেন ফুঁড়ে সাদা মানুষটি ক্রমশ দীর্ঘ হতে থাকেন, আর ট্রেনযাত্রীরা যেনবা খর্বকায়।’ (ওই)
‘কথাগুলো যেন গড়িয়ে পড়তে পড়তে ভেঙে চূর্ণ হয়, আর তা বালির মতো কিচকিচ করে।’ (‘নিজস্ব মেদিনী’)
‘নীরবতা দইয়ের মতো জমে যেতে থাকে।’ (ওই)
‘প্রতি ঘটনার পাশে পাশে বিল্লাহ পরিষ্কার যেন দেখতে পায়, তাঁর দুই দাদা শ্বশুর, শ্বশুর, তাঁর ছেলেপেলেরা একযোগে তাঁকে কিড়িমিড়ি পাথুরে চোয়ালে, সার্চলাইট নজরে, মাথা থেকে পা পর্যন্ত দেখছে। দেখে দেখে তাঁর ভিতরের তাবৎ কাদা-মাটি-বালি-পচা গাদ-পানি সব বের করে আনছে।’ (‘মুন্ডু মুখোশ’)
‘রাত হলে যত সমস্যা, আলো জ্বলা শোয়ার ঘরে বাদ বাকি ঘরের অন্ধকার গুলির শব্দে যেন হুড়মুড় ঢুকে পড়ে।’ (ওই)
‘বুয়ার নোনা ধরা এই কষ্ট যেন ফ্লোরে ছড়িয়ে পড়ে এবং তা বিলি কেটে কেটে সেলিনার বুকে উঠে আসে।’ (‘বুয়ার তিনদিন’)
‘শ্বশুরের সেই পুরনো স্মৃতি পুরনো কাঠের তোরঙ্গ থেকে পুরনো কাপড় বের করে রোদে দেওয়ার মতো করে সায়রা সাজিয়ে-গুছিয়ে নিয়েছে।’ (‘শব্দ-নৈঃশব্দ্য’)
‘তিন-চার মাস যেতে না যেতেই সব সুখের ওপর চর পড়তে থাকে।’ (ওই)
কল্পনাকে বিস্তৃত করে তোলার পাশাপাশি এসব দৃষ্টান্ত আমরা লক্ষ করি, অনুভূতি, চিন্তা ও স্মৃতির বিমূর্ততাকে মূর্ত করে তোলার অভিপ্রায়ে লেখক মনোজগতে অনুপ্রবেশ ঘটান বহির্জগতের কোনো চিত্রকে। করোটির তলে বৃষ্টির পানির মতো বিস্ময়ের চুঁইয়ে পড়া, কথার গড়িয়ে পড়ে ভেঙে যাওয়া বা বালির মতো কিচকিচ করা, দইয়ের মতো নীরবতার জমে যাওয়া, আলোকিত ঘরে অন্ধকারের হুড়মুড় ঢুকে-পড়া, সুখের ওপর চর-পড়া প্রভৃতি পরিচর্যায় স্পষ্ট হয় বিমূর্ত অনুভূতির ওপর প্রাণারোপের প্রয়াস। প্রচন্ড দুঃখ-বেদনা-যন্ত্রণায় মথিত হৃদয়কে অনুভূতিগ্রাহ্য করে তোলার লক্ষ্যে চলচ্চিত্রে আমরা ব্যবহৃত হতে দেখি উত্তাল সমুদ্র-তরঙ্গমালার চিত্রাত্মক পরিচর্যা। লেখকও চরিত্রের অন্তর্বাস্তবতা উন্মোচনে গ্রহণ করেছেন অনুরূপ চলচ্চিত্রিক পরিচর্যা কৌশলের। আমরা যেমন বাস্তবে মাটি খুঁড়লে সেখান থেকে উঠে আসে কাদা-মাটি-বালি-পচা গাদ-পানি তেমনি লেখকও বিল্লাহ-চরিত্রের হৃদয় খুঁড়ে তার অচেতন-অবচেতনলোকের যত গভীরে যাচ্ছেন সেখান থেকে ততই যেন উঠে আসছে স্মৃতির ওইসব গাদ। মনোজাগতিক চিত্র-নির্মাণে লেখকের এই সৃজনশীল দক্ষতা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়।

৪. সুশান্ত মজুমদারের ছোটগল্পে মূর্ত হয়ে উঠেছে শৈলীগত সৌন্দর্য সৃষ্টির আগ্রহ। উপরন্তু বিষয়ভাবনার সঙ্গে শৈলীচিন্তার সমন্বয় সাধনের ক্ষেত্রেও লেখকের দক্ষতা সার্থকতামন্ডিত। একথা ঠিক, বিষয়গত বৈভবকে তিনি লুকিয়ে রাখেন গল্পের সুসমঞ্জস অলংকারময় অবয়বের অভ্যন্তরে। এবং শুধু বিষয়ের জৌলুস দিয়ে তিনি দ্যুতিময় করতে চান না গল্প-শরীরকে। কিন্তু লেখকের রাজনীতি ও সমাজসচেতনতা, সমকাল-সতর্কতা, জাতীয় সংকটের স্বরূপ উপলব্ধি, সংস্কারমুক্ত উদারনৈতিকতা, ইহজাগতিকতা, নিম্নবর্গের প্রতি পক্ষপাত ও মানবকল্যাণ স্পৃহা প্রভৃতি সমৃদ্ধ ও পরিপুষ্ট করেছে তাঁর বিষয়চিন্তাকে। একই সঙ্গে বিশ শতকের আধুনিক মনস্তাত্ত্বিক আবিষ্কারের সঙ্গে নিবিড় পরিচয়সূত্রে গল্পের কাহিনি বিন্যাসে চেতনাপ্রবাহ রীতির অনুসরণ, তার উপযোগী ভাষা সৃষ্টি, সময় ও পরিসরের সংক্ষিপ্তিসাধন, নিরাসক্তি চেতনা, পরিমিতিবোধ, একমুখী গতি অব্যাহত রেখে গল্পকে সুসংহত করা প্রভৃতির যৌথ সমবায়ে লেখক গল্প-শরীরকে মন্ডিত করেছেন শিল্পসৌন্দর্যে। আর বিষয়বৈভব ও শৈলীসৌন্দর্যের সুসমন্বয়েই লেখক হয়ে উঠেছেন বাংলাদেশের ছোটগল্পধারায় বিশিষ্ট ও গুরুত্বপূর্ণ।

তথ্যনির্দেশ ও টীকা
১. চেতনাপ্রবাহরীতি কথাটি এসেছে ইংরেজি Stream of Consciousness থেকে। এই শব্দবন্ধটি প্রথম ব্যবহার করেন উইলিয়ম জেমস (১৮৪২-১৯১০) তাঁর Principles of Psychology (১৮৯০) গ্রন্থে – ‘to describe the unbroken flow of perceptions, thoughts, and feelings in the waking mind; it has since been adopted to describe a narrative method in modern fiction. … As it has been refined since the 1920s, stream of consciousness is the name applied specially to a mode of narration that undertakes to reproduce, without a narrator’s intervention, the full spectrum and continuous flow of a character’s mental process, in which sense perceptions mingle with conscious, and half-conscious thoughts, memories, expectations, feelings, and random associations. (M.H. Abrams, A Glossary of Literary Terms, seventh edition, Harcourt Asia PTE Ltd, 2000, p298-299). Stream of Consciousness রীতির প্রয়োগে খ্যাত উপন্যাসগুলির মধ্যে রয়েছে হেনরি জেমসের (১৮৪৩-১৯১৬) Portrait of a Lady (১৮৮১), জেমস জয়েসের (১৮৮২-১৯৪১) Ulysses (১৯২২), ডরোথি রিচার্ডসনের (১৮৮২-১৯৫৭) Pilgrimage (১৯১৫-৩৮), ভার্জিনিয়া উলফের (১৮৮২-১৯৪১) Mrs. Dalloway (১৯২৫) ও To the Lighthouse (১৯২৭), উইলিয়ম ফকনারের (১৮৯৭-১৯৬২) The Sound and the Fury (১৯২৯) প্রভৃতি।
২. মানব-মনস্তত্ত্ব সম্পর্কিত আবিষ্কারগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য : উইলিয়ম জেমসের (১৮৪২-১৯১০) Principles of Psychology (১৮৯০); হ্যাভলক এলিসের (১৮৫৮-১৯৩৯) Studies in the Psychology of Sex (১৮৯৭-১৯২৮); সিগমুন্ড ফ্রয়েডের The Interpretation of Dreams (১৯০০), Three Essays on the Theory of Sexuality (১৯০৫), Totem and Taboo (১৯১৩), The Unconscious (১৯১৫), Introductory Lectures on Psycho-Analysis (১৯১৭), The Ego and the Id (১৯২৩); আলফ্রেড অ্যাডলারের (১৮৭০-১৯৩৭) Organic Inferiority and Psychic Compensation (১৯০৭), Understanding Human Nature (১৯২৭); সি.জি. ইয়ুংয়ের (১৮৭৫-১৯৬১) Modern Man in Search of a Soul (১৯৩৩) প্রভৃতি।
৩. সুশান্ত মজুমদারের চারটি গল্পগ্রন্থে সংকলিত সাঁইত্রিশটি গল্পের নাম নিম্নরূপ :
ছেঁড়া খোঁড়া জমি (রূপম প্রকাশনী, ঢাকা, এপ্রিল ১৯৮৮) গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে এগারোটি গল্প – ‘এক জোড়া মোজা’, ‘অনিবার্য’, ‘সরল সত্য’, ‘একাকার’, ‘বিদেশী বুট’, ‘শরিক’, ‘টুথপেস্ট’, ‘ছেঁড়া খোঁড়া জমি-১’, ‘ছেঁড়া খোঁড়া জমি-২’, ‘ছেঁড়া খোঁড়া জমি-৩’ ও ‘প্রতিপক্ষ’;
রাজা আসেনি বাদ্য বাজাও (সন্ধানী প্রকাশনী, ঢাকা, ফেব্রুয়ারি ১৯৯৪) গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে নয়টি গল্প – ‘মুক্তি এবং ছেঁড়া ঠোঁট’, ‘রাজা আসেনি বাদ্য বাজাও’, ‘রক্তমাংস’, ‘ভেগল’, ‘ককটেল’, ‘সাধারণ হাত’, ‘ডিগবাজি’, ‘তৃতীয় ঘটনা’ ও ‘আমিই রমজান’;
শরীরে শীত ও টেবিলে গুন্ডাপান্ডা (প্রাচ্যবিদ্যা প্রকাশনী, ঢাকা, জানুয়ারি ১৯৯৮) গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে সাতটি গল্প – ‘নিজস্ব মেদিনী’, ‘মুন্ডু মুখোশ’, ‘আমি মুক্তিযোদ্ধার সন্তান’, ‘মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ডায়েরিতে লিখলেন’, ‘কফিলউদ্দিনের কি হয়েছে?’, ‘ভিন্ন পেশী অন্য তাপ’ এবং ‘শরীরে শীত ও টেবিলে গুন্ডাপান্ডা’;
জন্ম-সাঁতার (সন্ধানী প্রকাশনী, ঢাকা, ফেব্রুয়ারি ১৯৯৮) গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে দশটি গল্প – ‘বাবার গ্লানি’, ‘বুয়ার তিনদিন’, ‘শব্দ-নৈঃশব্দ্য’, ‘লম্বা চুল ও পাঁচটি বিয়ার’, ‘লতাপাতার ফাঁস’, ‘শূদ্রের ঘাড়’, ‘জন্ম-সাঁতার’, ‘এক মতুয়ার হোববোল’, ‘হাড়ের খাঁচা’ এবং ‘সামান্য উপায়’।