ছোটগল্পের হালচাল

সনৎকুমার সাহা
একটা সময় ছিল, যখন আমরা রবীন্দ্রনাথের ‘বর্ষা-যাপন’ কবিতাটির (সোনার তরী, ১৭ জ্যেষ্ঠ, ১২৯৯) শেষাংশের কিছুটাতে সাহিত্যকর্ম হিসেবে ছোটগল্পের সব লক্ষণ ধরা আছে বলে মনে করতাম। গল্পগুচ্ছেই তখন ছিল, বোধহয় এখনো আছে, ছোটগল্পের এক আদর্শ সংগ্রহ। তাঁর রচনাগুলোয় তারা যেন খাপে খাপে মিলে যায়। আমরা আনন্দ পেতাম। কোনো প্রশ্ন মাথা তুলত না। অল্প-স্বল্প বিদেশি গল্প তখন যা পড়েছি তাতে এও মনে হতো, গল্পগুচ্ছের অনেক লেখা তাদের টেক্কা দিতে পারে। এবং বাইরের গল্প পড়তেও ‘বর্ষা-যাপনে’ তাঁর ছোটগল্পের ধারণা থেকে সরে আসতে হয় না।
কিন্তু ইদানীং কথাগুলো মনে মনে আওড়াতে গিয়ে বারবার হোঁচট খাই। থমকেও যাই। এ কি সময়ের কারসাজি? শব্দের আন্তর মূল্যে কি তা কম-বেশি ঘটায়? অথবা উলটোদিক থেকে আমরাই বদলে যাই, চলমান প্রেক্ষাপটে শব্দকে তার আগের জায়গায়, আগের মহিমায় আর দেখি না?
না কি গল্পও আর আগের মতো থাকতে চায় না। থাকে না। পেছনে থাকে কি বাস্তবের প্ররোচনা? খোঁজে কি সে চেতনার আরো অন্য খোপ? আটকে যাই শুরুতেই ‘ছোটোপ্রাণ, ছোটো ব্যথা’তে। কোন প্রাণ কোন ব্যথা ছোট আর কোনগুলো বড়? ‘করো ত্রাণ মহাপ্রাণ আনো অমৃত বাণী’, – এখানে ‘মহাপ্রাণের’র স্বরূপ একটা ফুটে উঠতে দেখি। কিন্তু ছোটপ্রাণ বললে কোথায় কার বা কাদের ওপর চোখ রাখব? সে কি মহাপ্রাণের বিপরীত? না কি মহাপ্রাণেও তা মিশে যায়? অন্যদিকে যা কিছু ক্ষতিকর, বিদ্বেষ ও বিতৃষ্ণায় মনকে আবিল করে, তার প্রতিকৃতি হয়ে যদি কেউ সামনে আসে এমনকি ‘প্রতিকারহীন শক্তে’র দাপট দেখায়, তবে তাকে কোথায় ঠেলব? সে কি গল্পের বাইরে থেকে যাবে? সে বাইরে থাকলে ধরা যাক চার্লি চ্যাপলিনের লিট্ল ম্যান, যদিও অন্য মাধ্যমে, সে দাঁড়াবে কোথায়? রবীন্দ্রনাথ বলতে পারেন, তিনি রক্তকরবী লিখেছেন, অচলায়তন লিখেছেন, তার জায়গা চিনিয়ে দিয়েছেন; কিন্তু ছোটগল্পে তার মুখোমুখি হতে চাওয়া কি বিধিসম্মত নয়? ঘটনায় ও পরিসরে বিষয়ের ওজন মাথায় নিয়ে চলা কি ছোটগল্পের সাধ্যের বাইরে?
‘ছোটো ব্যথা’ বা ‘ছোটো ছোট্টো দুঃখকথা’; একই রকম আমাদের ভাবায়। এ নিয়ে কিছু বলার আগে তাঁরই একটা গানের প্রথম দুই চরণ মনে হানা দেয় : ‘অসীম ধন তো, আছে তোমার তাহে সাধ না মেটে।/ নিতে চাও তা আমার হাতে কণায় কণায় বেঁটে।’ অসীম ব্যথা, – অসীম দুঃখের যে কল্পনায় অনুভব, তাকে অবশ্য অকিঞ্চিৎকর ‘বহুর ভিতরে’ কণায় কণায় বেঁটে দিলেই কি মেলে ছোট ব্যথা, ছোট দুঃখ? কিন্তু তিনিই তো আবার ওই ‘কণায় কণায়’ পেতে চেয়েছেন পূর্ণকে। মন্ত্র জপেছেন, এ পূর্ণ, ও-ও পূর্ণ, পূর্ণ থেকে পূর্ণের উদয়; পূর্ণ থেকে পূর্ণ বাদ গেলেও পূর্ণই থাকে। তাহলে ছোট ব্যথা, আর ছোট ছোট দুঃখকথাও তো অসীমের পটে আঁকা এক-একটি পরিপূর্ণ শিল্প। তা-ই যদি হবে তবে কেন তারা ‘নিতান্তই সহজ-সরল’; ‘সহস্র বিস্মৃতিরাশি’ থেকে তাদের অশ্র“ভেজা উজ্জ্বল উদ্ধার?
এ কি তবে চিনিয়ে দেয় শুধু তাঁর প্রেক্ষাপটকেই? উনিশ শতকের শেষে, আর বিশ শতকের গোড়ায় এই বাংলার মানচিত্রে শিলাইদহ, পতিসর, শাহজাদপুরে তার অনেকটাই ভাসমান। তাদের ঘিরে থাকে পদ্মা-নারদ-গরাই-আত্রাই, আর তাদের অসংখ্য শাখা-প্রশাখা-খাল-বিল-নাব্য জলাভূমি। মানুষ সেখানে বাঁচে বিশিষ্ট হয়ে নয়, প্রকৃতিতে অঙ্গাঙ্গী মিশে গিয়ে। একেবারে নির্বিশেষ হয়ে। কাজের বহুবিচিত্র ধারা, ধাপে-ধাপে ওঠানামা, কিছুই প্রায় চোখে পড়ে না। এমনকি যখন ফিরে আসেন নাগরিক, কর্মধারায় তখন সেখানেও শুধু ধরাবাঁধা জীবনের ঢিমেলয়ে চলাচল। ‘বর্ণনার ছটা’ বা ‘ঘটনার ঘনঘটা’ নিতান্তই বেমানান। তত্ত্ব বা উপদেশও অর্থহীন, কারণ বিশ্বপ্রকৃতির নাট্যশালায় জীবন-মৃত্যুর বহমান ধারা অনিবার্য ও সুখ-দুঃখ অতিক্রান্ত, রসের স্রোতে রঙের খেলায় মায়ার ছায়া পড়ে, কিন্তু নিকটে টেনে তাকে ধরে রাখা যায় না। ছোটগল্প দেখে এবং দেখায় এই দূরত্ব মেনে নিয়েই।
তারপরে মোক্ষম একটি নিদান তিনি হাঁকেন। ‘অন্তরে অতৃপ্তি রবে, সাঙ্গ করি মনে হবে/ শেষ হয়েও হইল না শেষ।’ আর এক গানে তিনি শুনিয়েছেন, ‘শেষ নাহি যে, শেষ কথা কে বলবে?’ ছোটগল্পের বেলাতেও বুঝি তাই।
গানের ভাব অবশ্যই আরো ব্যাপক – বিশ্বচরাচরে তার বিস্তার। ছোটগল্পে তা কেবল টুকরো টুকরো ঘটনাখণ্ডে জুড়ে থাকে। যেন বলতে চাওয়া, ওই বিশেষ পরিস্থিতি কোনো সমাপ্তি নির্দেশ করে না। একটি বিস্মৃতির পিছনে পিছনে চলে আরো বিস্মৃতি। তাদের চলমান রেখা ছোটগল্প আঁকে না। কৌতূহল একটা জাগিয়ে রাখে। এর শেষ নেই। যত তুচ্ছ-ক্ষুদ্র জীবন হোক, অভিজ্ঞতা যত অকিঞ্চিৎকর হোক, নতুন সম্ভাবনার বীজ তাতে বিস্মরণেও থেকে যায়। আগ্রহ তার অবিনাশী। ছোটগল্প এক জায়গায় শেষ হলেও তা জেগে থাকে। যুগ থেকে যুগান্তরে। যদি অবশ্য ওই গল্পের সেই মানবিক শিল্পমূল্য থাকে, অথবা তার রূপবদ্ধ লাবণ্যে সঞ্চারিত জীবনজিজ্ঞাসা ভবিষ্যৎকেও বিদ্ধ করে। গল্পগুচ্ছের আবেদন এই জায়গায় এখনও অনিঃশেষ।
তবে তার মানে এই নয়, লক্ষণগুলো রবীন্দ্রনাথ গল্প-লেখায় কোথাও অতিক্রম করেননি, অথবা, বিচ্যুতি ঘটলে গল্পগুলোও পতিত হয়েছে। তাঁর দুটো স্মরণীয় গল্প ‘পোস্টমাস্টার’ ও ‘কাবুলিওয়ালা’। দুটোতেই শেষে, ঠিক তত্ত্বকথা নয়, একরকম উদাসীন, অথবা, সর্বজনীন বিবেকের ভূমিকায় আবির্ভাব ঘটে লেখকের। ‘পোস্টমাস্টারে’ শেষের কথাগুলো এইরকম : ‘- হায় বুদ্ধিহীন মানবহৃদয়! ভ্রান্তি কিছুতেই ঘোচে না, যুক্তি-শাস্ত্রের বিধান বহুবিলম্বে মাথায় প্রবেশ করে, প্রবল প্রমাণকেও অবিশ্বাস করিয়া মিথ্যা আশাকে দুই বাহুপাশে বাঁধিয়া বুকের ভিতরে প্রাণপণে জড়াইয়া ধরা যায়, অবশেষে একদিন সমস্ত নাড়ী কাটিয়া হৃদয়ের রক্ত শুষিয়া সে পলায়ন করে, তখন চেতনা হয় এবং দ্বিতীয় ভ্রান্তিপাশে পড়িবার জন্য চিত্ত ব্যাকুল হইয়া উঠে।’
গল্প শেষ হয়ে যায় রতনের নিরুপায় হাহাকারে। তারপরে এই বাগ্বিস্তার নি®প্রয়োজন। বোধহয় এর শিল্পসিদ্ধি কিছুটা হলেও ক্ষুণœ করে। ‘কাবুলিওয়ালা’ গল্পের উপান্তিক বর্ণনায় পড়ি – ‘সকালবেলার শরতের øিগ্ধ রৌদ্রকিরণের মধ্যে সানাই বাজিতে লাগিল, রহমত কলিকাতার এক গলির ভিতরে বসিয়া আফগানিস্থানের এক মরুপর্বতের দৃশ্য দেখিতে লাগিল।’
গল্প কিন্তু শেষ হয়ে গেছে এইখানেই। কিন্তু তারপরেও রবীন্দ্রনাথ বিশদ হন – “আমি একখানি নোট লইয়া তাহাকে দিলাম। বলিলাম, ‘রহমত, তুমি দেশে তোমার মেয়ের কাছে ফিরিয়া যাও; তোমাদের মিলনসুখে আমার মিনির কল্যাণ হউক।’
এই টাকাটা দান করিয়া হিসাব হইতে উৎসব সমারোহের দুটো একটা অঙ্গ ছাঁটিয়া দিতে হইল। যেমন মনে করিয়াছিলাম তেমন করিয়া ইলেকট্রিক আলো জ্বালাইতে পারিলাম না, গড়ের বাদ্যও আসিল না, অন্তঃপুরে মেয়েরা অত্যন্ত অসন্তোষ প্রকাশ করিতে লাগিলেন, কিন্তু মঙ্গল আলোকে আমার শুভ উৎসব উজ্জ্বল হইয়া উঠিল।”
শেষের এই তৃপ্তিদায়ী কল্যাণ-এষণা গল্পে সার্থকতার সূচিমুখ একটু হলেও কি ভোঁতা করে দেয় না?
অবশ্য অন্য একটা বিবেচনাও থাকতে পারে : তা পাঠক সংযোগের। উনিশ শতকের শেষে এই বাংলায় পাঠক-পাঠিকাদের প্রত্যাশার জায়গাটাকে আমলে নেওয়া কি ওই সময়ের কোনো লেখকের কাছে জরুরি হয়ে পড়ে না? তেমন হলে পাঠক-পাঠিকারাও তো হয়ে দাঁড়ায় গল্পের এক নিয়ন্তা। লেখকের মৃত্যু তাঁরা ঘোষণা করেন না, যেমন তাঁদের হয়ে করেছেন ইদানীংকালে ফরাসি চিন্তাবিদ রলাঁ বার্ত।
কিন্তু রুচির বা অনুভূতির মানদণ্ড নিয়ন্ত্রণে অথবা নির্মাণে, একটা পরিপূরক ভূমিকা রাখেন। এমন হওয়া অসম্ভব নয় যে, অতি নাটকীয় কাহিনির চূড়ান্ত ও সুনিশ্চিত অভ্যস্ত পাঠক-পাঠিকাদের কাছে ‘পোস্টমাস্টার’ বা ‘কাবুলিওয়ালা’র রচিত সমাপ্তিতেই অন্তরে অতৃপ্তি থেকে যায়। মনে হয় তাঁদের, শেষ হয়েও হইল না শেষ। গল্পবিচারে এক কথায় রায় দেওয়া তাই মুশকিলই।
এমনকি এক সময়ে বা এক জায়গায় যা সর্ববাদিসম্মত, অন্য সময়ে বা অন্য জায়গায় তা নাকচ হয়ে যেতে পারে। কখনো উপেক্ষিত, পরে হতে পারে আরাধ্য। শিল্পসৃষ্টির সব মাধ্যমের বেলাতেই এমন ঘটে। ছোটগল্প তার বাইরে নয়।
তবে বাংলা ছোটগল্পে রবীন্দ্রনাথ যে মান বেঁধে দেন – এবং বিশেষ বিশেষ সৃষ্টিতে তা যে দেশ-কালকে অতিক্রম করে না, তা নয় – তার সুফল কিন্তু পরে বহুদিন আমরা পাই। বাংলা ছোটগল্প শানিত ও সমৃদ্ধ হয়ে চলে। অন্তত গত শতকের ষাটের দশক পর্যন্ত তো বটেই। প্রভাত মুখোপাধ্যায়ের কিছু গল্প এখনো আমাদের টানে। তারাশঙ্কর, বিভূতিভূষণ বা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনেক গল্প বারবার পড়েও পুরনো হয় না। নরেন্দ্রনাথ মিত্র, জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী, বিমল কর ছোটগল্পেই দেশ-কালের এক বিপন্ন বিভ্রান্ত খণ্ডের নির্মোহ উন্মোচন ঘটান। আরো পাই অসাধারণ প্রতিভাবান ও প্রবলভাবে আত্মসচেতন কমলকুমার মজুমদারের বিস্ফোরক কটি গল্প। আমাদের তারা স্তম্ভিত করে রাখে।
কিন্তু বোঝা যায়, রবীন্দ্রনাথের এঁকে দেওয়া লক্ষ্মণরেখা তাঁরা সবাই মাথায় রাখেন। শেষের চমকে পাঠককে ধরাশায়ী করার কৌশল নিয়ে ভাবেন তাঁরা সকলেই। এবং গল্পের একক সূচিমুখের কথা ভোলেন না তাঁরা অধিকাংশ সময়েই। তাছাড়া ছিন্নমস্তা পটভূমিতে অমানিত মানব-মানবীরাই সামনে চলে আসে। তাদের সংকট, তাদের দুঃখকথা, বানিয়ে তুলতে হয় না। চারপাশের দৃশ্যমান জগৎ থেকে কুড়িয়ে নিতে হয়। কিছুই মেকি নয়। তবে বিস্মৃতিরাশিতে অনর্থক ভেসে যায় না। সমকালের ও ভবিষ্যতের বর্তমানে প্রাণের সঞ্চার তারা কিছু না-কিছু করে। যদি নষ্টপ্রাণ হয়, যদি জীবন মূল্য হারায়, তবু।
অবশ্য এখানে রবীন্দ্রনাথকে প্রারম্ভিক বিন্দু মানা যথার্থ হয় না। তিনি স্বয়ম্ভূ ছিলেন না। যদিও প্রাচীন কথা ও কাহিনি ছোটগল্পে তাঁর প্রেরণার উৎস ছিল না। প্রধানত পাশ্চাত্য কথাসাহিত্যের সঙ্গে পরিচয় তাঁকে এই সব গল্পরচনায় উৎসাহিত করে থাকবে। উপন্যাসেও তার প্রভাব পড়েছে নিশ্চয়। তবে ছোটগল্পে বিষয়ভাবনায় ও নির্মাণকলায় তা আরো বেশি গভীর। মপাসাঁ, অ্যাডগার অ্যালান পো, দস্তয়েভস্কি, তলস্তয় – এঁদের লেখা গল্প, চেখভের নাটক এসব তাঁর মনে রেখাপাত করেছে যদি কেউ বলেন, তবে তা অমূলক মনে করা বোধহয় ঠিক হবে না। তারপরেও নির্ভেজাল বাংলা গল্পই লিখেছেন, এবং তার প্রাণসম্পদ আহরণ করেছেন এখান থেকেই। তাতে চিন্তার বস্তুনির্ভরতা ও অনুভবের সততা বিন্দুমাত্র ক্ষুণœ হয় না। আমরা একাত্ম হই। যদিও বর্তমান সেখান থেকে সরে এসেছে বহুদূর। অনিশ্চয়তার ও প্রত্যাশার ছবিও পালটে গেছে অনেক।
গত বিশ শতক জুড়ে ঘটনায় ও বিষয়চেতনায় ওলট-পালট হুড়-হুল্লোড় এতদূর পর্যন্ত গড়ায় যে তাদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে অবিচল ও আত্মস্থ থাকা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। রবীন্দ্রনাথ যতদূর বেঁচেছিলেন, তাদের সঙ্গে যুঝেছেন, বলেছেন, মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ, কিন্তু শরশয্যার মিনতি মানতে হয়েছে তাঁকেও, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পূর্বক্ষণে (১৯৩৭) আর্তনাদের মতো ডুকরে উঠেছেন, ‘নাগিনীরা চারিদিকে ফেলিতেছে বিষাক্ত নিশ্বাস,/ শান্তির ললিত বাণী শোনাইবে ব্যর্থ পরিহাস -’ আর এই আহ্বানটুকু গভীর বেদনায় রেখে যেতে বাধ্য হয়েছেন, ‘বিদায় নেওয়ার আগে তাই/ ডাক দিয়ে যাই/ দানবের সাথে যারা সংগ্রামের তরে/ প্রস্তুত হতেছে ঘরে ঘরে।’ শুধু বিশ্বজুড়ে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের আশঙ্কাই নয়, আপন আবাসেও বাড়ে সাম্প্রদায়িক তিক্ততা আর স্বার্থের ইতর কলুষ বিস্তার।
জীবনভাবনা মানুষের বদলে যেতে শুরু করেছে আরো আগে থেকে। তার কর্তা আমরা খুব কমই থেকেছি। তবে কর্মফল এসে পড়েছে আমাদের ওপরেও। তাৎক্ষণিক না হলেও সাড়া দিতে দিতে চলেছি। বদলে যেতে থেকেছি আমরাও। জেনে, অথবা, না-জেনে।
প্রথম মহাযুদ্ধের (১৯১৪-১৮) আগে থেকেই য়োরোপের চিন্তা-শিল্প-সাহিত্যের জগতে গভীরতর অস্থিরতা ও বিপন্নতার ভাব আকার পেতে থাকে। ভদ্র সভ্য আচ্ছাদনে মনোজগতের অবৈধ কামনা বা বিকার বাসনা আড়াল করে রাখা ভণ্ডামি বলে মনে হয়। ভাষায় পেলব প্রতিমা নির্মাণ, অথবা, সুখস্বপ্নের জাল বোনা কৌলীন্য হারায়। নির্ভরতার ঈশ্বর শূন্যে বিলীন হয়ে যেতে থাকেন, অথবা স্বয়ং এক স্বেচ্ছাচারী ভয়ঙ্কর-অত্যাচারী একনায়কের পূর্ণরূপের প্রতিমূর্তি হয়ে ওঠেন। কথাসাহিত্যে ছোটগল্পেও এসবের প্রতিফলন ঘটতে শুরু করে। নিরীশ্বর বাস্তবতায় জীবনের রূপকল্প নির্মাণ দর্শনে শুধু নয়, শিল্প-সাহিত্যেও পথ খোঁজে। ইতিবাচক উৎসাহও পায় ১৯১৭-য় রুশ বিপ্লবে, যা সংযুক্ত সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত গণরাজ্যের প্রতিষ্ঠা ঘটায়। তবে ব্যক্তিস্বাধীনতার আকাক্সক্ষাকে মান্য করে গণতান্ত্রিক বিশ্বও মুখোমুখি থেকে যায়। মানুষ কী করে জীবন কাটাবে, এ-প্রশ্নের মীমাংসা হয় না। দ্বন্দ্ব অব্যাহত থাকে।
এদিকে তিরিশের দশকে পুঁজিবাদী বিশ্ব মহাসংকটে পড়ে। মন্দার ছোবলে অসংখ্য মানুষের কাজ হারিয়ে পথের ভিখিরি হওয়ার দশা। আশু উদ্ধারের পথ কিছু চোখে পড়ে না। পারস্পরিক দোষারোপ ও জবরদখলের মানসিকতা প্রশ্রয় পায়। বীর নেতার স্বপ্ন দুঃস্বপ্নের দিকে মানুষকে টানে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের (১৯৩৯-৪৫) মঞ্চ রচিত হতে থাকে।
এইরকম বাস্তবতাই জন্ম দেয় কাফকা (১৮৮৩-১৯২৪), ক্যামু (১৯১৩-৬০), সার্ত্র (১৯০৫-৮০) এঁদের। ক্ষমাহীন বিশ্বে নির্বাসিত এক-একটি মানুষের ছবি তাঁরা আঁকেন। এবং পথ খোঁজেন উদ্ধারের। উদ্ধার যেখানে মেলে না, সেখানে কোনো ইচ্ছাপূরণের স্বপ্নকল্পনায় তাঁরা মাতেন না। মানুষের যন্ত্রণাদীর্ণ মুখের রেখাই আমাদের বন্দি করে রাখে। শুধু যুক্তিতর্ক প্রবন্ধে নয়, উপন্যাসে ও ছোটগল্পেও। সাহসের সঙ্গে সৎ উচ্চারণে তাঁরা অকুণ্ঠ। যদিও তা আমাদের বিপন্নতাকেই চিনিয়ে দেয়। তাঁদের জগৎ রবীন্দ্রনাথের ‘বিরাট সুষমা’র প্রত্যয় থেকে যোজন যোজন দূর। গল্পের পর গল্পে আমাদের প্রসন্নতা তাঁরা কেড়ে নেন। অবশ্য দস্তয়েভস্কির বিপন্ন মানুষের দেখা মিলেছে আগেই। কিন্তু তাতে আবেগ ছিল, আকুলতা ছিল। এঁরা তাকে দাঁড় করান মননপ্রভ নিরাসক্তিতে। রবীন্দ্রনাথ যাকে বলেছেন প্রতারণার ছবি, তাকে তাঁরা প্রতারণাও বলেন না। বলেন, বাস্তবের অনিবার্য গোলকধাঁধা। অথবা তাও বলেন না। আমরা মনে করি, যদি মনে করতে চাই, তেমন তাঁরা বলেন। তার মুখোমুখি হওয়া, পথ খোঁজা – পাওয়া, বা না-পাওয়া – এই মানুষের নিয়তি। খুঁজে পাওয়াটাও শেষ কথা নয়। কারণ, প্রতিটি পাওয়া আবার অসংখ্য অনিশ্চয়তার মুখ খুলে দেয়। কাফকা তাঁর উপন্যাস, দ্য ট্রায়াল, বা দ্য ক্যাসলে অবিচল করুণাহীনতায়, আবার একই সঙ্গে নির্বিকার অবশ্যম্ভাবিতায় মানবভাগ্যের এই ছবি ফুটিয়ে তোলেন। হয়তো তিনি এইভাবে ওল্ড টেস্টামেন্টের ঈশ্বরের মুখোমুখি হতে চান। যদিও মানুষী মর্যাদায় আত্মস্থ থাকেন পুরোপুরি। তাঁর ছোটগল্পেও আমরা পাই একই মেজাজ, মানুষের একই অদৃষ্টলিপি। সেখানেও মাথা তুলে নিজেদের বরাবর একই রকম জানিয়ে চলেছে তাঁর দ্য মেটামরফোসিস বা দ্য জাজমেন্টের মতো গল্প। একশ বছর পরেও তারা আমাদের একই রকম বিচলিত করে। কারণ, মানুষের সুখ-সমৃদ্ধি বাড়–ক, অথবাকমুক, সীমিত জীবনে দুঃখ পাওয়া ও দুঃখ দেওয়া, সম্পর্কে ও সম্পর্কহীনতায় মানুষ মানুষে বিতৃষ্ণা জাগা ও দূরত্ব বাড়া, এদের কোনো বিরাম নেই। এক উদাসীন নিষ্ঠুরতায় যেন তাদের পতন। স্বেচ্ছায় নয়, এক নিস্পৃহ কিন্তু ক্রুদ্ধ নিয়ন্তার খেয়ালে।
আরো আছে কাফকার বেশ কিছু অণুগল্প। আধ-পাতা, এক পাতাতেই শেষ। বেশির ভাগই আছে লুকিং টু সি সংকলনে। ছোটগল্প বলেই এদের পরিচয়। তাদের একটা দ্য ট্রিজ (গাছেরা)। পুরোটা এই রকম :
কারণ আমরা বরফের ভেতরে গাছের গুঁড়ির মতো। মনে হয়, তারা মাটিতে চিৎ হয়ে পড়ে আছে এবং একটু ধাক্কা দিলেই তাদের সরানো যাবে না, তা কেউ পারে না। কারণ তারা মাটিতে শক্ত করে বসা। কিন্তু দেখ, এটাও কেবল মনে হওয়া।
প্রথমেই হকচকিয়ে যাই। একি গল্প? ভাবতে হয়। তারপরেই মনে হয়, একি মায়ার খেলার বিরাট প্রেক্ষাপট মেলে ধরছে না? যদিও কোনো সাজ-বাজ নেই। ‘রঙের খেলা’ নেই!
অনেকের মনে হতে পারে, বনফুলের অণু-গল্পের কথা। তবে তফাত এদের অসেতুসম্ভব। কাফকার অন্তর্দৃষ্টি ও নির্বিশেষে তার বিস্তার একেবারে অন্য ধরনের। বনফুল চমকপ্রদ হলেও প্রত্যক্ষের সীমাতেই বাঁধা। এটা কোনো ত্র“টি নয়। তারও মূল্য অসাধারণ।
তবে প্রেক্ষাপট বদলে দিলে রবীন্দ্রনাথের কথা আবার মনে হয়। অতি সম্প্রতি হাসান আজিজুল হক একটি প্রবন্ধে (বাংলাদেশের হৃদয় হতে, জ্যৈষ্ঠ, ১৪২১) তাঁর শেষ দিকের কিছু কবিতার দিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন – (ঢাকিরা ঢাক বাজায় খালে-বিলে)। বলতে চেয়েছেন, এই সব কবিতায়, বিশেষ করে ছড়া জাতীয় রচনায় গল্প আছে। কথাটা গুরুত্ব দিয়ে দেখার। কিন্তু অন্য একটি বিষয় এরই সম্পূরক হিসেবে, বোধহয়, সামনে চলে আসতে পারে। প্রচুর অণু-কবিতা লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ কণিকায় (১৮৯৯), লেখনে (১৯২৭), স্ফুলিঙ্গে, – এছাড়া লিপিকার রচনাও কবিতা। এদের কোনো-কোনোটিতে গল্প আছে। তারা ফেলনা নয়; বরং কোথাও কোথাও চেতনার আকাশে স্থায়ী চিত্রমায়ার গল্পকথা আঁকে। কাফকার অণুগল্পের মেজাজে না হলেও। এখানে প্রাসঙ্গিক নয় বলে এ নিয়ে আর কথা বাড়াতে চাইছি না। তবে একই সঙ্গে খেয়াল করি, কবিতায় উপন্যাসও লেখা হয়েছে। পুশকিনের ইভানজিনওনেজিন এক অসাধারণ কাব্যোপন্যাস। তারই প্রেরণায় সাম্প্রতিককালে বিক্রম শেঠ লিখেছেন দ্য গোল্ডেন গেট। বিষয়ের অঙ্গবিন্যাসে লেখকের কোনো প্রচলিত বিধিনিষেধ মেনে চলার প্রয়োজন করে না। প্রতিভাই স্বয়ম্প্রকাশ। অবশ্য পাঠক-পাঠিকারা কোথায় কখন কী খুঁজে পাবেন, তা বলার ক্ষমতা লেখকের থাকে না।
ভাগ্যহত মানুষের ‘দুষ্পাঠ্য কররেখা’য় চোখ রাখেন কামু এবং সার্ত্রও। তবে কাফকার মতো অনির্ণেয় শক্তি কল্পনা তাঁরা করেন না। দস্তয়েভস্কির ব্রাদারস কারমাজভ থেকে কামু উদ্ধৃতি দেন, ঈশ্বর যদি না থাকেন, তবে সবকিছুই সম্ভব। পাপ-পুণ্যের ভেদরেখা বলে কিছু থাকে না। সাধ্যের ভেতর যার যা খুশি, যতদূর খুশি করতে পারে। একে তিনি বলেছেন ‘অ্যাবসার্ড’ এবং বাস্তব যৌক্তিকভাবে তাই-ই। উদ্ধারের পথ খুঁজতে তিনি আবার মুখ ফেরান মানুষের দিকেই। প্রত্যেকে নিজের নিজের জায়গা থেকে একার জন্যে নয়, সবার জন্যে স্থির করবে, কীভাবে তারা বাঁচবে, কী করবে, আর কী করবে না। সমাধান তাতে নেই। কারণ সিসিফাসের মতো অভিশপ্ত জীবন তার। ভারি পাথর কাঁধে নিয়ে বারবার পাহাড়ের মাথায় সে উঠতে যাবে, আর, বারবার পাথর নিচে গড়িয়ে পড়বে। তবু এই অবিরাম চেষ্টাই জীবনকে করে অর্থময়। অনিবার্য ব্যর্থতা ভাগ্যলিপি হওয়ার পরও তিনি মনে করতে চান সিসিফাস সুখী (দ্য মিথ অফ সিসিফাস)। এরই বিপরীতে ভাবলেশহীন শুধুই যুক্তিসিদ্ধ মানুষের কথা লেখেন তিনি দুই বিস্ফোরক উপন্যাস দ্য আউটসাইডার ও দ্য ফলে। আর সিসিফাসের ভাবরূপ তিনি ফুটিয়ে তোলেন তাঁর দ্য প্লেগ উপন্যাসে ডাক্তার রিউয়ের ভেতরে।
তাঁর ছোটগল্পের বই একজাইল অ্যান্ড দ্য কিংডম। এখানেও মূল প্রশ্ন অভিশপ্ত মানুষের পথ খোঁজা, আর পথ বাছা। সুনিশ্চিত সমাধান কিছু নেই। বাস্তব, কিন্তু, আয়ত্তের অতীত বিভীষিকার সামনে বারবার হার মানব না। জনমত ফুঁসে ওঠে, ‘জোট বাঁধো।’ কিন্তু কামু নিশ্চিত হতে পারেন না। একটা গল্পে তারই প্রতিফলন দেখি। কী করবো তা ঠিক করতে করতে একজনের আয়ু নিঃশেষ হয়। পরে তার টেবিলে কাগজের ওপর লেখা চোখে পড়ে, কিন্তু বোঝা যায় না, সেটা ‘সলিটেয়ার’ না ‘সলিডেয়ার’ – একাকিত্ব, না সংহতি? বিশ শতকের শেষে এসে দেখি উত্তর এখনো অনিশ্চিত।
সার্ত্রও কামুর মতো যুক্তিহীন নির্মমতার প্রতিরোধে মানুষের সক্রিয়তার কথা বলেন। কামু যাকে বলেছেন ‘অ্যাবসার্ড’ তা তাঁর ভেতর জন্ম দেয় ‘নোসিয়া’র (হধঁংবধ) – নিরর্থক জীবনে বিবমিষার। তবে কিংকর্তব্যবিমূঢ় তিনি থাকেন না। মার্কসীয় বুদ্ধিবৃত্তিক ধারণার সঙ্গে (আবশ্যিকভাবে মার্কসীয় রাজনৈতিক সংগঠনবাদের সঙ্গে নয়) নিজেকে তিনি মেলান। আজীবন অবদমিত মানুষের অধিকারের সংগ্রামে জনমত গঠনে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন। নারী-পুরুষ, উভয়েরই মুক্ত আচরণ ছিল তাঁর অন্বিষ্ট। তবে তাঁর মননশীল গদ্য ও উপন্যাস চেতনায় সে আলোড়ন জাগায়, তাকে ঋদ্ধ করে, তাঁর ছোটগল্পে, অন্তত আমার কাছে মনে হয়, তা ঘটে না। কোনো পরিস্থিতির ভেতর থেকে হয়ে ওঠে না, সবটাই যেন আরোপিত। এ-কথা ঠিক, সব রচনাই লেখকের মস্তিষ্কপ্রসূত। সে অর্থে তা প্রত্যক্ষ বাস্তব নয়, লেখকই তার স্রষ্টা। কিন্তু তাঁর মস্তিষ্কের কোঠরে যে রূপ দানা বাঁধে, যে বর্ণনা বা যে সংলাপ ভাষা পায়, তার উৎস বাস্তবই। তাকে প্রত্যাখ্যান করা যদি উদ্দেশ্য হয়, তাও। সার্ত্রের ছোটগল্পে এখানে যেন স্বতঃস্ফূর্ততার অভাব। যদিও তিনি মানব-মানবীর মুক্তিকে একটি অতি জরুরি প্রতিপাদ্য বলেই মনে করেন, এবং সেখানে তিনি সচেতনভাবে একশ ভাগ সৎ। অস্তীতিবাদের ওপরেই তিনি শুধু নির্ভর করেন না। প্রয়োজনমতো ফ্রয়েড থেকেও রসদ সংগ্রহ করেন। তাদের জাহির করা বড় চোখে লাগে। গল্প সেই অনুপাতে পেছনে সরে।
আমাদের যাপিত জীবনের অভিজ্ঞতা – সরাসরি বা পরোক্ষে – এই অ্যাবসার্ডকে কিন্তু বেশ খানিকটা আটপৌরে করে ফেলে। পুঁজি ও প্রযুক্তির বিশেষ করে তথ্য-প্রযুক্তির বিশ্বায়ন তার কল্পনাকে ঘরোয়া মাধ্যমে নিয়ে আসে। মানুষের বিচলিত হওয়ার বোধটাও অসার হয়ে পড়ে। আজ তাই চলচ্চিত্রে, টেলিভিশনে গোলাগুলি, খুনোখুনি, মারামারি, পাশাপাশি ভোগের অসংখ্য উপকরণ, চমকপ্রদ তাদের উদ্ভাবন, ও প্রত্যক্ষে উন্মোচন, এসবে আমরা অভ্যস্ত হয়ে পড়ি। প্রতীক প্রাত্যহিক বাস্তবতায় মেশে। অ্যাবসার্ড আরো অ্যাবসার্ডের পেছনে ছোট। তা হানা দেয় সাহিত্যে, শিল্পকলায়। ছোটগল্পেও। শুধু য়োরোপ আমেরিকায় নয়, তাদের দেখাদেখি অন্যান্য অঞ্চলেও। যদি গল্পের মূল থেকে তা সমান্তরালে আপনা থেকে উঠে আসে, অথবা গল্পে তা স্থায়ী মূল্য সংযোজন করে, তবে তা কাম্যই। শুধু এই অ্যাবসার্ডের ধারণা নয়, যে কোনো তাড়নার, যে কোনো অনুভূতির। আমরা জানি, গত শতকে তৃতীয় দশকের পর থেকে ডি এইচ লরেন্সের গল্পে নরনারী সম্পর্কে আদিম সত্যের অনুশীলন বাংলা ভাষার কোনো কোনো গল্পকারকেও প্রভাবিত করেছিল। তাতে গুরুত্ব পেয়েছিল কেবল ইতিহাসবিচ্ছিন্ন মৌলিক প্রবণতা। সবটাই তার টেকেনি। মানুষের জীবন পরস্পরবিরোধী অনেক বৃত্তিতে জড়ানো। এবং বাস্তব পরিবর্তমান, পরিবর্ধমান। মানব-মানবীর মৌল বৃত্তিও তার সঙ্গে তাল মেলায়। একই সময়ে মার্কসের দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের নির্ধারণী ছক অনেক গল্পের বিন্যাস ও পরিণাম স্থির করে দেয়। তাদের ফাঁকিগুলোও বেশিদিন ঢাকা থাকেনি। তবে এরা সবাই আমাদের হয়ে ওঠার গতিপথে কিছু না কিছু আলো ফেলে। এবং তাও সার্চলাইটের মতো ঘোরাফেরা করে। মানুষ মরণশীল, এই তথ্যটুকু ছাড়া আর কোথাও আমরা নিশ্চিত হয়ে স্থির থাকতে পারি না।
গত শতকের ষাটের দশকে, বলা যায়, কামু সার্ত্রের আদলে লেখা বাংলা ভাষায় কোনো কোনো গল্পকারের ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এতে গল্প যে খুব এগোয়নি, তার বড় কারণ এখানে বস্তুগত অভিজ্ঞতা আমাদের সেদিকে খুব একটা টানেনি। বিপরীতে এই ঘটেছে, নিজেদের অভিজ্ঞতার গভীরেও আমাদের চোখ যায়নি। অনেকটা ত্রিশঙ্কু অবস্থাতেই গল্পেরা সব আটকে থেকেছে। আগে বলেছি, রবীন্দ্রনাথও বাইরে থেকে গল্প লেখার সমিধ আহরণ করেছেন। কিন্তু তাঁর গল্পের অস্থি-মজ্জা-প্রাণ সবই বাংলার চেনা জগতের। এবং ওই সমিধও তারই অচেনা আকুতি। কিছুই আমদানি মনে হয়নি। আলগা ঝুলে থাকা, বা, হাতসাফাই মনে হয়নি। কিন্তু এই সময়ে তেমনটি ঘটেছে। সাময়িক হাততালি পেলেও তারা হারিয়ে যেতে বসেছে। ব্যতিক্রম আছেন হাসান আজিুজল হক। হয়তো আরো দুচারজনের কিছু কিছু লেখা। এবং তা বাংলা ভাষার সমগ্র বিস্তারেই। তাতে প্রতিভার ঘাটতি ও বাস্তব বোধের বিপুল অভাব দূর হয় না।
আরো একটা বিষয় আমাদের ভাবায়। পঞ্চাশের মন্বন্তর, সাতচল্লিশে দেশভাগ, এখানে বায়ান্নোর ভাষা-আন্দোলন, পরে সমরশাসনের বিরুদ্ধে গণজাগরণ, একাত্তরে মুক্তি সংগ্রাম-স্বাধীনতা, এদের প্রত্যেকটি আমাদের পায়ের তলার মাটি কাঁপিয়ে দেয়। গল্পে যে এদের অভিঘাত ধরা পড়ে না, তা নয়। প্রবলভাবেই পড়ে। কিন্তু বেশির ভাগই ওপর ওপর। চেতনার গভীর তল কমই স্পর্শ করে। যেন এইভাবে বলতে হয়, তাই। হয়তো আবেগে আমরা ভাসি। তা মিথ্যা নয়। কিন্তু সত্যস্য সত্যম্ অনুভবের যে বাস্তবতা, তার দেখা মেলে কদাচিৎ। শিল্পসত্তার যে আন্তরিক তপস্যা, তাও যেন ধরা পড়ে না। প্রত্যক্ষের গতানুগতিক ‘বিস্মৃতিরাশি’তে মিশে যাওয়াই বুঝি তাদের নিয়তি। কখনো কখনো ধারকরা বুলি তোতাপাখির মতো উগরে দেওয়া চোখে পড়ে। অসংগত নয়। তারিফও জোটে। কিন্তু গল্পের ফাঁকি ভরে না। শুধু গল্পের নয়, সাহিত্যের সৃষ্টিক্ষম সব মাধ্যমেরই। বেশির ভাগেই ধরা পড়ে শুধু কালের সাময়িক জলছাপ। গাঢ় হয়ে পড়লেও মিলিয়ে যেতে সময় লাগে না। আরো একটা উৎপাত শুরু হয়েছে ইদানীং। তিন দশকের ওপর চলছে উত্তর-আধুনিকতার মাতব্বরি। আপাতদৃষ্টে ব্যাপারটা পাশ্চাত্যের। গুরু পুরোহিতরাও পাশ্চাত্যেরই। কিন্তু একটু ধীরে-সুস্থে মন দিয়ে ভাবলেই বোঝা যায় এর লক্ষ্য উত্তর-ঔপনিবেশিক চিন্তা-বলয়। যদিও ভাবখানা এই, তোমাদের হয়ে তোমাদের দৃষ্টিকোণ থেকেই আমাদের দেখা। কিন্তু গভীরে এর সঙ্গে জড়িত বিশ্বায়িত পুঁজি ও প্রযুক্তির কায়েমি স্বার্থ। তারা বলে, বিশ্ব-বাস্তবতায় মূল চালিকাশক্তি কিছু নেই। সবটাই অন্তঃসারশূন্য। অতএব প্রচ্ছদই সব। তার তলদেশে হাতড়ে মরা অনর্থক। জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত প্রত্যক্ষের সম্পর্কে সম্পূর্ণ। সম্পর্কের স্থায়িত্বের কথা, বা ভবিষ্যতের ভাবনা অপ্রাসঙ্গিক।
বাবা-মা-ছেলে-মেয়ে মিলে পরিবারের অস্তিত্বও মিলিয়ে যেতে বসে। যদি তা থাকে তা কোনো প্রাথমিক সত্য নয়। না থাকাটাও একই রকম বাস্তব। মানুষের স্বাধীনতার প্রকাশ এই বাস্তবতা মেনে নিয়েই। ব্যক্তি যদি এইভাবে ভাবনার মূল বিন্দু হয়, তবে অসংখ্য উপকরণে, এমনকি মানব-মানবীর তাৎক্ষণিক সম্পর্কে তার ইচ্ছাপূরণই প্রত্যেকের চূড়ান্ত লক্ষ্য। যদিও অন্যের ওপর জোর-জবরদস্তি করার অধিকার কারো নেই। এর পরিণামে রাষ্ট্রও অবান্তর হয়ে পড়ে। থাকে শুধু বিশ্বায়িত পণ্য সরবরাহ প্রক্রিয়া। তাতে ব্যক্তি জড়িয়ে থাকে তার আপন যোগ্যতা ও চাহিদা অনুযায়ী কাজে। কাজ জোটায় মুক্তপদ বিশ্ব-বিস্তৃত ছড়ানো-ছিটানো উদ্যোগ।
ব্যক্তির ক্ষেত্র এতে একদিকে গোটা পৃথিবী, অন্যদিকে তার একান্ত নিজস্ব, পরিপার্শ্ব। তা তাকে নিশ্চিত ও নিশ্চিন্ত রাখে তার সংকীর্ণ সীমানায়। জাত ধর্ম সম্প্রদায় গোষ্ঠী ইত্যাদির বিভাজন তাই স্বাভাবিক ও যৌক্তিক। এই প্রেক্ষাপটে দেখতে চাওয়া মানুষকে। মানব-মানবী, উভয়কেই। অ্যাবসার্ড বা নোসিয়ার আক্রমণ এখানে ভাবা যায় না। তা সর্বাংশে অবান্তর। আপন শিকড়ের সংযোগ এক প্রান্ত। তা নস্টালজিয়া বা বিস্মৃত উৎসের জন্যে কাতরতাই কেবল জাগাতে পারে। অন্য প্রান্তে অবাধ পণ্যের সমাহার। তার মোহ অফুরান। দুইয়ের মাঝখানে রাষ্ট্র এক বিরক্তিকর বাধাস্বরূপ। বিপুল ক্ষমতার নৈর্ব্যক্তিক প্রয়োগ। ব্যক্তির বিকাশ তার সামনে সংকুচিত, অথবা, বিভ্রান্ত। কিন্তু উৎপাদিকা শক্তির ব্যবহার প্রক্রিয়াতেই যে বৈষম্যসৃষ্টি অনিবার্য, তার ক্ষত ও ক্ষতি দূর করায় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা যে কল্যাণকর হতে পারে, এ-কথাটা ভাবনার বৃত্ত থেকে ক্রমাগত দূরে সরে। নেপথ্যে বিশ্বায়িত পুঁজি ও সর্বত্রগামী বাধা-বন্ধনহীন প্রযুক্তি তাদের অধিকার ও বিচরণ নিষ্কণ্টক করার সুযোগ আরো মুষ্টিবদ্ধ করায় তৎপর হতে পারে।
বিষয়টি কেবল ভাবনা-জগতেই ঘোরাফেরা করে না। বিদ্যার উন্নত প্রতিষ্ঠানসমূহে এর চর্চা ক্রমবর্ধমান। যাকে বলা হয় রিসার্চ-ফান্ডিং। বিশ্বায়িত বৃহৎ পুঁজি এ বাবদ দরাজ হাতে টাকা ঢালে। উন্নয়নশীল দেশসমূহের মেধাকে তা আকৃষ্ট করে। তাদের বোঝানো চলে, এ মানবমুক্তিরই সোপান। সম্মোহিত হই সকলেই।
এসবের প্রভাব পড়ে আমাদের ছোটগল্পের জগতেও। একদিকে ঐতিহ্যাশ্রয়ী হওয়ার নামে গ্রাম্যতার আপাদমস্তক উদ্ঘাটন, অন্যদিকে আন্তর্জাতিকতার নামে গল্পের পটভূমি ইচ্ছামতো প্রসারণ, যেন গড়ানো পাথর, যাতে কোনো শ্যাওলা জমে না। ভাষার ব্যবহারেও দেখি একদিকে অশালীন গ্রাম্যতার এবং আঞ্চলিকতার উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রদর্শনী, অন্যদিকে অকুণ্ঠ মিশ্রণে ভাষার মেরুদণ্ডের সাড়ম্বর অবলুপ্তি। গত তিরিশ বছরে, বিশেষ করে থ্যাচার-রিগান স্ট্রাকচারাল অ্যাডজাস্টমেন্টের কাল থেকে শুরু করে, বাংলা ভাষায় নতুন কোনো ছোটগল্পের লেখক আমাকে আকৃষ্ট করেছে, বলতে পারি না। যে কোনো জায়গার বাংলা ভাষার লেখকের কথাই আমি মাথায় রাখছি। অবশ্য যতটুকু আমি পড়েছি, বা পড়তে পেরেছি, সেইটুকু সম্বল করেই আমার এ-কথা বলা। নির্বিশেষ মানুষের উদ্বেগের একটা জায়গা আগে ছিল, মিলিত মানুষের উদ্ধারের স্বপ্নও কিছু ছিল। এখন এসব চোখে পড়ে না। গল্পের একরকম স্বগতোক্তিতেই সমাপ্তি। চরিত্র যতই থাক।
গল্প লিখতে ‘ছোটো প্রাণ ছোটো ব্যথা’ অপরিহার্য নয়। কিন্তু প্রাণের স্পর্শে যেন তা দীন না হয়। এবং চিন্তা যেন গভীর থেকে আরো গভীরে কিছু খোঁজে। তা মানুষের সীমানাতেই। কিছু যদি না পায়, তবুও। বিশ্বাসে মাথা মুড়িয়ে শুরু করা কোনো গৌরবের কথা নয়। এবং ভঙ্গিসর্বস্বতা সাহিত্যিক অপরাধ।
তবে ছোটগল্প বিরল প্রজাতি হতে চলেছে, এ-কথা বলার সময় এখনো আসেনি। এবারে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার যিনি পেয়েছেন, অ্যালিস মুনরো, তিনি ছোটগল্পকার। নাদিন গর্ডিমার, কোয়েতজে, প্যাট্রিক হোয়াইট, মো ইয়ান – এঁদের গল্পও আমাদের ভাবায়, বিচলিত করে। মার্কেজও লিখেছেন বেশ কিছু স্মরণীয় গল্প। তবে এঁরা কেউ উত্তরাধুনিক নন। আশা করতে চাই উত্তরাধুনিক অভিসন্ধি মানুষ – সব জায়গাতেই যত তাড়াতাড়ি পারে, – যেন ধরে ফেলে। জীবনের অসংখ্য সম্ভাবনা, অকল্পনীয় বিস্ময়, অব্যাখ্যেয় বিড়ম্বনা, এগুলো প্রতিটি পরিস্থিতিতেই নতুন নতুন জন্মায়, ডালপালা ছড়ায়। সাহিত্যের সৃষ্টিশীলতাকে, তার প্রতিভার দূরগামিতাকে তারা প্রাণিত করে। রসদ জোগাবে ছোটগল্পকেও। এখানে, এবং অন্যখানে।