জীবনানন্দ দাশের ‘শিকার’

সরকার আবদুল মান্নান

সম্ভবত ১৯২৯ সালের কোনো এক সময়ে জীবনানন্দ দাশ ‘শিকার’ নামে কবিতাটি লিখেছেন। সংলাপ ও কথোপকথন নিয়ে দীর্ঘ কবিতা। সংলাপের ভেতরে অনেক সংলাপ এবং কথার ভেতরে অনেক কথার কোলাহল। কিংবা সংলাপের মধ্যে কোনো সংলাপ নেই। কথার মধ্যে নেই শব্দময়তা। অবচেতনের স্রোত প্রবাহিত হয় সংলাপহীনতায়, নিঃশব্দতায়।

কবিতাটিতে চরিত্র আছে কয়েকজন। তাদের কোনো নাম নেই। এরা হলো – ‘একজন শিকারি’, ‘আর জন’ কিংবা ‘একজন’, ‘আমি, ‘তুমি’ ইত্যাদি। এক সময় সংলাপ এত দীর্ঘ হয়ে যায় যে, তখন বোঝার উপায় থাকে না, কতজনের সংলাপ স্বপ্নের মতো মাখামাখি হয়ে যায় বিস্রস্ত ক্যানভাসে। তখন আর চিত্র বলে কিছু থাকে না। মুছে যায় মানবীয় জৈবিক গড়ন। শুধু ভাবনার বিচিত্র বিপর্যাস বঞ্চনার আলেখ্য হয়ে ওঠে। এত স্বর আর স্বরান্তরের মধ্যে, এত কণ্ঠ আর ধ্বনিময়তার মধ্যে শেষ পর্যন্ত পাঠক হয়তো একটি সুর খুঁজে পাবেন কিংবা কোনো সুর শেষ পর্যন্ত দানা বেঁধে

না-উঠলেও ভাবনার একটি গড়ন খুঁজে পাবেন, যেখানে বহুতর ভাবনার বিচিত্র কোলাহল তৈরি হবে। বিস্ময়-জাগানিয়া এ-কবিতাটি নিয়ে আমার ভাবনাগুলো উপস্থাপন করতে চাই।

কবিতাটি দেখতে কবিতার মতোই। অন্তত ২৬ ডিসেম্বর, ১৯৯৮ সালে দেশ পত্রিকার ‘জীবনানন্দ ২’ সংখ্যায় কবিতাটি যেভাবে মুদ্রিত হয়েছে তাতে কবিতার আদল আছে। কিন্তু মোটেই প্রথাগত নয়। সুব্রত চৌধুরী প্রথম পৃষ্ঠা জুড়ে এবং বাকি পৃষ্ঠার ডানদিকে বা বাঁদিকে অর্ধেক পৃষ্ঠা জুড়ে লম্বালম্বি যে-অলংকরণ করেছেন, তাতে দীর্ঘ এই বিপর্যস্ত জীবনালেখ্যের কবিতাটির গড়নে লাবণ্য ছায়া ফেলেছে। তারপরও প্রায় সাড়ে তিনশো পঙ্ক্তির দীর্ঘ এ-কবিতার পঙ্ক্তিবিন্যাসে ও অনুচ্ছেদ রচনায় বিপর্যস্ততা আছে। মর্মামিত্মক জীবনের করুণ আলেখ্য নিয়ে রক্তঝরা কবিতা জীবনানন্দ অনেক লিখেছেন; কিন্তু ‘শিকার’ কবিতাটিতে সংবেদনশীল জীবনের চেতন-অচেতনের যে রক্তাক্ত প্রবাহ রচিত হয়েছে তার কোনো তুলনা চলে না। অন্তরাশ্রয়ী সেই মর্মন্তুদ রক্তক্ষরণের বহিরাশ্রয়ী গড়ন কবিতাটি দেখলেই অনুভব করা যায়। বিশেষ করে পরাবাস্তব চরিত্রগুলো কার মধ্যে কখন কে ঢুকে পড়ে, কখন কে কার সংলাপ বলে কিংবা একজনই কি নিজের মধ্যে অনেককে ধারণ করে – ইত্যাকার জটিল এক কথন-সংকল্পনা স্পষ্টতই অনুভব করা যায় কবিতাটির গড়ন সংগঠনে। কিন্তু কবিতাটি দেখতে কবিতার মতোই।

আবারো বলি, কবিতাটির নাম ‘শিকার’। প্রথম চরিত্রটির নাম ‘একজন শিকারী’। সে বলে :

মিছেমিছি কেন অই শিকারীর সাথে

আমরা শিকারে যাই?

এ-অংশে একটি শিকারযাত্রার প্রসঙ্গ আছে এবং এ-শিকারযাত্রাটি ‘মিছেমিছি’, অর্থহীন। শুধু তাই নয়, ‘ওই শিকারী’ বলতে কোন শিকারির কথা বলা হয়েছে – দীর্ঘ এ-কবিতায় তার কোনো পরিচয় নেই। আর কী শিকার, কোথায় শিকার, কীভাবে শিকার, কেন শিকার, কখন শিকার ইত্যাকার কোনো প্রশ্নেরই প্রচল কোনো উত্তর পাওয়া যায় না কবিতাটিতে।

‘আর জন’ নামে আরেকটি চরিত্র প্রশ্ন করেছে : ‘শিকার জানে না সে কি?’ ‘অই শিকারী’র আরেকটি সর্বনাম পাওয়া গেল ‘সে’। এবং পূর্বের ‘অই’ আর ‘সে’ যদি একই চরিত্র বলে ভেবে নেওয়া যায় তাহলে ভাবতে সুবিধা হয়। চিমত্মায় একটি গড়ন তৈরি হয়; কিন্তু জীবনানন্দ দাশ সেই সুযোগ আমাদের দেন না। মানুষের চিমত্মার মধ্যে কোনো গড়ন থাকতে পারে – বিশেষ করে পারম্পর্য ও ধারাক্রম – জীবনানন্দীয় কাব্যভাবনায় এই মীমাংসায় পৌঁছানো দুরূহ। ‘আর  জন’ কে – এ-প্রশ্নেরও কোনো উত্তর নেই এবং শিকার জানা বা না-জানার যে-প্রশ্ন সে তুলেছে তার উত্তরও অপরিহার্য নয়। কিংবা যেসব চরিত্রের কথা সর্বনামে উল্লেখ করা হয়েছে তাদের পরিচয়ও অপরিহার্য নয়। তা হলে কী অপরিহার্য? অন্তর্গত বিচিত্র কামনার রক্তাক্ত পরিণতি? কিংবা এর কিছুই নয় – শুধু মর্মন্তুদ জীবনের অফুরন্ত চলা? কবিতাটি পাঠশেষে শুধু অফুরন্ত ভাবনার গোলকধাঁধায় পর্যবসিত হওয়া ছাড়া আর কোনো মীমাংসায় উপনীত হওয়া যায় না।

‘আর জন’ জিজ্ঞাসা করেছিল ‘শিকার জানে না সে কি?’ কিন্তু এই প্রশ্নের কোনো উত্তর না দিয়েই ‘একজন’ বলে ‘ধলা এক ঘোড়া শুধু আছে,’ ‘আর জন’ বলে :

দুধের ভিতর থেকে সেই যে মাখন তোলে

গয়লার ধলা মেয়ে ভোরের বেলায়

ফেনার ধোঁয়ায় তার দুই চোখ ঘোলা হয়ে আসে;

তাদের সবার কথা মনে হয় যেন

ঘোড়ার পিঠের দিকে চেয়ে, –

আমরা ঘোড়ার মুখ দেখি না ক’!

গোয়ালার মেয়ে সাদা হয় কিনা জানি না। কিন্তু ধলা হতে পারে। কেননা ধলা অস্বাস্থ্যের প্রতীক, রুগ্ণতার প্রতীক। কিন্তু সে মেয়েমানুষ। স্বপ্নের ধলা ঘোড়া সে। সুতরাং একজন বলে : ‘কেবল সে চলে যেতে আছে;’। লক্ষণীয়, ক্রিয়াপদটি হলো ‘আছে’। অর্থাৎ তার থাকা নিরন্তর চলে যাওয়া। চলে যাওয়ার জন্যই সে আছে। এই ‘সে’ কে? জীবনের আকাঙক্ষা, তৃষ্ণা – বিশেষত নারীতৃষ্ণা? স্পষ্ট করে

কোথাও এর উত্তর নেই। এক ধরনের পরাবাস্তর অনুভবের ভেতর দিয়ে লক্ষহীনতায় অবগাহন করার পথ খুলে যায় শুধু। ‘আর জন’ বলে :

কোথায় সে যায়?

আমরা জানি না কেউ!

তবু তার পিছে যেতে হবে?

স্বপ্নের ভিতরে যেন চলিতেছি!

‘আর জনে’র ওই সংলাপের মধ্যে চিমত্মার একটি গড়ন পাওয়া যায়। আমরা অনুভব করতে পারি, আকাঙক্ষার পেছনে মানুষের নিরন্তর চলার নিয়তি অতিক্রম করতে পারে না সে কখনোই। আকাঙক্ষার সেই ঘোড়া কখনো সাদা কখনো লাল। ‘আর জন’ তাই বলে, ‘আমাদের লাল ঘোড়া;/ আমাদের ঘোড়া এত লাল, – / তাহাদের লোম যেন কালো হয়ে আসে! ওদের গায়ের রং আমাদের ক্ষুধার মতন;’ – এই বিচিত্র ক্ষুধা-তৃষ্ণা, আকাঙক্ষার বহুতর রূপ আর রূপান্তর নিয়ে যে- জীবন সে-জীবনের দৌড় সাদা কিংবা লাল কিংবা অন্য কোনো রঙের ঘোড়ার মতো। কিন্তু তৃষ্ণার সেই রূপান্তরের গতি ও স্বরূপ সর্বদাই আনন্দের বা উজ্জ্বলতার স্মারক নয়। কখনো তা ক্রমেই অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে ওঠে। জীবনানন্দ দাশ অনুভবের কোনো এক অবচেতন জগৎ থেকে তুলে এনেছেন এসব মহার্ঘ্যবোধ কিংবা বোধের বহুধা বিদীর্ণ চিহ্নসকল। ‘আর জনে’র সংলাপে বোধের এ-বিসত্মার ক্রমেই প্রলম্বিত হতে থাকে এবং চেতন-অবচেতন কিংবা অবচেতনের নিরাবলম্ব পথে চলতে থাকে উলস্নম্ফনের আশ্রয় নিয়ে-নিয়ে। যেমন :

পৃথিবীর জল থেকে ফিরে

মিছেমিছি অন্য দিকে যায় এরা;

কোন্ ঘাস কোন্ জল এদের সান্তনা দেবে?

এরা ম’রে যাবে, –  আমরাও;

আমরা র’য়েছি বেঁচে পৃথিবীতে তবু,

সেইখানে আমাদের খুঁজে পাবে – দেখ;

বুড়ো পাখিদের মত সেইখানে থাকি না আমরা;

হাঁসের ছানার মত পাখনায় ভিজে’

ছোট এক পুকুরের পাড়ে

আমরা সেখানে থাকি;

মানবীয় আকাঙক্ষার এই হলো নিয়তি। তৃষ্ণার জল যেখানে

কানায়-কানায় পূর্ণ, মানুষ নিষ্ঠার সঙ্গে সেখানেই থাকবে, এমন নয়, জলহীনতার দিকেও তার ভেতরগত দুর্বোধ্য-যাত্রাকে থামাতে পারে না সে। তার কোনো সান্তবনা নেই, সুস্থিরতা নেই, লক্ষ্য নেই, স্থিরতা নেই। আমরা যদি সত্যি-সত্যি জীবনের সব সান্তবনার সীমায় পৌঁছে যেতে পারতাম তাহলে বেঁচে থাকার আর কোনো প্রয়োজন হতো না। জীবনানন্দীয় অনুভবে এই সত্য মিথে পরিণত হয়েছে যে,

তৃষ্ণা আছে বলেই আমরা বেঁচে আছি আর সে-তৃষ্ণার কোনো বার্ধক্য নেই, বুড়ো পাখিদের মতো নয় সে – হাঁসের ছানার মতো, অফুরন্ত প্রাণের কোলাহল নিয়ে ছোট কোনো পুকুরের পাড়ে জলের কাছে বসে থাকা।

তারপর বড় হই;

আমরা হই না তবু বুড়ো;

 

হাঁসের মতন ডিম পাড়ে সেইখানে

আমাদের হৃদয়ের আশা!

‘হাঁসের মতন ডিম পাড়ে’ – সোনার স্বপ্ন। রূপসী বাংলা কাব্যগ্রন্থের ‘সেই দিন এই মাঠ’ কবিতায় একই অনুভবের প্রকাশ ঘটিয়েছেন জীবনানন্দ দাশ। লিখেছেন :

সেই দিন এই মাঠ স্তব্ধ হবে নাকো জানি –

এই নদী নক্ষত্রের তলে

সেদিন দেখিবে স্বপ্ন –

সোনার স্বপ্নের সাধ পৃথিবীতে কবে আর ঝরে!

প্রতিনিয়ত স্বপ্নের মধ্যে মানুষ বেঁচে থাকে। কত যে স্বপ্ন, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। আর সেই স্বপ্ন ভেঙেও যায় প্রতিদিন। রক্তাক্ত হয় মানবীয় হৃদয়। সেই রক্তাক্ত স্বপ্নের জন্ম শুধু আলোকিত

অধ্যায় থেকে নয় – বীভৎসতার মধ্যে থেকেও জন্ম নেয় স্বপ্ন। আশা-জাগানিয়া সোনার ডিম নয় তা। জীবনানন্দ দাশ লিখেছেন :

হাঁসের মতন ডিম,

তবুও সোনার ডিম নয়!

খড়ের কুটার মাঝে অনেক ময়লা ডিমে অন্ধকারে বসে

ভেবেছি অনেক দিন এই কথা; –

 

এই ডিমে ব্যথা পাই;

স্বপ্নের মধ্যে আনন্দ থাকে, সুন্দর থাকে, অনন্য প্রত্যাশার সুপ্ত প্রবাহ থাকে; কিন্তু সব স্বপ্ন তা নয়। সব মানুষের স্বপ্নও তা নয়। বরং আধুনিক জীবনের বিপুল বৈপরীত্যের মতো কিছু স্বপ্ন কিংবা মানুষের স্বপ্ন শুধু জন্ম দেয় দুঃস্বপ্ন। অন্তর্গত আকাঙক্ষার আবেষ্টনে শুধু ব্যথার উদ্গিরণ। আর অপেক্ষা – অপ্রাপ্তির জন্য, আশাহত হওয়ার জন্য – ‘ওর চেয়ে বেশি ব্যথা আছে, -/ জানি আমি;’।

মানুষের এই যন্ত্রণার উৎস কোথা? কোথায় প্রতিদিন রচিত হয় মানুষের স্বপ্নবিলাসী আঁধার! জীবনানন্দ দাশ লিখেছেন :

কোনো দিন কড়ি ফেলে তেল আমি নেই নাই, –

তবু কোনো কুনো ব্যাঙ কানাকড়ি দেবে?

কানাকড়ি ছাড়া তবু তেল পাবে নাকি?

তাই আমি হিজলের গাছে

এবার লয়েছি নাও বেঁধে’!

­আধুনিক বিশ্বের যুদ্ধটাই হচ্ছে টাকা আর তেলের যুদ্ধ। সে-যুদ্ধ ব্যক্তিগত জীবনের অনৈতিহাসিক পটভূমি থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় ও বৈশ্বিক জীবনের ইতিহাসখ্যাত যুদ্ধের পটভূমিতে নিহিত থাকে টাকা ও তেলের লড়াই। পুঁজিবাদী সভ্যতার এ-নিষ্ঠুর অভ্যুদয়ের ইতিহাস জানতেন জীবনানন্দ দাশ। আর সে-ইতিহাসের চেয়েও অনেক রক্তাক্ত ইতিহাস রচিত হয়েছিল তাঁর ব্যক্তিজীবনের আলেখ্য। টাকা আর তেলের এক বিস্ময়কর সংযোগহীনতার মধ্যে কেটেছে তাঁর জীবন। সুতরাং হিজলের গাছে তাঁকে বাঁধতে হয়েছে নিঃসঙ্গতার নাও। কেউ নেই, কিছু নেই। প্রত্যাশার দুয়ার বন্ধ। আকাঙক্ষার জগতে খরা। তবুও মরে বেঁচে ওঠা সাড়ে সাতখানা চোরের মধ্যে কবির আধখানা চোর হওয়ার প্রত্যাশায় তার

সহায়-সম্বলহীন জীবনের কিংবা মননশীল মানুষের অস্তিত্ববিনাশী চিত্রই ফুটে উঠেছে। জীবনানন্দ দাশ লিখেছেন :

দাও ছাড়া কথা নেই;

সাড়ে সাত চোর যদি ম’রে বেঁচে’ ওঠে

আমি সেই আধখানা চোর হ’ব।

আধখানা চোর হলেই এ-সমাজে শিকার আর শিকারির দ্বন্দ্ব ঘুচে যায় না। শিকারযাত্রার বাহন রং বদলেও নিঃসংশয় হতে পারে না যে, কোথায় শিকারি! তবুও শিকার আছে শিকারি আছে, আছে শিকারযাত্রার বাহন। আর এসবের লক্ষ্য – আলোকিত সমাজ বিনির্মাণ? নিশ্চয়ই নয়। জীবনানন্দ দাশের স্বীকারোক্তি :

মেয়েমানুষের ব্যথা, –

আমার মদের মুখ নাই!

মদের পিপার পরে সারা রাত একা  ব’সে থেকে

আমি তবু মাংসের – মাংসের কথা ভেবে’ ভেবে’

মেয়েমানুষের স্বাদ চাই আমি শুধু;

এর চেয়ে কম কিছু নয়।

‘শিকার’ কবিতার অনেকটা যাত্রাশেষে এইখানে এসে অনুভব করা যায় যে, শিকারযাত্রার আয়োজনে কেন এত রহস্যময়তা! যেখানে বেদনার জায়গাটা প্রত্যক্ষভাবে কড়িকেন্দ্রিক নয় – নারীকেন্দ্রিক, সেখানে বাচন রহস্যময় হয়ে ওঠাই স্বাভাবিক। এবং শিকারযাত্রার পাত্রপাত্রী ও আয়োজনের দিগ্বলয় শৃঙ্খলার মধ্যে কিংবা ন্যায়সূত্রে গ্রন্থিত হওয়ার সুযোগ নেই।

নারী-মাংস-মদ – ভোগের এই আয়োজনের মধ্যে অর্থের, পুঁজির, ক্ষমতার সংযোগ আছে। নারীর শরীর, মাংস আর শিকারের মাংসের মধ্যে আস্বাদের তারতম্য আছে নিশ্চয় এবং তার সঙ্গে মূল্যবান মদের সংযোগ সহজপ্রাপ্য নয়। যদি কারো মদে মুখ নাও থাকে তার মাংসের কথা ভাবতে বাধা নেই কোনো। কিন্তু মেয়েমানুষের ব্যথা, মেয়েমানুষের স্বাদ চেয়ে-চেয়ে শিকারযাত্রার আয়োজনে আর চেতন-অবচেতনে প্রবহমান বোধের যন্ত্রণায় মুমূর্ষু কবি শুধু যাত্রাপথের বিবরণ লিপিবদ্ধ করেন। শিকার আর শিকারির দ্বৈরথ যখন শেষ এবং যখন উৎসবের আয়োজন তখন কোনো এক শিকারযাত্রী সে-উৎসবের বিবরণ দিয়ে-দিয়ে অপ্রাপ্তির যন্ত্রণাকে রক্তাক্ত করে তোলে।

গাছের খোড়লে থেকে সারা দিন ব’সে

পেঁচানীর কাছ থেকে পেঁচার মতন

চুমো খেয়ে তোমরা হয়েছ ক্লান্ত, – জানি -;

কিন্তু আমি কিছু পাই নাই!

 

আমরা হই নি ক্লান্ত;

 

তোমরা অনেক চুমো পেয়েছ তবু;

পেঁচার মতন তবু, – ঘুঘুর মতন কিছু নয়;

 

জানি আমি; – চুমো তবু চুমো;

তোমরা পেয়েছ চুমো, আর সব চুমোর সমত্মান

তোমরা পেয়েছ;

আমি তবু একদিন ঘুম থেকে উঠে

রাতের বিছানা ধ’রে শুয়ে থাকি;

তবুও দেখিতে হবে চুনের মতন আলো এসে

চুন শাদা ক’রে গেছে জুল্পীর কাছে;

কাদাখোঁচা জলপিপি আবার এসেছে

চোখের ঘুমের পাতা খুঁড়ে’-খুঁড়ে’ খেতে;

নষ্ট বিড়ালের মতো সারাদিন মন

শুক্নো পাতার পিছে ছুটে’ ছুটে’ অবসন্ন হয়!

প্রেম কিংবা যৌনতা এবং প্রেম বা অপ্রেমের সমত্মান – এসবের উৎসবে যারা ক্লান্ত তাদের সময় সান্তবনার অববাহিকা খুঁজে পায়। অনেক না-পাওয়ার সঙ্গ-অনুষঙ্গের মধ্যে জীবনের কোলাহলের আস্বাদ অনুভূত হয়। জীবনের সার্থকতা কিংবা ব্যর্থতার প্রশ্ন নয় এখানে – প্রশ্ন জীবনের – জীবনের অনিবার্য অর্জনের। সুতরাং যারা ‘তোমরা’ পেয়েছে চুমো আর চুমোর সন্তান তারা ঘুম থেকে উঠে রাতের আস্বাদশেষে দিন খুঁজে পায় – আলোকোজ্জ্বল দিন। কিন্তু এই শিকারযাত্রী ঘুম থেকে উঠে দিন খুঁজে পায় না। রাতের বিছানা ধরেই সে শুয়ে থাকে আবার। কিন্তু দিন যায়, ‘চুনের মতন আলো এসে’ চুনসাদা করে যায় চুল। অর্থাৎ বয়স বাড়ে, প্রৌঢ়ত্ব প্রাপ্ত হয় জীবন। কাদাখোঁচা, জলপিপি আসে-যায় – জীবনের কোলাহল চলেই। কিন্তু কিছু মানুষের মন নষ্ট বিড়ালের মতো সারাদিন শুকনো পাতার পিছে ছুটে-ছুটে অবসন্ন হয়। তার পরেও ‘পৃথিবীতে ক্লান্ত হয়ে আমরা তো বেঁচে থাকি তবু;’। তারপরেই রচিত হয় বিপরীতের ঐকতান। ‘চুমো পেয়ে বেঁচে থাকি;/ তবু জানি অন্য দিকে কোনো এক চুমো বেঁচে থাকে/ আমাদের সব মেয়েমানুষেরা মরে গেলে!’ অন্য এক জীবনতৃষ্ণার পটভূমিতে – মানুষের অন্তর্গত মৃত্যুরতির উত্থানের অনুষঙ্গে জীবনানন্দ দাশ ‘আট বছর আগের একদিন’ কবিতায় লিখেছেন:

জানি – তবু জানি

নারীর হৃদয় – প্রেম – শিশু – গৃহ – নয় সবখানি;

অর্থ নয়, কীর্তি নয়, সচ্ছলতা নয় –

আরো – এক বিপন্ন বিস্ময়

আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে

খেলা করে;

আমাদের ক্লান্ত করে

ক্লান্ত – ক্লান্ত করে;

লাশকাটা ঘরে

সেই ক্লামিত্ম নাই;

এই মৃত্যুরতির উলটো পিঠ আছে। ‘পৃথিবীতে ক্লান্ত হয়ে আমরা তো বেঁচে থাকি তবু;’ এবং সেই বেঁচে থাকার জন্য নারীর হৃদয়, প্রেম, শিশু, গৃহ কিংবা অর্থ কিংবা সচ্ছলতা নয় সবটুকু। অন্য এক জীবনের চুমো আমাদের বাঁচিয়ে রাখে। জীবনানন্দ দাশ লিখেছেন :

রূপার হাঁসের পাখা দেখি নাই,

তবুও রূপার হাঁস আছে

কোনো এক পালকের বিছানার পরে;

সাত দিন সাত রাত শেষ হ’লে বনের ভিতরে

যে মানুষ ম’রে না ক’ তার মেয়েমানুষ সে আছে -।

সমাজ-সভ্যতারই শুধু প্রত্ন-ইতিহাস থাকে না, সেই সমাজ ও সভ্যতার প্রত্যেক ব্যক্তিমানুষের মনোজগতেরও বিস্ময়কর এক প্রত্ন-ইতিহাস থাকে; লোককাহিনি, লোক-ঐতিহ্য ও লোকবিশ্বাসের পটভূমিতে যে-ইতিহাস সে লালন করে চেতন-অবচেতনের গোপন এক অধ্যায়ে। সুতরাং রুপার হাঁসের পাখা না দেখলেও রুপার হাঁস আছে। পালকের পালঙ্কে যে রাজকুমারী আছে সেই পালঙ্ক আর সেই রাজকুমারী চিরকাল আমাদের রক্তমাংসের রাজকুমারদের অবচেতন মনের অতলে জেগে থাকা শাশ্বত এক সুন্দর। সুতরাং ‘সাত দিন সাত রাত শেষ হ’লে বনের ভিতরে/ যে মানুষ মরে না ক’ তার মেয়েমানুষ সে আছে -।’ আর জীবনানন্দ দাশের মতো নারীসংসর্গবিহীন শিকারিরা সেদিকেই যায়। অন্য একটি কবিতায় তাই তিনি লিখেছেন :

ডাকিয়া কহিল মোরে রাজার দুলাল, –

ডালিম ফুলের মতো ঠোঁট যার, – রাঙা আপেলের মতো লাল যার গাল,

চুল যার শাওনের মেঘ, – আর আঁখি গোধূলির মতো গোলাপি রঙিন,

আমি দেখিয়াছি তারে ঘুমপথে, – স্বপ্নে – কতদিন।

কিন্তু ঘুমপথে, স্বপ্নে মানুষ কত দিন সন্তুষ্ট থাকতে পারে, ধলা ঘোড়ার পিছু-পিছু কত হাঁটতে পারে মানুষ! সুতরাং শিকারি দুজনের মধ্যে কথা হয় :

দেশে ফিরে গিয়ে

আমার করিতে হবে বিয়ে!

­­­­­

হাঃ! হাঃ! হাঃ!

আমি এসবের নই;

 

আমিও না;

আমাদের ফিরে যেতে হবে;

কবিতার মধ্যে এভাবে চলে চেতনাপ্রবাহের স্রোত। সেই স্রোতে ঘূর্ণন আছে, আছে উলস্নম্ফন। কিন্তু সেই ঘূর্ণন ও উলস্নম্ফনের ভেতরে ভাবনার অন্তর্গূঢ় শৃঙ্খলা অনুভব করা যায়। ফলে কবিতাটি আর মায়াবী শব্দের প্রলাপ হয়ে ওঠে না। ঘটনার এই পর্বে যখন ‘(শিকারী দুজন ফিরে চ’লে যায়।)’ তখন অন্য এক ভাবনার মধ্যে অনির্দিষ্ট চরিত্রের সংলাপ শুরু হয়। সংলাপের কিছু অংশ উদ্ধৃত করি।

তুমি

তোমার পিছনে কারা?

আমি

আমার পিছনে আমি এতদিন ঘুমে জেগে’ কি কয়েছি কথা

কেউ তুমি শুনেছ কি?

চাঁদের আলোয় এসে যেন কোন চিতাবাঘ হ’য়ে

ঘাড় ধরে কামড়ায়ে গিয়েছে আমারে আকাশের চাঁদ যেন!

ব্যথা পেয়ে তবুও দেখেছি

চিতার উজ্জ্বল ছালে রূপ লেগে আছে!

চোখে তার পৃথিবীর কোনো এক মেয়ের মতন

ভালোবাসা আছে!

তাই আমি ক্লান্ত হ’য়ে আছি।

বাচনিক এ-বিশ্বব্যবস্থায় বাচনের উদ্দেশ্য হলো যোগাযোগ স্থাপন। কিন্তু এ-কবিতায় ‘তুমি’ ‘আমি’ নামক যেসব চরিত্র কথা বলে ঘুমে বা জাগরণে কিংবা ঘুমপথে, তারা কেউই অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে না। তারা অথবা এখানে অনেকে অথবা নির্দিষ্ট কেউ নয় – কোনো একজন নিজের সঙ্গে কথা বলে নিজে সর্বক্ষণ। ‘আমার পিছনে আমি এত দিন ঘুমে জেগে’ কি কয়েছি কথা/ কেউ তুমি শুনেছ কি?’ যে-কথা নিজের পেছনে থেকে নিজেই বলে যায় সে-কথা ‘কেউ তুমি’ শোনে কিংবা শোনে না। যখন সুনির্দিষ্ট ‘তুমি’র পূর্বে অনির্দিষ্টবাচক সর্বনাম ‘কেউ’ ব্যবহার করা হয়, তখন বক্তব্যের কাব্যব্যঞ্জনা ও রহস্যময়তা আশ্চর্য সমৃদ্ধি লাভ করে এবং রহস্যময়তার প্রগাঢ় কুজ্ঝটিকা আবর্তিত হতে থাকে অনির্দিষ্ট বলয়ে। সুতরাং তখন কাব্যের অনিবার্য আবাহনে লেখা হয়ে যায় ‘চাঁদের আলোয় এসে যেন কোন চিতাবাঘ হ’য়ে/ ঘাড় ধরে কামড়ায়ে গিয়েছে আমারে আকাশের চাঁদ যেন!’ আকাশের চাঁদ চাঁদের আলোয় যখন চিতাবাঘ হয়ে যায় তখন সুন্দর আর হিংস্রতার যুগলবন্দি অনুভব করা যায়। কিন্তু সেই হিংস্রতার অন্য এক স্বরূপ বিস্ময়কর মধুরিমা লাভ করে জীবনানন্দীয় অনুভবপুঞ্জে। চিতারূপী চাঁদ যখন কামড় বসিয়েছে কবির ঘাড়ে, তখন তিনি ব্যথা পেয়েছেন। কিন্তু যন্ত্রণাই শেষ কথা নয় – রক্তক্ষরণের ভেতরেও অনুভবের অন্য এক সৌন্দর্য মূর্ত হয়ে ওঠে, যখন কবি বলেন – ‘তবু আমি দেখেছি/ চিতার উজ্জ্বল ছালে রূপ লেগে আছে!/ চোখে তার পৃথিবীর কোনো এক মেয়ের মতন/ ভালোবাসা আছে!/ তাই আমি ক্লান্ত হয়ে গেছি।’ এই ক্লামিত্ম কেন? রূপ আর রূপহীনতার দ্বন্দ্বে ক্ষতবিক্ষত মানুষের রক্তক্ষরণ? সুন্দর আর অসুন্দরের সংঘাতে বিদীর্ণ মানবাত্মার অসহায়ত্ব? ভালোবাসাবোধে সমৃদ্ধ হৃদয় শুধু ভালোবাসাহীনতার মধ্যে আবর্তনের যন্ত্রণা? এই দ্বৈরথ জীবনানন্দীয় কাব্য-ভাবনার একটি ঘূর্ণায়মান অনুভবপুঞ্জ। সুতরাং ‘তুমি’ নামক চরিত্রটি বলে :

কোথায় যেতেছ তুমি? পৃথিবীর শেষে?

তুমি খুশি হবে নাকি পৃথিবীতে থেকে?

অন্য সকলের মত ডিমের হলুদ খেয়ে তুমি

স্বাদ তবু পাবে নাকি?

জলের পদ্মের বড় পাতার নীচেতে

ছায়া খুঁজে থাকিবে না মাছের মতন?

– মাছের আঁশটে গায়ে লেগে’

কোথাও পুঁটির মুখে রূপ খুঁজে’?

ডিমের হলুদ খেয়ে সন্তুষ্ট হয়ে পৃথিবীতে সুখে-শামিত্মতে বসবাস করা সাধারণ মানুষের কাজ। তাদের সুখের অনুভব ডিমের কুসুম পাওয়ার একটি অসাধারণ প্রতীকের মধ্যে কবি ধরতে চেয়েছেন। একটু নির্জন ছায়া, সামান্য আশ্রয়, বোধের মধ্যে ভালোবাসার সামান্য আবাহন – ইঁদুরের শরীরের ঘ্রাণ নিয়ে ছোট এক ইঁদুরের সঙ্গে ভালোবেসে নির্ভয়ে থাকার প্রত্যয় ‘কমলালেবুর মত লাল রোদ গিলে’ – বেঁচে থাকার এসব বিচিত্র অনুষঙ্গ কোন অর্থে তাৎপর্যময়? বেঁচে থাকার এই যন্ত্রণা কিংবা অর্থহীনতা সবচেয়ে তাৎপর্যময় হয়ে ওঠে যখন ‘তুমি’ চরিত্রটি বলে :

­- অশত্থ বটের গাছে পাখীদের মত

 

ব’সে থেকে দুই ঠোঁট বাঁকা হ’বে নাকি!

বুড়ো পাখীদের মত হ’বে নাকি আর

পৃথিবীতে ব’সে থেকে!

এইভাবে একঘেয়ে জীবনের মর্মন্তুদ বিবরণ লিপিবদ্ধ হয়েছে কতগুলো প্রতীকের মধ্য দিয়ে, প্রকৃতি থেকে নেওয়া জীবনানন্দীয় কতগুলো রূপকের আশ্রয়ে। বিশেষ করে কবি যখন বলেন, ‘অশথ বটের গাছে পাখীদের মত/ ব’সে থেকে দুই ঠোঁট বাঁকা হবে নাকি।’ ভালোবাসাহীন, সৌন্দর্যহীন, অনানন্দিত উৎসব কিংবা ভোগ থেকে ভালোবাসাসমৃদ্ধ, সৌন্দর্যময় ও আনন্দিত জীবনের অপেক্ষায় থেকে-থেকে বুড়ো হয়ে যাওয়ার যন্ত্রণার প্রতীক হলো ‘বাঁকা ঠোঁট’। সসত্মা আনন্দ, যার ভোগের মধ্যে যারা নিমজ্জিত থাকে, নারীর স্বপ্নের হৃদয় যারা স্বপ্ন দিয়ে, অনুভব-অনুভূতি দিয়ে বুঝতে পারে না – শুধু মুখের স্বাদ দিয়ে বোঝে এবং সমত্মানের জন্ম দিয়ে যায়, তাদের মতো নন কবি। কেননা, ‘স্বপ্ন নয় – কিন্তু তবু যাদের হৃদয় জ্ঞান আছে/ তাদের ঠোঁট বাঁকা।’ এর পরেই কবি লিখেছেন :

জানি আমি,

পৃথিবীতে ব’সে থেকে তাহাদের রোম সব শাদা হ’য়ে গেছে,

তাদের কপালে শিঙ্ পেঁচার মতন জেগে ওঠে;

অনেক রাতের বেলা জেগে’ থেকে থেকে তাহারা তারার কাছ থেকে

ফিতা আর চাখড়ির শাদা লাঠি বার করে আনে;

তারপর পৃথিবীর মানুষের হৃদয়েরে মেপে ফেলে।

 

– জানি;

 

স্বপ্ন নয়, – তাদের হৃদয়ে বোধ আছে!

পাঁকের জলের মত তারা নয়, – তাহাদের গভীরতা আছে!

তবু তারা ভালোবাসে!

এই স্থিতধী, হৃদয়বান ও ভালোবাসাকাতর কিছু মানুষের রক্তাক্ত স্বরূপের চিত্র পাওয়া যায় জীবনানন্দ দাশের অসংখ্য কবিতায়, গল্পে ও উপন্যাসে। বলা যায়, এ হলো জীবনানন্দীয় অনুভাবনার একটি কেন্দ্রবিন্দু এবং তাঁর ব্যক্তিজীবনের সবচেয়ে মর্মন্তুদ অধ্যায়। এ-বিশ্বাস জীবনানন্দ দাশের সারাজীবনই ছিল যে, মননশীল মানুষ, গভীর চিমত্মাশীল মানুষ, ন্যায়নিষ্ঠ মানুষ শরীর ও মনের অনেক আকাঙক্ষা ও প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হয়। বিশেষ করে নারীপ্রেম চিরকালই বৈদগ্ধ্যের পরিপন্থী। ফলে তাঁর কবিতার মতো তাঁর গল্পে ও উপন্যাসে বঞ্চিত মানুষের ভিড়ে, নিঃসঙ্গ ও রক্তাক্ত মানুষের

ভিড়ে কোনো নারী নেই – সবাই পুরুষ। ‘শিকার’ কবিতায় সর্বনামে যেসব চরিত্রের স্বগত সংলাপ রচিত হয়েছে, সে-সংলাপের ভাষা-বৈশিষ্ট্যের মধ্যে পুরুষকণ্ঠই অনুরণিত হয়েছে এবং জীবনানন্দ দাশ তাদের স্থাপন করেছেন রহস্যময় দূরতম কোনো পাহাড়ের তলদেশে।

তবুও তারার মত আমি কোনো সবুজ পাহাড়ে

অন্ধকারে তাহাদের দেখি নাই!

তারা পাহাড়ের নীচে তারার আলোর মত আছে;

সেইখানে? ঘোড়া আর কুকুরের সাথে?

মানুষের সঙ্গে নয়, ঘোড়া আর কুকুরের সঙ্গে। এই নৈঃসঙ্গ্য কিংবা জীবনের কোলাহল থেকে দূরবর্তী ওই মানুষগুলো অলস নয়। অধিকন্তু গোপন এক চৈতন্যের প্রগাঢ় দায়বোধ থেকে এরা সর্বদাই সচেতন, সচেষ্ট। এদের হৃদয়ের পরিচয় দিতে গিয়ে জীবনানন্দ দাশ লিখেছেন :

ছোট মেয়েদের মত হ’য়ে গেছে আমার হৃদয়!

পৃথিবীর অন্ধকারে ভয় পেয়ে তবু সে পারে নি ঘুমাতে,

লুকাতে চেয়েছে মুখ বিছানার কাপড়ের তলে;

সেইখানে স্বপ্ন খুঁজে ভুলিতে চেয়েছে ব্যথা,

তবু তার বুড়োরা তো ঘুমায়েছে;

তাহারা ঘুমায়।

বিস্ময়কর সহজতার মধ্যে আনন্দিত এক জীবন কাটাতে চান কবি। স্বপ্নের খোঁজে, সুন্দরের খোঁজে আর সৃষ্টিতে প্রেরণার এক জীবন অতিবাহিত করতে চান কবি। কিন্তু কখনো সম্ভব হয় না তা। নির্দয় পৃথিবীতে অন্ধকার গাঢ়বদ্ধ হয়। ভয় জেগে থাকে সর্বত্র। তাই বেঁচে থাকা কবিদের মতো সৃষ্টির শিকারযাত্রায় নিবেদিত পূর্বতন কবিরাও ঘুমোতে পারেনি নিশ্চয়। স্বপ্ন খুঁজতে গিয়ে, সৃষ্টির সোনার হরিণের পেছনে ছুটতে গিয়ে তারা ক্ষত-বিক্ষত হয়েছেন। রক্তাক্ত হয়েছেন। এ-যন্ত্রণার বিস্ময়কর বিবরণ লিপিবদ্ধ হয়ে যায় কবির হৃদয়-নিংড়ানো নিবেদনে। জীবনানন্দ দাশ লিখেছেন :

আমি এক বোতলের মত ক’রে তোমার নিকটে যদি রাখি

আমার এ হৃদয়েরে, –

তুমি তার ছিপি খুলে দেখো, –

কিছু কি দেখিতে পার?

ছিপি খুলে দাও;

আমি এক কাচের গেলাসে সব হৃদয়ের ঢেলে’

তোমার ঠোঁটের কাছে তুলে ধরি যদি;

সেই জলে কার যেন মুখ ভেসে ওঠে!

চেয়ে দেখ, –

তবু তারে কোথাও কি দেখা যায়?

… কোথায় সে চলে যেতে আছে!

কবিতার মধ্যে লেখা আছে, ‘তোমার নিকটে যদি রাখি’ – এই ‘তোমার’ সর্বনাশটি কোন নামের – কে এই তুমি? প্রিয়া, পৃথিবী প্রেম? কিংবা কবির নিজেরই অন্য কোনো সত্তা? কিন্তু সে যাই হোক না কেন, জীবনের কাছে কবি-হৃদয়ের মর্মামিত্মক আর্তি রক্তাক্ত স্বরূপে উন্মোচিত হয়েছে। হৃদয়কে জলের মতো কাচের গস্নাসে ঢেলে উপস্থাপনের এই বোধ, এই শব্দকলা বাংলা কবিতার ইতিহাসে নিশ্চয়ই সহজলভ্য নয়। জীবনানন্দীয় বোধের এই জগৎ,

তৃষ্ণা-কাতরতা ও স্বপ্নের বিসত্মার এবং শব্দ-কল্পনায় রহস্যময়তা ক্রমেই আশ্চর্য এক গতিময়তা ও উজ্জ্বলতা লাভ করে। সংবেদনশীল পাঠক সেই গতি, আর্তি আর আহবানের মধ্যে অফুরন্ত এক মায়ার জগৎ খুঁজে পান। নিরন্তর অন্বেষণের এই জগতে ইঁদুরেরা খুঁজে ফেরে সোনালি ধানের শিষ, আর ইঁদুরদের খুঁজে ফেরে পেঁচা। কিন্তু এই অন্বেষণের অন্য এক জটিল হিসাব আছে – চেতন-অচেতন আর অবচেতনের স্তরান্তর আছে। কল্পনাপ্রতিভার ঐশ্বর্যে তাই অন্বেষণ লৌকিক-অলৌকিক আর অতিলৌকিকতা পেরিয়ে যেতে পারে অবলীলায়। কবি লিখেছেন :

সেখানে পেঁচার পাখা রূপার মতন,

তাদের কপাল থেকে দুই শিঙ উঠে

চাঁদের শিঙের সাথে মিশে গেছে যেন;

সেই সরু পোলের উপর দিয়ে হেঁটে

মুখের রূপের মত কারা সব আসিতেছে যেন!

রূপ তাই বেড়ে গেল এত!

কবিতায় রহস্যময় এই যে রূপের বিবরণ আছে যা পরাবাস্তবতার আলো-আঁধারে কোনো এক স্বপ্নে কল্পনায় মূর্ত হয়ে ওঠে, তার কি কোনো বাস্তবতা নেই? পৃথিবীর মানুষেরা কি এর খোঁজ পায় না তাদের প্রতিদিনের জীবনে? সেও কি কোনো এক সোনার হরিণের মতো চিরকাল শিকারির নাগালের বাইরেই থেকে যায়? কিন্তু কবি বলেন, ‘তবু তারে পৃথিবীতে চাই আমি!’ যারা এই রূপ-শিকারি, যারা সুন্দরের স্রষ্টা, অমৃতে অধিকার যারা লাভ করতে চান তাদের পান করতে হয় গরল। বিষণ্ণ হতে হয় তাদের। কষ্ট পেতে হয় জীবনভর। এই নিয়তি অনিবার্য। গ্রিক ট্র্যাজেডির মতো যতই তারা সত্যকে, সুন্দরকে, কল্যাণকে, আনন্দকে খুঁজে পেতে চায় ততই তাদের পেরিয়ে যেতে হয় মিথ্যা, অসুন্দর, অকল্যাণ আর নিরানন্দের বিষণ্ণ এক জগৎ। এই দুয়ের যুগলবন্দিত্ব অতিক্রম করতে পারে না কেউ। চাঁদের আলোয় এক সমুদ্রের নৌকার মতো যে-হৃদয় সুন্দরে আরোহণ করতে চায়, সে একা। কোনোখানে কেউ তার সহচর থাকে না। সৃষ্টির সৌন্দর্য শিকারির লাল ঘোড়া, সাদা ঘোড়া, কালো ঘোড়া কোথায় হারিয়ে যায়। আর ‘আমি’ ‘তুমি’ ‘সে’ নামের এসব প্রতিভূ শেষ পর্যন্ত ‘আমি’তেই আপন হয়ে ওঠে। আলাদা কোনো স্বরূপে অনন্য অস্তিত্ব হিসেবে কবিতায় খুঁজে পাওয়া যায় না। মনে হয়, কবি তাঁর ‘আমি’ স্বরূপের মধ্যে খুঁজতে চান তুমি, সে প্রমুখকে। কিন্তু সংলাপ-সংকল্পনায় শেষ পর্যন্ত ‘তুমি’ বা ‘সে’কে আর খুঁজে পাওয়া যায় না। কেননা যিনি সৃষ্টি করেন তিনি ‘তুমি’ বা ‘সে’ নয়, তিনি একান্তই ‘আমি’। এই নিঃসঙ্গ ‘আমি’ শুধু নিরন্তর পূর্বপুরুষদের সঙ্গ পায় : ‘যে মরে গিয়ে রয়েছে পিছনে;’। অর্থাৎ সেই কবি যিনি পথ দেখান, যিনি কবিতা শিকারের পেছনে ঘোড়া ছুটিয়েছিলেন। জীবনানন্দ দাশ লিখেছেন :

ময়লা আলোয় তার ডানা যেন দেখিয়াছি আমি

মাঝ-সাগরের ঢেউ ভেঙে’ ভেঙে’ আসিতেছে কাছে;

আমারে সে নিয়ে যাবে;

শান্ত ঘুঘুর মত এক রাতে তবুও হৃদয়

শেষের চাঁদের শীতে বইঠার পরে

একাই ঘুমায়ে থাকে;

সেই ঘুম ভেঙে’ দিয়ে তবু

কোলের ছেলের মত কেঁদে’ ওঠে ঢেউ!

মাঝ রাতে মোম জ্বেলে কে তুমি এসেছ!

চোখ কচ্লায়ে উঠে দেখি নাই আর, –

বাতাসে মোমের গন্ধ প’ড়ে থাকে পিছনের সাগরে! …

‘সমুদ্রের বড় সেই সাদা পাখি’ চিরকাল জীবনানন্দকে সৃষ্টির

আনন্দ-বেদনায় জাগিয়ে রেখেছে। জীবনের প্রতি গভীর এক মমত্ববোধ কিংবা ভালোবাসাহীন জীবনের যন্ত্রণা অথবা এই উভয়কেই পাওয়ার যাত্রাপথে কখনো-কখনো বিরতি এসেছে, ঘুম পেয়েছে। কিন্তু জীবন-সমুদ্রের ঢেউ কোলের ছেলের মতো কেঁদে উঠেছে। জীবনের প্রতি এই মায়া, বাৎসল্যের মতো ভালোবাসা – জীবননন্দীয় বোধের অনন্য স্বরূপের স্বীকারোক্তি পাওয়া গেল এই প্রথম এবং কবিতাটিতে শিকারযাত্রার যে-আয়োজন বর্ণিত হয়েছে তার মূলেও আছে ব্যক্ত-অব্যক্ত, প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য জীবনে সকল রহস্যকে কবিতা-শিল্পের অস্ত্রে শিকারের সংকল্পনা। কিন্তু কবিতা শিকারের সেই যাত্রাপথে অন্য কোনো কবি যদি ঢেউ ভেঙে-ভেঙে বারবার কাছে এসে পড়েন তাহলে যাত্রা অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। তাই কবির জিজ্ঞাসা ‘কোথায় সে নিয়ে যাবে?’ আর এ-অনিশ্চয়তার বোধ থেকেই কবি তাঁর দ্বিধার বিবরণ দিয়েছেন, ‘ভয় হয় – আমি তারে এক দিন ভালোবাসি যদি!’

ঝরা পালকের পর্বে জীবনানন্দ দাশ নজরুল ঘরানার আবহে কবিতা লিখেছিলেন এবং তারপর অতি অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন তাঁর নিজস্ব কাব্যভাষা ও বোধের সর্বগ্রাসী জগৎ। কিন্তু তবুও এই কবিতায় তিনি ধরতে চেয়েছেন অনুকরণের চিরায়ত পরিণতিকে। তিনি লিখেছেন :

তারে ভালোবেসে তুমি ঢের দূরে চ’লে যেতে পার,

সেখানেও সুখ আছে;

সেইখানে হৃদয়ের স্বপ্নের শিশুরা সব বড় হয়ে বেড়ে গেছে, –

ঢের বড় সুন্দরীর মাংসের মতন!

সেইখানে রূপসীর মাংসে শুধু রূপসীর মাংস জন্ম লয়,

তারপর মাংসে পোকা পড়ে যায়!

সবচেয়ে রূপ যারা ভালোবাস

তাহারা রূপের স্বপ্ন ভালোবাসে সব চেয়ে!

তবুও সেখানে সব স্বপ্ন নষ্ট হয়!

অনুকরণের মধ্যে আনন্দ নেই, সৃষ্টির বেদনা নেই, উল্লাস নেই। রবীন্দ্র ও জীবনানন্দ প্রভাবিত কবিদের পরিণতি তারই প্রমাণ। একটি স্বপ্নের অঙ্কুর যখন শব্দপ্রতিমার সংগঠনে নির্দিষ্ট রূপ পরিগ্রহ করে তখন তার মতো আর একটি রূপ রচনা রূপ সৃষ্টি নয়। এই সৃষ্টিহীনতার অক্ষম প্রয়াসকে ফুটিয়ে তুলতে কবি ‘রূপসীর মাংসে শুধু রূপসীর মাংস জন্ম’ নেওয়ার মর্মন্তুদ রূপকল্পটি ব্যবহার করেছেন। এই কবিগণ মৃত হরিণ শিকার করে যেন। এদের স্বপ্ন বিনষ্টির মধ্যে শেষ হয়। কবির জিজ্ঞাসা, ‘কারা তবু সেইখানে যায়?’ এই নির্মম জিজ্ঞাসার একটি বিস্ময়কর জবাব আছে। জীবনানন্দ দাশ লিখেছেন :

পৃথিবীতে বিবাহের বিছানায় শুয়ে

যাহারা অনেক ক্লান্ত হ’য়ে গেছে।

–  তাহাদের ঢের অবসাদ,

তবু তারা আরো ক্লামিত্ম চায়;

তাহাদের মাংস ছুঁয়ে দেখেছ কি?

কেউ হয়তো দেখেছে কিংবা দেখেনি। তারও এক অতি সংক্ষেপ্ত উত্তর আছে এ-কবিতায়। কিন্তু যারা সৃষ্টিশীল মানুষ, যারা মাংসের সত্মূপে মাংস রেখে পরিমাণ বাড়িয়ে তোলে না, শুধু তাদের যন্ত্রণার কথা আছে এ-কবিতায়। তারা জানেন যে, বিপরীতের ঐকতান ছাড়া সৃষ্টি সম্ভব নয় এবং সেই ঐকতানের মধ্যে কল্পনাপ্রতিভার বহুতর বিপরীত রূপের, এবং রূপ ও অরূপের অন্বয় অনিবার্য। কবিতাটির মধ্যে বহুবার নারীপ্রতিমার যে বিচিত্র স্বরূপ আঁকা হয়েছে সেখানেও ধরা দিয়েছে সৃষ্টিশীল মানুষের জীবনতৃষ্ণার পটভূমিতে নারীতৃষ্ণার ও নারীস্বভারের বৈচিত্র্য। এখানে নারী সৃষ্টির প্রতীক, ভালোবাসার প্রতীক, যৌনতার প্রতীক, স্থূলতার প্রতীক। জীবনানন্দ

দাশ লিখেছেন :

এইখানে হালে ব’সে

পৃথিবীর মেয়েদের রূপ তবু আমার পড়েছে মনে;

তাদের সাড়িতে আর দাঁত নেই;

তাদের নাকে ডাঁশা ভেঙে’ পড়ে গেছে;

তাহাদের পেট থেকে অনেক সমত্মান

কৃমির মতন ক’রে খেয়ে গেছে তাহাদের;

কোনো দিন যারা আর মরে না ক’ তাহাদের মনের ভিতর

রূপ হয়ে বেঁচে আছে তারা শুধু!

এই হলো জীবনানন্দীয় বোধে সৃষ্টিশীল মানুষের পরিণতি। নৈঃসঙ্গ্যের সকল পর্যায়ে, কিংবা বিপর্যয়ের চরম অবস্থায়ও একজন কবি ভালোবাসেন সৃষ্টির প্রত্যয় ও প্রেরণার মধ্যে থাকতে। আর সে-সৃষ্টিই প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠে কবির। স্রষ্টা ও সৃষ্টির এই দ্বৈরথ মূর্তমান হয়ে উঠেছে অসাধারণ এক রূপকল্পের ভেতর দিয়ে – ‘তাহাদের পেট থেকে অনেক সন্তান/ কৃমির মতন করে খেয়ে গেছে তাহাদের;’। ফলে স্রষ্টা মরে যায়, কিন্তু সৃষ্টি বেঁচে থাকে চিরায়ত মহিমায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সৃষ্টি ও স্রষ্টার এ-দ্বৈরথ বিস্ময়কর এক দার্শনিক প্রত্যয়ে ও অসাধারণ শিল্পভাষ্যে তুলে ধরেছেন ‘সোনার তরী’ কবিতায়। কিন্তু ‘সোনার তরী’ কবিতার মধ্যে দার্শনিক প্রত্যয়গুলো যে-সহজ শৃঙ্খলার মধ্যে গ্রন্থিত, ‘শিকার’ কবিতায় তা নয়। এখানে বোধের দূরান্বয় ও উলস্নম্ফন দার্শনিক প্রত্যয়গুলোকে বিশৃঙ্খল করে তুলেছে এবং সে-বিশৃঙ্খলার মধ্যে ঐক্যের সূত্রগুলো আধুনিক জীবন-জিজ্ঞাসার রক্তাক্ত পটভূমিতে তীব্র হয়ে উঠেছে।

কবিতাটির শেষ পর্যায়ে এসে ‘তুমি’, ‘আমি’ ইত্যাদি চরিত্রের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ‘অনেক-বয়সের মেয়ে’। এই অনেক বয়সের মেয়ে কি সৃষ্টি, নাকি কবিতা? ‘শিকার’ কবিতার জটিল পটভূমিতে মনে হয় কবিতাই হবে সে। আমি, তুমি এবং আরো অনেকের যে-কণ্ঠ ধ্বনিত হয় এই কবিতায় তার সবকিছুই কবিতার দেহ-মন-আত্মা। আর সেই বোধের জগৎকে একটি জীবন্ত সংগঠনের মধ্যে মানবিক রূপ দেওয়ার জন্য শেষ পর্যন্ত একটি চরিত্রের আবির্ভাব – ‘অনেক বয়সের মেয়ে’। এই মেয়ের প্রথম সংলাপ :

তোমাদের সব কথা আমিও শুনেছি,

ঘুমাতে ঘুমাতে তাই জেগে ব’সে আছি;

হয়তো আমার মুখ ধনেশ পাখীর মত হ’বে;

তাহার তেলের মত মন তবু;

আমার হৃদয়ে আছে অসুখের তবুও ওষুধ!

কবি-অস্তিত্বের সব কথা ধ্বনিত হয় কবিতার দেহে, কবিতার আত্মায়। সুতরাং আমি, তুমি অনেক বয়সের মেয়ে এবং আরো অনেকের যে-কণ্ঠই ধ্বনিত হোক না কেন তা মূলত একজনেরই কণ্ঠ, আর তা হলো কবিকণ্ঠ। মেয়েটি সে-কণ্ঠকে ধারণ করেছে। সেখানে যন্ত্রণার দাহে ও দহনে ধনেশ পাখির মতো জীবনের ঠোঁট বেঁকে গেলেও সেখানেই থাকে নিরাময়ের নিরন্তর বার্তা। জীবনানন্দ দাশ যখন প্রগাঢ় বিশ্বাসের সঙ্গে এ-বোধের উন্মোচন ঘটান – ‘আমার হৃদয়ে আছে অসুখের তবুও ওষুধ’ – তখন জীবনতৃষ্ণার এক শাশ্বত সুন্দর তার সকল সম্ভাবনা নিয়ে আলোকোজ্জ্বল হয়ে ওঠে। তাহলে সেই মেয়ে কি কবিতা, কিংবা রূপ? – যে-কবিতা থেকে জন্ম নেয় অনেক কবিতা। যে রূপ থেকে জন্ম নেয় অনেক রূপ। ‘আমি’ তখন বলছে :

পৃথিবীর বিছানায় শুয়ে

মানুষের বুক থেকে সেই সব ভালোবাসা ফুরায় না;

ভোরের আলোর মত আঁশটে জালের থেকে ফেঁসে’

তবু আমি চলে গেছি!

কবিতার এই অংশে একটি চিত্রকল্পের ব্যবহার আছে – ‘ভোরের আলোর মত আঁশটে জালের থেকে ফেঁসে’। বাংলা কবিতার হাজার বছরের ইতিহাসে বাস্তবজীবনের কোনো এক চকিত মুহূর্তের যে-দৃশ্যটি এ-চিত্রকল্পের মধ্যে কবি ধারণ করেছেন, এর মধ্যে ধরা দিয়েছে ‘শিকার’ কবিতার সাদা ঘোড়া, লাল ঘোড়া আরোহী শিকারির সবচেয়ে মূল্যবান শিকার। ‘তবু তুমি রূপ ভালোবাস!’ – অনেক বয়সের মেয়ের এ-স্বীকারোক্তির মধ্যে রক্তাক্ত জীবনে প্রতিনিয়ত রূপের আহবান ধ্বনিত হয়েছে। কবিতা এ-রূপ ধারণ করে। তাই ‘তাদের মতন কেউ সুন্দরী কি আছে?’ এ-প্রশ্নের মধ্যে অনেক বয়সের মেয়ে, কিংবা কবিতা কিংবা রূপ অভিমানী হয়ে ওঠে। আর বলে :

রূপ নয় – রূপ নয় – কোনো এক ডাইনীর হাতে

কাপাশ ফুলের মত হৃদয় তোমার ধরা পড়ে গেছে!

চর্কার সব শেষ সূতা কেটে’ তোমারে সে ছেড়ে’ দেবে, –

তারপর হৃদয়ের রবে কিছু?

এই হলো একজন কবির নিয়তি। অর্থ-কীর্তি, সচ্ছলতা এবং এমনকি নারীপ্রেম, শিশু, গৃহ – সবকিছু জলাঞ্জলি দিয়ে শুধু কাব্যদেবীর আরাধনা করে এক জীবন শেষ করে দেওয়ার নিয়তি। আর প্রাপ্তি – সোনার হরিণ নয়, বীরত্বের প্রতীক বাঘ-সিংহ শিকারও নয় – কমপক্ষে জীবনানন্দ দাশের মতো অস্থিমজ্জায় একজন কবির জীবনে শুধু বঞ্চনাই নিয়তি। শূন্য হৃদয়ে মুখর পৃথিবীতে একা-একা হেঁটে চলাই ভবিতব্য। পৃথিবীর সে-পথে গিয়ে খুশি হয় কে? একজন, দুজন। তাঁরা কবি। জীবনানন্দ দাশ কিংবা তাঁর মতো বিরলপ্রজ কবি। ‘মাংস আর রক্তের জীবাণুর ঢেউয়ে’ যিনি প্রতিদিন কোথাও না কোথাও বেঁচে থাকতে দেখেন অনেক স্বপ্ন, সোনালি স্বপ্নের উৎসব। তিনি দেখেছেন, ‘এলডোরেডো’র থেকে সোনা খোঁজে যারা/ তাদের হৃদয়েরে জুতোর হীলের তলে রেখে’/ তাদের সোনার থলি এরা ভালোবাসে।’ এরা হলো রক্তমাংসের মেয়েমানুষ। এ-নিষ্ঠুর

পৃথিবীতে কবি এক – জীবনানন্দ দাশ আশ্রয় খোঁজেন – শিকার করতে চান কবিতার সোনার হরিণ এবং শেষ পর্যন্ত তিনি হয়ে ওঠেন অর্জুন। অবিশ্বাস্য এক কল্পনাপ্রতিভার আলোকে তিনি সৃষ্টি করেন কবিতা-শিল্পের রাজমহল। এবং অনেক মৃত্যুর পর, রক্তাক্ত এক জীবনযুদ্ধে প্রতিদিনের অফুরন্ত ক্ষতির পর শেষ পর্যন্ত কবিতা-শিল্পের সেই রাজমহলে ভালোবাসার, বিশ্বাসের, আস্থার উৎসব বেঁচে

থাকে। পেঁচারা মরে যায় জ্যোৎস্নায় হিমশিম হয়ে। তারও আগে ইঁদুরেরা মরে গেছে। সকল চাঁদের শিং খসে গেছে আকাশ থেকে। কিন্তু ‘ফুটোনো জলের থেকে ধোঁয়ার মতন/ আমার হৃদয় তবু ভাসিতেছে!’ এভাবে সকল বিনষ্টির পর বেঁচে থাকে কবিতা নামক শুভ ও কল্যাণ।

জীবনানন্দীয় বোধের একটি গড়ন আছে। সেই গড়নটি আমাদের জানা। কিন্তু মুশকিল হলো, জানা বটে, কিন্তু ব্যাখ্যা করা কঠিন। কিংবা বলা যায়, অনেক রকম ব্যাখ্যার অবকাশ থাকে। কবিতার জন্য এই বহুতর পাঠ কোনো নতুন বিষয় নয়।

কাব্য-ভাষায় শব্দের অর্থময়তার সীমা চিরকালই সীমা লঙ্ঘনের অধিকার রাখে। কিন্তু জীবনানন্দ দাশ শব্দপ্রতীকের ভেতর দিয়ে বোধের এমন এক জগৎ তৈরি করেন, যেখানে প্রকৃতির সামান্য উপকরণগুলো অসামান্য হয়ে ওঠে এবং বোধের বহুতর মাত্রাগুলোকে বিভিন্ন দিক থেকে কম্পমান করে তোলে। সে-কম্পনের প্রতিটি মাপজোখ নির্ণয় করা প্রায় অসাধ্য। সুতরাং তাঁর কবিতা নিয়ে শেষ কথা অশেষ থেকে যায়। ‘শিকার’ কবিতায় এমন কিছু বিপরীতের ঐকতান ঘটানো হয়েছে যেখানে সামান্য শৈথিল্য পাঠে বিভ্রম ঘটাতে পারে। এ-অর্থে জীবনানন্দ দাশের কবিতা বিভ্রমের কবিতা, কুহেলিকার কবিতা। এ-বিভ্রমের মধ্যে, কুহকের মধ্যে জীবনানন্দ-পাঠকরা মুগ্ধ থাকেন। মুগ্ধ থাকবেন। r

 

 

 

মহাশ্বেতার গোড়ার কথা : সিপাহি বিদ্রোহের সমাজ-সচেতন ইতিহাস

অংকুর সাহা

 

ঠিকঠাক মনে পড়ে না কোন সাল সেটা – ১৯৭২, ১৯৭৩, নাকি ১৯৭৪; খুব সম্ভবত ১৯৭৩; আজ আর মনে নেই কোন সিনেমা পত্রিকার শারদ সংখ্যা – উল্টোরথ, প্রসাদ অথবা জলসা; খুব সম্ভবত প্রসাদ। কোনো বামপন্থী পত্রিকা নয়, কোনো বুদ্ধিজীবীনির্ভর লিটল ম্যাগাজিন নয়, বাজারি সিনেমার কাগজে প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৭০ দশকের শ্রেষ্ঠতম উপন্যাসটি – হাজার চুরাশির মা – রক্তক্ষয়ী, সর্বনাশী, যন্ত্রণা আর বিলাপে আকীর্ণ সময়টির নির্যাস। নকশাল-আন্দোলন ছিল খবরের কাগজের কাহিনি – দূরের জলপাইগুড়ির, কুচবিহারের অথবা মেদিনীপুরের ‘পাশাপাশি’ দুটি গ্রাম ডেবরা আর গোপীবলস্নভপুরের – এবং ততদিনে নাভিশ্বাস উঠে গিয়েছে মূল আন্দোলনের, চলছে বদলা আর প্রতিশোধের মহড়া – কিন্তু ব্রতী, সুজাতা আর দিব্যনাথের মাধ্যমে তার চিরকালের জন্যে প্রবেশ ঘটল মধ্যবিত্তের শয়নকক্ষে, ড্রইংরুমে অথবা হেঁসেলে। দিনে রাসত্মায় পোস্টার বা দেয়াল লিখন আর রাতে গুলি-বোমার শব্দ শোনাই নয়, এবার তাঁদের নিজের, ভাইয়ের অথবা সমত্মানের আপন মুখচ্ছবি।

আমার সঙ্গে মহাশ্বেতা দেবীর পরিচয় অবশ্য তারও বেশ কিছু বছর আগে, সন্দেশ পত্রিকার মাধ্যমে। অনিয়মিতভাবে হলেও সেখানে লিখতেন তিনি, শারদ সংখ্যায় তো বটেই। দ্বিপদ এবং চতুষ্পদ সব অসাধারণ চরিত্র – বিরে ডাকাত, ছিরে ডাকাত, ন্যাদোস। খুব সম্ভবত সেখানেই পড়েছি এক কড়ির সাধ অথবা আর্মানী চাঁপার গাছ। আরেকটু বড় হওয়ার পরে পড়েছি তাঁর রচিত দুটি ঐতিহাসিক উপন্যাস। ইশকুলে পড়ি তখন, কোনো কারণে মেদিনীপুর থেকে গিয়েছিলাম কলকাতায় একদিনের জন্যে। বিকেলে হাওড়া স্টেশনে ফেরার পথে কলেজ স্ট্রিটে নেমে কিছু বইপত্তর কেনা; তার মধ্যে মহাশ্বেতা দেবীর আঁধার মানিক – বাংলাদেশে বর্গির আক্রমণের করুণ কাহিনি। রাজারাজড়ার বিলাসিতার বর্ণনা নয়, সাধারণ মানুষের রুক্ষ কঠোর জীবনযাপনের কাহিনি। বাঙালির ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়কে ধরে রেখেছেন তিনি তাঁর সমাজসচেতন ক্যানভাসে। পরবর্তী কয়েক দশকেও বর্গির আক্রমণ বা অত্যাচার বিষয়ে কোনো প্রামাণ্য বাংলা গ্রন্থ চোখে পড়েনি। আমার কাছে এ-উপন্যাসের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য এবং অবাক করে দেওয়া তথ্যটি হলো, বাঙালির বাস্ত্তচ্যুতি ও অভিবাসনের অন্তহীন পুনরাবৃত্তির – বর্গিরা ভয় পেত জলকে, তারা নদী পার হতে চাইত না। তাই অষ্টাদশ শতাব্দীতে পশ্চিম বাংলার গৃহহীন-সম্বলহীন মানুষেরা গঙ্গা ও পদ্মা পেরিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন পূর্ববাংলায়। দুশো বছর পরে বিংশ শতকের মাঝামাঝি তাঁদের একটা বড় অংশকে ফিরে আসতে হয় পশ্চিমবাংলায়, আবার বাস্ত্তহীন, গৃহহীন, কপর্দকহীন!

আমি আঁধার মানিক পড়ছি শুনে উৎসাহিত হলেন অগ্রজপ্রতিম কবি বীতশোক ভট্টাচার্য। তাঁরই প্রণোদনায় লাইব্রেরি থেকে এনে পড়লাম আর একটি মহতী উপন্যাস কবি বন্দঘটী গাঞ্চির জীবন ও মৃত্যু। আরো দুশো বছর পিছিয়ে ষোড়শ শতাব্দীতে – ধর্মগুরু ও সমাজসংস্কারক মহাপ্রভু শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্যের (১৪৮৬-১৫৩৪) সমসময়ে। ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক এই দুই বিপরীত স্রোতের টানাপড়েনে গড়ে উঠেছে মহাশ্বেতার সাহিত্যবিশ্ব। এখানে কাহিনির কেন্দ্রে মেদিনীপুরের চুয়াড় সমাজের এক আরণ্যক, আদিবাসী কবি। তিনি অমত্ম্যজ মানুষ, তাঁর সৃষ্টির দিগন্তটি প্রসারিত; কিন্তু বর্ণহিন্দুশাসিত সমাজ মেনে নেয় না তাঁকে; ব্রাহ্মণ্যবাদ ও সামন্ততন্ত্রের হাতে তাঁর কঠিন, অমোঘ, করুণ, অত্যাচারিত মৃত্যু। রক্তমাংসের জীবন্ত মানুষের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে পৌঁছে দেন সমাজসচেতন রাজনীতির কঠিন বাস্তবে প্রোথিত তত্ত্বগুলোকে।

এসব অবশ্য অনেক বছর আগেকার কথা। ইদানীংকালে তাঁর বইপত্তর হাতে আসে না বিশেষ; মাঝেমধ্যে উত্তপ্ত, শাণিত, রক্তাক্ত কিছু অসাধারণ ছোটগল্প ছাড়া। ক্যালিফোর্নিয়ার স্থানীয় জনগ্রন্থাগারে তাঁর আধডজনের মতন বাংলা বই রয়েছে, সেগুলো পড়া হয়ে গেছে কবেই, তাদের প্রকাশনায় অযত্ন আর অবহেলা দেখে কান্না এসে যায়। সঙ্গে-সঙ্গে দেখি তাঁর সুপ্রকাশিত কিছু ইংরেজি অনুবাদ, অনেক হিন্দি অনুবাদ, আর গুজরাতি, মালয়ালম ও কানাড়া ভাষাতেও অল্প কিছু। বিভিন্ন ভাষাভাষী পাঠক-পাঠিকার মননে পৌঁছে যাচ্ছেন তিনি, সেটা সুসংবাদ।

 

দুই

সম্প্রতি মহাশ্বেতা দেবীর  ঝাঁসীর রাণী গ্রন্থটি পাঠের সুযোগ পেলাম – তাঁর প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ। রচনাটি উপন্যাস নয়, জীবনী সাহিত্য১ বা নন-ফিকশন। প্রথমে প্রকাশ সাপ্তাহিক দেশ পত্রিকায় পাঁচ মাস ধরে, ১৯৫৫ সালের আগস্ট মাস থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত। গ্রন্থাকারে প্রকাশ শ্রাবণ ১৩৬৩ (জুলাই-আগস্ট ১৯৫৬); প্রকাশক নিউ এজ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড। ২৩৫ পৃষ্ঠার গ্রন্থটির আরো তিনটি সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে পরবর্তীকালে। হয়তো সিপাহি বিদ্রোহের আগতপ্রায় শতবর্ষ এ-গ্রন্থের অন্যতম অনুপ্রেরণা। এবং শৈশবে দিদিমার কাছে ঝাঁসীর রাণীর রূপকথার মতো গল্প শোনার স্মৃতি লেখিকা উল্লেখ করেছেন গ্রন্থটির ভূমিকার শুরুতে।

মহাশ্বেতা দেবীর প্রথম রচনা প্রকাশিত হয় ১৯৩৯ সালে খগেন্দ্রনাথ সেন-সম্পাদিত রংমশাল কাগজে। তখন তিনি কলকাতার বেলতলা গার্লস স্কুলে অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী। রচনাটির বিষয় রবীন্দ্রনাথের ছেলেবেলা বইটির পাঠ-প্রতিক্রিয়া। এরপরে মৌচাক পত্রিকায় কিছু শিশু ও কিশোর পাঠ্য রচনা লিখেছিলেন তিনি, তার মধ্যে একটির নাম ‘আলো হাতে’। ১৯৫২ সাল থেকে তিনি সুমিত্রা দেবী ছন্দ নামে গল্প লিখতে শুরু করেন সচিত্র ভারত পত্রিকায় – গল্পগুলো হালকা মেজাজের এবং হাস্যপরিহাসের। এইভাবেই চলে তাঁর ঝাঁসীর রানির প্রস্ত্ততিপর্ব এবং গ্রন্থটি প্রকাশের পর থেকেই তাঁর সাহিত্যিক হিসেবে অর্থ উপার্জনের সূচনা।

লেখিকার জবানিতে, ‘এ গ্রন্থ প্রচলিত অর্থে ইতিহাস নয়, রাণীর জীবনচরিত লেখার বিনীত প্রচেষ্টা মাত্র।’ অন্য একটি নিবন্ধে তিনি জানিয়েছেন, ‘ঝাঁসীর রাণী’ উপন্যাস নয়। প–তেরা পাত্তা দেবেন না যাকে, তেমন এক ইংরেজি ডিগ্রিধারী নির্বোধ মানুষের অক্ষম প্রচেষ্টা ইতিহাসাশ্রিত জীবনী রচনায়। জীবনভোর অনেক অদ্ভুত কাজ করে যাচ্ছি এভাবে। মূলধন নির্বোধিতা ও জেদ। ‘ঝাঁসীর রাণী’ তার প্রথম পরিচয়। অবশ্য মূল জায়গা থেকে আমি সরিনি। মূল জায়গার ব্যাপারটি হলো, কোনো ব্যাপারের যথার্থ ঐতিহাসিক প্রেক্ষেত পেতে হলে কাগজে ও নথিপত্র গবেষণা যথেষ্ট নয়। লোকগাথা-গীতকবিতায়, অর্থাৎ লোক-বৃত্তে সে ব্যাপারটির যতটা পরিচয় মেলে তাকেও মর্যাদা দিতে হবে।’ সত্যি-সত্যিই গ্রন্থের তথ্য এবং মাটির মানুষের থেকে সংগ্রহ করা তথ্যের সাবলীল মিশ্রণেই রূপ পেয়েছে গ্রন্থটি।

১৯৫২ সালে স্বামী বিজন ভট্টাচার্য আর শিশুপুত্র নবারুণকে সঙ্গে নিয়ে মহাশ্বেতা বোম্বাই গেলেন। বিজন সেখানে হিন্দি চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য লিখবেন। তাঁরা উঠেছিলেন মহাশ্বেতার বড়মামা শচীন চৌধুরীর চার্চিল চেম্বার্সের বাড়িতে। শচীন ইকোনমিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল উইকলি কাগজের প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক। তাঁর গ্রন্থাগারে অন্যান্য ইতিহাস প্রসঙ্গের গ্রন্থের সঙ্গে তিনি পড়েছিলেন সাভারকার রচিত ১৮৫৭। সেই থেকেই বিষয়টি ঘুরতে থাকে তাঁর মনের মধ্যে। স্বল্পকাল বোম্বাইতে কাটিয়ে তিনি কলকাতায় ফিরলেন এবং সমানে চলতে থাকল উপাদান সংগ্রহের কাজ। কাজে উৎসাহ দিয়েছিলেন ডক্টর প্রতুলচন্দ্র গুপ্ত এবং সাহায্য করেছিলেন বইপত্র দিয়ে। পদ্মপুকুর ল্যান্সডাউনের মোড়ে তাঁর বাড়ি থেকে পায়ে হেঁটে জাতীয় গ্রন্থাগারে যেতেন তথ্য সংগ্রহের কাজে। কাজকর্ম খানিকটা এগোলে তিনি আহমেদাবাদের ইতিহাস কংগ্রেসে গেলেন রানির ভাইপো গোবিন্দরাম চিমত্মামণি তাম্বের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে। সাহায্য করেছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যেরা। ডক্টর মহাদেব প্রসাদ যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছিলেন ঝাঁসিতে তাঁর পরিচিত মানুষজনের সঙ্গে।

এইভাবে গ্রন্থকীটের কাজের পাশাপাশি শুরু হলো ক্ষেত্রসমীক্ষার কাজ – ঝাঁসি, গোয়ালিয়র, বুন্দেলখ- – মধ্য পশ্চিম ভারতের গ্রামে ও শহরে; লোকগীতি, ছড়া, মানুষের মুখে-মুখে প্রচলিত উপকথা থেকে কাহিনির উপাদান সংগ্রহ করেন। লেখিকার নিজের কথায়, ‘এই বই লেখার সময় আমি প্রমাণ রেখেছি, (১) আমি গণবৃত্তের ইতিহাসে বিশ্বাসী; (২) সিপাহি বিদ্রোহ বা প্রথম স্বাধীনতা-সংগ্রাম মূলত কৃষকদের সংগ্রাম; (৩) ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে ইতিহাসের উপাদান হিসেবে লোকবৃত্তের গান গাঁথা এসব মূল্যবান সম্পদ; (৪) লক্ষ্মীবাঈ এ জন্যে স্মরণীয়, ইংরেজ ঐতিহাসিকেরাও স্বীকার করেছেন যে রানীকে কেন্দ্র করে মধ্যভারতে এক ব্যাপক গণ-অভ্যুত্থান গড়ে উঠেছিল।’ ঝাঁসি ও তার আশপাশের অঞ্চলের মানুষ বিশ্বাস করে, রানির মৃত্যু হয়নি। অনেক জ্যোৎস্নারাতে সেই বাইশ বছর বয়েসি রানিকে নাকি দেখতে পাওয়া যায় শিশুপুত্রকে নিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে তিনি চলেছেন। লেখিকা দেখে এসেছেন রানির কেল্লা – সেখানে ইংরেজের কামানের গোলার ক্ষতচিহ্ন; রয়েছে রানির দুই প্রিয় কামান – ভবানীশঙ্কর আর কড়কবিজলী; দেখে এসেছেন গোয়ালিয়রে তাঁর অমিত্মমশয্যার শূন্যস্থানটি। এভাবেই টুকরো-টুকরো তথ্য থেকে গড়ে উঠেছে কাহিনি – রানির জীবনের, মৃত্যুর, শাসনের, সংগ্রামের। গ্রন্থের পটভূমি থেকে, ‘সেসব কথা জানতে হলে চলে যেতে হবে একশো বছর আগেকার বুন্দেলখ–। জানতে হবে ঝাঁসীকে। আর যেতে হবে তীর্থযাত্রীর মন নিয়ে। কেননা রানি লক্ষ্মীবাঈ তো একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা এবং একক চরিত্র নন। শতাধিক বছর আগে ভারতবর্ষের বুকে বুটপরা পা রেখে মাড়িয়ে দিয়েছিল ইংরেজ। ভারতবর্ষের পাঁজর ভেঙে আর্তনাদ উঠেছিল সেদিন। সেই আর্তনাদই পরে মুখর হয়ে উঠেছিল একটি প্রতিবাদের সমুদ্রগর্জনে। কেঁপে গিয়েছিল তাতে শাসকের সিংহাসন।’ –

যাঁর আন্তরিক সহায়তায় রচিত হলো গ্রন্থটি, সেই গোবিন্দরাম চিমত্মামণি তাম্বের মৃত্যু ঘটল গ্রন্থটি প্রকাশের ঠিক আগেই। তাঁর পুণ্যস্মৃতির উদ্দেশেই গ্রন্থটি উৎসর্গ করলেন মহাশ্বেতা।

 

তিন

ঝাঁসীর রাণীর পরে আরো চার দশক পেরিয়ে, তাঁর ইংরেজি অনূদিত একটি গল্পসংকলনের ভূমিকায় মহাশ্বেতা লিখলেন, ‘I believe in documentation. After reading my work, the reader should face the truth of facts, and feel duly ashamed of the true face of India. To fully understand these stories, one must have a knowledge of the agricultural economy and land relations; because caste and class exploitations and the resistance of the exploited ones are rooted in India’s land system.’ (Bitter soil, seagull books, 1998)। ‘ভারতবর্ষের আর্থ-সামাজিক বৈষম্য’ এবং ‘ভূমির জন্যে দরিদ্র মানুষের

লড়াই’ মহাশ্বেতার তীক্ষন, ক্ষুরধার, সুসংহত, ক্ষমাহীন সাহিত্যসম্ভারের দুটি মূল্যবান ‘চাবি-শব্দ’। এবং এই দুটি অমোঘ কারণেই সংঘটিত হয় সিপাহি বিদ্রোহ – ভারতের প্রথম স্বাধীনতা আন্দোলন ও গণঅভ্যুত্থান।

১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর যুদ্ধের পর বাংলাদেশে ইংরেজ শাসনের সূত্রপাত। পরবর্তী একশ বছরে চলেছিল একদিকে অন্তহীন লুণ্ঠন ও শোষণ সাধারণ মানুষের ওপর এবং অন্যদিকে সুপরিকল্পিতভাবে দেশজ শিল্প, বাণিজ্য ও কৃষিকর্ম তিল-তিল করে ধ্বংস করা। ঔপনিবেশিক শক্তির প্রয়োজন দুটি জিনিসের – এক, স্বল্পমূল্যের বা প্রায় বিনামূল্যের অগাধ, অঢেল শ্রম, অর্থাৎ দরিদ্র, সর্বস্বান্ত জনসাধারণ এবং নিজের দেশে উৎপন্ন পণ্যদ্রব্যের রপ্তানির জন্যে নিষেধহীন, খোলাবাজার। যে-ভারতবর্ষের রেশম, পশম ও সুতির বস্ত্রশিল্প ছিল গুণে উৎকৃষ্ট ও পৃথিবীবিখ্যাত, ঊনবিংশ শতাব্দীতে তা হয়ে দাঁড়াল ব্রিটেন থেকে আমদানি করা বস্ত্রের ওপর নির্ভরশীল।

জমি-সংক্রান্ত বৈষম্যের শুরু ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বলপূর্বক রাজস্ব আদায়ের ফলে। ভারতবর্ষের কৃষিজীবী মানুষ চাষ করত। নিজের জমি এবং কর দিত নবাব, রাজা বা সম্রাটকে। ১৭৫৭ সালের পর প্রতি বছর বাড়তে শুরু করল করভার – কর ও ঋণের দায়ে জর্জরিত চাষিরা একের পর এক হতে থাকল নিরন্ন, ভূমিহীন। ইংরেজ শাসনের প্রথম দশকে রাজস্ব আদায় বাড়ে অন্তত তিনগুণ। তার ফলে ১৭৭০-৭১ সালে ভয়ঙ্কর দুর্ভিক্ষ – বাংলা ১১৭৬ সনে, যার নাম ছিয়াত্তরের মন্বন্তর। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি প্রাণ হারাল অনাহারে ও অসুখে। এর আগে শস্যশ্যামল বাংলায় এমন দুর্ভিক্ষের কথা শোনা যায়নি। আর নিরন্ন কৃষকদের অনেকেই বাধ্য হয়ে নাম লিখিয়েছিলেন ইংরেজের সেনাবাহিনীতে সেপাই হিসেবে।

সাড়ে চার কোটি বাঙালির দেড় কোটিকে নিকেশ করেও সাধ মিটল না ইংরেজদের। খাজনার পরিমাণ বেড়েই চলল বছরের পর বছর। তারপর ১৭৮৬ সালে ভারতবর্ষের শাসক হয়ে এলেন লর্ড কর্নওয়ালিস (১৭৩৮-১৮০৫) যার এখনো পর্যন্ত কর্মজীবনের সবচেয়ে গৌরবময় কীর্তি – আমেরিকার স্বাধীনতা-সংগ্রামে জেনারেল জর্জ ওয়াশিংটনের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ব্রিটিশ সেনার সেনাপতি হিসেবে লড়াই, পরাজয় ও আত্মসমর্পণ। ব্রিটেনে বদ্ধমূল ছিল যে, শ্রেণিভিত্তিক, আর্থ-সামাজিক বৈষম্য, কর্নওয়ালিস ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ নামে তাকে আমূল প্রোথিত করলেন ভারতের ভূমিতে। সৃষ্টি হলো মধ্যস্বত্বভোগী, অলস, কর্মবিমুখ, অর্থপিশাচ এবং ইংরেজের পদলেহী জমিদারশ্রেণির – জমির সঙ্গে তাদের একমাত্র সম্পর্ক রাজস্ব আদায়। মোঘল বা নবাব আমলে বন্যা, মহামারি বা দুর্ভিক্ষ ঘটলে রেহাই বা ছাড় পাওয়া যেত খাজনা থেকে, কিন্তু ইংরেজরা খারাপ সময়ে খাজনা মওকুফের বদলে তার বৃদ্ধি ঘটাল। জমিদারও পাইক-বরকন্দাজ নিয়ে তৈরি তাদের মদদ করতে। শুধু যে ইংরেজ সরকারের সিন্দুকে আয় বাড়ল তাই নয়, সপ্তদশ শতকের প্রথমে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পত্তনের পর থেকেই তার উচ্চপদস্থ কর্মচারীদেরও ভাগ্য খুলে গেল – অত্যাচার, শোষণ ও শঠতায় অর্জিত অর্থে তার অকল্পনীয় বিলাসে দিন কাটাতে লাগলেন দেশে ফেরার পর।২

অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে বিদ্রোহ করে মানুষ। ১৭৫৭ থেকে ১৮৫৭ – এই একশ বছরে ভূমিহীন কৃষক ও জনসাধারণ বিদ্রোহ করেছেন ৫৪ বার। কঠোরভাবে দমন করা হয়েছে তাঁদের। গণবিদ্রোহগুলোর সঠিক ইতিহাস লেখা হয়নি এখনো।

 

চার

বারানসির এক নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্ম হয় ঝাঁসীর ভবিষ্যৎ রানির, ২১ নভেম্বর, ১৮৩৫; জন্মের সময় তাঁর নাম মণিকর্ণিকা, সংক্ষেপে মনু। আট বছর বয়সে তাঁর বিবাহ ২৯ বছর বয়েসি ঝাঁসীর রাজা গঙ্গাধর রাওয়ের সঙ্গে। বিয়ের পর তাঁর নাম রাখা হয় লক্ষ্মীবাঈ। ১৮৫১ সালে তাঁর এক পুত্রসমত্মানের জন্ম; কিন্তু তিন মাস বয়েসেই তার মৃত্যু হয়।

মহাশ্বেতা গ্রন্থটি শুরু করেছেন ঢিমে তেতালায়, বড়ো একটি ক্যানভাস নিয়ে। আকবরের সমসাময়িক বুন্দেলখ- অঞ্চল ও তার আশপাশের মারাঠা ও রাজপুত রাজ্যগুলো নিয়ে – অজস্র রাজা ও রাজত্বের নাম, তাদের শাসন, শত্রম্নতা ও যুদ্ধবিগ্রহের কাহিনি। শিবাজী, আবুল ফজল, সেলিম, আওরঙ্গজেব, পেশোয়া বাজীরাও  – সবাইকেই ছুঁয়ে-ছুঁয়ে ইতিহাস এগিয়ে চলে তিন শতাব্দী। তারপর কাহিনির মূল স্রোতটি ঘনীভূত হয় ঝাঁসীতে, রাজা ও রানির উপস্থিতিতে। তাঁদের দৈনন্দিন জীবন, ‘হরিদ্রাকুঙ্কুমের উৎসবে বড়ো আনন্দ করতেন মেয়েরা। সকলে সকলকে ফুল ও কুঙ্কুম দিতেন। রাণীর ব্যবহারে মুগ্ধ অমত্মঃপুরিকারা তাঁর প্রশংসা করতেন এবং আনন্দে গঙ্গাধর রাও তাঁকে প্রায়শই স্নেহ-কৌতুকে বলতেন – তুমি কি তোমার নামের যোগ্য হবার জন্যে এত চেষ্টা করছ?… বয়েসের পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও রাণীর সঙ্গে তাঁর স্বামীর একটি হৃদয়ের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল।’

স্বচ্ছন্দ ও স্বাদু গদ্য-উপন্যাসের মতো পড়া যায়; চরিত্রগুলি পাঠকের খুব নিকটে সরে আসে, তাদের ঘরের মানুষ মনে হয়; ইতিহাস থেকে সেঁচে আনা তথ্য, কিন্তু নির্ভেজাল সাহিত্যরসে জারিত। অনেকদিন পরে একটি সাক্ষাৎকারে লেখিকা জানালেন, ‘The details of the Rani’s habits, her clothes, her favorite things, attracted me very much. Probably because I am a woman, my perspective have been different. …I was interested in not only learning about her army and such other things, her fights against the British and the facts of war, but wanted to get under the skin of the person. The different roles that she had to play interacted me intrinsically…’

১৮৫৩ সালের শরৎকালে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লেন রাজা গঙ্গাধর রাও; তাঁর অবর্তমানে রাজ্যের কী অবস্থা হবে সেই নিয়ে দুশ্চিমত্মা। অপুত্রক রাজা আইনগতভাবে দত্তক নিলেন আত্মীয়পুত্র আনন্দ রাওকে – পাঁচ বছর বয়েসি বালকটির নতুন নামকরণ হলো দামোদর গঙ্গাধর রাও। পরের দিনই (২১ নভেম্বর ১৮৫৩) রাজার মৃত্যু হলো। পুরো ব্যাপারটিই ঘটেছে ইংরেজ সরকারের প্রতিনিধিদের চোখের সামনে, কিন্তু তাঁদের প্রভুরা মানতে পারলেন না এই উত্তরাধিকার। গভর্নর জেনারেল লর্ড ডালহৌসি এর আগেই ‘Doctrine of Lapse’ নামে একটি প্রাচীন আইনের ধুলো ঝেড়ে বার করে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেছেন অনেকগুলো ভারতীয় রাজ্য – ঝাঁসীর ভাগ্যেও তাই ঘটল। রানিকে সেই দুঃসংবাদ দিতে এলেন মেজর এলিস – উত্তরে পর্দার আড়াল থেকে ভেসে এলো রানির সুদৃঢ়, ঐতিহাসিক কণ্ঠস্বর –

‘মেরী ঝাঁসী দুঙ্গী নহী।’ দিনটি ১৬ মার্চ ১৮৫৪।

শুরু হয়ে গেল সাধারণ মানুষের সঙ্গে পরাক্রান্ত ব্রিটিশ বাহিনীর যুদ্ধ। যে-রাজ্য এতদিন ছিল ব্রিটিশ রাজের একান্ত অনুগত, তার বিধবা অমত্মঃপুরিকা রানি নেতৃত্ব দিলেন এক সুদূরপ্রসারী বিদ্রোহের। অনেক ব্রিটিশ ঐতিহাসিকের মতে, ঝাঁসী এবং অন্যান্য দেশি রাজ্যগুলোর অন্যায় আত্মসাৎ না ঘটলে ভারতবর্ষে সেই গণঅভ্যুত্থান হওয়ার সম্ভাবনা কমে যেত অনেকটাই।

ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শক্তির বিরুদ্ধে ভারতের দরিদ্র কৃষিজীবী মানুষ বিদ্রোহ করেছে বারবার; কঠোর হাতে সেসব অভ্যুত্থান দমন করেছে ব্রিটিশ বাহিনী। ‘এই প্রসঙ্গে স্মরণীয় ১৮১৬ সালের বেরিলীর বিদ্রোহ, ১৮৩১-৩২ সালের কোল বিদ্রোহ এবং ছোট নাগপুর ও পালামৌ অঞ্চলের বিভিন্ন আদিবাসী অভ্যুত্থান।… ১৮৩১ সালে বারাসতে সৈয়দ আহমদ এবং তিতুমীরের নেতৃত্বে ফরায়েজী বিদ্রোহ, ১৮৪৭ সালে দিদুমীরের বিদ্রোহ, ১৮৪৯, ১৮৫১-৫২, ১৮৫৫ সালের মোপলা বিদ্রোহ এবং ১৮৫৫-৫৬ সালের সাঁওতাল বিদ্রোহ স্মরণীয়।’ এই রকম অসংখ্য স্ফুলিঙ্গের পটভূমিতেই ভারতের প্রথম মহাসংগ্রামের লেলিহান অগ্নিশিখা।

উত্তর এবং মধ্যভারতে ১৮৫৭ সালে স্বাধীনতা-সংগ্রামের নেতৃত্বে ছিলেন প্রধানত সামন্ততান্ত্রিক। দিলিস্ন, কানপুর বা লখনৌতে এই বিদ্রোহের লক্ষ্য মোঘল সম্রাটকে কেন্দ্র করে। মধ্যভারতে নানা সাহেব এবং তাঁতিয়া টোপী ডাক দিয়েছিলেন মারাঠা পেশোয়াশাহী পুনঃপ্রতিষ্ঠার। কিন্তু মারাঠা অধিকারের পেছনে সাধারণ মানুষের সমর্থন ছিল না। তাঁরা চেয়েছিলেন, ইংরেজ অত্যাচার থেকে মুক্তি। কিন্তু এক বিলাসী শাসককে ক্ষমতাচ্যুত করে আরেক বিলাসী শাসককে গদিতে বসালে সেই ইচ্ছা চরিতার্থ হবে না। একমাত্র ঝাঁসির রানির মধ্যেই জনসাধারণ ও সিপাহিরা দেখেছিলেন সংগ্রামী চেতনা। তিনিই গড়ে তুলতে পারতেন সুবিপুল, জনপ্রিয় ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন। ঝাঁসীর মানুষ তাঁর সঙ্গে ছিলেন; কিন্তু স্থানীয় দেশি সামন্ত রাজারা বেশির ভাগই ইংরেজের হাতের পুতুল।

সিপাহিদের অভিযোগগুলো ছিল যুক্তিযুক্ত এবং যথার্থ। ইংরেজ অফিসারদের অবিচার এবং বৈষম্যের সীমা ছিল না। সেনাবাহিনীতে মোট তিন লাখ পনেরো হাজার সৈন্য, তার মধ্যে একান্ন হাজার শ্বেতকায়, বাকি দুই লাখ চৌষট্টি হাজার ভারতীয়। সেনাবাহিনীর বার্ষিক খরচের পরিমাণ আটানববই লাখ পাউন্ড। তার মধ্যে শ্বেতাঙ্গদের জন্যে প্রায় সাতান্ন লাখ এবং ভারতীয়দের জন্যে চৌত্রিশ লাখ। গড় মাথাপিছু খরচা একত্রিশ পাউন্ড। কিন্তু শ্বেতাঙ্গদের মাথাপিছু একশ দশ পাউন্ড, যেখানে ভারতীয়দের মাথাপিছু সাড়ে পনেরো পাউন্ড। কেবল গড়ে মাথাপিছু সাতগুণ অর্থনৈতিক বৈষম্যই নয়, তার সঙ্গে প্রহার, জেল, ফাঁসি, কোর্ট মার্শাল, ধর্মবিশ্বাসে আঘাত। সবমিলিয়ে অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি। এই বিক্ষুব্ধ মানুষকে সংঘবদ্ধ করে একটি ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম গড়ে তুলতে পারলে তখনই নাভিশ্বাস উঠত অত্যাচারী, ঔপনিবেশিক শাসনের। তার বদলে ঘটল ছিন্নবিচ্ছিন্ন, বিশৃঙ্খল, পরিকল্পনাহীন সংগ্রাম। তাতেই ভিত কেঁপে উঠেছিল পরাক্রান্ত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের।

১৮৫৭ এবং ১৮৫৮ – এই দুটি সালকে ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে দেওয়ার চেষ্টা করেছে ব্রিটিশ। প্রথমত, তাদের শোচনীয় পরাজয় ও ব্যর্থতার কাহিনি; দ্বিতীয়ত, বিদ্রোহীদের পরাস্ত করার পরে ভারতীয়দের ওপর নারী-শিশু-নির্বিশেষে হত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ আর অত্যাচারের কাহিনি। সে-যুগে ব্যাংকের প্রচলন ছিল না, মানুষ সঞ্চিত অর্থ ও অলংকার লুকিয়ে রাখত নিজের গৃহে – এক-একটি শহর-গ্রাম জয় করার পরে চলেছে নির্বিচারে হত্যা ও লুণ্ঠন – সেই কালিমালিপ্ত ইতিহাস যতটা সম্ভব লুকিয়ে রেখেছে ব্রিটিশ। অনেক কাগজপত্র, দলিল-দসত্মাবেজ ঘটনাস্থলেই পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে, বাকি সব পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে ব্রিটেনে – সেগুলো বসত্মাবন্দি কোনো সরকারি মহাফেজখানায়।

এক মহাসাগরের দূরত্বে থেকেও ভারতের প্রথম স্বাধীনতা -সংগ্রামের গুরুত্ব ও মাহাত্ম্যটি সঠিক ধরতে পেরেছিলেন দার্শনিক কার্ল মার্কস (১৮১৮-৮১) লন্ডনে বসে। তাঁর সুচিমিত্মত প্রবন্ধ  প্রকাশিত হয়েছিল নিউইয়র্ক ডেইলি ট্রিবিউন সংবাদপত্রে – তাঁর বিশেস্নষণ অনুযায়ী এটি সামরিক বাহিনীর বিদ্রোহ নয়, ঔপনিবেশিক অত্যাচারের বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থান। ব্রিটেনের পার্লামেন্টে বিরোধীদলের নেতা বেনজামিন ডিজরেইলির (১৮০৪-৮১) মতে, ঘটনাটি ‘জাতীয় বিদ্রোহ’; কিন্তু তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লর্ড পামারস্টোনের (১৭৮৪-১৮৬৫) মতে, এটি ‘সামরিক বাহিনীর কিছু অংশের বিদ্রোহ’। পরবর্তীকালে সিপাহি বিদ্রোহের পটভূমিতে শার্লক হোমসের উপন্যাস লিখেছেন আর্থার কোনান ডয়েল (১৮৫৯-১৯৩০) এবং ফরাসি কল্পবিজ্ঞান-সাহিত্যিক জুলস গ্যাব্রিয়েল ভার্ন (১৮২৮-১৯০৫) তাঁর ভুবনবিখ্যাত সমুদ্রের কুড়ি হাজার লিগ নিচে (প্রথম প্রকাশ ১৯৬৯-৭০) উপন্যাসের মূল চরিত্র ক্যাপ্টেন নিমোকে কল্পনা করেছিলেন ভারতবর্ষের বুন্দেলখ–র রাজার পুত্র রাজকুমার দাক্কার (Prince Dakkar) হিসেবে, যিনি ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর শ্যেনচক্ষু এড়িয়ে পালিয়ে যান, বিজ্ঞান-সাধনায় মন দেন এবং ‘নটিলাস’ নামে সাবমেরিনটি নির্মাণ করে যাত্রা শুরু করেন। ঘটনাটি রয়েছে তাঁর ১৮৭৪ সালে প্রকাশিত রহস্যময় দ্বীপ উপন্যাসে। উপন্যাসটির যখন ইংরেজি অনুবাদ হয় তখন দেশপ্রেমিক ব্রিটিশ অনুবাদক উইলিয়াম কিংস্টন (১৮১৪-৮০) পুরো ব্যাপারটি বেমালুম চেপে যান, ফলে প্রায় একশ বছর ইংরেজি ভাষার পাঠকেরা জানতেন না ক্যাপ্টেন নিমোর প্রকৃত পরিচয়। একটি নতুন অনুবাদে প্রকাশ পায় বিষয়টি।

 

পাঁচ

পরবর্তী দশকগুলোতেও ভারতবর্ষের প্রথম স্বাধীনতা-সংগ্রামের বিষয়টি রয়ে গিয়েছিল মহাশ্বেতা দেবীর হৃদয় ও মননের খুবই নিকটে। ১৯৯৪ সালে প্রকাশিত হল ঝাঁসীর রাণীর পরিপূরক গ্রন্থ আগুন জ্বলেছিল (দে’জ পাবলিশিং, জানুয়ারি ১৯৯৪, ১১৯ পৃষ্ঠা, ত্রিশ টাকা) – সেখানে বিষয়টির আরো বিসত্মৃত আলোচনা এবং পরিণত বিশেস্নষণ। ইংরেজ সেনাপতিদের জবানীতে রানি ও তাঁর দেশপ্রেমিক এবং বিদ্রোহী অস্তিত্বের ওপর নতুন আলো ফেলা হয়েছে। ‘রাণী তাঁর সামন্ত শ্রেণীর সীমাবদ্ধতা ও স্বার্থচিমত্মার ওপরে উঠেছিলেন অন্যদের তুলনায়।’

এক অভিবাসী মা-মেয়ে জুটি বেঁধে ইংরেজি অনুবাদ করেছেন ঝাঁসীর রাণী গ্রন্থটির; ম্যাডিসন শহরে অবস্থিত উইসকনসিন বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষেণ এশীয় ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপক সাগরী সেনগুপ্ত এবং তাঁর মা মন্দিরা সেনগুপ্তের অনুবাদে ২০০০ সালে প্রকাশিত হয়েছে The Queen of Jhansi, প্রকাশক কলকাতার সিগাল বুকস। ২০০৭ সালে এই মহান সংগ্রামের ১৫০ বছরপূর্তি উপলক্ষে প্রকাশিত হয়েছে একগুচ্ছ নতুন গ্রন্থ – ইতিহাসের, রাজনৈতিক বিশেস্নষণের এবং ওই পটভূমির ওপরে নির্মিত কথাসাহিত্যের। এমনকি ব্রিটিশ লেখকদের রচনাতেও মিথ্যা ও প্রচারের পরিমাণ কমেছে অনেকটাই। সেই অর্থে প্রায় বছর ষাট আগে রচিত মহাশ্বেতা দেবীর গবেষণা ও গণমুখী রাজনৈতিক বিশেস্নষণ সার্থক হয়েছে। ‘ঝাঁসীর পথে পথে আমি অনেকবার ঘুরেছি। শীতের প্রবল বাতাসে, ক্যান্টনমেন্ট ছাড়িয়ে পুরানো ছাউনির পথে বড়ো বড়ো পাথরের ছায়ায়, নির্জন কেল্লার পরিত্যক্ত কোনায় কোনায়, জীর্ণ ও অবহেলিত রানী মহালের ঘরে ঘরে, সেই শহরের জনাকীর্ণ পথে এবং ‘লছমীতালের’ বুকে বজরা নিয়ে ঘুরে অতীতের পদ সঞ্চার শোনবার চেষ্টা করেছি।’ শুরু হয়েছে তাঁর দীর্ঘ, সুদূরপ্রসারী সাহিত্যজীবনের – সেই অর্থে ঝাঁসীর রাণী মহাশ্বেতার গোড়ার কথা।

 

টীকা

১। হায়, ‘নন-ফিকশনে’র কোনো যোগ্য বাংলা প্রতিশব্দ নেই। ‘ফিকশন’ যদি কথাসাহিত্য হয়, তাহলে কি ‘অ-কথাসাহিত্য’ অথবা ‘না-কথাসাহিত্য’? প্রবন্ধ সাহিত্য, জীবনী সাহিত্য, রম্যরচনা, ভ্রমণকাহিনি, রাজনৈতিক কলাম – এই সব জনার গুলি মিলিয়ে একটি সম্মিলিত নামের প্রয়োজন।

২। অন্তত একটি উদাহরণ রয়েছে পাপার্জিত অর্থের কিছু অংশের ব্যয় জনহিতকর কাজে। ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয় আমেরিকার এক শীর্ষস্থানীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ইলাইহু ইয়েল (১৬৪৯-১৭২১) ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে কাজ করেছেন ত্রিশ বছর, তার মধ্যে পাঁচ বছর (১৬৮৭-১৬৯২) মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির গভর্নর হিসেবে। ইয়েলের অত্যাচার ও শঠতার কাহিনি বিন্ধাপর্বতের দক্ষেণে সুবিদিত। কিন্তু এই নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সৃষ্টিতে তিনি সহায়তা করেন এবং পরে বিশ্ববিদ্যালয়টির নামকরণ হয় তাঁর নামে।

* মহাশ্বেতা দেবীর গ্রন্থগুলির বেশির ভাগ আমি ঋণ নিয়েছিলাম শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার থেকে, ইন্টার-লাইব্রেরি লোন প্রকল্পের মাধ্যমে। গ্রন্থাগার কর্তৃপক্ষকে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাই।