জ্যাকোমেত্তির ম্যাজিক

জ্যাকোমেত্তি, ৮ জুন-১২ সেপ্টেম্বর ২০১৮

গুগেনহাইম মিউজিয়াম, নিউইয়র্ক

জুনের মাঝামাঝি নিউইয়র্কে এসেছিলেন হাসনাতভাই – অর্থাৎ কালি ও কলমের সম্পাদক আবুল হাসনাত। শহরে সে-সময় শুরু হয়েছে আলবার্তো জ্যাকোমেত্তির ভাস্কর্য ও অংকনের একক প্রদর্শনী, তাও গুগেনহাইমে। মেঘ ও জল, দুটোই একসঙ্গে। হাসনাতভাইকে এই প্রদর্শনীর কথা বলামাত্রই তিনি এককথায় যেতে রাজি।

আমেরিকার বিভিন্ন শহরে ও এ-দেশের বাইরে অনেক স্থানে ফ্রাঙ্ক লয়েড রাইটের বিস্ময়কর সব স্থাপত্যের কাজ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। কিন্তু নিউইয়র্কের সেন্ট্রাল পার্কের ঠিক উলটোদিকে তাঁর করা ঘোরানো সিঁড়ির এই অদ্ভুতসুন্দর কাজটি যতবার দেখি, অবাক মানতে হয়। যেন লেবুর খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে আমরা ওপরে উঠছি, মাথার ওপর আলোয় আলো ভরা উজ্জ্বল এক গম্বুজ। ওপর থেকে নিচে তাকালে পুরো ভবনটি নজরে পড়ে, নজরে পড়ে গ্যালারিগুলো, যারা একের পর এক সাজানো। নিচের দিকে ভবনটি কিছুটা সরু, ওপরে উঠলে তা অনেক বেশি প্রশস্ত, বলা যায় উলটো পিরামিড। ১৯৪৩ সালে শুরু করে ষোলো বছর পর ১৯৫৯ সালে ভবনটি উদ্বোধনের আগে পর্যন্ত এই পুরো সময় অনেকেই এর নকশা নিয়ে গালমন্দ করেছেন। এমনকি একদল স্থপতি পত্রিকায় চিঠি লিখে শহরের  গুরুত্বপূর্ণ স্থানে এমন একটি বেঢপ ভবন নির্মাণের বিরুদ্ধে আবেদন করেছিলেন। ইতালো কালভিনোর মতো লেখক পর্যন্ত আপত্তি করেছিলেন, তাঁর মনে হয়েছিল এই জাদুঘরে রাখা চিত্রকলার চেয়ে ভবনটি অধিক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়বে। লোকজন ছবি নয়, ভবনটিই দেখবে। লয়েড রাইট ভেবেছিলেন ঠিক উলটো, তাঁর মনে হয়েছিল, এই স্পাইরাল ভবনটি জাদুঘরের জন্য একদম মানানসই, কারণ এটি শিল্পকর্মসমূহকে একই সঙ্গে মর্যাদা ও সৌন্দর্যে মণ্ডিত করবে।

জাদুঘর নয়, যেন এক মন্দির, রাইট নিজেই সেজন্যে এর নাম দিয়েছিলেন ‘টেম্পল অফ দি স্পিরিট’। এক সোমবার, সেদিন আকাশ ঝকঝকে আলোয় মোড়া, আমরা জ্যাকোমেত্তির সঙ্গে পরিচিত হতে সেই ‘চেতনার মন্দিরে’ এসে হাজির। ভবনটির বাইরে দাঁড়িয়ে হাসনাতভাই বললেন, ‘বাহ্, কী সুন্দর।’

আমরা ভেতরে পা বাড়াই, একতলা থেকে দোতলা, দোতলা থেকে তিনতলায় হেঁটে উঠি। গুগেনহাইমের প্রদর্শনীটা এ-শিল্পীর সারাজীবনের কাজ নিয়ে সাজানো হয়েছে, শুধু ভাস্কর্য নয়, তাঁর পেইন্টিং ও ড্রয়িংও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সবমিলিয়ে প্রায় দুশো উপকরণ, সনানুক্রমে সাজানো। ফলে শিল্পীর পুরো জীবনটাই আমরা আবিষ্কার করার সুযোগ পাই। প্যারিসের মঁপারসেতে তাঁর অতিক্ষুদ্র স্টুডিওতে শিল্পীর সঙ্গে সাক্ষাৎকার ও তাঁর কাজ করার ভিডিও ডকুমেন্টারি এই আবিষ্কারকে আরো অধিগম্য করে তোলে। ছবির পাশের দেয়ালে প্রতিটি ছবির সংক্ষিপ্ত বিবরণ, তার কারিগরি ব্যাখ্যা, আমাদের বোধের পরিধিকে বিস্তৃত করে।

একজন শিল্পী ক্রমশ কীভাবে নিজেকে আবিষ্কার করেছেন – একবার গড়েছেন, আবার তা ভেঙে নতুন করে গড়েছেন – সে-সত্যটি এই সনানুক্রমিক প্রদর্শনী থেকে আমাদের কাছে ধরা পড়ে। আমরা এ-সত্যটি বুঝতে পারি যে, একজন প্রকৃত শিল্পীর একটাই কাজ, সার্বক্ষণিক অন্বেষণ। স্বীকৃত শিল্পী হয়ে ওঠার পরও জ্যাকোমেত্তি নিজের কাজে কখনো সন্তুষ্ট ছিলেন না, একদম নিখুঁত একটি কাজকেও নির্মাণের পরপর ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছেন। যা চাই, তা হচ্ছে না। নিজেই বলেছেন, ঠিকমতো যদি একটি মাত্র মূর্তি বানানো শেষ করতে পারতাম তাহলে আরো হাজারটা আমি বানাতে পারতাম। কিন্তু সে-কাজটাই করে উঠতে পারি না। তাঁর লক্ষ্য ছিল সর্বাঙ্গ নিখুঁত – অ্যাবসলুট পারফেকশন। কিন্তু সেই পারফেকশন অধরা রয়ে যায়, তাই বারবার নিজেই নিজের কাজ ভেঙে ফেলেছেন বা বাতিল করেছেন। কোথায় যেন পড়েছি, একজন জ্যাকোমেত্তির এই ভাঙা-গড়ার খেলাকে সিসিফাসের সঙ্গে তুলনা করেছেন। গ্রিক পুরাণের এই চরিত্র পাহাড়ের চূড়ায় প্রস্তরখ- টেনে টেনে তোলে, তা নিচে গড়িয়ে পড়লে ফের তা ওপরে টেনে তোলে। আলবেয়র ক্যামু এ-অবস্থাকেই ‘অবাস্তব’ – অ্যাবসার্ড – নাম দিয়েছেন, মিথ অফ সিসিফাস এ-নামে বিখ্যাত গ্রন্থও লিখেছেন। নিখুঁতের এই অন্বেষণের কারণেই জ্যাকোমেত্তির নিজের ভাস্কর্য বিক্রি অথবা প্রদর্শনীতে অনীহা ছিল প্রচ-, যদিও এর ফল ছিল অবধারিত দারিদ্র্য।

জ্যাকোমেত্তির জন্ম অবশ্য সচ্ছল পরিবারে। পিতা জোভানি জ্যাকোমেত্তি ছিলেন তাঁর সময়ের সফল চিত্রকর, তিনি পুত্রকে নিজ হাতে নকশা শিখিয়েছেন, দেশ-বিদেশের – বিশেষত আফ্রিকান শিল্প-কৌশলের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। নিজের চেয়ে পুত্র অনেক প্রতিভাবান, কিন্তু সুইজারল্যান্ডে নিজের প্রতিভার স্বীকৃতি মিলবে না – এ-বিশ্বাস থেকে তিনিই জ্যাকোমেত্তিকে ১৯২২ সালে প্যারিসে ঠেলে পাঠান। তখন তাঁর বয়স ২১। সেই শহরে তখন নিজ নিজ আসন গড়ে নিয়েছেন পিকাসো, মাতিস, দালি ও মিরো। আধুনিক শিল্পকলার সে এক অসম্ভব সজীব সময়, ফবিজম, দাদাইজম, কিউবিজমের উন্মেষকাল পেরিয়ে গেছে, শিল্পকলা নিজের সম্ভাবনার সীমানা অনবরত অতিক্রমের এক অবাস্তব প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। এক কথায় অভাবিত ধনী এক সময়। জ্যাকোমেত্তি খুব সহজেই এই আধুনিক আন্দোলনের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়লেন, বন্ধুত্বও হয়ে গেল এই সময়ের সেরা লেখক-শিল্পী-বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে। এঁদের অন্যতম ছিলেন পরাবাস্তবতার প্রধান প্রবক্তা আঁদ্রে ব্রেতো, ফরাসি অস্তিত্ববাদের জনক জ্যঁ পল সার্ত্র, কবি গিয়ম এপোলেনিয়র, নাট্যকার স্যামুয়েল বেকেট ও জ্যঁ জেনে। জ্যাকোমেত্তির আঁকা এঁদের প্রত্যেকের স্কেচ অথবা তেলরং সেই বন্ধুত্বের প্রমাণ। কোনো সন্দেহ নেই, এঁদের ভাবনা-চিন্তা, বিশেষত কবিতা ও ভাস্কর্যের আন্তঃসম্পর্ক, নানাভাবে জ্যাকোমেত্তিকে প্রভাবিত করেছিল, তাঁকে আন্দোলিত করেছিল। ভাস্কর হিসেবে যখন তাঁর বিস্তৃত পরিচিতি, জ্যাকোমেত্তি তখনো সাগ্রহে কবি-বন্ধুদের বইয়ের জন্য, বিশেষত তাঁদের কবিতার, অঙ্গসজ্জা করে দিয়েছেন। যেমন, মৃত্যুর কয়েক বছর আগে রেনে শা-র একটি গদ্য কাব্যগ্রন্থের জন্য বিস্ময়কর ইলাস্ট্রেশন। বেকেটের ওয়েটিং ফর গদো নাটকের জন্য জ্যাকোমেত্তির        দৃশ্য-পরিকল্পনা, বিশেষত মঞ্চের কেন্দ্রে শুকনো লম্বা প্রায় পত্রহীন একটি ঝুলন্ত বৃক্ষ, একসময় প্যারিসে লোকের মুখে মুখে ফিরত।

১৯২৭ সালে জ্যাকোমেত্তি প্যারিসের মঁপারসেতে অতিক্ষুদ্র একটি স্টুডিও ভাড়া করেন। ১৯৬৬ সালে তাঁর মৃত্যুর সময় পর্যন্ত এই স্টুডিওতেই কাজ করেছেন তিনি। নামি অথবা অজানা মডেলরা এখানে এসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা শিল্পীর সামনে সেশনে অংশ নিয়েছেন। গুগেনহাইমের প্রদর্শনীতে এ-স্টুডিওতে কর্মরত শিল্পী – তিনি কাজ করছেন, একই সঙ্গে অনবরত কথা বলে চলেছেন, একের পর এক সিগারেট খাচ্ছেন – আমাদের প্যারিসের সেই স্বপ্নময় জগতে নিয়ে যায়। শিল্পীর কাজের জায়গা কত গুরুত্বপূর্ণ সে-কথা বোঝাতে জ্যঁ জেনে পঞ্চাশ সালের দিকে জ্যাকোমেত্তির স্টুডিও নিয়ে মস্ত এক প্রবন্ধই লিখে ফেলেছিলেন। পরবর্তী সময়ে পর্যাপ্ত বিত্তশালী হওয়া সত্ত্বেও জ্যাকোমেত্তি কখনো এ-স্টুডিও ছেড়ে যাওয়ার কথা ভাবেননি। বলেছিলেন, এখানে আমি যা খুশি করতে পারি, অন্য কোনো বড় স্টুডিওতে গেলে এর চেয়ে ভিন্ন কিছু করতে পারতাম তা তো মনে হয় না।

জ্যাকোমেত্তির জীবনীকার জেমস লর্ড অন্য আরেকটি বিষয়ে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। ছবি আঁকার কাজে জ্যাকোমেত্তির হাতেখড়ি তাঁর পিতার ক্ষুদ্র, অপরিসর স্টুডিওতে। ‘সেখানে ছবি আঁকতে আমি যে-আনন্দ পেয়েছি, অন্য কোথাও নয়। স্কুল শেষ হতে না হতেই আমি স্টুডিওতে ছুটে যেতাম, জানালার ধারে আমার জন্য নির্ধারিত স্থানে বসতাম, হয় ছবি আঁকতাম নয়তো ছবির বই উলটাতাম’, লর্ডকে জ্যাকোমেত্তি বলেছিলেন। অনুমান করি, শৈশবের সেই আনন্দ ধরে রাখতেই মঁপারসের এই অপরিসর স্টুডিও।

১৯৪৭ সালে, নিউইয়র্কে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর তাঁর প্রথম বৃহৎ প্রদর্শনীর সময়, সিমন দ্য বোভোয়ারের লেখা একটি চিঠি থেকে জ্যাকোমেত্তির এই স্টুডিও ও তাঁর প্রাত্যহিক অভ্যাসের একটি চিত্র – অথবা তার আভাস মেলে। বোভোয়ার  লিখছেন :

‘বিশ বছর আগেই জ্যাকোমেত্তি শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল। তার পরাবাস্তব কাজের জন্য বড় অংকের দাম পেয়েছে, যেমন পিকাসো পেত। কিন্তু এক সময় তার মনে হলো কিছুই হচ্ছে না, সবকিছু ছেড়েছুড়ে দিয়ে একা কাজে ডুবে গেল। বলতে গেলে কোনো কাজই বিক্রি করত না, বেঁচে থাকার জন্য যা দরকার শুধু সেটুকু। ফলে সে সময়টা খুব দারিদ্র্যের মধ্যে সে জীবন কাটায়, কাপড়চোপড় ভীষণ ময়লা। মনে হয় কাদামাটি তার খুব পছন্দ, স্নানে কোনো আগ্রহ নেই।

গতকাল ওর বাসায় গিয়েছিলাম। একটা বাগানের ভেতর দিয়ে ওর কাজ করার স্টুডিও, পাশে একটা ঘর, সেখানে কোনো আসবাবপত্র নেই, ছাদে ফুটো, জল পড়ে, সে জল ধরার জন্য অসংখ্য হাঁড়ি-পাতিল রয়েছে। এখানেই সে দিনে ১৫ ঘণ্টা কাজ করে, প্রায় সারারাত ধরে। ঠান্ডায় হাত জমে যায়, তা সত্ত্বেও কোনো সম্বিত নেই, কোনো ভাবলেশ নেই। অল্প বয়সী একটি মেয়ে আছে ওর সঙ্গে, তাঁর জন্য ওর বিস্তর দয়ামায়া, কিন্তু খুব মিষ্টি প্রকৃতির কোনো মানুষ সে নয়। তবে জ্যাকোমেত্তির যে জিনিসটা আমার পছন্দ তা হলো, কোনো কিছুতেই ওর   তৃপ্তি নেই। দেখা গেল একদিন হয়তো গত দুই বছরে যা কিছু করেছে, সব ভেঙে গুঁড়িয়ে ফেলল।’

জ্যাকোমেত্তি সম্বন্ধে বোভোয়ার মন্তব্য করেছেন, সব বিষয়েই তার আগ্রহ ছিল, জীবনকে সে ভালোবাসত, আর সেই ভালোবাসার পেছনে ছিল গভীর অনুসন্ধিৎসা। ‘সে এতো সুন্দর করে কথা বলত যে, তাকে শুনতে আমি কখনো ক্লান্তি বোধ করতাম না।’

অনেকেই বলেছেন, ভাস্কর না হলে জ্যাকোমেত্তি সম্ভবত কবি অথবা লেখক হতেন। ছবি আঁকার পাশাপাশি তিনি কবিতা ও গদ্য লিখতেন, নিজের নোটবই রাখতেন, তাতে প্রতিটি ছবির শুধু স্কেচ নয়, কাব্যিক ব্যাখ্যাও ছিল। একজন মন্তব্য করেছেন, জ্যাকোমেত্তি একজন ভাস্কর ছিলেন, যিনি লিখতে ভালোবাসতেন অথবা তিনি একজন লেখক ছিলেন, যিনি ভাস্কর্য নির্মাণ করতেন। গুগেনহাইমের প্রদর্শনীতে জ্যাকোমেত্তির নোটবই, খসড়া খাতা, হাতের লেখা দেখে সেকথায় প্রত্যয় জন্মে।

জ্যাকোমেত্তি বিশ্বজুড়ে পরিচিত তাঁর অতিরিক্ত লম্বা, অতিরিক্ত শুকনো মানুষের ভাস্কর্যের জন্য, তারা কখনো হাঁটছে অথবা বসে। কিন্তু সর্বদাই বিষণœ ও একাকী। সর্বদাই দর্শকদের কাছ থেকে বেশকিছু দূরত্বে। জঁ পল সার্ত্র প্রথম জ্যাকোমেত্তির ভাস্কর্যের এই দুই বৈশিষ্ট্যের প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। দুই বৈশিষ্ট্যই তাঁর কাছে জ্যাকোমেত্তির অস্তিত্ববাদী আনুগত্যের প্রমাণ বলে মনে হয়েছিল। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর করা তাঁর অধিকাংশ কাজের সঙ্গেই এই অস্তিত্ববাদী তকমা সেঁটে দেওয়া হয়, যার জন্য সার্ত্র ও তাঁর বিদুষী বান্ধবী সিমন দ্য বোভোয়ার বহুলাংশে দায়ী। এটি তাঁর শিল্পীজীবনের দ্বিতীয় পর্যায়। প্রথম পর্যায়ে, যার শুরু প্রথম মহাযুদ্ধের পর, জ্যাকোমেত্তি পরিচিত পরাবাস্তববাদী হিসেবে, সেটাও এই আন্দোলনের মুখ্য প্রবক্তা আঁদ্রে ব্রেতোর জন্য। সার্ত্র যেমন জ্যাকোমেত্তির ভাস্কর্যে নিজের তত্ত্বের অনুমোদন ও স্বীকৃতি খুঁজে পেয়েছিলেন, ব্রেতোও তাতে পরাবাস্তবতার স্পষ্ট লক্ষণ চিহ্নিত করেছিলেন, নিজের প্রয়োজনেই। জ্যাকোমেত্তি দুই লেবেলেই সম্মতি জানিয়েছিলেন, যদিও শিল্পী হিসেবে তাঁর নজর কোনোভাবেই কাটছাঁট কোনো তত্ত্বে বেঁধে রাখার পক্ষে ছিল না।

জ্যাকোমেত্তিকে যাঁরা ব্যক্তিগতভাবে চিনতেন তাঁদের ধারণা, তিনি শিল্পী হিসেবে নিজের অবস্থান পোক্ত করতেই ব্রেতো বা সার্ত্রের নিজস্ব রাজনীতিতে সম্মতি দিয়েছিলেন। জ্যাকোমেত্তি যখন পরাবাস্তববাদী নির্মাণরীতি ছেড়ে ফিগারেটিভ ভাস্কর্যে আগ্রহী হয়ে উঠলেন, অবচেতনের বদলে চেতনার জগতে এসে সরাসরি স্টুডিওতে মডেল নিয়ে ফের কাজ শুরু করেন, ব্রেতো ও তাঁর বন্ধুরা এতোটা ক্ষিপ্ত হয়ে পড়েন যে, তাঁরা রীতিমতো সভা ডেকে জ্যাকোমেত্তিকে পরাবাস্তববাদী ক্লাব থেকে বহিষ্কার করেন।

গুগেনহাইমের প্রদর্শনীর পরিকল্পনার পেছনে প্রধান মস্তিষ্ক জ্যাকোমেত্তি ফাউন্ডেশনের প্রধান ক্যাথরিন গ্রেনিয়ের। তিনি জানিয়েছেন, জ্যাকোমেত্তি যে পরাবাস্তব চিন্তাধারা দ্বারা প্রভাবিত, একথা প্রথম আবিষ্কার করেন এই শিল্পধারার সবচেয়ে সফল প্রবক্তা সালভাদর দালি। ১৯৩০ সালে প্যারিসের রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় এক গ্যালারির কাচের দেয়ালে জ্যাকোমেত্তির ‘সাসপেন্ডেড বল’ এই নামের একটি ভাস্কর্য হঠাৎ তাঁর চোখে পড়ে। তাঁর মনে হলো এটি যথার্থ একটি পরাবাস্তব কাজ। পরে দালি সে-ভাস্কর্যের প্রশংসা করে দীর্ঘ এক প্রবন্ধও লিখেছিলেন। দালির নিজের আগ্রহ ছিল ‘বস্তুর প্রতীকী কার্যকারিতায়’, তাঁর মনে হলো এ-ভাস্কর্যে সে-তত্ত্বের ব্যবহারিক রূপান্তর ঘটেছে। দালির কাছে এ-ভাস্কর্যের কথা শুনে ব্রেতো তা দেখতে আসেন এবং তাৎক্ষণিক জ্যাকোমেত্তিকে নিজের দলের সদস্য করে নেন।

গুগেনহাইমের প্রদর্শনীতে ‘নিলম্বিত গোলক’ ভাস্কর্যটি দেখে এর তাৎপর্য বোঝার চেষ্টা করি আমরা। কাজটির পরাবাস্তব ব্যাখ্যার সঙ্গে অপরিচিত এমন দর্শক স্থানগত দূরত্ব বজায় রেখেও যে জ্যামিতাকৃতি রেখায় ভাস্কর্যটি নির্মিত হয়েছে তার উৎকর্ষে মুগ্ধ হবেন। তবে এর পরাবাস্তব ব্যাখ্যার সঙ্গে পরিচয় থাকলে জ্যাকোমেত্তির শৈল্পিক লক্ষ্য অনুধাবনে সহজ হয়। এখানে আমরা দেখি লোহার একটি খাঁচার ভেতর আটকে আছে একটি শ্বেত গোলক, স্থির কিন্তু পেন্ডুলামের মতো দোদুল্যমান। একটি বক্রাকার বস্তুর সঙ্গে তার সংঘর্ষ ঘটছে, আমরা মনের চোখে দেখতে পাই দোদুল্যমান হওয়ায় গোলকটি বারবার এপাশ-ওপাশ করছে, বস্তুটির সঙ্গে তার স্পর্শ ঘটে, কিন্তু কখনোই তারা পরিপূর্ণভাবে একে অপরে নিমজ্জিত হয় না। এই বস্তু, সে কি শিশ্ন অথবা তার প্রতীক? অনুমান করি, দালি ও ব্রেতোর চোখে এই গোলক পুরুষের যৌনক্ষুধার প্রতীক, স্বপ্নে সে বারবার ফিরে আসে নিজের অবদমিত বাসনার প্রকাশ হিসেবে। এমনকি শ্বেত গোলকটির একটি উন্মুক্ত অংশ, তাও  যৌন-সহিংসার প্রতীক। কিন্তু এখানে কোনটি পুরুষ, কোনটি নারী?

গল্প রয়েছে, কাজটি ব্রেতোকে এতোটা আন্দোলিত করে যে, তিনি ভাস্কর্যটি নিজে কিনে নেন এবং সবাইকে গর্বের সঙ্গে তা দেখাতে ভালোবাসতেন। তাঁর পরাবাস্তব পরিবৃত্তির আগে জ্যাকোমেত্তি মুখ্যত কিউবিস্ট অংকন ধারায় বস্তুর আকার বা ফর্ম নিয়েই পরীক্ষা-নিরীক্ষায় অধিক আগ্রহী ছিলেন। পরাবাস্তবতা প্রকল্পে অংশগ্রহণের পর জ্যাকোমেত্তির আগ্রহের কেন্দ্র হয়ে পড়ে অবচেতনের আবিষ্কার। এ-আবিষ্কারের একটি আবশ্যিক উপাদান স্মৃতি – অথবা স্মৃতির ভ্রম। বলা যায় ‘সাসপেন্ডেড বল’ ভাস্কর্যটি জ্যাকোমেত্তির কিউবিজম থেকে পরাবাস্তবতায় আগমনের একটি সেতু।

জ্যাকোমেত্তির পরাবাস্তব পর্যায়ের অন্য প্রধান কাজ, ‘ওম্যান উইথ হার থ্রোট কাট’। এটির নির্মাণ সাল ১৯৩২। গুগেনহাইমে ভাস্কর্যটি দেয়ালে সাঁটা নয়, মাটিতে বিছানো, ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, দর্শক যেন পথ চলতে হঠাৎ হোঁচট খেয়ে পড়েন, সেজন্য এভাবে প্রদর্শনের জন্য শিল্পীর নির্দেশ। মাটিতে শায়িত এই নারীর মাথাটি দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন, তার বাঁ-হাতটি উঁচানো, যেন কারো আঘাত ঠেকাতে প্রস্তুত, অথচ তার আগ্রাসী পিনোন্নত স্তন ও অবমুক্ত দুই পা দর্শককে যৌন আগ্রাসনে আহ্বান জানায়। তাহলে কি এটি কোনো ধর্ষণের পূর্বমুহূর্ত অথবা তার আমন্ত্রণ? এই ভাস্কর্য দেখে একই সঙ্গে কামনা ও বিবমিষার অনুভূতি জাগে। জ্যাকোমেত্তির কল্পনায়, এই নারীদেহ একই সঙ্গে প্রবল শীৎকার ও মৃত্যুর পাতানো ফাঁদে নিক্ষিপ্ত। চরম যৌনসুখ – অর্গাজম – সে তো এক রকম মৃত্যু, কারণ চূড়ান্ত সুখ অর্জিত হয়েছে, এখন মৃত্যু যদি আসে তাতেও আপত্তি নেই।

প্রায় একই সময়ে, অর্থাৎ ১৯৩২ সালে, জ্যাকোমেত্তি ‘ওয়াকিং ওম্যান’ নামে আরো একটি নারীদেহের ভাস্কর্য নির্মাণ করেছিলেন। অন্য অধিকাংশ ভাস্কর্যের মতো এটিরও একাধিক সংস্করণ রয়েছে, যার কয়েকটি ব্রোঞ্জের। পেগি গুগেনহাইম, এই জাদুঘর যাঁর উৎসাহে ও আর্থিক বদান্যে নির্মিত, তিনিও একটি ব্রোঞ্জমূর্তি সংগ্রহ করেছিলেন, যা প্রদর্শনীতে রাখা আছে। ‘ওয়াকিং ওম্যানে’র অন্য একটি সংস্করণে জ্যাকোমেত্তি নারীমূর্তির মস্তকের পরিবর্তে ভায়োলিনের অগ্রভাগ ব্যবহার করেছিলেন, নিমজ্জিত স্বপ্ন ও গোপন বাসনার প্রতীক হিসেবে। গুগেনহাইমে যে-ভাস্কর্যটি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তা যতটা না পরাবাস্তব, তার চেয়ে অনেক বেশি আফ্রিকান, বিশেষত মিশরীয়, শিল্পধারার প্রতিনিধিত্বশীল কাজ মনে হয়। নারীর দেহটি মসৃণ, তার পিনোন্নত স্তন নির্ভুল, তন্বী নিখুঁত পায়ে তরুণী যোনির ইঙ্গিত, সব মিলিয়ে এক কথায় একদম ক্লাসিক্যাল একটি ভাস্কর্য যেন।

এটি তাঁর পরাবাস্তব পর্যায়ের কাজ, অথচ ফর্মের বিকৃতির বদলে নিখুঁত প্রকাশ অর্জনে তার সাফল্য আমাদের মনে করিয়ে দেয়, জ্যাকোমেত্তি অবদমিত বাসনার প্রকাশের বদলে অবলোকিত বস্তুর প্রতিনিধিত্বশীল নির্মাণেই অধিক স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন। তিনি ‘প্রকৃতি থেকে প্রতিরূপ’ নির্মাণে বিশ্বাসী, এ-কথা জ্যাকোমেত্তি অনেকবার বলেছেন। কিন্তু অবিকল প্রতিরূপ নয়, যে-ছবিটি তাঁর দৃষ্টিতে ধরা পড়েছে তার ‘ইন্টারপ্রিটেশন’। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর যে নব বাস্তব বা নিও রিয়েলিস্ট ধাঁচের কাজের জন্য তিনি দর্শকের কাছে সবচেয়ে বেশি পরিচিত, তা প্রকৃতি থেকে অবিকল প্রতিরূপ ভাবলে অন্যায় হবে। এতে অবলোকনের সাথে শিল্পীর উপলব্ধ চেতনার সমন্বয় ঘটেছে, আর সার্ত্রের কাছে সেসব শিল্পকর্ম ছিল ‘অস্তিত্ববাদের চুম্বক’ – এপিটম অফ একজিস্টটেনশিয়ালিজম।

জ্যাকোমেত্তি বলতে আমাদের কাছে – আমার কাছে – ১৯৪৭ সালে তৈরি ‘ম্যানপয়েন্টিং’ এই ভাস্কর্যটি। গল্প শুনেছি, নিউইয়র্কে তাঁর প্রথম প্রদর্শনী উপলক্ষে জ্যাকোমেত্তি মাঝরাতে শুরু করে সকাল ন’টার মধ্যে সে-কাজ শেষ করেছিলেন। ভেবেছিলেন দ্বিতীয় আরেকটি কাজ হবে, সেটিও পুরুষের, প্রথম পুরুষটি আঙুল তুলে দ্বিতীয় পুরুষটিকে কিছু একটা নির্দেশ করছে। সে-কারণেই এর নাম ‘ম্যানপয়েন্টিং’। সকালে নতুন ছাঁচ বানানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন, এমন সময় যে-ফাউন্ড্রিতেসে ছাঁচ দিয়ে ভাস্কর্যটি বানানোর কথা তাদের লোক এসে হাজির। ঠিক আছে, এতেই হবে, এই ভেবে দ্বিতীয় ভাস্কর্যটি না বানানোর সিদ্ধান্ত নিলেন। তিন বছর আগে, ২০১৫ সালে, লন্ডনে ১৪১ মিলিয়ন ডলারে সেই ভাস্কর্য বিক্রি হয়েছিল, তাঁর কোনো কাজের জন্য যে-মূল্যের কথা জ্যাকোমেত্তি জীবিত থাকতে স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারতেন না।

ঢুকতে না ঢুকতেই দেখা মিলে গেল ‘ম্যানপয়েন্টিং’য়ের সঙ্গে। কাচের দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে সে-মূর্তি, ঠিক পেছনে ম্যানহাটনের ফিফথ অ্যাভিনিউ, তার পাশ দিয়ে সেন্ট্রাল পার্কের ঘন কালো সবুজ অরণ্যের আমন্ত্রণ। জ্যাকোমেত্তি যত পুরুষের ভাস্কর্য নির্মাণ করেছেন, তার অধিকাংশ লম্বা – অস্বাভাবিক রকম লম্বা – এবং অস্বাভাবিক রকম শীর্ণকায়। তাদের প্রায় সবাই যেন কিছু করছে – হাঁটছে, আঙুল দিয়ে কিছু দেখাচ্ছে, যেন খুব ব্যস্তসমস্ত। মেয়েদের ছবিগুলো কিছুটা ভিন্ন, তারাও লম্বা ও শীর্ণকায়া, কিন্তু অধিকাংশই স্থির, উপবিষ্ট। ছেলেমেয়ে উভয়ের মুখই বিষণœ, এবড়ো-খেবড়ো, চলতাওঠা। মনে হয় ক্ষুধার্ত, কতদিন যেন আহার জোটেনি। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় ও পরে যত কাজ জ্যাকোমেত্তি করেছেন, তার অধিকাংশই ঠিক এ-ধাঁচের। যুদ্ধটা এ-রকম ছিল, কঠোর, অভাবের, যেন শুধু বেঁচে থাকার লড়াই। কিন্তু এটা লড়াই, নীরবে পরাজয় মেনে নেওয়া নয়, সে-কথার প্রমাণ লোকটা দাঁড়িয়ে আছে, পড়ে যায়নি। সে কোথাও যাচ্ছে, ছুটছে, এগোচ্ছে।

শুধু এই ভাস্কর্য নয় – জ্যাকোমেত্তির আরো অনেক পুরুষ ভাস্কর্যের বেলায় যা লক্ষণীয় তা হলো, অনবরত গতি। আর গতির ভেতর দিয়ে আমরা নিজেদের ক্রমাগত বদল করি। সবকিছুই অনিশ্চিত, সে-কারণেই অব্যাহত পরিবর্তন। এই অনিশ্চয়তাকে অনেকে ফরাসি অস্তিত্ববাদের প্রতিফলন বলে ধরে নিয়েছেন।

আমরা কাছ থেকে ‘ম্যানপয়েন্টিং’ দেখে সে-কথা বোঝার চেষ্টা করি। অস্তিত্ববাদের মোদ্দা অর্থ ছিল মানব অস্তিত্বের অর্থহীনতা, তার অনিবার্য অনিশ্চয়তা। ঈশ্বর নেই, অতএব নির্ধারিত নীতিবোধও নেই যার দ্বারা মানবজীবন চালিত হবে। এ-অবস্থায় মানুষ নিজেই খুঁজে নেয় তার সামনে  এগোনোর পথ, যদিও কখনো কখনো সে-পথ ঘন গহন আঁধারে মোড়া। অনিশ্চিত, দুর্বোধ্য, একাকী।

সন্দেহ নেই, ‘ম্যানপয়েন্টিং’ দেখে মানব অস্তিত্বের একাকিত্ব সম্বন্ধে ধারণা জন্মে, তার বিচ্ছিন্নতার ইঙ্গিতও মেলে। কিন্তু সে আশাহীন, এ-কথা আমার মনে হয় না। এতো নিথর নিশ্চল নয়, জ্যাকোমেত্তি নিজে গতিকে পরিবর্তনের প্রমাণ হিসেবে দাখিল করেছেন। তাহলে এ-ভাস্কর্যে যে-গতি, এখানে তো পরিবর্তনের সম্ভাবনারই ইঙ্গিত। তার চেয়েও বড় কথা, জ্যাকোমেত্তি বিষয়ে ওপরের গল্পটি যদি সঠিক হয়, তাহলে তো এই ভাস্কর অন্য মানুষের সঙ্গ কামনা করেছিলেন, যূথবদ্ধতায় আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। সে একাকী কিন্তু গভীরভাবে কামনা করে সঙ্গ। তাহলে?

সার্ত্র ‘ম্যানপয়েন্টিং’ ভাস্কর্যটির পুরুষটিকে বলেছেন ‘সলিটারি’। তার শালপ্রাংশু দেহ, শুকনো ডালের মতো লম্বা বাহু, ঠিক মানুষ নয় – তার কংকাল – দেখে তেমন একাকী, বিচ্ছিন্ন মানব অস্তিত্ব বিষয়ে আমাদের ভিন্ন এক আততি জাগে। জীবিত অথচ মৃত্যুর মুখোমুখি। হয়তো সে-কারণেই সার্ত্র এ-কাজটিকে ‘হাফ ওয়ে বিটুইন নাথিংনেস অ্যান্ড বিইং’ বলে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু তার পায়ের দিকে তাকান, সে শক্তভাবে মাটির ওপর দাঁড়ানো। কোনো সন্দেহ নেই, ক্ল্যাসিক্যাল অর্থে যে-ভাস্কর্যের সঙ্গে আমরা পরিচিত, যেখানে মানুষের দেহ ও দেহের প্রতিটি অঙ্গ নিখুঁত, জ্যাকোমেত্তির অঙ্গুলি নির্দেশরত পুরুষ তেমন ভাস্কর্য নয়।

এবড়ো-খেবড়ো, খুবলে খাওয়া মুখ, রক্তশূন্য দেহ এবং প্রায় নির্জীব এই দৃষ্টি আমাদের পরিচিত সব ভাস্কর্য থেকে ভিন্ন। কিন্তু সে তো মোটেই নির্জীব নয়, সে চলন্ত, এবং সেই কারণে সে এক অন্বেষণে ব্যস্ত। কেউ একজন বলেছেন, ‘ম্যানপয়েন্টিং’য়ের উত্থিত আঙুলটি একটি নারীর প্রতি নির্দেশিত, কিন্তু সে-নারী অধরাই থেকে যায়, যার ছাপ রয়েছে পুরুষটির ব্যথিত, আহত কোটরাগত অক্ষিগোলকে। সে যে যাই বলুন, আমার কাছে এই মূর্তি আশার সম্ভাবনার সংবাদ দেয়। কোথায় যেন পড়েছি, জ্যাকোমেত্তি একবার বলেছিলেন, তিনি রাস্তায় ট্রাফিক লাইটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে ভালোবাসেন, কারণ সেখানে নিরন্তর জীবনের ধুকপুকানি শোনা যায়। এমন লোক, হোক না তাঁর ভাস্কর্যের বাহ্য সুর দূরত্ব ও নিরাবলম্বতা, তিনি জীবনকে ভালোবাসতেন, এ-প্রদর্শনী দেখার পর সে-কথায় বিশ্বাস করতে আমার বিন্দুমাত্র দ্বিধা জাগে না।

জ্যাকোমেত্তি যে-রাজনৈতিক ধারার প্রতি নৈকট্য বোধ করতেন – ফরাসি কমিউনিস্ট পার্টি – তার কারণেও শুদ্ধ শিল্পের বদলে মানবিকতার প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ শিল্প নির্মাণে তাঁর আগ্রহ স্বাভাবিক, সে-কথা বলাও বোধহয় ভুল হবে না। কোনোদিন পার্টির সদস্যপদ গ্রহণ করেননি, কিন্তু এই দলের ভাবনা-চিন্তার প্রতি সংহতি প্রকাশে তিনি ইতস্তত করেননি। পরাবাস্তবতার প্রবক্তা হিসেবে ব্রেতো শিল্প ও রাজনীতিকে বিভক্ত রাখতে আগ্রহী ছিলেন, কমিউনিস্ট লুই আরাগঁ তাঁর সে-বক্তব্যের প্রতিবাদে পরাবাস্তব গ্রুপ থেকে পদত্যাগ করেন। সে-সময় জ্যাকোমেত্তি আরাগঁর পক্ষ নিয়েছিলেন। তিরিশের দশকে ‘লাল বাহিনী’ কবিতা লেখার জন্য যখন আরাগঁ ফরাসি সরকারের কোপানলে পড়েন, জ্যাকোমেত্তি সে-সময়েও তাঁর এই বামপন্থি কবিবন্ধুর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। আমার ধারণা, যুদ্ধ-উত্তর পর্যায়ে জ্যাকোমেত্তি যে ক্ষয়প্রাপ্ত ও বিচ্ছিন্ন ব্যক্তির ভাস্কর্য নির্মাণে নিজের শক্তি প্রয়োগ করেন, তা ছিল একই সঙ্গে নিজের সময়ের বিবৃতি ও সে-সময়ের অপচয় ও ক্ষয়ের বিরুদ্ধে এক ধরনের প্রতিবাদ, আর তা শিল্পীর নিজের রাজনৈতিক বোধ ও বিশ্বাসের প্রতিফলন।

এ-প্রদর্শনীর পর জ্যাকোমেত্তির ওপর সার্ত্রের লেখা আগ্রহ নিয়ে পড়েছি। তাঁর অন্যান্য লেখার মতো এটিও জটিল ও বহুলাংশে দুর্বোধ্য, তবে জটিলতার এই মোড়ক অতিক্রম করে ভেতরে প্রবেশে সমর্থ হলে পাঠক পুরস্কৃত হবেন, তাতেও সন্দেহ নেই।

সার্ত্রের সঙ্গে জ্যাকোমেত্তির পরিচয়ের শুরুটা ভারি মজার। ১৯৩৯ সাল, চারদিকে আসন্ন যুদ্ধের কালো পর্দা, সে-সময় একদিন প্যারিসের কাফে দ্য ফ্লোরে জ্যাকোমেত্তি বসে, সঙ্গে পানপাত্র। গত কয়েকদিন থেকেই তিনি লক্ষ করেছেন চশমা পরা মাঝবয়সী বিষণœমুখ এক ভদ্রলোক সেখানে এসে বসেন। সেদিন সেই ভদ্রলোক নিজেই জ্যাকোমেত্তির কাছে এসে কথা বললেন, ‘শুনুন, আপনাকে আমি রোজই এখানে দেখি, মনে হয় আমরা দুজনেই একই ধাঁচের মানুষ। আজ আমার পকেটে কানাকড়িও নেই। আপনি কি আমাকে এক গ্লাস সুরা কিনে দেবেন?’

সেই আলাপ থেকে বন্ধুত্ব, একজন নামজাদা দার্শনিক, অন্যজন নামজাদা ভাস্কর। দীর্ঘদিন এই বন্ধুত্ব টিকে ছিল। প্রায় শেষজীবনে এসে সার্ত্রের এক রচনায় নিজের সম্বন্ধে এক গল্প পড়ে ভীষণ খেপে যান জ্যাকোমেত্তি, আর সেখানেই বন্ধুত্বের শেষ।

আমরা যেভাবে জ্যাকোমেত্তিকে দেখে অভ্যস্ত, সার্ত্র কিছুটা ভিন্নভাবে তাঁকে দেখেছেন ও ব্যাখ্যা করেছেন। এ যে ক্ল্যাসিক্যাল ভাস্কর্য নয়, এর ধরনটাই ভিন্ন, সার্ত্রের মতো এতো তির্যকভাবে সে-কথা কেউ বলেননি। জ্যাকোমেত্তির ভাস্কর্য দর্শকের কাছ থেকে দেখার নয়, তাকে দেখতে হবে স্থানিক দূরত্বে, ঠিক যে স্থানিক দূরত্বে জ্যাকোমেত্তি নিজে তাঁর নির্মিত ব্যক্তি অথবা বস্তুর ‘কপি’ নির্মাণ করেন। এই দূরত্ব, সার্ত্রের চোখে, একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। এই স্থানিক দূরত্ব ব্যবহার করেই দর্শকের পক্ষে সম্ভব হয় জ্যাকোমেত্তির নির্মিত প্রতিটি মুখের ও মুখভঙ্গির অন্তর্ভেদী চরিত্র উদ্ধার। অথচ কাছ থেকে দেখলে সে প্রায় অর্থহীন, এবড়ো-খেবড়ো ও ক্ষয়প্রাপ্ত একটি অসুন্দর বস্তু মাত্র।

‘গত তিন হাজার বছর ধরে ভাস্করেরা যা খোদাই করে নির্মাণ করেছে তা মৃত মানুষের শব ছাড়া আর কিছু নয়। এসব মূর্তির কোনোটি হেলানো, কোনোটি সমাধিপ্রস্তরের ওপর বসানো। কোনোটি কেদারায় বসে, কোনোটি-বা ঘোড়ার ওপর সমাসীন। কিন্তু একজন মৃত মানুষ যদি একটি মৃত ঘোড়ার ওপর সমাসীন থাকে, তাহলে সে কোনোভাবেই অর্ধজীবিত একজন মানুষেরও সমতুল্য নয়। জাদুঘরে যেসব শ্বেত অক্ষিমূর্তি আমরা দেখি, তারা শুধু আমাদের প্রতারণাই করে। তাদের হাত দেখে মনে হয় চলন্ত, কিন্তু আসলে লোহার শলাকা দিয়ে তারা সাঁটানো। যে স্থবির ও শীতল দেহ থেকে অন্তর্গত ও অনন্ত বিচ্ছুরণ প্রকাশে সে আপ্রাণ সচেষ্ট, তা আসলে দর্শকদের ধোঁকা দেওয়ার চেষ্টা মাত্র। এই স্থূলসমরূপতা যা গতি, উষ্ণতা ও জীবনের সংকেত দাবি করে, তা আসলে বস্তুর অনন্ত নৈঃশব্দ্যে নিমজ্জিত।’

 

(জ্যঁ পল সার্ত্র, ‘জ্যাকোমেত্তির ভাস্কর্য, নিরঙ্কুশের অন্বেষায়’)

সার্ত্রের কথার অর্থ আমার কাছে এভাবে ধরা পড়ে যে, প্রথাগত ভাস্কর্য, এমনকি পিকাসোর মতো বিপুল প্রতিভাধর শিল্পীর ক্ষেত্রেও, স্থান ও ঘনমান – অর্থাৎ স্পেস ও ভলিউমের সমবণ্টনের নীতি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। জ্যাকোমেত্তি এ-হিসাবটি বদলে দিলেন, ঘনমানের চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল স্থান। মানবের ভঙ্গুরতা, তার অনিত্যতা প্রকাশে এই ভিন্ন সমীকরণ জ্যাকোমেত্তির ভাস্কর্যগুলোকে যে-বৈশিষ্ট্য আরোপ করল তাকে ‘মানবিকতার আধ্যাত্মিক নির্যাস’ হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। ‘ম্যানপয়েন্টিং’ এই নিষ্কর্ষের একটি উদাহরণ। এই শিল্পকর্ম শুধু দৃষ্টিগ্রাহ্য ও বাহ্য বাস্তবতার পুনর্মুদ্রণ নয়, এতে দৃশ্যমান বাস্তব ও উপলব্ধ শিল্প মিলিত হয়েছে, এই সম্মিলন ছাড়া এই ভাস্কর্যের কোনো গুরুত্বই থাকত না।

জ্যাকোমেত্তির ভাস্কর্য এতো বেদনামাখা কেন, তার অন্য একটা ব্যাখ্যা সম্ভবত এই যে, তিনি মৃত্যু দ্বারা ভীষণ প্রভাবিত হয়েছিলেন। ‘রডে ঝোলানো খোলা মু-ু’ নামে তাঁর একটি কাজ রয়েছে, যা দেখে ভীত হতে হয়। এটি একটি প্রায়মৃত মানুষের শুষ্ক করোটি, হয় মাত্র মারা গেছে অথবা মৃত্যুর আগমুহূর্ত। চোখদুটি কোটরাগত, গাল দুটি শুকনো-নির্জীব, ঠোঁট দুটি অবমুক্ত, হয়তো শেষ কোনো কথার উচ্চারণ মাত্র সমাপ্ত হয়েছে। এ-কাজটি ১৯৪৭ সালে করা, অনুমান করি, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের নির্মম অভিজ্ঞতা তাঁকে এ-ভাস্কর্য নির্মাণে আগ্রহী করেছিল।

মৃত্যুর অভিজ্ঞতা তাঁর আরো অনেক কাজেই সাক্ষ্য বহন করে। শুধু দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ নয়, ব্যক্তিগত জীবনেও জ্যাকোমেত্তি একের পর এক মৃত্যুর ভেতর দিয়ে গেছেন। পিতা, বোন, অসংখ্য লেখক ও শিল্পী বন্ধু, এঁদের অনেকেরই নিজ হাতে শেষকৃত্য করতে হয়েছে তাঁকে। ১৯৬৪ সালে মায়ের মৃত্যু তাঁকে এতোটা আক্রান্ত করে যে এর এক বছর পর তিনি নিজেই দেহত্যাগ করেন। মৃত্যুর আগে তিনি অস্বাভাবিক রকম শান্ত, সমাহিত ছিলেন। লর্ড জানিয়েছেন, ডাক্তারদের জ্যাকোমেত্তি বলেছিলেন, আহ্, অবশেষে আমার মায়ের সঙ্গে মিলিত হতে পারব। কিন্তু মৃত্যুর অভিজ্ঞতা তাঁকে জীবনবিমুখ করেনি, তাঁর শিল্পকর্মে ও রাজনৈতিক বিশ্ববীক্ষায় তার প্রমাণ দেখি না। বরং অন্তত আমার কাছে, তাঁর ভাস্কর্যে ও চিত্রকলায় বেদনার ভেতর জীবনকে ধারণ করার অনিবার্য আগ্রহের সংকেত ধরা পড়ে। এদিক দিয়ে আমাদের রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর মিল রয়েছে, যদিও এই মিলের পেছনে কোনো দার্শনিক সমান্তরালতা আবিষ্কার অর্থহীন।

জীবনীকার লর্ড যুবক জ্যাকোমেত্তির একটি অভিজ্ঞতার কথা লিপিবদ্ধ করেছেন। সে-সময় ইতালিতে ট্রেনে ভ্রমণকালে ষাটোর্ধ্ব এক ব্যক্তির সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। ভ্যান মিউর নামে এ-ব্যক্তির সঙ্গে জ্যাকোমেত্তির কী সম্পর্ক তা নিয়ে নানা জল্পনাকল্পনা রয়েছে, কেউ কেউ সমকামিতারও ইঙ্গিত করেছেন। আল্পস পর্বতের সন্নিকটে এক সরাইখানায় রাত্রিবাসের সময় তাঁর মৃত্যু জ্যাকোমেত্তিকে প্রত্যক্ষ করতে হয়। লোকটির চোখ আনত হয়ে আসছিল, গাল কুঁচকে যাচ্ছিল, খোলা মুখ দিয়ে শ্বাস নিতে গিয়ে সে হাঁপাচ্ছিল। জ্যাকোমেত্তির বুঝতে বিলম্ব হয়নি মৃত্যু পায়ে পায়ে এগিয়ে আসছে। তিনি স্কেচ বই নিয়ে বসলেন, সেই ব্যক্তির শেষমুহূর্তগুলো কাগজের পাতায় ধরে রাখলেন। লর্ডকে সে-অভিজ্ঞতার কথা বিবৃত করেছেন এভাবে :

মানুষটির মৃত্যু প্রত্যক্ষের এই অভিজ্ঞতা সবকিছু এলোমেলো করে দিলো। মনে হলো এক ভয়ানক ফাঁদের মধ্যে পড়ে গেছি। যেন কয়েক মুহূর্তের মধ্যে মানুষটি একটি নির্জীব বস্তুতে পরিণত হলো, আর কিছু নয়। তাহলে মৃত্যু যে-কোনো সময়ে যে-কারো জীবনে ঘটতে পারে। যেন একটি বিপদঘণ্টা বেজে উঠল। ট্রেনে তাঁর সঙ্গে আকস্মিক সাক্ষাৎ থেকে এই মৃত্যু পর্যন্ত কত কিছুই না ঘটনাচক্রে ঘটেছে। সবকিছুই যেন ঘটল আমাকে এই ঘটনার সাক্ষী বানাতে। যেন এক আঘাতে আমার জীবনটাই বদলে গেল। সবকিছু কেমন ভঙ্গুর হয়ে পড়ল।

জেমস লর্ড জানিয়েছেন, জ্যাকোমেত্তির স্মৃতিতে তাঁর আঁকা প্রথম যে-ছবিটির কথা ধরা আছে সেটিও মৃত্যুর। রূপকথার গল্প ‘স্নো হোয়াইট’, সেই তুষারশুভ্র কন্যা, এক অরণ্যে যে আশ্রয় পেয়েছিল সাত বামন ভ্রাতার গৃহে। প্রতিহিংসাপরায়ণ বিমাতার কোপে মৃত্যুমুখে স্নো হোয়াইট, তার স্ফটিকশুভ্র কফিনের চারপাশে ক্রন্দনরত সেই সাতভাই। কিন্তু স্নো হোয়াইট তো মৃত নয়, সে মৃত্যুর ভান করছে মাত্র। এভাবে মৃত্যুর ভেতরে জীবনের অন্য অর্থ তাঁর কাছে ধরা পড়ে, পরে ব্যক্তিগত জীবনে প্রকৃত মৃত্যুর মুখোমুখি হয়ে যে-অর্থ গভীরতর নির্দেশনা লাভ করে।

জ্যাকোমেত্তির অধিকাংশ ভাস্কর্যকে আমরা হয় পরাবাস্তব, নয়তো অস্তিত্ববাদী – এই দুভাগে বিভক্ত করে দেখতে অভ্যস্ত। এই বিভাজনের কারণে অনেক সময় আমাদের খেয়াল থাকে না যে, ইউরোপীয় ট্র্যাডিশনের বাইরে আফ্রিকান শিল্পরীতি দ্বারা তিনি কতটা প্রভাবিত হয়েছিলেন। এর একটি প্রমাণ দেখি ‘স্পুনওম্যান’ ভাস্কর্যটিতে। এটি তাঁর প্রথম বড় কাজ, ১৯২৬ সালের দিকে নির্মিত, এ-প্রদর্শনীর কিউরেটর আমাদের জানাচ্ছেন, তরুণ জ্যাকোমেত্তি সে-সময় কিউবিস্ট অংকনরীতির প্রতি ঝুঁকেছিলেন, কিন্তু কিছুতেই সন্তুষ্ট ছিলেন না। নিজের শিক্ষকদের প্রভাব কাটিয়ে ওঠার তাগিদ থেকে তিনি ‘আদিম’ বস্তু পুনর্নির্মাণে অগ্রসর হলেন। আর তার ফল এই ‘স্পুনওম্যান’। পশ্চিম আফ্রিকার ড্যান সম্প্রদায়ের মধ্যে উৎসব-অনুষ্ঠানে খাদ্যবণ্টনে যে-চামচ ব্যবহার করা হয় তা একদিকে ব্যবহারিকভাবে উপযোগী, কিন্তু এর একটি গূঢ় উদ্দেশ্য নারীর প্রতি শ্রদ্ধা জানানো। নারী মানেই মাতৃত্ব, সে-কারণে চামচের মধ্যভাগটি অতিরিক্ত গভীর ও বিস্তৃৃত, যা নারীর গর্ভধারণের কথা মনে করিয়ে দেয়। অন্যকথায়, একটি চামচ নারীর মতো, সে প্রকৃতির দান ধারণ ও বিতরণ করে। জ্যাকোমেত্তি এই মৌল ভাবনাকে গ্রহণ করলেন, কিন্তু তাঁর নবায়িত ব্যাখ্যায় নারী হয়ে দাঁড়াল চামচের মতো (চামচ নারীর মতো নয়)। আফ্রিকান রীতিতে যে ছিল প্রাকৃতিক ও সহজাত, জ্যাকোমেত্তির পুনর্নির্মাণে তা দাঁড়াল ‘বহুভুজবিমূর্তন’ বা ‘প্রিজম্যাটিক অ্যাবস্ট্রাকশন’।

সন্দেহ নেই, ভাস্কর্যটি আফ্রিকান শিল্পরীতি দ্বারা প্রাভাবিত হলেও এর উৎস পরাবাস্তবতায়। এমনকি কিউবিজমের প্রতি জ্যাকোমেত্তির আনুগত্যের ছাপও এতে রয়েছে। মানবদেহ নিয়ে যে-নিরীক্ষায় তিনি প্রায় সারাজীবন ব্যয় করেন, এখানে রয়েছে সেই নিরীক্ষার প্রথম সফল প্রকাশ। জ্যাকোমেত্তি তাঁর অধিকাংশ প্রধান ভাস্কর্যে নারীকে স্থির দেখিয়েছেন – সে স্থির ও অপরিবর্তিত, জ্যামিতিক অথচ সরলীকৃত এ-কাজটিতে তাঁর সেই নির্মাণদর্শনের প্রথম সফল আভাস মিলল।

প্রদর্শনীর প্রথম কয়েকটি গ্যালারি দেখার পরই জ্যাকোমেত্তির পুরুষ ও নারী ভাস্কর্যের মধ্যে যে ফারাক রয়েছে তা স্পষ্ট হয়।  পুরুষদের ভাস্কর্য দেখে মনে হয়, যেন এক গভীর হতাশায় তারা নিমজ্জিত, সে তুলনায় নারীরা যেন অনেক বেশি সাহসী, এক অজ্ঞাত আত্মপ্রত্যয়ে তারা যেন অধিকতর মানবিক। স্পষ্টতই এই নারীমূর্তির অনুপ্রেরণা তিনি পেয়েছিলেন আফ্রিকান, বিশেষত প্রাচীন মিশরীয় অংকনরীতি থেকে। জ্যাকোমেত্তির জীবনীকার লর্ড জানিয়েছেন, শৈশবে পিতার স্টুডিওতে তাঁর মা আনেতের যে-কটি ভাস্কর্য তিনি নির্মাণ করেন, তাতে নির্মিত ভাস্কর্য ও দর্শকের মধ্যে একটি অনিবার্য দূরত্ব রয়ে যায়। এটি আকস্মিক নয়, মায়ের ব্যক্তিত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য এই দূরত্ব জ্যাকোমেত্তির কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। যেন নিজের সামনে আনেত একটি সীমানা বেঁধে দিয়েছেন, কেউ সেই সীমান্ত অতিক্রম করতে পারে না। এই লক্ষ্মণরেখা যেন নারীর ব্যক্তিত্বের প্রকাশ।

মজার ব্যাপার হলো, আত্মবিশ্বাসী নারী চিত্রিত করতে অভ্যস্ত জ্যাকোমেত্তি নারীদেহের গূঢ় রহস্য আবিষ্কার করেন মূলত পতিতাদের কাছ থেকে। নারীদেহের প্রতি প্রবল আগ্রহ সত্ত্বেও যৌন মিলনে তিনি ভীত ছিলেন, লর্ড আমাদের জানিয়েছেন। প্রথম যে-নারীর সঙ্গে তিনি মিলিত হন, তখন তাঁর বয়স ২০, রোমে। এক জ্ঞাতি ভগিনীর প্রতি তাঁর প্রবল আকর্ষণ ছিল, কিন্তু সেখান থেকে কোনো সাড়া না পাওয়ায় খুব বেশিদূর এগোতে পারেননি। সমস্যার সমাধান হলো রোমের এক বেশ্যালয়ে গিয়ে, সেখানে প্রথমবারের মতো সঙ্গমের অভিজ্ঞতার পর তিনি প্রবলরকম আন্দোলিত হলেন। এ তো এক ধরনের স্বাধীনতা, অথচ এর জন্য কোনো অঙ্গীকারের বন্ধন নেই। ‘এটা শীতল, যান্ত্রিক।’

দর্শক হিসেবে যে-নির্মিত শিল্প আমরা দেখি তার অধিকাংশ ব্রোঞ্জের। এরা প্রায় সবই প্লাস্টার কাস্ট থেকে নির্মিত। ক্ল্যাসিক্যাল ভাস্করেরা স্টোন বা প্রস্তর খোদাই করে ভাস্কর্য নির্মাণে অধিক অভ্যস্ত ছিলেন; কিন্তু জ্যাকোমেত্তি তাঁর মাধ্যম হিসেবে নির্বাচন করলেন নরম, ঠুনকো, সহজেই পরিবর্তনযোগ্য প্লাস্টার। গুগেনহাইমের প্রদর্শনীতে জ্যাকোমেত্তির যে-ভিডিওটি রয়েছে তাতে পরিষ্কার দেখা যায় শিল্পী এই প্লাস্টারকে কীভাবে অনায়াসে ভাঙছেন, নতুন ছাঁচে ঢালছেন। ভিডিওটি দেখে আমরা বুঝতে পারি কাদামাটির মতো যে-উপকরণ দিয়ে জ্যাকোমেত্তি তাঁর ভাস্কর্যের মডেলটি নির্মাণ করছেন, তাতে হাতুড়ি নয়, ছুরি-হাতে সেই খোদাইয়ের কাজই তিনি করছেন।

সার্ত্র লিখেছেন, মাধ্যম হিসেবে প্লাস্টারের নির্বাচন আকস্মিক বা উদ্দেশ্যবিহীন ছিল না। প্রস্তরখ-ের জীবন অনিঃশেষ, কিন্তু সে-জীবন তো জড়, হিমায়িত। অন্যদিকে প্লাস্টার পরিবর্তনশীল, সে জীবন্ত, কারণ অনবরত বিবর্তনের ভেতর দিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা তার রয়েছে। জ্যাকোমেত্তি এই প্লাস্টার নিয়ে যেভাবে নিত্য ভাঙাগড়ার খেলায় মেতে উঠতেন, মাত্র নির্মাণ করেই তা ভেঙে ফেলতেন, সার্ত্রের কাছে তা বাস্তব জীবনেরই প্রতিরূপ ছিল। জীবনে তো আমরা অনবরত গতিতে বাস করি, প্লাস্টারের মাধ্যমে সে-গতি অর্জন সম্ভব – প্রস্তরে যা সম্ভব নয়। ‘জ্যাকোমেত্তি তাঁর নির্মাণ উপকরণকে প্রকৃত মানবিক ঐক্য প্রদানে সমর্থ হয়েছিলেন – ক্রিয়ার ঐক্য।’

জ্যাকোমেত্তি বরাবরই ভাস্কর্যের পাশাপাশি ছবি আঁকাতে আগ্রহী ছিলেন। শৈশবে ছবি অংকনের ভেতর দিয়েই শিল্পে তাঁর হাতেখড়ি। তিনি প্রথম ভাস্কর্য নির্মাণ শেষ করেন ১৯১৪ সালে, যখন তাঁর বয়স ১৩। সেই ভাস্কর্যের মডেল হয়েছিলেন তাঁর কনিষ্ঠ ভ্রাতা দিয়েগো। পরে প্যারিসে যখন তিনি রীতিমতো প্রতিষ্ঠিত শিল্পী, তখনো দিয়েগো রয়ে গেছেন তাঁর অনুগত মডেল। তাঁর সহপাঠী ফ্লোরা মায়ো, তাঁর স্ত্রী আনেত ও একাধিক খ-কালীন প্রেমিকাও মডেলের ভূমিকা পালন করেছেন। এমনকি জাপানি অধ্যাপক ইনাইহারাকেও তিনি মডেল হিসেবে ব্যবহার করেছেন। শোনা যায়, জ্যাকোমেত্তি ও ইনাইহারা ঘণ্টার পর ঘণ্টা মডেলিংয়ের কাজে ব্যস্ত থাকতেন, এই ব্যস্ততার ভেতর দিয়েই তাঁরা একে অপরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে ওঠেন। পাঁচ বছর তাঁরা একে অপরের নিকট-সহযোগী ছিলেন, ইনাইহারা নিজে এই বন্ধুত্ব নিয়ে বিস্তারিত লিখে গেছেন।

নিজস্ব বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত ভাস্কর্যের জন্য অধিক পরিচিত হওয়ায় আমরা অনেক সময় ভুলে যাই জ্যাকোমেত্তি বস্তুত একজন প্রথম শ্রেণির চিত্রকর। গুগেনহাইমের প্রদর্শনীটি সেই ভ্রান্তি শোধরাতে সাহায্য করে। শিল্পীজীবনের প্রথমদিকে তিনি পোর্ট্রেট করতে ভালোবাসতেন, পরিবারের নিকট-দূরের প্রায় সবারই পোর্ট্রেট তিনি করেছেন, যার অনেকগুলি রক্ষা পেয়েছে। প্যারিসে আসার পর, বিশেষত ভাস্কর হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার পর, দীর্ঘদিন কোনো ছবি আঁকেননি জ্যাকোমেত্তি। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর অবশ্য তিনি একই সঙ্গে ভাস্কর্য ও চিত্রকলায় – বিশেষত পোর্ট্রেচারে – সমান অভিনিবেশ প্রদান করতেন।

প্রদর্শনীটিতে কনিষ্ঠ ভ্রাতা দিয়েগোর একাধিক পোর্ট্রেট রয়েছে, ‘দিয়েগো’ এই নামে একটি পোর্ট্রেটের দিকে আমাদের নজর পড়ে। জ্যাকোমেত্তি বলেছেন, তিনি যে ব্যক্তির ছবি আঁকছেন, শুধু তার বহিরঙ্গের প্রতিই তিনি আগ্রহী। ‘মানুষের বাইরের রূপ নিয়েই আমি বিস্তর ঝামেলায় আছি, তার ভেতরে কী আছে তা নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় আমার নেই।’ অনুমান করি, কথাটা রসচ্ছলে, কারণ জ্যাকোমেত্তির ভাস্কর্যের মতো তাঁর পোর্ট্রেটগুলোয় আমরা চিত্রিত ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব আবিষ্কারেও সমর্থ হই। যেমন, ‘দিয়েগো’ পোর্ট্রেটটিতে। উপলব্ধ বাস্তবতার অবিকল উদ্ধার তাঁর ঘোষিত লক্ষ্য, কিন্তু ব্যক্তির অন্তর্গত চরিত্র তো সে বাস্তবতার জন্য বাহ্য নয়। দিয়েগো তাঁর শুধু কনিষ্ঠ ভ্রাতা নয়, তাঁর সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য উপদেষ্টা ও সহযোগী। এই আবাল্য বন্ধুর প্রতিরূপ নির্মাণে জ্যাকোমেত্তি হালকা ধূসর পুরোভাগের ভিতে গৈরিক রঙের যে-মুখচ্ছবি এঁকেছেন, তা একই সঙ্গে কোমল ও দৃঢ়। অনুমান করি, জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার কাছে তা ছিল অনুজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। নিজের ভাস্কর্যের ক্ষেত্রে জ্যাকোমেত্তি স্থানিক দূরত্বের ভিত্তিতে অবলোকিত বাস্তবতার পুনরুদ্ধারে আগ্রহী ছিলেন, কিন্তু চিত্রকলার ক্ষেত্রে তাঁর লক্ষ্য ছিল বাস্তবতার নিকটতম প্রতিরূপ। তিনি বলেছেন, আমার লক্ষ্য প্রতিরূপ নয়,

প্রতিচ্ছায়া (নট লাইকনেস বাট রেসেমব্লে­ন্স)। দিয়েগোর ফটোগ্রাফ ও তেলরঙের এ-কাজটি তুলনা করলে তাঁর সে-কথার অর্থ আমাদের কাছে ধরা পড়ে। এক জায়গায় তিনি শিল্পের লক্ষ্য ‘জীবিত উপস্থিতি’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন, এই ছবিটি আমাদের সেই উপস্থিতির প্রতি সজাগ করে।

সংখ্যার দিক দিয়ে না হলেও বিষয় ও মাধ্যম বৈচিত্র্যের দিক দিয়ে তিনি পিকাসোর সঙ্গে তুলনীয়, এ-কথা কেউ কেউ বলেছেন। গুগেনহাইমের প্রদর্শনীতে তার বিস্তর প্রমাণ রয়েছে। শুধু স্কেচ ও পেইন্টিং নয়, নানা নিত্যব্যবহার্য দ্রব্য নির্মাণেও জ্যাকোমেত্তি আগ্রহী ছিলেন। যেমন, প্রদীপ অথবা ফুলদানি, এমনকি শৌখিন কেদারা।

জ্যাকোমেত্তি নিজে বলেছেন, জীবন ও জাগতিক অভিজ্ঞতা অনুসরণেই তাঁর অধিক আগ্রহ। একই সাক্ষাৎকারে তিনি বস্তুর ফটোগ্রাফিক প্রত্যক্ষতা ও তার উপলব্ধ অভিজ্ঞতার মধ্যে এক দ্বন্দ্ব আবিষ্কারের কথা বলেছেন। এই দ্বন্দ্বের সমাধান তিনি অর্জন করেছেন অবচেতন থেকে নয় – প্রত্যক্ষ জীবন থেকে শিল্পের উপাদান আহরণের মাধ্যমে। তবে প্রত্যক্ষ জীবন থেকে হলেও যে-শিল্পের নির্মাণ তিনি করেন তা তো কিছুতেই প্রত্যক্ষ জীবনের অবিকল জলছাপ নয়, বরং শিল্পীর নিজস্ব ব্যাখ্যা – তাঁর উপলব্ধ বিশ্বাস ও বোধ দ্বারা রঞ্জিত। নিজের কথার ব্যাখ্যা জ্যাকোমেত্তি নিজেই করেছেন এভাবে : ‘বলতে পারো রিয়েলিজমের এক অর্থ হলো অনুকরণ (কপি) করা। ধরো টেবিলের ওপর যে-গ্লাসটা আছে তার কপি আমার এই ভাস্কর্য। কিন্তু বাস্তবে তুমি যা কপি করছো তা হলো সেই গ্ল­াস যেভাবে তোমার কাছে ধরা পড়ে তার প্রতিরূপ, তার বেশি কিছু নয়। গ্লাসটি নয়, তুমি যা দেখেছো তা কেবল সে গ্লাসের অবশিষ্টাংশ, যা তোমার মনে ধরা আছে।’ অন্যত্র জ্যাকোমেত্তি বলেছেন, প্রত্যক্ষ বস্তু – তা একজন মানুষ অথবা একটি আপেল যাই হোক – যত তিনি ভাবেন এই তো, পেয়ে গেছি, তত মনে হয় সে দূরে সরে যাচ্ছে।

নিকটবর্তী অথচ অধরা এই বাস্তবতা, যা আয়ত্ত করতে আজীবন কাটিয়ে দিলেন জ্যাকোমেত্তি, তা আমার কাছে মনে হয় যতটা না পরাবাস্তব বা অস্তিত্ববাদী, তার চেয়ে অনেক বেশি রিয়েলিস্টিক। এ-কথা যে একেবারে অতিরঞ্জন নয়, সে-কথার  স্বীকৃতি পাই জ্যাকোমেত্তির নিজের ভাষ্যেই। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘শিল্পের তো একটাই কাজ, আমাদের দৃশ্যমান পৃথিবীকে আরো ভালো করে বোঝা, গভীরভাবে অনুভব করা, তাকে আবিষ্কারে আমাদের ক্ষমতাকে যতটা সম্ভব বাড়ানো।’ এই অনুধাবনে শিল্পীর কাজ ভাস্কর্যটি নির্মিত হয়ে গেলে শেষ হয় বটে, কিন্তু শিল্পকর্ম হিসেবে সে-ভাস্কর্য জীবন্ত হয়ে ওঠে না। সেজন্য প্রয়োজন দর্শকের, একমাত্র তার দেখার ভেতর দিয়েই প্রাণহীন একটি শীতল বস্তু একজন পুরুষ, নারী অথবা তাদের সম্মিলিত আনুভূতিক অভিজ্ঞতা হয়ে ওঠে।

প্রাচীন মিশরীয় ভাষায় ভাস্কর কথাটার অর্থ ‘যে সবাইকে জীবিত রাখে’। জ্যাকোমেত্তি এ-শব্দের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন, ভাস্কর হিসেবে নিজের লক্ষ্যও ছিল তাঁর অবলোকিত মানুষ ও জীবনকে জীবিত রাখা। শুধু নিজের সময়কে ধারণের মাধ্যমেই সে-লক্ষ্য অর্জন সম্ভব। তাঁর মৃত্যুর অর্ধশতক পর আমরা এখন আরো স্পষ্ট করে বুঝি, নিজের সময়কে ধারণ করার মাধ্যমে কীভাবে একজন প্রতিভাবান ভাস্কর তাঁর সময়ের শুধু সেরা ইতিহাসবিদ নন, তাঁর সময়ের মানবিক অভিজ্ঞতার সেরা সংরক্ষক হয়ে ওঠেন। জ্যাকোমেত্তি সেরকমই একজন ভাস্কর।