জড়ুলের দাগটা

পলাশ পাত্র

থানায় মেসেজ আসার পর বিভিন্ন জায়গার মানুষ কল্যাণীর মর্গে এসেছে। মুখে কোপ, চোখ খুবলানো, অর্ধেক মাথা কোপানো দেহগুলো দেখে শিউরে ওঠার মতো অবস্থা। নোংরা ময়লা ভরা। কারো-বা রক্তাক্ত মুখ-চোখে কাদাভর্তি। অন্যগুলোর মতো  নাক-ঠোঁটফাটা দেহটা দেখেও সকলে একই আচরণ করল। সবংয়ের সুমিতা দেহটার কাছে গিয়ে স্থির হয়ে গেল। মর্গের ভেতর শায়িত লাশগুলো থেকে উৎকট গন্ধ নাকে আসছে। জন্মের ভাত ওঠার মতো অবস্থা। মর্গের ভেতর প্রত্যেকে নাক-মুখ ধরে রয়েছে। কারো হাতে রুমাল, শাড়ি বা জামার খুঁট। গন্ধটা ক্রমশ কম লাগছে। জামা, প্যান্ট, শাড়ি, ব্লাউজ, মাথার চুল ইত্যাদিতে বসে গেছে। নিখোঁজ ব্যক্তির খবর নিতে থানায় যাওয়ার পর থেকেই যেন আসে। কল্যাণী থানা ছত্রিশ ঘণ্টা আগে রাজ্যের সমস্ত থানায় মেসেজ দিয়েছে। বনগাঁ, জঙ্গিপুর, ইংলিশ বাজার, রানাঘাট, তাহেরপুর ইত্যাদি। রাজ্যের বিভিন্ন এলাকার লোকজন নিখোঁজ ব্যক্তির খোঁজ নিতে থানায়। তারপরই খবরটা জানতে পারে।

গত কয়েকদিনে রাজ্যের সমস্ত থানায় কয়েক হাজার নিখোঁজ ব্যক্তির অভিযোগ জমা পড়েছে। থানার দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ আধিকারিক থেকে পুলিশ অফিসার প্রত্যেকে অভিযোগ নেওয়ার সময় নিখোঁজ ব্যক্তির এক কপি ছবি নিয়েছে। ঝোপ-জঙ্গল, জলাভূমি, পুকুরপাড়, নদীর ধার, অলি-গলি তস্য গলি, গাছ, ঝিলের ধার থেকে উদ্ধার হওয়া দেহগুলোর ছবিও নেওয়া হয়েছে। প্রত্যেকের নামেই নিখোঁজের অভিযোগ আছে। ধূলিধূসরিত মৃতদেহটি কল্যাণীর ঝোপ-জঙ্গলে ঘেরা ঝিল রোড থেকে উদ্ধার হয়েছে। মাঝারি গড়ন। পরনে সাদা জামা-প্যান্ট পরা। উপুড় হয়ে পড়ে থাকা দেহটির দুপাশে হাত দুটি শায়িত ছিল। পুলিশ আসার সঙ্গে সঙ্গে এলাকার মানুষ জড়ো হলো। রটে গেল খুন খুন…। কিছুক্ষণ আগেই কয়েকজন গাছের ডাল দিয়ে খোঁচা মেরে মুখটা দেখার চেষ্টা করছিল। নাক, চোখ থেকে গোটা মুখটায় কালশিটে পড়েছে। বীভৎস দেখাচ্ছে। থানার ফটোগ্রাফার ছবি তুলল। বেশ কয়েকটা অ্যাঙ্গেলে। রাজ্যের অন্যান্য থানার মতো রানাঘাট, রঘুনাথগঞ্জ, মালদার কোতোয়ালি, কাকদ্বীপ বা হেস্টিংস সমস্ত থানাতেই ছবি পৌঁছে গেল। থানার পুলিশ অফিসার নিখোঁজের সঙ্গে এই ছবি মিলিয়ে দেখে। মিলে গেলে আত্মীয়রা সৎকারের জন্য মর্গে ছুটে আসে। আবার পরিচয়ের দেহ চিহ্নিত করতেও তারা মর্গে ছুটে এসেছে। সবং থেকে সুমিতা। নবদ্বীপের পুষ্পা। আরো অনেকে মর্গের ভেতর ড্রয়ার খুলে দেহ শনাক্তকরণের কাজ করছে। সুমিতা উপুড় হয়ে পড়ে থাকে দেহটির পায়ের কাছে। আঙুল, হাত, গলা থেকে কানের লতির পাশে। সুমিতা দেখছে। গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। মর্গের ডোম বলে, কি দিদি হলো? না হলে আমাদের কাজ করতে দিন। সুমিতার করুণ মুখ। বলে, ভাই আমার, একটিবার চাদরটা তুলে দাও…। ডোম বকতে বকতে চাদর তোলে। পচে দুর্গন্ধ বের হওয়া দেহটি ধরে সুমিতা বসে পড়ে। এই তো দাদা আমার, সাদা জামা-প্যান্ট পরেই বেরিয়েছিল…। সুমিতা কাঁদছে, সুর করে। উদ্বিগ্ন অনুরাধা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে। এক লহমায় চাদর তোলা দেহটির কাছে আসে। অনুরাধার চোখে জল। বুকের দিকে তাকাতে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল।

অনুরাধার কাঁদার অভ্যাস বহু পুরনো। মেয়েরা যেমন কাঁদে সেরকম। বিয়ের প্রথম কয়েক মাস পর থেকে অনুরাধার চোখে জল। অনেকটা আগুনের সামনে মাখন রাখার মতো। প্রথমে গলে যাওয়া। তারপর জলের মতো হওয়া। বিয়ের পর কাঁদার সময় কোথায়। বোষ্টম ওকে আদরে ভরিয়ে দিত। অনুরাধা বোষ্টমের জড়ুল বুকে চুমু খেত। দুজনা ঘর বন্ধ করে বসে থাকত। সকালে অনুরাধা ছাদে কাপড় মেলতে গিয়ে ঘণ্টাদেড়েকের আগে নামত না। ছাদ-লাগোয়া চিলেকোঠার ঘরটায় দুজনা খুনসুটিতে মেতে উঠত। সিঁড়ির ঘরটায় ওঠার আগে সামনে কলাপসিবল গেট ছিল। গেটটায় আলতো হাত দিয়ে টানতেই পাশের দেয়াল ছুঁতো। গেটে তালা দিয়ে বোষ্টম, অনুরাধা নিচে নেমে আসত। ভালো জলখাবার খেত। বেলা গড়াতে কাঠবিড়ালির মতো এদিক-ওদিক তাকিয়ে বোষ্টম রান্নাঘরে ঢুকত। অনুরাধা বলত – ছাড়ো, কেউ এসে পড়বে। শাঁখা, পলা, চুড়ির শব্দ দীর্ঘ হতেই হাঁক পারত বিজয়া। মাসছয়েকের মধ্যে এসবে ভাটা পড়ল। ঘরের কোণে অনুরাধা চুপ করে বসে থাকে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে। বোষ্টম তাড়া দেয়। বলে, খেতে না পরতে দিতে পারি না…। অনুরাধা চোখ থেকে জল মোছে। বলে, মেয়েরা কী চায় তুমি বোঝো না? তার কাছে স্বামীই সব। আর তুমি…। কথা না বাড়িয়ে বোষ্টম দোকান খুলতে বেরিয়ে পড়ে।

বোষ্টমের দোকান খোলার ভঙ্গি অদ্ভুত রকমের। সে প্রথম জীবনে মুদিখানা হোক বা পরে চায়ের দোকান। কিছুদিন আগে পর্যন্তও একই রকম ছিল। সকাল সাড়ে ১০টায় দোকান খোলার আগে পরনে থাকে একটা ফুলপ্যান্ট আর ফতুয়া। তার আগে বড় মেয়ে তমালিকার সাইকেলটা সিঁড়ির তলা থেকে বের করে। সাইকেলের প্যাডেলে পা দেওয়ার আগে রাস্তার দুদিকটা দেখে নেয়। সাইকেলটা একটু হাঁটিয়ে নিয়ে সিটে উঠে বসে। ধীরগতিতে সাইকেল চালিয়ে নিজের দোকান, রিকশাস্ট্যান্ড পেরিয়ে কালীবাড়ির পেছনের মাঠে আসে।

রাজমিস্ত্রি, কাঠমিস্ত্রি, রিকশাওয়ালা, বিভিন্ন শ্রমজীবী মানুষের সঙ্গে হালের কবিও আসে মাঠে। গোল করে সকলে বসে। মন্দির থেকে আসে কাঁসর ঘণ্টার আওয়াজ। বোষ্টম নাক ঝাড়তে ঝাড়তে সাইকেলটা মাঠের এককোণে হেলিয়ে রাখে। বসে থাকা একজনের পিঠে হাত দিয়ে মাটিতে ঝপ করে বসে। উৎকট গন্ধের সঙ্গে চারপাশটা গাঁজার ধোঁয়ায় ভরে ওঠে। বোষ্টম তখন রাজা। উপর-নিচ, চারপাশে ছোট-বড় বিভিনণ আকৃতির গ্লাস। তার ভেতর বাতি আর ঝাড়বাতিতে হলদে আলো। মন্ত্রীসপার্ষদের বিশ্বস্ত চাউনি। বর্শা, তরবারির ঝকমকি, ঝনঝনানি। অন্দর থেকে ফিনফিনে ঝালর ভেদ করে পোলাও, মাংস, মন্ডা-মিঠাইয়ের পাঁকে পাঁকে সুগন্ধি ঘ্রাণ। হাজার হাজার বছরের পুরনো, আদিম রতিক্রিয়ায় পারঙ্গম নারীদের পায়ের নূপুরের ধ্বনি। অগণিত অনুগত প্রজাদের ভিড় – পরম সুখ। টানে টানে সুখ আরো সুখ। বুঁদ হয়ে বসে থাকা। মাথাটা ঝিম ধরে গেছে। চল্লিশ বছর ধরে এভাবে গাঁজার টানে টানে অস্থির সুখ। মাথা থেকে চোখ, মুখ, গোটা শরীরে। ক্রমাগত ওষ্ঠ দুটোর বিড়বিড়। ঘোষ-পরিবারের জমি ছিল। দুলাল ঘোষের ছেলে বোষ্টম ঘোষ। পাড়ায় আলাদা রোয়াব। ধান, চালের অভাব ছিল না। জমি থেকে আসত সব। ছিল গরুর আস্তাবল। দাদা ঠাকুরদার পর বাবাই দেখাশোনা করত। দুধ, ক্ষির, ছানা…। কি বোষ্টম দোকান খুলবি না?

– হ্যাঁ হ্যাঁ।

থম মেরে যায় বোষ্টম। কাঁপতে কাঁপতে রড না থাকা লেডিস সাইকেলটায় পা গলিয়ে দেয়। দ্রুত সাইকেল চালিয়ে নিজের দোকানের সামনে দিয়ে বাড়ি ফেরে। রাস্তার ওপর শালিক পাখিগুলোর ঠোকাঠুকি করার মাঝে চাবি, কেরোসিনের ঢপ নিয়ে বোষ্টম দোকানের শাটার খোলে। জলভর্তি কেটলিটা স্টোভের ওপর চাপিয়ে দেয়।

মার্কেটের উঁচু ছাদওয়ালা ঘর স্টোভের শব্দে গমগম করে। দোকানঘরে বোষ্টম ঝাঁট দেয়। চেয়ার, টেবিলগুলো সরিয়ে নড়িয়ে ধুলো, আলুর দমের অংশবিশেষ, পাউরুটির প্যাকেট জড়ো হয়। এরই মধ্যে চা-পিপাসুরা আসে। কয়েক মাস  হলো বোষ্টম কাচের গ্লাসের ব্যবহার বন্ধ করেছে।

গত বছর বোষ্টম কাশতে কাশতে দোকানের মধ্যে লুটিয়ে পড়ল। মুখ দিয়ে গলগল করে রক্ত বের হয়েছিল। রানাঘাট হাসপাতাল থেকে কলকাতায় নিয়ে যাওয়া হয়। মাসদেড়েক চিকিৎসার পর বোষ্টম বাড়ি ফেরে। চিকিৎসকের নির্দেশমতো তিন মাস বিশ্রাম। ফের এক্স-রে, মল-মূত্র, কফসহ বিভিন্ন টেস্ট। রক্ত দেওয়া। ডাক্তার কড়া নির্দেশ দিয়েছেন। মদ, গাঁজা, সমস্ত নেশা বন্ধ করতে হবে। নিয়ম করে খাওয়া-দাওয়া, বিশ্রাম না নিলে বুকের সমস্যা থেকে যাবে। এরপর কাচের গ্লাসের পাট তুলে দেওয়া। এক সময় গ্লাসগুলোকে ধুয়ে বোষ্টম ট্রের ওপর উপুড় করে রাখত। যাতে জল ঝরে যায়। এ-সময় কেউ চা চাইলে পায় না। যতক্ষণ জল ঝরবে, ততক্ষণ ওই গ্লাসে চা করবে না। অন্য গ্লাসগুলো গরম জল দিয়ে ধুয়ে বোষ্টম ট্রেতে ফেলে। চামচ দিয়ে চা, চিনি, দুধ ঘোঁটে। ছলকেপড়া চা ট্রের জলে মেশে। স্টোভের নিচে থাকা বালতিতে চায়ের অংশবিশেষ ঢেলে দেয়। জল ফেলা, গায়ে গরম জল ছুড়ে দেওয়া বোষ্টমের পুরনো অভ্যাস। এ ব্যাপারে বোষ্টম স্পষ্ট কথা বলে। কায়দা মারলে স্যাক তো খাবেই…।

বোষ্টমের দোকানে ঢুকতে ছোট্ট টেবিলের ওপর গমগম আওয়াজ করে স্টোভ জ্বলে। অনেকটা বোষ্টমের মতো। লাল-ফিকে, নীল রঙের শিখা দীর্ঘ হয়। স্টোভের ওপর জল ফোঁটা কেটলির গায়ে থাকে দুধের কেটলি। ধোঁয়া চওড়া হতে গরম দুধ স্টোভের ওপর উপচে পড়ে। দুধ-পোড়া গন্ধে তখন এলাকার মানুষের ভ্রু কোঁচকায়। পটীর দোকানদাররা বলে, বোষ্টম জল দে রে…। সসপ্যানভর্তি জল নিয়ে তখনো ও ঠায় গরুটার সামনে দাঁড়িয়ে। আর পাঁচজনের সঙ্গে দোকানে বসে থাকা কোট-প্যান্টপরিহিত দীর্ঘদেহী ব্যক্তিটি মিনিটদশেক পর আচমকা চলে যায়। রানাঘাট স্টেশনের পেছনে জমজমাট এলাকায় বোষ্টমের দোকান। এলাকায় পরিচিত চায়ের দোকান। এক ডাকেই সকলে চেনে। ও অাঁ-অাঁ করতে করতে গরুটার গলায় হাত বুলিয়ে দেয়। জল খাওয়ায়। পথচলতি মানুষ এ-দৃশ্য দেখে। একটা মন ভালোর স্বস্তি নিয়ে চলে যায়। কেউ হাসে, মজা করে। সেলসে কাজ করা মাঝবয়সী গোলগাল চেহারার লোকটি চৌকো ব্যাগ নিয়ে এগিয়ে যায়। বোষ্টমের উদ্দেশে চিৎকার করে। বলে, ও দাদা, কী ব্যাপার? চা খাবো বলে বসে আছি। সেই অনেকক্ষণ ধরে। চা কি হবে?

বোষ্টম মুখে কিছু বলে না। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে নেয়। ফের ব্যক্তিটি একই প্রশ্ন করে। বোষ্টম উত্তেজিত হয়ে পড়ে। বলে, ঘ্যানর ঘ্যানর করছেন কেন? নিজের কাজ করুনগে।

ব্যক্তিটি ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। বলে, ও দাদা, কথাবার্তা ঠিক করে বলুন।

বোষ্টম তেড়ে ব্যক্তিটির দিকে যায়। বলে, গায়ে গরম জল ঢেলে দেবো। দেখতে পারছেন না, গরুকে জল খাওয়াচ্ছি। এটা আগে, না আপনার চা…।

– আপনি আমায় চেনেন? কী করতে পারি দেখবেন? সেলসম্যানটি হুংকার দেয়।

বোষ্টম জল-ফোটা কেটলিটাকে স্টোভ থেকে তুলে নেয়। বলে, অনেকক্ষণ ধরে ক্যালক্যাল মাড়াচ্ছ।… ও বে, পালাচ্ছিস কেন?

আশপাশের লোকজন পেছন থেকে বোষ্টমকে জাপটে ধরে। বলে, কী বোষ্টমদা ছাড়ো ছাড়ো…। উনি কলকাতা থেকে এসেছেন। অতশত জানে না। তোমাকে চেনে না তাই…।

– চেনে না, চুপ থাকবে। পেছন-পাকামো মারছে কেন?

বোষ্টমের কথা শুনে সেলসম্যানটি স্তম্ভিত। হাঁপাতে হাঁপাতে সে দৌড়ায়। কোমর থেকে প্যান্ট নেমে যায়। বোষ্টম পেছনে ধাওয়া করে। সেলসম্যানটি ভিড়ে মিশে যায়।

বোষ্টমের দোকান থেকে আট-দশ হাত এগিয়ে তিনমুখো  রাস্তা। এলাকাটা জমজমাট। সবসময় ভিড় থাকে। স্কুলের বাচ্চাদের গাড়ি, রিকশা, ভ্যান, তিন চাকা অটোর সঙ্গে অগণিত মানুষের যাতায়াত। রাস্তাটাকে হালকা করতে বোষ্টম মাঝেমধ্যে দোকান ছেড়ে বেরিয়ে আসে। রাস্তার মোড়ে ট্রাফিকের মতো দাঁড়িয়ে পড়ে। অ্যাই অ্যাই করে এগিয়ে যায়। পিছিয়ে আসে। তারপর হাত তুলে গাড়ি থামিয়ে দেয়। মুখের বাঁশিটা পি-পি করার মাঝে চ্যালাকাঠ দিয়ে গাড়িতে মারে।

চালককেও দু-এক ঘা দিয়ে দেয়। এসবই বোষ্টমের কাজের মধ্যে পড়ে যায়। এর মধ্যে কেউ চা চাইতে এলে নির্ঘাৎ তার গায়ে গরম জল পড়ে। কখনো হুমকিও জোটে। এ নিয়ে এলাকায় অশান্তি হয়েছে।

বোষ্টমের এ-ঘটনা আজকের নয়। অনেকদিনের। বছর পঁচিশ আগে থেকে। স্টেশনের পেছনে ফাঁকা জায়গা পাড়ার ছেলেরা দখল নিল। দোকান, মার্কেট তৈরি হলো। বোষ্টম ঘোষও দোকান পেল। খুব সামান্য টাকায়। তখন বয়স কত? বড়জোর বছর ছাবিবশ হবে। বোষ্টমের চেহারাটা বেঁটেখাটো গাট্টাগোট্টা ছিল। গায়ের রং ধবধবে ফর্সা না হলেও বেশ উজ্জ্বল। চোখদুটো ভাসা-ভাসা। নাকটা লকলকানো দেবদারু গাছের মতো। মুখে সবসময় হাসি। ঠাট্টা-ইয়ার্কিতে এলাকা ভরিয়ে রাখে।

প্রাণবন্ত এই বোষ্টমের বাড়ি আর দোকানের মধ্যে দূরত্ব হাত একশ হবে। গোটা মার্কেট এলাকায় একটাই মুদির দোকান। যখন-তখন বাড়ি, দোকান যাতায়াত করা যায়। বোষ্টমের দোকানে ক্রেতাদের ভিড় সবসময় থাকে। দোকান ছেড়ে দাঁড়িয়ে থাকাই বিলাসিতা। এলাকার মানুষ সে-কথাই বলে। তমালিকার তখন সবে এক বছর। পাড়া-প্রতিবেশী থেকে দোকানি বলে, বোষ্টমের ঘরে লক্ষ্মী এসেছে রে। দোকানে ধান-দূর্বা পড়েছে।

বোষ্টমের দোকানে অনেকে আসে। বাউল গায়ক জীবা ক্ষ্যাপার আনাগোনাটাও ক্রমশ বেড়ে গেল। ও জীবার সঙ্গে বাউলের আখড়ায় যায়। অনুরাধা একদিন আচমকা দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে। বলে, দোকানটা ধোঁয়া আর জলে শেষ করে দিবা! মানুষ বয়স হলে ঠিক হয়। তোমার দেখছি সে হুঁশ নেই। বোষ্টম প্রায়ই মাঠে-ঘাটে বাউল গাইতে যায়। বলে, বাবার প্রসাদ না খেলে কি কিছু হয়? জগৎ-সংসার সবই চলছে তিনার ইচ্ছায়। কল্কেতে মুখ দিয়ে টান দেয়। উগ্র পোড়া গন্ধ, ধোঁয়ার কুন্ডলী ছড়িয়ে পড়ে। বোষ্টম শিশুর মতো হাসে। বলে, সব পড়ে থাকবে। আজ মরলে কাল দুদিন।

বোষ্টম দশ ক্লাসের পরীক্ষায় ফেল করে। সে-বছরই বাবার প্রসাদ খাওয়া শুরু। ছেলেবেলায় দ্রুতগতিতে দৌড়ানোর জন্য ওর নাম ছিল। স্কুলের মাঠে জোরে দৌড়ে এসে বন্ধুদের পিঠে মাথা দিয়ে ধাক্কা মারত। বন্ধুরা তাড়া করত। বোষ্টম দুহাত মাটিতে দিয়ে চাকা মারতে মারতে পালিয়ে যেত। নাসরার ভূদেব আচার্য দেখে মুগ্ধ হলো। টানা পাঁচ বছর ভূদেববাবুর কাছে জিমন্যাস্টিকের অনুশীলন। একটা গোল রিঙের মধ্যে গোটা শরীরটা ঢুকিয়ে দিয়ে ঝাঁপ মারা। প্যারালাল বারে দুহাত থেকে এক হাতে ভর দিয়ে শরীর ঘোরানো। এরকম একাধিক কেরামতি।

ও স্টেশনের মাঠটাতে যেত। এলাকার রিকশাওয়ালা, কুলি-মজুররা সে-সময় ফাঁকা জায়গায় গোল হয়ে বসে থাকত। দেখতে দেখতে ওদের সঙ্গে বসা, ভাব জমানোটা হয়ে যায়। গাঁজার কল্কে ধরে টান মারাটাও রপ্ত হয়। কিছুদিনের মধ্যে বোষ্টম স্কুলমাঠে যাওয়া বন্ধ করে দিলো। পাড়ায় অশান্তি করা বোষ্টম বাসস্ট্যান্ডে কাজ পেল। ওকে তখন কে দেখে! কাঁচা পয়সায় পকেট ভর্তি। কথায় কথায় পাড়া, বাবা-দাদু, ঘোষ পরিবারের কথা বলে। সন্ধ্যা নামতেই বাসমালিক সমিতির পেছনে নিমতলার চাতালটায় মদ নিয়ে বসে। বাসস্ট্যান্ডের পেছনে মাসির দোকানের কষা মাংস, পেঁয়াজ, বাদাম সবই চলে আসে। বোষ্টম রাতে টলতে টলতে বাড়িতে ফেরে। দুলাল ঘোষ তখন বিছানায় বসত। জড়ানো গলায় বলত, আমরা কি মাল খাই না? তা বলে পা টলবে কেন হ্যাঁ? কী বলো বোষ্টমের মা…।

সে-সময় পাড়ার লোকজন মদ্যপ বাবা-ছেলের ঝগড়া শুনত  আর হাসত। কেউ বলত, বাপ-ছেলের উৎপাতে ঘুমিয়েও শান্তি নেই। বোষ্টম বাসস্ট্যান্ডে ছবছর কাজ করে। ততদিন এলাকার মানুষের যন্ত্রণার শেষ ছিল না। ঝুট-ঝামেলা লেগেই থাকত। ও একটি ছেলেকে চাকা তোলার রড দিয়ে পায়ে মারে। ছেলেটির তিন মাস চিকিৎসা চলে। ওর বাসস্ট্যান্ড যাওয়া বন্ধ হয়। বেপরোয়া ছেলেকে আটকাতে দুলাল, বিজয়া বিয়ে দেয়। বোষ্টম স্থিত হয়। খোলস ছাড়া সাপের মতো। তবে গাঁজার নেশা বন্ধ হয় না। রক্ত, ঘাম, শ্রমের পাঁচ বছরের আমানত করা মুদিখানার দোকানটা বন্ধ হয়ে গেল।

বোষ্টম পারিবারিক জমিতে চাষ করে। দশ বছর পর তোবড়ানো-চোবড়ানো মা লক্ষ্মী সাইনবোর্ডটা তুলে ফেলে। তারপর থেকে গত আট বছর মুদি দোকানটায় চায়ের দোকান। লিকার-দুধ চা, বাখরখানি বিস্কুট। সঙ্গে আলুর দম, ঘুগনি। বোষ্টম কিছুদিন যাবৎ করছে। দুপুরের মধ্যে এক কড়াই শেষ হয়ে যায়। সঙ্গে থাকে পাউরুটি, হাতরুটি। কখনো আলুর দম, ঘুগনি থাকলে বোষ্টম বাড়ি নিয়ে যায়। ছোট মেয়ে মাধুরী খায়। শ্যামলা মাঝারি গড়নের ও এবার উচ্চমাধ্যমিক দিলো। কুড়ি বছর বয়স। ক্লাস ফাইভ ও এইটে অকৃতকার্য হয়। তমালিকা ওর চেয়ে ছবছরের বড়। বর্তমানে ছাবিবশ। বোষ্টমের বড় মেয়ে। ছোট থেকেই পড়াশোনায় ভালো। এমএ পর্যন্ত কোনো ক্লাসে অকৃতকার্য হতে হয়নি। বাংলা নিয়ে কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দুবছর আগে পাশ করেছে। তারপরই বিয়ের তোড়জোড় শুরু। কল্যাণীতে তমালিকার সঙ্গে অনীশ বিশ্বাসের আলাপ হয়। তমালিকা তখন ফার্স্ট ইয়ারে। চুঁচড়া থেকে শিক্ষকতা করতে আসে অনীশ। তমালিকাকে বোষ্টম, অনুরাধা উচ্চমাধ্যমিকের পর থেকে বিয়ের কথা শোনায়। বলে, আমাদের অবস্থা কি আগের মতো আছে যে, মেয়েকে বেশিদিন ফেলে রাখতে পারব? মেয়েদের বয়স বাড়লে রূপ-যৌবনে টান পড়ে। তুই মা পড়াশোনা অনেক করেছিস। এবার আমরা তোর পাত্র দেখব। প্রতিবার আলোচনায় তমালিকা চোখ-মুখ বেঁকিয়েছে। রাগ প্রকাশ করেছে। শেষে বলেছে, খেয়েদেয়ে কাজ নেই। গন্ডমূর্খের দল। কিছু বোঝে না।

তমালিকা-অনীশের সম্পর্কের বলটা দ্রুত এগিয়ে যায়। এ-বিষয়ে মাধুরী প্রথম বাড়িতে বলে দেয়। শুরু হয় দেখাদেখির তোড়জোড়। তমালিকাকে দেখতে অনীশের বাবা-মা আসে। ধোপদুরস্ত পাজামা-পাঞ্জাবি পরা বোষ্টম হাত তুলে নমস্কার করে। প্রত্যুত্তরে সুখদেব, অনুদীপাও মুঠিবদ্ধ হাত দুটি কপালে ঠেকায়। অনীশের বাবা-মা কিছু বলতে যেতে বোষ্টম মুখে আঙুল দেয়। বলে,  চুপ। ওসব কথা পরে হবে। এখন ভালো করে বসুন তো! সেই কতদূর থেকে আসা! কী গো, কোল্ডড্রিংকটা দাও…।

সুখদেব গিন্নির দিকে তাকায়। বলে, বেয়াইয়ের সঙ্গে ভালো করে আলাপ করো। রেস্টুরেন্টে মেটে চ্চচরি তৈরির হাত। কী করে রাঁধতে হয় শিখে নিতে পারবে।

অনীশের মা অনুদীপাকে দেখলেই মনে হয় শান্ত, স্নিগ্ধ বনেদি বাড়ির মেয়ে। তাই সুখদেবের কথার রেশ ধরে বোষ্টমের দিকে তাকায়। বলে, তমালিকা আপনার কথা খুব বলে। আমাদের বাড়ি গিয়ে সুখ্যাতি করেছে। ওদের দুজনের চার হাত এক করে দিই। তারপর আপনার রেস্টুরেন্টে যাব। খেয়ে আসব।

বোষ্টম গদগদ মুখে বলে, যেদিন খুশি সেদিন যাবেন। এতে বলার কী আছে। ওর চোখের মণিটা স্থির। পুরনো সেগুনকাঠের কড়িবর্গায় ঘোরা ফ্যানটায়। বোষ্টমের মাথা, শিরা, উপশিরা, রক্তের সঞ্চালনে আচমকা যেন চাপ পড়ল। রান্নাঘর-লাগোয়া বড় বারান্দায় দাদা, কাকা, ভাই, বোন, অত্মীয়স্বজন মিলিয়ে চল্লিশজনের পাত পড়ত। সাতসকালে মা-কাকিরা রান্নাঘরে ঢুকত। দুপুরের আগে তার নিস্তার মিলত না। ভাতই কত রকমের! দাদু বলত, ঝনঝনে ভাত চাই। কাকা, দাদারা একটু নরম ভাত পছন্দ করত। মা-কাকিরা শেষ পাতে গলা ভাত পছন্দ করলেও তা হতো না। বাইরে থেকে শুধু নুনই কিনতে হতো। জমি থেকে সমস্ত কিছু আসত। পাড়া-প্রতিবেশী, বাইরের লোকজন বাড়িতে এলে খাঁটি দুধের চা পেত। বোষ্টমের বন্ধুরা বাড়িতে এলে বিজয়া এক গ্লাস জিভে সর-লাগা দুধ খাইয়ে ছাড়তেন। বাগানে গেলে আম, লিচু মুখে নেমে আসত। দুর্গাপুজোয় বারোয়ারির ঢাকিদের মধ্যাহ্নের আহার জোটাত বিজয়া। প্রথমে দাদু পরে বাবা মারা যেতে সব শেষ।

– কী বেয়াই কী ভাবছেন? সুখদেব হাসতে হাসতে বলে।

– হ্যাঁ, না কিছু না। কই কী গো, বেলা যে বয়ে যায়। খেতে দাও…।

– তাহলে পুরোহিতকে ডাকুন। আজই ফাইনাল হয়ে যাক। সুখদেব বলে।

– হ্যাঁ, মন্দ বলেননি। আমি যোগেশ বামুনকে আনছি। বোষ্টম হাসিমুখে বলে।

কার্তিক মাসে শীতটা ভালোমতো পড়ে যায়। ঠান্ডাতেই বিয়ে ঠিক হয়। বিয়ে মানে যজ্ঞ। প্রচুর টাকার দরকার। তার ওপর বোষ্টমদের যা পরিবার! আত্মীয়-পরিজন নিয়ে শদুয়েকের বেশি। নেই নেই করে চারশো লোককে বলতেই হবে। এ তো গেল নিমন্ত্রিত ব্যক্তিদের খরচ। মেয়েকে সাজাতে যা আছে হয়ে যাবে। বিয়ের দিন বিজয়া পাক্কা দুভরি সোনার সীতাহার দিয়েছিল। বউমার মুখ দেখে। কানের, টিকলি, নথসহ আরো বেশ কয়েক ভরি গহনাও। শাশুড়ির কাছ থেকে পেয়েছিল অনুরাধা। বাকি খরচের জন্য বোষ্টম আত্মীয়স্বজনের কাছে যায়। প্রত্যেকের স্বাচ্ছন্দ্যের পরিবার। কারো কাছ থেকে হাজারদুয়েকের বেশি পেল না। অনুরাধা-বোষ্টমের ঝগড়া পাড়ার লোকজনের মুখে মুখে। গত এক মাস রাতে নিয়ম করে। প্রতিবেশীরা এ নিয়ে আলোচনা করে। বলে দুদিন বাদে মেয়ের বিয়ে। বাবা এখনো নেশা-ভাং করছে। ঝগড়ায় পাড়া মাতায়। কোনোভাবে শুধরাল না। কালীপুজোর আগের দিন রাতে বোষ্টম বেরিয়ে যায়। তারপর নদিন বাড়িছাড়া। অনুরাধা রানাঘাট থানায় একটা অভিযোগ করল। কল্যাণী থানার মেসেজ পেয়ে একদিন অনুরাধা মর্গে। মর্গের এপাশ-ওপাশ ড্রয়ার খোলা চলছে। একের পর এক মৃতদেহ। এতক্ষণ অনুরাধা ঘুরে ঘুরে মৃতদেহ দেখছিল। সবংয়ের সুমিতার চাদর তোলা দেহটা দেখে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। বুকের বাঁদিকে জড়ুলটা মুদ্রার মতো। মর্গের মৃদু আলোতেও বেশ স্পষ্ট।