ঢেউটিন পাকা বারান্দা বদনা চিলমচি মাছালো পুকুর

সালেহা চৌধুরী

যখন ছেলেমেয়ে নিয়ে ভাবছে না আম্বুরি আর গফুর হঠাৎ করে জানা গেল আম্বুরি পোয়াতি। গত শীতে মরিবুজানের বাড়ি বেড়াতে গিয়ে মাঠের মাঝখানে একটা বড় গাছে নানা অং-এর তেনা ঝুলে থাকতে দেখেছিল।
Ñ এগলা কেংকা তেনা? প্রশ্ন করেছিল আম্বুরি।
Ñ তোর মতো বানজা বেটিছোল যারা কোনোদিন পোয়াতি হবার পারে না, যার কেরে জরায়ুত তালাচাবি তারা এটি আসে ত্যানা বান্দে ছোলপোল হবার জন্য মানত করে।
Ñ কেংকা মানত? প্রশ্ন করে আম্বুরি। যার জরায়ুর তালা গত বিশ বছরে খুলতে পারেনি গফুর পরামানিক। বলে Ñ হে পরোয়ার দেগার বাবা তেনাপির আপনার কাছে এই মানত করলাম ছোলপোল হলেই আমি এটি আসা একটা খাসির বিরানি করমো, তামান মানুষোক খিলামু। জিলাপি লয়, খাগড়া বাতাসা লয়, এক বড় ডেগচি খাসির বিরানি। হামার বউয়ের প্যাটোত ছোলপোল দাও।
এ-গাছ নাকি কথা শোনে। কথা শোনে গাছের নিচে যে-পিরের মাজার সেই কামেল পির। যাকে নিয়ে এই গ্রামে গল্পের অন্ত নেই। যিনি মাছের পিঠে চেপে রাতের আঁধারে ভ্রমণে যেতেন। এবং খড়ম পায়ে নদীর ওপর দিয়ে হেঁটে যেতেন। আম্বুরি শাড়ির আঁচল ছিঁড়ে খানিকটা ঝুলিয়ে দিয়েছিল তেনাপিরের মাজারে। অগ্রহায়ণ মাসে ঘটনাটি ঘটেছিল।
ফাল্গুনের প্রথম সপ্তাহে হড়বড় বমি করে চোখ উলটে তুলে আম্বুরি জানালো সে পোয়াতি। বয়স তখন ঊনচল্লিশ। ওর যে ছোলপোল আর হবে না সেটাই মেনে নিয়েছিল সকলে।
নয় মাস পর ফুটফুটে একটা মেয়ে বিয়োলো আম্বুরি। তেমন কোনো কষ্ট বা রাত জেগে ব্যথা সহ্য করতে হয়নি তাকে। চুলোর পাড়ে উপুড় হয়ে কী করতে করতে বুঝতে পারলো তার পেট ব্যথার কথা। এটা পচা পান্তা খাবার ব্যথা নয়। এটা অন্য এক ব্যথা। মেয়ের মাথা তখন প্রায় বেরিয়ে গেছে। আমেনাখালা দাই এসে বাকি কাজটা সারলো।
নাক-নকশা, মাথার চুল এবং ধলো অং। এ যে একেবারে ময়না পাখিরে। গফুর চেয়ে দেখে চোখ বড় বড় করে। সত্যিই মেয়ে অপরূপ। সেই মেয়ে যখন টলমল পায়ে উঠোন ধরে হাঁটতে শুরু করে গফুর মেয়ের দুধে আলতায় গোলা ধলো রং দেখে অবাক হয়ে যায়। এমন অং মেয়ে পেল কোথা হতে? গফুর নিজে কালো, আম্বুরি এখন পোড়া আর শ্যামলা। ছোট্ট মিষ্টি একটা নাকে টুলটুরি, কানে মাকড়ি পরিবানু গফুর আর আম্বুরির কাছে এক মহাবিস্ময়। তেনাপিরের দোয়া না থাকলে এমন মেয়ে হয় না। যে-পির এখনো রাতের আঁধারে হাঁটাচলা করে। আম্বুরির জরায়ুর তালা যিনি একবার খুলে দিয়েছিলেন। মনে হয় না আর খুলবে সেটা। গফুরের সঙ্গে মাছ মারার বন্ধু একদিন বাড়িতে এসেছে। দুই বন্ধু শংকরীর বিলে মাছ ধরতে যাবার পরিকল্পনা করছে। উঠোনে আপন মনে খেলছে পরিবানু। সেই অপরূপ ময়না-পাখির দিকে তাকিয়ে বলে বন্ধু করিম – মনে রাখিস গফুর এই ধলোঅং-এর মেয়ে তোর কোলে ভাগ্য ফিরাবি। পয়সার মাল এ বেটি তোর। কারো সঙ্গে বিয়া দিবার আগে দাবি-দাওয়া মোটা করবা। শেষ বয়সে এই বেটিছোল তোর ভাগ্য ফিরাবার জন্য তোর কোলোত আসিছে। প্রথম বেটি আসা সুন্নত।
গফুর মন দিয়ে কথা শোনে। ধলো অং-এর পরিবানুর দিকে তাকিয়ে এমন কিছুই ভেবেছিল সে। এই মেয়ে তার পয়সার মাল। ভবিষ্যতে বাপ-মায়ের ভাগ্য ফিরাবার মতো ভাগ্য নিয়েই এই মেয়ে তাদের সংসারে এসেছে।
বয়স যখন বারো পেরিয়ে গেছে, মেয়েটা একদিন পুকুরঘাট থেকে বাড়ি ফিরে আসছে, চোখে পড়লো রাজা মাতবরের। বুড়ো মাতবর অনেকদিন বিছানায় শোয়া, তার ছেলে রাজা মাতবরই এখন গ্রামের প্রধান। তার দুটো বউ। এবার সে দেখেছে পরিবানুকে। একদিন গফুরকে বললো, তোমার বাড়িত কাল আসবার চাই, কথা আছে গফুর পরামানিক।
গফুর তখনো ঠিক বুঝতে পারেনি কথাটা কী?
উঠোনে চেয়ার পেতে বসে প্রথমে যে কথা বললো তা এই Ñ হামার দুটা বউই বুড়ানি মুরগি। একটা বাতে জেরবার আর একা ছোলপোল আর গান্দা পোলাপান নিয়া জেরবার। শখ-আল্লাদ করবার মতো একখান ময়নাপাখি আমার চাই গফুর মিয়া। তোমার বেটির মতো একখান ডেকি মুরগি দরকার, বুড়ানি লয়।
– ডেকি হতে এখনো বাঁকি আছে বাবা।
– খুব বেশি বাঁকি নাই। জহুরি চোখ রাজা মাতবরের।
ঠিক তখনো বুঝতে পারছে না গফুর, কী বলতে চায় রাজা মাতবর।
– শোনেন চাচামিয়া আমার কোলে টাকার অভাব নাই। আমার একখান বউ চাই যারে নিয়ে এই একটু সাধ, আল্লাদ, হাউস, শখ পুরা করবার পারি। বাতের বুড়ানি আর ডিম পাড়ি কুঁচা মুরগি দিয়া সে-সাধ পূরণ হয় না চাচামিয়া? ভবিষ্যৎ শ্বশুরকে ফট করে সে মনের কথাটা বলে ফেলে।
মুরগি, ডিম, বুড়ানি, কুঁচা, ডেকি, এসব শব্দের অর্থ যে গফুর কিছুটা করতে পারছে না তা নয়। কিন্তু এই ধলো অংয়ের মেয়েকে নিতে কী দেবে রাজা শেখ সে তা তখনো জানে না। একটু থেমে হাত কচলে বলে – বাবা রাজা, তোমরা হলা গ্রামের মাথা, তোমরা গ্রামের রাজা। আমি বাবা গরিব। এডাই বেটি হামার। বেটা নাই। বাবা আমার ঘরের চাল দিয়া পানি পড়ে। বারান্দা পাকা লয়। আম্বুরি ওটি বসে জাল বোনে, ঝাঁটা শামটা বানায়। দেওয়া নামলে হামাকেরে নাজেহাল অবস্থা হয় বাপজান। আমার বেটিক দেমো কিন্তু বাবা হামাকেরে কিছু আবদার মিটান লাগবি।
– কী দরকার আপনের চাচা?
– ঘরের চালের ঢেউটিন আর পাকা বারেন্দা দিবা বাবা বেশি কিছু নয়। বারো বছরের পরিবানু তখন চুল মেলে উঠোন দিয়ে হেঁটে ওপারে চলে গেল কোনো একটা কাজে। বলে রাজা Ñ হামাক একটু ভাববার দ্যান।
দেবে সে ঠিকই কিন্তু একটু সময় নিয়ে গফুর মিয়াকে একটু চিন্তিত না করলে সে আর মাতবর কেন? বলে – এট্টু ভাববার দ্যান। দাবি তো চাচাজান আপনার অনেক।
ভাবতে ভাবতে তিনদিন নিলেও দেওয়ার সময় কেবল চালের ঢেউটিন আর পাকা বারান্দাই নয়, গফুর পেল একটা পাকা পায়খানা আর কলপাড় পাকা। মেয়ে যখন বাপের বাড়িতে বেড়াতে আসবে হাতে বদনা নিয়ে, সে তো আর মাঠে-ময়দানে যেতে পারে না। হাজার হলেও তখন সে রাজা মাতবরের পেয়ারের বউয়ের বাপ। মেয়ে ছোট বলে আম্বুরি কাঁদলো, নাক টানলো, হা-হুতাশ করলে কী হবে কচি মেয়েটার, সেসব ভাবলো; কিন্তু দেখা গেল গায়ে বিয়ের পানি পড়তেই রূপ যেন আর বাঁধ মানে না। সারা উঠোন আলো করে রাজা মাতবরের আর দুই বউয়ের চোখের সামনে দিয়ে দপদপিয়ে হাঁটলো সে কয়দিন। মানে কয়েক বছর। পাঁচ-পাঁচটা বছর ধলো অং আর নাক-নকশা নিয়ে বেশ ভালোই গেল পরিবানুর দিন-রাত। বাপের বাড়ির চেহারা-ছবিও বেশ ভালো হয়েছে। চাল দিয়ে যেমন পানি পড়ে না, ভাতের পাতিলেও ভাত থাকে। তবু একদিন সতেরো বছরের পরিবানুকে Ñ বানজা বেটিছোল এমন এক অপবাদে বাড়িতে পাঠিয়ে দিলো। যেখানে বড় আর ছোট মিলে এগারোজন কিলবিলে ছেলেমেয়ে, সেখানে পরিবানুর বাঁজা হয়ে থাকা এমনকি অপরাধ? কিন্তু ঘটনা এই Ñ রাজাবাবা শহরে এক এক্সট্রার পাল্লায় পড়েছে এবার। মেয়েটা দু-তিনটা সিনেমায় এক্সট্রা পাট করেছে। পুকুরে দুটো বড় বড় পদ্মফুলের মতো স্তন ভাসিয়ে এক্সট্রা মেয়েটা ‘সতীনের বেটি’ ছবিতে কাজ করেছিল। সিনেমায় নামতে গেলে স্তন একটা ফ্যাক্টর; কিন্তু এ-লাইনে শাইন করতে গেলে আরো কিছু থাকতে হয়। এক্সট্রা মেয়েটার সেসব কিছু ছিল না। ফলে স্টারকোয়ালিটির অভাবে সে আর বড় কোনো পার্ট পেল না। চার-পাঁচটা সিনেমার এক্সট্রা হয়ে একদিন তার কাজ শেষ হয়ে গেল। রাজা মিয়ার সঙ্গে দেখা তখনই।
আরো দু-একজন মক্কেল তার বাড়িতে পায়ের ধুলো দিতে শুরু করেছে বটে তবে রাজা মাতবরের মতো কারিশমা আর কারো নয়। ফলে জয় হলো রাজা মাতবরের। পাঁচ বছরে পরিবানুর শরীরের সবটুকু রস-কষ নিয়ে এখন অনেকটা ছিবড়ের মতো জ্ঞান করছে তাকে। সতেরো বছরের পরিবানু টসকায়নি মোটেই। কিন্তু টাউনের ওইসব এক্সট্রার এক্সট্রা কাজকর্ম সে জানে না। ফলে একদিন ধুলোপায়ে বাপের বাড়িতে ফিরে এলো।
ইতোমধ্যে চালে কয়েক বান্ডিল নতুন টিন, পাকা কলপাড়, পায়খানায় কাঁসার বদনা এসব হয়ে গেছে। কতদিন সেই বদনায় পানি খরচ করতে করতে বলেছে গফুর Ñ হে পরোয়ার দেগার তোমার কি শান। এই মেয়ে দিয়া তুমি আমার জীবনে কতটা সুখ-শান্তি আনিছো পরোয়ার দেগার।
এত ডাকাডাকির পরেও মেয়েটা ফেরত এলো। একটা টিনের স্যুটকেসে কয়েকটা শাড়ি নিয়ে। Ñ বাঁজা বেটিছোল সকালবেলা তোর মুখ দেখলে দিন ভালো যায় না। বাঁজা বেটিছোল আর মাকুন্দা সকালে এগলার চেহারা দেখা উচিত লয়। এরা সব মনহুজ। এমনই নানা অজুহাতে পরিবানু আবার বাড়িতে ফেরত এলো।
গায়ে-গতরে চমৎকার মাংস। অংটাও ধলো। নাক-নকশায় পরিবানু তখনো পরি। সেই দোস্ত আবার তাকে উপদেশ দিলো – এইবার দেইখা-শুইনা এমন একজনের হাতোত দেও যে তোমার আরো নানা খায়েশ পুরা করে। তোমার দিলের ভেতরে যে-ইচ্ছা তা সফল করবার জন্য কেমন পাত্র দরকার তা নিজেই তুমি ভালো জানো। গফুর নিজেও তা ভেবেছে। মেয়েটার দিকে তাকিয়ে তার ক্রয়ক্ষমতার সত্যতা জেনেছে। জীবনের আরো নানা বিলাসিতা সম্ভব এই বকনা গরুর মাংসে, বাপ হয়েও এমন একটা তুলনা এসেছে তার মনে।
এরপরের লোকটা তালেব আলী। এক বছর আগে বেশ কিছুদিন ভুগে বউটি মারা গেছে। চারজন ছেলেমেয়ে। খেটে খাওয়া মানুষ। বিঘা দশেক জমি আছে যা দিয়ে তার মন্দ চলে না। বউটা অবশ্য মরার আগে স্বামীর হাত ধরে বলেছিল – তুমি যদি হামার ছোলপোলক কষ্ট দাও তোমার মাথাত কোলে ঠাটা পড়বি। তখন তালেব আলী উত্তর করেনি। কয়েক মাস বিয়ে নিয়েও ভাবেনি। এক বিধবা বুড়ি বোন এসে বাড়ি সামালসুমাল দিয়ে, কোনোমতে সংসারটাকে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। কয়দিন হলো বেশ শীত। জাড়ের মাস। কাঁথার তলাত ল্যাপ গরম করবার জন্যও তো আর একজন দরকার। তা ছাড়া বাঘের মতো ক্ষুধা এখন গিলে গিলে কাজের শরীরে। তালেব আলী একদিন লোক মারফত পরিবানুকে বিয়ে করবার খবর পাঠায়। পরিবানুর বাপ লোকটাকে বসিয়ে একটা বড় লিস্টি সামনে ধরে।
– হামার পরির লাকান মাইয়া এমনিই নিবা তাই কি হয়?
– কী চাও তুমি?
– আমি যা চাই তার একটা লিস্টি বানাছি। দেমো?
সুতার ফ্রেমের চশমাটা নাকের উপর লাগিয়ে বলে লোকটা দেখি কী বানাছো।
১. ফুলকাঁসার থালাবাসন বদনা চিলমচি।
২. কাচের জিনিস রাখার আলমারি।
৩. এক ডর্জন ভালো প্লেট।
৪. বিছানার চাদর, বালিশ আর ল্যাপ।
৫. বারান্দা পাকা।
আগেরগুলোতে তেমন কিছু বলেনি তালেব আলীর বন্ধু। কিন্তু পাঁচ নম্বর লিস্টটা দেখে বলে Ñ বারান্দা তো আছেই। আবার পাকা বারান্দা?
– পাকা বারান্দা। আর বারান্দার টিনও বদলানি লাগবে।
ইতোমধ্যে বর্তমানের বাঘ পরিবানুকে গোসল সেরে পুকুর থেকে বাড়ি যেতে দেখেছে। তার মনে হয়েছে মাংসের স্বাদ আর গন্ধ তার আগের রোগ-তাপে পড়ে থাকা বউটার চাইতে সরেস। একেবারে রিদের রেজালা।
ফলে এসবে সে রাজি হয়ে গেল।
পরিবানুর সঙ্গে কথা বলে শহর থেকে মাঝে মাঝে গ্রামে ফিরে আসে হুরমুজ আলি। দুজনের বেশ একটু ভাবও হয়েছে। একদিন এক পাতা ফুল ফুল ক্লিপ উপহার দিতে গিয়ে একটা পরির মাথায় পরিয়েও দিয়েছিল। কিন্তু পরিবানু এমন আচরণে খুশি, না অখুশি সেটা বুঝতে পারেনি। কিন্তু হুরমুজের কথা বলা বা ফিতে ক্লিপ উপহার দেবার কথা মা জানলেও বাবা জানে না।
– তোর বাপ তোর আবার বিয়া ঠিক করবার লাগিছে পরি। হুরমুজ-টুরমুজের সঙ্গে এত হাসাহাসি কিসক।
পরিবানু উত্তর করে না। তার মনের ভাব জানে না কেউ।
– তোর চেহারাছবি একেবারে শাবনূরের মতো পরিজান। তার চাইতেও ভালো। তুই আমার সঙ্গে শহরে যাবি? বলেছিল হুরমুজ। পরিবানু তার প্রাণের পরিজান।
– শহরে নিয়া খাওয়াবা কী?
– চান্দের আলো আর নদীর পানি। এসব কথায় ভোলে না পরিবানু। নিজের ক্রয়ক্ষমতার কথা নিজে ও ভালো করে জানে।
– এখন তো খালি শহরোত কাম কর। একটা হোটেল দাও তারপর বিয়া করা নিয়া যাবা। পরিবানু জানে হোটেলে কাজ করা খানসামার পক্ষে হোটেল দেওয়া সহজ না।
তবু ছলছল একটা হালকা সবুজ বোধ এসে ফুরফুরে বাতাসের মতো ওর চারপাশে খেলা করে যখন হুরমুজ ওর চারপশে ঘোরাফেরা করে।
বিয়ের দিনটা ছিল কেমন একটা খনখনে দুপুর। বৈশাখ মাসের গরম চারপাশে। তালেব আলীর বাড়িতে পালকিতে যেতে যেতে দরজার ওপারে কদমগাছের ছায়ায়, মজা খালটার পাশে হুরমুজ আলীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিল। মনে হলো, একটা শীতল শান্ত বাতাস ছুঁয়ে গেল পরিবানুর শরীর। কিন্তু ও তখন মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। হুমহাম করতে করতে পালকিটা এসে নামে তালেব আলীর উঠোনে। গনগনে দুপুরে।
ইঁদুর ধরতে যাওয়া বেড়ালের মতো কয়েকটা শিশুমুখ এমনভাবে তাকিয়ে দেখছে পরিবানুকে ওর মনে হলো সুযোগ পেলেই এইসব বেড়াল তার শরীরে ঝাঁপিয়ে পড়বে। কে যেন বললো – ক আম্মা। ও তোর কেরে আম্মা। নয়া আম্মা। চারজন এক ছুটে চলে গেল ঘরে। তারা আম্মা বলতে চায় না। তারা  তাদের মায়ের স্মৃতি ভুলে যেতে পারেনি। আর রাতের বেলা আসল বাঘের সঙ্গে সাক্ষাৎ হলো পরিবানুর। তবে এমন ক্ষুধার খবর তার কাছে নতুন কিছু নয়। পরিবানু জেনে গেছে, নারীর জীবনে বাঘ, ভল্লুক, সিংহ, হাতি থাকে। আর যে-পরিবানুর গায়ের রং ধলো এবং তার নাক-নকশা খোদাই করা, তার আরো থাকে। পরিবানুর জীবন ইঁদুর ধরা বেড়াল এবং ক্ষুধার্ত বাঘের সঙ্গে চলছে যেমন চলবার কথা। এর মধ্যে এক-একদিন বাঁশঝাড়ে, আর আসবার সময় কদমবনে দাঁড়িয়ে থাকা সেই লোকটার কথা মনে পড়ে। বৃষ্টি নামলে মনে পড়ে, ঝড় উঠলে মনে পড়ে, যখন হৃদয়টা কী সব ভাবনায় ব্যথা ব্যথা, তখন মনে পড়ে। হুরমুজ এ পর্যন্ত তাকে এক পাতা ক্লিপের বেশি দিতে পারেনি, তবু তার কথা মনে পড়ে। কিন্তু সংসারের চালচুলোর দাবির কাছে এসব মনে পড়া নিয়ে বসে থাকে না পরিবানু। সে কাজ করে সারাদিন। চারজন বাচ্চার কত সব কাজ। তালেব আলীরও নিজস্ব অনেক কাজ আছে।
দিন চলে যায়। ঠিক চার বছর পার করার পর শহর থেকে বাড়িতে আসতে গিয়ে মাথায় বাজ পড়ে মারা যায় তালেব আলী। সে সন্তানদের অবহেলা করেনি, তারপরেও। এবার পরিবানুর বাড়িতে ফিরে আসার সময়। তালেব আলীর ভাই বাচ্চাগুলোকে রেখে একটা টিনের স্যুটকেসে কাপড়-চোপড় তুলে দিয়ে ওকে বাড়ি থেকে চলে যেতে বলে। বাচ্চাগুলো খুশি। যাকে ওরা কোনোদিন মা ভাবতে পারেনি তারা চলে গেলে খুশি ছাড়া আর কী হবে। কিন্তু এবার যারা ওদের জীবনে আসছে সেই উনোনমুখো নারীর খবর জানা থাকলে ওরা এতো খুশি হতো না। সে-নারী বাজপাখি। পরিবানুর মতো ময়নাপাখি নয়।
একুশ বছরে কেবল পড়েছে পরিবানু। দু-দুটো স্বামী পর্ব শেষ করে এবার সে বাড়িতে ফিরে আসছে। রূপ তখনো অফুরান। একুশ বছরের যৌবন তার। গায়ে-গতরে পরিপূর্ণ করে তাকে আরো আকর্ষণীয় করেছে। হুরমুজ দু-একবার আসে। একটু কথা না হলে একটু হাসাহাসি। বাপ তখন খুঁজছে আর এক বড় বোয়াল মাছ, যার কাছে মেলে ধরবে আরো কিছু ঢেউটিনের মতো ফর্দি। এবারের খোঁজা সার্থক। পাত্র মধ্যপ্রাচ্যে কাজ করে। বাড়িতে একজন বুড়িমা আছে যাকে দেখাশোনা করবার জন্য বউ দরকার তার। নিজের প্রয়োজন তাকে কখনো কষ্ট দেয় না। কিশোর বয়স থেকেই সে একইরকম। এবারের ফর্দিতে একটা ভালো বাথরুম, দুখানা পাকা ঘরের মতো বিশেষ এক ফর্দি মেলে ধরলো গফুর। পরামানিক মানে নাপিত। বুদ্ধি যার নাপিতের মতো। বাবা হওয়া যে এক বিশেষ দায়িত্ব ও আনন্দের কাজ এ-কথা তার চাইতে বেশি আর কে জানে। এক এক রাতে আম্বুরিকে বলে সে –
– আর দুকনা বেটিছোল হলে হামরা আজা হলাম হিনি।
– আর দুকনা। এই বলে আম্বুরি ঘুমায়। তারপর বলে – বারবার কি ইংকা ধলো অংয়ের বেটিছোল হলোহিনি।
– হবি না কেন। বেটিছোল তো হামার আর তোর। আর কারো লয়।
আম্বুরি কথা বলে না। জরায়ুর তালা একবারই খুলেছিল আর খুলবে না সে তা ভালো করে জানে। জরায়ুর তালা নয়, গফুর জানে এ তার ভাগ্যের তালা।
মিসির আলীর কাছে মেলে ধরে তার ফর্দি। মধ্যপ্রাচ্যে কাজ করে বেশ কিছু টাকা হয়েছে তার। সে বলে কেবল – দুখানা পাকা ঘরের কেন প্রয়োজন?
– বাবা আপনি হলেন আজা মানুষ। হামাকেরে বাড়িত যখন আসবেন কেংকা করে মাটির ঘরোত আপনাক শোবার দেই কন?
– দুকনা পাকা ঘর আর একখানা গোসলের পাকা জায়গা। আর ঘর হলে তার দু-একখানা খাট পালংও লাগে। সেটা বাবা – এই বলে হাত কচলাতে থাকে গফুর পরামানিক।
– ঠিক আছে। মিসির আলী বিনয়ী ছেলে। সে দামদর করবার মতো ছোট কাজ করতে চায় না। ফলে সাতদিনের ভেতর দুটো ছোট পাকা ঘর আর একটা পাকা গোসলের জায়গা হয়ে যায়। যেখানে গামছা বা তোয়ালে রাখবার র‌্যাকও লাগানো হয়েছে। একটা বেসিন। একটা আয়না। গফুর সেখানে নিজের মুখ দেখে হাসতে হাসতে। মিসির আলী বিয়ের দুদিন পর ফিরে যাবে মধ্যপ্রাচ্যে। বউ নিয়ে একটু রঙ্গরস করবার মতো তাগিদ সে জীবনেও কখনো অনুভব করেনি। নতুন বউ যখন পাশ ফিরে ঘুমোয় সে কেবল বলে Ñ টাকা-পয়সার কোনো অভাব থাকবে না।
ফিরতে ফিরতে আমার এক বছর। ভালো হয়ে চলাফেরা করবা।
পরিবানু কথা শুনে একটু অবাক হয়ে। এবার সে বাঘ বা সিংহের সঙ্গে ঘর করতে আসেনি, এসেছে এক ভেড়ার বউ হয়ে।
আবার নানা সব মন কেমন করা দিন আসে। পরিবানু আর হুরমুজ বেশ একটু ভাব করে। হাসাহাসির পর্ব পার হয়ে একটু গভীর। শাশুড়ি বুড়ি হলেও কানে শোনে এবং চোখে দেখে। পরিবানু ও হুরমুজের সম্পর্ক নিয়ে সে চুপ করে বসে থাকে না। একদিন দুজনকে ধরে ফেলে গ্রামের দু-একজন। দুজন বিছানায় বসে একসঙ্গে আয়নায় মুখ দেখছিল। এর বেশি কিছু নয়। পেটিকোট আর ব্লাউজ ছিল যথাস্থানে। শাড়ির আঁচলটা ছিল কাঁধের ওপর। ফলে পাথর খেয়ে মরতে হলো না পরিবানুকে। তবে কিছুদিন পর মধ্যপ্রাচ্য থেকে তালাকনামা এসে গেল। বাড়িতে ফিরে আসার সময় আবার তার এসে গেছে।
– ওইসব হুরমুজ-টুরমুজ লয়। হামি তোক আজার সঙ্গে বিয়া দেমো। বিয়ার ব্যাপারে পরিবানুর নিজের কোনো মত নাই। সে চুপ করে থাকে। এবার সে বাড়িতে ফিরে এসেছে তার চরিত্রহীনতার কারণে। এ অপরাধ ক্ষমারও অযোগ্য। ফলে এবার সে একটু ভীত আর চুপচাপ। তবে হৃদয়ের কিবা দোষ যদি সে হুরমুজের কথা ভাবে। দু-একবার দেখা করে। গ্রামের লোকেরা একদিন হুরমুজের এই গাঁয়ে থাকার দরকার কী – এই বলে ওকে গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে বলে।
হুরমুজ এমনিতেই গ্রামে থাকতে চায়নি। সে চলে গেল।
তিন-তিনটে স্বামী পার করে বাইশ বছরের ডাগর পরিবানু পাকা ঘরের বারান্দায় বসে তখন মায়ের মতো কাঁথা সেলাই করে। না হলে কাপড় কেটে সায়া-পেটিকোট বানায়। চুল আঁচড়ায় বড় আয়না চোখের সামনে রেখে।
বেশ কিছুদিন গফুর আর একটা পাকা রুই বা বড় বোয়াল বড়শিতে তুলতে পারে না। সে তুলতে পারে না কোনো মৃগেল বা চিতল। যে দু-একজন বিয়ের কথা বলছে তারা সব নেহায়েতই গরিব মানুষ। হয়তো ওরই মেয়েকে সারাবছর এটা-ওটা পাঠাতে হতে পারে। সে খুঁজছে আর একজন মাছের মতো স্বামী। এই খোঁজার কারণ দুটো। প্রথমত, সে মেয়েকে একজন টাকাপয়সাওয়ালার হাতে তুলে দিতে চায় আর দুই নম্বর কারণ সে এবার সত্যিই চায় একখানা মাছালো পুকুর। যে-পুকুরে বড় মাছের চাষ করবে সে। দরকার হলে বড়শি ফেলে নিজের পুকুরে মাছ ধরবে। একটা আছে এ-গাঁয়ে। কিছু দাম পেলে সে পুকুর বিক্রি করবে মালিক। দরকার কেবল পুকুরটার একটু সংস্কার করা। কিন্তু তিরিশ হাজার টাকা দেবার মতো কোনো সুপাত্র খুঁজে পাওয়া বেশ একটু মুশকিল এখন। এর ওপর মেয়ের গায়ে একটু কালিও পড়েছে। আগের মতো ঝকঝকে ফুলকাঁসার পাত্র নয় মেয়ে।
লোকটার গালের একপাশ পোড়া। একটা চোখ কানা। লোকটা এ-গাঁয়ে নতুন এসেছে। একদিন গফুরকে পাকড়াও করলো লোকটা। অনেকক্ষণ দুজনের কথা হলো। না লোকটা পরিবানুকে বিয়ে করতে চায় না। সে যা চায় সে এই পরিবানুকে চিরদিনের মতো কিনে আরব দেশ, মিশর বা তুরস্ক Ñ কোনো একখানে এক রাজার বউ করবে। কোনো এক বাদশার বিবি বানাবে।
– আজার বউ? অবাক হয়ে বলে গফুর।
– কেন নয়। তোমার মেয়ের এত রূপ।
– আজা এটি আসাঅক বিয়ে করবার পারে না।
– না। আমি নিজে গিয়ে রাজাকে দেব। কুর্নিশ করে বলবো Ñ শাহেনশাহ এই হলো পরিবানু। আপনার হেরেমের গোলাপফুল।
গফুর বলে – শুনছি মেয়ে দিয়া তারা বান্দিগিরি করায়।
– তোমার মেয়ের কি বান্দির মতো রং আর নাক-চোখমুখ। ওর ভাগ্যই তো রানী হবার।
যে-দাম বলছে মাছালো পুকুরটা হয়ে যাবে। রাতে আম্বুরিকে একটা বানানো গল্প বলতে হবে।
– অরে তো আর কোনোদিন দেখবার পামো না। সেই দালালকে বলে গফুর।
– তোমারও তো বুড়া হইছো। মরবা না। তাহলে এত ভাবনার কী আছে?
গফুর বাড়িতে আসে। বারান্দায় একটা মোড়ায় বসে চালতামাখা খাচ্ছে পরিবানু চারপাশে চুল মেলে দিয়ে। গফুর চেয়ে দেখে।
পাকা পায়খানায় ফুলকাঁসার বদনায় পানি খরচ করতে করতে ভাবে সে মাছালো পুকুরটার কথা। আম্বুরি যখন পোয়াতি ছিল একটা বড় মাছের স্বপ্ন দেখেছিল। এখন সে-স্বপ্নের অর্থ বুঝতে পারছে। এইটাই সেই স্বপ্নের অর্থ। একটা মাছভর্তি পুকুর হবে তার। শত শত মাছ খেলা করবে সেই পুকুরে।
রাতের বেলা বেশ কয়েকবার ঘুম থেকে উঠে সে মেয়ের ঘরে ঢোকে। জানালা বন্ধ করে দেয়। যদি কেউ এসে মেয়েটাকে ফুসলে নিয়ে যায়। হুরমুজকে গতকাল দেখেছিল সে। সে যদি মেয়েটাকে ভাগায়ে শহরে নিয়ে যায়। এই করতে করতে রাত পার হয়। সকালবেলা প্রশ্ন করে আম্বুরিকে Ñ মেয়ে কোন্টে গেছে?
– অর সইএর কাছে।
পাগলের মতো ছুটতে ছুটতে পরিবানুর সইয়ের বাড়িতে আসে। এই সাত সকালে সইয়ের বাড়িতে আসবার কারণ কী? মনে হয় হুরমুজ এই বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। সর্বনাশ! হায়রে আমার মাছালো পুকুর। সে দিব্যদৃষ্টিতে দেখতে পায় একটা গভীর নীল পুকুরে কত সব সোনালি মাছ সাঁতার কাটছে। একটা রুপোর বড়শি আর সিল্কের সুতোর মুখে টোপ ছুলিয়ে ফকফকা সাদা একটা পাঞ্জাবি পরে সে বসে আছে সেই পুকুরটার কাছে, যা এখনো কেনা হয়নি। মেয়ে একটু অবাক হয় বাবাকে এইভাবে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসতে দেখে। সে বলে – কিসের এত জরুরি কাজ। হামি বাড়িত যামোহিনি বাপজান, এট্টু পরেই যামো।
বাবা তাড়া দিয়ে বলে – এখনই চল। দেরি করিস না।
মেয়ে বাবার পিছু পিছু বাড়িতে আসে।
যেমন করে বস্তায় ভরে একটা বেড়ালকে কেউ বাড়ি থেকে বিদায় করে ঠিক তেমনিভাবে মেয়েটাকে সেই গালপোড়া আরেক চোখের দালালের হাতে তুলে দেয়। মাছালো পুকুরটা এখন আর স্বপ্ন নয়, সত্য।
দু-একদিন একটা মাছ এসে ঘুরে যায় বড়শির চারপাশে। যার চোখ দুটো দেখলে ওর আর দুটো চোখের কথা মনে পড়ে। বুকটা ব্যথা ব্যথা। তখনই বলে সে – পরিবানু গোলে বকাওলির মতো তোর গল্পটা এখন আর পরির গল্প লয়, এটা সত্যি। তুই এখন আনি।
আম্বুরি দিন দিন ক্ষয় হতে থাকে কী এক অসুখে বিছানা আঁকড়ে। কারণ কেউ জানে না। ডাক্তার-কবিরাজ কেউই রোগটা ধরতে পারে না।