তাঁর শিল্প-সাধনা

মাহমুদ আল জামান

শিল্পগুরু ও বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ ছাপাই ছবির শিল্পী সফিউদ্দীন আহমেদ নববই বছরের জন্মদিনের মাত্র কয়েকদিন আগে আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। তাঁর মৃত্যুতে আমাদের শিল্পজগতের অপূরণীয় ক্ষতি হলো। দীর্ঘদিন তিনি অসুস্থ ছিলেন। সেজন্যে অনেকদিন তিনি ছবি অাঁকতে পারেননি। এ নিয়ে তাঁর খেদ ছিল। মৃত্যুর কিছুদিন আগেও তিনি এ নিয়ে খেদ প্রকাশ করছিলেন। বলেছিলেন, ‘মনের ভেতর চিত্র সৃষ্টির এত অনুষঙ্গ আসা-যাওয়া করছে, অথচ কিছুই অাঁকতে পারছি না। একজন শিল্পীর জন্য এ ভয়ানক এক অবস্থা। এর চেয়ে মৃত্যুও শ্রেয়।’ আসলে তাঁর সৃষ্টিশীল জীবনের সকল পর্ব পর্যবেক্ষণ করলে আমরা দেখতে পাই তিনি নিরবচ্ছিন্ন সাধনার দ্বারা হয়ে উঠেছিলেন এক অনন্য শিল্পী। তাঁর সৃজনভুবনেও ছিল তিনটি পর্ব। এক পর্ব থেকে আরেক পর্বে উত্তরণ ও সিদ্ধির এক মনোগ্রাহী পথ তিনি নির্মাণ করেছিলেন। একাগ্র সাধনা ও সৃষ্টির মধ্য দিয়ে হয়ে উঠেছিলেন এদেশের চিত্রকলায় অনন্য এক সাধক ও শিল্পী।

Art work of Shafiuddin Ahmed
Art work of Shafiuddin Ahmed

ঐশ্বর্যময়, বৈচিত্র্যময় সৃজনে তাঁর সৃষ্টিক্ষমতার প্রাবল্য লক্ষ করা যায়। তেমনি শিল্পের অন্বিষ্ট ভুবনে তিনি কীভাবে নিজেকে উজাড় করে দিয়েছিলেন একজন আত্মসচেতন মানুষ হিসেবে তা পরিস্ফুট হয়েছে।
নিভৃতচারী এবং প্রচ্ছন্নে থাকা মানুষ ছিলেন তিনি। জয়নুল আবেদিনের সঙ্গে গড়ে তোলেন নতুন শিল্প-শিক্ষালয়। যে-শিক্ষালয় ক্রমে এবং নানা অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে হয়ে উঠেছে একটি আধুনিক ও বাঙালির রুচি নির্মাণের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ।
সফিউদ্দীন আহমদের জন্মদিন পালন উপলক্ষে ২৩ জুন ২০০৮ সালে বেঙ্গল গ্যালারি আয়োজিত ‘রেখার অশেষ আলো’ শীর্ষক যে-প্রদর্শনীটি আয়োজিত হয়েছিল তা এদেশের শিল্প অনুরাগী সকল মানুষের জন্য ছিল এক অভিজ্ঞতা। এই প্রদর্শনীটি শিল্পী সফিউদ্দীনের কাজ উপলব্ধির জন্যে আমাদের সাংস্কৃতিক চিদাকাশে হয়ে উঠেছিল এক বিরল ঘটনা। নানা যৌথ প্রদর্শনীতে অংশ নিলেও তিনি দেশে ২০০৮ সালের আগে কোনো একক প্রদর্শনী করেননি। তাঁর একক প্রদর্শনীতে এতগুলো কাজ একসঙ্গে দেখা হয়ে উঠেছিল আমাদের চিত্রকলা-আন্দোলনে আলোচিত ঘটনা। এক মনোগ্রাহী বোধ ও বুদ্ধিদীপ্ত চৈতন্যে চালিত হয়েছেন তিনি। কোনো প্রদর্শনী করা নিয়ে তাঁর এতটুকু আগ্রহ ছিল না। তাঁর মনে হতো, একক প্রদর্শনীতে যে-কোনো শিল্পীর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও শৈলী যতদিন না অর্থবহ বা সার্থক হয়ে উঠবে ততদিন কোনো একক প্রদর্শনী করা উচিত নয়। সেজন্যেই বোধকরি শিল্পাঙ্গনের সকল কোলাহল থেকে নিজেকে বিযুক্ত করে তিনি চিত্র-সাধনা করে গেছেন। তিনি তাঁর অভীষ্ট লক্ষ্য সম্পর্কে খুবই সচেতন ছিলেন। এক্ষেত্রে এক আত্মসচেতন বোধ দ্বারা সমগ্র জীবন তিনি চিত্রসাধনা করেছেন। তিনি দীর্ঘদিন ধরে দুর্ঘটনাজনিত কারণে শয্যাশায়ী ছিলেন বলে প্রদর্শনীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পারেননি। তিনি কোনো একক প্রদর্শনী করেননি বলে শিক্ষার্থী ও শিল্পানুরাগীরা তাঁর কোনো কাজ একসঙ্গে কোনোদিন দেখতে পারেননি। অথচ তাঁর নিজের সংগ্রহে ছিল নানা মাধ্যমে করা চার শতাধিক কাজ। চল্লিশের দশক থেকে দুর্ঘটনায় আহত হওয়ার আগ পর্যন্ত কত ধরনের কাজই না তিনি করেছেন। সেদিক থেকে অনেকের জন্যে ছিল বিরল অভিজ্ঞতা। এই প্রদর্শনীর কিছুদিন পরে ‘শিল্পের অশেষ আলো পর্ব-১’ শীর্ষক আরেকটি প্রদর্শনী আয়োজন করেছিল বেঙ্গল গ্যালারি। ২৬ নভেম্বর থেকে ৯ ডিসেম্বর ২০১০ সাল পর্যন্ত বেঙ্গল শিল্পালয়ে এই প্রদর্শনীটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ‘শিল্পের অশেষ আলো পর্ব-২’ প্রদর্শনীটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১০ থেকে ২৩ ডিসেম্বর-২০১০ পর্যন্ত।
শিল্পী সফিউদ্দীন আহমেদের কাজ এবং সৃষ্টির গহন, তীব্র ও সূক্ষ্ম বোধসম্পন্ন সৃষ্টি সম্পর্কে অনেকের সম্যক ধারণা থাকলেও একসঙ্গে এতো কাজ কোনো অনুরাগী বা শিল্পবোদ্ধা দেখেননি। এই তিনটি প্রদর্শনী সেই আগ্রহ যেমন নিরসন করেছিল, তেমনি তিনি যে কত বড় মাপের শিল্পী সে-কথা প্রমাণিত হয়েছে।
১৯৫৬ সালে ছাপাই ছবিতে উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণের জন্যে তিনি সম্পূর্ণ নিজ ব্যবস্থায় ও খরচে বিলেতে গেলেন। ভর্তি হলেন সেন্ট্রাল স্কুল অফ আর্টস অ্যান্ড ক্র্যাফটে। লন্ডনের অধ্যয়নই যেন তাঁর সৃষ্টিতে এক নতুন মাত্রা সঞ্চারিত করেছিল। তাম্রতক্ষণে হাতে-কলমে শিক্ষা পেয়েছিলেন এই ইনস্টিটিউটে। পাশ্চাত্যের ছাপাই ছবির সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয়গুলো ছাত্রদের অবহিত করা হতো। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর সম্পর্ক ছিল বন্ধুর মতো। পেয়েছিলেন উন্নত হৃদয়মনের এক শিক্ষক। দুবছর ধরে সফিউদ্দীন ব্যস্ত রইলেন বিলেতে শিক্ষাগ্রহণে। সৃষ্টিশীলতার এই ধারাটির উন্মেষ ও বিকাশ ঘটেছিল কলকাতায় ছাত্র থাকাকালে। কলকাতা আর্ট স্কুল ছাপাই ছবি সম্পর্কে তাঁর মানস ভুবন একদিকে সমৃদ্ধ হয়ে ছিল, অন্যদিকে ছাপাই ছবি যে কীভাবে শিল্পগুণসম্পন্ন ও শিল্পমন্ডিত হয়ে উঠতে পারে এ-শিক্ষাও তিনি পেয়েছিলেন সেখানে। লন্ডনের শিল্পশিক্ষা তাঁর বোধে ও শিল্পচৈতন্যে আরেক মাত্রা সংযোজন করেছে। সময় ও সুযোগ পেলেই ঘুরে দেখতেন মিউজিয়াম আর গ্যালারি; যেন ভবিষ্যতে যে-পথ তিনি নেবেন মনে মনে তারই প্রস্ত্ততি চলছিল তখন।
এই সময়ে বিশ্ববিখ্যাত প্রিন্ট মেকার হেটার তাঁকে দারুণভাবে প্রভাবিত করেছিলেন। কিন্তু হেটারের কাছ থেকে তিনি কিছুই পরিগ্রহণ করেননি। শুধু প্রিন্ট মেকিংয়ের বিষয় ও করণকৌশল উপলব্ধি করতে চেয়েছেন। বুঝতে চেয়েছেন কীভাবে হেটার ছাপাই ছবিকে চিত্রগুণসমৃদ্ধ করেছেন। কোথায় হেটারের সৃজনের কৌশলী গুণ।
বিদেশে পাড়ি দেওয়ার আগেই তিনি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছিলেন চারপাশের জীবনকে। দৃশ্যমান বাংলা এবং প্রবহমান জীবনের নানা অবয়ব তিনি ধমনীতে ধারণ করে রেখেছিলেন। জীবন থেকে শুষে নিচ্ছিলেন অভিজ্ঞতা, বিশেষ করে ১৯৫৬ সালের ভয়াবহ বন্যার দুঃসহ অভিজ্ঞতা তাঁর সত্তায় প্রভাব ফেলেছিল।
লন্ডনে নিউ ভিশন সেন্টার গ্যালারিতে সফিউদ্দীন আহমেদের প্রদর্শনী হয়েছিল ১৯৫৯ সালের ২০ এপ্রিল থেকে ৯ মে পর্যন্ত। একটি ফোল্ডার প্রকাশিত হয়েছিল। সর্বমোট ১৬টি তেলরং ও ছাপাই ছবির চিত্র ছিল। ফোল্ডারটির ভূমিকা লিখেছিলেন ফজলে লোহানী। তিনি তখন উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণের জন্যে লন্ডনে। লন্ডনে শিল্পশিক্ষা গ্রহণকালে তিনি এচিং, ড্রাই পয়েন্ট এবং অ্যাকুয়াটিন্টে দক্ষতা অর্জন করেন। প্রদর্শনীতে লন্ডনে করা কিছু কাজ ছিল। তিনি সৃজনের বিষয় হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন দেশীয় বিষয়। জাল, নৌকা, সেতু আর বন্যা। তাঁর উদ্ভাবনী কৌশল ও সৃজনী শক্তির যে-স্ফুরণ হয়েছিল শিল্পানুরাগীদের হৃদয় ও মনে তা স্থায়ী ছাপ রেখে গিয়েছিল।

দুই
বেঙ্গল গ্যালারি আয়োজিত ‘রেখার অশেষ আলো’ প্রদর্শনটি তাঁর সামগ্রিক কাজের কোনো প্রদর্শনী ছিল না। পূর্বে উল্লিখিত তিনটি পর্বে নির্বাচিত কিছু কাজ তাঁর সৃষ্টির অতলস্পর্শী অনুষঙ্গী হিসেবে কতভাবে যে জড়িয়ে আছে শিল্পানুরাগীরা সেরকম ধারণাই অর্জন করেছিলেন।
এ-প্রদর্শনীতে তাঁর কিছু নির্বাচিত ড্রইংও ছিল। শিল্পে সমর্পিত এই মানুষটির যে-কোনো সৃষ্টিতেই বহুভাবনার গুঞ্জন ও আলোড়ন খুব সহজেই প্রত্যক্ষ করা যায়। সংবেদনশীল ও অনুভূতির তীব্রতাও প্রাধান্য বিস্তার যে কতভাবে করে তাঁর সৃষ্টির মধ্যে তা উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল।
ড্রইং বা রেখা যেকোনো শিল্পীর সৃজনে গতিপথ নির্মাণ করে। রেখাই হয়ে ওঠে প্রাণভোমরা। বিংশ শতাব্দীর আলোড়ন সৃষ্টিকারীদের সৃষ্টিতে রেখার সৃজনময়তায় আমরা মুগ্ধ হয়েছি। রেখা যে সফিউদ্দীনের শিল্পযাত্রা ও সাধনার মৌল বিষয় সে-কথা তিনি দু-একটি সাক্ষাৎকারে আমাদের জানিয়েছেন। রেখাবিদ্যাকে চর্চার জন্যে যে-কোনো শিক্ষার্থীকে খুবই পরিশ্রম করতে হয়। শিল্পী সফিউদ্দীনও রেখাকে আয়ত্ত, গতিশীল ও চিত্রে মাধুর্যময় ও অর্থবহ করবার জন্যে নিরন্তর চেষ্টা করেছেন। রেখার চর্চাকে আরো প্রাণময় করবার জন্যে তিনি ছাত্রাবস্থায় ও পরবর্তীকালে যখন কলকাতা আর্ট স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন তখনো ড্রইংকে খুবই মূল্য দিয়ে অনুশীলন করেন। তিনি আলাপচারিতায় একাধিকবার এ-কথা নানাজনকে বলেছেন। ড্রইংয়ের শক্তিময়তার জন্য তাঁর সৃষ্টি এত সমৃদ্ধ, এত ব্যঞ্জনাময় ও সংবেদনময়।
কলকাতা আর্ট স্কুলে তিনি যখন ছাত্র সেই সময়ের শিল্পশিক্ষায় ড্রইংকে খুব প্রাধান্য দেওয়া হতো। এই রেখার অন্তর্নিহিত শক্তিকে আয়ত্ত করবার জন্য সকল ছাত্রকে প্রাণান্ত পরিশ্রম করতে হয়েছে। তাঁরা মানুষ, পশুপাখি, নদী ও নিসর্গকে নিয়ে যেমন ড্রইং করেছেন, তেমনি এ-ড্রইংয়ের বিষয়াবলিকে কখনো-সখনো রূপান্তরিত করেছেন ছাপাই ছবিতে।
তিনি পরবর্তীকালে ছাপাই ছবি ও চিত্রে ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জন করা সত্ত্বেও ড্রইংয়ের অমিত সম্ভাবনাকে নিয়ে সমগ্র জীবন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। বেঙ্গল শিল্পালয় আয়োজিত তিনটি প্রদর্শনীতে চল্লিশের দশকে করা তাঁর কিছু ড্রইং ছিল। এছাড়া ছিল পরবর্তীকালের ড্রইংচর্চার নানা নিদর্শন। গত সাত দশক ধরে তিনি ড্রইংকে কীভাবে যত্নসহকারে চর্চা করেছেন তা এ-প্রদর্শনীতে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল।
কিছু ড্রইং তাঁর ছাপচিত্র ও চিত্রকলার জন্যে পরিকল্পিত হলেও ড্রইং হিসেবে এই সৃষ্টিগুচ্ছ আলাদা মূল্য পেয়েছে। ঝড়, বন্যা, মানবদেহ স্টাডি, মাছ ধরা, জাল, গুণটানা, মুরগি বিক্রেতা, শরবত বিক্রেতা, ফল বিক্রেতা, বাদাম বিক্রেতা, ছাপাখানাসহ নানা বিষয়কে উপজীব্য করে তিনি ড্রইং করেছেন।
আজীবন শিক্ষাব্রতী, শিল্পধ্যান নিমগ্ন ও নিভৃতচারী সফিউদ্দীন ড্রইংয়ে যে কত দক্ষ এবং ড্রইং তাঁর সৃষ্টিভুবনে যে কতভাবে ছাপ রেখে যায় প্রদর্শনীতে স্থান পাওয়া এমন কিছু নিদর্শন দেখে তাঁর শিল্পিত শক্তিমত্তা সম্পর্কে নতুন করে জ্ঞান আহরণ করেছি। এখানে জীবনের নানা অনুষঙ্গ, ভঙ্গি, নানা মুখ, রমণীদেহের সুডৌল ছন্দ, ধীবর, নদী, শ্রমজীবী মানুষের নিরন্তর জীবনসংগ্রাম, মাছ ও জাল তাঁকে যেভাবে আলোড়িত করেছে তা তিনি তাঁর সৃজনে ধরে রেখেছেন। যে-কোনো শিক্ষার্থী ও শিল্পানুরাগী তাঁর ড্রইংয়ের আবেগ ও কাব্যধর্মী ব্যঞ্জনা দেখে সফিউদ্দীনকে নতুন করে আবিষ্কার করেছেন। শিল্প-শিক্ষার্থীদের জন্যে এই প্রদর্শনী হয়ে উঠেছিল বিশেষ ফলপ্রসূ। শিক্ষার্থীরা দলবেঁধে তাঁর কাজ দেখেছেন, রেখার শক্তিমত্তা নিয়ে কথা বলেছেন ও পুঙ্খানুপুঙ্খ বিষয় নিয়ে মতবিনিময় করেছেন। সফিউদ্দীন নববইয়ের দশকের শেষ দিকে ও এই শতাব্দীর সূচনায় চারকোল ও ক্রেয়নে বেশ কিছু ড্রইং করেছেন। এই ড্রইংগুলোর কম্পোজিশন অসাধারণ। কালোর অন্তর্নিহিত সৌন্দর্যের সঙ্গে সাদা রঙের বিন্যাস অসামান্য হয়ে উঠেছে। এই সৃষ্টিগুচ্ছ তাঁর শিল্পীজীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তি। আমরা জানি কম্পোজিশনজ্ঞানে এই কাজগুলো শুধু অসামান্য কাজই নয়, যে-কোনো শিল্প-শিক্ষার্থীর জন্য এই কাজগুলো হয়ে উঠেছে মেধা, মনন ও শিল্পের যথার্থ পথ নির্মাণের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। কালো রং নিয়ে তাঁর নিরীক্ষাপ্রবণ মন সর্বদাই জিজ্ঞাসা-উন্মুখ ছিল। সেজন্যে ছাত্রাবস্থা থেকেই কালো রঙের প্রতি তাঁর মোহ জন্মেছিল। এই কালো সিরিজের কাজও ছিল প্রদর্শনীতে। কালো রং কখনো তীব্র ও তীক্ষ্ণ হয়ে উঠেছে তাঁর কুশলী হাতে। গহন কালো এখানে এক অর্থযোজনা করেছে। কালো রংও যে কত উজ্জ্বল হয়ে ওঠে এবং আলোর অধিক হয়ে যায় এই রেখাগুলো যেন তারই প্রমাণ। গতানুগতিকতামুক্ত এসব ড্রইংয়ে তিনি চিত্রের গুণাবলি সঞ্চার করেছেন। ড্রইংয়ে এ-ধরনের নিরীক্ষা খুব একটা দেখা যায় না। রেখার সাবলীল ছন্দের মধ্যে তীব্র ও তীক্ষ্ণভাবে অনুভব করা যায় বিষয়ের অন্তর্নিহিত সৌন্দর্য। ফর্মপ্রধান এই সৃষ্টিগুচ্ছে তাঁর চিত্রের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও স্বরূপও প্রতিফলিত হয়েছে। দীর্ঘদিনের চিত্রসাধনায় এই রেখাসমূহ বিভাবসঞ্চারী হয়ে উঠেছে। সফিউদ্দীন আহমেদের সকল মাধ্যমকে উপলব্ধির জন্য এই রেখাসমূহের তাৎপর্য অসীম বলে প্রতীয়মান হয়েছে।
সফিউদ্দীন আহমেদ কলকাতা আর্ট স্কুলে (১৯৩৬-৪২) অধ্যয়নকালে ড্রইংকে বিশেষ যত্নসহকারে আয়ত্ত করেছেন। সেজন্যে সুদূর সাঁওতাল পরগনা দুমকা, চাইবাসা, গিরিডি আর গঙ্গা নদী-তীরবর্তী অঞ্চল তাঁর নৈমিত্তিক বিচরণের ক্ষেত্র ছিল। দলবেঁধে শিয়ালদা স্টেশনে যেতেন। দুচোখ ভরে দেখতেন অগুনতি মানুষ। মানুষের নানা অভিব্যক্তি তাঁকে প্রবলভাবে আকর্ষণ করত। সহপাঠী আদিনাথ ছিলেন নিত্যসঙ্গী। মানুষ ও প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ এবং ড্রইং করার জন্যই তিনি এসব অঞ্চলে নিয়মিত যেতেন। এ-ব্যাপারে বিশেষ দৃষ্টি দিতে বলতেন তাঁর প্রাণপ্রিয় শিক্ষক রমেন চক্রবর্তী ও অকালপ্রয়াত আরেক শিক্ষক আবদুল মঈন। আর অনেকদিন তিনি আর্ট কলেজ থেকে হেঁটে বেশ দূরে কাঁকুরগাছি গেছেন তাঁর আরেক শিক্ষক প্রহ্লাদ কর্মকারের স্টুডিওতে ড্রইংয়ের পাঠ নিতে। সেই সময় সাঁওতালদের জীবন ও গঙ্গা-তীরবর্তী মানুষজনের নানা অভিব্যক্তিকে অবলম্বন করে তিনি অজস্র ড্রইং করেছেন। পরবর্তীকালে ছাপাই ছবি ও তেলরঙে যখন সাফল্য অর্জন করেন ও ভারতে খ্যাতিমান হয়ে ওঠেন তখন এই অবলোকন তাঁর চিত্র-সাধনায় হয়ে ওঠে এক অবলম্বন। তাঁর সকল সৃষ্টির মাধ্যমে ড্রইংই বিশেষ মর্যাদা, ভিন্ন আদল ও মাত্রা নিয়ে রূপান্তরিত হয়েছে। ড্রইং তাঁর যে-কোনো সৃষ্টির বীজ হয়ে ওঠে এবং তাঁর নির্মাণের বোধের সঙ্গে লগ্ন ও একাত্ম হয়ে যায়।
তাঁর নানা মাধ্যমের কাজে আমরা যে সৃজনী-উৎকর্ষ ও পরিশীলিত আবেগ প্রত্যক্ষ করেছি, নানা দিক থেকে আমাদের চিত্রকলার ভুবনে তা হয়ে উঠেছে ব্যতিক্রমী ঘটনা। চল্লিশের দশকে তিনি যখন কলকাতা আর্ট কলেজের ছাত্র, তখন থেকেই তাঁর স্বতন্ত্র শিল্পীসত্তা ও বিশিষ্টতা শিল্পানুরাগীদের মধ্যে উজ্জ্বলতা নিয়ে প্রকাশিত হয়েছিল। ছাত্রাবস্থা থেকেই শিল্পের অনলে তিনি নিজেকে দগ্ধ করে কুশলী ও দক্ষ চিত্রী হয়ে উঠেছেন। এই সময়ে মুসলিম সমাজে চিত্রকলার চর্চাকে শ্রদ্ধার চোখে দেখা হতো না। তবু তিনি বিরুদ্ধ স্রোতে যাত্রা এবং শিল্পিত মানসকে সমৃদ্ধ করেই চিত্রকলার ভুবনে নিজের আসন দৃঢ় করেছিলেন।

তিন
চল্লিশের দশকে বামপন্থী শিল্পী ও সাহিত্যিকরা সমাজ অঙ্গীকারকে খুবই মর্যাদার সঙ্গে উপলদ্ধি করেছিলেন। ফ্যাসিবাদ-বিরোধিতার মধ্য দিয়ে তাঁরা শিল্প ও সাহিত্যে জনমানুষের দুঃখ, বেদনা, যাতনাকে তাঁদের সৃজনে নবীন আলোকে প্রতিফলিত করেছিলেন। ক্যালকাটা গ্রুপ ১৯৪৩ সালে গঠিত হলে চিত্রশিল্পীরা প্রাণিতবোধ করেন এবং ’৪৩-এর মন্বন্তরের চিত্র শিল্পীদের বিবেককে প্রবলভাবে নাড়া দিয়েছিল। তাঁদের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছিল অনেকটাই প্রচল-ছেঁড়া এক অনুষঙ্গ। এ ছিল এক অভূতপূর্ব ঘটনা। সফিউদ্দীন আলাপচারিতায় এ-সময়কে শিল্প ও সাহিত্যের ইতিহাসে এক উল্লেখযোগ্য পর্যায় বলে জানান। কবি ও শিল্প-সমালোচক বিষ্ণু দে ক্যালকাটা গ্রুপের সমাজ চেতনা ও দায়বদ্ধতার সঙ্গে ঐতিহ্যগত উত্তরাধিকারের সম্মিলনে গ্রুপ সৃজনের মধ্যে যে সমাজ বাস্তবতা ও অঙ্গীকারের চেতনা গড়ে উঠেছিল তাকে খুবই অনন্য বলে উল্লেখ করেছিলেন। গ্রুপের অন্যতম সদস্য প্রদোষ দাশগুপ্ত এ মত মেনে নিতে পারেননি। যদিও এ নিয়ে নানা ধরনের তর্ক রয়েছে।

চার
শিল্পচর্চায় ও সাধনায় সফিউদ্দীন তদ্গতভাবে মগ্ন থেকেছেন চল্লিশের দশক থেকে শয্যাশায়ী থাকা অবস্থায়ও। এই সময়ে তিনি শিল্প-ভাবনা ও সৃষ্টির আনন্দ-বেদনায় মগ্ন হয়ে থাকতেন। শয্যাশায়ী হওয়া সত্ত্বেও চিত্রকলার ভুবনকে কীভাবে ঋদ্ধ করা যায় এ নিয়ে ভেবেছেন। শিল্পচর্চার নানা বিষয় নিয়ে কথাবার্তা বলেছেন সুহৃদদের সঙ্গে। খোঁজ নিতেন কার প্রদর্শনী কেমন হচ্ছে। তাঁর মানসভুবন গড়ে উঠেছে ও তৈরি হয়েছে মূলত শিল্পের সৌন্দর্যবোধ, আদর্শবাদিতা এবং মুক্তিবুদ্ধির চেতনায়। সফিউদ্দীনের চরিত্রের অন্তর্গত এই বৈশিষ্ট্য তাঁর অন্তর্মুখিনতায়ও এক মাত্রা সংযোজন করেছে। এই বৈশিষ্ট্য তাঁর বোধ, বিশ্বাস ও শিল্পের অঙ্গীকারে ব্যতিক্রমী বিষয় হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।
সফিউদ্দীনের শিল্পিত পথচলাকে উপলব্ধি করতে হলে চল্লিশের দশকের প্রগতিশীল যে সাংস্কৃতিক আন্দোলন হয়েছিল তার স্বরূপ উপলব্ধি প্রয়োজন। এই সময় তাঁর মানস গঠিত হয়েছে আবার অঙ্গীকারের চেতনায় বলীয়ান হয়েছে। অঙ্গীকারের এই ধরনকে উপলব্ধি করা সেজন্যে খুবই জরুরি। ছাত্রজীবনে বামপন্থায় তাঁর নিমজ্জন হয়েছিল। সেজন্যেই ছাত্র ফেডারেশনের ১৯৪৫ সালের ক্যাটালগে একটি ছবি মুদ্রিত হতে দেখি।
পাঁচ
বাংলাদেশের চিত্রকলার ইতিহাসে তাঁর অবদান পথিকৃতের। দেশের অগ্রগণ্য শিল্পীদের মধ্যেও তিনি অন্যতম তো বটেই। জয়নুল-কামরুলের মতো তিনি অনন্য আধুনিকতার সূচনা করেন। তাঁর ছাপাই ছবি হয়ে ওঠে নবীন এক পথ-সৃষ্টির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। বিশেষত ছাপাই ছবির ক্ষেত্রে বিলেতের শিল্পশিক্ষা তাঁর মানসযাত্রাকে নবীন আলোকাভিসারী করেছে। পঞ্চাশের দশকের শেষ পর্যায় থেকে ছাপাই ছবিতে তিনি আধুনিকতার, শিল্পগুণের ও রস সঞ্চারের যে সূচনা করেন তা হয়ে ওঠে এ-দেশের চারুশিল্পের ইতিহাসে পথ চলার ও ছাপাই ছবির জল-হাওয়ায় বিশেষ এক অভিজ্ঞতা। তাঁর এই সৃষ্টির পথই ছাপাই ছবির ক্ষেত্রে আধুনিকতার এক পথ নির্মাণ করেছে। আধুনিকতার বোধ ও বুদ্ধির ক্ষেত্রকে করেছে প্রসারিত। তিনি চিত্রকলার নানা মাধ্যমে বহু ধরনের কাজ করেছেন। বিষয়বৈচিত্র্যে এসব সৃষ্টি সৃজনশীলতায় এবং উৎকর্ষে অসাধারণ। চল্লিশের দশকেই, তিনি যখন ছাত্র তখনই, সর্বভারতীয় একটি পুরস্কার অর্জন করে প্রতিষ্ঠা অর্জন করেন। তখন তাঁর বয়স মাত্র ২২ বছর। কলকাতা গভর্নমেন্ট স্কুল অব আর্ট থেকে শিক্ষা গ্রহণ করার সময়েই তিনি দৃষ্টি আকর্ষণ করেন ভারতের কলারসিকদের। উড এনগ্রেভিং, এচিং এবং ড্রাই পয়েন্টে তিনি তখনই সিদ্ধহস্ত হয়ে ওঠেন। সমকালীন ও সতীর্থদের মধ্যে তিনিই বোধকরি সৃষ্টির গুণাবলিতে শিল্পের সঞ্চার করে মনোযোগ আকর্ষণ করতে সমর্থ হন। জীবনের প্রথম পুরস্কার পেয়েছিলেন অসাধারণ জীবনঘনিষ্ঠ এক তেলরং কাজের জন্যে। চল্লিশের দশকের মধ্যপর্যায় থেকে তাঁর জয়যাত্রা শুরু হয়েছিল। সেই সময়ে ছাত্র ফেডারেশন ও মুসলিম ছাত্রসমাজ আয়োজিত প্রদর্শনীতে তাঁর চিত্র কলারসিক ও চিত্রামোদীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। তখন থেকে তিনি তাঁর সৃষ্টি নিয়ে কেবলই এগিয়ে গেছেন। আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। অসাধারণ সব শিক্ষক পেয়েছিলেন। আর ছাপাই ছবির কথা উঠলেই তিনি শ্রদ্ধাবনত চিত্তে স্মরণ করতেন তাঁর মাস্টারমশাই রমেন চক্রবর্তীকে। সফিউদ্দীন আহমেদের জন্যে তাঁর স্টুডিওর দরোজা সর্বদা উন্মুক্ত ছিল। ক্লাসের পরে দিনের পর দিন তাঁরা আলাপ করেছেন ছাপাই ছবির সূক্ষ্ম করণকৌশল ও আলো-ছায়ার নির্মাণ নিয়ে। এমনকি নিজের স্টুডিও-গৃহের মেশিনও তিনি ছেড়ে দিয়েছিলেন যুবক সফিউদ্দীনের জন্যে।
এ-প্রসঙ্গে তিনি একজন শিক্ষকের কথাও স্মরণ করেন। আজকের খ্যাতনামা শিল্পী প্রকাশ কর্মকারের পিতা প্রহ্লাদ কর্মকার, তিনিও ছিলেন তাঁর শিক্ষক। কাঁকুরগাছিতে তাঁর স্টুডিও ছিল। বন্ধু আদিনাথ আর তিনি যেতেন নিয়মিত তাঁর স্টুডিওতে কাজ করতে।
শিল্পী সফিউদ্দীন আহমেদের জন্ম ১৯২২ সালের ২৩ জুন, পশ্চিমবঙ্গে, শিল্পশিক্ষা কলকাতা আর্ট স্কুলে। তাঁর মানস গঠিত হয়েছে দেশভাগের পূর্বে চল্লিশের দশকে শিল্পের বৃহত্তর পরিমন্ডলে। তিনি এই শিক্ষালয়ে শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন উন্নত রুচির আলোকপ্রাপ্ত কয়েকজন শিক্ষককে। এই শিক্ষকরা বঙ্গীয় রেনেসাঁস বা নবজাগরণ থেকে জীবন ও শিল্পের রস আহরণ করেছিলেন। একপর্যায়ে অধ্যক্ষ হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন মুকুল দে। আর মুকুল দে ছিলেন রবীন্দ্রনাথের স্নেহধন্য। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে জাপান ও আমেরিকা ভ্রমণে সঙ্গী। পরবর্তীকালে ছাপাই ছবি সম্পর্কে জ্ঞান আহরণ করেন বিলেতে। সফিউদ্দীন এই স্কুলে শিক্ষা গ্রহণকালে নৈষ্ঠিক ছাত্র হিসেবে বৃহত্তর শিক্ষকমন্ডলীর কাছ থেকে জীবন ও শিল্পের পাঠ নিয়েছেন। সেজন্যেই বোধকরি তাঁর ভেতর শিল্পের যে-অনল জ্বলেছিল তার মধ্যে প্রাধান্য বিস্তার করে আছে প্রাখর্য, নির্লিপ্তি ও নাগরিকতা। এই অনুষঙ্গগুলোকে তিনি জীবনব্যাপী লালন করেছেন। এই তিনটি গুণ তাঁকে আজীবন চালিত করেছে। সেজন্যে তাঁর মনীষার দীপ্তি ভিন্ন এবং সৃজন ভুবনের শৃঙ্খলা ও তাপ সম্পূর্ণ আলাদা মেরুর।
বাংলাদেশের শিল্পের ভুবনে এই গুণাবলি দুর্লভ। তিনি যখন ছাত্র তখনকার সময়ের শিক্ষায় রেখার ধীশক্তি, বৈভব ও মর্মকে চিত্রবিদ্যাচর্চায় বিশেষ প্রাধান্য দেওয়া হতো। সেজন্যে বাংলাদেশের প্রথম প্রজন্মের যেকোনো চিত্রীর রেখালেখ্যে এর তাৎপর্য বিশেষভাবে প্রাধান্য বিস্তার করে আছে।
সফিউদ্দীন সার্থক চিত্রী ও সফল প্রিন্ট মেকার তো বটেই, অসাধারণ সংবেদনশীল শিক্ষকও ছিলেন। শিক্ষার্থীদের তিনি পরম মমতায় ছাপ ছবির করণকৌশল শিখিয়েছেন। এই মাধ্যমের অভিজ্ঞতা, শিল্পিত প্রকরণ ও পরিপ্রেক্ষিত জ্ঞানের ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন, শিল্পের রূপ ও রস সৃষ্টিশীলতার জন্যে যে কত অপরিহার্য বারংবার সে-কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন। ভারত ও পাশ্চাত্যের ছাপাই ছবির ধারাবাহিকতা সম্পর্কে অবহিত করেছেন। যখন শরীর জর্জর ও ভঙ্গুর হয়নি, তখন নিয়মিত নবীন শিল্পীদের প্রদর্শনী দেখেছেন এবং শিল্প-শিক্ষার্থীকে উৎসাহিত করেছেন।
সর্বদা অতৃপ্তবোধ তাঁকে তাড়া করত বলে নানা ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্যে দিয়ে অবশেষে একটি পর্যায়ে এসে কাজটি শেষ করতেন। একটি কাজ নিয়ে আত্মমগ্ন ভাবনার মধ্যে দিয়ে নিজেকে অতিক্রম করতেন তিনি।
শিল্পী সফিউদ্দীন এচিং আর উড এনগ্রেভিংয়ের জন্যে বিখ্যাত হলেও তিনি কিন্তু প্রথম সম্মান পেয়েছিলেন তেলচিত্রের জন্য। ছাপচিত্রের সকল শাখায় তাঁর নৈপুণ্য ও শিল্পকুশলতা ঈর্ষণীয় হলেও ছাপাই ছবির পাশাপাশি তিনি তেলরঙের কাজও করেছিলেন তখন। তাঁর চিত্রকর্মে বাস্তবধর্মিতা প্রধান্য পেলেও দুর্লভ এক সারল্য ও প্রাণময়তা যেন মূর্ত হয়েছিল এক অন্তর্লীন আবেগে। এ-সময়ে করা তাঁর একটি ছবি – বিস্তীর্ণ জলরাশির মধ্যে চারটি নৌকা। জেলেরা কোনোটিতে দাঁড়িয়ে, কোনোটিতে বসে মাছ ধরছে। একটি ছবিতে দুজন প্রায় নগ্ন চাষি, নিচু হয়ে পাট অাঁচড়াচ্ছে। হাঁটু ভেঙে কোমর বেঁকিয়ে তারা দাঁড়ানো। পেছনে সোনালি পাটের স্তূপ। দুটি স্টাডিতেই কড়া রঙের ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু রঙের ব্যবহার এতোই সুসামঞ্জস্য, যেন বাস্তব পরিবেশটাই ফুটে উঠেছে। আলো-ছায়া, লাইন ও কম্পোজিশনের জ্ঞানে শিল্পিত এক আমেজ সৃষ্টি করেছে। ছোট ক্যানভাসেও যে রং ও রেখা এত প্রাণময় হতে পারে যাঁরা এ দুটি ছবি প্রত্যক্ষ করেছেন তাঁরা সকলে বিষয়টি সম্পর্কে খুব ভালো করেই অবহিত হয়েছেন।
দেশ বিভাগের পর তিনি চলে এসেছিলেন ঢাকায়। এ-সময়ে তাঁর কাজে কিছুদিনের জন্যে ছেদ পড়েছিল। একটি স্কুলে ড্রইং শিক্ষকের চাকরি নিলেন। বাংলাদেশে চিত্রচর্চার আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হলেন। পরে বন্ধু জয়নুল আবেদিনের অনুরোধে আর্ট স্কুলে যোগদান করলেন। ব্রত হিসেবে নিলেন শিক্ষকতা; প্রতিটি নিশ্বাসের সঙ্গে মিশে গেল শিক্ষকতা।
আগেই বলেছি, নিজের ভেতর সারাক্ষণ এক অতৃপ্তিবোধ তাড়া করে বলে আশ্চর্য এক প্রত্যয়ে তিনি কাজ করে গিয়েছেন। সেজন্যে তিনি যতক্ষণ না মনে করেন ছবি পরিপ্রেক্ষিত পূর্ণতা অর্জন করেছে, ততক্ষণ এ-ছবিটির পুঙ্খানুপুঙ্খ বিষয়, সৃষ্টির অপূর্ণতা ও পূর্ণতা আনয়নে ক্রমাগত কাজ করেছেন। সে-চিত্র হোক কিংবা তাম্রতক্ষণ।
লন্ডনে শিক্ষা গ্রহণকালে ইউরোপীয় সমকালীনদের মৌলিক কাজ দেখার সুযোগ তাঁর ভেতর গ্রহণ-বর্জনের এক বোধ তাঁর শিল্পিত মানসকে উদ্দীপিত করেছিল। ইউরোপ ভ্রমণ, সমকালীন খ্যাতিমানদের এত কাজ পর্যবেক্ষণ করার পরও তিনি কিন্তু দেশ, সমাজ ও তাঁর চোখে দেখা নানা বিষয় থেকে সরে আসেননি। সেজন্যে দেশে ফিরে তিনি যখন তেলরঙে কাজ করছেন, তখনো তিনি জীবনের বাস্তব দিককেই প্রাধান্য দিয়েছেন। বাস্তব ইমেজ, নৌকা ও পাল, ট্র্যাডিশনাল মোটিফের ছায়া পড়েছে চিত্রে। অত্যন্ত সুপরিকল্পিত ও বিন্যস্ত তাঁর কাজ। প্রতিটি বিন্দু, প্রতিটি রেখা ভেবেচিন্তে অাঁকা। এক ধরনের বিবিক্তি ফুটিয়ে তোলাই যেন তাঁর উদ্দেশ্য।
তাঁর তেলরঙের কাজে যেন নির্জন, আত্মসমাহিত রূপেরই খাঁটি প্রতিফলন। সফিউদ্দীন আহমেদ পঁচাশি বছর বয়সেও ছিলেন নিত্য সৃষ্টিশীল। যদিও একটি দুর্ঘটনার ফলে তিনি পায়ে আঘাত পাওয়ায় দীর্ঘদিন শয্যাশায়ী ছিলেন। অস্ত্রোপচার করতে হয়েছে পায়ে। এই সময়ে তিনি অধ্যয়ন করেছেন এবং বাংলাদেশের চিত্রকলার উন্নয়ন ও বিকাশের সমস্যা, অন্তরায় ও সম্ভাবনা নিয়ে সর্বক্ষণ ভেবেছেন। একজন আধুনিক চিত্রকরের মতো তাঁর রয়েছে সজীব মন ও জাগর জিজ্ঞাসা, চিত্রকলার ঐতিহ্য, আধুনিকতার স্বরূপ ও দেশীয় আত্মপরিচয়ের সমস্যা নিয়ে নিজস্ব ভাবনা।
শিল্পগুরু সফিউদ্দীন আহমেদের শিল্পিত মানসযাত্রায় ছাপচিত্র বিশেষভাবে বিবেচিত হয়ে থাকে। ছাপচিত্র উৎকর্ষের দিক থেকে তাঁর অবিস্মরণীয় সৃষ্টি। চল্লিশের দশকে কলকাতা আর্ট ইনস্টিটিউটে অধ্যয়নকালেই তিনি ছাপচিত্রে দক্ষতা অর্জন করেন। তিনি কয়েকটি অসাধারণ কাজের জন্য ছাপচিত্রী হিসেবে প্রতিষ্ঠা অর্জন করেন এবং ভারতবর্ষের কলারসিকদের দৃষ্টি আকর্ষণে সমর্থ হন। পরবর্তীকালে তিনিই একক সাধনায় এই মাধ্যমের সৃষ্টিকে করে তোলেন আরো শিল্পগুণসম্পন্ন এবং সমৃদ্ধ। তাঁর দীক্ষায় দীক্ষিত হয়ে অগণিত শিক্ষাব্রতী এ-মাধ্যমটিকে করে তুলেছেন অনন্য।
সফিউদ্দীনের প্রয়াণের পর আমাদের কেবলই মনে পড়ছে, তিনি এককভাবে ছাপাই ছবিতে যে-শিল্পগুণ সঞ্চার করেছেন তা এই শিল্পগুরুকে চিরস্মরণীয় করে রাখবে।
লন্ডনে ছাপাই ছবি সম্পর্কে উচ্চতর জ্ঞান লাভের পর বৃহত্তর ইউরোপের শিল্পের অন্বিষ্ট ভুবন সম্পর্কেও প্রত্যক্ষণ তাঁর শিল্পীসত্তাকে করে তোলে আরো পরিণত। দীর্ঘদিনের এক শিল্পচর্চা ও সাধনায় ঋদ্ধ হয়ে ওঠে তাঁর সৃজনউদ্যান। এর সঙ্গে মিশ্রিত হয় তাঁর আধুনিকতাবোধ এবং শিল্পের ও জীবনের প্রতি অঙ্গীকার। পঞ্চাশের দশকের এই সময় থেকে একবিংশ শতাব্দীর সূচনাপর্বের এই সৃষ্টিগুচ্ছে আমরা প্রত্যক্ষ করি ছাপাই ছবির জন্য তাঁর ভাবনা কতভাবেই না দীপ্তিময় হয়েছে। তাঁর অবলোকনের কত না তুচ্ছ বিষয়কে তিনি প্রকরণের দিক থেকেও আধুনিকবোধ ও শিল্প সুষমামন্ডিত করে তুলেছিলেন।
শিল্পগুরু সফিউদ্দীন আহমেদ ও বাংলাদেশের শিল্প-আন্দোলনের এই অগ্রণী ব্যক্তিত্বের ছাপাই ছবিতে একদিকে ধরা পড়েছে তাঁর শিল্পকুশলতা, ভাবনা ও দীর্ঘদিনের পথপরিক্রমার অর্জিত অভিজ্ঞতা, অন্যদিকে ছাপাই ছবির উত্তরণে তাঁর সাধনার ইতিবৃত্ত।
মাঝে মাঝে আমার জিজ্ঞাসা জাগে, যাঁর সৃষ্টির ফসল অফুরন্ত, যাঁর চিত্রগুচ্ছে রয়েছে অসামান্য জীবন উপলব্ধির নতুন মাত্রা ও গহন-গভীর জিজ্ঞাসা, তিনি কেন এমনভাবে প্রচ্ছন্নেই ছিলেন? সে কি কেবল এই জন্যে যে, তাঁর শিল্পিত স্বভাবে, রুচিস্নিগ্ধ ব্যক্তিত্বের মধ্যেই আছে এক ধরনের বিনয়। এই বিনয়ই সমাজজীবন থেকে আজ অপসৃত। অনুকরণীয় এই বিনয় নিয়েই তিনি কতভাবেই না অনুজ চিত্রীদের দীক্ষিত করতে চেয়েছেন। উত্তরকালের সৃজনধারায় তাঁর সৃজনী উৎকর্ষ ও আদর্শবাদিতা অনিঃশেষ প্রেরণা সঞ্চারিত করতে সমর্থ হলে এদেশের চিত্রকলা উচ্চতর পর্যায়ে উন্নত হবে সন্দেহ নেই।

ছয়
সফিউদ্দীন আহমেদকে নিয়ে একটি গ্রন্থের কাজ করতে গিয়ে আমার অবাধ যাতায়াত ছিল তাঁর বাড়িতে। তিনি তখন স্বামীবাগের বাড়িতে বসবাস করতেন। কথোপকথন ও আলাপচারিতায় উপলব্ধি করেছি, এই শিল্পীপুরুষটির সাহিত্যে জ্ঞান কত গভীর ছিল। চল্লিশের ও পঞ্চাশের দশকের উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ তো বটেই, বহু স্মৃতিকথারও তিনি উল্লেখ করতেন। এ থেকে তাঁর পঠন-পাঠনের গভীরতা ও সাহিত্যরুচি সম্পর্কে বুঝতে পারতাম। এছাড়া ছাত্রজীবনে আন্তর্জাতিক শিল্পাঙ্গনের যেসব খ্যাতিমান চিত্রকরকে তিনি মর্যাদার চোখে দেখতেন তাঁদের নিয়ে রচিত বই কলকাতার ওয়েলিংটন স্কয়ারের বিখ্যাত বইয়ের দোকান থেকে সংগ্রহ করতেন। যদিও এসব বই সংগ্রহের কাজ খুব সহজ ছিল না। কেননা, জীবন ধারণের জন্য তিনি যে কতভাবে সংগ্রাম করেছেন সে-কথা বলতেন। অভাব ও অনটন যে সে-সময়ে তাড়া করেনি, তা নয়। ছাত্রজীবনে তাঁর প্রিয় শিল্পী ছিলেন ভ্যান গঁঘ ও রেমব্রান্ট। এ দুজন শিল্পীর জীবনী পাঠ করেছেন তখন তিনি। তাঁদের শিল্পীজীবনের গঠন পর্ব, প্রণয়, ব্যর্থতা ও সর্বোপরি সৃজনের উৎকর্ষে তিনি দারুণ আলোড়িত ছিলেন। ছাত্রজীবনেই ভারতীয় ধ্রুপদীসংগীতে তাঁর নিমজ্জন হয়েছিল। পরবর্তীকালে এই সংগীত থেকে পাশ্চাত্যের উচ্চাঙ্গসংগীত-প্রবণ তাঁর শিল্পসৃজনে প্রভাব বিস্তার করেছিল নিঃসন্দেহে। তিনি প্রায়ই বলতেন, ধ্রুপদীসংগীতের সূক্ষ্ম ওঠানামা, আবেদন ও অসীমকে স্পর্শ করার সাধনার সঙ্গে কোথায় যেন নিবিড় এক যোগ আছে চিত্রকলার। বিষয়টি ভেবে দেখার মতো।
তাঁকে নিয়ে একটি বই বেরোবে – এ নিয়ে কথা বলতে গেলেই তিনি এ-প্রসঙ্গ এড়িয়ে যেতেন। তিনি ছিলেন প্রচ্ছন্নে-থাকা মানুষ এবং প্রচারবিমুখ। খ্যাতিমান শিল্পী এবং সত্যিকার অর্থেই একজন সমীহজাগানিয়া শিক্ষক। তাঁর ব্যক্তিত্বে ও ব্যবহারে বিনয় ফুটে উঠত। গুণ ছিল দুর্লভ। এ দুর্লভ গুণই তাঁকে বিশিষ্ট করেছে। এত গুণাবলির অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও তাঁকে নিয়ে খুব যে লেখালেখি হয়েছে তা নয়।
বইয়ের জন্য যে-তথ্য, সৃষ্টির ধারাবাহিকতা এবং কোন মাধ্যমে কত ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা যে করছেন তা জানা খুব জরুরি হয়ে উঠেছিল। অথচ এ নিয়ে তাঁর কোনো আগ্রহই ছিল না। তিনি যে প্রতিনিয়ত কাজ করেন এবং প্রতিটি কাজের পেছনে যে-সময় ব্যয় করেন এবং একটি ছবি সকল দিক থেকে সম্পূর্ণতা অর্জন না করা পর্যন্ত কাজ করে যান, গুণগ্রাহী বা শিল্পানুরাগীরা তা জানুক সেটা তিনি পছন্দ করতেন না। আমাদের কাছে শুধুমাত্র শিল্পী রফিকুন নবীর দীর্ঘ একটি প্রবন্ধ ছিল। কিন্তু একটি পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থের তথ্যের জন্য এ যথেষ্ট ছিল না। এ নিয়ে বইয়ের পান্ডুলিপি তৈরি করা দুঃসাধ্য ও কঠিন কাজ বলে আমাদের কাছে প্রতীয়মান হয়েছিল। তবু আমরা হাল ছাড়িনি।
তাঁর বাড়িতে নিয়মিত যাতায়াত শুরু করেছিলাম। এই সময়ে তাঁর স্নেহ পেয়েছি এবং কিছুটা আস্থা অর্জন করায় এ-সময়ে শিল্প ও সাহিত্য নিয়ে নানা কথা হয়েছে। এতদিন শুনে এসেছিলাম, তিনি খুব বেশি কথা বলেন না এবং নিজের সম্পর্কে তো নয়ই। দীর্ঘদিন যাতায়াতের পর দেখেছি স্মৃতিচারণ করতে তিনি ভালোবাসেন। যে-স্কুলে শিক্ষাগ্রহণ করেছেন সেই চারুবিদ্যাপীঠ তাঁর হৃদয়ে সর্বদা ভিন্ন মর্যাদায় অধিষ্ঠিত। শিক্ষকমন্ডলীকে তিনি খুবই শ্রদ্ধা করেন। বিশেষত মুকুল দে, রমেন চক্রবর্তী, প্রহ্লাদ কর্মকার আর বসন্ত গাঙ্গুলীকে। বন্ধুবৃত্তে দিলীপ, মুরালী আর আদিনাথকে। বিশেষ করে আর্ট স্কুলে মুকুল দে-র অধ্যক্ষতাকালে এই শিক্ষায়তনে সৃজনশীল হয়ে ওঠার যে-পথ সৃষ্টি হয়েছিল তা বলতেন। আর ঘুরেফিরে আসত চল্লিশের দশকের কলকাতা এবং কেমন করে চিত্রবিদ্যাচর্চা অ্যাকাডেমিক বৃত্তের মধ্যে থেকে আবার কখনো তা পরিহার করে এক নবজাগরণের জোয়ার এনেছে, সে-কথা তিনি সবিস্তারে বর্ণনা করতেন। এই বর্ণনায় তাঁর শিল্পচিন্তায় জীবন সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত হতো। একটি কথা এখনো কানে বাজে। তিনি বলতেন, যে-মানুষ জীবন-সংগ্রাম করেনি, কষ্ট ও জীবনযন্ত্রণাকে উপলব্ধি করেনি, তার পক্ষে মহৎ শিল্পসৃষ্টি সম্ভবই নয়। এ প্রসঙ্গে চলে আসত ইউরোপ, আমেরিকা ও ভারতবর্ষের খ্যাতনামা ব্যক্তিদের জীবনপ্রসঙ্গ। শিল্পযাত্রার পথ ও মত নিয়েও জিজ্ঞাসামুখর হয়ে উঠতেন তিনি। যামিনী রায় পটচিত্র শিল্পীদের কাছ থেকে কিছু অনুষঙ্গ নিলেও তিনি ছিলেন প্রকরণ ও শৈলীতে আধুনিক; সে-কথা বলতেন।
যুদ্ধজনিত কারণে কলকাতা শহরে বিদেশি সৈন্যদের যত্রতত্র দেখা যেত। এদের মধ্যে অনেক শিল্পানুরাগী ছিলেন। এমনকি মধ্য পর্যায়ের অফিসারদের মধ্যে কয়েকজন তো রীতিমতো ছিলেন পন্ডিত ও শিল্পানুরাগী। সে-সময় এ-বইয়ের কাজে আমি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছিলাম। সেখান থেকে দুটো প্রশ্ন ও উত্তর তুলে দিলাম। তাঁরা অনেকেই যামিনী রায়ের সেই এঁদো গলির বাড়িতে গিয়ে তাঁর ছবি কিনেছেন। শিল্পমূল্যের দিক থেকে এসব ছবি ছিল অসাধারণ।

প্রশ্ন : ঢাকা আর্ট গ্রুপ দুটো প্রদর্শনী করেছিল ঢাকায়; এর ঐতিহাসিক তাৎপর্য কি আছে?
উত্তর : এদেশে শিল্পরুচি ও সাংস্কৃতিক পরিবেশ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ঢাকা আর্ট গ্রুপ বড় ভূমিকা পালন করেছে। প্রথম প্রদর্শনীটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল ঢাকা হলের লিটন হলে ১৯৫১ সালের ১৬ থেকে ২১ জানুয়ারি। পরে ১৯৫২ সালে গ্রুপের দ্বিতীয় প্রদর্শনী হয়েছিল। ঢাকার শিল্পানুরাগীরা এ দুটি প্রদর্শনীর মধ্য দিয়ে চিত্রশিল্পের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। সাংস্কৃতিক ও শিল্পরুচি গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে খুব ক্ষুদ্র হলেও একটি ভূমিকা পালন করেছে। তখনকার দিনের খ্যাতনামা ও প্রতিষ্ঠিত লেখকরা নিয়মিত আসতেন প্রদর্শনী দেখতে। তখন অনেকেরই বয়স ছিল অল্প। কিন্তু বুদ্ধির দীপ্তিতে উজ্জ্বল এসব সাহিত্যিক ও কবি পূর্ব বাংলার শিল্প-আন্দোলনের স্বরূপ উপলব্ধি করার চেষ্টা করতেন। নানা ধরনের জিজ্ঞাসা ছিল। এই দুটি প্রদর্শনী লেখকদের সঙ্গে শিল্পীদের মেলবন্ধ ঘটিয়েছিল। দু-একটি চিত্র আলোচনাও প্রকাশিত হয়েছিল।
প্রশ্ন : চল্লিশের দশকে ক্যালকাটা গ্রুপ আধুনিক চিত্রচর্চায় নবীন সৃজনধারা ও আবেগ সৃষ্টি করেছিল। এ সম্পর্কে কিছু বলুন।
উত্তর : চল্লিশের দশকে ক্যালকাটা গ্রুপ যে-সৃজনাবেগ সৃষ্টি করেছিল তা ছিল তাৎপর্যসঞ্চারী। ভারতীয় চিত্রকলা আন্দোলনে এঁরা এক ধারা সৃষ্টি করেছিলেন। বেঙ্গল স্কুলের শিল্পকুশলতা ও সৃজনকে কিছুটা অস্বীকারই করেছিলেন তাঁর। তাঁরা জনমানুষের নানা অনুষঙ্গকে প্রাধান্য দিয়ে ছবি এঁকেছেন। শুধু চিত্রশিল্পী নন, অনেক কবি, সাহিত্যিকও যুক্ত হয়েছিলেন এই আন্দোলনে। ভাস্কর প্রদোষ দাশগুপ্ত, রথিন মৈত্র, গোপাল ঘোষ যুক্ত ছিলেন। কবি বিষ্ণু দে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। এই গ্রুপ সত্যিকার অর্থেই চিত্রচর্চার ক্ষেত্রে প্রবলভাবে ধাক্কা দিয়েছিল। দলের দু-একজন ছিলেন মার্কসবাদী। সেজন্যে তাঁদের সৃজনে চলে এসেছিল নতুন এক আবেগ। জনজীবনের নানা দিক প্রতিফলনের আর্তি প্রতিফলিত হয়েছিল। 