তালবেতাল

রেজাউর রহমান

তুহিনের সঙ্গে ড. আরবাব সিদ্দিকীর দেখা হয় আমেরিকার ভার্জিনিয়ায়। দেখা হওয়াটা এখন তার কাছে দৈবচক্র বলেই মনে হয়। তুহিনের যতদূর মনে পড়ে, আরবাব ১৯৭২ সালের শেষের দিকে, নয়তো ১৯৭৩ সালের প্রথম ভাগের কোনো একসময় সে দেশ ছেড়েছিল। সে দেশ ছাড়ার আগেপিছের কোনো বিদায়ী অনুষ্ঠান-উপলক্ষ, নয়তো এয়ারপোর্ট তক তাকে পৌঁছে দেওয়া বা তেমন কোনো ঘটনা তুহিনের মনে পড়ে না। সে চলে গেছে…, বাস্… এটুকুই সে জানে। তার চলে যাওয়ার কথা সে শুনেছে, তা-ও অন্যের মুখে। অথচ তাদের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষাক্রমের শেষের বছর ও উভয়ের চাকরিজীবনের প্রথমদিকে তাদের প্রতিদিন অন্তত একবার দেখা হতো। সেই সময়টা ছিল ষাটের দশকের মাঝামাঝি। কোনো কোনো দিন একবারেরও বেশি। তাদের দৈনন্দিন
জীবনচক্রের এটা একটা রুটিনে পরিণত হয়েছিল। বেশিরভাগ সময় তুহিনই আসত, পুরনো শহর থেকে। তার আসার আরেকটি কারণ হলো, ওই সময়ে ঘোরার, রেস্তোরাঁয় বসার, খেলা দেখার মাঠ-স্টেডিয়াম, আধুনিক সিনেমা হল (শীতাতপ-নিয়ন্ত্রিত), অকারণে নিউমার্কেটে চক্কর লাগানো, বুক কর্নারে কালক্ষেপণ ইত্যাদির সুবিধা তো এ-তল্লাটেই ছিল।
আর বুয়েটের জুনিয়র শিক্ষক হিসেবে সদ্য পাওয়া চাকরির সুবাদে এক কক্ষের যে আবাসিক রুমটি পেয়েছিল সে, তা-ও ছিল আবার এসএম হলের উলটো কর্নারে, ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। আবাসন কক্ষটি পুরনো আমলের হওয়ায় আঙিনা চত্বরে বেশকিছু গাছগাছালি ছিল তখন। এর মধ্যে আম, জাম, কাঁঠালের পুরনো গাছও ছিল। তাতে ফলফলান্তও হতো। জায়গাটা তখনকার বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কেন্দ্রস্থল ছিল বলা চলে। সেখান থেকে তখনকার ঢাকার যাবতীয় সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক কর্মকান্ডে সহজেই যোগ দেওয়া যেত।
আরবাবের রুমে রাতকাবারে গল্পে-আড্ডায় ভরে উঠত তাদের যৌবনের টগবগে দিনগুলো। অথচ সেই আরবাব না জানিয়ে যখন চলে গেল, তখন যথেষ্ট আহত হয়েছিল তুহিন। অনেকদিন ধরে এ নিয়ে মনে একটা কষ্ট পুষে রেখেছিল সে। পরে বেমালুম কখন যে সে তা ভুলে গিয়েছিল, আজ তার ভালো মনে নেই। মনে থাকার কথাও নয়। তিন দশকের বেশি সময় আগেকার কথা।

দিন দশেক হয় আমেরিকায় এসেছে তুহিন ও রেবেকা। তারা বুড়ো হয়েছে বা হতে চলেছে। তুহিন আয়নার সামনে দাঁড়ালে তা সহজেই বুঝে নেয়। মাথাভর্তি ছাইরঙা চুল আর ভাঙাচোরা চেহারা। মুখরেখার চামড়ার কোথাও জৌলুস নেই। আগে কখনো-সখনো মুখে এক প্রস্থ তেল জমে থাকলে নিজেকে সামান্য সতেজ মনে হতো। আজকাল তা-ও নেই। তাকে বরং আগপিছ না ভেবে ‘বিবর্ণ’ বলাই সমীচীন। এ বয়সে এর জন্য বোধকরি আর কোনো ভালো শব্দ হয় না। তুহিনের তো তা-ই মনে হয়। অন্যদিকে, রেবেকার হাবভাবে বোঝার উপায় নেই যে তারও বয়স বাড়ছে। শুধু মাথার সামনের দিকে তার চুলে সামান্য পাক ধরেছে। সামান্য প্রচেষ্টায় কালি ও তুলির পরশে তার তা আর থাকে না। চেহারা তার মোটামুটি পরিপূর্ণ ধরনের। ভাঙাচোরার সময়ের চাপ তাকে ছুঁতে পারেনি খুব একটা। অবশ্য তাদের মধ্যকার বয়সের একটা বেশ ব্যবধান রয়েছে। তুহিন রেবেকার চেয়ে প্রায় ১৪-১৫ বছরের বড়। এ নিয়ে তুহিন মাঝেমধ্যে সামান্য জড়তা পোহালেও রেবেকার এ নিয়ে খুব একটা মাথাব্যথা ছিল না। তারা উভয় পক্ষই মোটামুটি মধ্যবিত্ত বা নিম্নমধ্যবিত্ত সীমানার চোখ-কান খোলা আধুনিক সমাজের সহজ মানুষ হয়েও একেবারে অচেনা-অপরিচিত একজন আরেকজনের হাত ধরে যে রেবেকার বড় ভাইয়ের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছিল, আর পেছন ফিরে তাকায়নি তারা। বড় ভাইয়ের বাড়িতেই তাদের বিয়ে হয়েছিল। কারণ, রেবেকার বাবা তখন স্বর্গে। মা জীবিত থাকলেও একা অবস্থান নিয়ে থাকার মতো ব্যবস্থা ছিল না তাঁর।
তুহিনের মায়ের সঙ্গেই থাকতে হয়েছিল রেবেকাকেও। এটাকে সংসারের তথাকথিত নিয়ম ধরেই মেনে নিয়েছিল সে। এর ওজর-আপত্তি খুব একটা কোনোদিন শোনেনি তুহিন।
ভালো দিন যেমন কেটেছে, মন্দ দিনও কম কাটেনি তাদের। এর মধ্যে আর্থিক অব্যবস্থার ব্যাপার তো অবশ্যই একটা ছিল। তাই তাদের দুজনকেই পরিশ্রম করতে হয়েছে অনেক। বাড়তি আয়ের অলিগলি হাতড়িয়ে বেড়াতে হয়েছে। এর মধ্যে উভয়ের টিউশনি করাটাই ছিল অন্যতম। সংসারে তাদের এক ছেলে ও এক মেয়ের আগমনে আনন্দ যেমন এসেছে, তেমনি দুর্ভাবনার জটিলতায়ও তারা তাড়িত হয়েছে। ছেলেমেয়ে দুটোকে মানুষ করা যাবে তো? এমনি ভেবে পিতামাতা নীরবে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করেছে। এত ভরসা খুব একটা পায়নি তারা। তাদের ছোটখাটো শিক্ষকতার জীবনে চতুষ্পার্শেব ছেলেমেয়েদের কত অনাসৃষ্টি না দেখছে। তার পরও সাহসে বুক বেঁধে ছেলেমেয়েদের লাগাম টেনে ধরে রেখেছে তারা। কারণ, ঢাকায় শক্ত পায়ে টিকে থাকার মতো সুদৃঢ় অবস্থান তাদের নেই। যা আছে, তা ছিল সামান্য একটু মাথা গোঁজার ঠাঁই। এ আস্তানার জনসংখ্যা অনেক। সব অংশীদারের সার্বক্ষণিক বাঁকাতেরা কথা, চোখ টাটানি তো একটা আছেই। সাত ভূতের পাল্লায় পড়ে আবার না ছেলেমেয়ে দুটির কোমল প্রাণ, স্বাচ্ছন্দ্য মন নষ্ট হয়ে যায় – এই ভাবনাও তুহিন-রেবেকাকে মানসিক বেকায়দায় ফেলেছে অনেক। তখনো তারা একে অপরের চোখে চোখ রেখে ধৈর্য ধরার, সহিষ্ণু হওয়ার নীরব ভাষাবিনিময় করেছে। মনের শত কষ্ট, পথ না-পাওয়ার নির্যাতন চেপে রেখে এবড়ো-খেবড়ো দুর্দম পথে অচেনা এক জন্তুচালিত স্লেজগাড়ি যেন চালিয়ে গেছে দুজনায়। কোনোদিকে তাকানোর কোনো অবসর ছিল না। সকাল গড়িয়ে রাত, রাত গড়িয়ে সকাল কেটে গেছে তাদের। সম্বল শুধু ছিল তাদের গা-গতর, হাত-পা, অক্লান্ত পরিশ্রম। মাঝেমধ্যে তাদের মনে হয়েছে, তারা কক্ষচ্যুত হয়ে ছিটকে পড়ে যাবে। তলিয়ে যাবে অতল গহবরের অন্ধকারে।
এই টালমাটাল, ভঙ্গদশার আবর্তে বেড়ে ওঠা রবীন-দীপা দুজনেও যেন কী থেকে কী বুঝল। তারা বেড়ে উঠতে থাকে একে অপরের হাত ধরে। তাদের বাবা-মায়ের শঙ্কা-আশঙ্কার দোল-দোলনা তাদের নাড়িয়ে দিতে চাইলেও তারা রুখে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছে; এবং দাঁড়িয়ে গেছেও।

আন্ডার গ্রেড লেভেলে বৃত্তি নিয়ে আমেরিকায় চলে যায় রবীন। বছর দু-একের মধ্যে একই পথে পা বাড়ায় দীপাও। ছেলে গেছে যাক, কিশোরী মেয়ে কীভাবে যায়? ধর্মীয় অনুশাসন থেকে পারিবারিক মান-ইজ্জতের নানা প্রশ্ন যে এখানে জড়িত…। তথাকথিত অভিভাবক মহল তো মুখরা হয়ে উঠতে থাকে, থেকে থেকে। তাদের কথা, এটা তো হতে দেওয়া যায় না… কোনোমতেই না। তুহিন-রেবেকা সব শোনে। বলে কম। তবু সবার কথা কি সবসময় উড়িয়ে দেওয়া যায়। তখন তাদের সংক্ষিপ্ত উত্তর, দেখা যাক। মেয়ে ক্ষেপেছে। চেষ্টা করুক। আমেরিকার ভিসা পাওয়া আজকাল কঠিন। না পেলে… আপনি থেকেই বসে যাবে।… এই আর কয়টা দিন… সবুর করুন…।
দীপার ভিসা হয়ে গেলে তুহিন-রেবেকা তা কয়েকদিন চেপে রাখে। রেবেকা-তুহিনের চোখে চোখ রেখে নিজেদের সুদৃঢ় করার চেষ্টা করে। আশায় বুক বাঁধে। চুপে-চাপে মেয়েকে প্লেনে তুলে দেওয়ার চূড়ান্ত প্রস্ত্ততি নেয়। তুলে দেয় প্লেনে।
ক্ষ্যাপা মহলকে সান্ত্বনা দেয়, আরে আমাদের মেয়েরা কি বিদেশ-বিভুঁইয়ে টিকে থাকতে পারবে? পারবে না। ভাইয়ের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করে ফিরে আসবে। আপনা-আপনিই। রবীনও বলেছে, প্রচন্ড ঠান্ডা।… এখানে দীপা টিকতে পারবে না।
দীপাকে প্লেনে তুলে দিয়ে এসে তুহিন-রেবেকা একে অপরের চোখে চোখ রেখে আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান হয়েছে। সে রাতে একান্ত ঘনিষ্ঠ হয়ে লম্বা শ্বাস টেনে প্রশান্ত ঘুমের অতলে তলিয়ে গেছে তারা। কিছুটা আপাত নির্ভার হয়েই।
সময় তো বসে থাকার নয়। গড়িয়ে চলে আপন গতিতে। বাবা-মায়ের ভীতি-আশঙ্কাও বাড়তে থাকে একই তালে। প্রায়শ তাদের ভোররাতে ঘুম ভেঙে যায়। তখন একজন আরেকজনের দিকে হাত বাড়ায়। কাছে টানে।
‘ঘুমিয়েছ?’
‘না। ঘুম আসে না…’
‘তাই… ছেলেমেয়ে দুটোই ঘরছাড়া?’
‘হ্যাঁ… কবে আবার ফিরে আসবে কে জানে?’
‘তাই তো ভাবি আমিও…।’
এমনি ধারায় চলতে চলতে দেখা গেল, তারা ভালো গ্রেড নিয়ে নির্দিষ্ট সময়ের আগেই গ্র্যাজুয়েট হয়ে গেল। তারা উৎফুল্ল হয়ে জানাল।
তোমরা আমাদের গ্র্যাজুয়েশন সেরিমনিতে আসবে। সামনের আগস্টে।
হ্যাঁ… তাই হবে। একবাক্যে তুহিন-রেবেকা রাজি হয়ে যায়।
ভিসা পেতেও সমস্যা হলো না। ছেলেমেয়ের সঠিক কাগজপত্র… নিজেদের শিক্ষকতার পেশা ইত্যাদি মিলিয়ে এমবাসি নারাজ হওয়ার কোনো কারণ খুঁজে পেল না। রেবেকা-তুহিন সময়মতো সব গোছগাছ করে আমেরিকা চলে যায়।
নর্থ ক্যারোলিনার ক্লেমসন বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে তারা রেল যোগাযোগে লিঞ্চবার্গ, ভার্জিনিয়ায় র্যা ন্ডডল্ফ ম্যাকন কলেজের বর্ণাঢ্য গ্র্যাজুয়েশন সেরিমনিতে যোগ দেয়। পরে মেয়ের ওয়াশিংটন ডিসির একটা অ্যাপ্রেন্টিশিপের প্রোগ্রামে থাকার কারণে সেখানে যেতে হয়। সময় মন্দ কাটছিল না। মেয়ের অস্থায়ী থাকার ব্যবস্থায় অসংকুলান হওয়ার কারণে রেবেকা-তুহিনের থাকার ব্যবস্থা হয় তাদের এক পরিচিত হিন্দু পরিবারে। ম্যারিল্যান্ড, সিলভার স্প্রিংয়ে। সকালে তারা মেট্রো ধরে চলে আসে ডিসিতে।
এদিক-সেদিক ঘোরাফেরা করে। এমনি এক ভরদুপুরে আরবাবের সঙ্গে তুহিনের দেখা। তুহিন ইতস্তত হেঁটে-হেঁটে, খুঁটে-খুঁটে পড়ছিল ওয়াশিংটন স্কয়ার চত্বরের ফ্লোরে লিখে রাখা আমেরিকার প্রখ্যাত লেখক-কবি, বিজ্ঞানী, দার্শনিকদের উদ্ধৃতি-কোটেশন। পায়ে পায়ে হাঁটার, ঘুরে বেড়ানোর জায়গায় মার্বেল ও মসৃণ প্রস্তরখন্ডে মূল্যবান বাণীসম্ভার সযত্নে লিখে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখার এই রেওয়াজ তার কাছে অভিনব ঠেকছিল। এবং এইসব লিখে রাখা মূল্যবান বাক্যগুলো ও তাদের নামধাম মনে রাখার একান্তভাবে চেষ্টা করছিল তুহিন। আজকাল সহজেই কেমনতর একধরনের ‘ভুলে যাওয়া’ রোগে পেয়ে বসেছে তাকে। তখন পেছন থেকে আরবাব তাকে জড়িয়ে ধরে।
‘তুহিন, এখানে কী করে?’
ঘুরে দাঁড়িয়ে যারপরনাই বিস্ময় প্রকাশ করে তুহিন, ‘তুই শালা আমায় চিনলি কেমন করে!’
‘চুল-দাড়ি পাকলেই কি মানুষ অচেনা হয়ে যায়?’
‘যে যাকে চেনার, ঠিকই চেনে।’
‘তুই কি এদিকে থাকিস?’
‘তা ঠিক নয়, চাকরি করি… তাও আবার বিশ-পঁচিশ বছর তো হয়ে এলো…’
‘তুই থাকিস কোথায়?’
‘আগে বল, তুই থাকিস কোথায়?’
‘আমি তো এক বন্ধুর বাড়িতে উঠেছি।’
‘কোথায়?’
‘সিলভার স্প্রিং, ম্যারিল্যান্ড।’
‘আমি তো কাছেই থাকি…আধা ঘণ্টার ড্রাইভ… ম্যারিল্যান্ডেই… চ্যাবি চেইজ… মরগ্যান ড্রাইভ – বলে একটা জায়গায়…।’
আরবাব তুহিনকে প্রায় তুলে নিয়ে যায় ‘স্টারবাক কফি হাউসে’।
তুহিন আপত্তি তুলতে চেয়েছিল… ‘মা-মেয়ে যে কোনদিকে গেল?’
‘…ও হবে নে। খুঁজে পাওয়া যাবে। আমেরিকায় হারিয়ে যাওয়া খুব সহজ নয়… সুতরাং, ভয়ের কিছু নেই। তুই আছিস কয়দিন?’
‘আছি কয়েকদিন… মেয়েটার কোম্পানি অ্যাপ্রেন্টিশিপ প্রায় শেষ হয়ে এলো। পাওয়েল টেটের পরে নিউইয়র্ক যাব… রেবেকার বোনের বাসায়…’
‘তাহলে শালা পাইছি। কাল সকালেই তোদের আমি তুলে নেব। ফোনে ছুটির কথা এখনই বলে দিই। আমার ছুটি সব পড়ে আছে… নিয়ে ঘোরার লোক পাই না…।’
আরবাব মুখর হয়ে থাকে, ‘দেশ ছেড়েছি কত বছর, মনেও করতে পারি না! মনে হয়, দেশ ছাড়িনি, পালিয়ে এসেছিলাম। প্রমাণ, তোদের কাউকে বলে আসিনি। অন্তত তোকে তো…। কী জানি, মনের অবস্থাটা আমার একেবারেই ভালো ছিল না… কারণ, একাত্তরের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় আমি ভেবেছিলাম, দেশ আমরা স্বাধীন করতে পারব না। পারলেও তা পকেটস্থ হবে ভারতের… যা আমার পক্ষে তখন মানিয়ে নেওয়া সহজ ছিল না। পরবর্তী পর্যায়ে কম্বল চুরির হিড়িক, রেসকোর্স ময়দানে সিরাজ শিকদার হত্যার লাল ঘোড়া দাবড়ানো হুঙ্কার, রক্ষীবাহিনীর দৌরাত্ম্য, রাজনেতিক কর্মী হত্যা সহ্য করতে পারলাম না আমি। এলাম পালিয়ে। চেষ্টা করলাম, দেশকে ভুলে যেতে… এখনো চেষ্টা করে যাচ্ছি। পেরেছি কি-না জানি না।’
কয়েকদিনের জন্য মার্কিন মুল্লুকে এসে আরবাবের প্রায় চার দশক আগেকার খিস্তি ঝাড়া, এর সপক্ষে ও বিপক্ষের ঘণ্টার পর ঘণ্টা দেশের দলীয় টিভি চ্যানেলে ‘টক শো’ বলে যে কতগুলো উত্থাপনের হিড়িক চলে, সর্বক্ষণ সেসবের ঘোরপ্যাঁচের কোনো কিছুতে কিঞ্চিৎ মাত্র উৎসাহবোধ করল না তুহিন; বরং সে অন্য কথায় যাওয়ার চেষ্টা করে, ‘রেবেকা-রবীনরা কোনদিকে গেল, একটু দেখা দরকার না?’
‘তা তো অবশ্যই। তবে কি জানিস, আমি আমাদের স্বাধীনতা লাভের প্রসেসটা সম্পর্কে দ্বিমত পোষণ করেছিলাম। এখনো করি…’
তখনই তুহিনের পকেটের সেলফোন বেজে ওঠে।
‘আমি তো সেই পার্কের কাছে কিনারেই আছি। আরবাবের কথা মনে নেই তোমার? হয়তো নেই… ওর সঙ্গে হঠাৎ দেখা!… তোমরা চলে আসো না। বিকাল হতে চলল…।’
রেবেকারা একটু দূরেই চলে গিয়েছিল। দীপার অফিস ছুটির পরপরই। তখন তারা এক বিশাল মলে। দোতলা-তিনতলা-চারতলায় এস্কেলেটরে ঘুরপাক খাচ্ছে। কাপড়-জামা, ভোগ্যপণ্য ও বিলাসী সামগ্রীর যাবতীয় সরঞ্জামের বিশাল সেলের সমারোহ সবখানে। তারা জানাল, ‘তাদের আসতে একটু দেরি হবে।’
আরবাব শুনে বলে, ‘ঘুরুক মা-বেটাবেটি। এ সুযোগে দেখুক না আহাম্মকের এই দেশটা… শালার ব্যাটারা নিজের দেশের সীমানা ছাড়িয়ে আর অন্য কাউকে চেনে না। অন্য যে আরো দু-দশটা দেশ আছে… সেখানেও মনুষ্যজাতীয় প্রাণী বাস করে, তা তাদের জানা নেই। জানার প্রয়োজনও পড়ে না তাদের।… তাদের জীবনদর্শন সরল ও সহজ। তা হলো, নিজে বাঁচলে বাপের নাম।’ এসব একতরফা বলতে বলতে হঠাৎ করে আরবাব থেমে গেল। দুই হাতের চেটোয় মুখে রেখে তুহিনের দিকে চেয়ে রইল অনেকক্ষণ। তারপর একসময় নিম্নস্বরে বলল, ‘তুই আছিস কয়দিন?’
‘এই তো, আর দিন পনেরো। নিউইয়র্ক ফিরে সপ্তাহখানেক…।’
‘কোন লাইনে এসেছিস?’
‘কোরিয়ান এয়ার…’
হঠাৎ একটা দীর্ঘশ্বাস চাপে আরবাব। আগের মতো নিম্নস্বরে আওড়ায়, ‘দেশে আর ফেরা হলো না আমার…।’
‘কেন?’
‘কেন-এর উত্তর আমারও জানা নেই সঠিক… তবে এটুকু মনে পড়ে, স্বাধীনতার এক তেতো স্বাদ আমার জিহবায় লেগে আছে। আর এই চার দশকের নির্বাসনে আমার শিকড়-বাকড় বিজাতীয় এক মাটিতে জড়িয়ে থেতে গেছে। এর থেকে বেরিয়ে আসার পথ নেই আমার। যাক এসব হেঁয়ালি কথা…। কাজের কথায় আসি। চল, বের হই… এক স্টার কাফেতে আর কতক্ষণ?’
‘ভাবিদের সঙ্গে যোগাযোগ কর… তারা যদি এখন আসতে না পারে অসুবিধা নেই… লেট দেম হ্যাভ দেয়ার টাইম। বরং আমরা প্ল্যান করি, কোথায় কীভাবে দেখা করব? আমরা রাতে একসঙ্গে খাব। চ্যাবি চেইজের শেষ মাথায় একটা ইন্ডিয়ান তান্দুরি রেস্তোরাঁ আছে, সেখানে। হোটেলের পরিবেশটা ভালো… হইচই কম…।’
তুহিন ফোন করে রেবেকাকে।
আরবাব তুহিনের হাত থেকে সেলফোন নেয়।
‘ভাবি, আমি আরবাব। আমি বলছিলাম কি, আপনাদের শপিং চলুক। আর আপনাদের সুবিধামতো আমরা একত্রিত হই… রাতে একসঙ্গে খাব।’

কথামতো সিলভার স্প্রিং টিউব স্টেশনের ওপরের চত্বরে ঠিক সময়মতো দেখা হয়ে গেল সবার।
ইন্ডিয়ান তান্দুরি রেস্তোরাঁয় খেতে খেতে আরবাব কথাটা ওঠাল, ‘এখান থেকে সামান্য দূরে, কয়েক কিলো দূরে একটা সার্কাস এসেছিল, মাসখানেকের জন্য। তোমরা দেখতে পারতে… আর কয়দিন আগে এলেই…’
আরবাব কথাগুলো যেন দীপাকে লক্ষ করেই বলছিল। সে বলতে থাকে, ‘সেই সার্কাসের প্রধান আকর্ষণ ছিল দুই পিগমি… সেগুলো বুড়ো, মাঝবয়সী না যুবক – বোঝার কোনো উপায় নেই। সে দুটি ছিল খুব ছোট আকারের ও খর্বাকৃতির। সার্কাসের বিশেষ আকর্ষণই হয়ে দাঁড়াল সেই দুটো মানুষ…(?)’
সরলচিত্তে দীপা তার অবুঝ কৌতূহল চেপে রাখতে পারল না। ‘ঠিক বুঝতে পারলাম না চাচু, ‘পিগমি’ ব্যাপারটা কী?’
‘কীভাবে বোঝাই তোমাকে? শব্দটা যদি না জেনে থাকো তাহলে ঠিক বোঝানো মুশকিল। তবে বলি, এরা মধ্য আফ্রিকার মানুষ, আকারে একেবারে ছোট…দেখতে কুৎসিত। কদাকারও বলা চলে। ইংরেজিতে ‘পিজরোটিভ’ কথাটার অর্থ তোমরা জানো কি-না জানি না? এর সঠিক অর্থ বলাও সহজ নয়। তবে তা ‘মর্যাদাহানিকর’ অর্থেই ব্যবহৃত হয়। পিগমি জাতিতে মানুষ, তবে ইংরেজি এ শব্দটিই এদের বেলায় ব্যবহার করা হয়ে থাকে। যেমন : ‘নিগ্রো…’ শব্দটা আজকাল আর কেউ ব্যবহার করে না… কারণ তা সম্মানজনক নয়…’
তখন দীপার ছোটবেলায় পড়া ভূগোলের এশিয়া-আফ্রিকার সংযোগী সাগর, মহাসাগরের যোগাযোগ ও দেশগুলো সম্পর্কে যা পড়েছিল, তা আবছা আবছা মনে পড়ে যেতে থাকে।
‘হ্যাঁ… এখন মনে পড়ছে, আফ্রিকার কঙ্গো অববাহিকার রেইন ফরেস্টে ও এর আশপাশের কতগুলো অঞ্চলে এরা বসবাস করে। জুলু-পিগমি-বানটু নামের সেসব মানুষ, সেখানকার আদিবাসী…।’
‘তা-ই, আমিও তাদের কথাই বলাছি। একেবারে অ্যাবরিজিন… তারা বনজঙ্গলেই থাকে। ফলমূল সংগ্রহ, এখনো পশুপাখি শিকার করে খায় তারা।’
আরবাব আরো বলে যায়, ‘সার্কাসের এই পিগমিরা তো সভ্যতার আলো দেখেনি… এরা যখন এসে পড়ল,… এই আকাশচুম্বী দালানকোঠা, ইটপাটকেল বিজলি-বাতি, মোটরযানের বেহাল ছোটাছুটি দেখে এরা থ মেরে রইল। একদম কথা বন্ধ হয়ে গেল তাদের। সার্কাসটার নাম আমার মনে পড়ছে না, আজকাল মনেও থাকে না ছাই।’
লোহার খাঁচায় শিকলবাঁধা পিগমি দুটিই স্থানীয়দের কাছে প্রধান আকর্ষণের বিষয় হয়ে উঠল। আমিও একদিন দৈবক্রমে ঘুরতে ঘুরতে সেখানে গিয়ে হাজির… এমন মানুষ আমি জীবনেও দেখিনি… এদের কি মানুষ বলা যায়? নাকি অন্য কিছু…’
দীপা খেতে খেতে গম্ভীর হয়ে যায়। তার হাতের কাঁটাচামচ কেমনতর জট পাকিয়ে যেতে থাকে। খাওয়ার গতি তার মন্থর হয়। তারপর হতবিহবল হয়ে সে আরবাবকে প্রশ্ন করে, ‘মানুষ নয় মানে? চাচু, ঠিক বুঝলাম না।’
‘মানুষ তো বলতেই হবে… তবে তারা বন্য, অনেক বন্য জীবজন্তুর মতো… উঁচা-লম্বা ইটপাটকেলের শহর তাদের সহ্য হচ্ছিল না। সার্কাস সঙদের বিচিত্র নাচ ও অঙ্গভঙ্গি আর ট্রামপেট-ক্লারিনেটের সমগ্র এলাকা কর্কশ শব্দে পিগমি দুটি চোখ বন্ধ অবস্থায়ই কানে হাত চেপে ধরছিল বারবার। আর আকস্মিক কখনো হকচকিত হয়ে চোখ মেলে চেয়েও যেন তাদের ফেলা আসা বনজঙ্গল খুঁজে বেড়ানোর চেষ্টা করছিল… হাত-পায়ের শিকল দেখছিল। এবং তাদের দেখে আমার মনে হচ্ছিল… হতাশায়, বিষণ্ণতায় এরা যেন তাদের কাঁদার শক্তিও হারিয়ে ফেলেছে…’
দীপা প্রশ্ন করে, ‘কিন্তু… কিন্তু… এদের সার্কাসওয়ালারা পেল কোথায়?’
‘কেন… আফ্রিকা থেকে ধরে নিয়ে এসেছে। সাদা চামড়ার জাতটা ব্যবসা-বাণিজ্যে পাকা। এখনো এরা বন্দুকের নলের ভয় দেখিয়ে ক্রীতদাস পাচার করে। এই পিগমি দুটোই তো এর প্রমাণ…। পয়সার লোভে আগ্রাসী হয়ে এরা পারে না, এমন কাজ নেই। …জাতীয় নেতা, রাষ্ট্রনায়ক এদের স্বার্থের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ালে তা সরাতেও তাদের সময় লাগে না। সেই গুপ্ত মেকানিজম তাদের রয়েছে। এরা জানে, কীভাবে কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলতে হয়। তবে চৌদ্দ-পনেরো শতাব্দী ধরে ২০-৩০ লাখ আফ্রিকানকে যে পণ্য হিসেবে রপ্তানি করেছে… এতে ক্রীতদাসদের যে কোনো লাভ হয়নি, তা আমি বলব না…। আমি কেন? কিছু নামিদামি ইউরোপ-আমেরিকার রজনীতিবিদ ও ঐতিহাসিকও এমনই বক্তব্য রেখেছেন। ক্রীতদাস হয়ে এলেও এখন তো তারা অনেক সুখী-সমৃদ্ধ জীবন যাপন করছে। তারা আমেরিকার স্থায়ী নাগরিক হিসেবে সব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছে…।
রেবেকা-তুহিন মোটামুটি কিছু সময়ের ব্যবধানে দেশি ধাঁচের খাবার পেয়ে তা গলাধঃকরণে মনোযোগী হয়ে রইল। অন্যদের কোন কথার তোড় কোনদিকে গড়াচ্ছে, তা নিয়ে তাদের তেমন মাথাব্যথা ছিল না।
এদিকে রবীন দীপা-আরবাবের কথোপকথন সুতীক্ষ্ণ আগ্রহ নিয়ে অনুসরণ করতে গিয়ে সে-ও প্রশ্ন রাখে, ‘বন্ধ লোহার খাঁচা, তার ওপর এদের পায়ে বেড়ি কেন, বুঝতে পারলাম না। নিরীহ বনজঙ্গলের দুটি মানুষ – এদের ঘিরে সার্কাসওয়ালাদের এত ভয় কিসের?’
‘ভয়ের ব্যাপার তো আছেই। এই বৈরী পরিবেশে এরা ভায়োলেন্ট হতে কতক্ষণ? তা ছাড়া এরা একবার মুক্ত হয়ে পালিয়েও যেতে পারে…।’
রবীন বিস্ময় প্রকাশ করে, ‘তাই বলে এত ভয়…। এরা যাবে কোথায়? এরা কি আফ্রিকার রেইন ফরেস্টে ফিরে যেতে পারবে আর কোনোদিন?’
আরবাব বিস্ময় প্রকাশ করে, ‘যাবে কেন? এখানে অ্যাডোপটেড হয়ে গেলেই তো ভালো। সভ্যতার আলো-বাতাসে এরা বাড়বে… বাড়বে এদের বংশধরও। পাবে শিক্ষাদীক্ষা…’
দীপা অসহিষ্ণু হয়ে ওঠে, ‘কিন্তু এরা কি এখানে আসতে চেয়েছে? এদের তো ধরে এনেছে কয়েদি করে। এদের বনজঙ্গলে কি এরা ভালো ছিল না?’
আরবার দীপার কথার বিপরীত সুরে কী একটা বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তা তাকে বলার সুযোগ না দিয়ে সে কিছুটা আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে।
‘দেখেন চাচু… আমরা যখন এসব জায়গায় আসি, আমরা কি খুব ভালো থাকি?’
‘তা, কেন থাকো না? ভালোই তো আছো…’
‘মন তো দেশেই পড়ে থাকে।’ দীপার কথাগুলো যেন প্রায় কষ্টকান্নার মতো শোনালো।
রেবেকা এবার সজাগ হয়। মেয়েকে তীক্ষ্ণভাবে পরখ করে, ‘তুমি তো একেবারে খাচ্ছ না…’
‘খাচ্ছি মা…খাচ্ছি…’
রবীন এবার আরবাবের কথা টেনে ধরে,
‘পিগমি দুটো এভাবে বাঁচল? এদের পরিণতি কী হলো?’
‘ব্যাপারটা পরে তেমন আর আমি ফলো করিনি। মাসখানেক পরে অবশ্য স্থানীয় বুলেটিনে একটা খবর বেরিয়েছিল এদের নিয়ে। এদের একজন নাকি রাতের অন্ধকারে লোহার খাঁচায় মাথা ঠুকে ঠুকে মরে গিয়েছিল। অন্যজনও তখন আধমরা… মৃত স্বজনের পাশে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে ছিল। এ-খবর পাওয়ার পর অবশ্য এক হৃদয়বান ব্যক্তি সার্কাসওয়ালাদের কাছ থেকে দ্বিতীয়জনকে টাকার বিনিময়ে ছাড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিল তার বাসায়। সেই হৃদয়বান বয়স্ক সাদা মানুষটির বাসায়ও সে টিকে থাকেনি। হয়তো দূরের বনজঙ্গলের হাতছানিতে একদিন উঁচু ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে সে মরে যায়।’
ততক্ষণে রেবেকা লক্ষ করে, দীপার চোখ থেকে ফোঁটা ফোঁটা জল পড়ছে খাবারের প্লেটে।
তুহিনও বিচলিত হয়ে পড়ে, ‘কী হলো রে মা, দীপা?
‘কিছু না…’ বলে দীপা কিচেনের পাশের বাথরুমে ঢুকে পড়ে। তুহিন তাড়াহুড়ো করে তাকে আগলে ধরতে গিয়ে ব্যর্থ হয়। ততক্ষণে দীপা ওয়াশরুমের দরজা ভেতর থেকে এঁটে দিয়েছে।
‘কী হলো আবার হঠাৎ করে…’
আরবাবের মুখেচোখে কেমনতর একটা অভিনব কাঠিন্য জমে ওঠে।
‘আর বলিস না… আজকালকার ছেলেমেয়েরা বড় সেন্টিমেটাল… রূঢ় বাস্তবতা এরা আমলে নিতে চায় না। ওরা যা বোঝে… ওই অতটুকুনই। অন্য ধারার, অন্য কোনো আইডিয়া যে থাকতে পারে, তা তারা সহসা মেনে নেয় না…। যেমন : দুইশো-আড়াইশো বছর আগে ২০-৩০ লক্ষ আফ্রিকান ব্ল্যাক ধরে আনতে না পারলে কি আজকের এই আমেরিকা হতো?’
রবীন ধীরেসুস্থে ধৈর্যসহকারে নীরবতা ভাঙে, ‘কালো ক্রীতদাস নামক পণ্য আমদানি-রপ্তানি ছাড়া কি কেউ উন্নতি করছে না?’
‘কোথায় করছে?’ আরবাব নিম্নস্বরে বিরক্তি চাপে। ‘কেন ইউরোপ, জাপান…’
দীপার মানসিক বিপর্যয়…। রবীনও যুক্তিতর্ক-বিতর্কে জড়িয়ে যাচ্ছে দেখে তুহিনকে মাঝখানে এসে দাঁড়াতে হয়, ‘তোমরা কী শুরু করলে? মুরবিবর মুখের ওপর তর্ক করতে নেই। খেতেও ভুলে গেলে তোমরা। কী সুন্দর খাবার না আমরা উপভোগ করছিলাম….মাসখানেক পরে দেশীয় ধাঁচের রান্নার স্বাদ পেয়ে…।
এ পর্যায়ে আরবাব প্রসঙ্গ পালটানোর চেষ্টা করে।
‘সরি ভাবি, এতক্ষণ আমি একাই বকবক করে গেলাম।’ পরক্ষণে আবার বলে যেতে থাকে, ‘একা একা মন্দ ছিলাম না বহুদিন। প্রায় এক যুগ হবে হয়তো-বা। একসময়ে আমার অজান্তেই বোধকরি এক্কা-দোক্কা খেলায় নেমে গিয়েছিলাম। এদেশে যা হয়। মেয়েটি ত্রিনিদাদের। ভারতীয় অরিজিন। পিয়ানিস্ট। রতেনশ্বরী ছিল কালো। তা যথেষ্ট কালো। পিয়ানোতে বসলে তাকে মনে হতো, স্বর্গ থেকে কেউ যেন নেমে এসেছে। তখন চুল তার বাতাসে উড়ত। এলোমেলো বছর কয়েক পরে আমরা বিয়ে করলাম। তখন আমাদের ছেলে ‘দুর্মূল্য’ রতেনশ্বরীর গর্ভে। ছয় মাসের। ছেলের বয়স যখন ছয় বছর, তখন ব্রাসেলস অ্যাকাডেমি অব মিউজিকে শিক্ষকতার অফার পেয়ে চলে গেল সে। সেদিন থেকে আমাদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। বহু বছর হয়ে গেল। দুর্মূল্য এখন হার্ভার্ডে ইতিহাসের ওপর পড়াশোনা করছে। আমি চাকরির পরে, লন ময়িং করে সময় কাটাই।’
রেবেকা বিস্ময়াভিভূত হয়ে শুনছিল আরবাবের কথা।
এর কিছুক্ষণ পরে দীপা টয়লেটের দরজা খুলে বেরিয়ে আসে। চোখমুখে তার চাপা কান্নার রেশ। গালমুখ ফুলে-ফেঁপে আছে তখনো।
আরবাব ততক্ষণে চেয়ার ছেড়ে উঠে গেছে।
‘এসো মা… এসো। দোষ হয়েছে আমারই। খাবারের টেবিলে জুলু-বানটু-পিগমি… এসব বিশ্রী উত্থাপন না ওঠালেই পারতাম। থাক, ওসব থাক…। তোমরা কে কী পড়ছ, তা-ও তো শোনা হয়নি।’
রবীন বলে, ‘আমি রাষ্ট্রবিজ্ঞান নিয়ে পড়ছি। আর মেজর ইন ক্রিয়েটিভ রাইটিং…’
‘বাহ্, চমৎকার তো। সুন্দর সাবজেক্ট…। আসলে আমরা যারা বিদেশে আসছি, তারা শুধু ইঞ্জিনিয়ারিং আইটি কম্পিউটার সায়েন্স পড়ছি। তাড়াহুড়ো করে। এর তাগিদ একটাই, দুটো ডলার কামানো। এদিকে যে আমরা অশিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত থেকে যাচ্ছি… সেই খেয়াল থাকে না। তাই চিন্তার দৈন্য কাটে না।’
ততক্ষণে খাবারের টেবিল থেকে উচ্ছিষ্ট খাবার, বাসনকোসন উঠিয়ে নিয়ে টেবিল ঝেড়েঝুড়ে শেষ পর্বের প্রস্ত্ততি নিতে থাকে বেয়ারা বাটলার।
‘ডেজার্ট… চা-কফি…?’
আরবাব তৎপর হয়, ‘আমি ভ্যানিলা আইসক্রিম…পরে ক্রিমার কফি…। তুহিন কি খাবি?’
‘আমি বরং পুডিং খাই। রেবেকা তুমি?’
‘আমি আর কিছু খাব না।’
আরবাব এবার দীপার দিকে মনোযোগ দেয়।
‘তোমায় কী দেব? চকোলেট আইসক্রিম… রবীন তুমি?’
কিছু সময় নিয়ে, দুজনই চকোলেট আইসক্রিম অর্ডার করে।
আরবাব কফিতে ক্রিমার মেশাতে মেশাতে দীপার মনোযোগ আকর্ষণ করার চেষ্টা করে, ‘লেখাপড়া শেষ করে কী করবে? সুবিধামতো চাকরি খুঁজবে নিশ্চয়ই?’
দীপা নিচুস্বরে বলে, ‘আমি জানি না।’
‘রবীন তুমি?’
‘আমি দেশে ফিরে যাব। মাস্টারি করব।’
হাসতে হাসতে এবার আরবাব রেবেকা-তুহিনের দিকে চায়। ‘ওরা কিছু ডলার সংগ্রহ করে গেলে ভালো হয় না?’
রেবেকা বলে, ‘সেটা তারাই ভালো জানে।’
তুহিন রেবেকার কথায় সায় দেয়, ‘ওরা যা ভালো মনে করে, তা-ই করুক…। আমাদের আর বলার কী আছে?’
এ পর্যায়ে আরবাব আজকের মতো সমাপ্তির প্রস্ত্ততি নেয়।
‘আমি আগামীকাল ছুটি নিয়েছি। তুহিন আমি সকাল সকাল তোর এখানে চলে আসব, আর রবীন-দীপা, তোমাদের ওয়াশিংটন টিউব ধরিয়ে দিই। চলো…। রাত হয়ে গেছে…।’ ঘড়ি দেখে আরবাব। ‘ওহ, তোমাদের ডিসিতে পৌঁছুতে পৌছুতে রাত প্রায় একটা-দেড়টা বেজে যাবে… তাড়াতাড়ি চলো… সিলভার স্প্রিং মেট্রোলাইনে। আর তোমরাও কিন্তু ডিসি টিউব স্টেশনের ওপরে আমাদের অপেক্ষায় থাকবে। আমরা এই ধরো ম্যারিল্যান্ড থেকে রওনা দিয়ে নয়টা-সাড়ে নয়টার মধ্যে তোমাদের ওখান থেকে উঠিয়ে নেব। ওয়াশিংটন ডিসি অনেক বড় আর ঐতিহাসিক শহর। এখানে কত কী যে দেখার আছে।’
রাতের আস্তানায় ফিরতে-না-ফিরতে তুহিন-রেবেকা দীপার মেসেজ পায়। দীপা জানিয়েছে, ‘আমরা কেউই তোমার ওই বন্ধুর সঙ্গে ঘুরতে পারছি না। হঠাৎ একটা কাজে পড়ে গেছি। কোনো অজুহাত দেখিয়ে সকালে তাকে বলে দিয়ো, তোমরা বরং ঘোরো। আমরা তো আছি। তোমরা তো চলে যাবে। আই লাভ ইউ। দীপা।’
দীপার মেসেজ পড়ে রেবেকাও দমে গেল।
‘না গেলে হয় না? ওদের ছাড়া…।’
তুহিনও কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। পরে বলে, ‘দেখো রেবেকা, সেটা কি ভালো দেখায়? আমাদের প্রতি তার সমাদর… তার অন্তরঙ্গতার কি ঘাটতি আছে কোনো?… তাহলে শুধু শুধু তাকে বিমুখ না করে বরং… একদিনেরই তো ব্যাপার…।’
তারা চষে বেড়াল সারা ওয়াশিংটন। সারাটি দিন রেবেকা-তুহিন-আরবাব ঘুরে বেড়াল। সারাদিন তারা যা দেখল, যা শুনল সবই যেন যন্ত্রতাড়িত হয়ে। তাতে তাদের না ছিল সহজাত কোনো আগ্রহ, না প্রাঞ্জল কোনো কৌতূহল। সন্তানদের এই যাত্রায় যোগ না দেওয়ার ব্যাপারটাই তাদের কাতর করে রাখে সারাদিন।