দেমাকি মেয়ে

ক্লারিস লিস্পেক্টরস (ব্রাজিল)

অনুবাদ : মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়

প্রত্যেক ভোরবেলাতে একই জিনিস বারে-বারে নতুন হয়ে আসে : জেগে উঠতে হবে এটা এমন একটা জিনিস যেটা শস্নথ, মন্থর, প্রসারিত, বিশাল। বিশাল তো বটেই, মেয়েটি তার চোখদুটি খোলে।

মেয়েটির বয়স পনেরো আর সে দেখতেও খুব একটা সুন্দর নয়। কিন্তু তার ভেতরটায় রোগাটে ভাবটা বজায় থাকে প্রায় তার রাজকীয় বিশালতায়, যার মধ্যে সে আসেত্ম-আসেত্ম নড়াচড়া করে, যেন কোনো ধ্যানে মগ্ন হয়ে আছে আর কুয়াশার মাঝখানে সেখানে ছিল কিছু একটা বহুমূল্য, যেটা নিজেকে বাড়িয়ে ধরেনি, কোনোরকম আপস করেনি নিজের সঙ্গে কিংবা তাকে কোনো কিছু ছুঁইয়ে দূষিত করে দেয়নি। যেটা ছিল কোনো মণিমুক্তোর মতো তীব্র ও প্রকট। সে নিজেই।

সে জেগে ওঠে অন্য কেউ জাগার আগেই। কারণ স্কুলে যাবার জন্যে তাকে তো একটা বাস ধরতে হবে এবং একটা ট্রেন আর এতে তার সময় লেগে যাবে অন্তত এক ঘণ্টা। এ অবশ্য তাকেই একটা ঘণ্টা সময় দেবে। সময় দেবে দিবাস্বপ্ন দেখার যা খুব তীক্ষন, যেন কোনো দুষ্ক্রিয়াকর্ম। সকালবেলার হাওয়া জানলা কাত হয়ে যাচ্ছে আর তার মুখ যতক্ষণে তার চোখদুটো কঠিন হয়ে ওঠে আর হিমশীতল তারপর সে মৃদু-মৃদু হাসে। যেন মৃদু হাসিটাই কোনো উদ্দেশ্য। এইসব কিছুই ঘটে যায় যদি এর ভাগ্য থাকে ভালো ‘কোনো কেউ তার দিকে তাকিয়ে থাকাটাকে আড়াল করার জন্যে’। যখন সে ভোরবেলায় উঠে পড়ল সেই বিশালতার মুহূর্ত এর মধ্যেই উধাও হয়ে গিয়েছে, যার মধ্যে সবকিছুই আসেত্ম-আসেত্ম খুলে গিয়েছিল। সে চটপট পোশাক পরে নিয়েছিল, নিজেকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ঠান্ডা করল যে, স্নানটা সেরে নেওয়ার কোনো সময়ই তার নেই, আর তার পরিবারের সবাই তখনো ঘুমিয়ে আছে, কখনোই আঁচ করতে পারবে না কতটা কম সে নিয়েছে। খাবারঘরের জ্বলন্ত বাতিটার নিচে সে প্রায় গিলেই খেল তার কফি, যেটা পরিচারিকা, রান্নাঘরের ঝাপসা আলোর মধ্যে নিজেকে চুলকোতে-চুলকোতে ফের গরম করে দিয়েছে। সে ক্বচিৎ কখনো ছোঁয় রুটিটাকে, যেটাকে মাখনের প্রলেপ আদৌ নরম করতে পারে না। উপবাস থেকে সদ্য-সদ্য বেরিয়ে তার মুখ সতেজ হয়ে আছে, তার বইগুলো তার বগলের তলায়, সে অবশেষে দরজাটা খোলে আর জুতো পায়ে হেঁটে বেরিয়ে যায় বাড়ির উষ্ণতা থেকে। সকালবেলার ঠান্ডা ফলফুলের মধ্যে। যেখানে সে আদপেই আর কোনো তাড়া অনুভব করে না। অ্যাভিনিউয়ে  পৌঁছবার আগে তাকে এক লম্বা পরিত্যক্ত রাসত্মা পেরিয়ে যেতে হয়, যার শেষপ্রান্ত থেকে আবির্ভাব হবে একটি বাসের, সকালবেলার আবছা আলোয় বাসটার হেডলাইটগুলো তখনো জ্বলছে। জুন মাসের হাওয়ায় এই রহস্যময় কাজটা কর্তৃত্বে ভরা আর সর্বাঙ্গসুঠাম, ছিল কারো হাতটা তুলে ধরার – আর এরই মধ্যে দূর থেকে কম্পমান বাসটা শুরু করে কেমন বেঢপ হয়ে উঠতে তার দেহের দাম্ভিকতার হুকুম তামিল করে, যেন কোনো প্রচ- ক্ষমতার প্রতিনিধি; দূর থেকে বাসটা কেমন যেন অনিশ্চয়তায় ভরে যেতে থাকে আর মন্থর হয়ে যেতে থাকে, মন্থর কিন্তু এগিয়ে আসছে। প্রত্যেকটা মুহূর্ত আরো যেন নিরেট – যতক্ষণ না সেটা তার সামনে এসে দাঁড়ায় তাপ আর ধোঁয়া উগরাতে-উগরাতে, ধোঁয়া আর উত্তাপ। তারপর মেয়েটি বাসে উঠে যায় কোণে মিশনারির মতো গম্ভীর, কারণ বাসের মধ্যে যে মজুররা ছিল। তারা হয়তো তাকে উদ্দেশ করে কিছু একটা বলে ফেলবে। ওই লোকগুলো কিন্তু এখন আর তেমন কিশোর নয়। কিন্তু মেয়েটি ছেলে-ছোকরাদেরও ভয় পায়, ভয় পায় এমনকি সবচেয়ে খুদে-খুদে বাচ্চাকাচ্চাকেও। ভয় পায় এজন্যে যে, তারা হয়তো তাকে উদ্দেশ করে কিছু একটা বলে ফেলবে, তার আপাদমস্তক তাকিয়ে-তাকিয়ে নিরীক্ষণ করবে, তার বোজানো ঠোঁটদুটি গাম্ভীর্যের মধ্যে একটা বিশাল কাকুতি-মিনতিও যেন ছিল যে তারা যেন তাকে একটু সম্মান করে। তার চাইতেও বেশি – যেন সে কোনো শপথ নিয়ে বসেছে, যেন সম্মানিত হওয়ার জন্যে সে আছে আর এখন, হৃদয়ের গভীরে কেমন যেন ভয়ে তার হৃৎপি- ধকধক করে ওঠে, আর সে নিজেই নিজেকে সম্মান দেখায় যে, সে কিনা এক ছন্দতালের অভিভাবক, যদি তারা তার দিকে তাকিয়ে থাকে তাহলে সে হয়ে ওঠে কেমন যেন করুণ আর কঠিন।

তাকে যেটা রেহাই দিয়েছিল সেটা ছিল এই তথ্য যে, লোকগুলো তাকে খেয়ালই করেনি, যদিও মেয়েটির ভেতরে কিছু একটা, যতই তার ষোড়শ বছর ধীরে-ধীরে তার কাছে ওই উত্তাপ আর ধোঁয়ার মধ্যে এসে পৌঁছয় – কিছু একটা প্রবল বিস্ময়ে যেন ভরে যায় – যা হয়তো কোনো-কোনো পুরুষকে বিস্মিত করে যাবে। যেন কেউ হঠাৎ তার কাঁধ স্পর্শ করেছে। হয়তো কোনো ছায়া। মাটির ওপর একটি মেয়ের বিশাল ছায়া পুরুষবিহীন, এক অনিশ্চয়তা যেটা স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ হয়ে উঠতে পারে, যেটা কোনো মস্ত জনসাধারণের উৎসবে বৈচিত্র্যবিহীন এক জ্যামিতি, যেন তারা তার কাঁধটাকে ছুঁয়েছে। তারা তার দিকে তাকিয়ে আছে কিন্তু তাকে দেখতেই পাচ্ছে না যে, বাস্তবতা আছে চারদিকে তার চাইতেও বড় এক ছায়া সে ফেলেছে। বাসের মধ্যে মজুরেরা চুপচাপ বসে আছে, তাদের লাঞ্চের প্যাকেটগুলো তাদের কোলের ওপর, ঘুম যেন এখনো তাদের মুখ-চোখের ওপর ঘুরে বেড়াচ্ছে। মেয়েটি লজ্জায় ভরে গেল, যেহেতু সে তাদের বিশ্বাস করেনি। পরিশ্রান্ত ঠিক যেমন এই মজুরেরা। কিন্তু যতক্ষণ না সে তাদের ভুলে যেতে পারে সে কেমন যেন অস্বস্তিবোধ করে। আসলে ‘তারা জানত’, আর যেহেতু সে নিজেও জানত আর সেজন্যেই তার মধ্যে এমন অস্থির অশামিত্ম। তার বাবাও জানতেন, আর এক বুড়ো যে বাইরে হাত পেতে ভিক্ষে চাইছে, সেও জানত। বিলিয়ে দেওয়া হলো ধনসম্পদ আর স্তব্ধতা।

পরে এক সৈনিকের মতো পা ফেলে সে বেরিয়ে এল কোনো

আঘাত ছাড়াই লাংগো-ডা-লাপায়, যেখানে দিনটা ফেটে পড়েছে, এখানটায় এসে যেন লড়াইটাকে প্রায় জিতেই নেওয়া গেছে। ট্রামে উঠে সে বেছে নিল একটা সিট, যেটা খালি পড়ে ছিল। যদি তা আদৌ সম্ভব হয় অথবা যদি তার বরাতটা ভালো থাকে, সে বসে পড়ল এক মহিলার পাশে যার কোলে কাপড়ের একটা বান্ডিল তাকে আশ্বস্ত করে দিল, কারণ উদাহরণত সেটাই প্রথম সন্ধের মুহূর্ত। একবার স্কুলে পৌঁছে গেলে, একে তো তবু মুখোমুখি পড়তে হবে লম্বা করিডোরটার, যেখানে তার সহপাঠীরা দাঁড়িয়ে থেকে একে অন্যের সঙ্গে কথা বলবে আর যেখানে তার জুতোর হিলগুলো এমন একটা গোলমেলে আওয়াজ করবে, যেটা তার অস্থির পাগুলো চেপে রাখতে পারবে না, যেন সে মিথ্যেই চেষ্টা করে যাচ্ছে তার ধুকপুক করে ওঠা হৃৎপি-টাকে শান্ত করে রাখার – ওই জুতোগুলো যেগুলোর মধ্যে আছে তাদের নিজেদের নৃত্যের ছন্দ-তাল। এক অস্পষ্ট স্তব্ধতা ফুটে বেরল ছেলেদের মাঝখান থেকে, যারা হয়তো বুঝতে পেরেছে, মেয়েটির অছিলার মধ্য থেকে যে-মেয়েটি, আসলে হয়তো একজন রুচিবাগীশ। সে তার সহপাঠীদের মাঝখানকার ছোট গলিটা দিয়ে বেরিয়ে গেল, যে-সহপাঠীরা এখন ভারিক্কি হয়ে উঠছে আর সেই ছাত্ররা হয়তো জানেই না, কী যে বলবে বা কী ভাববে। মেয়েটির জুতো থেকে যে-আওয়াজ উঠছিল সেটা এতই বিচ্ছিরি মেয়েটি তার সব গোপন কথা যেন ফাঁস করে দিল তার জুতোর কাঠের হিলগুলো দিয়ে। যদি করিডোরটা আরো একটু লম্বা হয়, যেন সে ভুলেই গিয়েছে তার নিয়তিকে, সে হয়তো ছুঁয়েই যাবে তার কানে তার হাতদুটো চেপে। তার তো ওই রকমই শক্ত জুতো আছে। জুতোগুলো যেন এখনো সেই রকমই আছে যেগুলো তারা তার পায়ে তার জন্মের সময় পরিয়ে দিয়েছিল। সে করিডোরটা পেরিয়ে এল, যেটাকে মনে হলো ওই স্তব্ধতারই মতো দুর্ভেদ্য। আর তার মুখ-চোখের অভিব্যক্তির মধ্যে এমন কিছু ছিল যেটা এত হিংস্র, আর দাম্ভিকও তার ছায়ার জন্যে – যে-কেউ তার সঙ্গে একটিও কথা বললে না। নিষেধে ভরা সে তাদের ভাবতেও বারণ করল।

অবশেষে সে তার ক্লাসঘরে এসে পৌঁছল। যেখানে হঠাৎ সবকিছু যেন অনাবশ্যক হয়ে পড়েছে। আর হয়ে উঠেছে আরো দ্রম্নতগতি আর হালকা-পলকা। যেখানে তার মুখটা এখন যেন খুলে দেখিয়ে দিল কয়েকটা তিল, তার চুল এসে পড়েছে তার চোখের ওপর আর যেখানে তাকে প্রায় একটা ছেলের মতোই ব্যবহার করা হলো। যেখানে সে ছিল বুদ্ধি-সুদ্ধিতে ভরা। তার নিজের কাজে প্রচুর দক্ষ। দেখে মনে হলো, সে বাড়িতে খুব পড়াশোনা করেছে। তার কৌতূহল তাকে বাতলে দিল সে যেসব প্রশ্নের জবাব দিয়েছে তার চাইতেও বেশি কিছু। সে গভীরভাবে ভেবে দেখল – তার ব্যথার তিক্ত স্বাদ – সে ভেবে দেখল মন্ত্রমুগ্ধের মতো তার বীতরাগ, যেটা তার সহপাঠীরা তার মাথার মধ্যে সৃষ্টি করে দিয়েছে। যারা, আরো একবার আদপেই বুঝতে পারেনি তার সম্বন্ধে কী যে বলবে। প্রতিবারই আরো যেন প্রতারক হয়ে উঠেছে, অনেক বেশি বুদ্ধিমতী। সে এখন শিখে গিয়েছে কেমন করে ভাবতে হয়। অত্যাবশ্যকীয় বিসর্জন : এইভাবেই ‘কেউ কোনো সাহসই পেল না’।

মাঝে-মাঝে, যখন শিক্ষক কথা বলছেন, সে প্রখর তীব্র আর একটু যেন গুটিয়ে গিয়ে, তার নিজের খাতার ওপর লিখছে। ছন্দে ভরা সব লেখা আঁকল। যদি কোনো রেখা যাকে একই সঙ্গে হতে হবে শক্ত আর নমনীয়, কাল্পনিক বৃত্তের থেকে যারা বাইরে যেখানে আসলে তাদের জায়গা হওয়ার কথা সবকিছুই যেন ধসে পড়বে। সে হয়ে উঠল আত্মমগ্ন আর শুধু, তার আদর্শের দ্বারা পরিচালিত। মাঝে-মাঝে লাইন টেনে যাওয়ার বদলে সে আঁকল তারাদের, তারাদের, তারাদের এতগুলো তারা যারা এত উঁচুতে আছে যে, সে বেরিয়ে এল এই কাজটার মধ্যে থেকে অবসন্ন হয়ে ওঠার ভবিষ্যদ্বাণী করে, তার ঘুমে ঢলেপড়া মাথাটাকে তুলে ধরে।

বাড়ি ফেরার যাত্রাটা এতই ক্ষুধায় ভরে গেল যে, অধীর আরো অস্থির হয়ে উঠল আর তার হৃদয়ের মাঝখানে যেন ঘৃণা তাকে কুরে-কুরে খেল। বাড়ি ফিরে এলে মনে হলো, এ যেন অন্য কোনো শহর : লাংগো-ডা-লাপায় শয়ে-শয়ে লোক ছিল। তার ক্ষুধার জ্বালায় প্রতিফলিত হয়ে যেন বিস্মৃত হয়ে গিয়েছিল। আর যদি তারা মনে করে দেখত যে, তারা তাদের দাঁত খুলে দেখাবে। ক্ষুধারই জ্বালায়। রোদ্দুর প্রত্যেকটা লোকের চেহারা যেন এঁকে গেল কালো কয়লা দিয়ে। তার নিজের ছায়া যেন একটা কালো থাম। এই প্রহরটায় আরো বেশি হুঁশিয়ার হওয়া উচিত। সে যেন রক্ষা পেল এমন এক ধরনের কুশ্রীতায় যেটা তার খিদে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। তার মুখ-চোখ যেন আরো কালো হয়ে উঠেছে কোনো শিকার হওয়া জানোয়ারের মতো। ফাঁকা বাড়িটায় পরিবারের সবাই বাইরে বেরিয়ে গিয়েছে, যে যার কাজে ব্যস্ত, সে পরিচারিকাকে উদ্দেশ করে চেঁচিয়ে বলল যে একটা কথারও উত্তর দিল না। সে যেন গোগ্রাসে গিলতে লাগল, তার মুখটা রেকাবির ওপর নামানো, তার চুলের গোছা প্রায় যেন তার খাবারের ওপর এসে পড়েছে।

‘চিমসে, তবে তুমি কিন্তু সবকিছুই ঠিকঠাক খেতে পারবে’, খুবই চালাক-চতুর পরিচারিকা বলছিল।

‘যাও গিয়ে আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়ো’, মেয়েটি বেজার মুখে চিৎকার করে তার দিকে তাকিয়ে বলল। ফাঁকা বাড়িটায় একা – শুধু পরিচারিকাটিই আছে, সে এখন আর কোনো ফৌজের লোকের মতো হাঁটছে না, এখন আর তার সারাক্ষণ হুঁশিয়ার হয়ে থাকার দরকার নেই। তবে সে কি না রাসত্মার মধ্যেকার লড়াইটাকে দেখতে পেল না : স্বাধীনতার বিষাদ, দিগন্ত এখনো কোন দূর-দূরামেত্ম, সে দিগমেত্মর কাছে আত্মসমর্পণ করে দিল। কিন্তু এখনকার যে বিষাদ তাকে ছেয়ে আছে। ধৈর্য ও অধ্যবসায়ের শিক্ষা, অপেক্ষা করার সেই প্রতিশ্রম্নতি এর মধ্যে থেকেই হয়তো সে কোনোদিন জানতে পারবে না নিজেকে কীভাবে মুক্ত করে ফেলতে হয়। বিকেলবেলাটা নিজেকে রূপান্তরিত করে ফেলছে কোনো এক অন্তহীন দৈর্ঘ্যে আর যতক্ষণ না তারা বাড়ি ফিরে আসে ডিনারের সময় আর সে হয়তো নিজেকে আশ্বস্ত করে ফেলবে বাড়ির এক কন্যা হয়ে ওঠে তার তো ছিলই ওই উত্তাপ, সামনে তার বইটা খোলা। তারপর সেটাকে বন্ধ করে দিল, কেমন করে যেন অন্তর্দৃষ্টির বলে টের পেয়ে গেল, আর এই

উত্তাপ : সে বসে পড়ল তার মাথাটা দুই হাত দিয়ে চেপে ধরে, কেমন যেন মরিয়া বোধ করছে। যখন তার বয়স ছিল দশ, তার মনে পড়ে গেল ছোট্ট একটি ছেলেকে, যে তাকে ভালোবাসত, একটা মরা ইঁদুর তার দিকে ছুড়ে ফেলেছিল। ‘নোংরা, কি নোংরা!’ সে তখন চিৎকার করে উঠেছিল। তীব্র ঘৃণায় একেবারে সাদা হয়ে। সেটা ছিল একটা অভিজ্ঞতা বটে। এই কথাটা সে কাউকেই কখনো বলেনি। তার দুই হাতের মধ্যে মাথাটা চেপে ধরে সে বসে রইল। সে এক-এক করে পনেরোবার বলল, ‘আমি ভালো আছি, আমি ভালো আছি, আমি ভালো আছি’। তারপর সে হঠাৎ টের পেয়ে গেল যে সে যোগফলটার দিকে একফোঁটা মনোযোগ দেয়নি। যোগফলটার সঙ্গে আবারো যোগ করে সে আরো একবার বলল, ‘আমি ভালো আছি, ষোলো বছর বয়স।’ আর এখন সে আর কারো দয়ার মুখাপেক্ষী হয়ে নেই। সে হয়ে উঠেছে তেরিয়া, একরোখা, কারণ সে এখন ভালো আছে, আর আছে স্বাধীন, সে এখন আর কারো দয়া বা ক্ষমার মুখাপেক্ষী হয়ে নেই। সে তার আস্থা হারিয়ে ফেলেছে, সে চলে গেল পরিচারিকাটির সঙ্গে কথা বলতে, যে কি না প্রাচীনা কোনো মহিলা যাজক। তারা একে অন্যকে চিনতে পারল। তারা দুজনেই খালি পায়ে চলে এলো রান্নাঘরে, উনুনটা থেকে ধোঁয়া উঠছে। সে কি না তার আস্থা আর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছে কিন্তু করুণার সীমামেত্ম পৌঁছে, সে পরিচারিকার কাছ থেকে শুধু সেটাই প্রার্থনা করল, যেটা সে এর মধ্যেই হারিয়ে বসে আছে, তার বদলে সে লাভ করেছে মোটেই তা নয়। সে ভান করল যেন তার মনটা অন্য কিছুর ওপর পড়ে আছে। কথা বলতে-বলতে, সে যেন আলোচনার বিষয়টাকে এড়িয়ে গেল। ‘সে ভেবেছে যে, আমার এই বয়সে আমি যতটুকু জানি তার চেয়েও বেশি জানা উচিত, আর সত্যি বলতে, সে আমাকে কিছু সহজেই শিখিয়ে দিতে পারবে’; সে ভাবল, তার মাথাটা দুই হাতের মধ্যে নিজের অজ্ঞতাকে বাঁচিয়ে রাখছে তার সারা শরীরটা দিয়ে। কোনো-কোনো উপাদান সেখানে আদপেই ছিল না, কিন্তু সে আদপেই সেগুলো অন্য কারো কাছ থেকে চায়ওনি যে, এর মধ্যেই সব ভুলে বসে আছে। এই অন্তহীন প্রতীক্ষা যেন তারই একটা অংশ। আর তার ভেতরে আছে সেই বিশালতা – যেটা মনে-মনে নতুন সব পরিকল্পনা আঁকছে।

এই সবই নিশ্চয়। অবধারিত, অবসন্ন, অবসাদের বিশাল অনুভূতি। কিন্তু পরের দিন সকালবেলায় যেমনভাবে কোনো অস্ট্রিচ আসেত্ম-আসেত্ম তার গোটানো মাথাটাকে তুলে ধরে, মেয়েটি ঘুম থেকে জাগল, সে জেগে উঠল সেই অটুট রহস্যটার মধ্যে, আর তার চোখদুটি খুলে সে যেন হয়ে উঠল সেই অটুট রহস্যের কোনো রাজকুমারী।

যেন কারখানাঘরটা এরই মধ্যে ঘণ্টা বাজিয়ে দিয়েছে, সে চটপট পোশাক পরে নিল আর প্রায় যেন এক চুমুকেই খেয়ে ফেলল তার কফি। সে সদর দরজাটা খুলল, আর তারপর তার মধ্যে আর কোনো তাড়াহুড়ো রইল না। রাসত্মাঘাটের সেই বিশাল হই-হট্টগোল। সুচতুর, সজাগ, এক আপাচের স্ত্রী। সেই আদ্যিকালের কর্মযজ্ঞেরই যেন একটা অংশ। এটা আগের দিনের চাইতেও আরো ঠান্ডা আর আঁধারে ভরা সকাল, আর সে তার সোয়েটারের মধ্যেও কেঁপে-কেঁপে উঠল। সাদা কুয়াশা রাসত্মার শেষ প্রান্তটাকে একেবারে যেন অদৃশ্য করে রেখেছে। সবকিছুই যেন পশমের পোশাকে ঢাকা, কেউ যেন পাশ দিয়ে চলে যাওয়া বাসগুলোর আওয়াজও শুনতে পাচ্ছে না। ওই একদিনের মধ্যে। সে রাসত্মাটার অনিশ্চিত একটা প্রান্ত ধরে হেঁটে চলল। বাড়ির ঘরগুলো যেন বন্ধ দরজার পেছনে পিছলে সরে গেল। বাগানগুলো জমাট তুষারে যেন কঠিন হয়ে আছে। অন্ধকার বাতাসের মধ্যে আকাশে নয়, বরং রাসত্মাটার ঠিক মাঝখানে সেখানে ছিল একটা তারা : বরফের তৈরি করা এক মস্ত তারা, যেটা এখনো অদৃশ্য হয়ে যায়নি, কী করবে না জেনেই যেন দোল খাচ্ছে হাওয়ায়, আর্দ্র আর নিরাবয়ব। তার নিজের দেরি হওয়াতেই যেন বিস্ময়ে অভিভূত সে তার ইতস্তত ভঙ্গিমার মধ্যেই গোলাকার হয়ে উঠল। মেয়েটি তাকাল কাছের তারাটার দিকে। সে বোমার বিস্ফোরণে আহত শহরটার মধ্যে দিয়ে একাই হেঁটে চলতে লাগল।

না-না সে মোটেই একা না। তার চোখদুটো জ্বলজ্বল করে উঠল অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে। তার রাসত্মার শেষ প্রামেত্ম কুয়াশার মাঝখানে সে যেন দেখতে পেল দুটি লোককে। দুটি যুবক তার দিকে এগিয়ে আসছে। মেয়েটি তার চারদিকে তাকিয়ে দেখল যেন সে হয়তো সহজে রাসত্মাটাকে ঠিক চিনতে পারেনি, শহরটাকেও চিনতে পারেনি। কিন্তু সে ভুল করে বসেছে মিনিটগুলোকে; সে তারার আগেই বাড়ির থেকে বেরিয়ে এসেছে আর লোকদুটির যেন সময় হয়ে গেছে উধাও হয়ে যাওয়ার। তার বুকটা যেন আতঙ্কে সংকুচিত হয়ে গেল। তার নিজের ভ্রামিত্মর মুখোমুখি পড়ে তার প্রথম ইচ্ছে হলো পায়ে-পায়ে পিছলে পড়ার। আর বাড়িতে ফিরে যাওয়ার যতক্ষণ না তারা এখান থেকে চলে যায় ‘আমি জানি ওরা আমার দিকে তাকিয়ে থাকবে, তারা আমার দিকে তাকিয়ে থাকবে, কেননা এখানে তো আর কেউ নেই যারা তার দিকে তাকাবে।’ কিন্তু সে পেছন ফিরে পালাবে কী করে যদি সে এইসব মুশকিল-টুশকিলে পড়ার জন্যই জন্মে থাকে। যদি তার সমস্ত প্রস্ত্ততির ধীর মন্থরতা অজানা কোনো কিছুর প্রতীক্ষা করে থাকে। সে তার সমস্ত নিষ্ঠাসমেত, মেনে নেয়, তাহলে সে পেছন ফিরে যাবে কী করে। আর কোনোদিনও তো সেই লজ্জাটাকে ভুলতে পারবে না, আর অপেক্ষা করে থাকবে দরজার পেছনে তার দুর্দশার মধ্যে।

আর হয়তো এখানে কোনোই বিপদ-আপদ নেই, তাদের হয়তো এই দুঃসাহস-ই হবে না যে তাকে কিছু বলে, কারণ সে তাদের পাশ কাটিয়ে যাবে দৃঢ় পদক্ষেপে, তার মুখ শক্ত করে গোঁজা সে চলছে তার এসপানিয়োল (españl) ছন্দে।

বীরের মতো পা ফেলে সে হেঁটে চলল। সে যত তাদের কাছে এল তারাও ততোই তার কাছে এল – তারপর তারা সবাই এ ওর কাছে এল আর রাসত্মাটা ক্রমে ছোট থেকে ছোট হয়ে পড়ল। সেই যুবকদুটির পায়ের জুতোর আওয়াজ মিশে গেল তার জুতোর আওয়াজের সঙ্গে। আর সেই শব্দটা কানে যে কী অসহ্য লাগে। অথচ আওয়াজগুলো কেন বারে-বারে খোঁচা দিয়ে বলে লোকশেখা। হয় তাদের জুতোগুলো ফাঁপা-ফোঁপরা, নয়তো পায়ের তলার মাটিই যেন ফাঁপা। রাসত্মার আশপাশের দোকানগুলো যেন সাবধান করে আওয়াজ তুলল, সবকিছুই ফাঁপা ও ফোঁপরা আর সে সব শুনে চলেছে। না শোনার কোনো ক্ষমতাই তার যেন নেই। আশপাশের বদ্ধ জায়গায় স্তব্ধতা যেন এই এলাকার অন্যসব রাসত্মার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করেই চলেছে। আর সে দেখতে পেল – না দেখে তার কোনো উপায় ছিল না – যে আশপাশের বাড়ির দরজাগুলো আরো যেন সাবধানে তালা-চাবি দেওয়া। এমনকি তারাটাও উধাও হয়ে গেছে। অন্ধকারের এই নতুন বিবর্ণ রূপের মধ্যে রাসত্মাটা যেন তাদের তিনজনের কাছেই আত্মসমর্পণ করে বসে আছে। সে হেঁটে চলেছে আর লোকদুটোর পায়ের আওয়াজ শুনে চলেছে। যেহেতু সে তাদের দেখতে পাচ্ছে না। আর তার তো তাদের চেনা উচিত। সে শুধু শুনতে পাচ্ছে, তাদের আর নিজের সাহসে সে যেন একটু বিস্মিতই হয়ে গেল। এটা একটা উপহার। আর কোনো নিয়তির উদ্দেশে নিবেদিত এক বিরাট উচ্চাশায় সে এগিয়ে চলল, যেন সে কারো একটা হুকুম তামিল করে বেজায় দুর্দশার মধ্যে পড়েছে।

যদি সে অন্য কোনো কিছু নিয়ে ভাবতে সফল হয়, তাহলে সে তাদের জুতোর শব্দ শুনতে পাচ্ছে না। আমরা কেউ এসব কথা হয়তো বলছি না। শুনতে পাবে না সেই স্তব্ধতাকে, যার মধ্যে তারা এ ওর পাশ কাটিয়ে চলে যাবে।

অতিতৎপরভাবে সটান হয়ে সে তাদের দিকে তাকাল। যখন সে এটা প্রত্যাশা করেছিল গোপনতার শপথ নিয়ে, সে দেখতে পেল তারা দ্রম্নতপায়ে চলেছে। ওরা কি মুচকি হাসছিল? না তারা গম্ভীর হয়েই ছিল।

তার এভাবে দেখা ঠিক হয়নি। কারণ এভাবে দেখে, সে একমুহূর্তের জন্য একজন ব্যক্তি হয়ে ওঠার বিপদে পড়ে যেত, আর তারাও বিপদে পড়ত। এই সম্বন্ধে যেন আগে থেকে হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছিল তাকে : যতক্ষণ সে ধ্রম্নপদী সুরের এক জগৎকে বাঁচিয়ে রাখতে পারবে, যতক্ষণ সে থাকবে নৈর্ব্যক্তিক, সে হয়ে উঠবে দেবতাদের দুহিতা, আর যা অর্জন করে নেওয়া যায় যেন তারই সহায়তায় সে প্রস্ত্তত। কিন্তু, তাকে দ্যাখে কোনো চোখ দেখার সময় ক্রমেই বিলীয়মান, সে নিজেকেই বিপদে ফেলে দিয়েছিল ‘সে যা তাই’ বলেই – এমন এক অস্তিত্ব যাকে ঐতিহ্য কখনো রক্ষা করে না।

মুহূর্তের জন্য সে কেবল ইতস্তত করল, কোনদিকে যে যাবে সেটাই যেন বুঝতে পারছে না। কিন্তু পেছনে ফিরে যাওয়ার পক্ষে এখন বড্ড বেশি দেরি হয়ে গেছে। এটা অবশ্যি বেশি দেরি হবে না যদি সে দৌড়ে যায়; কিন্তু দৌড়ে যাওয়ার মানে তো এটা নয় যে, সে পুরোপুরি ভুল রাসত্মায় চলে এসেছে আর যে-ছন্দটা তাকে এতক্ষণ বাঁচিয়ে রেখেছিল সেটাকে হারিয়ে বসে সেই ছন্দ যেটা ছিল তার একমাত্র রক্ষাকবচ – যা তাকে পৃথিবীর একপ্রামেত্ম দেওয়া হয়েছিল যেখানে সেটা ছিল তারই একা থাকার উপায় – পৃথিবীর সেই প্রামেত্ম যেখানে সমস্ত স্মৃতি পুরোপুরি মুছে দিয়েছে আরেক দুর্বোধ্য স্মারকের মতো, সেই অন্ধ রক্ষাকবচ থেকে গিয়েছে তার নিয়তির ছন্দ হিসেবে নকল করে নেওয়ার জন্যে, সারা জগৎটাকেই ভোগ করে নেওয়ার জন্যে। যেটাকে অনুসরণ করে চলতে হয়। তার নিজের নয়, যদি সে দৌড়ে যেত তাহলে সেই শৃঙ্খলা যেন বদলে যেত। আর তার সবচেয়ে বড় ভুলটার জন্যে তাকে কখনো ক্ষমা করা হতো না : এই তাড়াহুড়ো। আর যখন কেউ পালিয়ে যায় তারা একজন আরেক জনের পেছনে ছোটে, এমন জিনিস যা কেউ জানে।

কোনো জিজ্ঞাসুর মতো সটান খাড়া হয়ে এক মুহূর্তের জন্যেও তার সেই মন্থরগতিকে না পালটে সে এগিয়ে চলল, সে শুধুই এগিয়ে চলল।

ওরা নিশ্চয় আমার দিকে তাকিয়ে থাকবে, ‘আমি জানি!’ কিন্তু সে চেষ্টা করে গেল যেন আগেকার কোনো জন্মের বোধবুদ্ধির সাহায্যে, যাতে সে তার ভয়ভীতিকে প্রকাশ করে না ফেলে। সে অনুমান করে দেখল, সে কোনো আতঙ্ক ধীরে-ধীরে খুলে আসছে। এটা হবে দ্রম্নতগতিতে ভরা আর ব্যথা-বেদনাহীন। শুধু মুহূর্তের মধ্যে তাদের পথগুলো একে অন্যের পাশ কাটিয়ে যেত, দ্রম্নত, তাৎক্ষণিক, তারই পক্ষে সুবিধা দেওয়ার জন্যে যেন এক গতি আর উলটোদিক থেকে তাদের এগিয়ে আসা যেটা, সেই মুহূর্তটাকে আরো যেন ছোট করে দেবে প্রয়োজনীয় আবশ্যিকতার – সাত-সাতটি রহস্যের প্রথমটি ধসে পড়লে যে গোপন কথাটি কারো ধ্যানজ্ঞানের মধ্যে অবিচল থাকে : সংখ্যাটি সাত।

‘তাদের কোনো কিছু বলতে দিও না শুধু তাদের চিমত্মা করতে দাও। তারা ভাবলে আমার কিছু যায় আসে না।’ এটা হবে দ্রম্নতগতি আর মুখোমুখি হওয়ার একমুহূর্ত পরে সে বলবে বিস্মিত অন্যদের মধ্যে দিয়ে পায়ে-পায়ে এগিয়ে যাওয়া অন্য রাসত্মাগুলোর মধ্যে। ‘এ তো প্রায় যেন আহতই করে না।’ কিন্তু সত্যি বলতে, যেটা অনুসরণ করে এলো সেটা কোনো ব্যাখ্যাই নয়।

পেছন-পেছন এলো সেটা চার-চারটে অবিমৃশ্য হাত, চারটে অবিমৃশ্য হাত, যারা জানে না কী তারা সত্যি-সত্যি চায়, কোনো গন্তব্যবিহীন কারো-কারো ভ্রান্ত হাত, চার-চারটে হাত যারা তাকে ছুঁয়ে দেখল এমন অপ্রত্যাশিতভাবে যে, তার পক্ষে যেটা করা সবচেয়ে ভালো তাই করল সেই চলাচলের জগতে; সে একেবারে স্থাণু হয়ে পড়ল অভিভূত। তারা যাদের গ্রাহ্য ভূমিকা ছিল শুধু তার ভয়ের অন্ধকারের পাশ দিয়ে যাওয়ার আর তারপর সাত রহস্যের প্রথমটি একেবারে ধসে পড়ে যেত; তারা, দিগমেত্মর সেইটাকেই দেখাল, যারা কাছে আসার একটি পদক্ষেপ ও আদপেই বুঝতে পারেনি তাদের কর্তব্য কী হবে এবং যারা আতঙ্কের অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে গেছে সেই ব্যক্তিত্বদের মতো, তারা আক্রমণ করল। সেই শান্ত রাসত্মাটায় এই হামলাটা খাটল শুধু একটা মুহূর্তের সামান্য অংশের মতো। একটা মুহূর্তের টুকরো অংশের মধ্যে, তারা তাকে স্পর্শ করল যেন সেই সাতটা রহস্য শুধু তাদেরই দখলে আছে। যেটা মেয়েটি সাবধানে রেখে দিল তাদের সম্পূর্ণতার মধ্যে আর হয়ে উঠল যেন ওই ডিম থেকে বেরিয়ে আসা পোকা আর অনুভব করল পেছনে যেন পড়ে আছে আরো সাত-সাতটা বছর।

মেয়েটি তাদের দিকে একবারও তাকাল না কারণ তার মুখটা শূন্যতার মধ্যে কোনো এক শান্ত অবস্থার দিকে ফেরানো আছে। কিন্তু যে-দ্রম্নততার সঙ্গে তারা তাকে আহত করেছিল মেয়েটি অনুধাবন করতে পারল যে তারা যেন মেয়েটির চাইতেও বেশি ভয় পেয়ে গিয়েছে। এতটাই ভয় পেয়ে গিয়েছে যে, তারা আর সেখানটায় নেই। তারা ছুটে চলে যাচ্ছে।

‘তারা আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিল যে, সে নিশ্চয়ই বাঁচাও-বাঁচাও বলে চিৎকার করবে আর বাড়িগুলোর দরজা একটার পর একটা খুলে যাবে’, মেয়েটি কারণটা বোঝার চেষ্টা করল। তারা তো আর জানে না যে, কেউ শুধু সাহায্যের জন্যই চেঁচিয়ে ডাকে না।

সে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল কান পেতে শুনতে লাগল শান্ত উদ্দামতার মধ্যে তাদের পালিয়ে যাওয়া জুতোগুলোর শব্দ। ফুটপাত নিশ্চয় ফাঁপা ছিল অথবা তাদের পায়ের জুতোগুলোই ফাঁপা ছিল, অথবা মেয়েটি নিজেই বুঝি ফাঁপা ছিল। আর তাদের ফাঁপা জুতোর শব্দ সে কান পেতে মনোযোগ দিয়ে শুনল সেই দুই যুবকের ভয়ভীতিসুদ্ধ। ফুটপাতের পাথরের ওপর স্পষ্ট শোনা গেল ধুপধুপ শব্দ, যেন তারা একটানা কোনো দরজার ওপর ঘা দিচ্ছে আর নিয়তি অপেক্ষা করে আছে তারা কখন থেমে যাবে। পাথরগুলোর খালি গায়ের ওপর এত স্পষ্টভাবে তাদের পায়ের শব্দ উঠল যেটা মনে হলো যেন আর কোনো দূরে এই শব্দ ওঠেনি : এটা যেন সেখানেই  তার পায়ের কাছে কোনো বিজয় নাচনের মতো। দাঁড়িয়ে রইল সে, জানে না কোথায় যাবে নিজেকে বাঁচাতে, যতক্ষণ না নিজের কানে সে কিছু শুনতে পাচ্ছে।

এই আওয়াজগুলো কিন্তু কমে গেল না, তাদের প্রস্থান-সংবাদ তার কাছে এসে পৌঁছল জুতোর একটানা শব্দ আরো স্পষ্টভাবে এই জুতোর গোড়ালির শব্দগুলো ফুটপাতের ওপর আর প্রতিধ্বনি তুলছে না তারা বরং হাওয়ার মধ্যে বেজে যাচ্ছে, হয়ে উঠছে আরো বেশি নমনীয়, কোমল। তারপর সে টের পেল যে, বেশ কিছুক্ষণ ধরে সে কোনো শব্দই শুনতে পায়নি, আর হাওয়া যেন তাকে বয়ে নিয়ে উড়ে গেল, পেছনে দগ্ধতা আর সন্দেহ। আর বাতাস ধরাধরি করে উড়িয়ে নিয়ে গেল পেছনে, আর পড়ে রইল স্তব্ধতার আরেক ফাঁপা আশ্রয়।

এই মুহূর্তটার আগে অবধি মেয়েটি চুপ করেছিল, ফুটপাতের মাঝখানে ঠায় দাঁড়িয়ে। তারপর যেন সেই নিশ্চলতার অনেকগুলো স্তর ছুঁলো, মেয়েটি দাঁড়িয়ে ছিল স্থির। একমুহূর্ত পরে সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল আর যেন নতুন একটা দশায় পৌঁছে মেয়েটি স্থির হয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। সে তারপরে আসেত্ম-আসেত্ম পেছনে ফিরে গেল একটা দেয়ালের দিকে, কুঁজো হয়ে খুব আসেত্ম-আসেত্ম হেঁটে যেন সে তার হাত ভেঙে ফেলেছে, যতক্ষণ না দেয়ালের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়াল, যেন সেই দেয়ালে কেউ তার ছাপ ফেলে গিয়েছে। আর সেখানেই সে দাঁড়িয়ে রইল শান্ত, স্থির, নিশ্চুপ।

‘যা কাজে লাগে তা হলো একটুও নড়াচড়া না করা।’ সে যেন অনেকদূর থেকে ভাবল একটুও নড়াচড়া না করে। আরেকটু পরে হয়তো সে নিজেকেই বলত, ‘হ্যাঁ এখন তোমার পা-দুটো একটু নাড়াও, খুব আসেত্ম’, যার পরেই সে দীর্ঘশ্বাস ফেলল, চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল আশপাশে তাকিয়ে দেখতে-দেখতে। এখনো কিন্তু বেশ অন্ধকার।

তারপরে দিন ফেটে পড়ল। ধীরে-ধীরে তার মাটির ওপর ছড়িয়ে-পড়া বইগুলো কুড়িয়ে নিল। আরেকটু সামনে পড়ে আছে তার খোলা খাতাটা, যখন সে খাতাটা তুলে নেবে বলে নুয়ে দাঁড়াল সে দেখতে পেল বড়-বড় গোল-গোল হাতের লেখা যা আজ ভোরবেলা অবধি তারই হাতের লেখা ছিল। তারপর সে ওখান থেকে চলে গেল। নিজেই জানে না কেমন করে সে সময় কাটিয়েছে যদি না পদপাতের পর পদপাতে সে ইশ্কুলে এসে পৌঁছত দুঘণ্টার চাইতেও দেরিতে। যেহেতু সে কোনো কিছু নিয়েই ভাবেনি, সে বুঝতেই পারেনি কেমন করে এতটা সময় কেটে গেল। সে নিজেকে আবিষ্কার করল সবিস্ময়ে ক্লাসঘরের মধ্যে লাতিন শিক্ষকের সামনে, যখন তারা এর মধ্যেই তৃতীয় ঘণ্টার ক্লাস শুরু করে দিয়েছে।

‘তোর কী হয়েছে?’ ফিসফিস করে তার পাশে বসে থাকা মেয়েটি তাকে জিজ্ঞেস করল।

‘কেন?’

‘তোর মুখ একেবারে সাদা হয়ে আছে। তোর কি শরীর খারাপ লাগছে।’

‘না তো’ – সে এত স্পষ্ট করে বলল যে, আরো কয়েকজন ছাত্রছাত্রী তার দিকে চোখ তুলে তাকাল। সে উঠে দাঁড়ায় জোর গলায়, ‘আমাকে মাফ করুন!’ সে ল্যাভেটরিতে চলে গেল সেখানে সেই টালির ঘরের বিশাল স্তব্ধতার মধ্যে সে উঁচু-গলায় খনখনে সুরে কেঁদে উঠল, আমি এই জগৎটার মধ্যে একেবারে একা পড়ে আছি। কেউ আমাকে কোনোদিনও সাহায্য করবে না। কেউ আমাকে কোনোদিনও একটুও ভালোবাসবে না! আমি এই জগৎটার মধ্যে একেবারে একা। সেখানে সে দাঁড়িয়ে রইল। তৃতীয় ক্লাসটাও করা হলো না। দাঁড়িয়ে রইল ল্যাভেটরির লম্বা বেঞ্চিটার সামনে, যার সামনে বেশ কয়েকটা বেসিন আছে।

‘এতে কিছুই যায় আসে না, আমি না হয় পরেই ক্লাসে যা পড়ানো হয়েছে সব কপি করে নেব। আমি কারো কাছ থেকে তার নোটবইটা ধার করে নেব আর বাড়ি ফিরে গিয়ে সেগুলো আমার খাতায় লিখে রাখব। আমি তো এই সারা জগৎটার মধ্যে একেবারে একা পড়ে আছি।’

নিজের কথাকেই সে বাধা দিল। তার মুষ্টিবদ্ধ হাতটা দিয়ে কয়েকবার বেঞ্চটার মধ্যে ঘা মারল। ঝমঝম করে পড়া বৃষ্টির মতো। এক অন্ধ কোলাহল কোনো কিছুই প্রতিফলিত হচ্ছে না ঝলমলে ইট-পাথরের ওপর। শুধু একেকটা জুতোর স্পষ্ট আওয়াজ যেটা অন্য জুতোর আওয়াজের সঙ্গে কখনো জড়িয়ে যাচ্ছে না। যেন ওপর থেকে ঢিল পড়ছে। এটা তো শুধু একটু অপেক্ষা করারই মতো। যখন কেউ অপেক্ষা করে থাকে দরজার ওপর ধাক্কা দেওয়ার ঠকঠক শব্দ কখন থামবে। তারপর আওয়াজগুলো থেমে গেল।

যখন সে আয়নার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে নিজের চুলগুলো হাত দিয়ে ঠিক করার চেষ্টা করল। নিজেকে তার এত কুৎসিত লাগল।

এত সামান্য কিছু তার আছে আর তারা তাকে স্পর্শ করেছিল। সে এত কুৎসিত আর মূল্যবান।

তার মুখটা ফ্যাকাশে হয়েছিল, তার চেহারা যেন আরো সূক্ষ্ম সুকুমার হয়ে উঠেছে। তার হাতদুটো এখনো কালি দাগে ভরা গতকালের ক্লাসের পর যেমন হয়েছিল সেই হাতদুটো তার চুলে বোলাল।

আমার নিজের সম্বন্ধে আরো বেশি যত্ন নেওয়া উচিত। সে জানে না কেমন করে সে যত্ন নেবে, সত্যটা হলো এই যে, প্রত্যেকবারই সে জানতে পারে আগের চাইতেও আরো কম করে। তার নাকটার অভিব্যক্তি অনেকটা যেন ঝোপের মধ্যে থেকে বেরিয়ে আসা শুঁড়ের মতো। সে আবার বেঞ্চিটাতে ফিরে গেল, চুপচাপ বসে পড়ল তার ওই শুঁড়ের মতো নাকটা নিয়ে।

‘কোনো ব্যক্তি নিজে কিন্তু কিছুই নয়। না’ – সে খুব দুর্বল গলায় প্রতিবাদ জানাল, ‘অমন কথা বোলো না’, সে কেমন যেন সদয়ভাবে ভাবল। আর ভাবল বিষণ্ণতায়। ‘একজন মানুষ শুধু কোনো মানুষ নয়।’ সে দয়ায় ভরা গলায় বলল।

কিন্তু রাত্তিরে খাবার সময় জীবন নিয়ে নিল এক যেন তুমুল জরুরি হিস্টিরিয়ায় ভরা অর্থে ভরপুর।

‘আমার নতুন একজোড়া জুতো চাই। আমারটা বড্ড বেশি আওয়াজ করে। ওরকম কাঠের মতো হিল নিয়ে কোনো মেয়ে হাঁটতে পারে না। এমন আওয়াজ তোলে যে, বড্ড বেশি লোকেদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। কেউ আমাকে কিছু দেয় না! কেউ আমাকে কিছু দেয় নি!’ আর সে এমন জরাতুর হয়ে আছে আর রুদ্ধশ্বাস যে কারো কোনো সাহস হলো না তাকে এই কথাটা বলতে যে, এসব কিছুই পাবে না। তারা শুধু বলল, ‘তুমি কোনো মহিলা-টহিলা নও। আর প্রত্যেক জুতোর হিল তৈরি হয় কাঠ দিয়েই।’ যতক্ষণ না কেউ বড্ড মোটা হয়ে যায় সে জানে না কোন পদ্ধতির মধ্যে দিয়ে সে যাবে মূল্যবান হয়ে-ওঠার জন্য সেখানে একটা অস্পষ্ট কানুন যেন আছে যেটা ডিক্রি জারি করে বলে দেয় যে, কোন দিনটাকে সাবধানে সামলে রাখতে হবে যতক্ষণ না কোনো মুরগি-ছানা জন্মায়। আগুনে জড়ায় এক পাখি। আর সে তার নতুন জুতো পেয়ে গেল।