দেশপ্রেমিক দিকনির্দেশক দূরদর্শী এক স্থপতি

নূরুর রহমান খান

স্থপতি মাজহারুল ইসলাম প্রথমত ছিলেন অসাধারণ। তাঁর জীবনের প্রতিটি পদে তিনি যতগুলো decission নিয়েছেন তার প্রতিটিই ছিল অসাধারণ। তিনি নিজের অজান্তেই নিজেকে অসাধারণ করে গড়ে তুলেছিলেন। তাঁর চিন্তা, বোধ, দৃষ্টি, ব্যক্তিত্ব সবই ছিল অসাধারণ। তিনি একজন অসাধারণ স্থপতি ছিলেন বটে। কিন্তু শুধু স্থাপত্যকর্মের মধ্য দিয়ে তাঁকে বিচার করলে তাঁর অসাধারণ ব্যক্তিত্বের সম্পূর্ণ পরিচয় পাওয়া যাবে না।

তিনি যখন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে কলকাতা যান, সেখানে তিনি ফুটবল টিমের ক্যাপ্টেন ছিলেন। একবার তিনি আয়োজন করলেন ফুটবল প্রতিযোগিতা এবং তখনকার স্বনামধন্য টিম মোহনবাগানকে নিয়ে এসে তাঁদের সঙ্গে খেলার জন্য অনুরোধ করলেন। ইউনিভার্সিটির ডিসি বললেন, ‘তাদের সঙ্গে তো তোমরা কখনই জিততে পারবে না।’ এই প্রশ্নে ইসলাম স্যারের উত্তর ছিল, ‘এটা হার-জিতের ব্যাপার নয়, তাদের মতো great team-এর সঙ্গে একই মাঠে দাঁড়ানোর ব্যাপার।’ ইসলাম স্যারের চিন্তা তাঁর ব্যক্তিত্বের মতোই অসাধারণ ছিল।

জ্ঞান ও শিক্ষার ব্যাপারে তিনি ছিলেন uncompromising এবং একটা অদ্ভুত socialist mindset থেকে তিনি জ্ঞান এবং শিক্ষাকে দেখতেন। আমাকে একদিন বলেছিলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি, আমার ছেলে এবং একজন রিকশাওয়ালার ছেলে একই প্রাথমিক স্কুলে যাবে। আপনি কি তা বিশ্বাস করেন?’ অসাধারণ শক্তিশালী চিন্তাবিদ এবং philosopher ছিলেন তিনি। বারবার তিনি বলতেন, শিক্ষার বিভিন্ন স্তর এবং পদ্ধতির ওপর আমাদের চিন্তাচেতনা বাড়িয়ে গোটা দেশটাকে উন্নতির দিকে নিতে হবে। তাঁর সবচেয়ে পছন্দের দুটো গালির মধ্যে একটি ছিল ‘মূর্খ’ এবং সেটা সাধারণত তিনি উচ্চশিক্ষিতদের জন্য বরাদ্দ রাখতেন। কারণ দেশটাকে নিয়ে ভাবনাচিন্তা করার ব্যাপারে তিনি তেমন পারদর্শী ছিলেন না। অসাধারণ দেশপ্রেমিক ছিলেন তিনি। তিনি যখন graduation-এর পরদিনই দেশে ফিরে এলেন তখন তাঁর প্রবাসের শিক্ষকরা তাঁকে বলেছিলেন থেকে যেতে। বলেছিলেন, সবাই এখানে আসতে চায় আর তুমি এখান থেকে চলে যাবে? এর মধ্য দিয়েই স্যার প্রমাণ করেছিলেন তিনি ‘সবাই’ নন, তিনি সবার থেকে অনন্য। দেশে ফেরত এসে তিনি দায়িত্ব কাঁধে নিলেন। দেশ গড়ার দায়িত্ব, নিজের দক্ষতা এবং দায়িত্ব – এই দুই ব্যাপারে তাঁর পরিকর ধারণা ছিল। হয়তো এ-কারণেই নিজের ওপর leadership role-টা চাপিয়ে দিতে পেরেছিলেন। অসাধারণ সাহসের অধিকারী ছিলেন তিনি, কারণ নিজের ভেতরে দেশপ্রেমই ছিল তাঁর মূল চালকাশক্তি। তাঁকে যখন নতুন প্রজন্মের স্থপতিদের উদ্দেশে কিছু বলতে বলা হতো, তিনি সবসময় বলতেন, ‘দেশকে এবং দেশের সংস্কৃতিকে ভালোবাসতে হবে।’

এক ইন্টারভিউতে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি এই দেশ এই দুনিয়ার সবচেয়ে সুন্দর দেশের মধ্যে একটি। এবং আমি বিশ্বাস করি, এই দেশটি great।’ আরেক ইন্টারভিউতে তিনি বলেছিলেন, ‘গত দুই হাজার বছরের ইতিহাসে আমরা বেশিরভাগ সময়ই ধনী ছিলাম। শুধু গত আড়াইশো বছর ধরে আমরা গরিব হয়ে পড়েছি, তাও সেটা কলোনাইজারদের জন্য। আমরা যদি দারিদ্র্যতে ভুগি তাহলে আমরা মাত্র এক ধরনের দারিদ্র্যতেই ভুগছি এবং সেটা হচ্ছে অর্থনৈতিক দারিদ্র্য। দুনিয়ার বহু দেশ আরো অনেক ধরনের দারিদ্রে্য ভুগছে।’ আমাদের দেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের ব্যাপারে অসাধারণ আত্মসম্মান বোধ ছিল তাঁর।

ইসলাম স্যার ছিলেন দিকনির্দেশক। তিনি শুধু দিকনির্দেশক স্থপতি ছিলেন তা নয়। তিনি মূলেই ছিলেন দিকনির্দেশক। তিনি উভয় পাকিস্তানে Institute of Architecture গঠন করেছিলেন এবং তার প্রথম President ছিলেন। তিনি সেই সময় থেকেই physical planning-এর কথা বলতেন এবং একটি physical planning মন্ত্রণালয়ের গুরুত্ব সম্পর্কে সরকারকে বোঝানোর চেষ্টা করতেন। স্থপতি সামসুল ওরারেসের সঙ্গে এক ইন্টারভিউতে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি বিশ্বাস করেছিলাম যে, স্থাপত্য সমাজের ভালো করার একটি tool’ এবং তিনি সেই কারণেই প্রথমে সরকারি চাকরিতে যোগদান করেছিলেন। ইসলাম স্যার নিজেকে তাঁর পেশায় সীমাবদ্ধ না রেখে রাজনীতিতে যোগদান করেছিলেন এবং এমনকি আহ্ছানউল্লাহ বিশ্ববিদ্যালয়ের Academic Counsellor ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, দেশ গড়তে হলে সবাইকে দেশটাকে নিয়ে চিন্তাভাবনা করতে হবে, সবাইকে দায়িত্ব নিতে হবে এবং সে-দায়িত্ব শুধু যে যার শিক্ষা ও কাজের পরিসরের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না। ইসলাম স্যারের সেই leadership দেওয়ার ক্ষমতা এবং সাহস ছিল। ইসলাম স্যারের বাসায় চায়ের আড্ডায় আসতেন জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসান, রশিদ চৌধুরী, কলিম শরাফী, শামসুর রাহমান এবং আরো অনেকেই। এই দেশের স্থাপত্য, চারুকলা, সাহিত্য, সংস্কৃতি – এসবের ভরকেন্দ্র ছিল যেন সেই আড্ডা। এই association of masters একজন আরেকজনকে আরো জোরদার করেছেন এবং তাঁরা সবাই তাঁদের নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে আমাদের সবার জন্য মানদন্ড স্থাপন করে গিয়েছেন। এই আড্ডার পাশাপাশি তাঁর বাড়ির উঠানে চলত উদীচী শিল্পী গোষ্ঠীর অনুশীলন। এরকম একটি দৃশ্য চিন্তা করলেই সেই সময়ের গতি, দৃষ্টি এবং socio-cultural mindset-এর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জাগে।

আমাদের দেশের সংসদ ভবন ডিজাইন করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল স্থপতি মাজহারুল ইসলামকে। একজন স্থপতি হিসেবে এটা যেমন সম্মানজনক, তেমনি অনেক লোভনীয় একটি প্রজেক্ট। প্রচন্ড sacrifice এবং নিজের পেশার প্রতি শ্রদ্ধার উদাহরণ ছিল তাঁর পরবর্তী পদক্ষেপ। তিনি প্রশাসনকে বললেন যে, তিনি নন, বরং একজন আন্তর্জাতিক master architect-এর এই প্রজেক্টটা করা উচিত। তার ফল হিসেবে আজ আমরা পেয়েছি আমাদের দেশে Louis I Kahn-এর মতো স্বনামধন্য স্থপতির একটি masterpiece, যা শুধু আমাদের পৃথিবীর স্থাপত্যশিল্পের মানচিত্রে একটি স্থায়ী স্থান করে দিয়েছে তা নয়, যুগ-যুগ ধরে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের স্থপতিদের জন্য উদাহরণস্বরূপ কাজ হিসেবে থাকবে।

একবার এক NGO একটি মেটার্নিটি ক্লিনিক ডিজাইন করে দেওয়ার আবদার নিয়ে আসেন তাঁর কাছে। তখন তাঁর পরিবাগের অফিস আর নেই এবং তিনিও আর কাজ করছেন না। তখন তিনি আমাকে বললেন আমি কাজটা করব কিনা। মূলত তাঁর grawingগুলো করে দেব কিনা। আমি অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে রাজি হয়ে গেলাম। Design-এর একপর্যায়ে আমি কিছু ১০র্ x ১৫র্ কলাম এঁকেছিলাম দেয়ালের সঙ্গে মিলিয়ে। কিন্তু তিনি আমাকে সেগুলো ১২র্ x ১২র্ করে দিতে বলেছিলেন। পরদিন আমি তা করে নিয়ে যাইনি। তিনি তখন আমাকে বলেছিলেন, ‘আপনি কি মনে করেন আমি জানি না যে-কলামগুলো ১০র্ দেয়ালের সঙ্গে মিলিয়ে দিলে সুন্দর লাগবে? কিন্তু আপনার এই সৌন্দর্য কিসের মূল্যে হবে সেটা আপনি জানেন না। ১২ x ১২ করলে আমরা shuttering থেকে যে cost কমাতে পারব সেটা দিয়ে হয়তো ক্লিনিকের ইনকিউবেটরটা একটু ভালোমানের কেনা যাবে। সেই বোধটুকু আপনার থাকা উচিত।’ এরকম বোধ আমাদের অনেকেরই এখনো জাগ্রত হয়নি। তাঁর চিন্তা-চেতনা শুধু একজন অসাধারণ স্থপতির নয়, একজন অসাধারণ মানুষেরও।

মাজহারুল ইসলাম স্থপতি হিসেবে ছিলেন অসাধারণ দেশপ্রেমিক, দূরদর্শী। নির্দ্বিধায় বলা যায়, ইসলাম স্যার তৎকালীন পাকিস্তান এবং তখনকার বাংলাদেশের সর্বশ্রেষ্ঠ স্থপতি। ইসলাম স্যারের কাজ বর্তমান যুগের স্থপতি এবং শিক্ষার্থীদের জন্য নির্দেশনা বইয়ের মতো, যাতে আমরা অনুধাবন করতে পারি বাংলাদেশের স্থাপত্যশিল্পের মান কোথায় যাওয়া উচিত। বর্তমান সময়ে আর কোনো স্থপতি নেই যিনি দক্ষতায়, দর্শনে এবং আদর্শে তাঁর সমতুল্য। এই উপমহাদেশেও তাঁর মতো গভীর চিন্তার এবং দার্শনিক আদর্শের স্থপতির সংখ্যা নেই বললেই চলে। তিনি তাঁর জীবনের প্রথম কাজ চারুকলা ইনস্টিটিউটের মাধ্যমে কলোনিয়াল জল ছিঁড়ে superficial regionalism-এর ঊর্ধ্বে উঠে সেই সময়ের uninspiring international style থেকে অনেকদূর এগিয়ে গিয়ে আমাদের দেশের জন্য আধুনিক স্থাপত্যের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন। একজন দক্ষ চিত্রশিল্পী যেমন তুলির এক দাগে একটি সম্পূর্ণ ছবি এঁকে ফেলতে পারেন, যা ধারণ করে তাঁর আবেগ, অনুপ্রেরণা, দর্শন এবং শৈল্পিক চেতনা – সব, ঠিক তেমনিভাবে স্থপতি মাজহারুল ইসলাম তাঁর এই এক কাজের মাধ্যমেই আমাদের দিয়েছেন এই দেশের আধুনিক স্থাপত্যের দিকনির্দেশনা। তাঁর প্রখর চিন্তা, মেধা, দর্শন, অনুপ্রেরণা, শৈল্পিক চেতনা, দূরদর্শিতা – এ সবকিছুর সমন্বয়ে যেন গড়ে উঠেছে আমাদের চারুকলা। রবিঠাকুর যে শান্তিনিকেতন কল্পনা করেছিলেন মনে হয় যেন সেটার সবচেয়ে সুন্দর উদাহরণ তাঁর শান্তিনিকেতন নয়, বরং স্থপতি মাজহারুল ইসলামের চারুকলা। সেই গাছের ছায়ায় পাঠ, সেই প্রকৃতির মধ্য থেকেই অনুপ্রেরণা নিয়ে জীবনদর্শন দাঁড় করানো, বৈষয়িক লোভ থেকে দূরত্ব, নিজের একটি একান্ত স্থান – সবকিছু যেন এখানেই। অথচ তা তৈরি করতে শহর থেকে বহুদূর যেতে হয়নি। এটা এমন এক জায়গা যেখানে শিক্ষক ছাড়াই শিল্পী শিক্ষা পাচ্ছেন প্রতিদিন। প্রতিনিয়ত প্রকৃতির কাছ থেকে। আলো-বাতাস, ঝড়-তুফান, রোদ-বৃষ্টি, পাখির ডাক, ফুলের সুবাস – সব গড়ছে শৈল্পিক চেতনা। তাঁর NIPA ভবন আরেকটি অসাধারণ সৃষ্টিকর্ম। বৃষ্টিবহুল দেশ বাংলাদেশ। আমাদের বৃষ্টি নিয়ে রচিত হয়েছে বহু গান, বহু কবিতা। অথচ স্থাপত্যের বেলায় স্থপতিদের সঙ্গে বৃষ্টির ব্যাপারটা অত্যন্ত unromantic। ইসলাম স্যার তাঁর NIPA ভবনে এমন একটি progressive cannopy তৈরি করেছেন যেটা যে শুধু রোদ, বৃষ্টি ছায়া দিচ্ছে তা নয়, বরং তাঁর অনেক বারান্দা থেকে বৃষ্টি ‘দেখা’ যায়। অত্যন্ত সহজ অথচ গভীর  sensitivity-র অধিকারী এই স্থাপত্যকর্ম। একদিকে brutalist aes cast concrete-এর তৈরি এ-ভবনটি, অন্যদিকে  রোদ-বৃষ্টির সঙ্গে romantic ডায়ালগে লিপ্ত।

স্থপতি মাজহারুল ইসলাম এরপর থেকে একের পর এক স্থাপত্যকর্মের মাধ্যমে প্রতিবারই উদাহরণস্বরূপ কাজ রেখে গেছেন আমাদের জন্যে। অনেকে বলতে পারেন, বিভিন্ন সময়ে তিনি তাঁর ‘style’ বদলেছেন। বর্তমান সময়ে আমাদের স্থপতিদের এই সমস্যা। আমরা চাই আমাদের কাজ হোক আমাদের স্বাক্ষরস্বরূপ। স্থপতি মাজহারুল ইসলাম আমাদের চেয়ে অনেক উঁচুমানের স্থপতি ছিলেন। তিনি কখনো কোনো কাজ প্রচারের জন্য করেননি। অনেকেই আমাকে সময়ে সময়ে জিজ্ঞেস করেছেন, ইসলাম স্যারের স্থাপত্যদর্শন কী? ইসলাম স্যারের আলাদা কোনো স্থাপত্যদর্শন ছিল না। তাঁর ছিল একটি অসাধারণ সুন্দর জীবনদর্শন। সেই জীবনদর্শনই তাঁকে দিকনির্দেশনা দিয়েছে তাঁর প্রতিটি পদক্ষেপে, প্রতিটি কাজে, প্রতিটি কথায়। তাঁর স্থাপত্য তাঁর জীবনদর্শনের বহিঃপ্রকাশ। আজ আমরা খুব বলতে পছন্দ করি, ‘আমি চিন্তা করেছি’, ‘আমি মনে করি’, ‘আমি চাই’ ইত্যাদি। ইসলাম স্যারের সঙ্গে বহু সময় কাটিয়েছি আমি। তিনি সবসময় বলতেন, ‘আমি  চিন্তা করে দেখলাম আমার কী করা উচিত।’ ‘কী করা উচিত’ – এ-ব্যাপারটাই কেমন জানি আমাদের মধ্য থেকে হারিয়ে গিয়েছে। সুনাম, সচ্ছলতা, লোভ, আত্মতুষ্টি – এসবই হচ্ছে আমাদের এখনকার trend। আমরা তাঁর মতো অসাধারণ নই, দেশপ্রেমেও বেশ ঘাটতি পড়েছে। বর্তমান সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট আমাদের দিগ্বিহীন করেছে। স্থপতি হিসেবে শুধু দালানকোঠা নয়, দেশ গড়ার ধ্যান-ধারণা, চিন্তা ও দক্ষতা ইসলাম স্যারের ধারেকাছেই যায় না। মাজহারুল ইসলাম গত হয়েছেন। এটা চিন্তা করার মতো বড় ভুল আর হতে পারে না। তাঁর কাজ, তাঁর জীবন, তাঁর চিন্তা সবসময়ই আমাদের দিকনির্দেশনা দেবে। এই মহান, নমনীয়, আদর্শবান, উদার, জ্ঞানী, সুশীল মানুষটাকে আমরা রোলমডেল হিসেবে না ধরে রাখলে অবক্ষয় হবে আমাদেরই। আমাদের মধ্যে আজকাল রোল মডেলের ভীষণ অভাব।

স্থপতি হিসেবে আমি মনে করি, প্রত্যেক স্থপতির জন্য সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কাজ তাঁদের নিজেদের বাসা। কিন্তু আমি আমাদের সিলেটের বাসাটা নিজে না design করে ইসলাম স্যারকে অনুরোধ করেছিলাম design করে দিতে। এটাই ছিল তাঁর জীবনের শেষ স্থাপত্যকর্ম। এ-কাজটা করার সময় তাঁর সঙ্গে আমার এক অদ্ভুত সম্পর্ক তৈরি হয়। একদিকে তিনি আমাদের গুরুস্বরূপ, আরেকদিকে আমি তাঁর client। প্রতিটি পদে তিনি আমাদের পরিবারের সঙ্গে যে শ্রদ্ধাভরে চিন্তার আদান-প্রদান করেছেন তা সত্যিই লক্ষণীয়। আবার একই সঙ্গে পেশার প্রতি দায়িত্ব এবং স্থাপত্যের নির্ণয়গুলোর ব্যাপারে ছিলেন uncompromising। এত বছর পরও তাঁর কাছে কোনো ধরনের ঘাটতি ছিল না। তিনি প্রামাণ্যচিত্রের মধ্যে খালেদ আশরাফ বলেছিলেন, তিনি একজন tragic figure। মূলত তাঁর uncompromising চিন্তাভাবনার জন্যই তিনি অনেক কাজ করতে পারেননি এবং তিনি আশা করেছিলেন, তাঁকে মানুষ বুঝবে এবং তাঁকে দিয়ে অনেক কাজ করিয়ে নেবে। পরিশেষে এই ‘tragedy’টা ঘুরে দাঁড়াচ্ছে আমাদের সবার। না পেল এই দেশ তাঁর মেধার ব্যাপ্তি, আর না পেল এদেশের Architecture Schoolগুলো তাঁর মতো একজন অসাধারণ শিক্ষক এবং বহু প্রজন্মের স্থপতি তৈরি হয়েছে যারা না পেল তাঁর সান্নিধ্য। তাঁর সঙ্গে আনাগোনা, বিস্তারিত ইন্টারভিউ এবং নানা কাজ করে দেওয়ার মধ্যে দিয়ে তাঁকে জানতে পেরেছি বলে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করছি। আজ বাংলাদেশি হিসেবে আমাদের এই বাংলাদেশকে গড়ে তোলার জন্য তাঁর মতো ‘কী করা উচিত’ এরকম নিঃস্বার্থ চিন্তা এবং অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে তাঁকে আমাদের দরকার। বাংলাদেশের স্থাপত্যকর্মের উন্নতি ঘটাতে হলে আগে মাজহারুল ইসলামকে ধারণ করতে হবে নিজেদের মাঝে। অসাধারণ দেশপ্রেমিক, দিকনির্দেশক, দূরদর্শী স্থপতি মাজহারুল ইসলাম হোক আমাদের গর্ব, আমাদের অনুপ্রেরণা।