নদী কারো নয়

সৈয়দ শামসুল হক

\ ১৮\

উনিশশো সাতচল্লিশ সালের আগস্ট মাস – হিমালয় দক্ষিণের উপমহাদেশ থেকে – বিশেষ আমাদের এই জলেশ্বরীতে ব্রিটিশ বিদায়ের সেই দিনটি – পাকিস্তানের জন্মলগ্নের চোদ্দই আগস্ট বৃহস্পতিবার, আর হিন্দুস্থান তথা ভারতে পনেরোই আগস্ট শুক্রবার – সেই উন্মত্ত সময়ের বয়ান আমাদের কাছে কে করবে? আমরা কুসমির ঘরে সাইদুর রহমান কন্ট্রাক্টরের মুখে গল্প শুনছিলাম – বুঝলু রে কুসমি, তোমার তখন তো জন্ময় হয় নাই, সে বড় পাগলা
সময় গেইছে! বলিলেও না প্রত্যয় হয়! হবার কথাও নয়। ওয়াহেদ ডাক্তার তো জলেশ্বরী হতে হরিষাল গেইলো ঝ্যান পঙ্খির পাখায় ভর করিয়া নদী পার হয়া। ঘাটে মাঝি নাই, নাও নাই, সুনসান পড়ি আছে নদীর পাড় – সেই কথা কার বা মনে আছে? মাঝে মাঝে যখন আসমান ভরি ম্যাঘ আসে রাজার হাতির মতো, পাগলা হাতির মতো তারা আসমানজুড়ি দাপাদাপি করে, তখন মনে পড়ি যায়! মানুষে কয়, তখন বাজের ঠাঠা পড়িবার শব্দে ওয়াহেদ ডাক্তারের উচ্চহাসি শোনা যায়! সে একসময় গেইছে রে, কুসমি!
সময় আর দুঃসময়, এই দুই প্রকার সময়ের কথা আমরা শুনে থাকি, সংসার যাপনে অবিরাম বলেও থাকি – এর অতিরেকে উন্মত্ত সময়, সে আবার কেমন? সময় নিজে নিজেই আপন খেয়ালে সু হয়ে ওঠে কি দুঃখের, কি আমাদের নিজেদের কর্মকারণেই সময়ের ওপরে আমরা আরোপ করি তার সুখ ও দুঃখরূপ? সময় নদীর মতো – বহে চলে, এ কত পুরনো কথা, কিন্তু পুরনো বলেই ব্যবহারে-ব্যবহারে তার ধার ক্ষয়ে যায় নাই। সেই কবে কোন আমাদের পূর্বপুরুষ বলে গেছেন – নদীর প্রবাহ আর সময়ের প্রবাহ কারো জন্যে অপেক্ষা করে না; নিরবধি সে বহেই চলে। কারো জন্যে অপেক্ষা করে না সত্য, কিন্তু দুই পাড় যে ভাঙতে ভাঙতে অগ্রসর হয় – এটাও সত্য বলে জেনে নিতে হয়।
সেদিন, সাতচল্লিশের সেই চোদ্দই আগস্ট বৃহস্পতিবার, ঝকঝকে দিন, রোজার দিন, সেই দিনটিতে জলেশ্বরীর পাশ দিয়ে বহে যাওয়া আধকোশা নদীর পাড়ে আমরা যদি জাদুবলে ফিরে যেতে পারি, যদি কাছেই কাছারির ময়দানে ব্রিটিশের নিশান নামিয়ে পাকিস্তানের নিশান তোলার সমাবেশ আর উল্লাস থেকে নিজেদের সরিয়ে, কাছারির লাল দালানের পেছনে পথ ধরে খানিকটা দূর হেঁটে যেতে পারি, বাবলা আর বাঁশবনের ভেতর দিয়ে পথ করে নদীর ঘাটে এসে দাঁড়াতে পারি, তবে সেখানে পূর্ব-পশ্চিম নিরিখ করে দেখলে, আমরা একটি মানুষকে দেখে উঠবো – নদীর দিকে একদৃষ্টে সে তাকিয়ে আছে। একদৃষ্টে কি মানুষটার দেহেও নড়ন-চড়ন নাই! ইস্টিশানের সিগনাল থামের মতো নিশ্চল! কাকপক্ষীর যদি ভ্রম হয়, তবে তারা নেমে এসে তার কাঁধের ওপর বসলেও আমাদের অবাক হবার কিছু নাই। কিন্তু আজ এখানে কাকপক্ষীও নাই। মানুষটা দাঁড়িয়েই আছে। বাতাসেও আজ এখানে নদীর পাড়ে বিন্দুমাত্র বেগ নাই যে তার বস্ত্রেও আমরা কোনো চঞ্চলতা লক্ষ করি। কিন্তু তার বস্ত্রই আমাদের বলে দেয় – ফুলপ্যান্ট একদা শাদা ছিল এখন হলদেটে, ধূসর হয়ে যাওয়া কালো রঙের কোট, পায়ে মোজা ছাড়াই কালো পাম্প শু – মানুষটা আর কেউ নয় – আমাদের জলেশ্বরীতে আগত বাংলার খ্যাতনামা ঔপন্যাসিক মকবুল হোসেনের বাবা জলেশ্বরীর ডাকসাইটে মোক্তার মইনুল হোসেন।
নদীর জল সেদিন স্তব্ধ, বুকে তার স্রোতের টান নাই, ঢেউ নাই। খাপখোলা তলোয়ারের মতো ঝকঝক করছে আধকোশা, দেখলেই বুক কেঁপে ওঠে – এই বুঝি সটান লাফিয়ে উঠে বিদ্যুৎবেগে আঘাত করবে, দ্বিখন্ডিত করে ফেলবে সবকিছু, গলগল করে রক্তধারা ছুটবে চরাচর প্লাবিত করে। মইনুল হোসেন কাছারির ময়দানে পাকিস্তানের উৎসবে যায় নাই। অথচ, নিশানের মঞ্চে থাকবার কথা ছিল তারও, অন্তত মঞ্চের কাছাকাছি তো বটেই, মুসলিম লীগের নেতা নজির হোসেনের পাশেই। নজির হোসেন একবার আশেপাশে দৃষ্টিও করেছিল – নাই! দুএকজনকে জিগ্যেসও করেছিল – মোক্তার গেইলো কোনঠে? খোঁজ করি দ্যাখো, ধরি আনো তাকে। শুভ সময়ে তার হাজির না থাকা কেমন কথা! – কিন্তু ততক্ষণে পাকিস্তান জন্মের তোপ পড়ে গেছে, বিউগলে ভোঁ বেজে উঠেছে, হাকিম নেয়ামতউল্লাহ্র ভাষণ শুরু হয়ে গেছে – কে আর খবর রাখে মইনুল হোসেন মোক্তারের!
আর কেউ খোঁজ না করুক, আমরা করি। আমরা নদীর পাড়ে যাই। আমাদের সময় এখন – গল্পের সময়! গল্প তো মানুষই কেবল লেখে না – কাগজে কলমের কালিতে, যেমন মকবুল হোসেন; গল্প লেখে সময়! আ, তবে সময়ের এও এক কাজ! সময়ের হাতে থাকে তবে রচনার কলম? ধ্যান করে দেখলে সে কলমটিও প্রকৃত প্রস্তাবে মানুষেরই হাতে। মানুষের সঞ্চালন ছাড়া সময়ের নিজস্ব কোনো সৃজনক্ষমতা নাই। সেই মানুষেরই হাতে আজ এই নদী আধকোশা এমন এক উন্মত্ত নাটকের দৃশ্যপট হয়ে উঠেছে যার সমুখে এখন স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মইনুল হোসেন মোক্তার। এই সেই নদী! এ যেন মইনুল হোসেনেরই অন্তর্গত বিস্ময়-উক্তি – এই সেই আধকোশা! আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে যখন বৃষ্টির ঢল নামে, গ্রীষ্মে যখন হিমালয়ের বরফ গলতে থাকে, সারাটা শীতকাল মরে পড়ে থাকা এই নদী তখন হঠাৎ যৌবন পাওয়া নারীর মতো উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে। চোখের পলকে কানায় কানায় ভরে ওঠে তার দেহ। তারপর জিনে ধরা যুবতীর মতো সে খলখল হেসে উঠে প্রান্তর ভেঙে ছুটতে থাকে। ভাঙন! ভাঙনই বটে। যুবতীর শরীরের বস্ত্র যখন খসে পড়ে, দৌড়ের বেগে তার যৌবনবতী নিতম্ব স্তনের হেলন-দোলনে তখন পুরুষজনের শীলতা চুরমার হয়ে যেতে থাকে, কামনা বাসনার মত্ততায় তারা তখন জ্যোৎস্না পাগল হয়ে পড়ে; কিন্তু নদীর এ খর যৌবন তাদের ভীত করে, তারা প্রত্যক্ষ করে ওঠে কেয়ামত, কোরানের সুরায় বর্ণিত সেই ভয়াবহ ঘটনা – যখন পর্বত হবে বিচলিত, যখন মৃত্তিকা হবে বিদীর্ণ, মানুষ তখন দিগ্বিদিকহারা হয়ে ছুটবে – সেই কেয়ামত তখন অনুষ্ঠিত হতে আছে বলে তারা বিস্ফারিত চোখে অবলোকন করবে। তখন আধকোশার বুকে উত্তর থেকে ছুটে আসা প্রবল ঢল, যেন জল নয় অগ্নি! – পাটল তার বর্ণ, পাটল জলে উন্মত্ত ঘূর্ণি, রাতারাতি নদী তখন বিস্তার পায় অর্ধক্রোশ, তখন আধকোশা নামে সত্যকার সে হয়ে ওঠে অর্ধক্রোশব্যাপী, উন্মত্তের মতো পাড় ভেঙে চলে। আর, এ সকলই শুরু হয় গভীর রাতে – যেন ডাকাতের মহড়া; কামানের শব্দের মতো গুমগুম শব্দ ওঠে জলেশ্বরীর আকাশে বাতাসে, ঘুমের ভেতরে মানুষেরা ধড়মড় জেগে ওঠে বিছানায়, চারদিকে রব ওঠে ভীত আর্ত – গেল গেল! ধড়াস্ ধস্ মাটি ভেঙে পড়তে থাকে নদীর বুকে, যেন কতকালের ক্ষুধার্ত সে, বৃক্ষ বাড়ি সড়ক গিলেও উদরপূর্তি নাই তার – আরো আরো আরো চাই। ভাঙতে ভাঙতে গিলতে গিলতে নদী যেন এই জনপদবাসীর মতোই কতকাল মঙ্গার কবলে ছিল; মানুষ যেমন অনাহার সইতে সইতে একসময় পাগল হয়ে যায়, কচুঘেচু যা-ই পায় গোগ্রাসে গিলতে থাকে, কিংবা অনাহার আরো অসহন হয়ে পড়লে মানুষ যেমন মহাজনের ঘরের ওপর চড়াও হয়ে পড়ে, আগুন দেয় চালের গুদামে, লুট করে শস্যের ভান্ডার, নদীও যেন তেমনই।
আধকোশা নদীর ক্ষুধা কী প্রবল! নদীর দক্ষিণ পাড়ে ছিল যে জলেশ্বরী শহর, ছিল সেই মনোরম জনপদ – বৃক্ষ ছিল কত, কতকালের প্রাচীন, ছিল কত বকুল শেফালি নাগকেশরের বিতান, নীলকুঠির দোতলা দালান, মান্দারবাড়ির রাজাদের কাছারি, গুরু ট্রেনিং ভবন, হাইস্কুলের লাল দালান, মহকুমা কাছারির বিশাল অট্টালিকা, রায়বাবুদের জমিদারবাড়ি, সেই বাড়ির সমুখ বাগানে মর্মর পাথরের বিলাতি নারীমূর্তি – সব গ্রাস করে আধকোশা। দক্ষিণ পাড় ভাঙতে ভাঙতে, শহর গিলতে গিলতে এখন আড়াই মাইল সরে এসেছে আধকোশা নদী; আর, এখনো তার ক্ষুধার নিবৃত্তি নাই, নদীভাঙন থামে নাই; প্রতি বর্ষা মৌসুমে এখনো নদী হয়ে ওঠে জিনে ধরা যুবতী, কিংবা মঙ্গার কবলে পড়া মানুষ – খলখল ছুটে আসে, মাটি গিলে খেতে থাকে, শহরের আরো একটি সড়ক কি মহল্লা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়, শহর আরো দক্ষিণে সরে আসে।
কিন্তু কী নির্বিকার মানুষ, আর কী নির্বিকার প্রশাসন। জলেশ্বরীর মানুষ যেন মেনেই নিয়েছে তাদের শহর ভাঙার নিয়তি, আর ইংরেজের সরকারও যেন মনে করে বসে আছে – মানুষ হচ্ছে পশুর সমান, তাদের ভালো-মন্দ দেখার জন্যে সাত সাগর উজিয়ে তারা আসে নাই! এখানেই জলেশ্বরীর মোক্তার মইনুল হোসেনের প্রসঙ্গটা উঠে পড়ে। এই জনপদে নজির হোসেনরা যখন পাকিস্তানের আন্দোলন নিয়ে ব্যস্ত, ডাকবাংলার মাঠে নাজিমুদ্দিন আর সোহরাওয়ার্দীকে নিয়ে ছেচল্লিশের প্রাদেশিক নির্বাচনের আগে বিশাল এক জনসভা করে মুসলিম লীগকে জয়যুক্ত করার স্বপ্নে বিভোর, দিকে দিকে যখন তারা আওয়াজ তুলছে – কবুল মোদের জানপরান, লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান, আর ওদিকে যখন রাজেনবাবুরা গান্ধী নেহেরুর পক্ষে জলেশ্বরীর টাউন হলে নিত্যসন্ধ্যায় সভা করে চলেছে, আর কংগ্রেস থেকে যুবক ভবেশদের আলাদা হয়ে ফরোয়ার্ড ব্লকে যোগ দেওয়া ঠেকাতে দিনরাত শলা-পরামর্শ করছে – ফরোয়ার্ড ব্লকের অফিসঘর দিয়েছে যে বিধবা মহিলা, মুকুলের মা নামেই যার পরিচয়, সেই মুকুলের মাকে বশ করতে না পেরে তার নামে চরিত্রের কুৎসা যখন তারা ছড়াতে শুরু করেছে, সেই কালে মইনুল হোসেন মোক্তার না মুসলিম লীগে, না কংগ্রেসের মাতামাতিতে আছে। সে আছে আধকোশা নদী নিয়ে। এরও একটা ইতিহাস আছে।
উনিশশো পঁয়তাল্লিশের বর্ষাকাল। প্রতিবারের মতো সেবারও আধকোশায় নেমেছে পাহাড়ি ঢল। প্রথমে কিছুই বোঝা যায় না। বৃষ্টি হচ্ছে, দিনমান বৃষ্টি। এ-অঞ্চলে একবার বৃষ্টি শুরু হলে অন্তত তিনদিনের আগে তার বিরাম নাই, কখনো কখনো সাত-সাতদিন। বৃষ্টি শুরু হয় প্রথমে মুষলধারে, তারপর টিপিটিপি গুঁড়িগুঁড়ি, হঠাৎ এক-আধবার আবার সেই মুষলধারে। নদীর পানি বাড়তে থাকে ক্ষীণ মাত্রায়। অভিজ্ঞতা থেকে মানুষ কি শেখে? – শেখে না। কতকাল থেকে মানুষেরা দেখে এসেছে নদী একদিন চন্ডমূর্তি ধারণ করবে অকস্মাৎ, কিন্তু প্রতিবারের মতো এ-বছরও তারা সে-কথা মনে আনে না, মনে করে ওঠে না। জীবনযাত্রা আগের মতোই এক লয়ে চলে। শনি-মঙ্গলে হাট বসে বর্ষার মধ্যেই। জেলেরা উৎসাহী হয়ে ওঠে মাছ ধরতে। বর্ষার কালে মাছ ঠেলে ওঠে নদীতে। বৃষ্টির ছাঁট রোহিত শোল বোয়াল চিতলেরা পিঠ পেতে নিতে ভাসান দিয়ে ওঠে। বড় সুখ বৃষ্টির অাঁচড়ে। মানুষেরও বড় সুখ – বৃষ্টির দিনে গা মুড়ে গোল হয়ে বসতে, বিড়ি টানতে, সিদলের ব্যঞ্জন দিয়ে ভাত মুখে তুলতে। তারপর হঠাৎ মাঝরাতে তাদের সুখের আড়তে আগুনের তপ্ত গোলা ছিটকে পড়ে। কামানেরই গোলা হেন গুমগুম শব্দ ওঠে রাতের সুনসান স্তব্ধতা গুঁড়িয়ে। ধড়াস্ ধস্ মাটি ভেঙে পড়তে থাকে আধকোশার বুকে। আধকোশা যেন দৈত্যের মতো থাবা বাড়িয়ে খাবলে টেনে নিতে থাকে মাটি, একেক গ্রাসে খেতে থাকে আস্ত একটা বটগাছ, ওই একটা বাড়ি, ওই একটা সড়কের পাড়। নদীর প্রান্তঘেঁষা মানুষেরা জেগে উঠে দ্রুতহাতে সরাতে থাকে বাড়ির মালামাল। মায়েরা শিশুদের বুকে তুলে ছোটাছুটি করে আর্তচিৎকার তুলে। এখনো নিরাপদ যারা, তারা ছুটে আসে নদীর পাড়ে। রাতের অন্ধকারও যেন নদীর ওই ভাঙন দেখবে বলে আকাশে রচনা করে ভোরের আগেই ফিকে আলো – আকাশটা হয়ে ওঠে চাপা আলোয় উদ্ভাসিত। সে আলোয় দূর থেকে ছুটে আসা মানুষেরা নদীর ভাঙন দেখে বলাবলি করে – এবার তবে কতটা মাটি নদী খাবে!
কিন্তু মইনুল হোসেন মোক্তারের বাড়ি ছিল নদীর পাড়েই। সেই দুর্ভিক্ষের বছরে, পঞ্চাশের সেই মন্বন্তরের কালেও আধকোশার বিরাম ছিল না, বরং সে-বছর যেন বাংলার মানুষের মতো আধকোশাও ছিল দীর্ঘ এবং আশাহীন অনাহারে; সে-বছর আধকোশা এক লপ্তে পুরো একটা মহল্লাই গিলে খেয়েছিল। মইনুল হোসেন মোক্তারের বাড়িটাও সে-বছর আধকোশার উদরে যায়। সে তার বসত সরিয়ে আনে এখানে, আর এখানে এই পঁয়তাল্লিশ সালে আরো একবার মইনুল হোসেন বর্ষার এক মাঝরাতে জেগে উঠে দ্যাখে নদীর ছোবল তার ভিটের গোড়ায় প্রবল আঘাত হানছে। আমাদের আজকের জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক মকবুল হোসেন তখন মায়ের কোলে দুগ্ধপোষ্য শিশুটি। তাকে কোলে নিয়ে মা ভীতস্বরে চিৎকার করে ওঠে – আল্লা গো! আর বিপরীতে মইনুল হোসেন তীব্রকণ্ঠে গাল দিয়ে ওঠে – হারামজাদি! না, স্ত্রীর প্রতি নয়, নদীর প্রতি, আধকোশার প্রতি। – হারামজাদি, ফির খেপি উঠিছে। এইবার তোরে একদিন কি মোরে একদিন! কত খাবু তুই মাটি! এইবার মুই দেখি নেমো!
চোখের সমুখে নদীর গহবরে তলিয়ে যায় মইনুল হোসেনের ভিটা। টিনের বাড়ি, কোমরভাঙা হয়ে একবার থিরথির করে কাঁপে, নদীর বুকে নত হয়ে পড়ে উত্তর কোণ, যেন জলে মুখ দেখতে বড় সাধ তার, অনেকক্ষণ ওই অমন ভঙ্গিতে স্থির হয়ে থাকে ঘরখানা, তারপর হুঁস করে ডুব দেয় ঘূর্ণিজলে, ঘূর্ণিটা গভীর হয়ে ওঠে মুহূর্তে, যেনবা জলের শরীরে বিপুল এক নাভি রচিত হয়, তারপর চক্কাস করে শব্দ ওঠে, লোলুপ জিহবায় গ্রাস টেনে নেওয়ার শব্দ ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হতে থাকে বহুক্ষণ ধরে। মইনুল হোসেন স্ত্রী পুত্র নিয়ে বন্ধু এক মোক্তার দেবদত্ত বিশ্বাসের বাড়িতে ওঠে। দেবদত্ত বাবুর পসার তেমন নয়, পসারের দরকারও তার নাই, বাপের বিস্তর জমিজমা তার, নদী থেকে মাইলখানেক দূরে পেশকার পাড়ায় তার ঘর। আর সে কি ঘর! টিনের আটচালা, বাইরে বাংলাঘর, পেছনে গোয়াল, সুপারি বাগান, একপাশে মন্দিরও একটা রাধাগোবিন্দের। সেই মন্দিরের বারান্দায় বসে কাছারি ফেরতা মইনুল হোসেন কতদিনই না গল্পগাছা করেছে। একবার তো যখন দুর্গাপ্রতিমা বিসর্জনের সময় গন্ডগোল হলো শহরে – কী না, বিসর্জনের ঢাকবাজনা মসজিদের সামনে হয়েছে – সেই নিয়ে দারোগা পুলিশ, সারা শহরে উত্তেজনা, নজির হোসেনের হুমকি, এইবার দেখি নেমো হিন্দুর ঘরের আস্পদ্দা কতখান আর শালা গান্ধীর কোন জারুয়া ব্যাটা আসে তাদের উদ্ধার করিতে – তখন মইনুল হোসেন পুলিশের কাছে সাফ সাক্ষ্য দিয়েছিল – এ সকল মিছা কথা, মসজিদের সামনে ঢোল বাজে নাই, সক্কল ওই মুসলিম লীগের নজির মিয়ার মিছাও আন্দোলন! একটা ছুতা ধরিয়া বিভেদ ছিরিষ্টির হুজুগ তাঁই তুলিচ্ছে! তখন প্রাণনাশের হুমকি আসে মইনুল হোসেনের। শহরের গুন্ডা মজিবর পুলিশের সাক্ষাতেই বলে, মোক্তার তোমার দিন শ্যাষ, হায়দর শেখের দোকানে যায়া কাফনের কাপড় কিনি রাখো, রাইত না পোহাইতেই দরকার হইবে। কিন্তু হিন্দু দারোগার কাছে মুসলমানের লাশের জন্যে যে কাফন দরকার সেই কাফন শব্দটাই জানা নাই। অতএব, এর কোনো বিহিত করে নাই দারোগা, হুমকিটা শুনানিতে নেয় নাই। হ্যাঁ, প্রাণভয় হয়েছিল মইনুলের। শহরে তখন জিন্নাহ আর পাকিস্তানের উত্তেজনা। মুসলিম লীগের যুবকেরা দিনরাত চোঙা ফুঁকছে – সাবোধান! সাবোধান! মনে হিন্দু মুখে মোছলমান! কবুল মোদের জানপরান! লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান! তখন তাদের দাপট কী! জলেশ্বরীর ডাকবাংলার মাঠে সদ্য মিটিং করে গেছেন খাজা নাজিমুদ্দিন আর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী; আধকোশার রুইমাছ ধরে আর হস্তিবাড়ির বিখ্যাত খাসি জবাই করে তাঁদের আপ্যায়ন করা হয়েছে, ডাকবাংলার কাছে ট্রেন থামিয়ে তাঁদের নামানো-ওঠানো হয়েছে, নদীপাড়ের ঝাউগাছ কেটে গেট বানিয়ে তাঁদের স্বাগত করা হয়েছে, ইংরেজ হাকিম বাটলার সাহেব পর্যন্ত তাঁদের ইয়েস স্যার ভেরি গুড স্যার করেছেন – আর কথা কী! রাজত্ব এখন মুসলিম লীগের! কংগ্রেসের কেউ জলেশ্বরীতে আসে নাই, এমনকি রংপুরের চুনোপুঁটি নেতা ব্রজেন চক্রবর্তীও নয়। কংগ্রেসও যেন জলেশ্বরীতে মুসলিম লীগের জয় আগাম মেনে নিয়েছে। সেই বিসর্জনের বাজনার গন্ডগোলে, হিন্দুর পক্ষে ন্যায্য কথা বলে, প্রাণভয়ে তিন দিন তিন রাত ঘরে থাকে নাই মইনুল হোসেন মোক্তার। শহরের কোনো মুসলমান তার পক্ষে আহা-উহু পর্যন্ত করে নাই। তখন দেবদত্ত মোক্তারই তো আশ্রয় দিয়েছিল মইনুলকে। নদীর গর্ভে মইনুলের ভিটা নাশ হওয়ার পরে সেই দেবদত্তই এগিয়ে আসে, তাকে বলে, আইসো, মইনুল, আইসো, চিন্তা কী! আপদকালে মানুষ মানুষকে না দেখিলে কাঁই দেখিবে! ধীরে সুস্থে জমি দেখিয়া ফির ঘর তোলেন। হামরা তো আছিয়ে!
সেই দেবদত্তের বাড়িতে স্ত্রীপুত্র নিয়ে উঠে মইনুল হোসেন মোক্তার যেন নিজের নতুন ঘর তোলার কথা বেমালুম ভুলে বসে থাকে। ঘর তোলার জন্যে জমি দেখা দূরে থাক, এ-বিষয় যেন অপর কারো সমস্যা, এমত বোধ হয় তাকে দেখে। এমনকি মোক্তারিও তার লাটে ওঠে। আসামি ফরিয়াদি মামলা নিয়ে এসে ফিরে যায়। মুহুরী আবজল মিয়া প্রথমে মনে করে, ভিটা গেছে তাই মোক্তার সাহেবের মাথার ঠিক নাই। কিন্তু অচিরে সেও বড় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। মক্কেল না এলে তারও দুপয়সাই বা আসে কোথা থেকে! একদিন সে খানিক তপ্তস্বরেই বলে, অ্যামন আর কতকাল তব্ধ মারি থাকিবেন? ভাতেরে বা জোগাড় হয় কিসে! উত্তরে মইনুল যা বলে শুনে এতদিনের পুরনো মুহুরী আবজল মিয়া – মোক্তার সাহেবের শত মেজাজের সঙ্গে এত পরিচিত থেকেও – হতবাক হয়ে যায়। – যা, যা, ভাতের জোগাড় না হয়, অন্য ঠাঁই যায়া চাকরি নে! হামার কাছে আর নয়!
গতিক দেখে একদিন দেবদত্তও বন্ধু মইনুলকে বেশ করে হুঁকো সাজিয়ে হাতে তুলে দিয়ে বলে, মোক্তার, অ্যামন করি আর কদ্দিন! ধন্দ মারি থাকা কোনো কাজের কথা নয়। যা গেইছে তা গেইছে। নত্তুন করি ফির শুরু করো। দরকার হইলে মুঁই তোমাক সব সুসার করি দেমো। দম্ ধরি বসি না থাকো। কথাটা শুনেই হুঁকো ফিরিয়ে দিয়ে মইনুল বলে, তোমার হেথায় কি মুঁই ভার হয়া গেইছোঁ? কও তো আইজের রাইত গেলে মুঁই অন্য জাগা চলি যাঁও। – না, না, সে-কথা নোয়ায়, তোমরা ভার হইবেন ক্যানে! থাকেন না, যদ্দিন খুশি থাকেন, মোর এতবড় বাড়ি, দুইটা মানুষের কি জাগা হবার নয়! ভার হয়া গেইছো, এগুলা কী কথা কও? বাড়ির তিনি তো কয়, আহা, মকবুলের মা ঝ্যান হামার মায়ের প্যাটের বুইন। দ্যাখো না, দুই সই মিলি কত আল্লাপ-সাল্লাপ করে, বাগানে ঘুরিফিরি বেড়ায়, মন্দিরে আসি বসে, সে এক দেখিবার শোভা। – তবু মইনুলের মুখে ভাবান্তর না দেখে দেবদত্ত শেষে বলে, তার বাদে শোনো, একখান জমির খবর পাওয়া গেইছে, ডাকবাংলার নিকটে, নদী হতেও দূরে, বাড়ি করিলে দশ বিশ বচ্ছরে নদী না নাগাল পাইবে। জমির দরও শস্তা, মোরে এক মক্কেলের। কন তো বায়না করি দেই, ট্যাকা পরে দিলেও চলিবে।
মইনুলের চোখেমুখে ভাবান্তর নাই। তার কঠিন চেহারা দেখে দেবদত্তর সন্দেহ হয় লোকটার বুঝি মাথাটাই খারাপ হয়ে গেছে। ধীরে সে বাড়ির ভেতরে চলে যায়। স্ত্রীকে গিয়ে বলে, ভিটার যে কী মায়া সে আমি মইনুলকে দেখিয়া আইজ বুঝিলোম। পাগলে না হয়া যায় কি হয়া গেইছে! দেবদত্তর স্ত্রী বাস্তববোধের পরিচয় দেয়। আমরা বহুবার দেখেছি, পুরুষের যখন বুদ্ধিভ্রম হয়, নির্বোধ বলে চিরকালের খোঁটা খাওয়া ঘরের নারীরাই তখন পুরুষের অধিক বুদ্ধির পরিচয় দেয়। দেবদত্তর স্ত্রী বলে, ভিটার মায়ার কথা কী কন? মায়া তো হয় ভিটা পুরানকালের হইলে। এই যে নদীতে তার ঘর গেইছে সে ঘরও তো মোটে দুই বচ্ছর আগের। আরেক ভাঙনে সরি আসি এই ভিটা করিছিল। তার জইন্যে এত মায়া জন্মিবে যে পাগল হয়া যাইবে! – হ্যাঁ, এটা একটা কথা বটে। মইনুলের এ-ভিটা তো মাত্র সেদিনের। দেবদত্তর মনে পড়ে, তখন এত করে বলেছিল সে মইনুলকে – নদীর এত কাছে ফির না ঘর তোলো! নদীর গতিক তো জানো! দুই তিন বচ্ছরেই ফির আসি ছোবল দিবে। নদী নয় তো, গোক্ষুরা সাপ! বিষ ঢালিবেই! – আমরা এখানে একটু থেমে লই; নদীর তবে এ উপমাও হয় – সাপ!
মইনুল কিন্তু দেবদত্তর সে পরামর্শ শোনে নাই। একবার বাড়ি ভাঙনের পর দ্বিতীয়বার সে নদীর নিকটেই বাড়ি তুলেছিল। শুধু সে কেন, অনেকেই; যেন নদীর আছে কী এক মায়া, তার পাড় ছেড়ে দূরে যেতে ইচ্ছা করে না। সাপই তবে! সাপের ফণা ধরা চোখে আছে সম্মোহন, সেই সম্মোহনেই মানুষেরা ফিরে ফিরে নদীর পাড়েই ভিটা গাড়ে। স্ত্রী বলে ঈষৎ তিরস্কার করেই যেন, আর তোমরাই বা মানুষটাকে নিয়া অ্যাতো পড়িলে ক্যানে? আছে, থাউক। সময় হইলে ঠিকে জমি সন্ধান করিবে, ফির ঘর তুলিবে। মনও হামার পড়ি গেইছে। – দেবদত্ত জানে তার স্ত্রী এবার কোনো প্রসঙ্গ তুলবে। দেবদত্তর ঘরে সন্তান নাই। এত জমিজমা, মোক্তারির পয়সা না হয় না-ই হলো, অভাব তো নাই কিছুর – শুধু এক সন্তানের! সেই সন্তানের সুখ বুঝি এই নারী মইনুলের ছেলে মকবুলকে কোলে নিয়ে পেয়েছে। সন্তান যে দিতে পারে নাই দেবদত্ত, জানে, এখন সেই বিষাদমাখা অভিযোগ উঠে পড়বে কথার ফেরে। বরং সে নিজেই উঠে আসে, সরে যায় স্ত্রীর সমুখ থেকে।
পরদিন ভোরে কাছারি যাবে দেবদত্ত মোক্তার, যাবার আগে মইনুলকে বলে, কী হে, ঘরে থাকিবেন, না কাছারি একপাক ঘুরি আসিবেন হামার সাথে। আজ কয়েকদিনই কাছারি যাবার আগে বন্ধুকে এমন ডাক দিত দেবদত্ত, প্রতিবারই জবাব আসত – না, তোমরা যাও। আজ মইনুল তাকে অবাক করে দিয়ে বলে, যামো। একজল্লা অপেক্ষা করো, মুই গোসলটা সারি আসি। চোখের পলকেই প্রায় মইনুল হোসেন তৈরি হয়ে যায়। সেই মোক্তারি পোশাক আজ তার অঙ্গে ওঠে, আধকোশার গহবরে সেই ভিটানাশের পর এই প্রথম। দেবদত্ত খুশি হয় – যাক! এতদিনে তবে ভিটার শোক কাটিয়ে উঠতে পেরেছে তার বন্ধু। এ শোক তো পুত্রনাশের সমান। সন্তানেরও অধিক তবে ভিটাবাড়ি – লোকের কথা তবে সত্য দেখা যায়! দেবদত্ত তার মুহুরী গণেশকে আড়ালে হুকুম করে, যাও, যায়া আবজল মিয়াকে খবর দেও যে, মইনুল মিয়া ফির কাছারি যাইচ্ছে।
কাছারিতে এসে মইনুল মোক্তার সোজা লাইব্রেরিতে ঢোকে, মোক্তারদের উকিলদের এটাই নিত্যকার করণ। এখানেই তারা প্রথমে আসে, এখানেই মক্কেলদের সঙ্গে কথাবার্তা বলে হাকিমের কাছে হাজির হওয়ার আগে, আর মক্কেল বা মামলার তারিখ না থাকলে চেয়ারের ওপর আয়েশে গা ঢেলে, কি প্রাচীন হলে টেবিলের ওপর আধখানা পা তুলে দিয়ে পান তামাক খায়, গল্পগাছা করে। আজও লাইব্রেরি ঘর উকিল মোক্তার মক্কেলে ভরপুর। আবজল মিয়াকেও দেখা যায়, সে বড় উৎসুক মুখে দরজার কাছে, কখন তার ডাক পড়ে – আইসো, কাছে আইসো, কেস কিছু আসিলো কি? অথবা, আবজল, পান দ্যাখো তো! জরদা ঝ্যান না দেয়! কাঁচা গুয়া হইবে। কিন্তু আবজলের দিকে মইনুল আজ দৃষ্টিপাতমাত্র করে না। বরং অনেকক্ষণ সে সমবেত উকিল মোক্তারদের জটলা দ্যাখে চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে, তারপর গলা খাঁকারি দিয়ে উচ্চকণ্ঠে বলে, শোনেন তবে, হামার একখান কথা আছে, ধ্যান করি শোনেন সবায়। মইনুল হোসেন মোক্তারের নামডাক অনেকদিনের। হিন্দু-মুসলমান সকলের চোখেই তার একটা আলাদা সম্মান আছে কাছারিতে। সকলেই ফিরে তাকায় তার দিকে।
মইনুল হোসেন মোক্তার চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। সকলে একটু অবাক হয়। কথাটা তবে গুরুতর, নইলে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াবে কেন? মক্কেল মুহুরীরা নীরব হয়। উকিল মোক্তারেরা নড়েচড়ে বসে। মইনুল হোসেন বলে, কথা আর কিছুই নয়, সর্বনাশা নদীর কথা! আধকোশার কথা! আধকোশার ভাঙনের কথা! এই পাগলিকে শাসন করিবার কথা! আর তারে জন্যে মোর একখান প্রস্তাব আছে। বিশদ তবে খুলিয়া কই। (চলবে)