নদী কারো নয়

সৈয়দ শামসুল হক

 

\ ২৯ \

 

নখের আঁচড়ের মতো নদীর চিকন একটানা একটি রব চরাচরের ওপর দাগ কেটে চলে, আঁকের পর আঁক মকবুলের মনে তার মেয়েটির উদ্ভ্রান্ত মুখ রচনা করতে থাকে, নক্ষত্রের আগুন রেখায় যেন বিন্যস্ত হয়ে ওঠে প্রিয়লির মুখ, রাতের সম্মোহিত গভীরে নদী নয় প্রিয়লিরই কান্না শুনে ওঠে মকবুল। কতকাল সে মেয়েটিকে দেখে নাই। কে তাকে ছিন্ন করে নিয়ে গেলো? ফোনে প্রিয়লির চিৎকার – বাবা, আমাকে এখান থেকে নিয়ে যাও! – এখনো আছাড় খেয়ে পড়ছে তার চারদিকে, ছিন্নপাখা পাখির মতো ঝটপট করছে। ফুঁপিয়ে ওঠে মকবুল। গুমরে গুমরে ওঠে। বারবার মেয়ের নাম উচ্চারণ করে, যেন সে ডাক পাঠায়। নদীর ওপরে ঝুলে থাকা রাত্রিশেষের পাতলা কুয়াশার ভেতরে যেন দাঁড়িয়ে আছে প্রিয়লি, তারই উদ্দেশ্যে মকবুলের বুকের ভেতর থেকে এই ডাক। রাত্রিশেষ? হ্যাঁ, সে এত দীর্ঘক্ষণই বাংলাবাড়ির নদীমুখী বারান্দাতে দাঁড়িয়ে ছিলো। টের পায় নাই নদী ও সময়ের বহে যাওয়া!

এদিকে আমরাও সেই কবে থেকে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছি তার বাবা মইনুল হোসেন মোক্তারের সঙ্গে আধকোশার পাড়ে। চোদ্দই আগস্টের ভোরবেলায় নদীটির ধারালো রুপালি আলো – যেন ঝলসিত খড়গ – এই কি সেই নদী? – এখন পেনসিলের একটি রক্তলাল দাগে হিন্দুস্থানে, তিন দিন পরেই আবার ফিরে আসবে পাকিস্তানে? আমরা মুকুল নামে বালকটিকে ভুলি নাই। তার বিধবা মা চোদ্দ আগস্টের ভোরেই রওনা করিয়ে দেয় পাকিস্তান থেকে, যে-পাকিস্তানের বয়স এখন একবেলাও হয় নাই। এইকালেই বালকটির দেশত্যাগ! আমরা তো  তাকিয়ে ছিলাম তার দিকে, ওই সে আধকোশার পাড়ে। এই নদী পার হলেই হিন্দুস্থান। বাড়ি ছেড়ে আসবার কালে আর কিছু নয়, তার বইখাতা নিয়ে এসেছিলো; বইগুলো পাড়ে নামিয়ে মুকুল দুই হাতে নদীর জল তোলে, আঁজলা ভরে তোলে আর গালের ওপর ঝাপটে ঝাপটে মারে। আহ, শীতল! শীতল হয় চড়ের জ্বলুনি, মুকুল শীতল হতে থাকে। নদীর জলে হাঁটু ডুবিয়ে সে দাঁড়িয়ে আছে, অাঁজলায় জল তুলছে আর গাল ভেজাচ্ছে। আহ্, এই না হলে হিন্দুস্থানের নদী, হিন্দুস্থানের জল! শীতল! কী শীতল! কিন্তু মুকুলের শীতল এই নদীটি যে তিনদিন পরেই পাকিস্তানে ফেরে, ছিন্ন কুমারী হয়েই কি সে ফিরে আসে নাই? আমরা স্মরণ করে উঠবো মইনুল হোসেনের খিস্তিটাও। মুকুল নামে ওই বালক থেকে একটু দূরেই দাঁড়িয়ে ছিলো সে নদীর দিকে নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে; পাকিস্তানের জন্মকাল ছিলো সে-বছর রমজানের শেষে। রোজার মুখে তার ওই বালকের জলপান শিহরণ তোলে, তৃষ্ণা গজগজ করে ওঠে মইনুল হোসেনের। – শালার শালা, কী হইবে মোর রোজা রাখিয়া? কীসের আশায় রোজা? পরকালে বেহেশতে হামাক শরাবন তহুরা পান করাইবে, তারে ঝইন্যে এই নিদয়া খর কালে খাদ্য পানি উপাস? পুটকি মারো মুই রমজানের! আমরা মইনুল হোসেনের মনে ধর্মকর্মের এতবড় বিনাশ দেখে, খিস্তি শুনে, যেন চঞ্চল না হই। জল শীতল কি তাপে উথল – সে বড় উন্মাদ সময় গেছে। আমাদের স্মরণ হবে আজ রাতে এই কথাটিই কুসমির বারান্দায় কন্ট্রাক্টর সাইদুর রহমান আর কুসমির ভেতরেও উঠে পড়েছিলো। – কুসমি রে, জটিলতাখান একবার মালুম করিয়া দ্যাখ। নদীকে বলা হয় নারী। ব্রহ্মপুত্রকে বলা হয় নদ, পুরুষ ব্যাটা তাঁই। আধকোশা যে হিন্দুস্থানে হিন্দুর ভোগে গেইছিলো, তিনদিন বাদে যে ফিরি আসিলো, কুমারী তো না ফিরিলো!

মকবুলও ভাবছে – প্রিয়লি যখন ফিরবে, তার সেই নিষ্পাপ মেয়েটি তো আর ফিরবে না। তবে তাকে কেন উদ্ধার করা? কেন সে তার সমস্ত চেষ্টা ও সাধ্য দিয়ে ঠিকানাটি খুঁজে বের করে প্রিয়লিকে ফিরিয়ে আনবে? কেন সে জলেশ্বরীতে এসেও বাবার মৃত্যুর ঘটনাটির পূর্বাপর সন্ধান ফেলে রাখবে? এ তো শুধু ব্যক্তিগত আর নয়, মকবুলের মনের মধ্যে বাবার ওই পূর্বাপরটি যে বীজ বুনে দিয়েছে একটি উপন্যাসের। ফেলে রাখবে এখন? ছেড়ে যাবে সৃজনের তাড়নাটি? বুকের মধ্যে হাহাকার করে ওঠে মকবুলের। নদী নিস্তরঙ্গ। পৃথিবী শব্দহীন। রাত্রিরও বিগত যৌবন। তবু এখনো নক্ষত্র রয়েছে আকাশে। সন্ধ্যা বা মধ্যরাতের তুলনায় নক্ষত্রগুলো রাত্রিশেষের আকাশে এখন বেশি জ্বলজ্বল করছে। আগুনের অশ্রুফোঁটার মতো দেখাচ্ছে। আর, যেন বড্ড বেশি কাছে নেমে এসেছে মাটির। দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে মকবুলের বুকের গভীর থেকে। নিজেই নিজের কপালে বুলোনোর হাত রাখে সে। বড় নিঃসঙ্গ মনে হয় নিজেকে। এবং অসমর্থ! দেশভাগের ওপর উপন্যাসটি লেখার জন্যে কিছুদিন থেকেই যে মনের মধ্যে সৃজন-যাঁতার ঘরঘর শুনছে, ওই দেশভাগটাই বাবা মইনুল হোসেনের মৃত্যুর কারণ – মৃত্যু নাকি আত্মহত্যা? অথবা হত্যা! হত্যাই কি তাকে করা হয়েছিলো? – ইতিহাসটা জানবার জন্যে মকবুল জলেশ্বরীতে যে এসেছে, অনির্দিষ্টকাল এখানে আছে ও থাকবে, এখন সবই ভেঙে ভেঙে ঝুরে ঝুরে পড়তে থাকে। সে নিজেকে অসমর্থ ও ব্যর্থ মনে করে ওঠে।

অচিরে গলা খাঁকারির শব্দ পায় সে। যদিও খুবই সামান্য ও সংক্ষিপ্ত, তবু বড় বাস্তব ওই শব্দ। নদী তার চোখ থেকে মুছে যায়। নদী বা প্রিয়লির কান্নাটি মুছে যায়। শেষরাতের পাতলা আলোয় জগৎ বড় মূর্তিমান ও প্রত্যক্ষ হয়ে ওঠে তার কাছে। মকবুল পেছন ফিরে তাকায়। – কে? – আমি। – আমি কে? – সোলেমান! তৎক্ষণাৎ সে নির্ণয় করতে পারে না ব্যক্তিটিকে। বারান্দার সমুখে নদীর পানিতে এক ধরনের আলো, ওতেই অনেকদূর পর্যন্ত আবছা স্পষ্ট হয় আছে বটে, বারান্দার পরে ঘরের দরোজার দিকে অন্ধকারটি গাঢ়। আর তার ভেতরেই একটি মানুষ। মানুষটি আরো একবার গলা খাঁকারি দিয়ে ওঠে, এক পা এগোয়। মকবুল তখন চিনে ওঠে। সাইদুর রহমানের কেয়ারটেকার। এই লোকটিই তার দেখভাল করছে এখানে। থাকেও সে এই বাংলাবাড়িরই কোণের একটি ঘরে। হঠাৎ সে এত রাতে? মকবুল বিস্ময়ে প্রশ্ন করে, কী ব্যাপার? – না, কিছু না, বলতে বলতে লোকটি চলে যাওয়ার জন্য দরোজার দিকে ফেরে। কিন্তু চলেও যায় না, দাঁড়িয়ে থাকে, ইতঃস্তত করে, যেন কী একটা কথা তার আছে। তখন মকবুলের ভেতরে হালকা একটা ভয় ফণা ধরে ওঠে, সে শুষ্ককণ্ঠে জানতে চায়, কী! কিছু হইছে, কেয়ারটেকার? বলেই মকবুল অবাক হয়ে যায় হয়েছে-টা তার উচ্চারণে হইছে হয়ে যেতে দেখে! তবে কি কোনো অমঙ্গল আশঙ্কায় সে ছিটকে পড়েছে তার ভাষা অভ্যেস থেকে? সোলেমান বলে, আপনার ঘরের দরোজা খোলা, উঁকি মারি দেখি বিছনাতেও আপনি নাই, আলাউদ্দিন কইলে আপনের কিবা হইছে! – সেও কি জেগে আছে? – জাগি থাকিবার তো কথা নয়, কিন্তু কী করা? তারও তো চিন্তা হয়! – না, আমার জন্যে চিন্তা নেই, আমি ঠিক আছি। ঘুম আসছে না, এই! কিন্তু আপনি? আপনি কেন জেগে? বাংলাবাড়িতেই বা এত রাতে কোন্ কারণে? – সোলেমান তখন জানায়, আপনি, ছার, ভুলি গেইছেন যে এই বাংলাতেই আমি থাকি। – ও! তাই! – মকবুল মুখে বলে বটে, চোখ তার প্রশ্নসংকুল হয়ে থাকে। লোকটি যদি এখানেই থাকে তবে তো রাতের লুঙ্গিটি তার পরনে থাকবার কথা, কিন্তু প্যান্ট! হাওয়াই শার্ট! মকবুল বলে, কোথাও বেরুচ্ছেন বুঝি? – না, ফিরিয়াই তো কেবল আইলোম। – সে কী! – মকবুলের এ-কথার উত্তর দেয় না সোলেমান, রহস্যময়ভাবে মাথা নাড়ে শুধু। – আপনাক্ চা দিতে কই, রাইত তো প্রায় ভোর হয়া আসে, চা খান।

মনে হয় যেন সোলেমানের কথারই অপেক্ষা ছিলো, কথাটা শেষ হতে না হতেই আলাউদ্দিন চায়ের সরঞ্জাম নিয়ে আসে। ততক্ষণে বসবার ঘরে মকবুল এসে বসেছে, একটু ইতঃস্তত করে সোলেমানও এসে বসেছে অদূরে একটা টুলের ওপর। আলাউদ্দিন কেতলি থেকে চা ঢালতে থাকে। যেন সে একটা শিল্প রচনা করেছে, কোনো তাড়াহুড়ো নেই, কাপে চা ঢালা, চিনি-মেশানো, দুধ ঢালা সে এক যুগ নিয়ে করে চলে। তারপর মকবুলকে চা দিয়ে সে নিজেও একটা টুল এনে দরোজার কাছে বসে পড়ে। মকবুল জিগ্যেস করে, আপনিও মনে হয় ঘুমোন নাই, আলাউদ্দিন। – কেয়ারটেকার আইসা আমারে ডাক পাড়লো যে! – তখন সোলেমান বলে, আর কন ক্যানে! ডাক না পাড়িয়া করি কী? হামার তো নিন্দ হারাম হয়া গেইছে, আসিয়া যদি ইয়াকে নিন্দে দেখি, তবে কন মেজাজ ঠিক থাকে! রাইতভোর তালাশ, তালাশে গেইছে! কন্ট্রাক্টরসাব বাড়ি ফেরে নাই। হামার ডিউটি তো বোঝেন! তাঁই বাড়ি ফিরিবে, খাওয়া-দাওয়া করিবে, আমার কাছে তামাম দিনের রিপোট আর হিসাব নিবে, তার বাদে মোর ছুটি। দাসের চাকরি! – মকবুল চায়ে চুমুক দেয়। উষ্ণ পানীয়টি তার গলা বেয়ে নামতেই শরীর চাঙ্গা হয়ে ওঠে, বলে, তিনি বাড়ি যান নাই তো কোথায় গেছেন বলে যান নাই? – সোলেমান দুঃখিতস্বরে বলে, না। কিন্তু মকবুলের চোখে পড়ে সোলেমানের ঠোঁটে অপ্রস্ত্তত ও সংকেতপূর্ণ আবছা হাসি।

অচিরে সোলেমানের কাছে বিবরণ পাওয়া যায়। – খোঁজ করিতে করিতে এদিক আমি দেখি কন্ট্রাক্টর সাবের জিপখান রেললাইনের বগলে, ড্রাইভার মেহেরুল্লা ভিতরে ভোঁ-ভোঁ নিন্দ যায়। ধাক্কা দিয়া তাক্ উঠাইলোম, কইরে সায়েব কোনঠে? আর কোনঠে? তারে কাছে খবর পাই তাঁই কুসমির ঘরে আছে। কুসমির ঘরে! সেই রাইতের দশটা এগারোটা হতে এলা ভোরের ভোর এতখন পজ্জন্ত! বোঝেন তবে! এই সম্বাদ যদি বিবিসাবে পায় তবে অগ্নিকান্ড করি ছাড়িবে। সারা-সারা রাইত হিন্দুমাগীর বাড়িতে! পড়ি গেইলোম আতান্তরে। সব বিভ্রম হয়া গেইলো। বাড়িতে কওয়া যাইতো যে সম্পত্তির ফয়সালা করিতেই কন্ট্রাক্টর সাবে কুসমির ঘরে। তাতে কি মন ঠান্ডা হইতো বিবিসাবের? বোঝেন তো নারীর মন! আগে পুরুষ, তারপরে জমিজিরাত! তবে ইয়ার অন্য রকমও আছে। অনেক নারী আগে সম্পত্তি চায়, তার বাদে সোয়ামি কি আর কোনো ব্যাটা যায় হউক না ক্যানে, আগে হামার বিষয় আশয়! আগে হামার জমিদারি। টাকা-পয়সা! জেওর অলংকার! এ থাকিলে জগতে কি পুরুষের অভাব হয় না হইবে! জানি রাখেন, কুসমিও এই তালের একঝন নারী! জলেশ্বরীর টাউনে বাজারে সক্কলে জানে। কন্ট্রাক্টর সায়েব যতয় মনে করেন না কেনে, কুসমির হাত হতে সম্পত্তি তাঁই একজল্লাও পাবার নন। কুসমি গরমেন্টের অফিসারগুলার মাথা ঘুরাই দিছে দেহ দিয়া। নারীর বিছনায় শুতিছেন কি হয়া গেইলেন নারীর বশ। অফিসারগুলাও বশ হইছে। কিন্তু কন্ট্রাক্টর সায়েব আশা করিয়াই আছে, কুসমি তাকে নিরাশ করিবে না, কুসমি তার বশেই থাকিবে, তাই চেষ্টার বিরাম নাই তার। বোঝোঁ তো মুই সব, এলা তার বিবিসায়েবে বুঝিলে হয়!

মকবুল বুঝতে পারে সোলেমানের উদয় হবার কারণ, কিন্তু তার মাথায় আসে না কন্ট্রাক্টর যে কুসমির ঘরে এ খবরটা পেতে তার রাত ভোর হয়ে গেলো কেন? ধরা যাক রাত বারোটাতেও কন্ট্রাক্টর ফেরেন নাই, তখনই যদি সোলেমান খোঁজ করতে বেরুতো, তাহলে রাত এক দেড়টা নাগাদই তার কাছে পরিষ্কার হয়ে যেতো যে তিনি আছেন  কোথায়। তিন ঘণ্টা পার হলো তবে কিসে? সে কৌতূহলী হয়ে ওঠে এবং এই প্রশ্নটির নখ তার মনের মধ্যে অাঁচড়াতে থাকে। তার চেতনা থেকে প্রিয়লি সরে যায়, কন্ট্রাক্টর-কুসমি-সোলেমান এসে দাঁড়ায়। যে-প্রিয়লির উদ্বেগে তার ঘুম ছিঁড়ে গিয়েছিলো, যে-প্রিয়লির মতো নদীকেও কান্না করতে শুনেছিলো, সেই প্রিয়লির কথা এত দ্রুত সে কী করে আড়ালে ঠেলে দিতে পারে – ভেবে আমরা অবাক হতে পারি, কারণ ব্যক্তিগত আর রক্ত সম্পর্কিত মানুষের চেয়ে অপর মোটেই অধিক আমাদের মনোযোগ পায় না, কিন্তু আমাদের ভুলে যাওয়া ঠিক হবে না যে মকবুল হোসেন ঔপন্যাসিক, এবং কাহিনি রচনার অভ্যাসক্রমেই সে এখন কৌতূহলী।

কিন্তু মকবুল এটাও জানে যে কাহিনি একটা সমুখে ঝুলছে দেখেই ব্যস্ত হতে নাই, তড়বড় করে জেরা করতে নাই, আরামে আলস্যে ধীরে ধীরে গল্পটা বের করে আনতে হয়। আলাউদ্দিন বাবুর্চিকে মকবুল বলে, কেয়ারটেকার সায়েবকেও চা দিন। – ওনি বলেন তো নাই! – সোলেমান বলে, চায়ের নিশা হামার ততখান নাই। – তবু খান। সকালবেলা চায়ের মতো জিনিস নাই। আলাউদ্দিন কাপ আনতে যায়, সোলেমান খোলা দরোজার ওপারে চোখ পাঠায়, বলে, সকাল এলাও হয় নাই। মকবুল হেসে বলে, সকাল হতে বড় বাকিও নাই। মকবুল জানতে চায়, কন্ট্রাক্টর সাহেব রাত কটার মধ্যে বাড়ি ফেরেন? – তার ঠিক নাই। – তবু? সোলেমান মাথা দুলিয়ে বলে, যেন কেউ বিপরীত একটা সময় বলেছে, তারই প্রতিবাদে তার মাথা নাড়া, – না! রাইতের বারোটার ওপারে নয়! তারে মইধ্যে তাঁই বাড়িৎ। – মকবুল দেয়ালের দিকে দৃষ্টি পাঠায়, দেয়ালঘড়ির কাঁটা এখন চারটা চল্লিশ দেখাচ্ছে। মকবুলের মাথার ভেতরে কৌতূহলটা বনবন করতে থাকে। ধরা যাক রাত সাড়ে বারোটাতেও কন্ট্রাক্টর বাড়ি ফেরেন নাই, বেগমসাহেব নিশ্চয় তখন উদ্বিগ্ন হয়ে কেয়ারটেকারকে বলেছেন খোঁজ নিতে কি পথ এগিয়ে দেখতে। সোলেমানের তো অজানা থাকার কথা নয় যে, কুসমির বাড়িতে তার সাহেব মাঝে মাঝেই আসেন, দিনে নয়, আসেন যখন সন্ধ্যাকালেই আসেন। স্বাভাবিকভাবে কুসমির বাড়িতেই আগে খোঁজ নেওয়ার কথা; কিন্তু এদিকপানে আসতেই রাতের তিন চার ঘণ্টা পার করে দেয় সে! কেন?

কুসমিও বড় কৌতূহলী করে রেখেছে মকবুলকে। আধকোশা নদীতে সন্ধ্যার সেই অবগাহন! আধকোশার জল থেকে স্বপ্নবিভ্রমের মতো স্নাত যুবতীর সেই উঠে আসা! যুবতী নারীটিকে সে দেখেছিলো নদী ছিন্ন করে উঠে আসতে তার চুলের ঢল নিয়ে। চুলের সেই বিপুল ঢলে যুবতীর মুখটাই পুরো ঢাকা। ধীরে তার কাঁধ ওঠে। ক্রমে দেহটি জেগে ওঠে নদীজলে। সে পানি ঠেলে ঠেলে উঠে আসে পাড়ে। প্রথমে প্রকাশিত হয় তার ঊরু, ক্রমে শরীরটি  পাড়ে ওঠে। মকবুলের মনে চিত্রটি অঙ্কিত হয়ে আছে। আরো গভীর অঙ্কিত এ-কারণে যে, যুবতীকে মনে হয়েছিলো যেন তার মেয়ে প্রিয়লিই বুঝি নদী ছিঁড়ে উঠে এসেছে, যদিও বাস্তবতা এই ছিলো যে প্রিয়লি এখানে নাই এবং কোথায় যে আছে মকবুলের তা জানা নাই। যখন এই প্রিয়লি-বিভ্রমটা মকবুল নিজেই কাটিয়ে ওঠে আর গাহন থেকে ওঠা ওই যুবতীর বিষয়ে আলাউদ্দিনের কাছে প্রশ্ন করে, এবং যে-বিবরণ পায়, সেটিও মকবুলকে আলোড়িত করে রাখে এবং এখনো রেখেছে। আলাউদ্দিন বলেছিলো ওই যুবতী – কুসমি ছাড়া কেউ না। অসীম সাওস। কাউরে পরোয়া নাই। সানঝের বেলায় গাঙে নামতে ভয়ডর নাই। আল্লা তারে রূপও দিছে, ছার। চক্ষু ধান্দায়া যায়। মুনির মন টলে। দরবেশের আলখাল্লা খুইলা পড়ে। যদি কন, ছামনে তারে আনতে পারি। খবর দিলেই সে আয়া পড়বে! – কুসমিকে এক্ষুনি সে ডাকতে যাবে কি যাবে না, উত্তরের অপেক্ষায় আলাউদ্দিন যে ব্যগ্র হয়ে তাকিয়ে ছিলো, ওতেই মকবুলের কাছে পরিষ্কার হয়ে যায় ইঙ্গিতটা – কুসমি নামে যুবতীটিকে শয্যায় পাওয়া যায় টাকার বিনিময়ে। আর এখন সোলেমানও তাকে নষ্ট নারীই বলছে!

সেই কুসমির ঘরে আজ সারারাত কন্ট্রাক্টর সাইদুর রহমান, তবে নিশ্চয় সেটি সোলেমানেরই ভাষ্যমতে সম্পত্তি ঘটিত কারণে, শরীরের কোনো ভূমিকা এখানে নাই, মকবুল এমনটা প্রথমে ভাবলেও অচিরে সে ধাক্কা খায়। সোলেমান বলে, মন হামার আউলি গেইছে। ভাঙ্গিয়া নাশ হইছে। – আরে, বিষয়ডা কী? চমকিত হয়ে আলাউদ্দিন প্রশ্ন করে। তার দিকে ভ্রূক্ষেপ না করে মকবুলকে উত্তরটা দেয় সোলেমান। – বিষয় হামার মনিব। বিষয় হামার মনিবের সম্মান। – কুসমির ঘরে গেইছে বইলা? মানিকগঞ্জের উচ্চারণে তিক্ত প্রশ্ন করে আলাউদ্দিন। বলে, কুসমি তো কুনো পূজাপাঠের সৎ নারী না, সক্কলেই তা জানে। – মকবুলের দিকে ফিরে সে বলে, আর ছার, আপনেরে তো হেইদিনই কইছি, তার মতো রূপের নারী ছিনেমাতেও নাই। রসগোল্লা ছামনে পড়লে কার না খাইতে লোল্ পড়ে? কন্ট্রাক্টরসাবে যদি কুসমিরে ইচ্ছা করে – লইতে পারে। – এবার আলাউদ্দিন সোলেমানের দিকে ফিরে রুষ্ট গলায় তাকে বলতে থাকে, তহন আমাগো কর্তব্যটা কী? মানীর মান বাঁচায়া চলা। যে আমারে তুমারে পালতে আছে, তার গোপনডা গোপন রাখা। – আবার সে মকবুলের দিকে ঘুরে বসে বলে, আপনে বই কেতাব ল্যাখেন, আপনেরে পরথম দিন থিকাই ভক্তিছদ্দা করি। কথা যে লেইখা প্রকাশ করে, চক্ষু খোলা রাইখা যা সে দ্যাখে তাই তো ল্যাখে, নাকি!

মকবুল অবাক হয় লোকটির বোধ ক্ষমতা দেখে, একজন লেখকের দেখার চোখ আর লেখার কলম সম্পর্কে তার পর্যবেক্ষণটি অনেক পন্ডিতেরও নাই। মকবুল সপ্রশংসদৃষ্টিতে আলাউদ্দিনের দিকে চোখ ফেলে রাখে। এর আগে, বলতে গেলে সেই প্রথম দিনেই লোকটির মুখে তার দেশের বাড়ি মানিকগঞ্জের সেই জমিদারপুত্রের কাহিনিটা শুনেই মুগ্ধ হয়েছিলো মকবুল। সাতচল্লিশে ব্রিটিশ চলে গেলো ভারতবর্ষটাকে হিন্দুস্থান পাকিস্তান করে দিয়ে, মানুষের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে গেলো এক দেশ থেকে আরেক দেশে যাবার; আলাউদ্দিন বলছিলো তার এলাকার জমিদারের কথা, ছিলো তাদের তিনটি ঘোড়া – আমার তখন বাইল্যকাল। সব কথা স্মরণ নাই। তবে ছবিটা মনে আছে। জমিদারের ছোট ছেলে, ছোট ছেলে মানে যুবক তিনি, ছোট কুমার – সেই ছোট কুমার দ্যাশ ছাইড়া যাওনের আগে রাজবাড়ির তিনটা দুধের মতো শাদা ঘোড়ারে মাঠের মইধ্যে খাড়া করায়া নিজের হাতে বন্দুকের গুল্লি কইরা মারলো। নিজের হাতে। কুমারের চক্ষে পানি নাই। কুমারের মুখের চেহারা চেনন যায় না এমন কঠিন। মানুষজনে তাজ্জব। বিষয় কী? ক্যান, নিজের হাতে নিজের ঘোড়া মারেন ক্যান? এই ঘোড়ায় চইড়া না শিকারে যাইতেন! এই ঘোড়ায় না আপনেদের জুড়িগাড়ি টানতো! এই ঘোড়া না ঈদের দিনে পূজার দিনে জরির সাজপোশাকে সাজাইতেন। আর মেলায় আনতেন। আর দৌড়বাজি দেখাইতেন। এখন নিজের হাতে জান কবচ করলেন? মুরুবিবরা তখন কইতো শুনছি, পাকিস্তান মোসলমানের দ্যাশ, হিন্দুর জাগা নাই পাকিস্তানে, এই রকম একটা রব চাইরদিকে।

আলাউদ্দিনও অনুভব করে তার ওপরে মকবুলের সপ্রশংস চোখের আলোটি পড়ে আছে। মহা উৎসাহে সে বলে, কন্ট্রাক্টরসাবে যদি কুসুমিরে লইতেই চায়, তবে এই বাংলাতেই লইতে পারে। হেই কামের লাইগা তারে কুসমির ঘরে যাইতে অয় না। কি কন? বাংলায় মখমলের চাদর, খাট, ইলেকট্রিকের বাত্তি! তা ফালায়া কুসমির ঘর? ভাঙা চকি! মাটির মাইঝা! হেরিকেনের বাত্তি। তার উপরে ঘরে এক বুইড়া। হরিচরণ! তার কাশের ধমকে বিলাই চমকায়। কুসমি দ্যাখতে পরির লাহান হইলেও কন্ট্রাক্টরসাবে তার দিকে ফিরাও দেখপে না, এ আমি তামার পাতে লেইখা দিতে পারি। – তামার পাত! কথাটা ঠাহর করতে পারে না মকবুল। – তামার পাত বুঝলেন না? নরুণ দিয়া তার উপরে একবার লিখলে চিরকালের! কেউ মুছতে পারে না। – কন্ট্রাক্টর সাইদুর রহমান সম্পর্কে আলাউদ্দিনের এহেন অটল ভক্তি ও বিশ্বাস দেখে মকবুল চমৎকৃত হয়। নাহ্, লোকটা নুনের মর্যাদা দিতে জানে। আলাউদ্দিন বলে চলে, খানিকটা যেন সোলেমানকে আঘাত করেই, মনিবের দিকে মন রাখিলে ধর্মও থাকে জগতও চলে। না হইলে সমুদয় বিনাশ! না, ছার, আমার কন্ট্রাক্টর সায়েবের নারীলোভ নাই। – পালটা ঝংকার দিয়ে সোলেমানও ক্রুদ্ধস্বরে বলে ওঠে, আমি কি তাই কইলোম! এগুলা বিবাদের কথা তুলি না আনো আলাউদ্দিনভাই। হামার আইজের রাইত যে কীভাবে কোন সুবাদে কাটিলো তার উদ্দেশ তোমরা পান নাই। – তবে খুইলা কন! এই সায়েবের কাছে গোপন কইরেন না। ইনি বই ল্যাখেন। বই যারা ল্যাখে তারা সত্য কথার কারবারী ভিন্ন আর কিছু নয়।

মকবুল আরো একবার সপ্রশংস এবং চমৎকৃত হয় আলাউদ্দিনের এ-কথা শুনে। সাধারণ মানুষও তবে  এতটা গভীর ও জ্ঞানী হতে পারে বটে! সত্য! সত্য! মুহূর্তে সে নিজের রচনাবলি পরিক্রম করে ওঠে। সত্যটাই কি সেখানে সে লিখেছে, নাকি অসত্যেরই বাখানি ছিলো তার? হ্যাঁ, জনপ্রিয় রচনার তোড়ে সে হয়তো রমণীয় কাহিনিই এতকাল লিখেছে, কিন্তু না, উপন্যাসে মিথ্যার অবতারণা সে করে নাই। যা সে করেছে তা হয়তো বড়জোর এই যে, সত্যের তিক্ততাকে মধুর প্রলেপ মাখিয়ে উপস্থিত করেছে। আর যে-মুহূর্তে সে ঢাকায় কন্ট্রাক্টর সাইদুর রহমানের মেয়েজামাই গফুরের মুখে আভাস শুনে ওঠে যে তার আধকোশা নদীতে তার বাবার মৃত্যুর সঙ্গে হিন্দুস্থান-পাকিস্তানে দেশটি বিভক্ত হয়ে যাবার যোগ আছে, সেই মুহূর্তেই সত্যের দিকে ধাবন তার শুরু হয়। সত্য! সত্য!

মকবুলের মনোগত কথাটারই যেন প্রতিধ্বনি শোনা যায় কেয়ারটেকার সোলেমানের কণ্ঠে। – সত্য? তবে সত্যটাই শুনি রাখেন। মিছা কথার মিঠায় না তাকে মিষ্ট করিমো। মুইও জানোঁ, টাউনের সক্কলে জানে, সায়েবের নারীদোষ নাই। কিন্তুক – মকবুলের দিকে অম্লান মুখ তুলে সোলেমান নাটকীয়ভাবে খানিক থামে, তারপর বলে – কুসমির ঘরেই আইজ তিনি! বোধ করি এলাও তার ঘরেই। তবে আইজ মাঝের রাইতে হামাকে এক আদেশ করে কন্ট্রাক্টর সায়েব! তৎক্ষণাৎ মকবুল সচকিত হয়ে বলে, তবে যে আপনি বললেন তিনি কোথায় সেই খবর নিতে সারারাত আপনি খোঁজ করেন, আর বললেন যে তিনি কুসমির বাড়ি কিনা সেটা আপনি শেষরাতে ড্রাইভারের কাছ থেকে প্রথম শোনেন! – স্খলিত হেসে সোলেমান তখন বলে, মনিবের সম্মান রাখিয়াই চোঠো মিছা কথাটা তখন কইছিনু। আসল বিত্তান্ত হইলো, সায়েব বাড়ি ফেরে নাই দেখিয়া বিবিসায়েবে তো আমাকে তালাশে পাঠাইলো। তার বাদে শুইতে গেলেন তাঁই। জানিয়া রাখেন দুইঝনের – স্বামী ইস্তিরির বিছানা বহুদিন হতেই আলাদা, আর বিবিসায়েবের নিন্দও বড় গভীর। তাঁই নিন্দ গেইলেন, মুইও রাস্তায় নামিলোম। সোজা আসিলোম রেললাইনের কিনারে। দ্যঁাখো সায়েবের জিপ খাড়া। মেহেরুল্লাকে পুছ করিলোম, সায়েব কখন বির হইবে। সে কইলো, মুঁই কি সায়েব যে কখন হামার ভোগের শ্যাষ হইবে তায় তোমাকে জানামো! শুনিয়া মাথা মোর একটায় গরম হয় যে পারিলে উয়াকে নগদে নগদ কববরে গাড়ি থুই! কিন্তু ছিগ্রেটের নেশা হামার। সেও তখনে ছিগ্রেট এক শলা হামাকে দিয়া কয়, খাও! খায়া জুৎ করি বসি থাকো। শলার মুখে ম্যাচখান জ্বালেয়া ধরিছি কি ধরি নাই, পকেটের মোবাইখান বাজি উঠিলো। কন্ট্রাক্টর সায়েব! ফোন দিছে! হ্যালো! হ্যালো!

এতখানি বলে সোলেমান নাটকীয়ভাবে আরো একবার থামে, আলাউদ্দিনকে বলে, চা যদি তোমার কেতলিতে থাকে, হামাক আর এক কাপ দ্যান না কেনে? – আলাউদ্দিন সে বায়না কানে না তুলে অধৈর্য কণ্ঠে বলে, হ্যালো তো কইলেন, সায়েবে কী কইলো? – মকবুল নিজেই কেতলি থেকে চা ঢেলে দেয় সোলেমানকে, দিয়ে সে উৎসুক হয়ে অপেক্ষা করে তার মুখের দিকে তাকিয়ে। চায়ে সড়াৎ করে চুমুক দিয়ে সোলেমান বলে, মুই তো হ্যালো হ্যালো করিয়াই চলিছি, মোবাইলে সায়েবের নামও পষ্ট দেখি, অপরদিক হতে আওয়াজ নাই। নদীর পাড়ে হাওয়ার তোড়! কানের ভিতরে ক্যাবল সোঁ-সোঁ শব্দ শোনোং, কতক্ষণ বাদে ধমকের আওয়াজ! কী রে ছোলেমান! কানে কী তুলা দিয়া আছিস! মোর কথা কানে না যায়? – কাতর হয়া কইলোম, নদীর পাড়ে তো, কথা না পষ্ট আসে। – টাইম নাই! তাঁই কয়। কিসের টাইম? ভাবিয়া না পাঁও। মোবাইল কানে দিয়া আছি তো আছিই। হঠাৎ পষ্ট হয়া গেলো মোবাইলের আওয়াজ। সায়েবে কইলে, বুড়ির চরে কাজী আছে না? – কোন কাজী? – আরে, বিয়া পড়ায় যে কাজী। তার কাছে যা! – কইলোম, রাইত তো অনেক, নিন্দ যায় বুঝি! – নিন্দের গুষ্টি মার। তার ধরি আন। – শুনিয়া হতভম্ব হয়া গেইলোম। বিয়ার কাজী এত রাইতে! তাকে ধরিয়া আনা! সায়েবকে পুছ করিলাম, কোনঠে আনিম! সায়েব চড়াও হয়া কইলে, রেললাইনের পাশে মেহেরুল্লা জিপ নিয়া আছে, কাজীকে আনিয়া জিপে বসেয়া রাখ। তার বাদে দেখা যাইবে। মোবাইল করিলে তাকে আনি হাজির করিও। – এত বলি ফোন কাটি দিলে কন্ট্রাক্টর সায়েব। বোঝেন তবে, কুসমি! বিয়ার কাজী! সায়েব তার ঘরে! সাধে মুই আউলিয়া গ্যাছো? r (চলবে)