নস্টালজিয়া

রত্নমঞ্জুলিকা মুখোটি

আজকাল আমার ভেতরে স্মৃতির আনাগোনা শুরু হয়েছে অদ্ভুতভাবে। যেমন, ভিড় বাসে দাঁড়িয়ে হাঁপিয়ে উঠছি, ঠিক তখনি চোখ ঝাপসা করে বুকের ভেতর উথাল-পাথাল করে উঠল, মুহূর্তে এলোমেলো হয়ে গেল জাগতিক সব কিছু। মরিয়ার মতো বাস থেকে নেমে খুঁজতে থাকি একটা নির্জন জায়গা। যদি একটা ফাঁকা পার্ক নজরে পড়ে যায়, দেরি না করে চলে যাই সেখানে। বসে পড়ি বেঞ্চিতে, চলচ্চিত্রের মতো চোখের সামনে ভেসে উঠতে থাকে আমার হারিয়ে যাওয়া কোনো একটা সময়। পুঙ্খানুপঙ্খ সব দেখতে পাই। শুনতে পাই। আশ্চর্যের বিষয়, বিগত স্মৃতির গন্ধ পর্যন্ত উঠে এসে আমার স্নুায়ুকে জাগিয়ে তোলে প্রগাঢ়ভাবে। এক অপার্থিব ভালো লাগায়
ছেয়ে যায় সমস্ত শরীরমন। নিভৃত হস্তমৈথুনের মতো এভাবেই আমি  আমার স্মৃতির নির্যাস বের করে আনি এক একটা নির্জন দুপুরে ইদানীং।
এসব কথা কাউকে বলি না। লোকে বুঝতেই পারবে না। আর পাঁচটা গৃহবধূর মতোই সংসারে দায়দায়িত্ব, রুটিনমাফিক জীবনের ঘেরাটোপে আটকে থাকলেও এজন্যই ঘর থেকে আমাকে আজকাল প্রায়ই বাইরে বেরোতে হচ্ছে। ব্যাপারটা অনেকটা নেশার মতো। মাঝে মাঝে মনে হয় এসব ঠিক হচ্ছে না। যুক্তি-তক্কো করি নিজের সঙ্গে। কখনো ভাবি বিজনকে কথাটা বলা দরকার; কিন্তু ব্যাপারটা শুনলে ও মস্করা করবে, এটা আমার বদ্ধ ধারণা। এই একান্ত অনুভূতির কেউ মজা ওড়াক তা আমি চাই না। যখন ঘরে থাকি তখন কিছুতেই স্মৃতির প্রজেকশন হতে চায় না। অনেকবার চেষ্টা করে দেখেছি; মাথার ভেতরটায় অন্ধকারের ঢেউ আর শারীরিক অস্বস্তি ছাড়া আর কিছুই হয় না। এই সময়ের প্রকৃতির সান্নিধ্য দরকার। আর সেজন্যই আমার বাইরে বেরোবার আকাক্সক্ষা বাড়তে থাকে ক্রমশ। মেয়েকে নিয়ে ওর স্কুল থেকে ফিরছিলাম, হঠাৎই বুকের ভেতর ঝড় উঠল। টিনুকে নিয়ে সোজা এলাম নিউ আলিপুরে আমার ভাসুরের বাড়ি। আমার জা লিপিকাকে মিথ্যে কথা বললাম – এলআইসি অফিসে একটা জরুরি কাজ আছে, টিনুকে রেখে গেলাম। বিকেল বেলায় নিয়ে যাব। বেরিয়েই ট্যাক্সি নিয়ে নিলাম, ফাঁকা জায়গা খুঁজতে খুঁজতে আউটট্রামঘাটে চলে এলাম। একগাদা পয়সা খরচ হয়ে গেল; কিন্তু এসব ভাবার সময় এখন নেই। বুঝতে পারছি, স্মৃতির মন্থন শুরু হয়ে গেছে। একটা গাছের তলায় এসে বসলাম। চোখ ঝাপসা করে উঠে আসতে লাগল আমার শৈশবস্মৃতি। এত স্পষ্ট। এত স্বচ্ছ। আমি সব দেখতে পাচ্ছি, শুনতে পাচ্ছি টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ…।
সকাল থেকে অঝোরে ঝরছে। এত অন্ধকার যে, ঘরে আলো জ্বালিয়ে রাখতে হয়েছে দিনের বেলাতেও। টিনের চালে অবিরাম ধারাপাত। উঠোনময় জল। তবু মিনি স্কুলে যাবেই। একদিনও স্কুল কামাই করতে চায় না মিনি। ক্লাস এইটে ওঠার পর থেকে ও আরো যেন সিরিয়াস হয়ে গেছে। মা তখনো বিছানায় শুয়ে। মিনি জানে, ওর মা এখন পোয়াতি। কথাটা ঠাকুমার মুখে শুনে শুনে ওর মুখস্থ হয়ে গেছে এতদিনে। মায়ের উঁচু পেটটা দেখতে একদম ভালো লাগে না ওর। ছোট ভাই দুটো এই জল-কাদায় কোথায় যে বেরিয়ে গেছে, সেদিকে কারো কোনো খেয়াল নেই। দিদি গোঁসা করে রান্নাঘরে কাজ করে যাচ্ছে। মিনি রোজের মতো ভাত, ডাল, আলু সেদ্ধ নিয়ে খেতে বসে গেল।
…‘যত ঢং, একদিন স্কুলে না গেলে কী ক্ষতি হতো? দিদি ঝাঁঝিয়ে ওঠে। মিনি চুপ করে খেতে থাকে। দিদি ডালে সম্বর দিতে দিতে বলে – ‘আমি আর কাজ করতে পারব না। মাকে গিয়ে বলে দে।’ … ‘বাবা তো বলে গেছে কাল থেকে রান্নার লোক আসবে? মিনি ফোঁড়ন কাটে – ‘নে, অনেক হয়েছে, কথা না বলে যেখানে যাচ্ছিস যা,’ দিদি খেঁকিয়ে ওঠে। ভিজতে ভিজতে  ঠাকুমা রান্নাঘরের সামনে এসে দাঁড়ান।
… ‘চিনি, মায় কিসু মুখে দিসে?’ মিনির দিদি চিনি কোনো উত্তর দেয় না, খচ্খচ্ করে কুমড়ো কাটতে থাকে।
… ‘হ্যাঁ, দিদি চা-মুড়ি দিয়ে এসেছে, তুমি আবার ভিজতে ভিজতে আসলে কেন?’ মিনি হাত চাটতে চাটতে তাকায়।
… ‘আমার কথা ভাবতে হইবো না, গিয়া দেখো ভাই দুইটা গেলো কোথায়? ইশ্কুল কি আইজ হইবো? এই জল মাথায় কোইরা যাইয়ো না মিনি, ভালো কথা কোইতাসি।’ … ‘তুমি ঘরে যাও’, চিনি আদেশের সুরে ঠাকুমাকে বলল। মিনি থালা তুলে কুয়োতলায় চলে যায়।
ছাতায় কি আর বৃষ্টি মানে। তবু মিনি চলল ইশ্কুলে। চারদিকে জল-কাদা। স্কুলের পাশের নদীটাকে চেনাই যাচ্ছে না। ফুলে-ফেঁপে একাকার, মিনি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কচুরিপানার হুটোপুটি দেখল খানিকক্ষণ। বাড়ি থেকে বেরিয়ে স্বস্তি হয়েছে অনেকটাই। বাড়িতে আজকাল শুধুই ঝগড়া মায়ের আর দিদির। ও কলেজ যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। ওকে নিয়ে নাকি বন্ধুরা মজা করে। এতবড় বয়সে ওর ভাইবোন হওয়ার জন্য। সত্যি সত্যি স্কুল হলো না, রেনি ডে ঘোষণা করে দিলেন বড় দিদিমণি। মন খারাপ করে কাকভেজা হয়ে বাড়ি ফিরল মিনি। বাড়িতে তখন গুঞ্জন চলছে। জেঠিমা, কাকিমা, জ্যাঠতুতো দিদি, বউদিরা সবাই ফিসফিস করছে। ঠাকুমা চেঁচিয়ে বলছেন – ‘ব্যাদনা  যখন উইঠ্যা গ্যাছে, তখন আর দেরি করণ ঠিক হইবো না। রিস্কা ডাকো। সেই মুহূর্তে বাবা এসে ঢুকলেন সারারাত বাসজার্নি করে। মায়ের মুখ যন্ত্রণায় কাহিল। বাবা দেরি না করে মাকে রিকশায় তুললেন, সবাই বেরিয়ে এসেছে। বাড়ির বাইরে। দিদি আর মিনি কাঁদছে, মায়ের চোখেও জল। মা দিদির দিকে তাকিয়ে বলেন – আর রাগ করিস না সোনা। বোনভাইদের দেখে রাখিস …।’ মা আর কথা বলতে পারে না। ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে, সেই দেখে মিনিও সজোরে কেঁদে ওঠে। রিকশা চলতে শুরু করে, মিনির ভাইদুটো ছুট লাগায় রিকশার পেছন পেছন।
খানিকক্ষণ পর মিনি ভাইদের নিয়ে ফিরে আসে। দিদি তখনো কাঁদছে। দিদি যখন কাঁদে, তখন মিনির ওকে খুব সুন্দর দেখতে লাগে। চিনিকে নিয়ে ওর দারুণ গর্ব। দিদিকে দেখতে একদম দুর্গা ঠাকুরের মতো। দিদি কাঁদতে কাঁদতে টুবলু-বুবলুকে জামা-কাপড় ছাড়িয়ে শুকনো পোশাক পরায়। ভাত মেখে খাইয়ে দেয়। মিনি ওদের বলে, ‘চলো, গল্পের বই পড়ি।’ গল্পের নাম শুনে ওরা দুজন সুড়সুড় করে বিছানায় উঠে আসে। মিনি ওদের মধ্যিখানে শুয়ে পড়তে শুরু করে – ‘ভোম্বল সর্দার’। গল্প শুনতে শুনতে টুবলু- বুবলু কখন যেন ঘুমিয়ে পড়ে। মিনি খেয়ালই করেনি। দিদি পাশের খাটে মুখ গুঁজে শুয়ে আছে। দড়াম করে বাইরের টিনের দরজাটা খোলার আওয়াজ হলো। ঠাকুমার গলা শোনা গেল – ‘ও দেবু, বাচ্চা হইয়া গ্যাছে?’ বাবা বললেন – ‘হু’, মিনি তড়াক করে খাট থেকে নেমে বাইরে বারান্দায় ছুটে এলো। বাবা বললেন, ‘মিনির বোন হইসে।’ বাবাকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে। বারান্দায় কাঠের বেঞ্চিটাতে বসে সিগারেট ধরালেন। মিনিকে কাছে ডাকলেন, সে বাবার গা-ঘেঁষে বসে। বাবা ঠাকুমার দিকে হেসে তাকালেন – ‘বুঝলা মা’ বোইনটা না খুব সুন্দর হইব।’ মিনির একটু রাগ হলো,  ঠাকুমা হাসলেন – ‘যাহ্, এখন থিকা মিনির আদর কইমা গেল। বাপে আর সোহাগ করবো না।’
মিনির চোখে জল চলে আসে। দেখে ঠাকুমা বললেন – দেবু তোর এই মাইয়াডা কি কান্দনিটাই না হইসে রে, স্বভাব, বাপরে দেখলেই পাড়া টোকাইয়া কান্দন লইয়া আসে।’ বাবা ওর মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বললেন, ‘দশটা না পাঁচটা না আমার একটা মাত্র মাইজা মাইয়া, তার আদর কমবো ক্যান?’ ঠাকুমা হেসে ওঠেন। দিদি চা এনে বাবাকে দেয়, বাবা দিদির দিকে তাকালেন, ‘ছোটো বোইনটার একটা ভালো নাম ঠিক কর তো চিনি!’ দিদি বলে ওঠে – ‘বরষা’, বাবার মুখে হাসি – বাহ্, খুব সুন্দর নাম’। – আয় আমার কাছে আইসা বস্।’ দিদিকে ডাকলেন। দিদি বাবার অন্যপাশে গিয়ে বসে। দুইবোনের কাঁধে হাত রেখে বাবা ঠাকুমাকে, বললেন – ‘মা, কও তো আমার মতন সুখী আইর কয়ডা মানুষ আছে, লক্ষ্মী-সরস্বতীর মতো দুইডা মাইয়া পাইছি।’ বাবার কথায় মিনির খুব আনন্দ হয়, সব মনখারাপ মুহূর্তে হাওয়া। বাবা কাছে থাকলে মিনির একটুও কষ্ট হয় না, কেমন ভরা-ভরা লাগে। বাবার গায়ের চারমিনার সিগারেটের গন্ধে মনে একটা অদ্ভুত আবেশ আসে। আরামে চোখ বন্ধ করে ফেলে মিনি।
ঘোর কাটাতেই দেখি সন্ধে হয়ে গেছে। টিনুকে নিয়ে বাড়ি ফিরতে হবে। অফিস থেকে ফিরে দরজায় তালা দেখে বিজন চিন্তা করবে। বেরোব সে-কথা ওকে ফোন করে জানাইনি। অবশ্য  সে- অবস্থা তখন ছিল না। ছেলেটা সিগারেট খেতে খেতে যাচ্ছিল দেখে খুব খেতে ইচ্ছে করল। হঠাৎই ডেকে ফেললাম, – ‘একটা সিগারেট হবে?’ ছেলেটি অবাক হয়ে তাকাল, – ‘হ্যাঁ হ্যাঁ।’ পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে একটা দিলো, লাইটার দিলো। জ্বালিয়ে ধন্যবাদ দিলাম। ছেলেটা চলে গেল। যেতে যেতে একবার ঘুরে তাকাল। সুখটান দিতে দিতে গঙ্গার দিকে তাকালাম। অনেকদিন বাদে নদীটাকে খুব নিবিড়ভাবে দেখলাম। ভাসুরের বাড়িতে এসে দেখে, হুলস্থুল পড়ে গেছে। বিজন এখানে উপস্থিত। এলআইসি, অফিসে আমার যে কোনো কাজ ছিল না, বিজন সেটা সবাইকে বলেছে, মিথ্যে কথা বলে আমি কোথায় যেতে পারি এ নিয়ে বেশ ঘোলা হয়েছে এরই মধ্যে। মোবাইল ব্যবহার করি না বলে আবার বিজন গালাগাল দিলো। এদিক-ওদিক ফোনাফুনিও হয়েছে বুঝতে পারলাম। আমি কিন্তু আজ অসম্ভব নির্বিকার। বিজন সোজাসুজি জানতে চাইল – ‘এতক্ষণ কোথায় ছিলা? – ‘আউট্রামঘাটে’ –  তাই’
– ‘কী হয়েছে তোমার?’
– ‘কিছু হয়নি তো। বিজন রেগে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
আমার আট বছরের মেয়ে টিনু ছুটটে ছুটতে এলো – ‘মা আজকে বাড়ি যাব না। জেুার কাছে থাকব।’
– ‘কাল তোর স্কুল নেই?’ – ‘আছে।’ – ‘তবে?’ টিনুর মুখটা করুণ হয়ে গেল। মেয়েটা এখানে সবার সঙ্গে থাকতে খুব ভালোবাসে, বললাম – ঠিক আছে, কাল তো শুক্রবার, একবারে রোববার বিকেলে এসে নিয়ে যাব। ‘আমার জা এসে গম্ভীরভাবে বলল – ‘মিনি তোর সঙ্গে কথা আছে’, টিনু বলল – ‘জেুা, মা আমায় থাকতে বলেছে।’ লিপিকা হাসল – তাই নাকি, যা বাবাকে বলে আয়, ও চলে গেল – ‘তুই কেন আমাকে মিথ্যে কথা বললি বল তো?’ আমি ওর রাগ ভাঙাতে চেষ্টা করি কপট ন্যাকামো মিশিয়ে – স্যরি দিদি, আর কখনো বলব না। আসলে এক পুরনো বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম, – ‘সেটা বললে কি ক্ষতি হতো? মেয়েটা এখন বড় হচ্ছে, এবার একটু সিরিয়াস হ। জানিস, বিজু পুলিশে খবর দিতে যাচ্ছিল। এত দেরি হচ্ছে, একটা ফোন করা কি উচিত ছিল না?’ মোবাইল ইউজ করা কতটা দরকার বুঝতে পারছিস তো। মুখ বুজে সব হজম করলাম। সত্যি দোষ করেছি আমি। ট্যাক্সিতে ফিরতে ফিরতে বিজন কোনো কথা বলল না। রাগ এখনো কমেনি। আমার কিন্তু মজাই লাগছে। ফ্ল্যাটে ঢুকে সোজা বাথরুমে ঢুকে গেলাম। খেয়ে এসেছি তাই রান্নার চিন্তা নেই। অনেকক্ষণ ধরে আয়নায় মুখ দেখলাম। দাঁত বের করে নানারকম মুখভঙ্গি করলাম। তারপর শাওয়ার খুলে মেঝেতে বসে পড়লাম। আরামে ঘুম এসে যাচ্ছিল। … দুমদাম দরজায় ধাক্কা, বিজন সহজে রাগে না, আজ ওকে সামলানো মুশকিল হবে। গা মুছে নাইটি গলিয়ে বাইরে বেরোলাম। বিজন দরজার সামনে দাঁড়িয়ে, আমার হাতটা ধরে ফেলল – ‘কী করছিলে এতক্ষণ বাথরুমে?’ – ‘ঘুমোচ্ছিলাম, হেসে বললাম, বিজন বেশ জোরে আমার কব্জিটা ধরে ঝাঁকাল –  ‘দিস ইজ টু মাচ’।  – ‘উফ্, ছাড়ো লাগছে। গায়ে ঘামের গন্ধ, চান করে এসো।’ বিজন হাত ছেড়ে দিয়ে বাথরুমের দরজা বন্ধ করে দিলো। আমি শোবার ঘরে চলে এলাম। একটু বেশি বাড়াবাড়ি করে ফেলেছি। বেচারা বিজন, এবার রাগ ভাঙাতে হবে। ওকে কীভাবে শান্ত করতে হয় সেটা গত দশ বছরে আমি জেনে গেছি। শরীর-শরীর খেলা মন্দ লাগে না।
বিজন বিছানায় এসে আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ল। ওর গায়ের কাছে সরে এসে গায়ে পা তুলে দিয়ে বললাম – ‘তুমি কি এক্ষুনি ঘুমিয়ে পড়বে নাকি?’ – হুঁ, খুব টায়ার্ড লাগছে। বিকেল থেকে যা গেছে। আচ্ছা সত্যি করে বলো তো, কোথায় গিয়েছিলে? – বললাম তো আউট্রামঘাটে, একটু হাওয়া খেতে গিয়েছিলাম, তবে একা যাইনি।’ বিজন পাশ ফিরে শুলো। আমি ওর ঠোঁটটা কামড়ে দিলাম আচমকা।
– ‘জানো আমি প্রেম করছি? বিজন উঠে বসল -‘মানে?’
– ‘ক্রমশ প্রকাশ্য…’ আমি রহস্য করে বললাম। বিজন হুট করে বিছানা থেকে নেমে ফস্ করে একটা সিগারেট ধরিয়ে বাইরে ব্যালকনিতে চলে গেল। ঘুমে চোখ বুজে আসছে। কখন যেন ঘুমিয়ে পড়লাম।
বিজন অফিস থেকে বেশ তাড়াতাড়ি ফিরল। অসম্ভব ভালো মুডে। ওর গতকালের রাগ কীভাবে ভাঙাব তার প্ল্যান বিকেল থেকেই করে রেখেছিলাম। কারণ আজ সকালে অফিসে বেরোবার সময় ও আমার সঙ্গে একটা কথাও বলেনি। এতদিনে এই প্রথমবার ওকে এতটা বিরক্ত হতে দেখে আমি; কিন্তু বেশ ঘাবড়ে গেছি। দরজা খুলতেই একগাল হেসে বিজন ঘরে ঢুকল, সঙ্গে একজন অপরিচিত যুবক। ওরা এসে সোফায় বসে পড়ল ধপ্ করে। ছেলেটির মুখটা কেমন চেনা চেনা লাগল। কোথায় দেখেছি মনে করতে পারলাম না। বিজন আলাপ করিয়ে দিলো বেশ নাটকীয় কায়দায় – ‘রজত, ও মালবিকা, আমি ওর সঙ্গে আছি গত দশ বছর। আমার প্রিয় বান্ধবী। মেয়েটা বেশ ভালো, তবে একটু ক্ষ্যাপাটে টাইপের – আর মালবিকা ও রজত। আমাদের অ্যাড এজেন্সিতে, নতুন জয়েন করেছে। গ্রাফিক্স আর্টিস্ট। খুব ইন্টারেস্টিং ছেলে।’ বিজনকে না বলে পারলাম না – ‘বাব্বা, এত ভালো মুড, কী ব্যাপার?’ বিজন হেসে ফেলল, – ‘আর বলো না, রজত আজকে আমাকে একটা ফ্যানটাস্টিক বড় তামাক খাওয়ালো, অনেকদিন বাদে খেয়ে এত ভালো লাগছে যে, ওকে ধরে নিয়ে এলাম তোমার সঙ্গে আলাপ করার জন্য।’ বিজনকে এভাবে দেখতে আমারও খুব ভালো লাগছে। বড় তামাক মানে গাঁজা খেলে ও একদম পাল্টে যায় কেমন বাচ্চা ছেলের মতো – আমি সেটা খুব রিয়েলাইজ করি। রজত হঠাৎই অদ্ভুত একটা কথা বলল – কী দারুণ একটা যোগাযোগ। কাল আপনি আউট্রামঘাটে আমার কাছে সিগারেট চেয়ে খেলেন আর আজকে বিজনদাকে গাঁজা খাওয়ালাম। এত ভালো লাগছে, মনে হচ্ছে লটারি পেয়ে গেছি। কাল যখন আপনি আমার কাছে সিগারেট চাইলেন, আমি একটু অবাক হয়েছিলাম; কিন্তু খুব ভালো লেগেছিল। এরকম আন্তরিকভাবে কোনো মহিলা আমার কাছে কখনো কোনো কিছু চায়নি। রাতে শুয়ে আপনার মুখটা ভাববার চেষ্টা করছিলাম। জানতাম, আর কোনোদিন আপনার সঙ্গে দেখা হবে না। একেই মিরাকল বলে। ভাগ্যিস আজ আপনাদের বাড়ি চলে এলাম, নইলে আপনার সঙ্গে দ্বিতীয়বার দেখা না হয়েই আমার পুরো একটা জীবন কেটে যেতে পারত।
রজতের কথা শুনে আমি একদম হতভম্ব। এরকমও হয়। ছেলেটির কথার মধ্যে এমন একটা ব্যাপার আছে, আমরা দুজনেই মুগ্ধ হয়ে শুনছিলাম। – ‘জানো, কাল ওর সঙ্গে … হ্যাঁ শুনলাম তো। তার মানে কাল তুমি একাই গিয়েছিলে হাওয়া খেতে। তবে যে আমায় … বিজন তাকাল আমার দিকে। আমি প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে দিলাম – ‘তোমার জন্যে একটা সারপ্রাইজ আছে। চোখ বন্ধ করো।’ বিজন বাধ্য ছেলের মতো দুহাত দিয়ে চোখ ঢাকে। জোরে জোরে শুনতে শুরু করি – ‘এক-দুই … তিন।’ শোবার ঘরের পর্দা সরিয়ে মুচকি মুচকি হাসতে হাসতে বেরিয়ে আসে আমার ছোট বোন বর্ষা। বিজনের কাছে এসে ওর কানে কু দেয়, বিজন তো ওকে দেখে হতবাক, – ‘আজ তো সবকিছুই ম্যাজিকের মতো মনে হচ্ছে, তুই কখন এলি? আসার তো কথা ছিল না। কার সঙ্গে এলি?’ বর্ষা বলল – এরকম অস্থির  হচ্ছে, কেন? বলছি বাবা বলছি। সকালে তুমি অফিস যাওয়ার পর এসেছি দার্জিলিং মেলে। ট্রেন লেট ছিল। বন্ধুর দাদার বিয়েতে বরযাত্রী এসেছি। কাল বিয়ে। ওরাই পৌঁছে দিয়ে গেছে।
বর্ষা বলল – ‘উফ্ বাবা, অন্ধকারে বসিয়ে রেখে দিদি তুমি আমায় যা মশার কামড় খাওয়ালে না।’ বিজন কী করবে ভেবে পাচ্ছে না। বর্ষার সঙ্গে প্রায় বছরখানেক বাদে দেখা হলো। অনেকটাই যেন বড় হয়ে গেছে। এরই মধ্যে হঠাৎ বিজন বলল – ‘চল সমুদ্রে বেড়াতে যাবি?’ ওর কথার মধ্যে একটা মরিয়া ভাব লক্ষ করলাম। – ‘কী যা-তা বলছ? আমি পরশুদিনই চলে যাব,’ বর্ষা আহ্লাদি গলায় বলল।
– ‘তোকে যেতে দিলে তো যাবি।’
– ‘বা রে, আমার বুঝি কলেজ নেই? বন্ধুর দাদার বিয়ের জন্য কতগুলো ক্লাস মিস হয়ে গেল জানো?’
– ‘রাখ তা তোর কলেজ, ফার্স্ট ইয়ারে কেউ সিরিয়াসলি ক্লাস করে নাকি? বর্ষা ও বিজন নিজেদের মধ্যে কথায় মশগুল। বেচারা রজত একটা বই হাতে বসে রয়েছে। বিজনের কিন্তু সে- খেয়াল নেই। আমার কেমন অস্বস্তি হচ্ছে। রজতকে বললাম, ‘চলো আমাদের ছাদটা দেখিয়ে নিয়ে আসি; ওরা এখন এমন বকবে যে, কাউকে চিনতে পারবে না। ওকে দেখে মনে হলো ধড়ে প্রাণ এসেছে। তক্ষুনি উঠে পড়ল, বিজনকে বললাম – ‘তোমরা আড্ডা দাও, আমরা ছাদে যাচ্ছি।’ বিজন আপত্তি করল না।
দুজনে ছাদে এলাম। দুদিন আগেই যে পূর্ণিমা গেছে, সেটা চাঁদটাকে দেখেই বোঝা গেল।
পরিষ্কার কালো আকাশে গুটিকয়েক তারা আর ভরা চাঁদ। দূরে বাইপাসের আলোর মালা অনেকদিন বাদে দেখলাম। রজত চুপচাপ, মুখে হালকা হাসি। ও একসঙ্গে বেশ কায়দা করে দুটো সিগারেট ধরাল। একটা আমার দিকে এগিয়ে দিলো। দেখে খুব ভালো লাগল। আরাম করে টানতে থাকলাম।
– ছাদে ‘রোজ আনে?’
– ‘না না, তবে প্রথম প্রথম যখন এই ফ্ল্যাটে আসি, তখন আসতাম। এখন আর হয়ে ওঠে না।’
রজত একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। হঠাৎই পকেট থেকে একটা নোট প্যাড আর পেন বের করে হালকা আলোয় মনোযোগ দিয়ে স্কেচ করতে শুরু করে দিলো। ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমার ভেতরেও ওলট-পালট শুরু হয়ে গেল। চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। আবারো আমি কোনো এক বিস্মৃত স্মৃতির তলায় চাপা পড়ে যেতে থাকলাম ক্রমশ … চা-বাগানের ভেতরদিকে সরু পায়ে হাঁটা পথটা সোজা চলে গেছে জঙ্গলে। জঙ্গল মানে লম্বা লম্বা শালগাছ আর কিছু বুনো ঝোপঝাড়। একে ঘন জঙ্গল বলা যায় না। তবু এখানে এলে গা ছমছম করে মিনির। প্রত্যেকবার শীতে বাড়ির সবাই মিলে পিকনিকে আসার একমাত্র জায়গা এই শালপাতা ফরেস্ট। বাড়িতে নতুন কেউ বেড়াতে এলেই মিনিরা নিয়ম করে তাদের এখানে নিয়ে আসবেই। জায়গাটা নিয়ে মিনিদের আলাদা গর্ব। মিনি জানত, সন্তুদাও মুগ্ধ হবে। তাই ও চলে যাওয়ার ঠিক আগের দিন মিনি ওকে এখানকার শেষ আকর্ষণ এই শালপাতা ফরেস্টে নিয়ে এসেছে। গত দশদিনে সন্তুদা ওকে প্রত্যেক মুহূর্তেই নানাভাবে মুগ্ধ করেছে। অবাক করেছে। এবার মিনির পালা, দুপুর থাকতেই মিনি আর সন্তু দুটো সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিল, বাড়ির কেউ খেয়ালই করেনি। বিয়েবাড়িতে যা হয়, সারাদিন হইচই। মিনির জ্যাঠতুতো দিদি মল্লিকার বিয়েতে সন্তু এসেছে কলকাতা থেকে, মল্লিকাদির মাসির ছেলে। এবারের এইচএস দিয়েছে। বছর দুয়েকের বড় হলেও ভাবটা এমন, যেন মিনি ওর সমবয়সী। মিনির প্রথমটা বেশ আড়ষ্ট লাগছিল; কিন্তু এখন দুজনের বেশ ভাব হয়ে গেছে। কাল সন্তুদারা চলে যাবে ভাবতেই মিনির কেমন কষ্ট হচ্ছিল ভেতরে ভেতরে। সাইকেল নিয়ে চুপচাপ হাঁটছিল ওরা পাশাপাশি। বিকেল গড়িয়ে সন্ধে হয়ে গেছে খানিকক্ষণ আগে। একটা বড় চাঁদ বেরিয়ে পড়েছে আকাশের বুক চিরে। সন্তু ডাকল – ‘মিনি’। মিনি তাকাল – ‘থ্যাংকস’, হেসে বলল সন্তু। এই গত দশ দিনে একশবার মিনিকে থ্যাংকস বলেছে সন্তু। সাহেবি স্কুলের আদব-কায়দা নাকি এটা। মিনিরা কখনো কাউকে মুখে ধন্যবাদ জানায় না, এসবের চল নেই এখানে। মিনি বলল, ‘কেন?’ – ‘এত সুন্দর একটা জায়গায় নিয়ে আসার জন্যে। মিনির চোখদুটো আবেগে জলে ভরে গেল। অন্ধকারে নিশ্চয়ই সন্তু সেটা বুঝতে পারেনি। জঙ্গলটা শেষ যেখানে হয়েছে ঠিক সেখানে শুরু হয়েছে ধরণা নদী, উঁচু একটা বালিয়াড়ি পেরিয়েই। সন্তু আর মিনি এসে বসল বালিয়াড়ির ওপর। বাতাসে ধোঁয়াটে বুনো গন্ধ, রোগা শরীর নিয়ে ধরণা বয়ে যাচ্ছে কুলকুল করে, এরই মধ্যে জোৎøায় ভরে গেছে সমস্ত জায়গাটা। মিনি আগে কখনো এরকম সময়ে এখানে আসেনি। একটু ভয়-ভয় করছিল, তবু এখান থেকে যেতে ইচ্ছে করছে না – ‘কী, কথা বলছ না কেন?’ মিনির যে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে, সন্তুদা চলে যাবে কাল ভাবতেই কান্না পেয়ে গেল – ‘তোমাকে ছেড়ে চলে যেতে হবে ভাবলেই মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে …।’ সন্তু মিনির হাতটা আলতো করে ধরে ফেলল। সন্তুদা আর মিনির ভাবনা একরকম। মিনির গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। কানটা কেমন গরম গরম লাগছে, গলার কাছে দলা পাকিয়ে থাকা একটা ব্যথার ভাব, – ‘মিনি চলো না আমাদের সঙ্গে কলকাতায়, ‘মিনি সজোরে ঘাড় নাড়ল -’ নাহ্, সামনের সপ্তাহে মাধ্যমিকের রেজাল্ট বেরোবে। আমি এখন কোথাও যেতে পারব না।’ সন্তু মিনির চোখের দিকে গভীরভাবে তাকিয়েছিল। সন্তু ওর দিকে তাকালে মিনি বেশিক্ষণ ওর চোখে চোখ রাখতে পারে না, কেমন যেন লজ্জা লজ্জা করে, মিনি চোখ নামিয়ে নেয়। সন্তু মিনির গা-ঘেঁষে বসে হাতটা ওর ঘাড়ে রাখে। তারপর হঠাৎই মিনির বুকের ভেতরটা ধক্ করে ওঠে। মিনি চোখ বন্ধ করে ফেলে। সন্তু মিনিকে জড়িয়ে ধরে ওর ঠোঁটে চুমু খায় আচমকা। মিনির এরকম আনন্দ আগে কখনো হয়নি। তবু ওর চোখ দিয়ে জল পড়েছে। বালির ওপর দুজনে শুয়ে পড়েছে কখন যেন। সন্তুদার হাত ছুঁয়ে আছে মিনির হাত। মিনির স্বপ্নের পানসিটা ভাসতে ভাসতে ধরণা নদীর বুকের ওপর রুপোলি রেখা টানতে টানতে এগিয়ে চলেছে দূর থেকে আরো দূরে। শালপাতার জঙ্গলের বনতুলসীর গাঢ় গন্ধ আর সধবা চাঁদের জৌলুসে মাতায়োরা সমস্ত চরাচর মিনিকে যেন বোঝাতে চাইছে, পৃথিবীর বুকে এক একটা সুন্দর মুহূর্ত তার শরীরের রঙিন সুতো দিয়ে যে-নকশা তোলে, তা কখনই মুছে যায় না; কেবল চাপা পড়ে যায় একটার ওপর আরেকটা…
বিজনের এই অহেতুক রাগের মোকাবেলা করতে ইচ্ছে করে না। একই প্রশ্নের উত্তর বারবার দিতে কারো ভালো লাগে? – ‘বললাম তো, রজত কখন চলে গেছে সেটা আমি খেয়াল করিনি। রজতকে ফোন করে জেনে নাও না,’ – ‘এত রাতে ফোন করব না। ছেলেটা কী ভাবল কে জানে?’ রাতদুপুরে এই একটা সামান্য ব্যাপার নিয়ে বিজন সত্যি সত্যি বাড়াবাড়ি শুরু করে দিয়েছে। আলোটা নিভিয়ে দিলাম ইচ্ছে করেই। ভীষণ ঘুম পাচ্ছে। বিজন সঙ্গে সঙ্গে সুইচ অন করে ফেলল। আমার কাছে এগিয়ে এলো। ‘স্যরি বলে’ ওর জেরার হাত থেকে নিস্তার চাইলাম। একটু আগে যে-সুরে কথা বলছিল, এখন সেটা বদলে গেছে। হয়তো আমার চোখের ভাষায় কোনো অব্যক্ত অসহায়তা ওর নজরে পড়েছে। বিজন ছেলে বোঝাবার ভঙ্গিতে পুরনো কথার পুনরাবৃত্তি করে চলে – ‘তোমার যদি কোনো সমস্যা হয়ে থাকে তো খুলে বলো। কিছুদিন ধরে  লক্ষ করছি, তুমি সবসময় কেমন অন্যমনস্ক হয়ে থাকো। আজকে একটা জলজ্যান্ত মানুষ তোমার চোখের সামনে থেকে কখন চলে গেল, সেটা তুমি খেয়ালই করলে না। আমার মনে হয় তুমি আমার কাছে কিছু লুকোচ্ছ। হুট করে চলে গেল আউট্রামঘাটে। বউদিকে, মিথ্যে কথা বলতে তোমার একবারও বাধল না। সত্যি বলছি মিনি, আমার কিন্তু এবার টেনশন হচ্ছে।’ বিজন আমার হাত ধরল। টেনশন করাটা ওর বাতিক। বিজনের জন্য মায়া হচ্ছিল। শত হলেও বিয়ে করা বর তো। একটা সাধারণ ঘটনার জন্যে বিজন – এতটা চিন্তিত হচ্ছে কেন – তবে কি আমার মধ্যে সত্যি সত্যি কোনো অ্যাবনর্মালিটি আসছে? – ‘আসছি বলে চলে এলাম বাথরুমে। চোখমুখে ঠান্ডা জলের ঝাপটা দিলাম অনেকক্ষণ ধরে। নিজেকে জোর করে বোঝালাম – কাল থেকে একদম ঠিকঠাকভাবে চলব। টিনুকে জড়িয়ে ধরে ঘুমোতে ইচ্ছে করছে খুব। ও এতক্ষণে জেন্মার হাতের ওপর মাথা রেখে নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে নিশ্চয়ই। ঘুমোক -। শোবার ঘরে এসে দেখি ততক্ষণে বিজনও ঘুমিয়ে পড়েছে। বিজনের কপালে আলতো করে হাত রেখে মনে মনে বলি, তুমি আর তোমার বেরাদারির সব পুরুষের ওপর আমার অসীম মমতা। তোমরা এত অসহায়। বিজন পাশ ফিরে শুলো। আমি আলো নিভিয়ে চলে এলাম পাশের ঘরে। বর্ষাও ঘুমে কাদা। কাল মেয়েটা চলে যাবে। আমার ছোট্ট বোনটা। আমার গভীর স্রোত আবারো বেরিয়ে আসতে চাইছে। সত্যি সত্যি আমি আজকাল খুব ভালো থাকতে শুরু করেছি। ভেতরের সমস্ত অনুভূতি পুরোদস্তুর কাজ করতে শুরু করে দিয়েছে। একটা অর্ধ-বিকল যন্ত্রকে সারিয়ে তোলার পর প্রথম প্রথম যখন সেটা ঠিকঠাক চলতে শুরু করে তখন তার মালিকের যেরকম তৃপ্তি হয়, আমার এখনকার বোধটা অনেকটা ঠিক সেরকম। হঠাৎই আমার উত্তেজনা বাড়তে শুরু করে দেয়। এ-অবস্থায় চার দেয়ালের মধ্যে নিজেকে আটকে রাখতে আমি পারব না। কিছুক্ষণ আগে বাথরুমে নিজের কাছে যে-প্রতিশ্র“তি দিয়েছিলাম সেসব ভুলে বন্ধ ফ্ল্যাটের দরজা খুলে বেরিয়ে এলাম। নিঃশব্দে একটার পর একটা সিঁড়ি ভেঙে নিচে নেমে এলাম। হাউজিং কমপ্লেক্সের সামনের বাগানের কোণের দিকে এগিয়ে গেলাম দ্রুত, কারণ নাইট ওয়াচম্যানের নজরে পড়ে গেলে ঝামেলা হওয়ার সম্ভাবনা আছে। বাহারি ফুলের ঝোপটার পেছনে গিয়ে নরম ঘাসের বিছানায় বসে পড়লাম। বুকভরে বাতাস নিলাম। ঠান্ডা হাওয়া ছুয়ে দেয় আমার চোখের পাতা আর আমি মুগ্ধ দর্শকের মতো দেখতে থাকি আমারই স্মৃতির  প্রজেকশন।
ঠাকুরমার ঘরের বড়সড় ঠাকুরমঞ্চের সামনে বসে আছে মিনিদের অশীতিপর ঠাকুমা, পরনে সাদা থান, মুখময় ছড়ানো বলিরেখার আঁকিবুকি। গায়ে জড়ানো ঘিয়ে রঙের আলোয়ান। ঠাকুমার মুখে হাসি। ঠাকুমা এখন বক্তা। ওঁর সামনে বসে আছে মিনিরা জ্যাঠতুতো সব মিলিয়ে নয় বোন। অঘ্রানের রোববারের রাতে ঠাকুমা তাঁর ঘরভরতি নাতনিদের নিয়ে নাটাই মঙ্গলচণ্ডীর ব্রত করছেন। মিনির কোলে ওর ছোট্ট বোন বর্ষা। ও অবশ্য এখন ঘুমে কাদা। মিনি বড় বড় চোখে মন দিয়ে ঠাকুমার ব্রতকথা শুনছে।  প্রত্যেক শীতে, মানে অঘ্রান মাসের প্রতিটি রোববারই এই ব্রত ওদের বাড়িতে হয়, মিনি সেই ছোটবেলা থেকে দেখে আসছে। শুনে শুনে মুখস্থ হয়ে গেছে নাটাই মঙ্গলচণ্ডীর ব্রতকথা। তবু যতবারই গল্প শোনে ওর নতুন মনে হয়, এই ব্রতর দিন খুব ভোর থাকতেই মিনি দিদিদের সঙ্গে বেরিয়ে পড়ে ব্রতর উপাচার জোগাড় করার জন্য। সাতটা তুলসীপাতা, সাতটা ছোট কচুপাতা, সাতটা বেলপাতা, সাতটা দূর্বা, একটা আমের পল্লব আর একটা কলাপাতার ওপরের অংশ – ঠাকুমার ভাষায় ‘মাইজ’।
প্রত্যেক ব্রতী আলাদাভাবে সেগুলো সংগ্রহ করে নিয়ে এসে ঠাকুরের বেদির সামনে যে যারটা গুছিয়ে রাখে। মিনির তখন খুব আনন্দ হয়। বিজলির মাঠে যায় ওরা ভোর ভোর থাকতে। ভেজা শিশিরে পায়ের তলা ভিজে যায়, তখন যে কী আরাম লাগে, মিনি সে-কথা ভাষায় বোঝাতে পারে না কাউকে। বাড়িতে চটি পরে হাঁটার বালাই নেই মিনিদের, তা সে শীতই হোক কিংবা বর্ষা। এই ভোরে বেরোনোর আরেকটা আকর্ষণ মিনির আছে। একমাত্র এই সময়ই মিনির কখনো কখনো দেখা মিলে যায় নিশি-বৈরাগীর, লোকটা লণ্ঠন হাতে গান গাইতে গাইতে  যায় -। ‘- হল নিশিভোর, খোলো সবে দোর, ঘুমায়ে আর ভাই থেকো না। জাগো গো শচীমাতা। গৌর হল প্রেমদাদা। ঘরে ঘরে হরির নাম বিলায় রে।’ কী অপূর্ব সেই গানের সুর, কী মিষ্টি বৈরাগীর গানের গলা। মিনির খুব ইচ্ছে করে লোকটার সঙ্গে ওর বাড়ি চলে যেতে, গিয়ে দেখতে ইচ্ছে করে লোকটা কখন বেরোয়। ও কি রাতে একটুও ঘুমোয় না। ও কেন এই ঠান্ডায় এত কষ্ট করে ঘুমন্ত মানুষদের গান শুনিয়ে বেড়ায়, এতে ওর কী লাভ?
ঠাকুমা ব্রতকথার শেষ প্রান্তে চলে এসেছেন – ‘এই ব্রত করলে হারাল পায়, মইল জিয়ে, অস্মরণ রাজার স্মরণ হয়, অবিয়াতির বিয়া হয়, নিজ্জনের ধন হয়, অপুত্রকের পুত্র হয়, নাটাই মঙ্গলচণ্ডীর কৃপায় কারো কোনো অপচয় হয় না। জয় মা নাটাই মঙ্গলচণ্ডী।’ ঠাকুমা গড় হয়ে প্রণাম করে। বর্ষার ঘুম ভেঙে যায়, ও কেঁদে ওঠে। মিনির ঠাকুরের কাছে অনেক কিছু চাওয়ার আছে। মিনি বর্ষাকে নিয়ে দ্রুত নিজেদের ঘরে এসে মায়ের কোলে দিয়ে ছুট লাগায় ঠাকুমার ঘরে। তখনো সবাই প্রণাম করছে মাথা মেঝেতে ঠেকিয়ে। মিনি গড় করে, বিড়-বিড় করে নাটাই মঙ্গলচণ্ডীকে বলতে থাকে। – ‘সন্তুদা যেন চিঠি দেয়, দিদির যেন এই সম্বন্ধটাতেই বিয়ে হয়, টুবলু-বুবলু যেন ভালো রেজাল্ট করে, বাবার টাকার কষ্ট যেন দূর হয়।’ এবার প্রসাদ খাবার পালা। প্রসাদ মানে বাতাসা আকৃতির ছোট ছোট ক্ষীরের চিতোইপিঠে। ঠাকুমার কাছ থেকে সাতটা পিঠে এক একটা ছোট পিতলের থালায় করে নিয়ে ঠাকুরের গেলাসে জল নিয়ে মিনিরা প্রত্যেকে উঠোনে নামে। অন্ধকারে দাঁড়িয়ে পিঠেগুলো এক এক করে খায় তারপর সাতঢোক জল খায়। জল খেয়ে চোখ বন্ধ করে বলে – ‘জোনাকে পোড়ে, আন্ধারে খায়, যে যেই বর মাগে, সে সেই বর পায়।’ তারপর সবাই মিলে সাতঝাঁক উলু দিয়ে ঘরে চলে আসে।
ঠাকুমা তখন বিছানায় উঠে বসেছেন। ঠাকুমার কাজ শেষ। এবার ঘুমোতে যাবেন। মিনিরা সবাই মিলে বড় ঘরটার এদিক-ওদিক ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসে। ঠাকুমা বলেন – ‘ও চিনি, এদিকে শুইনা যাও।’ দিদি ঠাকুমার কাছে আসে। ঠাকুমা বলেন – ‘দেখবা অগো তোমারে ঠিক পছন্দ হইবো, নাটাই মঙ্গলচণ্ডীরে কইসো?’ দিদি বলে – ‘কী বলব?’ – ‘ক্যান বিয়ার কথা।’ দিদি লজ্জা পেয়ে যায় – ‘কী যে বলো। এসব কথা বলা যায়?’ মিনি জানে, দিদির এ-বিয়েতে মত নেই। দিদি বাবুনদাকে ভালোবাসে। বাবুনদা বেশ কিছুদিন হলো পাটনায় চলে গেছে একটা মেডিক্যাল কোম্পানিতে চাকরি নিয়ে। দিদির তাই মন খুব খারাপ। কিন্তু মিনি এখন বুঝতে পারে, দিদির সঙ্গে বাবুনদার সম্পর্কটা স্থায়ী হবে না কখনই। মিনি চায় দিদির খুব ভালো একটা বিয়ে হোক। দিদির বিয়েতে ও খুব আনন্দ করবে। ইস্, এখন যদি সন্তুদা আবার আসে! মিনির যে ওকে খুব দেখতে ইচ্ছে করে। কলকাতার ফিরে যাওয়ার পর আর কোনো যোগাযোগ করেনি। কয়েক মাস কেটে গেছে, একটা চিঠি পর্যন্ত দেয়নি মিনিকে। তবে কি সন্তুদা মিনিকে ভুলে গেছে? মিনির তো ওর কথা সবসময় মনে পড়ে। কান্না সামলাতে পারে না, কুয়োতলায় গিয়ে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে কাঁদতে থাকে।
হাউজিং কমপ্লেক্সের বাগানে অন্ধকারে বসে অঝোরে কাঁদছি, সেটা দেখে বিজন হতভম্ব। ও কখন এখানে চলে এসেছে টেরই পাইনি। আমি যেন ধরা পড়ে গেছি, এত অস্বস্তি হচ্ছে। হাউসকোটের হাতায় চোখমুখ মুছে, মুখে হাসি আনার চেষ্টা করি। বিজনের মুখ অন্ধকারে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি না। তবে দেখে মনে  হচ্ছে ওর চোয়াল শক্ত হয়ে আছে। বিজন কি চিৎকার করে উঠবে? না বিজন একটা কথাও বলল না। ধপ্ করে পাশে বসে পড়ে।
বর্ষারা আজকে ফিরে যাচ্ছে। ওদের সি-অফ করতে শেয়ালদা স্টেশনে এসেছি বিজন, আমি আর টিনু। বর্ষার বন্ধুদের পরিবারের প্রচুর লোক যাচ্ছে। নতুন বউয়ের সঙ্গে বর্ষার দেখলাম ভালো আলাপ হয়ে গেছে। মেয়েটা খুব হাসিখুশি। বিয়ের পর প্রথম শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছে কিন্তু কান্নাকাটির কোনো নামগন্ধ নেই। দিব্যি হেসে হেসে সবার সঙ্গে বলছে। ভাবলাম কলকাতার জাঁকজমক ফেলে আমাদের সেই শান্ত-ছোট শহরে গিয়ে ওকি অ্যাডজাস্ট করতে পারবে? ওখানে তো এখনো সময় যেন থেমে থাকে। ইস্ কতদিন বাড়ি যাই না। এই দলবলের সঙ্গে চলে যেতে খুব ইচ্ছে করছে। কিন্তু সেটা কোনোভাবে সম্ভব নয়। টিনুর এখন পুরোদমে স্কুল চলছে। আমার ঘরসংসার আমি ছাড়া তো অচল, বাবা-মায়ের জন্য মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল, এজন্যে আমার স্টেশনে আসতে ইচ্ছে করে না। এত বছর কলকাতায় আছি, তবু দূরপাল্লার ট্রেন দেখলেই মনটা কেমন ছুটে যায়। বর্ষা অবশ্য বিজনের কাছ থেকে কথা আদায় করে নিয়েছে গরমের ছুটিতে এবার যেতেই হবে। বিজন খুব জোর দিয়ে বলেছে – ‘যাবই যাব’। গত দুদিন বিজন আমার সঙ্গে অদ্ভুত ভালো ব্যবহার করছে। আমার সেই রাতের কাণ্ডকারখানা নিয়ে কোনো প্রশ্ন করেনি কিন্তু ভেতরে ভেতরে যে ও খুব চিন্তিত, সেটা আমি ওর চোখমুখ দেখে বুঝতে পারছি। আমার ইদানীং মনে হয় দাম্পত্য সম্পর্কটা সব মানবিক সম্পর্কের মধ্যে সবচেয়ে ইউনিক সম্পর্ক। আপাত আলাদা দুটো মানুষ যাদের মধ্যে রক্তের সম্পর্ক নেই তারা কীভাবে সারাটা জীবন একসঙ্গে কাটায়। একে অন্যের দুঃখ-সুখের ভাগীদার হয়। অধিকার  ফলায়। ঝগড়া করে। দরকারে একে অন্যকে চূড়ান্ত অপমান করে। অথচ অদ্ভুত এক অদৃশ্য বন্ধনে দুজনেই আবদ্ধ থাকতে চায় প্রাণপণে। এই যেমন আমি চাইলেই পারতাম বিজনকে ছেড়ে কদিন বাড়িঘরে আসতে টিনুর স্কুলের দোহাইটা বাহানা, কারণ অতটুকু মেয়ের পাঁচ-সাতদিন স্কুল কামাই হলে এমন কিছু মহাভারত অশুদ্ধ হবে না। আসলে বিজনকে একা ফেলে গেলে শান্তি পাব না। ঘরসংসার সামলাতে ও এতটাই অপটু যে, আমি জানি, আমি না থাকলে ওর একেবারে ল্যাজে-গোবরে অবস্থা হবে। ট্রেন ছেড়ে দিলো। বর্ষা আসতে আসতে দূরে সরে যাচ্ছে। যতদূর দেখা গেল, দেখলাম বর্ষা হাত নাড়ছে। টিনু খুব কাঁদছে। মেয়েটা আমার মতোই ছিঁচকাঁদুনে হয়েছে, কথায় কথায় কাঁদে, আসলে জিন যাবে কোথায়? ট্যাক্সিতে ফেরার পথে বিজনের মুখটা দেখে ওর ওপর আমার ভালোবাসা কেমন যেন উথলে উঠল। ও তাকাল। চোখে চোখে ভাব বিনিময় করতে চাইলাম। ও বুঝতে পারল না বোধহয়। আমাদের দুজনের মধ্যিখানে বসে টিনু তখন গুনগুন করে কী একটা হিন্দি গানের কলি ভাঁজছে। ওকে দেখে কে বলবে একটু আগেই ও মরাকান্না কাঁদছিল মাসির বিরহে।
বিজন আমাদের গেটে নামিয়ে দিয়ে ট্যাক্সিটা নিয়ে চলে গেল। বলল, একজনের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছে, কী একটা জরুরি দরকার। কার সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছে সে-কথা ও নিজে থেকে না বললে আমি আগ বাড়িয়ে কৌতূহল দেখিয়ে বেশি প্রশ্ন করতে পছন্দ করি না, এটা আমার স্বভাববিরুদ্ধ। জিজ্ঞেস করলে ক্ষতি ছিল না। কিন্তু এই যে বললাম, ভালো লাগে না। বিজন নিশ্চয়ই বলবে, এটা আমি জানি।
ফ্ল্যাটের বন্ধ দরজার সামনে একটা ঢাউস সুটকেসের ওপরা পিয়ালি বসে। ও নাকি এক ঘণ্টা ধরে অপেক্ষা করছে। পাগলি একটা। ঘরে ঢুকেই জানতে চাই ওর এই আনমনের হেতু। ও যেটা বলল সেটা শোনার পর ঘরের পরিস্থিতিটা স্বাভাবিকভাবেই বদলে গেল। টিনুকে নিজের ঘরে গিয়ে জামাকাপড় ছাড়তে বললাম। ও চলে যেতেই পিয়ালিকে চেপে ধরলাম। – ‘সন্দীপনকে ছেড়ে চলে এলি মানে? কী হয়েছে বলবি? ছমাসও হয়নি তোদের বিয়ের, এর মধ্যে কী এমন ঘটল যে বাক্স-পেটরা নিয়ে আমার বাড়ি চলে এলি? পিয়াল বলল -’ আমি সিরিয়াস, এক্ষুনি কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই তাই তোমার কাছে চলে এলাম। দিনকয়েক থাকতে চাই। থাকতে দেবে?’ যেদিন থেকে পিয়ালির সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা হয়েছে সেদিন থেকে দেখছি ওর আমার ওপর অসম্ভব একটা অধিকারবোধ অথচ আমি তো ওর নিজের কেউ নই, এমনকি সমবয়সী বন্ধু পর্যন্ত না। পিয়ালি হস্টেলে আমার রুমমেট ছিল। ও আমার থেকে প্রায় দুবছরের ছোট, আমরা যখন থার্ড ইয়ারে, ওর তখন ফার্স্ট ইয়ার। বড়লোকের মেয়ে, আমার সঙ্গে ওর কোনোদিক থেকে কোনো মিল নেই, তবু পিয়ালি সেই সময় আমাকে অদ্ভুতভাবে আঁকড়ে ধরে ছিল। বললাম – সে তুই যতদিন ইচ্ছা এখানে থাকতে পারিস, তোর বিজনদাকে তো চিনিস, কখনই আপত্তি করবে না। কিন্তু সন্দ্বীপনের সঙ্গে তোর কী এমন প্রবলেম হলো যে … পিয়ালি মুখের কথা কেড়ে নিল – প্রবলেম মানে চূড়ান্ত প্রবলেম। ওর সঙ্গে আমার কোনো কমপেটিবিলিটি নেই, ও শভিনিস্ট মিন … ও ইম্পোটেন্ট জানো?’ পিয়ালি রাগতভাবে আমার দিকে তাকায়। এই কথা শোনার পর আমার আর কিছু বলার থাকল না। পিয়ালি বলল – চান করব। আই অ্যাম স্টিংকিং।’ সুটকেস খুলে নাইটি আর তোয়ালে বের করে বাথরুমে চলে গেল। আমি অসহায়ভাবে সোফায় বসে পড়লাম। পিয়ালির মোবাইল বাজছে। মোবাইলে সন্দীপনের নাম দেখতে পাচ্ছি। বাথরুমের দরজায় ধাক্কা দিয়ে পিয়ালিকে বললাম – ‘সন্দীপনের ফোন’… ভেতর থেকে ওর গলা শুনতে পেলাম। -’ ফোন কেটে দাও। আমার মনে হলো সন্দীপনের সঙ্গে আমার একটু কথা বলা দরকার। ফোনটা নিয়ে ব্যালকনিতে এলাম। হ্যালো বললাম। সন্দীপন চেঁচিয়ে উঠল – ‘হোয়ার্টস রং? তুমি নাকি মার সঙ্গে অসভ্যতা করে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছ? কাম অন পিয়ালি, প্লিজ গ্রোআপ।’ আমি সন্দীপনকে থামিয়ে দিয়ে বললাম – ‘আমি মালবিকা বলছি। পিয়ালি আমার বাড়িতে এসেছে। ও বাথরুমে, তোদের হঠাৎ গণ্ডগোল হলো কেন? কী ব্যাপার?’ সন্দীপন অসহায়ভাবে বলল – ‘মালবিকা, ওকে প্লিজ তুই একটু বোঝা, বিয়ের পর থেকে ও আমাকে, মাকে, বাবাকে কাউকে একদণ্ড শান্তি দেয়নি। ওর যা ইচ্ছে তাই করে বেড়াচ্ছে। আমরা সব মেনে নিয়েছি। কিন্তু বাড়াবাড়ির লেভেলটা যেভাবে বাড়ছে, তাতে ওকে সহ্য করাটাই ইমপসিবল হয়ে দাঁড়িয়েছে। জানিস, আমি রিসেন্টলি খবর পেলাম, বিয়ের ঠিক মাসখানেক আগে ওর নাকি আরেকটা অ্যাফেয়ার হয়েছিল আর সেটা ও এখানে কন্টিনিউ করছে। আমি লোকমুখে খবর পাচ্ছি। ও আমার স্ত্রী, তাই আমার কি এ-কথাটা ওর কাছ থেকে জানতে চাওয়াটা অন্যায়? সকালে জিজ্ঞেস করেছিলাম। কোনো কথার উত্তর দিলো না। দুম করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল – আমি অফিস যাওয়ার পর বাবা জানালেন। সারাদিন মোবাইল অফ। কোনো ট্রেস পেলাম না, এখন বাড়ি এসে শুনি বিকেলবেলা সুটকেস নিয়ে বেরিয়ে গেছে।’ এক নিশ্বাসে সন্দীপন কথা বলে গেল। আমি বললাম – ঠিক আছে দেখছি। তুই চিন্তা করিস না। কলিংবেল বাজাল। ফোন কেটে দিলাম। বিজন এলো বোধহয়। সন্দীপন আমার খুব ভালো বন্ধু। কলেজে আমরা ক্লাসমেট ছিলাম। আমিই পিয়ালির সঙ্গে ওর আলাপ করিয়ে দিয়েছিলাম। দীর্ঘদিন প্রেম করার পর ওরা বিয়ে করেছে।  বুঝতে পারছি না, কার কথা সত্যি। খুব খারাপ লাগছে।
রাতে খাবার টেবিলে বিজনকে বেশ গম্ভীর দেখাচ্ছিল। কী জানি কী হয়েছে। পিয়ালি খাচ্ছিল গোগ্রাসে, ওর নাকি সারাদিন কিছু খাওয়া হয়নি। আমি চুপচাপ ওদের লক্ষ করছিলাম। খেতে খেতেই টিনু ঘুমে ঢলে পড়ছিল। নিজের প্লেট ছেড়ে ওকে নিয়ে শোবার ঘরে চলে এলাম। জামা ছাড়িয়ে বিছানায় চাদর পাল্টে শোয়াতে যতক্ষণ সময় লাগল, তারই মধ্যে বিজন পিয়ালির খাওয়া শেষ হয়ে গেছে। বিজন ঘরে এসে বলল – ‘আমরা ব্যালকনিতে বসছি। তুমি কি আসবে? মেয়েটা এত দুষ্টু, হঠাৎ ড্যাব-ড্যাব করে তাকিয়ে বলল – ‘না,  মা এখন যাবে না, আমায় ঘুম পাড়াবে।’ আমি বলি – কিরে পাজি, এক্ষুনি না তুই ঘুমে কাদা হয়ে গেছিলি, আমাকে খেতে পর্যন্ত দিলি না। টিনু খিলখিল করে হেসে উঠল। বিজন হুট করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। টিনু বলল – ‘মা, এ-গানটা গাও না’। – কোনটা? আট বছর বয়স হয়ে গেল, এখনো গান গেয়ে ঘুম পাড়াতে হয় ওকে। আমার জন্যেই এই বদ্ অভ্যাসটা হয়েছে ওর। অনেকেই বলেছে, অভ্যাসটা ভীষণ গ্রাম্য। কিন্তু কী করব, ছোটবেলা থেকে এই গ্রাম্যতার মধ্যে আমি মানুষ। গাইতে শুরু করলাম –
‘খোকা খুকু ভাইবোনেরা তোদের সাথে ভাব করিবো,
তোদের খেলাঘরের পাশে, আবার আমি ঘর বাঁধিবো,
আবার আমি কিনবো পুতুল, রাঙা বাড়ি পাড়িয়ে তাকে,
হাতে দিয়ে লতাব কাঁকন, সাজিয়ে দেব কুঁচের হারে, তোদের
দেশে পুতুল কুমার,
পাতাল টুপি মাথায় পরে, কলার খোসার পালকি চড়ে,
আসরে হেসে আমার বাড়ী…
তাকিয়ে দেখি টিনু ঘুমিয়ে পড়েছে। রাতের চুল বাঁধার জন্যে আয়নার সামনে এসে দাঁড়ালাম। হঠাৎ মনে হলো আমার এই সাম্প্রতিক মানসিক অভিজ্ঞতার কথা বিজনের কাছে আর গোপন করে রাখা উচিত নয়। আজকে পিয়ালির উপস্থিতিতে ওকে বলে দেবো। ও হয়তো বিশ্বাস করতে চাইবে না। হাজারটা যুক্তি দেবে। স্মৃতি রোমন্থন করাটা মানুষের স্বাভাবিক একটা ধর্ম। এর মধ্যে অসাধারণত্ব কিছু নেই; কিন্তু আমার ব্যাপারটা যে একদম অন্যরকমভাবে ঘটছে। সিনেমার মতো অতীতের এক একটা ঘটনা আমি পুঙ্খানুপুঙ্খ দেখতে পাচ্ছি, শুনতে পাচ্ছি। তবু আমি ওকে বোঝানোর চেষ্টা করব। নির্জনতা ছাড়া আমার স্মৃতিরা আসতে চায় না। আসবে বলে জানান দেয় যখন, তখনই আমি অস্থির হয়ে উঠি, রীতিমতো শারীরিক অস্বস্তি হয়। প্রকৃতির সান্নিধ্য খুঁজি আর কোনো কিছু না ভেবেই আমি প্রায় প্রায় ঘর থেকে বেরিয়ে পরি। বুঝতে তো পারছি, বিজন আমার এ-আচরণ নিয়ে রীতিমতো চিন্তিত। ওকে অযথা চিন্তার হাত থেকে মুক্তি দিতে চাই। ব্যালকনির দরজায় এসে দাঁড়াতেই বিজন ও পিয়ালির চাপা গলায় কথোপকথন কানে এলো। দাঁড়িয়ে পড়লাম, ওদের কাছে আর যাওয়া হলো না।
শুনলাম বিজন বলছে –
– ‘মালবিকা যে কীসব কাণ্ডকারখানা শুরু করেছে, ভাবতে পারবে না।’
– ‘কেন, কী করছে আবার?’
– ‘সত্যি পিয়ালি, ওকে নিয়ে আমি আর পারছি না। হুটহাট বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। কোথায় যায়, কেন যায়, আমাকে কিছু জানায় না। টিনু আমায় কমপ্লেন করেছে, ওর স্কুল ছুটি হয় ১টায় আর ও স্কুলে পৌঁছায় দুটোয়।’
– ‘তুমি জিজ্ঞেস করো না, কোথায় যায়?’
– ‘জিজ্ঞেস করলে উল্টোপাল্টা বলে। আমার অফিসের এক কলিগ ওকে একদিন আউট্রামঘাটে বসে থাকতে দেখেছে।’
– ‘ও কি আবার প্রেমে পড়ল নাকি?’
– ‘না না, সেসব কিছু নয়। এর মধ্যে হঠাৎ একদিন রাতে দেখি বিছানায় নেই। ফ্ল্যাটের দরজা খোলা। ছুটে নিচে গেলাম। গিয়ে দেখি ও বাগানে চুপ করে বসে কাঁদছে। আমার অবস্থাটা ভাবো।’
– ‘ওর কি কোনো সাইকোলজিক্যাল ডিসঅর্ডার হলো নাকি?’
–  ‘হুঁ, আমারও তাই মনে হচ্ছে …’
– ‘সাইকিয়াট্রিস্টের সঙ্গে কনসাল্ট করো ইমিডিয়েটলি, আমার মনে হয় ইটস অ্যা কেস অব স্কিৎসোফ্রিনিয়া।’
– ‘আজ ডাক্তারের অ্যাপো. নিয়ে এলাম। কাল নিয়ে যাব।’
– ‘জানো, আমার মনে হয় ওর তখন চাকরিটা ছাড়া ঠিক হয়নি। কাজের মধ্যে থাকলে …’ – ‘ওই তো  তখন বলল চাকরির আর বাচ্চা মানুষ একসঙ্গে করতে পারব না। আমি ভাবছি ডাক্তার দিয়ে ওকে নর্থবেঙ্গল পাঠিয়ে দেবো ওর বাবা-মায়ের কাছে। আমার পক্ষে ওকে সারাদিন চোখে-চোখে রাখা সম্ভব নয়। শারীরিক অসুস্থতা এক জিনিস, ওষুধ খাওয়ালাম, সেবা করলাম; কিন্তু মনের  অসুখ সারানো আমার ক্ষমতার বাইরে।’
– ‘আর টিনু? ওর কী হবে?’
– ‘সেটাই তো চিন্তার, মেয়েটা ওর ওপর বড় বেশি ডিপেন্ডডেন্ট।’ ভাবছি বউদির কাছে রেখে আসব। আমার বউদি ভীষণ রেসপনসিবল। ওকে যথেষ্ট কেয়ার করবে।
ওদের কথা চলতে থাকল, আমি চলে এলাম বেডরুমে, বিজনের কথাগুলো কানে বাজছে। ঘুমন্ত মেয়েটার দিকে তাকাতেই ভেতরটা টন্টন্ করে উঠল। চোখ ফেটে জল বেরিয়ে আসতে চাইছে। মনে পড়ে গেল ঠাকুমার সে-কথাটা – ‘ভ্যাঁৎ কান্দুনি স্বভাব, বাপরে দেখলেই পাড়া টোকাইয়া কান্দন লইয়া আসে …।’ আয়নার সামনে এসে দাঁড়ালাম। নিজেকে লক্ষ করলাম ভালো করে। তবে কি আমরা সত্যিই পাগল হয়ে যাচ্ছি? হঠাৎই সশব্দে কেঁদে উঠলাম। আমার কান্না শুনে টিনুও জেগে গেল। উঠে বসে আমাকে দেখে ঠোঁট ফুলিয়ে কেঁদে উঠল। ঝাপসা চোখে আয়নায় দেখতে পাচ্ছি দূরে বিজনের প্রতিবিম্ব। ও হয়তো আমার কান্না শুনেই দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। ওর চোখে আতঙ্কের ছাপ, না বেদনার ছাপ সেটা ঠিক বুঝতে পারলাম না।…