নারীর জীবন ও সম্ভ্রম

মাসুদুল হক

 

ইজ্জত

সেলিনা হোসেন

 

দেশ পাবলিকেশন্স

ঢাকা, …

 

২৮০ টাকা

 

 

 

সেলিনা হোসেন বাংলাদেশের ছোটগল্পে একটি অনিবার্য নাম; অনিবার্যতা তাঁর বিষয় নির্বাচন, গঠনরীতি ও ভাষাভঙ্গিতে। বাংলাদেশের সামাজিক সংকটময় আবর্ত, মেরুদন্ডহীন রাজনীতি, সন্ত্রাস, সামাজিক অবক্ষয় এবং মধ্যবিত্ত জীবনের ক্লেদই শুধু তাঁর গল্পের বিষয় নয়, তাঁর গল্পে মনস্তাত্ত্বিক চেতনা নিয়ে বাঙালি নারী শাশ্বত বিষয় হয়ে উঠেছে। শুধু নারীবাদী বিবেচনা নয়, নারীর সার্বিক অস্তিত্ব ও মর্যাদা অভিন্ন মন্ত্রে তাঁর ছোটগল্পের মূল সুরে পরিণত। নারীর আপসহীন মনন, সম্ভাবনা, জীবন-মনস্তাপ, অন্তর্দ্বন্দ্ব, দারিদ্র্য, অসহায়তা, গ্লানি, দ্রোহ, প্রতিবাদ, কামনা-বাসনা, জীবন-যন্ত্রণা ও জটিলতা তাঁর গল্পের বিষয়। দক্ষ শিল্পীর কারুকাজে মনস্তাত্ত্বিক চেতনাপ্রবাহে তিনি নারীর অস্তিত্ব নির্মাণ করে চলেছেন, যা দাঁড়িয়েছে শক্ত ভিতের ওপর এক ব্যতিক্রমী রীতিতে। চিরন্তন গল্পের পাশাপাশি তাঁর গল্পকে নারীবাদী গল্প বললে একবিংশ শতাব্দীর মনন ও মেজাজ স্পষ্ট হয়ে ওঠে আরো বেশি করে।

ইজ্জত গল্পসংকলনে সেলিনা হোসেনের নারীবাদী ধারার তেরোটি গল্প অন্তর্ভুক্ত। গল্পগুলোর কেন্দ্রবিন্দু নারী, নারীর জীবন ও তার অনুভব। গ্রামীণ ও শহুরে নারীর সংগ্রাম, বেঁচে থাকা ও অনুভবের সমান্তরাল বয়ান  উঠে এসেছে এ-গ্রন্থে। ‘সন্ধিক্ষণ’ গল্প নানি-নাতনির শ্রমজীবী জীবন আর নিম্নবিত্ত জীবনে সন্ত্রাসের রূপের অপরূপ কাহিনি। নানি হাসিরুন বিবি আর নাতনি ফয়জুন্নেসা। গ্রামে বেড়ে ওঠা নানি তার মায়ের কাছে শুনেছিল, ‘মানুষ রে বুজা কঠিন রে মাইয়া। মানুষের ভালোমন্দের জায়গা বুঝা সহজ না।’ তাই হাসিরুন বিবির মা তাকে জীবনমন্ত্র শিখিয়ে দেয়, মানুষ নয় পাখিকেই ভালোবাসা প্রয়োজন। কেন এ-প্রয়োজন? এর উত্তর পায়নি হাসিরুন। তবে হাসিরুনের মা মৃদু হেসে বলেছিল, ‘জীবন দিয়া বুঝবি।’ সেলিনা হোসেন এর বিস্তার আরো ঘটান এভাবে : ‘হাসিরুনের মনে হয় একাত্তর বছর বয়স হলেও ও জীবন দিয়ে বুঝতে পারেনি। ওর বোঝার সাধ্য শেষ হয়ে এসেছে। ও নিজে জানে না যে, আর কতদিন লাগবে ওর মানুষের কথা বুঝতে! ওর মা কেন মানুষকে বাদ দিয়ে পাখিকে ভালোবেসেছিল!’ কেন এই ভালোবাসা? মানুষ তার মনুষ্যত্বকে বর্জন করে পশু হয়ে উঠছে। মানুষ তার প্রকৃত অস্তিত্বকে হারিয়ে ফেলছে। এই চরম সত্যই গল্পকার আবহমান গ্রামীণ মানুষের সরল উক্তি দিয়ে প্রকাশ করেন। সেইসঙ্গে গল্পকার ‘বীজ কুঠরি’ প্রতীকে নারীর সতীত্ব ও কৌমার্যের গূঢ় তাৎপর্য তুলে ধরেছেন আঞ্চলিক ভাষা ও লোকসংস্কৃতির প্রয়োগে। দৃষ্টান্ত : ‘শুধু কুঠরিতে রাখলেই বীজ ভালো হয় না। বীজ রাখার জন্য নিয়ম মানতে হয়। নাতনি রে বীজ রাখা সহজ কাজ না। বীজ রাখার নিয়ম আছে। পোকায় খাওয়া বীজ রাখলে কী আর ফসল হবে। পোকায় খাওয়া খারাপ বীজ দিয়ে বিয়ের সংসার-ফসল হবে না। তুই বলেছিস বিয়ের বীজ তোর কুঠরিতে নাই। পুষ্ট আর দানাদার বিয়ার বীজ চাই তোর কুঠরিতে। কুঠরিতে বীজ রাখার আগে ভালোভাবে শুকিয়ে নিতে হবে। ভেজা বীজ রাখলে সেটা নষ্ট হবে নাতনি। ওহ নাতনি – বীজ রাখার নিয়ম মানতে হবে।’

‘যুদ্ধক্ষেত্র’ গল্পে মুক্তিযুদ্ধের বীরাঙ্গনা সুরবালার যুদ্ধ-পরবর্তী মানসিক ভারসাম্যহীনতা ও যুদ্ধ-নির্যাতনের স্মৃতি অসাধারণ দক্ষতায় চিত্রিত হয়েছে। সেলিনা হোসেনের কলমে আমাদের জাতীয় জীবনে ঘটে যাওয়া যুদ্ধ, ভাষা-আন্দোলন কিংবা ইতিহাস কি লোকসংস্কৃতি নিপুণ শিল্পীর তুলির অাঁচড়ের পরিবর্তে শব্দ তুলির সম্ভারে ফুটে ওঠে। তাঁর হাতে যে-কোনো একক চরিত্র অনন্য এক মহত্ত্বপূর্ণ চরিত্রে রূপান্তর ঘটে। এমনই একটি চরিত্রের উদাহরণ বীরাঙ্গনা ‘সুরবালা’। গল্পে লেখকের অসাধারণ বর্ণনা লক্ষ করা যাক : ‘সুরবালা জোরে জোরে বলতে থাকে, বৈশাখ-বৈশাখ। ঝড় ছিল না। আকাশে মেঘ ছিল না। ঝড় উঠেছিল ওর জীবনে। ওকে চ্যাংদোলা করে জিপে উঠিয়েছিল সৈনিকগুলো। ও লাত্থি দিয়েছিল একজনের পিঠে। ওরা ওকে রাইফেল দিয়ে চেপে রেখেছিল। ও থুতু ছিটিয়েছিল। ওর মুখটা বুট দিয়ে চেপে রেখেছিল। ওহ্ বৈশাখ, বৈশাখ। পঁচিশে বৈশাখ।

 

দিনটি মনে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সুরবালার শরীরে গুড়গুড় শব্দ হয়। শব্দ ওকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। ওর মনে হয় পতাকার মতো উড়ছে ওর শাড়ির অাঁচল। বাতাসের প্রবল ঝাপটা উড়িয়ে নিয়ে যেতে চায় ওকে। কালবৈশাখি ধুলোয় ভরে ফেলেছে চারদিক। ঘূর্ণির সঙ্গে উড়ছে শুকনো পাতা। জমা হচ্ছে ওদের পায়ের কাছে। বাতাসের ধাক্কায় সুরবালার কপাল ঠুকে যায় গাছের কান্ডে। গাছ অাঁকড়ে ধরলে মাথাটা ঘুরে ঘুরে ঠুকতে থাকে কান্ডের সঙ্গে। মেয়েটি সুরবালার রক্তাক্ত মাথা নিজের বুকে চেপে ধরে বলতে থাকে, ‘মাসী-মাসী-মাসী গো। মেয়েটি দেখতে পায় সুরবালার শাড়ি খুলে যাচ্ছে। কোমরের সঙ্গে হালকা গিট্ঠু দিয়ে আটকে রাখা শাড়ি যে-কোনো ঝাপটায় খুলে যাবে। মেয়েটি বুঝতে পারে না যে ও কী করবে। চেঁচিয়ে বলে, মাসী তুমি ন্যাংটো হয়ে যাচ্ছো। মাসী গো -। মেয়েটি কাঁদতে শুরু করে।’

‘আকালির স্টেশনের জীবন’ গল্পে বেঁচে থাকার দায়ে বেশ্যা হয়ে ওঠা আকালির অনুভব উঠে এসেছে। যে-আকালি     জীবন-সংগ্রামে ভরা যৌবনেই বার্ধক্যের অবস্থা অনুভব করে। সে বুঝতে পারে, জীবনের বোঝা টানা মানুষের সাধ্য নয়। টানতে গেলে জীবনটা ছিঁড়ে যায়, ছেঁচড়াতে ছেঁচড়াতে দু-পা বেয়ে রক্ত নামে। এ-অনুভব শুধুই কি একজন বেশ্যার। এ-অনুভবের ভেতর দিয়ে নারীর নিরাপত্তাহীন জীবনের দায় উঠে আসে। দগদগে রক্তস্রোতে নারীর বঞ্চনার চিত্র তুলে ধরেন সেলিনা হোসেন তাঁর ‘আকালির স্টেশনের জীবন’ গল্পে।

‘ইজ্জত’ গল্পে গ্রামীণ নারী মালেকার আশ্চর্য মানসিক দৃঢ়তা ও মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ গল্পটিকে নারীবাদী গল্পের ভিন্নমাত্রায় নিয়ে গেছে। বাস্তবে মৃত মালেকাকে মৃত্যুর পর অনুভবী মানুষে রূপান্তর করেছেন গল্পকার। মৃত মালেকা নদীতে ভাসতে ভাসতে ভাসছে। এক পর্যায়ে জাদুবাস্তবের মতোই মালেকা তার স্বামীর বাড়ির ঘাটে এসে দাঁড়ায়। তখন সন্ধ্যা। চুলোয় অাঁচ দিচ্ছে তার স্বামী লতিফের বড় বউ। ভাত ফুটছে। বারান্দায় বসে হুঁকো টানছে লতিফ। এমনি করে মালেকা জীবন্ত হয়ে ওঠে। পাঠক বাস্তব না কল্পনা – এমন একটা ঘোরের জগতে ঢুকে যেতে থাকে। ইতোমধ্যে মালেকা সবার কাছে মিথে পরিণত হয় আর মালেকার স্বামীর বড় বউ, মালেকার মৃত্যুর পর থেকে যে-কিনা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত, সে হঠাৎ করেই সন্ধ্যায় অধ্যাসে ভোগে। সে সত্যি সত্যি যেন মালেকাকে দেখতে পায়। চেঁচাতে চেঁচাতে বলে, ‘মালেকা! মালেকা! গলাকাটা মালেকা!’ গল্পের মধ্যে এক অসাধারণ জাদুবাস্তবতার পরিবেশ তৈরি করে ফেলেন গল্পকার সেলিনা হোসেন। দৃষ্টান্ত :

বড় বউ চেঁচাতে চেঁচাতে বলে, মালেকা! মালেকা! গলাকাটা মালেকা!

ধমক দিয়ে ওঠে লতিফ, খামোশ! চুপ করো।

অন্যরা চেঁচায়, কোথায়? কোথায়?

ঐতো – ঐতো – ঐখানে – ঐখানে –

লতিফ লাফ দিয়ে গিয়ে চুলের মুঠি ধরে। ধামধম কিল-চড় লাগায়। মাটিতে গড়িয়ে পড়ে বড় বউ। জ্ঞান নেই।

অনেক রাতে বারান্দায় বসে থাকে লতিফ। শুনতে পায় কেমন একটা ফিসফিস কণ্ঠ, আপনের কাছে কী আমার অপরাধ ছিল?

উহ্, মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করছে। উঠতে গিয়ে মাথাটা বারান্দার খুঁটিতে ঠোক্কর খায়, চমকে ওঠে লতিফ, সেই কথাগুলো যেন আরো স্পষ্ট হয়ে কানে বাজছে। তোলপাড় করছে চারদিক। তখন ও নিজের অজান্তেই বলে, মাইনকা তোমার দিকে হাত বাড়াইছিল ক্যান? তুমি ভাবছিলে আমার বয়স বেশি। বুড়ো হয়ে গেছি। না?

না, আমি তা ভাবব ক্যান? আপনের জন্য তো বয়স বেশি না, আমার জন্য বেশি। আপনের সঙ্গে আমার বয়সের বত্রিশ বছরের তফাৎ।

বেটা মানুষের আবার বয়স কী?

বাতাসে হাসির হল্লা শোনা যায়। লতিফ দ্রুতপায়ে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়। ওর গা ছমছম করে। মনে হয় উঠোনে কেমন একটা ছায়া নড়ছিল। ও বুকে থুতু দেয়। আসলে সব মনের ভুল। হারামজাদি বেঁচে থাকতে একটা নষ্ট মেয়ে ছিল, মরেও নষ্টই হয়ে গেল।

মালেকা সে-বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে। রাত-দুপুর। চারদিকে চাঁদের আলো জীবনকালে এত রাতে এমন চাঁদের আলো ও দেখেনি। ওহ্ কী সুন্দর এই দুনিয়া – ওর দীর্ঘশ্বাস ছুটে যায় চারদিকে। তারপর মাঠে মাঝখানের তালগাছের নিচে বসে পড়ে ও। কতদিন এই গাছটির দিকে তাকিয়ে ভেবেছিল, এখানে এসে দুদন্ড দাঁড়াবে। দেখবে গাছটা কত উঁচু? দেখবে আকাশ কত বড়? কিন্তু বাড়ি থেকে বেরোবার জো ছিল না। শোবার ঘর, রান্নাঘর, গোয়ালঘর, পুকুরঘাট – এই তো ছিল ওর প্রতিদিনের দুনিয়া। এখন ওর চারদিক কেমন ফকফকে – তুলোট মেঘের মতো ছেঁড়াছেঁড়া, অনায়াসে লুকোচুরি খেলা যায়। ও বালিকার মতো গোল্লাছুট খেলায় মেতে উঠতে চায়। পারে না। মন খারাপ হয়ে থাকে।

মৃত মালেকা সমস্ত গল্পজুড়ে দাপিয়ে বেড়ায় জ্যান্ত মানুষগুলোর ওপর। যেন গ্রামের মানুষগুলোর বিবেকের ঘরে ঘণ্টা বাজাতে থাকে মিথিক চরিত্র এই মালেকা। মালেকা চরিত্রের মধ্য দিয়ে স্বামী-স্ত্রীর বয়সের তারতম্য বিষয়ে নারীর অনুভব, ইজ্জত বিষয়ে নারী আর পুরুষের যে চিরায়ত ধারণা তার বেদিতে দারুণ কুঠারাঘাত হেনেছেন গল্পকার সেলিনা হোসেন। নারীবাদী গল্পের মধ্যে জাদুবাস্তবতা প্রয়োগের এটা এক অনন্য দৃষ্টান্ত।

এছাড়া ‘পা ও গ্রেনেড’ গল্পের সামিনা, ‘অনুভব’ গল্পের তানিয়া ও মনিমা, ‘হৃদয় ও শ্রমের সংসার’ গল্পের ফুলবানু – এরা সবাই বাংলাদেশের শহুরে ও গ্রামীণ নারীর এক একটি প্রতীক, যে-প্রতীকের মধ্য দিয়ে গল্পকার সেলিনা হোসেন সমকালীন নারীর মনস্তত্ত্ব, অনুভব, সংগ্রাম ও জীবনপ্রবাহের দলিল রচনা করেছেন, যেখানে নারীবাদী চিন্তা-দার্শনিক মননে আমাদের পাঠক-সত্তায় সম্বিত ফেরায়। গল্পগুলো হয়ে ওঠে বাংলাদেশের নারীর জীবন ও চেতনার সারসংগ্রহ।