নিসর্গে অন্তর্হিত হৃদয় ও আনুষঙ্গিক

এস এম সাইফুল ইসলাম
গভীর বিষাদে আচ্ছন্ন আজ মানুষের মন। নগর, সভ্যতা ও যান্ত্রিক কোলাহল আমাদের সহজাত বোধ ও সূক্ষ্ম অনুভূতি ক্রমশ ধ্বংস করে চলেছে। প্রকৃতির সঙ্গে বাড়ছে মানুষের দূরত্ব। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মানুষের কল্যাণে অনেক কিছুই করেছে সত্যি, কিন্তু একই সঙ্গে প্রকৃতি ও মানুষের মাঝে গড়ে দিয়েছে অগুনতি দূরত্বের দেয়াল। ইট-পাথরের দেয়ালঘেরা শহর মানুষকে অনেকটাই কাবু করে ফেলেছে। কাবু হওয়া কিছু মানুষ প্রকৃতির বিরুদ্ধে নেমেছে লোভাতুর দানবের মতো। এর কারণ আমাদের অজানা নয়। আইন থাকার পরও আইনের যথাযথ প্রয়োগ না হওয়ায় এবং প্রশাসনের উদাসীনতার ফলে অবাধে গাছকাটা, বনভূমি উজাড় করা, ইটের ভাটায় লো-গ্রেডের কয়লা ও টায়ার পোড়ানো, কালো ধোঁয়া, নদীর নাব্যতা হ্রাস করে চিংড়ি চাষ, জলাশয় ও নদী ভরাট, পাহাড়কাটা, অধিক হারে বন্যপ্রাণী ও পাখি নিধন, কৃষিভূমিতে কীটনাশকের ব্যাপক ব্যবহার এবং শিল্প-কারখানা ও ট্যানারির বর্জ্য আমাদের স্বাভাবিক পরিবেশকে উদ্বেগজনকভাবে বিপর্যস্ত করেছে।
বিশিষ্ট শিল্পী হামিদুজ্জামান খানের জলরঙে অাঁকা মনোরম নিসর্গচিত্রের সামনে দাঁড়িয়ে ভাবছি আমাদের প্রাকৃতিক পরিবেশ আজ কীভাবে বিপন্ন হতে চলেছে। সম্প্রতি গ্যালারি কায়ায় শিল্পীর ‘জলরং ও ভাস্কর্য’ শীর্ষক একটি একক শিল্পকর্ম প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। ২৪ মে থেকে ৬ জুন পর্যন্ত। তাঁর কাজ বিশেষত জলরঙে অাঁকা ল্যান্ডস্কেপ বা নিসর্গচিত্র আমাদের চমৎকৃত করে। তিনি গোড়া থেকেই প্রকৃতি ও নিসর্গের নানাবিধ অনুষঙ্গে মজে আছেন। সময় ও সুযোগ বুঝে প্রায়শ ভ্রমণ করেন দেশ-বিদেশের নানা মনোমুগ্ধকর স্থানে। ইমপ্রেশনিস্ট শিল্পীর মতো দুচোখ ভরে দেখেন প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য ও আলোছায়া; বস্ত্তত ওই দেখার মূল্যবান অভিজ্ঞতা ও আবেগের রসায়নে সৃষ্টি হয় শিল্পীর নিসর্গ-উপজীব্য চিত্রসমূহ।
হামিদুজ্জামানের প্রধান পরিচয় ও প্রতিষ্ঠা ভাস্কর হিসেবে, কিন্তু এখানে উল্লেখ্য, তাঁর শিল্পচর্চার মূলভিত্তি তৈরি হয়েছে অঙ্কন ও চিত্রায়ণ বিদ্যায় শিক্ষালাভ এবং দীর্ঘ অনুশীলনের মধ্য দিয়ে। ফলে চিত্রকর হিসেবেও তাঁর বিশিষ্টতা গুরুত্বের দাবি রাখে। জলরঙের প্রতি তাঁর প্রবল ঝোঁক। নিরবচ্ছিন্ন সাধনায় এই মাধ্যমে তিনি বহু আগেই স্বাতন্ত্র্য ও সিদ্ধি লাভ করেছেন। তাঁর সাম্প্রতিক প্রদর্শনীর বিশাল অংশজুড়ে রয়েছে জলরং চিত্র, অল্পসংখ্যক অ্যাক্রিলিক চিত্র ও ভাস্কর্য। শিল্পীর জলরঙে অাঁকা নিসর্গচিত্রে আমরা প্রত্যক্ষ করি – জোয়ার-ভাটায় পরিবর্তনশীল নদী ও সমুদ্রের বিবিধ অভিব্যক্তি, নীল আকাশে পেঁজা তুলার মতো শুভ্র মেঘের ওড়াউড়ি, রৌদ্রস্নাত বালুকাবেলা, নদীর ধারে গজিয়ে ওঠা ঝোপঝাড়, রাত্তিরে জেলেদের ভাসমান নৌকায় কেরোসিনের কুপিতে জ্বলা মায়াবী আলো, তপ্ত দুপুরে জনমানবহীন তটে ছোট্ট নৌকোর একাকিত্ব, পাহাড়চূড়ায় সন্ধ্যার নীরবতা ইত্যাদি।
পরিপ্রেক্ষিত নির্মাণে হামিদুজ্জামান প্রকৃতি অবলোকন করেন কখনো পাখির চোখে, কখনো অনেক দূরের সমতল থেকে, কখনো উঁচু পাহাড়ের সানুদেশ ও পাদদেশ থেকে। পরিপ্রেক্ষিতের এই বিচিত্রতা তাঁর নিসর্গচিত্রে অনেক ক্ষেত্রে প্রচ্ছন্নভাবে নাটকীয়তা তৈরি করেছে, বিষয়টি দর্শকের জন্য নিঃসন্দেহে উপভোগ্য ও দৃষ্টিসুখকর হয়ে ওঠে। আরেকটি বিষয় উল্লেখ্য, হামিদুজ্জামানের নিসর্গচিত্রে মনুষ্য ফিগার অনেকটাই অনুপস্থিত। কদাচিৎ মনুষ্য ফিগারের দেখা মিললেও তা আবছা অবয়বের মতো প্রকৃতির সঙ্গে মিশে থাকা। বোধ করি তিনি প্রকৃতির অন্তর্গত নৈঃসঙ্গ্য ও নীরবতার সৌন্দর্যকে বেশি ভালোবাসেন।
প্রায়োগিক ক্ষেত্রে তাঁর জলরঙে স্বচ্ছ ও অস্বচ্ছ এই দুই পদ্ধতির দেখা মেলে। কখনো রঙের স্বচ্ছতা বজায় রেখে কয়েকটি ওয়াশে তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন প্রত্যাশিত দৃশ্য ও অনুষঙ্গ। এক্ষেত্রে একটি রঙের ওয়াশের ওপর পরবর্তী রঙের ওয়াশের সম্মিলনে সৃষ্ট কোমল। অনুভূতিময় আমেজ অসামান্য। রাত্রিকালীন নিসর্গচিত্রে দেখি আইভরি কালো ও আলট্রামেরিন নীলের শক্তিমত্তা এবং তা একই সঙ্গে শিল্পীর বিশেষ দক্ষতাও নিরূপণ করে। হামিদুজ্জামান তাঁর শিল্পগুরু হিসেবে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন ও শিল্পী মুস্তাফা মনোয়ারের নাম কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করেন। আলাপকালে জানা যায়, তাঁর জলরঙের ক্ষেত্রে এই দুই শক্তিমান শিল্পীর অবদান সবচেয়ে বেশি।
নিসর্গচিত্রের কম্পোজিশন সাধারণত আনুভূমিক হয়ে থাকে। কারণ তা চিত্রের অন্তর্গত পরিসরের ব্যাপ্তি বাড়িয়ে দেয়। মালদ্বীপ ও ভুটানের নদী, সমুদ্র ও পাহাড়বেষ্টিত প্রকৃতি শিল্পীর জলরং চিত্রে আনুভূমিক কম্পোজিশনে চমৎকার ব্যঞ্জনা পেয়েছে।
নিসর্গের পাশাপাশি হামিদুজ্জামানের অন্য একটি প্রিয় বিষয় মানুষের মুখাবয়ব। শিল্পীজীবনের শুরুর দিকে তিনি অসংখ্য বাস্তবানুগ প্রতিকৃতি চিত্র এঁকেছেন। অবশ্য প্রদর্শনীর ‘মুখাবয়ব’ শীর্ষক সিরিজ চিত্রসমূহ নিরীক্ষাধর্মী। জলরঙে অাঁকা এসব চিত্রে বিভিন্ন লোকজ মুখোশ, আদিবাসী শিল্প ও আফ্রো-এশীয় শিল্পের প্রতিফলন ঘটেছে। অ্যাক্রিলিক মাধ্যমের কয়েকটি চিত্রে অনুষঙ্গ হিসেবে বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযোদ্ধা, সুন্দরবনের গোধূলি ও আদিবাসী নারী ফিগার প্রতিভাত হয়েছে। বিষয় ও শৈলীর কারণে চিত্রগুলো প্রদর্শনীতে ভিন্নমাত্রা যোগ করেছে। কয়েকটি ব্রোঞ্জে নির্মিত ভাস্কর্যের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা, নারীমুখ ও পাখির সরল অবয়ব পরিলক্ষিত হয়।
শিল্পমাধ্যম হিসেবে জলরং ও ভাস্কর্য একটি অন্যটি থেকে ভিন্নতর। একটি কোমল এবং অন্যটি কঠিন। শিল্পী হামিদুজ্জামান খান এই দুই ভিন্নধর্মী মাধ্যমে সাফল্য অর্জন করেছেন। তাঁর এই সাফল্যের পেছনে রয়েছে শিল্পীর মেধা, পরিশ্রম, দক্ষতা ও নিরবচ্ছিন্ন সাধনার যোগ। উল্লেখ্য, বাংলাদেশে আধুনিক ভাস্কর্যশিল্পের চর্চা ও বিকাশে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে হামিদুজ্জামানের ভাস্কর্য যেমন স্বীকৃতি লাভ করেছে, তেমনি জলরং মাধ্যমেও তিনি তৈরি করেছেন একটি স্বতন্ত্র ও সমৃদ্ধ চিত্রভাষা।
বিনয়ী ও সজ্জন এই শিল্পীর দীর্ঘায়ু ও উত্তরোত্তর সাফল্য কামনা করি। 