পটেশ্বরী

শঙ্করলাল ভট্টাচার্য

তৃতীয় অ্যালবাম

এক

অনেকগুলো চিঠি তো লেখা হলো অ্যাদ্দিনে। সারাক্ষণ মনটা কু গায় মারি আঁতোয়ানেতের।

শেষ অবধি মেয়েটাকে খুনই করল ভিক্টর!

আমি প্রথম দিন থেকে রুখে দিতে চেয়েছিলাম ওদের ঢলাঢলি। কই পারলাম?

কী না কী সম্বন্ধ দেখেছি মেয়ের! একটাও মানল? সেই জোর করে ওই চাল নেই, চুলো নেই ভিখিরি ডাক্তারটাকেই ধরে রইল। এত গুণের মেয়ে কেন এত লক্ষ্মীছাড়া হয় জীবনে, হে প্রভু? যার মেধায় এত শৃঙ্খলা সে জীবনে এত ভুল দান দেয় কেন? যার বুকভরা ভালোবাসা, সে ভালোবাসা ঢালার পাত্র খুঁজে পায় না?

মারি আঁতোয়ানেত সোফা থেকে উঠে ওঁর স্টাডি টেবলে বসলেন। যার একধারে গুচ্ছগুচ্ছ চিঠি। নানা লোকজনকে লেখা চিঠির নকল। সবেরই বিষয়বস্ত্ত এক : ভিক্টর অন্ত:সত্ত্বা অমৃতার গর্ভপাত করাতে গিয়ে ওকে মেরে ফেলেছে। সম্পূর্ণ আনাড়ি হাতে অ্যাবরশন।

এক সময় দেরাজ থেকে তাস বার করে ব্রিজের ডিল পরিবেশন করলেন মারি। তারপর নিজের মনে কল দিতে শুরু করলেন।

এইক্ষণে বান্ধবী অমরজিৎ এসেছিলেন একটু চা নিয়ে আড্ডা দেওয়ার জন্য। আপনমনে মারির ডাকা সব কল শুনে চুপ করে বসে রইলেন কিছুক্ষণ। টেবল ল্যাম্প-জ্বালা আলো-আঁধারি ঘরটাতে মহিলাকে ওভাবে হরতন রুহিতন ইস্কাবন চিড়িতন করতে শুনে অমরজিতের মনে হলো মারি আঁতোয়ানেত তাস নিয়ে বসে নেই, একা-একা পস্ন্যানচেটে বসেছেন। আর একা-একাই বা কেন, যেভাবে ‘অমরি’, ‘ইন্দু’ করে হাওয়ায় ডাকছেন, কে বলবে মেয়েদের কেউই ওখানে নেই?

এমনটা মনে হতে ভেতরটা ছাঁৎ করে উঠল অমরজিতের। তাই যেমনটি নিঃশব্দে এসেছিলেন, তেমনটি নিঃসাড়ে বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে। যেতে-যেতে শুনলেন মারি আঁতোয়ানেত কোনো অদৃশ্য অতিথির উদ্দেশে বলছেন : সমস্যা তো ওখানেই ফোরি, হতচ্ছাড়াটার তো কোনো ট্রেনিংই ছিল না অ্যাবরশন করানোর মতো। অথচ ঠিকঠাক ডাক্তারও ডাকল না নিজের বিদ্যে ধরা পড়ার ভয়ে। এমন একটা লোককে খুনি ছাড়া আর কী বলব বলো?

হঠাৎ করে তাস গুটিয়ে ফের অন্ধকারে সোফায় গিয়ে বসলেন মারি।

খানিক পরে উমরাও ঘরে এলেন একটা কলমের খোঁজে।

অন্ধকারে সেঁধিয়ে-যাওয়া স্ত্রীকে দেখে বললেন, একটু আগে তোমার গলা শুনলাম যেন? মারি বললেন, হ্যাঁ, ফোরি নেহরু এসেছিল। বলছিল, ভিক্টরেরই বাচ্চা ছিল অমরির পেটে।

উমরাও বললেন, তাহলে গর্ভপাতের প্রশ্ন উঠল কেন?

মারি বললেন, সেই প্রশ্ন তো আমারও।

উমরাওয়ের কণ্ঠে একটা হতাশার সুর এলো, এসব আর এখন ভেবেই বা কী লাভ?

মারির স্বরে কিন্তু প্রত্যয় বেজে উঠল, সত্যটা লোকে বুঝলে আমি অন্তত শামিত্মতে মরতে পারব।

উমরাওয়ের শান্ত বুকেও খোঁচা লাগল কথাটায়। টেবল থেকে কলমটা তুলে নিজের বুকে ঠুকলেন। মৃত্যু যখন আসার – উনি ধীরকণ্ঠে বললেন – তখন তো সে আসবেই। আমরা চেষ্টা না করলেও।

মারি বললেন, মৃত্যুর অপেক্ষায় থাকার মতো শামিত্মও তো আমার নেই এখন।

উমরাও কলম নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে মারির নজর গেল টেবলের ওপর আরো কটা কলম ও রাইটিং প্যাডের দিকে। কী মনে করে দ্রম্নত উঠে গিয়ে কলমের একটা তুলে নিয়ে একটা প্যাডের কাগজে লিখে বসলেন ‘আমার প্রিয় ভিক্টর’!

কিছুক্ষণ আগেও যাকে মেয়ের খুনি হিসেবে নিশ্চিত জেনে চর্চা হচ্ছিল হঠাৎ সে প্রিয় হয়ে উঠল কেন?

মারি নিজেও এ নিয়ে খানিকটা ভাবলেন। দাঁতে চিবোলেন কলমের মাথাটা। তারপর এক ঝটকায় লেখা শুরু করলেন, এবং লিখেই চললেন…

‘বেশ কয়েক সপ্তাহ, থুড়ি, মাস যাবৎ তোমাকে লিখে জানাব ভাবছিলাম যে কী কষ্টেই না আছি ওইসব উদ্ভট কথাবার্তা রটিয়ে, যা তোমাকে ঘোর অসুখী করেছে।’

কিন্তু বিশ্বাস করো, আমি খুবই অসুস্থ। চিরকাল আমি আমার বিশ্রী স্বভাবের জন্য ভুগেছি। আমি সত্যিই ভালো হতে চাই, কিন্তু আমার হৃদয় বা মগজ কোনোটাই পদের নয়।

যখন ছোট ছিলাম, বয়স মাত্র উনিশ, আমি কোনো নাচের আসরের পর সারারাত বারান্দায় বসে থাকতাম, যদি ওভাবে মরে যেতে পারি।  যখন বার্সি পরিবারের সঙ্গে থাকতাম একবার বিষও খেলাম; কিন্তু মরিনি। তারপর আরো অনেকবার খেলাম। তাতেও…

প্যারিসে একবার জানালার ধারে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম, কিন্তু ঝাঁপটা দিতে পারিনি। কারণ ওভাবে মরতে কীরকম বিব্রতবোধ করলাম।

আমি এখন শরীর ও মনে পচে গেছি। আমায় এত কুৎসিত ও বুড়ি লাগে এখন যে দেখলে চিনতেও পারবে না। আমার ভেতরের সমস্ত শয়তানি মুখে জানান দেয়।

আমার চুলগুলোও চুলোয় গেছে আর গলার আওয়াজটা জঘন্য হয়ে গেছে। তাই মুখে যা-ই বলি তা-ই বিতিকিচ্ছিরি শোনায়, কোনো ভালোবাসার ছিটেফোঁটাও থাকে না।

আমি সেরকমই একজন, যার জন্য অন্যরা ভোগে, আর যতদিন বাঁচব ততদিন জ্বালিয়ে যাব। আমার উন্মাদনার তাড়নায় সত্তর বছরের নয়নাভিরাম গাছটা কাটিয়ে দিলাম। কেননা ওটার জন্য বাঁদরের উৎপাত হয়। সেজন্য বাগানটা যে কী খারাপ দেখতে হয়ে গেছে এখন!

আমার এখন ইন্দুর মনখারাপের মুখোমুখি হতে সাহস হয় না; একেক সময়ে যা খারাপ মেজাজে থাকে ও। ১৯৪১-এর ক্রিসমাসে ও আমায় বলেছিল আমি সারাক্ষণ তোমার নিন্দে করতাম বলে আমার আদরের অমৃতা আমাকে ঘেন্না করত। আর সেই ঘৃণার অধিকার ওর ছিল।

আমার মেয়েরা যখন ছোট ছিল আমি আমার স্বভাবের বাজে দিকগুলো ঢেকে রাখতে পারতাম, যে-ঢাকাঢাকিটা সারাজীবনই করে গেছি। আমি দানধ্যান করতাম, যাতে কাছের মানুষরা আমার আসল চরিত্রের টের না পায়। আমার মেয়েরা তখন খুবই ছোট আর আমায় বড্ড ভালোবাসত। আমার জীবনের ওটাই একমাত্র সুখী দিন। আমার কিন্তু তখনো ভয় ছিল যে, এই বাচ্চারা বড় হয়ে আমায় আর ভালোবাসবে না, কারণ আমাকে ভালোবাসা যায় না।

আর এখন দুঃখ পেতে-পেতে আমি একেবারে বদ্ধ উন্মাদ। আমার সব চিমত্মাই এখন মৃত্যু ঘিরে। আর দুদিন আগে আমি পাহাড় থেকে ঝাঁপ দিতে গিয়েছিলাম।

কিন্তু সেটা বড় কুৎসিত মৃত্যু হতো। বড্ড আঘাত করত আমার সঙ্গী ভালোমানুষটিকে। তাই, প্রিয় খোকন আমার, তোমার কাছে ভিক্ষে চাইছি যদি রেজিস্ট্রি ডাকে একটু বিষ পাঠাতে পার…’

চিঠি শেষ হতে আগে লেখা চিঠিগুলোকে একপাশে ঠেলে সরিয়ে এটিকেই সুন্দর করে খামে পুরলেন। ভিক্টরের ঠিকানা লিখে খামে স্ট্যাম্প বসালেন। তারপর গায়ে ভারী সিল্কের হাউসকোট চড়িয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতে থাকলেন নিচে।

সাধারণত পাঠানোর মতো চিঠি মারি আঁতোয়ানেত একতলার দরজার পাশের টেবলে রেখে দেন। কাজের লোক কেউ বা উমরাও সেসব বাড়ির অদূরে লাল ডাকবাক্সে ফেলে দেন।

আজ কিন্তু মারি নিজেই হিমেল অন্ধকারে চিঠি পোস্ট করতে বেরোলেন।

বাক্সে চিঠি ফেলে ফেরার পথে প্রিয়, পরিচিত খাদের কিনারে এসে দাঁড়ালেন। শুনলেন খাদ ডাকছে ‘আয়! আয়! আয়!’

মাথা ঘুরিয়ে ‘দ্য হোলস’-এর দিকে চাইলেন। বারান্দায় আলো জ্বলছে। খুব বেশি আলো নয়, তবু…

তার মানে উমরাও টেলিস্কোপে তারা খুঁজছে। বলেছে নতুন, অনামী তারার খোঁজ পেলে নাম রাখবে ‘অমৃতা’।

মারি ফের খাদের দিকে চোখ ঘোরালো। সে ডেকেই যাচ্ছে ‘আয়! আয়! আয়!’ বড় মধুর, ঘনিষ্ঠ ডাক। কিন্তু বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হলো না। ফের বাড়ির দিকে মুখ ঘুরিয়ে হন-হন করে হাঁটা ধরলেন মারি। বারান্দায় বসে এই দৃশ্যটাই মন দিয়ে দেখছিলেন উমরাও।

 

দুই

১১ মার্চ, ১৯৪৪

দুদিন ধরে অদ্ভুত অস্থিরতায় কাটিয়ে আজ শাশুড়ির চিঠির জবাব লিখতে বসল ভিক্টর। কোনো চিঠির উত্তর লিখতে এই বিহবল দশা আগে কখনো হয়নি ওর।

বুকে একরাশ অভিমান তো জমেই ছিল। আগে শাশুড়িকে কখনো উন্মাদ মনে হয়েছে ওর, কখনো স্রেফ হিংস্র। কখনো শুধুই অবান্তর। সহ্য করতে হয় বলে সহ্য করা।

কিন্তু গত দুদিন ধরে ওঁকে কেবল একটাই পরিচয়ে দেখে যাচ্ছে ভিক্টর – করুণার পাত্রী।

এর মধ্যে বারকয়েক পড়া হয়েছে মারি আঁতোয়ানেতের চিঠি। একেক সময় শক্তপোক্ত মনের ভিক্টরের চোখদুটো জলে কেঁপে উঠেছে।

আজ তাই চিঠি লিখতে বসে মহিলার চিঠিটা ধারপাশে রাখেনি। চেষ্টা করেছে সহানুভূতির সঙ্গে একটা ডাক্তারি উপদেশে গুছিয়ে তুলতে বয়ানটা। ও লিখল :

 

‘প্রিয় মিচি নেনে,

আমি তোমার অতি, অতি মনখারাপ করা চিঠিটা পেয়েছি, এবং না-বলে পারছি না খুবই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছি। সঙ্গে-সঙ্গেই উত্তর দেবার ইচ্ছে ছিল, পারিনি। অবশেষে একটা লম্বা চিঠি লিখতে বসলাম এবং ডাক্তার মানুষ বলে চেষ্টা করলাম তোমার সমস্যাটা যতখানি সম্ভব বিশেস্নষণ করে তার একটা বিহিত করার। আজকালকার মনোবিজ্ঞানীরা যেমনটা করেন আর কি।

মনোবিদরা কী করেন? তাঁরা সমস্যাটির গোড়ায় যাবার চেষ্টা করেন এবং সেখানে পৌঁছে ব্যাপারটা রোগীদের খুলে দেখাবার চেষ্টা করেন। কারণ এই কারণগুলো এত সেঁধিয়ে থাকে মনের অতলে যে, রোগীরা তার হদিসই পায় না।

অথচ অনেক ক্ষেত্রেই একবার কারণের চেহারা ধরা পড়লেই সমস্যারও সমাধান হয়ে যায় আপনাআপনি।

কখনো-কখনো বাচ্চারা একটা অন্ধকার ঘরে ঢুকতে ভয় পায়। কারণ তারা ভাবে কত কী ভয়ংকর জিনিস সেখানে জমা আছে। কিন্তু যেই সুইচ টিপে আলো জ্বালা গেল, অমনি ওদের ভয়ও নিমেষে উবে গেল। এত ভয় যার থেকে সেটা দেখল একটা নিরীহ চেয়ার। বাকি ভয়ংকর ব্যাপারগুলোও বোঝা গেল একেবারে মনগড়া।

তোমার চিঠি পড়ে আমার প্রথম চিমত্মাই ছিল তোমার মনের এইসব ঝুল, ময়লাগুলো সাফ করার পথে হাঁটি। তাতে একটু আশঙ্কাও হলো যে, তুমি ভুল বুঝবে। আমার মধ্যে তোমার জামাই আর ডাক্তারকে আলাদা করতে পারবে না। ভাববে আমি সুযোগ পেয়ে খারাপ-খারাপ কথা শোনাচ্ছি তোমাকে। তাই লিখতে বসেও চিঠিটা লেখা হলো না।

দেখ, মিচি নেনে, আমি তোমাকে সেই শিশুকাল থেকে চিনি। তাই জানি যে তোমার মধ্যে কত সুন্দর-সুন্দর সব ভাবনা, চিমত্মা, আবেগ কাজ করে। কিন্তু তোমার ভেতরেরই কিছু অন্য চিমত্মাভাবনা তোমাকে উদ্ব্যস্ত করে সেসব প- করে দেয়। ইস্, যদি তোমার সঙ্গে দেখা করে কথাগুলো মুখোমুখি বলতে পারতাম!

তাহলে হয়তো সত্যিই তোমার কিছুটা কাজে আসতাম। অ্যাদ্দূর থেকে উপদেশ শুনিয়ে কতটা কী করা যাবে জানি না। তবু…

প্রথমত, মিচি নেনে, তোমার বোঝা চাই যে তোমার কষ্ট, দুঃখ, বেদনা বাইরে থেকে আসছে না।

তোমার একটি অত্যন্ত প্রিয়, দরদি স্বামী আছেন। তোমার সুন্দর একটি নাতি আছে। টাকা-পয়সা নিয়ে তোমার কোনো দুশ্চিমত্মা নেই। তুমি থাক এক অতিসুন্দর পরিবেশে। আর তোমার শরীর-স্বাস্থ্য সুন্দর, সুঠাম। কাজেই সুখের জন্য মানুষ যা-যা চায়, আকাঙক্ষা করে, তার সবই প্রায় তোমার আছে। তা সত্ত্বেও তুমি অসুখী, যা তোমাকে ভাবায় দুঃখ, জ্বালা, অশামিত্ম সব বাইরে থেকেই আপদ হয়ে আছড়ে পড়ছে।

হয়তো তোমারও কিছু দাবি থাকে অন্যদের কাছে – তাদের ভাব-ভালোবাসা সহানুভূতি, যা হয়তো তুমি পাও না। তার কারণ হয়তো এই যে, সারাক্ষণ তোমার দাবি-দাওয়াও তাদের কাছে অসহ্য হয়ে ওঠে। ফলে শুধু তোমার দিক থেকে ওদের বিচার করাটা ঠিক না।

আসলে তোমাকেই জগতের সঙ্গে মানিয়ে চলার রাস্তা নিতে হবে। অন্যদের সঙ্গে যদি আরেকটু সহৃদয় ও স্বাভাবিক হতে পার তাহলে অচিরে দেখবে তোমাকে ঘিরে ভালোলাগার, ভালোবাসার মানুষের ভিড়।

মিচি নেনে, তুমি দুনিয়ার মানুষের জীবনের কেন্দ্রে থাকার চেষ্টা ছাড়ো। একটা সরল, সুন্দর জীবনে বাঁধো নিজেকে, দেখবে বাকি সবাই তোমাকে নিয়ে টানাটানি শুরু করেছে। তোমার অহমিকা বিদেয় হচ্ছে।

এটা মোটেই খারাপ কিছু না যে, তুমি একজন ডাক্তারেরই শরণাপন্ন হয়েছো। তোমার চেয়েও খারাপ দশায় পড়েছে এমন হাজার-হাজার মানুষ চিকিৎসা করিয়েই তো দিব্যি আছে। এটা ভুলে যেও না যে, ডাক্তারি বিদ্যে হালফিল বহুত এগিয়ে গেছে তাই কথায়-কথায় জবাব দেবার দিন আর নেই। এককালে যেসব রোগে ডাক্তাররা হাত তুলে দিতেন, এখন সেসবই সাগ্রহে নিচ্ছেন, সারাচ্ছেন। আমি নিজে এমনসব মহিলার সাক্ষাতে এসেছি এক সময় প্রায় আত্মহত্যা করে বসেন আর কি! দিনভর মরার রাস্তা খুঁজছেন। তাঁরাই এখন সব সুখী মা, ঠাকুমা!

তুমি চাইলে সিমলার কোনো ভালো ডাক্তারের কাছে খোঁজ করে জানতে পারবে কার্ডিয়াজেল শক ট্রিটমেন্ট সম্পর্কে। এ ছাড়া আরও নানা পথ আছে তোমাকে আত্মহননের ভাবনা থেকে সরিয়ে নেবার জন্য। বেঁচে ওঠার রাস্তা অসংখ্য, প্রিয় মিচি নেনে। আর সে-পথগুলো খুব কাছেও তোমার। তুমি শুধু সেদিকে মুখ ঘোরাও। আর তোমার আশপাশের সবাইকে সুখী করো।

তুমি বিশ্বাস করো, তোমার প্রতি আমার কোনো বিদ্বেষ নেই। এটা জেনে তোমার যদি মনের আরাম হয় তো পিস্নজ সেই আরামটুকু উপভোগ করো। তাতে আমারও ভালো লাগবে।

আমি বরাবরই একটা কঠিন জীবনের ভেতর দিয়ে গেছি। জীবনের থেকে বেশি কিছু প্রত্যাশা না করায় অভ্যস্ত হয়ে গেছি। জীবনে যেটুকু যা পেয়ে©র্ছ তাই নিয়ে খুশি থাকতে চেয়েছি।

উচ্চাকাঙক্ষা পরিত্যাগ করেছি, ভবিষ্যৎ নিয়ে স্বপ্ন দেখা বর্জন করেছি, বর্তমান জীবনের যেটুকু স্নিগ্ধতার স্বাদ পেয়েছি তাই আঁকড়ে ধরেছি বুকে। তাই তোমাকেও বলছি, অযথা বিবেকের তাড়নায় ভুগো না। তোমার মনে হলেই আমাকে চিঠি লিখো, আর তোমার জন্য আর কী করতে পারি যদি জানাও তো সানন্দে করে ওঠার চেষ্টায় থাকব।

আমার প্রতি, প্রিয় মিচি নেনে, তোমার ভাবনাগুলি যদি বদলে যায় তাহলে আমি যে কী খুশি হবো সেটা বলে বোঝানোর চেষ্টাও করব না। তবে এইটুকু বলি যে, সেটা যদি সত্যিই হয় তাহলে আমার মনের আকাশ থেকে একটা মস্ত কালো মেঘ সরে যাবে। আর তুমিও মস্ত স্বসিত্ম পাবে।

আর এমনও একটা সময় আসবে, আশা করি। যখন আমরা পাশাপাশি বসে কথা বলব…’

চিঠি শেষ করে সারায়ার তীব্র উষ্ণ, রৌদ্রোজ্জ্বল দুপুরে সেটা ডাকবাক্সে ফেলতে বেরোলো ভিক্টর। ভেতরে একটা হালকা ঠান্ডা হাওয়া বইছে যেন। অমরির মৃত্যুর পর এই প্রথম অমন বাতাস খেলল ওর বুকে। বাইরের গরমটা ও টের পেল না।

 

তিন

‘স্নেহের ভিক্টর,

তোমার সুন্দর চিঠিটা আমাকে খুব আশ্বস্ত করেছে। তাহলে আমার মতো জঘন্য প্রবৃত্তির মানুষেরও সুস্থ হওয়ার আশা আছে।

কিন্তু শুধু আশা করেই থেমে পড়তে চাই না, ভিক্টর। সেরে ওঠার রাস্তাটা কী, কোথায়? তুমি বলেছ এটা আমাকেই খুঁজে নিতে হবে। কিন্তু একজন মনোরোগীর আত্মজিজ্ঞাসার কী মূল্য আছে? তাহলে কিসের বিশেস্নষণ করবে। প্লিজ আমাকে জানাও।…’

 

‘প্রিয় মিচি নেনে,

তুমি কি অন্যের প্রতি ব্যবহারে আগের থেকে নরম হতে পেরেছ? এই প্রশ্নটা নিজেকে করো। কী উত্তর পাও জানিও।

অন্যেরা তোমার সঙ্গে কেমন ব্যবহার করছে সেটা জানার দিকে মন দিও না। নিজের ব্যবহারের দিকে তাকাও।

মনোরোগীর আত্মজিজ্ঞাসা এলোমেলো হতে পারে, কিন্তু তার মধ্যেও সত্য থাকে। মনোরোগীর সব প্রশ্নই অবান্তর নয়।

আর তা ছাড়া, তুমি শুরুতেই নিজেকে মনোরোগী ভেবে নিচ্ছ কেন? ওই ভাবনাটাই তো রোগের মতন।…’

 

 

‘স্নেহের ভিক্টর,

আমার কোনটা স্বাস্থ্য আর কোনটা রোগ তা আর জানার উপায় নেই। সকালের কফিতে চুমুক দিতেই রাতের দুঃস্বপ্নের কথা মনে এলো। যে-দুঃস্বপ্নে সমানে দেখছিলাম আমি একটা পাহাড়ের ঢাল দিয়ে গড়িয়ে পড়ছি।

পাহাড়টা কিন্তু সিমলার নয়। কোথাকার তাও ঠাওরাতে পারছি না। শুধু শুনছি পাহাড়ের মাথায় দাঁড়িয়ে কিছু লোক ‘গেল! গেল!’ রব তুলছে; কিন্তু কেউ আমার পড়াটা রোখার চেষ্টা করছে না।

আমি পড়ছি আর ভাবছি, আর কতক্ষণ? আর কত দূর? কত নিচে?

হঠাৎ কোত্থেকে এক লাল পোশাকের অপরূপ সুন্দুরী মেয়ে পাশের বন থেকে দৌড়ে এসে আমায় জাপটে ধরল এবং আমি আর পড়লাম না। মেয়েটির মুখের দিকে তাকিয়ে দেখি – অমৃতা!

আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী রে, তুই এখানে?’

ও কিছু বলল না, শুধু হাসল। একটা কান্নার হাসিই যেন।

তখনই স্বপ্নটা কেটে গেল।…’

 

‘প্রিয় মিচি নেনে,

কফিতে চুমুক দিতে দুঃস্বপ্নটা মনে এলো। তখন কী করলে? বাকি দিনটাই বা কী করলে? শরীরের দিক থেকে কোনো সমস্যা হয়নি তো?’

 

‘স্নেহের ভিক্টর,

কফি খেতে-খেতে যখন দুঃস্বপ্নটাই বলতে গেলে উপভোগ করছি অমৃতার বাবা একটা ম্যাগাজিন আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে কী যেন বলতে লাগল। পরে শুনলাম অমরিকে নিয়ে একটা লেখা বেরিয়েছে, সেটা আমার পড়ার জন্য দিচ্ছিল। আমি কিছু শুনতে পাইনি।

কিন্তু অমরির স্বপ্নটা ভেঙে দেবার জন্য ভীষণ রেগে গেলাম। জানি না সেই রাগের মাথায় কী না কী বলেছি বেচারিকে।

ও চুপ করে সব শুনল, তারপর নিজের স্টাডিতে চলে গেল।

দুপুরে খাওয়ার সময় দেখলাম খিদে নষ্ট হয়ে গেছে। মনটাও খুব খারাপ হয়ে গেল। বিশেষ করে উমরাওকে যখন দেখলাম মাথা নিচু করে খাচ্ছে। কোনো শব্দ করছে না।

একটু-একটু নিজের ওপর রাগ হলো। খাওয়া শেষ করে একটা ফরাসি উপন্যাস পড়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু মন বসাতে পারলাম না। তখন অমৃতাকে নিয়ে ম্যাগাজিনে যা বেরিয়েছে সেটা পড়ার চেষ্টা করলাম।

তখন কেবলই ফিরে এলো ওই স্বপ্নটা। আমি গড়িয়ে পড়ছি তো পড়ছিই। শেষে অমরিই আমাকে এসে ধরল।

স্বপ্নটা এভাবে আসতে একটা অদ্ভুত বাসনা হলো। পাহাড় দিয়ে পড়ে দেখিই না, যদি অমৃতা এসে বাঁচায়।

আমি চট করে ড্রেস বদলে বেরোবার জোগাড় করলাম; কিন্তু বেরোবার আগে উমরাওকে বলতে গেলাম, যাচ্ছি।

দেখি ভালো মানুষটা উদাস চোখে আকাশ দেখছে। কী জানি কী খুঁজছে। আমার আর যাওয়া হলো না।…’

 

‘প্রিয় মিচি নেনে,

এই তো তোমার নিজেকে সারানোর শুরু। স্বামীকে দেখে তোমার পাহাড় থেকে গড়ানোর ইচ্ছেটা চলে গেল। কত বড় উপকার, সেটা ভাবো। তারপর কী করলে?…’

 

‘আদরের ভিক্টর,

ফিরে এসে পোশাক বদলে আবার মন খারাপ হলো। ফের রাগ হলো উমরাওর ওপর। ওর জন্যই তো আমার দেখা হলো না অমৃতার সঙ্গে।

আমি পিয়ানোয় বসে ভের্দির অপেরার একটা সিন থেকে গাইবার চেষ্টা করলাম। না পারলাম কথা, না পারলাম সুর মনে করতে। তখন রাগ তৈরি হলো নিজের ওপর।

সটান চলে গেলাম বিছানায়, ঘুমিয়ে পড়ব বলে।

ঘুম ঠিক এলো না। একটা আধো ঘুম, আধো জাগরণে উমরাওয়ের সঙ্গে আমার প্রথম মিলনরাত্রিটা মনে এলো। কী সুন্দর মিলন! আমার ভীষণ ভালো লাগছিল।

ওই ভালো লাগার মধ্যেই আমি ঘুমিয়ে পড়লাম।

যখন ঘুম ভাঙল দেখলাম উমরাও আমার জন্য চা তৈরি করে মাথার পাশের চেয়ারে অপেক্ষা করছে।

বহু, বহুদিন পর হঠাৎ সাধ হলো ওকে চুমু খাওয়ার। কিন্তু নিজেকে সংবরণ করলাম।…’

 

‘কেন সংবরণ করলে, প্রিয় মিচি নেনে?

এই চুম্বনই হয়তো একটা নতুন রাস্তা খুলে দিত!…’

 

‘স্নেহের ভিক্টর,

নিজের ওপর ঘেন্নায় চুম্বন করতে পারিনি। মনে হলো পবিত্র মানুষটাকে হয়তো অশুদ্ধ করে ফেলব। ও থাক নিজের জগতে, আমি আমার।…’

 

‘প্রিয় মিচি নেনে,

চুম্বন না করে কী বললে বরকে?…’

 

‘স্নেহের ভিক্টর,

একটা প্রশ্নই করলাম, কেমন আছ?

ও মাথা নেড়ে বোঝাল ভালো নেই।

তখন ভাবলাম, তাহলে আমরা কী নিয়ে বেঁচে আছি? কিসের জন্যই বা?

রাতে শোবার সময় মনে হলো, ঘুমই যদি না আসে, অন্তত মৃত্যু আসুক।

ভিক্টর, তেমন ওষুধ পাঠাও না, পিস্নজ, যাতে আমার ঘুম কখনো না ভাঙে!…’

 

‘প্রিয় মিচি নেনে,

আমি ডাক্তার। রোগীকে ঘুম পাড়ানোর ওষুধ দেবার দায়িত্ব আমার আছে; কিন্তু বরাবরের মতো ঘুম পাড়ানোর অধিকার আমার নেই। তুমি যে চিরকালের মতো ঘুমিয়ে পড়তে চাইছ তা কি একটা অন্তহীন নিদ্রা ও আরাম ভালোবেসে? নাকি জীবনের এত শোক-দুঃখ, কাজ ও দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি পেতে?

খুব মন দিয়ে দেখলে দেখবে দ্বিতীয়টার মধ্যেই অনেক মনের আরাম লুকিয়ে। ভাবো তো, সারাদিনের অকথ্য পরিশ্রমের পর যখন পিয়ানোতে বসে একটু সুর তোলো – সে যে কী অলৌকিক উন্মাদনা তা কি তোমাকে বোঝানোর দরকার আছে? সারাজীবনই তো তুমি এ-মুহূর্তগুলো উপভোগ করেছ, আমি জানি। চিরনিদ্রিত হলে তুমি তো জানবেও না যে, ঘুমিয়ে আছ। এই অনন্ত অজ্ঞানতার কি খুব দরকার আছে? আমরা ডাক্তাররা, এই থেমে পড়াটা এত কাছ থেকে, এত ঘনঘন দেখি যে, এটাকে খুব ভালো সমাধান বলে মনে করতে পারি না। এই যে তুমি মৃত্যু নিয়ে এত ভাবনা-চিমত্মা করো, তার মধ্যেও জীবনের ছোঁয়া আছে। মারা গেলে সেটাও সম্ভব হবে না। অমরি যে অপূর্ব ছবিটা – ছাদ থেকে – শেষ করে যেতে পারল না, তার মধ্যেও কী জীবন খেলা করে! আমরা বুঝতে পারি মেয়েটা একটা নতুন, অপূর্ব ছবির ভাষার দিকে এগোচ্ছিল। মৃত্যু কিন্তু সে-ভাষাটাকেও অকালে মূক করে দিলো।

কাজেই মৃত্যুকে অকারণ গুরুত্ব দিও না। যখন আসার সে আসবে। শুধু সেই দিনটার জন্য তৈরি থেকো। মৃত্যুর রিহার্সালের কোনো প্রয়োজন নেই।…’

 

‘তুমি কাকে বলছ মৃত্যুর রিহার্সাল, স্নেহের ভিক্টর? মৃত্যুকে আমার আগ বাড়িয়ে কল্পনা বা অনুমান করতে হয় না। আমি সারাক্ষণ মৃত্যুকে আমার সামনে, পাশে, চার ধারে দেখতে পাই। যেমন তোমাকে দেখি, উমরাওকে দেখি, ইন্দুকে দেখি, অমরিকে দেখি… রাতে জানালার বাইরে চোখ মেললে মনে হয় পাহাড় ডাকছে। কিচেনে রান্নার চেহারা দেখতে গেলে মনে হয় ছুরিগুলো উড়ে আসতে চাইছে আমার হাতে। নাকি গলায়?

প্রথম-প্রথম ভয় পেতাম। এখন, সত্যি বলছি, বেশ গা-সওয়া হচ্ছে ব্যাপারটা। ছুরি-কাঁচি কোনো দিনই আমার খুব পছন্দের নয়। রক্ত দেখলে আমার বরাবরই ঘোর ধরে যায়। রক্ত আর মৃত্যুকে খুব কাছাকাছি ব্যাপার মনে হয়েছে। যে-মৃত্যুর ধরনটা আমার আনরোমান্টিক ঠেকে।

পূর্ণ চাঁদের রাতে পাহাড় থেকে গড়িয়ে পড়ার একটা অন্য মাদকতা আছে। বরাবরের মতো ঘুমিয়ে পড়ার আগে একটু নিদ্রার প্রস্ত্ততি। ‘আয় ঘুম!’ ‘আয় ঘুম!’ করে ঘুমকে ডেকে এনে নয়। বেটোফেনের ‘মুনলাইট সোনাটা’র একটা গভীর রহস্যের মধ্যে গড়িয়ে পড়ে। যেন পিয়ানোর একটা স্বর থেকে আরেকটা স্বর হয়ে অন্য এক স্বরে গিয়ে মেশা।

অথচ এখন, দিনে দিনে, রক্তারক্তির মৃত্যুও আমার ভালো লাগছে। কেন জান? একদিন স্বপ্নে দেখলাম অমরি রক্তে ভাসতে-ভাসতে দূরে চলে যাচ্ছে। তুমি তো দেখেছ ওকে ওভাবে চলে যেতে। কাঁদেনি একটুও। শুধু নিজের রক্তে চান করতে-করতে। নিজের রক্তে নিজেকে পবিত্র করে।

উমরাওর বন্দুকটা তাই আজকাল থেকে-থেকে আমাকে ইশারা করে। কোনো মানুষের ওপর তা কখনো ব্যবহার হয়নি। তাই বন্দুকটা রক্ত চেনে না। ও আছে আমাদের প্রতিরক্ষার জন্য। জানে না আমাদের কারো মৃত্যু-বাসনা হলে ও কী করে আমাদের বাঁচাবে।

আচ্ছা ভিক্টর, বাঁচতে চাওয়ার পেছনে কোনটা বেশি কাজ করে? আমাদের জীবনের টান, না মৃত্যুভয়?…’

 

‘প্রিয় মিচি নেনে,

চারপাশের সবাইকে তোমার মৃত্যুর দূত মনে হওয়াটা জীবনকে –  হ্যাঁ জীবনকে ভয় পাওয়ার লক্ষণ। চার বছর ধরে নিজেকে বাইরের বাস্তবগুলোকে দেখার যে পরামর্শগুলো দিচ্ছিলাম, তা তুমি মন দিয়ে শুনে যথারীতি অবজ্ঞা করে গেলে। নিজের প্রতি তোমার এত ঘৃণা, কে জানে? হয়তো তোমার চরম আত্মপ্রেম!

তুমি নিজের রোগের নিখুঁত বর্ণনা করে গেলে এতদিন। রোগের লক্ষণ চিনতে পারার পরেও তুমি সেই রোগের থেকে নিস্তার চাইলে না। তুমি আমাকে সমানে কথা দিলে ঠিকই, কিন্তু সেরে উঠতে চাইলে না। কেন, মিচি নেনে? কেন?…’

 

‘কারণ, আদরের ভিক্টর, অমৃতা চলে যাবার পর আর বেঁচে থাকার কারণ খুঁজে পাচ্ছি না! শুধু মনে হয় মৃত্যুর ওপারে কোথাও যদি ওকে খুঁজতে হয় তো এই মৃত্যুর দোর দিয়েই তো বেরোতে হবে।

আবার ভাবি, আমার লক্ষ্মী মেয়েটা তো স্বর্গেই যাবে। এবং আমি অবধারিত নরকে। তাহলে দেখাটা হবে কীভাবে?

এও একটা বাজি ধরা। আমি চিরদিনই যেটা করেছি। উমরাওকে বিয়ে করে যে-বাজি ধরা শুরু।

তবে সেরা বাজি এই শেষ বাজি। আর ওই আমার প্রিয়তম জীবনসঙ্গী উমরাওর বন্দুক টিপে।

অমরি, আমি আসছি!

সরি, ভিক্টর, এই চিঠিটা আর তোমায় পোস্ট করতে পারলাম না।’

 

চার

উমরাও ওর স্টাডিতে নেই। বেচারি হয়তো ওর ইদানীংকার নেশায় মেতেছে। দুরবিনে নতুন তারা খোঁজা। যার নাম হবে অমৃতা।

আমি অত দূরে অমরিকে খুঁজতে যাব না। আমি ওকে স্পর্শ করতে  চাই, হাতের এই পিস্তলটার মতো। তবে এত শীতল নয়, তাজা রক্তের মতো উষ্ণ করে। যেভাবে মেয়েটাকে এককালে এই দুই হাতে আঁকড়ে ধরতাম। নিজের হৃদয়টাকেও কখনো এত আদরে হাতে নিতে পারব না, যেমন নিয়েছি অমরির দুই গাল।

উমরাও, আমাকে ভুল বুঝো না। আমি অমরির কাছে যাচ্ছি। আমার যে-শরীরটা তোমার পড়ার টেবিলের পাশে লুটিয়ে থাকতে দেখবে সেটা আমি নই। লালরঙে আঁকা অমরির আরেকটা পেইন্টিং। শুধু রংটা খুব তাজা, উষ্ণ, জীবন থেকে পাওয়া। অমরির শেষ ছবির লালের মতো।

একেকটা ছবিতে তো, উমরাও, জীবন ও কল্পনা, স্বেদ ও রক্ত মিশে যায়ই। এ-ছবি দেখতে-দেখতে তুমি তোমার প্রিয় গীতা থেকে পড়ো। এ-ছবি আঁকতে-আঁকতে আমি অমরির আঁকা ‘প্রাচীন গল্পকার’-এর মুখে অবাক-করা কোনো গল্প শুনব।

যেরকম একটা গল্পের চরিত্র আমরা সবাই। তুমি, আমি, ইন্দু, ভিক্টর, কল্যাণ অমরি সববাই। তুমি শুধু ছবির লালরঙে হাত দেবে না। গল্পকে গল্প থাকতে দিও… ‘গুড়ুম্!’ করে যে আওয়াজ হবে তখন থেকেই গল্প শুরু…

 

পাঁচ

৩১ জুলাই, ১৯৪৮

স্বামীর বন্দুকে আত্মহত্যা করলেন মারি আঁতোয়ানেত।

উমরাও সিংহ শের-গিল গুলির আওয়াজ পেয়ে নিজের পড়ার ঘরে ছুটে এসে স্ত্রীকে দেখলেন এক ছবির মতো ছড়িয়ে আছেন।

কাছে গিয়ে ওর মাথাটা কোলে নিলেন। একটা হাসির ঝিলিক এলো ওঁর শ্মশ্রূগুম্ফম–ত মুখে যখন মহাভারতের যুধিষ্ঠিরের কথাটা উচ্চারণ করলেন : দিন দিন, প্রতিদিন, মানুষ দেখছে মানুষের মৃত্যু। তবু যারা বেঁচে রইল তারা বাসনা ছাড়ে না চিরকাল বেঁচে থাকার।

ক্রমশ মলিন হলো অমৃতার বাবার হাসি। তারপর একসময় ওঁর দুচোখ বেয়ে জল ঝরল। তার কিছুটা পড়ল অমৃতার মায়ের রক্তে।

অশ্রম্ন আর রক্ত মিশে পিস্তলের তুলিতে আঁকা ছবিটা একটু ঘেঁটে গেল।     (শেষ)