পলাশীকান্ডর আগে-পরে

সনৎকুমার সাহা  

একটা কথা আমাদের অনেকের মাথায় গেঁথে আছে, ১৭৫৭-র পলাশীর যুদ্ধে বাংলা তার স্বাধীনতা হারায়। নবাব সিরাজউদ্দৌলা শেষ স্বাধীন নবাব। তারপর ব্রিটিশ শক্তির রাজত্ব। অবসান তার ১৯৪৭-এ। তখন ভারতবর্ষ পুরোটাই ছিল কার্যত ব্রিটিশ সাম্রাজ্য। তা ভাগ হয় ভারত ও  পাকিস্তানে। বাংলাও ভাগ হয়। প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ পড়ে পাকিস্তানে। বাকিটা থেকে যায় ভারতে। পাকিস্তান অংশ, যার শুরুতে নাম ছিল পূর্ববাংলা, পরে পূর্ব-পাকিস্তান, ১৯৭১-এ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে গণজাগরণের ভিতর দিয়ে স্বয়ং এক স্বাধীন সার্বভৌম প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। আমরা মনে করি, পলাশীর কলঙ্কের বুঝি মোচন হলো। কিন্তু  প্রাক-পলাশী ষড়যন্ত্রের তুলনীয় অবস্থা সৃষ্টি হয় আবার। অবশ্য প্রকাশ্যে কেবল দেশের ভেতর থেকে ক্ষমতালিপ্সু চক্রের। বাইরের যোগাযোগ থাকলেও তা ধরাছোঁয়ার বাইরে। মূল ভূমিকায় কতিপয় সামরিক কর্মকর্তা। স্বার্থান্ধ কিছু রাজনীতিকও তাদের সঙ্গে হাত মেলায়। পাকিস্তানি সাম্প্রদায়িক পরিচয়ে যাদের পরিতৃপ্তি ছিল, তারাও আশা করে, বাংলাদেশ বোধহয় আবার তাদের মনমতো হবে। এই চক্রান্তের ও বিকারের শোকাবহ পরিণাম পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্ট সামরিক অভ্যুত্থানে বঙ্গবন্ধু-পরিবারের নির্মম নিধন। শিশুপুত্র রাসেলও বাদ যায়নি। কেবল দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা আপন আপন সংসারে দূরে থাকায় রক্ষা পান। এই ঘটনাকে আমরা নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরিণতির সঙ্গে কেউ-কেউ মিলিয়ে দেখি এবং পলাশীর প্রান্তরে বাংলার স্বাধীনতা বিসর্জিত হয়েছিল বলে যে আজ অনুভূত হয়, তার সঙ্গে ঢাকার ধানমন্ডির বাসভবন থেকে বঙ্গবন্ধুর প্রেরণায় ও নেতৃত্বে সেই স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের বীরত্বগাথাও। ‘পলাশী থেকে ধানমন্ডি’ – এই কথাটা তাই মুখে-মুখে ফেরে। পরাজিত ও বিধ্বস্ত হলেও স্বাধীনতা রক্ষার ব্যর্থ প্রয়াসে তাঁর ভূমিকার জন্য নবাব সিরাজউদ্দৌলা বাঙালি স্মৃতিতে এক বিফল নায়ক হিসেবেই থেকে যান। বঙ্গবন্ধুর নিষ্ঠুর হত্যাকান্ডও তাঁকে গণচেতনা থেকে মুছে ফেলতে পারেনি। তাঁর স্বপ্নের আদর্শ – বাংলাদেশ থেকেও না।

তবে এইখানেই, সবার না হলেও আমার মনে প্রশ্ন জাগে, পলাশীর যুদ্ধ কি সত্যিই বাংলার স্বর্গ থেকে পতন – যে-স্বর্গে প্রত্যাবর্তনের ডাক দেন উত্তর-আধুনিক উত্তর-ঔপনিবেশিক চিন্তাবিদেরা? আর, একাত্তরের স্বাধীনতা কি লক্ষ্যচ্যুত ও বিভ্রান্ত? কোনো সহজ উত্তর মিলবে না, জানি। কারণ ইতিহাসের সঠিক স্বরূপ খুঁজে পাওয়া মুশকিলই। আমার পক্ষে আরো কঠিন। কোনো পদ্ধতিগত শিক্ষা আমার নেই। আর এটা কিছুতেই আমার কাছে সহজ হয় না, যা পুরাকাহিনি বলে পড়ি, তা সবটাই কি পুরাকাহিনি ঘটনার যথাসাধ্য অবিকল পুনর্নির্মাণ, নাকি মিশে যায় তাতে বর্তমানের দৃষ্টি-ভাবনা? মূল্য আরোপ করি যদি আজকের, তবে ইতিহাসের শুদ্ধতা কি মেলে? আবার বর্তমানের এবং অতীত কালখন্ডেরও ‘শতচক্ষু সহস্রপাত’। তা হলে পুরোটা দেখি কী করে? জানিইবা কতটুকু? এই অপূর্ণতার আক্ষেপ নিয়েই পেছনদিকে ফিরে তাকাই। হিজিবিজি যা-ই হোক, কিছু তো চোখে পড়বে। সেটুকুই তুলে আনার চেষ্টা করি। আমি না পারি, আর কেউ হয়তো তা স্পষ্ট করে ফুটিয়ে তুলবেন।

 

দুই

বাংলার ‘শেষ স্বাধীন নবাব’ সিরাজউদ্দৌলাকে নিয়ে আমাদের আগ্রহ যে তুঙ্গে ওঠে, তা প্রকৃতপক্ষে বিশ শতকের চতুর্থ দশকের ঘটনা। তখন চলছে ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতাসংগ্রাম। এবং আমাদের চাই তার সঙ্গে খাপ খাইয়ে সংগ্রামী নায়কের উজ্জ্বল উদাহরণ। আরো ভালো, যদি সেই নায়ক জীবন বিসর্জন দেন স্বদেশের স্বাধীনতা রক্ষায়। দুদিক থেকেই সিরাজউদ্দৌলা গণমানসে আসন পাতেন। তাঁকে নিয়ে আবেগের ঢেউ একটা তৈরি হয়। আগ্রহ-বিন্দুটা মুছে যায়নি এখনো। কিন্তু মজা এই, ওই আগ্রহের উৎসে আমাদের ইতিহাস-পাঠ ভূমিকা রাখে সামান্যই। এখানে চেতনায় আঘাত হানে নাটক। ১৯৩৮-এ ছেপে বেরোয় শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তর সিরাজদৌল্লা। ছাপার অক্ষরেই তা আটকে থাকে না। তার মঞ্চাভিনয় ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে। যাত্রাপালাতেও রূপান্তরিত হয়। তেমন হবার সব উপাদানই তাতে ছিল। তাছাড়া গ্রামোফোনে দেশের সেরা নট-নটীদের কণ্ঠাভিনয়ে জীবন্ত হয়ে ওঠে সিরাজদৌল্লা। সঙ্গে কাজী নজরুল ইসলামের গান। নাটক লোকযান হয়ে ওঠে। এবং যে-ছাপ রেখে চলে, তা স্থায়ী হয়। ওই একই বছরে মন্মথ রায় লেখেন মীর কাশিম নাটক। অভিন্ন লক্ষ্য। নাটকের প্রেক্ষাপটও প্রায় এক। তবে সিরাজদৌল্লার ভাবমহিমা মীর কাশিম পায়নি।

এখানে যা বলবার, তা হলো, ‘ঐতিহাসিক নাটক’ সিরাজদৌল্লা ১৭৫৭-র বাস্তবতাকে যতটা চেনায়, তার চেয়ে অনেক বেশি জানায় ১৯৩৮-এর বাংলার চেতনাভুবনকে, যদিও সেই ভুবনও পূর্ণাঙ্গ নয় – তার অনেক মুখের একটা মুখের ছাপ মাত্র। এবং তাতে জনচিত্ত আন্দোলিত হয় ১৯৩৮-এ, এবং তার পরে। ১৭৫৭-র ঘটনার স্মৃতিকে তা বহন করে, কিন্তু ১৭৫৭-য় ওই ঘটনা বাংলার মানুষের মনে তেমন কোনো ছাপ ফেলে না। নাটক ঐতিহাসিক তথ্যের ওপরেই দাঁড়ায়; তবে তা নির্বাচিত তথ্য। এবং এই নির্বাচন ১৯৩৮-এর। খোদ ইতিহাস পাঠেও এই নির্বাচনের পক্ষপাতিত্ব এড়াতে পারি না। অন্ধের হাতি দেখার মতো অবস্থা যে ঘটবে না, তা বলা যায় না। তবু যে দেখতে চাই, তা আমরা কীভাবে বেঁচে এসেছি, বেঁচে আছি, বাঁচতে চাই, তা যতটুকু পারি বোঝার জন্য।

 

সিরাজউদ্দৌলা ছিলেন বাংলার ‘শেষ স্বাধীন নবাব’, এ-কথা পুরোপুরি যথার্থ নয়। মোগল শাসনে বাংলার কোনো নবাবই রীতিমাফিক স্বাধীন ছিলেন না। দিল্লিতে তাঁকে রাজস্ব পাঠাতে হতো। ভেট পাঠাতে হতো। তবেই সুবেদারির সনদ পেতেন। অথবা দিল্লিই কাউকে ওই দায়িত্ব দিয়ে সুবেদার করে পাঠাতেন। যেমন, আকবরের আমলে মান সিং, জাহাঙ্গীরের আমলে ইসলাম খান, আওরঙ্গজেবের সময় দীর্ঘকাল শায়েস্তা খান (১৬৬৪-৭৭, ১৬৭৯-৮৮)। সম্রাট শাহজাহানের সময় শাহসুজা ছিলেন বাংলার শাসনকর্তা। আওরঙ্গজেবের দক্ষ সেনাপতি মীর জুমলা তাঁকে আরাকানে বিতাড়িত করেন। সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়। সুবেদার নিযুক্ত হন মীর জুমলা। তাঁর মৃত্যুর পর শায়েস্তা খান।১

বাংলার রাজধানীও বরাবর এক জায়গায় থাকেনি। মান সিং রাজধানী স্থাপন করেন রাজমহলে। পরে ইসলাম খান ১৬১০ সালে তা স্থানান্তরিত করেন ঢাকায়। নতুন নাম দেন তার জাহাঙ্গীরনগর। শায়েস্তা খানের আমলেও ঢাকাই ছিল রাজধানী। এমনকি ১৭০১ সালে আওরঙ্গজেব যখন হায়দরাবাদ থেকে মুর্শিদকুলী খানকে বাংলার দেওয়ান করে পাঠান, তখনো ছিল তা-ই।২ সে-সময় বাংলার সুবেদার ছিলেন নবাব আজিম উশ্ শান। তিনি আওরঙ্গজেবের পৌত্র। কিন্তু দেওয়ানি বা রাজস্ব সংক্রান্ত বিষয়ে সম্রাটের আস্থা ছিল বেশি মুর্শিদকুলী খানের ওপর। এতে সুবেদার ও দেওয়ানের ভেতর মনোমালিন্য দেখা দেয়। তা পারস্পরিক অবিশ্বাসের রূপ নেয়। তাতে দেওয়ান তাঁর কাজ নির্বিবাদে করতে পারবেন, এই উদ্দেশ্য নিয়ে গোটা দেওয়ানি দফতর ১৭০৩ সালে গঙ্গার তীরবর্তী অঞ্চল মুক্সুদাবাদে তিনি তুলে নিয়ে যেতে চান। আওরঙ্গজেব তাতে সম্মতি দেন; এবং আজিম উশ্ শানকে বিহারের পাটনায় রাজধানী উঠিয়ে নিয়ে যেতে আদেশ পাঠান। সম্রাট তখন দাক্ষিণাত্যে। মুর্শিদকুলী খান নিজে গিয়ে তাঁকে রাজস্ব সংক্রান্ত সব বিষয় বুঝিয়ে বলেন। সম্রাট সন্তুষ্ট হয়ে তাঁকে একই সঙ্গে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার নায়েব-নাজিমের দায়িত্বও অর্পণ করেন। দেওয়ানের কাজ যেমন রাজস্ব বিভাগ চালানো, নাজিমের কাজ তেমনি আইন-শৃঙ্খলা ইত্যাদি সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করা। সুবেদার স্বয়ং নাজিম। দেওয়ানির সঙ্গে নায়েব-নাজিমের পদ পাওয়ায় মুর্শিদকুলী খানের প্রভাব-প্রতিপত্তি আরো বাড়ল। নিজের নাম অনুসারে মুকসুদাবাদের নতুন নাম দিলেন তিনি মুর্শিদাবাদ।৩ তখন থেকে এই নামই চল।

রাজস্ব-বিশারদ মুর্শিদকুলী খানের মুকসুদাবাদে তাঁর দফতর সরিয়ে আনার পেছনে মনে হয় অন্য একটা বৈষয়িক যুক্তিও কাজ করেছিল। গঙ্গার পাড়ে হওয়ায় উত্তর-ভারতের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যের যোগাযোগ তদারকি করে সরকারি প্রাপ্য আদায় করা সহজতর ছিল। তাছাড়া ইংরেজ, ফরাসি ও ওলন্দাজ বণিকদের আনাগোনা তখন বেড়ে গিয়েছিল অনেক। সমুদ্রপথে এসে হুগলি হয়ে ভাগীরথী বেয়ে সোজা তারা দেশের ভেতর ঢুকে পড়ে বাণিজ্য করতে শুরু করেছিল। তাদের কাছ থেকে নির্ধারিত মাশুল আদায়ের জন্যেও খবরদারি করায় ঢাকার চেয়ে মুকসুদাবাদ বেশি উপযোগী ছিল।৪ এই বিষয়গুলোও বোধহয় আওরঙ্গজেবকে বোঝানোয় কাজে দিয়েছিল। কারণ, রাজস্ব বাড়ানোর প্রয়োজন তখন তাঁর অতি জরুরি। এ-বিষয়টি কেন অত গুরুতর ছিল, তা পরে বোঝার চেষ্টা করছি। পরিণাম অবশ্য তার শুভ হয়নি। তাঁর নিজের জন্যেও না।

এদিকে আওরঙ্গজেবের জীবনাবসান ঘটে ১৭০৭-এ। তারপর থেকেই মোগল শাসনে দুর্বলতা প্রকট হয়ে পড়ে। আজিম উশ্ শানের বাবা বাহাদুর শাহ নাম নিয়ে সিংহাসনে বসেন। বেশিদিন রাজত্ব করা তাঁর কপালে ছিল না। তারপরে জাহান্দর শাহ হয়ে আজিম উশ্ শানের ছেলে ফারুকশিয়ার দিল্লির বাদশাহ হন। ১৭১৩ সালে তিনি মুর্শিদকুলী খানকে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার দেওয়ানি ও নাজিমি উভয় দায়িত্বই আনুষ্ঠানিকভাবে অর্পণ করেন। তখন থেকেই মুর্শিদকুলী খান জাফর সুবেদার ও নবাব।৫ মোগল সম্রাটের দরবারে আমির-ওমরাহদের সারিতেও তাঁর ঠাঁই। তবে বেশি তাৎপর্যপূর্ণ, রাজস্ব ও সমরব্যবস্থা, দুটোর কর্তৃত্বই তাঁর একার হাতে আসা। মনসবদারদের নিয়োগ, বদলি, অবস্থান বা প্রত্যাহার, এগুলোর জন্যে দিল্লির অনুমোদনের আর প্রয়োজন করে না। বাংলা-বিহার-উড়িষ্যা অনেকটাই দিল্লি থেকে আলগা হয়ে যায়। আলগা হওয়া মানে অবশ্য বিচ্ছিন্ন হওয়া নয়। মোগল বাদশাহর প্রতি আনুগত্য অব্যাহতই থাকে। তা তাঁর পরেও মুর্শিদাবাদ যতদিন বাংলার রাজধানী ছিল, ততদিন।

রাজস্ব বাড়ানোতেই মুর্শিদকুলী খানের নজর ছিল বেশি। তখন বাংলা অপেক্ষাকৃত নিরুপদ্রব অঞ্চল। তাই দিল্লিরও তাতে সায় ছিল। এতে মনসবদারদের ঘাঁটির সংখ্যা হ্রাস পেল। তাদের দাপটও গেল কমে। পুষিয়ে নিতে ছলচাতুরীর আশ্রয় নিতে থাকে কেউ কেউ। একশ ঘোড়-সওয়ার রেখে এক হাজার ঘোড়-সওয়ারের হিসাব দিয়ে টাকা তোলা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। আলীবর্দি খানের সময় হাতেনাতে ধরা পড়ে অপদস্থ হন মীর জাফর।৬ পলাশীর ষড়যন্ত্রের পেছনে একই লোভ ও কাপুরুষতাও ইন্ধন জোগায়। তবে এখানে যা বলবার, তা হলো, সেনা-ছাউনিগুলোর দুর্বলতা প্রকট হয়ে উঠতে শুরু করে। যোগ হতে থাকে চুরি-ছ্যাঁচড়ামি। দায়বদ্ধতার জায়গাটা ব্যক্তিগত লাভ-লোকসানের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। স্বাদেশিকতার প্রশ্ন অবান্তর। কারণ অধিকাংশ রাজপুরুষই বহিরাগত। ইরান-তুরান-মধ্যপ্রাচ্যের। অনেকে আবার একে অন্যের আত্মীয়। মুর্শিদকুলী খান নিজে ছিলেন ভিনদেশি। জনশ্রুতি, দাক্ষিণাত্যে তাঁর জন্ম। কিন্তু পারস্যে এক ধনাঢ্য পরিবারে প্রতিপালিত। মোগল প্রশাসনে যুক্ত হয়ে ফিরে আসেন দাক্ষিণাত্যেই। আওরঙ্গজেবের সুনজরে পড়ে তারপর তাঁর বাংলায় আসা।৭ একা নয়। পারস্য থেকে তাঁর মতো আসা একদঙ্গল আত্মীয়-স্বজন-দলবল নিয়ে। এতে যে নিজেদের ভেতরে তাদের সংহতি বাড়ে, তা কিন্তু নয়। ইতিহাস বলে, ব্যক্তিগত উচ্চাভিলাষ ও পারস্পরিক হানাহানিই বরং তুলনায় বেশি। এবং তা গোটা মোগল আমল জুড়েই। এই মুর্শিদাবাদের নবাবিতেও।

তবে রাজস্ব আদায় সুবিন্যস্ত ও সুশৃঙ্খল করায় মুর্শিদকুলী খানের কৃতিত্ব খাটো করে দেখা চলে না। আগে দাক্ষিণাত্যে তাঁর প্রশাসনিক উদ্ভাবনী ক্ষমতার পরিচয় মেলে।৮ তাতেই সন্তুষ্ট হয়ে আওরঙ্গজেব তাঁকে বাংলায় দেওয়ান করে পাঠান। রাজস্বের মূল উৎস কৃষি। সেইসঙ্গে বাংলায় ব্যবসা-বাণিজ্যও তখন আগের চেয়ে বেশি সরগরম। বিশেষ করে বিদেশি বণিকদের              কেনা-বেচা ক্রমবর্ধমান। শুল্ক আদায়ের পন্থা-পদ্ধতি নির্ধারণ ও তাদের প্রয়োগ তাই আলাদা গুরুত্ব পায়। ঝগড়া-ফ্যাসাদ-চক্রান্ত-যুদ্ধ যা ঘটে, তা পরে। রাজস্ব বাড়লেই নবাব খুশি।

এই সূত্রে কৃষি-ব্যবস্থায় তিনি কতকগুলো বড় ধরনের পরিবর্তন আনেন। বলেছি, মনসবদারদের অধীনে যে জায়গিরগুলো ছিল, তাদের বেশির ভাগ তিনি তুলে দিলেন। কিছু সরিয়ে দিলেন উড়িষ্যায়। এইসব জায়গির চালাবার খরচ সরাসরি রাজকোষ থেকে দিতে হতো। অথবা জায়গিরের জমিজমা থেকে মনসবদাররা তা উশুল করে নিত। জায়গিরের সংখ্যা কমে যাওয়ায় নবাবের রাজস্ব-ব্যয়ও কমে গেল। আবার ওইসব জমি মুক্ত হওয়ায় তাদের নতুন করে বন্দোবস্ত দিয়ে রাজস্ব-আয় বৃদ্ধি পেল। তবে আরো গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার ঘটনা ঘটল ভূমি-রাজস্ব আদায়ের ব্যবস্থাপনায়। বিশাল-বিশাল খন্ডে বড়-বড় জমিদারি গড়ে উঠল। এমন জমিদারি আকবরের আমলে টোডরমলের নকশাতেও ছিল। কোনো উৎপাত না ঘটলে সাধারণত তা বংশানুক্রমিকই থাকতো। মুর্শিদকুলী খান তাদের আয়তন অনেকগুণ বাড়িয়ে দিলেন। এবং সেপাই-সান্ত্রী দিয়ে সরকারি ব্যয়ে তদারকিও প্রায় তুলে নিলেন। ওই দায় গিয়ে পড়লো বেশিরভাগ জমিদারের ওপর। তাদের নায়েব-গোমস্তা, পাইক-পেয়াদাদের দাপট বাড়লো। জমিদাররা আপন আপন এলাকায় কৃষকদের কাছ থেকে খাজনা আদায় করে নবাবের প্রাপ্য অংশ তাঁর কোষাগারে জমা দিতেন। এতে কোনো গাফিলতি না হলে, অথবা কোনো উটকো ঝামেলায় জড়িয়ে না পড়লে নিজ নিজ জমিদারিতে তারাই একরকম প্রভু। তাদের করিৎকর্মা দেওয়ান বা নায়েবরা কখনো কখনো রাজকোষে খাজনা দিতে প্রবঞ্চনার আশ্রয় নিয়ে জমিদারির কিছু-কিছু ভাগ নিজেদের নামে করে নিত। তা নইলে বড়-বড় জমিদার রাজা-মহারাজার সম্মানই পেত। আগেও যে বড়-বড় ভূস্বামী ছিল না, তা নয়। আকবরের আমলে বারো-ভূইঞার কাহিনি তো আমাদের জানা। তবে মুর্শিদকুলী খান ব্যবস্থাটাকে এমন এক নিয়মের মধ্যে নিয়ে এলেন, যাতে নবাবের প্রাধান্য অক্ষুণ্ণ রেখেও ক্ষমতার বহির্বৃত্তে তাদের প্রভাব অনেক বেড়ে গেল। এমনকি ভেতর-বৃত্তেও ঢুকে পড়ে কেউ কেউ। এটা সম্ভব হয় বিশেষ করে মনসবদার-জায়গিরদারদের স্থানচ্যুতির ও তুলনায় অবান্তর হয়ে পড়ার ফলে।৯ শতাব্দী শেষে ১৭৯৩-তে লর্ড কর্নওয়ালিস যে জমিদারদের সঙ্গে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করেন, তার বীজ কিন্তু পোঁতা হয় এই মুর্শিদকুলী খানের আমলে। অবশ্য তার অন্য মাত্রাও ছিল। রণজিৎ গুহ তার আলোচনা করেছেন।৯ক

ক্ষমতাবলয়ে জমিদাররা দৃশ্যমান হলেও নবাব যে তাদের স্বার্থকেই অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন, এমন ধারণা ঠিক নয়। তাঁর লক্ষ্য ছিল রাজস্ব-আয় বাড়ানো ও ব্যয় কমানো। দুদিক থেকেই জমিদারদের মাঝখানে রাখা তুলনায় লাভজনক। যেসব জমিদার সময়মতো খাজনা শোধ করতে ব্যর্থ হতো, তাদের প্রতি তিনি সদয় ছিলেন না। অতি নিষ্ঠুর আচরণ তাদের সঙ্গে করা হতো। নবাবের নিকট আত্মীয় সৈয়দ রেজা খানের ওপর ভার ছিল ওইসব জমিদারকে ধরে এনে তাদের ওপর নির্যাতন করার। সবচেয়ে গা-শিউরে-ওঠা ব্যাপার ছিল ‘বৈকুণ্ঠ’-বাস। অকল্পনীয় নোংরা খুপরি বানিয়ে তার নাম দেওয়া হয়েছিল ‘বৈকুণ্ঠ’। খাতক জমিদারদের সেখানে দায় খালাস না হওয়া পর্যন্ত পুরে রাখা হতো। অথবা তাদের জমিদারি কেড়ে নিয়ে তাদের ন্যূনতম খোরপোশের ব্যবস্থা করে দেওয়া হতো।১০ ব্যাপারটা কিন্তু বাস্তবে এখানেই থেমে থাকেনি। ঊর্ধ্বতন জমিদাররাও অধস্তন খাতকদের ওপর কেউ কেউ এই আচরণের অনুকরণ করতে শুরু করেন। গোটা দেশেই এর প্রাতিষ্ঠানিক চেহারা একটা দাঁড়িয়ে যায়। এখানে অপ্রাসঙ্গিক হলেও আগে থেকে আরো বলে রাখি, ১৭৬৫-তে বাদশাহ শাহ আলমের কাছ থেকে রবার্ট ক্লাইভ বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার দেওয়ানি হস্তগত করেন। তিনি আর এক মোহাম্মদ রেজা খানকে তাঁর সহকারী বানান। জমিদারদের নির্যাতন নতুন নয়, ইংরেজ প্রভুদের খাঁই মেটাতে সাধারণ প্রজাদের উৎপীড়নেও তিনি কম যান না। মুর্শিদকুলী খানের পর নবাব সুজাউদ্দিন             (১৭২৫-৪০) জমিদারদের গাফিলতির ব্যাপারে অনেকখানি নমনীয় হন। ধরে এনে জন্তু-জানোয়ারের মতো তাদের বেঁধে রাখায় তিনি খুব উৎসাহী ছিলেন না।১১ দিল্লি থেকে মোগল শাসনের কড়াকড়ি শিথিল হয়ে পড়ায় জমিদারদের ওপর নির্ভরতাও বাড়ে। বিশেষ করে মুর্শিদকুলী খানের ভূমি-ব্যবস্থা চালু করার পর যারা বড় জমিদার, যেমন, নাটোর, বর্ধমান, ঢাকা, বীরভূম, নদীয়া, বিষ্ণুপুর, কলকাতা ইত্যাদির আওতায় বড়-বড় এলাকাজুড়ে যাদের কর্তৃত্ব, তাদের উপেক্ষা করা চলে না। নবাব দরবারেও আসন পাতেন কেউ কেউ। বেশির ভাগই এই ভূখন্ডের। পাঠান-মোগলও যে কেউ ছিল না, তা নয়। পরে পলাশীকান্ডে এদের কারো কারো ভূমিকা যথেষ্ট সক্রিয় ছিল।১২ কলকাতার ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তো নিজেই সরাসরি প্রতিপক্ষ। এতে আরো বোঝা যায়, বিদেশি বণিকশক্তি তখন সাবালক হয়েছে। দেশের ভেতরে ডালপালা ছড়িয়েছে।

শুরু কিন্তু এর আরো একশ বছর আগে এবং তা মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীরের আনুকূল্যেই। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির গোড়াপত্তন ১৬০৮ সালে। পেছনে ছিল ব্রিটিশ রাজশক্তির অনুমোদন। স্যার টমাস রো ১৬১৫ সালে তাদের হয়ে মোগল সম্রাটের কাছ থেকে গোটা ভারতবর্ষে বাণিজ্য করার সনদ আদায় করে নেন।১৩ অবশ্য সম্রাটের অন্য বিবেচনাও ছিল। বেশ কিছুদিন থেকে পর্তুগিজ জলদস্যুরা সমুদ্রোপকূলে মোগল নৌবহরগুলোর ওপর হামলা চালিয়ে আসছিল। এমনকি উপকূলবর্তী অধিবাসীরাও তাদের আক্রমণ থেকে রেহাই পেত না। তাদের বাধা দিতেই ইংরেজ, ওলন্দাজ ও ফরাসি বণিক কোম্পানিগুলোর জন্যে বিশেষ সুবিধার কথা ভাবা। প্রত্যাশা ছিল, তারা নিজেদের স্বার্থে পর্তুগিজদের ঠেকাবে। পর্তুগিজ বাড়াবাড়ি যে এতে অনেকখানি দমানো যায়, তাতে সন্দেহ নেই। তবে ইংরেজরা ১৬৯০ সালে কলকাতা শহরের পত্তন ঘটালেও অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের সুযোগ খুব সহজে পায় না। মুর্শিদকুলী খান মোগল সম্রাটের অনুমোদন থাকলেও তা বাংলায় পুরোপুরি কার্যকর হতে দেন না।১৪ পরে এই নিয়ে খিটিমিটি। চূড়ান্ত পরিণতি পলাশীর যুদ্ধে।

তবে য়োরোপীয় বণিকরাই শুধু নয়, এখানকার অর্থ-লগ্নিকারকরাও ক্রমশ দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। সমুদ্রপারের বিদেশিদের ব্যবসা এর একটা পরোক্ষ কারণ ছিল নিশ্চয়। দেশি-বিদেশি টাকার বিনিময়-লেনদেন, কিস্তিমাফিক ধার দেওয়া ইত্যাদি বাড়ে। টাকায় রাজস্ব দেবার বিধিও বেশি প্রাধান্য পায়, ফলে টাকার কারবারিরা সামনে চলে আসে। বাংলার কৃষি, কুটির ও হস্তশিল্পের খ্যাতি, বহির্বিশ্বে উদ্বৃত্ত চাহিদা, এগুলো তাতে উৎসাহ জোগায়, গতি আনে। আওরঙ্গজেবের কাল থেকেই, সতেরো শতকের শেষ থেকে, অর্থ-ব্যবসার মূল কেন্দ্র দিল্লি বা পশ্চিম ভারত থেকে বাংলায় সরে আসতে শুরু করে। শেঠদের কারবার এখানে জাঁকিয়ে বসে। ১৭২৪ সালে বাদশাহ মহম্মদ শাহ শেঠ ফতেচাঁদকে জগৎ শেঠ উপাধি দেন এবং তা বংশানুক্রমিক হবে বলে ঘোষণা করেন।১৫ ইংরেজ ঐতিহাসিকরাও স্বীকার করেছেন, তাঁর তুল্য টাকার কারবারি তখন পৃথিবীতে কেউ ছিল না।১৬ জগৎ শেঠের প্রভাব শুধু ব্যবসার জগতেই সীমাবদ্ধ থাকে না। নবাবের ট্যাঁকশালের দায়িত্বও তাঁর ওপর এসে পড়ে। সেখানে ধাতব মুদ্রায় উপযুক্ত ছাপ পড়লে তবেই তা বৈধ বলে গণ্য হয়। জগৎ শেঠ অন্যান্য বিদেশি মুদ্রার বিনিময়ে বাটা আদায় করে টাঁকশালে তৈরি বিহিত মুদ্রা দিতেন। এই ব্যবসা তাঁর একচেটিয়া ছিল। বিদেশি মুদ্রা গলিয়ে তিনি আবার নবাবি মুদ্রা তৈরি করে বাজারে ছাড়তেন। এই ব্যবস্থা ইংরেজদের মনঃপূত ছিল না। এছাড়া দিল্লিতে একবার টাকার আকাল হলে হুন্ডি ব্যবস্থার ব্যাপক প্রয়োগ ঘটিয়ে তিনি বিপদ সামলে বাদশাহর প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠেন। নবাবের দরবার থেকে বাদশাহর দরবারে পাওনা অর্থ লোক-লস্কর দিয়ে সাড়ম্বরে বিপুল প্রহরায় পাঠাবার বদলে তিনি তাঁর দিল্লির কুঠির ওপর প্রাপ্য অর্থ মিটিয়ে দেবার বরাত দিতেন। এতে ঝামেলা অনেক কমে যায়। গোটা নবাবমহল তাঁর ঋণের ওপর নির্ভরশীল হয়েছিল। দরবারেও তিনি অন্যতম প্রধান প্রভাবশালী ব্যক্তি হয়ে উঠেছিলেন।১৭ নবাব সুজাউদ্দীনের সময়ে আর এক অর্থ-বিশারদ রায়রায়ান আলমচাঁদ রাজস্ব বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার পদ পান। জগৎ শেঠের মতো তিনিও প্রধান আমিরদের একজন বনে যান। নবাব আলীবর্দি খানের সময়েও (১৭৪০-৫৬) এ-ব্যবস্থা বহাল থাকে। বোঝা যায়, ক্ষমতার কেন্দ্রভূমির চরিত্র বদলে গেছে অনেকখানি। মীর জুমলা, শায়েস্তা খানের আমলে যেখানে কেবল ছিল মোগল সেনাপ্রধানদের আধিপত্য, সেখানে পরিবর্তিত অবস্থায় তারা প্রায় অপসৃত। কিছু ভাগ্যান্বেষী-উচ্চাভিলাষী মনসবদার তখনো ছিলেন। কিন্তু বেশি গুরুত্ব পেতে শুরু করে ভূস্বামী ও বণিকদের স্বার্থ। ভূস্বামীরা বেশিরভাগ স্থানীয় হলেও বণিকপ্রধানরা অধিকাংশ বহিরাগত। জগৎ শেঠ ও তাঁর মতো মাড়োয়ারিদের সেখানে সংখ্যাধিক্য। এছাড়াও ছিলেন গুজরাটি, পাঞ্জাবি, আরমানি বণিকরা। সমুদ্র পেরিয়ে আসা বণিকরা তাতে নতুন মাত্রা যোগ করেন। নতুন সংঘাতের ক্ষেত্রও তৈরি হয়। তার সুদূরপ্রসারী ফল নিয়ে তখন যে কেউ কিছু ভেবেছিল, এমনটি কিন্তু মনে হয় না। ব্রিটিশ কোম্পানির মাথায় সাম্রাজ্যের কোনো চিন্তা ছিল না। ব্যবসায়ে ফায়দা লোটাই ছিল তাদের লক্ষ্য।

বণিকতন্ত্রের (মার্কেন্টাইলিজম) একচেটিয়া কারবার ও বহির্বাণিজ্যে উদ্বৃত্ত আত্মসাৎনীতি তাদের তাড়িত করতো। পুঁজিবাদী তত্ত্বকাঠামো গড়ে ওঠে আরো পরে। ১৭৭৬-এ অ্যাডাম স্মিথের এন ইনক্যুয়ারি ইন টু দ্য নেচার অ্যান্ড কজেস অব দ্য ওয়েল্থ অব নেশন্স ছাপা হলে। তবে তত্ত্বকাঠামো খাড়া করা মানেই পুঁজিবাদী ব্যবস্থা চালু হওয়া নয়। পুরোপুরি তা কোনোখানেই হয়নি। আমরা প্রতিটি বাস্তব পরিস্থিতিতে অনেক রকম জানা-অজানা আয়ত্তাধীন ও  আয়ত্তের বাইরে ফলের সামনে দাঁড়াই। তখনো তেমন ঘটেছিল। ব্যক্তি ও সমষ্টি দুই-ই তার মুখোমুখি হয়।

এখন আওরঙ্গজেব কেন মুর্শিদকুলী খানের ওপর আস্থা রেখে তাঁকে বাংলায় রাজস্ব বিষয়ের দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়েছিলেন, তার একটা ব্যাখ্যা পাবার চেষ্টা করি। আগেই বলেছি, মুর্শিদকুলী খানের কর্মপ্রতিভার পরিচয় মেলে প্রথমে দাক্ষিণাত্যে। সম্রাট নিজেও তখন ওইখানে। আসলে তাঁর জীবনের শেষ কুড়ি বছর দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিম ভারত তাঁকে যুদ্ধবিগ্রহ ও বিদ্রোহ সামলানোয় ব্যতিব্যস্ত রাখে। শুরুও তার ওইখানে। শাহজাহান তখন বেঁচে। তিনি কাছে থেকে মুর্শিদকুলী খানের রাজস্ব বাড়াবার নতুন নতুন কৌশল লক্ষ করেছিলেন। এদিকে দাক্ষিণাত্যে গোলমাল লেগেই আছে। সেখানে সুফল অনিশ্চিত। বিপরীতে বাংলা স্থিতিশীল। আগেই তাঁর আমলের গোড়ার দিকে মীর জুমলা আসাম ও কোচবিহার কব্জা করে মোগল সাম্রাজ্যে নিয়ে এসেছেন। শায়েস্তা খান আরাকান রাজকে পরাস্ত করে চট্টগ্রাম দখল করেছেন ১৬৬৬ সালে। তারপর থেকে এ-অঞ্চল শান্ত এবং বাংলার মাটি অনেক বেশি উর্বরা। বিশ্বস্ত মুর্শিদকুলী খানের ভূমি-রাজস্ব ব্যবস্থায় এখান থেকে বাদশাহর রাজকোষ ভরবে অনেক বেশি। তার প্রয়োজনও বেড়ে গেছে অনেকগুণ। পেছনে কাজ করেছে সম্রাটের দূরাকাঙ্ক্ষা।

দাক্ষিণাত্যে বিজাপুর ও গোলকোন্ডায় ছিল শিয়া-শাসন। তাদের বিধ্বস্ত করে আওরঙ্গজেব ভারতবর্ষে মোগল সাম্রাজ্যের বিস্তার সম্পূর্ণ করেন। উত্তর-দক্ষিণে প্রায় গোটা উপমহাদেশেই তাঁর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। উত্তরে ভারতবর্ষের সীমানাও তা ছাড়িয়ে যায়। এদিকে শিয়া-সুন্নি বিভেদ মুসলিম জগৎকে বিভক্ত করে রেখেছে দীর্ঘদিন ধরে। ইরানে, ইরাকে ও তুরস্কের কিছু অংশে শিয়া প্রাধান্য; অন্যদিকে তুরস্ককেন্দ্রিক অটোমান সাম্রাজ্য (১২৮৪-১৯২১) দীর্ঘদিন ধরে সুন্নি মতাদর্শের নেতৃত্ব দিয়ে এসেছে। ইসলামে সবচেয়ে পবিত্র ধর্মীয় পীঠস্থান মক্কা-মদিনাও হয় সরাসরি তার আওতায় থেকেছে, নয়তো তাদের শাসনব্যবস্থার সঙ্গে তার একাত্মতা অব্যাহত রয়ে গেছে। ভারতবর্ষে মোগল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বাবরের আগমন মধ্য এশিয়ার স্টেপভূমির সমরখন্দ থেকে। শিয়া-সুন্নি বিরোধের কেন্দ্রভূমি তা কখনো হয়নি। এখানে প্রথম তিন মোগল সম্রাটও এ নিয়ে মাথা ঘামাননি। আকবর (১৫৫৬-১৬০৫) তো এই বিতর্কের বাইরে গিয়ে উদার মানবিক বোধের এক সমন্বিত রূপ দীন-ইলাহি চালু করার চেষ্টা করেছিলেন। এই সমন্বয়-সাধনা ছিল সাধারণ মানুষের ভেতরেও। এবং তার শুরু মোগল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার আগে থেকেই। এই ধারাতে পঞ্চদশ শতকে আসেন কবীর, ষোড়শ শতকে নানক, চৈতন্য দেব, দাদু, সতেরো শতকে রামদাস। তুলসী দাসের রামচরিত মানসও (১৫৭৫) এই ধারারই আর এক কীর্তি।১৮ তবে আকবরের পর মোগল সম্রাটদের দরবারে ও সেই সূত্রে শাসন       ভাবনায় সুন্নি মত প্রাধান্য পেতে শুরু করে। আওরঙ্গজেব (রাজত্বকাল, ১৬৫৮-১৭০৭) তার শুদ্ধতার প্রতিনিধি হয়ে উঠতে চান।

শুধুই ধর্মপরায়ণতা বোধহয় এর কারণ নয়। তখন অটোমান সাম্রাজ্যের গৌরবদীপ্তি আগের চেয়ে ম্লান। মোগল সম্রাটের চোখ পড়ে গোটা সুন্নি মুসলিম জগতের নেতৃত্বের ওপর। ভারতবর্ষ, আরাকান, আফগানিস্তান হয়ে তাঁর সাম্রাজ্য যদি মধ্য এশিয়াতেও প্রসারিত করা যায়, তবে তাঁর তুল্য ক্ষমতাবান সুন্নিজগতে আর কেউ তখন থাকেন না। এই কারণে দাক্ষিণাত্যে শিয়া সুলতানদের পরাস্ত করে তাঁদের বশ্যতা স্বীকারে বাধ্য করা। শাসিত ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের ওপর নানা বিধিনিষেধ আরোপ করা। একমাত্র কারণ না-ও হতে পারে। অন্য বিবেচনাও থাকা সম্ভব। তবে মোগল সম্রাটের প্রভাব-প্রতিপত্তি ও গৌরব সুন্নি মুসলিম জাহানে অদ্বিতীয় করে তোলার এই তাগিদকে খাটো করে দেখা যায় না।১৯

কিন্তু কোনো কিছুই বিনামূল্যে মেলে না। কাউকে না কাউকে কিছু না কিছু দাম দিতেই হয়। সঙ্গে সঙ্গে না হলেও কাল একসময় না একসময় তা চুকিয়ে নেয়। এখানে দামটা সবচেয়ে বেশি দেয় মোগল সাম্রাজ্যই। যদিও আপাতদৃষ্টে আওরঙ্গজেবই ছিলেন ভৌগোলিক বিস্তারে সবচেয়ে বড় মোগল সম্রাট। তবে তিনিও তাৎক্ষণিকভাবে হিসাব-নিকাশের ছক কিছু বদলাতে বাধ্য হয়েছিলেন। মুর্শিদকুলী খানকে দেওয়ান করে বাংলায় পাঠানোর পেছনে এই অনিবার্যতা কাজ করেছে বলে মনে হয়।

যুদ্ধবাজ হওয়া মানে সৈন্য-সামন্ত বাড়ানো। তাদের নিয়মিত বেতন দেওয়া, খুশি রাখা। দক্ষ সেনানায়কদের পদোন্নতি ঘটানো। তাদের মর্যাদা বৃদ্ধি করা। তখনকার দিনের অস্ত্র-শস্ত্র, সাজ-সরঞ্জাম, হাতি-ঘোড়া ইত্যাদির পেছনে বিপুল থেকে বিপুলতর খরচ অব্যাহত রাখা। জয়ী হবার আকাঙ্ক্ষা ছাড়া যৌক্তিক প্রত্যাশা একটাই – বিজিত অঞ্চল থেকে ধনদৌলত, ক্ষতিপূরণ, নজরানা, খাজনা ইত্যাদি ইচ্ছামতো তুলে আনা। যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি উশুল করা। হেরে গেলে কিছু করার নেই। রাজা স্বয়ং বিধ্বস্ত হয়ে নিজের দায় চোকান। কিন্তু খরচের বোঝা দুদিক থেকেই ঘাড়ে চাপে। হারলে তো বটেই। জিতলেও। এটা খেয়াল করবার, সৈন্য-সামন্ত বেশিরভাগ জোগাড় হয় অভাবী অঞ্চল থেকে। রাজ্য জয়ের প্রাথমিক নেশাও সেসব জায়গায় বেশি। পরে তা সাম্রাজ্য বিস্তারের আকার নেয়। অবশ্য সময় থেমে থাকে না। দুইয়ের ভেতর কালের ব্যবধান থাকতে পারে বিপুল। আর জ্ঞান ও প্রযুক্তির উদ্ভাবন, অগ্রগতি ও নিবেশন বদলে দিতে পারে গোটা প্রেক্ষাপটকেই। আওরঙ্গজেবের কালে তেমন পরিবর্তন কিছু ঘটেনি।

রাজ্যবিস্তার করতে গিয়ে আওরঙ্গজেব নিজেই নিজের ফাঁদে আটকা পড়ে যান। খরচ তুলতে যথেচ্ছ কর বাড়ান। জিজিয়া কর চাপান। এতে গণঅসন্তোষ বাড়ে। বিদ্রোহ ছড়ায়। দাক্ষিণাত্যে ১৭০২-০৪ সালে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ হয়। বিশ লাখের বেশি মানুষ মারা যায়। শিখ, আফগান, রাজপুত বিদ্রোহ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। মূল কারণ, ভূমি-রাজস্ব বৃদ্ধি ও তা আদায়ে কড়াকড়ি। মোগল প্রশাসনও নিরুপায়। কারণ, যুদ্ধ চালাতে আরো টাকার প্রয়োজন। প্রয়োজন আরো সৈন্য বাড়ানো; সেনা কর্মকর্তাদের খুশি রাখা, তাতে নিয়মের বাইরে গিয়েও দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেওয়া। এই পরিস্থিতিতেই ঘটে মারাঠা শক্তির উত্থান। ১৬৮০ খ্রিষ্টাব্দে শিবাজীর মৃত্যুর পরও তাদের গেরিলা হামলা জারি থাকে। অতিষ্ঠ হয়ে আওরঙ্গজেব নিজেই সেনাবাহিনী নিয়ে তাদের নির্মূল করতে এগিয়ে যান। কিন্তু মারাঠারা মোগল বাহিনীকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে। কোনোরকমে আওরঙ্গজেব প্রাণ নিয়ে পালিয়ে বাঁচেন। তারপরেই তাঁর মৃত্যু হয়। শেষ জীবনে ত্যক্ত-বিরক্ত সম্রাট ছেলেদের কাছে আক্ষেপ করে লেখেন, ‘এমন যে মূল্যবান জীবন তা-ও অকারণে নষ্ট হয়ে গেল।’২০ দাক্ষিণাত্যেই দৌলতাবাদে তাঁকে দায়সারাভাবে সমাহিত করা হয়। বিশাল মোগল সাম্রাজ্য ভেঙে পড়তে থাকে তারপরেই। কেন্দ্র ও প্রান্তর সমন্বয়, যা আকবরের সময়ে ছিল এবং যা গণমানুষেও সঞ্চারিত হয়েছিল, তা হারিয়ে যায়। তবে সব প্রান্তেই মোগল সম্রাটের প্রতি আনুগত্যের অঙ্গীকার বজায় থাকে। বাংলাতেও। কেন্দ্রে রাজস্ব ও নজরানা পাঠানো বন্ধ হয় না।

এই বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে মুর্শিদকুলী খানকে অষ্টাদশ শতকের গোড়ায় বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার দেওয়ান করে পাঠাবার বিষয়টি আমরা ভেবে দেখি। যুদ্ধবিগ্রহ সম্রাটের কোষাগার খালি করে দেয়। বিভিন্ন জায়গায় ভূস্বামীদের নেতৃত্বে কৃষিজীবীদের বিদ্রোহ অবস্থা আরো জটিল করে তোলে। অথচ রাজস্বের প্রয়োজন ক্রমবর্ধমান। বাংলা-অঞ্চল তুলনায় দীর্ঘদিন ধরে শান্ত। দাক্ষিণাত্যের পাহাড়ি জমিতে উৎপাদন কম। ব্যবসা-বাণিজ্যেও বাংলায় নতুন নতুন সম্ভাবনা বেশি-বেশি শুল্ক আদায়ের আশা জাগায়। কাজেই সম্রাটের কোষাগার ভরতে উদ্বৃত্ত আদায়ে বাড়তি নজর পড়ে এদিকেই। এবং সততা ও দক্ষতার সঙ্গে সেই কাজ সামাল দিতে মুর্শিদকুলী খানকেই মনে হয় যোগ্যতম ব্যক্তি। দেওয়ান হয়ে সম্রাটের এই আস্থার যোগ্য বলে তিনি নিজেকে প্রমাণ করেছেন। পরে নিজেই যখন মুর্শিদাবাদে তিনি নবাব হয়ে বসেন, তখনো তাঁর কর্মদক্ষতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা একই রকম থেকেছে। তবে আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর পরিস্থিতি পালটে যায় অনেকখানি। দিল্লির রাশ আলগা হয়ে পড়ে। নবাব নিজের বুদ্ধিতে বেশি চলেন।

এদিকে বাংলায় মুর্শিদকুলী খানের মৃত্যুর (১৭২৫) পরই পরিস্থিতি ঘোলাটে হয়ে উঠতে শুরু করে। জনজীবনে শান্তি ও সুস্থিতির বাতাবরণ যে একটা ছিল, তা দ্রুত মিলিয়ে যেতে থাকে। ভূস্বামীরা খাজনা আদায়ে বেশি তৎপর হয়। কারণ, নবাবের দরবারে তা সময়মতো পৌঁছানো চাই। তা নইলে লাঞ্ছনার একশেষ। কোথাও কোথাও এরই অজুহাতে প্রজাপীড়ন মাত্রা ছড়ায়। জমিদারদের ভিতরে স্তরবিন্যাস বাড়ে। কারণ, বড় বড় ভূস্বামীর বিশাল এলাকায় একার পক্ষে খাজনা আদায় করার মতো উপযুক্ত বিধি-ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। যান-চলাচলও সব জায়গায় সুগম ও নিরাপদ ছিল না। এটা নতুন কিছু নয়। কিন্তু স্বচ্ছন্দ জীবনযাপন অনিশ্চিত হয়ে পড়ায় অভাবের তাড়নায় চুরি-ডাকাতি বেশি বেশি হতে থাকে। পথেঘাটেও। আর নবাবের প্রশাসনিক ব্যবস্থার ভিতরেও সুযোগমতো যে যেমন পারে বাড়তি ফায়দা লোটার দিকে ঝোঁকে। সেনা ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীতে তো আরো বেশি। আজ যে আমরা ঘুষ আর দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিক বেড়াজালে আটকা পড়ে হাবুডুবু খাই, কার্যকরভাবে তার শুরু কিন্তু ওই সময়েই। উনিশ শতকে এসে কাজকর্মের সংকীর্ণ পরিসরেও বাঙালিবাবুদের ‘উপরি-খাওয়া’ এক সংস্কৃতিতে দাঁড়িয়ে যায়। তাতে বাহাদুরির গৌরবই ফুটে ওঠে।২১

নবাবির উত্তরাধিকার তখন থেকে কোনোবারই নির্বিবাদে ঘটেনি। এবং তা নিয়ে প্রতিবারই গণ্যমান্য প্রভাবশালীরা সাগ্রহে জড়িয়ে পড়েছে। নবাববাড়ি ও আমির-ওমরাহদের ছাড়িয়ে এই  প্রভাব-বলয় সেনাবাহিনীর ওপর মহলে ও প্রতাপশালী বড় বড় ভূস্বামীর ভিতরেও ছড়িয়েছে। সেখানেও কিন্তু দলাদলি-রেষারেষির কমতি ছিল না। মুর্শিদকুলী খানের কোনো পুত্রসন্তান ছিল না। দৌহিত্র সরফরাজ খানকে তিনি উত্তরাধিকারী মনোনীত করে বিশেষ করে ফতেচাঁদ জগৎ শেঠের পরামর্শ নিয়ে অর্থ-রাজস্ব ব্যবস্থা পরিচালনার উপদেশ দিয়ে যান।২২ কিন্তু সরফরাজ নবাব হতে পারেননি। তাঁর বাবা সুজাউদ্দীন ছিলেন উড়িষ্যার শাসনকর্তা। তাঁর অত্যধিক ইন্দ্রিয়পরায়ণতার জন্য মুর্শিদকুলী খানের তিনি বিরাগভাজন ছিলেন। তাঁর স্ত্রীও তাঁর সঙ্গে না থেকে মুর্শিদাবাদে বাবার কাছে থাকতেন। নবাবের মৃত্যুসংবাদ পেয়েই তিনি সৈন্য-সামন্ত নিয়ে নবাবের তখত দখলের অভিযানে বেরিয়ে পড়েন। তাঁর এক আত্মীয়ের দুই ছেলে আলীবর্দি খান ও হাজি আহম্মদ ছিলেন তাঁর অধীনে কর্মরত দক্ষ উপদেষ্টা। তাঁদেরই পরামর্শে দিল্লির দরবারে তদবির করে তিনি তাঁর সুবেদারি পাকাপোক্ত করেন। বড় বড় আমির-ওমরাহ এবং জগৎ শেঠও তাঁর আনুগত্যই মেনে নেন। যদিও মুর্শিদকুলী খানের নির্দেশের কথা তাঁরা জানতেন এবং তাঁর চারপাশে থেকেই তাঁদের বাড়বাড়ন্ত। তাঁদের পরামর্শ অনুযায়ী সরফরাজও পিতার বশ্যতা স্বীকার করেন। এদিকে আলীবর্দি খান ও হাজি আহম্মদ উজিরসভায় সবচেয়ে প্রভাবশালী হয়ে ওঠেন। আমরা জানি, মুর্শিদকুলী খান ছিলেন বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার নবাব। কিন্তু শুরুতে সুজাউদ্দীনকে দায়িত্ব দেওয়া হয় কেবল বাংলা ও উড়িষ্যার। পরে ১৭৩২ সালে বিহারও আবার এই সঙ্গে জুড়ে দিয়ে দিল্লি থেকে ফরমান জারি হয়। বিহারের শাসনভার পরিচালনার জন্য সুজাউদ্দীন আলীবর্দি খানকে সেখানে পাঠিয়ে দেন। ষড়যন্ত্র ও ক্ষমতার খেলা প্রকট হয়ে উঠতে থাকে তখন থেকেই।

আরো নৃশংস ও ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটে ১৭৩৯ সালে সুজাউদ্দীনের মৃত্যুর পর। পাত্র-মিত্র অমাত্যরাই এর প্রধান কুশীলব। সরফরাজ এবার নবাব হন। কিন্তু হাজি আহম্মদ, রায়রায়ান আলমচাঁদ, ফতেচাঁদ জগৎ শেঠ, এঁরা ইন্ধন জোগালে আলীবর্দি খানও পাটনা থেকে নবাব হবার প্রস্ত্ততি নিতে শুরু করেন। এই লক্ষ্যে প্রচুর উপঢৌকন দিয়ে দিল্লির দরবার থেকে সনদ জোগাড় করে তিনি মুর্শিদাবাদ দখল করতে যুদ্ধযাত্রা করেন। কোনো কৃতজ্ঞতাবোধ এখানে কাজ করে না। সরফরাজও সৈন্যসামন্ত নিয়ে আলীবর্দি খানকে ঠেকাতে অগ্রসর হন। ১৭৪১ সালে জানুয়ারি মাসে গিরিয়ার যুদ্ধে সরফরাজের বাহিনীকে পরাজিত ও তাঁকে নিহত করে আলীবর্দি খান মুর্শিদাবাদের মসনদে জাঁকিয়ে বসেন। ষড়যন্ত্রই ফলবতী হয় এবং ভবিষ্যতে আরো ভয়ংকর ষড়যন্ত্রের পথ প্রশস্ত করে।

দক্ষ প্রশাসক বলে আলীবর্দি খানের সুনাম ছিল। আস্থাভাজন ব্যক্তিদেরই তিনি দরবারে উচ্চপদে আসীন করেন। তাদের খাতিরও করতেন। রায়রায়ান, ফতেচাঁদ, রাজবল্লভ এঁরাও তাঁদের ভিতর ছিলেন। তবে সেনাবাহিনীতে মোগল-পাঠান-আরবরাই ছিল শীর্ষে। মীর জাফর ছিলেন অশিক্ষিত আরব। কবে কোথা থেকে এসে জুটেছিলেন, ঠিক জানা যায় না। পরে অবশ্য আলীবর্দি খানের এক শ্যালিকার সঙ্গে বিয়ে হয় তার।২৩ কর্মজীবনের শুরুতে যথেষ্ট বীরত্ব দেখিয়ে তাঁর উন্নতি। মাঝপথে এসে এই বীরত্বের অবশেষ কিছুমাত্র ছিল না। তবে পদমর্যাদা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে উচ্চাশাও প্রবলতর হয়। এটা অবশ্য ওই চক্রজালে কোনো অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়। আলীবর্দি খান নিজেও সেভাবে উঠে আসেন।

আলীবর্দি খানের শাসন-আমল কিন্তু নির্ঝঞ্ঝাট ছিল না। মোগল শাসন তখন নানা আঞ্চলিক শক্তির উত্থানে ব্যতিব্যস্ত। সেনাবাহিনী পোষার সংগতি ক্রমহ্রাসমান। তার ওপর একের পর এক উত্তর-পশ্চিম থেকে বহিঃশক্তির হামলা। প্রথম প্রবল আক্রমণ বাংলায় সরফরাজের স্বল্পকালীন শাসনকালে। পারস্য সম্রাট নাদির শাহ ১৭৩৯ সালে দিল্লি দখল করেন। তাঁর নিষ্ঠুরতার কাহিনি বাংলাতেও এসে পৌঁছায়। ভয় পেয়ে সরফরাজ আগেভাগে নাদির শাহের দাবি অনুযায়ী তিন বছরের রাজস্ব তাঁকে পাঠাবার ব্যবস্থা করেন। তাঁর নামে মুদ্রাও চালু করেন। পারস্য সম্রাট কিন্তু দিল্লিতে স্থায়ী হতে আসেন না। নির্বিচার হত্যাকান্ড ও যথেচ্ছ লুণ্ঠন সমাধা করে দুমাস পরেই ফিরে যান। অবশ্য সিন্ধু নদের পশ্চিম ভূখন্ড তাঁর অধিকারে, এই ঘোষণাও দিয়ে যান। মোগল সম্রাট মহম্মদ শাহ আবার দিল্লির অধিকার ফিরে পান। তবে সরফরাজের নাদির তোষণের বৃত্তান্ত তাঁকে রুষ্ট করে। পরে আলীবর্দি খানকে নবাব হিসেবে স্বীকৃতি দেবার পেছনে এটাও ইন্ধন জুগিয়েছিল বলে মনে হয়।

এরপর শুরু হয় নাদির শাহের আফগান সেনাপতি আহমদ শাহ আবদালির পৌনঃপুনিক ভারত আক্রমণ। তিনি ১৭৪৮, ১৭৫০, ১৭৫২, ১৭৫৬-৫৭, ১৭৫৮ ও সবশেষে ১৭৬১-তে হামলা চালান। নাদির শাহের মতো তাঁরও লুণ্ঠনই ছিল প্রধান লক্ষ্য। তার একটি কারণ অভ্যন্তরীণ হানাহানি। নিজ দেশে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু থেকে দীর্ঘদিন দূরে সরে থাকলে তাঁর নিজের অবস্থা দুর্বল হয়ে পড়বে, এ আশঙ্কা তাঁর ছিল। আর, লুণ্ঠনেই যদি কাঙ্ক্ষিত সম্পদ হরণ করা যায়, তবে রাজ্য শাসনের বাড়তি ঝামেলার প্রয়োজন পড়ে না। দেশের ঘাটতি অঞ্চল থেকে জড়ো করা সৈন্য-সামন্তদেরও তুষ্ট রাখা যায়। মধ্য এশিয়ার স্টেপ-ভূমি থেকে এই ধারা চেঙ্গিস খাঁর সময় থেকেই (ত্রয়োদশ শতাব্দী) চলে আসছে। অবশ্য ভারতবর্ষে আফগান আক্রমণের ইতিহাস আরো আগে থেকে। একাদশ শতকের শুরুতে গজনির সুলতান মাহমুদ ১০২৬ সাল পর্যন্ত প্রায় প্রতিবছর লুটপাট করতে আসতেন। ত্রয়োদশ শতকে এসে ১২০৬ সালে মহম্মদ ঘুরীর তুর্কি ক্রীতদাস কুতুবুদ্দিন আইবক প্রথম ভারতভূমিতে স্থায়ী রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে দিল্লিতে রাজধানী স্থাপন করেন। তখন থেকে দিল্লিই হয়ে ওঠে সুলতান বা বাদশাহদের রাজশক্তির কেন্দ্রবিন্দু। কিন্তু ঘাটতি অঞ্চলে রাজ্য প্রতিষ্ঠা করলে আর উৎপাদন প্রযুক্তিতে যদি কোনো উন্নতি না ঘটে, তবে লুণ্ঠনের তাগিদ থেকেই যায়। বর্গির হাঙ্গামার পেছনে এইটিই ছিল মূল কারণ।

আহমদ শাহ আবদালি বাংলা পর্যন্ত না এলেও যখনই এসেছেন, তখনই মুর্শিদাবাদকেন্দ্রিক ভূখন্ডের শাসন কেঁপে উঠেছে। দিল্লি বেশি বেশি রাজস্বের তাগাদা দিয়েছে। তা মেটাতে জগৎ শেঠের ওপর নির্ভরতা বেড়েছে। বাড়তি খাজনা আদায়ে ভূস্বামীদের বাধ্য করা হয়েছে। চাষিদের শোষণ করে তারা তা মিটিয়েছে। এদিকে আফগান-উৎপাত বেধে যায় ভিতর থেকে বিহার অঞ্চলেও। সেনাবাহিনীতে উচ্চপদস্থ আফগানরা একের পর এক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে বিহারের কর্তৃত্ব দখলের চেষ্টা চালায়। তাদের সামলাতে আলীবর্দি খানকে হিমশিম খেতে হয়।

তবে সবচেয়ে বেশি নাকাল হয়েছেন তিনি মারাঠি বর্গিদের হাতে। লুণ্ঠনই ছিল তাদের মূল লক্ষ্য। যখন দলে দলে আসত, দেশে হাহাকার পড়ে যেত। দাবি ছিল তাদের, ‘চৌথ্ দেও’। চৌথ্ হলো উৎপাদিত ফসলের এক-চতুর্থাংশ। কখনো কখনো কোনো কোনো অঞ্চলে তাদের ওই দাবি বাংলার নবাব মেটাতে বাধ্য হতেন। এই করে উড়িষ্যার কর্তৃত্বও তাদের হাতে ছেড়ে দিতে হয়। বাংলা ছড়ায় যে অক্ষয় ছাপ রেখে চলেছে ‘ছেলে ঘুমালো, পাড়া জুড়ালো, বর্গি এলো দেশে, বুলবুলিতে ধান খেয়েছে, খাজনা দেব কীসে?’ – তার বাস্তব উৎকণ্ঠার পটভূমি চিনে নিতে অসুবিধা হয় না। চল্লিশের দশকে বর্গিরা প্রায় প্রতিবছরই হানা দিত। ১৭৫১-তে আলীবর্দিকে নাস্তানাবুদ করে ‘চৌথ্’ দেবার শর্ত চাপিয়ে ফিরে যাবার পর তাদের উপদ্রব স্তিমিত হয়ে আসে। ‘চৌথ্’ আদায়ের ভার পড়ে জমিদারদের ওপর। তার বাড়তি বোঝা বইতে হয় চাষিদের। পূর্ববঙ্গে বর্গির হাঙ্গামা ঘটেনি। কিন্তু সেখান থেকেও পাইকারি হারে চৌথ্ সংগ্রহ চলে। লুটপাট আর রাহাজানি থেকে রক্ষা পেতে সবাই মুখ বুজে এই জুলুম মেনে চলে। তারপরও পলাশীর যুদ্ধের পর ১৭৬১ সালে আবার রব ওঠে, পেশোয়া বালাজি বাজিরাও-এর নেতৃত্বে বর্গিরা আবার আসছে। কিন্তু তা আর ঘটে না। ওই বছরই তৃতীয় পানিপথের যুদ্ধে আহমদ শাহ আবদালির আফগান বাহিনীর হাতে মারাঠা শক্তি পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়। বালাজি বাজিরাও-ও প্রাণ হারান। বাংলায় বর্গির উৎপাতের সমাপ্তি ঘটে এভাবে। তবে আলীবর্দি খানের আমলে তারা তাঁকে কখনো নিশ্চিন্ত হতে দেয়নি। তারপরেও অবশ্য তাঁর নবাবি অটুট থেকেছে। এতে আর্থিক সহায়তার জন্য ক্রমশ তিনি প্রথমে ফতেচাঁদ ও পরে মহতাব চাঁদ জগৎ শেঠের ওপর বেশি বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। ক্ষমতার ভারসাম্য কিন্তু এতে স্থানচ্যুত হতে শুরু করে। তার ওপরতলের সমাবেশ আর এক-রঙা থাকে না। আগে যে মনসবদার-প্রধান প্রশাসন গোটা দেশে হুকুম চালাতো, তাতেও নানা ধরনের দ্বন্দ্ব-বিশৃঙ্খলা মাথাচাড়া দেয়। সেখানে একটি বড় ভূমিকা রাখে তাঁর নিজেরই আত্মীয়স্বজনেরা। তিনি তা সামাল দেন। কিন্তু পারস্পরিক হিংসা থেকে যায়। তাকে চরমসীমায় নিয়ে যেতেও কেউ পিছপা থাকে না।

আলীবর্দি-শাসনের শেষ তিন-চার বছর পারিবারিক অশান্তিতে ভরা। এর মূল কারণ তাঁর বার্ধক্য ও বিভিন্ন আপনজনের নবাবি মসনদের দিকে লোলুপদৃষ্টি। নবাব কিন্তু আগে থেকেই নির্বাচন করে রাখেন দৌহিত্র সিরাজউদৌল্লাকে। এতে তিক্ততা আরো বাড়ে। আমরা দেখেছি, মুর্শিদকুলী খান একইভাবে দৌহিত্র সরফরাজ খানকে তাঁর উত্তরাধিকারী মনোনীত করে যান। কিন্তু জামাই সুজাউদ্দীন তা হতে দেননি। পরে সরফরাজ খান। মসনদে বসলেও আত্মীয়দের ভিতরে গণ্য আলীবর্দি খান তাঁকে হত্যা করে নিজে নবাব হয়ে বসে জগৎ শেঠের প্রভাবে দিল্লি থেকে তার সনদ নিয়ে আসেন। এবার তাঁর জীবিতাবস্থাতেই সবাই নড়েচড়ে বসেন। আর সিরাজউদ্দৌলার চালচলন এমন ছিল যে, তাঁকে যে কেন আলীবর্দি খান বেছে নিলেন, এটা খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার।২৪

মুর্শিদকুলী খানের মতো আলীবর্দি খানও অপুত্রক ছিলেন। তাঁর মেয়ে গহ্সেটি বেগমের বিয়ে দেন তাঁর বড়ভাই হাজি আহম্মদের বড় ছেলে নওয়াজিশ মহম্মদের সঙ্গে। দ্বিতীয় জামাই ছিলেন মধ্যম ভ্রাতুষ্পুত্র সৈয়দ আহম্মদ। কনিষ্ঠ কন্যা আমিনা বেগমের স্বামী জয়েনউদ্দীন আহম্মদ ছিলেন আর এক ভাইপো। এই ছোট মেয়ের ছেলে সিরাজ। আলীবর্দি খান নওয়াজিশ মহম্মদকে করেছিলেন ঢাকার শাসনকর্তা, সৈয়দ আহম্মদকে উড়িষ্যার ও জয়েনউদ্দীনকে বিহারের। হাজি আহম্মদ ও জয়েনউদ্দীন বিহারে বিদ্রোহী আফগানদের হাতে প্রাণ হারান। নওয়াজিশ মহম্মদ ছিলেন ধীরস্থির ও কর্মদক্ষ। নবাব দরবারে তাঁর প্রভাবও ছিল যথেষ্ট। স্ত্রী গহ্সেটি বেগমের উচ্চাভিলাষ গোপন ছিল না। দুই বিশ্বস্ত কর্মকর্তা হোসেন কুলী খান ও রাজবল্লভ সেন তাঁর সহায় ছিলেন।

গোল বাধে গহ্সেটি বেগমের আচরণে। তিনি হোসেন কুলী খানের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েন। এদিকে ছোট বোন আমিনা বেগমও আকৃষ্ট করেন হোসেন কুলী খানকে। ক্ষিপ্ত গহ্সেটি প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে নবাববাড়িতে তোলপাড় তোলেন। তারই পরিণামে আলীবর্দি খানের বেগমের ইঙ্গিতে সিরাজউদ্দৌলা প্রকাশ্য দিবালোকে হোসেন কুলী খান ও তাঁর অন্ধ ভাই হায়দার আলী খানকে রাজপথে টেনে বের করে এনে খন্ড খন্ড করে হত্যা করেন। আলীবর্দি খান কোনো প্রতিক্রিয়া দেখান না। কিন্তু দরবার হকচকিত হয়। আত্মরক্ষার জন্যে এবং প্রয়োজনে আঘাত হানার জন্যে প্রত্যেকে আপন আপন কৌশল স্থির করায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এরই ভিতরে নওয়াজিশ মহম্মদ ও সৈয়দ আহম্মদ মারা যান। তারপরও গহ্সেটি বেগম রাজবল্লভ সেনের ওপর নির্ভর করে একটি ক্ষমতা-বলয় তৈরির চেষ্টায় থাকেন। তাঁর নিজের কোনো সন্তান ছিল না।

সিরাজের দৌরাত্ম্য কিন্তু বেড়েই চলেছে। আগে পিতা জয়েনউদ্দীন আহম্মদের মৃত্যুর পর নবাবের ফরমানের তোয়াক্কা না করেই তিনি বিহারের কর্তৃত্ব নিতে একবার হাঙ্গামা বাধিয়েছিলেন। নবাব কৌশলে তাঁকে নিবৃত্ত করেন। বর্গির হাঙ্গামা প্রশমিত হলে আলীবর্দি খান কিছু সময় মৃগয়ায় কাটাতে যান। সেখানেও সিরাজ তাঁর দলের ওপর হামলা চালান বলে অনেকে অভিযোগ করেন। নবাব এসবে কান দেন না। কিন্তু দরবার বিরক্ত ও অস্থির বোধ করতে থাকে। ভেতর থেকে কোনো স্বাভাবিক আনুগত্য গড়ে ওঠে না। কোনো উল্লেখযোগ্য বীরত্বের নিদর্শন না দেখাতে পারলেও মীর জাফর প্রধান সেনাপতির পদে উন্নীত হন। তিনিও উচ্চাশা পোষণ করতে থাকেন। সুযোগ পেলে যার-যা-খুশি করার পরিবেশ একটা তৈরি হয়। অবশ্য দৃষ্টি কেন্দ্রীভূত থাকে মুর্শিদাবাদের মসনদেই। তাতে দূরের কোনো স্বার্থকে কাজে লাগাবার কথা ভাবা যায়। কিন্তু তা নিজেই এসে সবার ঘাড় মটকাবে, এ-কথা কেউ কল্পনা করে না।২৫

১৭৫৬ সালে আলীবর্দি খান গত হলে তাঁর উত্তরাধিকার নিয়ে বিরোধ আবার মাথাচাড়া দেয়। তাঁর মনোনীত সিরাজউদ্দৌলা নবাব হয়ে বসেন। কিন্তু তা মানতে চান না আলীবর্দির আর এক দৌহিত্র সৈয়দ আহম্মদের ছেলে, বিহারের শাসনকর্তা শওকত জঙ্গ। গহ্সেটি বেগমও তাঁর পালিত পুত্র সিরাজের ভাই একরামউদ্দৌলার নাবালক সন্তান মোবারকউদ্দৌলার নামে মসনদ দাবি করে বসেন। রাজসভা ষড়যন্ত্রের আখড়া হয়ে ওঠে। তবে এটা নতুন কিছু নয়। এই পথেই নবাব হয়েছেন আগে সুজাউদ্দীন ও আলীবর্দি খান স্বয়ং। সরফরাজ নবাব হয়েও প্রাণ হারিয়েছেন। শওকত জঙ্গ দিল্লি থেকে সনদ পেয়েছেন বলেও দাবি করেন। এবং জগৎ শেঠের মতো প্রভাবশালী ব্যক্তির প্রচ্ছন্ন সমর্থন তাঁর দিকে ছিল, এমনটি অনুমান করা যায়। সিরাজউদ্দৌলা বিষয়টি জানতে পেরে এতটুকু দেরি না করে সৈন্য-সামন্ত নিয়ে বিহারে শওকত জঙ্গের মোকাবিলা করতে ছোটেন, এবং তাঁকে বিনাশ না করে ফেরেন না। তার আগে মসনদে বসেই গহ্সেটি বেগমকে তিনি পাকড়াও করেন। গহ্সেটির বিষয়-সম্পত্তি সব বাজেয়াপ্ত হলো। তাঁর প্রধান মন্ত্রণাদাতা বলে অভিযুক্ত অন্তত তখনকার দেশীয় সমাজের ওপর মহলে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ,২৬ রাজবল্লভ সেন আপন পরিবারের জন্যে কলকাতায় ইংরেজ কুঠিতে আশ্রয়ভিক্ষা করলেন। ইতিহাসের গতিপথ পরিবর্তনের সূত্রপাতে ইন্ধন জোগালো এই ঘটনা। তবে না নবাব, না ইংরেজ বণিকেরা, না রাজবল্লভ, কেউ এর গুরুত্ব বা পরিণাম-সম্ভাবনা সম্পর্কে তখন এতটুকুও সচেতন ছিলেন বলে মনে হয় না। আমরা এ-বিষয়ে পরে আসছি। তার আগে যা জেনে রাখা প্রয়োজন, এতসব কান্ডকারখানায় জনগণের কোনো সংযোগ ছিল না। তাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছা, কোনোটিই কারো কোনো চালে ছায়া ফেলে না। যদিও ভুক্তভোগী হয় তারা সকলেই। ওই সময়ের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা স্ক্র্যাফটন তাঁর স্মৃতিচারণে মন্তব্য করেছেন, ‘Yet an Englishman cannot but wonder to see how little the subjects in general are effected by any revolution in government; it is not felt beyond the small circle court. To the rest it is a matter of the utmost indifference, whether their tyrant was a Persian or a Tartar; for they feel all the curses of power, without any of the benefits but that of being exempt from anarchy, which is alone the only state worse than they endure.’২৭ এতে সহানুভূতির অভাব থাকতে পারে। তবে কোনো অতিশয়োক্তি নেই। এটুকুই শুধু যোগ করার, ওই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিরই দৌরাত্ম্য পরের বছরগুলোতে যেখানে গিয়ে পৌঁছায়, তাতে জনগণের নিত্য দুর্গতি বিভীষিকার আকার নেয়। এই বাংলা-ভূখন্ড ছারেখারে যায়।

 

তিন

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে নবাবি শাসনের ঠুকুমুকু লেগে যায় আলীবর্দি খানের আমলেই। মারাঠাদের ঠান্ডা করতে তাঁর অনেক টাকার প্রয়োজন। বিদেশি বণিকদের ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপরও তাই তিনি বাড়তি শুল্ক চাপাতে শুরু করলেন। আদায়পত্রতেও কড়াকড়ি বাড়লো। এছাড়া ১৭৪৯ সালে ইংরেজ-কুঠির সশস্ত্র কর্মীরা নবাবকে উপেক্ষা করে আর্মানি বণিকদের ঘাঁটিতে হামলা চালায়। ক্ষিপ্ত নবাব তাদের ব্যবসা বন্ধ করে দেবার উদ্যোগ নেন। শেষ পর্যন্ত বিপুল অর্থদন্ড দিয়ে ইংরেজরা পরিত্রাণ পায়। এই অর্থ প্রদানে জগৎ শেঠের কারবারের ওপর তাদের নির্ভর করতে হয়। উভয়ের ভিতর যোগাযোগও আরো গভীর ও  অর্থবহ হয়ে উঠতে থাকে। নবাব কিন্তু ইংরেজদের ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খাওয়ার ফন্দি-ফিকিরের ব্যাপারে সবসময়ে সন্দিহান ছিলেন। মারা যাবার আগে সিরাজকে তিনি সতর্ক করে দিয়ে যান, এদের বিশ্বাস করো না।

নবাবি হাতে পেয়েই সিরাজউদ্দৌলা ইংরেজদের সঙ্গে সংঘাতের পথে ছোটেন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি মনে করেছিল, গহ্সেটি বেগমের দলই বেশি প্রভাবশালী। তাই রাজবল্লভের ছেলে কৃষ্ণ দাসকে ও তাঁর পরিবারের অন্যান্য সদস্যকে বিপুল পরিমাণ ধনরত্ন সমেত আশ্রয় দিতে দ্বিধা করে না। নিয়াবতের হিসাব-নিকাশ ঠিকঠিক জমা দেননি, এই অজুহাতে রাজবল্লভকে নবাব বরখাস্ত করলেন ও মুর্শিদাবাদে এনে নজরবন্দি করে রাখলেন। তাঁর হুকুমের তোয়াক্কা না করে ইংরেজ কুঠিয়ালরা পলাতক আসামিদের রক্ষা করছে, এতে তিনি বিলক্ষণ চটলেন। তাঁর মেজাজ যখন এইরকম চড়া, তখন তিনি জানতে পেলেন, ইংরেজরা তাদের কুঠিগুলোকে প্রাচীর দিয়ে ঘিরে দুর্গ বানাচ্ছে। তাদের অজুহাত, য়োরোপে ইঙ্গ-ফরাসি যুদ্ধের অনুসরণে এখানেও ফরাসিরা তাদের ওপর হামলা করতে পারে। তাই তাদের উদ্যোগ সবটাই আত্মরক্ষামূলক। নবাব এতে কর্ণপাত করলেন না। দ্রুত এসে কাশিমবাজারের কুঠি দখল করে নিলেন, তারপর কলকাতার ওপর চড়াও হয়ে সেখানে কোম্পানির লোকজনকে হেনস্থার একশেষ করে ছাড়লেন। কাশিমবাজার দখল করার পর চুক্তিপত্রে তাদের রাজি হতে বাধ্য করলেন, তারা কোনো দুর্গ তৈরি করতে পারবে না, নবাব-মুলুকের কোনো পলাতককে আশ্রয় দিতে পারবে না, মুর্শিদকুলী খানের সময় যে-শর্তে ব্যবসা-বাণিজ্য করতো তার চেয়ে এতটুকু বেশি সুযোগ-সুবিধা পাবে না, কোম্পানির কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারী স্বাধীন ব্যবসায় কোম্পানির সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে পারবে না এবং তাদের অবাধ্যতার জন্যে নবাবকে বিপুল পরিমাণ অর্থদন্ড দেবে।২৮ এখানে ব্যবসা করতে হলে তখন ইংরেজদের এসব মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। কলকাতার বা অন্য জায়গার কুঠিগুলো অবশ্য তাদের হাতে ফিরে আসে। কলকাতা ফতে করে বীরদর্পে মুর্শিদাবাদে প্রত্যাবর্তন করেন নবাব। যেমন আগে বলেছি, শওকত জঙ্গের নিকাশ সাধনে বেরিয়ে পড়েন। কার্য সমাধা হলে তিনি নিজেকে নিষ্কণ্টক ভাবতে শুরু করেন। তাঁর ভিতরে ধরাকে সরা জ্ঞান করার ঔদ্ধত্য আরো বাড়ে।

অগ্র-পশ্চাৎ-বোধহীন এই উন্মত্ততাই কিন্তু তাঁর কাল হয়। আলীবর্দি খানের পুরনো পারিষদ প্রমাদ গোনেন। মান-ইজ্জত কারো থাকে না। চক্রান্ত ও দলাদলিতে তাঁরা অভ্যস্ত । এবং সিরাজের ওপর তাঁরা সবাই বিরক্ত। এই বিরক্তি ক্রমবর্ধমান। নতুন যোগ হয় মুর্শিদকুলী খানের প্রবর্তিত ভূমি-রাজস্ব ব্যবস্থায় বৃহৎ ভূস্বামীদের ওপর নবাবের নির্ভরতা ও জগৎ শেঠকে কেন্দ্র করে অর্থায়নে ও ধনসম্পদ আহরণে বণিক সম্প্রদায়ের প্রভাব।২৯ বিদেশি বণিকদের আগ্রহ গ্রামীণ অর্থনীতির কর্মকান্ডেও নিঃশব্দে ছড়াতে শুরু করে। তাদের চাহিদা অনুযায়ী পণ্যসামগ্রী পেতে কৃষক-কারিগরদের কোনো কোনো জায়গায় দাদনের জালে তারা বাঁধতে থাকে। এই দাদনই অবশ্য অল্প কিছুদিনের ভিতর ক্ষমতার ওলট-পালটের পর কৃষকদের গলার ফাঁস হয়ে উঠবে। কিন্তু তখন প্রাথমিক পর্যায়ে তা উৎসাহই জাগায়। মধ্যস্থ হিসেবে ফড়ে-দালাল-মুৎসুদ্দির একটা শ্রেণি মাথাচাড়া দেয়। অনেকেই তাদের ভিতর আত্মস্বার্থপরায়ণ ফিচেল-বদমাশ। এবং তাদের তৎপরতা চোখে পড়ে ১৭৫৭-র আগেই। আজকের অতি চালাক গুণধরদের এনজিও-সংস্কৃতিতে তাদের অনুরণন কি বাজে?

নবাব তাঁর সভার প্রাচীন সভাসদদের নিত্যদিন প্রকাশ্যে অপমান করেন। অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ লেগেই আছে। রটে যায়, দরবার চলাকালেই মহতাব জগৎ শেঠকে তিনি চপেটাঘাত করেছেন। তাঁর ইয়ার-দোস্ত কাশ্মিরি ব্রাহ্মণ মোহনলালকে তিনি নিয়ে এসে সোজা প্রধানমন্ত্রীর পদে বসিয়ে দেন; এবং হুকুম জারি করেন, সব আমির-ওমরাহ যেন প্রতিদিন তাঁর নিযুক্ত এই প্রধানমন্ত্রীকে কুর্ণিশ করে। জনশ্রুতি, মোহনলাল তাঁর অনন্যসুন্দরী বোনকে নবাবের হাতে তুলে দিয়ে তার আনুকূল্য লাভ করেন। প্রধান সেনাপতি মীর জাফরকে একবার সিরাজ পদচ্যুত করেন। পরক্ষণেই অবশ্য তিনি এ-সিদ্ধান্ত পালটান। এটা তাঁর অস্থির মতির নিদর্শন, যা ফুটে ওঠে অন্যান্য কাজেও। লঘু-গুরু বিবেচনা কোথাও পাত্তা পায় না। খেয়াল-খুশিটাই বড় হয়ে দেখা দেয়। যুদ্ধে পলায়নপটু ও আর্থিক দুর্নীতিতে অভ্যস্ত মীর জাফরকে বরখাস্ত করা অহেতুক ছিল না। কিন্তু আবার তাঁকে ফিরিয়ে আনায় বোঝা যায়, তাঁর কাছে সবটাই ছেলেখেলা। ফলাফল কী হতে পারে, এ নিয়ে তাঁর কোনো মাথাব্যথা ছিল না। তিনি সর্বেসর্বা, যা খুশি করতে পারেন, এর বেশি কিছু তাঁর মাথায় আসেনি। ঢাকার ছাউনি থেকে নিম্নপদস্থ এক সেনা মীর মদনকে নিয়ে এসে তিনি মুর্শিদাবাদ ছাউনির অধ্যক্ষ বানান। পরে মীর মদন জীবন দিয়ে তাঁর দক্ষতার ও বিশ্বস্ততার পরিচয় রাখেন। কিন্তু তাঁর পদোন্নতি ও প্রভাব-বৃদ্ধি ওই সময় প্রভাবশালী মহলে অনেককে বিরূপ ও অসহিষ্ণু করে তোলে।৩০

নিটফল দাঁড়ায় এই, দরবারে অস্থিরতা দানা বাঁধে। যাঁরা রাজা বানানোর ও রাজা ফেলে দেওয়ার চক্রান্তে দীর্ঘদিন ধরে হাত পাকিয়েছেন, তাঁরা আবার সক্রিয় হয়ে ওঠেন। এবার তার পরিসর অবশ্য রাজদরবারেই সীমিত থাকে না। কারণ, বাস্তব পরিস্থিতি পালটেছে। দিল্লির রাজশক্তি অভ্যন্তরীণ অশান্তিতে ও বারবার বাইরের আক্রমণে একেবারে ঠুঁটো জগন্নাথ। এদিকে মুর্শিদাবাদ ভেতরের ভূস্বামীদের রাজস্ব আদায়ের ওপর বিশেষভাবে নির্ভরশীল। তাদের সমর্থনের বিষয়টাও হিসেবে নিতে হয়। যোগ হয় তার সঙ্গে বাইরের বণিকশক্তির উপস্থিতি। তারা নিরস্ত্র নয়। শক্তির পরিচয় তারা মাঝেসাঝেই দেয়। যদিও নিজেরা তারা শাসনকর্তা হয়ে বসবে, এমন চিন্তা তখনো তাদের মাথায় ঢোকেনি।

এদিকে কলকাতা ফতে করে সিরাজউদ্দৌলা যখন বুক ফুলিয়ে হুংকার ছাড়ছেন, তখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মাদ্রাজ-কাউন্সিল উদ্বিগ্ন হয়ে কলকাতা পুনরুদ্ধারের জন্য অ্যাডমিরাল ওয়াটসন ও কর্নেল ক্লাইভের নেতৃত্বে একটা সেনাদল সেখানে পাঠাবার ব্যবস্থা করে। তারা এসে প্রথমেই কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ পুনর্দখল করে এগিয়ে এসে গঙ্গার পাশে হুগলি দুর্গও অধিকার করে নেয়। নবাব এই অবাধ্য ও দুর্বিনীত আচরণে ক্ষিপ্ত হয়ে আবার সসৈন্যে তাদের উচিত শিক্ষা দিতে অগ্রসর হন; কিন্তু এবার কলকাতায় ওয়াটসন ও ক্লাইভের সুশিক্ষিত সৈন্যদের মোকাবিলা করতে হয় এবং ভোরের কুয়াশায় হকচকিত হয়ে পড়েন। শেষ পর্যন্ত ক্লাইভের সঙ্গে সন্ধি করে তিনি মুর্শিদাবাদে ফিরে আসেন। এই সন্ধির শর্তাবলি সবই ইংরেজদের অনুকূলে যায়। (৯ ফেব্রুয়ারি, ১৭৫৭)। স্থির হয়, ইংরেজ কোম্পানি আবার বঙ্গদেশে বণিজ্যের অধিকার পাবে, কলকাতা সংলগ্ন ৩৮টি গ্রাম কিনে নিতে পারবে, কলকাতা দুর্গের যথেচ্ছ সংস্কার সাধন করতে পারবে, নিজেদের টাঁকশাল গড়ে সেখান থেকে কোম্পানির নামে টাকার প্রচলন করতে পারবে এবং তাদের যে সমস্ত কুঠি নবাব দখল করে নিয়েছিলেন, তা সবই তারা ফেরত পাবে। একই সঙ্গে নবাব আগেরবার তাদের যে ক্ষতিসাধন করে গেছেন, তা যথোপযুক্তভাবে মিটিয়ে দেবেন।৩১ নবাব এতটা নমনীয় হতে বাধ্য হয়েছিলেন তাঁর ঘরের শত্রু বিভীষণদের প্ররোচনায়। তবে এতে যে তাঁর বোধোদয় ঘটেছিল তা মনে হয় না।

মুর্শিদাবাদে ফিরে নবাব শুনলেন, আহমদ শাহ আবদালির অভিযান বাংলার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। তিনি তা প্রতিহত করতে বিহারের দিকে অগ্রসর হয়ে ইংরেজদেরও সহযোগিতা চাইলেন। ক্লাইভ তাতে কর্ণপাত না করে নবাবকেই ক্ষতিপূরণের জন্য চাপ দিলেন এবং তাঁর নিষেধ সত্ত্বেও ফরাসিদের ঘাঁটি চন্দননগর দখল করে বসলেন। আবদালি পূর্বদিকে আর অগ্রসর হন না। সিরাজও ফিরে আসেন এবং ইংরেজদের অবাধ্যতার সমুচিত জবাব দেবেন বলে স্থির করেন।

কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র তখন পুরোপুরি পাকিয়ে উঠেছে। মীর জাফর মসনদ চান। প্রধান আমির-ওমরাহদের সঙ্গে তাঁর দীর্ঘদিনের সদ্ভাব। তাঁর সঙ্গে এসে ভেড়েন রায় দুর্লভ, ইয়ার লতিফ খান, গহ্সেটি বেগম, রাজবল্লভ এবং জগৎ শেঠের নেতৃত্বে প্রায় পুরো শেঠ সম্প্রদায়। মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র ও আরো অনেক জমিদারও প্রত্যক্ষে বা পরোক্ষে এতে অংশ নেন। মীর জাফর ইংরেজদের সহযোগিতা চান। তাদের প্রতিশ্রুতি দেন, নবাব হলে তিনি তাদের সব সুযোগ-সুবিধা দেবেন। ক্লাইভও এতে সাড়া দেন এবং আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠেন।

সিরাজউদৌল্লা যখন বিহার থেকে ফিরে আসেন, তখন এই ষড়যন্ত্রের ব্যাপারটা আর গোপন ছিল না। তিনি প্রথমে মীর জাফরকে বন্দি করার আদেশ দেন; কিন্তু পরমুহূর্তেই তাঁর সঙ্গে মিটমাট করে নিতে উদ্যোগী হন। মীর জাফরও আনুগত্যের ভান করেন। ইংরেজরা কিন্তু বসে থাকে না। চন্দননগর থেকে কাটোয়া হয়ে পলাশীতে এসে নবাব বাহিনীর ওপর হামলা করার জন্য তৈরি হয়। নবাবের সৈন্যরাও মীর জাফরের সেনাপতিত্বে পরিকল্পনামাফিক যুদ্ধে দাঁড়ায়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কোনো যুদ্ধই হয় না। মীর জাফর বুকে হাত বেঁধে দূরে দাঁড়িয়ে থাকেন। তাঁর জামাই মীর কাশিমও তাই। নবাব সেনারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। মীর মদন ও মোহনলাল কেবল লড়ে যাবার চেষ্টা করেন ও মারা যান। নবাবের পরাজয় ঘটে। একে যুদ্ধ বলা চলে না; বরং অবিমৃষ্য স্বেচ্ছাচারিতার, কাপুরুষতার ও সীমাহীন লোভের নিকৃষ্ট উদাহরণ হয়ে ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই করে নেয়। সিরাজউদ্দৌলা সঙ্গিনী লুৎফুন্নেসাকে নিয়ে মুর্শিদাবাদ থেকে বিহারের পথে পালাবার চেষ্টা করেন। এই লুৎফুন্নেসা তাঁর বিবাহিত স্ত্রী ছিলেন কি-না, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। তাঁর শরিয়তসম্মত স্ত্রী ছিলেন এক অভিজাত মোগল রাজপুরুষের কন্যা। পলাশীর যুদ্ধের পর শ্বশুর ও স্ত্রী দুজনই তাঁকে পরিত্যাগ করে মীর জাফরের পক্ষ নেন। একমাত্র লুৎফুন্নেসাই সিরাজের সঙ্গে থাকেন। তবে রাজমহলের কাছে তাঁরা মীর জাফরের ছেলে মীরনের হাতে ধরা পড়েন। তাঁদের মুর্শিদাবাদে আনা হলে মীরনের হুকুমে জল্লাদ মোহাম্মদী বেগ সিরাজকে কুপিয়ে হত্যা করে।৩২ তবে তখনই নবাবি আমল শেষ হয় না। ষড়যন্ত্রকারীরাও তেমনটি চায়নি। ইংরেজদের বলে বলীয়ান হয়ে মীর জাফর নবাব হন।৩৩

প্রসঙ্গান্তরে যাবার আগে পলাশীকান্ডের কুশীলবদের কারো কারো ভাগ্যে কী ঘটেছিল, তার ওপর একবার দ্রুত চোখ বুলিয়ে নিই। ষড়যন্ত্রকারীরা কেউই গোটা দেশের কথা, জনগণের কল্যাণের কথা ভাবেনি। প্রত্যেকে ছিল নিজের নিজের তালে। মীর জাফর চেয়েছিলেন স্বয়ং নবাব হতে। শেঠেরা ভয় পেয়েছিল, বিদেশি বণিকেরা আসায় তাদের কারবারে যে বাড়বাড়ন্ত, তা বুঝি নবাবের হঠকারী কাজকর্মে বিপর্যস্ত হবে, সঙ্গী-সাথি নিয়ে সিরাজের বেলেল্লাপনা আর যখন যাকে খুশি হেনস্থা করা জমিদারদের উৎকণ্ঠা বাড়িয়েছিল, রাজপুরুষরা চেয়েছিল আরো বড় রাজপুরুষ হতে। ওদিকে ইংরেজ কোম্পানির লক্ষ্য ছিল সারা বাংলা মুলুকে মার্কেন্টাইল ধ্যান-ধারণা অনুযায়ী তাদের একচেটিয়া কারবার নিশ্চিত করা, আর তারই আড়ালে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ব্যক্তিগত বাণিজ্যও বিনাশুল্কে চালিয়ে ফায়দা পুরো উশুল করা। নিজেরাই তখতে বসার কথা তখনো তারা ভাবেনি।

পরিণামে এক ব্রিটিশ শক্তি ছাড়া কেউই লাভবান হয়নি। ইংরেজদের মদদে মীর জাফর নবাব হয়ে বসেছিলেন। তাদের সঙ্গে চুক্তি প্রসারিত হয়ে চলে। তাদের দাবি ক্রমাগত বাড়ে। তা মেটাতে মেটাতে নবাবের ফতুর হবার দশা। হতে চেয়েছিলেন তিনি মহাবত জঙ্গ। কিন্তু হয়ে উঠলেন ‘ক্লাইভের গাধা’।৩৪ যখন এই ‘গাধা’ও ১৭৬০ সালে আরো ভার বইতে অক্ষম হয়, তখন বিপুল অঙ্কের টাকা এবং বর্ধমান, মেদিনীপুর ও চট্টগ্রামের রাজস্ব আদায়ের অধিকার কোম্পানির হাতে তুলে দিয়ে আর এক ষড়যন্ত্রকারী তাঁরই জামাতা মীর কাশিম নবাব হয়ে বসেন। কিন্তু ইংরেজদের খাঁই মেটাতে তিনিও ব্যর্থ হন। তারা চায় শুল্কহীন একচেটিয়া কারবার। আরো চায়, কোম্পানির সৈন্যদের ভরণপোষণের ব্যয়ও বহন করবেন নবাব। জমিদারদের ওপর বাড়তি বোঝা চাপিয়েও সব চাহিদা পূরণ করা যায় না। তাঁতিরা, কারিগররাও, বিশেষ করে ঢাকার ও শান্তিপুরের তাঁত-শিল্পীরা, কোম্পানির দাদন নিয়ে অল্প দামে মাল দিতে বাধ্য হওয়ায় অতিষ্ঠ। শেষ পর্যন্ত আর না পেরে মীর কাশিমই কোম্পানির বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। তিনি দেশি-বিদেশি সবার জন্যেই কারবার শুল্কমুক্ত ঘোষণা করেন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এটা মনঃপূত হয় না। তাদের সঙ্গে সংঘাত অনিবার্য হয়ে ওঠে। এই সময়ে ইংরেজরা মীর জাফরকে আবার ডেকে এনে গদিতে বসায় ও মীর কাশিমকে উপযুক্ত শিক্ষা দেবার আয়োজন শুরু করে (১৭৬৪)। মীর জাফর তাদের সঙ্গে সঙ্গে চলেন। প্রথম যুদ্ধ হয় গিরিয়ায়। তারপর উধুয়ানালায় ও সব শেষে বক্সারে  (১৭৬৪)। সবকটিতেই মীর কাশিম হেরে গিয়ে ও অযোধ্যার নবাব সুজাউদ্দীনের কাছে সঞ্চিত ধনসম্পত্তি পুরোপুরি খুইয়ে নিঃস্ব অবস্থায় দিল্লির উপকণ্ঠে ফ্যা-ফ্যা করে ঘুরে অবশেষে ১৭৭৭ সালে নামহীন-গোত্রহীন রাস্তার এক ভিখারির মতো মারা যান। গলায় ইংরেজদের দেওয়া বক্লস এঁটে ১৭৬৫ সালে মীর জাফর কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত হয়ে ধুঁকতে ধুঁকতে ভবলীলা সাঙ্গ করেন। তার আগে ১৭৬৩-তে নবাব মীর কাশিম তাঁর বিরুদ্ধে ইংরেজদের সহযোগিতা করার সন্দেহে পলাশীকান্ডের অন্যতম প্রধান ষড়যন্ত্রকারী মহতাবচাঁদ জগৎ শেঠ ও তাঁর ভাই স্বরূপচাঁদকে মুঙ্গেরে বন্দি করে নিয়ে গিয়ে গলায় বালুর বস্তা বেঁধে গঙ্গায় ডুবিয়ে হত্যা করেন। মীর জাফরের ছেলে মীরন একই কায়দায় গহ্সেটি বেগম ও তাঁর ছোট বোন সিরাজ-মাতা আমিনা বেগমকে গঙ্গায় ডুবিয়ে মারেন। লোকে বলে, তাঁদেরই অভিশাপে মীর জাফর বেঁচে থাকতেই মীরনের বজ্রাঘাতে মৃত্যু। সুবিধাবাদী হাড়-বজ্জাত মহারাজ নন্দকুমার ছিঁচকে পাওনার লোভে শুরু থেকেই ইংরেজদের চরবৃত্তি করে এসেছেন। ওয়ারেন হেস্টিংস্ কোম্পানির শাসনে গভর্নর জেনারেল হয়ে এসেই (১৭৭৪) তাঁকে ফাঁসিতে লটকান। রায়দুর্লভের বংশলোপ হলো। তাঁর নাতবউ এক ব্রাহ্মণ পরিবারে আশ্রিতা হয়ে জীবন কাটালেন। বিপুল ধনসম্পদ তাঁর আত্মীয়-স্বজনে লুটেপুটে নিল। মীর কাশিমের হুকুমে ঢাকার রাজবল্লভের শেষ পরিণতি গঙ্গায় সলিলসমাধি। খাজা আবদুল হামিদ খানকে মীর জাফর বিশ্বাসঘাতকতা করে মেরে ফেলেন; আর খাদেম হোসেন খান মীরনের তাড়া খেয়ে জঙ্গলের ভেতরে হাওয়া হয়ে গেলেন। সাপে কাটলো না বাঘে খেলো, কেউ জানতে পারলো না। উমি চাঁদকে জাল দলিলে সই করিয়ে তার প্রাপ্য টাকা ইংরেজরা মেরে দিলো। বিরাট সমাজপতি, নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের ইংরেজদের দাবি মেটাতে মেটাতে ঋণের জালে বাঁধাপড়া ছাড়া উপায় থাকলো না; বংশধরেরা তাঁর জমিদারির কিছুই আর রক্ষা করতে পারলো না। অন্যসব জমিদারিও ধসে পড়তে শুরু করলো।

তবে পাকাপাকিভাবে ইংরেজ শাসন তখনো শুরু হয়নি। মীর কাশিমকে পর্যুদস্ত করার পর ক্লাইভ বাংলায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির গভর্নর নিযুক্ত হন। ১৭৬৫ সালে দিল্লির বাদশাহ শাহ আলমকে তিনি বাধ্য করেন বাংলার দেওয়ানি কোম্পানির হাতে তুলে দিতে। চালু হয় দ্বৈত শাসনব্যবস্থা। রাজস্ব আদায়ের কর্তৃত্ব নেয় কোম্পানি। আর নাজিমির, অর্থাৎ আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখার ভার পড়ে নবাবের ওপর। এই দ্বৈত শাসন কোনো সুফল বয়ে আনে না। অবশেষে ১৭৭৩ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ‘ভারত নিয়ন্ত্রণ আইন’ পাশ হয়। তাতে কোম্পানি শুধু ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান নয়, ভারতের শাসক হিসেবেও গণ্য হয়। কোম্পানির ওপর সরাসরি ব্রিটিশ সরকারের এখতিয়ার প্রতিষ্ঠিত হয়। পার্লামেন্ট একজন গভর্নর জেনারেল (বড়লাট) ও চারজন উপদেষ্টা নিয়োগ দিয়ে তাঁদের ওপর এই দেশের শাসন পরিচালনার ভার অর্পণ করে। ওয়ারেন হেস্টিংসকে বানানো হয় প্রথম গভর্নর জেনারেল (১৭৭৪)। তিনি অবশ্য অনেক আগে থেকেই এদেশে কোম্পানির কাজের সঙ্গে জড়িত। ক্লাইভ দেশে ফিরে যান ১৭৬৭ সালে। নীতিবিগর্হিত কাজের জন্যে তিনি দোষী সাব্যস্ত হন। কিন্তু তাঁর কৃতিত্বের জন্য পার্লামেন্ট তাঁকে ক্ষমা করে দেয়।৩৫

 

চার

তাহলে আঠারো শতকে প্রাক-ব্রিটিশ শাসন পর্বের বাংলা আমাদের কি কোনো প্রেরণার উৎস হয়? সিরাজউদৌল্লা, অথবা তাঁর আগের কোনো রথী-মহারথী কি হতে পারেন আমাদের জাতীয় বীরের আদর্শ? সমাজে আর কোথাও কোনো ভাবনায় বা কর্মকান্ডে কি এমন কিছু পাই, যা থেকে আমরা আমাদের আত্মরূপের গৌরবময় কোনো আকার উদ্ধার করতে পারি? অথবা কোনো উন্নয়নের গতিরেখা, যা ব্যাহত ও বিপর্যস্ত হয়েছে বিদেশি আগ্রাসনে? এই ‘বিদেশি’ শব্দটিই বা আমরা কীভাবে, কতদূর টানি? ভারতবর্ষের ইতিহাসের বৈশিষ্ট্যে কি পূর্বাপর তা ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে নিই? যদি বলি ‘ঔপনিবেশিক শোষণ’, তবে তার আগে জানতে হয়, ঔপনিবেশিকতা কি সমজাতীয়? সব জায়গায় কি তার একই রূপ? এবং ঔপনিবেশের আক্ষরিক অর্থ যদি হয় কোনো ভূখন্ডে বাইরে থেকে গিয়ে স্থায়ী বসতি স্থাপন ও তার প্রশাসনিক কর্তৃত্ব দখল, তবে এখানে ব্রিটিশ ‘উপনিবেশিকতা’কে তার কোন অক্ষরেখায় কোন দ্রাঘিমাংশে স্থাপন করি? সাম্রাজ্য-প্রতিষ্ঠা বললে অবশ্য বিষয়টি একক মাত্রা পায়। কেন্দ্র ও প্রান্তের সম্পর্ক সেখানে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। তবে এখানেও ঝামেলা একটা জোটে। সাম্রাজ্য কি প্রান্তদেশে সবসময় কুফল বয়ে আনে? এই ঔপমহাদেশের ইতিহাস থেকে সেই সিদ্ধান্তই কি আমরা ছেঁকে তুলি? সভ্যতার ক্রমবিকাশ, অথবা তার স্থবিরতা, এর সঙ্গে কি তার কোনো সম্পর্ক গড়ে ওঠে?

প্রশ্নগুলো তোলার মানে এ নয়, বাংলায় ব্রিটিশদের ক্ষমতা দখলের পক্ষে আমরা কোনো সাফাই গাইতে চাইছি। শুধু তার আগের কালে আমাদের সুখ-শান্তি ও সমৃদ্ধির যে মধুর স্বপ্ন-কল্পনা তাতে কোনো ভ্রান্তি থেকে যায় কি-না, তা বোঝার চেষ্টা করছি। প্রকৃতপক্ষে ১৭৫৭-র পর বাংলায় যে ওলট-পালট ঘটে চলে, তাতে নিরুপদ্রব জীবন যাপনের পরিবেশ কোথাও আর থাকে না। সাধারণ মানুষের ভোগান্তি চরমে গিয়ে পৌঁছোয়। নবাব কোম্পানির হাতের পুতুল। দেওয়ানি পাবার পর এই পুতুলেরও প্রয়োজন ফুরোয়। রাজস্ব আদায় তখন তাদের প্রধান লক্ষ্য হয়ে ওঠে। জমিদারদের থোড়াই কেয়ার করে তারা তাদের ইজারাদার বসায়। যে যত অর্থ জোগাবে, তার ততো কদর। অর্থ জোগানো মানে প্রজাদের সর্বস্বান্ত করা। খাজনার হার ক্রমাগত বাড়ে। কোথাও কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না। তা জোগাতে না পারলে প্রজারা নাকালের একশেষ। পরিবার-পরিজনরাও রক্ষা পায় না। বিশেষ করে স্ত্রী-কন্যারা প্রকাশ্যে অবমানার শিকার হয়। মুর্শিদাবাদে নায়েব দেওয়ান মহম্মদ রেজা খান, রংপুরের ইজারাদার দেবি সিং, নাটোরের গোমস্তা প্রাণ বসু ও দুলাল রায়, এদের নির্লজ্জ নির্বিচার-নির্যাতনে গ্রামবাংলা উচ্ছন্নে যেতে বসে।৩৬ তাঁতি ও কারিগরদের দুর্দশার কথা আগেই বলেছি। অনেকেই তারা পাততাড়ি গুটিয়ে দিনমজুরে বা কৃষিশ্রমিকে পরিণত হয়। এরকম পরিস্থিতিতেই ঘটে ছিয়াত্তরের মন্বন্তর (১১৭৬ বঙ্গাব্দ)। গোটা বাংলার এক-তৃতীয়াংশ মানুষ তাতে প্রাণ হারায়।

বঙ্কিমের আনন্দমঠে ওই মন্বন্তরের বিবরণে এক বর্ণও বাড়িয়ে বলা নেই।

তবে সেই প্রেক্ষাপটে ফকির বা সন্ন্যাসী বিদ্রোহের যে-কীর্তিকথা আমরা শুনি, বঙ্কিমও তাতে দেশাত্মবোধের মহিমা আরোপ করেছেন, তা সর্বাংশে যথার্থ নয়।৩৭ আসলে মোগল শাসন ভেঙে পড়লে বেকার সেনারা এসে ফকির বা সন্ন্যাসী-দলে জোটে। বর্গিদের মতো তাদেরও প্রধান লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায় প্রতিবছরের অভিযানে হত্যা ও লুণ্ঠন। এখনকার চাঁদাবাজির সংস্কৃতিতে মেলে তারই প্রেতচ্ছায়া।

এরই পরিপ্রেক্ষিতে লর্ড কর্নওয়ালিস গভর্নর জেনারেল (১৭৮৬-৯৩) থাকাকালে বাংলায় ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থাকে স্থিতিশীল করার লক্ষ্যে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত (১৭৯৩) প্রবর্তন করেন। সদিচ্ছা যদি তাতে কিছু থাকে, তবে তার পেছনে কাজ করে ফিজিওক্র্যাটদের তাত্ত্বিক ধারণা, ভূমিই সব সম্পদের উৎস। তার সঙ্গে যোগ হয় ফরাসি বিপ্লবের আদর্শের অনুসরণে ব্যক্তিমালিকানায় আস্থা। এদের তিনি মেলাতে চান বিধ্বস্ত গ্রামীণ অর্থনীতিতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে রাজস্ব আদায়কে যুক্তিসংগত করার চেষ্টায়। নতুন এই বন্দোবস্ত অনুযায়ী ১৭৯০-এর খাজনার হার অপরিবর্তিত থাকবে। খাজনা আদায়ের অধিকার জমিদারদের বংশপরম্পরায় চিরস্থায়ী ও বিক্রয়যোগ্য হবে, ওই খাজনার এক-দশমাংশ জমিদারদের প্রাপ্য হবে। এই অধিকার খোলা বাজারে বেচাকেনা, ইজারা দেওয়া সবই আইনসিদ্ধ বলে গণ্য হবে। রায়ত বা চাষির ভাগ্যে কী ঘটবে, সে নিয়ে আলাদা করে কিছু ভাবা হয় না। আশা থাকে, জমি যেহেতু সম্পদের উৎস, তাই ওই সম্পদ বাড়াতে ভূম্যধিকারী যত্নবান হবেন এবং সেই সূত্রে রায়তদের মৌলিক প্রয়োজনও পূরণ করবেন। ভূমিব্যবস্থায় শৃঙ্খলা অনেকটা ফিরে আসে ঠিকই; কিন্তু অন্য উদ্দেশ্য কিছুই অর্জিত হয় না। নবাবি ব্যবস্থাকে রাতারাতি পুঁজিবাদী কৃষিব্যবস্থায় ঢেলে সাজানো যায় না। নিটফল দাঁড়ায় এই, জমিদার ও রায়তের মাঝখানে খাজনা আদায়ের অধিকারের কেনাবেচায় মধ্যস্বত্বভোগী একাধিক স্তর মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে; এবং বাড়তি বোঝা সবটাই গিয়ে পড়ে যারা জমি চাষ করে তাদের ওপর। দুর্দশা তাদের ঘোচে না। কৃষিতে রূপান্তরের কোনো তাগিদ সৃষ্টি হয় না। তা স্থবিরই থেকে যায়। পুঁজি খাটিয়ে অন্য পণ্যসামগ্রী তৈরির দিকেও তেমন উৎসাহ জাগে না। কারণ, বহুস্তরে উদ্বৃত্ত ভাগ হয়ে যাওয়ায় কেউই উপযুক্ত বিনিয়োগ করার মতো অর্থের মালিক হয় না। খেয়ে-পরে স্বচ্ছন্দে চলার মতো অবস্থা অবশ্য কারো কারো হয়। সেইসঙ্গে নিকটতর অতীতের অনুবর্তনে বড়লোকি দেখাবার ঝোঁক।

উনিশ শতকে এসে এই আধখ্যাঁচড়া পরিমন্ডলেই নতুন ভাবনা বলয়ের বিকাশ ঘটতে শুরু করে। অনুঘটক কিন্তু তখন রাজদন্ড হাতে ইংরেজরাই। তাদের সঙ্গে যোগাযোগের সূত্রে জাগে য়োরোপের সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিষয়ে কৌতূহল। উৎসাহ জোগায় সদ্য ঘটে যাওয়া ফরাসি বিপ্লব, নেপোলিয়নের অবিশ্বাস্য উত্থান ও পতন এবং জনগণের অংশ নিয়ে রাষ্ট্র গড়ার ভাবনা। সাম্য, মৈত্রী ও মুক্তির বাণীতে শিহরিত হয় মুষ্টিমেয় তরুণ। ক্রিয়ায়-প্রতিক্রিয়ায় একটু একটু করে ছড়ায় তা গোটা ভারতবর্ষ জুড়েই। আমেরিকার স্বাধীনতাও অনুপ্রাণিত করে। এদের কোনোটিই সিরাজউদ্দৌলার ঐতিহ্যের ফসল নয়, বরং ঠিক তার বিপরীত।৩৮

অন্তত সেন আমল থেকে (ত্রয়োদশ শতক) বাংলা ভূখন্ডে রাজ্য শাসন ও সমাজজীবন দুটো ভিন্ন ধারায় প্রবাহিত হয়ে এসেছে। শাসক কোন দেশের কোন ভাষার এগুলো জনগণের মনে রেখাপাত করে না। বীরভোগ্যা বসুন্ধরা। শক্তসমর্থ দেহ, ঘোড়া আর তরোয়াল বীরত্ব দেখাবার প্রধান অবলম্বন। কে তা দেখায়, সেটা অবান্তর। দাশু রায়ের পাঁচালিতে পড়ি, ‘আদার ব্যাপারী হয়ে জাহাজে কি কাজ গো’ – এই জাহাজ সাধারণ মানুষের কাছে রাজ্য শাসনেরও প্রতীক। লাঠালাঠি-মারামারি করে জিতে তখ্তে কেউ বসলে জনগণের কিছুই যায়-আসে না। পলাশীর যুদ্ধ নিয়েও তাই সে-সময়ে তাদের কোনো মাথাব্যথা ছিল না। এর পরিণামে সমাজ-কাঠামোও যে ধাক্কা খাবে, এটা তারা ভাবেনি। ইংরেজরা শাসক হয়ে বসলে ইউরোপীয় ধ্যান-ধারণার সঙ্গে যোগাযোগে এই ধাক্কাটা ভালোভাবেই লাগে। তারই পরিণাম ১৯৩৮-এ লেখা সিরাজউদ্দৌলা নাটক। স্বাধীনতার চেতনা নিয়ে – যে-চেতনা ইংরেজ শাসনেরই ফসল, আমরা এক বীর নায়কের প্রতিমা চাই। সিরাজউদৌল্লাকে দিয়ে সে-চাহিদা মেটাই। বাস্তবে তিনি তেমন ছিলেন না। তাই আজ যখন আমরা ‘পলাশী থেকে ধানমন্ডি’ – এই ভাবনা-কল্পনায় উভয়ের ভিতর সংযোগরেখা টানি, তখন তা যথাযথ হয় না। আমাদের স্বাধীনতা আধুনিক প্রাগ্রসর পাশ্চাত্য চিন্তার অনুসারী। এতে লজ্জার বা হীনমন্যতার কিছু নেই। দেওয়া-নেওয়ার ভিতর দিয়েই মানুষের সভ্যতা এতদিন এগিয়েছে। ভবিষ্যতেও তাই হবে। শুধু দেখবার, পথ বাছাই সঠিক হচ্ছে কি-না। না হলে পিছিয়ে পড়াই ভাগ্যলিপি। এবং পিছিয়ে পড়ার প্রলোভনও যে থাকে না, তা নয়। থাকে ভেতরে থেকে, বাইরে থেকেও।

আজ একদিকে ধর্মীয় মৌলবাদ, অন্যদিকে উত্তর-আধুনিকতার রাষ্ট্রকাঠামোকে অস্বীকার করে প্রাক্-রাষ্ট্রীয় নৈরাজ্যে ক্ষমতা-বিচ্ছিন্নতায় ফিরে যাবার আহবান এই প্রলোভনেরই সৃষ্টি করছে। তা প্রকারান্তরে আমাদের নিয়ে যেতে চাইছে পলাশীতেই। কারণ আজকের পৃথিবীতে রাষ্ট্রহীন ব্যক্তি কেবল বিশ্বায়িত পুঁজির দাস্য-দালালিতেই জীবনের চরিতার্থতার সীমা খুঁজে পেতে পারে। এনজিও সংস্কৃতি এখন আমাদের সেদিকেই টানে। তা আমাদের ১৭৫৭-র পলাশীতে নিয়ে যেতে পারে; ১৯৭১-এর ধানমন্ডিতে নয়। সেখানে গড়ে ওঠে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষকে নিয়ে তাদের মিলিত ভাগ্যোন্নয়নের আশায় পুঁজি ও প্রযুক্তির রূপান্তরের চ্যালেঞ্জ নিয়ে এক রাষ্ট্র। পলাশীর প্রত্যুত্তরই সেটা।

 

টীকা ও নির্দেশিকা

১. Muhammad Mohar Ali, History of the Muslims of Bengal, Vol. 1A, Imam Muhammad Ibn Saud Islamic University, Riyadh 1985, Chapters xiv & xxi।

২. পূর্বোক্ত, Chapter xxiii।

৩. নিখিলনাথ সেন, জগৎ শেঠ, ১৯১২; নতুন সংস্করণ, প্রজ্ঞাভারতী, কলকাতা, ১৯৮২, পৃ ১১-১৫।

৪. পূর্বোক্ত, পৃ ১৪।

৫. পূর্বোক্ত, পৃ ১৮।

৬. রজতকান্ত রায়, পলাশীর ষড়যন্ত্র ও সেকালের সমাজ, ইতিহাস গ্রন্থমালা ৩, আনন্দ পাবলিশার্স, ১৯৯৪, পৃ ১৩৭।

৭. নিখিলনাথ সেন, পূর্বোক্ত, পৃ ১২।

৮. Irfan Habib, The Agrarian Systems of Mughal India, New Delhi, Chapter 6।

৯. রজতকান্ত রায়, পূর্বোক্ত পৃ ৪২-১৩৩।

৯ক. Ranajit Guha, A rule of property for Bengal : an essay on the idea of permanent settlement, Mouton and Co., paris,1963।

১০. নিখিলনাথ সেন, পূর্বোক্ত,পৃ ১৯।

১১. পূর্বোক্ত।

১২. রজতকান্ত রায়, পূর্বোক্ত।

১৩. কোকা আন্তোনভা, ‘মধ্যযুগীয় ভারত’, (অনুবাদ, মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়) ভারতবর্ষের ইতিহাস, প্রগতি প্রকাশন, মস্কো, ১৯৮২, পৃ ৩৩৫, ৭৪৪।

১৪. পূর্বোক্ত, পৃ ৩৭০।

১৭১৭-তে মোগল সম্রাট ফারুকশিয়ার যে ফরমান জারি করেন, তাতে বলা হয়, হুগলি বন্দরে বার্ষিক তিন হাজার টাকা মাত্র শুল্ক দিয়ে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এদেশে বাণিজ্য করতে পারবে। কলকাতা, সুতানুটি ও গোবিন্দপুরের ইজারা তাদের স্থায়ী করা হবে। সুবেদারের অনুমতি সাপেক্ষে তাদের চারপাশের আটত্রিশটি গ্রাম তারা কিনতে পারবে। কোম্পনির আর্কট মুদ্রা সুরাটের মতো হলে বাংলায় বিনা বাটায় চালানো যেতে পারবে। আর, কোনো কারখানার মালিকের ‘দস্তক’ বা ছাড় থাকলে নবাবের লোক-লস্করের পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই কোম্পানি ওই কারখানার পণ্য নিয়ে যেতে পারবে; এবং মুর্শিদাবাদের টাঁকশালে সরকারের স্বার্থহানি না হলে তারা তাদের মুদ্রা বানিয়ে নিতে পারবে। [দেখুন, N. K. Sinha (ed) The History of Bengal (1757-1905), The University of  Calcutta, 1967, p 9.]

‘সুবেদারের অনুমতি সাপেক্ষে এবং সরকারের স্বার্থহানি না ঘটলে’, এই দুই শর্তের দোহাই দিয়ে মুর্শিদকুলী খান ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করেন। কারণ, এ স্পষ্টত বৈষম্যমূলক। অবাধ বাণিজ্য সুবিধা অন্যান্য বিদেশি বাণিজ্যিক সংস্থাগুলোও চায়। তাছাড়া এতে নবাবের কর্তৃত্ব কিছুটা শিথিল হয়ে পড়ে। তবে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ছলের অভাব হয় না। স্থানীয় বশংবদ লোকজনকে দিয়ে উপরি লাভের লোভ দেখিয়ে বেনামিতে তারা কার্যোদ্ধার করতে থাকে। তেমন লোক পেতে অসুবিধা হয় না। ‘ফেল কড়ি মাখো তেল, কে কার পর’ – এমন মূল্যবান প্রবাদবাণী বোধহয় সেই সময়েই চালু হয়। তাছাড়া আঠারো শতকের নবাবি আমলেই ‘চাচা আপন প্রাণ বাঁচা’ বা ‘আপনি বাঁচলে বাপের নাম’ এই রকম কথা চালু হয়। বোঝা যায়, সামাজিক প্রেক্ষাপটে সামষ্টিক কোনো চেতনা তখনো গড়ে ওঠেনি। এগুলোই অবশ্য আমাদের এই সময়ের উত্তর আধুনিক-উত্তর ঔপনিবেশিক তোতা পাখিদের কানে মধু বর্ষণ করে।

১৫. রজতকান্ত রায়, পূর্বোক্ত, পৃ ১৫০।

১৬. ঐতিহাসিক অর্মে ওই সময়ে কিছুদিন বাংলায় ছিলেন। ফতেচাঁদ জগৎ শেঠ সম্পর্কে তিনি মন্তব্য করেছেন, The greatest shroff and banker in the known world. উদ্ধৃতি : Sushil Chaudhuri, `Merchants, Companies and Rulers, Bengal in the Eighteenth Century’, Journal of the Economic and Social History of the Orient, Vol xxxi, p 91।

১৭. রজতকান্ত রায়, পূর্বোক্ত, পৃ ১৫০-১৫৪।

১৮. ভারতবর্ষের ইতিহাস, পূর্বোক্ত, পৃ ৩৩২।

১৯.W.H. McNeill, The Rise of the West, A History of the Human Community, The University of Chicago Press, 1963, p 678-679, আরো দেখুন, H.A.R. Gibb and Harold Bowen, Islamic Society and the West, Vol 1, part 1, p 35।

২০. ভারতবর্ষের ইতিহাস, পূর্বোক্ত, পৃ ৩৬০।

২১. বঙ্কিম চন্দ্রের ইন্দিরা উপন্যাসে (১৮৭৩) রসিকা ও মুখরা কামিনী অগ্রজা ইন্দিরার স্বামীকে নিয়ে রঙ্গ করতে গিয়ে বলছে, ‘যখন মিত্র মহাশয় কমিসেরিয়েটের কাজ করেছেন, তখন চুরি তো করেছেন। আর চামারি, – তা যখন রসদ জুগিয়েছেন, তখন চামারিও করেছেন।’ হালকা-চটুল কথা; কিন্তু সমাজ-বাস্তবতার একটা দিক উঁকি দিয়ে যায়। এটুকু অন্তত বুঝতে পারি, এই ‘চুরি-চামারি’ নিয়ে অগৌরবের কিছু ছিল না। বোধহয়, এখনো নেই। তার প্রাতিষ্ঠানিক জটাজাল নিজেকে ছড়াতে শুরু করে আঠারো শতকের প্রথম ভাগেই। নবাবের শাসনযন্ত্রে তা আশ্রয় পায়। প্রশ্রয় পায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কারবারে।

২২. নিখিলনাথ সেন, পূর্বোক্ত, পৃ ২৪।

২৩. Muhammad Mohar Ali, op. cit., p 608.

২৪. নবাব দরবারে এক অভিজাত মনসবদার গোলাম হোসেন খান তাঁর সিয়র উল-মতাক্ষরীণ গ্রন্থে (আমি ফারসি জানি না, এই নামের অর্থও আমার অজানা। এখানে বাংলা অনুবাদ থেকে নেওয়া) এ-বিষয়ে সোজা-সাপটা লিখছেন : ‘নবাব আলীবর্দি খানের বিবিজানরা এবং তাঁর পেয়ারের সিরাজউদৌল্লা এমন সব কদর্য কুকর্ম এবং বেহায়া বেলেল্লাপনায় লিপ্ত থাকতেন, যা খানদানি লোকের কথা দূরে থাক আমজনতাকে পর্যন্ত বেইজ্জত করবে। তাঁর এই স্নেহের পুত্তলি সিরাজউদৌল্লা রাজপথে ছোটাছুটি করতে করতে যেসব ঘৃণিত ও অকথ্য আচরণ করতেন, তাতে লোকে তাজ্জব বনে যেত। নবাবের নাতিপুতিদের নিয়ে তিনি এক দল গড়ে রাস্তায় রাস্তায় অলিতে-গলিতে যা আরম্ভ করলেন তাতে পদ, বয়স, স্ত্রী-পুরুষ ভেদ কোনো কিছুর মর্যাদা রইল না।… জেনানা বা মর্দানা যাকে দেখে পছন্দ হতো, সে-ই তাঁর রিরংসার শিকার হতো।… পাপ-পুণ্যের তফাৎ না করে, খুব নিকট রক্তের  রিশতা না মেনে তিনি যেখানে যেতেন সে জায়গা অপবিত্র করে আসতেন, পাগলের মত সম্ভ্রান্ত নরনারীর ঘরে ঘরে ব্যভিচার ঘটাতেন, পদমর্যাদা বা বংশমর্যাদা জানতেন না।… (উদ্ধৃতি, রজতকান্ত রায়, পূর্বোক্ত, পৃ ২২) আর তাঁর দুর্নাম ছিল, তিনি ফুর্তি করতে সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে নদীতে বজরায় বেরোতেন, কোনো ঘাটে কোনো সুন্দরীকে মনে ধরলেই তাকে অপহরণের ব্যবস্থা করতেন। বাংলায় প্রাক-ব্রিটিশ পর্বের বাস্তবতার এও এক নিদর্শন। মনে হয় না তা কেবল নবাবজাদাদের ভেতরেই সীমাবদ্ধ ছিল। অধস্তন ভূস্বামীদের ভিতরেও তা ছড়িয়েছিল, এবং উনিশ শতকেও তা বলবৎ ছিল। রবীন্দ্রনাথের যোগাযোগ উপন্যাসে কুমুর বাবার আচরণে তার প্রতিফলন ধরা পড়ে। মূল্যবোধে পরিবর্তনের ইঙ্গিতও এ-উপন্যাসে পাই।

২৫. রজতকান্ত রায়, পূর্বোক্ত, পৃ ১৫-১৮।

২৬. রাজবল্লভ সেন বাংলার বৈদ্য সমাজে উপবীত ধারণের বিধান কাশীর পন্ডিত সমাজের কাছ থেকে সংগ্রহ করেছিলেন। এতে বৈদ্য সমাজের মর্যাদা ব্রাহ্মণের সমতুল্য বলে গণ্য হতে থাকে। আজ যত খেলো মনে হোক না কেন, তখনকার দিনে সামাজিক স্তরভেদে এর গুরুত্ব ছিল যথেষ্ট। আরো যেটা খেয়াল করার, তখন পন্ডিত সমাজকে টাকা দিয়ে বশীভূত করে কাঙ্ক্ষিত বিধান আদায় করা খুব কঠিন কাজ ছিল না। প্রেক্ষাপট বদলালেও মূল জায়গায় তাদের মনোভঙ্গি আজকেও কি খুব একটা পালটেছে? রাজবল্লভ সেন অবশ্য অন্য এক উদ্যোগে ব্যর্থ হন। তাঁর নাবালিকা বিধবা কন্যার তিনি দ্বিতীয়বার বিয়ে দিতে চান। কিন্তু নদীয়ার পরাক্রমশালী রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় নবদ্বীপের নৈয়ায়িকদের হাত করে, অবশ্যই কাঞ্চনমূল্যে, রাজবল্লভের মহৎ অভিলাষ পূর্ণ হতে দেন না। আঠারো শতকের প্রথম ভাগে বাংলার সামাজিক চালচিত্রের একটা টুকরো অংশ এতে ফুটে ওঠে। সেটা গৌরবের নয়। সার্বিকভাবে পন্ডিত সমাজের ফিচলেমির ঐতিহ্য থেকে আমরা কিন্তু একটুও সরে আসিনি। বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের কর্মকান্ডে তা হাড়ে হাড়ে  টের পাই। দেখুন, পূর্বোক্ত, পৃ ২৪, ৩৮।

২৭. Scrafton, Reflections, P 30-31.

২৮. নিখিলনাথ সেন, পূর্বোক্ত, পৃ-৬৬-৬৭।

২৯. Sushil Chaudhuri, op. cit.

৩০. J. Long, Selections from the unpublished Records of Government, no 198,  উল্লিখিত, রজতকান্ত রায়, পূর্বোক্ত।

৩১. নিখিলনাথ সেন, পূর্বোক্ত, পৃ ৮৩।

৩২. সিয়র-উল মুতাক্ষরীণের অনুবাদ, দ্বিতীয় খন্ড।

৩৩. সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে যাঁরা ষড়যন্ত্র করেছিলেন, তাঁরা ভেবেছিলেন, রবার্ট ক্লাইভ, ও, এরকম আরো কাউকে নবাব দরবারে হোমড়া-চোমড়ার উচ্চাসন দিলেই ল্যাঠা চুকে যাবে। নবাবি রাজত্ব যেমন চলছে, তেমনি চলবে। বিদেশি উচ্চাভিলাষী করিৎকর্মারা আগে এভাবেই নিজেদের জাহির করেছে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রাতিষ্ঠানিক বন্দোবস্ত সম্পর্কে তাঁদের কোনো ধারণাই ছিল না। তারা যে ব্রিটিশ সরকারের অনুমোদননির্ভর, এটা ছিল তাঁদের কল্পনার বাইরে। ব্রিটিশ সরকার ধরাছোঁয়ার বাইরে। তার কার্যপ্রণালী তাদের মনে কোনো উৎসাহ জাগায় না। য়োরোপীয় ধ্যান-ধারণা নিয়ে কোনো কৌতূহল তাঁদের জাগেনি। এটাও অনস্বীকার্য, য়োরোপে গণমানুষের জীবনযাত্রার মান তখন এদেশে অনুরূপ অধিবাসীদের তুলনায় উন্নত ছিল না। অভাবের তাগিদই তাদের বহির্মুখী করে। তবে পেছনে থাকে দুশো বছরের চিন্তায় অগ্রগতি। তা হঠাৎ হয় না।  জ্ঞান ও প্রযুক্তির রূপান্তর কর্মকাঠামোয় ও কর্মপ্রণালীতে প্রতিফলিত হয়। তা সামরিক প্রস্ত্ততিতেও। মধ্য এশিয়ার স্টেপভূমি থেকে অশ্বারোহী দুঃসাহসী সেনাবাহিনী যে একসময় দেশের পর দেশ পদানত করেছিল, তার কৌশল ও দক্ষতার পরিমাপ নিতান্তই অকার্যকর হয়ে পড়ে; এদেশে আমরা যদিও সে-বৃত্তেই আটকে থাকি।  উন্নততর গোলাবারুদ ও পদাতিক ব্যূহরচনা হাতি-ঘোড়ার সমাবেশকে বিকল করে ফেলে। এটা আমরা খেয়াল করি না, পলাশীর নকল যুদ্ধেই এদেশে ইংরেজদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয় না। মীর জাফর বাংলার পুরো নবাব হয়েই বসেন। যদিও ইংরেজরা তাঁকে ওঠায়-বসায়। পরে কিন্তু মীর কাশিম সর্বশক্তি নিয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে উপর্যুপরি তিনবার লড়াই করেন এবং হারেন। একই দশা হয় মহিশূরের সুলতানদের, মারাঠাদের ও শিখদের। গোটা ভারতবর্ষ ইংরেজদের হাতে আসে আরো একশ বছর পরে। সরাসরি ব্রিটিশ রাজের অধীনে ভারতবর্ষের শাসন শুরু হয় ১৮৫৮-তে মহারানী ভিক্টোরিয়া তখন গ্রেট ব্রিটেনের রাজেশ্বরী। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিরও বিলোপ ঘোষণা করা হয় তখন।

প্রায় একই সময়ের য়োরোপ সম্পর্কে জানতে দেখুন, E.J. Hobsbawm, The Age of Revolution, Europe 1789-1848, abacus, London, 1984; আরো দেখুন, W.H. McNeill, পূর্বোক্ত; p 709-753.

৩৪. সিয়র-উল মুতাক্ষরীণ।

৩৫. ভারতবর্ষের ইতিহাস, পূর্বোক্ত, পৃ ৩৮৪-৩৮৬।

৩৬. রায়তদের ওপর অত্যাচারে কোনো ইজারাদারই পিছিয়ে থাকে না। তবু তার ভিতরে দেবি সিং-এর পৈশাচিকতা দুঃস্বপ্নকেও হার মানায়। কোনো রায়ত খাজনা দিতে না পারলে তার স্ত্রী ও অনূঢ়া কন্যা থাকলে তাকে ধরে এনে সে তাদের ওপর অকথ্য নির্যাতন চালাতো। তাতেও কাজ না হলে ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিত। অনেক রায়তের মাথা কেটে নিত। এই রকম ইজারাদারদের সরদার ছিল মুর্শিদাবাদের নায়েব দেওয়ান মহম্মদ রেজা খান। বেশিরভাগই এরা ‘কিন্তু বাংলার বাইরে থেকে আসা। রংপুরের ‘জাগের গানে’ দেখি – রাজপুত কালাভূত দেবি সিং হয়/ চেহারায় মৈষাসুর হইল পরাজয়\’ এদের প্রভুত্ব বাংলার মানুষ যুগ যুগ ধরে সয়ে এসেছে। ১৯৭১-এ তার অবসান। কিন্তু পরবশ্যতাও একটা অভ্যাসে দাঁড়ায়। পেছন থেকে মৌলবাদকে আশ্রয় করে তা টেনে ধরে। আমাদের বিভ্রান্তি কাটে না।

৩৭. ইজারাদারদের নির্যাতনের পরিপ্রেক্ষিতে ফকির ও সন্ন্যাসী বিদ্রোহ যে প্রতিষ্ঠানবিরোধী মাত্রা পায়, গ্রামবাংলার মানুষের কাছে কিন্তু তা সামান্যই সান্ত্বনা বয়ে আনে। সমকালীন গ্রামীণ বর্ণনায় পাই :

সহজে বাঙালিলোক অবশ্য ভাগুয়া।

আসামি ধরিতে ফকির যায় পাড়াপাড়া \

…   …   …

ফকির আইল বলি গ্রামে পৈল হুড়।…

নারীলোক না বান্দে চুল না পরে কাপড়।

সর্বস্ব ঘরে থুয়া পাথারে দেয় নড়।…

ভাল মানুষের কুলবধূ জঙ্গলে পালায়।

লুটরা ফকির যত পাছে পাছে ধায় \ …ইত্যাদি।

সন্ন্যাসীরাও কম যায় না –

বড় মানুষের নারী পালায় সঙ্গে লয়ে দাসী।

জটার মধ্যে ধন লয়্যা পালায় সন্ন্যাসী।…

তারা কাশীবাসী, মহাঋষি, ঊর্ধ্ববাহুর ঘটা \

সন্ন্যাসী আইল বল্যা লোকের পড়ে গেল শঙ্কা।…

হাজারে হাজারে বেটারা লুট করিতে আইসে।

বেটাদের অস্ত্র আছে, রাখে কাছে, বন্দুক সাঙ্গি তীর।

তামার চিমিটা, খাপে ঢাল, ঢাকা শির \

বঙ্কিম মানস এই জায়গায় দ্বিধান্বিতই ছিল। তা নইলে আনন্দমঠ ইংরেজ-রাজত্বের অনুমোদনে শেষ হয় কেন? ইংরেজ-রাজত্ব এখানে  য়োরোপীয় জ্ঞানচর্চার প্রতীক।

৩৮. তবে বাঙালির এই জাগরণ খন্ডিত থেকে যায়। এখানে মেধার চর্চা য়োরোপীয় জ্ঞানকান্ডের বিকাশের ধারায় আকৃষ্ট হয় ঠিকই। কিন্তু সেই জ্ঞান তো নিরবলম্ব নয়। তার প্রয়োগিক আশ্রয় চাই। ওই আশ্রয়েরও আনুষঙ্গিক চাই। সেই রূপান্তর আবার জ্ঞানের ক্ষেত্রে নতুন নতুন দিক নির্দেশ করে। তেমন কিছুই এখানে ঘটে না। ইংরেজ শাসন তার বৈরী ছিল। বাঙালি চেতনাও এদিকে ধাবিত হয়নি। জমি-জিরেত নিয়ে তার ওপর নির্ভর করে বাঁচা অথবা তা থেকে যে যেমন পারে উদ্বৃত্ত হরণ করা। এতে কোনো বস্ত্তগত রূপান্তর ঘটে না। বাঙালি ভদ্রলোক এর বাইরে কেবল চাকরি খোঁজে। ইংরেজদের অধীনে তার ক্ষেত্র প্রসারিত হয় না। উৎপাদনের নতুন নতুন সম্ভাবনায় বাঙালিরাও আগ্রহ দেখায় না। কৃষি ঐতিহ্যকেই অাঁকড়ে থাকে এবং প্রাচীন কুটিরশিল্পের গৌরবময় স্মৃতিতে বুঁদ হয়ে রোমন্থনে তৃপ্তি খোঁজে। তার যে দিন ফুরিয়েছে, তুলনামূলক সুযোগ ব্যয়ের বিচারে তার টিকে থাকার যৌক্তিক ভিত্তি যে হারিয়ে যায়, এটা তারা উপেক্ষাই করে। ওই ব্রিটিশ ভারতেও শিল্পায়ন যা যতটুকু হয়, এমনকি বাংলাতেও তার কর্তৃত্ব থাকে অবাঙালিদের হাতে। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় এ নিয়ে আফসোস করেছেন, আপ্রাণ লড়েছেন, কিন্তু তা অরণ্যে রোদনেই শেষ হয়েছে। পরিণামে সমন্বিত উদ্বোধন কিছু ঘটে না। কটি উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা দেখা যায় মাত্র। জনজীবনে আড়াই হাজার বছর আগের, দেড় হাজার বছর আগের অথবা পাঁচশো বছর আগের ধ্যান-ধারণা সহাবস্থান করে। কোনো মিলমিশ হয় না। প্রত্যেকে নিজের নিজের মতো থেকে যায়; কখনো কখনো একে অন্যে লাঠালাঠি করে। জীবন-বিচ্ছিন্ন জ্ঞান বৃথা যায়।

এই অসামঞ্জস্য থেকে বেরিয়ে আসার সুযোগ একটা সৃষ্টি হয় ১৯৭১-এ বাংলাদেশের স্বাধীনতায়। কোটরবাসী থাকার আকর্ষণ কিন্তু যায় না।