পুরানা পল্টন – ৫নং বাড়ি

অলকনন্দা প্যাটেল

কোনো একসময় আমরা চলে আসি পুরানা পল্টনে, ৫নং বাড়িতে – কবে জানি না। পুরানা পল্টনকে আমরা নতুন ঢাকার অংশ বললেও এর ইতিহাস নতুন নয়। পাঁচশো বছর আগে পাঠানি সুলতান আমল থেকে এ-অঞ্চল ছিল ক্যান্টনমেন্ট বা সৈন্যদের আখড়া। এ ব্যবস্থা চলেছিল ইংরেজ রাজত্বেও, প্রথম মহাযুদ্ধ অবধি। তারপর আখড়া চলে গেল তেজগাঁও; ধীরে-ধীরে শুরু হলো সাধারণের বসবাস, যেন আমাদেরই জন্য গড়া নতুন বাড়িঘর, নতুন বসতি। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেকেই পুরানা পল্টনে থাকতেন – পরিমল রায়, মন্মথ ঘোষ, সত্যপ্রসাদ রায়চৌধুরী, সবাই আমাদের প্রতিবেশী এবং বাবার বন্ধু হিসেবে আমাদের কাকা বা মেসো। এঁদের স্ত্রীরা ছিলেন মায়ের বন্ধু, আর এঁদের মেয়েরা আমার খেলার সাথি। ফুটবল খেলি না বলে সমবয়সী ছেলেরা আমাদের হেয় মনে করত, তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব ছিল বলতে পারি না।
শান্ত, খোলামেলা পাড়া, পুরানা পল্টন – ঢুকলেই বড় দিঘি, তার বাঁধানো ঘাটের এক কোণে উঁচু মন্দির। সন্ধ্যাবেলা পুজো-আর্চা করতে আসেন কেউ, আবার কেউ আসেন ঘাটের বাঁধানো সিঁড়িতে খোলা আকাশের নিচে বসে খবর আদান-প্রদান করতে। পাড়ার সামনে সবার প্রিয় পল্টনের মাঠ। খেলাধুলা, স্বাস্থ্যচর্চা, বৃদ্ধদের গল্পগুজব, অল্পবয়সীদের আলোচনা, রাজনীতি, বক্তৃতা সবই চলত এখানে। এই মাঠ সম্বন্ধে বুদ্ধদেব বসু এক চিঠিতে পরিমল রায়কে লিখেছেন, ‘কী মজা দ্যাখো, তোমার ন্যুইয়র্কে গিয়ে পুরানা পল্টন মনে পড়ে, আমার মনে পড়ে চাঁইবাসা, লক্ষেèৗ, দিল্লী, এমনি নানা জায়গায় যেখানেই অনেক মস্ত মস্ত ফাঁকা মাঠ আছে – মনে হয় পুরানা পল্টনের মতো, কিন্তু ঠিক সেরকম না; পল্টনের মাঠের মতো সুন্দর পৃথিবীর অন্য কোনো মাঠ আমাদের চোখে লাগবে না। তার কারণ এ নয় যে ঐ প্রান্তর রূপগৌরবে শ্রেষ্ঠ – ভাবতে গেলে জায়গাটা অতি সাধারণ ভিন্ন কিছুই নয় – কিন্তু ওখানে আমরা যুবক ছিলাম, উন্মীলিয়মান সদ্য যুবক আমাদের কাছে সেটাই ওর মহিমা, সে মহিমার তুলনা নেই। আমার লেখার মধ্যে পুরানা পল্টনের কথা এতবার এসে গেছে… তবু এখনো এক-এক সময় আবার নতুন করে লিখতে ইচ্ছে করে; মনে হয় অনেক কথাই বলা হয়নি, সেখানকার দিন, রাত্রি, বিকেল, সন্ধ্যা, স্তব্ধ মধ্যরাত্রির আশ্চর্য নীল সিনেমার মতো জোছনা, তার ঠিক সুরটি স্পর্শটি আবার নতুন করে ধরতে ইচ্ছে করে।’১
আমার ঢাকা শহর ছিল অত্যন্ত সীমিত, পুরানা পল্টন ছিল আমার জগৎ। আর জানতাম গে-ারিয়া, ওয়ারী, লক্ষ্মীবাজার – তবে কোনোটাই ঠিক পাড়া হিসেবে নয়। নবাবপুর বাজারের এলাকা, ঘোড়াগাড়ি থেকে দেখেছি আলোয় ঝলমল বাটার দোকান, ছোট্ট ‘টি সেন্টার’, আমার এক মামার চায়ের ব্যবসা ছিল, তাঁর দোকান এবং তাঁর সমসাময়িক অনেকেরই আড্ডার স্থল। কোথাও এক জায়গায় ছিল সাধনা ঔষধালয়ের বিশাল সাইনবোর্ড, আজো মনে হয় আছে। নাম শুনেছি অনেক; শাঁখারীবাজার, তাঁতীবাজার, শুনে মনে হয়েছে ঐতিহ্যভরা বহুদূরের পথ। আরমানিটোলা বা ফরাশগঞ্জ নামে রোমাঞ্চ জাগত। ধানম-ি তো প্রায় বাঘ-ভালুকের দুনিয়া – সেখানে কেউ থাকে বা যায়, সেটা বিশ্বাস হতো না। সবচেয়ে রোমাঞ্চকর ছিল নীলক্ষেত; যেন আকাশছোঁয়া অনেক খোলা মাঠ, দিগন্তরেখা যেখানে নেমে এসেছে। এই সুদূরের হাতছানি খুব আকর্ষক হলেও আমরা আমাদের পুরানা পল্টনের ছোট এলাকা নিয়েই খুশি ছিলাম।
আমার প্রথম স্মৃতি পুরানা পল্টনের ৫নং বাড়িকে ঘিরে। নিরিবিলি পাড়া, অনেকটা জমি নিয়ে বেশিরভাগ একতলা বাড়ি। কুন্দ, দোলনচাঁপা, মাধবীলতা, জুঁই-কাঞ্চন ছাড়াও অনেক বাড়িতে ছিল মৌসুমি ফুলের বাগান। আমার বাবার বাগানের শখ এতবেশি ছিল যে, চন্দ্রমল্লিকার ফরধসবঃবৎ ঢাকাতেও মাপতেন, শেষ জীবনেও মাপ নিয়ে ১র্২র্ বা ১র্৪র্ হলো তা জানিয়ে উৎফুল্ল হয়ে আমাদের কাছে চিঠি দিতেন। বাগানের শখ মেটাতে অনেকেই বাইরে থেকে বীজ আনিয়ে বিদেশি ফুল ফোটাতেন। বিদেশি কেন যে বলি, প্রতিবছরই তো ঢাকার মাটিতে শেকড় গেড়ে ফুটে উঠত। শীতকালে ৫নং-এ বেড়ার সঙ্গে বাঁশ আঁকড়ে চড়ে যেত ‘সুইট পি’ ফুলের লতা – ছোট-ছোট ফুল মিটমিট করে তাকিয়ে থাকত। ন্যাস্টারসিয়াম, ফ্লক্স, পিটুনিয়া ছড়িয়ে দিত পাঁচমিশালি গালিচা। এছাড়া থাকত পুজোর ফুল – গাঁদা, টগর, লাল গোলাপ, জবা, বিশেষ করে পঞ্চমুখী, আর সুগন্ধি রজনীগন্ধা, বেলফুল, কুন্দ, কাঞ্চন। আমার প্রিয় ছিল মাধবীলতার গুচ্ছ, ঝুমকোলতা আর সবুজ ঘাসের ওপর ছড়ানো শিউলি ফুল। পুজোর জন্য শিউলির মালা গাঁথা, বোঁটা শুকিয়ে বাসন্তী রঙে পুতুলের শাড়ি রাঙানো, কাজ কিছু কম ছিল না। আর শিউলি ফুল মানেই তো শরতের নরম সোনালি রোদ, দুর্গাপূজার ঢাকের ধ্বনি, উৎসবের ডাক, আনন্দ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে নানা এলাকার বেশিরভাগ বাড়িতে সুন্দর বাগান ছিল। নীলক্ষেতের বাগান ছিল বিখ্যাত। বিশেষ করে প্রোঃ সত্যেন বোসের বাগান, সেখানে উনি পায়চারি করতেন। আমার বাবার মতো, মালি কাজ করলেও গৃহস্বামী নিজেই বাগানের সৌন্দর্য ফুটিয়ে তুলতেন। গাছের তলা অপরিষ্কার থাকলে সৌন্দর্য বজায় থাকে না – বাবাকে দেখেছি আটাশি বছর বয়সে শান্তিনিকেতনে গোলাপের ঝরেপড়া শুকনো পাপড়ি কুড়িয়ে সযতেœ জমা করে রাখছেন। ঢাকাতে পরিমল কাকার দিদি ছিলেন, ছোড়দি। গল্প শুনতাম যে, ছোড়দি-পিসিমা তাঁর বাগান এত পরিচ্ছন্ন রাখেন যে গাছকে সজোরে ঝেড়ে শুকনো পাতা ঝরিয়ে সেটা কুড়িয়ে নেন। পাড়াতে এই নিয়ে হাসিঠাট্টা হতো। আজ আমি নিজের অজান্তেই এভাবে গাছ ঝাঁকিয়ে শুকনো পাতা কুড়োই।
বাবা আমাকে আর দাদাকে (প্রয়াত সমীর দাশগুপ্ত, আমার জেঠতুতো দাদা, যিনি আমাদের বাড়িতে থেকে বড় হয়েছেন)
আলাদা-আলাদা গোলাকার জায়গা দিয়েছিলেন বাগান করার জন্য। মাটি খোঁড়া, বিচি লাগানো, জল দেওয়া, সবই আমাদের করতে হতো। বাবাদের সান্ধ্য-আড্ডায় আমার অবাধ গতি থাকায়, নানা কথার মধ্যে শুনেছিলাম সুদূর বিলেতে একশ বছরেরও আগে রিকার্ডো নামে কোনো এক অর্থনীতিবিদ ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে, অত্যধিক ব্যবহারের সঙ্গে সঙ্গে মাটি নীরস, ক্লান্ত হয়ে যাবে, উপযুক্ত যতœ না নিলে ফসল কম হয়ে যাবে (অন্তত আমি এ-ই বুঝেছিলাম)। পাঁচ বছরের আমি, যতেœর খাতিরে অত্যধিক জল ঢেলে মাটি, ফুলের চারা, সবকিছুকেই এত পরিশ্রান্ত করে দিলাম যে, ‘আমার বাগানে এত ফুল’, একথা জাহির করার সুযোগই পেলাম না। জলে ভারাক্রান্ত আমার শখের বাগান শুকিয়ে গেল।
বাবার শতবার্ষিকী শ্রদ্ধার্ঘ্যে সমীর দাশগুপ্ত লিখেছেন, ‘পুষ্পোদ্যান রচনায় তাঁর বরাবরই গভীর আগ্রহ ছিল। পুরানা পল্টন পাড়ায় তাঁর ৫নং বাড়ির প্রশস্ত উদ্যানে প্রাণভরে ফুল ফুটিয়েছেন। পঞ্চাশের দশকে বারানসিতে তাঁর বাড়ির উদ্যানে ফুল ফোটানোর খেলা চলত। তবে শেষজীবনে শান্তিনিকেতনে নিজের বাড়িতে এসে এক দশককালের বেশি সময় আকাক্সক্ষা তৃপ্ত করে ফুলের বাগান রচনা করেছিলেন। নিজের হাতে বেশি কিছু করতে পারতেন না, সারাদিন বাগানে ঘুরে ঘুরে কাটাতেন। আমাকে প্রায়ই চিঠি লিখতেন তাঁর অনুপম হস্তাক্ষরে, (কখনো) লিখতেন দুটো গোলাপ গাছ মরে গেছে, আমি যেন একটা জন এফ কেনেডি এবং একটা মাদাম কুরির চারা নিয়ে যাই। কিংবা চাইতেন ব্ল্যাক প্রিন্স অথবা তাজমহল অথবা প্যারাডাইস। কাকার অর্থনীতি চর্চার প্যাশন এবং ফুল ফোটানোর আগ্রহের মধ্যে কোনটা বেশি জোরালো ছিল বুঝে উঠতে পারিনি।’২
নীলক্ষেতের বাগান যখন চোখে ভাসে মনে হয় শুধু বাবা কেন, অধ্যাপক মহলের অনেকের ক্ষেত্রেই একথা প্রযোজ্য। কোনটা বেশি প্রিয়, নিজের বিষয়ে অনুসন্ধান, না ফুল ফোটাবার আকাক্সক্ষা? গাছপালা, ফুলপাতার মাঝে শান্তি আসে; বিখ্যাত গায়ক, প-িত মল্লিকার্জুন মনসুরকে একবার জিজ্ঞাসা করেছিলাম, উনি আদৌ রেয়াজ করেন কিনা এত দশকের গানের পর; যদি করেন তো কখন করেন? উত্তরে বলেছিলেন, ‘তানপুরা নিয়ে রেয়াজ করিনি বহু বছর হয়ে গেল। এখন রোজ ভোরে বাগানে ঘুরি, পুজোর ফুল তুলি; নিরালায়, নিভৃতে রাগের প্রাণ খুঁজে বেড়াই গুনগুন করে – সেই হলো আমার রেয়াজ।’
৫নং বাড়ি ছিল ছড়ানো বাংলো, দুদিকে বাগান, কিছু বড় গাছ, সামনে গাছের বেড়া, আর ভেতরবাড়িতে বিরাট উঠান।৩ বাড়ির ভেতরে বাবার বড় পড়ার ঘর, তাতে বড় টেবিল, কাঁচ দেওয়া বইয়ের আলমারি, শোয়ার খাটে পরিপাটি বিছানা, গোটা দুই চেয়ার, একটি আরামকেদারা ও বাবার সেতার। একসময় বাজাতেন, আমরা যদিও শুনিনি। অন্য ঘরে জোড়াখাট, এডওয়ার্ডিয়ান আমলের ধাঁচে মায়ের ফৎবংংরহম ঃধনষব, আলমারি। বসার ঘরটি লম্বা, প্রচুর জায়গা, তাতে একটি সোফাসেট, কিছু চেয়ার, টেবিল ইত্যাদি। সোফার পেছনে সোনালি কাগজে লাল-কালো হরফে লেখা এ. ঈ. ইধংধশ। যেমনি চকচকে কাগজে নাম লেখা, তেমনি চকচকে পালিশ। মায়ের ১৯৩৪-এর হিসাবের খাতায় দেখেছি, ‘গোকুল বসাক – ১০ টাকা আলমারির জন্য’। এটা আগাম, তিন খেপে ৩৫ টাকা দিয়ে পুরো সোফাসেট ও আলমারি বানিয়েছিলেন। এই তিনটি ঘর ছাড়া পেছনে লম্বা ঘর, প্রায় পুরো বাংলোর মাপে, সেটাতে খাবার টেবিল, তখনকার দিনের ‘যিধঃ হড়ঃ’ যাতে যা খুশি ইচ্ছে রাখা যেত আর মাটিতে বসে খাবার কিছু পিঁড়ি। রান্না-ভাঁড়ার ছিল লাগোয়া, সে সঙ্গে জল রাখার ঘর ইত্যাদি। তিন দিকে প্রশস্ত বারান্দা, খোলা ও ঢাকা; সংকীর্ণ ব্যাপার নয়।
আলো-হাওয়া থাকার জন্য জানালা-দরজা বেশিমাত্রায় থাকত। ৫নং-এ বাইরে যাওয়ার দরজা ছিল ছয়টি। আজকের দিনে বাঞ্ছনীয় নয়। তখনকার দিনে জানালা ছিল ভিন্ন ধরনের। একটি দেখালেও থাকত দুটি জানালা – ওপর-নিচ লাগোয়া; নিচেরটি ঘরের মেঝে অবধি নেমে আসত। ওপরেরটি খোলা হতো আলো-হাওয়ার জন্য, শিক ছিল বলে চিন্তার কিছু ছিল না। বাইরে কারো সঙ্গে কথা বলতে হলে নিচেরটি খোলা হতো। জানালায় খড়খড়ি থাকত আর আমাদের খেলা ছিল তাকে ওপর-নিচ করা। জানালা বা আলমারির দরজা বন্ধ করা হতো কাঠের ব্যাং দিয়ে, সত্যি ব্যাঙের মতো দেখতে ছিল এগুলো, আর দরজা বন্ধ করার জন্য ছিল কাঠের লম্বা চ্যাপ্টা লাঠির মতো কিছু (মনে হয় ‘দাশা’ বা ‘দাড়ি’ বলা হতো)। ছিটকিনি মনে পড়ে না, থাকলেও শুধু রাতে বন্ধ করার সময় ব্যবহার হতো।
ঢাকা বৃষ্টি-জলের শহর, বাড়ি কয়েক ধাপ সিঁড়ি বেয়ে উঁচু বানালে সাপ, ব্যাঙ ইত্যাদি আসার সম্ভাবনা কম থাকে; খটখটে বাড়ি, ওপর থেকে যাতে জল চুয়ে না পড়ে তার খেয়াল রাখতে হয়, আলো-হাওয়া আসে, সেদিকেও নজর দিতে হয়; তাছাড়া বাগান, উঠোন, চারদিকে খোলা জমি; বাড়িভাড়া এ-পাড়ায় বেশি হতো। কিন্তু এতে স্বাস্থ্য ভালো থাকত, তাই পাড়া-প্রতিবেশী সবাই মাইনের একটা বড় অংশ বাড়ি ভাড়াতে খরচ করতেন। মায়ের হিসাবের খাতা থেকে দেখেছি,
১৯৪১-এ ৫নং-এর ভাড়া ৩০ টাকা, যখন কেটেকুটে বাবার মাইনে আসত ৯০ টাকা।
আমাদের সব বাড়িতে আসবাবপত্র ভালো হতো; গোছানো, পরিচ্ছন্ন থাকত; কিন্তু সাজানোর জন্য শখের জিনিস বিশেষ রাখা হতো না, বড়জোর হাতের কাজ বা লেসে তৈরি টেবিলের কভার। এর ব্যতিক্রম ছিল দুটি বাড়িতে। সেগুনবাগানে জে. কে. চৌধুরী মশায়ের বাড়ির বসার ঘরের ছাদের নিচে, জানালার ওপর ভাগে পুরো দেয়ালের মাপে ওঁর ভ্রাতৃবধূ এঁকেছিলেন লম্বা ফ্রেস্কো। শুকনো ফুল, পাতা, গাছের ছাল দিয়ে রং উনিই বানাতেন। মনে পড়ে বলেছিলেন, ডিমের ব্যবহারও হয়। পরে বুঝেছি যাকে ইবহমধষ ঝপযড়ড়ষ ড়ভ অৎঃ বলা হয়, যেমন নন্দলাল বসু ফ্রেস্কো এঁকেছেন বরোদাতে, সেই ধাঁচের। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতাম – একা-একা তুলি দিয়ে এত উঁচুতে কী করে করলেন এই সূক্ষ্ম কাজ! সে-বাড়ি সম্ভবত আজ নেই – থাকলেও, ফ্রেস্কোর ওপর না জানি কত চুনকাম হয়েছে। প্রফেসর চৌধুরীর কন্যা অমিতা বাবার ছাত্রী ছিলেন, অর্থনীতি বিভাগের সবচেয়ে মেধাবী ছাত্রছাত্রীর মধ্যে একজন, পরে কলকাতায় অর্থনীতির নামী শিক্ষয়িত্রী হয়েছিলেন। অমিতাদির সঙ্গে যোগাযোগ কখনো বন্ধ হয়নি। বছরপাঁচেক আগে যখন তাঁর নব্বই ছুঁইছুঁই, বলছিলেন, ‘দ্যাখ – এত এত বছর কলকাতায় থেকে ঢাকার জন্য কষ্ট হয় তা বলতে পারি না। তবে জানিস, বাড়িটার কথা খুব মনে হয় – অমন সুন্দর বাড়িতে আর তো কখনো থাকিনি। ওটা ছেড়ে আসতে খুব কষ্ট হয়েছে, এখনো হয়।’
অন্য সাজানো বাড়ি ছিল অজিত সেন মেসোদের। বসবার ঘরে সোফার সামনে, হরিণের শিংয়ের পায়ার ওপর ছিল ঝকঝকে গোলাকার নকশা করা পেতলের টেবিল, তার ওপর রাখা পেতলের গ-ার, হাতি ইত্যাদি। এক কোণে রাখা থাকত পেতলের লম্বা ডাঁটের ওপর কারুকার্য করা বিরাট ফুলদানি। শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা, ঝকঝকানি কমত না। এগুলো এত ভালো লাগত যে, আমার বিয়ের সময় সোনা-গয়নার বদলে এই বাহারের জিনিস চেয়েছিলাম। পেয়েছিলাম। আজো সবকিছু যতœ করে সাজানো আছে, কিন্তু সেই ঝলক কিছুতেই আনতে পারি না।
মধ্যবিত্ত পরিবারের ভূষণ ছিল বই – আলমারি ভরা বই। শুধু অধ্যাপক মহলে নয়, প্রায় বাড়িতেই থাকত ইংরেজি ও বাংলা সাহিত্য – গদ্য এবং পদ্য, ভ্রমণকাহিনি বা ভক্তিমূলক বই। পাঠ্যপুস্তক ছাড়া ছোটদের জন্য আনা হতো গল্পের বা শিক্ষামূলক বই, যাতে ছোটরা একটি বৃহত্তর পৃথিবীর ছোঁয়া পায়। এছাড়া আসত নানারকম মাসিক পত্রিকা যেমন প্রবাসী, ভারতবর্ষ, বসুমতী। ১৯৩০-এর দশকে দেখেছি প্রবাসী শুরু হতো রবীন্দ্রনাথের কবিতা দিয়ে, তারপর বিশ্বের নানা সংস্কৃতির ওপর প্রবন্ধ, নানা গল্প ও ধারাবাহিক উপন্যাস। পড়–য়াদের ব্যস্ত রাখবার রসদ কম ছিল না। গৃহিণীরা সংসারের শতকাজের মাঝেও সময় করে দুপুরে একটু বই পড়ে নিতেন; দৈনন্দিন জীবনের বিশেষ অঙ্গ ছিল বই পড়া।
শিক্ষকদের বাড়িতে নিজেদের বিষয়ের বই থাকত নিজস্ব গ্রন্থাগারে। বাবার পড়ার ঘরের আলমারিতে কালো বাঁধাইতে সোনালি অক্ষরে নাম লেখা অর্থনীতির ওপর পুরনো, নতুন কত বই ছিল, বেশিরভাগ দ্বিতীয় বা তৃতীয় খেপে কেনা। বিভিন্ন নাম লেখা তাতে, যখন যিনি মালিক ছিলেন তাঁর। উপহারের বই হলে তাতে নানাবিধ উৎসর্গ থাকত, হাতে নিলে রোমাঞ্চ জাগত – কি জানি যাঁদের নাম লেখা তাঁরা কেমন পড়াশোনা করেছেন, আবার কী পরিবেশে বই বিক্রি করতে হয়েছে। তাঁরা কি বাবার মতোই এদের এত ভালোবাসতেন, এত যতœ নিয়ে রাখতেন? যখনকার কথা বলছি তখন অনেক বইয়ের বয়স পঞ্চাশোর্ধ্ব, ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকের। এদের শতবর্ষ পূর্ণ হয়েছে বহু বছর, ব্যবহারে জরাজীর্ণ বই, আজ আমার গ্রন্থাগারের ভূষণ।
যখন ঢাকা ছাড়ি, বইপত্র আমাদের মতো নিরাপদে শহর ছেড়েছিল, ভবঘুরে জীবনেও তারা সযতেœ ছিল। সবার পক্ষে তা সম্ভব হয়নি। অজিত সেন মেসোরা ১৯৫০-এর দাঙ্গায় সবকিছু রেখে, বাড়ি বন্ধ করে কলকাতা চলে এসেছিলেন। শহর শান্ত হলে উনি ফিরে গিয়ে দেখলেন বাড়িতে অন্য বাসিন্দা, সেন পরিবারের রুচিসম্মত সাজানো বাড়ি অন্য রূপে সাজানো, কিছু খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়। মহাভারতের এক খ- পেয়ে নিয়ে এলেন – আর কিছু নয়। একজন অধ্যাপকের পক্ষে একটি বই হারানো দুঃখের, এ তো তাঁর বহু বছরের সঞ্চয়। এ রকম বহু ‘হারিয়ে যাবার’ কাহিনি আছে এপার-ওপার মানুষের জীবনে।
৫নং বাড়ির ভেতরের উঠোনের আকর্ষণ ছিল প্রচুর। কুয়ো থেকে জল তোলা, কয়লা ভাঙা, গুল দেওয়া, কাঠ কাটা, গেরস্থালির কত কাজ সেখানে হতো। উঠোনের দরজায় দাঁড়িয়ে দুই কাঁধে বাঁশে ঝোলানো হাঁড়িতে দুধ, ঘি, গুড় বিক্রি করতে নানাজনের আনাগোনা, কাবুলিওয়ালার হাঁক, মুশকিল আসানের গান – সেই টানা সুর ‘মুশকিল আসান’; দেখতে, শুনতে নানা অভিজ্ঞতা, অনুভূতি আনন্দ। এই দরজায় নিয়মিত আসতেন এক মহিলা; পায়ে চটি, সাদা শাড়ি সাধারণ করে পরা, চোখে চশমা, মার্জিত কথা। এর নাম ছিল মৎধফঁধঃব ভিখিরি, চশমার জন্য। মুশকিল আসানের আলখাল্লার থেকে চশমার ভীতি বেশি ছিল আমার। এই উঠোনেই পুরনো ধুতি গায়ে জড়িয়ে বাবা বসতেন আর নাপিত তার দক্ষ হাতে কাঁচি দিয়ে চুল ছেঁটে দিত। পেছনের বারান্দায় চলত ঝামা দিয়ে পা পরিষ্কার করে আলতা পরা, চুল বাঁধা – আমার বিনুনি, মায়ের খোঁপা; লুডু খেলা, ছবির বই দেখা, জলছবি লাগানো – যেন মেয়েদের, ছোটদের আলাদা মহল।
লুডু খেলার সঙ্গে মনে পড়ে ‘গোলকধাম’, যতীনদা তাঁর দেশ নোয়াখালীর কাছাকাছি কোনো গ্রাম বা সদরঘাট থেকে এনেছিলেন। দিনের কাজের শেষে সাঁঝবেলায় বা দুপুরে সময় নিয়ে খেলা – আলো-হাওয়া উপচেপড়া পেছনের বারান্দায়। আর কোথাও, কখনো এ-খেলা দেখিনি। একটি মস্তবড় চকচকে কাগজে, যেমন মানচিত্রের কাগজ হয়, বড়-বড় খোপের মাঝে নানা ভগবানের বা পৌরাণিক কাহিনি আঁকা। সবার উঁচুতে কাগজের পুরো প্রস্থ ছড়িয়ে গোলকধাম বা স্বর্গ। শুরুতে, একেবারে নিচে নরক। কড়ি দিয়ে খেলা – কড়ি চিত না উলটো তার ওপর নম্বর, প্রতি খোপেও নম্বর, ওপর-নিচ করার নানা সিঁড়ি; অনেকটা ংহধশবং ধহফ ষধফফবৎং-এর মতো। প্রচুর সিঁড়ি ভেঙে, ওঠানামার পর যদি ভাগ্যে থাকে তো গোলকধাম পৌঁছোনো। বুক দুরুদুরু করা খেলা, যদি নরকে নেমে যাই?
এই উঠোনের বারান্দাতেই বসতেন ফলওয়ালারা নানা ফল নিয়ে। আমের ঝুড়ি বেশি করে মনে পড়ে, ফজলি, ল্যাংড়া আরো কত কী। দর ছিল ১০০ করে। তাদের জিজ্ঞেস করা হতো, ‘১০০-তে কত?’ উত্তর আসত ১০০-তে ১১০ বা ১২০। ডিমওয়ালার হিসাব ছিল ২০-তে, ২০-তে কত? আমি বড় বিপদে পড়ে যেতাম কারণ আমাকে যেভাবে অঙ্ক শেখানো হয়েছিল তাতে ১০০, ১০০ই; ১২০ বা ১১০ হতে পারে না। ‘ফাউ’ কথাটা অনেক পরে বুঝেছি – ততদিনে হিসাব থেকে ফাউ উঠে গিয়েছে। আঁট করে খোঁপা বাঁধা, ডুরে শাড়ি পরা বউমারা বা লাল-সবুজ পাড়ের মোটা মিলের শাড়িপরিহিত শাশুড়ি মায়েরা, কখনো থান পরা বিধবা মহিলারা আসতেন মুড়ি, চিড়ে, খই, মোয়া নিয়ে। জল খেয়ে, মায়ের সঙ্গে দুটি কথা কয়ে চলে যেতেন। মোয়া গুনতে ‘খুকি’, খোকার জন্য কখনো দুটি বেশি দিতেন, কিন্তু ফাউ ছিল না।
নন্দ স্যাঁকরা আসতেন ভেতরবাড়িতে, তাঁর ডিজাইনের বই নিয়ে। বইটিতে জাদু থাকত – কত গয়না, কত নকশা; কান, কানবালা, দুল, ঝুমকো, কানপাশা; গলার মপচেন, চিক, সাতনরি, সীতাহার, সাধারণ হারের কী বাহার; বিছে, ডবল বিছে, মটর মালা; হাতের বালা, কঙ্কণ, মানতাসা, বাউটি, ওপর হাতের তাবিজ বা আর্মলেট, দেখে চোখ জুড়িয়ে যেত। এক বহু পুরনো বসুমতীর পাতায় বিজ্ঞাপন ছাড়া এসব ডিজাইন উঠে গেছে, অন্তত আমার নজরে আসে না। বাইরে থেকে অতিথি এলে বা পারিবারিক বিয়ে থাকলে ওঁকে ডাকা হতো, মায়ের পক্ষে নতুন গয়না গড়ানো সম্ভব ছিল না। একটি মাত্র হার ছিল, মাঝে মাঝে নন্দ স্যাঁকরাকে দিয়ে ডিজাইন বদলে নিতেন। মনে হতো নতুন কিছু।
কাপড়চোপড় কেনাকাটা মানেই ঢাকেশ্বরী বস্ত্রালয়। লেপ-তোশকের কাপড়, মার্কিন, লং ক্লথ, শালু থেকে বেনারসি শাড়ি অবধি, সবকিছুতেই এই দোকানের নাম দেখতে পাই পুরনো কাগজপত্রে। মার্কিন, লং ক্লথ কিন্তু হেলাফেলার ছিল না, এ দুটি ছাড়া সংসার করা ভার। শুধু ওয়াড় কেন, মার্কিন দিয়ে তৈরি হতো ছেলেদের নিমা, ছোট মেয়েদের হালকা জামা, যাতে একটু কুঁচি করা কাপড় এদিক-ওদিক লাগালেই হয়ে যেত বাহারের ফ্রক। বড়দের সেমিজ, হালকা পর্দার প্রয়োজন হলে পর্দা, প্রায় হলুদের গুঁড়োর মতো। লং ক্লথ একটু শৌখিন, শুধু পাজামা নয়, অল্পবয়সীদের শার্ট, পাঞ্জাবিও বানানো হতো এ দিয়ে। বাবা-কাকাদের পাঞ্জাবির জন্য আসত আদ্দি। সবকিছু পাওয়া যেত এক ছাদের নিচে ঢাকেশ্বরী বস্ত্রালয়ে। বছরের পর বছর কেটেছে, মায়েদের পছন্দের দোকান বদলায়নি। কলকাতার গড়িয়াহাটে সারি সারি কত বাহারের দোকান, মায়েরা যেতেন শুধু ঢাকেশ্বরীতে। পুরনো পরিচয়ের আবহাওয়া নতুনে নেই।
৫নং বাড়ির সংসার খুব ছোট ছিল না। বাবা-মা, দাদা, ভাই (জন্ম ১৯৪২, নভেম্বর ১৭), আমি ছাড়াও ছিলেন যতীনদা, অল্পবয়সী অনাথ ছেলে। ধুতির খুঁট গায়ে জড়িয়ে সামনের বাড়ির দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে ছিল কাজের খোঁজে। সেই যে মা ওকে বাড়ি নিয়ে এলেন ওরকম একলা দেখে, যতীনদা আমাদের পরিবারের অঙ্গ হয়ে গেলেন। তার বিয়ে হওয়ার পর, আমরা কাশী ছাড়ার পরই, মা-বাবা তাকে আলাদা সংসার করতে দিলেন। আমার ভাই অন্তপ্রাণ ছিল যতীনদার; ১৯৯৮-তে তাঁর দীর্ঘ জীবনের প্রায় শেষদিন পর্যন্ত আমার ভাই যতীনদার দেখাশোনা করেছে, যদিও যতীনদা কাশীতে, ভাই বিলেতে। সেকালে যতীনদার মতো অনেক বাড়িতেই কোনো দাদা বা দিদি সংসারের নানা দায়িত্ব নিয়ে স্নেহ-যতেœ পরিবারের সদস্য-সদস্যা হয়ে থাকতেন।
আমরা ছ-জন ছাড়া, আমার সেজ জেঠিমা, দাদা সমীরের মা, দুই মেয়েকে নিয়ে বছরের অনেকটা সময় আমাদের সঙ্গে ঢাকায় কাটাতেন, ১৯৩৪-এ বাবা-মার সংসার শুরু হবার পর থেকেই। জেঠামশায় আসামের এক চা-বাগানে ডাক্তার ছিলেন, জেঠিমা, আমাদের সেজমা, নির্জন চা বাগানে থাকতে অপছন্দ করতেন, তাই এ-ব্যবস্থা। ঢাকা না হলে তিনি চলে যেতেন বরিশালে বড় জেঠামশায়ের কাছে, মাঝেমধ্যে আসামে, নির্বাসনে। সম্ভব হলে সেজ জেঠা ছুটি নিয়ে চলে আসতেন আমাদের কাছে; পিঠাপিঠি ভাই – বাবা আর তিনি ভাই ছাড়াও নিকটবন্ধু ছিলেন।
মধ্যবিত্ত পরিবারে নিজের সংসার না করে ভাশুর-দেওরের কাছে লম্বা সময় থাকা তখনকার দিনে একেবারেই স্বাভাবিক ছিল না। আপত্তি
থাকলেও সেটা কেউ ব্যক্ত করেননি কারণ সেজমা ছিলেন গৈলা বক্সিবাড়ির পাশে গুপ্তবাড়ির মেয়ে, বাবার অন্তরঙ্গ বন্ধুর ছোট বোন; সংসারে তাঁর অধিকার বা স্থান ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। তিনি কাজ করতে ভালোবাসতেন না, গল্প-গুজব, হাসিঠাট্টার মধ্যে দিন কাটাতেন; সংসারের কোনো দায়িত্ব এঁর ওপর দেওয়া যেত না। মা-জেঠিরা এটা মেনে নিতেন কারণ সেজমার স্নেহ-ভালোবাসা দেওয়ার ক্ষমতা ছিল প্রচুর। মায়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব ছিল, উনি থাকলে বাড়ি ভরে যেত। আমার মায়ের যেমন বিয়ের পর সাজগোজ, গয়নাগাটির দিকে মন একেবারেই ছিল না, বা মন দেওয়ার সময় ও সামর্থ্য ছিল না, সেজমা ছিলেন একেবারে উলটো। তিনি গয়না পরতে খুব ভালোবাসতেন। আসামের জনশূন্য বাড়িতেই হোক বা ঢাকাতে একটু লোকজনের মাঝে হোক, মনে পড়ে স্নান করে ছোটখাটো গোলগাল মানুষটি লাল পাড় সাদা মিলের শাড়ি সাধারণ করে পরে চুড়ি, কঙ্কণ, ওপর হাতের আর্মলেট, গলায় চিক ও একাধিক চেন, কানে ঝুমকো পরে ৫নং বাড়ির ভেতর বাড়িতে হাঁটাচলা করছেন। হাসি-ঠাট্টা সইতে হতো, আবার এই সহজ-সরলতার জন্যই হয়তো সবাই ওঁকে ভালোবাসতেন।
৫নং সংসার, ছোট ছিল না বলা সঠিক নয়, ‘বড় ছিল’ বলা উচিত। ২৮/৩/৩৮-এ ধীরেন দাসগুপ্ত, পরিবারের জ্যেষ্ঠ জামাতা, বাবাকে লিখছেন, ‘অতুলের (আমার বড় জেঠামশায়) কাছে জানতে পারলাম ওর ছেলেমেয়েদের শরীর বরিশালে সুস্থ থাকে না বলে তারা তোমাদের কাছে। এখন কেমন আছে?’ এটা যদিও সেগুনবাগানের দুটি ঘরের সংসারের কথা, ৫নং-এ আসার পর খুব একটা বদল হয়নি। তবে স্কুল ইত্যাদি শুরু হবার পর স্বাস্থ্যোন্নতির চেষ্টা ছুটির সময় হতো। মাকে কলেজজীবনে দিদিমা ঘরের কাজ, রান্না করতে শেখাননি কারণ ‘বিয়ের পর তো সংসার, রান্নাবাড়ি নিয়ে ব্যস্ত থাকবে, এখন পড়াশোনা করে, বন্ধুদের নিয়ে আনন্দ করুক।’ হয়েও ছিল তাই, বিয়ের পর থেকে বড় পরিবার, রান্নাবাড়ি, আতিথেয়তা নিয়ে মায়ের জীবন কেটেছে। আশেপাশের মাসি-কাকিদের দু-একজন যাঁরা চাকরি করতেন, তাঁদেরও সংসার নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হতো। এতে মায়ের বা অন্যদের কোনো আপত্তি ছিল না, কারণ তাঁরা কেউ অন্দরমহলে সীমাবদ্ধ হয়ে থাকেননি। কোনো তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের আলোচনা না হলে সব আড্ডাতেই বাবা-মেসো-কাকাদের সঙ্গে মা-মাসি-কাকিদের সমান স্থান ছিল। এঁদের নিজেদের মধ্যে বন্ধুত্ব ছিল, সিঁড়িতে বসে বা খোলা বারান্দায় কত সময় নিজেরা গল্পগুজব করতেন। ‘সারাদিন হেঁসেল ঠেলছি’ এই অনুশোচনা শুনিনি। আশ্চর্য, এত কাজের মাঝেও মায়েদের বই পড়া, পাড়ায় অল্প বেড়ানো, দুপুরে একটু গড়িয়ে নেওয়া বা সেলাই করা – সবকিছুর সময় থাকত।
ছোটবেলার প্রধান স্মৃতি হচ্ছে আমার ভাইয়ের জন্ম। ভাইবোন কেউ আসছে আমাকে বোঝানো হলেও, এর তাৎপর্য বুঝতে পারিনি। সেজমারা বাড়িতে – হইচই সবসময়। হঠাৎ একদিন এক ঘোড়াগাড়ি এলো – দুই ইংরেজ বা বিদেশি মহিলা নামলেন, নীল-সাদা গোড়ালি অবধি নিচু বিদেশি বেশ, গলার মালায় ক্রস। মাকে পরীক্ষা করতে এসেছেন – এঁরা ডাক্তার। ভয় ঢুকে গেল, মা নিশ্চয়ই অসুস্থ। এই ভয়ের জন্যই বোধহয় গাড়ি থেকে নেমে দুই শ্বেতাঙ্গী মহিলা গেট দিয়ে ঢুকছেন, এ-ছবি আমার চোখের সামনে থেকে কখনো মুছে যায়নি।
একদিন শুনলাম আমার ভাই হয়েছে। আনন্দ, ঈর্ষা কিছু মনে পড়ে না, শুধু মনে পড়ে দিশেহারা হয়ে গিয়েছিলাম। বাবা যতœ নিলেও আমার দৈনন্দিন জগৎ পালটে গেল, আমি মায়ের কাছ থেকে দূরে। পরে শুনেছি ভাইকে দেখতে যখন সবাই ঘরে ঢুকছেন, আমি ছিলাম সবার পেছনে, মুখে খুশির লেশও ছিল না। একেই হয়তো হিংসা বলে। ছেলে হয়েছে – সবাই সেই আনন্দে ব্যস্ত, আমার দিকে তাকাবার কারো সময় নেই। হঠাৎ একাধিপত্য চলে গেল, আমি বাইরের কেউ হয়ে গেলাম।
আমার সহায় হলেন দিদিমা। তিনি কাছে টেনে নিলেন, হয়তো বললেন, ‘আমাগো মাইয়াই লক্ষ্মী।’ ষষ্ঠীর দিন বাড়ি ভরা, সবাই আসছেন সদ্যোজাত শিশুর জন্য উপহার নিয়ে, আমি উপেক্ষিত। ঠোঁট ফোলাতে ওস্তাদ, এদিক-ওদিকে ঘুরতে লাগলাম। দিদিমা সব উপহার আমাকে দিয়ে বললেন, ‘আসলে এগুলো তোমার জন্য, ভাই ছোট বলে ওকে দেওয়া হয়েছে।’ ঠোঁট ফোলানো আমিকে বুঝ দিতে সময় লাগত না। একটি ছোট মেয়ের মনের উচাটন বুঝেছিলেন দিদিমা; আর বুঝেছিলেন মৃণাল মাসিমা, মায়ের মাসতুতো বোন। শুধু ভাইয়ের জন্য নয়, কমলা রঙের সিল্কের জামার কাপড় আমার জন্য আলাদা করে এনেছিলেন। সেকালে একটি কন্যাসন্তানের মনে ঈর্ষা নয়, ব্যথা হতে পারে, তা নিয়ে আত্মীয়-পরিজন বড় একটা চিন্তা করতেন না।
ছোটবেলার প্রখর স্মৃতিতে আছে বিবন দাই, ভাইকে জুড়েই তার উপস্থিতি। সে নাকি আমার শিশুকালে অনেকদিন আমার যতœ করেছে – তা তো আমার মনে নেই, আমি তাকে দেখেছি পাঁচ বছর বয়সে, ভাইয়ের জন্মের পর। এক সোনালি রোদভরা সকালে বিবন বাইরে সবুজ ঘাসের ওপর দাঁড়িয়ে, মা নিচের জানালা খুলে তার সঙ্গে কথা বলছেন, ফ্রেমে রাখা ছবির মতো এ-দৃশ্য পরিষ্কার আমার সামনে। পরদিন থেকে সে ভাইয়ের যতœ-আত্তিতে সাহায্য করতে শুরু করল। পাতলা, ফর্সা, ছোটখাটো, কোঁকড়া চুল, খয়েরি দাঁতে (কী সেবন করত জানি না) তাকে আরো সুন্দর দেখাত। বিবনের ভাষা ছিল কিঞ্চিৎ অপরিচিত, সকালকে সে বলত ‘বেয়ান’ বা ‘বিয়ান’, জলকে ‘পানি’, আমি এই তফাতের কারণ বুঝে উঠতে পারতাম না। সদ্যোজাত শিশুর যতœ নিতে অভিজ্ঞ বিবন আর মায়ের মধ্যে আমাকে ও ভাইকে জড়িয়ে একটা বন্ধন ছিল। বিবন ছিলেন স্বল্পভাষী, উঁচু স্বরে কথা বলতে কখনো শুনিনি; ছাপা শাড়ি হালফ্যাশনে পরা, কোমরে আঁচল গোঁজা, বিবনকে এত যুগ পরও ছেলেবেলার অন্তরঙ্গ একজন মনে হয়। ভাইয়ের জন্মের কমাস পরই দুর্ভিক্ষ শুরু হলো, বিবন ভাইয়ের নাম দিলো ‘আকালবাবু’। বড় আদরের সঙ্গে ডাকত, ‘আকালবাবু, ও আকালবাবু’। ১৯৪২-৪৩ সালে সে আমাকে ভিনদেশে বানানো চিনেমাটির ছোট্ট পেয়ালা রেকাবি দিয়েছিল পুতুলখেলার সামগ্রী হিসেবে, আজো তা আমার কাছে রাখা আছে। দেশবিভাগের সময় ভবঘুরের মতো নানা ট্রেনে চড়ে, নানা শহরে থেমে, কখনো স্টেশনে, কখনো কারো বাড়িতে সময় কাটিয়ে, দিল্লি, বর্ধমান, কটক কত জায়গায় বাস করেছি; শুধু আসবাবপত্র কেন, ঢাকার সংসারের বেশিরভাগ জিনিসই ছেড়ে আসা হয়েছে বা হারিয়ে গেছে, কিন্তু মায়ের পুঁটুলিতে সাবধানে কাপড়ে জড়ানো বিবনের দেওয়া সেই উপহার আজো অটুট অবস্থায় রয়ে গেছে।
প্রিয় বন্ধু ছিল কৃষ্ণা, পরিমল কাকার ভাইঝি। সুন্দরী, বুদ্ধিমতী, কথায় পটু; তার পাশে নিজেকে বোকা মনে হতো। আমার থেকে চার মাসের বড়, আমার ওপর বড়র মতোই প্রতাপ ছিল তার – আমার কিন্তু খারাপ লাগত না। খুব ভাব ছিল আমাদের। পড়াশোনায় তখন ওর মন ছিল না। একবার খেলাচ্ছলে কোনো গুরুজন ওকে পড়াতে গেলে খানিক খেলার পর হঠাৎ সে বলে উঠল, ‘ওমা, তোমরা আমাকে লেখাপড়া শেখাচ্ছো – এ-খেলা খেলব না।’ হয়ে গেল পড়া! গল্প শুনেছি, এক বিকেলে কৃষ্ণা যথারীতি ৫নং-এ এসেছে; আমি মাটিতে বসে পা ছড়িয়ে কাঁদছি – এ-কাজ আমি প্রায়শ করতাম। কৃষ্ণা বলে উঠল, ‘ওমা, তুই কাঁদছিস? কেন? জেঠিমার (আমার মা) কথা শুনিসনি বুঝি? তাই বকুনি খেয়েছিস? জানিস না, বড়দের কথা শুনতে হয়?’ এ নিয়ে কৃষ্ণার মা, জেঠিমা খুব হাসাহাসি করতেন, কারণ ও যে সবসময় সুবোধ বালিকা হয়ে কথা মেনে চলত তা নয়। তবে ওর একটা স্বাভাবিক তেজ ছিল, যাকে হয়তো ইংরেজিতে ঢ়বৎংড়হধষরঃু বলা হয়; ওর উপদেশ মেনে চলতে আমার অসুবিধে হতো না।
কৃষ্ণা পরে কলেজ পাশ করে পদার্থবিজ্ঞানের গবেষক সুনীলদাকে বিয়ে করে সুখে সংসার করেছে। ওর বিয়েতে কনে সাজানো থেকে শয্যাতুলুনির টাকা অবধি সবকিছুতেই মহানন্দে অংশগ্রহণ করেছি। আর আমার বিয়েতে কৃষ্ণা ছিল প্রধান শ্যালিকা।
খুব কাছের ছিলেন, আজো আছেন, আমার মিষ্টিদি, অজিত সেন মেসোর মেয়ে। আমার থেকে কয়েক বছরের বড়, আমাকে তাঁর ছোট বোনের মতোই স্নেহ করেন। শুনেছি আমার জন্মের কিছুদিন পর যখন গে-ারিয়া থেকে সেগুনবাগানের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়, এই মেসোমশায় তাঁর গাড়িতে আমাদের সবাইকে নিয়ে যান। ছোট মিষ্টিদিও সঙ্গে ছিলেন। শান্ত, ধীরস্থির, মিষ্টিদি আমাদের ঝগড়া, রেষারেষি, বিশেষ করে পুতুলখেলার ঝগড়া মেটাতে পটু ছিলেন। আজো তাঁর মাঝে একটা সৌম্য ভাব আছে। এঁর বিয়েতে (১৯৫৪ কি ’৫৫) প্রথমবার শয্যাতুলুনির টাকা পেয়ে কি আনন্দ হয়েছিল। তখন বিয়েতে শাড়ি, গয়না খাটে বা কোথাও সাজাতে হতো, যাতে সবাই যৌতুক দেখতে পারেন। বেগুনি রঙের বেনারসিতে সোনালি জড়ির শঙ্খ আজো আমার চোখের সামনে। ওঁর স্বামী শঙ্করদাও শান্ত ছিলেন। সুনীলদা, শঙ্করদা দুজনের সঙ্গেই আমার সুন্দর বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল, যদিও দেখা-সাক্ষাৎ কম হতো। আজ অনেক সুখস্মৃতি নিয়ে আমরা তিন বান্ধবীই একা।
আরেক বন্ধু ছিল টুটু – এ-ও কৃষ্ণা, বাবার বন্ধু অরুণ দত্ত মেসোর মেয়ে। উনিও বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক – বাবারা একই সময় লন্ডনে ছিলেন। এঁরা পুরানা পল্টনে থাকতেন না, প্রায়ই বিকেলে বেড়াতে আসতেন। টুটু ছিল অন্যরকমের বন্ধু, পুতুলখেলার সাথি নয়, বই পড়ার সাথি। আমরা বই নিয়ে আলোচনা করতাম, সেটা হয়তো ‘টুনটুনির বই’র মধ্যে সীমিত থেকেছে, তা ‘টুনটুনির বই’র আনন্দ তো চিরকালের।
ওঁদের সম্বন্ধে দুটো কথা মনে পড়ে। গরমের ছুটিতে একবার ওঁরা পুরো পরিবার দার্জিলিং গিয়েছিলেন। পূর্ববঙ্গের আমরা – কলকাতায় আস্তানা নেই, দার্জিলিং যাবার প্রশ্ন আসে না। তখন ওখানে রকমারি পাথরের গয়না পাওয়া যেত। মাসিমারা ফিরে এসে আমাকে ইটের রঙের কোনো পাথরের এক জোড়া কানের গয়না দিয়েছিলেন – শৌখিন জিনিস পেয়ে আমার যে কী আনন্দ! কার হবে না? উপহার দেবার চল তখন ছিল না, বড়জোর জন্মদিনে একটি বই, মাসিমা অত্যন্ত স্নেহ করতেন আমাকে, তাই দিয়েছিলেন। এই কানের গয়না বহুকাল আমার সঙ্গী ছিল, হঠাৎ পাথরটা আলগা হয়ে গেল, দার্জিলিংয়ের ছোঁয়া কোথায় মিলিয়ে গেল। সেই বিখ্যাত শহর দেখতে বহু বছর লেগেছে, আমার ১৯৮২ আর ভাইয়ের ২০১০। ততদিনে শহরের আভিজাত্য, জৌলুস হারিয়ে গিয়েছে। পাথরের গয়না কোথাও নেই, তার বদলে পাওয়া যায় মেকি হাতির দাঁত ও প্লাস্টিকের গয়না। ইংরেজ আমলের ভার বইছে কাঠের সিঁড়ি ও কার্নিশওয়ালা একটি হোটেল, আর সেখানে প্রতি বিকেল পাঁচটায় পরিপাটি করে সাজানো চায়ের সরঞ্জাম। ভিড় ও আবর্জনায় কাঞ্চনজঙ্ঘা বা টাইগার হিল দেখবার আনন্দ স্তিমিত হয়ে গিয়েছে। সাহস করে নিচে জঞ্জালের স্তূপ ডিঙিয়ে শহরের বাসিন্দাদের ঘিঞ্জিবাজারে পাওয়া যায় অপূর্ব সোনার গয়না। সে তো সোনা। টুটুর দেওয়া পাথরের কানপাশাই আমার দার্জিলিংয়ের প্রিয় স্মৃতি।
টুটুর মা, মাসিমাকে খুব ফ্যাশনদুরস্ত মনে হতো – তিনি সাধারণ করে শাড়ি না পরে, কুঁচি দিয়ে আমার কলকাতার মাসিদের মতো শাড়ি পরতেন। পাতলা, লম্বা, যতদূর জানি, কলকাতায় বড় হয়েছিলেন, হালফ্যাশনে ছিমছাম হয়ে সেজে আসতেন। ওঁর একটা কথা ভোলার নয়। বেশ কয়েকটি বোন, সাজগোজ করতে সময় নিতেন, এঁদের বাবা তাতে মাঝে মাঝে একটু বিরক্ত হতেন। একদিন রুষ্ট মনে বললেন, ‘তোদের তৈরি হতে এত সময় লাগে কেন? দেখিস না, ভুতার মা, সবসময় তৈরি, কই, তার তো সময় লাগে না।’ ভুতার মা বাড়ির কাজের মহিলা। ব্যস, হয়ে গেল, ‘ভুতার মা’ যুক্ত শব্দ হয়ে আমাদের শব্দকোষে জায়গা নিল। চট করে কোনোদিন সাজগোজ করে বেরোলেই বাবা বলতেন, ‘ও আজ বুঝি ভুতার মা?’ ছোট-ছোট ব্যাপার – মন ভরানো।
দেশবিভাগে টুটুরা ঢাকা ছাড়েনি। মা-বাবাদের যোগাযোগ থাকলেও আমরা নতুন জীবন, নতুন বন্ধু নিয়ে ব্যস্ত, পুরনোদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার কথা ভাবিনি। বহু বছর পর টুটুর সঙ্গে দেখা হলো কলকাতায়। ঘরসংসার, পড়াশোনা ছাড়াও ছোটবেলার নানা গল্প হতো। টুটু কামরুন্নেসায় পড়ত – একদিন বলল, ‘এ-ই জানো, হঠাৎ একদিন ইডেন আর কামরুন্নেসা একত্র হয়ে গেল। তুমি তো ইডেনের মেয়ে, বাব্বা, তোমার ইডেনের মেয়েদের কি ডাঁট, কি নাক উঁচু, আমাদের গ্রাহ্যই করে না। কথা বলত না আমাদের সঙ্গে, সারাক্ষণ ‘আমরা ইডেনের’ – কী রাগ যে হতো। স্কুল কিন্তু আমাদের – ওরাই বাইরের, সেসব তোয়াক্কা করত না।’ ততদিনে ষাট বছরের ওপর কেটে গিয়েছে, আমরা দুজনেই সত্তরের কোঠায়, পুরনো অবহেলা টুটু ভোলেনি – ভুলে যাবার কথাও নয়।
আমাদের জীবন ছিল সাদামাটা, নিয়মে নিয়ন্ত্রিত। খেলনা, সাজগোজ, বইপত্র কিছুরই প্রাচুর্য ছিল না। প্রাচুর্য না থাকলেও জীবনযাত্রা সুঠাম, পরিচ্ছন্নভাবে চালানো হতো। সাজের মধ্যে প্রজাপতি আকারের ক্লিপ পেলেই খুশি। প্লাস্টিক আসেনি, গ্যাটাপার্চারের হলে তাকে অত্যন্ত শৌখিন মনে হতো। কিছুটা কারণ নিশ্চয়ই অর্থের অসংকুলান; শুধু তাই নয়, হেলাফেলার প্রাচুর্যকে অনেকেই সুনজরে দেখতেন না। যেন সংস্কৃতি, ঐতিহ্যহীন হঠাৎ-বড়লোক। পাড়ায় এরকম দু-একজন যাঁরা ছিলেন, পরিমল কাকা তাঁদের নিয়ে হাসিঠাট্টা করতেন।
মধ্যবিত্ত, বিশেষ করে মাস্টারমশায়েদের পরিবারের ছোট মেয়েদের পোশাক-আশাক ছিল সাধারণ; সুতির ফ্রক, বেশি শখ হলে এক-আধটি সাটিনের। জন্মদিন বা পুজোয় কখনো একটি ছোট শাড়ি। ছেলেরা পরতেন প্যান্ট-শার্ট বা ধুতি-শার্ট, বড়রা ধুতি-পাঞ্জাবি। কোনো-কোনো বাড়িতে নিমার ব্যবহার ছিল। পুরান ঢাকায় যেমন আমার মামাবাড়িতে লুঙ্গির চল ছিল, পুরানা পল্টনে এটা মনে পড়ে না। বাবারা ধুতি পরতেন শান্তিপুরি বা ফরাশডাঙ্গার – অবাক লাগত, ফরাশডাঙ্গার ধুতি নীল হয়ে আসত, এক ধোপে সাদা হয়ে যেত। ধুতি কুঁচিয়ে রাখা একটা কলা, বাবা-কাকারা এটা নিজেরা করতেন। কোঁচানো ধুতি বা কোঁচানো শাড়ি রাখার জন্য আলনা ছাড়া চলত না। গৃহস্থের প্রয়োজনীয় আসবাবপত্রের মধ্যে সামান্য আলনার উচ্চ স্থান ছিল। সবচেয়ে শৌখিন ছিল পাঞ্জাবি – সাদা ফুটফুটে আদ্দি, তা আবার গিলে করা। গিলে করার পদ্ধতিটা আজো আমার কাছে রহস্য রয়ে গিয়েছে। আমাদের ‘সাত্তারের’ বা ঢাকার দর্জিদের মতো মিহি সেলাই, বিশেষত পাঞ্জাবির সেলাই আর কোথাও দেখিনি। মেটিয়াবুরুজেও নয়। পরিমল কাকার চেহারা মনে পড়ে, কোঁচানো ধুতির ওপর গিলে করা সাদা পাঞ্জাবি আর শীতে হালকা ছাই নয়তো খয়েরি রঙের একটু গরম পাঞ্জাবি পরে হেঁটে আমাদের বাড়ি আসছেন।
তৈরি জামা সদরঘাট থেকে আনলে কারো মনঃপূত হতো না, সব বাড়িতেই ‘সাত্তারের’ আনাগোনা ছিল। পাঞ্জাবি ছাড়াও আমাদের সাত্তার কত সুন্দর ফ্রক, ব্লাউজ তৈরি করে দিত। ওই যে বলেছি, এমন মিহি সেলাই আর কোথাও দেখিনি। একবার ফ্যাশন হলো ‘স্মকিং’ করা হাঙ্গেরিয়ান নামের ব্লাউজের। সাদা মিহি কাপড়ে সাত্তারের হাতের তৈরি মেরুন ও কালো রঙের স্মকিং এনে দিয়েছিল বাইরের জগতের এক ঝলক। সেকাল হিসেবে মজুরি ছিল বেশি – দুই টাকা।
বয়স তিরিশের কাছাকাছি গেলেই বা দুই-এক ছেলেমেয়ের মা হলেই মায়ের দলকে রঙিন শাড়ি ছেড়ে সাদা শাড়ি পরতে হতো। এঁরা শখ মেটাতেন পাড়ের রঙে ও নকশায়। সাধারণ করে শাড়ি পরতেন, বাড়িতে মিলের আর বাইরে গেলে ধনেখালি বা শান্তিপুরি। আজ ধনেখালির কদর নেই আর শঙ্খ-পাখি ডিজাইনের ডবল কি সিঙ্গল জরি পাড়ের শান্তিপুরি পাওয়াই যায় না, সংগ্রহালয়ে দেখতে হয়। শান্তিপুরি শাড়ির ঐতিহ্য পুরনো, এর বিশেষত্ব ছিল পাড়ের কারুকার্যে, সৌন্দর্যে; হাঁস, লতাপাতা, শঙ্খ বা আঁশপাড়ে আবদ্ধ থাকত না; প্রয়োজনে সামাজিক বিষয়ে মন্তব্য থাকত। ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি যখন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয় হিন্দু সমাজে বিধবা বিবাহের প্রচলনের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছেন আর গোঁড়া হিন্দুরা হিন্দুধর্ম রক্ষা করতে তাঁর বিরুদ্ধে প্রচ- আন্দোলন চালাচ্ছেন, শান্তিপুরের তন্তুবায়রা শাড়ির পাড়ে রচনা করলেন এই কবিতা :
বেঁচে থাক বিদ্যাসাগর
চিরজীবী হয়ে
সদরে করেছে রিপোর্ট
বিধবাদের হবে বিয়ে।
কবে হবে এমন দিন
প্রচার হবে এ আইন
দেশে দেশে জেলায় জেলায়
বেরোবে হুকুম
বিধবা রমণীর বিয়ের
লেগে যাবে ধুম।৪

সমর্থন, না পরিহাস?
শিক্ষক মহলে ঢাকাই শাড়ি ছিল শৌখিন, চল ছিল কম। মায়ের কাছ থেকে শুনেছি একবার জোড়া-কলসি পাড়ের একটি ঢাকাই শাড়ি বড় পছন্দ হয়েছিল, খুব শখ হয়েছিল কিনবার, ১৮ টাকা দামের এই শাড়ি মায়ের পক্ষে কেনা সম্ভব হয়নি। বহু বছর পর আমাকে এ-কথা বলেছিলেন। মায়ের শাড়ি-গয়নার প্রতি নজর খুব একটা ছিল না, তাই একটা শখ মেটাতে পারেননি বলে আমার খুব দুঃখ হয়েছে। তবে প্রায় সব বাড়িতেই তখন এই অবস্থা। মহিলারা বিয়েতে পাওয়া কিছু ভালো শাড়ি যেমন বেনারসি, যতœ করে রেখে দিতেন, বিয়েথাতে পরে যাওয়ার জন্য। বিশেষ শাড়ি ছিল ‘করিয়াল’; পুজো, দুর্গাপূজার প্রতিমা বরণের জন্য রাখা থাকত। কোরা রঙের বেনারসের সিল্ক, খুব মসৃণ নয়, তাতে লাল পাড়ের কোলে জরির সূক্ষ্ম দাঁত, আর আঁচলে জরির কারুকার্য। বিয়ের যৌতুকে এ-শাড়ি দেওয়া হতো; তা সম্ভব না হলে লালপাড় সুতির শাড়ি, পুজোর জন্য আলাদা করে।
সাধারণত লাল হলেও মীরামাসির৫ করিয়াল শাড়ির পাড়ের রং ছিল গাঢ় বেগুনি। দুই বন্ধু যার-যার পুজো দেবার শাড়ি পরে যখন একসঙ্গে দশমীর দিন প্রতিমা বরণ করতে যেতেন, বড় ভালো দেখাত। চাবি ঝোলানো আঁচলের খুঁটি ঘোমটার ওপর দিয়ে গলায় জড়ানো, কপালে সিঁদুরের টিপ, নিজেরাই একেকটি প্রতিমা। নতুন ফ্যাশনে, আধুনিক জীবনযাত্রায় করিয়াল শাড়ির প্রয়োজন নেই, কাশীর বিশ্বনাথ মন্দিরের গলিতে বাহারের শাড়ির দোকানেও পাওয়া যায় না; এ-ও সংগ্রহালয়ের ফর্দে চলে গিয়েছে।
আমরা ছেলেমেয়েরা ভাবতাম, মায়েদের দক্ষতা ছিল রান্নাঘরে, আতিথেয়তা করতে, পরিবারের দেখাশোনা করতে আর অপরিসীম ভালোবাসা দিতে। এর বাইরে যে তাঁদের কোনো ভাবনা থাকতে পারে বা শখ-আহ্লাদ থাকতে পারে তা কখনো মনে আসেনি – অন্যায়মতোই মনে আসেনি। হঠাৎ জানতে পারলাম, মা সুগন্ধি পাউডার ভালোবাসেন। যুদ্ধের বাজারে কোথা থেকে বাবা ণধৎফষবু খধাবহফবৎ চড়ফিবৎ নিয়ে এলেন। মায়ের বাহারের ফৎবংংরহম ঃধনষব-এ ষধাবহফবৎ রঙের ছবি আঁকা চ্যাপ্টা কৌটো, যার ফুটো-ফুটো মুখ একদিকে প্যাঁচ দিলে খোলে, অন্যদিকের প্যাঁচে জাদুর মতো বন্ধ হয়ে যায়; শুধু ঘরে নয়, আমাদের জীবনেও সুগন্ধ ভরে দিলো। মা-মাসিদের প্রসাধনের শখ অল্পবিস্তর ছিল না তা নয়, তবে সামগ্রী ও সামর্থ্যরে অভাব ছিল। সত্যি কথা বলতে কি, পুরানা পল্টনে কারো সাজগোজের প্রতি নজর দেওয়ার ইচ্ছে বা সময়ও বিশেষ ছিল না। চুলের তেল সম্বন্ধে সবাই সচেতন ছিলেন। তৈলচিক্কণ, ঘন, কালো লম্বা কেশের জন্য কোন তেল ভালো এ নিয়ে মহিলা মহল বিভক্ত ছিলেন, প্রায় ইস্ট বেঙ্গল-মোহনবাগান ফুটবল টিমের ভক্তদের মতো। জবাকুসুম না ক্যান্থারাইতিন? নিজস্ব পছন্দ কেউ ছাড়বেন না। ড্রেসিং টেবিলে থাকত ট্যালকম পাউডার, ‘হিমালয়’ জাতীয় নামের বরফের মতো সাদা স্নো, মুখে-গলায় বুলিয়ে নেবার জন্য পাউডারের বাক্স আর সিঁদুর কৌটো। মিহি পাউডার আসত গোলাকার বাক্সতে, তাতে দু-তিন রঙের গোলাকৃতি এবড়োখেবড়ো ছাপ, আধুনিক শিল্পীর ক্যানভাসের মতো – ভেতরে থাকত নরম, প্রায় কায়াহীন সুতোর গুচ্ছ দিয়ে তৈরি পাফ।
শিবরাম চক্রবর্তীর ‘তোমার ঠোঁটের সিঁদুর অক্ষয় হোক’-এর সিঁদুর আমাদের চৌহদ্দির ভেতর ঢোকেনি তখনো – আলতা, সিঁদুর, পানের খিলির রাঙা দিয়ে সাজতেন
শাশুড়ি-বউমারা। পান শুভ। রামপুর ঘরানার কর্ণধার ইনায়েত খাঁ সাহেবের বন্দিশ আছে হামীর রাগে, আড়াচৌতাল তালে – ‘প্যারি লাডলিসি সুন্দর’ দুলহনের বর্ণনা; পানের লাল রঙে সৌন্দর্য –
হসত হসত ফুল ঝরত ঝরত
মুখসোঁ বিড়ি পানন লাল লাল
দিখত ইনায়েত –
কপোল লোচন বনি দুলারি প্যারি।’
(ব্রজভাষায় পানের ‘বিড়া’কে ‘বিড়ি’ বলা হয়, জানালেন ওস্তাদ রাশিদ খাঁ)।
মা-মাসি-কাকিমারা পাড়ার বাইরে বিশেষ যেতেন না, অভিভাবক ছাড়া কখনই নয়। বাইরে যেতে হলে ঘোড়াগাড়ি আনা হতো। অবস্থাপন্নরা যেতেন ফিটনে করে। বিকেলে গা-ধুয়ে, পাট ভাঙা শাড়ি পরে পাড়ার মধ্যে বেড়াতে গেলেও সন্ধের মধ্যে সবাইকে বাড়ি ফিরতে হতো। সংসারের কাজ শুধু নয়, ছেলেমেয়েদের এটা ছিল পড়ার সময়। তাছাড়া গৃহলক্ষ্মী কথাটা মনে রাখা হতো – ধূপ-ধুনোর সঙ্গে-সঙ্গে গৃহলক্ষ্মী শাঁখ বাজিয়ে দেবী লক্ষ্মীর আবাহন করতেন।
বিশেষ দিন বা পুজো ছাড়া মন্দির যাবার চল খুব ছিল না। একে তো যানবাহনের অসুবিধে, তাছাড়া পুজোকে পারিবারিক, নিজস্ব ব্যাপার বলে বিশ্বাস ছিল, বাড়ির চার দেয়ালের ভেতরেই করা হতো। মাঝেমধ্যে গিয়েছি সিদ্ধেশ্বরী মন্দির বা রমনা কালিবাড়ী, তা কোনো নির্দিষ্ট দিনে নয়।
আমরা ঘটা করে বাড়িতে সরস্বতী পুজো করতাম। এই দিন বই-খাতা খোলা মানা – পুজো, প্রসাদ, শাড়ি পরা – সম্ভব হলে বাসন্তী রঙের শাড়ি – সারাদিন নির্ভেজাল আনন্দ। একটি মুশকিল ছিল; সরস্বতী পুজোর আগে কুল বা বরই খাওয়া মানা, বাড়ির কুলগাছ ফলে ভরে যেত, নিচে কুল ছড়িয়ে থাকত, অতিকষ্টে লোভ সংবরণ করতাম। বিদ্যার দেবী, নিয়ম অমান্য করা যায় না। পুজোর ব্যাপারে পরিমল কাকার মা বলতেন, ‘মূর্তির প্রয়োজন কী,
বই-খাতা, পেনসিল, দোয়াত-কলম পুজো করো।’ ঢাকার জীবন থেকে শুরু করে আজো প্রতি বসন্ত-পঞ্চমীতে তাই করছি। এখন তো আর পাঠ্যপুস্তক নেই, পছন্দের বই, পরিবারের কারো লেখা বই, তানপুরা, তবলা ফুল দিয়ে সাজিয়ে প্রণাম করি। আগে মা মন্ত্র বলতেন, ‘টং টং সরস্বতী, নির্মলবরণী’। শেষ লাইন ছিল ‘যাবৎ জীবন তাবৎ থাক’ – মাঝে কোথাও ছিল ‘রতেœ বিভূষিত গজমতি হার’, পুরোটা পরিবারের কারো মনে নেই। পুজোতে ফাঁক রয়ে যায়, সন্দেহ নেই – তবে অন্য একটি মন্ত্র আছে, মিঞা তানসেনের লেখা ধ্রুপদ অঙ্গে সরস্বতী-বন্দনা :
সরস্বতী মাতা হো বরদাঈ
ব্রহ্মা বিষ্ণুকী তো হৈ দুহাই
বীচ সভা কে রহো সহাঈ
দেহ তোহে অব রাম দোহাঈ।৬
মায়ের বলা মন্ত্রর কথা সম্বন্ধে অনেককাল ভেবেছি, টং টং তো হতে পারে না, ত্বং ত্বৎ-কে বোধহয় এভাবে বলা হয়। আমার ধারণা একেবারেই ভুল। লক্ষ্মীপুজোয় ঘণ্টা বাজাতে নেই, আওয়াজ শুনে চঞ্চলা মা-লক্ষ্মী গৃহস্থের বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে পারেন। সরস্বতী পুজোয় তার উলটো – সশব্দে, সজোরে ঘণ্টা বাজিয়ে দেবীকে আবাহন করতে হয় – তাই প্রথমে ‘টং টং’।
প্রায় বাড়িতে লক্ষ্মীর আসন ছিল, আর কোনো পুজো হোক না হোক, লক্ষ্মীব্রত রাখা হতো প্রতি বৃহস্পতিবার। সন্ধেবেলা মা-বউরা কেউ দেবীর মূর্তির সামনে বসে লক্ষ্মীর পাঁচালি পড়তেন। প্রসাদ হতো বাতাসা, খয়েরি বা সাদা। মা-মাসিদের গলায় শুনতে পাই :
পূর্ণিমার তিথি যদি হয় গুরুবারে,
যেই নারি সেই দিন উপবাস করে…
তাঁর কামনা পূর্ণ হয়। মায়েরা সেদিন উপোস করতেন, সন্ধেবেলা পাঁচালির কাহিনি শুনতে আমরা বসে যেতাম। বাতাসার সঙ্গে প্রসাদে
থাকত ফল। কোজাগরী পূর্ণিমার দিন পুজো হতো জাঁকজমক করে – শরৎপূর্ণিমা, দেবীপক্ষের শেষ দিন, সে-রাতে চাঁদ যেন আরো সুন্দর। সারাবাড়িতে সে-সন্ধেয় মা-লক্ষ্মীর ‘পা’ আঁকা, জানালা-দরজা সব খোলা, যেদিক দিয়ে খুশি তিনি ভেতরে আসতে পারবেন। পা হবে অন্দরমুখী, ওঁকে আহ্বান করা। সেদিন বাড়ির সব বাতি জ্বালা, বাইরে প্রদীপ। বাইরে-ভেতরে আলপনা। চালের বাটা দিয়ে আলপনা, উজ্জ্বল সাদা রং পুজোর ভাব এনে দেয়। চালের বাটা বেশি ঘন হবে না, আবার জল বেশিও পড়বে না, যে-নরম কাপড়ের সাহায্যে আলপনা দেওয়া হচ্ছে, তা যেন মাটি না ছোঁয়, মাঝের আঙুল দিয়ে আঁকতে হবে। দক্ষতার প্রয়োজন – বাঙালি মেয়ের এমনিতেই এসে যায়, শিখবার প্রয়োজন হয় না।
এদিন ভোগের আয়োজন বিরাট – লুচি, আলুর দম, পাঁচ রকম ফল, হালুয়া, রকমারি ছাঁচে করা সন্দেশ, পায়েস, আর মোয়া-চিড়ে, খই, মুড়ি – আরো যদি কিছু পাওয়া যায়, নারকেলের নাড়–, আর গে-ারিয়ার প্রথায় মুগের জালা।৭
বিশেষ উপোস ছিল শিবরাত্রির। নির্জলা কিনা জানা নেই, তবে সারাদিন উপোস করে সন্ধের পর মা জলভরা ঘট, ফুল, বেলপাতা নিয়ে শিবমন্দিরে যেতেন পুজো দিতে। তারপর খাওয়া – ভাত নয়, রুটি। মা আরো কিছু মানতেন; শিবরাত্রির আগের রাতে আর পরের দিন দুপুরে রুটি খেতেন। একে বলা হতো শিবরাত্রির উপোসে ‘চুনি-পান্না’ করা।
ঘটা করে পুজো করা হতো বলছি, তবে আমাদের বাড়িতে কোনো অনুষ্ঠানে বাইরে থেকে পুরোহিত ডাকা হতো না। সে হাতেখড়ি বা অন্নপ্রাশন। উৎসব মানে নতুন জামা-কাপড়, ফুল, চন্দন, বেলপাতা, তুলসীপাতা, আলপনা, ভাইফোঁটাতে কাজল, পায়েস আর ভোজ; নারকেল দিয়ে ছোলার ডাল, লুচি হলে তো কথাই নেই। মিলের শাড়ির পাড় থেকে সুতোর গুচ্ছ টেনে আমরা চটের আসনে কারুকার্য করা আসন বানাতাম। যার জন্য অনুষ্ঠান, অর্থাৎ জন্মদিন, ভাইফোঁটা, হাতেখড়ি বা কারো কোলে বসে অন্নপ্রাশন, আসন হতো সেদিন তার সিংহাসন। ভাইফোঁটা বিশেষ করে মনে পড়ে। বরিশালে দেয়ালির পর প্রতিপদে ফোঁটা দেওয়া হয়, ভাইয়ের দীর্ঘ জীবনের জন্য প্রার্থনা একটু আলাদাভাবে :
প্রতিপদে দিয়া ফোঁটা,
দ্বিতীয়ায় দিয়া নিতা,
যমুনা দেয় রে যমরে ফোঁটা,
আমি দিই আমার ভাইরে ফোঁটা,
আমার ভাই হোক –
লোহার কাঠি; নিম তিতা।
মামাবাড়িতেও প্রতিপদে ফোঁটা দেওয়া হতো – প্রার্থনার ভাষা ছিল ভিন্ন।
দ্বিতীয়াতে নিতিয়া, প্রতিপদে ফোঁটা,
আইজ অবধি ভাইগণ আমার
যমদুয়ারের কাঁটা।
যমের বইন যমুনা আমি
যমদুয়ারে যাইও না তুমি,
যমদুয়ারে দিয়া কাঁটা
বইন দেয় ভাইরে ফোঁটা,
আমি দিই আমার ভাইরে ফোঁটা
আমার ভাই হউক লোহার কাঠি
নিম তিতা।
দুর্গাপূজা ছিল বছরের সবচেয়ে বড় উৎসব – নতুন জামাকাপড় পরে, ঢাকের ধ্বনি, পুজোর মন্ত্রপাঠ, চ-ীপাঠ শুনতে-শুনতে সবাই একত্র হয়ে পুজো দেখার মতো আনন্দ বছরে কমই আসে। সকালে উপোস করে ভক্তিভরে অঞ্জলি দেবার মতো আনন্দও যেন অন্য কখনো হয় না। এ-দিনগুলোকে গে-ারিয়ার ভাষায় বলা হতো ‘বছরকার দিন’, এসব দিনে সব শুভ-সুষ্ঠুভাবে করতে হয়, ছোটদের কান্না-ঝগড়া বন্ধ। সপ্তমীর দিন বোধহয় কাছে-পিঠে কোথাও যেতাম পুজো দেখতে – প্রতিবছর অষ্টমীর দিন কয়েক পরিবার মিলে যাওয়া হতো রামকৃষ্ণ মিশনে, অষ্টমীতে কুমারী পুজো, আরো ঝলমলে পুজো। সারাদিন ওখানেই কেটে যেত। নবমীর দিন যাওয়া হতো ঢাকেশ্বরী মন্দিরে; যতদূর মনে পড়ে একটি বড় চত্বরে বিরাট প্রতিমা, ডাকের সাজের সাজে তেজস্বিনী মা-দুর্গা, কোথাও যেন কোমলতা ছোঁয়া। লক্ষ্মী, সরস্বতী, গণেশ, কার্তিক – সবার আলাদা ভঙ্গি, আলাদা রূপ। নবমীর দিন পুজো শেষে বাড়ি এসে মন খারাপ হতো, দশমীতে তো মায়েরা বরণ করবেন, মা-দুর্গা ও তাঁর পরিবারকে বলবেন, ‘আসছে বছর, মা, আবার এসো।’ পুজোর কদিন মা-দুর্গা কৈলাস পর্বত ছেড়ে বাপের বাড়ি আসেন, দশমীতে ফিরে যান স্বামীর ঘরে, আসবেন আবার পরের বছর, এই ছিল বিশ্বাস। নবমীর রাতে মা গাইতেন, ‘নবমী নিশি, তুমি ফুরায়েও না’ – নিশি ফুরালেই তো বরণ ও বিদায়, শূন্যতা। গান শুনে চোখে জল আসত, এ ছিল সব মায়ের আর্তনাদ, পুজোশেষে মেয়ে যে চলে যাবে স্বামীর ঘরে!
দুর্গাপূজার আগে শরৎকালে শুরু হয় আগমনী গান। দেবীর আগমনের আনন্দের সঙ্গে ছিল প্রতি মায়ের হৃদয়ে আশা-নিরাশার দোলা। ছোট বয়সে মেয়েদের বিয়ে দিয়ে পাঠিয়ে দিতেন অন্য ঘরে; দুর্গাপুজোয় তাদের আসতে দেওয়া হবে কি? কত মাকে যে নিরাশ হতে হতো। ‘আগমনীতে দুঃখিনী মায়ের অন্তরের কান্নাই শোনা যায়। …পূর্ববঙ্গের শরৎ; ভরা নদী, ভরা খাল-বিল।’ জলপথে ছোট-ছোট নৌকোয় আসা-যাওয়া। ‘সকল সময়েই মায়ের মন কাঁদিয়া মরে দূর প্রবাসিনী কন্যার জন্য। প্রতি কন্যাই যেন গৌরী, সব মাতাই যেন মেনকা। কত নৌকা আসে, কত নৌকা যায় – মায়ের মন ভাবিয়া মরে, এরই কোনো নায়ে যেনবা আমার গৌরী আজ আসিতেছে। হতাশ মায়ের নয়নে শুধু জল ঝরে। বাউল গোলাম মৌলা সেই ব্যথার গান গাহিয়াছেন :
গোলাম মৌলা মোছে নয়ন
কে-বা দিবে ভাও।
কোন নায়ে বা গৌরী আমার
যায় তো কতই নাও।৮

বিয়ের পর স্বামীর কর্মস্থলেই মেয়েদের নতুন বন্ধুত্ব, সম্পর্ক গড়ে ওঠে। মিষ্টিদির মা, জুনোমাসি, ছিলেন মায়ের নিকট বন্ধু। দু-মেয়ে নিয়ে মাসি-মোসা প্রায়ই আসতেন – আড্ডা জমত ভালো, সহজে ভাঙত না। শান্ত মুখশ্রী, জুনোমাসি রকমারি পাড়ের শান্তিপুরি শাড়ি পরা, ৫নং-এর বাগানে বা অন্দরে গল্প করছেন, ছবিটি মনোরম। বিয়ের পর অল্প বয়সে নতুন সংসার মা ও মাসি কাছাকাছি বাড়িতে করেছিলেন – সুবিধে-অসুবিধে ভাগ-বাট করে বহু বছর একসঙ্গে কাটিয়েছেন – সম্পর্কে কোনোদিন ছেদ আসেনি। দেশবিভাগ সম্পর্ক নষ্ট করতে পারে না, যে যেখানে থাকুন, একে অন্যের খবর রেখেছেন, সম্ভব হলে দেখা করেছেন।
১৯৮২-তে মা-বাবা শান্তিনিকেতনে অবসর জীবন কাটাতে গেলেন। শান্তিনিকেতনে মার নিজেকে অত্যন্ত নিঃসঙ্গ মনে হতো। হঠাৎ দেখি হিসাবের খাতায় কাকে-কাকে চিঠি লিখেছেন তার রোজনামচা আছে। তাতে ‘জুনো’কে প্রায়ই চিঠি লেখা হচ্ছে। দশ বছর পর ১৯৯২-তে আমার বাবার মৃত্যুর পর জুনোমাসি মাকে লিখছেন, ‘এ যে কি হারানো কেবল যার যায় সেই জানে। এই দুঃখের কোনো সান্ত¡না নেই। আমি একা হয়েছি আজ কতদিন হলো। তবু আমাদের কম বয়সের সুখস্মৃতি তো ভোলার নয়।’
মায়ের প্রিয় বান্ধবী ছিলেন মীরামাসি, ইংরেজির অধ্যাপক মন্মথ ঘোষের স্ত্রী, পুরানা পল্টনে প্রতিবেশী। মা-মাসিদের মধ্যে উনিই চাকরি করতেন – স্কুলে পড়াতেন। কাজ সেরে প্রায় বিকেলেই উনি মায়ের কাছে আসতেন, সন্ধে হলে ফিরতেন। ওঁদের বাড়িটা ছিল একটু দূরে, পাড়ার সীমানায়, কোণে। মা জিজ্ঞাসা করতেন, ‘মীরা, তোমার ভয়-ডর নাই?’ মীরামাসির সত্যি ভয়-ডর ছিল না, উনি বকুনি দিলে লেঠেলও পালিয়ে যাবে মনে হতো। ওঁর কর্মক্ষমতা ও ধৈর্য ছিল অসাধারণ। যৌথ সংসারের বড় বলে দায়িত্ব ছিল প্রচুর; স্কুলে সারাদিন খাটুনি, বাড়িতে নিজের দুটি ছেলেমেয়ে, শ্বশুর-শাশুড়ি, দেওরের সংসার ও স্বামী নিয়ে বিরাট সংসার। স্বল্প আয়ে সবকিছু সামলানো, বড়দের মন-মেজাজ ঠিক রেখে চলা, আবার কাঁকড়ার ঝোল রান্না করা – এই ছবি আমার চোখে ভাসে। ওঁর কঠিন অবয়বের পেছনে লুকিয়েছিল একটি স্নেহপ্রবণ মানুষ। দিল্লিতে ওঁদের ক্যারলবাগের বাড়িতে গেলেই বলতেন, ‘এই, একটু মাছ খা – টাটকা পাবদা, এই রাঁধলাম।’ বা ‘পায়েস আছে, নে না একটু, তুই তো মিষ্টি ভালোবাসিস, না বলিস না, এতদূর থেকে আসিস।’ ঢাকার স্পর্শ, স্নেহভরা কথা। মন্মথকাকা ও মীরামাসির জন্য আমার মনে একটা বিশেষ জায়গা ছিল, তাই মধ্যবয়সী হয়েও ছুটে যেতাম ওঁদের কাছে, সেই পুরনো স্পর্শ পেতে।
যেদিন স্কুল থেকে অবসর নেন, ক্লাসশেষে বিদায় অনুষ্ঠানের পর ছুটে এসেছিলেন মায়ের কাছে – সামনে হঠাৎ শূন্যতা, এক মাকেই বলতে পারতেন। ততদিনে দায়িত্বের ভার লাঘব হয়েছে, ‘কাজ নেই’ জীবন ওরকম কর্মঠ মানুষের পক্ষে সামনা করা মুশকিল। সৌভাগ্যবশত দেশবিভাগের পরও ঘোষ ও দাশগুপ্ত পরিবার এক শহরে থেকেছেন বহু বছর। জুনোমাসির মতো অল্পবয়সে মা, মীরামাসি পুরানা পল্টনে কাছাকাছি নতুন সংসার শুরু করেছিলেন। মাসির জীবন মসৃণ ছিল না, তবে রোজকার জীবনযুদ্ধ ওঁকে পরাজিত করতে পারেনি।
বিয়ের পর মাকে হাত ধরে সংসার করতে শিখিয়েছিলেন ‘মেজবউদি’, বাবার বন্ধু অধ্যাপক অক্ষয় ঘোষালের স্ত্রী। ওঁর নাম কেউ জানতেন বলে জানি না, কেন মেজবউদি ডাকা হতো তাও জানি না, মা-বাবা দুজনেই এভাবে সম্বোধন করতেন ওঁকে। ১৯২৬ থেকে শুরু করে বহু বছর অক্ষয় জেঠা, বীরেন জেঠা (গাঙ্গুলী, অর্থনীতির অধ্যাপক) আর বাবা বক্সিবাজারে একটি বাড়ি ভাড়া করে থাকতেন। অক্ষয় জেঠা তখন বিবাহিত, তবে পরিবার কলকাতায় থাকত। মেজবউদি মাঝে-মাঝে এসে সংসার সামলে নিতেন। ছোটখাটো, রোগা – প্রায় কাঠির মতো শরীর বলা যায় – মহিলা, ওঁর ঘন কালো চুল ছিল গোড়ালি অবধি লম্বা। গোলাকার খোঁপা এতই বিশাল ছিল যে, মনে হতো খোঁপার ওজন ওঁর থেকে বেশি। মা বলতেন, ‘বেচারি, কোনোদিন বালিশ ব্যবহার করতে পারল না।’ খোঁপার ওজন নিয়ে, কাঠি-কাঠি শরীরে উনি ছিলেন অসম্ভব কর্মঠ। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ, কথা বলার ভঙ্গি ছিল ভিন্ন, আমার খুব ভালো লাগত। বাড়িতে এলেই ওঁর কলকলে বাড়ি ভরে যেত।
তিনি মায়ের বন্ধু ছিলেন না, মা ওঁকে দিদির মতো শ্রদ্ধা করতেন, ভালোবাসতেন। আমার মনে পড়ে, মেজবউদি গল্পের মাঝে বলছেন, ‘ও শান্তি, বড়িটা আরেকটু ভেজে নাও’ বা ‘মাছে আরেকটু নুন-হলুদ দাও’, ‘আচারটা আরো দু’দিন রোদে দিও।’ হিসাব রেখে আয়ের মধ্যে কীভাবে সংসার চালাতে হয় তাও মেজবউদি শিখিয়েছিলেন মাকে। দেশবিভাগে যোগাযোগ বন্ধ হয়নি, দেখাশোনা প্রায়শ হতো। ততদিনে মেজবউদির শিক্ষায় মা গৃহকর্মে নিপুণ, তবে অক্ষয় জেঠার শতচেষ্টাতেও বাবার বিষয়-বুদ্ধি তীক্ষè হলো না; নিজের একটি বাসস্থান হওয়া উচিত তা উপলব্ধি করতে অনেক বছর কেটে গেল। বীরেন জেঠা কোনোদিনই এ-মর্ম বুঝলেন না, বাড়িভাড়া দিতে তাঁর সম্বল উজাড় হলো। ধুতি অল্প উঁচু করে পরা, একটু মোটা কাপড়ের সাদা পাঞ্জাবি, কালো সুতোয় গাঁথা সোনার বোতাম, ছোটখাটো দেখতে অক্ষয় জেঠা, বেতের চেয়ারে বসা, পাশে তাঁর কালো পোর্টম্যান্টো, যেটা ছাড়া উনি কোথাও যেতেন না, ঈষৎ পা দুলিয়ে বাবাকে বলছেন, ‘অমিয়, তুমি বোঝ না, একটি নিজস্ব বাড়ির কত প্রয়োজন’ – এ-ছবিটি আমার সামনে স্পষ্ট। মা-বাবার প্রতি ওঁদের অকপট বন্ধুত্ব-ভালোবাসা সেই ছোট বয়সে আমাকেও স্পর্শ করত। মেজবউদি বা মীরামাসির মতো মহিলাদের কাছে পাওয়া সৌভাগ্য।
মাসি, জেঠি, কাকি – পাড়ার সবাইকে আমার পছন্দ হতো তা নয়। একজনকে কখনো ভুলব না। পুরানা পল্টনে কাছাকাছি গৈলার সম্পর্কে এক জেঠিমা থাকতেন। মেদবহুল শরীর নিয়ে দুপুরে আমাদের বাড়িতে আসতেন। আমার বছরচারেক বয়স হবে, বারান্দায় বসে ক, খ, গ, ঘ লিখতে চেষ্টা করছি; হঠাৎ তিনি এসে তাঁর অনবদ্য ভাষায় বললেন, ‘অ শান্তি, তোমার মাইয়া বাউয়া নাকি?’ বলেই এমন অপকর্ম থেকে রক্ষা করার জন্য, তাঁর বলিষ্ঠ হাতে আমার গালে একটি চড় মারলেন, ‘থাপ্পড় মাইরা তরে ঠিক করুম’ হুমকি দিয়ে। ভবিষ্যদ্বাণী সফল হলো আমি ‘ঠিক’ হয়ে গেলাম, ডান হাতে লিখি।
বলা বাহুল্য, মহিলার ওপর আমার দারুণ আক্রোশ, প্রতিশোধ নেবার অপেক্ষায় রইলাম। কদিন পর এসে বললেন, ‘অ মাইয়া, তর সেফটিপিনটা আমারে দে, কান চুলকাইতাছে।’ আমি চোখ গোল-গোল করে বললাম, ‘দেব না।’ তিনি ভয় দেখিয়ে বললেন, ‘না দিবি তো তরে মাইয়া আমি কিছু দিমু না।’ চট করে জবাব দিলাম, ‘ইস, কবে যেন কিছু দিয়েছ যে ভয় দেখাচ্ছ।’ তিনি আমার অবাধ্যতার জন্য মাকে ভালো-মন্দ কিছু বললেন। মা ‘ছোট জা’, যতই দূরসম্পর্ক হোক, চুপ করে রইলেন।
পাড়াতে ৩নং বাড়িতে থাকতেন মায়ের বন্ধু জ্যোৎস্নাদি। লম্বা, দোহারা চেহারা, কর্মঠ, গুণী মানুষ, মাকে নানা কিছু শেখাতেন। মায়ের থেকে বয়সে বড় ছিলেন, অভিজ্ঞতাও ছিল বেশি। মাকে নানা পরামর্শ দিতেন। সুচিন্তিত হলেও ফল যে ভালো হতো তা নয়। একবার মাকে বোঝালেন, বিবির (অর্থাৎ আমি) চুল অত্যন্ত পাতলা, সাতবার ন্যাড়া করলে চুল ঘন কালো হবে। ব্যস, শুরু হয়ে গেল আমার ন্যাড়া মাথা চেহারা! একটু চুল হলেই মু-ন ব্যবস্থা। এরকম চলতে লাগল বহুদিন। বাবার এক বন্ধুর স্ত্রী ছিলেন মায়ের শুধাদি, তিনিও মায়ের থেকে অনেকটা বড় এবং ভারতবর্ষের নানা শহরে থেকে অভিজ্ঞ। বাবা লাহোর যাবেন কাজে। শুধামাসিমা বহুদিন লাহোরে থেকেছেন, বাবাকে বললেন, ‘লাহোর থেকে উল আনবেন আর আনবেন ফুৎনা (চুলের জন্য ট্যাসল)।’ বাবা রং-বেরঙের ফুৎনা আনলেন – লাভ কী, আমার চুল তো আবার সজারুর কাঁটা। সময়ে চুল লম্বা হলো, তবে সাত মু-নেও কেশ ঘন হলো না। জ্যোৎস্না মাসির প্রতি অভিমান বা রাগ ছিল বইকি, কিন্তু ও-বাড়ির নিমকি-মিষ্টির স্বাদ সব হারিয়ে দিত।
পাড়ায় বিভিন্ন রকমের মানুষ থাকেন, সবার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয় না; দেখি বা তাঁদের কথা শুনি। বেশিরভাগ হাসি-ঠাট্টার। একটি সুন্দর ঘটনা মনে পড়ে। আমাদের অপরিচিত কোনো মেয়ের বিয়ে – পুরানা পল্টনেই একটু দূরে থাকেন ওঁরা। হঠাৎ এক ভরদুপুরে ঢোলকের বাজনা, গান – বেরিয়ে দেখি, মেয়েকে কনের সাজে সাজিয়ে, মহিলারা রং-বেরঙের শাড়ি-গয়না পরে ঢোলক আর গীতের সঙ্গে পুরো পাড়া ঘুরে যাচ্ছেন। কোথাকার এঁরা জানি না; কে জানে, হয়তো এভাবে অনেকের আশীর্বাদ নিতেন। জরিভরা ঝলমলে পোশাক, মেয়েরা ঢোলক বাজাচ্ছেন, আগে কখনো দেখিনি, নতুন অভিজ্ঞতা, ভিন্ন রকমের আনন্দ।
ছোটরা পাড়ার গুজব জড়ো করতে ওস্তাদ – কত গল্প যে শুনেছি। সব তো লেখা যায় না, তবে নানা মজার কথা ছাপিয়ে একটি মনে গেঁথে আছে, সেটা লিপিবদ্ধ করি। এক বিধবা দিদিমা ছিলেন, কাছেই থাকতেন, তাঁর জামাতার অভিজাত বংশ নিয়ে দারুণ গর্ব, দম্ভ বলা উচিত ছিল। অবস্থাপন্ন পরিবার, পোশাক-আশাক, কথাবার্তায় আভিজাত্যের ছাপ দেখা যায়। পাড়ার সবার বন্ধু মানুষ। দিদিমা, জামাতার গর্বে নিজেকে আলাদা রাখেন। এক বিকেলে গিয়েছেন পরিমল কাকার বাড়ি – টেবিলে লুচি-বেগুন ভাজার ভোজ চালু। দিদিমা বলে উঠলেন, ‘তোমাদের বেশ সুবিধে, সবাই পুরো লুচি খেয়ে নিচ্ছে। আমার জামাইবাবাজি তো ফুলকো লুচির ‘টুসকো’টুকু ছাড়া কিছু খান না।’ বাম আর কি, ‘ফুলকো লুচির টুসকো’ হয়ে গেল আমাদের বুলি। মনে হতো ‘টুসকো’ তো কুরকুরে হয়, গলা খসখস করে না?
এই দিদিমা আমার মাকে একটু করুণা করতেন। ওঁর মেয়ে আরামে থাকেন, মা বেচারি তো সারাদিন সংসার নিয়ে ব্যস্ত। যুদ্ধে বাড়ি অধিগ্রহণে ওঁরা, আমরা, সবাই পুরানা পল্টন ছেড়ে যাচ্ছি। আমরা গেলাম ওয়ারী, আশুতোষ সেনের বাড়ির একদিকে। ওঁদের নতুন বাড়ি জানা নেই। দিদিমা অমিতা মাসিকে বললেন, ‘শান্তিদের বেশ, এক ঠেলাগাড়িতে সব জিনিসপত্র এলো আর এক ঘোড়াগাড়িতে ওঁরা সবাই এসে গেল। নিশ্চিন্তি। আমাদের যে কত ব্যবস্থা, কোনোটা যাবে হাতে করে, কোনো জিনিস গাড়িতে কোলে নিয়ে, কিছু মুটের মাথায়, কিছু ঠেলাগাড়ি আর রিকশায়। অন্তত চারদিন লাগবে। শান্তির কত সুবিধে।’ অমিতা মাসির কাছে এ-গল্প শুনেছি, তবে তাতে এই দিদিমার প্রতি কখনো রাগ হয়নি। ‘টুসকো’র মতো কথা শিখতে পেরেছি, আর কী চাই। যাঁদের নিয়ে দিদিমা বড়াই করে কথা বলতেন তাঁরা কিন্তু ঘুণাক্ষরেও জানতেন না এসব কথা, অত্যন্ত ভালো মানুষ ছিলেন। তখন হেসে উড়িয়ে দিলেও আমার মনে নিশ্চয়ই দাগ কেটেছিল, তাই আজো মনে আছে সম্বলহীন শান্তিদের পুরানা পল্টন থেকে ওয়ারীর অভিযান।
কৃষ্ণাদের ‘পরম ভবন’, মিষ্টিদিদের ‘পল্টন ভিলা’ বা মীরামাসিদের বাড়ি ছিল ক’রাস্তা পেরিয়ে। গুজরাটিতে কথা আছে, ‘পহলা সা¹ো পাড়সি’, অর্থাৎ ‘প্রথম আত্মীয় প্রতিবেশী’। ৫নং পুরানা পল্টনের প্রতিবেশীরা আত্মীয়ের মতোই ছিলেন। আমাদের বাড়ির সামনের রাস্তা ডানদিকে যেখানে একটু বাঁক নিয়েছে, সেখানে ছিল জ্যোৎস্নামাসিদের ৩নং বাড়ি। মেসোকে বেশি দেখিনি, প্রায়ই ট্যুরে থাকতেন, ওঁদের মেয়ে অঞ্জুদি অনেক বড়, বোধহয় কলেজে পড়তেন – মাঝেমধ্যে আসতেন বাগান দেখতে। ছোট ভাই তিলক, আমার ভাইয়ের সমান – ওদের তখনো খেলা করার বয়স হয়নি। ভাই যতীনদার ঘাড়ে আর তিলক তার ‘যতীনদার’ ঘাড়ে একসঙ্গে বেড়াতে যেত। জ্যোৎস্নামাসি আসতেন দিনে অন্তত একবার। খুব লম্বা, আধঘোমটা দেওয়া, দশ হাত শাড়ি পরতে অসুবিধে হতো। রান্নাঘরের দাওয়ায় বসে মার সঙ্গে গল্প করতেন। ব্যস্ত মানুষ, কখনো বেশিক্ষণ থাকতে পারতেন না।
আমি ওঁদের বাড়িতে প্রায়ই ঢুকে যেতাম, সেই নিমকি-মিষ্টির লোভে। কিঞ্চিৎ গোলাকার বাড়ি, মেঝে থেকে শুরু হয়ে হালকা নীল রঙের লম্বা কাঠের জানালা, অর্ধচন্দ্র আকারে বাড়িতে যাওয়ার সিঁড়ি, বারান্দা, বড়-বড় ঘর। সামনে খোলা জমি। অন্যান্য বাড়ি থেকে ধাঁচ আলাদা, আমার এ-বাড়ি খুব সুন্দর মনে হতো। একবার এখানে একটি অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হয়েছিল। যথারীতি না বলেকয়ে বাড়িতে ঢুকে পড়েছি – বাড়িভরা অতিথি, একটু এলোমেলো ব্যাপার। কোনো এক ঘরে ছোটরা খেলা-গল্প করছে – বিনাদ্বিধায় ঢুকে পড়লাম। একটি ছেলে, বছর ১২-১৩ হবে, ভাবলেশহীন মুখে লম্বা দড়ি নিয়ে স্কিপিং রোপের মতো লাফ দিচ্ছে। হঠাৎ দেখি ঘর খালি, সবাই অন্য কোথাও চলে গিয়েছে। ছেলেটি লাফ দিয়ে চলেছে, তার মাঝে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তোমার বাবা কি বিলাত্ফেরত (ত, ফ যুক্তাক্ষর করে)?’ বারতিনেক জিজ্ঞাসা করার পর প্রশ্ন বুঝতে পেরে বললাম, ‘হ্যাঁ।’ ছেলেটি কিছু না বলে আগের মতো ভাবলেশহীন মুখে চলে গেল। প্রশ্নের তাৎপর্য না বুঝে আমি কি রকম ভয় পেয়ে দৌড়ে বাড়ি চলে গেলাম। হয়তো সরলমনে সে প্রশ্ন করেছিল, আচমকা ‘যুক্তাক্ষর’ শুনে ভয় পেয়েছিলাম। প্রশ্ন বা ভয় পাওয়া, কোনোটারই কারণ বুঝে উঠতে পারিনি। এবাড়ি-ওবাড়ি ছোটরা ঢুকে যেতাম মানে এই নয়, আমরা শাসনের মধ্যে থাকিনি। সবকিছুর নির্দিষ্ট সময় ছিল – তা ভাঙা যেত না।
৪নং-এ থাকতেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানের কোনো বিষয়ের অধ্যাপক সত্যপ্রসাদ রায়চৌধুরী। শান্তিপ্রিয় মানুষ, নিজের মনে থাকতেন। ওঁর একটি রেডিও ছিল, বাবা যেতেন ও বাড়িতে দিলীপ রায়ের গান শুনতে। ১৯৪৩-এ তিনি বিয়ে করে নিয়ে এলেন ছোটখাটো সুন্দরী কাকিমাকে। দু-বাড়ির মাঝে কাঁটাতারের বেড়া – কাকিমা তাঁর দিকে, মা এদিকে, কত সকাল-বিকেল দাঁড়িয়ে গল্প করতেন, কাকিমা ঘর-সংসার, রান্নাবাড়ি নিয়ে প্রশ্ন করতেন। সেই শীতকালে মনে পড়ে কাকিমার ছবি, গল্প করছেন আর উল বুনে চলেছেন।
কাকিমা বিয়ের পর কলকাতা থেকে সঙ্গে নিয়ে এলেন ভাশুরপো মেধোকে। মেধোদা সেন্ট গ্রেগরিতে, দাদার থেকে দু-ক্লাস উঁচুতে। গাঢ় বন্ধুত্ব হলো। স্কুলের পর বাড়ি ফিরে একটু পরই কাঁটাতারের বেড়া লাফ দিয়ে ডিঙিয়ে টুক করে এসে যেতেন মেধোদা ৫নং-এ। কোনোদিন গেট দিয়ে আসতেন না। লম্বা চেহারা, হাতে সবসময় বই। বারান্দা থেকে ডাকতেন, ‘কাকিমা’, অর্থাৎ মা, অমনি মা শুরু করতেন, ‘কে, মেধো, আয় আয় – কী খাবি বল?’ ৪নং-এ তার নিজের কাকিমা যতই যতœ করুন না কেন, মেধোদা এই কাকিমার আদর-যতœ সানন্দে গ্রহণ করতেন। তারপর দাদাতে, মেধোদাতে ছুট মাঠে – ফুটবল খেলতে। মা মেধোদাকে বাড়ির ছেলের মতোই দেখতেন। একবার কোনো অতিথি বাড়িতে দুটি ছেলেকে দেখে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘ওইটি তো সমীর, অন্যটি কে?’ মা অবাক, এ আবার জিজ্ঞাসা করবার কথা নাকি, সজোরে বললেন, ‘ও তো মেধো, পাশের বাড়িতে থাকে – এ-বাড়ির ছেলের মতো।’ অর্থাৎ আমাদের দু-বাড়িতে ভেদাভেদ নেই। আপন করে নেবার অসীম ক্ষমতা ছিল মায়ের, বোধহয় বাংলার সব মায়ের মধ্যে এটা আছে।
রাস্তার উলটোদিকের কোণে থাকতেন পূর্ণদাজেঠা। এঁর পুরো নাম জানি না। তিনি ‘বোটানির’ অধ্যাপক ছিলেন। অকৃতদার, মধ্যবয়সী, মাথায় চুল বিরল না হলেও সংখ্যা কম, একটু উঁচু সাদা পাজামা আর গেরুয়া জাতীয় রঙের পাঞ্জাবি পরে হঠাৎ করে চলে আসতেন। ‘আসুন, আসুন, পূর্ণদা’ বলে মা ওকে বসিয়ে গল্প করতেন। কোথা থেকে
চা-জলখাবার উদয় হতো জানি না। মা ওঁকে খুব শ্রদ্ধা করতেন, ‘পূর্ণদার মতো মানুষ কম দেখা যায়’, প্রায়ই বলেছেন আমাদের। গাছপালা ছিল পূর্ণদাজেঠার জীবন। কাউকে কাছে পেলেই গাছের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবার চেষ্টা করতেন। অনেকে ঠাট্টা-মশকরা করতেন; দুঃখের কথা, প্রকৃতিকে ভালোবাসতে যদি তখন থেকে আমরা শিখতাম, আজ
পৃথিবীর অবস্থা হয়তো এত অসহায় হতো না।
৫নং-এর উলটোদিকে ছিল বোস বাড়ি। যৌথ পরিবার – দুই বোন মনিদি আর মিনুদিকে মনে পড়ে, দিনের মধ্যে কতবার এবাড়ি-ওবাড়ি যাওয়া-আসা হতো। পুরানা পল্টনে আমরা কত আনন্দে এক পরিবারের মতো কাটিয়েছি, হৃদ্যতা, নৈকট্য কত পোক্ত ছিল, তা মিনুদির চিঠি থেকে বোঝা যায়। ১৯৯২-এর জানুয়ারির ১৪ তারিখে আমার বাবা মারা যাওয়ার পর ১৭ তারিখে মাকে মিনুদি লিখছেন :
‘অমিয়দার মৃত্যু সংবাদ পড়ে ভাবছিলাম আপনজনেরা একে একে আমাদের ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। ছোটবেলার কথা মনে পড়ে। কত ছুটে ছুটে তোমাদের বাড়িতে গেছি, কত দুষ্টুমি করেছি। তারপর পাকিস্তান হওয়ার পর কে কোথায় হারিয়ে গেলাম। তোমার মনে আছে কিনা জানি না, মার কাশীতে আসার খবর পেয়ে অমিয়দা নিজে এসে আমাকে আর মাকে তোমাদের বাড়িতে নিয়ে গেলেন। এরকম কত স্মৃতি মনে ভেসে আসছে।… সর্বদা আমার ঢাকার ছোটবেলার কথা মনে পড়ে ও তোমাদের মুখগুলো ভেসে ওঠে। কত আদর, কত ভালোবাসা তোমাদের কাছে পেয়েছি।’
আমাকে লেখা পরিমল কাকার এক ছড়ার কিছু পঙ্ক্তি থেকে এই আপনজন সম্পর্কের আন্দাজ পাওয়া যায়।
ছিল পাশাপাশি বাড়ি,
অথবা মাঠের পাড়ি,
ব্যবধান নহেক অধিক,
কাদের বাড়ির ও যে
অপরে কেমনে বোঝে
আমরাই বুঝি নাই ঠিক।৯

বাইরের কেনাকাটার কাজ বাবা-কাকারাই করতেন। বিশেষ প্রয়োজন হলে হয়তো ঢাকেশ্বরী বস্ত্রালয়ে যাওয়া হতো – এর বেশি নয়। মায়েরা পর্দানশিন ছিলেন না, তবে একা-একা বা মহিলারা দলবেঁধে কোথাও যাবেন, সে-প্রথাও ছিল না। প্রধান কারণ যানবাহনের অসুবিধে, কেউ গিয়ে ঘোড়াগাড়ি ঠিক করে নিয়ে আসবেন, তবেই তো বাইরে যাওয়া। বাবা-কাকাদের পক্ষে নবাবপুর জাতীয় জায়গায় যাওয়ার সুবিধে বেশি ছিল, তাই এ-ব্যবস্থা। আমাদের জুতো কেনা এতে একটু কষ্টসাধ্য হতো – বার দু-তিন বদলেও আনতে হতো কোনো-কোনো সময়। সাদা ফুলস্ক্যাপ কাগজে পায়ের পাতার মাপ এঁকে দিতাম, তা মিলিয়ে বাটার দোকান থেকে বাবা জুতো নিয়ে আসতেন। কী সুন্দর চামড়ার বুট, ওপরে প্রজাপতি ক্লিপ বা ট্যাসলের মতো চামড়া দিয়ে তৈরি সাজ। কাগজে পা দেওয়া অন্যায়, দেবী সরস্বতীর প্রতীকের ওপর পা রাখা; উপায় ছিল না, ছাপ আঁকা হয়ে গেলে কাগজকে প্রণাম করে নিতাম। প্রশ্ন হতে পারে আমাদের নিজেদের পছন্দ-অপছন্দ কি ছিল না? সত্যি তো – ওসব কথা ভাবতে শিখিনি ছোটবেলায়, বাবার পছন্দের জুতো আর মায়ের পছন্দের ফ্রক ছিল আমাদের পরিধান। ভালো-মন্দের কথা নয় – সে-সময় এটাই ছিল স্বাভাবিক। এতে আমাদের ভাবনা-চিন্তা, সৌন্দর্যবোধ, নিজস্ব রুচি বা ব্যক্তিত্ব প্রকাশ পেতে বাধা পেয়েছে বলে মনে হয় না।
জুতোর মাপের কথায় মনে হলো ফুলস্ক্যাপ কাগজ ছাড়া চলত না। শুধুই কি মাপ, মাসের হিসাবের খাতা, ধোপার হিসাবের খাতা, ছোটদের লেখা শেখা, স্কুলের হোমওয়ার্ক লেখা, শিক্ষকদের গবেষণার ফল, এই কাগজজুড়েই সব খাতা বানানো হতো। হিসাবের খাতা বানাবার একটা বিশেষ ধরন ছিল। খাতা হবে সরু ও লম্বা সাড়ে র্র্৪-১র্৪র্ । সেভাবে কাগজ ভাঁজ করে মাঝে পোক্ত সেলাই করে দিলে হতো মনের মতো খাতা। এই পদ্ধতি বা আকারের ব্যতিক্রম আমাদের বাড়িতে কখনো হয়নি, দীর্ঘ ১৯৩৪ থেকে ১৯৮৫ অবধি নিশ্চয়ই নয়। আমার কাছে মায়ের প্রায় সব হিসাবের খাতা সুরক্ষিত আছে।
আমার মা লেখিকা ছিলেন না; লেখিকা হবার কোনো ইচ্ছে ছিল, তাও মনে হয় না। কিন্তু উনি লিখতে ভালোবাসতেন। নানা ডায়েরিতে টুকরো-টুকরো দিনপঞ্জি আছে, যেমন কোথায় বেড়াতে গেলেন, কে দেখা করতে এসেছিলেন, কারা চা খেতে এলেন, কে টেলিফোন করলেন ইত্যাদি – নিজের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা, অনুভূতির কথা। অনেকটাই আছে তাঁর ভ্রমণ সম্বন্ধে, সে কাশী শহরের সরু গলিই হোক বা তাজমহল, বুডাপেস্ট হোক। পরে কোনোদিন পড়তে ভালো লাগবে বা পরের প্রজন্ম জানতে পারবে আমার মা-বাবার জীবন সম্বন্ধে, অন্তত কিছুটা – হয়তো এটাও ছিল লেখার কারণ। এই অভ্যেস তাঁর শেষ জীবন অবধি ছিল। আশি-পঁচাশি বছর বয়সেও লিখছেন, ‘বিবি টেলিফোনে জানিয়েছে যে সে কাল সন্ধের প্লেনে বরোদা ফিরবে’, কিংবা ভাইয়ের কাছে বিলেতে গেলে, ‘নাদিনের (মায়ের পুরনো বন্ধু) বাড়ি গেলাম চা খেতে।’
এসব লেখা মাঝেমধ্যে হলেও, একটা খাতা তাঁর দৈনন্দিন ব্যবহারের ছিল, নিত্যসঙ্গীর মতো – তাঁর হিসাবের খাতা। দীর্ঘ বিবাহিত জীবনের, প্রায় ছয় দশক, অন্তত পঞ্চাশ বছরের হিসাবের খাতা তিনি রেখে গিয়েছেন। ছোটবেলায় মনে পড়ে শেষবেলায়, সন্ধেবাতি দেবার আগে, পেছনের বারান্দায় মোড়াতে বসে মা দৈনিক হিসাব লিখছেন। খুঁটিনাটি, বড়-ছোট সব খরচই তাতে আছে, যেমন ১৯৩৭-এর ১৩ জুলাই ‘রজনীকে ঝিনুকবাটির জন্য ৬ টাকা ৪ আনা।’ রজনী কে জানি না, হয়তো কোনো সামাজিক দায়িত্ব। খুচরো পাওনা, বড় পাওনা বিশেষ করে লেখা :
তারিখ ১২ আগস্ট –
১. ঘিওয়ালার পাওনা-১ টাকা ৫ আনা, ১২ই আগস্ট তারিখে
২. দুধওয়ালির জুলাইর পাওনা ১ টাকা ৪ আনা।
৩. ৩১ জুলাই : পর্দার কাপড়, টেবিল ক্লথ ইত্যাদির জন্য ঢাকেশ্বরী বস্ত্রালয় হইতে ৮ টাকা ১৫ পয়সার কাপড় আনা হয় – দাম বাকি। আগের পাওনাসমেত মোট বাকি – ১৭/১০।
স্বল্প আয়ে শুধু ঢাকার সংসার নয়, বরিশালের বড় ভাইয়ের সংসারে প্রতি মাসে টাকা পাঠিয়ে, হিসাব মেলানো সহজ ছিল না, সহজ নয় বলেই এ-কাজে অবহেলা করা যেত না।
আমরা যখন একটু বড় হয়েছি, সংসারে টানাটানি কম হয়েছে, ভাই মাকে বলত, ‘হিসেব লেখা তো একটা অভ্যেস তোমার, গোঁজামিল দিয়ে গরমিল মেলাও।’ মা রুষ্ট হতেন না, মালির মাইনে বা দুধের দাম ক্রমশ বেড়ে চলেছে, হিসাব লেখার প্রয়োজন শেষ হতে দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর লেগেছে।
১৯৩৭-এর হিসাবের খাতায় দু-একটি জিনিস লক্ষণীয়। মধ্যবিত্ত পরিবারে আয়ের মধ্যে পারিবারিক ও সামাজিক দায়িত্ব পূরণ করা সহজ নয়। হিসাবের খাতায় আছে, ‘সুন্দর দিদির তহবিল’, অর্থাৎ আমার পিসিমার নামে তহবিল। এতে কোনো মাসে রাখা হতো পাঁচ টাকা, আবার কোনো মাসে কিছু নেই। এই তহবিল থেকে মাঝে মাঝে ধার নেওয়া হতো, আবার সেটা শোধ দেওয়া হতো। পিসিমা অবস্থাপন্ন ছিলেন, তাঁকে টাকা পাঠাবার প্রয়োজন ছিল না। মনে হয় এভাবে টাকা বাঁচিয়ে পুজোতে দিদি-জামাইবাবুকে ভালো শাড়ি-ধুতি দিতে পারতেন। পুজোতে নিজেদের জন্য কিছু কেনা হিসাবের খাতায় নেই, আমাদেরও মনে পড়ে না। এটা অভ্যেসের মতো হয়ে গিয়েছিল, পরে যখন কেনা সম্ভব ছিল, তখনো নিজেদের ওপর খরচ বিশেষ করতেন না। জিজ্ঞেস করলে মা বলতেন, ‘ওই তো হইল; অমুকে দিলো, তুই দিলি, আছে তো নতুন শাড়ি, আবার কি?’ ১৯৮২ প্রথম দেখছি নিজেদের জন্য কিছু; ‘পুজোর তহবিল থেকে প্রোঃ রাখলেন ১০০ টাকা – তা থেকে সাতটি গোলাপের চারা কেনা হলো (৫১ টাকা ৪০ পয়সা), বাকিটা দিয়ে লংগ ক্লথ।’ বাবার শৌখিনতা চিরকাল রয়ে গেল গোলাপ চন্দ্রমল্লিকার কুঁড়িতে।
১৯৩৭-এর অন্য উল্লেখযোগ্য হিসাব আমার সেজ জেঠিমাকে ঘিরে। তাঁর ছেলে সমীরের জামা, জুতো, বই, চুল ছাঁটা, সব খরচ লেখা; মেজমার নিজের ব্যবহারের শাড়ি বা জামা-কাপড়, মায়ের সংসার খরচের হিসাবে উল্লেখ করা। আবার আছে, ‘সেজদির কাছ থেকে ধার ৫ টাকা।’ ক’মাস পর, ‘সেজদির ধার শোধ ৫ টাকা।’ সেজমা ঠিক অসহায় ছিলেন না। তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে দেওর-জায়ের কাছে একনাগাড়ে দীর্ঘদিন থাকতেন, কিন্তু ধার, ধারই – শোধ দিতে হয়।
১৯৩৭-এ সত্যিকারের ধার থাকত ঢাকেশ্বরী বস্ত্রালয়ে – নতুন সংসার, নানাবিধ জিনিস, লেপ, তোশক, ওয়াড়ের কাপড়, মশারি, কত কিছুর প্রয়োজন। প্রতি মাসেই ধার থাকত। ১৯৩৭-এর পর এটা দেখছি না।
এ বছর ১লা মার্চ মা লিখছেন, ‘ঢাকেশ্বরী বস্ত্রালয়ের পূর্ব-বাকি ২২ টাকার মধ্যে ১০ টাকা ১লা মার্চ দেওয়া হইল, বাকি ১২ টাকা এবং উক্ত তারিখে নেটের মশারির কাপড়ের দাম সম্পূর্ণ বাকি রইল। মশারির বাকি ১১ টাকা ৮ আনা ১৫ পয়সা।’ দু-মাস পর ধার শোধ হয়ে যায়। সবই প্রয়োজনীয় জিনিস। ঢাকেশ্বরী থেকে আনা ‘অপ্রয়োজনীয়’ জিনিস মায়ের ‘করিয়াল শাড়ি – ১৯ টাকা, ২০ সেপ্টেম্বর ১৯৩৭’। বিয়েতে পাওয়া করিয়াল শাড়ি বড় জাকে দিতে হয়েছিল শুনেছি, দুর্গাপূজা সামনে, তাই এটা বাবা কিনে দিয়েছিলেন। ননদ পুঁটুলি ও নমস্কারি শাড়ি দেওয়া হলেও বড় জায়েরা, ননদরা দু-একখানি শাড়ি নিয়ে নিতেন। ১৯৭১-এ এই প্রথা দেখেছি গুজরাটে – সেখানে
ননদ-পুঁটুলি নেই, তবে নববধূর ট্রাঙ্ক থেকে একটি শাড়ি ননদ নিতে পারেন। শুধু একটি। লটারির মতো করে ঠিক হতো কোন ননদের অধিকার এটা। যতই শাঁখ বাজুক, উলুধ্বনি হোক, নববধূর আগমন খুব মসৃণ হতো না আমাদের সমাজে।
আরেক হিসেব ছিল সাপ্তাহিক – ধোপার কাপড়, কী এলো, কী যাবে তা লেখা। ওই মোড়ায় বসেই লেখা। আমাদের ধোপার নাম ছিল খগেন; আমার ধারণা ছিল খগেন মানেই ধোপা। একবার খগেনের আসতে কদিন দেরি হয়েছে, আমি পাড়া বেড়িয়ে এসে মাকে বললাম, ‘দেখ, ওদের বাড়ির খগেন তো আজ এসেছে, আমাদের বাড়ির খগেন কেন এলো না?’ ধোপার খরচ অপেক্ষাকৃত বেশি ছিল, ১৯৩৭-এর সেপ্টেম্বর মাসে লেখা, ‘ধোপা ১১ টাকা।’ খগেনের ঘাড়ে করে আনা বস্তাটা কখনো হালকা হতো না, ১১ টাকা নিশ্চয়ই ন্যায্য ছিল। কাপড় নেওয়া-দেওয়ার ব্যাপারে খগেন নিয়মিত ছিল না, প্রায়ই বচসা হতো। খগেনের একই জবাব, ‘কী করুম, ঠাইরেন।’
প্রতি মাসে হিসাব শুরু হয় ভিন্নভাবে – শুধু আমদানি ও খরচ নয়। আমার এক মামা, সুবোধ সেন, বাবার নিকট বন্ধু, ‘টি সেন্টার’ চালাতেন; মাইনে এলে, প্রাথমিক খরচটা হাতে রেখে বাকিটা জমা রাখা হতো সুবোধ মামার কাছে। যখন যেমন প্রয়োজন ওঁর কাছ থেকে নেওয়া হতো। মাসের শেষে কোনো সময় কয়েকটি টাকা জমা থাকত, আবার কোনো মাসে একটু বাকি। এ-ব্যবস্থা কেন, বুঝতে সময় লেগেছে। ব্যাংকের ঝামেলা থেকে রেহাই পেতেন বাবা, বাড়তি টাকার প্রয়োজন হলে চিন্তা থাকত না। আর সুবোধমামা ব্যবসা করতেন, কাঁচা টাকার প্রয়োজন হতো, বাবার মাইনের যতটুকুই হাতে থাকত, কাজে লাগত। এমন বিশ্বাস, সুদহারা অলিখিত দেনা-পাওনার উদাহরণ আর দেখিনি।
মাসকাবারে হিসাব মেলানো প্রায় বাড়িতেই ছিল পীড়াদায়ক। তা সত্ত্বেও দুই ব্যাপারে কার্পণ্য ছিল না – আতিথেয়তা ও খাওয়া-দাওয়ায়। ঢাকার অপর নাম ‘আতিথেয়তা, খাতিরদারি’ – আজো এর পরিবর্তন হয়নি। ভরা বাড়ি, ভরা টেবিল মা ভালোবাসতেন লিখেছি; বাবা ছিলেন বন্ধুবৎসল মানুষ। যেমন একাগ্রভাবে অধ্যাপনা ও গবেষণার কাজ করতেন, বাগান করতেন, তেমনি উদ্যম নিয়ে আড্ডা দিতে পারতেন। বাড়িতে সান্ধ্য-আড্ডা নিয়মিত চলত – বক্সিবাজার, পুরানা পল্টন, ওয়ারী, দিল্লি বা শান্তিনিকেতন। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকরা বা অর্থনীতিবিদরা বাবার বন্ধু ছিলেন, বলা বাহুল্য, তবে বাবার বন্ধুত্ব এঁদের মধ্যে আবদ্ধ ছিল না; শুধুই সমবয়সীদের সঙ্গে বন্ধুত্ব ছিল, তাও নয়। বাবার বন্ধুমহল ছিল যেন খোলা আকাশ – বিভিন্ন জগৎ থেকে তাঁরা আসতেন। জ্যোতির্ময় রায়, নামী লেখক ও চলচ্চিত্র-পরিচালক; সুধীশ ঘটক – ফটোগ্রাফিতে মার্গ প্রদর্শক; শচীন চৌধুরী, অর্থনীতিবিদ হলেও তিরিশ-চল্লিশের দশকে বহুকাল বোম্বাইয়ে নিউ থিয়েটার্সের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট; কবিবন্ধুদ্বয় বুদ্ধদেব বসু ও অজিত দত্ত, কলকাতায় থিয়েটারের মঞ্চে অভিনেতা, রামকৃষ্ণ রায়চৌধুরী, সুধীর সেন, যিনি এক সময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেক্রেটারি ছিলেন; এঁদের সঙ্গে দেখা হতো কলকাতায় কারো বাড়িতে বা হ্যারিসন রোডের কোনো মেসবাড়িতে, যেখানে শচীনকাকা থাকতেন। মাঝেমধ্যে এঁদের কেউ ঢাকা এলে, জড়ো হতেন বাবার বাসস্থানে।
সবাইকে আমার মনে নেই, তবে কয়েকজনের কথা বিশেষভাবে মনে পড়ে। রামকৃষ্ণ বাবুকে ভুলতে পারি না কারণ ওঁর সঙ্গে আমার প্রথম থিয়েটার দেখা জুড়ে আছে। জ্যোতির্ময় রায়ের হাসি, ব্যক্তিত্ব ভোলার নয়। প্রথম যখন দেখি ঠিক তার আগে বাবা ওঁর লেখা পদ্মনাভ পড়ছিলেন; বইয়ের নাম ও লেখকের উজ্জ্বল চেহারা দুটিই ভালো লেগেছিল। সদাশিব কাকা (সেনগুপ্ত) লন্ডনের বন্ধু, কলকাতায় ওহফরধহ ঝঃধঃরংঃরপধষ ওহংঃরঃঁঃব-এ শুরু থেকে কাজ করতেন – যখন কলকাতায় কোনো পাড়ায় দুটি ঘরে প্রশান্ত মহলানবীশ ইনস্টিটিউট আরম্ভ করেন তখন থেকে। বাড়ি ছিল ঢাকায়। প্রায়ই আসতেন। এ-রকম নম্র, স্নেহপ্রবণ, রসিক, সৎমানুষ কম দেখেছি। স্যুটপরিহিত ছাড়া কখনো দেখিনি, কিন্তু ছিলেন খাঁটি বাঙালি, বাঙালও বলা যেতে পারে। রুগ্ণ মানুষ, এলেই মা বলতেন, ‘বেচারা, চিরটাকাল দুধ-ভাত খাইয়া রইল আলসারের লই¹া। একটু খাওয়াইয়াও সুখ পাইলাম না।’ মা-মাসিরা কেউ অন্দরমহলে থাকতেন না তো, তাই বাবার সব বন্ধুর সঙ্গে মায়েরও হৃদ্যতা ছিল। চমক দিয়ে বজ্র আওয়াজে হঠাৎ উপস্থিত হতেন লম্বা-বলিষ্ঠ চেহারার ‘ভিম-ভ্যাট’, যেন একটি নাট্যমুহূর্ত। ওঁকে এই নামেই সবাই ডাকতেন, আসল নাম বোধহয় ছিল বিমল ভট্টাচার্য্য – এ-নাম ওঁকে মানাতো না। কোনো সময় আসতেন একটি বিশাল অ্যালসেশিয়ান কুকুর নিয়ে, ভয়ে পালিয়ে যেতাম। কুকুর কিন্তু শান্ত ছিল। টুঁ-শব্দটি করত না। ভিম-ভ্যাট এলে মনে হতো বাড়ির সব কোনা থেকে হাসি-হট্টগোল-আনন্দ ভেসে আসছে। উনি বীরেন জেঠারও খুব বন্ধু ছিলেন। শেষ জীবনে বোধহয় কোনো ব্যর্থতা বা বিশ্বাসঘাতকতা ওঁকে আঘাত করেছিল। বীরেন জেঠার স্ত্রী, ঊষা জেঠিমাকে লিখেছিলেন, ‘আমি মানুষের সঙ্গ ত্যাগ করেছি, কুকুর অনেক ভালো – বিশ্বাসে ঘা দেয় না।’ ভীমরতি না সত্যের উপলব্ধি জানি না।
এক কাকাকে বিশেষভাবে মনে পড়ে, অলন্দা কাকা, ছেলেবেলায় পুরো নাম উচ্চারণ করতে না পেরে বলেছিলাম ‘অলন্দা’ – সেই থেকে আমি অলন্দা, উনি অলন্দা কাকা। আমার ভাই, আমার স্বামী – সবাই ওঁকে এ-নামেই ডাকতেন। গালভরা হাসি নিয়ে উচ্চৈঃস্বরে ‘বৌদি’ বলে ঢুকতেন অরুণ মুখার্জি, আমার অলন্দা কাকা ও ওঁর স্ত্রী, গীতা কাকিমা। প্রথমে ও.ঈ.ঝ., পরে ব্যারিস্টার ও ভারতবর্ষে সুপ্রিম কোর্টের জজ, শুরুতে দর্শনের ছাত্র, ওঁর মেধা ছিল তীক্ষè। একদিকে হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয়সংগীত, অন্যদিকে নবদ্বীপের নব্য-ন্যায়, দু-বিষয়েই ওঁর পা-িত্য ছিল গভীর। ওঁর জ্ঞান ও অনুশীলনশক্তি-পরবর্তী জীবনে আমাকে অবাক করে দিয়েছে। প্রতিভাবান মানুষটি। জমিয়ে আড্ডা দিতেন, আমাকে পরে বন্ধুর মতোই দেখতেন। শুনেছি, ওঁদের বিয়েতে যখন আমি খুবই ছোট, বায়না ধরেছিলাম কাকার কাছে থাকব। পুরো বিয়ের অনুষ্ঠান ওঁর কোলে বসেছিলাম। শান্ত হয়ে বসলেও একে শান্ত বলা যায় না।
হঠাৎ করে ৫নং এসে যেতেন প্রোঃ সত্যেন বোস, কিঞ্চিৎ উচ্চৈঃস্বরে বলতেন, ‘কোথায়? তোরা কে কোথায় আছিস?’ ঘোমটা টেনে মা অমনি এসে পড়তেন বসার ঘরে। অসুস্থ হওয়া অবধি ঠিক এভাবেই আসতেন কাশী বা দিল্লির বাড়িতে।
বন্ধুদের সঙ্গে বাবার কী রকম আত্মিক বন্ধন ছিল তার একটি উদাহরণ দিচ্ছি। কলকাতায় ইংরেজির অধ্যাপক, কালিপদ ব্যানার্জি ছিলেন সুবোধ মামা ও বাবার নিকট-বন্ধু। বাবার কাছে ওঁর মাস্টারমশায় লাওনেল রবিন্সের লেখা ঞযব ঘধঃঁৎব ধহফ ঝরমহরভরপধহপব ড়ভ ঊপড়হড়সরপ ঝপরবহপব বইটির দুটি কপি ছিল। একবার আমি একটি কপি নিয়ে চলে আসছি, বাবা বললেন, ‘এ বইটা তুই নিস না, অন্য কপিটা নে।’ অবাক হয়ে ‘কেন’ জিজ্ঞেস করার আগেই বললেন, ‘যেটা তোর কাছে, তাতে কালিপদ ব্যানার্জির হাতে আমার নামটা লেখা আছে। কালিপদ তো নেই, বইতে অন্তত ওর হাতের লেখাটা তো দেখতে পাব।’
আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, ছাত্রছাত্রীতে ভরা থাকত আমাদের বাড়ি। খাবার টেবিলে শুধু আমরা পাঁচজন এটা কমই হতো। আমার ভাই লিখেছে, ‘আমরা বড় হয়েছি আমাদের মা-বাবাকে ভাগ করে কারণ বাড়িতে সবসময় আরো দাদা-দিদি, কাকা-কাকি অনেকেই থাকতেন; আর মনে পড়ে বাবার প্রাণখোলা হাসি। আড্ডা, আলোচনা, শোরগোল, অট্টহাসিতে ভরা থাকত আমাদের বাড়ি।’১০ অবারিত দ্বার বাড়িতে বড় হয়েছি আমরা। ‘অবারিত দ্বার’ এ-বাড়িতে কেন স্বাভাবিক পরিবেশ ছিল তা আমার মা-বাবা সম্বন্ধে নবনীতা দেব সেনের লেখাতে স্পষ্ট হয়ে আসে।
‘অবিকল মায়ের স্নেহের স্বাদ পেয়েছিলাম [মাসিমার] কাছে, [এক] প্রবল স্নেহের আশ্রয়।… শান্তিনিকেতনের বাড়িতে যখনই গেছি, আদর-যতেœ ভরে দিয়েছেন। মাসিমা স্বভাবত অতিথিবৎসল, রান্না করে খাওয়াতে ভালোবাসতেন। … মেসোমশাই শান্তিনিকেতনে গল্প করতে সময় পেতেন। নানা বিষয়ে আগ্রহ ছিল তাঁর অর্থনীতির বাইরে। স্মৃতিচারণ শুনতে মুগ্ধ লাগত সব সময়েই। জানা মানুষদের অজানা সময়ের কাহিনি।… [আর] তখনকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরবের কাহিনি, বেনারসের গল্প, পাটনার গল্প, ওয়াশিংটনের কাহিনি, দিল্লির গল্প, কত কী!…
ছেলে ও মেয়েকে নিয়ে যারপরনাই গর্ব ছিল তাঁর (মেসোমশায়ের)। মাসিমার ওসব ছিল না – ছেলেমেয়েরা কে কতটা মেধাবী, তা নিয়ে মাথা ঘামানোর চেয়ে কে কী খেল, কতটা খেল, কে মোটা হচ্ছে, কে রোগা হলো, কার শরীর কেমন আছে, কার মন কেমন আছে – ব্যস, এদিকটাতেই নজর ছিল বেশি মাসিমার। কে কী কাজকর্ম করে বিশ্বভুবনে কতখানি গভীর দাগ কাটতে পারল, তা নিয়ে অতটা চিন্তিত ছিলেন না মাসিমা। মেসোমশায় তা ছিলেন।… আমরা বড় ভাগ্যবান, এমন একটা সময়ে জন্মেছি যখন চতুর্দিকেই পেয়েছি মহীরুহের ছায়া, মহৎ প্রাণের আশীর্বাদ। ‘পিতৃমাতৃতুল্য’ কথাটা তখন অর্থবহ ছিল।’১১

তথ্যসূত্র
১. ১২ অক্টোবর, ১৯৫১। দুর্ভাগ্যবশত পরিমল রায়ের মৃত্যুর দুদিন পর এ-চিঠি ঘবি ণড়ৎশ পৌঁছেছিল। অর্থনীতিবিদ ও সাহিত্যিক পরিমল রায়ের নামের সঙ্গে বুদ্ধদেব বসুর প্রথম পরিচয় হয় স্কুলজীবনে, মৌচাকের ধাঁধার উত্তরে। পরে কলেজে একসঙ্গে পড়তে গিয়ে মুখোমুখি আলাপ ও বন্ধুত্ব। এঁরা দুজন ও অজিত দত্ত ছাত্রজীবন থেকে ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন, আজীবন রয়ে গেলেন। ভৌগোলিক দূরত্ব কোনো বাধা দেয়নি। পরিমল রায় ছিলেন প্রতিবেশী, বাবার প্রিয় ছাত্র, প্রিয় সহকর্মী, আমাদের পরিবারের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও ছোটদের প্রিয় পরিমল কাকা।
২. পৃ ২৭-২৮। শান্তিনিকেতনের বাড়ি বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়কে দেওয়া হয়েছে। এটি এখন বাবার নামে একটি রিসার্চ সেন্টার। বাগান, বিশেষ করে গোলাপবাগান, পুনর্জীবিত করা হয়েছে।
৩. এ-পাড়ার বেশিরভাগ বাড়ি অনেকটা জমির ওপর ছিল।
৪. ‘পশ্চিমবঙ্গ’ : বিদ্যাসাগর সংখ্যা, বর্ষ ২৯, ১৪০১।
৫. মায়ের অন্তরঙ্গ বন্ধু।
৬. সেন, পৃ ৯১। রাগ বা তাল উল্লেখ নেই।
৭. ভেজানো কাঁচা মুগডাল, মিহিকাটা শসা আর কুরোনো নারকেল।
৮. সেন, পৃ ১১২।
৯. লেখিকার সংগ্রহ।
১০. শতবার্ষিকী শ্রদ্ধার্ঘ্য, পৃ ৮৮।
১১. ওই, পৃ ৪৩-৪৪।