প্রতিভা, সাধনা ও খামখেয়াল সংগীতপ্রতিভা-প্রসঙ্গ

রমেশচন্দ্র চন্দ

  জীবনের পড়ন্তবেলায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রানী চন্দকে একদিন বলেছিলেন, ‘জিনিয়াসে জিনিয়াসে বাড়ী আমাদের ভরা ছিল। জিনিয়াস হওয়া বড় বিপদের কথা। জানিস, আমি একটুখানির জন্য বেঁচে গেছি। আর একচুল বেশি জিনিয়াস হলেই বিপদ হত রে।’ জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে বিরল প্রতিভা ও পাগলামির বিচিত্র সহাবস্থান সত্যি বিস্ময়কর। রবীন্দ্রনাথের বড়দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথ ছিলেন যেমন বিদগ্ধ, তেমনি খামখেয়ালি। তাঁর পুত্র দ্বিপেন্দ্রনাথকে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ব্যারিস্টারি পড়তে বিলাতে পাঠাতে চেয়েছিলেন, কিন্তু সমুদ্রে জাহাজডুবির ভয়ে দ্বিপেন্দ্রনাথের বিলাত গিয়ে ব্যারিস্টারি পড়া হয়নি। রবীন্দ্রনাথের দুই দাদা বীরেন্দ্রনাথ ও সোমেন্দ্রনাথ উন্মাদ রোগগ্রস্ত ছিলেন। পাগল ও প্রতিভাবানে হয়তো সামান্যই রকমফের।

টমাস আলভা এডিসনকে জিনিয়াস বলায় তিনি নাকি বলেছিলেন, জিনিয়াসের মূলে রয়েছে শতকরা দশভাগ দৈব অনুপ্রেরণা আর বাকি নববই ভাগ মাথার ঘাম পায়ে ফেলা। চিরকাল মানুষ গাছ থেকে আপেল মাটিতে পড়তে দেখেছে। আকাশে উৎক্ষিপ্ত না হয়ে আপেল কেন ভূতলে নেমে আসে? ব্যাপারটা এতই সাধারণ যে, আইজাক নিউটনের আগে এ-প্রশ্ন কারো মাথায় আসেনি। শুধু অনুসন্ধিৎসাই নয়, নিউটনের বৈজ্ঞানিক প্রস্ত্ততি ও ধীশক্তি ছিল বলেই তিনি তাঁর প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেলেন। তাঁর চিন্তার ফসল মাধ্যাকর্ষণ তত্ত্ব আবিষ্কার, যার মাধ্যমে নিউটন বিশ্বব্রহ্মান্ডের যাবতীয় বস্ত্তর পারস্পরিক অবস্থান ও গতিবিধির ব্যাখ্যা খুঁজে পেলেন। শারীরবিজ্ঞানী লুইগি গ্যালভানি দৈবক্রমে আবিষ্কার করেন যে, নুনে জারিত ব্যাঙের মধ্যে বিদ্যুৎ সঞ্চারের ফলে ব্যাঙটি নেচে উঠেছিল। বিদ্যুৎ সম্বন্ধে সে-সময়ে বলতে গেলে কিছুই জানা ছিল না। তিনি ব্যাঙের ওপর আরো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন। লোকে তাঁকে ‘ব্যাঙ নাচানো অধ্যাপক’ বলে উপহাস করত। ওই সূত্র অনুসরণের ফলে পরে বিদ্যুতের আরো রহস্য আবিষ্কার হয়।

জমি যথেষ্ট প্রস্ত্তত করে বীজ বপন করলে তাতে ভালো ফসল ফলে। তেমনি যে-কোনো ক্ষেত্রে সফল হওয়ার জন্য যথেষ্ট অধ্যয়ন, কর্মকুশলতা ও নিষ্ঠাসহকারে পরিশ্রম করে নিজেকে প্রস্ত্তত করা অপরিহার্য। যেমন স্ফুলিঙ্গের সংস্পর্শে দাহ্য বস্ত্ত জ্বলে ওঠে ও পরশমণির স্পর্শে লোহা সোনা হয়, তেমনি ‘জিনিয়াসে’র মূলেও আকস্মিক অনুপ্রেরণা ও ইনটিউশন (সজ্ঞা) দুয়ের ভূমিকা অনস্বীকার্য।

প্রতিভাবানদের জীবনী পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, তাঁদের অনেকেই সমগ্র জীবন প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন। প্রথম জীবনে নিদারুণ দারিদ্র্য ও অন্যান্য প্রতিবন্ধকের সম্মুখীন হয়েও নিষ্ঠা, দৃঢ় সংকল্প ও চরিত্রের দৃঢ়তা, কৃচ্ছ্রসাধন, একাগ্র অধ্যবসায় ও কঠোর পরিশ্রমের ফলে নিজেদের তাঁরা প্রতিষ্ঠা করেছেন। প্রতিভাবানগণ সাধারণের ব্যতিক্রম। চিন্তাধারা, কর্মজীবন ও সৃজনশীলতায় তাঁরা সমকালীন দেশ ও সমাজের চেয়ে অগ্রবর্তী হন। তাঁরা নিজ নিজ সাধনায় এত নিবিষ্ট, আত্মভোলা ও বাহ্য ব্যবহারে চূড়ান্ত অন্যমনস্ক যে, অনেক সময়েই জাগতিক বিষয়ে অনভিজ্ঞ ও উদাসীন এবং শিশুর মতো সরল প্রতিপন্ন হন। এ-প্রসঙ্গে বিশ্ববরেণ্য বৈজ্ঞানিক আইজাক নিউটন ও অ্যালবার্ট আইনস্টাইন সম্বন্ধে বহু কাহিনি শোনা যায়। প্রতিভাবানদের চিন্তাশীল মন সদাই কোনো না কোনো বিষয়ে ব্যাপৃত। কলকাতার রসা রোডে অবস্থিত রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউট অব কালচারের ছাত্রাবাসে আমার থাকাকালীন একবার ইনস্টিটিউটে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য বিখ্যাত ব্রিটিশ জীববিজ্ঞানী জে.বি.এস. হলড্রেনকে বরানগরের ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট থেকে আনার ভার ছিল আমার ওপর। আমি সংখ্যাবিজ্ঞানের ছাত্র জেনে তিনি সারারাস্তা ভারতের জলবায়ু, পরিবেশ এবং দেশের জীবজন্তু, গাছপালা প্রভৃতির নানা বৈশিষ্ট্য কীভাবে সম্বন্ধিত, তা আলোচনা করলেন, যা আমি কখনো ভাবিনি।

সমকালীন সমাজ প্রতিভাবানদের বুঝতে ভুল করে, অনেক সময় তাঁদের অনন্য প্রতিভার মূল্যায়ন করতে ব্যর্থ হয়, তাঁদের খামখেয়ালি এমনকি অপ্রকৃতিস্থও মনে করে। কবিগুরুর ভাষায় :

যে তোরে   পাগল বলে তারে তুই বলিস নে কিছু।

আজকে তোরে কেমন ভেবে   অঙ্গে যে তোর ধুলো দেবে

কাল সে প্রাতে মালা হাতে আসবে রে তোর পিছু-পিছু …

নিজ নিজ ক্ষেত্রে অদ্বিতীয় কিন্তু ব্যবহারিক জীবনে উদাসীন অনন্য প্রতিভাও অনেক সময় বাস্তব জীবনে বিফল হয়। সর্বকালে, সর্বদেশে ও সর্বসমাজে বিজ্ঞান, সাহিত্য, ললিতকলা, বস্ত্তত সর্বক্ষেত্রে, এরূপ অজস্র উদাহরণ মেলে। বর্তমানে প্রবন্ধের কেন্দ্রীয় বিষয় সংগীতের ক্ষেত্রেও উপর্যুক্ত মন্তব্য করা যায়। হিন্দুস্তানি মার্গসংগীতের প্রসিদ্ধ শিল্পীদের অনেকেই প্রথম জীবনে কঠিন পরীক্ষা ও কঠোর পরিশ্রমের সম্মুখীন হতেন। মাইকেল মধুসূদন দত্তের মতোই তাঁদের ক্ষেত্রেও বলা যায় – ‘কাটাইনু বহুদিন সুখ পরিহরি অনিদ্রায় অনাহারে সঁপি কায়মন’। অস্থিরচিত্ত অ্যামেডিয়স মোৎসার্টের সংগীতজগতে উল্কার মতো উত্থান-পতন ও করুণ পরিণতি বেদনাদায়ক।

একসময়ে হিন্দুস্থানি সংগীত কয়েকটি ঘরানার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। প্রতিটি ঘরানা তাঁদের বিশিষ্ট ‘চিজ’ (গায়কি, বন্দিশ প্রভৃতি) যক্ষের ধনের মতো অাঁকড়ে থাকতেন। সংগীতে পূর্বপুরুষের সঞ্চিত জ্ঞানভান্ডার যেন পরিবারের নিজস্ব ধন; পুত্র, ভ্রাতৃষ্পুত্র ছাড়া অর্থাৎ ঘরানার বাইরের কাউকে সহজে গ্রহণ করা ও তালিম দেওয়া হতো না। বাইরের কাউকে তা শেখালে ওই ধনের লাঘব ও বিকৃতি ঘটবে এবং পারিবারিক ধনের একচেটিয়া অধিকার হাতছাড়া হবে, এরূপ আশঙ্কাও ছিল। এরূপ সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গিহেতু সংগীতের বহু মূল্যবান সম্পদ ও ধারা লুপ্ত হওয়া অসম্ভব নয়।

পন্ডিত বিষ্ণু নারায়ণ ভাতখন্ডে, পেশায় আইনজীবী হয়েও, কঠোর পরিশ্রম ও আত্মত্যাগ করে বিভিন্ন ঘরানার বন্দিশ, গায়কির বৈশিষ্ট্য, দোষ-গুণ প্রভৃতি সম্বন্ধে সমকালীন ভারতীয় সংগীতের বৈজ্ঞানিক প্রণালিসম্মত আলোচনা করেন। ফলে তিনি প্রাচীনপন্থী সংকীর্ণমনা ওস্তাদদের বিরূপ সমালোচনার সম্মুখীন হন। প্রচলিত ঘরানার বাইরেও সংগীত-শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে তাঁর উদ্যোগে কয়েকটি সংস্থা গড়ে ওঠে। এ-প্রসঙ্গে বলা যায় যে, ‘গুরুশিষ্য পরম্পরার দোষ এবং গুণ দুই-ই ছিল। ওস্তাদের ভুলগুলো ও মুদ্রাদোষ পুরুষানুক্রমে সংক্রমিত হতো। অন্যদিকে গুরুকুল শিক্ষায় শ্রদ্ধা, ভক্তি ও অনন্যমনা হয়ে দিবারাত্র রেওয়াজের বিশেষ স্থান ছিল।’ পন্ডিত ভীমসেন যোশী তরুণ বয়সে গান শেখার জন্য কলকাতায় থাকাকালীন যখন পাহাড়ি সান্যালের আশ্রয়ে ছিলেন, তখন তাঁর গলা ছিল নাকি অত্যন্ত কর্কশ (‘মোষের বাচ্চার মতো গানের গলা’)। পরে তিনি রামপুর, লখনউ প্রভৃতি স্থানে বড় ওস্তাদদের কাছে গান শিখে ভারতীয় সংগীতের শীর্ষস্থানে পৌঁছেছিলেন। এ-সাফল্য তাঁর দীর্ঘ স্বরসাধনা ও কঠোর পরিশ্রমের ফসল (‘দৈনিক আট ঘণ্টার কম তিনি রেওয়াজ করেননি’) যা বর্তমান যুগে বিরল। নতুন সংগীতশিক্ষা পদ্ধতিতে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া অনেকের একমাত্র উদ্দেশ্য। কিন্তু ভাতখন্ডে মনে করতেন, আধুনিক স্কুল-কলেজের গন্ডি পেরোলে যেমন প্রকৃত শিক্ষা শুরু হয়, সংগীতের ক্ষেত্রেও তাই। তার জন্য শিক্ষার্থীর আগ্রহ ও নিষ্ঠা থাকা চাই।

নামি ঘরানার বহির্ভূত হয়েও কোনো কোনো দৃঢ়সংকল্প শিল্পী, সংগীতের মোহময় আকর্ষণে, অবর্ণনীয় ত্যাগ স্বীকার ও অপমান সহ্য করে সংগীত শিক্ষা নিতেন। গত শতাব্দীর কয়েকজন সংগীতপ্রতিভা এর দৃষ্টান্ত। এখানে প্রবাদপ্রতিম দুই শিল্পী – যন্ত্রসংগীতে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ ও কণ্ঠসংগীতে পন্ডিত ভাস্কর বুয়া বাখ্লে – কত কঠিন পরীক্ষা, কঠোর সংগ্রাম ও একাগ্র সাধনার ফলে সংগীতজীবনে প্রবেশ করেছিলেন, তা আলোচনা করব।

ত্রিপুরার এক গ্রামের কৃষকসন্তান ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর সংগীতশিক্ষার কাহিনি গল্পের মতোই মনে হয়। তাঁর পিতা সংগীতে কোনো শিক্ষা না পেয়েও সংগীতের ভক্ত ছিলেন, লুকিয়ে লুকিয়ে ত্রিপুরার রাজদরবারের রবাববাদকের বাজনা শুনতেন। একদিন ধরা পড়ে গিয়ে তিনি ওস্তাদজিকে অনুরোধ করলেন তাঁকে রবাব শেখাতে হবে। ওস্তাদজি নিজের পরিবারের কাউকে ছাড়া রবাব শেখাতেন না, কিন্তু তাঁকে সেতার শেখাতে সম্মত হলেন। পিতার সংগীতপ্রীতি আলাউদ্দিনের মধ্যেও সঞ্চারিত হলো, তিনি স্কুল ফাঁকি দিয়ে এক সাধুর গান শুনতেন। ধরা পড়ে তিনি তাঁর মায়ের হাতে প্রচন্ড শাস্তি পেলেন। সুযোগ বুঝে একরাতে তিনি বাড়ি থেকে পালিয়ে ঢাকা ও অবশেষে কলকাতায় পৌঁছলেন। সেখানে বহু কষ্টের পরে সাত-আট বছরের বালক আলাউদ্দিন আত্মপরিচয় গোপন করে নানুগোপাল নামক কলকাতার এক ধ্রুপদ-ধামারের গুরুর কাছে আশ্রয় পেলেন। তিনি তাঁর কাছে তালিম নিতে শুরু করলেন এবং একাগ্রতা ও নিষ্ঠাগুণে তাঁর মন জয় করলেন। এভাবে সাত বছর কেটে গেল। তাঁর দাদা তাঁর খোঁজে অবশেষে কলকাতায় এসে আলাউদ্দিনের সন্ধান পেলেন। একমাসের মধ্যে আলাউদ্দিনকে কলকাতায় ফিরে আসতে দিতে হবে – এ-শর্তে দাদার সঙ্গে তাঁকে গ্রামে যেতে দিতে গুরু সম্মত হলেন।

আলাউদ্দিন গ্রামে ফিরে আসায় বাড়িতে আনন্দের জোয়ার বইল। সংগীতজ্ঞ হওয়ার নিজের সুপ্ত উচ্চাভিলাষ পুত্রের মধ্যে পূর্ণ হতে চলেছে দেখে আনন্দিত পিতা তাঁকে আশীর্বাদ করলেন। কিন্তু বালকের মন সংগীত থেকে ঘরের দিকে ফেরানোর আশায় তলে তলে তাঁর বিয়ের আয়োজন চলল। সেকালে গানবাজনা শেখা অত্যন্ত নিন্দনীয় ছিল। কারণ ধরে নেওয়া হতো, কেউ ওদিকে ভিড়লে সে চরিত্রভ্রষ্ট হবে। তবু তাঁর পরিবারের খাতিরে মেয়েপক্ষ বিয়েতে মত দিলো। বিয়ের রাতেই দশবর্ষীয় বালিকা ঘুমন্ত বধূকে ছেড়ে বিয়ের যৌতুক ৩০০ টাকা ও নববধূর ছেড়ে রাখা অলঙ্কার নিয়ে আলাউদ্দিন ঘর ছাড়লেন। কলকাতা পৌঁছে তিনি গুরুর মৃত্যুসংবাদ পেলেন। অগত্যা তিনি এক ডাক্তারের ডিসপেনসারির বারান্দায় আশ্রয় নিলেন ও লঙ্গরখানায় খেতেন। স্বামী বিবেকানন্দের এক ভাই, যিনি যন্ত্রসংগীতে নিপুণ ছিলেন, আলাউদ্দিনকে যন্ত্রসংগীত শেখাতে লাগলেন। তাঁর সহায়তায় আলাউদ্দিন গিরিশচন্দ্র ঘোষের নাটকের অর্কেস্ট্রা দলে স্থান পেলেন, সঙ্গে ক্ল্যারিনেট, সানাই প্রভৃতি শিখতে লাগলেন। তিনি কলকাতায় তিন বছর একই সঙ্গে মোট তিনজন গুরুর কাছে বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র শিখেছিলেন।

কিছু অর্থ উপার্জনের জন্য আলাউদ্দিন তাঁর সব বাদ্যযন্ত্র নিয়ে মুক্তাগাছার সংগীতপ্রেমী জমিদার-আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে উপস্থিত হলেন। সেখানে রামপুর ঘরানার সরোদবাদক ওস্তাদ আহমেদ আলি খানের সরোদবাদন শুনে এত মুগ্ধ হন যে, তিনি সরোদ শিখতে বদ্ধপরিকর হন। জমিদারের সহৃদয় সহায়তার ফলে ওস্তাদজি আলাউদ্দিনকে সাগরেদ-রূপে গ্রহণ করেন। এরপর খানসাহেব কলকাতা ফেরার সময় আলাউদ্দিনকেও সঙ্গে নিলেন। সেখানে আলাউদ্দিন তাঁর রান্নাবান্নাসহ ঘরের সব কাজ করতেন। কার্যত ভৃত্যরূপে সেবা ছাড়া তবলায় যথেষ্ট দক্ষ আলাউদ্দিন মজলিশে খানসাহেবের তবলাসংগতও করতেন। ওস্তাদজি কোথাও কোনো অর্থ উপার্জন করলে তা আলাউদ্দিনের কাছে গচ্ছিত রাখতেন আবার পরে তা নিয়েও নিতেন; কিন্তু সাগরেদেরও যে টাকার দরকার সেদিকে তাঁর কোনো লক্ষ্য ছিল না। আলাউদ্দিন বাধ্য হয়ে নিজের পুরনো কাপড় কোনোক্রমে জোড়াতালি দিয়ে পরতেন। কোনো মজলিশে যাওয়ার সময় ওস্তাদ তাঁর নিজের পুরনো পোশাক আলাউদ্দিনকে পরতে দিতেন কিন্তু মজলিশ থেকে ফিরে এসেই তা নিয়ে নিতেন। তবু ওস্তাদজি তাঁকে সরোদ শেখানোর কোনো নাম করেন না; শুধু তাঁর বাজনা শুনে শুনে আর আগের শেখা গানের সুর সরোদে বাজিয়ে আলাউদ্দিন নিজের চেষ্টায় তা অনেকটা আয়ত্ত করলেন। একদিন ওস্তাদজি তা শুনে সন্তুষ্ট হয়ে তাঁকে সরোদ শেখাতে শুরু করলেন।

এদিকে বিবাহের পরে ছয়-সাত বছর ধরে স্ত্রীর সঙ্গে আলাউদ্দিনের কোনো সম্পর্ক নেই বলে কনেপক্ষ আলাউদ্দিনের বিরুদ্ধে নানা মনগড়া অভিযোগ করে মেয়েকে শ্বশুরবাড়ি পাঠাতে অস্বীকার করল। তাঁর দাদার তিরস্কার-সূচক চিঠি পেয়ে আলাউদ্দিন বাড়িতে ফিরে এলেন। সেখানে তাঁকে বহু গঞ্জনা সহ্য করতে হলো। সংসারে আকৃষ্ট করার জন্য খুব সুন্দরী একটি মেয়ের সঙ্গে তাঁর দ্বিতীয় বিয়ে দেওয়া হলো। কিন্তু সংগীতে সমর্পিতপ্রাণ আলাউদ্দিন আবার গুরুর কাছে ফিরে গেলেন। এবারো ওস্তাদজি আলাউদ্দিনকে প্রাথমিক স্তরের চেয়ে বেশি শেখাতে নারাজ। ওই সীমিত তালিমের বাইরেও ওস্তাদজির অনুকরণে আপন প্রতিভাবলে আলাউদ্দিন ভালো সরোদ বাজাতে শিখলেন। একদিন আলাউদ্দিনের বাজনা শুনে ওস্তাদজি রুষ্ট হলেন, ভাবলেন সাগরেদ তাঁরই বিদ্যা শুনে শুনে আত্মসাৎ করছে। এরপর ওস্তাদজি সাগরেদকে সঙ্গে নিয়ে ছুটিতে রামপুর গেলেন কিন্তু তাঁকে আর টাকা-পয়সার ভার দেন না, যদি সে বিদ্যার মতো টাকাও চুরি করে!

রামপুর পৌঁছে আলাউদ্দিন তাঁর কাছে গচ্ছিত প্রায় পাঁচ হাজার টাকার সম্পূর্ণ হিসাব ওস্তাদজিকে দিলেন। আলাউদ্দিনের সততায় মুগ্ধ হয়ে ওস্তাদজির মা তাঁকে দ্বিতীয় পুত্রের মতো সাদরে গ্রহণ করলেন, তবু ওস্তাদজি তাঁর অনুকরণ-প্রতিভা দেখে শঙ্কিত হয়ে তাঁকে আর শেখাতে অস্বীকার করলেন। আলাউদ্দিন বুঝলেন, সংগীতের যে-কোনো বিষয় অনায়াসে আয়ত্ত করার অনন্য প্রতিভার জন্য এযাবৎ কেউই তাঁর ওপর প্রসন্ন হননি! ছুটি শেষ হলে ওস্তাদজি কলকাতায় ফিরে গেলেন কিন্তু আলাউদ্দিন তাঁর পিতামাতার সঙ্গে রামপুরেই রয়ে গেলেন। এবার আলাউদ্দিন রামপুর নবাবের সংগীতগুরু ও দরবারের গায়ক ওস্তাদ ওয়াজির খানের শিষ্য হওয়ার সংকল্প করলেন। চার-পাঁচ মাস ধরে ওস্তাদের নিকটবর্তী হওয়ার ব্যর্থ প্রয়াসের পর আলাউদ্দিন জীবনে বীতশ্রদ্ধ হয়ে নিয়মিত  খাওয়া-দাওয়া ছাড়লেন, অবর্ণনীয় কৃচ্ছ্রসাধন শুরু করলেন। করুণাপরবশ হয়ে তাঁর পরিচিত এক মৌলবিসাহেব নবাবকে উদ্দেশ করে আলাউদ্দিনকে একটি আবেদনপত্র লিখে দিলেন। বহুদিন অপেক্ষা করেও আলাউদ্দিন নবাবকে তা দেওয়ার সুযোগ পাননি। একদিন অন্যান্য গাড়ির ভিড়ে নবাবের গাড়ি যখন প্রাসাদ থেকে ধীরে ধীরে বেরোচ্ছিল, তখন আলাউদ্দিন ওই গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে পড়লেন। সে-সময় সশস্ত্র স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্য বাঙালি যুবকমাত্রই সন্দেহের পাত্র ছিল। পুলিশ আলাউদ্দিনকে ধরে উত্তম-মধ্যম দিয়ে নবাবের সামনে পেশ করল। সে-সুযোগে আলাউদ্দিন তাঁর আবেদনপত্র নবাবকে লক্ষ্য করে ছুড়লেন। সংগীতশিক্ষার জন্য আলাউদ্দিনের আগ্রহ, কৃচ্ছ্রসাধন, এমনকি হতাশার ফলে আত্মহত্যার চেষ্টা, সবই তাতে বর্ণিত ছিল। তাঁর প্রতিভা সম্বন্ধে নিশ্চিত হয়ে নবাব আলাউদ্দিনকে শিষ্যরূপে গ্রহণ করতে ওস্তাদ ওয়াজির খানকে সম্মত করালেন। তবু ওস্তাদজি আড়াই বছর চালচুলোহীন আলাউদ্দিনকে কোনো তালিম দেননি। ইত্যবসরে আলাউদ্দিন স্বরলিপি রচনায় ও বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রে দক্ষতাহেতু নবাবের বিরাট অর্কেস্ট্রা দলে নির্বাচিত হয়ে তার অপরিহার্য সদস্য গণ্য হলেন।

আলাউদ্দিনের অবহেলিত দ্বিতীয় স্ত্রী ক্ষোভে-দুঃখে দুবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেন ও অবশেষে হৃৎযন্ত্র বিকল হয়ে তাঁর মৃত্যু হয়। ওস্তাদ ওয়াজির খান ওই মৃত্যুসংবাদ আলাউদ্দিনকে বলার সময় তাঁর সমস্ত কাহিনি শুনে নরম হলেন ও আলাউদ্দিনের সংগীতশিক্ষার ভার গ্রহণ করলেন।

দরিদ্র মারাঠি ব্রাহ্মণসন্তান ভাস্কর বুয়া বাখ্লের সংগীতশিক্ষার কাহিনি আলাউদ্দিনের মতোই চমকপ্রদ। বরোদা রাজ্যের এক গ্রামে তাঁর জন্ম। বাল্যকাল থেকেই তিনি সুরেলা কণ্ঠ ও অসামান্য প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। এক মারাঠি নাট্য কোম্পানি চৌদ্দো-পনেরো বছর বয়সী সুরেলা কণ্ঠ ভাস্করকে নায়িকার ভূমিকায় অভিনয়ের জন্য বালক গায়করূপে নিযুক্ত করে। মারাঠি নাট্যসংগীত রাগাশ্রিত। বিভিন্ন নাটকে নায়িকার ভূমিকায় অভিনয় ও গানের জন্য বালক ভাস্করের নামডাক হয়। নাট্য কোম্পানির সঙ্গে বিভিন্ন স্থান ঘুরে তিনি ইন্দোর পৌঁছেন। ইন্দোর রাজসভার প্রসিদ্ধ বীণাবাদক ও সভাগায়ক এবং কিরানা ঘরানার জনক বন্দে আলি খাঁ একটি নাটকে ভাস্করের গান শুনে মুগ্ধ হন এবং তাঁকে শিষ্যরূপে গ্রহণ করেন।  ওস্তাদজির কাছে ভাস্কর তিন মাস মাত্র তালিম পেয়ে একাধিক রাগ শেখেন। নাটক কোম্পানি ইন্দোর ছেড়ে অন্যত্র যাওয়ায় ভাস্করের শিক্ষায় ছেদ পড়ল। এর পরে বয়ঃসন্ধিহেতু স্বরভঙ্গ হওয়ায় ভাস্করের কাজ গেল।

গ্রামে ফিরে মন না টেকায় ভাস্কর বরোদায় গিয়ে গান শেখার সংকল্প করলেন। সেখানে তিনি এক উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারীর নজরে পড়লেন। রাজসরকার থেকে তাঁর জলপানির ব্যবস্থা করা হলো। তাঁর সুপারিশে বরোদার সভাগায়ক ও গোয়ালিয়র ঘরানার ওস্তাদ ফয়েজ মহম্মদ খাঁ তাঁকে তালিম দিতে স্বীকৃত হলেন। ভাস্কর চালচুলোহীন গ্রাম্য বালক, নাটকে মেয়ের ভূমিকায় অভিনয় ও গান করত, তাঁর গলাও ভাঙা। ফলে খাঁসাহেব তাঁকে গান শেখাতে অনিচ্ছুক ছিলেন। ছটি মাস তিনি কিছুই শেখালেন না। এ-কথা ভাস্করের উপকারী রাজকর্মচারীটির কানে গেল। তাঁর চাপে অবশেষে ওস্তাদজি ভাস্করকে তালিম দিতে শুরু করলেন।

সংগীতের ক্ষেত্রে গুরুকুল প্রথায় শিষ্যের গুরুভক্তির অবিশ্বাস্য নিদর্শন পৌরাণিক যুগের কাহিনি মনে করিয়ে দেয়। শিষ্য কায়মনোবাক্যে গুরুর সেবা করতেন, তাঁর প্রতিটি নির্দেশ নির্দ্বিধায় পালন করতেন। গুরু যাই শেখাবেন তাই শিখতে হবে, প্রশ্ন করা চলবে না; গীতায় বর্ণিত ‘প্রণিপাত, পরিপ্রশ্ন ও সেবা’ – জ্ঞানলাভের তিন স্তম্ভের দ্বিতীয়টির অভাব ছিল প্রথাগত ভারতীয় সংগীতশিক্ষায়। ভাস্করের গুরুভক্তির নানা কাহিনি শোনা যায়। একবার ভাস্করকে গান শেখাবার সময় গলায় পানের কুচি আটকে ওস্তাদ ফয়েজ খাঁ সাহেব বিষম খান। কোনো পিকদান কাছে না থাকায় ভাস্কর দুহাত পেতে ওই শ্লেষ্মাজড়িত পানের ছিবড়া নিয়ে তা বাইরে ফেলে এলেন। তখনকার রীতি অনুযায়ী ওস্তাদজি ভাস্করকে পা টেপানো থেকে ঘরের সব কাজ করাতেন, রান্নাবান্নার কাজও। একদিন ওস্তাদজি গোশত (নিষিদ্ধ মাংস) খাওয়ার শখ ভাস্করের কাছে ব্যক্ত করলেন। বাজার থেকে সে তা কিনে আনতে পারবে কি-না জিজ্ঞাসা করলেন। কট্টর মারাঠি ব্রাহ্মণসন্তান ভাস্কর – গোশত দূরে থাক, পেঁয়াজ-রসুনও কখনো ছোঁননি। ক্ষণকাল চুপ করে থেকে তিনি বললেন, ওস্তাদ যখন বলছেন তিনি অবশ্যই তা করবেন। ভাস্কর থলি নিয়ে মাছ-মাংসের বাজারের দিকে চললেন। মাংসের দোকানিকে তিনি বললেন, ‘ওস্তাদজি মাংস খেতে চেয়েছেন। আমি মাংসের কিছুই জানি না; এই টাকা নিয়ে সেরা মাংস কেটে এতে ভরে দিন।’ থলি ভর্তি করে মাংস, আদা, পেঁয়াজ ইত্যাদি নিয়ে বাজারের নিষিদ্ধ অংশ থেকে বেরোনোর সময় ভাস্কর তাঁর মারাঠি বন্ধুদের কাছে ধরা পড়ে গেলেন। বন্ধুদের ভৎর্সনার উত্তরে ভাস্কর বললেন, ‘আমার জীবনে এসব খাইনি, চোখেও দেখিনি, উৎকট গন্ধে আমার বমি আসছে। তবু আমার গুরু পিতার চেয়েও বড়, আমাকে বিদ্যাদান করছেন,  যাঁর চেয়ে বড় জিনিস কিছু নেই। তিনি আমাকে যা আদেশ করেন, তা পালন না করলে আমার শিক্ষা নিষ্ফল হবে।’ বাড়ি ফিরে ভাস্কর ওস্তাদজির তদারকিতে পেঁয়াজ ভাজলেন, মশলা ইত্যাদি দিয়ে মাংস কষালেন। ওস্তাদজি মাংস চড়িয়ে ভাস্করকে সেখানে বসিয়ে লক্ষ রাখতে বললেন, রান্নার বদ্বু আস্তে আস্তে দূর হয়ে গেলে তাঁকে ঢেকে দিতে বললেন। ভাস্কর মন শক্ত করে অবিচলচিত্তে ওস্তাদজির আদেশ পালন করলেন। ভাস্করের তৈরি চাপাটি দিয়ে মাংস খেয়ে তৃপ্ত ওস্তাদজি বললেন, তিনি তাঁর গুরুভক্তির পরীক্ষা নিয়েছিলেন, নইলে মাংস রান্নার মতো তাঁর ধর্মবিরুদ্ধ কাজ তিনি করাতেন না। আরো বললেন, তিনি এবার থেকে প্রাণমন ঢেলে শেখাবেন, যাতে ভাস্কর সংগীতজগতের শীর্ষস্থানে পৌঁছতে পারেন। এর পরে তিনি তাঁর হৃদয় উজাড় করে ভাস্করকে শেখাতে লাগলেন।

ভাস্কর যাতে সংগীতজগতের উচ্চতর শীর্ষে আরোহণ করতে পারেন সেজন্য ওস্তাদ ফয়েজ খাঁ আগ্রা ঘরানার অন্যতম সেরা গায়ক নথ্থন খাঁকে অনুরোধ করলেন ভাস্করকে তালিম দিতে। ভাস্কর সম্বলহীন, তায় হিন্দু, কোনো খানদান নেই। সুতরাং নথ্থন খাঁ তাঁকে তালিম দিতে আগ্রহী নন; অন্য ছেলেদের যখন তালিম দিতেন, ভাস্কর সেখানে উপস্থিত থাকতেন মাত্র; কিন্তু তাঁর প্রিয়পুত্রকে তালিম দেওয়ার সময় নানা কাজের অজুহাতে ভাস্করকে বাজারে পাঠিয়ে দিতেন। কৌরব ও পান্ডব তরুণদের অস্ত্রশিক্ষার সময় দ্রোণাচার্য অশ্বত্থামাকে বিশেষ শিক্ষাদানের জন্য আর সবাইকে কোনো কাজে অন্যত্র পাঠাতেন। তৎপর অর্জুন সবার আগে কাজ সেরে ফিরে এসে অশ্বত্থামাকে দ্রোণাচার্য যা শেখাতেন, অর্জুনও তাই শিখতেন। শুনে শুনে যা শেখা যায় প্রখর শিষ্য ভাস্করও তা তুলে নিতেন, খাঁসাহেব বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলে দরজা বন্ধ করে রেওয়াজ করতেন।

একবার ওস্তাদ ফয়েজ খাঁ মহারাজদের সেবায় কয়েক মাসের জন্য উত্তর ভারত ভ্রমণে গেলেন, সঙ্গে তাঁর প্রিয় পুত্র ও শিষ্য; বাজার করা ও ফাইফরমাশ খাটার জন্য ভাস্করকে বাড়িতে রেখে গেলেন। খাঁসাহেবের স্ত্রী বিখ্যাত ওস্তাদ দরসপিয়ার ভগ্নি, খানদানি ঘরের কন্যা – বাল্যকাল থেকে সংগীতের পরিবেশে থেকে তিনিও সংগীতে যথেষ্ট পারদর্শী ছিলেন। তিনি ভাস্করের ওপর সদয় ছিলেন। খাঁসাহেব ছেলেকে যা যা শিখিয়েছিলেন, তার সবকিছুই বেগমসাহেবা খাঁসাহেবের অনুপস্থিতিতে প্রতিদিন ভাস্করকে নিজের কাছে বসিয়ে শেখালেন। এর কয়েক মাস পরে খাঁসাহেবকে অমৃতসরে এক মজলিশে যেতে হলো, নানা কারণে প্রিয় পুত্রদের না পেয়ে তিনি ভাস্করকে সঙ্গী করলেন। সেখানে একদিন সকালে খাঁসাহেবের অনুপস্থিতির সময় ভাস্কর তানপুরা বেঁধে নিশ্চিন্তমনে ভোরের রাগ রেওয়াজ করছিলেন। তাঁর অপূর্ব কণ্ঠ শুনে সেখানে ভিড় জমে গেল। লোকে যখন শুনল যে, বালক ভাস্কর মাত্র দু-এক বছর খাঁসাহেবের সামান্য তালিম পেয়েছেন, তখন তাঁর অসাধারণ প্রতিভা সম্বন্ধে নিশ্চিত হয়ে তারা অনুষ্ঠানের সংগঠকগণকে ধরে পড়ল, ভাস্করকে গান গাইতে দিতে হবে। তাঁদের সনির্বন্ধ অনুরোধে খাঁসাহেব নরম হলেন, ভাস্করকে অনধিক আধঘণ্টা গাইতে দিতে রাজি হলেন। ভাস্করের গান শুনে শ্রোতারা মুগ্ধ। খাঁসাহেব তাজ্জব বনে গেলেন, কারণ এসব তাঁর ঘরের খাস চিজ, তাঁর প্রিয় পুত্র ছাড়া কাউকে তিনি শেখাননি। ভাস্কর খাঁসাহেবের পা ধরে ক্ষমা চেয়ে বললেন, এসব মাতাজির কৃপায় তিনি শিখেছেন। খাঁসাহেব বুঝলেন, তাঁর প্রিয় পুত্রের চেয়েও ভাস্কর বেশি প্রতিভাশালী, এ-ই তাঁর নাম রাখবে।

 

অবশেষে হিন্দুস্তানি মার্গ সংগীতের দুই দিকপালের খামখেয়ালি ব্যবহারের ঘটনা আলোচনা করব। ঠুংরি গানে বারানসির সিদ্ধেশ্বরী দেবী বেগম আখতারের মতোই এক বিরল প্রতিভা। তিনি একবার পুরনো দিল্লিতে এক বিবাহ-আসরে গানের মুজরায় উপস্থিত। পরিচিত শ্রোতাদের অনেকেই তাঁকে নমস্কার করে অভিনন্দন জানালেন। সিদ্ধেশ্বরী দেবী বেশ হাসিখুশি মেজাজে একটি ঠুংরি   শুরু করলেন। তাঁর সঙ্গে সংগত করছিলেন জীর্ণদীর্ণ আচকান-পরিহিত এক শীর্ণকায় তবলচি আর তেমনি বিশুষ্ক বৃদ্ধ এক সারেঙ্গি বাদক। সারেঙ্গির প্রথম টান শুনেই সিদ্ধেশ্বরী দেবী আরো যেন সজাগ হয়ে মনোসংযোগ করছিলেন, হয়তো কী গান দিয়ে শুরু করবেন ভাবছিলেন। মনস্থির করেই তিনি সংগতকারীদের নির্দেশ দিয়ে গলা সাফ করলেন ও পরিচিত ভঙ্গিতে বাঁ-কান করতল দিয়ে ঢেকে এক ঠুংরি গাইতে শুরু করলেন। জলসা জমে উঠতেই গায়িকা দাঁড়িয়ে পড়ে পায়ের ঘুঙুর বাজিয়ে গানের সঙ্গে নাচতে শুরু করলেন, তবলচি ও সারেঙ্গিবাদকও তবলা ও সারেঙ্গি গলায় এবং কোমরে বেঁধে দাঁড়িয়ে উঠে সংগত করতে শুরু করলেন, জলসাও খুব জমে উঠল।

একবার সিদ্ধেশ্বরী দেবী দিল্লির আকাশবাণী স্টুডিওতে গান রেকর্ড করতে বসেছেন। সারেঙ্গিতে যিনি সংগত করছিলেন তাঁর বাজনা চলনসই, কিন্তু মহিলাদের প্রতি অপাঙ্গে দৃষ্টিপাতের বদভ্যাস ছিল। পোশাক-পরিচ্ছদের ব্যাপারে সিদ্ধেশ্বরী দেবী কিছুটা উদাসীন ছিলেন। পরিণত বয়সে তাঁর ছিল দশাসই চেহারা। তায় সেদিন অত্যন্ত অাঁটসাঁট চোলি পরেছিলেন, যা তাঁর আব্রু রক্ষার জন্য যথেষ্ট ছিল না, কিন্তু তা অাঁচল দিয়ে ঢাকা ছিল বলে সেদিকে তাঁর বিন্দুমাত্র খেয়াল নেই। গানের সময় নড়াচড়া করতে বা তানপুরা শোনার জন্য একটু বাঁকতে বা ঝুঁকতেই তাঁর শাড়ির অাঁচল চোলির ওপর থেকে মাঝে মাঝে খসে পড়ছিল। কৌতূহলী সারেঙ্গিওয়ালা নির্লজ্জের মতো চোলির আড়ালের রহস্য উঁকি মেরে দেখার চেষ্টা করছিলেন। সারেঙ্গির দিকে তাঁর মন ছিল না, ফলে সংগতও ঠিকমতো হচ্ছিল না। এরকম বারবার হওয়ায় ক্রুদ্ধ গায়িকা বাঘিনীর মতো সারেঙ্গিওয়ালার দিকে ফিরে এক ঝটকায় অাঁচল ফেলে অবজ্ঞাভরে বললেন, ‘এতক্ষণ কেবল উঁকিঝুঁকি মারছিলে। এবার যা দেখার ভালো করে দেখে নাও। এ-পর্ব শেষ করে বাজনার দিকে মন দাও যাতে সুরে সুরে মেলে।’ সারেঙ্গিবাদকের মুখ একেবারে ফ্যাকাশে হয়ে গেল, সিদ্ধেশ্বরী দেবীর পা প্রায় ছুঁয়ে ‘ভুল বোঝাবুঝি’র জন্য ক্ষমা চাইল সে। সিদ্ধেশ্বরী দেবী জোরে হেসে ফেললেন, অন্য সংগতকারীরাও তাই। গায়িকা অবিলম্বে গানের আমেজ ফিরে পেলেন আর রেকর্ডিং হলো দুর্দান্ত।

সিদ্ধেশ্বরী দেবীকে কখনো দেশের বাইরে অনুষ্ঠান করতে বলা হয়নি বলে তিনি খুব ক্ষুণ্ণ ছিলেন। অন্য কত সংগীতশিল্পী, নৃত্যশিল্পী, যাঁদের অভিজ্ঞতা তাঁর মতো নয়, আমেরিকা, ইউরোপ, রাশিয়া, আফগানিস্তানের মতো দেশ ঘুরে এসেছেন। তাঁরা সেসব দেশের কত গল্প করেন, দামি-দামি উপহার নিয়ে আসেন। তাঁর ধারণা, তিনি স্থূলকায়া ও অন্যদের মতো সুন্দরী নন। তাছাড়া তাঁদের মতো তিনি প্রভাবশালী কেষ্টবিষ্টুদের সঙ্গে দহরম-মহরম করেন না, তাই তাঁকে উপেক্ষা করা হচ্ছিল। তিনি সবার কাছে এ নিয়ে অভিযোগ করতেন। কোনো দলের সঙ্গে বিদেশে যেতে তাঁর সায় ছিল না। তাঁর গুণমুগ্ধরা তাঁকে বোঝাতে চেষ্টা করত যে, কাউকে বিদেশে পাঠানো সরকারি কর্তাদের মর্জির ওপরই নির্ভর করে, যোগ্যতা নয়, ইত্যাদি। কিন্তু সিদ্ধেশ্বরী দেবীর বদ্ধমূল ধারণা, অত্যন্ত স্থূলকায়া বলেই তিনি বাদ পড়তেন। কৃশ হওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে তিনি এক ওজন কমাবার ক্লাসে ভর্তি হলেন ও সেখানে গোপনে যেতে শুরু করলেন। তিনি এত মোটা ছিলেন যে, ব্যায়ামের সময় বেল্ট দিয়ে তাঁর কোমর বেড় দেওয়া যেত না। একদিন তিনি ক্লাস থেকে হাঁপাতে-হাঁপাতে ফিরে এসে ধরা পড়ে গেলেন। তিনি বোঝালেন, মেদ না কমালে তাঁকে প্লেনে চড়তে দেওয়া হবে না, তাই তাঁর এত কৃচ্ছ্রসাধন।

সিদ্ধেশ্বরী দেবীর বাইরে যাওয়ার এত আগ্রহ দেখে তাঁর কিছু ভক্ত ও আকাশবাণীর কর্মকর্তা অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে তাঁর বিলাতে যাওয়ার বন্দোবস্ত করলেন। যাতায়াত, বিলাতে এক মাসের থাকা-খাওয়া, অনুষ্ঠান করা ইত্যাদি যাবতীয় ব্যবস্থার জন্য এক এজেন্ট নিযুক্ত হলো। সিদ্ধেশ্বরী দেবীর মতো শিল্পী পেয়ে সে যেন হাতে স্বর্গ পেল। এজেন্টটি যেমন নির্ভরযোগ্য নয়, তেমনি সফরের শর্তও অনুকূল নয়; কিন্তু আর কোনো উপায়ও ছিল না। সিদ্ধেশ্বরী দেবীর ইংরেজি জানা মেয়েরও তাঁর সঙ্গে যাওয়া ঠিক হলো। উল্লসিত শিশুর মতো সিদ্ধেশ্বরী দেবী অনেক আগে থেকেই সফরের তোড়জোড় শুরু করলেন। নির্দিষ্ট দিনে তাঁর ভক্তগণ তাঁকে বিমানবন্দর পৌঁছে দিয়ে বিদায় জানালেন।

এক সপ্তাহ পরে সিদ্ধেশ্বরী দেবী দিল্লি ফিরে এলেন। তাঁর নিশ্চয়ই গুরুতর অসুখ বা দুর্ঘটনা জাতীয় কিছু অঘটন ঘটেছে আশঙ্কা করে তাঁর অনুরাগীরা ছুটলেন তাঁর কাছে। তাঁদের দেখে সিদ্ধেশ্বরী দেবী দুহাত দিয়ে দুকান মলে মাথা নেড়ে বললেন, ‘রাম, রাম, রাম! ওখানকার লোক এত নোংরা। আর কোনো দিন বিলাত যাচ্ছি না বাবা।’ তাঁর অনবদ্য ভাষা ও ভঙ্গিতে যা বললেন তার সারমর্ম এরূপ :

জঘন্য এক ইংরেজ ডাইনির বাড়ির দোতলায় একটি ঘরে তাঁদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল। এত লম্বা সফরের পরে স্নান করতে চাওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু স্নানের ঘরে যদি কার্পেট থাকে তো এরা কি আদৌ জল ঢেলে স্নান করে? তাছাড়া না আছে বালতি, না লোটা, না বসার পৈঠা, না পা ঘষার কিছু। এক্কেবারে কিচ্ছু নেই। আছে শুধু ফুলের নকশার কার্পেট! একটা দেয়াল বরাবর কফিনের মতো দেখতে সাদা লম্বা একটা গামলা। ঘরে একটা প্লাস্টিকের মগও ছিল। তাঁর মেয়ে বলল, গামলাটা বালতির মতো জলে ভরে নিয়ে তা থেকে মগে করে ও আমার মাথায় জল ঢেলে দিলেই তো হয়। তা তো হলো, কিন্তু তিনি বসবেন কোথায়? মেয়ে বলল, ওখানকার লোকে গামলায় বসে ওদেরই গায়ের নোংরা জল নিজের ওপর ছিটায়। রাম, রাম, সিদ্ধেশ্বরী দেবী কি তা করতে পারেন? তাঁর চাই সাফবহতা জল, তাঁর গানের ছনদ ও তানের মতোই তা ঝম-ঝম-ঝম ঢালবেন, তবেই না।

মায়ের কথামতো মেয়ে মেঝের কার্পেট গুটিয়ে একদিকে রাখল। তার নিচে কাঠের পাটাতন। সিদ্ধেশ্বরী দেবী তাতে বসে বেসন দিয়ে মাথা ঘষলেন, তারপর মেয়ে জল ঢেলে দিলো। স্নান চমৎকার সারা হলো। আর তখুনি নিচের তলা থেকে চেঁচামেচি ও ধড়াম ধড়াম আওয়াজ। মেয়ে জানাল, স্নানের জল চুঁইয়ে নিচে রান্নাঘরে স্টোভে চড়ানো মাছের স্টিউর ওপর পড়ায় বাড়িওয়ালি ডাইনি রেগেমেগে জানতে চাইছিল ওপরে কী হচ্ছিল।

পরদিন মেয়ে একমেবাদ্বিতীয়ম মগটি সিদ্ধেশ্বরী দেবীর শৌচকর্ম ও স্নান উভয় কাজে ব্যবহারের জন্য বলায় তিনি মেয়ের ওপর চটে লাল। বললেন, জায়গার দোষে সেও শুচিতা ভুলে গেছে। জলের বদলে কাগজ ব্যবহার করার রীতি শুনে তিনি ভাবতেই পারছিলেন না, বিলাতের লোক এত নোংরা থাকে কী করে। বাড়িওয়ালির কাছ থেকে আরেকটি মগ চেয়ে মেয়েকে পাঠাতেই সে দুমদুম করে সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠে এলো। দুটি মগ চাওয়ার রহস্য জানতে পেরে সে শৌচের জন্য হাত ব্যবহার করার মতো জঘন্য রীতির কথা শুনেই মূর্ছা গেল ও ধপ করে একটা চেয়ারে এলিয়ে পড়ল।

সেদিন সন্ধ্যায় গানের জলসায় সামনের সারিতে কয়েকজন লালমুখো সাহেব দেখে সিদ্ধেশ্বরী দেবীর সকালের ঘটনা বারবার মনে পড়ছিল। যারা এত নোংরা থাকে, তাদের গান শোনাতে হবে ভেবে তিনি কিছুতেই গানে মনোসংযোগ করতে পারলেন না। তিনি এর পরের সব অনুষ্ঠান বাতিল করলেন, এজেন্টকে অনেক টাকা গুনাহগার দিয়ে নিস্তার পেয়ে দেশে ফিরে এলেন; এর পরে আর কখনো বিদেশে যাবেন না বলে প্রতিজ্ঞা করলেন।

ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলি খান তাঁর বিশেষ শৈলী এবং সুরেলা অথচ দরাজ শক্তিশালী কণ্ঠস্বরের জন্য হিন্দুস্তানি সংগীত-জগতে অত্যন্ত জনপ্রিয় গায়ক ছিলেন। হিন্দুস্তানি সংগীতে কণ্ঠস্বর, তান ও স্বরনিক্ষেপ কলা আয়ত্ত করা দীর্ঘকালব্যাপী কঠিন সাধনাসাপেক্ষ। তাছাড়া প্রতিষ্ঠিত গায়ককেও নিয়মিত নিরলস অভ্যাস (রেওয়াজ) করতে হয়। খানসাহেবের গুরু ছিলেন তাঁর পিতৃব্য ওস্তাদ কালে খান। শিষ্য প্রথমে কোনো কোনো তান যথাযথ করতে অসমর্থ ছিলেন। ফলে তাঁকে গুরুর নির্দেশ অনুযায়ী লাহোর শহরের বাইরে কোনো আমরাস্তার ওপরে অবস্থিত এক প্রাসাদোপম মসজিদের সামনে খোলা রাস্তার পাশে উন্মুক্ত কণ্ঠে স্বরসাধনা করতে হতো। প্রথম দিন গুরু ও শিষ্য উভয়ে মসজিদের প্রকান্ড প্রাচীরের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পড়লেন। গুরুর আদেশ অনুযায়ী শিষ্য গাইতে শুরু করলেন। তিনি সামনের দেয়াল থেকে তাঁর স্বরের প্রতিধ্বনি শুনতে পেলেন। এবার গুরু নিজেই গাইতে শুরু করলেন আর মাঝে মাঝে থেমে শিষ্যকে ওই গানের প্রতিধ্বনি শুনতে বললেন। শিষ্য লক্ষ্য করলেন যে, গুরুর কণ্ঠস্বর ও তার প্রতিধবনি উভয়ই একেবারে নিখুঁত। শিষ্যও গুরুর অনুকরণ করলেন কিন্তু প্রতিধ্বনি শুনে বুঝতে পারলেন, তা গুরুর মতো নিখুঁত হয়নি। এরপর থেকে ওই মসজিদ হলো খানসাহেবের নিয়মিত রেওয়াজের প্রিয় স্থান। মসজিদটি শহরের বাইরে হওয়ায় তিনি খুব উঁচু গলায় গাইলেও কেউ আপত্তি করত না।

শহরের বাজারে বেচার জন্য গ্রাম থেকে শস্য, শাকসবজি-বোঝাই বহু গরুগাড়ি ওই রাস্তা দিয়ে চলত। তাদের চালক বেশিরভাগই গ্রামের চাষি। তারা অনেক সময় মসজিদের দেয়াল ঘেঁষে বসে জিরোত ও রুটি খেত। খানসাহেবকে উচ্চৈঃস্বরে নিবিষ্টমনে রেওয়াজ করতে দেখে তারা ধরে নিত, উনি নিশ্চয়ই কোনো পাগল ফকির, তাই তাঁকে নিয়ে একটুও মাথা ঘামাত না। একদিন কয়েকজন শিখ গাড়োয়ান জিরোবার জন্য সেখানে বসে খানসাহেবের কান্ড দেখে ভাবল, পাগলা গায়ক ওদের সঙ্গ পছন্দ করছে না, তাই ইচ্ছা করেই তারস্বরে চেঁচাচ্ছে। তারাও পাল্লা দিয়ে তারস্বরে গাইতে শুরু করল। তাদের ‘গান’ যেই একটু থামত, খানসাহেব অমনি তাঁর রেওয়াজ শুরু করতেন। আধঘণ্টা ধরে দুপক্ষের গানের লড়াই চলল কিন্তু খানসাহেব হার মানতে নারাজ। অগত্যা শিখ গাড়োয়ানরা হাল ছেড়ে দিলো আর খানসাহেব তাঁর রেওয়াজ করতে থাকলেন।

খানসাহেবের মতে, দুনিয়া বহু সুন্দর জিনিসে ভরপুর। যা কিছু তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করত তিনি তা তাঁর সঙ্গীদের মাধ্যমে প্রকাশ করতেন। তিনি হয়তো নদীর পাড়ে বা কোনো বাগানে বসে আছেন, দেখছেন পাখিরা কোনোদিকে দৃকপাত না করে আপনমনে ইতস্তত উড়ছে। কোনো পাখি হয়তো আচমকা উড়ে বেশকিছু দূর উঠে হঠাৎ ঝাঁপ দিয়ে নিচে নেমে কোনো গাছে তার নিজের বাসায় পৌঁছে গেল। খানসাহেব মুগ্ধ হয়ে পাখিদের খেলা দেখতেন। কখনো তাঁর খেয়াল হতো, পাখিদের খুশিভরা ওড়ার খেলা তাঁর গানে কি বোঝানো যায় না? তিনি কোনো তান বেছে নিয়ে তা অতিদ্রুত উঁচু পর্দায় তুলে আবার তা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নিচে নামিয়ে খেলতে লাগলেন, যেমন পাখিরা করে। তিনি মনে করতেন, যে-কোনো স্থানে, যে-কোনো সময়ে রেওয়াজ করতে বাধা নেই। যে-কোনো জল দেখে, তা যে-কোনো জলাশয় যেমন নদী, সরোবর বা সমুদ্র হোক বা বৃষ্টির জল হোক, খানসাহেব উল্লসিত হতেন, জলের তরঙ্গের ছন্দে সুরে সুর মিলিয়ে রেওয়াজ করতেন। সমুদ্রের কোনো প্রকান্ড ঢেউ যখন ভেঙে আছড়ে পড়ত, তিনি হয়তো মিয়া কি মল্লার রাগে গান শুরু করলেন, তাঁর সুর ও তান ঢেউয়ের তালে তাল মিলিয়ে উঁচু-নিচু পর্দায় ওঠানামা করত, এমনই ছিল তাঁর প্রকৃতির সঙ্গে সংগীতের সহজ সমন্বয়।

খানসাহেব ছিলেন সৌন্দর্যের পূজারি, তা সে প্রকৃতিরই হোক কি মানুষের। একদিন তিনি মুম্বাইয়ের চৌপাট্টি ময়দান দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন, সঙ্গে পন্ডিত দেওধর। এমন সময় এক অষ্টাদশী পাঞ্জাবি তরুণী একই দিকে হেঁটে যাচ্ছিল। তার সুষমা, সৌন্দর্য ও চলার লীলায়িত ভঙ্গি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করছিল। মুগ্ধ খানসাহেব পা টিপে টিপে তরুণীর পেছনে গিয়ে তার অনুসরণ করলেন। পন্ডিত দেওধর তাঁর কাঁধে হাত দিয়ে ঠাট্টা করে বললেন, খানসাহেবের আগের দিনের ব্রহ্মচর্য সম্বন্ধীয় ভাষণের কী হলো। খানসাহেব সহজভাবে বললেন, ‘আমি কী দেখছি, কী চিন্তা করছি, তা হয়তো আপনি বুঝতে পারছেন না। দেখুন, ভগবান তরুণীটিকে কত সুন্দর করে গড়েছেন; মুগ্ধ পথচারীরা ওর সৌন্দর্য, চলার ভঙ্গি দেখে চোখ ফেরাতে পারছে না কিন্তু ওর সেদিকে কোনো খেয়াল নেই।’ গন্তব্যস্থানে পৌঁছে খানসাহেব একটি ঠুংরি গেয়ে তরুণীর সৌন্দর্য, চলার ছন্দ ও ভঙ্গি প্রাণবন্তভাবে ফুটিয়ে তুললেন।

খানসাহেব অত্যন্ত খামখেয়ালি ছিলেন। কোনো মজলিশে তাঁর গান মেজাজের ওপর নির্ভর করত; মেজাজ ভালো থাকলে চমৎকার গাইতেন। কিন্তু যে-কোনো কারণে, যেমন মসলিশের কর্মকর্তাদের ব্যবহার, পরিবেশ, সংগত বা দর্শক মনের মতো নিখুঁত না হলে তাঁর মেজাজ বিগড়ে যেত, কোনোক্রমে গান সেরে তিনি তৎক্ষণাৎ মজলিশ ছেড়ে চলে যেতেন। একবার কোলহাপুরে এক মজলিশে গাইবার সময় তবলা তাঁর মনমতো ছিল না। তিনি বুঝলেন, সে-রাতের গান তাঁর মনের মতো হয়নি। ফলে মেজাজ বিগড়ে গিয়ে তিনি একটি খেয়াল ও কয়েকটি হালকা গান করেই উঠে পড়লেন। মজলিশ থেকে রাত আড়াইটা নাগাদ তিনি সরাসরি তাঁর আশ্রয়স্থান দেবাল ক্লাবে চললেন, পিছে পিছে পঞ্চাশ-ষাটজন শ্রোতাও সেখানে হাজির। তিনি তাঁর অনুগামীদের বারান্দায় বসতে বলে গান গাইতে শুরু করলেন। খানসাহেবের কোলে তাঁর প্রিয় স্বরমন্ডল আর তবলার অভাবে তাঁর নির্দেশমতো এক সাগরেদ একটি ডেকচি নিয়ে সংগত করতে লাগল। সকাল ছটা পর্যন্ত খানসাহেব গেয়ে চললেন। থিয়েটারের দর্শকরা বাড়ি ফেরার পথে তাঁর গলা শুনে দেবাল ক্লাবে এসে তাঁর গান শেষ না হওয়া পর্যন্ত শুনল, কারো যেন বাড়ি ফেরার তাড়া নেই। বেলগমেও অনুরূপ একটি ঘটনা। মজলিশে খানসাহেবের অনুষ্ঠান তাঁর মনমতো হয়নি। সকাল ৫টায় মুম্বাইয়ের ট্রেন ধরার তাগিদ ছিল, তাই তিনি সরাসরি রেলস্টেশনে উপস্থিত হলেন। গানের সমঝদার বেশ কিছু শ্রোতাও তাঁকে অনুসরণ করল। প্রসিদ্ধ তবলাবাদক ওস্তাদ তিরকাওয়াও রেলস্টেশনে উপস্থিত ছিলেন। রাত ৩টায় খানসাহেব গান শুরু করলেন, তবলা সংগতে তিরকাওয়া। সবাই দিব্যি প্ল্যাটফর্মেই বসে পড়ে ট্রেন না আসা পর্যন্ত খানসাহেবের গান শুনল। ভিড় বাড়তে বাড়তে প্রায় দুশো শ্রোতা জমায়েত হলো। অর্থের বিনিময়ে মজলিশে গাওয়া গানের চেয়ে খোলা প্ল্যাটফর্মে খানসাহেবের স্বতঃস্ফূর্ত বিনে পয়সার গানের আসর বেশি জমেছিল।

 

তথ্যসূত্র

১।      ‘ঠাকুরবাড়ীর পাগল কাহিনি’, পার্থসারথি চট্টোপাধ্যায় (বর্তমান শারদ সংখ্যা, ১৪১৮)।

২।      Here’s Someone I’d like You to Meet : Tales of Innocents, Musicians and Bureaucrats Sheila Dhar (Oxford University Press, 1995).

সিদ্ধেশ্বরী দেবীর কাহিনি স্বর্গত শীলা ধরের কাছে শোনা তাঁর স্মৃতিচারণ ও উল্লিখিত গ্রন্থ অবলম্বনে।

৩.      Pillars of Hindustani Music, B. R. Deodhar,  English Translation by Ram Deshmukhi (Popular Prakashan Private Limited, 1993).

৪।      আমার কথা : ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, অনুলেখক শুভময় ঘোষ (আনন্দ, ২০১০)।

৫।             কুদরত রঙ্গিবিরঙ্গী, কুমার প্রসাদ মুখোপাধ্যায় (আনন্দ পাবলিশার্স, ১৯৯৪)।