ফাদার দ্যতিয়েন : তাঁর গদ্য

মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

 

 

ফাদার দ্যতিয়েন সদ্য একানববইতে পড়লেন গত ৩০.১২.২০১৪তে। এই বয়সেও তিনি দ্রুতগতিতে হাঁটেন, পরোটাসহ খাসি হজম করেন, খালিচোখে লেখাপড়া করেন। না, কস্মিনকালেও শরীরচর্চা করেননি, আর খেলাধুলোও তাঁর জীবনযাপনের অঙ্গ ছিল না কোনোদিন। এসবের কারণ জানতে চাইলে তিনি নিজেই আশ্চর্য হয়ে গিয়ে উত্তর দেন, ‘আশ্চর্য!’

নববই-পেরোনো সক্রিয় মানুষ দেখার অভিজ্ঞতা তো আছেই আমাদের, – অন্নদাশঙ্কর রায়, হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, নীরদ সি চৌধুরী। হ্যাঁ, জীবৎকালে আত্মশতবর্ষও দেখে গেছেন কেউ-কেউ, – মধুসূদন, সরস্বতী, লালন ফকির, মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন। আমরা ফাদার দ্যতিয়েনকেও শতায়ু দেখতে চাই।             যে-বিস্ময়করতায় তাঁর বাংলা রচনায় তিনি আমাদের মুগ্ধ করেন, তাতে আশা করি এ-দাবি অন্যায্য নয়।

বাংলাভাষার নিষ্ঠ সেবক দ্যতিয়েন কথা প্রসঙ্গে আমাকে বলেছিলেন, একটি বাক্য রচনার পর পরিপূর্ণ তৃপ্তি না আসা পর্যন্ত তিনি দ্বিতীয় বাক্যটি লেখেন না। বাক্যে ব্যবহৃত প্রতিটি শব্দের প্রতি তাঁর আবেগ এবং সচেতনতা কাজ করে। তৎসম শব্দের সঙ্গে দেশি শব্দের মেলবন্ধনে বাক্যে কোনো আড়ষ্টতা এলো কিনা, বা লেখায় ছন্দস্পন্দ বজায় আছে কিনা, এসব দেখতে-দেখতে তাঁর গদ্য অগ্রসর হয়। লালিত্য, প্রসাদগুণ, সরসতা আর বুদ্ধির দীপ্তির মিলিত প্রবাহ তাঁর গদ্য।

একটু উদাহরণ দেওয়া যাক। ২৬.৭.১৯৬৯ সংখ্যার দেশে তিনি লিখছেন (পরে ডায়েরির ছেঁড়াপাতা নামে বই হয়ে বেরোয়) – ‘আজকালকার দিনে দেখি আধুনিক পরিচালকের অ্যান্টিফিলম, আধুনিক শিল্পীর অ্যান্টিচিত্র… সেদিন কুমোরটুলির মন্টু আমায় গোটা কতক স্বরচিত কবিতা শোনাতে এসেছিল – কিসসু বুঝিনি; ঢোঁক গিলে ‘লাইনগুলোর মানে কী?’ জিজ্ঞেস করতেই পান্ডিত্যপূর্ণ ভারিক্কি গলায় সে বলল, ‘জানেন না, বুঝি? এগুলো অ্যান্টি-পোয়েট্রি।’ একজন বিদেশীর পক্ষে এই রকম তৎসম-তদ্ভব দেশী-বিদেশী শব্দ প্রয়োগের কারুকৃতি লেখকের ভাষাপ্রীতি ও সে-ভাষায় মুনশিয়ানার পরিচয় দেয়। খেয়াল রাখতে হবে, লেখক ‘কিসসু’ লিখছেন, ‘কিছু’ নয়। কানকে খুব দৃঢ়তার সঙ্গে সজাগ রাখলেই বিদেশীর পক্ষে এই রকম সাহসিক প্রয়োগ সম্ভব।’

হ্যাঁ, ভাষার মুনশিয়ানা। এজন্য তিনি বাংলাভাষা শিখতে দশ বছরের ওপর ব্যয় করেছেন, মিশেছেন হাটবাট-ঘাটের মানুষের সঙ্গে, নোটবই রেখেছেন সঙ্গে, নতুন শব্দ শুনেই লিখে রাখতেন, শব্দের যথার্থ অর্থ জেনে নিতেন বক্তার মুখ থেকে। বাংলা গদ্যের নিবিড় পাঠ নিয়েছেন, উনিশ শতকের গোড়াকার গদ্য থেকে সাম্প্রতিকতম গদ্যের হালহকিকত তাঁর নখদর্পণে।

ডায়েরির ছেঁড়াপাতা আর রোজনামচা তাঁর দুটি বিখ্যাত গ্রন্থ।  তাছাড়া ছোট রাজকুমার নামে অনুবাদের বইও রয়েছে তাঁর। এটি একটি ফরাসি রূপকথার বই।

ফাদার দ্যতিয়েন প্রাথমিকভাবে ধর্মের সূত্রেই এদেশে আসেন। কলকাতায় আসেন ১৯৪৯-এ, লন্ডন থেকে বোম্বাই (ইদানীং মুম্বাই) ষোলোদিনের জাহাজপাড়ি ও সেখান থেকে ট্রেনে। কলকাতা, শ্রীরামপুর ও বিশ্বভারতীতে (শান্তিনিকেতন) বাংলা শেখেন তিনি। মধ্যপর্বে সুনদরবন অঞ্চলে শিক্ষকতার কাজেও নিয়োজিত ছিলেন।

আবু সয়ীদ আইয়ুব দ্যতিয়েনের বাংলারচনার মূল্যায়ন করতে গিয়ে বলেছেন, বাংলায় অবাঙালিদের সেরা প্রতিনিধি তিনি এবং ফাদার দ্যতিয়েন। এর সঙ্গে আরো যোগ করা যায়, বিদেশি যেসব বাংলাভাষাসেবী, উইলিয়াম কেরি থেকে শুরু করে হানা ক্যাথারিন ম্যালেনস, মার্টিন কেম্পশেন, দানিলচুক, ভেরা নোভিকোভা, উইলিয়াম রাদিচে, কাজুও আজুমা, তাদের বাংলা রচনা বনাম দ্যতিয়েনের, প্রতি তুলনায় তাঁকে সর্বাগ্রগণ্য বলে মানতেই হবে।

আমরা চীনদেশীয় বাংলাপ্রেমী রবীন্দ্র পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখক দং ইউ চেনের রচনা থেকে খানিক উদ্ধৃতি দিয়ে বিষয়টি স্পষ্ট করতে চাই। দং ইউ চেন তাঁর ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও চীনদেশ’ প্রবন্ধে (কার্তিক মোদক-প্রকাশিত সীমান্ত সাহিত্য, ৫৯ বর্ষ, ২০১২) লিখছেন, ‘উনিশশ বিংশ সালে শাংহাই খাই-দং প্রকাশনালয় রবীন্দ্রনাথের গল্পগুচ্ছ প্রকাশিত করেছিল।… রবীন্দ্রনাথ বাংলা-ভাষার মহান কবি, চীনা জনগণের মাঝে তিনি প্রিয়তম কবি ও মহান বন্ধু।’ পড়লেই বোঝা যায়, লেখা খুবই শিথিলভঙ্গিতে। অন্যদিকে দ্যতিয়েন রবীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গেই একস্থানে লিখেছেন তাঁর নিজস্ব ভাষা বৈদগ্ধ্যে, ‘…জন্মসূত্রে ব্রাহ্মসমাজভুক্ত হলে কী হবে, কবিগুরু ঈশ্বরের উভয়লিঙ্গ স্বীকার করেছেন; জননী, তোমার করুণ চরণখানি…। তাঁর রচিত জাতীয় সংগীতেও ভারত ভাগ্যবিধাতা দেখা দিয়েছেন স্নেহময়ী মাতারূপে। পাশ্চাত্য জগতে অনাস্বাদিত এই সংবোধনের মূল্য হৃদয়ঙ্গম করতে করতে আমিও ঈশ্বরকে নিঃসঙ্কোচে মা বলে ভাবতে শিখেছি।’ এ-গদ্যভাষা স্বভাবতই স্বতন্ত্র।

ফাদার দ্যতিয়েন সম্পর্কে ভাষাচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের প্রশস্তি রচনাটি এরকম, ‘I thank you for drawing out some of the hidden powers of my mother tongue in such a beautiful and convincing way, that Bengali is such an expressive language is once again demonstrated by your perfect little notes and observations.’ ২৯.৪.১৯৭৫-এর লেখাটিতে সুনীতি কুমার দ্যতিয়েন সম্পর্কে এ-ও লেখেন, ‘It is remarkable how you have made a complicated language like Bengali so much your very own?’

আর দ্যতিয়েন তাঁর নিজের বাংলাভাষা শিক্ষা এবং সে-ভাষায় লিখতে গিয়ে তাঁর বিবেচনাসমূহ পেশ করেন এভাবে, ‘তৎসম-তদ্ভব দেশি-বিদেশি শব্দ সংমিশ্রণের মধ্যে দোষ তো দূরের কথা, মজার খেলার সম্ভাবনাপ্রাচুর্য প্রথম থেকেই দেখেছি। খেলা বটে, তবে সার্কাসের ছাদে ঝুলন্ত নর্তকীর ক্রীড়ার মতো বিপজ্জনক খেলা। সুনিপুণ হস্তে চালিত হলে সাহিত্যিক অলংকার পর্যায় উত্তোলিত হতে পারে। জিজ্ঞাসা এই, আমার হাত ওই খেলাটায় কতখানি দক্ষ?’

দক্ষ, দক্ষ। ল্যাটিন, গ্রিক, সংস্কৃত, হিব্রু, ফরাসি, ইংরেজিতে সু-অধীত দ্যতিয়েনের ভাষাবিজ্ঞতা প্রশ্নাতীত। নিজস্ব অনুপম এক স্টাইল তৈরি করেছেন তিনি, যা একাধারে বুদ্ধিদীপ্ত এবং অন্যদিকে সরস ও সাবলীল। একটু উদাহরণ, ‘ভারতে আছে লরি-সাহিত্য, বাংলাদেশে আছে রিকশা কলাশিল্প।… ঢাকায় সাইকেল রিকশার সংখ্যা আল্লাই জানেন। সরকারি হিসেবে কুড়ি হাজার, সাধারণ শুমারিতে তেত্রিশ। প্রতিটি রিকশা আবার রাজপুতানিসুলভ                 রং-বেরঙে সজ্জিত।… আমার রিকশার নম্বর ১৮০১৪, রিকশাওয়ালার নাম নাসিরুদ্দীন; উভয়েরই হাঁপানি আছে।’ প্রসঙ্গত বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই ১৯৭২-এ ঢাকা যান তিনি। ২০১৫তে আবার যোগ দিতে আসেন ঢাকায়, আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলনে।

তাঁর এইবারের ঢাকা-আগমনে আমার কিঞ্চিৎ ভূমিকা রয়েছে বলে তৃপ্তি পাচ্ছি। ২০১৪-এর কলকাতা বইমেলায় বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান যোগ দিতে এলে আমি তাঁকে দ্যতিয়েনের ই-মেইল দিয়ে তাঁকে ঢাকায় আনার আবেদন জানাই। এরই ফলে ফাদারের ঢাকা আগমন।