বইপত্র

তিন পতাকা

এক জীবন

সাজ্জাদ শরিফ

 

জীবনের বালুকাবেলায়

ফারুক চৌধুরী

 

প্রথমা প্রকাশন

ঢাকা, ২০১৪

 

৭৫০ টাকা

 

 

ফারুক চৌধুরী তাঁর বই শুরু করেছেন খুবই সাবধানে। জীবনের বালুকাবেলায় বইটি তিনি শুরুই করেছেন উৎসাহী পাঠকের অত্যধিক প্রত্যাশার গায়ে পানি ঢেলে দিয়ে। পাঠককে সতর্ক করে দিয়ে তিনি বলেছেন :

প্রথাগত অর্থে এই বই কোনো আত্মজীবনী নয়। আমার মতো একজন সাধারণ জীবনযাপনকারীর পক্ষে তা লেখা ধৃষ্টতাই হবে। আকাশে আমার উড্ডয়নের কোনো ইতিহাস রচনার ক্ষমতা থেকে আমি বঞ্চিত রয়ে গেছি। এই বইয়ে আমার জীবনকে কেন্দ্র করে আমার অনুভূতি আর অভিজ্ঞতার পরতে পরতে কতগুলো বৃত্ত রচনার প্রয়াস নিয়েছি। তা-ও সব সময় আমার জীবনের চলার পথের ক্রমান্বয়তায় যে করেছি, তা নয়। আমি তা করেছি জীবনের বালুকাবেলায়, ইতস্তত বিচরণ করে গল্প বলার অবাধ স্বাধীনতায়।

কোনো পরিসরে বিস্তৃত হলে যে স্মৃতিকথার আত্মজীবনীতে উত্তরণ ঘটে, সে বড় জটিল ও সূক্ষ্ম বিতর্ক। আত্মজীবনী বিচিত্র। গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের আত্মজীবনী বিপুল, কমলা দাসের চটি। জাঁ জাক রুশোর আত্মজীবনী নিজের সম্পর্কে নেতির প্রচারে উন্মুখ, পাবলো নেরুদার অকপট, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়েরটি সতর্ক ও আংশিক উন্মোচিত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আত্মজীবনীতে নির্জলা ঘটনাবস্ত্তর পরিমাণ অতি-সামান্য, তা যেন অন্তর্লোকের দীপ্তিময় উন্মেষের এক বস্ত্তভারহীন বিবরণ।

আত্মজীবনীর এই বিচিত্র প্রকারের মধ্যে জীবনের বালুকাবেলায়ও নিজের মতো একটি পথ করে নিয়েছে। বরং লেখক যা দাবি করেছেন, তার সবটা আক্ষরিক অর্থে যথার্থও নয়। ইতিহাস-কাঁপানো যে বিপুল ঘটনাবর্ত ও ব্যক্তিত্বরাশির মধ্য দিয়ে ফারুক চৌধুরীর জীবন প্রবাহিত হয়েছে, সেটি তাঁকে আর নিছক ‘একজন সাধারণ জীবনযাপনকারী’ হয়ে থাকতে দেয়নি। তাঁর             এ-রচনাও নিছক ‘ইতস্তত বিচরণে’র গল্পমাত্র নয়; সময়ের অনুক্রমে, পর্বে পর্বে, যথেষ্ট পরিমাণে ‘জীবনের চলার পথের ক্রমান্বয়তায়’ই এটি সাজানো।

তারপরও লেখকের এই সতর্কতার কারণ কী? আত্মজীবনীর ভরকেন্দ্র একজন ব্যক্তির মন। সেখানে একটি কালখন্ড, সামাজিক পরিসর ও আরো অসংখ্য ব্যক্তির উপস্থিতি থাকে বটে – সেটি থাকতে বাধ্য, কারণ সমাজের বাইরে ব্যক্তি নেই এবং অন্যদের জীবনের সাপেক্ষেই একজন ব্যক্তির জীবন আকার পায়; কিন্তু আত্মজীবনীতে তাদের বিচ্ছুরণ ঘটে একজন ব্যক্তির মনের প্রিজমের মধ্য দিয়েই। এতে ব্যক্তিচৈতন্যের নিরিখই মুখ্য। ইতিহাসে আমরা পাই একটি সময়ের সামান্য বর্ণনা, অসংখ্য মানুষের বিচিত্র টানাপড়েনে রচিত সেই সময়ের নিরঞ্জন উদ্ভাস। আত্মজীবনীতে ব্যক্তির মন সে-সময়টিকে রাঙিয়ে দেয়। ঘটনার তলায় চাপাপড়া মানুষের অন্তরের মূল্য সেখানে প্রধান।

বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে এ-উপমহাদেশের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ বিচিত্র উপায়ে তাদের রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা রূপ দিতে চেয়েছে। তার ফল হিসেবে এ-উপমহাদেশে কখনো রক্তগঙ্গা বয়ে গেছে, কখনো অপরিসীম আশা সঞ্চারিত হয়েছে। তিন দশকেরও কম সময়ের মধ্যে এর মানচিত্র বদলেছে দুবার। ক্রমশ নিবিড় হয়ে আসা আত্মস্বার্থে উন্মুখ নানা দেশও উপমহাদেশের এই রাজনৈতিক ব্যাপারে জড়িয়ে পড়েছে নানাভাবে। পেশার সূত্রে ফারুক চৌধুরী উত্থান-পতনময় এ-ইতিহাসের বিচিত্র ঘটনার সাক্ষী হয়ে আছেন। সেসব ঘটনার ঘনঘটা, প্রভাব ও ভার এতই বেশি যে, সেগুলোই হয়ে উঠেছে তাঁর এ-বইয়ের কেন্দ্রভূমি। একটু এগিয়ে বরং এ-কথা বলা যায় যে, সেসব ঘটনার যে-অংশবিশেষ ফারুক চৌধুরীর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় ধরা পড়েছে, তা এ-বইটির মূল আকর্ষণ। নিজের এ অনন্য অভিজ্ঞতার কথা লেখক নিজেও বিলক্ষণ জানেন। এ-বইটিতে তিনি তাই সেসব ঘটনাকে ছাপিয়ে যাওয়ারও চেষ্টা করেন। বইয়ে নিজের জীবনটিকে তিনি সাজিয়েছেন সেসব ‘অভিজ্ঞতার পরতে পরতে কতগুলো বৃত্ত রচনার’ পরিকল্পনা নিয়েই।

জীবনের বালুকাবেলায় বইটির প্রথম কিছু অধ্যায়ে ফারুক চৌধুরী দ্রুত তাঁর শৈশব-কৈশোর-তরুণ বয়সের জীবনপর্বগুলো পার করে এসেছেন। আসাম, শিলং, সিলেট ও ঢাকায় ছড়ানো  সে-জীবনের বর্ণনা অনুপম ও অসামান্য। এক নিস্তরঙ্গ সমাজপটে আত্মীয়-পরিজন, বন্ধু ও শিক্ষক-পরিবেষ্টিত এক জীবন। রাজনৈতিক বিভঙ্গে ভেঙে যাচ্ছে সে-স্থিরতা। বাবার চাকরিসূত্রে বা নতুন দেশ বরণ করে নেওয়ার সূত্রে লেখক সপরিবারে ছুটছেন এক স্থান থেকে অন্যত্র। কিশোর লেখকের কাছে এর সবটাই আনন্দময় উত্তেজনার, নতুনের সঙ্গে পরিচয়ের। লেখকের দৃষ্টি এখানে ইতিহাসে নয়, একান্তে। ইতিহাসের খাত বেয়ে অবিভক্ত পূর্ব ভারত থেকে সদ্যোজাত পূর্ব পাকিস্তানে এক পরিবারের যাত্রার অস্ফুট ছবি এখানে ফুটে উঠেছে ইশারাভরা কোমল ও স্নিগ্ধ ভাষায়। রাজনীতির মহাতরঙ্গ কীভাবে ব্যক্তিমানুষের তটে আছড়ে পড়ে প্রবল বা প্রচ্ছন্নভাবে তার জীবনধারার ছক পালটে দেয়, বাংলার পটে এ তার এক অনন্য চিত্র।

ছোট ছোট দুটো অধ্যায়ে দ্রুত অাঁচড়ে কিন্তু পরম মমতায় মা ও বাবার চেহারার একটি আভাস ফারুক চৌধুরী রচনা করেছেন। বেশ আন্দাজ করা যায়, চাকরিসূত্রে বাবার স্থানান্তরণ যেমন লেখকের শৈশব-কৈশোর জীবনকে আন্দোলিত করেছে, তেমনি তাঁর রসবোধ ও পাঠরুচি লেখককে প্রভাবিত করেছে ভেতর থেকে। বস্ত্তত প্রথাগত অর্থে লেখক না হলেও ফারুক চৌধুরীর ভাষাব্যবহার, বর্ণনার কুশলতা এবং কোনো ঘটনার বর্ণনায় পাঠকের কৌতূহল জাগিয়ে রাখার ক্ষমতা অতুলনীয়। এ সম্ভবত সেই পাঠরুচিরই গভীরতর প্রভাব। আর রসবোধে তো ফারুক চৌধুরীর জুড়ি মেলা ভার। বইটির ছত্রে ছত্রে ছড়িয়ে আছে তাঁর বুদ্ধিদীপ্ত স্নিগ্ধ কৌতুক। এই কৌতুকরসের তীরে তিনি নিজেকেও বিদ্ধ করেন বলে এর আবেদন আরো বেড়ে যায়।

দু-একটি উদাহরণ না দিলেই নয় :

মনে পড়ে রসায়নশাস্ত্রে আমার জ্ঞান আহরণের চরম ব্যর্থতার করুণ ইতিহাস। বাবার ইচ্ছে ছিল ডাক্তার হব। হলে, ঢাকার বর্তমান দুঃখজনক চিকিৎসাব্যবস্থার অবনতিতে আমার অবদান হতো সুনিশ্চিত। ডাক্তারি দূরের কথা, ইন্টারমিডিয়েটের রসায়নশাস্ত্রে সামান্যতম জ্ঞানলাভেও আমার ছিল অপারগতা ও অনীহা। আমার সহপাঠীরা গবেষণাগারে যখন ধাতব লবণের ধাতু (বেসিক         র‌্যাডিক্যাল) এবং অম্লীয় যৌগমূলক (অ্যাসিড র‌্যাডিক্যাল) নির্ণয়ে সক্ষম হতো, তখন আমার মনে হতো নোবেল প্রাইজই তাদের প্রাপ্য।… রসায়নশাস্ত্রে আমার প্রধান ভরসা ছিলেন উর্দুভাষী, ঢাকা কলেজের বহু পুরোনো ল্যাবরেটরি সহায়ক, হানিফ মোহাম্মদ। ম্যাট্রিকে উর্দুতে ‘লেটার’ পাওয়া আমার ভাষাটির ওপর কিছুটা দখল ছিল, আর তার সঙ্গে দুই-পাঁচ টাকা হাতে তুলে দিলে আমার উর্দু হয়তো হানিফ মোহাম্মদের কানে বিশুদ্ধই শোনাত। প্রসন্নচিত্তে ধাতব লবণ হাতে নিয়ে তিনি কানে কানে বলে দিতেন আমার সে দিনের সমস্যাটি সোডিয়াম নাইট্রেট না পটাশিয়াম ক্লোরাইড।… আমাদের বহিরাগত পরীক্ষক ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মোকাররম হোসেন।… ড. মোকাররম আমাকে ধাতব লবণ সম্বন্ধে একটিও প্রশ্ন করলেন না। জিজ্ঞাসা করলেন :

বলো, ‘ইনফিনিটি’ কী?

‘ইনফিনিটি’র সঙ্গে রসায়নশাস্ত্র অথবা ধাতব লবণের কোনো সম্পর্ক আছে কি না আমার জানা ছিল না। আমার মনে হলো, প্রশ্নটি সাধারণ জ্ঞানভিত্তিক। দ্রুত চিন্তা করেই নিবেদন করলাম :

স্যার, সংখ্যা ‘১’ লিখে অনন্তকাল ধরে যদি শূন্য লেখা যায়, সেটাই হবে ইনফিনিটি।

তার পুরু চশমার ফাঁক দিয়ে বিস্ময়বিস্ফারিত নয়নে আমার দিকে তাকালেন ড. মোকাররম।

ফারুক চৌধুরী বর্ণনা করছেন বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর হলের জীবন :

সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের ১৪৭ নম্বর কামরায় আমরা প্রথমে থাকতাম তিনজন, যার একজন মুনাওয়ার (প্রয়াত) ছিল আমার মতোই টেনিসে উৎসাহী। আমার কামরায় নিয়মিত আড্ডা হতো, কিন্তু নিয়মিত লেখাপড়া করার ছিল না কোনো তাড়া। ক’মাস পর একজন নতুন রুমমেটের উদয় হলো। কিছুদিন থাকার পর সে যখন বুঝল যে তার বাড়ি থেকে পাঠানো টিনের মুড়ি অস্বাভাবিক দ্রুততায় নিঃশেষিত হয়ে যাচ্ছে, তখন হাউস টিউটরের অনুমতি নিয়ে মুড়িবিহীন ক্ষুধার রাজ্যে আমাদের ফেলে রেখে সে কামরা বদল করল।

এসব তো আনন্দময় তারুণ্যদিনের ঘটনা। এমনকি ইতিহাসের নিষ্করুণ কোনো ঘটনার বিবরণ দেওয়ার সময়ও এই কৌতুকদৃষ্টি ফারুক চৌধুরী হারিয়ে ফেলেন না। এই রসবোধ জীবনের বালুকাবেলায় বইটির প্রাণ।

দুই

‘আমাদের ইতিহাসের একটি অসাধারণ এবং রোমাঞ্চকর অধ্যায়েই জীবন কাটিয়েছি – তিন পতাকার নিচে; অবিভক্ত ভারত থেকে পাকিস্তান আর পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে। পরাধীনতা থেকে স্বাধীনতায়।’ বলেছেন বটে ফারুক চৌধুরী। এ-বইয়ের মূল উপজীব্য কিন্তু লেখকের কূটনীতিক-জীবনের ইতিকথা, যে-জীবনে ‘শুধু কী করেছি নয়, কী দেখেছি তা-ও যথেষ্ট আগ্রহ-উদ্দীপক’। বটে। বিগত শতাব্দীর মধ্য পর্যায়ে, ১৯৫৬ সালে, তিনি যোগ দেন পররাষ্ট্র দফতরে। আশির দশকের উপান্ত পর্যন্ত তাঁর দীর্ঘ পেশাজীবনকালে এ-উপমহাদেশের ইতিহাসের ওপর দিয়ে কী ঝঞ্ঝামুখর ঝোড়ো হাওয়াই না বয়ে গেল। বিলয় ঘটল পাকিস্তান রাষ্ট্রের, অভ্যুদয় হলো নবীন রাষ্ট্র বাংলাদেশের। রাজনীতির বহু নায়ক পরিণত হলো খলনায়কে। নৃশংস হত্যাকান্ডের শিকার হলেন বহু রাষ্ট্রনায়ক। এরকম বহু ঘটনা তিনি দেখেছেন বেশ কাছ থেকে। সংস্পর্শে এসেছেন দেশ-বিদেশের বহু রাজনীতিবিদের। আনুষ্ঠানিকতার নির্মোকের অন্তরালে ধরা পড়েছে অনেকের মানুষী সত্তা।

১৯৬৩ সালে মওলানা ভাসানী যখন গণচীনে বেড়াতে গেলেন, দূতাবাসে কর্মরত ফারুক চৌধুরীকে দেওয়া হলো তাঁর দোভাষীর দায়িত্বভার। সেই সফরের সূত্রে লেখকের কলমে ধরা পড়ে ভাসানীর সহজ-সরল কিন্তু কৌতূহলী এক অকপট সত্তা। নানা কিছু দেখার ফাঁকে চীনের জেলখানা-দর্শন ও শেষ সম্রাট পু ইর সাক্ষাৎ কামনা করেন ভাসানী। গণচীনের লৌহকঠিন নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে, নানা কান্ডের পরে, তাঁর দুই ব্যতিক্রমী অনুরোধই রক্ষা করে সরকার।

জেলখানায় গিয়ে সুদর্শনা এক তরুণীর সঙ্গে তাঁদের দেখা। কী অপরাধ সে মেয়ের? জানানো হয়, ‘এই মেয়েটি ছিল লোভী। লোভের বশে অর্থের প্রত্যাশায় একই সময়ে একাধিক ব্যক্তির কাছে সে তার প্রেম নিবেদন করত। তাই তাকে মৃদু শাস্তি দেওয়া হয়েছে।’ দোভাষী ফারুক চৌধুরী বাংলায় কথাটা বুঝিয়ে বলতে না বলতেই মওলানার মন্তব্য – ‘ও, বুঝেছি। মেয়েটি বেশ্যা।’ তাদের সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে যে বেশ্যাবৃত্তি আছে, এ-কথাটা চীনারা স্বীকার করে না বলে কথাটি তারা ঘুরিয়ে বলেছে।

সম্রাট পু ইর সমস্যা আবার বিচিত্র। একসময় অর্থের কোনো মূল্য ছিল না তাঁর কাছে। এক কেজি সোনা আর এক কেজি আপেলে কী তফাৎ, রাজা হিসেবে তা বোঝার কখনো কোনো দরকার পড়েনি তাঁর। চীনে সমাজতন্ত্র আসার পরে কোন জিনিসের দাম কম আর কোনটির বেশি, সেটি বুঝে উঠতে বড্ড বেগ পেতে হয়েছে তাঁকে।

আবার মওলানার সঙ্গে এ চমকপ্রদ অভিজ্ঞতার বিপরীতে আছে পাকিস্তানের সামরিক জান্তা ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে শঠতাপূর্ণ অভিজ্ঞতা। নভেম্বর ১৯৭০-এ ইয়াহিয়া যাবেন পাঁচদিনের সফরে চীনে। প্রথা অনুযায়ী সফরের আগে চীনের রাষ্ট্রদূত চাং তুন দেখা করবেন ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে। এরকম সাক্ষাৎকালে পররাষ্ট্র দফতরের সংশ্লিষ্ট পরিচালককে হাজির থাকতে হয় বলে ফারুক চৌধুরীও উপস্থিত। পুরো সাক্ষাৎপর্বটিই হলো খাপছাড়া ও অদ্ভুতুড়ে। লেখক সেদিন এর কারণ বুঝতে পারেননি। তিনি লিখছেন :

আজ আমি বিশ্বাস করি যে সেদিনকার সেই সাক্ষাৎকার ছিল লোকদেখানো অভিনয়, যাতে করে পররাষ্ট্র দপ্তর আর সরকারের অন্যান্য মহল বিশ্বাস করে যে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের চীন সফর একটি সাধারণ দ্বিপক্ষীয় সফর।… চীনে ইয়াহিয়া খানের সেই সফরের আসল উদ্দেশ্য ছিল আমেরিকা আর চীনের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনে দূতিয়ালির ভূমিকা পালন। বিভিন্ন কারণে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ছিল সম্পূর্ণভাবে সেই গোপনীয়তা রক্ষা করার। সে কথা আজ আমরা হেনরি কিসিঞ্জার অথবা জি ডব্লিউ চৌধুরীর বই কিংবা অন্যান্য প্রকাশনা থেকে জানতে পেরেছি। সেই সময়ে তদানীন্তন ইয়াহিয়া খান মন্ত্রিসভার সদস্য জি ডব্লিউ চৌধুরী আর সম্ভবত পররাষ্ট্র সচিব সুলতান খান ছাড়া সফরের আসল উদ্দেশ্য কেউ জানতেন না। এঁরা দুজনই ছিলেন পিকিংয়ে ইয়াহিয়া খানের সফরসঙ্গী। আর বাকি আমাদের মতো সফরসঙ্গীরা ছিলাম আমাদের অজান্তে গোপনীয়তা রক্ষায় এই বিরাট প্রচেষ্টায়, প্রয়োজনীয় কিছু অতিরিক্ত।

সে-সফরে পাকিস্তানের প্রতিনিধিদল যখন পিকিংয়ে ছিল, চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই তখন ঘনঘন অতিথিভবনে আসতেন। ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে রোজই তাঁর একান্ত বৈঠক হতো। সে-বৈঠকে ইয়াহিয়ার সময় ব্যয়িত হতো চীন-আমেরিকার পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নয়নের দূতিয়ালিতে। এসব বৈঠকের গভীরতর প্রভাবে একাত্তরে বাঙালির স্বাধীনতার সংগ্রামে নানা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়।

এ-বইয়ের সবচেয়ে প্রাণবন্ত পর্ব সম্ভবত শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে লেখকের অভিজ্ঞতার সংশ্লিষ্ট অংশটুকু। স্বাধীনতার পর ভারত থেকে শেখ মুজিবের সঙ্গে তাঁর স্বদেশ-প্রত্যাবর্তন, স্বাধীন বাংলাদেশে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গড়ে তোলার প্রাথমিক দিন, একটি আত্মমর্যাদাসম্পন্ন ও প্রায়োগিক পররাষ্ট্রনীতি অবলম্বন করার ব্যাপারে বঙ্গবন্ধুর উৎসাহ ও প্রজ্ঞা, লন্ডনে শেখ মুজিবের চিকিৎসাকালে তাঁর অন্তরঙ্গ সান্নিধ্য, শেখ মুজিবের পররাষ্ট্র-ভাবনা – এসব প্রসঙ্গ লেখক যত্ন ও মমতার সঙ্গে তুলে ধরেছেন।

সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশ তখনো মুজিবশূন্য। শেখ মুজিব তখনো পাকিস্তানের কারাগারে অন্তরীণ। কবে মুক্তি পাবেন, তা অনিশ্চিত। পাকিস্তানের কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য আন্তর্জাতিক মত গড়ে তুলতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদের নেতৃত্বে          ভারত-সফরে গিয়েছেন তাঁরা। ফারুক চৌধুরী লিখছেন :

সেখানে ভারতীয় কর্মকর্তাদের সঙ্গে আমাদের বৈঠক চলছে। অকস্মাৎ সম্মেলনকক্ষের দরজাটি সশব্দে খুললেন মানি দীক্ষিত। চোখেমুখে তাঁর উত্তেজনার ছাপ।

এইমাত্র খবর এসেছে শেখ মুজিব মুক্তি পেয়েছেন। খবর এসেছে তিনি ইতিমধ্যে পাকিস্তান ত্যাগ করেছেন।

ভেঙে গেল বৈঠক, সম্মেলনকক্ষটি ভেঙে পড়ল স্বতঃস্ফূর্ত করতালিতে। নিমেষে একটি সাধারণ দিন স্মৃতির মণিকোঠায় প্রবিষ্ট হলো অসাধারণের বেশে। উত্তেজনাময় মুহূর্তগুলোর স্মৃতিধারণ সুকঠিন। সেই মুহূর্তগুলোর ঘটনাপ্রবাহ অতিদ্রুত। তাদের বর্ণনা দুরূহ।

অবশেষে ব্রিটিশ বিমানে করে সে-সময়ের ইতিহাসের মহানায়ক শেখ মুজিবুর রহমান এসে নামলেন ১০ জানুয়ারি ১৯৭২। লেখক দিয়েছেন তার অভূতপূর্ব বর্ণনা :

ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর রুপালি কমেট বিমান। ধীরে ধীরে এসে সশব্দে সুস্থির। তারপর শব্দহীন কর্ণভেদী নীরবতা। সিঁড়ি লাগল। খুলে গেল দ্বার। দাঁড়িয়ে সহাস্যে, সুদর্শন, দীর্ঘকায়, ঋজু, নবীন দেশের রাষ্ট্রপতি। অকস্মাৎ এক নির্বাক জনতার ভাষাহীন জোয়ারের মুখোমুখি। সুউচ্চ কণ্ঠে উচ্চারণ করলেন তিনি আবেগের বাঁধভাঙা দুটি শব্দ। ‘জয় বাংলা’। করতালি, উল্লাস, আলিঙ্গন, তারপর আবেগের অশ্রুতে ঝাপসা স্মৃতি। রাষ্ট্রপতি গিরি, ইন্দিরা গান্ধী, ভারতের মন্ত্রিসভার সদস্য, কূটনীতিবিদ, শত শত সাংবাদিক। ক্যামেরা, মাইক্রোফোন, টেলিভিশন। অদূরে ক্যান্টনমেন্টের জনবহুল জনসভা।           আন্তরিক অভ্যর্থনায় রাস্তার দুপাশের জনতা।…              স্বাধীনতা-উত্তর অভিজ্ঞতায় এই প্রথমবারের মতো দিল্লির আকাশে-বাতাসে প্রতিধ্বনিত হলো আমাদের রাষ্ট্রপতির সম্মানে একুশটি তোপধ্বনি।…

বিমানবন্দর থেকে মোটরমিছিলে সভাস্থলে। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে রয়েছেন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। প্রথম হিন্দিতে সংক্ষিপ্ত ভাষণ দিলেন তিনি। বঙ্গবন্ধুর পকেটে রয়েছে জনসভার জন্য প্রণীত একটি ইংরেজি ভাষণ। ভাষণটি তাঁর পকেটেই রয়ে গেল। তিনি বাংলায় করলেন তাঁর ভাষণের শুরু। ‘শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী, উপস্থিত ভদ্রমহিলা ও ভদ্রমহোদয়গণ…।’ তাঁর কথা শেষ না হতেই করতালি, তারপর তাঁর উচ্চারিত প্রতিটি লাইনের সঙ্গে করতালি। জনসভায় বসে আমার মনে হয়েছিল, এটি যেন বঙ্গবন্ধুর ভাষণ আর করতালির দ্বৈত সংগীত।

যুদ্ধবিধ্বস্ত নতুন স্বাধীন রাষ্ট্রে বঙ্গবন্ধু কীভাবে বিভিন্ন রাষ্ট্রের সঙ্গে আত্মমর্যাদার সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করতে শুরু করলেন লেখক শুধু তার বর্ণনা দেননি, বিশদ বিশ্লেষণও তুলে ধরেছেন। এসব বিশ্লেষণ বহু ঘটনাকে একটি তাৎপর্যপূর্ণ পরিপ্রেক্ষিতের ওপর দাঁড় করিয়েছে।

বইটিতে নানা প্রসঙ্গের আলোচনায় ফারুক চৌধুরীর আরেকটি যে-মৌল ভাবনা লক্ষ করা যায় তা হলো, বিস্তৃত এই উপমহাদেশ ও এর সংলগ্ন অঞ্চলের মধ্যে একটি কার্যকর সম্প্রীতির আকাঙ্ক্ষা। সার্কের ভাবনা, প্রতিষ্ঠা ও কয়েকটি সার্ক সম্মেলন আয়োজনের যে বিস্তারিত বর্ণনা তিনি দিয়েছেন, তার মধ্যে এ-ভাবনার বিচ্ছুরণ লক্ষ করা যাবে। সার্কের ভাবনার পেছনে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের কথা তিনি যেমন উল্লেখ করেছেন; প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান যে এ-বাসনাটি প্রথম স্পষ্টভাবে উচ্চারণ করেছেন, সেটিও তুলে ধরেছেন সযত্নে।

লেখক তখন আবুধাবিতে রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করছেন। সেখানে রাষ্ট্রীয় সফরে এসেছেন প্রেসিডেন্ট জিয়া। শেখ জায়েদের দেওয়া নৈশভোজ শেষে প্রেসিডেন্টের কাছে বিদায় নিতে গেছেন লেখক।

যখন বিদায় নিতে যাব, বললেন, ‘বসুন, আরও একটু। আরও একটি কথা আছে। ঢাকায় একটি ব্যাপারে আমরা ভাবছি। আমাদের অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে সহযোগিতা আমরা কেন বাড়াতে পারি না? এই সংযুক্ত আমিরাতে এসেও দেখছি বাংলাদেশি, ভারতীয়, পাকিস্তানি এবং শ্রীলঙ্কার অধিবাসীরা পারস্পরিক সহযোগিতায় এই দেশ আর এই অঞ্চলকে গড়ে তুলছেন। এটা অত্যন্ত আনন্দদায়ক। সুদূরে এসে আমাদের অঞ্চলের অধিবাসীদের এই সৌহার্দ্য, সম্পৃক্তি ও সহযোগিতা নিঃসন্দেহে ইতিবাচক। কিন্তু আমাদের নিজেদের অঞ্চলে কেন আমরা এই সহমর্মিতা স্থাপনে ব্যর্থ হয়েছি? আমাদের এ ব্যাপারে কিছু করার প্রয়োজন রয়েছে।’ জিয়া থামলেন।

সহজ চিন্তা। সরল যুক্তি। অ-জটিল ভাবনা। কিন্তু ইতিহাসের সব মহান সাফল্যের গোড়াতেই রয়েছে অতিসাধারণ                চিন্তাধারা। অসাধারণ জন্ম নেয় সাধারণকেই কেন্দ্র করে। অসাধারণের সৃষ্টি সাধারণের সম্পৃক্তিতে। তার পরের বছরগুলোতে দক্ষিণ এশিয়া আঞ্চলিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে যা ঘটেছে তা আজ ইতিহাসেরই অঙ্গ।

পরে – ১৯৮০ সালে – ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা, নেপাল, ভুটান ও মালদ্বীপের সরকারপ্রধানদের কাছে এক বার্তায় জিয়া লেখেন, ‘পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলে সহযোগিতা জোরদার করার প্রয়াস নেওয়া হচ্ছে, যাতে আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হয়… দক্ষিণ এশিয়াই পৃথিবীর একমাত্র অঞ্চল, যেখানে কোনো আশাবাদ নিয়ে আঞ্চলিক সহযোগিতা সম্বন্ধে চিন্তাভাবনা চলছে না।’                 এ-ভাবনায় লেখক উদ্দীপিত বোধ করেছিলেন। কিন্তু এর পর বাংলাদেশে পানি গড়িয়ে যায় অনেক দূর। লেখক যখন বেলজিয়ামে কর্মরত, সে-সময় নির্মম হত্যাকান্ডের শিকার হন জিয়াউর রহমান। অভ্যুত্থান-পালটা অভ্যুত্থানে অস্থির দেশে নানা নিয়ম-অনিয়ম পেরিয়ে লেখক অবশেষে পান পররাষ্ট্র সচিবের দায়িত্ব। অদ্ভুত নিয়তিচক্রে ১৯৮৫ সালে বাংলাদেশে প্রথম শীর্ষ সম্মেলন আয়োজনের ভার তাঁর ওপরই বর্তায়। লেখক সে-আয়োজনের বিবরণ দিয়েছেন কাব্যমাখা আবেগপূর্ণ ভাষায়।

 

তিন

ফারুক চৌধুরীর অন্তরঙ্গ স্মৃতিচারণে দেশের ও উপমহাদেশের বহু ইতিহাস-রচনা করা মুহূর্ত ধরা পড়েছে বটে। তাই বলে অম্লমধুর ছোটখাটো ঘটনা তিনি এড়িয়ে যাননি। আর তার মধ্যে ধরা পড়েছে বড় বড় মানুষের ছক-কাটা চেহারার অন্তরালে তাঁদের চকিত মানবিক মুহূর্ত। পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খানের ধর্মান্তরিত স্ত্রী রানা লিয়াকতের উদারতা ও শেষ জীবনের নিঃসঙ্গ বিষণ্ণতা, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আলজেরিয়ার রাষ্ট্রপতি বুমেদিয়ানের দক্ষতা, বেলজিয়ামের রাজা বঁদোয়াকে রাষ্ট্রদূতের পরিচয়পত্র পেশ করার সময়কার হাস্যপরিহাসময় ঘটনা, প্রিন্স চার্লসের হাস্যরস, মুষ্টিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলির প্রত্যুৎপন্নমতি ও ঢাকার সার্ক সম্মেলনে কাশ্মিরের বিতর্কিত সীমান্তচিহ্নিত ডাকটিকিট নিয়ে রাজীব               গান্ধী-জিয়াউল হককে নিয়ে উত্তেজনাময় প্রহর – এমন অসংখ্য প্রসঙ্গ বইটিকে মুক্তাখচিত অলংকারের সৌন্দর্য দিয়েছে।

ফারুক চৌধুরীর বড় গুণ তাঁর ইতিবাচক মানসিকতা। রাজনীতির নায়ক বা খলনায়ক যাঁর প্রসঙ্গেই তিনি উত্থাপন করুন না কেন, প্রথমেই তাঁকে ভালো বা মন্দের সাদায়-কালোয় বিভাজিত প্রকোষ্ঠের দিকে ঠেলে দেন না। তাঁদের ভেতরকার নানা রঙে মেশানো মানুষী সত্তাটিই যেন তাঁর অন্বিষ্ট। যখন তিনি তাঁদের ইতিহাসের পটে রেখে বিচার করছেন, তখন নিজের বিবেচনা ও মূল্য তিনি আরোপ করছেন। কিন্তু যখন তাঁদের সাহচর্যে আসছেন, ইতিহাসপট থেকে নামিয়ে আনছেন তাঁদের। তাঁদের নিজস্ব চরিত্রগুণ ও মানবিক মাত্রাটিই ফারুক চৌধুরীর কাছে মুখ্য। তাঁর বইয়ের কোথাও তাই কোনো তিক্ততার রেশ নেই। তাঁর লেখার ছত্রে ছত্রে যে অন্তর্বাণীটি ঘোষিত হচ্ছে, তা হলো ‘যা দেখেছি, যা পেয়েছি, তুলনা তার নাই।’

এ-বইয়ের নানা প্রসঙ্গের ফাঁকে ফাঁকে গোপন অন্তঃস্রোতের মতো আর যে-বিষয়টি বয়ে চলেছে, তা হলো, নানা দেশের বিচিত্র ও উৎকৃষ্ট খাদ্যের প্রতি ফারুক চৌধুরীর অপরিমেয় আগ্রহ। যেন যেখানেই তিনি যাচ্ছেন, সেখানকার খাবার চেখে না দেখলে পূর্ণ উপলব্ধি সম্পূর্ণ হচ্ছে না। ফলে ভুটানের কাঁচামরিচের সঙ্গে রাঁধা ঝাল পনির; কাশ্মিরের গুজতাবা, ইয়াখনি, রোগন জোশ; বাগদাদের মাসগুফ; চীনের মাওতাই; রোমে গালিয়াজ্জি রেস্তোরাঁর মুরগির কাচ্চাতোরে ইত্যাদি খাদ্য ও পানীয়ের মৌতাতে যে বইটি ভরে উঠবে, তা আর বিচিত্র কি!

বইটির শেষ অংশে যুক্ত হয়েছে ব্র্যাকের সঙ্গে তাঁর অভিজ্ঞতার পর্বটি। ব্র্যাক কীভাবে সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ল, তার অনুপুঙ্খ বিবরণ এখানে আছে। তবে এ-কথা বলতেই হয়, লেখক তাঁর পরিব্যাপ্ত কূটনৈতিক জীবনের মধ্য দিয়ে দুই ভিন্ন রাষ্ট্রকাঠামোয় উপমহাদেশের বিস্তৃত ইতিহাসপটের যে-অন্তরঙ্গ চেহারাটি মেলে ধরেছেন, সমাপ্তি পর্ব হিসেবে শেষ এ-অংশটি তার ছন্দপতন ঘটায়। এটি আলাদা বই হলে পৃথক পরিপ্রেক্ষিতে দুটো মূল্যবান স্বতন্ত্র বই হতে পারত।

লেখক নিজে বলেছেন এবং আমরাও দেখেছি, আত্মজীবনীতে লেখকের যে-ব্যক্তিস্বরূপকে খুঁড়ে তুলে ধরা হয়, এ-বইটি তা নয়। কিন্তু তাতে এ-বইয়ের গুরুত্ব মোটেই কমে না। এ-বই আমাদের ইতিহাসের বহু মোড়-ফেরানো ঘটনার অন্দরমহলে নিয়ে যায়।             এ-বই বরং আমাদের প্রত্যাশা আরো বাড়িয়ে দিলো। আমরা এবার তাঁর একটি যথার্থ আত্মজীবনী প্রত্যাশা করতে পারি।

ফারুক চৌধুরী বইটিতে জানিয়েছেন, তাঁর বাবার মৃত্যুর পর তিনি তাঁকে প্রতি বছর অন্তত একটি করে চিঠি লিখছেন। আর তাতে ধরে রাখছেন তাঁদের সুবিশাল পরিবারের নানামুখী বিবর্তন। সেগুলো গাঁথতে পারলে ‘তা হবে আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক আর সমকালীন নানা টানাপোড়েনে, অস্ট্রেলিয়া থেকে ইউরোপ হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে অপকেন্দ্রিক টানে ছড়িয়ে পড়া একটি পরিবারের নানা মনের আর নানা পেশার মানুষগুলোর ক্রমে ক্রমে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার বিয়োগান্ত একটি কাহিনি।’ আমরা যারা জীবনের বালুকাবেলায় পড়েছি তারা সে-বইটি লেখার জন্য ফারুক চৌধুরীর কাছে দাবি জানাব।

ফারুক চৌধুরীর বাবার মৃত্যু হয়েছিল নিদারুণ এক সড়ক দুর্ঘটনায়। দুই ভাই ফারুক চৌধুরী ও ইনাম আহমেদ চৌধুরীও                       সে-গাড়িতে বাবার সঙ্গে ছিলেন। তাঁরা ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান। তাঁদের তখন বরাভয় দিয়েছিল বাবার এই বাণী যে, ‘জীবনে যদি বিপদের মুখোমুখি হও, এটা মনে রেখো যে যা ঘটেছে তার চেয়েও ভয়াবহ বিপদ ঘটতে পারত।’ বাবার এই আর্ষোক্তি স্মরণ করে লেখক বলছেন, ‘হ্যাঁ, তা-ই ঘটত, যদি একটি সীমিত আয়ের মধ্যবিত্ত উঠন্ত পরিবার থেকে আমরা তিনজন একযোগে অন্তর্হিত হতাম।’

আমরা অকিঞ্চিৎকর পাঠকেরা বলব, হ্যাঁ, তা-ই, জীবনের বালুকাবেলায় বইটি আমরা পেতাম কোথায়? r

 

 

নিমপ্রবন্ধে যাঁর

ব্যক্তিত্ব উদযাপিত

কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর

 

নির্বাচিত নিমপ্রবন্ধ

ফেরদৌস আরা আলীম

 

বেঙ্গল পাবলিকেশন্স লিমিটেড

ঢাকা, ২০১৪

 

৩৫০ টাকা


 

ফেরদৌস আরা আলীম-প্রণীত নির্বাচিত নিমপ্রবন্ধ নামের গ্রন্থে দরকারি কিছু প্রবন্ধই সংকলিত হয়নি, এখানে তিনি  যেন নিজের ব্যক্তিত্ব উদযাপন করছেন। তাঁর বলার জাদুকরী মোহনীয়তায় একধরনের মুগ্ধতার চাষাবাদ করেছেন। তাতে প্রবন্ধ আছে তেইশটি, – সবগুলোর ভেতরই ভাষার মমতা আছে, আছে নিজেকে প্রকাশের একমুখী বাসনা। আমরা যদি                 এ-প্রবন্ধগ্রন্থকে একটা বিচারালয়ের সঙ্গে তুলনা করি, তাহলে তার বলার ধরনটা হচ্ছে – তিনি বাদীর পক্ষে অনবরত তার নিজস্ব সাধনার কথা, মতপ্রকাশের কথা, এমনকি ব্যক্তিত্ব লালনের কথা বলে গেছেন। তাঁর প্রকাশের ধরনটি চমৎকার। তাতে ফাঁক-ফোকর তেমন আছে বলে মনে হয় না এবং তা ভাষিক মজায় পরিপূর্ণ। তাহলে আমরা তাঁর গ্রন্থে প্রবেশ করি, ক্ষণে ক্ষণে বিবাদির দেখা পাই কিনা, তাও আমরা সরেজমিন দেখে নিই।

তাঁর সৃজিত প্রথম নিমপ্রবন্ধ (কেন এ-ধরনের শব্দচয়ন তা আমরা বুঝতে পারি না! প্রবন্ধ-নিবন্ধ-মুক্তগদ্যের নির্যাস নিয়ে গড়ে ওঠা নতুন কোনো প্রত্যয় নাকি?) হচ্ছে ‘আমি বাঙালি’, যেখানে তিনি তাঁর জাতিসত্তা প্রকাশের একটা ধারণা বিকশিত করছেন। আমরা জানি যে, ভাষা-এলাকা-বোধ-ধর্ম নিয়ে নানাধরনের জাতিসত্তা প্রকাশ পায়। তিনি কার্যত ভাষার ওপরই তার জাতিসত্তার বিকাশ চান। তাতে আরো প্রকাশ পায় আমাদের সংস্কৃতি, সনের হিসাব – যেখানে শাস্ত্র আর ধর্মের বিষয়টি তিনি দেখতে চান না, সেখানে আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রকাশই মুখ্য। বৈশাখের প্রথম দিনকে তিনি মর্যাদা দেন, সাহিত্যমেলা আর কাব্যিক আবহ তাঁকে প্রশান্তি দেয়। পুণ্যাহ নামের জমিদারি বিষয় নয়, তা যেন এখন জনসংস্কৃতির দ্বারে চলে আসছে, তা সাহিত্যমেলার সতীর্থ মনে হয়। এভাবেই প্রতিদিনের প্রতি, কাজের প্রতি, মুহূর্তে বাঙালিত্বের প্রতি, তিনি দায়ী থাকতে চান। কথা হচ্ছে, এতে জাতিরাষ্ট্র পরিচয়ের একটা পথ আমরা পাই, কিন্তু অন্য নৃগোষ্ঠীর তো তা থেকে পেষণের সুযোগ থেকেই যায়। জাতীয়তাবাদ তো রাজনীতির বাইরের কিছু নয়, এটি নিজের অভিজাত অবস্থান পেতে চায়, পুঁজি আর ধর্মের সঙ্গে বন্ধন তৈরি করে নেয়, আন্তর্জাতিক প্রগতিশীলতার সঙ্গে কখনো কখনো বৈরিতা মোকাবেলা তৈরি করে। আবার রাষ্ট্রীয় দাপটও তাতে থাকতে পারে, যেমন আমরা রাষ্ট্রীয়ভাবে যখন পহেলা বৈশাখ পালন করি, তখন প্রায়ই বাংলাদেশ তথা অপরাপর হিন্দু সম্প্রদায় চৈত্রসংক্রান্তির উপবাস পালন করে। ক্যাবল-টিভির দরুন এ-পার্থক্য আরো প্রকট হয়ে দেখা দিচ্ছে। এটিও তো আমাদের ভাবতে হবে?

তারপরই যার জন্য লেখক ‘ভুবনজোড়া আসনখানি’ পেতেছেন তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি তাঁর সার্ধশত জন্মবছরের এক অনুষ্ঠানের কথা লিখেছেন। দুদিনব্যাপী সেই অনুষ্ঠান প্রথম আলো ও ব্র্যাক ব্যাংকের যৌথ উদ্যোগে পালিত হয়, যেখানে তাঁর কথাসাহিত্য, কবিতা, গান, চিত্রকলা, নাটক, মনুষ্যত্ব, জাতিভাবনা ও শিক্ষাভাবনা নিয়ে আলোচনা হয়। তাতে বিভিন্ন পর্যায়ে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, হাসান আজিজুল হক, হায়াৎ মামুদ, আকবর আলী খান, ড. মালেকা বেগম, খালিকুজ্জামান ইলিয়াস, ওয়াসি আহমেদ, আনিসুল হক প্রমুখ আলোচনা করেন। দুদিনের এ-আয়োজনে রবিঠাকুরের প্রায় সবদিকই অতিআনুষ্ঠানিকতায় আলোচিত হয়। এতে আমাদের জাতিসত্তার বিকাশ, রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি ও মানবিক মূল্যবোধের অনেক দিকই আমরা পাই। কাজী নজরুলের সার্ধশতজন্মবার্ষিকী উদযাপনের তাড়নায় তিনি লিখেছেন ‘কবি নজরুলের সার্ধশতজন্মবর্ষের অপেক্ষায়’ নামের প্রবন্ধ। এতে নজরুলের সাহিত্য-শিল্প, বিশেষত সাংস্কৃতিক নানান কর্মযজ্ঞের তিনি বর্ণনা করেছেন। এটা ঠিক, এই অঞ্চলের বিশেষত পূর্ববঙ্গের মানুষের মানসগঠনে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। তাঁর দ্রোহ, কবিতা, সংগীত ও কথাসাহিত্যকে আলাদাভাবে বিচার করতেই হবে। তিনি অতি আবেগি মানুষ, যখন যা মন চেয়েছে তখনই তা করেছেন, প্রতিবাদ করেছেন, স্বাধীনতার জন্য জেল খেটেছেন, প্রগতির পক্ষে কাজ করেছেন, মুসলমান সম্প্রদায়ের ভেতর স্বতঃস্ফূর্ত জাগরণ আনার দিশারি তিনি; যদিও তাঁর কাব্যকৌশল, প্রতিভা, মেধা, দর্শন নিয়ে প্রচুর মতদ্বৈততা আছে। এমনকি পুত্র বুলবুলের মৃত্যুর পর, চরম দারিদ্রে্যর ভেতর, তিরিশের দশকে, তার যে-মানসিক পরিবর্তন হওয়া শুরু করেছিল, তা রীতিমতো উদ্বেগজনকই ছিল। আমরা তবু তাঁকে স্মরণ করব, তাঁকে ভালোই বাসব। কারণ তিনি হিসাব-নিকাশ না রেখেই মানুষের আনন্দময় রোমান্টিকতায় নিজেকে সমর্পণ করেছিলেন। এ লেখকের মতোই বলতে হয়, – সকল অসুন্দরের আড়াল থেকে নজরুল মুক্তি পাবেন এবং আমরা উদযাপন করব তাঁর সার্ধশতজন্মবর্ষের ‘নিঃসংশয়, নির্বিবাদে’ এবং ‘মহাসমারোহে’।

অতঃপর আমরা পাঠ করি জীবনানন্দ দাশকে, তাঁর প্রবন্ধের নাম ‘ভুল পৃথিবীর এক শুদ্ধ কবি’। এর ভাষাও যেন জীবনানন্দের মায়াময়তা দিয়ে নির্মিত। আমরা হেমন্তের এই কবিকে অত্যন্ত চমৎকারভাবে এখানে পাই। বরং একজন জীবনানন্দকে যেন দারুণ তৃষ্ণা নিয়ে পান করতে থাকি। তাঁর সাহিত্য সম্পর্কে জানি, তাঁর সলাজ অবস্থান দেখি, পারিবারিক বিষয় সম্পর্কেও জানতে থাকি। কোনো চাকরিই তাঁকে শান্তি দেয়নি, তা যেমন সত্য, কোনো পারিবারিক অবস্থানই তাঁকে শান্তিতে রাখেনি এটাও তেমনি সত্য। তার এই যে যন্ত্রণা, সাহিত্যিক এই যে অতৃপ্তি, কথিত ভুল জগতের একটা বাসনা আমরা লেখকের কথনে পাই। এখানে লেখক জীবনানন্দ নামের মানুষটির সহপ্রেমী, তার যাতনায় একেবারে নিমজ্জিত লেখক। এভাবে দেখার ধরনটিও আমাদের কাছে নতুন মনে হতে পারে। এই প্রেম, এই মুগ্ধতা কবিকে নতুন প্রাণ দিয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় আমরা পরবর্তী প্রবন্ধটি পাঠ করি, যার শিরোনাম ‘কবিমাতা নিজেই যখন কবি’। এটি জীবনানন্দ দাশের মা কুসুমকুমারী দাসকে নিয়ে লেখা প্রবন্ধ। কবির মাও ছিলেন কবি। সংস্কৃতিবান্ধব এক চরিত্র ছিলেন তিনি। তার প্রভাব হয়তো কবির ওপরও পড়েছিল। তার মা যথার্থ সাধনাও করেছেন – এ-বিষয়টি হয়তো আমরা অনেকেই জানি না। তিনি ছিলেন সমাজসেবক, ব্রাহ্মসমাজের মানুষ, ব্যক্তিত্বের স্বকীয় প্রকাশের এক সত্তা। তিনি দৈহিকশ্রমীও ছিলেন। সবচেয়ে বড়ো কথা, কবি বা কথাশিল্পীর জন্য নিজস্ব একটা পরিবেশ রচনা করে রাখতেন। এভাবেই আমরা একটা চরিত্রমাহাত্ম্যের সঙ্গে পরিচিতি হই। তবে এ দুটি প্রবন্ধপাঠের পর জানতে পারি না, জীবনানন্দ কেন কায়স্থ সম্প্রদায়ের উপাধি ‘দাশ’ ব্যবহার করতেন। কারণ তাঁর মাকে তো নিম্নবর্গীয় ‘দাস’ উপাধি ব্যবহার করতে দেখেছি। যাই হোক, নারীত্বের কথা বলতে বলতেই আমরা অতঃপর তাঁর আরেকটা রচনা পাঠ করব, সেটি ‘জননীত্বের বৃত্তে জীবনের গল্প’। এখানে একজন জননীর কথা আমরা জানি, এ-জননী মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জননী নামের উপন্যাস সম্পর্কে একটা বিশ্লেষণ। এই নারী যে কত ধরনের অপমান, যন্ত্রণা, নারীত্বের ওপর জান্তব পেষণ সহ্য করেছেন, তা-ই একেবারে ধরে ধরে এখানে দেখিয়েছেন। এটিও হয়ে গেছে এক বিকল্প সাহিত্যসৃজন। মানিকও এ-জননীর জন্য একফোঁটা মায়া-মমতা রাখেননি। পুরুষের সংসারে এক নারীর ক্রন্দনপাঠে আমরা হয়তো রোদনমুখরও হই!

আমরা অতঃপর পাঠ করি তার ঝাঁঝালো প্রবন্ধ ‘তাহার জীবন তাহার ছিল না, তাহার গল্পও তাহার ছিল না’। এটি যেন এক প্রতিবাদ, এক পোস্টার যেন, – নারীকে অবদমনের, নির্যাতনের, থরো থরো কম্পন-ইতিহাসের এক দীর্ঘ বয়ান। আমরা এখানে নারী নির্যাতনের কথা, তাকে দাবিয়ে রাখার নানান ঘটনা ও কাহিনি শুনি। নারীবাদও এখন এক প্রতিবাদী স্তরেই আছে। তবু নারীর ওপর নির্যাতন, তাকে মানুষ মনে না-করার গল্পও অহরহ জমা হচ্ছে। তাই তিনি তাঁর অত্যন্ত প্রয়োজনীয় লেখাটি লিখেছেন। তাতে নারীবাদ, বেগম রোকেয়া, সেলিনা হোসেন, পূরবী বসু, নাসরীন জাহান এমনকি জেসমিনের ইচ্ছাপূরণের কথাও তিনি বর্ণনা করে গেছেন। তাঁর বলার ভেতর দিয়ে একটা ভয়ংকর চিত্র আমরা পাই। আমরা হকচকিত, বিহবল, এমনকি প্রতিবাদমুখরও যেন হই। ‘নারীর কলম, এখন-তখন’ নামের প্রবন্ধে তিনি নারী-লেখকদের একটা যথার্থ ইতিবৃত্তই দাঁড় করিয়েছেন। তাতে দশক হিসাব করে তিনি নারী-লেখকদের পরিচয় করিয়েছেন। তাতে আমরা একটা সাংস্কৃতিক ইতিহাস পাই। তাঁদের যন্ত্রণা, সংগ্রাম, দ্রোহ দেখি। অনেক নারীর কথাই আছে, তবে তাতে সন্জীদা খাতুন, আনোয়ারা সৈয়দ হক, আকিমুন রহমান, মাসুদা ভাট্টি, সাগুফতা শারমিন তানিয়া, শামীমা বিনতে রহমান, জেসমিন মুন্নী, নিরমিন শিমেল, মেঘ অদিতির নামও থাকতে পারত। তিনি মহাশ্বেতা দেবীকে নিয়ে ‘মহাশ্বেতা দেবীর এটি বর্ষার্ত গল্প নিয়ে যৎকিঞ্চিৎ’ নামের প্রবন্ধে এই সংগ্রামী, মায়াময়, রোদনকাতর, তথ্যপিপাসু সাহিত্যিকদের নানান দিক তুলে ধরেছেন। রাজনৈতিক ইতিহাসকে এত জনসমক্ষে আর কোনো কথাশিল্পী এনেছেন বলে আমাদের জানা নাই। মাহমুদুল হককে নিয়ে একটা সারগর্ভমূলক প্রবন্ধ তিনি দাঁড় করিয়েছেন, যার শিরোনাম – ‘মাহমুদুল হক ও তাঁর কথাশিল্প’। মাহমুদুল হক শুধু ভাষার জন্য নন, সাহিত্যের নতুন দিক উন্মোচনেরও তিনি কারিগর। তাঁর লড়াইটা ছিল প্রগতিশীল সাহিত্যগোষ্ঠী নামের যে টানটান উত্তেজনামুখর একটা ধারা ছিল তার বিপরীতে। তিনি মুরিদ বা গোষ্ঠী খোঁজেননি, কারো কাছে নিজের দর্শন বিসর্জন দেননি। তিনি আনন্দময় মুক্ততার এক ধ্বজাধারী ছিলেন। এ-লেখক আরেকটি অত্যন্ত সাহসী প্রবন্ধ লিখেছেন ‘মালতীর পক্ষে’ নামে। বুদ্ধদেব বসুর রাত ভ’রে বৃষ্টি নামের প্রবন্ধের মালতীর নারীস্বাধীনতা, যৌনতার মুক্তি, তার ভালোবাসা, বিকল্প জীবন নির্মাণের পক্ষেই তিনি কথা বলেছেন। এভাবে আমরা এক দরকারি বিকল্প কথনভাষ্য পাই। বন্ধুত্বের আরেক দিক প্রকাশ পেয়েছে ‘একটি সামাজিক সত্য ও আবু সয়ীদ আইয়ুব’ নামের প্রবন্ধে। এখানে তিনি বন্ধুত্বের এক নতুন নজির হাজির করেছেন, যেখানে আবু সয়ীদ আইয়ুব             স্বামী-স্ত্রীর কাছে সমান গুরুত্বপূর্ণ বন্ধুত্বের নমুনা হাজির করেছেন। মানসী রায়কে ঘিরেই এই সমজাল আমরা দেখি। ‘অগ্নিদীপ্ত এক অন্ধকার জীবনের গল্প’ নামের প্রবন্ধে শহীদ সাবেরকে দিয়ে অতিঅনুসন্ধানী হৃদয়বিদারী জীবন দেখিয়েছেন লেখক। এখানে সংবাদ পত্রিকাকে ঘিরে প্রগতিশীল জীবনের অনেক কথাই উঠে এসেছে। শহীদ সাবের, আহা আগুনের বান্দা, – কাব্যে, গল্পে, রাজনীতিতে আগুনমুখর সে-মানুষটা সংবাদ অফিসে পাক-বাহিনীর দেওয়া আগুনে ’৭১-এর ৩০ মার্চে পুড়ে ছাই হয়ে গেলেন। তিনি তো যাননি, আগুনে আগুনে আমাদের হৃদয়ে থেকে গেছেন। ‘উমরতুল ফজল : মর্তুশিখায় জ্বলে ওঠা মাটির প্রদীপ’ নামের প্রবন্ধে উমরতুল ফজলের লড়াইকাতর-সংসারী এক জীবনের কথা পাই।

চট্টগ্রামের লোকসংগীত আমাদের জাতীয় জীবনেরই এক সাংস্কৃতিক সম্পদ, যা এই লেখক ‘আমাদের লোকসঙ্গীত : প্রেক্ষিত চট্টগ্রাম’ নামের প্রবন্ধে দেখিয়েছেন। এভাবে আলাউলের কবিভাষা আর আবদুল হক চৌধুরীর জীবনও তিনি বয়ান করেছেন। এতে যথাক্রমে আলাউলের ভাষামাধুর্য আর চট্টগ্রামের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সমাজ-সংস্কৃতি, ভূগোল, কাব্যসৌকর্য প্রকাশ পেয়েছে। ছোটকাগজ নিয়ে তিনি একটা আবেগমুখর লেখাও তাতে যুক্ত করেছেন। তবে তাতে এ-সময়ের লিরিক আর নিসর্গ দিয়েই শেষ করলেন! এতে আরো অনেক ছোট কাগজের প্রতি অবিচারই করা হলো। কথাশিল্পী সেলিনা হোসেনকে নিয়ে ‘গড়ানো দিনের গল্প’ নামের তথ্যধর্মী একটা লেখা এখানে আছে। তাতে তিন বিঘা করিডোরের নানান বিষয় অনেকটা পরাবাস্তববাদী আবহে লেখক সৃজন করেছেন। তবে সেখানকার যাপিত জীবন, চিকিৎসাসংকট, চোরাকারবার ও  স্বাধীনতার প্রথম নিশান উড়ানোর গৌরব নিয়ে কথা থাকতে পারত। মোতাহার হোসেন চৌধুরী, জ্যোতির্মালা দেবী, এবং সবশেষে  নারী- লেখকদের নিয়ে একটা লেখা দিয়ে শেষ করেছেন তার                এ-গ্রন্থ। লেখকের ভাষা অত্যন্ত মোহনীয়, জাদুমাখা, ব্যক্তিত্বপ্রত্যাশী এ-গ্রন্থ খুবই দরকারি এক কর্মযজ্ঞের এক চিহ্ন বটে। গ্রন্থটির প্রকাশনার মানও সর্বদিকেই অত্যন্ত উচ্চমার্গীয়।           এ-গ্রন্থের বহুল প্রচার, বিকাশ কামনা করতেই পারি। r

 

 

মানুষের জীবনের গদ্য

শ্যামল চন্দ্র নাথ

 

ভালোবাসো, বাঁচো

আনিসুল হক

 

জ্ঞানকোষ প্রকাশনী

ঢাকা, ২০১৪

 

১২০ টাকা

 

পৃথিবী আসলেই অনেক সুন্দর। তবে সৌন্দর্যের এবং রঙের মাত্রাটা বিভিন্নজনের কাছে বিভিন্নরকম। ভালোবাসো, বাঁচো উপন্যাসটি সে-কথারই এক পুনর্ব্যক্ত আখ্যান। এ-উপন্যাসটি লিখেছেন বর্তমান সময়ে সবচেয়ে জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক, যদিও তাঁর লেখালেখির সূত্রপাত হয়েছিল কবিতার মাধ্যমে। বইটির নাম ছিল খোলা চিঠি সুন্দরের কাছে। যদিও শুধু কথাসাহিত্যিক হিসেবে নন, তিনি একজন নাট্যকার ও সাংবাদিক হিসেবেও সমধিক পরিচিত। তুমুল জনপ্রিয়তার চাপে অনেক অনেক বই ও লেখা লিখতে হলেও তাঁর লেখার ধরন এবং গদ্যরীতি সাহিত্যমানের উৎকর্ষ সাধনে নব নব সংযোজন সত্যি বিস্মিত হওয়ার মতো। এই উপন্যাসের শুরু যদিও একটি খুনের মধ্য দিয়ে। আক্কাস মাহমুদ ওরফে আকাশ এই গল্পের নায়ক এবং কথক। সে বলেছে, সে একটা খুন করেছে। খুন করে সে ছুটে চলেছে পুলিশ স্টেশনে। ধরা দেওয়ার জন্য। আস্তে আস্তে জানতে পারে, আকাশের জীবনের নানা পরত। সে ভালোবাসে কাবেরিকে। তার বন্ধুর নাম রাশেদ। এই রাশেদকেই সে খুন করেছে। কারণ রাশেদ অপমান করেছে আকাশের প্রেমিকা কাবেরি আর মাকে। মা? আকাশ অপছন্দ করে তার মাকে। কেন? সেই আকাশই তার মায়ের কাছে ফিরে আসে। কারণ মা তাকে জন্ম দিয়েছিল সমাজের           নিয়ম-কানুন ভেঙে। মায়ের কারণেই সে পেয়েছিল এই সুন্দর পৃথিবীতে বসবাস করার সুযোগ। যদিও এই কাহিনি পড়ার পর চোখের জল ধরে রাখা সত্যি মুশকিল। জীবনের প্রতি এক অপূর্ব ভালোবাসায় পাঠকের মন স্নিগ্ধ হয়ে উঠবে।’ এটি এ-উপন্যাসের মূল ভাষ্য। লেখক এ-বইটি উৎসর্গ করেছেন সম্পাদক আবুল হাসনাতকে। এবার আমি যাব উপন্যাসের প্রতিটি পরতে। কারণ, উপন্যাসকে উপন্যাস হওয়ার জন্য ঘটনার সঙ্গে সংলাপের সামঞ্জস্য অতীব জরুরি। এক্ষেত্রে লক্ষ্যণীয় যে, আনিসুল হক সে-কাজটি নির্দ্বিধায় করতে পেরেছেন। একটি অংশের ক্ষাণিক অংশ তুলে দিচ্ছি – ‘রাশেদের সঙ্গে দেখা সেই বিকেলেই। আজিজ সুপার মার্কেটের সিঁড়িতে। চারতলার পেছন দিককার এই সিঁড়িটা সারাক্ষণই অন্ধকার আর নির্জন। রাশেদ সিঁড়িতে বসে আছে। সঙ্গে আরো তিনজন তরুণ। আমি চপ্পলে শব্দ তুলে সেখানে যাই। সিঁড়ি বেয়ে উঠতে ক্লান্তি লাগে। রাশেদ আমাকে দেখে ডেকে ওঠে – ‘আকাশ। আসছিস? আয় বস।’ আমি রাশেদের পাশে বসি। সে বলে,             ‘দোস্তো। পকেটে তো মাল নাই। আইজকা চলব কেমনে?’ ‘মাল নাই কেন? তুই না পরীক্ষার ফি তুললি?’ ‘এক পরীক্ষার ফি দিয়া কয় দিন চলব?’ ‘সব উড়াইছস। অহন বুঝ।’ ‘বোঝাবুঝির কিছু নাই। টাকা তো জোগাড় করন লাগবই।’ ‘কেমনে করবি?’ ‘যেমনে করি?’ রাশেদ টাকা জোগাড় করার ব্যাপারে সিদ্ধহস্ত। এ-ব্যাপারে আমাদের কৌশল মোটামুটি অভিন্ন ও বহুলচর্চিত। টাকা ধার করা ও ফেরত না দেওয়া। এ জন্য আমরা নতুন নতুন ফন্দি বের করি। রাশেদ বলে, চল, টাকার ধান্দায় বাইর হই। আইজকা কোন দিকে যাবি? আমি জিজ্ঞেস করি। চল, বুয়েটের দিকে যাই। চল। রাশেদ আর আমি হাঁটতে থাকি। ভ্যাপসা গরমে দুজনের সেদ্ধ হওয়ার জোগাড়। রাশেদ বলে, আমি হাঁটতে পারছি না। চল রিকশা নেই। আমি বলি, আমার পকেটে টাকা নাই। রাশেদ বলে, আমার পকেটেও টাকা নাই। তাই বলে কি আমরা এই গরমের মধ্যে হাঁটবো নাকি? এই রিকশা, দাঁড়ান। একটা রিকশা দাঁড়ায়। রাশেদ লাফিয়ে উঠে পড়ে। রিকশাওয়ালা বলে, কই যাইবেন। রাশেদ বলে, এই তো সামনে। রিকশাওয়ালা বলে, সামনে যামু না। রাশেদ বলে, তাহলে পেছনে যাও। রিকশাওয়ালা বলে, আমার রিকশার ব্যাক গিয়ার নাই। আপনে কই যাইবেন, সেইটা কন না কেন? রাশেদ বললো, এই তো আহসানউল্লাহ হল। পলাশী। রিকশাওয়ালা বলে, ওইদিকে যামু না। রাশেদ খেপে যাচ্ছে। এখনই সে রিকশাওয়ালার কলার ধরে ফেলবে। আমার পাশে বসা রাশেদের তপ্ত মাথার ঝাঁজ যেন আমার কানে এসে লাগছে। আমি তার ধাবন্ত হাতকে নিরস্ত করি, বলি, আমরা যাব, আবার আসব। কাজেই ভাড়া নিয়া আপনার চিন্তা নাই। রিকশাওয়ালা বলে পুরো কুড়ি টাকা দেওন লাগব। রাশেদ বলে কুড়ি না বাইশ টাকা দিমু। চলো তো। রিকশা চলতে শুরু করলে হাওয়া এসে লাগে চোখেমুখে। ঘর্মাক্ত শরীরে বাতাস একটা শীতল স্পর্শ বুলিয়ে দেয়। রাশেদ গান ধরে, নিশীথে যাইও ফুলবনে… আমরা আহসানউল্লাহ হলের সামনে রিকশা দাঁড় করাই। দ্রুত নেমে যাই। রাশেদ রিকশাওয়ালার উদ্দেশে বলে, আমরা যাব, আর আসব। তুমি জাস্ট দুই মিনিট খাড়াইবা।’ তবে এখানে মূল কাহিনির সঙ্গে উপ-কাহিনিরও সংযোজন চমকপ্রদ বলে মনে হয়। অতঃপর আমি এ-উপন্যাসটির উপন্যাস হয়ে-ওঠার দিকে মনোযোগ দেবো। তার আগে বলে নিই যে, উপন্যাস এমন একটি সাহিত্যকর্ম, যার কোনো বাঁধাধরা সংজ্ঞা নিরূপণ প্রায় অসম্ভব। তাই নানাজন উপন্যাসের নানা সংজ্ঞা দিতে সচেষ্ট হয়েছেন। কারো মতে ‘উপন্যাস বা নভেল, গদ্যে লিখিত দীর্ঘ গল্প’। যদিও উপন্যাস নিয়ে আরো একটি সংজ্ঞায়ন আমার প্রিয় যেমন – ‘কার্যকারণশৃঙ্খলিত, চরিত্রদ্যোতক ও জীবন-স্বরূপ নির্দেশক কাহিনিই উপন্যাস।’ যদিও আমরা একটা উপন্যাস পড়ে মানুষের ঘনিষ্ঠ অনুকৃতি পেয়ে থাকি, তবু অনেক উপন্যাসই হয়তো সময়ের কাছে দাবি রাখে। তবে আধুনিক এবং মার্কসবাদী           সাহিত্য-সমালোচক র‌্যাফেল ফক্স তাঁর নভেল অ্যান্ড দ্য পিপল্স বইয়ের ভূমিকায় উল্লেখ করেছেন, ‘উপন্যাস হলো মানুষের জীবনের গদ্য, উপন্যাস হলো মানুষকে সম্পূর্ণভাবে গ্রহণ করার ও তাকে অভিব্যক্তি দেবার প্রথম নান্দনিক প্রচেষ্টা।’ দেখা যাক, সেই নান্দনিক প্রচেষ্টায় ঔপন্যাসিক আনিসুল হক এই গ্রন্থখানিতে কতটা অগ্রগামী ও সৃজনশীলতার পরিচয় দিয়েছেন। যদিও তাঁর লেখা মা উপন্যাসটি থেকে অন্য কোনো উপন্যাস এত অধিক পঠিত ও গ্রহণযোগ্য হয়েছে কিনা, তা আমার ক্ষুদ্র পাঠকজীবনে জানা নেই। তবে উপন্যাসের জন্য গল্প বা আখ্যান বা প্লট, মানুষ বা মনন, অথবা ব্যক্তি বা চরিত্র এবং বর্ণনা বা প্রকাশ এই তিনটি উপাদান অপরিহার্য। এর কোনোটি ছাড়া উপন্যাস সৃষ্টি সম্ভব নয়। তদুপরি এই ‘সৃষ্টির’ জন্য অর্থাৎ উপরোক্ত বিষয় তিনটিকে এক খাতে প্রবাহিত করতে প্রয়োজন চতুর্থ একটি অবলম্বনের, তা হলো ভাষা। ভাষা হলো কোনো সাহিত্য সৃষ্টির মূল সেতুবন্ধ। এক্ষেত্রে প্রথমেই আমি এই উপন্যাসটির আখ্যান বা প্লট নিয়ে বলতে চাই, যা মানুষের নিরন্তর স্বভাব। তবে কোন কাহিনি নিয়ে উপন্যাস রচিত হবে, তা একমাত্র ঔপন্যাসিকের ওপর বর্তায় কিংবা নির্ভর করে। এরই ফলে বলতে হয়, ভালোবাসো, বাঁচো উপন্যাসটির নির্মাণকৌশল একদিকে যেমন প্রাণবন্ত, মর্মস্পর্শী, তেমনি এর আখ্যান নির্মাণের কৌশল, ঋদ্ধতা এবং কাহিনির চিরন্তন চরিত্র কিংবা স্বভাব এগিয়ে চলা কোনো এক একাকী অতীতের জীবনবৃত্তান্ত। তাই উপন্যাসটির শুরুর দিককার কিছু অংশ তুলে না দিলেই নয়। যেমন – ‘আমি একটা খুন করি। খুন করে রক্তাক্ত রঞ্জিত জামা-কাপড়-চেহারা নিয়ে আমি হাজির হই রমনা থানায়। থানার প্রবেশপথে দুজন রাইফেলধারী পুলিশ প্রহরারত। রোদ্দুরে তাদের ছায়াদুটোকে লম্বা দেখায়। রাইফেলের ডগায় রোদ পড়ে ঝিলিক দেয়। সম্ভবত তারা তেল মেখে রেখেছে বন্দুকের নলে। আমি তাদের অতিক্রম করি অবহেলায়, তারাও আমার প্রতি কোনো রকম মনোযোগ দেয় বলে মনে হয় না। আমি তাদের ছায়াদুটোকে মাড়িয়ে এগোতে থাকি। আমার নিজের ছায়ার হাতে একটা ছুরির ছায়া দেখে আমার বুকটা সামান্য কেঁপে ওঠে। এতক্ষণ এই পুরোটা পথ আমি দৌড়েছি, পথে কোনো মানুষ আমার গতিরোধ করেনি। কেউ আমাকে দেখে চিৎকার করে ওঠেনি। আমাকে অনুসরণ করেনি। কেউ কেউ পথ ছেড়ে দিয়ে সরে দাঁড়িয়েছিল। আমার পিঠে চোখ নেই যে আমি জানব, তারা আমার দিকে ঘুরে তাকিয়েছিল কি-না। থানার বারান্দা পেরিয়ে প্রথম ঘরটাতে আমি যাই। আমার স্যান্ডেল ধূলিমাখা বারান্দায় আওয়াজ তোলে।’ যদিও এই উপন্যাসটির আখ্যান একটি খুনকে কেন্দ্র করে, কিন্তু সব বাধা পেরিয়ে আকাশের মায়ের কাছে ফিরে আসার ঘটমানতা অন্যরকম এক অভিব্যক্তির শিহরিত এবং মায়াময় দুনিয়ায় বেঁচে থাকার আনন্দময় অনুভূতির দিকে নিয়ে যায়। লেখকের মতো আমাকেও বলতে হয়, জীবন এত সুন্দর কেন? কারণ, যখন আনিসুল হক লিখেন – দুধারে মাটির চোরকাঁটা। সেই পথ গিয়ে শেষ হয়েছে একটা মাটির ঘরে। সেখানে ফেরিওয়ালার বউ অপেক্ষা করে আছে সবুজ রঙের শাড়ি পরে। হয়তো তার দুবছরের বাচ্চার কোমরে ঘুঙুর। সে বাচ্চাটাকে কোলে নেবে। বাচ্চা বলবে, বাবা, ঝুমঝুমি। বাচ্চার মা বলবে, ওটা নিতে হয় না বাবা। ওটা বাবা বিক্রির জন্য নিয়ে বেড়াচ্ছে। ফেরিওয়ালা বলবে, আচ্ছা একটা ঝুমঝুমিই তো। খোকাকে দাও ওটা। বাববা, তোমার ছেলের জন্য এত টান? আমার জন্য তো কোনোদিন তোমার পসরা থেকে কিছুই দিলে না? আচ্ছা। তোমাকে আজ দেব আলতা। দেখি তোমার পা দুখানা। ফেরিওয়ালা বসে আঙিনায়। পিঁড়ি পেতে। তার বউ তাকে পা দুটো এগিয়ে দেয়। ফেরিওয়ালা তার বউয়ের পায়ের সাদা পাতায় লাল আলতা মেখে দেয়। তার খোকা তখন ঝুমঝুমি হাতে নাচছে। ঝুমঝুম… উফ। জীবন এত সুন্দর কেন? হঠাৎ আমার মায়ের কথা মনে পড়ে। আমার মা আমাকে অ্যাবরশন করে ফেলে দেননি বলেই আজকের এই সুন্দর জীবনটা আমি পেয়েছি।’ অতঃপর আমি চরিত্র নির্মাণের কথা বলব। কারণ, চরিত্রের সঙ্গে সময়ের এবং সময়ের সঙ্গে পরিবর্তিত পরিস্থিতির সুনিপুণ কারিগরি দক্ষতা একজন প্রকৃত শিল্পীর মতো এ-উপন্যাস পড়ার সময়, অনুধাবন করার সময়, নেবার সময় অবশ্যই চোখে পড়বে। সে-বিবেচনায় আক্কাস মাহমুদ ওরফে আকাশ, কাবেরি, রাশেদ, ফেরিওয়ালা এবং চরিত্রটি এক পশলা বৃষ্টির মতো নয়, সময়ের আবর্তে বিবেচিত হার কথাই বলে। যদিও আনিসুল হকের অনেক উপন্যাস, অনেক কবিতা, অনেক নাটক, অনেক প্রবন্ধ এবং অনেক গল্পের সঙ্গেই আমার পরিচয় দীর্ঘদিনের। সে-ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত সম্পর্কের পসরা না-ই ছড়ালাম। কিন্তু আনিসুল হক শুধু একজন লেখক নন, আমার চোখে, আমার হৃদয়ে এক অসাধারণ মানুষও বটে। যদিও এর আগেই আমি এ-উপন্যাস বর্ণনার কথা আংশিক বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছি, তবু বলব যে, এ-উপন্যাসটির বর্ণনার পরিব্যাপ্তি আরো বিস্তৃত হলেও হতে পারত বলে আমার মনে হয়। উপন্যাসের কিছু কিছু অংশে উপমার ক্ষাণিক ঝলকও পরিলক্ষিত হয়েছে, যা মাঝে মাঝে স্বপ্নের মতো মন হয়েছে। এবং তুলনার ব্যবহার দেখেছি কয়েকবার। যেমন – ‘বই বাঁধাইয়ের দোকানে একজন কর্মচারী ছিলেন, তাঁর ছিল রবীন্দ্রনাথের মত দাঁড়ি-গোঁফ।’ কিংবা ‘এইসব কথা আমার মনে তেমন মনে নাই, দুই বছর বয়সের স্মৃতি মানুষের থাকে না, কিন্তু মার কাছে শুনে শুনে সেইসব দিনও যেন আমি দেখতে পাই।’ এই উপন্যাসটি পড়তে পড়তে আমার মনে হয়েছে, আমি যেন জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীর লেখা সমুদ্র কত দূরে উপন্যাটির ছায়া কল্পনা করতে থাকি। ওই উপন্যাসটিরও মূল বিষয়বস্ত্ত একটি খুনকে কেন্দ্র করে। এ শুধু আমার লেখক-হৃদয়কে নয়, পাঠক-হৃদয়কেও আন্দোলিত করেছে, যা আমি অস্বীকার করতে পারি না।  তাই আমারও চোখে জল চলে এলো। দুনিয়াটা আসলেই সুন্দর। এবং মায়াময়। বেঁচে থাকা আসলেই এক মধুর ব্যাপার। এই অঘোম ও সত্য কথার কথক আনিসুল হক আবারো মনে করে দিয়েছেন তাঁর কলমের এবং ভাষাশৈলীর কারুকার্যে। যদিও পাঠক এবং সময়ের কাছে এখন উপন্যাসটির এগিয়ে চলার কথা। যদিও এই আলোচনা এক আনিসুল হকের লেখা নিয়ে বলার জন্য যথেষ্ট কিছু নয়, তবু তাঁর এ-উপন্যাসটি আমার কাছে মানুষের জীবনের গদ্য বলেই মনে হয়েছে। r

 

 

শাকুর মজিদের

ভাটির পুরুষ-কথা

রেজা ঘটক

 

ভাটির পুরুষ-কথা

শাকুর মজিদ

 

বেঙ্গল পাবলিকেশন্স লিমিটেড

ঢাকা, ২০১৪

 

২৭৫ টাকা

 

রতনে রতন চেনে – এ-কথাটি শাকুর মজিদের বেলায় হবে, বাউলে বাউল চেনে। কে বাউল কে তারে চেনে? বাংলার ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল জুড়ে কত কিসিমের বাউল, কে কারে চেনে? শাকুর মজিদ একজন বাউল – এ-কথাটি রাজধানী ঢাকায় বসে বললে অনেকে এটা নিয়ে বিতর্ক শুরু করবেন। অনেকে এটার পক্ষে-বিপক্ষে নানান যুক্তি খাঁড়া করাবেন। অনেকে নানাভাবে নাক শিঁটকাবেন। কিন্তু বাউল মন মন রে আমার; আমি জানি শাকুর মজিদও একজন বাউল। শহরের আধুনিক বাউল, নগর-বাউল। বাউল মন নিয়ে তিনি গোটা বিশ্বের নানান প্রান্তে নানান কিসিমের বিষয়ের প্রতি মনযোগী হয়ে একজন আধুনিক বাউলের মতো ঘুরে বেড়ান। শুধু কি ঘুরে বেড়ান? নানাভাবে খুঁড়ে আনেন অনেক বাউলের হাঁড়ির খবর।

শাকুর মজিদ গল্প, নাটক, ভ্রমণ-কাহিনি লেখেন। টেলিভিশনে নাটক বানান। প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেন। টেলিফিল্ম নির্মাণ করেন। নাটকের সকল শাখায় তাঁর অবাধ বিচরণ। মঞ্চনাটক লেখেন। ঘুরে ঘুরে ইচ্ছামতো ছবি তোলেন। স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থ লেখেন। স্থাপত্য ও আলোকচিত্র বিষয়েও লেখেন। পেশায় একজন স্থপতি হলেও বাউলের মন নিয়ে শুধু পেশার সীমানার মধ্যে নিজেকে আটকে রাখেননি শাকুর মজিদ। তাই বাউল শাকুর মজিদের            শিল্প-সাহিত্য-নাট্যকলায় নানাভাবে নানান ঢঙে বিচরণ।

এর আগে তিনি বাউল শাহ আবদুল করিমের জীবন ও দর্শন নিয়ে লিখেছেন মঞ্চনাটক মহাজনের নাও। বাউল শাহ আবদুল করিমের জীবন নিয়ে নির্মাণ করেছেন তথ্যচিত্র ভাটির পুরুষ। বাউল শাহ আবদুল করিমের জীবন নিয়ে তথ্যচিত্র বানাতে গিয়ে শাকুর মজিদ দীর্ঘ ছয় বছরে যেসব অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছেন, সেসব অভিজ্ঞতার আলোকে এবার লিখেছেন স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থ ভাটির পুরুষ-কথা।

বাউল শাহ আবদুল করিমের ওপর প্রামাণ্যচিত্র বানানোর জন্য বিশিষ্ট নাট্যনির্মাতা, প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা, ভ্রমণ-কথাসাহিত্যিক, স্থপতি, গবেষক, শিক্ষক ও আধুনিক নগর-বাউল শাকুর মজিদ ২০০৩ সালের ২১ সেপ্টেম্বর থেকে ২০০৯ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ছয় বছরে প্রায় দশবার বাউল শাহ আবদুল করিমের মুখোমুখি হন। এসব করতে গিয়ে হাওরের ঢেউ-খেলানো জল, কালনী নদী, নৌকাবাইচ, ধলমেলা, উজানধলের ওরস, সিলেটের প্রত্যন্ত উপশহর দিরাই ও বাউল শাহ আবদুল করিমের শিষ্যদের সঙ্গে তিনি নানাভাবে মিশেছেন। বাউল শাহ আবদুল করিমের ওপর যাদের আগ্রহ রয়েছে, যারা তাঁর গান নিয়ে কাজ করেছেন, গবেষণা করেছেন, নানাভাবে নানান পর্যায়ে যারা শাহ আবদুল করিমের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তাদের সঙ্গে নানান পর্যায়ে নানাভাবে শাকুর মজিদ কথা বলেছেন। এসব করতে গিয়ে নগর-বাউল শাকুর মজিদ যেসব অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন, সেসব স্মৃতিচারণই অত্যন্ত সহজ-সরল ভাষায়, মনের মমতা মিশিয়ে তুলে ধরেছেন তাঁর নতুন স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থ ভাটির পুরুষ-কথায়।

লোকায়ত সংস্কৃতি ও আধুনিক সংস্কৃতির যুগসন্ধিক্ষণের গীতিকবি বাউল শাহ আবদুল করিম। ১৩২২ সালের ফাল্পুন মাসের প্রথম মঙ্গলবার (১৯১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে) দিরাই থানার উজানধল গ্রামে বাউল শাহ আবদুল করিমের জন্ম। খুব ছোটবেলায় মুদিদোকানের অ্যাসিসট্যান্ট হিসেবে কর্মজীবনের শুরু। তারপর মহাজনের বাড়িতে রাখালের চাকরি। গানের নেশায় একসময় গান শেখার জন্য ওস্তাদের কাছে গমন। তারপর শাহ আবদুল করিমের জীবনে নানা বাধা-বিপত্তি এলেও তিনি গানসাধন ছাড়েননি। ঈদের জামাত থেকে তাঁকে বের করে দেওয়া, মসজিদ থেকে তাঁকে বিতাড়িত করা, এক পর্যায়ে গানের কারণেই তাঁকে গ্রামছাড়া করার পরও শাহ আবদুল করিম জীবনে কখনোই গান ছাড়েননি। আবার গ্রামবাসীর উদ্যোগে গানের লড়াইয়ে নিজেদের গ্রামকে জেতানোর মতলব থেকেই শাহ আবদুল করিমকে সেই গ্রামবাসীই ডেকে আনেন। শাহ আবদুল করিম সন্ন্যাসী জীবন যাপন করতেন। বাড়ি থেকে একবার বের হলে তিন মাস আর কোনো খোঁজ থাকত না। সন্ন্যাসী জীবনের মধ্যেও তাঁর সংসার ছিল। প্রথম স্ত্রী হারানোর পর আবারও বিয়ে করেছিলেন। স্ত্রীর নামে তিনি প্রথম গানের বইও প্রকাশ করেছিলেন। ১৩৫৫ সালে আফতাব সংগীত নামে সে-বইয়ে মোট ৪০টি গান ছিল। বইটির দাম ছিল বারো আনা। শাহ আবদুল করিমের দ্বিতীয় গানের বইয়ের নাম গণসংগীত। এগারোটি গান নিয়ে ষোলো পৃষ্ঠার বইটির প্রকাশক ছিলেন ছনাওর রাজা। ১৯৮১ সালে ১৬৫টি গান নিয়ে তিনি প্রকাশ করেন দশ ফর্মার কালনীর ঢেউ গানের বইটি। বইটির প্রকাশক তার ছেলে নূর জালাল (বাবুল)। বইটির দাম ছিল ১৫ টাকা। বইটি তিনি নিজের টাকায় প্রকাশ করেছিলেন। এরপর ১৯৯০ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি ধলমেলার দিন          (১ ফাল্গুন) একটি দীর্ঘ কবিতা ও একটি গান নিয়ে তিনি প্রকাশ করেন ষোলো পৃষ্ঠারধলমেলা বইটি। ১৯৯৮ সালে ৮৫টি গান নিয়ে প্রকাশ করেন ভাটির চিঠি বইটি। বইটি প্রকাশ করে সিলেট স্টেশন ক্লাব। ১৯৮১ সালের পরে তিনি যেসব গান লিখেছেন সেগুলো নিয়ে প্রকাশিত হয় ৮৮ পৃষ্ঠার বই কালনীর কূলে। বইটির প্রকাশক লোকচিহ্ন। ২০০১ সালে শাহ আবদুল করিম একুশে পুরস্কার পাওয়ার পর ২০০৯ সালের ২২ মে প্রকাশিত হয় শাহ আবদুল করিম রজনাসমগ্র। এতে মোট ৪৮০টি গান স্থান পেয়েছে। শাকুর মজিদের গবেষণায় উঠে এসেছে শাহ আবদুল করিমের মোট গানের সংখ্যা ৪৮০টি।

ভাটির পুরুষ নির্মাণ করতে গিয়ে শাকুর মজিদ শাহ আবদুল করিমের শিষ্য রুহী ঠাকুর, রণেশ ঠাকুর, জামাল উদ্দিন হাসান বান্না, আবদুর রহমান, সিরাজ মিয়া, ভাগিনা তোয়াহেদ ও ছেলে নূর জালালদের (বাবুল) সঙ্গে কথা বলেছেন। এছাড়া হুমায়ূন আহমেদ, সাবেক ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরী, অধ্যাপক ড. মৃদুল কান্তি চক্রবর্তী, সংগীতশিল্পী ও সুরকার সঞ্জীব চৌধুরী, হাবিব, লন্ডনের কায়া ও হেলাল, কলকাতার দোহার শিল্পগোষ্ঠী, কালিকা প্রসাদ, কবি ও প্রাবন্ধিক শুভেন্দু ইমাম, লোক-গবেষক ড. আবুল ফতেহ ফাত্তাহ, সাংবাদিক ও গবেষক সুমনকুমার দাশসহ অনেকের সঙ্গে কথা বলেছেন।

দীর্ঘ ছয় বছরে বাউল শাহ আবদুল করিমকে নিয়ে নানাভাবে গবেষণা করার যে-অভিজ্ঞতা শাকুর মজিদ অত্যন্ত ধৈর্য নিয়ে করেছেন, সেখানে কিছু কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত বিড়ম্বনার মুখোমুখিও তাঁকে হতে হয়েছে। তবু একজন নির্ভীক অভিযাত্রীর মতো তিনি যে অসাধ্য সাধন করেছেন, সে-অভিজ্ঞতার সরল বয়ান ভাটির           পুরুষ-কথা। বইটির প্রকাশক আবুল খায়ের। বইটি প্রকাশ করেছে বেঙ্গল পাবলিকেশন্স। বইটির প্রচ্ছদ করেছেন শাকুর মজিদের আলোকচিত্র অবলম্বনে শিল্পী শিবু কুমার শীল। বইটির মূল্য ২৮৫ টাকা। বইটির পৃষ্ঠাসংখ্যা ১৬৮। বোর্ড বাঁধাই বইটিতে শাকুর মজিদ প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণের নানান পর্যায়ের অনেক দুর্লভ ছবিও ব্যবহার করেছেন। যারা বাউল শাহ আবদুল করিম সম্পর্কে জানতে চান, এই বইটি তাদের সংগ্রহ করতেই হবে। শাহ আবদুল করিমের অনেক গানের কথা বইয়ে স্থান পেয়েছে। বাউল শাহ আবদুল করিমের জনপ্রিয় গানগুলো যেমন – বন্দে মায়া লাগাইছে, পিরিতি শিখাইছে, আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম, গাড়ি চলে না, আমি কুলহারা কলঙ্কিনী, কেমনে ভুলিবো আমি বাঁচি না তারে ছাড়া, কোন মেস্তরি নাও বানাইছে, কেনে পিরিতি বাড়াইলারে বন্ধু, বসন্ত বাতাসে সইগো, আইলায় না আইলায় না রে বন্ধু, মহাজনে বানাইয়াছে ময়ূরপঙ্খী নাও, আমি তোমার কলের গাড়ি, সখী কুঞ্জ সাজাও গো, জিজ্ঞাস করি তোমার কাছে, মানুষ হয়ে তালাশ করলে, আমি বাংলা মায়ের ছেলে, রঙের দুনিয়া তরে চায় না ইত্যাদি গান বাংলার গানপাগল মানুষের অন্তরে চিরদিন বেঁচে থাকবে। শাকুর মজিদ বাউল শাহ আবদুল করিমকে যেভাবে তুলে ধরেছেন, তাঁর এই পরিশ্রমকে অন্তরের অন্তস্তল থেকে সাধুবাদ জানাই। ২০০৯ সালের ১২ সেপ্টেম্বর সিলেটের নূরজাহান পলি ক্লিনিকে বাউল শাহ আবদুল করিম ইহকাল ত্যাগ করেন। উজানধল গ্রামে নিজের বাড়িতে স্ত্রী সরলার কবরের পাশে তাঁকে সমাহিত করা হয় ১৩ সেপ্টেম্বর ২০০৯ সালে। যারা বাউল শাহ আবদুল করিমের গান ভালোবাসেন, তারা দেখতে পারেন শাকুর মজিদের লেখা মঞ্চনাটক সুবচন নাট্য সংসদের মহাজনের নাও আর তথ্যচিত্র ভাটির পুরুষ। r

 

জারিগানের আসরে বিষাদ-সিন্ধু

আবুল হাসান চৌধুরী

 

ফোকলোর ও লিখিত সাহিত্য

জারিগানের আসরে

বিষাদ-সিন্ধু

আত্তীকরণ ও পরিবেশন-পদ্ধতি

সাইমন জাকারিয়া ও নাজমীন মর্তুজা

 

বাংলা একাডেমি

ঢাকা, ২০১২

 

৪০০ টাকা

 

 

হালে বাংলাসাহিত্য ও লোকসংস্কৃতির গবেষকদের মধ্যে অভিজাত বা উচ্চশ্রেণির সাহিত্যে ‘লোকউপাদান’ অনুসন্ধানের প্রবণতা অনেকটা সংক্রামক ব্যাধির মতো ছড়িয়ে পড়েছে। প্রাচীন-মধ্যযুগের বাংলাসাহিত্য থেকে শুরু করে আধুনিক বাংলাসাহিত্যের প্রায় সকল শাখায় ফোকলোরের নানা উপাদান খুঁজে বের করা এক শ্রেণির ফোকলোরদরদি গবেষকের শখে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের  এমফিল/ পিএইচ-ডি গবেষণায় ‘লোক-উপাদান’ জাতীয় বিষয়ই বেশি দেখা যায়। একদা মধ্যযুগের কবিরা লোকমুখে প্রচলিত কথা-কাহিনিকেই নিজের মতো করে কলারূপ দিয়েছিলেন। তাই খুব স্বাভাবিকভাবেই তা অনেকটা তথাকথিত লোকউপাদানের সম্ভারে পরিণত হয়েছে। অন্যদিকে আধুনিক  কবি-সাহিত্যিকরাও লোককথা, লোকপুরাণ, লোকসংগীত ইত্যাদিকে তাঁদের সৃষ্ট সাহিত্যে আত্তীকরণ করে তার নবরূপায়ণ কিংবা ক্ষেত্রবিশেষে নবজন্মও ঘটিয়েছেন। এক্ষেত্রে মাইকেল মধুসূদন দত্ত থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাশ, আল মাহমুদসহ আরো অনেকের নাম করা যাবে। পরবর্তীকালে তাঁদের সাহিত্য অবলম্বনে লোকউপাদান জাতীয় গবেষণাও হয়েছে প্রচুর। বিপরীতক্রমে ফোকলোরের যাঁরা প্রত্যক্ষ ধারক-বাহক, স্রষ্টা এবং পরিবেশনকারী? লোককবি, কথক, লোকশিল্পী, গায়ক, বয়াতিরা অভিজাত বা শিষ্ট সাহিত্য থেকে কোন কোন উপাদান কতটুকু গ্রহণ করেছেন, সে-গবেষণায় মনোনিবেশ করার কথা এতকাল কারো মাথায় আসেনি। সম্প্রতি ক্ষেত্রসমীক্ষানির্ভর গবেষণায় সুপরিচিত সাইমন জাকারিয়া ও তাঁর সহযোগী লেখক নাজমীন মর্তুজা ফোকলোর ও লিখিত সাহিত্য : জারিগানের আসরে বিষাদ-সিন্ধু আত্তীকরণ ও পরিবেশন-পদ্ধতি শিরোনামে একখানি বৃহৎ কলেবর বই লিখে ফোকলোর ও লিখিত সাহিত্যের মধ্যে সম্পর্কসূত্র নির্ণয়ে সচেষ্ট হয়েছেন। এ-কাজে তাঁরা কতখানি সফল হয়েছেন সে-বিচারের চেয়েও বড়ো কথা হলো, দেশে ফোকলোরবিদ বলে খ্যাত অনেক পন্ডিতই যখন বিষয়টি নিয়ে ভাবেননি, তখন তাঁরা কাজটিতে হাত দিয়েছেন। অবশ্য এ-ধরনের ভাবনা ও কর্মের প্রথম কৃতিত্বের শিরোপা যদি কাউকে দিতে হয় তবে তিনি হলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বইটির প্রথম ফ্ল্যাপে ‘এ দেশে ফোকলোরের সঙ্গে লেখ্য-ঐতিহ্য, এমনকি লিখিত সাহিত্যের সম্পর্ক বিচার বিষয়ে বিশ্লেষণ বা আলোচনা-সমালোচনা চোখে পড়ে না’ বলে যে-দাবি করা হয়েছে, তা সর্বাংশে সত্য নয়। এ-প্রসঙ্গে স্মরণ করা যেতে পারে যে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর লোকসাহিত্য গ্রন্থের ‘গ্রামসাহিত্য’ প্রবন্ধে প্রথম এ-বিষয়টির অবতারণা করেন এভাবে :

গাছের শিকড়টা যেমন মাটির সঙ্গে জড়িত এবং তাহার অগ্রভাগ আকাশের দিকে ছড়াইয়া পড়িয়াছে, তেমনি সর্বত্রই সাহিত্যের নিম্ন-অংশ স্বদেশের মাটির মধ্যেই অনেক পরিমাণে জড়িত হইয়া ঢাকা থাকে; তাহা বিশেষরূপে, সংকীর্ণরূপে দেশীয়, স্থানীয়। তাহা কেবল দেশের জনসাধারণেই উপভোগ্য ও আয়ত্তগম্য, সেখানে বাহিরের লোক প্রবেশের অধিকার পায় না। সাহিত্যের যে-অংশ সার্বভৌমিক তাহা এই প্রাদেশিক নিম্নস্তরের থাক্টার উপরে দাঁড়াইয়া আছে। এইরূপ নিম্নসাহিত্য এবং উচ্চসাহিত্যের মধ্যে বরাবর ভিতরকার একটি যোগ আছে। যে অংশ আকাশের দিকে আছে তাহার ফুলফল-ডালপালার সঙ্গে মাটির নীচেকার শিকড়গুলার তুলনা হয় না? তবু তত্ত্ববিদদের কাছে তাহাদের সাদৃশ্য ও সম্বন্ধ কিছুতেই ঘুচিবার নহে।

মীর মশাররফ হোসেন তাঁর অতিজনপ্রিয় উপন্যাস, রবীন্দ্রনাথের কথায় যা ‘উচ্চসাহিত্য’? সেই বিষাদ-সিন্ধু রচনায় পুঁথিসাহিত্যের অনেক আজগুবি গালগল্প, কিংবা অলৌকিক উপাদান অকপটে গ্রহণ করেছিলেন, যা সাহিত্যবোদ্ধাদের কাছে সচরাচর ‘নিম্নসাহিত্য’ বলেই পরিচিত এবং যার একটি শক্তপোক্ত লোকায়ত ভিত্তি আছে। আমরা জানি, বিষাদ-সিন্ধু এক বিশাল মহাকাব্যিক আবহে গুরুগম্ভীর সংস্কৃতঘেঁষা বাংলায় রচিত। সে-গ্রন্থ গ্রামের নিরক্ষর কিংবা সামান্য লেখাপড়াজানা লোকের পক্ষে সহসা বুঝে-ওঠা সম্ভব নয়। সেই গ্রন্থে বর্ণিত কাহিনি ও ঘটনা  (লোকসমাজে যার বিশেষ আকর্ষণ ও আবেদন আছে) সাধারণ মানুষের বোধগম্য ভাষায় যাঁরা জারিগানের আসরে তুলে ধরেন, তাঁরাও আসলে রবীন্দ্রনাথ-কথিত ‘উচ্চসাহিত্য’ আত্তীকরণ করে নিজস্ব কলানৈপুণ্যে তা দর্শক-শ্রোতার মনোরঞ্জনের জন্য পরিবেশন করেন। লোকনন্দনতত্ত্বের পাঠ নিতে গিয়ে আমরা এটা লক্ষ করেছি যে, একজন পুঁথিপাঠক থেকে শুরু করে কবিগান, পালাগানের সরকার কিংবা জারিগানের বয়াতি, যাঁরাই আসরে সমাগত মানুষকে আনন্দ দেওয়ার জন্য কলাকার হিসেবে অবতীর্ণ হন, তাঁদেরকে একই সঙ্গে যেমন প্রদর্শনকলায় কালোয়াতি দেখাতে হয়, তেমনি ধর্মশাস্ত্র, বিজ্ঞান-দর্শন ও অন্যান্য  তত্ত্বকথায়ও জ্ঞান অর্জন করতে হয়। সেদিক থেকে জারিগানের একজন বয়াতি যখন কারবালার শোকাবহ ঘটনা নিয়ে গান করবেন, তিনি যদি অল্প লেখাপড়াজানা লোকও হন তাহলে বিষাদ-সিন্ধু তাঁর পড়া থাকবে এবং সেটি তিনি জারিগানের পরিবেশনায় কাজে লাগাবেন এটাই স্বাভাবিক। আবার কোনো কোনো আধুনিক কবি-সাহিত্যিক           সর্বস্তরের পাঠকের কাছে যখন খুবই জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন, তখন দেখা যায় তাঁদের সৃষ্ট সাহিত্যের কোনো বিশেষ চরিত্র কিংবা ঘটনা নিয়ে লোককবিরা কবিতা, গান ইত্যাদি রচনা করেন। যেমন – জসীমউদ্দীনের নক্সী কাঁথার মাঠ অবলম্বন করে কবিয়াল বিজয় সরকার গান রচনা করেছেন। সুতরাং বলা চলে, লোকসাহিত্যের সঙ্গে অভিজাত সাহিত্যের কিংবা বিপরীতক্রমে লিখিত সাহিত্যের সঙ্গে মৌখিক সাহিত্যের যোগ? উভয়ের সৃষ্টিলগ্ন থেকেই রয়েছে। তবে এ দুয়ের সম্পর্কসূত্র সন্ধান এবং তুলনামূলক আলোচনা ও বিশ্লেষণ এ-দেশের ফোকলোর গবেষকরা তেমন একটা করেননি। মৌখিক সাহিত্যের উপাদান লিখিত সাহিত্যে কতটা কীভাবে ব্যবহৃত হয়েছে, তা নিয়ে বিস্তর গবেষণা হলেও লিখিত সাহিত্যের উপাদান মৌখিক সাহিত্যে কতটা গৃহীত হয়েছে এবং কী কারণে হয়েছে সে-বিষয়ে কোনো আলোচনা আগে হয়নি; খানিকটা অভাবিতপূর্বরূপেই, জারিগানের আসরে মীর মশাররফ হোসেনের বিষাদ-সিন্ধুর আত্তীকরণ ও পরিবেশন পদ্ধতি বর্ণনার মাধ্যমে তা করে দেখালেন সাইমন জাকারিয়া এবং তাঁর সহযোগী লেখক নাজমীন মর্তুজা।

বইটিতে উপসংহারসহ মোট সাতটি অধ্যায় এবং চারটি পরিশিষ্ট রয়েছে। প্রথম অধ্যায়ে সংজ্ঞায়নের দিক থেকে ফোকলোরের সাম্প্রতিক ব্যাখ্যাসহ লিখিত ঐতিহ্যের সঙ্গে এর সম্পর্ক এবং হস্তান্তর বা রূপান্তর প্রক্রিয়া ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এ ছাড়া এতে লোকসংস্কৃতি ও ফোকলোরের পার্থক্যও তুলে ধরা হয়েছে। ফোকলোর সম্পর্কে পুরনো ধ্যান-ধারণার বিপরীতে এখন ফোকলোর বলতে কী বোঝায়, সে-সম্পর্কে খানিকটা নতুন আলো ফেলবার চেষ্টা আছে। তবে এ-অধ্যায়ে খ্যাতনামা ফোকলোরবিদ প্রফেসর মযহারুল ইসলামের ‘ফোকলোর পরিচিতি ও পঠন-পাঠন’ বইয়ের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে পাশ্চাত্যের বিশেষত আমেরিকান ফোকলোরে মৌখিক ও লিখিত ঐতিহ্যের সম্পর্কসূত্র বিষয়ে কী ধরনের গবেষণা হয়েছে সেটি উল্লেখ করলে ভালো হতো বলে মনে করি। অবশ্য ফোকলোর অনুরাগী কৌতূহলী পাঠকদের জন্যে বাড়তি পাওনা হলো এখানে সংযোজিত লিখিত সাহিত্যে স্থান পাওয়া লোকসাহিত্যের নিদর্শনসমূহের উল্লেখ। একই সঙ্গে আধুনিককালে লিখিত সাহিত্যের ফোকলোর হয়ে-ওঠার বেশকটি দৃষ্টান্তও এতে রয়েছে। যেমন – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলীর ‘মরণ রে তুঁহুঁ মম শ্যাম সমান’ পদটির অনুসরণে প্রখ্যাত কবিয়াল বিজয় সরকার লিখেছেন? ‘মরণ রে তুঁহুঁ মম শ্যামও সমান।/ আমায় রাধাসম বাধা দিয়ে/ রেখেছে সংসার আয়ান\’ সাইমন জাকারিয়া ও নাজমীন মর্তুজা বিজয়ের পদটিকে লোকসংগীত বলেছেন। অবশ্য লোকসংগীত মুখে মুখে রচিত ও প্রচারিত হয়? আশুতোষ ভট্টাচার্যের এ-সংজ্ঞা মানলে বিজয়ের গানটিকে লোকসংগীত বলা না গেলেও সেটিতে যে লোকচারিত্র্য বর্তমান, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। বিজয় সরকার জসীমউদ্দীনের নকশীকাঁথার মাঠে বর্ণিত রূপাই-সাজুর করুণগাথাকেও নিজের মতো করে উপস্থাপন করেছেন। যেমন – ‘নকশীকাঁথার মাঠে রে/ সাজুর কথায় আজো কাঁদে রূপাই মিঞার বাঁশের বাঁশি।/ তাদের আশরা বাসা ভেঙে গেছে রে/ তবু যায়নি ভালবাসাবাসি \’ (ইত্যাদি) প্রসঙ্গত, আমরা উল্লেখ করতে পারি তিরিশের দশকের বিখ্যাত পঞ্চকবির একজন বিষ্ণু দে জনপ্রিয় লোককাহিনি সাতভাই চম্পা নামেই কাব্য রচনা করেছিলেন। এ উদাহরণগুলোই লিখিত সাহিত্য ও লোকসাহিত্যের পরস্পর  দেওয়া-নেওয়ার সম্পর্ককে প্রমাণ করে।

দ্বিতীয় অধ্যায়ের আলোচ্য বিষয় মূলত কারবালা যুদ্ধের মর্মান্তিক ইতিহাস এবং সে-ইতিহাসনির্ভর সাহিত্য-সংস্কৃতির ঐতিহ্য সম্পর্কে সবিস্তার আলোচনা। জারিগান ও বিষাদ-সিন্ধুর বিষয়বস্ত্ত তুলে ধরতে গিয়ে এটি করা হয়েছে, যা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে একেবারে নতুন নয়; বিশেষ করে কবি জসীমউদ্দীন তাঁর জারীগান গ্রন্থে এ-বিষয়ে বিস্তৃত আলোচনা করেছেন। অবশ্য লেখকদ্বয়               এজন্যে পূর্বসূরি লেখক-গবেষকদের কাছে ঋণ স্বীকার করেছেন।

তৃতীয় অধ্যায়টি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ এ জন্যে যে, এতে ক্ষেত্রসমীক্ষার ভিত্তিতে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্তের সাহায্যে বাংলাদেশের জারিগানের আসরে মীর মশাররফ হোসেনের বিষাদ-সিন্ধু আত্তীকরণের ইতিহাস ও পরিবেশন-পদ্ধতি বিশ্লেষিত হয়েছে। আত্তীকরণের ইতিহাসটি অনেকেই হয়তো জানেন না। পরিবেশন-পদ্ধতি জারিগানের আসরে গিয়ে দেখে নিলেই চলে, কিন্তু ইতিহাসটি তো আর বয়াতিরা সরাসরি আসরে উপস্থাপন করেন না। এ-বিষয়ে নেত্রকোনা অঞ্চলের বিখ্যাত জারিশিল্পী হেলিম বয়াতির যে দীর্ঘ ও প্রাসঙ্গিক সাক্ষাৎকারটি এখানে সংযোজিত হয়েছে তা অত্যন্ত মূল্যবান। নেত্রকোনা থেকে সংগৃহীত শুধু ‘বিষাদ-জারির নমুনা বা টেক্সট বিশ্লেষণ করেই লেখকদ্বয় যদি বিষাদ-সিন্ধুর আত্তীকরণ কীভাবে হয়, তা দেখাতেন তাহলে তা আধুনিক এবং বিজ্ঞানসম্মত গবেষণা  হতো না। এক্ষেত্রে জারিশিল্পীদের নিজস্ব ব্যাখ্যা, মতামত এবং আবেগ-অনুভূতি সংবলিত অভিব্যক্তি, যা সাক্ষাৎকারে প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে বের করে আনা গেছে, তা কনটেক্সচুয়াল গবেষণার জন্যে অপরিহার্য। এ সাক্ষাৎকারের মাধ্যমেই আমরা জানতে পারি, জারিগানের আসরে ‘বিষাদ-সিন্ধু’ দুভাবে আত্তীকৃত হয়। প্রথমত, প্রশ্নোত্তরে বিষাদ-সিন্ধুর মূল গদ্যরীতি উদ্ধৃত হয়; দ্বিতীয়ত, ওই গদ্যরীতিকে বিভিন্ন ছন্দ-অলংকারের রূপ-রসে, পদ্যরীতিতে উপস্থাপন করা হয়। পদ্যরীতিতে রূপান্তরের কাজটি বয়াতিরা মুখেই মুখেই করেন; আগে থেকে লিখে নেন না (বিস্ময়কর হলেও সত্য যে, নেত্রকোনার জারিশিল্পী আবদুল হেলিম বয়াতী, আবুল হাশেম সরকার প্রমুখের বিষাদ-সিন্ধুর ৬১টি প্রবাহ রীতিমতো মুখস্থ আছে)।  তবে এ-রূপান্তর কখনো হুবহু হয় না, ‘কিছু ছেড়ে এবং কিছু ধরে’ অর্থাৎ প্রয়োজন অনুযায়ী গ্রহণ-বজ©র্নর মাধ্যমে এটি করা হয়। এতে অবশ্য বিষাদ-সিন্ধুর মূল ভাবের কোনো অপলাপ ঘটে না। পরিবেশনকালে মূল টেক্সট এবং শিল্পীদের বহিরঙ্গে যে নতুন কিছু যোগ করার চিন্তা মাথায় আসে, সে-সম্পর্কে হেলিম বয়াতি খোলাখুলি বলেছেন, ‘চিন্তাগুলি আসছে এই যে, নিত্য-নতুন জগৎ আসছে? নিত্য-নতুন আইডিয়াও আসছে।’ আবার জারিগান শোকের হলেও সেখানেও বিনোদনের ব্যাপার থাকে। তাই দর্শক-শ্রোতার চাহিদার কথা মাথায় রেখেই বিষয়টিকে উপভোগ্য করে তোলার জন্যেই মূলত ছন্দের মিল, অলংকার ও সুর যোজনা এবং তাল-লয়-দিশার দরকার পড়ে। এ সম্পর্কে হেলিম বয়াতি তাঁর সাক্ষাৎকারে আরো খোলাসা করে বলেছেন – ‘মানুষের কাছে শ্রুতিমধুর করতে গেলে তা গান আকারেই উপস্থাপন করতে হবে। গান যেহেতু করতে হবে তাই আমাদের এখানে বিষাদ-সিন্ধু থেকে কিছু কারচুপি করতে হবে। অর্থাৎ বিষাদ-সিন্ধু হতে কিছু নিতে – কিছু দিতে হবে। লেখক মীর মশাররফ হোসেন কোনো সুর-রাগিণী তাঁর ‘বিষাদে’ দেন নাই। সুরটা আমাদের দেয়া। আমরা সাধারণত পাঁচ প্রকার, সাত প্রকার, আট প্রকার, দশ প্রকার, বিশ প্রকার, পনের প্রকার সুর দিই।’ হেলিম বয়াতির এ-বক্তব্য থেকে বোঝা যায় জারিগানের আসরে লোকসমাজের রসপিপাসু দর্শক-শ্রোতার সামনে পরিবেশনকালে বিষাদ-সিন্ধুর নবজন্ম ঘটে।

বিষাদ-জারির আসরে মীরের অসম্ভব জনপ্রিয় এই উপন্যাসের ঘটনা, চরিত্র ও ঘটনার রসবিচার বুঝতে হলে আলোচ্য গ্রন্থের চতুর্থ অধ্যায়টিও পাঠককে আমলে নিতে হবে বিশেষ গুরুতেবর সঙ্গে।            এ-অধ্যায়ের আলোচ্য বিষয় বিষাদ-জারির দোহার-দিশা এবং ডাকের প্রকরণ-উপকরণ। আর এগুলো জারিগান পরিবেশনায় একটি আবশ্যিক ও আকর্ষণীয় অংশ। এতে বিচিত্র রস সৃষ্টি করে জারিয়ালরা দর্শক-শ্রোতাদের আনন্দে আপ্লুত করে। লেখক জারিগানের এই আনন্দ উপকরণের যথাযথ উদাহরণ ও তার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন।

পঞ্চম অধ্যায়টিকে এ-গ্রন্থের কেন্দ্রবিন্দু বলা যেতে পারে। এখানে জারিগানের আসরে মীর মশাররফ হোসেনের বিষাদ-সিন্ধু উপন্যাসের কোন পর্ব এবং কোন্ প্রবাহ থেকে জারিয়ালরা কতটুকু কীভাবে উপস্থাপন করেছেন তা ওই উপন্যাস আর বিষাদ-জারি গান পাশাপাশি তুলে ধরে দেখানো হয়েছে। প্রশ্ন উঠতে পারে, তুলনামূলক আলোচনার জন্যে বিষাদ-সিন্ধুর পুরো টেক্সট তুলে দেওয়ার আদৌ দরকার আছে কি-না। দরকার আছে এজন্যে যে, দুটি টেক্সটকে পাশাপাশি রেখে না পড়লে বোঝা যাবে না জারিগানের বয়াতিরা মূল বিষাদ-সিন্ধু থেকে কতটা কীভাবে গ্রহণ করছেন এবং তাঁদের নবতর সৃষ্টির রূপ ও রসায়নই বা কী? তবে তুলনামূলক পাঠের জন্য নিছক দুটি টেক্সটকে পাশাপাশি তুলে ধরাই যথেষ্ট নয়, টেক্সট বিশ্লেষণের মাধ্যমে বিভিন্নমুখী তুলনা হতে পারে। যেমন? কাহিনি, ঘটনা, চরিত্র কিংবা লিখিত সাহিত্যের লেখক এবং মৌখিক সাহিত্যের পরিবেশনকারীর প্রকাশভঙ্গি, মনোলোক অথবা চেতনার বিশ্লেষণ হতে পারে, যা এ-বইয়ে সবিস্তারে করা হয়নি। আবার ফোকলোরের দৃষ্টিকোণ থেকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গেও জারিগান নিয়ে গবেষণা হয়েছে (দ্রষ্টব্য : মালা মৈত্র-কৃত লোকসংস্কৃতি বিজ্ঞানের আলোকে জারিগান, অপ্রকাশিত পিএইচ-ডি অভিসন্দর্ভ, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়)। তাতে দেখা যায়, পশ্চিমবঙ্গে বিশেষত মুর্শিদাবাদ জেলার জারিগানেও মীর মশাররফের               বিষাদ-সিন্ধু উপন্যাসের কোনো কোনো অংশ আত্তীকৃত হয়েছে।                  এ-অধ্যায়ের তুলনামূলক আলোচনায় পশ্চিমবঙ্গের জারিগানের শিল্পীরা কীভাবে কতটা বিষাদ-সিন্ধুকে অবলম্বন করে থাকেন তা দেখাতে পারলে এ-অধ্যায়টি আরো সমৃদ্ধ হতো বলে মনে করি।

মীর মশাররফ তাঁর উপন্যাস রচনা করতে গিয়ে কারবালাবিষয়ক পুঁথি থেকেও অনেক উপাদান গ্রহণ করেছিলেন। উল্লেখ্য, পুঁথি একসময় গ্রামীণ জনপদে বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে রীতিমতো একটি পরিবেশনা শিল্পরূপেই আদরণীয় ছিল। তাই ষষ্ঠ অধ্যায়ে কারবালাবিষয়ক পুঁথির সঙ্গে ‘বিষাদ-জারি’র যে তুলনামূলক আলোচনা করা হয়েছে তাও যথেষ্ট প্রাসঙ্গিক।

এই বইয়ের পরিশিষ্ট ১-এ সংযোজিত ‘বিষাদ-জারি’র প্রতিযোগিতামূলক আসরের নিয়মাবলি বিশেষ কৌতূহলোদ্দীপক। যেমন, একটি নিয়ম হলো বয়াতিদের হাতে কোনো কাগজ থাকবে না। এটি পুরোপুরি মৌখিক সাহিত্যেরই পরিবেশনারীতি। পরিশিষ্ট ৩-এ বিষাদ-জারির শিল্পীপরিচিতি বইটিকে সমৃদ্ধ করেছে। কারণ ফোকলোরের প্রত্যক্ষ ধারক-বাহকদের পাশ কাটিয়ে শুধু টেক্সটনির্ভর গবেষণা কখনোই পূর্ণতা লাভ করে না।

গ্রন্থশিরোনাম সম্পর্কে আমাদের বক্তব্য হলো – নামকরণের ভেতর দিয়ে আলোচ্য বিষয়সমূহ একনজরে বোঝানোর জন্যেই হয়তোবা বইয়ের নামটি দীর্ঘ করা হয়েছে। যার প্রয়োজন ছিল না। আসলে, ‘নেত্রকোনা অঞ্চলের বিষাদজারি’, ‘জারিগানের আসরে বিষাদ-সিন্ধু’ কিংবা ‘জারিগানে ‘বিষাদ-সিন্ধু’র আত্তীকরণ ও পরিবেশন-পদ্ধতি’? এ ধরনের সংক্ষিপ্ত ও সহজে স্বল্পতম সময়ে উচ্চারণযোগ্য নামকরণ করে প্রাসঙ্গিক বিষয়াদির আলোচনা ভূমিকায় সেরে নিলেই ভালো হতো।

পরিশেষে এটুকু বলা যায়, বইটির বিষয়-বিন্যাস ও বিশ্লেষণ হয়তো সকল পাঠককে সমানভাবে তুষ্ট করবে না, তবে ক্ষেত্রসমীক্ষনির্ভর শ্রমসাধ্য যে-কাজটি সাইমন জাকারিয়া এবং তাঁর যোগ্য সহলেখক নাজমীন মর্তুজা করেছেন তা বাংলাদেশের ফোকলোর চর্চার ইতিহাসে নতুন ও বেশ কৌতূহল উদ্রেককারী। উপসংহারে জন মাইল ফলির ‘দি থিয়োরি অব ওরাল কম্পোজিশন : হিস্ট্রিরি অ্যান্ড মেথোডলজি’র উল্লেখ করে বলা হয়েছে :                 ‘… কোনো গায়ক বা গায়েন যখন তাঁর স্মৃতিতে ধারণকৃত ধ্রুপদী আখ্যানের কোনো একটি অংশ বা ঘটনা মৌখিক রীতিতে উপস্থাপন করতে যান তখন গানের সুর বা বাণীর চরণবিন্যাসে তিনি সাধারণত ঐতিহ্যবাহী কোনো না কোনো পদ্ধতি যেমন অনুসরণ করেন, তেমনি গানের বাণীর বা আখ্যানের ঘটনার ব্যাখ্যায় নিজস্ব অভিজ্ঞতা বা নিজের ব্যক্তিগত আবেগকে অনেক ক্ষেত্রে আখ্যানে বর্ণিত চরিত্রের আবেগের সঙ্গে মিশিয়ে দেন। এমনটা তো আমাদের দেশের  লোক-পরিবেশনাগুলোতেও প্রত্যক্ষ করা যায়।’ লেখকদের এ কথার সূত্র ধরেই বলতে চাই বিষাদ-জারির বয়াতিরা তা কতটা করেছেন এবং কোথায় কোথায়? তার বিস্তারিত ও নিবিড় ব্যাখ্যা খুবই দরকার ছিল। আবার, উপসংহারের একদম শেষ বাক্যে ‘বিষাদ-জারির প্রতিযোগিতামূলক আসর পর্যবেক্ষণ’ করে ‘লিখিত সাহিত্যের মৌখিক উপস্থাপন কৌশল বিষয়ে’ যে ‘স্বতন্ত্র একটি  লোক-তত্ত্বের বীজ চিহ্নিত করা যায়’ বলে লেখকদ্বয় তাঁদের এ বিশালাকার গ্রন্থের ইতি টেনেছেন সে লোকতত্ত্বের বীজটি সম্পর্কে খানিকটা ব্যাখ্যা দিলে সাধারণ পাঠকের কৌতূহল পরিপূর্ণ হতো। এ নিয়ে ভিন্ন একটি গবেষণাগ্রন্থ লেখা যেতে পারে বলে লেখকদ্বয় আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। সাধারণ পাঠক হিসেবে আমরাও আশা করব, কোনো না কোনো ফোকলোরবিদ এ-কাজটি করে সফল হবেন এবং তা বাংলাদেশের ফোকলোরতত্ত্বের পঠন-পাঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। সাইমন জাকারিয়া ও নাজমীন মর্তুজার এ-বইয়ে ফোকলোর ও লিখিত সাহিত্যের সম্পর্কসূত্র নির্ণয়ে               যে-পথের দিশা দেওয়া হয়েছে তা  ফোকলোর অনুরাগী পাঠকদের অনুপ্রাণিত করবে বলেই মনে করি। r

 

সাহিত্য-সমালোচক কবি সাহিত্যমানের পূর্বশর্ত

শামস আরেফিন

 

কবি ও কবিতার সংগ্রাম

মিনার মনসুর

 

আগামী প্রকাশনী

ঢাকা, ২০১৩

 

৩৫০ টাকা

 

সমালোচনা বলতে ভালো ও মন্দের তুলনামূলক                        সম-আলোচনাকে বোঝায়। সাহিত্য-সমালোচনা বলতে বোঝায় কোনো সাহিত্যকর্মের তুলনামূলক বিশ্লেষণ, বিবর্তন, বর্ণনা ও গবেষণামূলক আলোচনা; যাকে বিখ্যাত সমালোচক হেরি লিওন সংজ্ঞায়িত করেন এভাবে, ‘Literary criticism is the evaluation, analysis, description, or interpretation of literary works’। প্রকৃত সাহিত্য-সমালোচনাহীন কোনো সাহিত্য মানোত্তীর্ণ হতে পারে না। অথচ অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, বাংলা সাহিত্যে সমালোচনা খুঁড়িয়ে-খুঁড়িয়ে চলছে। আর তাই গত কয়েক দশকে পাঠককে কবিতাবিমুখ করতে সফল হয়েছেন কবিরা। উত্তরাধুনিকতার উপহারস্বরূপ মেধা মোচড়ানো কবিতায় দূরান্বয়ী ভাষণ, ইঙ্গিতময়তা, পরোক্ষ উপমা ও চিত্রকল্প, রূপক ও কথোপকথনকে করেছেন অপরিহার্য। জাদুবাস্তবতার ছোবলে প্রকৃতি ও বাস্তবতা হরণ সহ্য করা যায় কবিতায়। স্বয়ং টিএস এলিয়টের হাত ধরে আধুনিক কবিতার এসব বৈশিষ্ট্য সূচনা হলেও বেঁচে থাকলে তিনিও এ-বাড়াবাড়ির জবাব দিতেন। এর কারণ সমালোচনা-সাহিত্য যে বিকলাঙ্গ তা কিন্তু নয়। বরং কবিরা কখনো সৎ সমালোচক হওয়ার চেষ্টা করেননি। কবির ভালোবাসা না পেয়ে মূলত সাহিত্য-সমালোচনার এই অবস্থা। অথচ সাহিত্য-সমালোচনা ষোড়শীর মতো আকর্ষণীয়, না ফোটা পদ্মের মতো রহস্যময়ী                বা হাসনাহেনার মতো সুঘ্রাণে ভরপুর। তারপরও বর্তমানে           সাহিত্য-সমালোচনা হুইল চেয়ারে বসার অপেক্ষায়। ঠিক এ-সময়ে মিনার মনসুরের কবি ও কবিতার সংগ্রাম বাংলা সমালোচনা সাহিত্যে একটি নতুন সংযোজন। কারণ কবির সমালোচনা শিক্ষকের বেতের মতো আক্রমণাত্মক সমালোচনা নয় বা অধ্যাপকের চর্বিতচর্বণ জ্ঞানের অত্যাচারও তুলনায় অনেকটা বাস্তববাদী, কবিসত্তার বিশ্লেষক এবং স্বাদ ও তৃপ্তির বাহক। একজন কবিই তাঁর কবিতার শ্রেষ্ঠতম ব্যাখ্যা – এই বাস্তবতা বিশ্লেষণে সমালোচক কবি মিনার মনসুরের প্রয়োজন। কারণ মিনার মনসুর বোঝাতে পারেন, জীবন মানেই সংগ্রাম; কবির জীবন বা কবিতার বীজতলা তো আরো সংগ্রামমুখর। কবি-জীবন কেমন হবে, কবির আদর্শ কী হবে, কবি কি শুধুই সীমাবদ্ধ থাকবেন প্রকৃতির সৌন্দর্য অনুসন্ধানে – না শুধু প্রেমিকার রুদ্ররোষে পুড়তে পুড়তে ছাই হয়ে যাবেন? না শুধু তরুণ কবির মতো কবিতার প্রেমে পড়বেন কৈশোরে প্রথম প্রেমে পড়ার মতো। কবির স্বচ্ছতা কতক্ষণ পর্যন্ত টিকে থাকে। উত্থান-পতন জীবনকে করে বিচ্যুত। আশার সুজলা-সুফলা প্রকৃতিকে করে মরুভূমি। তরুণ কবিরা জ্যোৎস্নার ছোঁয়া পেতে চান, ভালো থাকার স্রোতে ভেসে যেতে চান অনাবিল আনন্দের দেশে। তাঁদের আশা কখনো পূরণ হয়; আবার পূরণ হয় না। এই তো ব্যক্তি কবি বা কবিতার চাওয়া-পাওয়া। কিন্তু সামাজিক জীব হিসেবে কবিদের কিছু দায়িত্ব পালন করতে হয়। রাজনৈতিক, সামাজিক ও আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট কবি এড়িয়ে যেতে পারে না। কবিকে যেমন চিত্ররূপময় আবহাওয়া সৃষ্টি করতে ভাসতে হয় স্বপ্নের ভেলায়, তেমনি               বাস্তবতার কশাঘাতে স্বপ্নকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে পুনরায় তৈরি করতে হয় জীবন। ঘুমিয়ে পড়া জাতিকে জাগাতে হয়, সাংস্কৃতিক আগ্রাসন ও স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের অতন্দ্র প্রহরী হতে হয়। বুকের দরদ ঢেলে তৈরি করতে হয় শিল্পসংস্কৃতির ঢাল, যা দিয়ে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন বন্ধ করা যায়। তাই কবি মিনার মনসুর কোনো ঐশীদূতের মতো কবির সামাজিক দায়বদ্ধতার বাস্তবতা স্মরণ করিয়ে দিয়ে রচনা করেন কবি ও কবিতার সংগ্রাম। মোট আঠারোটি প্রবন্ধের         এ-বইয়ে তিনি কবির সংগ্রাম, বাংলা কবিতার গতি-প্রকৃতি, সিকান্দার আবু জাফর, হাসান হাফিজুর রহমান, শহীদ কাদরী, সিকদার আমিনুল হক, ষাটের কবিতা ও রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহকে নিয়ে তুলনামূলক বিশ্লেষণ করেছেন।

মিনার মনসুর তুলে ধরেছেন, বাংলাদেশে কবিতার যাত্রায় কবিরা কখন কোথায় প্রতিবাদী হয়েছেন, কখন তারা হাসান হাফিজুর রহমানের মতো লালন করেছেন বাঙালি সংস্কৃতি ও সমাজবাস্তবতা। আবার কখনো সিকান্দার আবু জাফর হয়ে এই কবিরাই আগলে রেখেছেন বাংলাদেশের সংস্কৃতি। প্রকাশ করেছেন সমকালের মতো প্রতিনিধিত্বশীল সাহিত্যের কাগজ। অর্থকষ্টের ভয়ে অনেকে কবিতাকে বিদায় জানিয়েছেন পরকীয়া-আক্রান্ত প্রেমিক বিদায়ের মতো; আবার কেউ অর্থকষ্টে পড়তে হবে জেনেও কবিতাকে আগলে ধরেছেন। এই তো কবির চিত্ররূপময় জীবন। জীবন যদি কবিতা নাই-বা হবে, তবে কোন অজুহাতে কবিতা লেখা? তবে কেন কবিতা নামের ষোড়শীর জন্য দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বাদাম খাওয়া? তাই কবি ও কবিতার সংগ্রামে একজন কবিকে যেমন পাঠকের হৃদয় ছোঁয়ার চেষ্টা করতে হয়, তেমনি কবিতার মাধ্যমে দৈহিক আনন্দ ছাপিয়ে দিতে হয় আধ্যাত্মিক পরিতৃপ্তি। এই নিয়ে লিখতে হয় তার কবি-জীবনের হালখাতা, যা বছরের পর বছর পুরনোকে বাদ দিয়ে, নতুনত্বকে অাঁকড়ে ধরতে শেখায়। মিনার মনসুর জানেন, কবিতার সরস্বতী আর বিত্তবানের লক্ষ্মী দেবী একসঙ্গে থাকে না। তাই তিনি বলেন, ‘সহজ সিদ্ধির প্রত্যাশায় রাজনৈতিক কিংবা দলীয় কবিতা রচনার বিপদ’ প্রায়ই আক্রান্ত করেছে বাংলাদেশের কবিতাকে। অথচ এমনটা হওয়ার কথা ছিল না। বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রাম কবিতাকে রাজনীতির জ্বরে আক্রান্ত করেছে। বাংলা সাহিত্যে স্বাধীনতার অহংকার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে সমর্থ হয়েছে। আর এই গণমানুষের সংগ্রামী অভিযাত্রায় তাই অংশীদার হতে পেরেছেন কবি শামসুর রাহমান। তল্পিবাহক হলেই যে কবিতা কবরস্থ হবে; এর চেয়ে বাস্তব উদাহরণ আর কোনো সমালোচনা গ্রন্থে পাওয়া যাবে!

বাংলা সাহিত্যে মৃত্যুচিন্তা ও দর্শনে নতুন আকাশ সৃষ্টি করতে সমর্থ হয়েছেন কবি সিকদার আমিনুল হক। এই নিভৃতচারী কবি জীবন-সায়াহ্নে এসে পেয়েছেন বাংলা একাডেমির স্বীকৃতি। দ্বারস্থ হননি পরগাছা নামের কোনো সম্পাদকের কাছে। লিখে গেছেন আত্মতৃপ্তি নিয়ে। সাধারণ কথাকে যুক্তির উপমায় করেছেন অলংকৃত। একের পর এক কবিতার ভাব তৈরি করে এমন উপসংহার টেনেছেন, যাকে বলা যায় গালিব, রুমি বা সাদির উত্তরসূরি  হওয়ার প্রচেষ্টা। প্রাত্যহিক আচার-আচরণ কবিতায় উপস্থাপন করে, কীভাবে কাব্যভাষা ও দর্শন একাকার করে ফেলতে হয়, তা বাংলা সাহিত্যে সিকদার আমিনুল হকই দেখালেন। কবিতায় যুক্তি দিয়ে বলেছেন, ‘যে ভাবমূর্তির কথা বলছি, যেখানে এক মৃত্যু কাজ করে, সেটিকে উত্তরোত্তর আরও ঝকঝকে করে তুলতে চাইলে তুমি তোমার নিজত্ব খর্ব করো। তুমি যেনো শুধুমাত্র তোমার আবির্ভাবের মাঝেই বেঁচে থাক।’ অর্থাৎ মানুষের পরিচয় কর্মে ও বিনয়ে। সবাই তা জানে। কিন্তু এত সুন্দরভাবে কবিতায় দার্শনিক সত্যকে উপমাসহকারে উপস্থাপন কজনই বা করতে পারেন? বা কবিতা কতটুকু পবিত্র হতে পারে – তা প্রশ্ন। আর সিকদার আমিনুল হক রূপক বলুন, উপমায় ও চিত্রকল্পে কবিতার পবিত্রতা ঘোষণা করেন এভাবে, ‘কবিতাকে থাকতে দাও একা, অস্পষ্ট আর পরস্ত্রীর মতো পবিত্র।’ কাকের তুলনায় কবির সংখ্যা বেশি – এ বলে তিনি কবির অপমান করতে চাননি। তিনি কবিতাকে যথার্থ হতে বলেছেন, কবিতার সংখ্যাধিক্যের প্রতি দৃষ্টি দিতে চেয়েছেন। আর বলেছেন, ‘অনেক বেশি কবিতা আমরা লিখেছি।… এবং মেয়েদের  ঋতুস্রাবের চেয়ে অযাচিত।’ এসবই পাঠক সহজে জেনে যাবেন মিনার মনসুরের সমালোচনায়।

কবি সিকদার আমিনুল হক তাঁর প্রতিবাদের ভূমিকা নিয়ে             ক্লান্ত। তাও দৃষ্টি এড়ায়নি কবি মিনার মনসুরের। তিনি আমাদের পরিচয় করিয়ে দেন সেই সিকদার আমিনুল হকের সঙ্গে, যিনি মৃত্যুকে ভয় পান না; কিন্তু যথার্থ কারণে তাঁকে পিছপা হতে হয়। আর সেই যথার্থ কারণ হচ্ছে, ‘কত চিন্তিত আমি/ মৃত্যুর জন্য নয়, আরেকবার যে প্রতিবাদ করবো, তার শিহরণে।’ কবিরা ভবিষ্যৎকে অনেক আগেই দেখতে পান। তাই স্বাধীনতা-আন্দোলনের পর কোনো ক্ষেত্রেই আর দ্বিধাবিভক্ত বাঙালি এক হতে পারবে না বলে মনে হয় কবির। শেখ মুজিবুর রহমানের পর আর কোনো বঙ্গবন্ধু আসেন না, যিনি জাতিকে এক উদ্যানে জড়ো করতে পারেন। তাই কবি সিকদার আমিনুল হক ভয় পান – কীভাবে এরশাদ-পরবর্তী সংগ্রামে জাতি দ্বিতীয়বার প্রতিবাদমুখর হবে। কবি ভাবেন, প্রেমিকা নিয়ে কবিতা লিখবেন বলেই প্রেমিকা কবির পাণিপ্রার্থী। কিন্তু কবি তাঁদের স্বার্থের মাপকাঠির দুর্বলতা ধরিয়ে দেন। রূপসী যদি একবার কবিতা হয়ে কবিকে কবিতা লিখতে সাহায্য করে, তবে সে শুধু কবিরই থেকে যাবে। কারণ কবির প্রেমিকা কখনো মনেপ্রাণে আর কারো প্রেমিকা হতে পারে না। এ বাস্তবতা বোঝাতে মিনার মনসুর উদ্ধৃত করেন সিকদার আমিনুল হককে, ‘আমাকে কবিতা দিয়ে, হে রূপসী যতই নিঙড়ে নাও না কেন শান্তি আর ঘুমের গৌরব – মনে রেখো আমি তোমারই আছি’। সিকদার আমিনুল হককে নিয়ে বাংলা সাহিত্যে এত বিশ্লেষণধর্মী লেখা আর হয়নি। এই বইয়ে তাঁকে নিয়ে মোট ছয়টি প্রবন্ধ সংকলিত হয়েছে। পাঠকের দৃষ্টি বা সমালোচকের তীক্ষ্ণ সমালোচনার ছুরি বিপর্যস্ত হতে পারে এই সমালোচনামূলক প্রবন্ধের গভীরতার কাছে। এতে আরো সংকলিত হয়েছে ষাটের কবি আবুল হাসান, আসাদ চৌধুরী, মহাদেব সাহা, রফিক আজাদকে নিয়ে লেখা ‘ক্রান্তিকালের কবিতা’ শিরোনামে অসাধারণ প্রবন্ধ – যা কবির পাঠ-গভীরতার সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেয়। পরিচয় করিয়ে দেয় ষাটের প্রধান কবিদের কাব্যভাষার সঙ্গে।

শুধু এ কয়েকটি প্রবন্ধে সীমাবদ্ধ থাকলে হয়তো বইটিকে অসাধারণ মনে হতো। কিন্তু রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহকে নিয়ে  লেখা ‘রুদ্র তোমার বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠির শূন্যতা’ পাঠ করার পর থমকে দাঁড়াতে হবে। পাঠক সহজেই জানতে পারবেন কীভাবে রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ তাঁর সাহিত্য জগতে একক প্রাধান্য বিস্তার করে রেখেছিলেন, কীভাবে কবিকে নিষ্ঠুর সমাজ মৃত্যুর কাছে পরাজয় বরণ করতে বাধ্য করে। তারপরও কবি অমর হয়ে থাকেন সৃষ্টির মাঝে, কবিতার মাঝে আর তাঁর পাঠকহৃদয়ে। মুকুটবিহীন বাংলা কবিতার রাজত্বকে শাসন করেছেন রুদ্র। পেয়েছেন অগ্রজ কবিদের চেয়ে বেশি স্বীকৃতি। সুন্দরীদের আশীর্বাদেরও তাঁর কমতি ছিল না। বাংলা কবিতাকে মুক্তি দিয়েছেন সংস্কৃত ভাষার কঠিন বানান রীতির অপশাসন থেকে। একাই সমুদ্রস্রোতের গতি থামিয়ে দিয়ে তৈরি করেছেন নিজস্ব স্রোত। হৃদয় নিংড়ে ভালোবাসা বের করে আনলে যেমন সাহিত্য রচনা করা যায়, ঠিক তেমনি স্মৃতির রোমন্থনে, পাঠকের চেতনাকে ভারাক্রান্ত করতে সমর্থ এ-রচনাটি। এখানে  বাস্তবতা এতটা সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছেন মিনার মনসুর যে, বাংলা সাহিত্যে রুদ্রকে নিয়ে হয়তো এর চেয়ে মানোত্তীর্ণ লেখা কদাচিৎ হতে পারে।

আর সবশেষে এই বইয়ের সংযোজন আত্মজিজ্ঞাসামূলক প্রবন্ধ ‘কেন লিখি, কেন লিখি না’ তরুণ কবিদের আত্মসমালোচনায় পাথেয় হবে নিঃসন্দেহে। কারণ একজন কবি চাইলেই লিখতে পারেন না। তাঁকে অপেক্ষা করতে হয়, নিজেকে প্রস্ত্তত করতে হয় নবীর মতো, যাতে কাব্যদেবী বর নিয়ে আসেন সময়মতো। কবি যদি স্বেচ্ছায় যখন-তখন লিখতে পারতেন, তবে তো বিশ্বসাহিত্যের শাসন যে কেউ করতে পারতেন। আর একবার যদি কাব্যদেবী কারো হাতে এসে পড়তেন, তবে তিনি পূজা-অর্চনার মাধ্যমে কাব্যদেবীকে করতেন পরিতৃপ্ত। কিন্তু লেখক তা পারেন না। বরং মিনার মনসুরের ভাষায় বলতে হয়, ‘প্রসূতির মতো লেখকই কেবল অনুভব করেন লেখার ক্রমশ বেড়ে ওঠা, তার বেদনা ও আনন্দ।’ আর এই আনন্দ ও বেদনাই লেখককে লেখক হতে সাহায্য করে। নিয়ে আসে পড়ার টেবিলে। পড়তে-পড়তে, জীবনের অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে-করতে একসময় তিনি হয়ে ওঠেন পরিপূর্ণ লেখক। তখন যে-কোনো জাদুমন্ত্রবলে খুলে যায় তাঁর লেখার পাহাড়ি ঝরনা। যে-ঝরনা অনাবিল আনন্দে প্রবাহিত হতে থাকে। যা পাঠকের তৃষ্ণাই মেটায় না, বরং পাঠকের মনে আনন্দকে সংক্রামক রোগের মতো ছড়িয়ে দেয়। স্রষ্টার এই সময়টুকু বা আশীর্বাদ সহজলভ্য হলে মূল্যহীন হতো কাব্যশক্তি। আল মাহমুদ সোনালী কাবিন এরকম হাজারটা লিখতেন, শামসুর রাহমান ‘প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’র মতো কবিতা অসংখ্য লিখতেন, আর ‘আমিও গেরামের পোলা চোতমারানি গাইল দিবার পারি’র মতো পঙ্ক্তি অসংখ্য রচিত হতো। লেখককে অপেক্ষা করতে হয় সেই নির্দিষ্ট সময়ের জন্য, কখন কলমের মাথায় লেখা এসে উপস্থিত হবে। টেবিলে বসামাত্রই হয়ে যাবে তাঁর লেখা। কবিতা বা গল্প যখন নিজেই লেখককে বাধ্য করে লিখতে, তখনি বুঝতে হবে এ-লেখা প্রকৃত লেখা, যার জন্য লেখকের সন্তানহীনা নারীর মতো অপেক্ষা, যা সহজেই স্পর্শ করতে পারে পাঠক-হৃদয়।

কবি মিনার মনসুরও বোঝাতে চেয়েছেন, তিনিও সেই কাব্যদেবীর অপেক্ষায় থাকেন, যে তাঁকে বাধ্য করে লিখতে। যা রচনা করে তিনি পরিতৃপ্তি পান, আর পাঠক পায় অনাবিল আনন্দ। এ-কারণে কবিজীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নির্ণয়ে বা কবিতার মহাকাশে যাত্রার আগে কবির অন্তত একবার বইটি পড়া  অপরিহার্য। কারণ গন্তব্যহীন যাত্রা যেমন সুখকর নয়, তেমন পরিণয়হীন ভালোবাসাও কাম্য হতে পারে না। ভালোবাসা মানে যদি না হয় ছুঁয়ে দেখার অজুহাত, কবিতা লেখা মানে যদি না হয় পাঠকের মাঝে বেঁচে থাকা, তবে বিকলাঙ্গ কবিতা জন্ম দেওয়ার চেয়ে কবিতা সৃষ্টি করার প্রয়োজন কী? কবি ও কবিতার সংগ্রাম বইটি পড়লে সাহিত্য-সমালোচনার স্বাদ যেমন আস্বাদন করা যাবে, তেমনি বোঝা যাবে একজন কবির কেন লেখা উচিত আর কেন লেখা উচিত নয়? তিনি কি শুধু রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তিতে সীমাবদ্ধ থাকবেন, না প্রতিবাদের হাতুড়ি দিয়ে সমাজ পুনর্গঠনে ভূমিকা রাখবেন, সীমাবদ্ধ থাকবেন না প্রেমিকার অাঁচলে? সাহিত্য               ভাবের বাহক। এই ভাব প্রকাশের মাধ্যমে মানুষ খুব সহজেই তার চিন্তা-চেতনা, বিশ্বাস ও আদর্শ অন্যের কাছে পৌঁছে দিতে পারে। আর সবাই জানে সংস্কৃতির একটি বড়ো অংশ সাহিত্যনির্ভর। তাই উন্নত সংস্কৃতি বিকাশে সত্য ও সুন্দরের সাহিত্যচর্চা প্রয়োজন, যাতে করে এ-বক্তব্য, ‘Culture is a means to achieve a more satisfactory intellectual, emotional, moral and spiritual existence’ সত্য হতে পারে। প্রকৃত সাহিত্য-সমালোচনা মানোত্তীর্ণ সাহিত্যের পূর্বশর্ত। মানোত্তীর্ণ সাহিত্যই পারে একটি সমৃদ্ধ সংস্কৃতি উপহার দিতে। r

 

নষ্ট সমাজের কথাছবি

মারুফ আবেদ

বসন্ত কারাগারে বারো মাস

তৌহিদুর রহমান

 

অনন্যা

ঢাকা, ২০১৩

 

১৫০ টাকা

 

 

‘অনেক কথা যাও যে ব’লে কোনো কথা না বলে’ – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই গানের মতোই আমাদের জীবনের অনেক কথাই বলা হয় না। দুঃখ, কষ্ট, ঘৃণার আগুনে পুড়ে-পুড়ে নিঃশেষিত হয় এক-একটি জীবন, একটি পরিবার। এমনই                 একটি পরিবারের অব্যক্ত যন্ত্রণার কথাছবি এঁকেছেন            কথাসাহিত্যিক তৌহিদুর রহমান তাঁর বসন্ত কারাগারে বারো মাস উপন্যাসে।

বসন্ত শব্দটি উচ্চারিত হলেই মনের মাঝে যে আনন্দের ফল্গুধারা প্রবহমান হয়ে ওঠে, তার ছিটেফোঁটাও খুঁজে পাওয়া যাবে না বসন্ত কারাগারে বারো মাসে। উল্টো কারান্তরীণ জীবনের যন্ত্রণাক্লিষ্ট ছায়াই উপন্যাসের ছত্রে-ছত্রে ছড়িয়ে আছে। সামাজিক দ্বন্দ্বমুখর জীবনের খুঁটিনাটি অত্যন্ত নিপুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন তৌহিদুর রহমান।

বসন্ত কারাগারে বারো মাস একটি আটপৌরে নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের চাওয়া-না পাওয়ার শাহরিক জটিলতা ও পুতিগন্ধময়তার আখ্যান। ছোট একটি ফ্ল্যাটে পাঁচ সদস্যের পরিবারের              ‘চাপাচাপি’-বাস। নাগরিক সুবিধার তেমন কোনো ছোঁয়াই পায় না এ-পরিবারটি। দারিদ্রে্যর অন্তহীন জাঁতাকলে প্রতিনিয়ত পিষ্ট              হয়ে চলেছে এ-শহরের এমনই অনেক নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবার,            সে-পরিবারগুলোরই যেন প্রতিনিধি উপন্যাসে বর্ণিত পরিবারটি। নিজের অধিকার আদায়ে এদের বুক ফাটে কিন্তু মুখ ফোটে না, কারণ – ভদ্রতা।

বিবাহযোগ্য দুই মেয়ের বিয়ে দিতে ব্যর্থ পরিবারের কর্তাব্যক্তিটি যখন নিরুপায়, সে-সময় দুই পুত্রের সংসারের হাল ধরার সব প্রচেষ্টাও একপ্রকার নিষ্ফল হয়ে যায়। এ-অবস্থায় বড় মেয়ে ল’ পাশ করে পরিবারের দুর্গতি ঘোচাতে নামে কর্মক্ষেত্রে। কিন্তু সেখানেও বিধিবাম। হাইকোর্টে সিনিয়র উকিলের সঙ্গে কাজ করলেও তার ভাগ্যে জোটে না সামান্য সম্মানীও। বাধ্য হয়েই সে বেছে নেয় বিকেলে টিউশনি। এতে প্রায়ই রাত করে তাকে বাড়ি ফিরতে হয়, যা নজর এড়ায় না ভ্রূ কুঁচকে থাকা ছিদ্রান্বেষী প্রতিবেশীদের।

মানসিক যন্ত্রণার এক ধারাবাহিক উপাখ্যানই যেন রচনা করে চলেন তৌহিদুর রহমান। এখানেই শেষ নয়। পরিবারের ছোট মেয়েটি শিক্ষকরূপী নরপিশাচের লালসার শিকার হয় এবং হতেই থাকে। গোপনে ধারণ করা একটি ভিডিওচিত্রকে অস্ত্র করে সে যৌনবিকৃত শিক্ষকরূপী পশুটি ভোগ করতে থাকে অবলা-অসহায় কোমল মেয়েটিকে। একসময় এসব কর্মকান্ড ওই শিক্ষকের স্ত্রীর কাছে ধরা পড়লেও শিক্ষকের চাতুরীতে অসহায় মেয়েটিকেই দোষীসাব্যস্ত করে সবাই।

সেই ভিডিওচিত্র ছড়িয়ে দেওয়া হয় ইন্টারনেটের মাধ্যমে। ভেঙে পড়ে মেয়েটি। হয়ে পড়ে মানসিক রোগগ্রস্ত। সময় এগিয়ে চললেও পুরো পরিবারটিই যেন থমকে দাঁড়ায় একটি বিন্দুতে; যেন এক অসীম স্থবিরতা।

বর্তমান সমাজবাস্তবতায় বসন্ত কারাগারে বারো মাস  উপন্যাসটি অত্যন্ত সহজ-সরল বিষয় নিয়েই উপস্থিত। কোনো অতিরঞ্জিত ঘটনার ছোপ পড়েনি কাহিনিবিন্যাসে। যা অহরহ আমাদের চারপাশে ঘটছে তারই এক সুলিখিত ছবি শুধু আরেকবার আমাদের চোখের সামনে মেলে ধরেছেন তৌহিদুর রহমান। ইভটিজিং, কর্মক্ষেত্রে-শিক্ষাক্ষেত্রে যৌন হয়রানি একটি পরিবারকে কীভাবে বিপর্যস্ত করে তোলে তার অনুপুঙ্খ বর্ণনাই দিয়ে গেছেন লেখক।

বসন্ত জীবনের রঙের বাহার নিয়ে আসে, কিন্তু অনেক সময় এই বসন্তই হয়ে ওঠে কারা-প্রকোষ্ঠ। হয়তো ওই পরিবারটিও স্বপ্ন দেখেছিল সুসময়ের, রঙিন বসন্তের। কিন্তু সবই বিলীন হয়ে যায় পাষাণ সমাজের প্রাচীরে বাধা পেয়ে। r