বাংলা ভাষার আকরগ্রন্থ

সুজিৎ ঘোষ

 

বাংলা আকর গ্রন্থ

ইতিহাস ও তথ্যপঞ্জি

অসিতাভ দাশ

প্রদোষকুমার বাগ্চী

যূথিকা দাম (দাস)

 

নয়া উদ্যোগ

কলকাতা, ২০১৪

 

৪০০ টাকা

 

বাংলা ভাষার বয়স কমবেশি হাজার বছর। প্রধানত অনেক অনার্য কৌম নরগোষ্ঠী তাদের পরস্পরের সংযোগের মাধ্যম হিসেবে নব্য ভারতীয় আর্য ভাষার পূর্বাঞ্চল থেকে এই ভাষার উৎপত্তি। কিন্তু হাজার বছরে এই ভাষার অগ্রগতি কম নয় – চর্যাপদ থেকে রবীন্দ্রসাহিত্য পর্যন্ত এই ভাষার বৈশ্বিক বিস্তার। ভাষার স্থান নির্ধারিত হয় মূলত দুটি মানদন্ডে – পৃথিবীর কতসংখ্যক মানুষ কোন বিশেষ ভাষায় কথা বলে এবং সেই ভাষার সৃষ্টিশীল ও মননসমৃদ্ধ রচনার মান কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে। ভাষার উন্নতির সঙ্গে আসে ব্যাকরণ, অভিধান, আকরগ্রন্থ, বিশ্বকোষ প্রভৃতি।

সংস্কৃত ভাষায় আমরা পেয়েছি অমরকোষের মতো অভিধান। কোনো বিশেষ গ্রন্থে শব্দ-অর্থ সম্পর্কে বিশদ আলোচনাও এক ধরনের অর্থপুস্তক, যেমন মল্লিনাথের টীকা বা চর্যাপদের মুনি দত্তের টীকা – এগুলি সংস্কৃত ভাষায় লিখিত, কিন্তু এই ধরনের রচনাগুলিকে অভিধান বলা যাবে না – শব্দের অর্থ, ব্যুৎপত্তিসজ্জিত শব্দকোষই অভিধান। শব্দের নাম, সংজ্ঞা, উপাধি এবং প্রাথমিক অর্থ অভিধানের প্রাথমিক বিষয়। অভিধানের অর্থ অতিক্রম করে লক্ষণা এবং ব্যঞ্জনার প্রকাশ।

কিন্তু ‘আকর’ কাকে বলা হবে? ‘… ১. খনি, উৎপত্তি স্থান, ২. মূল পুস্তক, যে বই থেকে কোনো বিষয়ের মৌলিক তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে।’ (আকাদেমি বিদ্যার্থী বাংলা অভিধান, কলকাতা, ২০০৯)

হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় : আকর : … ১. যে স্থানে লোকেরা আসিয়া ব্যবহার করে (তত্ত্ববোধিনী) : যে স্থানে রত্নাদি আকীর্ণ থাকে। রত্নাদির উৎপত্তি স্থান; খনি।… উৎপত্তিস্থানমাত্র। … ৩ সমূহ পরীশিষ্টে, ৪. শ্রেষ্ঠ, প্রধান (মেদিনী)। ৫. মূল পুস্তক (Text)…। বঙ্গীয় শব্দকোষ, প্রথম খন্ড, সাহিত্য অকাদেমি, নিউ দিল্লি।

জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস জানিয়েছেন : আকর… উৎপত্তি স্থান। ২ [অক্ষর>] আকর… ৩ দ্রব্যসামগ্রী। – বাঙ্গালা ভাষার অভিধান, প্রথম ভাগ, সাহিত্য সংসদ, কলিকাতা ৭০০০০৯।

শব্দ সংকেত জানিয়েছে : আকর – খনি, আধার। – জামিল চৌধুরী, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা ৭০০০৭৩, ২০০৯।

– চারটি প্রচলিত বাঙলা অভিধানেও আকর গ্রন্থের অর্থ স্পষ্ট হয় না।

আমাদের হাতে এলো বাংলা আকর গ্রন্থ : ইতিহাস ও তথ্যপঞ্জি – সংকলন ও সম্পাদনা করেছেন ড. অসিতাভ দাশ, প্রদোষকুমার বাগ্চী ও যূথিকা দাম (দাস)।

এঁদের বইটি থেকে ‘আকরগ্রন্থ’ বলতে অর্থ স্পষ্ট হয়, – Reference Book – এঁদের গ্রন্থের প্রাথমিক আদর্শ ১৯০২ সালে আমেরিকান লাইব্রেরি অ্যাসোসিয়েশন থেকে প্রকাশিত গাইড টু দ্য স্টাডি অ্যান্ড ইউজ  অফ রেফারেন্স বুকস। গ্রন্থটি সংকলন করেছিলেন অ্যালিস বার্থা ক্রোইগার। তাহলে আকরগ্রন্থ সাধারণ অভিধান নয়, বরং কোষগ্রন্থ।

যে-কোনো ভাষাতেই মননধর্মী রচনা এবং সাহিত্যসৃষ্টির পথ ধরেই আসে ব্যাকরণ এবং তারপরে অভিধান। অভিধানের বিভিন্ন প্রয়োজন ও অভিমুখ লক্ষ করা যায় – একই ভাষার  অন্তর্গত প্রচলিত ও অপ্রচল শব্দের অর্থ,         প্রবাদ-প্রবচন, সমার্থশব্দ, বানান, উচ্চারণ প্রভৃতি বিষয়ের ওপর স্বতন্ত্র অর্থ-জিজ্ঞাসার উত্তর; হতে পারে দ্বিভাষিক, ত্রিভাষিক শব্দার্থের অর্থ সংকলন; হতে পারে বিষয়-নির্দিষ্ট অভিধান – যেমন যতীন্দ্রমোহন ভট্টাচার্য-কৃত বাঙলা অভিধান গ্রন্থের পরিচয় (১৭৪৩ হইতে ১৮৬৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত) – প্রকৃতপক্ষে এখান থেকেই বাংলা আকর গ্রন্থের সূচনা বলা যেতে পারে – শব্দার্থ নয়, বিষয়গত গ্রন্থগুলির পরিচয়, Reference Book, আকরগ্রন্থের প্রয়োজনীয়তা।

পঞ্চদশ শতকের শেষ থেকে ষোড়শ শতকের সূচনায় ইউরোপীয় বণিক এবং এদের সঙ্গে খ্রিষ্টান ধর্মপ্রচারকারীদের কাছে ভারতের পশ্চিম উপকূলের কয়েকটি বন্দর এবং সমগ্র-বঙ্গদেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। এদেশের ভাষা শেখার প্রয়োজনে ও আগ্রহে নিজেদের ভাষায় বাংলা ভাষার ব্যাকরণ, অভিধান প্রভৃতি রচিত হতে থাকে। যতীন্দ্রমোহন জানিয়েছেন, ‘ষোড়শ শতাব্দীর পূর্বে সঙ্কলিত কোনো বাঙলা অভিধানের সন্ধান এ যাবৎ পাওয়া যায় নাই। সপ্তদশ শতাব্দীর শেষ ভাগের জনৈক পোর্তুগীজ পাদরীর লেখা হইতে জানিতে পারি যে, পোর্তুগীজ পাদরীরা ঐ সময় বাঙলা ব্যাকরণ ও অভিধান প্রভৃতি সঙ্কলন করিয়াছিলেন।

সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের অধ্যাপক রেভারেন্ড ফাদার হস্টেন তাঁহার একটী প্রবন্ধে ১৬৮৪ খ্রীষ্টাব্দের পূর্বে পোর্তগীজ মিশনারী রচিত অভিধানের উল্লেখ করিয়াছেন। ফাদার মার্কস আন্তনিও সাঁতুচি (Father Morcos Antonio Satuchi S. J) ১৬৭৯ হইতে ১৮৮৪ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত বাঙলা মিশনের অধ্যক্ষ ছিলেন; তিনি লিখিয়াছেন ‘পাদরীগণ তাঁহাদের কর্তব্য সাধনে বিরত নহেন; তাঁহারা এই দেশের ভাষা উত্তমরূপে শিখিয়াছেন, অভিধান, ব্যাকরণ, অপরাধ-ভঞ্জন ও প্রার্থনা-পুস্তক প্রভৃতি রচনা এবং খ্রীষ্টধর্ম বাঙলা ভাষায় বিবৃত করিয়াছেন, ইহার পূর্বে এ সমস্ত কিছুই ছিল না।’ (ক.বি)

পর্তুগিজদের পর এগিয়ে আসেন ইংরেজরা – বাংলা ব্যাকরণ, অভিধান, প্রবাদমালা রচনায়। কেরির অধীনে শ্রীরামপুর মিশনে এবং ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে ইউরোপীয়রা বাংলাসহ এদেশীয় ভাষাশিক্ষার উদ্যোগ নেয় এবং ভাষাশিক্ষার সূত্রেই আসে বাংলা গদ্য রচনার তথা সাধুগদ্য রচনার প্রয়াস – যে-ভাষা মূলত তৎসম শব্দভিত্তিক। ভারতে ধীরে ধীরে ইংরেজ শাসনের বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে এবং আইন-আদালতে ফারসির বদলে ইংরেজি বাধ্যতামূলক হওয়ার পরে ছবিটি পালটে যেতে থাকে – এদেশের মানুষ চাকরি, আদালতের কাজ, ব্যবসার প্রয়োজনে ইংরেজি শিক্ষায় মনোযোগী হয়ে উঠল।

প্রতিক্রিয়ায় কিছু কাজও হলো – প্রাচীনপন্থী রাধাকান্ত দেবের (১৭৭৪-১৮৬৭) মতো মানুষ-বহুভাষাবিদ, দেশের শিক্ষা, সমাজ-সাহিত্য আন্দোলনে রক্ষণশীলতা সত্ত্বেও অন্যান্য অনেক কিছুর সঙ্গে দীর্ঘ ষোল বছর ধরে (১৮০৩-১৯) সাত খন্ডে প্রকাশ করলেন শব্দকল্পদ্রুম, সংস্কৃতে বিশাল অভিধান। যদিও বাংলা অভিধানচর্চায় ওই গ্রন্থের কোনো ভূমিকা নেই এবং বাংলা  সাহিত্যের ইতিহাসের অনেক পড়ুয়াই জানেন না, বইটি সংস্কৃত-অভিধান।

ফরাসডাঙা-চন্দননগরের মতো পূর্ব-ভারতের ফরাসি শাসনের অধীন নাতিবৃহৎ ভূমিখন্ডেও বাংলা-ফরাসি শব্দ-সংকলনের চেষ্টা হয়েছিল। ফরাসি দোভাষী ওগুস্তে ওঁসা ১৭৮৩ সালে ১১ হাজার ফরাসি শব্দ ও প্রায় তিন হাজার বাংলা প্রতিশব্দ সংকলিত প্যারিসের বিবলিওতেক নাসিওনিলে সংকলিত থাকলেও সুনীতিকুমারের মতো ব্যক্তিরাই তা জানতেন। ২০০৩ সালে ঢাকার সাহিত্য প্রকাশ থেকে ওগুস্তে ওঁসার বাংলা-ফরাসি শব্দকোষ নামে ফ্রাঁস ভট্টাচার্য ও আনিসুজ্জামানের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়। আনিসুজ্জামান তাঁর সম্পাদকীয়তে কিছু বাংলা শব্দের উচ্চারণকে বিকৃত উচ্চারণ বলেছেন – ১৭৮৩ সাল নাগাদ বা তার পরেও ওঁসার সংকলনে স্থান পাওয়া বেশ কিছু শব্দই আঞ্চলিক উচ্চারণ, যেমন : কাগ<কাক; শাগ<শাক, বগ<বক – (শব্দের অল্পপ্রাণতার ফলে); বা, অাঁম<আম এসব শব্দ আসলে ভাষার আঞ্চলিক ব্যবহারের অন্তর্গত।

এভাবেই শব্দার্থ থেকে অভিধান এবং অভিধান থেকে আকরগ্রন্থের দিকে এগিয়ে গেছে বাংলা ভাষা।

বাংলা আকরগ্রন্থের সজ্জাটি আমরা দেখে নিই :

* ক. বিষয় অনুসারে সজ্জিত এবং বিষয়ের অন্তর্গত বিভাগ ও উপবিভাগগুলি লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।

* খ. বিষয়ের অন্তর্গত এবং বিভাগ ও উপবিভাগের অন্তর্গত বর্ণানুক্রমিকভাবে প্রতিটি গ্রন্থের পরিচয় ও গ্রন্থটি সম্বন্ধে তথ্য প্রদান করা হয়েছে।

* গ. লেখক ও আখ্যা সম্বন্ধে যাতে ব্যবহারকারীরা সহজেই সন্ধান পেতে পারেন তার জন্য লেখক ও            আখ্যা-নির্দেশিকা তৈরি করা হয়েছে।

* ঘ. লেখক ও আখ্যা-নির্দেশিকায় নির্দেশিত সংখ্যাটি এই গ্রন্থের নির্দিষ্ট ক্রমিক সংখ্যাকে নির্দেশ করেছে, যার মাধ্যমে ব্যবহারকারী জানতে পারবেন এই গ্রন্থে আকরগ্রন্থটি কোথায় অবস্থান করছে।

–  শেষ বাক্যটি : এই আকরগ্রন্থে গ্রন্থটি কোথায় অবস্থান করছে – মুদ্রিত হলে যথার্থ হবে।

বাংলায় এই আকরগ্রন্থটির সজ্জা এভাবেই সাজিয়েছেন এই গ্রন্থের সংকলকরা – অন্য নানাভাবে হয়তো সাজানো যেত – বিষয়ক্রমিক, কালানুক্রমিক ইত্যাদি নানাক্রমে হতে পারত। এই বই হাতে পেয়েই মনে হলো, বাংলায় ইতিহাস, ভূগোল, বিজ্ঞানের নানা শাখার রেফারেন্স গ্রন্থ এখনো নেই। সময়ের সঙ্গে ভাষার উন্নতির সঙ্গে-সঙ্গে পাঠকের নানা বিষয়ের রেফারেন্স বা আকরের প্রয়োজন সৃষ্টি হয়। আশা করা যায়, আমাদের বাঙালি পাঠকদের কাছেও সেই প্রয়োজন ভবিষ্যতে সৃষ্টি হবে। এবং কোনো রেফারেন্স বই-ই চূড়ান্ত, সম্পূর্ণ হতে পারে না।

 

এই গ্রন্থে আমরা যা পেয়েছি তা কম নয় – ‘সূচীপত্র’টি নয়টি ভাগে বিভক্ত :

১. অভিধান : ক. ভাষা অভিধান; খ. আঞ্চলিক ভাষার অভিধান; গ. বানান অভিধান; ঘ. উচ্চারণ অভিধান; ঙ. সমার্থ শব্দকোষ; চ. উদ্ধৃতি অভিধান; ছ. বিষয় অভিধান।

২. বিশ্ববিদ্যাসংগ্রহ : ক. সাধারণ বিশ্ববিদ্যাসংগ্রহ; খ. বিষয় বিশ্ববিদ্যাসংগ্রহ।

৩. প্রবাদ ও প্রবচন।

৪. পরিভাষা।

৫. পঞ্জি : ক. গ্রন্থপঞ্জি, খ. পত্রিকাপঞ্জি; গ. রচনাপঞ্জি, ঘ. সংবাদপত্র ও সাময়িকপত্র উৎস, ঙ. সংগীতপঞ্জি।

৬. তথ্যনির্দেশী নিমেষ উৎস : ক. তথ্যপঞ্জি, খ. দিনপঞ্জি, গ. বর্ষপঞ্জি; ঘ. নির্দেশপঞ্জি; ঙ. আইন, চ. সারগ্রন্থ ও সহায়িকা।

৭. জীবনীমূলক উৎস : ক. জীবনীমূলক তথ্য; খ. জীবনপঞ্জি; গ. চরিত্রসূচি।

৮. ভৌগোলিক তথ্য উৎস : ক. ভৌগোলিক তথ্য, খ. ভ্রমণ সহায়িকা ও স্থান বিবরণ।

৯. নির্দেশিকা।

প্রায় এক হাজার ছয়শো বাংলা আকর গ্রন্থ এই গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।

বাংলা ভাষার ৫৫৫ পৃষ্ঠার এই আকরগ্রন্থ এখনই যথেষ্ট কাজের – পরবর্তী সংস্করণে হয়তো আরো কিছু বিষয় যুক্ত হবে এবং এভাবেই বাংলা আকর Reference গ্রন্থ থেকে বহুখন্ডে Encyclopedia বিশ্বকোষের দিকে এগিয়ে যাবে।

এ-মুহূর্তে সমগ্র বঙ্গভূমির আকরগ্রন্থ হিসেবে এই সংকলন মূল্যবান। শেষে একটি কথা : যতীন্দ্রমোহন ভট্টাচার্যের গ্রন্থটির যথার্থ নাম বাঙলা অভিধান গ্রন্থের পরিচয় – ‘বাংলা অভিধান গ্রন্থের পরিচয়’ নয়। সুনীতিকুমার তাঁর বাঙ্গালা ভাষাতত্ত্বের ভূমিকা গ্রন্থের (১৯২৯) প্রথম সংস্করণের ‘ভূমিকা’তেই ‘বাঙলা’, ‘বাঙালি’ শব্দে অনুস্বর (ং) নয় কেন, ‘ঙ’ লেখাই সংগত, তার ব্যাখ্যা করেছেন। গোপাল হালদার, যতীন্দ্রমোহন সেই যুক্তিসিদ্ধ নির্দেশই পালন করেছেন। বিশেষ করে মুদ্রিত পুস্তকের নাম সম্পর্কে সচেতন থাকা বাঞ্ছনীয়।

এই গ্রন্থের সংকলকগণ এবং প্রকাশককেও অভিনন্দন জানাই।