বাংলা সাহিত্যের এক বিদেশি সাধক

আনিসুজ্জামান

সৌভাগ্যবশত অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষদিক থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য অনেক বিদেশি গুণীজনের সেবা লাভ করেছে। হ্যালহেডের কথা প্রথমেই মনে পড়ে, যিনি বাংলা ভাষায় প্রথম ব্যাকরণ লিখেছিলেন। ওই বই ছাপতেই চার্লস উইলকিন্সের তত্ত্বাবধানে পঞ্চানন কর্মকার তৈরি করেছিলেন চলমান বাংলা টাইপ। তারপর মনে পড়ে উইলিয়ম কেরীর কথা। বাংলা গদ্যগ্রন্থ প্রকাশে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, ব্যাকরণ ও অভিধান সংকলন করেছিলেন। আরো পরে জনাথন ডানকানের মতো কোম্পানি-কর্মকর্তা আইনের বাংলা অনুবাদ করে বিপস্নব সাধন করে ফেলেন।

এঁদের উত্তরসূরিরা আমাদের কালেও কত না কাজ করেছেন। ফাদার দ্যতিয়েন, উইলিয়ম রাদিচে, ক্লিন্ট সীলি, ফ্রাঁস ভট্টাচার্য, হানস হার্ভার – এমন অনেক নাম চলে আসবে আলোচনায়। এঁরা সকলেই আজও সক্রিয়।

বাংলা সাহিত্যের এমনি একজন বিদেশি সাধক ছিলেন চেক প–ত দুসান জ্বাভিতেল। তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় হয় ১৯৬০-এর দশকে। তখন তিনি ময়মনসিংহ-গীতিকা নিয়ে গবেষণা করতে কলকাতা-ঢাকা ছুটে বেড়াচ্ছেন। তাঁর গবেষণার ফল Bengali Folk-Ballads From Mymensingh and the Problem of their Authenticity কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত হয় ১৯৬৩ সালে। বইতে এই তারিখই দেওয়া আছে, তবে তা বাজারজাত করতে হয়তো আরো একটু দেরি হয়েছিল। দুসান তখন পূর্ব বাংলার বাউল গান নিয়েও কাজ করার কথা ভাবছিলেন। তিনি মানুষ হিসেবে ছিলেন বন্ধুসুলভ ও সৌজন্যপূর্ণ। অকৃত্রিম বিনয় দিয়ে নিজের পা–ত্য ঢেকে রাখতেন। তবে তাঁর তীক্ষন দৃষ্টি তাঁর আগ্রহের বস্ত্তর একেবারে অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে পারতো। সংস্কৃত ও বাংলায় তাঁর বিদ্যাবত্তা ছাড়াও সীমান্তের দুদিকের সমকালীন বাংলা সাহিত্য সম্পর্কে তাঁর অনুরাগ দেখে আমি খুব মুগ্ধ হয়েছিলাম। পরে তিনি এর থেকে বেশ কিছু অনুবাদও করেছিলেন।

চোকোসেস্নাভাকিয়ার এক ছোটো শহরে দুসানের জন্ম হয় ১৯২৫ সালে। যে-রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য নিয়ে তিনি জীবন ও সাধনার অনেকটা সময় ব্যয় করেছিলেন, কাকতালীয়ভাবে তাঁর জন্ম ও মৃত্যুর তারিখ আর দুসানের জন্ম ও মৃত্যুর তারিখ এক। প্রাগের চার্লস বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাচ্যতত্ত্ব অধ্যয়ন শেষ করে বাংলা সাহিত্য নিয়ে অভিসন্দর্ভ লিখে তিনি সিএস্সি উপাধি লাভ করেন। চেকোসেস্নাভাক অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্সের ওরিয়েন্টাল ইনস্টিটিউটে দু দশকের বেশি সময় তিনি কাজ করেন, কিন্তু রাজনৈতিক কারণে ১৯৭১ সালে সেখান থেকে বিতাড়িত হন। তাঁর পক্ষে প্রাগে প্রবেশ করাও নিষিদ্ধ হয়ে যায় এবং এ-নিষেধাজ্ঞা অনেকদিন বলবৎ থাকে। তিনি যাতে নিজের মতো করে অনুবাদের কাজ চালিয়ে যেতে পারেন, সে-উদ্দেশ্যে তাঁর বন্ধুরা তখন প্রাগের নানা গ্রন্থাগার থেকে বইপত্র নিয়ে তাঁকে পাঠিয়ে দিতেন। ১৯৭৮ সালে আবার রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর দুসানের ওপর এই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়। প্রাগের স্কুল অব ল্যাংগুয়েজে তিনি শিক্ষকতার একটি পদও লাভ করেন। সেখানে তিনি সংস্কৃত ও বাংলা পড়াতেন। ২০১২ সালে জীবনাবসান পর্যন্ত তিনি বেশির ভাগ শ্রম ও সময় দিয়েছিলেন চেক ভাষায় অন্য ভাষার সাহিত্য অনুবাদ করতে।

ড. দুসান জ্বাভিতেল সংস্কৃত, পালি, বাংলা, ইংরেজি ও জার্মান থেকে চেক ভাষায় অনুবাদ করেন। সংস্কৃত থেকে তিনি অংশত বা সম্পূর্ণত অনুবাদ করেছিলেন মানব-ধর্ম-শাস্ত্র, উপনিষদ, কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র, বাল্মীকির রামায়ণ এবং সোমদেবের কথাসরিৎসাগর। বাংলা থেকে যেসব বই অনুবাদ করেন, তার মধ্যে রবীন্দ্রনাথের গোরা ও গীতাঞ্জলি এবং আরো কিছু রচনা আছে, আছে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, সুকান্ত ভট্টাচার্য, সমরেশ বসু ও শংকর এবং সৈয়দ ওয়ালীউলস্নাহ ও আবু ইসহাকের লেখা। রবীন্দ্রনাথের প্রতি তাঁর অনুরাগের এবং অনুবাদক হিসেবে তাঁর দক্ষতার পরিচয় বহন করে তিন খ– সংকলিত রবীন্দ্রনাথের রচনাসংগ্রহ।

তাঁর ইংরেজি রচনার মধ্যে ময়মনসিংহ-গীতিকা সম্পর্কিত বইটির উল্লেখ আগেই করা হয়েছে। বইটি খুবই গুরুত্ববহ। তাছাড়া রয়েছে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস সম্পর্কে একটি বিশদ রচনা (১৯৭৬) এবং প্রাচ্য সাহিত্যের অভিধান (এর দ্বিতীয় খ- দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার সাহিত্যবিষয়ক, ১৯৭৩) বাংলার কতিপয় ক্রিয়াপদ-সম্পর্কিত একটি ক্ষুদ্রাকার রচনা (১৯৭০) এবং হিন্দুধর্ম সম্বন্ধে একটি সহজপাঠ্য বই (১৯৯৩)।

চেকোসেস্নাভাকিয়ার সবচেয়ে গুণী প্রাচ্যতত্ত্ববিদরূপে দুসান জ্বাভিতেল স্বদেশে স্বীকৃতি লাভ করেছিলেন। পশ্চিমবঙ্গ সরকার রবীন্দ্র-পুরস্কার দিয়ে তাঁকে সম্মানিত করে। কলকাতার টেগোর রিসার্চ ইনস্টিটিউট তাঁকে রবীন্দ্রতত্ত্বাচার্য উপাধিতে ভূষিত করে। ২০০৪ সালে চেক প্রজাতন্ত্র সরকার অনুবাদকর্মের জন্যে তাঁকে রাষ্ট্রীয় সম্মান প্রদান করে। তাঁর ৭৫ বছরপূর্তি উপলক্ষে দেশ-বিদেশের বাংলা গবেষকরা তাঁর সম্মানে অৎপযরা orientalni গবেষণাপত্রিকার একটি বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করে। গত বছর টোকিওতে অনুষ্ঠিত চতুর্থ বঙ্গবিদ্যা সম্মেলনে তাঁর নামাঙ্কিত স্মারক বক্তৃতা প্রদান করি আমি।

ড. দুসান জ্বাভিতেল মনেপ্রাণে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে ভালোবেসেছিলেন। বাংলা সাহিত্যকে বহির্বিশ্বে পরিচিত করার ক্ষেত্রে তাঁর সক্রিয় ভূমিকা ছিল। তাঁকে যেন আমরা ভুলে না

যাই।