বুদ্ধদেব বসুর কয়েকটি চিঠি অমিয় দেবকে লেখা

যে-কয়েকজন ছাত্রকে নিয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগ শুরু করেছিলেন বুদ্ধদেব বসু, তাদের একজন আমি। পাশ করার পর তাঁর অধীনে পড়াবার কাজ পাই। ধীরে ধীরে তাঁর স্নেহেও বৃত হই। এই চিঠিগুলি সেই স্নেহেরই স্বাক্ষর। তারা বিবিধ পর্বে লেখা। ১৯৬১-তে তিনি রবীন্দ্রশতবর্ষ উপলক্ষে নানা দেশ থেকে বক্তৃতার আমন্ত্রণ পান। সেইসঙ্গে নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছুদিন পড়াবারও আমন্ত্রণ। প্রথমে যান জাপানে। তাঁর ও স্ত্রী প্রতিভা বসুর এই দশদিনের জাপানভ্রমণ নিয়ে লেখা ‘জাপানি জর্নাল’ (১৯৬২) পরে তাঁর সমুদয় বিদেশভ্রমণের কাহিনি দেশান্ত-এ (১৯৬৬) অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯৬৩-তে আবার বিদেশ যান তাঁরা। বুদ্ধদেব বসুর আমন্ত্রণ ছিল এক FILLM (আন্তর্জাতিক আধুনিক ভাষা ও সাহিত্য সংস্থা) কংগ্রেসে ও তারপরে ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম সেমেস্টার পড়ানোর। তাতেই যাদবপুর থেকে ছুটি পেতে গিয়ে বিভ্রাট হয় ও তিনি পদত্যাগ করেন। আমি তখন আমেরিকায় পিএইচ.ডি করছি, যাদবপুর থেকে স্টাডি লিভ নিয়ে। ১৯৬৩-৬৪-র দ্বিতীয় সেমেস্টার বুদ্ধদেব বসু পড়ান নিউইয়র্কের ব্রম্নকলিন কলেজে। গ্রীষ্মে বোল্ডারে কলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয়ে। তারপর ১৯৬৪-৬৫ পুরো এক বছর পড়ালেন ইলিনয়ের ওয়েসলিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে। ১৯৬৫-এর গ্রীষ্মে তিনি পড়াতে গেলেন হাওয়াইয়ের ইস্ট-ওয়েস্ট সেন্টারে। অগস্টে দেশে ফিরলেন। এই ১৯৬৩-৬৫ পর্বের কয়েকটি চিঠি আছে এখানে। ১৯৬৬-৬৭-তে আমি পিএইচ.ডি শেষ করে দেশে ফেরার চেষ্টা করছি : চিঠি আছে তখনকারও। পরবর্তী পর্ব কলকাতা থেকে কলকাতায়।

 

চিঠি ১

 

Hotel

Mark Hopkins

NOB HILL : SAN FRANCISCO

২৫ জানুয়ারি, ১৯৬১

 

কল্যাণীয়েষু

অমিয়, টোকিওতে তোমার চিঠি পেয়ে খুব ভালো লেগেছিলো। আজ খোদ আমেরিকায় পৌঁচেছি – জগতের সবচেয়ে সমৃদ্ধ দেশ – কিন্তু জাপানের কথা ভুলতে পারছি না। এই হোটেলে দৈনিক পঁচাত্তর টাকায় যতটা সুখ-সুবিধে, জাপানে দৈনিক পঁয়ত্রিশ কি চলিস্নশ টাকায় তার চেয়ে বেশি বই কম নয়। ওদের এরোপেস্ননের তুলনা হয় না। অতিথির প্রতি এমন সেবাপরায়ণতা, তুচ্ছতম সুখ-সুবিধের প্রতি এমন অবিচল ও নিত্যসহাস্য মনোযোগ আর-কোনো দেশে আমি দেখিনি। এর মধ্যে কিছু ব্যাবসাদারি আছে বলতে পারো – কিন্তু ব্যাবসা তো জগৎ ভ’রে সবাই করছে, শুধু জাপানিরা পারে তারও মধ্যে ব্যক্তিগত স্পর্শ দিতে – তাছাড়া সাজে সজ্জায় রুচিতে অনুষ্ঠানে ওরা জগতের সেরা। জাপানি মেয়েদের মতো নিচু গলা বাঙালি মেয়েদেরও না। চোখে চোখ পড়লেই হাসে – সেটা শিক্ষারই অঙ্গ হয়তো, কিন্তু একেবারেই স্বতঃস্ফূর্ত মনে হয়। হাকোনোতে একটা জাপানি হোটেলে একরাত কাটিয়েছিলাম, খাঁটি জাপানি ধরনের ভোজেও কয়েকবার যোগ দিয়েছি – ও-রকম নম্র, সুন্দর, পরিচ্ছন্ন
আতিথেয়তা আমাদের ও পাশ্চাত্য জাতিদের কল্পনার অতীত। ওদের খাওয়া বসা (এবং শোওয়াও) পুরোনো মতে মেঝের উপর – কিন্তু সেই মেঝের উজ্জ্বলতা ও আরামের ব্যবস্থা তাজমহল হোটেলকে লজ্জা দেয়। পশ্চিমী সভ্যতায় ঘটাপটা বেশি – স্বল্পতম আভরণে মহত্তম রূপ রচনা করতে পারে জাপানিরা – ওদের জীবনযাপনের পদ্ধতির কথা বলছি। জাপানি হোটেলে পরিচারিকা বা মালিক যতবার ঘরে ঢোকে ততবার মেঝেতে হাঁটু ভেঙে ব’সে নিচু হ’য়ে অভিবাদন করে – সমকক্ষদের মধ্যেও এই ধরনের অভিবাদন প্রচলিত আছে। এতে কিছুমাত্র দীনতা প্রকাশ পায় না, সমস্তটাই স্নিগ্ধ ও শ্রীম–ত মনে হয়। হয়তো এটা ফর্ম্যালিটিরই অঙ্গ, কিন্তু মাত্রই ফর্ম্যালিটি নয় – পশ্চিমী লোকের আঙুল-ছোঁয়ানো হাত-ঝাঁকুনির মতো দায়-সারা গোছের ব্যাপার নয়, কিংবা যে-কোনো কথার পরে ‘হাউ ওয়া-ারফুল’-এর মতো বানানোও নয়। জাপানে ব’সে ভাবতাম জাপান মার্কিনী ব’নে গেছে – নানা দিক থেকে সে-কথা সত্য, কিন্তু আসল আমেরিকায় পা দেয়ামাত্র তফাৎ টের পাচ্ছি। আর লিখবো না, আমার জাপান-প্রেমে বাড়াবাড়ি হ’য়ে যাচ্ছে – আমি জানি নিউ ইয়র্কে পৌঁছবার পরে বন্ধুতার ও সহৃদয়তার অভাব হবে না, খুবই ভালো লাগবে। আসলে বোধহয়, যেমন পশ্চিমীদের কাছে, তেমনি আমাদের কাছেও চীন-জাপান হ’লো সত্যিকার বিদেশী – যাকে বলে exotic – সেই জন্যেই এর আকর্ষণ এত প্রবল। হাওয়াইয়ি বিশ্ববিদ্যালয় ভারতীয়দের অনেকগুলো বৃত্তি দিচ্ছে – তোমরা কেউ এলে মন্দ হয় না। পরে সব কাগজপত্র পাঠাবো। পাপ্পা, অমলকান্তি, দু-জনেরই পড়াশুনো ভাল চলছে, এই খবর পেয়ে খুব সুখী হয়েছি।

বুবসু

 

চিঠি ২

 

নিউ ইয়র্ক

১৫ ফেব্রম্নয়ারি ১৯৬১, রাত্রি

 

অমিয়,

এতদিন পরে এই পাড়ারই দু-একটা বইয়ের দোকানে ঢুকেছিলাম। হা ঈশ্বর – থরে-থরে কী সব সাজিয়ে রেখেছে। যে-সব বইয়ের বহু বছর ধ’রে নাম শুনে আসছি, যে-সব বই বহু বছর ধ’রে পড়তে চেয়েছি, যাদবপুরে পড়াবার সূত্রে যে-সব বই পাগলের মতো খুঁজেছি, এখানে হাত বাড়ালেই তার যে-কোনোটিকে তুলে নেয়া যায়, মায় মঁতেসকিউ-র ‘‘পারস্য পত্র’’। সবই জানতাম, তবু জাজ্বল্যমান চোখে দেখে কেমন চমক লাগে। আসেত্ম-আসেত্ম অনেকগুলো পেপার-ব্যাক কিনতেই হবে – যদিও জানি তার প্রায় কোনোটাই আমি নিজে পড়বো না, যথাসময়ে তোমাদের উপভোগের জন্য পাঠিয়ে দেবো। পেপার-ব্যাক ছাড়া আর যা পাওয়া যায় সেদিকে তাকাতেও ভয় করে। এই ওয়াশিংটন স্কোয়ার পাড়ার নামান্তর হ’লো Greenwich Village সংক্ষেপে the Village, এককালে শিল্পীদের পাড়া ব’লে নামডাক ছিল, এখনো পূর্বগৌরব লুপ্ত হয়নি – বীটনিকদের বাসভূমি এখানেই শুনতে পাই। এ-পাড়ার পুরোনো বইয়ের দোকানগুলিও বিখ্যাত, পথ চলতে-চলতে কাচের জানলায় তস্করনয়নে দৃষ্টিপাত করি – একদিন ভাবছি সাহস ক’রে ঢুকে পড়বো, মহামূল্য পুরোনো এডিশনের ফাঁকে-ফোকরে হয়তো আমার সাধ্যের উপযোগী কিছু লুকিয়ে আছে। এদের এই প্রাচুর্যের সামনে আমরা কেমন অসহায় বোধ করি – খাবার, বই, কাপড়চোপড়, বিলাসদ্রব্য, যা-কিছু ভাবতে পারো, দোকানগুলো একেবারে উপচে পড়ছে যেন, রবিবারের নিউ ইয়র্ক টাইমস ব’য়ে নিতে আসতে মুটে ডাকতাম (যদি পাওয়া যেত), ছবিওলা পত্রিকা বই লোকেরা জঞ্জালের সত্মূপে ফেলে দেয়, কোনো-কিছু বিকল হয়ে গেলে না-সারিয়ে নতুন কেনে। পুরোনো জিনিশের উপর আমাদের যে-মমতা জন্মায়, সেই মোহ থেকে এরা একেবারে মুক্ত – কোনো স্মৃতির সেবা এরা করে না, জীবন এত জঙ্গম ক’রে ফেলেছে যে এক মুহূর্ত কোথাও দাঁড়াবার অবকাশ নেই। আমাদের দারিদ্রে্যর কথা অনেক শুনতে পাই, কিন্তু এই অত্যধিক প্রাচুর্যেও মন ঠিক তৃপ্তি পায় না – বড্ড বেশি, বড্ড বড্ড বড্ড বেশি, শেষটায় এরা নিজেরাই না একদিন সব ভেঙে-চুরে ছারখার ক’রে দেয়। বইয়ের কথাই ধরো : ভেবে দ্যাখো তুমি, একটা মানুষ জীবনে কত পড়তে পারো, আর প্রত্যেককেই কি গ্রীক চৈনিক ভারতীয় জর্মান রাশিয়ান সব সাহিত্য পড়তে হবে? একটা নেশার ঘোরে চলছে : যে-কোনো বিষয়ে যে-কোনো ভালো বই কিছুদিনের মধ্যে পেপার-ব্যাক-এ বেরোবেই, অচিরে না ফাউন্টেন পেনের মতো বাঁধানো বইও লুপ্ত হ’য়ে যায়, তাহ’লে বই জিনিশটার স্থায়িত্বই ভেঙে গেলো। ভগবান করুন, এ-দেশে যেন শেষ পর্যন্ত কিছু শিক্ষিত ধনী লোক টিকে থাকে – ঐ দুই বিশেষণের সমন্বয় সব দেশেই বিরল হ’য়ে আসছে, আমেরিকার সমাজ তো প্রায় শ্রেণীহীন। থাক এসব কথা, এ-সবে আমাদের কারো কিছু এসে যায় না, আসল কথা এই যে এখানে অনেক ভালো-ভালো বই পাওয়া যায়, কিছু তোমাদের পাঠাবো।

বুব

 

 

চিঠি ৩

 

পিকচার পোস্টকার্ড : উলটোপিঠে ওয়াশিংটন, ডি.সি.-র ন্যাশনাল গ্যালারি অব আর্ট-এ রক্ষিত এল গ্রেকো-র ছবি ‘সেইন্ট মার্টিন এ্যা- দি বেগার’-এর প্রিন্ট

২৬ ফেব্রম্নয়ারি ১৯৬১

রাত্রি

 

অমিয়,

আজ ওয়াশিংটন থেকে ফিরে এসে অতুল গুপ্তর মৃত্যুসংবাদ পেলাম। তিনি আমাকে স্নেহ করতেন – মাঝে বহুকাল যোগাযোগ ছিল না – সম্প্রতি আবার দু-তিনবার দেখা হ’লো – সুধীন্দ্রর মৃত্যু উপলক্ষে। মৃত্যু যেন শোভাযাত্রায় বেরিয়েছে, তার বিপুল গম্ভীর গতির সামনে আমরা স্তব্ধ হ’য়ে দাঁড়িয়ে আছি, কিন্তু আসলে দাঁড়িয়ে নেই।

বুব

চিঠি ৪

 

HOTEL CHELSEA

AT SEVENTH AVENUE

WEST TWENTY THIRD STREET

NEW YORK 11, N.Y.

৫ এপ্রিল ১৯৬১

 

অমিয়,

আজ তাড়াতাড়িতে নরেশের একটা ইংরেজি লেখা তোমাকে পাঠিয়ে দিচ্ছি, এটা আমাদের যাদবপুর জর্নালে যাওয়া চাই। শিকাগোর টেগোর-সেমিনারে নরেশ এটি পড়েছিল, এবং লেখাটির সারবত্তা সম্বন্ধে সেখানে দ্বিমত ছিল না। আমারও লেখাটি সত্যি ভালো লেগেছে – মতে অবশ্য সর্বত্র মেলে না, কিন্তু সেটা ছোটো কথা। এবার কয়েকটা কাজের কথা সেরে নিই।

(১) জর্নালে ‘About our Contributors’ তুমি লিখে দিয়ো – প্রয়োজন হ’লে জ্যোতির সহযোগিতায়। কার বিষয়ে কী বলতে হবে তোমাদের অজানা নেই। নরেশের বিষয়ে – Currently working on a dissertation “The Orient [al] Influence on W.B. Yeats [”] at Northwestern University, U.S.A. … this paper was read at a Tagore Seminar organised by the Far Eastern Association Inc. in Chicago on March 27, 1961.

সুধীন্দ্রর বিষয়েও তোমরা এক পাতা লিখে দেবে। ছবি কিছুতেই হ’লো না?

(২) তোমার নিশ্চয়ই মনে আছে যে গ্রীষ্মের ছুটির আগে ১ ও ২ জুলাইয়ের ‘বার্ষিক পরীক্ষা’র প্রশ্নপত্র তৈরি করিয়ে তারকবাবুর কাছে জমা দিতে হবে? ফাদার ফালঁ ও অন্যান্যদের ব’লে ওগুলো করিয়ে নিয়ো – কোনো গোলযোগ না হয়। 1st Yr. B.A.-র জন্য অর্ধেক য়োরোপীয়, অর্ধেক বাংলা-সংস্কৃত;1st Yr. M.A.-র জন্য দুটো আলাদা পেপার। ছুটির আগে ছাত্রদের স্মরণ করিয়ে দেয়াও কর্তব্য।

(৩) ফাইনাল বি.এ. পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের প্রম্নফ অচিরে আবির্ভূত হবে – দেবেনবাবুকে তোমার কথা ব’লে এসেছিলাম, হয়তো
এক-এক পেপার এক-একজন অধ্যাপককে দিয়ে দেখাতে হবে – এই গোলমেলে ও দায়িত্বপূর্ণ কাজে তুমি ভিন্ন গতি নেই।

এভানস্টনে নরেশ-চিনুর সঙ্গে কয়েকদিন কী আনন্দে কাটিয়ে এলাম তা বলতে শুরু করলে এই চিঠির সীমা ছাড়িয়ে যাবে। প্রায় মিশিগান হ্রদের প্রান্তে মস্ত খোলামেলা বাড়িতে রাজার হালে আছে ওরা। প্রণবেন্দুও তিনদিন ছিল – আমরা কথা বলতে-বলতে রাত্রে প্রায় ঘুমোইনি। প্রণবেন্দুর সত্যিকার পরিণতি হয়েছে – দেখে বড়ো আনন্দ হ’লো। বস্নূমিংটনে গিয়েছিলাম, সেখানে নবনীতা ও পৃথ্বীশবাবুর কথা অনেকেই বললেন। ম্যাডিসনে হ্যাস্কেল বস্নক্-এর সঙ্গে খুব ভালো আলাপ হ’লো; হোর্স্ট ফ্রেন্জ্ মানুষটিও চমৎকার – আগের বারে তাঁর সঙ্গে ভালো ক’রে কথা বলার সময় পাইনি।

এপ্রিল মাস পড়ার পর থেকেই মনে হচ্ছে এ-দেশে আমার মেয়াদ ফুরিয়ে এলো। অথচ এখনো কত কাজ বাকি – এ-মাসেও দু-বার বাইরে যেতে হবে। এই মহানগরীর দ্রষ্টব্য প্রায় কিছুই দেখা হয়নি – হয়তো শেষের দিকে কিছু জ্বোরো ঘোরাঘুরি হবে – তবে অনেক বিচিত্র গভীর সুন্দর মানুষের পরিচয় পেলাম, দৃশ্য অথবা জ্ঞানের চাইতে সেটাকে কত মূল্যবান ভাবি না। পূর্ণ কিছুই নেই আমাদের জীবনে – কিন্তু যতই অপূর্ণতা থাক, সব মিলিয়ে নিশ্চয়ই বলবো এই প্রবাস সার্থক হয়েছে। শুধু একটা কথা মাঝে-মাঝে আক্ষেপ হয় – এখানে আমার পরিচয় ‘‘অধ্যাপক’’ হিশেবে, দশ বছর বাস করার পরেও অমিয় চক্রবর্তীরও তা-ই – এমনকি রবীন্দ্রনাথকেও মাঝে-মাঝে এরা ‘ডক্টর টেগোর’ ব’লে ফ্যালে – আর সত্যি বলতে, কবি রবীন্দ্রনাথের পরিচয় এ-দেশে ক-জন পেয়েছিল? একবার এ-দেশে নিতান্তই বাংলা ভাষার লেখক হ’য়ে আসতে ইচ্ছে করে – কিন্তু তা কেমন ক’রে হবে, এরা তো কেউ আমাদের ভাষা জানে না, আমাদের হৃদয় এদের কাছে
অনাবিষ্কৃত। এখানেই ফরাশি, জর্মান, স্প্যানিশ প্রভৃতির সঙ্গে আমাদের বিরাট ব্যবধান – তা কখনো দূর হবে কিনা কে জানে।

বুবসু

 

চিঠি ৫

 

পিকচার পোস্টকার্ড : উলটোপিঠে আক্রোপলিসের এরেকথেইয়ন

আথেন্স, ২৭ শে জুন, ১৯৬১

 

অমিয়,

আজ আথেন্সের আক্রোপলিস দেখে আমি অভিভূত হয়েছি : মনে হচ্ছে এমন আর দেখিনি, আর দেখবো না কোনোদিন। য়োরোপে আমাদের শেষ রাত্রি যে এই নগরে যাপন করছি সেটা আমাদের সৌভাগ্য : কেননা অনেক কিছু দেখার পরেও আথেন্স অপরাজেয়। ভুল বলে তারা, যাদের মতে দু’একদিনের জন্য কোনো তীর্থে এসে লাভ নেই, যদি কখনো কয়েক ঘণ্টাও আথেন্সে কাটাতে পারো, তাহ’লে এমন কিছু দেখবে যা জগতে আর কোথাও নেই।

বুবসু

 

 

চিঠি ৬

 

১১/৮/৬৩

অমিয়,

আমাদের রিজা্র্ভ ব্যাঙ্কের অনুমতি এসে গেছে; এখন বোধহয় বললে ভুল হয় না যে তেইশে অগস্ট ন্যু ইয়র্কে পৌঁচচ্ছি। আমাদের ফ্লাইট-নম্বর হয়তো আগেই তোমাকে জানিয়েছিলাম, তবু আর-একবার লিখি – QF (Qantas) 531 – আইডলওয়াইল্ডে অবতরণের সময় বিকেল আড়াইটে। ন্যু ইয়র্কে আমাদের ঠিকানা – Joe Weinstein Residence Halls, 5 University Place, NYC 3. অন্তত তেসরা সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মহানগরীতে থাকবো, তারপর ধীরে-ধীরে বস্নূমিংটনের দিকে রওনা হ’তে হবে। তুমি অন্তত একদিনের জন্য কনফারেন্সে আসতে পারবে নিশ্চয়ই?

ইতিমধ্যে রুমি মোটরবিদ্যা শিখতে গিয়ে ওদের গাড়িটাকে জখম করেছে – ভাগ্যে ওদের নিজেদের কোনো আঘাত লাগেনি। শেষ চিঠি যেটা পেয়েছি তাতেও গাড়ির স্বাস্থ্যোদ্ধারের খবর ছিল না। এদিকে প্রদীপের মাষ্টারমশাই ভীষণ কড়া, সে নাকি ছুটি নাও পেতে পারে – তবু আশা করছি রুমি অন্তত ন্যু ইয়র্কে আসবেই – সম্ভবত দু-জনেই আসবে।

তুমি যে দু-তিনদিনের মধ্যে প্যারিসের এতগুলো দ্রষ্টব্য দেখে উঠতে পেরেছো এটা খুবই প্রশংসনীয়। এ-সব শহর অফুরন্ত – অতএব ‘‘আরো কেন হ’লো না’’ ভেবে মন-খারাপ করা বৃথা। যতদিনে এ-চিঠি পাবে, ততদিনে নিশ্চয়ই ন্যু ইয়র্কেরও প্রধান চিত্রশালাগুলি দেখে ফেলেছো – ‘‘বহুদিন ধ’রে বহু পথ ঘুরে’’ ও-সব দেশে উপস্থিত হবার এ একটা মস্ত সার্থকতা।

দিলিস্ন বম্বাই ঘুরে এসে ডক্টর পরিমল দাস বললেন যে ফুলব্রাইটের উচ্চতর কর্তৃপক্ষেরা তোমার প্রশংসায় পঞ্চমুখ – শুনে আমার আনন্দ অনুমান করতে পারো। এখনকার কলকাতায় যে-ক’জন সত্যিকার ভালো এবং খাঁটি লোক, পরিমল দাস তাঁদেরই একজন – তাঁর সঙ্গে পরিচিত হওয়াটাকে সৌভাগ্য ব’লে জ্ঞান করছি। তোমার কাইরোর চিঠি পাবার পর নরেন-দার সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেছিলাম – তারপর একদিন রাধারানী দেবীর সঙ্গে কথা হ’লো (তুমি যাবার পর তিনি একদিন এসেওছিলেন) – তোমার অভাব ভুলতে পারছেন না তাঁরা, আর এখন আমার মনের অবস্থাটা এই রকম যে কোথাও কেউ আমাকে স্নেহ করছেন বুঝতে পারলেই আমার মন সে-দিকে ধাবিত হয়। হয়তো মনের এই ভাবটাও একরকমের হূব্রিস – কিন্তু অন্ততপক্ষে কিছু সান্তবনা তো আছে জগতে।

আর দশদিন পরে ২০২ থেকে অনেক দূরে চ’লে যাবো, এটা এখনো ঠিক ধারণার মধ্যে আসছে না। ভালো থেকো।

 

বু. ব.

 

চিঠি ৭

 

বস্নূমিংটন, ই–য়ানা

১১ অক্টোবর, ১৯৬৩

 

 

অমিয়,

সচ্চরিত্র বস্নূমিংটনে এসে আমিও প্রায় সুবোধ বালক ব’নে গেছি – সপ্তাহে দুটো ক্লাশ নেই, মাঝে-মাঝে চিঠিপত্র লিখি, চিত্তবিনোদনের জন্য কারণে-অকারণে পাড়ার মুদিখানায় ঘুরে আসি – অবশিষ্ট সময় বই প’ড়ে কাটাতে হয়। ‘‘কাটাতে হয়’’ – এটা একটু অত্যুক্তি হ’লো; শুনে হয়তো অবাক হবে যে পড়তে আমার খুব ভালো লাগছেও এবার, আড্ডা পাব্ রেসেত্মারাঁ ইত্যাদির অভাব বইয়ের দ্বারা মেটাতে হচ্ছে ব’লে আমি যে খুব দুঃখিত তা কিন্তু নয়। শুধু পড়াবার জন্যেই নয় – আমার নিজেরই কেমন নেশা চেপে যাচ্ছে, জানতে লোভ হচ্ছে হোমরের চরিত্রদের নিয়ে সফোক্লেস থেকে রাসীন পর্যন্ত লেখকেরা কী করেছিলেন, কথাসরিৎসাগর জাতক পঞ্চতন্ত্র ইত্যাদি কোন-কোন রাস্তা ধ’রে কী-ভাবে য়োরোপে ছড়িয়েছিল, এবং পশ্চিমী সাহিত্যে প্রাচীর ব্যবহার ও প্রভাবই সত্যি কতখানি এবং কী-ধরনের। এ-সব বিষয়ে আমার ধারণা যে অস্পষ্ট নয় এমন মোহ আমার মনে কোনোদিনই ছিল না, আমার অজ্ঞতা যে সীমাহীন এ-আবিষ্কারও আমার পক্ষে নতুন নয় – কিন্তু এর প্রত্যেকটা বিষয় কত গভীর ও দূরবিসত্মৃত তা দেখতে পেয়ে আমার কেমন অস্থির লাগছে, ইতিমধ্যেই খান পঞ্চাশ বই এনে জড়ো করেছি লাইব্রেরি থেকে, এবং রোজই প্রায় কোনো-না-কোনো নতুন তথ্য খুঁজে পেয়ে চমকে উঠছি। ‘‘প্রাচী-প্রতীচী’’ সম্বন্ধ সত্যি কিন্তু এক বিপুল বিষয়, এর মধ্যে এত কিছু আছে যে এ নিয়ে বংশপরম্পরায় ‘‘গবেষণা’’ করা যায়। অথচ এই বিষয়ে কোনো-একখানা সমগ্র বই আজ পর্যন্ত লেখা হয়নি; এমনকি – দুঃখের কথা কী বলবো – ই–য়ানার মতো সমৃদ্ধ লাইব্রেরিতেও ‘‘গ্যেটে ও প্রাচী’’ বিষয়ে খুঁজে পেলাম একটিমাত্র ক্ষুদ্র নিবন্ধ, তাও তেমন সারবান নয়। রুসো-প্রণীত পুস্তকগুলোর মার্জিনে ভলতেয়ার যে-সব মন্তব্য করেছিলেন তারও সংগ্রহ সম্পাদিত ও প্রকাশিত হয়েছে – কিন্তু নেই ‘‘ভলতেয়ার ও প্রাচী’’ বিষয়ে কোনো আলোচনা, যদিও প্রাচী বিষয়ে ভলতেয়ারের লেখা প্রচুর ও নানাদিক থেকে আলোচনাযোগ্য। – কিন্তু শ্বেতাঙ্গদের দোষ দিয়ে লাভ কী, ওরা তো সবই করেছে – আমাদের প্রাচীন গৌরবের পুনরুদ্ধারও ওদেরই কীর্তি – আমরা যে এদিকে দৃষ্টি দিচ্ছি না এটা আমাদেরই অক্ষমতার অন্য এক প্রমাণ। আমার কেবলই মনে হচ্ছে যে তোমরা যারা তু.সা.র মধ্যে প্রবেশ করেছো – এই কাজ তোমাদেরই জন্য অপেক্ষা করছে। আমাদের দেশে যারা শুধু একটি সাহিত্য পড়ে এই দৃষ্টি ও আয়তন তারা পেতেই পারে না। রুমিকে থীসিসের বিষয় হিশেবে প্রস্তাব করেছি ‘‘বেস্নক থেকে শেলি পর্যন্ত ইংরেজি সাহিত্যে প্রাচী’’ (‘‘এলিয়ট ও ভারত’’-এ যে-সব ধর্মতত্ত্ব এসে যাবে তা ওর পক্ষে অনুকূল হবে না) – ইংরেজি আঠারো শতকে প্রাচী বিষয়ে একখানা বই আছে, রোমান্টিক যুগের শুধু একটা তথ্যনির্ভর বিবরণ দাঁড় করাতে পারলে খুব কাজের একখানা বই হয়। তোমাকে বলি – ঝর্না যেটা হাতে নিয়েও করলো না সেটা তুমি ভেবে দেখতে পারো, ভলতেয়া(রে)র যে প্রাচী বিষয়ে – এমনকি ভারত বিষয়ে – কত দীর্ঘ গঞ্জিকার ছিলিম চালিয়েছিলেন তা আমরাও জানি না, কৌতুক হিশেবে এটা খুব আকর্ষণযোগ্য। অথবা – ‘‘হুগো ও বোদলেয়ারে প্রাচী’’ – এই খনিটিও গভীর। মহাভারত বিষয়ে দ্বিতীয় বই নিশ্চয়ই তুমি লিখবে (তোমারটা ‘‘দ্বিতীয়’’ হবে এই আশা এখনো আমি ছাড়িনি), কিন্তু অন্য কোনো বিষয়ে প্রথম বই লেখার জন্যে এখন থেকেই তোড়জোড় করো – সেটা আমেরিকাতেই করা ভালো, কেননা দেশে ফিরে এত বই হাতে পাবে না।

তোমার পেনসিলভ্যানিয়ার কোর্সের বিবরণ যে-রকম দিয়েছো তা সত্যি নৈরাশ্যজনক। সাহিত্য আর ফরাশির ক্লাশ পাপ্পার খুব ভালো লাগছে – সাহিত্যে পড়ানো হয়েছে ‘‘প্যান’’, প্রথম ডুইনো এলিজি, একখানা জিদ, এখন পড়ছে প্রম্নফ্রক। এদের পাঠনের দ্রম্নতি অবশ্য অমানুষিক, জানি না ছাত্ররা কতটুকু নিতে পারে সত্যি – কিন্তু অন্ততপক্ষে বইগুলো ভালো। ভূগোল নিয়েই মুশকিলে পড়েছে পাপ্পা – এখানকার ভূগোল বেশ শক্ত, প্রায় সবটাই জিওলজি, ফলত পাপ্পাকে কলেজ থেকে ফিরেই ঘাড় গুঁজে পড়তে হচ্ছে – উপায় নেই। কিন্তু তোমার বয়স, পরিণত রুচি ও অভিজ্ঞতা নিয়ে তুমি কিছুটা স্বাধীনতা আশা করতে পারো – এমনকি ছিটে(া) ফোঁটা সুখ – দু-চারখানা ভালো বই থাকলেও এই নাগপাশ সহনীয় হ’তো। স্পষ্টত, পেনসিলভ্যানিয়া ছেড়ে কোনো পুরো তু.সা. বিভাগে আসতে হবে তোমাকে – সব ক-টা ভালো জায়গাতেই আবেদন পাঠাও, ই–য়ানা ভালো হবে।

আমি যে ভেবেছিলুম থ্যাঙ্কসগিভিং-এর ছুটির সঙ্গে বক্তৃতা জুড়ে নেব তা হ’য়ে উঠবে না। ওঁদের প্রস্তাবিত তারিখ হ’লো – ৭, ৮ ও ১৪, ১৫ নবেম্বর। থ্যাঙ্কসগিভিং বিষয়ে আমার প্রস্তাব হ’লো – তুমি ছুটি হওয়ামাত্র সোজা বস্নূমিংটনে চ’লে এসো। এখানে ছুটি ২৮শে নবেম্বর থেকে ১লা ডিসেম্বর – যদি তোমাদেরও তা-ই হয় তাহ’লে তুমি সাতাশে বিকেলে বাস্ ধ’রে আঠাশে দুপুর নাগাদ এখানে পৌঁছতে পারবে। ঊনতিরিশে বিকেলে আমরা দল বেঁধে শিকাগো যেতে চাই – দু-দিন খুব হৈ-হৈ করা যাবে ওখানে। প্রদীপ গাড়ি নিয়ে যেতে খুব উৎসুক – ওর মাষ্টার মশাই করুণা করলেই হয়। তুমি এখন থেকেই ব্যবস্থা করো যাতে ছুটি হবার দিনই বেরিয়ে পড়তে পারো – কোনো কারণেই দেরি না হয়। এই মফস্বলে এমন ধরনের জীবনযাপন করছি যে খুব একটা জমাট আড্ডা বা বড়ো শহরের ব্যস্ততা ও ভিড় – এ-সব ভাবতেই রোমাঞ্চ হচ্ছে। – ‘‘দেশ’’ থেকে আমার একটা কবিতা তোমাকে পাঠালাম – এর ইংরেজি সেপ্টেম্বরের ‘‘পোইট্রি’’তে বেরিয়েছে। ভালো আছো তো?

বু. ব.

চিঠি ৮

 

INDIANA UNIVERSITY

COMPARATIVE LITERATURE

১৮ অক্টোবর, ১৯৬৩

অমিয়,

আমি কয়েকদিন আগে তোমাকে দু-পাতা জোড়া চিঠি লিখেছি – তাতে ফ্ল্যাট নম্বর ছিল না, কিন্তু নিশ্চয়ই পেয়েছ? থ্যাঙ্কসগিভিং-এ তোমার সঙ্গে দেখা হবার জন্য উৎসুক হ’য়ে আছি – দেখো, যেন না ফশকায়।

আমার মনে ছিল না তুমি ‘‘দময়মত্মী : দ্রৌপদীর শাড়ি’’ দেখে আসোনি। রুমির নামে একটা পাঠিয়েছিলাম – সেটা ক-দিন আগে পৌঁছলো – মিমিকে লিখব তোমাকে এক কপি পাঠাতে। ‘‘ভাসো, আমার ভেলা’’ বেরিয়েছে খবর পেয়েছি – সুপ্রিয়দের ক্রিয়াকর্ম কিছুটা মন্থর, জানি না কতদিনে আমরা চোখে দেখবো।

এখানে পু[]]জা-সংখ্যা ‘‘উল্টো রথ’’ সমাগত; তাতে নব্যা অভিনেত্রীর নামে ‘‘লোলিতা’’ বানান দেখেও আমি ম’রে যাইনি! তাতে জড় জগতের মাহাত্ম্য ঘোষিত হচ্ছে। মেয়েটি আবার আমাদের কল্যাণী মুখোপাধ্যায়ের বোন।

তোমার জন্য ‘‘দেশ’’ পত্রিকাও জমিয়ে রাখছি – ফেরার সময় নিয়ে যেতে পারবে।

যে-বইটা আমাদের নয় অথচ কালো ট্রাঙ্কে ছিল সেটার নাম ‘‘The Prospects of Communism in China’’. এটাই তোমার অন্বিষ্ট হ’লে জানিয়ো – পাঠিয়ে দেব।

তোমার পাঠানো চটি প্রদীপের পায়েও লেগেছে পছন্দও হয়েছে। ওরা একেবারে সময় পায় না চিঠি লেখার – কিন্তু প্রদীপ ঘন-ঘন জিগেস করে – ‘‘অমিয় কবে আসছে?’’ আর রুমি খুঁটে-খুঁটে তোমার চিঠিগুলো প’ড়ে যায়।

ইতিমধ্যে ডেভিডের চিঠি পেয়েছি, ‘‘বিভাগ’’ ভিন্ন অন্য বিষয়ে ভালো আছে, তোমার খবর জানিয়ে দিয়েছি ওকে। আর চিঠি এসেছে আমাদের ছাত্র হিজলিবাসী কল্যাণের। মানব নীরব – নীরব থাকার কারণ নেই তাও নয়।

এখানে দুটো ভালো জিনিশ দেখা হ’য়ে গেল – ঈডিপাস রেক্স সিনেমা আর বলশয় ব্যালে। ব্যালেটা অবশ্য খুচরো পরিবেষণ করলো – ধারাবাহিকতার অভাবে রস পাওয়া গেল না, শুধু ওস্তাদি দেখানো হ’লো। সিনেমাটা ল-নের এক থিয়েটার থেকে অবিকল ছবি তুলে নিয়েছে – ঠিক গ্রীক ধরনে মুখোশ প’রে অভিনয় – ভঙ্গিপ্রধান – কোরাসগুলো সুর ক’রে বলা, গ্রীসে কী-রকম যাত্রা হ’তো তার কিঞ্চিৎ ধারণা পাওয়া গেল। এখানে ‘‘অফুরন্ত নিদাঘের দিন’’ চলছে। সুধীন্দ্রকে প্রায়ই মনে পড়ে। ভালো থেকো।

বু. ব.

 

চিঠি ৯

 

Hotel Bossert

Montague and Hicks Streets

Brooklyn 1, New York City

১৬ ফেব্রম্নয়ারি, ১৯৬৪

 

অমিয়,

আজ রবিবার, সকালে একখানা তিন-সেরি ন্যু ইয়র্ক টাইমস কিনে এনেছি – কিছুক্ষণ পাতা ওল্টাবার পরে মনটা যেন অবসাদে ভ’রে গেল। পাতার পর পাতা জুড়ে প্রকা- বিজ্ঞাপনের মিছিল – আসন বসন তৈজসপত্রের বিচিত্র অথচ বৈচিত্র্যহীন মেলা ব’সে গেছে – এই মহার্থ বিলাসিতার চেয়ে ক্লান্তিকর আর কিছু নেই। মানুষ তার এই ক্ষুদ্র দেহটুকু নিয়ে কতটুকুই বা ভোগ করতে পারে, পাঁচটা ইন্দ্রিয়ের একটা সক্রিয় হ’লে অন্যগুলো বুজে যায়, এমনি মানুষের দুর্ভাগ্য। স্ট্যা–শ আর্ম্স্ হোটেলের বারো তলায় আশ্চর্য দৃশ্য ছিল – কিন্তু তুমি তো সারাক্ষণ দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারো না, দু-চারদিনের জন্য বেড়াতে এলে ভালো, কিন্তু লেখা-পড়া ইত্যাদি যদি করতে হয় তাহ’লে দৃশ্যের দিকে পিঠ ফেরানো ছাড়া উপায় কী? এই হোটেলটায় আমাদের ঘর থেকে এক চিলতে সমুদ্র দেখা যায়, সেটা বরং ভালো, বেশি বিক্ষিপ্ত করে না, দুটি ঘরেই রোদ আসে প্রচুর – কিন্তু একটিও লেখার টেবিল না-থাকাতে কিছুটা কাতরভাবে কালাতিপাত করছি। স্ট্যা–শ আর্মসে একতলায়
এক-ঘরের একটা ফ্ল্যাট দেখিয়েছিলো – তাতে ছিলো ভালো বাথরুম ও রান্নাঘর, লেখার টেবিল ছিল, বইয়ের শেলফ দেবে বলেছিল – মাত্র একখানা ঘরের ১৬০ ডলার ভাড়া ব’লে গেলুম না, কিন্তু এখন মাঝে-মাঝে ভাবি, সেখানে অন্তত লেখার টেবিল পেতুম তো? মানুষের পক্ষে সুখী হওয়া কতই না সহজ, অথচ কত কঠিন! ব্যক্তিত্ব ও পেশা হিশেবে প্রত্যেকের বিশেষ কয়েকটি প্রয়োজন থাকে – অল্প কয়েকটি মাত্র প্রয়োজন – অথচ সেইটুকু যোগাযোগও সব সময় ঘ’টে ওঠে না। এই দ্যাখো না – এখানে অন্যান্য সুবিধে থাকা সত্ত্বেও লেখার টেবিলের অভাব কিছুতেই ভুলতে পারছি না, আমার পক্ষে সেটা অত্যন্ত জরুরি – তোমাদের অ্যাটওয়টরের টেবিল দুটোকে বেজায় হিংসে হচ্ছে, মনে হচ্ছে যে-কোনো প্রকার একটা দেরাজওলা টেবিলে টাইপরাইটার ও কাগজপত্র নিয়ে গুছিয়ে বসার মতো স্বর্গসুখ আর-কিছু নেই। যে ক’রে হোক, একটা জোগাড় ক’রে নেব – মার্শাল আশা দিয়েছেন।

কাল রাত্রে হঠাৎ আমার মনে প্রশ্ন জাগলো : ‘‘এমিলিয়া গালোট্টি’’ না কার লেখা? ঐ যে… ঐ যে… কিছুক্ষণ পরে ‘‘লাওকূন’’ নামটা মনে পড়লো, ‘‘Nathan the Wise’’কেও ধরতে পারলুম, কিন্তু লেখকের নাম কেবলই স’রে যাচ্ছে। অনেকক্ষণ প্রচেষ্টার পরে লেসিং মহাশয় ধরা দিলেন। তারপর ভাবলুম, এই ধরনের স্মৃতিশক্তি নিয়ে আর যা-ই হোক মাষ্টারি করা চলে না, হাতের কাছে পুস্তক চাই। ‘‘European Literature’’ নামে ভল্যুম দুটো পাপ্পার জন্যে রেখে এসেছিলুম, কিন্তু সে তো এ-সেমেস্টারে কোনো পাশ্চাত্ত্য সাহিত্যের কোর্স নেয়নি, তার বা তোমার বা রুমির যদি অসুবিধে না হয়, আমাকে ও-দুটো পাঠিয়ে দেবে? তোমরা লাইব্রেরি থেকে তিন মিনিটমাত্র দূরে আছো – সে-দিক থেকেও আমার দাবি হয়তো বেশি। [এখান থেকে ব্রম্নকলিন কলেজ আধঘণ্টার পথ, সপ্তাহে দু-দিনের বেশি কখনোই যাবো, এমন আশা অকিঞ্চিৎকর, লাইব্রেরির সঙ্গে অন্তরঙ্গতার সম্ভাবনাও বেশি নেই।] আর-এক কথা : আমাদের ঘণ্টা-বাজানো ঘড়িটা বোধহয় বেকার প’ড়ে আছে – রুমির ও পাপ্পার আপত্তি না-থাকলে পাঠিয়ে দেবে? (একটা মাপসই বোর্ডের বাক্সে ভ’রে, সুতো দিয়ে বেঁধে ডাকঘরে নিয়ে যাওয়া – এটুকুমাত্র ব্যাপার, কিন্তু এর জন্যেও উদ্যোগ চাই।) আজ অনেক বেলায় উঠে অনুতপ্ত হয়েছি, আমার বয়সে অধিক নিদ্রার প্রয়োজন নেই, কিন্তু শুধু মনস্থির ক’রে সাতটায় ওঠা সম্ভব হয় না, একটা যান্ত্রিক সাহায্য উপকারী। অতএব এই আবেদন।

তুমি কি কোর্স বদল করলে? ই–য়ানাতে ফেলোশিপের আবেদন পেশ করেছো? ওখানকার পড়াশুনো কেমন লাগছে বিস্তারিত লিখো। পাপ্পার চিঠি রোজই আশা করছি। তোমার প্রিন্সটনের চিঠি পরের দিন পাঠিয়েছি – আশা করি অগ্রাহ্য হবে না। এখানে তুষারপাত বেশি, কিন্তু শীত এবার প্রখর নয়।

হোটেলের ঠিকানাতেই চিঠি লিখো, বই, ঘড়ি পাঠিয়ো।

বু. ব

চিঠি ১০

 

Hotel Bossert

Montague and Hicks Streets

Brooklyn 1, New York City

৫ এপ্রিল, ১৯৬৪

 

অমিয়,

তুমি ফেলোশিপ পাবে সেটা আশাই করেছিলাম, কিন্তু পাকা খবর পেয়ে খুব খুশি হয়েছি। ভাবতে ভালো লাগছে যে তোমার যোগ্যতা

এঁদের কাছে ধরা পড়েছে, এবং আমার অনুরোধও উপেক্ষেত হয়নি। ই–য়ানার তু.সা. বিভাগের সঙ্গে প্রায় একটা আত্মীয়তা অনুভব করছি। ভাগ্যের পাকে পাপ্পাও সেখানে এসে পড়লো। আগামী এক বছর তুমি আর পাপ্পা একসঙ্গে বস্নূমিংটনে থাকতে পারবে, এই শুভ যোগাযোগে আমরা যে কত নিশ্চিন্ত হলাম তা না-বললেও চলে।

প্রাচী ও প্রতীকীদের বিষয়ে তোমার লেখাটা হয়তো এতদিনে শেষ করেছো। মালার্মের ‘‘ভারতীয় কাহিনী’’র কথা আমি জানতাম না। সম্প্রতি একটা বইয়ের পাতা ওল্টাচ্ছি – ‘‘Hindu Polytheism’’ – লেখক, Alain Daniélou, বলিঞ্জেন থেকে শিগগিরই বেরোচ্ছে, আমি এক বন্ধুর মারফৎ অগ্রিম কপি পেয়েছি। ই–য়ানার লাইব্রেরিতে এলে বইটা দেখো। প্রথম পরিচ্ছেদে হিন্দু দেবদেবীদের ‘‘সিম্বলিজ্ম’’ বিষয়ে আলোচনা আছে – আমার হঠাৎ মনে হ’লো সিম্বলিস্ট কবিতার ধারণাগুলোকে হিন্দু দেবদেবীতে তর্জমা ক’রে নেয়া যায়। ফরাশি প–ত বেশ লিখেছেন – বহু তথ্য ও তত্ত্ব আছে যা আমার জানা ছিল না।

তুমি কি এ-দেশে খবর-কাগজ পড়ো? আমি পড়ি না, শুধু মাঝে-মাঝে রবিবারে N.Y. Times কিনি। আজ সেই ধোপার বস্তার প্রথম পাতাতেই একটা মজার খবর পাওয়া গেল। ফরাশি ভাষায় সম্প্রতি যে-সব ইঙ্গ-মার্কিন শব্দ ঢুকে যাচ্ছে তার বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেছেন সর্বনের তু.সা. প–ত Et[i]emble, তাঁর পুস্তকের নাম ‘‘Parlez-vous Franglais?’’ – অর্থাৎ বাঙালির বাংরেজির মতোই নাকি ফরাশি ভাষা ইংরেজি মিশ্রণে কিম্ভূত হয়ে যাচ্ছে। অধ্যাপকটির মার্কিন-বিদ্বেষ তীব্র, এবং সেটা গোপন করার কোনো চেষ্টা বা ইচ্ছে নেই তাঁর। আমি দেখছি আমেরিকার ও রাশিয়ার ভয়ে অন্যান্য দেশ নতুন ক’রে উগ্র জাতীয়তাবাদ বরণ করছে – তাই ফ্রান্সে এখন দ্য গোল মহামানব ব’লে গণ্য। আশ্চর্য এই যে অনেক উদারনৈতিক মার্কিনী বুদ্ধিজীবীও দ্য গোলের প্রতি অত্যন্ত সশ্রদ্ধ। ব্যাপারটা বোঝা শক্ত, কিন্তু হয়তো আসলে শক্ত নয় – আসল কথা, জগৎটাকে চালিয়ে দিচ্ছে ধর্ম নয়, প্রেম নয়, মৈত্রী নয় – ক্ষমতা, নিতান্ত পাশব ক্ষমতা। কোথাও কোনো শক্তিশালী শত্রম্নর উত্থান হ’লে সেই শত্রম্নর সঙ্গে মিতালি করাই এখনকার পলিটিক্স। ভারতবর্ষ ধর্মের বুলি জ’পে তলিয়ে যাচ্ছে, শক্তিপূজক চীন ও পাকিস্তানের প্রতি শ্বেতাঙ্গ জাতির ঔৎসুক্য এখন স্পষ্ট। যুধিষ্ঠির স্বর্গে যান বটে, কিন্তু মর্ত্য শাসন করে আকীলিসেরা।

তুমি কি ‘ওয়াশিংটনের চিঠি’ লেখার কথা ভাবছো? সাগরবাবু যে শুধু রাজনীতি চান তা নয়, নানা ধরনের মুখরোচক খবর চান। প্র.ব. সম্প্রতি একটা লেখা পাঠিয়েছেন, কিন্তু মাসে একটা ক’রে তো দরকার – তুমি লিখলে আমাদের জানিয়ো। মাঝে-মাঝে নানা ধরনের কাগজ পড়লে উপাদানের অভাব হবে না।

কাল রুমির পরীক্ষা আরম্ভ, যে-অবস্থায় আমাদের এই ছাত্রীটি পরীক্ষা দিচ্ছে সেটা বেশ প্রশংসনীয়। নিশ্চয়ই ভালো হবে।

চিঠি লিখো।

বু. ব.

 

প্র. ব. তোমাকে পরে লিখবেন।

পুনশ্চ – একটা কাজের কথা লিখি। যে-খর্বকায় কৃষ্ণবর্ণ ভারতীয় যুবকটি ব্যালেন্টাইনে সারাদিন ব’সে বই পড়ে, তার কাছ থেকে সুব্রহ্মণ্য ভারতী (কবি) বিষয়ে কিছু তথ্য জোগাড় ক’রে দেবে? ভারতী বিষয়ে তার কোনো প্রবন্ধ হাতের কাছে থাকলে পাঠাতে পারো – বা কোনো বই যদি থাকে। আমাকে সেই এনসাইক্লোপিডিয়ার লেখাটায় হাত দিতে হবে এবার। পাপ্পাও চেনে যুবকটিকে – তার নাম বোধহয় মূর্তি। এটা জরুরি। (জন্ম-মৃত্যুর তারিখ, প্রধান পুস্তকের নাম, কী-ধরনের লেখা, এই সব চাই।)

চিঠি ১১

 

1502 North Franklin

Bloomington, Illinois

২ নবেম্বর, ১৯৬৪

 

অমিয়,

তোমাকে বহুদিন চিঠি লিখিনি। পড়া, পড়ানো, বাজার করা, ল–্রতে যাওয়া-আসা – এই সমৃদ্ধ ও বিলাসিতাবর্জিত দেশ কী ভাবে মানুষকে পরিশ্রমী ক’রে তোলে, তা তোমার অজানা নেই। মার্কিনী জীবন যে ‘‘দৈনন্দিনের মধ্যে দৈনন্দিনতম’’ তা এবারে উপলব্ধি করার সুযোগ হ’লো। আর যারা বলে ন্যু ইয়র্ক আমেরিকা নয় তারাও হয়তো ভুল বলে না। ন্যু ইয়র্ক হ’লো জগৎ, আর আমেরিকা হ’লো মফস্বল – এই তফাৎটা  কি উড়িয়ে দেবার?

কিন্তু আমেরিকার প্রতি আমার প্রীতিও বদ্ধমূল। এই দেশে, অবশেষে, আমাদের কালিকার সমাদর হয়েছে – নর্থ ড্যাকোটার জ্যাকসন কলেজে (শহরের নামও জ্যাকসন) চমৎকার চাকরি পেয়েছে সে। এতদিনে ওর আঁধার রজনী পোহালো। এমন একটা সুখবর আমি শিগগির পাইনি – আগামী দু-তিন বছরের মধ্যে সে হার্ভার্ড অথবা ইয়েলের পি-এইচ.ডি হবে, সেটা এবার ধ’রে নেয়া যায়। (আগামী কয়েক বছর পরে আমার যাদবপুরীয় ছাত্রদের মধ্যে পি-এইচ.ডির সংখ্যা এত বেড়ে যাবে যে আমি ময়ূরের মতো পেখম তুলে বেড়াতে পারবো। নবনীতা বার্কলিতে রামায়ণ নিয়ে যে-গবেষণা করছে, তার অর্থ কি আরো একটা ডিগ্রি?)

তোমাকে বলার কথা আমার অনেক জমেছে – সাহিত্য, রাজনীতি, পরচর্চা – নানা ধরনের। থ্যাঙ্কসগিভিং-এ যখন আসবে মনের বোঝা নামাতে পারবো। আমাদের এই বাড়িটায় স্থানাভাব নেই – থাকলেও তোমাকে আসতে বলতাম। আমি আমার ইংরেজি অ্যান্থলজির জন্য ‘‘আট বছর আগের একদিন’’ অনুবাদের চেষ্টা করছি – কিন্তু ‘‘কালীদহ’’ কথাটার ইংরেজি কী হ’তে পারে তা কিছুতেই ভেবে পাচ্ছি না। বাংলা ইডিয়মে কথাটার কী ইঙ্গিত তা কি তোমার জানা আছে? যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত ‘‘কামনার কালীদহ’’ লিখেছিলেন – জীবনানন্দর লাইনে সেখান থেকেই আসছে সন্দেহ নেই – কিন্তু এতদিন পরে মনে হচ্ছে যে কথাটার অর্থ কখনো ভেবে দেখিনি। ‘‘দহ’’ মানে ডাঙা, স্থান, জনপদ (পোড়াদ’, শিয়ালদ’) – কিন্তু ‘‘কালীদহে’’ আবেগের অনুষঙ্গটা কী? ‘‘বুড়ি চাঁদটারে আমি ক’রে দেব কালীদহে বেনোজলে পার’’ – Limbo? Styx? Lethe? বিস্মরণ?

তোমার মাথায় কিছু খেললে জানিয়ো।

এই অনুবাদের ব্যাপারে কিছু সাহায্য করবে আমাকে? তোমাকে কোনো ভার নিতে লুব্ধ করা কি সম্ভব?

‘‘আধুনিক বাংলা কবিতা’’র পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে মনে হচ্ছে অমিয় চক্রবর্তী সত্যিকার ভালো কবি। কবিতা যে কবির প্রকাশ্য ব্যক্তিত্ব ও ঘোষিত জীবনদর্শনের উপর নির্ভর করে না, সেটা আমাদের কত বড়ো সৌভাগ্য তা ভেবে অবাক লাগে।

বু. ব.

এই চিঠিটা যখন অর্ধেক লেখা হয়েছে তখন তোমার ফোন এলো। যাদবপুর বিষয়ে আমরা সকলেই বেদনাহত, কিন্তু নরেশই হয়তো সবচেয়ে বেশি, কেননা তাকে অপ্রিয় ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকতে হ’লো। তুমি নরেশের চিঠির জবাব দিতে দেরি কোরো না, আমিও শিগগিরই তাকে লিখবো। আমি রেজিস্ট্রারকে জানিয়েছি আমার ‘‘মৌলিক কোনো আপত্তি নেই’’ – এ-অবস্থায় এর বেশি আর কী লেখা যেতো?

চিঠি ১২

 

কলকাতা ২৯

২৯/১২/৬৫

কল্যাণীয়েষু,

অমিয়, এ-মাসের প্রথম দিকে আমরা দল বেঁধে – জ্যোতি, নরেশ, নিরুপম, আমি – পাটনা গিয়েছিলুম তিন দিনের জন্য; সেখানে USIS-এর উদ্যোগে মার্কিনী সাহিত্য বিষয়ে একটি সেমিনার অনুষ্ঠিত হ’লো। সেমিনারে পা–ত্য অথবা রসবোধের উজ্জ্বল কোনো দৃষ্টান্ত পাওয়া গেল না – তা আশা করাও অন্যায় – কিন্তু সবাই এক হোটেলে ছিলুম ব’লে বেশ আড্ডা জমানো গিয়েছিল। সুনীলও (গাঙ্গুলি) ছিল, চেনাশোনা আরো অনেকে। তারপর এই সেদিন উড়িয়া লেখকদের নিমন্ত্রণে দু-দিন ভুবনেশ্বর ঘুরে এলুম – তিরিশ বছর পরে কোনারক আবার দেখা হ’লো। আর-একদিন থাকলে চিল্কা অথবা পুরীও ঘুরে আসা যেত, কিন্তু ইতিমধ্যে নরেশ যাদবপুরে এক বিরাট ইয়েটস-উৎসব চালাচ্ছিলো, তার সর্বশেষ দিনে উপস্থিত থাকার জন্য চিল্কার লোভ কাটিয়ে ফিরে এলুম। সন্ধেবেলা ‘‘Yeats Country’’ নামে একটি ফিল্ম দেখানো হ’লো (চলনসই গোছের), হিমানীর (মানবের স্ত্রী) পরিচালনায় যে-কবিতা পাঠ ও নাটক-পাঠ হ’লো সেটা না হ’লে কোনো ক্ষতি ছিল না, তারপর সুধীন্দ্রর অনুবাদে ‘‘দি রেজা্রেকশন’’ অভিনয় হ’লো – এটার পরিচালক ছিল প্রণবেন্দু। যীশু যেখানে প্রবেশ করছেন নাটকের সেই চরমক্ষণ জমাতে পারেনি ওরা, কিন্তু তাছাড়া অভিনয় ইত্যাদি সুষ্ঠু হয়েছিল – সকলেরই ভালো লেগেছে। দ্বিতীয় লিরিকটায় সুর দিয়ে একটি মেয়ে গান করলে, সেটা – আর মেয়েটির ও রীয়ার আবৃত্তি বেশ হৃদয়গ্রাহী হয়েছিল। নরেশ বেশ বড়ো মাপে আয়োজন করেছিল – UGC ছ-হাজার টাকা দিয়েছিলেন এর জন্যে – কলকাতার বাইরে থেকে অনেকে এসেছিলেন, মলিস্নক বললেন সকলেই খুব প্রীত হয়েছেন। নরেশ বলছিল তুমি আর দীপক থাকলে আরো সুব্যবস্থা হ’তে পারতো – এ-বিষয়ে আমি তার সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত।

আমার শরৎচন্দ্র-বক্তৃতা লেখা হ’য়ে গেছে – ১৯শে জানুয়ারি থেকে চারদিন সেগুলি পাঠ করতে হবে, তারপর ‘‘অমৃতে’’ বেরোবে, তারপর বই। সেই ইয়ার-বুকের কপি খুঁজে পেয়েছি – ‘‘Tagore in Translation’’টা আরো বিসত্মৃতভাবে বাংলায় লিখলাম,  সেটাও ও-বইয়ের অংশ হবে। ‘‘মহাভারতে’’ এখনো হাত দিইনি, ‘‘বিপন্ন বিস্ময়’’ও আজ পর্যন্ত অস্পৃষ্ট থেকে যাচ্ছে। এর কোনো-একটা শিগগিরই শুরু ক’রে দেব ভাবছি – কিন্তু উপন্যাস লেখার মতো মানসতা নিজের মধ্যে আর খুঁজে পাচ্ছি না, বরং একটা নাটক চেষ্টা করতে লুব্ধ হই মাঝে-মাঝে। ফাঁকে-ফাঁকে কবিতাও লেখা হচ্ছে – কবিতা লেখাই আমার সত্যিকার কাজ ব’লে মনে হয়, কিন্তু যেহেতু সব সময় কবিতা লেখা যায় না, এবং অধিকাংশ সময়ই কবিতা লেখা যায় না, তাই দুই অর্থেই ‘‘মোটা ভাত-কাপড়ের’’ জন্য গদ্য লেখা আমার পক্ষে অপরিহার্য। আমরা হয়তো কিছুদিন পরে নাকতলায় বদলি হবো – এই ঘটনা আমাদের পক্ষে একটা সংকট, সত্যিকার ক্রাইসিস – রা. বি. এভিনিউ ছেড়ে কী ক’রে বাঁচবো ভাবতে পারি না, অথচ বিবিধ কারণে মনে হচ্ছে নাকতলায় না-গিয়েও আর উপায় নেই।

জ্যোতিদের মার্কিনী ঘুঁটি এবারে পেকে এল, ফেব্রম্নয়ারি নাগাদ ওরা যাত্রা করবে ব’লে আশা করা যাচ্ছে। ওরা প্রথমে যাবে শিকাগোতে – তোমার সঙ্গে নিশ্চয়ই দেখা হবে – কিন্তু রুমিদের সঙ্গে কীভাবে দেখা হতে পারে সেটাই একটু ভাবনার কথা, কেননা রুমিরা এপ্রিল নাগাদ দেশমুখো রওনা দেবার তোড়জোড় করছে। সুপ্রিয়া নির্বিঘ্নে একটি কন্যা প্রসব করেছে, দু-জনেই ভালো আছে – এ-খবর কি আগে পেয়েছিলে? সেদিন শুনলুম রাজেশ্বরী কেম্ব্রিজ (ইং) বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে একটা খুব ভালো কাজ পেয়েছেন – জানুয়ারির মাঝামাঝি শিকাগো ছাড়বেন। এটা বিশেষ সুখবর, কেননা তিনি যে আমেরিকার চাইতে য়োরোপে অনেক বেশি আরাম পাবেন তাতে সন্দেহ নেই – ইংল–র কেন্দ্রীয়-তাপহীন সুদীর্ঘ ও সুতীব্র শীত সত্ত্বেও।

ডিসেম্বরের ছুটি কেমন কাটলো তোমাদের? কোথাও কি বেড়াতে গিয়েছিলে? শুলজ্কে বোলো তার চিঠি পাবার দু-তিনদিন পরেই শংসাপত্রটি যথাস্থানে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম – তাকে আমার শুভকামনা জানিয়ো। তাজউদ্দীনকে বোলো কখনো কলকাতা এলে আমাদের সঙ্গে যেন দেখা করে। তুমি যে মহাভারত ও ডস্টয়েভস্কিকে নিয়ে বই লেখার কথা ভাবছো এটা আমার খুব ভালো মনে হ’লো – লেখনীর ধীরগামিতায় উৎসাহ হারিয়ো না – মনে রেখো রোজ মাত্র দু-পৃষ্ঠা করে লেখা হ’লেও ৩০০ দিনে ৬০০ পৃষ্ঠা লেখা হ’য়ে যায়। ধৈর্য, ধৈর্যই সব – আর প্রতিজ্ঞা। দেশে ফিরে ‘‘নেহাৎ মাষ্টার’’ হ’য়ে যেয়ো না, এই ‘‘অধ্যাপকবর্ষে’’ সেটা একটা মহাআশঙ্কা। পাপ্পা তোমাকে এখনো চিঠি লিখতে না-পেরে বিবেকপীড়িত অবস্থায় কাল কাটাচ্ছে – দেখছি ওকে একটা আলাদা লেখাপড়ার জায়গা ক’রে দেবার জন্যেই নাকতলায় যাওয়া দরকার। আজকাল – কলকাতার হিশেবে – বেশ শীত চলছে, আমি নিস্তাপ ও নিরালোক ঘরে বাতি জ্বেলে দিন কাটাচ্ছি।

বু. ব.

(লাল কালিতে যোগ) রানু তোমাকে স্নেহ-আশীর্বাদ জানাচ্ছে।

 

 

চিঠি ১৩

কলকাতা ৪৭

১ ডিসেম্বর, ১৯৬৬

 

অমিয়,

লেখা, লেখার ভাবনা, প্রম্নফ পড়া, বই পড়া, মাঝে-মাঝে সাংসারিক দুশ্চিমত্মা, মাঝে-মাঝে নৈরাশ্য ও বিমর্ষতা, মাঝে-মাঝে প্রফুলস্ন সমীরণ, ২০২ ছেড়ে এসে নাকতলায় অভ্যস্ত হবার কষ্ট – এই সবের মধ্য দিয়ে আমি আটান্ন বছর বয়স পার হ’য়ে এলাম। আমার কয়েকটা নতুন বই বেরিয়েছে ও বেরোচ্ছে, তোমাকে ইচ্ছে ক’রেই পাঠাইনি, কেননা তুমি হয়তো শিগগিরই ফিরে আসবে, আর জাহাজ-ডাক পৌঁছতে তো চার মাস, তার উপর থীসিস ও পড়ানোর ব্যস্ততায় হয়তো অবসরও বেশি পাও না, আবার আসবার সময় পার্সেল পাঠাবার ঝামেলা। তুমি কলকাতায় ফিরলে সবগুলো বই একসঙ্গে তোমার হাতে দেব, সেই আশায় আছি। আমার ঋষ্যশৃঙ্গ-সম্পর্কিত নাটক (‘তপস্বী ও তরঙ্গিণী’) বই হ’য়ে বেরিয়ে গেছে, ডিমক্কে একটা কপি দিয়েছিলুম, শিকাগোতে গেলে সেটা পোড়ো, অথবা মিমিকে পাঠানো ‘‘দেশ’’-এর ফাইল। (বইটা কিঞ্চিৎ ‘পরিশোধিত’)। আর-একটা নাট্যাকৃতি গল্প লিখেছিলুম পূজা-সংখ্যা ‘দেশ’-এ। দীপক সেটা পড়েছে, কখনো সুযোগ হ’লে প’ড়ে নিতে পারো। নরেশ তোমাকে যে-উপন্যাস দুটোর কথা লিখেছে সে-দুটো এখন অনেকটা বাড়াচ্ছি ও বদলাচ্ছি – বই বেরিয়ে গেলেই পড়া ভালো। নতুন কবিতার বই ‘মরচে-পড়া পেরেকের গান’ ভারবি থেকে শিগগিরই বেরোচ্ছে। (বিরামবাবুর পরিচালনায় ভারবি প্রকাশনী একেবারে মনোমুগ্ধকর, কিন্তু তিনি শুধু ‘বিদগ্ধ’ বই বের করেন ব’লে লাভের অঙ্কে এখনো রেখাপাত হচ্ছে না – জ্যোতিকে তিনি কয়েকটা বই পাঠিয়েছিলেন, আয়ওয়াতে গেলে আশা করি দেখতে পাবে।) আমার মনটা এখন খুব নাটকের দিকে ঝুঁকেছে, ভবিষ্যতে যদি আরো নাটক লিখে ফেলি অবাক হোয়ো না। (‘কবি রবীন্দ্রনাথ’ – শরৎচন্দ্র-বক্তৃতা, ভারবি থেকে বেরিয়েছে।)

প্রণবেন্দু ও মানব দু-জনেই যাদবপুরে তু.সা.বি-তে পড়াচ্ছে – ওরা আসে কদাচ বা মাঝে-মাঝে। ‘তপস্বী ও তরঙ্গিণী’ মঞ্চস্থ করার জন্য প্রণবেন্দু ও অন্য দু-একজন উৎসাহিত, কিন্তু প্রয়োজনা সমস্যাবহুল ব’লে এখনো কার্যত কিছু এগোয়নি। মাঝে-মাঝে সুদূর নাকতলাতেও আড্ডা জমে, প্রধানত নরেশ-চিনুকে নিয়ে, বিরামবাবু আসেন সপ্তাহান্তে একদিন, কখনো বা সুনীল ও তরুণ কবিরা, কখনো সাগরময় ঘোষ। তবু এমন অনেক সন্ধ্যা কাটে যখন কথাবার্তার জন্য তৃষিত হ’য়ে থাকি, হুইস্কিতে সেই তৃষ্ণা নিবারণ হয় না, অগত্যা বই সম্বল। শুনে হয়তো অবাক হবে যে আমি আজকাল মিমির মতো (বা আমারই ছেলেবেলার মতো) একই সঙ্গে নানা বই পড়ছি; একই সময় বালজাক, ইয়োনেস্কো, মার্সেল প্রম্নস্ত (এতদিনে প্রম্নস্ত আমার ভালো লাগছে, কিন্তু ইচ্ছে ক’রেই
ধীরে-ধীরে পড়ছি, অন্য কাজের ফাঁকে-ফাঁকে, যাতে বারো ভল্যুম নিয়ে বহুকাল কাটানো যায়।) সম্প্রতি রিলকে ও হ্যেল্ডার্লিন থেকে কিছু নতুন অনুবাদ ও পুরোনোগুলোর মাজা-ঘষা করলাম (একটা বই বেরোবে), এক নম্বর ডুয়িনো এলিজি তর্জমা ক’রে উঠতে পেরেছি, এটা বোধহয় সুখবর। ভাবছি, ১৯৬৭-তে কোনো সময়ে ‘বিপন্ন বিস্ময়ে’ হাত দেব। দীপ্তি ত্রিপাঠীর সুধীন্দ্র-জীবনী বিষয়ে আর-কিছুই শুনিনি, বোধহয় পরিকল্পনাটি ত্যাগ করেছেন।

আসল খবরটাই এখনো লেখা হয়নি – রুমি-প্রদীপ-বুয়ান এসে পৌঁচেছে, নাকতলা এখন প্রাণোচ্ছল। জানুয়ারির শুরুতেই ওরা চ’লে যাবে কানপুরে তাই এ-ক’দিন প্র.ব.র লেখাপড়া বন্ধ, আমিও মাঝে-মাঝে জীবন ও শিশুর দ্বারা সম্মোহিত হচ্ছি। তুমি কবে আসবে? নরেশ ও তার বিভাগ ব্যাকুলভাবে তোমার প্রতীক্ষা করছে, আমরাও পথ চেয়ে আছি। মুকুলের সঙ্গে দেখা হ’লে আমাদের শুভেচ্ছা জানিয়ো, এবার ওর সঙ্গে কথাবার্তা বলে খুব ভালো লাগলো।

বু. ব.

 

(লাল কালিতে যোগ)

জ্যোতি একটা নাটক লিখেছে, আওয়াতে গেলে পোড়ো। তুমি নাটক অনুবাদ করবে শুনে উৎসাহিত হয়েছি।

আমেরিকা ছাড়বার আগে-ভাগে সময় থাকতে জানিয়ো, তোমাকে কয়েকটা জিনিশ আনতে বলব।

 

 

 

চিঠি ১৪

 

কলকাতা ৪৭

১১/৯/৬৭

অমিয়,

কাল তোমাকে যে-ভৌগোলিক নামটার বিষয়ে বলছিলুম সেটা MESSOGIS। ‘পাটমস’-এর লাইনগুলো এই –

…where down

from tmolus descends

The Pactolus adorned with gold,

And Taurus stands, and Messogis…

অন্যগুলোর হদিশ পেয়েছি, কিন্তু মেসোগিস কোথাও পাচ্ছি না, যদিও Messis ব’লে এক প্রাচীন এশিয়া-মাইনর-স্থিত নগরের নাম আছে আমার (কলম্বিয়া) বিশ্বকোষে। এ-দুটো এক কিনা সেও এক প্রশ্ন। তুমি তল্লাস কোরো। ফাদার আঁতোয়ান হয়তো বলতে পারবেন।

বু .ব.

 

চিঠি ১৫

 

কলকাতা ৪৭

৬/৩/৭৩

অমিয়,

তুমি দেখার পরেও প্রম্নফে কয়েকটা ভুল বেরুলো – য-ষ, উ-ঊ-বিভ্রাট, এক জায়গায় দেখি পৃষ্ঠার মাথায় ‘মহাভারতের কথা’ কধা হ’য়ে আছে। ছাপার ভুলেরা আরশোলার মতো চতুর, আমাদেরও দুর্ধর্ষ হওয়া দরকার।

তোমার কি অতীকরণকারী এক খ- কাচ আছে?

দুষ্যন্ত-দুষ্মন্ত বিষয়ে –

বঙ্গবাসী, আর্যশাস্ত্র, কালীপ্রসন্ন, বিদ্যাসাগর সর্বত্রই দুষ্মন্ত আছে, শুধু রবীন্দ্রনাথই দেখলাম দুষ্যন্ত লিখেছেন। জ্ঞানেন্দ্রমোহন হরিচরণেও দুষ্মন্ত অনুমোদিত। কিন্তু M-W তে এই বানানটি আদৌ নেই, তাঁর মতে মূল রূপ ছিলো দুঃষন্ত, পরে দুষ্যন্তরূপ গ্রহণ করে।

এখন, মনে-মনে বহু বিচারবিতর্ক ক’রে আমার মনে হ’লো বঙ্গবাসী ও বিদ্যাসাগরও যখন ষ্ম লিখেছেন তখন ওটাই নিশ্চয়ই বাংলা প্রকরণগুলিতে প্রচলিত বানান। আমি বইয়ে একস্থলে লিখেছি যে আমি সর্বত্র বাংলা প্রকরণ অনুসরণ করেছি (সত্যিও তা-ই), তাই দুষ্মন্ত রাখাই স্থির করলাম।

বাঙালির মুখে উচ্চারণে তফাৎ হবে না – শুধু ষ্ম-তে আনুনাসিক ধ্বনি হবে। স্মার্ত-কে শাঁর্ত বললে দোষ হয় না। শিগগিরই আরো প্রম্নফ পাওয়া যাবে আশা করছি।

বু. ব.

 

 

চিঠি ১৬

 

KAVITABHAVAN : 364/19 NETAJI S. C. BOSE ROAD

CALCUTTA 47

৪/৩/৭৪

 

অমিয়,

পাপ্পা বলছিলো তোমার বাড়িতে কোনো-এক টেলিফোনে তুমি অধিগম্য। সেই নম্বরটি জানিয়ো। তোমার বাড়ির নম্বর কি ৬৯? মাঝে-মাঝে সংযোগের অভাব অনুভব করি।

বু. ব.

 

 

…                     …                           …

 

চিঠিগুলোতে দুটো চিহ্ন যোগ করেছি : ( ) বর্জন ও [ ] সংযোজন বোঝাতে।

 

সূত্র

 

চিঠি ১

হাওয়াইয়ি বিশ্ববিদ্যালয় : টোকিও থেকে সান ফ্রান্সিসকোর পথে হনলুলুতে থামেন বুদ্ধদেব বসুরা। সেখানে ওয়াটুমল ফাউন্ডেশনের আতিথ্যে বক্তৃতা ছিল বুদ্ধদেব বসুর।

পাপ্পা : শুদ্ধশীল বসু, পুত্র। তখন ষোলো বছরের, স্কুল শেষ করছে। (অকালপ্রয়াত)

অমলকান্তি ভট্টাচার্য যাদবপুরে তুলনামূলক সাহিত্যে বি.এ. পড়ছিল। মেধাবী। শুদ্ধশীলকে তার স্কুলশেষের পড়াশুনোয় সাহায্য করছিল।

চিঠি ২

বুদ্ধদেব বসুর প্রবন্ধ ‘বীটবংশ ও গ্রীনিচগ্রাম’ দ্রষ্টব্য, দেশান্ত গ্রন্থের (১৯৬৬) অন্তর্ভুক্ত।

 

চিঠি ৩

অতুলচন্দ্র গুপ্ত (১৮৮৪-১৯৬১) বিখ্যাত আইনজীবী ও লেখক। তাঁর মৃত্যু হয় [১৯৬১-র] ১৭ ফেব্রম্নয়ারি।

সুধীন্দ্রনাথ দত্তের মৃত্যু হয়েছিল ২৫ জুন ১৯৬০-এ। যামিনী রায়, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ও বুদ্ধদেব বসুর আহবানে ২৮ অগস্ট মহাজাতি সদনে যে-সভা হয় তাঁর স্মরণে, তাতে সভাপতিত্ব করেন অতুলচন্দ্র গুপ্ত।

 

চিঠি ৪

চেলসী হোটেল : বুদ্ধদেব বসুরা নিউ ইয়র্কে প্রথমে ছিলেন এক প্রায়ান্ধকার ফ্ল্যাটে। সেখান থেকে উঠে আসেন এই বিখ্যাত হোটেলে।

নরেশ গুহ ছিলেন যাদবপুরে বুদ্ধদেব বসুর সহকর্মী। কবি। (প্রয়াত।) তাঁর প্রবন্ধটি, ‘Rabindranath in the West’ Jadavpur Journal of Comparative Literature-এর প্রথম সংখ্যায় (১৯৬১) বেরোয়।

জ্যোতি : জ্যোতির্ময় দত্ত বুদ্ধদেব বসুর বড়ো মেয়ে মীনাক্ষীর (মিমি) স্বামী, তখন স্টেটসম্যান-এ কর্মরত। সুধীন্দ্রনাথ দত্তের স্নেহধন্য।

ফাদার পিয়ের ফালঁ, এস.জে. তখন যাদবপুরে সপ্তাহে দুদিন করে তুলনামূলক সাহিত্য পড়াচ্ছেন।

দেবেনবাবু : দেবেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, যাদবপুরের তদানীন্তন পরীক্ষা-নিয়ামক।

প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত যাবদপুরে বুদ্ধদেব বসুর প্রথম বছরের ছাত্র, আমার সহপাঠী। তখন মিনেসোটায় তুলনামূলক সাহিত্যে পিএইচ.ডি-র জন্য পাঠরত। কবি। (প্রয়াত।)

নবনীতাও [এখন, দেব সেন] তাই। বস্তুত যাদবপুরে বুদ্ধদেব বসুর প্রথম ছাত্র। ইন্ডিয়ানা থেকে তুলনামূলক সাহিত্যের পিএইচ.ডি (১৯৬৩)। কবি ও কথাসাহিত্যিক। ‘সই’ সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা।

পৃথ্বীশবাবু : পৃথ্বীশচন্দ্র চক্রবর্তী, যাদবপুরের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান অধ্যাপক। বস্নূমিংটন, ই–য়ানায় উপস্থিতি অতিথি অধ্যাপক হিসেবে।

হ্যাস্কেল বস্নক তুলনামূলক সাহিত্যের এক মার্কিনি তাত্ত্বিক।

হোর্স্ট ফ্রেন্জ্ ই–য়ানার তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগের তদানীন্তন প্রধান অধ্যাপক।

 

চিঠি ৬

রুমি : বুদ্ধদেব বসুর ছোটো মেয়ে দময়মত্মী [বর্তমানে, বসু সিং], তখন ই–য়ানায় তুলনামূলক সাহিত্যে পিএইচ.ডি-র জন্য পাঠরত।

প্রদীপ ঘোষ দময়মত্মীর প্রথম স্বামী, ইন্ডিয়ানায় রসায়নশাস্ত্রে পিএইচ.ডি-র জন্য গবেষণারত।

ডক্টর পরিমল দাস USEFI-র (ইউনাইটেড স্টেটস এডুকেশনাল ফাউন্ডেশন ইন ই–য়া) তদানীন্তন রিজিওনাল ডিরেক্টর।

নরেনদা : নরেন্দ্র দেব (১৮৮৮-১৯৭১), বিখ্যাত লেখক, আমার সহপাঠী বন্ধু নবনীতার বাবা।

রাধারানী দেবী (১৯০৩-৮৯) বিখ্যাত লেখক (স্বনামে তো বটেই, অপরাজিতা দেবী ছদ্মনামেও লিখেছেন), নবনীতার মা। (মেয়ে নবনীতা উচ্চশিক্ষার্থে বিদেশ যাবার পর তাঁদের সস্নেহ আগ্রহে আমি কয়েকবছর তাঁদের সঙ্গে ৭২ হিন্দুস্থান পার্কে থাকি – সেই স্নেহের ঋণ ভুলবার নয়।)

চিঠি ৭

‘রুমিকে থীসিসের বিষয়’ : শেষ পর্যন্ত দাঁড়ায় এলিয়ট ও ভারতই (‘ইন্ডিয়ান থট ইন টি.এস. এলিয়ট’)

ঝর্না [বসু, বিবাহোত্তর দাস, পরে ভট্টাচার্য] যাদবপুরে বুদ্ধদেব বসুর ছাত্র। এইক্স-অ-প্রভঁস-এ ‘ভলতেয়ার ও ভারত’ নিয়ে কাজ শুরু করেছিলেন। তা শেষ না করে পরে সর্বন থেকে ‘আধুনিক বাংলা কবিতায় ফরাসি প্রতীকীবাদী ভাব ও ভঙ্গি’ নিয়ে ডক্টরেট করেন।

‘সাহিত্য আর ফরাশির ক্লাশ পাপ্পার খুব ভালো লাগছে’ : শুদ্ধশীল তখন ইন্ডিয়ানাতে বি.এ. পড়ছে।

থ্যাঙ্কসগিভিং : উত্তর আমেরিকায় হেমন্তশেষের ছুটি।

দেশ-এ ছাপা, পোয়েট্রিতে অনূদিত কবিতা ‘হ্যেল্ডার্লিন’।

 

চিঠি ৮

সুপ্রিয় : সুপ্রিয় সরকার, বুদ্ধদেব বসুর অন্যতম প্রধান প্রকাশক এম.সি. সরকার অ্যা- সন্স প্রাইভেট লিমিটেড’-এর তদানীন্তন কর্ণধার।

কল্যাণী মুখোপাধ্যায় : একদা লন্ডন-নিবাসী ও লেখক সুধীরঞ্জন মুখোপাধ্যায়ের প্রাক্তন স্ত্রী।

ডেভিড : ডেভিড ম্যাকাচ্চন, ইংরেজ, যাদবপুরে তুলনামূলক সাহিত্যের অধ্যাপক। টেরাকোটা মন্দির নিয়েও প্রামাণ্য কাজ করেছেন। ১৯৭২-এ তাঁর অকালমৃত্যু হয়।

কল্যাণ চৌধুরী : যাদবপুরে বুদ্ধদেব বসুর ছাত্র। পরে সাংবাদিক। (প্রয়াত।)

মানব : বুদ্ধদেব বসুর ছাত্র, আমাদের সহপাঠী বন্ধু মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়।

 

চিঠি ১০

এতিয়াঁবস্ন শুধু তুলনামূলক সাহিত্যের প–তই নন, পাঁচের দশকে তুলনামূলক সাহিত্যের এক তরুণ তুর্কিও। বলেছিলেন, তুলনামূলকতা খালি প্রভাব মেপে বেড়ানো নয়।

‘ওয়াশিংটনের চিঠি’ : দেশ-এর জন্য।

সাগরবাবু : দেশ সম্পাদক সাগরময় ঘোষ।

রুমির পরীক্ষা : পিএইচ.ডি রেজিস্ট্রেশনের আগেকার ‘কম্প্রিহেনসিভ’ পরীক্ষা। দময়মত্মী তখন অমত্মঃসত্ত্বা।

‘খর্বকায় কৃষ্ণবর্ণ ভারতীয় যুবকটি’ সম্ভবত ভি. সচ্চিদানন্দন, মাদুরাই বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজির অধ্যাপক। তাঁরই উদ্যোগে এই বিভাগ ‘ইংরেজি ও তুলনামূলক সাহিত্য’ বিভাগে রূপান্তরিত হয়। দক্ষিণ ভারতে আরো কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় সেই উদাহরণ অনুসরণ করে।

 

চিঠি ১১

কালিকা : কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্য, যাদবপুরে বুদ্ধদেব বসুর ছাত্র। আমেরিকায় পড়তে এসে তাঁর সংকল্প ছিল হার্ভার্ড বা ইয়েলের মতো বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া অন্য কোথাও পিএইচ.ডি করবেন না।

নবনীতার রামায়ণ গবেষণা ডক্টরেট-উত্তর কাজ। তাঁর চন্দ্রাবতী ও অন্যান্য নারী কবির রামায়ণ চর্চা তারই পরবর্তী পরিণতি।

ইংরেজি অ্যান্থলজি : বুদ্ধদেব বসু-সম্পাদিত অ্যান অ্যান্থলজি অব বেঙ্গলি রাইটিং

টেলিফোন প্রসঙ্গ : নরেশ গুহ ও যাদবপুরের তদানীন্তন রেজিস্ট্রার প্রবীরচন্দ্র বসু মলিস্নক বুদ্ধদেব বসুকে যাদবপুরে ফিরিয়ে আনা যায় কিনা তার চেষ্টা করেছিলেন।

 

চিঠি ১২

নিরুপম চট্টোপাধ্যায় ছিলেন ইংরেজির অধ্যাপক। পরে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেসের সঙ্গে যুক্ত হন। এক সময় নরেশ গুহ, অরুণকুমার সরকার ও অশোক মিত্রের সঙ্গে কবিতাভবনে (২০২ রাসবিহারী এভিনিউ) নিয়মিত আড্ডাধারী ছিলেন। (প্রয়াত।)

সুধীন্দ্রনাথ দত্তের ‘রেজা্রেকশন’ অনুবাদের নাম ‘পুনরুজ্জীবন’ (পরিচয়-এ ছাপা হয়েছিল ভাদ্র ১৩৪৩-এ)। ১৯৪৩-এ ফ্যাসিস্টবিরোধী লেখক ও শিল্পী সংঘের পক্ষ থেকে এই নাটিকা প্রথম অভিনয় হয়। পরিচালনা করেছিলেন বিষ্ণু দে।

রীয়া [বসু, পরে চৌধুরী] বিভাগের ছাত্র, বুদ্ধদেব বসুর পরিচিত।

‘জ্যোতিদের মার্কিনী ঘুঁটি’ : জ্যোতির্ময় দত্ত আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পল এঙ্গল-পরিচালিত রাইটার্স ওয়ার্কশপে আমন্ত্রিত ছিলেন। মীনাক্ষী দত্তসহ তাঁর সেখানে যাবার কথা, কিন্তু মার্কিনি ভিসা পেতে দেরি হচ্ছিল।

সুপ্রিয়া : দীপক মজুমদারের স্ত্রী। পরে তাঁদের বিচ্ছেদ হয় ও তিনি বাংলাদেশের নাগরিক শামসুল বারিকে বিয়ে করেন। (প্রয়াত।)

প্রখ্যাত রবীন্দ্রসংগীত গায়ক রাজেশ্বরী দত্ত (১৯১৮-৭৬) স্বামী সুধীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর একসময় শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রন্থাগার বিজ্ঞান অধ্যয়ন করেন।

শুলজ্ : আমেরিকায় আগত জার্মান যুবক, ই–য়ানায় তুলনামূলক সাহিত্যের ছাত্র। বুদ্ধদেব বসুর কোর্স নিয়েছিলেন। শুদ্ধশীল ও আমার বন্ধু।

তাজউদ্দীন : ভারতীয়, ইন্ডিয়ানায় ইংরেজির ছাত্র। বুদ্ধদেব বসুর কোর্স নিয়েছিলেন (?)। একসময় এক মার্কিনি ছাত্রের সঙ্গে আমরা দুই ভারতীয় এক বাড়িতে ছিলাম।

রানু : প্রতিভা বসু।

 

চিঠি ১৩

ডিমক্ : এডওয়ার্ড ডিমক, শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘দক্ষিণ এশীয় ভাষা ও সভ্যতা’ বিভাগের অধ্যাপক, বৈষ্ণব পদাবলী ও চৈতন্যচরিতামৃতের অনুবাদক, কলকাতার বিদ্বৎ-মহলের বন্ধু। (প্রয়াত।)

‘নরেশ তোমাকে যে-উপন্যাস দুটোর কথা লিখেছে’ : সম্ভবত পাতাল থেকে আলাপরাত ভ’রে বৃষ্টি

বিরামবাবু : বিরাম মুখোপাধ্যায় (১৯১৫-৯৮), তাঁর রুচি ও যত্নের জন্য বাংলা প্রকাশনা-জগতে স্মরণীয়। তাঁরই উদ্যোগে নাভানা থেকে ত্রিশের কবিদের শ্রেষ্ঠ কবিতা বেরোয়। নাভানা গুটিয়ে গেলে আসেন ভারবি-তে। পরে নিজেই প্রতিষ্ঠা করেন নবার্ক। এবং সেই প্রকাশনী থেকে ১৯৮৬-তে তিনি বুদ্ধদেব বসুর শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ বের করেন।

মার্সেল প্রম্নস্ত : ১৯৫১-তে বুদ্ধদেব বসুকে লেখা সুধীন্দ্রনাথ দত্তের চিঠি (কবিতা, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত-স্মৃতিসংখ্যা) দ্রষ্টব্য : ‘প্রম্নস্ত কেমন লাগলো? দ্বিতীয় ভাগ পড়ার নিরুৎসাহ দেখে মনে হচ্ছে ভালো লাগেনি। কিন্তু প্রম্নসেত্মর সঙ্গে সৌহার্দ্যস্থাপন চেষ্টাসাপেক্ষ; মনে আছে প্রথম একশ পাতা পড়তে তিনবার থেমে গিয়েছিলুম।’

দীপ্তি ত্রিপাঠী : আধুনিক বাংলা কাব্যপরিচয় গ্রন্থের লেখক।

বুয়ান : দৌহিত্র অনির্বাণ। এখন জীববিজ্ঞানে ভালো কাজ করছে।

মুকুল (পদবি মনে নেই) তখন ই–য়ানায় বিজ্ঞানের কোনো শাখাতে গবেষণা করছেন। শুদ্ধশীলের বন্ধু।

‘জ্যোতি একটা নাটক লিখেছে’ : সতীশ সেন যা পরে অভিনীত হয়েছিল?

 

চিঠি ১৫

প্রম্নফটা মহাভারতের কথার।

 

চিঠি ১৬

মৃত্যুর (১৮ মার্চ ১৯৭৪) দু-সপ্তাহ আগে লেখা।

 

* দময়মত্মী বসু সিং চিঠিগুলি পড়ে দিয়েছেন। তাঁকে বিশেষ কৃতজ্ঞতা। আর কৃতজ্ঞতা, কয়েকটি অনুপুঙ্খ নির্ধারণের জন্য, অমস্নান দত্ত, ঝর্না ভট্টাচার্য, নবনীতা দেব সেন, প্রণব বিশ্বাস ও প্রদীপ ঘোষকে।