বুদ্ধদেব বসুর পূর্ব বাংলা

মামুন মুস্তাফা

বাংলা আধুনিক কবিতাকে সুরম্য প্রাসাদনন্দনে স্থাপন করার অন্যতম কারিগর তিরিশের যুগপ্রধান কবি বুদ্ধদেব বসু। বিস্তৃত ঔপনিবেশিক পটভূমিতে দাঁড়িয়ে সে-সময়ের বাংলাদেশ ও কলকাতায় গড়ে ওঠা একটি স্থানিক বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের মনোজগতে ঠাঁই পাওয়া ন্যায়-অন্যায়, নির্মমতা-নৈরাশ্য এবং সুখ-শান্তি-সুস্থতার উৎসারণ ঘটিয়েছেন তাঁর কবিতা ও গদ্যে। সেই অর্থেই কি তিনি নাগরিক? মূলত প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর পরিবেশে কলোনিয়াল সমাজের নগর-মানুষের পরিপার্শ্ব – হতাশা, বিপন্নতা, আশা-স্বপ্নকে নিজের কল্পনামুগ্ধতা দিয়ে সবার করে তুলতে পেরেছিলেন বলেই বুদ্ধদেব বসু নাগরিক কবি। কিন্তু তাঁর এই নগর-মানসিকতার উন্মেষ এই বাংলাদেশেই। একটা ব্যাপক সময় বুদ্ধদেব বসু কাটিয়েছেন তৎকালীন ভারতবর্ষের পূর্ব বাংলায়। কবি বুদ্ধদেব বসুর নাগরিক মননের সিদ্ধি কিংবা প্রস্ত্ততিপর্ব এই বাংলাদেশে এবং তাঁর সেই সূচনাকালের বেশকিছু স্মৃতির দেখা আমরা পাই হঠাৎ আলোর ঝলকানি কিংবা উত্তরতিরিশের অনেক লেখায়।

কোন বয়সের অতীত মানুষের মনে থাকে? স্মৃতি খুব সহজে মগজের কোষে ধরা দেয়? বালক বয়স? কিন্তু বালক বয়সেরও একটা সীমারেখা থাকে। যাহোক বুদ্ধদেব বসু এই বাংলাদেশকে স্মরণ করেছেন তাঁর বালক বয়সে। তৎকালীন পূর্ববাংলার সমুদ্র-তীরবর্তী একটি মফস্বল শহর ‘নোয়াখালী’ কবিকে দিয়েছিল বাংলার রূপ-রস-গন্ধ। একদিকে তিনি দেখলেন পুকুর, ডোবা, নালা, গাবের আঠা, মাদারের কাঁটা, সাপের ভয়। আবার তারই পাশে নারকেলগাছ, ঝাউয়ের সারি, লকলকিয়ে ছিপছিপে গড়নে উপরে উঠে গেছে সুপুরিগাছ, তাদের শাখে শাখে গোল গোল আলোছায়ার ঝিকিমিকি। অন্যদিকে বনবহুল ঘনসবুজ, সমুদ্র-উদ্বেল, মেঘনার রাক্ষুসী মোহনা – এসবই বুদ্ধদেব বসুর মনের মধ্যে জন্ম নেওয়া নগর-মানুষের সূচনাকাল।

বুদ্ধদেব বসু এই নোয়াখালীতে যেমন প্রকৃতি চিনেছেন, তেমনি নানা ধরনের নানা পেশার মানুষও দেখেছেন। তাঁর পড়ার টেবিলে আছড়ে-পড়া একটি বলের অদৃশ্য বালক, তাকে তিনি উপলব্ধি করেছেন নিজের ভিতরে। আবার সরকারি চাকরিজীবী, ডাক্তার-কবিরাজ, খেটে-খাওয়া মজুর, পর্তুগিজ জলদস্যু কিংবা পাগল – এরা সকলেই বালক বুদ্ধদেবের মনে একটি আসন করে নিয়েছিল আগামী দিনের ‘কবি বুদ্ধদেব বসু’র কারণে। আর এই মানুষ চেনার মধ্য দিয়ে তিনি উপলব্ধি করেছিলেন মানুষ যত ভয়ংকরই হোক না কেন, তার ভেতরে বাস করে এক নিরীহ প্রাণী। এই নিরীহ প্রাণী মানুষের মধ্যে তিনি আরো দেখেছেন – কিছু স্থানীয় এবং উচ্চ বংশীয় সম্প্রদায়, ভিন্ন গোত্র মুসলমান যাদের গড়ন-চলন-বলন মেলানো মুশকিল। তথাপি তিনি তাদের ভেতরে আবিষ্কার করলেন সাহিত্য-সংস্কৃতি, নাটক-আড্ডার এক মেলবন্ধন। আবার অন্যদিকে এরাই জাতিদাঙ্গায় মেতে উঠল, গান্ধীজি অহিংস মানবতার মন্ত্রে ছুটে এলেন নোয়াখালী। পূর্ব বাংলার আরো পুবের এই আধা শাহরিক একটি স্থান নোয়াখালী এভাবেই বুদ্ধদেব বসুর মননে তৈরি করেছিল ক্রমবর্ধমান নগর-মানুষের লাভ ও লোভের সোনালি সকাল।

বুদ্ধদেব বসুর কবিতার একটি প্রধান অনুষঙ্গ হিসেবে যে প্রকৃতিচেতনার কথা বলা হয়ে থাকে, সেটিও নাগরিক জীবনের শিল্পভাষ্যে পরিণত হয়েছে। কঙ্কাবতী, নতুন পাতা, পৃথিবীর পথে, দময়ন্তী প্রভৃতি কাব্যের বেশকিছু কবিতায় বুদ্ধদেবের কবিচৈতন্যকে প্রকৃতির শিল্পিত ক্যানভাসে প্রাণিত ও উদ্বেলিত হতে দেখি। প্রকৃতি কখনো তাঁর কবিতায় জাগ্রত করে প্রেম, কখনো স্মৃতিবিধুরতার উৎস, আবার কখনো মধ্যবিত্ত জীবনের স্বপ্নভঙ্গের রূপকাভাস। আর এটি সম্ভব হয়েছিল প্রকৃতির বিচিত্রতা তিনি এই পূর্ব বাংলা থেকে আহরণ করেছিলেন বলে। ‘নোয়াখালী’-পর্বে যে প্রকৃতির বর্ণনা কবি আমাদের দিয়েছেন, সেসবই যেন ছলকে উঠেছে পরবর্তীকালে কবির বিভিন্ন কবিতায় :

আকাশে আষাঢ় এলো; বাংলাদেশ বর্ষায় বিহবল।

মেঘবর্ণ মেঘনার তীরে-তীরে নারিকেলসারি

বৃষ্টিতে ধূমল : পদ্মাপ্রান্তে শতাব্দীর রাজবাড়ি

বিলুপ্তির প্রত্যাশায় দৃশ্যপট-সম অচঞ্চল।

রাত্রিশেষে গোয়ালন্দে অন্ধ কালো মালগাড়ি ভরে

জলের উজ্জ্বল শস্য, রাশি-রাশি ইলিশের শব,

নদীর নিবিড়তম উল্লাসের মৃত্যুর পাহাড়।

(‘ইলিশ’, দময়ন্তী)

বুদ্ধদেব বসু যে-সময়ে বিশববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেন, ঠিক সে-সময় থেকে প্রগতি পত্রিকার যাত্রা শুরু। সেই সাহিত্য প্রয়াসের ক্ষণ থেকেই বলা যায় বুদ্ধদেব বসু নাগরিক মধ্যবিত্ত শ্রেণির চিত্তসংকট, মানসিক জটিলতা, মনোজৈবনিক চরিতার্থতা, প্রেম-বিরহ, এমনকি স্মৃতিমুগ্ধতার শিল্পরূপ প্রকাশ করেন তাঁর কবিতা ও গদ্যে। কিন্তু ওই ‘স্মৃতিমুগ্ধতা’ তিনি বয়ে আনেন ‘নোয়াখালী’ থেকে তৎকালীন ব্রিটিশ বাংলার নব্য গড়ে-ওঠা নগর-জীবনের কেন্দ্রবিন্দু ঢাকার ‘পুরানা পল্টনে’। পুরোদস্ত্তর নাগরিক হতে চেয়েছিলেন বলেই কি বুদ্ধদেব বসুকে ‘কোলকাতা’ হাতছানি দিয়ে ডাকত? অথচ কেবল নগর হয়ে-ওঠা ‘ঢাকা’র জীবনে মানুষ সবেমাত্র শাহরিক জীবনে অভ্যস্ত হতে শুরু করেছে।

যৌবনের উন্মেষ থেকে বিকাশ – এ-পর্যায়ে সহিত্যজীবনের দীক্ষা, বন্ধুত্ব, অভিজ্ঞতা অর্জন, রুচি ও অভ্যাস গঠনের আত্মপ্রস্ত্ততির ক্ষেত্রে বুদ্ধদেব বসুকে সহায়তা করে আজকের বাংলাদেশ। এখানেই তিনি পেয়ে যান জীবন সম্পর্কে তাঁর প্রথম উপলব্ধি, করেন রাজনীতি, সমাজনীতি, সর্বোপরি মানুষের সমগ্রতা সম্পর্কে ধারণা ও সচেতনতা লাভ, আবিষ্কার করেন নতুন আস্বাদ, নতুন অনুভূতি। আর এর ওপর ভিত্তি করেই নানা চড়াই-উতরাই ও পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে শেষাবধি কবি বুদ্ধদেব বসুর নিজস্বতা রূপ পায়। ‘পুরানা পল্টনে’র স্মৃতিতে পূর্ব বাংলার কাছে বুদ্ধদেবের যে অনেক ঋণ তা তাঁর লেখার মধ্য দিয়েই প্রকাশ পায় :

পুরানা পল্টন আজ স্মৃতিতে পরিণত হয়েছে; তাই তার সমস্ত অপরাধ ক্ষমা ক’রে শুধু তার সৌন্দর্য উজ্জ্বল হয়ে আমার মনে ফুটে উঠছে; বর্তমানে যাকে নিয়ে সম্পূর্ণ সুখী হতে পারিনি, আজ অতীতের প্রেক্ষিতে তাকে একান্তরূপে ভালোবাসছি।   বাস্তবে যার মধ্যে অনেক অভাব ছিলো, স্মৃতিপটে তার যে ছবি উঠলো, দেখলুম তাতে কোনো খুঁত নেই। আজ যদি কেউ আমাকে জিজ্ঞেস করে, পৃথিবীতে সবচেয়ে সুন্দর কোন জায়গা, আমি অনায়াসে উত্তর দিই : পুরানা পল্টন।

(‘পুরানা পল্টন’  হঠাৎ আলোর ঝলকানি)

 

কবি বুদ্ধদেব বসুর কবিতায় যে-ভঙ্গুর সমাজের দেখা মেলে, তা তাঁর সমকাল ও সমসাময়িক জীবনের প্রতিফলন। তাই কবির শৈশব, কৈশোর এবং যৌবনের পূর্ব বাংলাকে উত্তর-যৌবনেও প্রতিফলিত হতে দেখি তাঁর কাব্যসৃষ্টি কিংবা গদ্য রচনার ভেতরে। এই যে শিকড়বিচ্যুতি, দেশভাগের যন্ত্রণায় লালিত বিচ্ছিন্নতা ও নিঃসঙ্গতা – এসবই পরবর্তীকালে বুদ্ধদেব বসুর কাব্যবৈশিষ্ট্যের অন্যতম অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে। লোকপুরাণের ফিনিক্স পাখির দেহভস্ম যেমন সুপ্ত মনে প্রাণের সঞ্চার ঘটায়, তেমনি স্থানিক দূরত্বের বিচ্ছিন্নতা সত্ত্বেও পূর্ববাংলা বর্তমান সময় ও সমাজের সঙ্গে নিয়ত দ্বন্দ্বে বিক্ষত বিচূর্ণ হয়েও কবির সত্তায় নবজন্মের উন্মেষ ঘটায়। তাই কবি বলতে বাধ্য হয়েছিলেন, ‘কিন্তু এও জানি, সে-আনন্দ আর কখনো পাবো না, পুরানা পল্টনের টিনের বাড়িতে যা পেয়েছিলাম। তখনকার জীবনকে আমি যেমন ক’রে ভালোবেসেছিলাম, কৃতি ও সম্মানিত পরবর্তী জীবনকে ঠিক সে-রকম করে ভালোবাসতে পারবো কি? কে জানে।’

কবি সেই সংশয় নিয়ে থিতু হলেন কলকাতা নগরীতে। কিন্তু পূর্ব বাংলা তাঁকে যে-ঐশ্বর্য দান করেছিল, সেই মিথস্ক্রিয়ায় ভর করে তিনি নির্মাণ করলেন আধুনিক নগর-মানুষের স্বকাল সংকট, মধ্যবিত্ত জীবনের বহুমাত্রিক যন্ত্রণা ও মনোবিকলন এবং বিপন্নতা। এর ভেতর দিয়েই উত্তর-রৈখিক যুগে বুদ্ধদেব বসু আধুনিক বাংলা কবিতার প্রাতিস্বিক কবি হিসেবে চিহ্নিত হলেন। বস্ত্তত ত্রিশোত্তর নেতিবাচক পরিবর্তনশীল সমাজপ্রবণতাই বুদ্ধদেব বসুর মানসপটে প্রোথিত করে জীবনবোধের ভবিষ্যবিস্তারী বীজ, যা তিনি পূর্ব বাংলা তথা আজকের বাংলাদেশের নগর-মানুষ ও জল-মাটি-হাওয়া থেকে আহরণ করেছেন এবং তাকে বহন করেছেন উন্মূল দেশভাগের বেদনার্ত একাকিত্ববোধের অনুভূতিতে।